রামকৃষ্ণদেব বলেছেন, কামিনী-কাঞ্চন থেকে তফাত তফাত খুব তফাত থাকো। কাঞ্চনকে এড়াতে পারেনি হেমাঙ্গ। তবে কামিনীকে অনেকটাই পেরেছে। গড়চার বাড়িতে আসার পর তার জীবন প্রায় কামিনী-শূন্য।
তবে এই যে একটা গোটা বাড়ি নিয়ে সে একা থাকে এটা কারও কারও কাছে খুব অন্যায় রকমের বাড়াবাড়ি বলে মনে হয়। বিশেষ করে পিসতুতে দিদি চারুশীলার কাছে। পিসতুতো হলেও চারুশীলা একসময়ে তাদের বাড়িতেই লালিত পালিত হয়েছে। কারণ পিসিমার ছিল দুরারোগ্য নানা আধিব্যাধি। চারুশীলাকে দেখার কেউ ছিল না। সেই শিশুকাল থেকে চারুশীলা তার ওপর শতেক খবরদারি করে এসেছে। আজও করে। মাঝে মাঝেই এসে বলে, অ্যাই, তোর বাড়িটা সামনের শনিবার ছাড়তে হবে, আমি এখানে একটা পার্টি দেবো।
হেমাঙ্গ আপত্তি করলেও এঁটে ওঠে না। দিদিটি বড়ই প্রখরা। যখন মুখ ছোটায় তখন রোখে কার সাধ্য। হেমাঙ্গ অগত্যা বাড়ি ছেড়ে কোনও ছোটখাটো ট্যুরে আশেপাশে কোনও জায়গায় চলে যেতে বাধ্য হয়। মেয়েদের সে যে পছন্দ করে না তার অন্যতম প্রধান কারণ কি এই দিদিটি? হতে পারে। চারুশীলা দুর্দান্ত সুন্দরী। দুটো সিনেমার নায়িকাও হয়েছিল। মুখখানা এমনিতে সুন্দর হলেও ফটোগ্রাহী নয় বলে আর বিশেষ সুযোগ পায়নি। তবে সুন্দরী বলেই ভাল একখানা বর বাগিয়ে নিয়েছে। ওর স্বামী আন্তজাতিক সম্মান-টম্মান পাওয়া একজন বিখ্যাত স্থাপতি। সল্ট লেকে অনেকগুলো বাড়ি তার ডিজাইন করা। দিল্লি, বোম্বাই, নিউ জার্সি ও লন্ডনের শহরতলীতে সে বেশ কয়েকটা বাড়ি বানিয়ে নাম করে ফেলেছে। দেদার টাকা। উদয়াস্ত ব্যস্ত মানুষ। স্বামী যেমন ব্যস্ত, বউটির তেমনই অখণ্ড অবসর। সারাদিন নেই কাজ তো খই ভাজ করে বেড়াচ্ছে। পার্টি দেওয়ার জন্য চারুশীলার জায়গার অভাব নেই। গোলপার্কের কাছে তার নিজস্ব বাড়িটিই কি কম? তবু চারুশীলা যে হেমাঙ্গর বাড়ি মাঝে মাঝে ধার করে সে শুধু কর্তৃত্ব ও আধিপত্য বজায় রাখার জন্য।
আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর সভ্যতাকে হেমাঙ্গ খুব অপছন্দ করে না। সে বিজ্ঞানের ছাত্র নয়, কারণ সলিড জিওমেট্রি ও ডিফারেনশিয়াল ক্যালকুলাস তাকে চোখ রাঙিয়ে এমন ভয় দেখিয়েছিল যে, সে পালিয়ে বাঁচে। কিন্তু বিজ্ঞানের অত্যাশ্চর্য আবিষ্কারসমূহকে সে অতিশয় বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করে। বিশেষ করে ভোগ্যপণ্য ও নিত্য ব্যবহার্য যে সব জিনিস হাতের কাছে এগিয়ে দিচ্ছে বিজ্ঞান, সেগুলিই তাকে আকর্ষণ করে সবচেয়ে বেশী। তবে বিজ্ঞানের কিছু অভিশাপও আছে। তার মধ্যে একটা হল টেলিফোন। গড়চার বাড়িটাকে টেলিফোনমুক্ত রাখতে পারলে সে সত্যিকারের স্বাধীন হতে পারত। কিন্তু ভাড়াটে ভদ্রলোক অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে একটা জ্যান্ত টেলিফোনও রেখে গেছেন এবং হেমাঙ্গর বাবা সেটা বহাল রেখেছেন। ফলে বহির্জগতের নানা কৌতূহল ও প্রশ্ন তাকে সময়ে অসময়ে ব্যতিব্যস্ত রাখে। পিসতুতে দিদি চারুশীলার আক্রমণ ওই টেলিফোনের মাধ্যমেই আসে সবচেয়ে বেশী।
রাত দশটায় হেমাঙ্গ অখণ্ড মনোযোগে ভি সি আর-এ একখানা সায়েন্স ফিকশনের ক্যাসেট চালিয়ে দেখছিল। ঠিক এই সময়ে চারুশীলার টেলিফোন এল।
কি রে কিম্ভুত! কী করছিস?
হ্যালো আইডল ব্রেন, আবার কিসের দরকার পড়ল?
তোর ঘরে কিসের শব্দ হচ্ছে বল তো! ভি সি আর চলছে নাকি? একা বাড়িতে বসে ব্লু ফিল্ম দেখছিস না তো!
তুই একটা অত্যন্ত বাজে মেয়ে, তা কি জানিস?
একটু হেসে চারুশীলা বলে, আহা, দোষের তো কিছু নয়। এখন বয়স হয়েছে, একা বাড়িতে থাকিস, ওসব তো হবেই বাবা। স্বীকার করলেই হয়। শুধু শুধু সাধু সেজে থাকা কেন বাপু?
তোর মতো সবাই রদ্দি মার্কা কিনা। আমি একটা সায়েন্স ফিকশন দেখছি।
আজকাল বেশীর ভাগ ইংরিজি ছবিতেই একটু পর্ণোগ্রাফি থাকে।
থাকলে থাকে। তোকে আমার মরাল গার্জিয়ান হতে হবে না।
আবার খিলখিল হাসি শোনা গেল।
হেমাঙ্গ গম্ভীর গলায় বলে, দেখ, রাত দশটার সময় ইয়ার্কি ভাল লাগে না। ছবিটা শেষ হলেই আমি শুতে যাবো। কাল অফিস আছে। তোর মতো বেলা ন’টায় ঘুম থেকে উঠলে আমার চলবে না।
তুই কিরকম কাজের লোক তা জানি। আমিও একটা দরকারেই ফোন করছি। মোটেই ইয়ার্কি নয় সেটা।
তাহলে ভ্যানতাড়া করছিস কেন? কী দরকার?
আচ্ছা, তোর একজন চেনাজানা হোমিওপ্যাথ আছে না? চৌধুরী না কী যেন।
আছে তো। কণাদ চৌধুরী।
অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া কি শক্ত?
দিন দশেক লাগে অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেতে। কেন?
আমার একটা বন্ধু আছে না, রিয়া, ওর একটু প্রবলেম হচ্ছে।
কী প্রবলেম?
মেয়েদের অনেক প্রবলেম থাকে। তাতে তোর কী দরকার?
যা বাবা! আমি তো স্রেফ অ্যাকাডেমিক ইন্টারেস্ট থেকে জিজ্ঞেস করলাম।
সব ব্যাপারে ছেলেমানুষদের অত ইন্টারেস্ট ভাল নয়। যাকগে, কাল একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে দিবি? বিকেল ছটা সাড়ে ছটা নাগাদ?
রিয়া মানে সেই মোটাসোটা ফর্সা মতো না? যার হাজব্যান্ড একটু গেঁয়ো টাইপের, কিন্তু দারুণ কোয়ালিফায়েড!
হ্যাঁ। কিন্তু রিয়া মোটেই মোটা নয়। সলিড় হেল্থ।
একটু বেশী সলিড। তোর মতোই।
কী, আমি সলিড! জানিস, গত এক বছরে আমার ওজন দেড় কেজি কমেছে, দশ গ্রামও বাড়েনি।
দেখে তো তা মনে হয় না। স্বামী বেচারা হিল্লিদিল্লি করে মরছে আর বউ গ্যাঁট হয়ে বসে বসে খাচ্ছে আর মুটোচ্ছে। তোর মতো আইড্ল ব্রেনের অপদার্থ মেয়েদের দেখে দেখেই আমার বিয়ের ইচ্ছেটা চলে গেছে।
আর তোকে দেখে বহু মেয়ে চিরকুমারী থাকবে বলে তৈরি হচ্ছে, তা জানিস? আমার বর হিল্লি দিল্লি করে বেড়ায় সেটা কি আমার দোষ? আমি তো বলেই দিয়েছি, অত টাকা রোজগারের কোনও দরকার নেই, এবার একটু বাড়িতে থাকো। যা আছে তাতেই আমাদের ঢের। কিন্তু পুরুষদের তো টাকার নেশা। আরও চাই, আরও চাই। এই যে তুই, মামার টাকার পাহাড়ের ওপর বসে আছিস, তাও টাকার গন্ধে গন্ধে কোথায় কোথায় ছোঁক ছোঁক করে বেড়াচ্ছিস। আজকাল তো শুনি গাঁয়ে গঞ্জের ছোটো ছোটো ইস্কুলে অবধি অডিট করতে যাস। শুনে ঘেন্নায় মরে যাই।
একটা চড়াই পাখির মাথায় যেটুকু ঘিলু আছে সেটুকুও যদি তোর থাকত! জানিস তো, ভগবান খুব ইমপারশিয়াল। যাকে বিউটি দেন তাকে ব্রেনটা দেন না, যাকে ব্রেন দেন তাকে বিউটি থেকে বঞ্চিত করেন। এরকমই আর কি! তবে ব্রেন না থাকা খুব ভাল। ব্রেনলেসরাই জগতে সুখী। পাখির মস্তিষ্ক না হলে কেউ ভাবতে পারে যে, আমি টাকার লোভে গাঁয়ে অডিট করতে যাই?
তাহলে কেন যাস?
আমার রুর্যাল লাইফ দেখতে ভাল লাগে, তাই যাই।
শেষে একদিন একটা গাঁয়ের বঁধূ এনে হাজির করবি নাকি? দেড় হাত ঘোমটার নিচে নোলক দুলবে, চোখে জ্যাবড়া কাজল, কনুই অবধি গয়না, পরনে রোলেক্স শাড়ি!
তবু তোদের চেয়ে ভাল। রাত হয়ে যাচ্ছে, ছাড়ছি।
ওরে দাঁড়া দাঁড়া। আমার অ্যাপয়েন্টমেন্টটার কী হবে?
কী আবার হবে! বলে দেখব’খন।
দেখব’খন বললে হবে না। কালকেই চাই।
হয়ে যাবে।
চেম্বারটা বদ্রীদাস টেম্পল স্ট্রিটে না?
হ্যাঁ। তুই তো একবার গিয়েছিলি!
সে তো কবে! তিন বছর আগে।
তোর কথা শেষ হয়েছে?
না, না, শোন, লোকটার ভিজিট কত?
জানি না। ষাট-টাট হবে। কেন, রিয়ার কি টাকার প্রবলেম?
না। তবে ওর মেয়ের একটি প্রাইভেট টিউটর আছে। ছেলেটা খুব ভাল। দারুণ পড়ায়। কিন্তু বোধহয় ছেলেটা এপিলেপটিক। জানিস তো, এপিলেপসির কোনও চিকিৎসাই নেই। রিয়ার ইচ্ছে সেই ছেলেটাকেও নিয়ে যায়। ভিজিট বেশী হলে পেরে উঠবে না।
বেশী নয়। আমার রেফারেন্সে গেলে ভিজিট হয়তো নিতেই চাইবে না। তোরা মেয়েরা এত কিপ্পুস কেন রে? প্রাইভেট টিউটরের চিকিৎসা করাতে চায় সেটা বেশ ভাল জেসচার, কিন্তু ভিজিট বেশী হলে চিকিৎসা করাবে না এটা কেমন কথা?
মেয়েরা হিসেব করে চলে বলেই স্বামীরা টিকে আছে।
বেশী বকিস না। নিজের শাড়ি, গয়না, সাজের জিনিস কেনার সময় স্বামীর টাকার মায়া করিস?
ওই একটা ব্যাপারে মেয়েরা মোটেই কিপ্পুস নয়।
তাহলে ভিজিট বেশী নয় বলছিস?
আমি খবর রাখি না। তবে কণাদকে বলে দেবোখন যেন প্রাইভেট টিউটরের ভিজিট না নেয়, আর রিয়ার ভিজিট যেন অবশ্যই নেয়।
ঠিক আছে বাবা, তাই হোক। রিয়া মোটেই বিনা ভিজিটে চিকিৎসা করাতে চাইছে না।
এবার কি কথা শেষ হয়েছে?
আর একটা কথা।
আবার কী?
একটা ফার্স্ট ক্লাস মেয়ে আছে আমার হাতে। তোর সঙ্গে খুব মানাবে।
সে তো পুরোনো কাসুন্দি। তোর হাতে সব সময়েই পাত্রী মজুদ থাকে, আর তাদের সবাইকেই আমার সঙ্গে মানায়।
না মাইরি, এ মেয়েটা দারুণ ভাল।
ভাল না হওয়ার তো কারণ নেই। দুনিয়াতে বিস্তর ভাল মেয়ে আছে।
আমার একটা কি সন্দেহ হয় জানিস? তোকে কেউ দাগা দিয়েছে। কিন্তু কে যে দিল সেইটেই বুঝতে পারছি না। আগে তো সব কথা আমাকে বলতিস, আজকাল লুকোস। বলবি সত্যি কথাটা?
বলছি। আমাকে একজন ভীষণ দাগা দিয়ে গেছে। হল তো!
ইয়ার্কি রাখ। সত্যি করে বল না ভাই!
তুই যা শুনতে ভালবাসিস তাই তো বলছি।
আচ্ছা, তুই কি নারীবিদ্বেষী?
প্রবল রকমের। তোর মতো মেয়েদের দেখে দেখেই বিদ্বেষটা জন্মেছে।
আমার জন্য কত ছেলে পাগল ছিল তা জানিস?
জানি। পৃথিবীতে আহাম্মকদের সংখ্যাই বেশী। আমার ঘুম পাচ্ছে, এবার ছাড়ছি।
ওরে দাঁড়া, দাঁড়া। কাজের কথাটাই তো হয়নি।
আবার কিসের কাজের কথা?
শোন না পাগলা, কাল ডাক্তারের কাছে যাওয়ার ব্যাপারে একটু প্রবলেম রয়েছে যে!
কিসের প্রবলেম?
কাল আমাদের অন্তু ড্রাইভার দেশে যাচ্ছে। গাড়ি চালাবে কে?
তার আমি কি জানি? অটোমোবাইল অ্যাসোসিয়েশন থেকে ড্রাইভার নিয়ে নে।
দূর পাগলা, বাইরের একটা অচেনা লোক গাড়িতে থাকলে কি ফ্রীলি কথা বলা যায়, বল! গাড়ি চড়ার আরামটাই মাটি হয়ে যায়। অন্তু থাকলে কথা ছিল না, সে পুরোনো লোক।
কী বলতে চাস খোলসা করে বলবি? অন্তু না থাক, তোর আর একটা গাড়ি আর তার ড্রাইভারও তো আছে।
ছাই জানিস। সেটা তো আমার কর্তা নিজে চালায়। গত সপ্তাহে আমস্টারডাম যাওয়ার আগে ড্রাইভারকে ছাড়িয়ে দিয়ে গেছে। আমাকে বলে গেছে, যেন এই অয়েল ক্রাইসিসে দুটো গাড়ি ব্যবহার না করি। ফলে ও গাড়ি এখন অস্পৃশ্য। কর্তা ফিরলে ফের চলবে।
তাহলে মানেটা কী দাঁড়াল?
মানে দাঁড়াল, কাল তুই একটু সকাল সকাল অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা আমার এখানে চলে আসবি। তোর সঙ্গেই আমরা দুই বান্ধবী ডাক্তারখানায় যাবো।
অসম্ভব! অসম্ভব!
অসম্ভব কথাটা কাদের অভিধানে থাকে তা জানিস?
বোকাদের। আমি তো বোকাই।
বোকা একটু আছিস, তবে সেটা ধরছি না। আসলে তুই হচ্ছিস কলকাতার সবচেয়ে ভাল দশ জন মোটর ড্রাইভারদের একজন। ইন ফ্যাক্ট তুই-ই হয়তো এক নম্বর।
তেল দিয়ে লাভ হবে না রে। আমি পারব না। কলকাতায় ট্যাক্সির অভাব নেই।
কী যে বলিস তার ঠিক নেই। পুরুষ ছাড়া শুধু মেয়েরা ট্যাক্সিতে চড়ে কখনও? যদি নিয়ে পালিয়ে যায়?
তোকে নিয়ে কেউ পালাবে না, যদি ঘটে তার বুদ্ধি থাকে। তুই হচ্ছিস যে কোনও পুরুষের গভীর লায়াবিলিটি। আর, কলকাতার ট্যাক্সিওলাদের অনেক দোষ থাকলেও মহিলা হাপিস করার বদনাম নেই। প্রতিদিন শয়ে শয়ে মেয়ে একা একা ট্যাক্সিতে চড়ে দাবড়ে বেড়াচ্ছে।
আমরা কি ওরকম? অত সাহস আমার নেই। তা ছাড়া জায়গাটাও যে ভাল চিনি না। সেই কবে, একবার গিয়েছিলাম। লক্ষ্মী, ভাই, তোর তো পরোপকারী বলে একটা নাম আছে।
আমি আজকাল তেল নিই না রে।
তেল নয়, তোর কিছু ভাল গুণ তো সত্যিই আছে। তোর কি আর সবটাই খারাপ?
সবটাই খারাপ এমন লোক দুনিয়াতে বিশেষ নেই। ওটা কোনও কমপ্লিমেন্ট হল না। আর তোর মতো দুমুখো লোকের কমপ্লিমেন্ট আমি নিইও না।
আমি দুমুখো লোক! আচ্ছা বেশ তাই হল। কিন্তু একা ট্যাক্সিতে গিয়ে যদি আমাদের বিপদ হয় তো মামার কাছে মুখ দেখাতে পারবি? নিজের বিবেককেই বা কি বলবি?
তুই কলকাতা-চষা ঝানু মেয়ে, ন্যাকামি রাখ। তোকে যে-ট্যাক্সিওলা সীতাহরণ করবে সে এখনও মায়ের পেটে।
কিডন্যাপ নয় না-ই করল, টাকা-পয়সা গয়নাগাঁটি কেড়ে নিতে পারে তো!
না, পারে না। বাজে কথার সময় নেই। ছাড়ছি।
আহা, শোন না কথাটা! ছেলেবেলায় তোর মনটা কত নরম ছিল ভাব তো। আমার একদিন স্কুল থেকে ফিরতে দেরী হয়েছিল বলে কেঁদে ভাসিয়েছিলি। মনে আছে? আর একটা কথা শোন, পিন্টুটাও সঙ্গে যাবে। ওর খুব ইচ্ছে তোর সঙ্গে যায়।
উফ, তোদের চক্রান্তে একটা ইনোসেন্ট বাচ্চাকেও টেনে নামালি! তোর মতো…..
আচ্ছা আচ্ছা, তুই বরং পিন্টুর সঙ্গেই কথা বলে দেখ!
সে যে লড়াইয়ে হারছে তা হেমাঙ্গ বুঝতে পারছিল। কিছু করার নেই। চারুশীলার দুই সন্তানের মধ্যে বড়টি মেয়ে নন্দনা, ছোটোটি স্পন্দন বা পিন্টু। দুটিই সাহেব-বাচ্চাদের মতো সুন্দর। পিন্টুটা কোনও এক কার্যকারণে হেমাঙ্গর ভীষণ ন্যাওটা। যখন দুধের শিশু ছিল তখনই আর কারও কোলে নয়, শুধু হেমাঙ্গ হাত বাড়ালে ঝাঁপ খেয়ে চলে আসত এবং আর কারও কাছে যেতে চাইত না। হেমাঙ্গ চারুশীলাকে বলত, দেখ, শিশুরা ঠিক মানুষ চেনে। ওরা হচ্ছে ভগবানের লোক, তাই নিষ্পাপ মানুষ দেখলেই র কাছে চলে আসতে চায়। চারুশীলা বলত, তা নয় রে। ও আসলে তোর মধ্যে আর একটি অবোধ শিশুকেই দেখতে পায়, তাই অমন করে। তোর মাথাটা তো ডেভেলপ করেনি।
পিন্টুর বয়স এখন সাত আট হবে। আজও ওর প্রতি হেমাঙ্গর এক প্রগাঢ় মায়া। আর পিন্টুও বড্ড ভালবাসে হেমু মামাকে। পিন্টুর কথায় বরাবর হেমাঙ্গ দুর্বল। ফোনে পিন্টুর গলা পাওয়া গেল, মামা, আমি কাল তোমার সঙ্গে যাব কিন্তু।
যাবে। কিন্তু তোমার মা যে একটি বিচ্ছু তা কি তুমি জাননা?
হ্যাঁ। তোমার সঙ্গে রোজ ঝগড়া করে।
আমি ভাল লোক হওয়া সত্ত্বেও করে। এসব দেখে রাখো। বড় হয়ে একদিন বিচার কোরো। কেমন?
পিন্টু বুঝল না, তবু বলল, আচ্ছা।
ফোনটা রেখে দিয়ে হেমাঙ্গ ভি সি আর বন্ধ করল। ছবিটা আর দেখতে ইচ্ছে করল না। আগামী কাল তার দু-দুটো এনগেজমেন্ট আছে। খুব গুরুতর কিছু নয়। একটা পার্টি, আর তার আগে একজন অসুস্থ ক্লায়েন্টকে নার্সিং হোম-এ দেখতে যাওয়া। দুটোই কাটিয়ে দেওয়া যাবে।
মায়া জিনিসটা যে কী ভয়ংকর তা ঘুমোনোর আগে অনেকক্ষণ ভাবল হেমাঙ্গ। একথা নিশ্চিত যে সে বিয়ে করবে না। কিন্তু তার খুব ইচ্ছে হয়, পিন্টুর মতো নিষ্পাপ ও দেবদুর্লভ সৌন্দর্যের একটি ছেলে তার হোক। সে একবার চারুশীলাকে বলেছিল, পিন্টুকে দত্তক দিবি?
ইল্লি! দত্তক নিয়ে পাকাপাকি ব্যাচেলর থাকার ইচ্ছে? খুব তো স্বার্থপর দেখছি। বিয়ে করে নিজের ছেলের বাপ হ’ গে যা। পরের ছেলে নিয়ে টানাটানি কেন রে অলম্বুস?
অলম্বুস শব্দের মানে হেমাঙ্গ জানে না। জানার দরকারও নেই। হয়তো ওটার কোনও মানে নেইও। চারুশীলার নিজস্ব ডিকশনারি আছে, তাতে এরকম বিস্তর শব্দ থাকে এবং যেগুলোর কোনও মানেই হয় না।
কিন্তু মায়া জিনিসটা ভাল নয়। একদম ভাল নয়। মায়াও একধরনের পরাধীনতা, এক ধরনের স্বাধীনতার অভাব, মুক্তির প্রতিবন্ধক। বাচ্চাদের সে খুব ভালবাসে। এই ভালবাসাটাই কি একদিন তার কাল হবে?
পরদিন অফিসের পর হেমাঙ্গ যখন গাড়ি নিয়ে চারুশীলার বাড়িতে হাজির হল তখন আরও একটা মায়া তার জন্য অপেক্ষা করছিল। সে হল ওই প্রাইভেট টিউটরটি।
রোগা, গোবেচারা ছেলেটাকে দেখলেই বোঝা যায়, এর ভিতরে গভীর ও গোপন অসুখ রয়েছে। তবু যেন বাঁচার এক প্রাণপণ ইচ্ছে এর দুখানা আয়ত চক্ষুতে এসে বাসা বেঁধেছে। সেখানেই দুটি পিদিমের মতো জ্বলছে এর সবটুকু প্রাণশক্তি। অস্বস্তিতে, লজ্জায়, হীনম্মন্যতা ছেলেটা নুয়ে পড়েছে। কৃতজ্ঞতায় ছলছল করছে চোখ। কেননা তাকে এরা নিজেদের পয়সায় চিকিৎসা করাতে নিয়ে যাচ্ছে। তাও আবার গাড়িতে করে। এই বিরল সৌভাগ্যে তার যেন ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না।
কয়েক মিনিট কথা বলেই ছেলেটাকে ভারী ভাল লাগতে লাগল হেমাঙ্গর। গরিব, দীনভাবসম্পন্ন, নিরহংকারী লোকেরাই কি ঈশ্বরের চিহ্নিত মানুষ? কে জানে, হতেও পারে। এ ছেলেটার কাছে বসলে একটা ভাল অনুভূতি হয়। যেটা অধিকাংশ মানুষের সান্নিধ্যে হয় না।
সাজগোজ করতে চারুশীলা সময় নেয়। আজও নিল। তারপর যখন বন্ধু রিয়া আর ছেলে পিন্টুকে নিয়ে বেরিয়ে এল তখন ঘর একেবারে মাতোয়ারা হয়ে গেল নানা সুগন্ধে।
নাক কুঁচকে হেমাঙ্গ বলে, ইস। তোকে যে ডাক্তারখানায় ঢুকতেই দেবে না।
চারুশীলা ফোঁস করল, ইস! কেন দেবে না শুনি?
হোমিওপ্যাথি ওষুধ দারুণ সেনসিটিভ। উগ্র গন্ধে তাদের গুণ নষ্ট হয়ে যায়।
যাঃ, বাজে বকিস না।
রিয়া কিন্তু একটু অস্বস্তিতে পড়ে বলে, হ্যাঁ, আমিও কিন্তু ওরকম কথা শুনেছি। কী হবে এখন!
চারুশীলা ধমকের গলায় বলে, ওর কথায় নাচিস না তো। ওটা এক নম্বরের পাজি। লোককে ভড়কে দেওয়াই ওর হবি।
হেমাঙ্গ গম্ভীর থেকেই বলে, আজ তোর কপালে অপমান লেখাই আছে। কণাদ নিশ্চয়ই তোকে বের করে দেবে চেম্বার থেকে। বিদেশ থেকে গুচ্ছের সেন্ট আনিয়ে মাখছিস, তোর আক্কেল নেই? এত সেন্ট মাখলে অন্য সব গন্ধ পাবি কি করে? ফুলের গন্ধ, ফলের গন্ধ, খাবারের গন্ধ, শিশুর মুখের গন্ধ এসবই তো তোর অজানা থেকে যাবে!
চারুশীলা চোখ পাকিয়ে বলল, থামবি? আমাকে আর গন্ধ চেনাতে হবে না। যা একখানা শহরে বাস করি, মাগো, ডাস্টবিনের গন্ধ, পচা ইঁদুরের গন্ধ, ডিজেলের গন্ধ গা গুলিয়ে দেয়। উনি এসেছেন গন্ধ নিয়ে বক্তৃতা দিতে।
গাড়িতে সামনের সীটে হেমাঙ্গর পাশে চয়ন বসল, জানালার ধারে পিন্টু। পিছনে কলরবমুখর চারুশীলা আর রিয়া।
গাড়ি চালাতে চালাতে হেমাঙ্গ নিচু গলায় জিজেস করল, আপনার প্রবলেমটা কি? এপিলেপসি?
চয়ন মাথা নেড়ে বলে, না না। এপিলেপসি নয়।
তাহলে?
একটা অদ্ভুত ব্যাপার হয়। কুয়াশার মধ্যে একটা ট্রেন ঝিক ঝিক করতে করতে এগিয়ে আসে। তখন আমার বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলটা নড়তে থাকে। আর তারপর……
তারপর?
আমার আর কিছু মনে থাকে না।
ঝিরঝির করে বৃষ্টি নামল। ওয়াইপারটা চালু করে হেমাঙ্গ বলল, অজ্ঞান হয়ে যান?
হ্যাঁ। কিন্তু সেটা ফিটের অসুখ বলে আমার মনে হয় না। আমার বিশ্বাস, ওই ট্রেনের শব্দটা না হলে আমিও আর অজ্ঞান হবো না। কেন যে শব্দটা হয়! আপনি জানেন?
দুনিয়ার কতটুকুই বা আমরা জানি? বাড়ি থেকে আপনার কোনও চিকিৎসা হয়নি?
একটু দোনোমোনো করে চয়ন বলে, হয়েছে। লাভ হয়নি।
অ্যালোপ্যাথি না হোমিওপ্যাথি?
দু’রকমই। মাদুলি-টাদুলিও দেওয়া হয়েছিল।
কখনও ব্যায়াম বা আসন-টাসন করেছেন?
আমি পারি না। শরীরে দেয় না। আমি ভীষণ দুর্বল।
অনেক সময়ে আসন করলে সারে।
চয়ন বিনীতভাবে চুপ করে থাকে। বড্ড কাঁটা হয়ে বসে আছে। এয়ার কন্ডিশনার চলছে বলে কাচের গায়ে ভাপ জমে যাচ্ছে। বাইরে বৃষ্টির তোড় বাড়ছে।
বাড়িতে কে কে আছে?
চয়ন যেন একটু সচকিত হয়ে বলে, মা দাদা বউদি।
কে আর্নিং মেম্বার?
দাদা।
দাদা কোথায় চাকরি করে?
একটা ব্যাংকে।
বাবা নেই, না?
না। আমার দশ বছর বয়সে মারা যায়।
বাড়িটা কি নিজেদের?
আবার একটু দোনোমোনো করে চয়ন বলে, বাড়ি দাদার।
বুঝেছি।
পিছন থেকে চারুশীলা বলে, এই উদ্ভট, ঠাণ্ডা লাগছে, এয়ারকুলারটা বন্ধ করে দে।
দিচ্ছি। কিন্তু এতগুলো লোকের শ্বাসের দূষিত বায়ু বেরোবে কি করে? জানালা খোলা যাবে না, বৃষ্টি হচ্ছে।
তোর দিকের জানালা একটু ফাঁক করে রাখ, তাতেই হবে।
সেলফিস আর কাকে বলে!
হেমাঙ্গ এয়ারকন্ডিশনার বন্ধ করে নিজের দিকের জানালার কাচ একটু নামিয়ে দিয়ে বলল, ব্যাচেলরদের সবাই এক্সপ্লয়েট করে।
তুই আবার ব্যাচেলার কিসের? এক ফোঁটা তো বয়স। বিয়ের যুগ্যি আগে হ, তারপর ব্যাচেলর কপচাবি।
কাল তো তুই-ই একটা পাত্রীর খবর দিলি।
ওরকম দিদিরা করেই থাকে। বিয়ের কথায় বেসামাল হয়ে আবার গাড়ি কোথাও ভিড়িয়ে দিস না। এত ঝাঁকুনি লাগছে কেন?
কলকাতার রাস্তা তো আর আমার বানানো নয়।
দেখে চালা। যা বকবক করছিস তখন থেকে। গাড়ি চালানোর সময় অত কথা কিসের?
বকবক তুইও কি কিছু কম করছিস?
করছি বেশ করছি। আমি তো আর গাড়ি চালাচ্ছি না।
বেশী মেজাজ দেখাবি তো গাড়ি থামিয়ে নেমে কোথাও চলে যাবো।
আচ্ছা বাবা, বকবক করতে করতেই চালা। রিয়া জানতে চাইছে কণাদ চৌধুরী কি বিলেত-ফেরত?
হ্যাঁ। জার্মানি আর আমেরিকাতেও ছিল। বলে হেমাঙ্গ চয়নের দিকে তাকিয়ে বলল, বাঁ হাতটা অমন চেপে ধরে আছেন কেন? সামথিং রং?
ক্লিষ্ট মুখে ভয়াতুর চয়ন বলে, সেই রেলগাড়ির শব্দটা হচ্ছে। বড্ড কুয়াশা।
মাই গড!