কিছুক্ষণ আগে গাড়ি এসে ইমনকে নিয়ে গেছে। সে কোনো স্মৃতিচিহ্ন রেখে যায় নি। মার কাছ থেকে আসার সময় যা যা নিয়ে এসেছিল, খুব গুছিয়ে প্রতিটি জিনিসই তার ব্যাক প্যাকে ভরেছে।
শওকত ভেবেছিল— পাজেরো জিপ স্টার্ট নিয়ে যখন সামনে যেতে থাকবে, তখন ইমন জানালা দিয়ে মাথা বের করে একবার হলেও হাত নাড়বে। বিদেশী বাচ্চাদের মতো বাই বা এই জাতীয় কিছু বলবে। তা সে বলে নি। জানালা দিয়ে মাথাও বের করে নি।
শিশুদের মনোজগৎ আলাদা। তারা তাদের ক্ষুদ্র হৃদয় দিয়ে অনেক হিসাবনিকাশ করে। সেই হিসাব-নিকাশের রহস্য বড়রা বুঝতে পারে না।
ইমন চলে যাবার পর শওকতের নিজেকে ভারমুক্ত মনে হলো। যেন এই কদিন মাথার উপর অদৃশ্য চাপ ছিল। এখন সেই চাপটা নেই। মানুষ হিসেবে সে এখন মুক্ত মানুষ। শুধু একটা সমস্যা হচ্ছে, বাসাটা হঠাৎ জনমানবশূন্য মনে হচ্ছে। যেন এই বাসায় কিছুদিন আগেও অনেক লোক বাস করত, এখন কেউ নেই। আবারও পুরনো অবস্থায় ফিরে যেতে সময় লাগবে।
শওকত ঘর তালাবন্ধ করে বের হলো। একা একা কিছুক্ষণ হাঁটবে। বাড়ি ফেরার কোনো তাড়া নেই। একসময় ফিরলেই হলো।
তৌফিকের বাসায় যাওয়া যায়। ছবি এঁকে সে খুব নাম করেছে। জাপান ন্যাশনাল মিউজিয়ামে তৌফিকের একটা পেইন্টিং আছে। প্রায়ই শোনা যায় পৃথিবীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় তার ছবির শো হচ্ছে। হঠাৎ খ্যাতিতে তৌফিক বদলেছে কি-না তা দেখে আসা যায়। বছর ছয় আগেও তৌফিকের সঙ্গে দেখা হওয়া ছিল আতঙ্কজনক ব্যাপার। তৌফিক অবধারিতভাবে জাপ্টে ধরে বলবে— দোস্ত, পকেটে যা আছে সব দিয়ে দে। আমার অবস্থা ভয়াবহ।
সেই তৌফিক ধানমণ্ডিতে বিশাল ফ্ল্যাট কিনেছে। সেই ফ্ল্যাটে ছবি আঁকার স্টুডিও না-কি দর্শনীয়।
রাস্তায় নেমেই তৌফিকের বাসায় যাবার পরিকল্পনা বাদ দিয়ে শওকত টেলিফোনের দোকানে ঢুকে গেল। ইমন বাড়িতে ঠিকমতো ফিরেছে কি-না জানা দরকার। রেবেকাই টেলিফোন ধরল।
কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই রেবেকা বলল, ইমন ঠিকমতো ফিরেছে। তুমি কি কথা বলবে ইমনের সঙ্গে?
শওকত বলল, ইমন কী করছে?
লেবুর শরবত বানিয়ে দিয়েছি, শরবত খাচ্ছে।
তোমরা নিউইয়র্ক কবে যাবে?
টিকিটের উপর নির্ভর করছে। টিকিট পেলেই চলে যাব।
যাবার তারিখটা কি জানাবে?
জানাব। তোমার কোনো ফোন নাম্বার আছে যেখানে জানাতে পারি?
না নেই।
লোক পাঠিয়ে খবর দেব। রাখি তাহলে।
রেবেকা টেলিফোন রেখে দেবার পর শওকতের মনে হলো, ইমনের সঙ্গে কথা বলা হলো না। সে কি আবার টেলিফোন করে ইমনকে চাইবে? তেমন বিশেষ কোনো কথাও তো নেই যে এই মুহূর্তেই বলতে হবে। কেমন আছ ইমন? এখন কী করছ? মাকে দেখে ভালো লাগছে?– এর বাইরে তো আর কিছু নেই জিজ্ঞেস করার মতো।
শওকত আনিকাকে টেলিফোন করল। আনিকা ঘুম ঘুম গলায় বলল, কী ব্যাপার?
শওকত বলল, কয়টা বাজে?
আনিকা বলল, কয়টা বাজে জানার জন্যে টেলিফোন করেছ? দশটা পঁচিশ।
বলো কী! এত রাত হয়েছে? ঘুমিয়ে পড়েছিলে?
হ্যাঁ।
তাহলে রাখি, পরে কথা হবে।
ঘুম যখন ভাঙিয়েই দিয়েছ, কথা বলো। ছেলে কোথায়?
মার কাছে চলে গেছে।
একা একা লাগছে, সেই জন্যে টেলিফোন?
হয়তোবা।
চলে যাবার সময় ছেলে কি কান্নাকাটি করেছে?
না।
তোমার ছেলে খুব শক্ত। তুমি বোধহয় জানো না সে আমাকে খুব পছন্দ করেছে।
জানি। সে বলেছে।
কী বলেছে?
অদ্ভুত কথা বলেছে। সে বলেছে, আনিকার গানের গলা ক্রিস্টেল গেইলের চেয়েও ভালো।
ক্রিস্টেল গেইল কে?
আমি জানি না কে। আমেরিকান কোনো পপ সিঙ্গার হবে। আমাকে ইমন অনুরোধ করেছে—তোমার একটা গানের সিডি যেন তাকে দেই। তুমি যে গান গাইতে পার, তাই তো আমি জানি না।
জানার চেষ্টা কর নি বলে জানো না। আশেপাশের মানুষদের প্রতি তোমার কৌতূহল খুব কম।
হয়তো কম।
ভাত খেয়েছ?
না।
তোমার গলার স্বর শুনে মনে হচ্ছে, তোমার মনটা খুব খারাপ। সম্ভব হলে আমি এসে তোমাকে ভাত খাইয়ে যেতাম। বুঝতেই পারছ সেটা সম্ভব না।
বুঝতে পারছি।
আজ রাতে খামারের মালিকের সঙ্গে চাইনিজ খেয়েছি। তার সঙ্গে চাইনিজে যাওয়ার ব্যাপারটা না থাকলে আমি আসতাম। আমার সিক্সথ সেন্স বলছিল তোমার ছেলে সন্ধ্যাবেলা চলে যাবে। ভালো কথা, খামার মালিকের সঙ্গে চাইনিজ খাওয়ায় তুমি রাগ করো নি তো?
রাগ করব কেন?
ভদ্রলোককে আমার পছন্দ হয়েছে। সামান্য বোকা, সেটা কিছু না। ভদ্রলোক এমন ভাব করছিলেন যেন তিনি অতি তুচ্ছ একজন। আর আমি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বিদুষী। রূপে মিস এশিয়া।
ভালো তো!
কিছু কিছু মানুষ আছে যারা প্রেমিক হিসেবে মোটেই ভালো না। কিন্তু স্বামী হিসেবে অসাধারণ। আদর্শ স্বামী, আদর্শ পিতা।
প্রেমিকরা আদর্শ স্বামী হয় না?
হয় না। তারা আদর্শ স্বামী যেমন হয় না, আদর্শ পিতাও হয় না। তোমার নিজের কথাই ধর। তুমি কি আদর্শ পিতা?
না।
রাগ করলে আমার কথায়?
না।
প্লিজ রাগ করো না। তোমাকে রাগানোর জন্যে আমি কিছু বলছি না। তুমি অসহায় একজন মানুষ। অসহায় মানুষকে রাগাতে নেই।
অসহায় মানুষকে কী করতে হয়? করুণা?
হ্যাঁ, এরা করুণাভিক্ষা করে জীবন পার করে দেয়। করুণা পেতে পেতে এরা অভ্যস্ত হয়ে যায়, তখন করুণা না পেলে তাদের ভালো লাগে না।
তুমি কি খামার মালিককে বিয়ে করার কথা ভাবছ?
একেবারেই যে ভাবছি না তা না। রাতে যখন ঘুমুতে গেছি, তখন মনে হয়েছে আগের চ্যাপ্টারটা ফেলে দিয়ে নতুন একটা চ্যাপ্টার লেখা শুরু করলে কেমন হয়!
আমার মতামত চাও?
আমি কীভাবে আমার জীবন সাজাব সেটা আমি ঠিক করব। অন্যের মতামত কেন নেব! এখন বাসায় যাও। খাওয়া-দাওয়া করে ঘুমাও।
আনিকা, আমার ছেলে তোমার জন্যে একটা গিফট রেখে গেছে। একদিন এসে নিয়ে যাবে।
কী গিফট?
এক মুঠো পার্ল। সে মোমবাতি দিয়ে পার্ল বানিয়েছে।
তোমার ছেলের মতো শান্ত বুদ্ধির ছেলে আমি আমার জীবনে দেখি নি। আমার জীবনে অনেক হতাশা আছে। তোমার ছেলেকে দেখে আরেকটা হতাশা যুক্ত হয়েছে।
সেটা কী?
আমার কেন কোনোদিন এরকম একটা ছেলে হবে না!
কেন হবে না? অবশ্যই হবে!
আনিকা হঠাৎ বলল, তোমার সঙ্গে এখন আর কথা বলতে ভালো লাগছে। রাখি।
শওকত বাসায় ফিরল না। রাত সাড়ে এগারোটার সময় তৌফিকের বাসার দরজার কলিংবেল বাজাল। তৌফিক নিজেই দরজা খুলে দিল। উল্লসিত গলায় বলল, আরে তুই! দি গ্রেট শ। (তৌফিক শওকতকে ডাকে শ। এই শ নাকি শওকতের শ না, শালার শ।)
শওকত বলল, আছিস কেমন?
চমৎকার আছি। বাসায় পার্টি চলছে। তরল নেশা, বায়বীয় নেশা— সব ব্যবস্থাই আছে। তুই ভালো সময়ে এসেছিস। বারটা এক মিনিট থেকে বাঁশি শুরু হবে। ওস্তাদ মিনু খান এসেছেন। নাম শুনেছিস মিনু খানের?
না।
বলিস কী! তুই কোন ভুবনে বাস করিস যে মিনু খানের নাম জানিস না?
জমজমাট পার্টিতে ঢুকে শওকত অস্বস্তির মধ্যে পড়ে গেল। অপরিচিত সব নারী-পুরুষ। তাদের চোখের দৃষ্টি ঘোরলাগা। গলার স্বর জড়ানো। তৌফিক শওকতকে পরিচয় করিয়ে দিল হলেও হতে পারত মহান শিল্পী দি গ্রেট শ।
একসঙ্গে পঁচিশ-ত্রিশজন চেঁচিয়ে বলল, চিয়ার্স। কেউ একজন হাতের গ্লাস দেয়ালে ছুড়ে ফেলল। এই জাতীয় পার্টিতে আনন্দমাত্রা অতিক্রম করলে গ্লাস ভাঙতে হয়। তাই নিয়ম।
রাত বারটা এক মিনিটে ওস্তাদ মিনু খান বাঁশিতে বেহাগ বাজাতে শুরু করলেন। তৌফিক বড় একটা ক্যানভাসের সামনে রঙ-তুলি নিয়ে বসল। বেহাগের সুর সে ক্যানভাসে আনবে। এই উদ্দেশ্যেই আজকের পার্টি।
বাঁশিতে বেহাগ বাজছে। তৌফিক ব্রাশ টানছে। তার ব্রাশের টানে কোনো দ্বিধা নেই। যেন সে জানে সে কী করছে।
শওকত ঘরের এক কোনায় বসে আছে। তৌফিকের শক্ত হাতে ব্রাশ টানা দেখতে তার ভালো লাগছে। সতের-আঠার বছরের অত্যন্ত রূপবতী এক তরুণী এসে শওকতকে বলল, আপনি শুধু হাতে বসে আছেন— এটা কেমন কথা! খুব ভালো রেড ওয়াইন আছে। পর্তুগিজ। এনে দেব?
শওকত বলল, না। আমার শরীর খারাপ।
আপনার কী হয়েছে?
আমি একজন মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত মানুষ।
তাই না-কি? মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত কোনো মানুষের সঙ্গে আমি আগে কখনো গল্প করি নি। আপনার সঙ্গে কি গল্প করতে পারি?
হ্যাঁ পারেন।
আচ্ছা বলুন তো, বাঁশির সুর কি কোনো পেইন্টার তার ক্যানভাসে ধরতে পারেন?
দুটা দুরকম জিনিস।
কোন অর্থে দুরকম? সুর এবং রঙ আলাদা কোন অর্থে?
আপনি কি সত্যি জবাবটা চান?
আপনার কি মনে হয় আমি জবাবটা চাই না?
শওকত বলল, আপনি জবাবটা শুনতে চাচ্ছেন না। আপনার কথা বলতে ভালো লাগছে বলেই আপনি কথা বলছেন।
মেয়েটি উঠে চলে গেল।
শওকতেরও উঠে চলে যেতে ইচ্ছা করছে। আবার ছবিটা কী দাঁড়ায় সেটাও দেখতে ইচ্ছা করছে। শওকতের মনে হলো ইমনকে এই অনুষ্ঠানে নিয়ে এলে সে মজা পেত। একজন বাঁশি বাজাচ্ছে আর আরেকজন সেই বাঁশির সুর ক্যানভাসে ধরতে চেষ্টা করছে। ছোটদের অদ্ভুত জগতে এই ঘটনা অতি রোমাঞ্চকর।
ওস্তাদ বাশি ভালো বাজাচ্ছেন। ছবি তত ভালো হচ্ছে কি-না বোঝা যাচ্ছে। নীল রঙের নানান শেড পড়ছে। বেহাগের রঙ কি নীল?
শওকত ভাই! একা একা ঝিম ধরে বসে আছেন কেন? আমাকে চিনতে পারছেন?
স্কার্ট পরা লাল চুলের এই মহিলাকে চেনা যাচ্ছে না। তবে গলার স্বর চেনা। মিষ্টি গলা।
আমি রুমা!
ও আচ্ছা রুমা ভাবি! আমি চিনতে পারি নি। ঘরে ঢোকার পর থেকে মনে মনে খুঁজছিলাম— তৌফিকের বউ কোথায়?
রুমা বলল, চিনতে পারার কথাও না। আয়নায় যখন নিজেকে দেখি, খুবই অচেনা লাগে। চুল রঙ করিয়েছি। থ্যাবড়া নাক ছিল, তিন হাজার পাউন্ড খরচ করে নাক ঠিক করেছি। নাক ঠিক হয়েছে না? আপনি আর্টিস্ট মানুষ, আপনি ভালো বলতে পারবেন।
শওকত বলল, ভাবি, আমি এখন আর্টিস্ট না। আমি ছবি আঁকা ছেড়ে দিয়েছি।
ছাড়লেন কেন?
ভালো লাগে না।
বাঁশির সুরের সঙ্গে ছবি আঁকার ব্যাপারটা আপনার কাছে কেমন লাগছে?
তেমন ভালো লাগছে না।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আর্টের ফরম বদলাবে। অনেক পপ জিনিস ঢুকে যাবে। আর্টকে জনপ্রিয় করার জন্যে এর প্রয়োজনীয়তা আছে।
আছে হয়তো।
হয়তো বলবেন না ভাই। নিশ্চয়ই আছে। আগে ক্রিকেট খেলা হতো পাঁচদিন, এখন হচ্ছে ওয়ানডে। সময়ের সঙ্গে সবকিছুকেই তাল মিলিয়ে চলতে হবে।
শওকত হাসল। রুমা ভাবির মতো একশ পারসেন্ট খাঁটি বাঙালি মেয়ের তর্ক করার ভঙ্গিতে কথা বলা দেখতে মজা লাগছে।
ভাই, আপনার হাত খালি কেন? অন্য কিছু না খান, শ্যাম্পেনের বোতল খোলা হয়েছে, শ্যাম্পেন খান। আমার সঙ্গে গ্লাস ঠোকাঠুকি করে শ্যাম্পেন খেতে হবে। নিয়ে আসি? আজ আমাদের একটা বিশেষ দিন।
বিশেষ দিনটা কী?
আজ আমাদের বিয়ের দিন। আপনি কেন ভুলে গেলেন? আমরা গোপনে কাজি অফিসে গিয়ে বিয়ে করলাম। আপনি সাক্ষী ছিলেন। আমাদের হাতে কোনো টাকা-পয়সা ছিল না। আপনি আমাদের তিনশ টাকা দিলেন। মনে পড়েছে?
ঘটনাটা মনে পড়েছে। কত টাকা দিয়েছিলাম মনে নাই।
আমার মনে আছে। টাকাটা আপনি দিয়েছিলেন আমার হাতে। কী কষ্টের দিন যে গেছে! পুরনো দিনের কথা আমার অবশ্য মনে পড়ে না। অ্যালকোহল বেশি খেয়ে ফেললে তখন মনে আসে। ভাই, আনি আপনার জন্যে এক গ্লাস শ্যাম্পেন?
আনুন।
আপনার বন্ধু স্পেনে একটা ফ্ল্যাট কিনেছেন। ঐসব দেশে বাড়িঘর কেনা খুব সহজ। সামান্য কিছু ডাউন পেমেন্ট করলেই কেনা যায়। একবার আসুন না স্পেনে? আপনাদের মতো আর্টিস্টদের জন্যে ইন্টারেস্টিং জায়গা।
শওকত আবারও হাসল। পার্টি তার ভালো লাগতে শুরু করেছে। ঘরের আলো কমিয়ে দেয়া হয়েছে। ওস্তাদ বংশিবাদক ভালো বাজাচ্ছেন।
নিমন্ত্রিত অতিথিরা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে নিচু গলায় গল্প করছেন। মাঝে-মাঝে গ্লাসের টুং টাং শোনা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে বিদেশী কোনো ছবির পৃশ্য। মন্দ কী!
শ্যাম্পেনের গ্লাসে চুমুক দিয়ে শওকত প্রায় ফিসফিস করে বলল—
এইখানে এই তরুর তলে
তোমায় আমায় কৌতূহলে
যে কটি দিন কাটিয়ে যাব প্রিয়ে
সঙ্গে রবে সুরার পাত্র
অল্প কিছু আহার মাত্র
আরেকখানি ছন্দ মধুর কাব্য হাতে নিয়ে।
রুমা তার হাতে গ্লাস ধরিয়ে দিয়ে চলে গেছে। একের পর এক কবিতা আবৃত্তি করলেও এখন আর কেউ চোখ সরু করে তার দিকে তাকাবে না। শওকত কবিতা মনে করার চেষ্টা করছে। মনে পড়ছে না।
শওকত ঘোরলাগা মাথায় অনেক রাতে বাসায় ফিরল। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে, আবার ঘুম আসছে না এমন অবস্থা। এই অবস্থার সুন্দর ইংরেজি নাম আছে। নামটা মনে আসছে না। ইমন বাসায় থাকলে তাকে জিজ্ঞেস করা যেত। ইমন নেই। আবার কখনো কি তাকে পাওয়া যাবে? পাঁচ সাত আট বছর পর হয়তো সে এলো। তখন যদি বলা হয়— হ্যালো বেবি, চা বানানো মনে আছে? খুব কড়া করে এক কাপ চা বানাও। দুধ-চিনি সবই বেশি বেশি দেবে।
ইমনের আর না আসাই ভালো।
অভ্যস্ত জীবনে হঠাৎ ঘূর্ণির কোনো প্রয়োজন নেই। সবাই সবার নিজের জীবনে থাকুক। প্রতিটি জীবন নদীর মতো। একটা নদীর সঙ্গে আরেকটা নদীর মিলে-মিশে যাওয়া খুব খারাপ ব্যাপার।
শওকত রাত সাড়ে তিনটায় মগ ভর্তি করে চা বানাল। ঘুমানোর আগে কড়া এক কাপ চা খেলে তার ঘুম ভালো হয়। আজ এমনিতেই ভালো ঘুম হবে, তারপরেও অভ্যাস ঠিক রাখা। মানুষ এমন এক প্রাণী যে যে-কোনো মূল্যে অভ্যাস ধরে রাখার চেষ্টা করে। সব কিছু চলে যাক, শুধু অভ্যাসটা থাকুক।
ঘুম আসছে না। অনেকদিন পর তাকে অদ্রিা ব্যাধিতে ধরেছে। আধ্যাত্মিক মানুষদের ব্যাধি এপিলেন্সি, আর সৃষ্টিশীল মানুষদের ব্যাধি অনিদ্রা। সে এখন কোনো সৃষ্টিশীল মানুষ না। সে এখন হাবুগার মানুষ। হাবুগাবুরা খায়-দায়, বাথরুমে যায়, রাতে আরাম করে ঘুমায়।
জানালায় দিনের আলো ঢোকার পর শওকত ঘুমুতে গেল। পাশাপাশি দুটা বালিশ। একটা তার জন্যে, আরেকটা ইমনের জন্যে। ইমনের বালিশের এখন আর প্রয়োজন নেই। এই বালিশ সরিয়ে ফেলা ভালো। স্মৃতির মতো অস্পষ্ট বায়বীয় কোনো বিষয় জমা করতে নেই। শওকত ইমনের বালিশটা তুলে নিজের মাথার নিচে রাখতে গিয়ে দেখল, বালিশের নিচে ক্রিস্টমাস ট্রি আঁকা খাম। খামের উপর বাংলায় লেখা— বাবা।
ভেতরের কার্ডটা ইংরেজিতে লেখা। ক্রিসমাসের অভিনন্দন। কার্ডের সাদা পৃষ্ঠায় ইমন আবার সবুজ পেন্সিল দিয়ে গুটি গুটি করে ইংরেজিতে আট-নয় লাইন লিখেছে। ইংরেজির বাংলা তরজামা অনেকটা এরকম–
আমি কল্পনায় ভেবে রেখেছিলাম তুমি কেমন। কল্পনার সঙ্গে মোটেও মিলে নি। তুমি কল্পনার বাবার চেয়েও অনেক বেশি ভালো। তুমি ছবি আঁকা ভুলে গেছ কেন? ছোটরা অনেক কিছু ভুলে যায়, বড়রা তো ভোলে না। তুমি কেন ভুলে গেলে?