১০. কুরআন কেন আরবী ভাষায়

কুরআন কেন আরবী ভাষায়

শরতের রাতের আকাশ। তারায় তারায় ভরে উঠেছে আকাশের বুক। চাঁদ ঝুলন্ত একটি আলোকপিণ্ডের মতো দেখাচ্ছে। আলোর গহ্বর বললেও খুব-একটা ভুল হবে না। ঠিকরে পড়ছে জোছনা। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য শরতের এরকম কোনো এক রাতের দৃশ্য দেখেই সম্ভবত লিখেছিলেন তার বিখ্যাত কবিতার দুটো লাইন—

ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়;
পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।

উঠোনজুড়ে জোছনা নেমেছে। শিমুলের গা বেয়ে লকলকিয়ে উঠেযাওয়া সন্ধ্যামালতির চারা, গোয়ালঘরটার কোণে বুড়োর মতো ঝিমুতে থাকা ডালিম ফলের গাছ আর পুব দিকে বুক ফুলিয়ে সগর্বে দাঁড়িয়ে থাকা অশ্বথের চেহারা এই আলো-আঁধারীতেও বেশ বোঝা যাচ্ছে। আমরা আবার এসেছি সাজিদদের গ্রামে। বরিশাল জেলার রসুলপুর গ্রাম। গত বছরও ঠিক এই সময়টায় আমরা রসুলপুরে এসেছিলাম।

উঠোনে বিছানো মাদুরে গোল হয়ে বসে আছি। রাহাত, জোবায়ের, সঞ্জু, সাজিদ আর আমি। এরা মূলত সাজিদের বন্ধু। আমার সাথে গতবারই প্রথম পরিচয়। রাহাত শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজে পড়ছে। জোবায়ের বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োকেমিস্ট্রিতে পড়ত; কিন্তু উদ্যোক্তা হবার ঝোঁক ওঠায় পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে এখন গরুর খামার নিয়ে ব্যস্ত। সঞ্জু আবার এতদূর আগাতে পারেনি। উচ্চ মাধ্যমিকের পরে টাকা-পয়সার অভাবে পড়াশোনার ইতি টেনে দিয়েছে। সাজিদ এসেছে শুনে বেচারা চৌদ্দ মাইলের রাস্তা সাইকেলে পাড়ি দিয়ে চলে এসেছে। আমাদের মাঝখানে আছে সরিষার তেল দিয়ে মাখানো মুড়ি। খাঁটি সরিষার তেলের গন্ধে আমার নাকে ইতোমধ্যেই জ্বালাপোড়া শুরু হয়েছে। ঢাকার দূষিত আবহাওয়া আর ভেজাল খাদ্যদ্রব্য খেতে খেতে খাঁটি জিনিসে রি-অ্যাকশান দেখা দিচ্ছে কি না কে জানে!

মুড়ি চিবোতে চিবোতে রাহাত আমায় বলল, তুমি মশাই ভালোই ম্যাজিক পারো।

বললাম, মানে!

মানে হলো, সাজিদের মতো গোঁড়া নাস্তিক আমি আমার জীবনে একটিও দেখিনি। তাকে কত রকমে বুঝাতাম সৃষ্টিকর্তা, ইসলাম, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে। কোনো কিছুতেই কাজ হয়নি। সে জেদ ধরে পাল্টা প্রশ্ন করত। আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করতাম অবশ্য; কিন্তু সে গোঁ ধরে থাকত। তখন এত বিরক্ত লাগত যে, একটি সময় ওকে বোঝানোই ছেড়ে দিই। এরকম অসাধ্য তুমি ভাই সাধন করে ফেলেছ। রিয়েলি, ইউ ডিড অ্যা গ্রেট জব।

রাহাতের কথাগুলোতে বেশ বাড়াবাড়ি আছে। আমি আসলে সাজিদকে আস্তিক হবার মতো আহামরি কিছু বোঝাইনি কখনো। তবে একটি ব্যাপার ঠিক, সাজিদ কোনো কিছু জানতে চাইলে তখন সে খুব বেশি প্রশ্ন করে। প্রশ্ন করা অবশ্য খারাপ কিছু নয়। আমাদের ডিপার্টমেন্টের সজল স্যার প্রায়ই বলেন, যে-ছাত্র প্রশ্ন করে না, ধরে নিতে হবে পড়াশোনায় সে বেশি ফাঁকিবাজ।এই মুহূর্তে আমার জায়গায় সাজিদ হলে রাহাতের এই বক্তব্যের বিপরীতে কুরআনের আয়াত টেনে বলত, হেদায়াত জিনিসটি কেবল আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার হাতে। কেউ ইচ্ছে করলেই কাউকে হেদায়েত দিতে পারে না। মানুষ কেবল চেষ্টা করতে পারে।

আমাদের কথার মাঝখানে জোবায়ের বলে উঠল, তো, আজকে আমরা কোন বিষয়ে গল্প করব?

রাহাত বলল, ভ্রমণ কাহিনি বিষয়ক গল্প হতে পারে। সাজিদ তো দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করে বেড়ায়। ওর কাছে কাশ্মীর, নেপালের পোখারা ভ্রমণের কাহিনি শুনতে পারি আমরা।

সাজিদের সব ভ্রমণের কাহিনিই আমার আদ্যোপান্ত শোনা আছে। তাই আমি মতামত দিলাম সাহিত্যালাপের পক্ষে। সঞ্জু কোনো মতামত দেয়নি। যেন শুনে যাওয়াতেই তার আনন্দ। জোবায়ের বলল, আচ্ছা, ইলুমিনাতি নিয়ে আলাপ করলে কেমন হয় রে? ড্যান ব্রাউনের থ্রিলার পড়ার পর থেকে আমি তো ইলুমিনাতি নিয়ে খুবই আগ্রহী হয়ে পড়েছি। সারাক্ষণ রহস্য নিয়ে ভাবতে মন চায়।

সাজিদ বলল, তো, নিজেকে তুই কি রবার্ট ল্যাঙডন ভাবতে শুরু করেছিস নাকি?

সাজিদের কথা শুনে আমরা হো হো করে হেসে উঠলাম। হাসল জোবায়েরও। ইলুমিনাতি নিয়ে আমারও বেশ আগ্রহ আছে অনেক আগ থেকেই। এই সিক্রেট সোসাইটির ব্যাপারে নানা মুনির নানা মত শুনতে শুনতে আগ্রহের পারদ উঁচু থেকে আরও উঁচুতে উঠেছে বলা যায়। আমি প্রশ্ন করলাম, আচ্ছা সাজিদ, ইলুমিনাতি বলতে সত্যিই কি কিছু আছে পৃথিবীতে? সাজিদ উত্তর দেওয়ার আগে জোবায়ের বলে উঠল, থাকতেও পারে, নাও থাকতে পারে। তবে থাকার সম্ভাবনাই বেশি…।

কীভাবে?, আমি জানতে চাইলাম।

থাকার সম্ভাবনা বেশি এ কারণেই, কারণ, গডলেস একটি পৃথিবী নির্মাণের চিন্তা অনেক পুরোনো। সেই চিন্তার বাস্তবতা এখন আমরা সর্বত্র দেখতে পাচ্ছি। আজকের উন্নত বিশ্ব থেকে বিজ্ঞান অ্যাকাডেমিয়া, সবখানেই বস্তুবাদের রাজত্ব। আমি বললাম, তুমি কি বস্তুবাদকেই ইলুমিনাতি বলতে চাচ্ছ?

ঠিক তা নয়। তবে বস্তুবাদের ধ্যান-ধারণার সাথে ইলুমিনাতির চিন্তাভাবনার মধ্যে ব্যাপক মিল পাওয়া যায়।

এবার মুখ খুলল সঞ্জু। বলল, দাঁড়া। ইলুমিনাতি জিনিসটাই-বা কী সেটাই তো বুঝলাম না। এরকম নাম তো কখনো শুনিনি আমি।

জোবায়ের বলল, ইলুমিনাতি হলো একটি গোপন ভ্রাতৃসংঘের নাম। ইলুমিনাতি শব্দটির অর্থ এনলাইটেনমেন্ট বা আলোকায়ন। এই গোপন সংঘে তারাই যোগ দিত, যারা হাইলি কোয়ালিফাইড; যেমন-বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, ব্যবসায়ী ইত্যাদি।

সঞ্জু বলল, তা বুঝলাম। তবে এটিকে গোপন ভ্রাতৃসংঘ বলছিস কেন?

এটি গোপন এ জন্যেই; কারণ, এটি তৈরিই হয়েছিল তৎকালীন খ্রিষ্টধর্মের বিরুদ্ধে।

কারণ কী?

কারণ, খ্রিষ্টধর্মের অনেক নিয়মকানুন তখনকার অনেকে মেনে নিতে পারেনি। খ্রিষ্টানদের কবল থেকে মুক্তি পেতে সমাজের সবচেয়ে জ্ঞানী লোকদের সমন্বয়ে এই ইলুমিনাতি গড়ে ওঠে বলে ধারণা করা হয়। তবে, ক্রিশ্চিয়ানিটির ব্যাপক প্রভাব এবং শক্তিমত্তার কারণে তারা কখনোই সামনে আসতে পারেনি।

ও আচ্ছা, সঞ্জু বলল।

ক্রিশ্চিয়ানিটির বিরুদ্ধে তৈরি হলেও এই ইলুমিনাতি একপর্যায়ে এমন-সব মানুষের হাতে গিয়ে পড়ে, যারা আগাগোড়া নাস্তিক। তারা চায় পৃথিবীতে একটি নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার কায়েম করতে। তাদের মুঠোয় থাকবে পৃথিবী। এই লক্ষ্যে তারা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বড় জ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী, বিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিবিদদের দলে। ভেড়ায় এবং অনেকের মতে বর্তমান বিশ্ব পরিচালনা করে এই ইলুমিনাতিরাই।

সঞ্জুর মাথা যেন গুলিয়ে গেল। সে বলল, কী সব ছাইপাঁশ বলছিস। একবার বলছিস তারা গোপনে আছে। আবার বলছিস তারা পৃথিবী পরিচালনা করছে। আগামাথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

আমি হো হো করে আরেকবার হেসে উঠলাম। জোবায়ের বলল, ইলুমিনাতির একটি নীতি হচ্ছে তারা নিজেদের কখনোই প্রকাশ করবে না। অর্থাৎ তারা কখনোই প্রকাশ্যে প্রচার করবে না যে—তারা ইলুমিনাতি। এই নিয়ম ইলুমিনাতির ভেতরে খুব কঠোরভাবে মেনে চলা হয়। ইলুমিনাতির কোনো সদস্যই কখনো মুখ ফুটে বলবে না, সে ইলুমিনাতির সদস্য। মরে গেলেও না।

সাংঘাতিক ব্যাপার, বলল সঞ্জু। তাহলে তাদের অস্তিত্ব বোঝা যাবে কীভাবে?

তাদের নির্দিষ্ট কিছু সাইন আছে।

কী সেগুলো?, সঞ্জুর উৎসুক প্রশ্ন।

আমাদের ইলুমিনাতি সম্পর্কিত আলাপে বাগড়া দিল এতক্ষণ ধরে চুপ করে থাকা রাহাত। বলল, কী সব ফালতু ব্যাপারে আলাপ করছিস বল তো। এসব ইলুমিনাতি টিলুমিনাতি বলতে কিছু নেই। ষড়যন্ত্রতত্ত্ব আমার একদম ভালো লাগে না শুনতে। বাদ দে।

রাহাতের আপত্তির মুখে এতক্ষণ ধরে অনর্গল বলতে থাকা আমাদের ইলুমিনাতি বিশেষজ্ঞ রবার্ট ল্যাঙডন ওরফে জোবায়ের মুহূর্তেই হাওয়া ছেড়ে দেওয়া ফানুসের মতো টুস করে চুপসে গেল। তার চুপসে যাওয়ার নীরবতা ভেঙে সাজিদ বলল, আমরা তাহলে অন্য কিছু নিয়ে আলাপ করতে পারি।

আবারও কি ষড়যন্ত্রতত্ত্ব?

না, বলল সাজিদ।

তাহলে?, রাহাতের প্রশ্ন।

সূরা ফাতিহার ব্যাপারে।

সূরা ফাতিহার ব্যাপারে সাজিদ কী আলোচনা করবে সেটাই ভেবে পেল না জোবায়ের। সাত আয়াতের এই সূরা সকলে মুখস্থ বলতে পারে। অর্থও মোটামুটি সবাই জানে। এরপরও এখানে আলোচনার কী থাকতে পারে?

আমি নীরবতা পালন করছি। সাজিদ যখন সেধে কোনো কিছু নিয়ে আলাপ করতে চায়, তার মানে সেখানে নিশ্চয়ই ভিন্নরকম কিছু আছে। গত দু-বছরে তার সাথে ওঠা-বসা করতে করতে এই আত্মবিশ্বাস আমার ভালোভাবেই জন্মেছে।

রাহাত বলল, এরকম আলোচনায় আমার আপত্তি নেই। শুরু করে দে।

সঞ্জু এবারও চুপ। সে সম্ভবত সবকিছুতেই আগ্রহী থাকে। এবার সাজিদ হালকা নড়েচড়ে বসল। কথা বলার আগে তার এরকম হাবভাব আমার কাছে পরিচিত। একটু পরেই গলা খাঁকারি দিয়ে বক্তৃতা শুরু করবে। এখানে কফির বন্দোবস্ত করা গেলে তার জন্যে আরও সুবিধে হতো; কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে রসুলপুরের এই গ্রামে কফির কোনো ব্যবস্থা নেই।

আমার ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করে সাজিদ কোনো প্রকার গলা খাঁকারি দেওয়া ছাড়াই বলা শুরু করল, কয়েকদিন আগে আমি সূরা ফাতিহা তিলাওয়াত করছিলাম।

সচরাচর যে-রকম করি, সে রকম। সেদিন হঠাৎ করে আমার মনে হলো, আমি মনে হয় সূরা ফাতিহার বিশেষ একটি দিক ধরতে পেরেছি।

কীরকম?, জোবায়ের জানতে চাইল।

সাজিদ বলল, সূরা ফাতিহায় রয়েছে সাতটি আয়াত, তাই না?

হু, বলল রাহাত।

এই সাতটি আয়াতকে দুই ভাগে ভাগ কর; কিন্তু মাঝের আয়াতকে কোনো ভাগেই ফেলিস না। অর্থাৎ একদম মাঝের আয়াতটিকে আলাদা রেখে দুই ভাগ করলে কীরকম দাঁড়ায় হিশেব কর।

রাহাত বলল, তাহলে সাত আয়াতের মধ্যে মাঝের আয়াত হলো আয়াত নম্বর চার। চার নম্বর আয়াতকে আলাদা রেখে দুই ভাগ করলে এক, দুই এবং তিন নম্বর আয়াত পড়ে এক ভাগে, এরপর পাঁচ, ছয় এবং সাত নম্বর আয়াত পড়ে অন্য ভাগে।

সাজিদ বলল, গুড।

সঞ্জু বলে উঠল, আমি বুঝি নাই রে দোস্ত। আরেকটু সহজ করে বল।

আচ্ছা, সহজ করেই বলছি,বলল সাজিদ।ধর, তোকে বললাম ১ থেকে ৭ পর্যন্ত সংখ্যাগুলো দুই ভাগ করতে হবে, তবে মাঝের সংখ্যাটিকে কোনো ভাগে না ফেলে আলাদা রাখতে হবে। তুই কীরকম ভাগ করবি? সঞ্জু মাথা চুলকাতে লাগল। কথা বলে উঠল রাহাত। বলল, সঞ্জু, ১,২,৩,৪,৫,৬ এবং ৭ এর মধ্যে মাঝের সংখ্যা কোনটি হবে বল।

সঞ্জু এবারও বিভ্রান্ত। সাজিদ বলল, আমি আরও সহজ করি। ১-৭ এর মধ্যে ১,২,৩ এক ভাগে আর ৫,৬,৭ অন্য ভাগে। বাদ পড়ল কোন সংখ্যাটা?

চার, বলল সঞ্জু।

রাইট। এই চার সংখ্যাটাই মাঝের সংখ্যা এখানে। দেখ, চার সংখ্যাটার আগেও তিনটি সংখ্যা ১,২,৩ এবং চার সংখ্যাটার পরেও তিনটি সংখ্যা ৫, ৬ এবং ৭। এবার বুঝতে পেরেছিস?

সঞ্জু মাথা নেড়ে বলল, ফকফকা পরিষ্কার।

সঞ্জুর কথা শুনে আমরা সকলে হেসে উঠলাম। সাজিদ আবার বলতে লাগল, তাহলে সূরা ফাতিহাকেও যদি আমরা এরকম দুই ভাগ করি, তাহলে সূরাটার প্রথম তিন আয়াত চলে যাবে এক ভাগে, আর শেষের তিন আয়াত চলে যাবে অন্য ভাগে। মাঝে থাকবে আয়াত নম্বর চার। রাইট?

হুম।

এখানেই আসল রহস্যটা, বলল সাজিদ। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা এই মাঝের আয়াতে এমন কিছু বলেছেন, যেটি সূরা ফাতিহার প্রথম অংশ এবং পরের অংশ, দুই অংশেরই প্রতিনিধিত্ব করে।

ইন্টারেস্টিং, বলল জোবায়ের।

সাজিদ বলল, আয়াতের অর্থগুলোর দিকে খেয়াল করলেই বুঝতে পারবি। প্রথম তিনটি আয়াতে কী বলা হচ্ছে দেখে নিই। প্রথম আয়াতে বলা হচ্ছে, যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহ তাআলার যিনি জগৎসমূহের অধিপতি।

দ্বিতীয় আয়াতে বলা হচ্ছে, যিনি পরম করুণাময়, অসীম দয়ালু।

তৃতীয় আয়াতে বলা হচ্ছে, যিনি বিচারদিনের মালিক।

এই তিন আয়াত প্রথম ভাগে। চতুর্থ আয়াতে বলা হচ্ছে, আমরা তোমারই ইবাদত করি এবং তোমার কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করি। এটি কিন্তু মাঝের আয়াত। এটি কোনো ভাগেই পড়বে না। এটিকে কেন্দ্রবিন্দু বলা যেতে পারে। এই আয়াত দিয়েই আমরা প্রথম ভাগ আর পরের ভাগকে যাচাই করব।

আমাদের মাঝে পিনপতন নীরবতা। সেই নীরবতা ভেঙে সাজিদ আবার বলতে লাগল, পরের ভাগের আয়াতগুলোতে কী বলা হচ্ছে দেখ।

পঞ্চম আয়াতে বলা হচ্ছে, আমাদের সরলপথে পরিচালিত করুন।

ষষ্ঠ আয়াতে বলা হচ্ছে, ওই সব লোকদের পথে, যাদের আপনি নিয়ামত দান করেছেন।

সপ্তম আয়াতে বলা হচ্ছে, তাদের পথ নয়, যাদের ওপর আপনার অভিশাপ নাযিল হয়েছে এবং যারা পথভ্রষ্ট।

এবার আমরা সিকোয়েন্সটি মিলাতে পারি। প্রথম ভাগের আয়াতগুলো এক জায়গায় নিয়ে আসা যাক। প্রথম অংশের আয়াতগুলো হলো—

যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহ তাআলার যিনি জগৎসমূহের অধিপতি।

যিনি পরম করুণাময়, অসীম দয়ালু।

যিনি বিচারদিনের মালিক।

মাঝখানে আছে আমরা তোমারই ইবাদত করি এবং তোমার কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করি। আর, পরের অংশে আছে :

আমাদের সরলপথে পরিচালিত করুন।

ওই সব লোকদের পথে, যাদের আপনি নিয়ামত দান করেছেন।

তাদের পথ নয়, যাদের ওপর আপনার অভিশাপ নাযিল হয়েছে এবং যারা পথভ্রষ্ট।

আমরা সকলে গভীর মনোযোগের সাথে সাজিদের কথাগুলো শুনছি। সে বলতে লাগল, মাঝখানের, অর্থাৎ চার নম্বর আয়াতে দুটো অংশ আছে। আমরা তোমারই ইবাদত করি এতটুকু একটি অংশ, এবং তোমার কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করি এতটুকু একটি অংশ। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, এই আয়াতের প্রথম অংশ সূরার প্রথম তিন আয়াতের প্রতিনিধিত্ব করছে এবং পরের অংশ প্রতিনিধিত্ব করছে সূরার পরের তিন আয়াতের। এই আয়াতের প্রথম অংশ দিয়ে ওপরের তিন আয়াতকে যাচাই করা যাক :

আমরা তোমারই ইবাদত করি

আমরা কার ইবাদত করি?

সকল প্রশংসা যার এবং যিনিই সৃষ্টিজগতের অধিপতি। [সূরা ফাতিহার ১ম আয়াত]

আমরা কার ইবাদত করি?

যিনি পরম করুণাময়, অসীম দয়ালু [সূরা ফাতিহার ২য় আয়াত]

আমরা কার ইবাদত করি?

যিনি বিচারদিনের মালিক।[সূরা ফাতিহার ৩য় আয়াত]

দারুণ তো!, বলে উঠল জোবায়ের।

এবার আসা যাক ওই আয়াতের পরের অংশে। যেখানে বলা হচ্ছে—

তোমার কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করি।

আমরা কীসের জন্যে সাহায্য প্রার্থনা করি?

যাতে আমরা সরল পথে চলতে পারি।[সূরা ফাতিহার ৫ম আয়াত]

আমরা কীসের জন্যে সাহায্য প্রার্থনা করি?

যাতে আমরা নিয়ামতপ্রাপ্তদের দলে ভিড়তে পারি। [সূরা ফাতিহার ৬ষ্ঠ আয়াত]

আমরা কীসের জন্যে সাহায্য প্রার্থনা করি?

যাতে আমরা অভিশপ্ত এবং পথভ্রষ্টদের দলের অন্তর্ভুনাই। [সূরা ফাতিহার৭মআয়াত]

চিন্তা কর, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা এই ছোট্ট সূরাটার মধ্যেও কীরকম ভাষার মান, সাহিত্য মান দিয়ে দিয়েছেন। প্রথমে কিছু কথা, মাঝখানে একটি বাক্য, শেষে আরও কিছু কথা; কিন্তু মাঝখানের সেই বাক্যটিকে এমনভাবে সাজিয়েছেন এবং এমনভাবে বলেছেন, যেটি প্রথম এবং শেষ—দুটো অংশের সাথেই সামঞ্জস্যপূর্ণ। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, যারা বলে কুরআন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বানিয়ে লিখেছেন, তারাও স্বীকার করতে বাধ্য হবে যে, এতটা সূক্ষ্মভাবে, এতটা সাহিত্যমান দিয়ে কোনোকিছু লেখা কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। আরও ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো, এই আয়াতগুলো একই সাথে নাযিল হওয়া। একটির পর একটি, বিরতিহীন। পৃথিবীর কোনো মানুষ যদি ইনসট্যান্ট কিছু রচনা করে, তার পক্ষে কখনোই সম্ভব নয় যে, কুরআনের মতো এরকম সিস্টেম্যাটিক পদ্ধতিতে কোনো কিছু লিখবে।

ওয়াও! দ্যাটস অ্যামেইজিং!, চিৎকার করে বলে উঠল রাহাত। সহজে কোনো কিছু বুঝতে না পারা সঞ্জুও এবার ব্যাপারটি বুঝে গেছে। সেও বলে উঠল, সত্যিই দারুণ! এরকমভাবে কখনো ভেবে দেখিনি। জোবায়ের বলল, সিম্পলি গ্রেট! এটি নিশ্চিত মিরাকল।

আমি একটি ব্যাপার ভাবতে লাগলাম। সূরা ফাতিহা এর-আগে অনেকবার আমি পড়েছি; কিন্তু এত সহজ অথচ আশ্চর্যজনক এই ব্যাপারটি কখনো আমার মাথায় আসেনি কেন!

আমাদের ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে রাহাত বলল, এটি কেবল আরবী ভাষাতেই সম্ভব। এ জন্যেই বোধকরি কুরআন আরবী ভাষায় নাযিল হয়েছে, তাই নারে সাজিদ?

সাজিদ বলল, কুরআন আরবী ভাষায় নাযিল হওয়ার এটি একটি কারণ। তবে এর পেছনে আরও অনেক কারণ আছে।

যেমন?, প্রশ্ন করল রাহাত।

এবার সামান্য গলা খাঁকারি দিল সাজিদ। এরপর যখনই সে তার পরবর্তী লেকচার শুরু করতে যাবে, অমনি আমি হাত তুলে বললাম, আমার একটি কোয়েশ্চান আছে।

এতক্ষণ ধরে সাজিদের দিকে চেয়ে থাকা বড় বড় চোখগুলো এবার সম্মিলিতভাবে আমার ওপরে এসে পড়ল। আমি কী প্রশ্ন করব সেটি শোনার জন্যে সবাই যেন ব্যাকুল হয়ে উঠেছে।

আমি বললাম, সাজিদ, তোর ব্যাপারে আমার কমন একটি অবজার্ভেশন হলো এই, তুই যখনই কোনো লম্বা বক্তৃতা শুরু করতে যাস, তখনই একবার গলা খাঁকারি দিয়ে এরপর শুরু করিস; কিন্তু আজকে আলাপের শুরুর দিকে তুই এরকম করিসনি। কেন করিসনি?

আমার প্রশ্ন শুনে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছে জোবায়ের। সে মুখ হা করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে কমবোঝা লোক সঞ্জু সম্ভবত খুব মজা পেয়ে গেল। সে হো হো করে হেসে উঠল। হাসার সময় তার ফোকলা দাঁতগুলো দেখলে তাকে চকলেটে আসক্ত বাচ্চার মতো দেখায়। সাজিদ কিছু একটি বলতে যাচ্ছিল, তাকে থামিয়ে দিয়ে রাহাত বলল, দাঁড়া দাঁড়া। এটি তো ডাক্তারি ইস্যু। আমাকে কথা বলতে দে।

এরপর রাহাত আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, আরিফ ভাই, সাজিদ কি এরকম সবসময়ই করে, নাকি শুধু কথা বলার সময়ই এমনটি করে?

সবসময় করে না। কথা বলার সময়েও করে না। তখনই করে, যখন ও বড় কোনো বক্তব্য দিতে যায়।

রাহাত বলল, হুম। বুঝতে পেরেছি। ও যদি এই জিনিসটি নিয়মিত করত তাহলে ধরে নেওয়া যেত—তার শুচিবায়ু রোগ আছে। যেহেতু নিয়মিত করে না, তাই এটি কোনো রোগ নয়; বরং এটি অভ্যাসের রোগ।

অভ্যাসের রোগ?, আমি প্রশ্ন করলাম।

সেটি আবার কীরকম?, প্রশ্ন সঞ্জুর।

রাহাত বলল, ব্যাপারটি সাইকোলজির। বিশেষ বিশেষ সময়ে কোনো কিছু করতে করতে একটি সময় জিনিসটি ওই ব্যক্তির সাইকোলজিতে এমনভাবে সেট হয়ে যায় যে, সে পরবর্তী সময়ে মনের অজান্তেই ওই জিনিস করে চলে। যেমন ধরা যাক, দাঁত দিয়ে হাতের নখ কাটা। এই ব্যাপারটি বেশির ভাগ লোকই মনের অজান্তেই করে। কারণ, কোনোকিছু নিয়ে গভীর চিন্তার সময়ে দাঁত দিয়ে নখ কাটতে কাটতে একটি সময়ে গিয়ে ব্যাপারটি তার অনিয়ন্ত্রিত অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়।

আমি বললাম, বাহ রাহাত ভাই। তোমার কাছ থেকে তো দারুণ দারুণ সব টার্মিনোলোজি শিখলাম। অভ্যাসের রোগ, অনিয়ন্ত্রিত অভ্যাস…হা…হা…হা…।

এবার মুখে ভেংচি কেটে জোবায়ের বলল, ফালতু কথাবার্তা। হাতুড়ি ডাক্তার হলে যা হয় আরকি।

জোবায়েরের কথা শুনে এবার আমি, সাজিদ আর সঞ্জু তিনজনই হেসে উঠলাম। বেচারা ইলুমিনাতির গল্প চালিয়ে যেতে না পারার শোধ কী সুন্দরভাবেই না তুলে নিল।

রাহাত ওর দিকে খটমটে চেহারায় তাকিয়ে আছে। সাজিদ বলল, বেশ ঝগড়া হয়েছে। এবার থামা যাক।

সাজিদের কথা শুনে সবাই আবার নড়েচড়ে বসল। রাহাত বলল, তো বল, কুরআন আরবী ভাষায় নাযিল হওয়ার পেছনে আর কী কী কারণ থাকতে পারে?

সাজিদ আবারও বলতে শুরু করল, ব্যাপারটি সহজে বোঝার জন্য আমাদের প্রথম যা বুঝতে হবে তা হলো, আরবী ভাষার অনন্যতা। যে-ভাষায় সৃষ্টিকর্তার বাণী প্রেরিত হবে, সেই ভাষা যদি যত্নের সাথে সংরক্ষণ করা না-হয়, তাহলে নিশ্চিতভাবে সেই ভাষার বিলুপ্তির সাথে সাথে সৃষ্টিকর্তার বাণীও বিলুপ্ত হয়ে যাবে অথবা বিকৃত হয়ে যাবে।

ভাষা বিলুপ্ত বা বিকৃত হতে পারে?, প্রশ্ন করল জোবায়ের।

অবশ্যই। হিব্রু ভাষার কথাই ধর। তাওরাতের মতো বিখ্যাত আসমানী কিতাব এই ভাষাতেই নাযিল হয়েছিল। অথচ কালের বিবর্তনে আজ হিব্রু ভাষা মৃত। মুসা আলাইহিস সালামের ওপরে তাওরাত নাযিল হয়েছিল আজ থেকে আরও তিন হাজার বছর আগে। অথচ ইতিহাস থেকে জানা যায়, হিব্রু ভাষার প্রথম শব্দকোষ তথা ডিকশনারিই লিখিত হয় মাত্র সেদিন। দশম শতাব্দীতে। চিন্তা করে দেখ, আজ থেকে তিন হাজার বছর আগে নাযিল হওয়া একটি কিতাবের ভাষা বোঝার ডিকশনারিই তৈরি হয়েছে মাত্র সেদিন। তাহলে মাঝখানের লম্বা টাইম-গ্যাপে যে-শব্দগুলো হারিয়ে গেছে, যে-শব্দগুলো কালের বিবর্তনে অর্থ বদলে ফেলেছে, সেগুলোর প্রকৃত অর্থ বের করার উপায় কী?

আমরা সবাই চুপ করে আছি। রাহাত বলল, শব্দ অর্থ বদলাতে পারে?

অবশ্যই পারে। যেমন ধর ইংরেজি ভাষার কথা। ইংরেজিতে Nice মানে কী বল।

জোবায়ের বলল, সুন্দর।

সাজিদ বলল, কিন্তু চতুর্দশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে এই Nice শব্দ দিয়ে কী অর্থ করা হতো জানিস?

কী?, সঞ্জু জানতে চাইল।

এই Nice শব্দটি লাতিন Nescius শব্দ থেকে এসেছে। চতুর্দশ শতাব্দীর ইংল্যান্ডে এই Nice শব্দের অর্থ করা হতো Ignorant বা মূর্খ বোঝাতে।

কালক্রমে Shyness, Resreve অর্থেও ব্যবহার করা হয় এই Nice শব্দটি।

সঞ্জু অবাক হয়ে বলল, বলিস কী!

হুম। এরপর অষ্টাদশ শতাব্দীর দিকে এসেই এই Nice শব্দ আজকের সুন্দর সুশ্রী অর্থ লাভ করে। চিন্তা করে দেখ, ভাষা কীভাবে পাল্টে যেতে পারে। কুরআন যদি হিব্রু ভাষাতে নাযিল হতো, তাহলে কী অবস্থা হতে আর যদি ইংরেজিতে হতো তাহলে কী হতো ভেবে দেখ।

রাহাত বলল, সত্যিই!

কিন্তু আরবী ভাষার ক্ষেত্রে কি এরকমটি হয়েছে সাজিদ?, জানতে চাইল জোবায়ের।

না। আরবী ভাষার ক্ষেত্রে এরকমটি হয়নি মোটেও। বলা চলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এমন একটি জাতির কাছে এবং এমন একটি ভাষায় কুরআন দেওয়া হয়েছে, যারা তৎকালীন সময়ে সাহিত্যে সবচেয়ে এগিয়ে ছিল। সে সময়ে পৃথিবীতে সাহিত্যের জীবন্ত ভাষাই ছিল আরবী। আরবরা কবিতা, সাহিত্যে এত বেশিই দক্ষ আর মুন্সিয়ানার অধিকারী ছিল যে, সমসাময়িক কোনো জাতিই সাহিত্যে এতটি অগ্রগতি লাভ করেনি। কুরআনকে সর্বোচ্চ এবং শ্রেষ্ঠ সাহিত্যমান দিয়ে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপরে একটি মিরাকল হিশেবে পাঠিয়েছিলেন। এর প্রমাণ আমরা কুরআন থেকেই পাই।

যেমন?, প্রশ্ন করল রাহাত।

যেমন, মূসা আলাইহিস সালামের সময়ে জাদুবিদ্যা ছিল পৃথিবীব্যাপী বিখ্যাত ব্যাপার। চারদিকে তখন জাদুকরদের জয়জয়কার। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা মূসা আলাইহিস সালামকে সমসাময়িক বিষয় জাদুবিদ্যার মতোই মোজের জ্ঞান দিয়ে পাঠিয়েছিলেন। এটাই ছিল মূসা আলাইহিস সালামের জন্যে মিরাকল। ফেরাউনের সামনে তিনি যখন হাত থেকে লাঠি রাখলেন, তখন সেটি সাপ হয়ে গেল। তার সময়কার বাঘা বাঘা জাদুকরেরা এটি দেখে তো অবাক হয়ে গেল। বলে উঠল, এত এত জাদু দেখলাম, জাদু শিখলাম; কিন্তু এরকম জাদু তো কখনো দেখলাম না। ব্যস, তারা মূসা আলাইহিস সালামের রবের ওপরে ঈমান নিয়ে এলো। আবার ঈসা আলাইহিস সালামের সময়ে চিকিৎসাবিদ্যার ছিল জগৎজোড়া খ্যাতি। তাই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা ঈসা আলাইহিস সালামকে এমন বিদ্যা দিয়ে পাঠালেন, যা দেখে তখনকার ডাউস ডাউস চিকিৎসকরা অবাক হয়ে গেল। কী ছিল সেই বিদ্যা? সেটি হলো তিনি মৃত মানুষকে জীবিত করতে পারতেন। এটি দেখে তো সবার চক্ষু ছানাবড়া। এটি কীভাবে সম্ভব? যে-যুগে যে-জিনিসের কদর সবচেয়ে বেশি, প্রচলন সবচেয়ে বেশি সেই যুগের রাসূলদের আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা ঠিক সেই জিনিসের শ্রেষ্ঠ জ্ঞান বা সেই জিনিস দিয়েই পাঠাতেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগ ছিল সাহিত্যের যুগ। তখন সাহিত্যকে ধর্মের মতো পূজা করা হতো। চারদিকে যখন আরবী সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের জয়জয়কার, তখন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এমন সাহিত্যমান-সমৃদ্ধ কুরআন দিয়ে পাঠালেন, যা এ যাবৎকালের সব সাহিত্যকর্মকে ছাপিয়ে একেবারে শীর্ষে আরোহণ করে বসল। সাহিত্যের জন্যে বিখ্যাত আরবরাই অবাক হতে বাধ্য হলো। কুরআনের শব্দচয়ন, সুর ও তাল-লহরি এতই চমৎকার যে, রাতের অন্ধকারে কাফিররা লুকিয়ে কুরআন শুনতে আসত।

সাজিদের কথা শুনে সঞ্জু সুবহানাল্লাহ বলে চিৎকার করে উঠল। বলল, সত্যিই চমৎকার!

সাজিদ বলতে লাগল, কুরআন আরবী ভাষায় নাযিল হওয়ার পেছনে আরেকটি অন্যতম কারণ হলো আরবী ভাষার সহজবোধ্যতা। আরবী ভাষার চমৎকারিত্ব, শব্দ এবং বাক্যগঠনই এমন যে, এই ভাষাটি সহজেই বোঝা যায়, মুখস্থ করে ফেলা যায়। সহজ ও সুন্দর আরবী ভাষায় কুরআন নাযিল করে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা যুগের পর যুগ ধরে এই কুরআনকে যেকোনো প্রকার বিকৃতি ও বিনষ্টের হাত থেকে রক্ষা করে চলেছেন।

কীভাবে সেটি?, সঞ্জু আবার জানতে চাইল।

এই যে, পৃথিবীজুড়ে যে-লক্ষ-লক্ষ কুরআনের হাফেজ, এদের মাধ্যমে। এরা কুরআনের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আগাগোড়া মুখস্থ করে রাখে। যদি কোনো দুর্যোগে কুরআনসহ পৃথিবীর সকল বই নষ্ট হয়ে যায় বা পুড়ে ছাই হয়ে যায়, তবুও কুরআনকে হুবহু, ওয়ার্ড বাই ওয়ার্ড লিখে ফেলা সম্ভব। কারণ, পৃথিবীজুড়ে লক্ষ লক্ষ কুরআনের হাফেজ রয়েছে।

সঞ্জু আরেকবার সুবহানাল্লাহ বলে উঠল।

সাজিদ এবার থামল কিছুক্ষণ। রাত আরও গভীর হয়ে উঠেছে। সাদা মেঘের ছুটোছুটি বেড়ে গেছে আকাশে। দূর থেকে কিছু শিয়ালের আওয়াজ ভেসে আসছে কানে। হালকা শীত লাগছে গায়ে। দ্বিতীয়বারের মতো গলা খাঁকারি দিল সাজিদ। গলা খাঁকারি দিয়ে সে এবার আমার দিকে তাকাল। ভাবল আমি হয়তো এবারও অবজেকশান জানাব। আমাকে চুপচাপ দেখে সে আবার বলতে শুরু করল, আরবী ভাষার আরও অনেক চমৎকারিত্ব আছে, যা অন্য ভাষায় নেই।

যেমন?, জানতে চাইল রাহাত।

যেমন ধরা যাক, বাংলায় যদি আমরা বলি তারা যাচ্ছে, অথবা They are going, তখন আমরা বুঝতে পারি না যে—এই তারা বা They বলতে আসলে নারীকে বোঝানো হচ্ছে না পুরুষকে। কারণ, বাংলা বা ইংরেজিতে এই সর্বনামের জন্য কোনো আলাদা শব্দ নেই, যা দিয়ে এক শব্দেই বোঝানো যাবে যে, তারা বলতে আসলে নারীদের বোঝানো হচ্ছে না পুরুষকে; কিন্তু আরবীতে এই সমস্যা নেই। যেমন আরবীতে They শব্দটি যদি পুরুষের ক্ষেত্রে হয়, তখন শুধু Hum(৯) লিখলেই চলে। এই শব্দ থেকেই বুঝে ফেলা যায় যে, এখানে আসলে পুরুষদের বোঝানো হচ্ছে। আবার, They দিয়ে যদি নারীদের বোঝানো লাগে, তখন শুধু Hunna (2) বললেই হয়ে যায়। এখানে সহজেই বোঝা যায়—তারা বলতে নারীদের বোঝানো হচ্ছে।

জোবায়ের বলল, অ্যামেইজিং ফিচারস!

সাজিদ বলল, আরও চমৎকার জিনিস আছে। যেমন ধর Camel বা উট শব্দটি। নারী-উট বা পুরুষ-উট বোঝানোর জন্য ইংরেজিতে কিন্তু একক কোনো শব্দ নেই। যদি নারী-উট বোঝাতে হয় ইংরেজিতে কী বলতে হবে? বলতে হবে Female Camels, পুরুষ-উট বোঝাতে গেলে বলতে হবে Male Camels। কিন্তু আরবীতে পুরুষ-উট বোঝানোর জন্যে আলাদা শব্দ, নারী-উট বোঝানোর জন্যে আলাদা শব্দ রয়েছে। ইংরেজিতে Camel বলতে ইন জেনারেল সব ধরনের উটকেই বোঝানো হয়ে থাকে। আরবীতে ইন জেনারেল সব উটকে বোঝানোর জন্যেও শব্দ আছে। যেমন : Ibil (V) এই শব্দ ইংরেজি Camel শব্দের মতোই। এটার মধ্যে সব ক্যাটাগরির উটই অন্তর্ভুক্ত। আবার যদি ইংরেজিতে পুরুষ-উট বোঝাতে যাই, তখন কী বলতে হবে? তখন বলতে হবে Male Camels; কিন্তু আমি যদি আরবীতে পুরুষ-উট বোঝাতে চাই, আমাকে কিন্তু ইংরেজির মতো এত ঝামেলা পোহাতে হবে না। আমি স্রেফ একটি শব্দ দিয়েই কাজ সেরে ফেলতে পারব। যেমন-আমি যদি পুরুষ উটের কথা বলি, তখন খালি আরবী Jamal (641) শব্দটি বললেই হবে, ব্যস। এই শব্দ দিয়েই বোঝানো হয়ে গেছে—আমি পুরুষ উটের কথা বলছি।

আমাদের সবার চোখেমুখে বিস্ময়ের ভারি রেশ। সাজিদ বলল, তোদের একটি আয়াতের কথা বলি। সূরা তাকবীরের শুরুতেই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা কিয়ামতের পূর্বে ঘটবে এমন কিছু নিদর্শনের কথা বলেছেন। ওই সূরার চার নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলছেন, যখন পূর্ণকালীন গর্ভবতী উটগুলো উপেক্ষিত হবে। এই আয়াতের ইংরেজি অনুবাদ করা হয়েছে এরকম-when full term she camels will be neglected। দেখ, বাংলায় বলা হয়েছে পূর্ণকালীন গর্ভবতী উট, আর ইংরেজিতে বলা হয়েছে Full term she camels. উটগুলো যে নারী-উট হবে এবং সেগুলো যে পূর্ণকালীন গর্ভবতী হবে, সেটি বোঝাতে বাংলায় দরকার হয়েছে তিনটি শব্দ—পূর্ণকালীন গর্ভবতী উট আর ইংরেজিতে দরকার হয়েছে চার চারটি শব্দ—Full term she camels অথচ, আরবীতে পুরো ব্যাপারটির জন্যে কয়টি শব্দ দরকার হয়েছে জানিস?

রাহাত জিজ্ঞেস করল, কয়টা?

জাস্ট ওয়ান!কুরআন কেবল Ishar শব্দ দিয়েই পুরো ব্যাপারটি ক্লিয়ারলি বুঝিয়ে দিয়েছে। আরবীতে Ishar শব্দের অর্থ হলো এমন নারী-উট, যেটি হয়তো কিছুদিনের মধ্যেই বাচ্চা প্রসব করবে। চিন্তা করতে পারিস আরবী ভাষার গভীরতা কতটুকু?

সঞ্জু তৃতীয়বার সুবহানাল্লাহ বলে চিৎকার করে উঠল। সে আরও বলল, এমন সমৃদ্ধ যে-ভাষা, সে ভাষায় কুরআন নাযিল হবে না তো কোন ভাষায় হবে? সুবহানাল্লাহ! সুবহানাল্লাহ!

বাড়ির ভেতর থেকে ডাক চলে এসেছে। সাজিদের বড় কাকা চিৎকার করে বলছেন, কই রে সাজিদ! তোরা কি খাওয়া দাওয়া করবি না নাকি? ছেলেগুলো সেই কোন সন্ধ্যায় এসেছে। আরেকটু হলে তোত ফজরের আযান হবে মসজিদে।

আমরা যেন কেউই সেদিকে খেয়াল দিইনি। সাজিদের কথাগুলো মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম। এত চমৎকার কুরআন নিয়ে কখনোই আমাদের সেভাবে ভাবা হয় না। সামান্য একটি শব্দের মধ্যেও যে এরকম বিস্ময় লুকিয়ে থাকতে পারে সেটি আজ সাজিদের মুখে না শুনলে বুঝতামই না।

সাজিদ বলল, এই দেখ, আমার বাড়িতে এনে তোদের না খাইয়ে লেকচার শোনাচ্ছি। চল, এবার খাওয়া-দাওয়া করা যাক…।

ভাজা ইলিশের গন্ধ আসছে নাকে। আচ্ছা, এতক্ষণ এই গন্ধ টের পাইনি কেন? কে জানে, হয়তো পেয়েছি কিন্তু সাজিদের লেকচারে এমন ঝুঁদ হয়ে ছিলাম যে ইলিশের গন্ধ নাকে লাগছে অথচ সেটি টেরই পাইনি।

3 Comments
Collapse Comments

লেখা গুলো কি কপি পেস্ট করে নিজের কাছে রাখা যাবে বা পেজ কি সেভ করা যাবে?

Bangla Library (Administrator) May 2, 2022 at 2:55 am

অবশ্যই।

আরিফ আজাদ কোরানে বিরাট বিরাট জিনিস আবিষ্কার করে চলেছেন। কিন্তু সূরা ফাতিহা যে আল্লাহর উদ্দেশ‍্যে বান্দার নিবেদন এবং এটা আল্লাহর বাণী নয়-এই সোজা জিনিসটা তো আবিষ্কার করতে পারলেন না।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *