১০. কাজু
ঘোষ বাইন্ডিং-এর সামনের কাঠের নড়বড়ে বেঞ্চটায় বসে রয়েছে ঝিকু। একমাথা কাঁচা-পাকা চুল। কালো-সাদায় জড়িয়ে যাওয়া গোঁফদাড়ি। চোখ দুটো হলদেটে। বেঞ্চটায় উবু হয়ে বসে এদিক-ওদিক দেখছে। রাস্তার উলটো দিক থেকে মানুষটাকে দেখল কাজু। সতু পাশে দাঁড়িয়ে বিড়ি কিনছে দোয়ারিদের দোকান থেকে। বিড়ি আর মৌরি লজেন্স। কাজু নেশা করে না কোনও। সতুকেও বকে এইসব বিড়ি-সিগারেট খায় বলে। কিন্তু সতু তো আর শোনার ছেলে নয়, বরং বিড়ি খেলে সমাজের কী উপকার হতে পারে, সেটা ওকে সবিস্তারে বলে দেয়। এও যে একটা কুটির শিল্প এবং এটাকেও যে বাঁচিয়ে রাখা মানুষের নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে, সেটা নানাভাবে ওকে বোঝানোর চেষ্টা করে।
কাজু মানতে চায় না। কিন্তু মনে মনে এটাও বোঝে, ও যেমন মানতে চাইছে না তেমন সতুও মানতে চাইছে না ওর কথা। আসলে জীবনে একটা সময়ের পরে কেউ কারও কথাই মানতে চায় না। ইগো, লজিকের চেয়ে বড় হয়ে যায়। আজকাল তাই আর কিছু বলে না সতুকে। কিন্তু সতু বোঝে। তাই বিড়ি-সিগারেট খাওয়ার সময় কাজুর সঙ্গে নরম করে কথা বলে।
কাজু তাকাল ঝিকুর দিকে। মানুষটা কেমন হয়ে গিয়েছে! ছোটবেলায় দেখত এই লোকটাই কী ফিটফাট হয়ে মিল-এ যাচ্ছে চাকরি করতে। কিন্তু তারপর যে কী হল!
কেউ বলে প্রেমে পড়ে ঝিকুর এমন অবস্থা হয়েছে। কেউ বলে ওর ভাইরা ওকে খাবারে ওষুধ মিশিয়ে পাগল করে দিয়েছে। কেউ আবার বলে, ও নাকি পরি দেখেছিল জোনাক-বাড়ির পেছনের গঙ্গায়!
যাই হোক না কেন, মানুষটা এমন একটা বাতিল অঙ্ক-খাতার মতো পড়ে আছে, দেখতে খুব খারাপ লাগে ওর। কষ্ট হয়। মনে হয় কিছু করে। কিন্তু কী করবে বুঝতে পারে না।
গতকাল পেখমকে দেখে হঠাৎ ঝিকুর কথা মনে পড়েছিল কাজুর।
পেখম এসেছিল হস্টেলের মাঠে। সোনাঝুরির এই দিকটা খুব সুন্দর। মিলের লোকজনের জন্য যেমন কিছু কোয়ার্টার্স আছে, তেমনই হস্টেলও রয়েছে। হস্টেলের পেছনেই খাবারের মেস। হৃষীকেশদা রান্না করে মেসে। দুপুরে আর রাতে বেশ ভিড় থাকে। কিন্তু বিকেলের দিকটায় হস্টেলের পেছনের মাঠটা খুব নির্জন আর শুনশান হয়ে থাকে।
ওদিকটায় বেশ কিছু সার দেওয়া পামগাছ আছে। আর আছে বট-অশ্বত্থের ভিড়। এদের ছায়ায় জায়গাটায় কেমন একটা একা-একা ভাব তৈরি হয়।
পেখমকে ও বলেছিল ওইখানে আসতে। পেখম খুব একটা বাড়ি থেকে বেরোয় না এখন। ওর মা সারাক্ষণ ওকে চোখে-চোখে রাখে। এমনকী পারলে, ওর সঙ্গে কলেজেও যায়!
সতু বলে, “তুই শালা সোনাঝুরিতে দেখা করিস কেন ওর সঙ্গে? কলকাতায় দেখা করতে পারিস না?”
কলকাতায় পেখমের সঙ্গে দেখা করে কাজু, কিন্তু সেটা খুব অল্প কয়েকবারই হয়েছে। আসলে নয়না থাকে পেখমের সঙ্গে। নয়না কলেজ না গেলে ওদের দেখা হয়। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, নয়না কেমন যেন পেখমের সঙ্গে সেঁটে থাকে, একটুও জায়গা দেয় না ওদের।
নয়নারা এখন নেই এখানে। পুরী বেড়াতে গিয়েছে। নয়নার জ্যাঠার একটা ফোটো স্টুডিয়ো আছে স্টেশনের কাছে। ওর জেঠতুতো দাদা সেটা চালায়। তার কাছ থেকেই জেনেছে যে, সাত দিনের জন্য বাবা-মায়ের সঙ্গে ঘুরতে গিয়েছে নয়না।
পেখম এসেছিল বিকেলের দিকে। একটা পামগাছের নীচে অপেক্ষা করছিল কাজু। নরম ঘাসের ওপর শুয়ে একটা বইয়ের পাতা উলটোচ্ছিল। তখনই শাড়ির খসখস শুনতে পেয়েছিল ও।
পেখম কোনও সেন্ট ব্যবহার করে না, কিন্তু তাও ও কাছে এলেই কাজু কী অদ্ভুত একটা নরম চন্দন মেশানো কর্পূরের গন্ধ পায়! কেন পায়? কোথা থেকে এই গন্ধ ভেসে আসে কে জানে!
আর শুধু কাছে এলেই নয়, ঘুম ভেঙে উঠে বসা মাঝরাতে, একাকী দুপুরের মনখারাপে বা ভোররাতের স্বপ্নের মধ্যেও এই অদ্ভুত নরম একটা গন্ধ জোনাকির মতো একা পিটপিট করে বুকের মাঝে! ওর অন্ধকার জীবনে কেমন অদ্ভুত সবুজ-হলুদ এক আলো জ্বালিয়ে দেয়! সেই আলোটুকুতেই যেন কাজু দেখতে পায় নিজেকে। ওর মনে হয় জোনাকির আলোর গন্ধ কি এমন চন্দন মেশানো কর্পূরের মতো হয়?
গতকাল ঘাসে শুয়ে বইয়ের দিকে চোখ থাকলেও সেই গন্ধটা আচমকা ভেসে এসেছিল বিকেলের রোদে। আর কাজু না তাকিয়েও বুঝতে পারছিল কে এসে দাঁড়িয়েছে মাথার কাছে।
লেবু-হলুদ শাড়ি আর ঘন সবুজ ব্লাউজ় পরেছিল পেখম। গায়ে পাতলা একটা চাদর জড়ানো।
উঠে বসেছিল কাজু। বইটা ভাঁজ করে ঢুকিয়ে রেখেছিল পাশের ঝোলায়। বুকের ভেতরে তিতির পাখি কাঁপছিল কাজুর! পেখমকে দেখলেই এমন একটা কাঁপন টের পায় ও।
পেখম বসেছিল ঘাসে। শীতের মফস্সলে বিকেল নামছিল ধীরে। আকাশ বেয়ে গড়িয়ে পড়া সূর্য দিগন্তের দিকে যেতে-যেতে আরও কমলা হয়ে উঠছিল যেন। আর হাওয়া আসছিল। শেষ শীতের দিক থেকে বসন্তের দিকে যেতে-যেতে হাওয়া সোনাঝুরি ছুঁয়ে যাচ্ছিল একটু-একটু করে। কাজুর মনে হচ্ছিল এই বিকেলটা যেন সারা জীবন ধরে চলে।
“বলো!” পেখমের স্বরে অজস্র প্রজাপতি ছড়িয়ে গিয়েছিল সোনাঝুরির হাওয়ায়।
কাজু তাকিয়ে ছিল সেই সব প্রজাপতির দিকে। কথা বলতে পারছিল না একটুও। মনে হচ্ছিল ওর গলার আওয়াজ পেলেই সব প্রজাপতি মিলিয়ে যাবে নিমেষে।
“আরে! খালি তাকিয়ে থাকে!” পেখম সামান্য লজ্জা পেয়ে আলতো করে চিমটি কেটেছিল কাজুর হাতে।
কাজু হেসেছিল। কথা, শব্দ, বাক্য মাঝে মাঝে অর্থহীন হয়ে যায়। মাঝে মাঝে দৃষ্টিপাতের চেয়ে সহজ কথোপকথন আর কিছু হয় না।
“আচ্ছা, আমি তবে আসি,” সামান্য বিরক্ত হয়ে পেখম উঠে যাচ্ছিল।
এবার ওর হাতটা ধরেছিল কাজু। বলেছিল, “ছটফট করছ কেন?”
পেখম বলেছিল, “মা রাগ করছিল খুব। বলছিল, কোথায় যাচ্ছি? কলেজ নেই কিছু নেই, তাও কেন বেরোচ্ছি। জানোই তো! আর তুমি তো কাল আসতেই বাড়িতে। কেন আজ ডাকলে?”
কাজু হেসেছিল সামান্য। তারপর বলেছিল, “আচ্ছা, এমনি ডাকা যায় না?”
পেখম মাথা নিচু করে নিয়েছিল। বলেছিল, “যায় তো। কিন্তু মা… মা খুব রাগ করে… আমার ভয় করে, যদি তোমায় আর আমাদের বাড়ি যেতে না দেয়! তাই আমি সাবধানে থাকি। আমার ইচ্ছে-টিচ্ছেয় তো মা তেমন আমল দেয় না কখনও!”
কাজু মাথা নামিয়ে নিয়েছিল। ওই মাথা নিচু করে মৃদুস্বরে বলে যাওয়া পেখমের কথাগুলো আসলে কথা নয়! এসব ধ্বনি আসলে প্রজাপতিদের জন্ম দেয়!
কাজুর এমনি পেখমকে দেখতে ইচ্ছে করছিল বলে ও বিজনকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছিল। ও জানে পেখমের বাড়িতে এসব অসুবিধে আছে। কিন্তু তাও আজ এমন একটা কষ্ট হচ্ছিল যে, ইচ্ছে করছিল এই নির্জনে দেখা করতে।
পেখম আবার বলেছিল, “ঠিক আছে দেখা তো হল, এবার আমি আসি?”
কাজু হেসেছিল, “কেন? আর-একটু বোসো। আশপাশে কে আছে যে, দেখে ফেলবে?”
“মিল ছুটি হলেই কাতারে-কাতারে লোক বেরিয়ে আসবে। তখন? মিল ছুটির সময় হয়ে গেল তো!”
কাজু হেসে বলেছিল, “দেখলে কী হবে? বাড়িতে বলে দেবে?”
পেখম নামিয়ে নিয়েছিল মাথা। বলেছিল, “গতকালও মা খুব অশান্তি করেছে। ছোটকাকিমার বাপের বাড়ি জামশেদপুর। সেখান থেকে কে যেন একটা সম্বন্ধ নিয়ে এসেছে। ছেলে ডাক্তার। আমি ‘না’ বলেছি বলে মা গতকাল খুব রাগ করছিল। আমার আজ বাইরে থাকাটা মা ভাল মনে নেবে না। তাই বলছি দেখা তো হল… আর কী-ই বা এত দেখো! এলাম তো! কী হল এতে!”
কাজু তাকিয়েছিল পেখমের দিকে। বুকের ভেতর অসংখ্য তিতির এসে ডানা ঝাপটাচ্ছিল! ওই মুখ নিচু করে বসে থাকা পেখম। ওই ছোট্ট গোলাপি পাপড়ির মতো ঠোঁট! কমলা আলো লেগে সামান্য রাঙা হয়ে ওঠা গাল কোথায় যেন মেরে ফেলছিল ওকে! প্রেম এমন নিঃশব্দে এসে মেরে ফেলে যে, মানুষ নিজেও বুঝতে পারে না কখন সে আর নেই!
“কী দেখি? কেন পাগল হই? কী হল এতে?” কাজু হাসল। চোখ বন্ধ করল খানিক তারপর বলল:
“Come to the orchard in Spring.
There is light and wine, and sweethearts
in the pomegranate flowers.
If you do not come, these do not matter.
If you do come, these do not matter.”
পেখম কিছু না বলে শুধু ছলছলে চোখ নামিয়ে নিয়েছিল। আর দূরে বসেও সেই কর্পূর-চন্দনের গন্ধটা আবার পেয়েছিল কাজু!
পেখম আর-একটু সময় বসেছিল। তবে কথা বলেনি একবারও। শুধু কমলা বিকেল গাঢ় হয়ে উঠছিল পেখমকে নিজের কাছে পেয়ে।
একসময় পেখম উঠে চলে গিয়েছিল নিঃশব্দে। কিন্তু আসলে নিঃশব্দে নয়। যাওয়ার আগে পেখম একবার চোখ তুলে তাকিয়েছিল কাজুর দিকে। আর কাজু আবার স্পর্শ পেয়েছিল। শব্দের অতীত এক স্পর্শ! হাজার-হাজার বছর ধরে যা গ্রন্থিবিহীনভাবে বেঁধে রেখেছে প্রেম-বদ্ধ নারী-পুরুষকে!
কাজু ঘাসে মোড়া মাটিতে বসে দেখছিল পেখম চলে যাচ্ছে। লাল-সাদা কোয়ার্টার্সের ফাঁক দিয়ে মাথা নিচু করে ওই চলে যাচ্ছে পেখম। বিকেলের আলো আকাশ থেকে চুঁইয়ে নেমে আসছে আর যেন ক্রমশ সেই আলোর মধ্যে মিশে যাচ্ছে ও!
আর তিতির উড়ছিল! বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে সারা মফস্সল জুড়ে তিতির উড়ছিল যেন! কাজু বুঝতে পারছিল, এই মেয়েটি ছাড়া ওর জীবনের আর কোনও অর্থ নেই। ভাবছিল পেখম যদি চলে যায়, তা হলে কি ওকেও ওরকম ঝিকুদার মতো রাস্তার পাশে বসে সব কিছুর এককথায় উত্তর দিতে হবে? বলতে হবে, “বিলকিস!”
“কী রে কী দেখছিস? ঝিকুদা বৈজয়ন্তীমালা নাকি?”
সতুর কথায় মুখ ফিরিয়ে তাকাল কাজু। বিড়িটা দু’আঙুলে ধরে মুখ তুলে ধোঁয়া ছাড়ল ও। তারপর হাত বাড়িয়ে বলল, “এই নে তোর মৌরি লজেন।”
মৌরি লজেন্স হাতে নিয়ে হাসল কাজু। বলল, “মানুষটাকে দেখলে আমার খুব কষ্ট হয় জানিস সতু। ভেবে দেখ, লোকটার কেউ নেই! কোথাও যাওয়ার নেই, ওর কোথাও থেকে ফেরার নেই। কেউ আসবে না ওর কাছে। ও যে কারও কাছে যাবে, তেমন কেউ নেই! সারা জীবন এই স্টেশন রোড, সোনাঝুরির বড় রাস্তা, গঙ্গার পাশের চৌধুরীদের পোড়োবাড়ির মধ্যে বসে থেকে থেকে সব শেষ হয়ে যাবে ওর!”
“শালা,” সতু ছিক করে থুতু ফেলল। তারপর বলল, “আলট্রা-ন্যাকা হয়ে যাচ্ছিস দিন-কে-দিন! শালা, তোদের এই যে লাউগাছের মতো ন্যাতপেতে মন, এটা এই যুদ্ধের বাজারে মেনটেন করিস কী করে?”
“বা রে, লোকটাকে দেখে কষ্ট হবে না?” অবাক হল কাজু।
“ওর তো বোধ নেই! খিদে পেলে খায়, হাগু পেলে হাগে, ঘুম পেলে ঘুমোয়। যে-কোনও প্রাণীর মতো হয়ে গিয়েছে! কিন্তু যেসব মানুষ সব বোধ নিয়েও দিনের পর দিন কষ্ট করছে, নিজের বাচ্চাদের মুখে ভাত তুলে দিতে পারছে না, তাদের কথা ভাব। জোতদার, দালাল, পুঁজির পুঁজ জমে যাওয়া, হাতে গোনা কিছু মানুষ, যাদের জন্য সৎ, গরিব মানুষগুলো সারা জীবন সার্ফদের মতো অত্যাচারিত হয়ে গেল, তাদের কথা ভেবে তোর মনখারাপ হয় না?” সতু স্ট্রিট কর্নার করার ঢঙে বলল, “আমি তো গিয়েছিলাম উত্তরবঙ্গে। দেখে এলাম! ওদিকে ভিয়েতনামে যে-রেজ়িস্ট্যান্স চলছে, তেমন একটা যদি এখানে আমরা গড়ে তুলতে পারি, শালাদের মুতিয়ে ছেড়ে দেব! তোর ওই ন্যাকা প্রেম আর পাগলদের দেখে আহা-উহু-ই শালা বাঙালিদের শেষ করে দিল!”
কাজু কিছু বলতে গিয়েছিল, কিন্তু পারল না। বিজন আর পরিতোষ সাইকেল করে এসে থামল ওদের সামনে।
বিজন বলল, “আরে, তোমরা এখানে কী করছ? বিমলদা তোমাদের জন্য ওয়েট করছে তো!”
কাজু, বিজনের সাইকেলের সামনে বসা ছেলেটাকে দেখল। পরিতোষ। প্রায় বিজনের মতোই বয়স। ভাল ছেলে! ক্লাসে ফার্স্ট হয়। সোনাঝুরিতে ওর নাম আছে। কিন্তু বিজনের সঙ্গে ছেলেটা ঘুরছে কেন? বিজনটা নিজে লেখাপড়া করে না। এই বয়স থেকেই খালি পার্টি আর পার্টি! সেখানে পরিতোষের মতো ছেলেরা কেন ঘুরবে ওদের সঙ্গে?
কাজু এই ছেলেটার সঙ্গে কথা বলে না। কিন্তু আজ এত বিরক্ত লাগল যে বলল, “পরিতোষ, তুই কী করছিস বিজনের সঙ্গে?”
পরিতোষ ছেলেটা একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল! আসলে সোনাঝুরিতে কাজুর খুব নামডাক। সেখানে সেই মানুষটা এমন করে ওর সঙ্গে নিজে থেকে কথা বলছে বলেই বোধহয় কিছুটা ঘাবড়ে গেল।
পরিতোষ বলল, “না, মানে… ইয়ে…”
“আরে, আমি বলছি,” বিজন বলল, “আমি ওকে বলেছি আমার সঙ্গে বিমলদার কাছে যেতে। সারাক্ষণ বই মুখে বসে থাকে! আরে বাবা দেশে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার কি কম আছে? যা কম আছে, তা হল প্রকৃত মানুষ। সেটা হতে হবে না? আমি ওকে বলেছি ট্রটস্কি পড়তে! গোর্কি পড়তে! তুমি বলো কাজুদা, গোর্কি গ্রেটেস্ট রাশিয়ান নভেলিস্ট না? ওর সমান আর কেউ আছে?”
কাজুর মনে হল, বিজনের কানটা পেঁচিয়ে ধরে। এত বাড়তি কথা বলে ছেলেটা! আর পরিতোষের সামনে জ্ঞান ফলাচ্ছে!
কাজু বলল, “আলেকজান্দার পুশকিন কি বানের জলে ভেসে এসেছে?”
“পুশ…” ঘাবড়ে গেল বিজন। পরিতোষের সামনে বিদ্যে জাহির করছিল ভালই, কিন্তু এই নামটা আর কমন পড়েনি!
কাজু বলেছিল, “ওকে মডার্ন রাশিয়ান লিটারেচারের জনক বলা হয়। কেন বলা হয় বড় হয়ে পড়বি। বুঝলি?”
পরিতোষ বলল, “পুশকিন! অদ্ভুত নাম তো!”
বিজন চোখ ঘুরিয়ে বলল, “নে পরিতোষ, তোর নামের খাতায় লিখে রাখ নামটা। পরে বাচ্চা হলে নাম রাখিস! হুঁ! পুশকিন! বিমলদা বলেছে, গোর্কি বেস্ট!”
সতু বলল, “শালা, মারব কানের গোড়ায়। ডেঁপোমি সব সময়।”
বিজন বলল, “সে মেরো পরে। আগে চলো চক্রবর্তীর চায়ের দোকানে। বিমলদা অপেক্ষা করছে।”
রাস্তার পাশের চায়ের দোকানটা বেশ বড়। চক্রবর্তীকাকু আর কাকুর দুই ছেলে সারাদিন চা, ডিম টোস্ট, ভেজিটেবল চপ, ঘুঘনি, এসব বানিয়ে যায়। সোনাঝুরির কফি হাউস এই দোকানটা।
বিমলদাকে যদি কেউ পার্টি অফিসে না পায়, তা হলে এই দোকানটাতে পাবেই। বিমলদা মানুষটা বিয়ে করেনি। সারাক্ষণ পার্টির কাজে ঘোরে। একটা কাপড়ের ঝোলা সারাক্ষণ কাঁধে থাকে। তাতে রেড বুক থেকে সহজ হোমিওপ্যাথি শিক্ষা, সব থাকে! ঝোলাটা সব সময় হরিণ গিলে ফেলা অজগরের মতো ফুলে থাকে! সোনাঝুরির সবাই জানে বিমলদার মতো সন্ন্যাসী হয় না। কিন্তু কাছের লোকজন জানে বিমলদা কতটা বদমেজাজি মানুষ। কখন যে রেগে যাবে, কেউ জানে না।
এখন তেমনই কাজুদের দেখেই মানুষটা রেগে গেল। হাতের আধখাওয়া চায়ের গেলাসটা এমন ঠক করে টেবিলে রাখল যে, বাকি চা-টা চলকে পড়ে গেল টেবিলে!
কাজু একটু ঘাবড়ে গেল।
বিমল স্থান-কাল-পাত্র ভুলে চিৎকার করে উঠল, “শুয়ার, তুই হিরো হয়েছিস? তোকে বলেছি না, যে যাবি না গোপেনের কাছে। সেখানে গিয়েছিলি কেন তুই?”
কাজু থমকে গেল! দেখল সতুও ওর দিকে কেমন একটা চোখে তাকিয়ে রয়েছে!
কাজু সময় নিল একটু। এখানে মাথাগরম করলে বা ঘাবড়ে গেলে হবে না।
ও বলল, “আমি তো এমনি-এমনি যাইনি বিমলদা। আপনি বলেছেন যে, আপনি জুটমিলের ওই কাজের ঝামেলার ব্যাপারে কিছু করতে পারবেন না। মালিক যদি মিল লকআউট করে দেয়, তারপর আপনি আন্দোলনে যাবেন। কিন্তু লক আউট করে দেওয়ার পর আর কতদিন খালি পেটে ওয়ার্কাররা আন্দোলন করবে? কতবার আর ওদের ওপর দিয়ে আমরা আমাদের পার্টির মাহাত্ম্য বোঝাব? আমি চাই শ্রমিকদের যাতে সুরাহা হয়। গোপেনদা যদি মালিককে বুঝিয়ে শ্রমিকদের ইনসেনটিভটা দেখে বা অন্তত কাজের কোথায় প্রবলেম হচ্ছে, কোথায় প্রোডাকশন মার খাচ্ছে, সেটা নিয়ে যদি শ্রমিকদের সঙ্গে বসে একবার! তাই… এ ছাড়া গোপেনদার সঙ্গে তো দেখা হয়নি আমার। তা হলে? এত রাগ করার কী আছে! পার্টি করছি তো মানুষের হকটা তাদের দেওয়ার জন্য। সেটা যদি দেওয়া যায় সেটাই তো আসল!”
“গান্ডু তুই? নাকি গোপেনের এজেন্ট?” বিমলদা দাঁতে দাঁত ঘষল, “এটা বুঝিস না যে, প্রবলেমটা যদি গোপেন সলভ করে দেয়, তা হলে আমাদের পার্টির কী হাল হবে? মাসকয়েক বাদে মজদুর ইউনিয়নের ভোট। আর কেউ আমাদের ভোট দেবে? আর গোপেনের সঙ্গে মালিকের ভালই আঁতাত আছে। ওরা যদি ইউনিয়নের দখল নেয়, তা হলে কী ভেবেছিস, শ্রমিকদের খুব সুরাহা হবে? ছাগল তুই? এমন দাড়ি রেখে কলির কেষ্ট সেজে ঘুরে কচি মেয়েদের মাথা আর বুক খেয়ে বেড়াচ্ছিস বেড়া, আমাদের পার্টির পেছনে কাঠি করতে এলে কিন্তু মেরে রেখে দেব একদম!”
“মানে?” কাজুর মাথায় আচমকা রক্ত চলকে উঠল, “কী বলছেন এসব? এমন নোংরা কথা বলছেন কেন?”
কাজু দেখল বিমলদার চিৎকারে আশপাশের টেবল থেকে সবাই ঘুরে তাকাচ্ছে! কী লজ্জার ব্যাপার!
“বেশ করেছি, বলেছি!” বিমলদা চেঁচাল, “খুব র্যালা নিয়ে ঘোরা হচ্ছে, না? রক্ত দিয়ে এই পার্টিকে সোনাঝুরিতে এই জায়গায় নিয়ে এসেছি আমি। তুমি হিরো সাজবে বলে সেটাকে আমি নষ্ট করব ভেবেছ? নাকি আমায় ল্যাং মেরে নিজে আমার জায়গাটা নিবি? কী ভেবেছিস, এই সব কেতাবি ঢ্যামনামি করে লোকের সামনে ভাল হবি? নেতা হবি? শালা, পাছায় লাথ মেরে তোকে বের করে দেব পার্টি থেকে!”
কাজু চোয়াল শক্ত করে বলল, “ইতরের মতো কথা বলবেন না। পার্টি কারও সম্পত্তি নয়। মানুষের যাতে ভাল হয় আমি সেটাই করব। তাতে পার্টির হাইকম্যান্ড আমায় কিছু বললে তাদের উত্তর আমি দেব। আপনার খেউড়কে আমি পাত্তা দিচ্ছি না।”
বিমলদা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “শালা, খুব তেল হয়েছে, না? বিপ্লবী হবে? যদি আর-একবার তুই গোপেনের কাছে গিয়েছিস তো পার্টি থেকে তোকে লাথ মেরে বের করে দেব হারামজাদা!”
কাজু চোয়াল শক্ত করে একবার বিমলদাকে দেখল, আর-একবার তাকাল সতুর দিকে। দেখল, সতু মাথা নিচু করে একপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
কাজু আর না-দাঁড়িয়ে বেরিয়ে এল দোকান থেকে। দোকানের বাইরে সাইকেল নিয়ে থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিজন। পরিতোষ নেই। নিশ্চয় চলে গিয়েছে।
কাজুর মাথা দিয়ে মনে হল আগুন বেরোচ্ছে! আরে, ও কি আর সাধ করে গিয়েছিল নাকি গোপেনদার কাছে?
এই বিমলদাই তো বলেছিল, “এখন এসব করা যাবে না। আমরা আবেদন-নিবেদন করতে যাব কেন? আমরা আন্দোলন করব। কেন শুধু-শুধু মালিকের জুতো চাটতে যাব? দিক না বন্ধ করে মিল! আন্দোলনের জোর আমরা দেখিয়ে দেব। মালিকের কাছে গিয়ে মাথা নত আমি করতে পারব না।”
‘আমি’! এই আমিটাতেই আপত্তি কাজুর। যেখানে মানুষের হয়ে কাজ করার কথা সেখানে ‘আমি’ আসবে কেন? এত ইগো কীসের? কীসের এত অহং?
কাজু চোয়াল শক্ত করল। গোপেনদা কিছুদিনের জন্য দিল্লি গিয়েছে। সেখান থেকে ফিরলে ও আবার যাবে। এতজন শ্রমিকের রুজির ব্যাপার! সেখানে সামনের ইউনিয়নের ভোটে কে কী সুবিধে নেবে, সেটা পরে দেখা যাবে। আর বিমলদা যদি ওকে পার্টি থেকে বের করার ষড়যন্ত্র করে, তবে ও নিজেই পার্টি থেকে বেরিয়ে যাবে। মানুষের হয়ে কাজ করতে কোনও পার্টি না হলেও ওর চলবে!
“কাজু, কাজু! এই কাজু…” আচমকা একটা ডাকে ও দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর মুখ তুলে দেখল কাকিমা! মানে পেখমের মা! কেন কে জানে কাজুর শিরদাঁড়া দিয়ে হিমস্রোত বয়ে গেল! কাকিমা তো এভাবে ওকে কখনও রাস্তায় ডাকে না! তা হলে!
কাকিমা কাছে এসে বলল, “কী হল? এতবার ডাকছি, শুনছ না যে বড়!”
“ডাকছেন?” কাজু কী বলবে বুঝতে পারল না। আসলে মাথা এমন গুলিয়ে আছে যে… ও খুব অন্যমনস্ক ছিল। তাই শুনতে পায়নি।
“হ্যাঁ,” কাকিমার গলাটা বেশ গম্ভীর!
কাজু এবার ভাল করে দেখল। কাকিমার হাতে একটা ঠোঙা। কাকিমা তো সচরাচর বাজারে বেরোন না!
“কিছু বলবেন?” কাজু নিজের গলাটা যথাসাধ্য নরম করার চেষ্টা করল।
কাকিমা কোনওরকম ভণিতা না করে বলল, “তুমি হস্টেলের পেছনের মাঠে পেখমকে ডেকে পাঠিয়েছিলে?”
কাজু ঘাবড়ে গেল। এটা কী হল? কাকিমা এটা জানল কী করে?
কাকিমা বলল, “তুমি এটা ঘোরতর অন্যায় করেছ। কিছুদিন আগে আমি বাড়ি ছিলাম না, তুমি পেখমের সঙ্গে লোডশেডিং-এ আমাদের ছাদে গিয়ে বসেছিলে। এতটা বাড়াবাড়ি না করলেই কি নয়? আমাদের সমাজ আর তোমাদের সমাজ এক নয়। এটা বোঝো না?”
কাজু কী বলবে ভেবে পেল না। ও তাকিয়ে রইল শুধু।
কাকিমা বলল, “আমার মেয়ে, তাই আমাকেই তার ভালমন্দ দেখতে হবে। ভাল বিয়ের সম্বন্ধ আসছে ওর। আমি চাই না ওর বদনাম হোক। তুমি আর আমাদের বাড়িতে এসো না। পেখমের সঙ্গে আর বন্ধুত্ব রেখো না। বুঝলে? এই আমি বলে দিলাম। আশা করি ভদ্রলোকের ছেলে তুমি, আমার কথা রাখবে!”
বন্দুকের গুলির মতো কথাগুলো ছুড়ে দিয়ে কাকিমা চলে গেলেও কাজু নড়তে পারল না। দুপুরের মফস্সল ওর সামনে টলমল করতে লাগল। মাথার ওপরের আকাশটা যেন একবাটি গরম ডালের মতো ফুটছে! শীতের শহরতলি থেকে শিরশিরে হাওয়া যেন তার চাদর গুটিয়ে নিয়েছে ক্রমশ! যেন আর কিছু নেই চারপাশে! শুধু একখণ্ড নির্জন মৃত নগরের পথে দাঁড়িয়ে রয়েছে কাজু! পেখমের সামনে ও আর যাবে না? পেখমের বিয়ে হয়ে যাবে? ও অন্য কারও হয়ে যাবে? এও সম্ভব! পেখম আছে বলেই তো ওর এই চারপাশের দম বন্ধ করা পৃথিবীটা তুচ্ছ! আর পেখম না থাকলে তো সবকিছুই তুচ্ছ হয়ে যাবে!
কাজু এদিক-ওদিক তাকাল। কাউকেই যেন ঠিক চিনতে পারছে না ও। শুধু লোকজনের ভেতর থেকে ওর দিকে এগিয়ে আসা ঝিকুদাকে চিনতে পারল।
ঝিকুদা মাথা নাড়তে-নাড়তে কাজুর পাশ দিয়ে যেতে-যেতে ওর দিকে তাকাল একবার। তারপর ফিক করে একটু হেসে দিয়ে বলল, “বিলকিস! সব শালা বিলকিস!”
.
১১. নোঈ
বেসিনের কলটা খুলে চোখেমুখে ভাল করে জল দিল নোঈ। মাথাটা ঝাঁ-ঝাঁ করছে! এভাবে যে জয়ের সামনে পড়ে যাবে, ভাবতে পারেনি ও। জীবনে যা চায় না সেটাই কেন এসে পড়ে ওর সামনে? মনেপ্রাণে তো চেয়েছিল যে, জয়ের সামনে যেন ওকে পড়তে না হয় আর কোনওদিন! কিন্তু ঠিক সেটাই হল! জয় যে এই অফিসেই চাকরি করছে, সেটা তো আর জানত না ও। জয় বলেনি। কিন্তু সেভাবে দেখতে হলে জয় কিছুই বলেনি ওকে। কোনওদিনই কিছু বলেনি। নোঈই যা খবর নেওয়ার নিয়েছে। যা উতলা হওয়ার হয়েছে। কষ্ট পাওয়ার পেয়েছে। জয় সেসব খুব একটা পাত্তা দেয়নি। সেই কলেজের ফার্স্ট ইয়ার থেকেই এমন। জয় যে কী চায়, কাকে চায়, সেটা জয় নিজেই জানে না। কলেজে পড়ার সময়ে ওর চেয়ে চার বছরের বড় এক মহিলার সঙ্গে জয়ের সম্পর্ক ছিল, কিন্তু সেটাও সেকেন্ড ইয়ারে ওঠার আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। তারপর থেকে জয় আর কারও সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেনি। বা করলেও সেটা জানতে পারেনি নোঈ।
কলেজের প্রথম দিন থেকে নোঈর ভাল লাগত জয়কে। মানে কিছু-কিছু জিনিস হয় না, মানুষ বোঝে যে এতে বিপদ বাড়বে কিন্তু তাও এড়াতে পারে না? এটাও সেরকমই ছিল। অনেকটা মাধ্যাকর্ষণ বলের মতো। কিন্তু দীর্ঘদিন সেটা জয়কে জানতে দেয়নি ও। শুধু সংগ্রহ করে গিয়েছে। জয়ের দেওয়া লজেন্সের র্যাপার, জ়েরক্সের বিল, ফেরত নিতে ভুলে যাওয়া ক্ষয়ে যাওয়া উড পেন্সিল, রাবার ব্যান্ড, বাসের টিকিট, খাতার লেখার লুজ় পৃষ্ঠা, আরও কত কী! ওই যে দশ টাকার নোট! ওটাও তো জয়েরই দেওয়া।
কিন্তু সেসব পেছনে ফেলে এবার এগিয়ে যেতে চায় নোঈ। নতুন করে দাঁড়াতে চায় জীবনে! কিন্তু পারছে কই? এখানে জয়ের সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়াটা কি খুব জরুরি ছিল?
আয়নায় নিজের দিকে তাকাল নোঈ। ফরসা মুখটা লাল হয়ে গিয়েছে! কপালে অনুস্বর-এর মতো করে আঁকা টিপটা জলের ঝাপটায় মুছে গিয়েছে কিছুটা। চোখদুটোও লাল হয়েছে বেশ! নোঈ বুঝতে পারছে শরীর বেয়ে একটা কান্না উঠে আসার চেষ্টা করছে!
নোঈর মনে হয় কান্না যেন কোনও পর্বতারোহী। শরীরের অদৃশ্য কোটর থেকে তুষার-কুড়ুল, কাঁটাওয়ালা জুতো শরীরে গেঁথে উঠে আসে চোখের কাছে। এই বেসিনের সামনে দাঁড়িয়েও নোঈ বুঝতে পারল অদৃশ্য কোটর থেকে বেরিয়ে আসছে সেই মানুষটি। নিজের শরীরে তার কাঁটাওয়ালা জুতো, বরফের কুড়ুলের আঘাত বুঝতে পারল।
নোঈ চোয়াল শক্ত করে নিজেকে সংযত করল। না, এখানে আর কান্নাকাটি করা যাবে না। খুব বাজে একটা ব্যাপার হয়ে যাবে।
ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে নিজের মুখটা ভাল করে মুছল নোঈ। পাশে রাখা চশমাটা পরল। তারপর পেছন ফিরে বেরিয়ে এল লু থেকে।
পার্ক স্ট্রিটের এই অফিসটা বিজ্ঞাপনের। ওদের কোম্পানির কিছু বিজ্ঞাপনের কাজ এই প্রোমোট নামে কোম্পানিটিকে দেওয়া হয়েছে! সোদপুরের কাছে একটি আর বারাসতের কাছে দুটি, মোট তিনটে হাউজ়িং প্রোজেক্টের কাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু শুধু বাড়িঘর তৈরি করলেই তো হবে না, তার সঙ্গে বিজ্ঞাপন দেওয়াটাও গুরুত্বপূর্ণ!
অফিসে আপন এই কাজটা দেখছে। নোঈকে আপনই পাঠিয়েছে এখানে। আসলে প্রোমোট-এর লোকজন বলেছিল, ওরাই গিয়ে দিয়ে আসবে কিছু পেপার। কিন্তু আপন বারণ করেছে। বলেছে ওদের অফিস থেকেই লোক যাবে।
নোঈকে আপন বলেছিল, “তুমি পেপারগুলো নিয়ে আসবে। সঙ্গে ওদের মার্কেটিং-এ যে-ছেলেটা আছে, তাকে বলবে আমার সঙ্গে দেখা করতে। ওটা কিন্তু ইমপর্ট্যান্ট। কাজ নেওয়ার সময় এসে ‘স্যার’, ‘স্যার’ করছিল, এখন একে-ওকে পাঠিয়ে পাশ কাটানোর ধান্দা। বলবে আপ্রুভালটা আমি দেব। ওই ছেলেটি যেন এসে আমার সঙ্গে দেখা করে যায়।”
তখন তো আর নোঈ বুঝতে পারেনি এই মার্কেটিং-এর ছেলেটি আর কেউ নয়, জয়! নোঈ দেখেছে ও যা এড়িয়ে যেতে চায়, তাই এসে আছড়ে পড়ে ওর জীবনে। এই যে চাকরিটা, সেটাও কি আর ও চেয়েছিল! বরং ডিনোদের সঙ্গে আর যাতে দেখা না হয় সেটাই চেয়েছিল। বা আরও স্পষ্ট করে বলা ভাল, পুশকিনের সঙ্গে যাতে দেখা না হয় সেটাই চেয়েছিল। কেন কে জানে, পুশকিনকে দেখলেই কেমন একটা নাগরদোলা থেকে পড়ে যাওয়ার মতো ফিলিং হয় নোঈর! কেন এমন হয়, কে জানে! আর সত্যি বলতে কী, কারণটা নিয়ে নিজেকে বেশি খোঁচাখুচি করতে চায় না নোঈ। মোদ্দা কথা পুশকিনের মুখোমুখি আর যেন না হতে হয়, সেটাই মনেপ্রাণে চেয়ে এসেছিল। তাই সেদিন আইকা কথাটা বলার পরে নোঈ থমকে গিয়েছিল একদম। কিছুক্ষণ কথাই বলতে পারেনি। শুধু অবাক হয়ে ভাবছিল, আবার সেই কাণ্ডটাই ঘটল!
মা আপত্তি জানিয়েছিল এই কাজের ব্যাপারে। সব ব্যাপারেই মায়ের নিজস্ব লজিক থাকে। এই ব্যাপারেও আছে। আইকা বোঝানোর চেষ্টা করছিল মাকে যে, জীবনে এসব ভাবলে বা দেখলে চলে না। কিন্তু মা কিছুতেই মানছিল না। আর নোঈ সেই তর্কের ফাঁকে নিজে সময় নিচ্ছিল। নিজেকে প্রস্তুত করছিল। নিজেকে বোঝাচ্ছিল যে, সব কিছু থেকে জীবনে পালানো যায় না। ও যত পালাতে চাইবে তত সমস্ত অপ্রিয়, অস্বস্তিকর জিনিস আরও বেশি করে ছুটে আসবে ওর কাছে।
তাই শেষে নিজেই বলেছিল, সিভিটা দেবে।
পরের দিন সকালে ই মেলে সিভি পাঠিয়ে কেমন একটা অদ্ভুত লাগছিল ওর। কেবলই মনে হচ্ছিল কাজটা হয়ে যাবে। পুশকিনের মুখটা মনে পড়ছিল। ওই এলোমেলো করে তাকিয়ে থাকা। চশমার ওপারের চোখ। ওই মাথা নামিয়ে সামান্য হাসি। তা ছাড়া ওর দিকে পুশকিনের তাকানোর মধ্যে একটা কেমন যেন ব্যাপার আছে। না, কোনও খারাপ কিছু নয়, কিন্তু কিছু আছে একটা। তাই তো ওই চোখের দিকে তাকালে নোঈর মনে হয় প্রচণ্ড বেগে ঘুরতে থাকা নাগরদোলা থেকে ছিটকে পড়ছে ও!
ডাকটা এসেছিল তার চারদিনের মাথায়। ছোট্ট এক লাইনের একটা ই মেল। ওর ইন্টারভিউয়ের তারিখ আর সময় জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল ই মেল-এ।
মা তো প্রথম থেকেই গজগজ করছিল, কিন্তু তাও মনে একটু আশা ছিল যে, নোঈকে হয়তো ইন্টারভিউয়ে ডাকবে না। কিন্তু ওই ই মেলটা আসার পরে মা যেন খেপে উঠেছিল একদম।
সারাদিন নোঈকে বুঝিয়ে সফল না হয়ে রাতে খাওয়ার টেবিলে বসে বাবাকে নিয়ে পড়েছিল।
বাবা শুধু জিজ্ঞেস করেছিল, “ইন্টারভিউয়ে গাড়ি নিয়ে যাবি কি? না ক্যাব ডেকে নিবি? অত দূর!”
মা ভাত দিচ্ছিল। বাবার এই একটা কথাতেই মা হাত থেকে ভাতের হাতাটা শব্দ করে টেবলে রেখে বলেছিল, “নাও, আরও মাথা খাও মেয়ের! এত আহ্লাদ করার কী আছে মেয়েকে? আদর দিয়ে তো মাথায় তুলে ফেলেছ! দেশে কি আর কোম্পানি নেই? সেখানে কি আর কেউ চাকরি পায় না? ওই কোম্পানিতেই ওকে কাজ করতে হবে?”
বাবা শান্ত গলায় বলেছিল, “তুমি ওকে কেন ওর মতো করে ডিসিশন নিতে বাধা দিচ্ছ? ও যদি নিজের মতো করে ঠিক-ভুল না শেখে, সারা জীবন তো কষ্ট পাবে! আমরা তো আর সারা জীবন ওকে গার্ড করে ঘুরে বেড়াব না!”
মা রাগে ফুঁসছিল, “সারাক্ষণ তোমার শুধু তত্ত্বকথা। আমেরিকার ছেলেটিকে না করার সময় মনে ছিল না যে, এটা একটা ভুল ডিসিশন নেওয়া হচ্ছে! আর এখন ওর দাদার কোম্পানিতে চাকরি করবে!”
বাবা আচমকা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল এবার। চিৎকার করে বলেছিল, “এনাফ! আমি সেদিন থেকে শুনছি এসব নিয়ে তুমি অশান্তি করছ! কেন করছ এমন? ওই ছেলেটাকে বিয়ে করেনি তো কী হয়েছে? কোন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গিয়েছে তাতে? সব কিছুর একটা লিমিট আছে! তোমার আমেরিকায় থাকা জামাই হলে কি সমাজে মান বাড়বে? মেয়ের পছন্দ নয় যাকে, তার সঙ্গে সে থাকবে কেমন করে? ওর ইচ্ছে হয়েছে এখানে কাজ করার ও করবে! আমি কিছু বলি না মানে এই নয় যে, অন্যায় দেখেও কিছু বলব না! এই নিয়ে আর যদি কোনও কথা হয়, তবে আমি কিন্তু আর চুপ করে থাকব না।”
বাবা আর ভাত না খেয়ে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল শব্দ করে। নোঈর খারাপ লাগছিল খুব। ওর খিদে পেয়েছিল, কিন্তু এসব দেখে ওরও আর খাবার মুখে তুলতে ইচ্ছে করছিল না। আস্তে করে প্লেটটা ঠেলে সরিয়ে ও নিজেও উঠে গিয়েছিল।
মা বসেছিল একা। পাথরের মতো। নোঈর কষ্ট হচ্ছিল মায়ের জন্য। কিন্তু ও জানত মাকে এই সময়ে কিছু বললে আর রক্ষে থাকবে না!
আসলে বাবা সংসারের কোনও কিছুতে থাকে না। নিজের কাজ আর হবি নিয়েই থাকে। সেই মানুষটা যে এমন করে রেগে যেতে পারে সেটা নোঈ বুঝতে পারেনি। কোনওদিন বাবাকে রাগতে দেখেনি নোঈ। তাই ওর নিজেরও খুব খারাপ লেগেছিল। মনে হচ্ছিল ওর জন্য বাড়িতে একটা বাজে পরিস্থিতি তৈরি হল!
তবে পরের দিন ঘুম থেকে উঠে নোঈ অবাক হয়ে দেখেছিল যে বাড়ির পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে। বাবা আবার নিজের কাজে। মা আবার রোজকার মতো এই রাগছে, এই হাসছে!
ও অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে ইশারা করে জিজ্ঞেস করেছিল, কী হয়েছে!
বাবা মুচকি হেসে ওর পাশে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলেছিল, “কাল রাতে আমার জামা টেনে ছিঁড়ে দিয়েছে রাগের চোটে। আমায় বালিশ দিয়ে খুব মেরেছে! তারপর কেঁদে শান্ত হয়েছে! জানিস তো তোর মাকে। পাগলি! আমি কোনওদিন তো বকিনি তাই খুব অভিমান হয়েছিল। তবে তোকে আর কিছু বলবে না। তোর যেটা ঠিক মনে হয় সেটাই কর।”
নিজেদের গাড়ি নেয়নি নোঈ। মোবাইল থেকে গাড়ি বুক করে নিয়েছিল। ভেবেছিল চাকরি পেলে তখন ভেবে দেখবে রোজ কী করে যাবে!
অফিসটা দেখে বেশ ভাল লেগেছিল নোঈর। বেশ বড়। অনেক উঁচুতে! আর, একদিকের কাচের দেওয়াল দিয়ে বহুদূর দিগন্ত দেখা যায়। বিকেল বলে ওই দৃশ্যটা যেন আরও সুন্দর লাগছিল। গ্রাউন্ড ফ্লোরের একটা রিসেপশন পেরিয়ে ওকে ওপরে পাঠানো হয়েছিল। সেখানেও আর-একটা রিসেপশন। গদি-আঁটা চেয়ার। কয়েকটা গাছ। সামনে টেবিলে জলের গেলাস। আর, একটা যেন চুপচাপ শীত-শীত ভাব! কেউ শ্বাস নিলেও শব্দ শোনা যায় এমন নিস্তব্ধতা! রিসেপশনে বসে সামান্য টেনশন হচ্ছিল ওর। কেন হচ্ছিল কে জানে! ইন্টারভিউ বলে, নাকি পুশকিনের সামনে যেতে হচ্ছে বলে!
প্রায় দেড় ঘণ্টা বসিয়ে রাখার পরে ওকে ডাকা হয়েছিল একটা ঘরে। উঠে দাঁড়িয়ে পাশের কাচে একবার নিজেকে দেখে নিয়েছিল নোঈ। তারপর এগিয়ে গিয়েছিল।
“আরে, কোথায় তুমি?” লু থেকে বেরিয়েই সামনে স্মরণকে দেখল নোঈ। সেই সামান্য এলোমেলো চুল, জামাটা ঠিকমতো গোঁজা নয়, পায়ে স্নিকার! নোঈ মাথা নাড়ল। এই ছেলেটাকে বলে লাভ নেই! সেই একইরকম ভাবে থাকবে।
অফিসে গিয়ে প্রথম দিনেই স্মরণের সঙ্গে দেখা হয়েছিল নোঈর। এমন একটা ছেলে কী করে এই সংস্থায় কাজ করে! এমন ছন্নছাড়া, উসকোখুসকো একটা ছেলেকে কেউ কিছু বলে না!
বলে, আপন বলে। ও সুযোগ পেলেই ঝাড়ে স্মরণকে। কিন্তু ছেলেটা কী দিয়ে তৈরি কে জানে! গায়ে যেন কিছুই লাগে না! আপন যখন খারাপভাবে ওকে বলে, স্মরণ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর বকাঝকা শেষ হয়ে গেলে নিজেই বলে, “আমি তবে যাই স্যার?”
আপন লোকটাকে প্রথম দিন দেখেই ভাল লাগেনি নোঈর। ইন্টারভিউ দিতে ঢুকেই আপনের মুখে এমন কিছু একটা দেখেছিল নোঈ যেটা ওর ভাল লাগেনি একদম! আর পাশে বসা পুশকিন ওর দিকে তাকিয়ে সামান্য হেসেছিল মাত্র!
আপন সামনের চেয়ারটা দেখিয়ে বলেছিল, “সিট।”
নোঈ বসার পরে মাথা ঝুঁকিয়ে “গুড আফটারনুন” বললেও আপন উত্তর দেয়নি।
পুশকিন পালটা উইশ করে বলেছিল, “আমরা তোমার সিভি দেখেছি। সাপোর্টিং ডকুমেন্টসও দেখেছি। তুমি আগে যে-কোম্পানিতে কাজ করতে সেটার রেফারেন্সও দেখলাম। তবে একটা কথা, আমাদের এখানে কিন্তু অ্যাকাউন্টসে তেমন করে ভেকেন্সি নেই! তোমার তো মার্কেটিং-এ একটা ডিপ্লোমা আছে। প্রজেক্ট ওরিয়েন্টেড কাজ করতে অসুবিধে নেই তো?”
নোঈ কিছু বলার আগেই, আপন বলেছিল, “আরে, আপত্তি থাকলে এখানে কাজ করা যাবে না। সিম্পল। তা পুশকিন, তুই তো মোটামুটি ঠিক করেই রেখেছিস যে ওকে নিবি, তা এটা বসকে বলেছিস তো?”
আপনের কথার মধ্যে কেমন একটা খোঁচা ছিল। কিন্তু পুশকিন উত্তেজিত না হয়ে স্বাভাবিক গলায় বলেছিল, “না বলে, ওঁর সঙ্গে কনসাল্ট না করে কি আমি কাজ করছি নাকি?”
আপন কেমন একটা চোখে তাকিয়েছিল নোঈর দিকে। তারপর বলেছিল, “প্রজেক্টের কাজ কিন্তু কঠিন। এমনও হতে পারে অন সাইট গেলে সেখানে রাতে থাকতে হতে পারে। লেবারদের মধ্যে থাকা… হোপ ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড দ্য সিচুয়েশন। তখন কিন্তু ট্যানট্রাম সহ্য করা হবে না। আর-একটা কথা, এখন প্রবেশনারি পিরিয়ড থাকবে ছ’মাস, এরপর তোমার জব ইভ্যালুয়েশন হবে, তারপর পারমানেন্ট। এটা যেন মনে থাকে।”
আপনের কথার ধরন মোটেও ভাল লাগছিল না নোঈর। কিন্তু পুশকিনের মুখে একটা সহজ হাসি ছিল। কোথায় যেন নিরুচ্চারে ভরসা দিচ্ছিল ওকে।
“ওকে স্যার,” নোঈ মাথা নেড়েছিল।
“ক্যান ইউ জয়েন টুমরো?” জিজ্ঞেস করেছিল পুশকিন।
“শিয়োর স্যার,” নোঈ উঠে দাঁড়িয়েছিল। ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় যেন আবছাভাবে আপনের মৃদু গলা শুনতে পেয়েছিল নোঈ। শুনেছিল আপন বলছে, “কেমন ননির পুতুলের মতো চেহারা! দেখ, কতদিন টেকে!”
সেদিন ইন্টারভিউ সেরে কয়েকটা পেপারে সই করতে-করতে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। পুশকিন নিজেই বলেছিল যে, ও গাড়ি করে বাড়ি পৌঁছে দেবে ওকে। নোঈ আপত্তি করেছিল, কিন্তু পুশকিন খুব একটা পাত্তা দেয়নি।
ফেরার পথে গাড়িতে পুশকিন প্রায় কথাই বলেনি। সামান্য একটু “হুঁ, হাঁ” করেছে। সামনের সিটে পুশকিনের পাশে বসে নোঈর কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছিল। এই গাড়িটায় একদিন উঠতে চায়নি ও। আর আজ এই গাড়িতেই ওকে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে। সত্যি, জীবন অদ্ভুত! কোন বাঁক থেকে সে যে মানুষকে কোন বাঁকে এনে ফেলে!
শুধু পাড়ার মুখে যখন নোঈ নেমে যেতে চেয়েছিল, তখন পুশকিন বলেছিল, “কেন? আমি ফ্ল্যাটের নীচ অবধি ছেড়ে দিচ্ছি। প্রবলেম আছে?”
নোঈ কী বলবে বুঝতে না পেরে ফস করে বলে ফেলেছিল, “মানে… মা একটু… আসলে…”
হেসেছিল পুশকিন, “উনি চান না তুমি আমাদের কোম্পানিতে জব করো, তাই না? ডিনোর সঙ্গের ব্যাপারটা ওঁর খুব একটা ভাল লাগেনি বোধহয়। আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি যাচ্ছি তোমার সঙ্গে, চলো। লেটস সর্ট ইট আউট। প্লাস, তোমার বাবাকে আমার চমৎকার লেগেছে।”
নোঈ কী বলবে বুঝতে পারছিল না। কেউ নিজে থেকে ওদের বাড়ি যেতে চাইছে! তাকে তো আর না বলা যায় না! আর অবাক হয়ে যাচ্ছিল দেখে যে, মনের মধ্যে অস্বস্তির সঙ্গে কেমন একটা ভাল লাগাও আসছিল নোঈর। পুশকিন বেশ সহজ-সরল মানুষ! জটিলতা যেন ঠিক পছন্দ নয় ওর!
বাড়িতে দরজা খুলেই মা পুশকিনকে দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিল বেশ। নোঈর মাকে নিয়ে ভয় ছিল। কিন্তু অবাক হয়ে দেখেছিল মা হেসে, নরম ভাবেই কথা বলছে পুশকিনের সঙ্গে।
তবে পুশকিন বসেনি বেশিক্ষণ। আইকা মাগোকে কোলে করে ঘরে ঢুকতেই উঠে দাঁড়িয়েছিল। নোঈর কেমন যেন একটা লেগেছিল। আইকা ঘরে ঢুকতেই কি পুশকিন কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছিল? কেন?
পুশকিন উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিল, “আমি তা হলে আসি।”
মা এবার সামান্য হেসে বলেছিল, “আপনাকে কী বলে যে ধন্যবাদ দেব! আপনাদের সঙ্গে আমাদের একটা আত্মীয়তা হতে পারত কিন্তু নোঈটা এমন…”
“ও ঠিক করেছে!” পুশকিন হেসে তাকিয়েছিল মায়ের দিকে, “ডিনো ইজ় নো ম্যাচ ফর হার। বিদেশে থাকে মানেই যে, সে সাংঘাতিক, সেটা কিন্তু ভাববেন না।”
“কিন্তু তাও…”
মাকে কথাটা শেষ না করতে দিয়ে পুশকিন বলেছিল, “আর নোঈ নিজের যোগ্যতাতেই চাকরিটা পেয়েছে! আমার কথায় নয় কিন্তু! আমাদের বস, তিনি নিজেও সব রিক্রুটের ব্যাপারে সিভি স্ক্রুটিনি করেন! আপনি মনে কোনও দ্বিধা রাখবেন না।”
“তুমি এতক্ষণ বাথরুমে কী করছিলে?” স্মরণ গোলগোল চোখ করে তাকাল ওর দিকে। এমনিতেই ছেলেটার চোখগুলো গোল্লা ধরনের। তার ওপর আবার ওরকম করে তাকিয়ে আছে! ছেলেটা সত্যি অদ্ভুত, একটা মেয়েকে যে এমন প্রশ্ন করতে নেই, সেটাও জানে না।
নোঈ কিছু না বলে হাসল।
স্মরণ বলল, “সে কী! হাসি প্র্যাকটিস করছিলে নাকি? আরে, ওই জয় রয় ডাকছে আমাদের। চলো।”
আবার জয়ের কথা ওঠায় নোঈর বুকের ভেতর যেন দশ কেজির বাটখারা আছড়ে পড়ল। আসলে ও রিসেপশনে বসে দূর থেকে জয়কে দেখেছিল। এবার যে একদম সামনে থেকে ফেস করতে হবে, সেটা ভাবলেই পেটের ভেতরে কেমন যেন পাক দিচ্ছে! তবু মনে মনে নিজেকে শক্ত করল নোঈ।
স্মরণ বলল, “তুমি মাঝে মাঝে পজ় মোডে চলে যাচ্ছ কেন আজ? আসার সময় তো ভালই ছিলে! তেমন হলে তুমি বোসো, আমি গিয়ে ওই কথাটা বলে আসছি। জাস্ট তো একটা লাইন। আপনস্যারের সঙ্গে দেখা করতে বলতে হবে। আমি বলে আসছি।”
স্মরণ নোঈর উত্তরের অপেক্ষা না করে এগোতে গেল। কিন্তু নোঈ স্মরণকে হাত ধরে টেনে দাঁড় করিয়ে দিল। বলল, “না। আমিই যাব। এটা কাজ। আমায় ঠিক থাকতে হবেই।”
“মানে?” স্মরণ চোখ গোলগোল করে তাকাল আবার, “কোনও কেস আছে নাকি? এমন করে বলছ কেন?”
নোঈ নিজেকে ঠিক করল। তারপর জোর করে হাসল। আর কথা না বাড়িয়ে এগিয়ে গেল সামনের দিকে।
জয়ের কিউবটা রিসেপশন থেকে সামান্য দূরে। পেছন থেকে জয়কে দেখে নোঈর বুকটা কেঁপে গেল আবার। জয় বড় চুল রেখেছে। পাশ থেকে দাড়ির আভাস পাওয়া যাচ্ছে। চোখে চশমা। মাথা নিচু করে জয় কিছু একটা করছে।
নোঈ একবার আড়চোখে স্মরণকে দেখে নিল। ছেলেটা এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। কী খুঁজছে কে জানে!
“এক্সকিউজ় মি!” নোঈ সাবধানে ডাকল।
জয় না তাকিয়েই প্রথমে “ইয়া,” বলে তারপর মুখ তুলে নোঈকে দেখে চমকে গেল!
“তু…” জয় কেমন যেন ঘাবড়ে গেল!
নোঈ দ্রুত স্মরণকে হাত দিয়ে টেনে সামনে এনে বলল, “আমরা এসেছিলাম আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে। আপন বাসু আমাদের পাঠিয়েছেন। আর্টওয়ার্কের হার্ড কপিটা নেব। আর উনি আপনাকে একটা কথা বলতে বলেছেন।”
এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে নোঈ চোয়াল শক্ত করল। ও যতই চাইছে না, কিন্তু তবু ওর চোখ বারবার খুঁটিয়ে দেখছে জয়কে। চশমার ফ্রেমটা নতুন। শার্টের মাঝের বোতামটা অর্ধেক লাগানো। দাড়িটা ট্রিম করা। লম্বা চুলে বার্গেন্ডি কালার। নাকের ব্রিজের পাশে সেই তিল। কানের লতির নীচে একটা ছোট্ট জড়ুল। আঃ! কী করছে কী ও! আচ্ছা জয় কি বুঝতে পারছে এটা? ওকে কি হ্যাংলা ভাবছে?
জয়ও নিজেকে সামলাল। তারপর যেন কিছুই হয়নি এমন করে বলল, “বাবা, তুই এভাবে আমায় আপনি-আজ্ঞে করছিস কেন? আমি তোর ভাশুর নাকি?”
নোঈ কী বলবে বুঝতে পারল না।
স্মরণ বলল, “আপনারা একে অপরকে চেনেন?”
“চিনি মানে?” জয় হাসল, “চিনি, গুড়, সুগার, সুগার ফ্রি সব।”
নোঈ বলল, “এটা অফিস ম্যাটার। আমাদের কিছু প্রোটোকল মেনটেন করা উচিত।”
জয় হাসল, “দূর, কী যে বলিস! আমরা এখানে অত আপটাইট নই। তা তোদের আপন কী বলেছেন?”
নোঈ বলল, “স্যার বলেছেন আপনাকে একবার দেখা করতে। মানে ইন পার্সন।”
“অ,” মাথা নাড়ল জয়, “এই কেস। বুঝেছি। তা আর্টওয়ার্ক পেয়েছিস তো?”
স্মরণ বলল, “হ্যাঁ, ওই রিসেপশনে রাখা আছে, বেরোনোর সময় নিয়ে যাব। আপনি কিন্তু একবার গিয়ে দেখাটা করবেন। স্যার বলেছেন এটা আর্জেন্ট।”
“কফি খাবি?” জয় মাথার চুলে হাত ডুবিয়ে হাসল।
নোঈর মনে হল বুকের কোনও এক সূদর খাতে ঝুপঝুপ করে নদীর পাড় ভেঙে পড়ল। নোঈ জানে হাসির সঙ্গে টোল জেগে উঠেছে। কিন্তু দাড়ি বলে বোঝা যাচ্ছে না।
“না, আমাদের যেতে হবে,” নোঈ মাথা নামিয়ে নিল, “আপনি শুধু একবার দেখা করে নেবেন, থ্যাঙ্কস।”
“আরে, তুই এমন করছিস কেন বল তো?” জয় এবার যেন সামান্য বিরক্ত হল, “আপনি-আপনি করছিস কেন? তোর এসব ওভার রি-অ্যাকশন আমার ভাল লাগে না!”
নোঈ আর পারল না। শুধু চাপা গলায় বলল, “ভাল যে লাগে না সেটা জানি। বাই।”
মে মাসের আঠারো তারিখ আজ। আকাশ থেকে কেউ যেন গলন্ত লাভা ঢেলে দিচ্ছে কলকাতার মাথায়। নোঈ আকাশের দিকে তাকাল। এই রংচটা নীল বেডকভারটা কবে থেকে যে টাঙানো আছে মাথার ওপর! ওর মনে হল পাখিরা যে রোস্ট হয়ে মাটিতে টুপটুপ করে খসে পড়ছে না, সেটাই অনেক ভাগ্যের।
পার্ক স্ট্রিটের রাস্তায় বেশ ভিড়। স্মরণ হাতে আর্টওয়ার্কের বড় ফোল্ডারটা নিয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। আজ আর রাজারহাটের অফিসে যেতে হবে না। এই বিকেল সোয়া চারটের সময় অতদূরে গেলে পৌঁছতেই ছ’টা বেজে যাবে।
স্মরণ বলল, “আইসক্রিম তেষ্টা পেয়েছে, খাবে?”
“কী?” হাসল নোঈ।
স্মরণ বলল, “বলছি, আইসক্রিম খাবে? সামনেই হবি সেন্টার। খাবে?”
নোঈ বলল, “না, আমি ঠিক মানে…”
স্মরণ বলল, “আরে বাবা, আমি তোমায় এমনি খেতে বললাম। আমার অন্য উদ্দেশ্য নেই! তুমি যা ভালনারেবল স্টেটে আছ, তাই… প্যাঁও রেগে গেলে বা মনখারাপ করলেই আমি ওকে আইসক্রিম খাইয়ে দিই।”
“কে?” নোঈ বুঝতে পারল না ঠিক!
“আরে প্যাঁও! আমার প্রেমিকা!” স্মরণ বলল, “দারুণ সুন্দর দেখতে প্যাঁওকে। ছোট্ট মুকুট কপাল। এইটুকু ঠোঁট। জাপানি পার্লের মতো দাঁত। থুতনিতে একটা আলতো ডিপ্রেশন আছে। নাকের দু’পাশে ছোট্ট ফুলস্টপের মতো দুটো তিল। থুতনিতেও আর-একটা। আর হাতের আঙুলগুলো যা দারুণ না! ওঃ!”
স্মরণ বর্ণনা দিতে-দিতে নিজেই খুশি হয়ে উঠল। বলল, “তবে একটা ব্যাপার, প্যাঁও খুব রাগী কিন্তু। সিংহ লগ্ন তো! মানে আমার সিংহী আর কী। আমায় খুব বকে। মাঝে মাঝে তাড়িয়েও দেয়। পরে আবার কাছে ডাকে। মেয়ে নয়, পুরো মুডের স্পেকট্রাম। কতরকমের মেজাজ চাই? সব রকম দেখিয়ে দেবে। আসলে ও গান গায় তো খুব সুন্দর, তাই রাগটা একটু বেশি!”
নোঈ কী বলবে বুঝতে পারল না। ওর মনটা মোটেই ভাল লাগছে না। বরং সেই নাম-না-জানা কোটর থেকে আবার পর্বতারোহীটি বেরিয়ে আসতে চাইছে। তার মধ্যে স্মরণের এই সব কথা ভাল লাগছে না মোটেই।
স্মরণ বলল, “জয়ের জন্য তুমি বাথরুমে ঢুকে কান্নাকাটি করছিলে?”
“কী?” আচমকা এমন একটা কথায় নোঈ বেশ হকচকিয়ে গেল।
স্মরণ বলল, “ও তোমায় ‘তুই’ করে কথা বলছিল। এমন ভাব করছিল, যেন সব কিছু ঠিক আছে, আর তুমি ঠিক উলটোভাবে ওর সঙ্গে একটা আরোপিত দূরত্ব দেখাচ্ছিলে। স্ট্রেস দিচ্ছিলে ‘আপনি’ শব্দটার ওপর। ওর ওই ক্যাজ়ুয়াল বিহেভিয়ার আর তোমার অতিরিক্ত চোয়াল শক্ত করে ওর সঙ্গে দূরত্ব রাখার চেষ্টা তো একটা জিনিসই স্পষ্ট বুঝিয়ে দেয়।”
“কী বুঝিয়ে দেয়?” নোঈ ভুরু কুঁচকে তাকাল।
স্মরণ হেসে বলল, “এটাই বোঝায় যে, ও মোটেই ক্যাজ়ুয়াল নয়। অকোয়ার্ড সিচুয়েশানে পড়ে সেখান থেকে নিজের মুখ রক্ষা করছে। আর তুমি কিছুতেই ওকে সেই সিচুয়েশন থেকে বেরোতে দিতে চাও না। ওকে একটা গিল্ট দিয়ে কোণঠাসা করতে চাও।”
নোঈ কী বলবে বুঝতে পারল না। এভাবে যে কেউ কলিগের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কথা বলতে পারে, ও ভাবতেই পারে না! কিন্তু স্মরণের এসব বোধ আছে বলে মনে হয় না!
স্মরণ আবার বলল, “ওই অনুস্বরের মতো টিপ মুছে ফেলে যখন বাথরুম থেকে বেরোলে, বুঝলাম কিছু কেস হয়েছে। তারপর জয়বাবুকে দেখে তো নিশ্চিত হলাম কী কেস।”
নোঈ আর নিতে পারল না। সামান্য গম্ভীর গলায় বলল, “প্লিজ়। তোমার মনে হচ্ছে না যে, তুমি বড্ড বেশি জাজমেন্টাল হয়ে যাচ্ছ?”
স্মরণ বলল, “দূর! এগুলো তো মনে এল বলে বললাম। সারাক্ষণ তোমরা ফেসবুকে সেলফি দেবে, কী করছ তার স্টেটাস দেবে। কেমন ফিল করছ তা বলবে। আর কেউ একটু কিছু বললেই এমন ভাব দেখাবে, যেন সবার মনের ভেতর একটা করে নিউক্লিয়ার বোমার লঞ্চ কোড লুকোনো আছে! সেটা জানার চেষ্টা চলছে। তোমার যা হয়েছে সেটা কমন ব্যাপার। এটাকে এত গুরুত্ব দিয়ো না। যাই হোক, তুমি যখন বাথরুমে ছিলে আমায় ফোন করেছিলেন পুশকিনস্যার। বলছিলেন, কাজ শেষ হলে একবার রাসেল স্ট্রিটের ওখানে যেতে। উনি আসবেন। আমি বলেছি আমায় ডালহৌসি যেতে হবে। তুমি চলে যাবে। এখান থেকে একটু হেঁটে গেলেই পেয়ে যাবে অফিসটা। দেখবে, একটা পুরনো চাইনিজ় লন্ড্রি আছে। তার পাশেই।”
নোঈ বলল, “ঠিক আছে। তুমি তা হলে কাল ওই আর্টওয়ার্কটা নিয়ে যেয়ো মনে করে। আমি আসছি।”
স্মরণ হেসে বুড়ো আঙুল তুলে ওকে দেখিয়ে পা চালিয়ে রাস্তা পার হয়ে গেল।
নোঈ দাঁড়াল একটু। এই পার্ক স্ট্রিটে আসতে নোঈর ভাল লাগে খুব। কেমন একটা পুরনো অভিজাত কলকাতা যেন আজও বেঁচে আছে এই পার্ক স্ট্রিটে। এই চওড়া রাস্তা। পুরনো ধাঁচের বাড়িঘর। কাঠের প্যানেলওয়ালা রেস্তরাঁ। সব মিলিয়ে সময়টা কেমন যেন কলোনিয়ান ক্যালকাটায় ফিরে যায়!
“দিদি, একটা চুইং গাম কিনবেন?” আচমকা সামনে একটা খয়াটে চেহারার লোক এসে দাঁড়াল।
লোকটাকে ভাল করে দেখল নোঈ। কালো, রোগা। কানে একটা ছোট্ট পাথরের দুল। গায়ের ডোরাকাটা গেঞ্জিটা কতদিন যে কাচে না কে জানে! লোকটার গা থেকে সস্তা মদের গন্ধ আসছে।
“দিদি, পিলিজ। খিদে পেয়েছে। দুটো পড়ে আছে চুইংগাম। পিলিজ!” লোকটা কেমন যেন এগিয়ে আসছে নোঈর দিকে। নোঈ ভয় পেয়ে গেল।
“এই ভাগ, ভাগ এখান থেকে!”
নোঈ সামান্য ঘাবড়ে গেল। দেখল পেছন থেকে এসে লোকটাকে কড়া ধমক দিল জয়।
লোকটা গুটিয়ে গেল কিছুটা।
জয় আবার বলল, “ভাগ বলছি না! পাতা খাবি এখন বসে আর বলছিস খিদে পেয়েছে! ভাগ!”
লোকটা চোয়াল শক্ত করে একবার দেখল জয়কে, তারপর মাথা নামিয়ে চলে গেল।
নোঈ তাকাল জয়ের দিকে। ও কী করছে এখানে?
জয় বলল, “আমি সিগারেট খেতে নীচে নেমেছি। তোর জন্য নয়।”
নোঈ মাথা নিচু করে নিল। চলে যেতে হবে ওকে এখান থেকে। পুশকিন ডেকেছে। কিন্তু যেতে পারছে না। জয় এত কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওর গায়ের সেই ‘হট ওয়াটার’ পারফিউমের সঙ্গে তামাক মেশানো গন্ধ! সেই বিকেলবেলা! নোঈর গায়ে নিজের অজান্তেই কাঁটা দিয়ে উঠল। জীবন খুব নিষ্ঠুর। সব কিছু সাজিয়ে সামনে মেলে ধরেও এমন একটা ফাঁক রেখে দেয় যে, জীবনটাই অর্থহীন হয়ে পড়ে!
নোঈ চোয়াল শক্ত করে বলল, “এভাবে গায়ে পড়ে অপমান করছিস কেন? আমি কি বলেছি, তুই আমার জন্য নীচে নেমে এসেছিস?”
জয় হাসল। বলল, “দেখ, এভাবে যে দেখা হবে, সেটা তো আমরা জানতাম না। কিন্তু কোয়াইট ফ্র্যাঙ্কলি, আর দেখা না হলেই বোধহয় ভাল হবে। নেক্সট টাইম তুই আসিস না।”
“মানে?” নোঈর বিরক্ত লাগল, “আমি চাকরি করি। সেই কাজে দরকার পড়লে আবার আসব।”
জয় মাথা নাড়ল। হাতের সিগারেটে শেষ টান দিয়ে মাটিতে ফেলে পা দিয়ে পিষে নিভিয়ে বলল, “চাকরি? হাঃ হাঃ! তোদের আবার চাকরি! টাইম পাস বল? শখ। আর আসবি মানে? মানে আবার সেই… ওঃ… অনেক তো হল নোঈ, এবার ছাড়। আর কতদিন? এটা প্রেম না, ইগো আর অবসেশন! প্লাস আমি চেষ্টা করছি, বিদেশে চাকরির কথা হচ্ছে। বাই বাই ক্যালকাটা। বুঝলি?”
জয় হেসে ওদের যা কিছু সম্পর্ক আর বিচ্ছেদ ছিল সব আকাশে ধোঁয়ার মতো উড়িয়ে দিয়ে চলে গেল। ঢুকে গেল বড় বাড়িটার মধ্যে। আর নোঈর মনে হল গোটা পার্ক স্ট্রিটটা যেন জয়ের সঙ্গে অদৃশ্য হয়ে গেল ওর সামনে থেকে! ওর মনে হল সামনের রাস্তাটা কেমন যেন টলছে! মনে হল, আসলে পাখি নয়, ওর নিজের ঝলসানো মাংস টুপটুপ করে খসে পড়ছে আকাশ থেকে! মনে হল এই গ্রীষ্মের যেন কোনও শেষ নেই। এক অক্লান্ত আগুন, যুগের পর যুগ ধরে, ঝলসে, পুড়িয়ে দিয়ে যাবে সবকিছু। আর সব শেষে মাটিতে পড়ে থাকবে ওই পিষে ফেলা সিগারেটের মতো কিছু আধপোড়া মানুষ আর তাদের নরম, একাকী ইচ্ছেগুলো।
নোঈ দেখল ওই চুইংগাম বিক্রেতা ছেলেটা আবার ফিরে আসছে। ও ব্যাগ খুলল এবার। কিছু কার্ড, কাগজ আর কয়েকটা একশো টাকার নোটের পাশে চারটে দশ টাকার নোট দেখা যাচ্ছে। তার মধ্যে একটা সেই পুরনো পাঁজর ওর।
নোঈ চোখ বন্ধ করে হাত বাড়াল। দেখা যাক কোন নোটটা হাতে ওঠে। যদি সেই নোটটা ওঠে, তবে সেটাই দিয়ে দেবে। আজ আর কোনও পিছুটান রাখবে না।
হাতে পাতলা কাগজগুলো ঠেকল নোঈর। ও চিন্তা না করে তুলে নিল একটা। কী উঠল হাতে? ও কী চায়? কোন নোটটা উঠুক? এখনও, আজকের পরেও কি ওর মনে হবে ‘রেখে দিই’ ওই কাগজের টুকরোটা?
আবার মদের গন্ধ নাকে আসছে। ঘ্যানঘ্যানে গলাটা শোনা যাচ্ছে। নোঈ নিজেকে প্রস্তুত করল। তারপর চোখ খুলে তাকাল হাতের নোটটার দিকে!
.
১২. রাধিয়া
উত্তর কলকাতাটাকে কেমন একটা বাতিল চিলেকোঠার মতো লাগে রাধিয়ার। ঘিঞ্জি রাস্তা, রংচটা বৃদ্ধ বাড়িঘর, ধুলোমাখা রুগ্ণ গাছ, ছেঁড়া পোস্টার, বেখেয়ালি হকার। সব নিয়ে মনে হয় বাতিল আর অতিরিক্ত জিনিসপত্র কে যেন দলামোচড়া করে ঢুকিয়ে দিয়েছে একটা ঘরের ভেতরে! কেন এমন করে রাখা হয়েছে শহরটাকে? কেন এমন একটা শহর চলে যায় দখলদারদের হাতে?
রাধিয়ার মনে সারাক্ষণ এমন নানা প্রশ্ন ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু কাকে কী বলবে?
আজ ইউনিভার্সিটিতে পলি আর বুদা এসেছে, বাকিরা কেউ আসেনি। ক্লাসও তেমন ছিল না। তাই ভেবেছিল বাড়ি চলে যাবে। কিন্তু পলি তো ছাড়ার পাত্রী নয়।
বলেছে, “এত তাড়াতাড়ি বাড়ি গিয়ে কী করবি? আমার সঙ্গে চল। ‘ব্রোঞ্জ ইয়ার্স’-এ নিয়ে যাব চল তোকে। কতদিন যেতে বলেছি, তুই তো শুনবি না!”
কলেজ স্ট্রিটটা আজ যেন উপচে পড়ছে! সামনে জামাইষষ্ঠী, কিন্তু তাতে কী? আজকাল তো আর মানুষজন কেউ কাউকে খুব একটা বই-টই উপহার দেয় না! বই পড়াকে লোকে হয় অবজ্ঞার চোখে দেখে, নয়তো ভাবে শো অফ করছে! তাই পালাপার্বণে বইয়ের বাজারে ভিড় দেখলে খুব আশ্চর্য হয় রাধিয়া!
মধুদা গাড়িটা পার্ক করেছে সেই সূর্য সেন স্ট্রিটে বিখ্যাত শরবতের দোকানটার কাছে। এখানে থেকে ওই অবধি হেঁটে যেতে বেশ কসরত করতে হবে।
তবে তার আগে একটা কাজ আছে। ঠাকুরমা বলেছে কয়েকটা বইয়ের অর্ডার দিয়ে আসতে। কোন এক স্কুলে দিতে হবে। এসবের জন্য মধুদা আছে। বাবার অফিসের লোকজন আছে। কিন্তু ঠাকুরমা রাধিয়ার ওপরই জোর দেয় এসব করার জন্য। বলে, “তোর আপত্তি কোথায়? অত পুতুপুতু করে থাকতে হবে না। তুই কানাইয়ের দোকানে গিয়ে আমার নাম করে অর্ডার দিয়ে আসবি। অন্য লোক গিয়ে ডেলিভারি নিয়ে আসবে। বুঝলি?”
ঠাকুরমা অদ্ভুত মানুষ। ওদের বাড়িতে থাকলেও কেমন একা-একাই থাকে। বড় বাড়ি বলে অসুবিধেও হয় না। আসলে এইসব বাড়িঘর, নানারকমের ব্যাবসাপত্র, এই সবকিছু ঠাকুরমার নামেই। তবে বাবাও মালিক গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান। আর রোজকার ব্যাবসা বাবাই দেখে!
ঠাকুরমা বলে, “এত নানা ধরনের ব্যাবসা, আমার আর ভাল লাগে না। সত্যি, বিষয় বিষ! জানিস রাধি, আমি শ্বশুরঠাকুরকে বলেছিলাম যে, আমার নামে এসব দিয়ে যাবেন না। কিন্তু উনি শোনেননি। নিজের ছেলের চেয়ে আমাকে বেশি বিশ্বাস করতেন। লোকটা শেষজীবনে কেমন পালটে গিয়েছিলেন। সেই রাগ বা তেজ, কিছুই ছিল না।”
রাধিয়ার এসব শুনতে ভাল লাগে না। ওদের যে অনেক টাকা সেটা ও জানে। কিন্তু কী-কী ব্যাবসা আছে, কোথায়-কোথায় কী আছে সেসব নিয়ে ওর আগ্রহ নেই।
ঠাকুরমা যদিও বলে এসব একটু জেনে নিতে, কিন্তু রাধিয়া কিছুতেই কিছু শুনতে চায় না। কিছুদিন আগে ওই যে রাধিয়া সোনাঝুরিতে গেল, সেখানেও ওদের একটা জুটমিল আছে। ঠাকুরমা সোনাঝুরির কথা শুনে শুধু বলেছিল, “তুই যাচ্ছিস? যা। আমি যে কত বছর যাইনি!”
রাধিয়ার অবাক লেগেছিল, “কেন যাওনি ঠাকুমা? খুব তো কিছু দূর নয়। আর আমাদের তো একটা মিল আছে। তা হলে?”
ঠাকুরমা বলেছিল, “ওদিকে আর যাব না আমি। যে-জীবন ওখানে ফেলে এসেছি, সেই জীবন কষ্ট ছাড়া আর কিছু দেয়নি আমায়।”
“কিন্তু ওখানে অনেক সম্পত্তি আছে না তোমার নামে?”
“শ্বশুরমশাই খুব ভালবাসতেন আমায়। তাই কিছু জিনিস আমার নামে করে গিয়েছেন। কিন্তু নামে করা মানেই তো সেটা আমার নয়! আমার আর কিছুই নয়। শুধু প্রশ্ন ছাড়া আমার আর কিছু নেই,” ঠাকুরমা আর কিছু না বলে চুপ করে গিয়েছিল।
“সোনাঝুরির কথা তুমি কিছু বলতে চাও না কেন ঠাকুমা?”
“কিছু বলার নেই রে রাধি। সেই জীবনটাই নেই তো আর কী বলব!”
রাধিয়া বোঝে না ব্যাপারটা কী। সোনাঝুরির প্রসঙ্গ উঠলেই এমন ম্রিয়মাণভাবে কেন কথা বলে ঠাকুরমা! তবে এই নিয়ে বেশি প্রশ্ন করে না ও। কাউকে কোনও ব্যাপারে জোর করা ওর পছন্দ নয়।
ঠাকুরমার দানধ্যানের হাত খুব। নিজের শ্বশুরমশাইয়ের নামে একটা বৃত্তি চালু করছে। বিভিন্ন অনাথাশ্রমে বার্ষিক একটা টাকা দেয়। আরও নানা কিছু করে। পলিদের এই ওল্ড এজ হোমটাতেও প্রতিমাসে একটা করে টাকা পাঠায় ঠাকুরমা।
ঠাকুরমা বলে, “ভগবান অনেক দিয়েছেন। আমি না হয় তার থেকে একটু দিলাম। তাতে আমার তো কমছে না!”
আজ যে এই বইয়ের অর্ডার দেওয়ার ব্যাপার আছে, সেটাও এমন একটা কাজের অঙ্গ।
রাধিয়া আপত্তি করেনি। ওর এসব ছোটখাটো কাজ ভালই লাগে। মা সারাক্ষণ ওকে আগলে রাখে। তুলোয় মুড়ে রাখে। কিন্তু রাধিয়ার সেটা ভাল লাগে না। ওরও ইচ্ছে করে আর-পাঁচজনের মতো ঘুরতে। কিন্তু পারে না। সারাক্ষণ গাড়ি করে ঘোরা! এসিতে বসে থাকতে-থাকতে মাঝে মাঝে ভুলে যায় কলকাতায় কোন ঋতু চলছে!
মায়ের কথা হল বাইরে এত পলিউশন, তোর স্কিন আর চুল খারাপ হয়ে যাবে। আরে বাবা, মানুষ কি শুধু রূপটুকু নাকি? ওর অন্য বান্ধবীরা কেমন প্রজাপতির মতো স্বাধীনভাবে উড়ে-ঘুরে বেড়ায়!
মায়ের তো কলকাতাতেও ওকে পড়তে দেওয়ার ইচ্ছে ছিল না। ওর দুই মামা ইংল্যান্ডে থাকে। মা খুব জেদ ধরেছিল রাধিয়াকে ওখানে পড়তে পাঠাবে। কিন্তু রাধিয়াও জেদ করে যায়নি। আর শুধু রাধিয়াই নয়। ঠাকুরমাও রাধিয়ার পক্ষে ভোট দিয়েছিল। আসলে ঠাকুরমাকে টপকে ওদের বাড়িতে কিছু হয় না। মা এই নিয়ে বাবার কাছে অনুযোগ করে। বলে, “আমরা এত বড় হলাম, তাও ওঁর কথামতো কেন আমায় চলতে হবে? আমার মেয়ে, তাকে আমি আমার ইচ্ছেমতো পড়াতেও পারব না! ওই দেশে গিয়ে পড়লে ওর কেরিয়ার কত ভাল হত!”
বাবা বেশি কথার মানুষ নয়। সঙ্গে কিছুটা রাগীও আছে। মায়ের এক কথা বারবার বলায় বলেছিল, “ওর যেখানে ভাল লাগবে পড়বে। তুমি এই নিয়ে আর অশান্তি কোরো না। আর রাধি তো নিজেই এখানে থাকতে চায়!”
রাধিয়া বোঝে কেন এমন বলে মা। আসলে মায়ের নিজের ইচ্ছে ছিল বিদেশে গিয়ে লেখাপড়া করার। কিন্তু তাড়াহুড়ো করে বিয়ে হয়ে যাওয়ায় সেটা আর হয়নি। তবে ঠাকুরমা বা বাবা নিষেধ করেনি লেখাপড়া করতে। কিন্তু মায়ের খুব অভিমান হয়েছিল নিজের বাবা-মায়ের ওপর। তাই নিজেই আর পড়েনি।
মা ওকে বলে, “তোকে তো আমি বিয়ে করতে বলব না। তুই ইচ্ছে হলে বিয়ে করবি, না হলে করবি না। কিন্তু লেখাপড়া থামাবি না।”
মায়ের মধ্যে ওর মনে হয়, দুটো মানুষ আছে। একটা মানুষ কেমন যেন স্নব, অহংকারী। আর আর-একজন বুকের ভেতরে চাপা পড়ে যাওয়া মনখারাপ করা এক মানুষ। মাঝে মাঝে মাকে ঠিক বুঝতে পারে না ও।
“তুই কি রাস্তা ক্রস করবি? নাকি মোটামুটি রাত অবধি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকার প্ল্যান আছে তোর?”
পলির কথায় পাশে তাকাল রাধিয়া।
“হ্যাঁ, এই তো!” রাধিয়া হাসল।
পলি বলল, “তাড়াতাড়ি চল। আমায় হোমে ছ’টার মধ্যে পৌঁছতে হবে। তারপর স্যারের বাড়ি যাব!”
“যাচ্ছি বাবা, যাচ্ছি। অমন তাড়া দিচ্ছিস কেন?” রাধিয়া হাসল, “আর রোজ স্যারের বাড়ি যাস কেন? রোজ পড়া থাকে?”
“কাজ থাকে, পড়া, নোটস… সে অনেক ব্যাপার, আমার কথা ছাড়, তুই চল,” পলি ওকে তাড়া দিল।
“তুই আজকাল মাঝে মাঝে কী চিন্তা করিস রে? অন্যমনস্ক হয়ে যাস হঠাৎ-হঠাৎ! কী হয়েছে তোর? জিতেনের ভাগ্য খুলল নাকি?” বুদা পাশ থেকে ফুট কাটল।
“খালি বাজে কথা,” রাধিয়া বিরক্ত হল, “কী সব বলিস না!”
জিতেন ওদের সঙ্গেই ইংরেজিতে এমএ করছে। আর সেই প্রথম থেকেই রাধিয়ার পেছনে পড়ে আছে। ইউনিভার্সিটির আর কারও জানতে বাকি নেই যে, জিতেন রাধিয়ার জন্য পাগল!
রাধিয়ার বিরক্ত লাগে এসব। এমন গায়ে-পড়া মানুষ দেখলে মনে হয় পালিয়ে যায়। জিতেন আবার বিশ্ব-আঁতেল! কীসব ম্যাগাজ়িন বের করে! ঘাড় অবধি লম্বা চুল রাখে ছেলেটা। মাঝে মাঝে আবার খোঁপাও করে। সারাক্ষণ রংবেরঙের পাজামা আর পাঞ্জাবি পরে থাকে। কাঁধে একটা তাপ্পিমারা ঝোলা। স্নান করে কি না কে জানে! সারাক্ষণ সিগারেট জ্বলছে মুখে। দেখলেই ঘেন্না লাগে রাধিয়ার। আর মুখে সব সময় বড়-বড় কথা। জয়েস, কাফকা, বোর্হেস, লোরকা, কাম্যু, ইয়োসা… আরও কত কী নাম! এদিকে নিজেরা যা লেখে, সেসব ওদের ওই ধরাচুড়ো পরা গ্রুপটা ছাড়া আর কেউ বোঝে কি না কেউ জানে না। ভান দেখলেই গা-পিত্তি জ্বলে রাধিয়ার। ওর মনে হয় যারা অযোগ্য কিন্তু লোভী, তারাই ঘ্যাম আর ভান নিয়ে ঘোরে।
কফি হাউসটা বাঁ দিকে রেখে প্রথম বাঁ হাতের রাস্তাটা শ্যামাচরণ দে স্ট্রিট। সেই রাস্তা দিয়ে ভেতরে ঢুকে কিছুটা এগিয়ে গেলেই কানাইদার দোকান।
গল্পের বইটই এই মানুষটার কাছ থেকেই কেনে রাধিয়া। কানাইদা খুব ভাল মানুষ। সারাক্ষণ পান মুখে থাকে। রাজ্যের বাংলা বইয়ের নাম আর পাবলিশার্সের নাম মুখস্থ!
কানাইদা একটা প্লাস্টিকের টুলের ওপর বসে হাতপাখার হাওয়া খাচ্ছিল। কানাইদার দুই ছেলেই মূলত দোকান দেখে এখন।
রাস্তার ওপরেই দোকান। বেশ ভিড়। দাঁড়ানোর জায়গা নেই। তাও রাধিয়া দু’জন মানুষকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল কানাইদার সামনে।
কানাইদার হাতপাখা থেমে গেল। এক গাল হেসে বলল, “আরে, কেমন আছ? অনেকদিন আসোনি!”
রাধিয়া হাসল। তারপর ব্যাগের ভিতর থেকে চার ভাঁজ করা কাগজ বের করে সামনে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “এখানে দুশোটা বই আছে। ঠাকুমা যেমন পাঠায় আর কী। কালকে এলে কি পাওয়া যাবে?”
কানাইদা কাগজটা হাতে নিয়ে মাথা উঁচিয়ে বাইফোকাল চশমার তলা দিয়ে দেখল। তারপর বলল, “আচ্ছা, হয়ে যাবে। তোমাদের যে লোক আসবে তাকে বোলো আসার আগে একবার যেন আমায় ফোন করে নেয়। আসলে রাস্তার ওপরে তো এভাবে এত বই রাখা যায় না! তাই অন্য জায়গায় রেখে দেব। উনি এলে তখন দিয়ে দেব।”
“কিছু টাকা দিয়ে যাব?”
কানাইদা হাসলেন। তারপর মাথা নেড়ে বললেন, “না গো দিদিমণি, যখন নেবে তখন দিয়ো।”
রাধিয়া আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু পলি পাশ থেকে খোঁচা মারল। মেয়েটা খুব তাড়া দিচ্ছে আজ!
রাধিয়া হাসল কানাইদার দিকে তাকিয়ে তারপর বলল, “আমি তা হলে আসি?”
“গাড়ি কোথায় রেখেছ?” কানাইদা জিজ্ঞেস করলেন।
“ওই সামনেই… আসছি…” রাধিয়া হেসে পেছন ফিরল।
এই রাস্তাটা আরওই ঘিঞ্জি! তার মধ্যে একটা ঠেলাওয়ালা তার বিরাট বড় ঠেলা ঢুকিয়ে দিয়ে রাস্তার মুখটা বন্ধ করে দিয়েছে প্রায়।
বুদা বিরক্ত হয়ে বলল, “নাও ঠেলার জন্য এখন ঠেলা বোঝো!”
রাধিয়া কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই ও দেখতে পেল ছেলেটাকে। রোগা-পাতলা, বেঁটে, এক মাথা উসকোখুসকো চুল। চোখে চশমা। শার্টটা অর্ধেক গোঁজা আর অর্ধেক বের করা।
আরে, এই ছেলেটাকে দেখেছিল না সুম্পার জন্মদিনে! কী যেন নাম! হ্যাঁ মনে পড়েছে। স্মরণ।
কিন্তু ছেলেটা করছে কী? রাধিয়া দেখল, বড় ঠেলাটার পেছনের দিকটা ধরে টানছে স্মরণ। ওর মনে হল, এই ভিড়টা থেকে ঠেলাটাকে বের করার জন্য এমন করছে ছেলেটা। এবার একটা মেয়েকে দেখল ও। ফরসা। কাটা-কাটা মুখ চোখ। চশমা পরা। একটা জিন্স আর সাদা কালো ডোরাকাটা একটা গোল গলা টি-শার্ট পরে রয়েছে মেয়েটা। আর স্মরণকে দু’হাত দিয়ে টেনে সরানোর চেষ্টা করছে ও।
পলি বলল, “ওই দেখ কোন মক্কেল! কী করছে মালটা?”
রাধিয়া দেখল বুদা হাসছে। আর সত্যি বলতে কী, আরও নানা লোকজন হাসছে।
রাধিয়ার খারাপ লাগল। সবাই ঠেলাওয়ালাটাকে গালাগালি করছে। কিন্তু সে বেচারা রুজির জন্য বেরিয়েছে। আর শুধু ঠেলাওয়ালার দোষ নয় মোটেই। রাস্তাটাকেই সবাই মিলে এমন করে রেখেছে যে, জট পাকিয়ে গিয়েছে। আর বেচারা স্মরণ সেই জট খোলার চেষ্টা করছে বলে সবাই ওকে দেখে হাসছে।
মাঝে মাঝে এইসব দেখে মনখারাপ হয়ে যায় রাধিয়ার। যে কোনও কিছু করার চেষ্টা করে তাকে নিয়েই পৃথিবীতে হাসাহাসি হয়। এখন যেমন হল।
ও দ্রুত এগোল। মানুষের ফাঁকফোকর দিয়ে গলে, দোকানের সিঁড়িতে উঠে, কাঠের টুল টপকে ও গিয়ে পৌঁছল ওদের সামনে।
“স্মরণ, কী করছ?”
স্মরণ ফিরে তাকাল। নাক থেকে পিছলে চশমাটা নেমে এসেছে নীচে। ও চশমাটা তুলে নাক কুঁচকে সেটাকে সেট করে বলল, “আরে রাধিয়া! দেখছ না কী কেস! এভাবে কেউ এখানে ঠেলা ঢোকায়! এটাকে বের না করে দিলে গোটা রাস্তাটা দাঁড়িয়ে যাবে!”
“ছাড়ো, ছাড়ো বলছি! ছাড়ো তুমি…” পাশ থেকে মেয়েটা আলতো করে এবার থাপ্পড় মারল স্মরণের কাঁধে।
স্মরণ তাও ছাড়ল না। তবে রাধিয়াকে এগিয়ে যেতে দেখেই বোধহয় এবার আরও কিছু মানুষজন মজা দেখা বাদ দিয়ে এসে হাত লাগাল। তার ফলে ঠেলাটা সোজা হয়ে এগিয়ে যেতে পারল। আর জট খুলে রাস্তাও স্বাভাবিক হয়ে গেল।
পলি আর বুদা এসে দাঁড়াল রাধিয়ার পেছনে। ওদের দেখে স্মরণ হাসল, “আরে, তোমরা সবাই এসেছ! দারুণ তো!”
জয়তী আর রাখি আসেনি। কিন্তু সেটা আর বলল না রাধিয়া।
ও শুধু বলল, “আমাদের তো ইউনিভার্সিটি এখানে। তোমরা? বই কিনতে?”
“আরে না, না,” স্মরণ হাসল, “কিছু স্টেশনারি কিনতে এসেছি। আমাদের আপনস্যার পাঠালেন। আর স্যারের কিছু বইও কিনতে হবে। যাই হোক, আলাপ করিয়ে দিই। ও আমাদের অফিসেই আছে। নাম নোঈ।”
নোঈ হেসে ওদের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝোঁকাল। এবার মেয়েটাকে আরও ভাল করে দেখল রাধিয়া। খুব সুন্দর দেখতে। ফেয়ারনেস ক্রিমের বিজ্ঞাপন করতে পারে এমন স্কিন! এই বিকেলের ধুলোটে আলোতেও মুখটা ঝলমল করছে।
“আমি রাধিয়া।”
আশপাশ থেকে ভ্যান, গাড়ি, লোকজন ক্রমাগত ওদের ধাক্কা দিয়ে চলে যাচ্ছে।
স্মরণ বিরক্ত হয়ে বলল, “এটা এমন একটা জায়গা যে, শান্তিতে হাঁটতেও পারবে না কেউ! তা সেদিনের পরে তো আর দেখাও হল না তোমাদের সঙ্গে!”
রাধিয়া বুঝল স্মরণের তেমন কোনও কথা নেই বলার। ও পলির দিকে তাকাল।
এসব অবস্থায় পলি সোজাসাপটা কথা বলতে পারে ভাল।
পলি বুঝল ইঙ্গিতটা। ও বলল, “ঠিক আছে স্মরণ, আমরা তা হলে আসি। আসলে উই আর ইন আ হারি।”
“তাই?” স্মরণ হাসল। যেন পলি খুব হাসির কথা বলেছে, “আমার কোনও তাড়া নেই। বসের পারসোনাল কাজে এসেছি। তোমরা মুড়ি খাবে? কলেজ স্কোয়ারে মাখে একজন। ওই দিকটায় বসে। খাবে?”
“আঃ,” নোঈ বলল, “ওদের তাড়া আছে স্মরণ!”
“ও আচ্ছা,” স্মরণ মাথা নাড়ল, “কিন্তু মুড়ি খেতে আর কতক্ষণ টাইম লাগবে?”
বুদা জিজ্ঞেস করল, “তোমার প্যাঁও কেমন আছে?”
“প্যাঁও দারুণ আছে,” স্মরণ আবার নতুন উদ্যমে শুরু করল, “আজ সন্ধেবেলাতেই দেখা হবে আমাদের। ও আসলে গান শেখে তো! ওই বেহালা চৌরাস্তার কাছে গান শিখতে আসে। আমি না গেলে খুব রাগ করে। মানে, ওখান থেকে ওকে পিক আপ করে বাড়িতে দিয়ে আসতে হয় আমায়! আসলে…”
“বাই স্মরণ,” পলি হাত নেড়ে বুদা আর রাধিয়াকে টেনে নিয়ে এগিয়ে গেল।
স্মরণ থতমত খেয়ে চুপ করে গেল। রাধিয়া যেতে-যেতে শুনল নোঈ চাপা গলায় স্মরণকে বলছে, “তোমার কাণ্ডজ্ঞান নেই? সব জায়গায় প্যাঁও প্যাঁও! যেন হারমোনিয়াম বাজাচ্ছে! তুমি কি পাগল?”
ওদের গাড়িটা বেশ বড়। সরু রাস্তা ধরে আমহার্স্ট স্ট্রিটে বেরোনো অবধি গাড়িটা শামুকের মতো চলল। আশপাশের লোকজন যে বিরক্ত হচ্ছে, সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারল রাধিয়া। বড় আর সুন্দর গাড়ি দেখলেই রাস্তার লোকজন খেপে যায়। এটা দেখেছে রাধিয়া। আমাদের আশপাশটা হিংসুটেদের নিয়ে তৈরি।
বুদা গাড়ির সামনে বসেছে। ও মুখ ঘুরিয়ে বলল, “আচ্ছা, সুম্পাদের বাড়িতে সেই ছেলেটা ছিল না? সেই যে রে তোর সঙ্গে আলাদা হয়ে কথা বলছিল খাবারের সময়। কী যেন নাম!”
“নিশান!” রাধিয়া ছোট্ট করে বলল।
বুদা বলল, “রাইট। গতকাল ওকে দেখলাম নন্দনে। একটা ফিল্ম দেখতে গিয়েছিলাম। দেখলাম ওকে। সঙ্গে একজন বেশ বয়স্ক মহিলা ছিলেন। ছোট করে কাটা চুল। সামান্য উইয়ার্ড ড্রেস করেছিলেন। সো আই সেড, হাই!”
পলি বলল, “ছেলেটা বেশ। দেখতে অনেকটা ক্রিকেটার মণীশ পাণ্ডের মতো, না?”
বুদা বলল, “কী একটা লিটল ম্যাগের জন্য এসেছিল বলল। আরে, আমি তো নামটা কিছুতেই মনে করতে পারছি না! ও এদিকে আমায় ডেকে কথা বলছে! আই ফেল্ট সো অকোয়ার্ড!”
রাধিয়া চুপ করে রইল। ছেলেটা বুদার সঙ্গে কথা বলেছে! ওর কথা জিজ্ঞেস করেনি? কথাটা মনে হতেই নিজেকে ধমক দিল রাধিয়া। এসব কী ভাবছে ও! কেন জিজ্ঞেস করবে ওর কথা! একদিন স্টেশন থেকে নিয়ে একটা বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিল আর একদিন একটা নেমন্তন্নে দেখা হয়ে টুকটাক একটু কথা বলেছিল। তাতে তেমন তো আর পরিচয় হয়নি যে, ওর কথা জিজ্ঞেস করবে! তবে একটা দীর্ঘশ্বাস মনে মনে চাপল রাধিয়া, ছেলেটার পারফিউমটা খুব সুন্দর! কথাটা মনে পড়তেই চোখ বুজে এল। আর ওর সামনে ভেসে উঠল সেই আধো অন্ধকারে জড়িয়ে থাকা একটা গলি। তার ভেতর দিয়ে ডুবে ভেসে এগিয়ে যাচ্ছে একটা সাইকেল। আর সেই হলুদ পাঞ্জাবিটা হালকা হাওয়ায় উড়ছে প্রজাপতির মতো।
“তোর কথা জিজ্ঞেস করছিল জানিস?” বুদা এবার পিছন ফিরে তাকাল রাধিয়ার দিকে।
রাধিয়া সামান্য হাসল। ওর জানতে ইচ্ছে করছে কী জিজ্ঞেস করেছে, কিন্তু ও জানে বেশি কৌতূহল দেখালে পলি আর বুদা ওকে খুব জ্বালাবে!
বুদা বলল, “নিশান বলল, ‘আপনার সেই অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় বান্ধবী কেমন আছেন?’ তোকে এমন করে বলল কেন রে?”
রাধিয়ার ভুরু কুঁচকে গেল! এ আবার কেমন কথা! ও এর উত্তরে কিছু না বলে সামনে বসা মধুদাকে বলল, “ওই কালীঘাট ট্রাম ডিপো হয়ে যেয়ো তো মধুদা। পলি আর বুদা নামবে।”
“কেন, তুই নামবি না?” পলি পাশ থেকে অবাক হল।
“না রে,” ছোট করে বলল রাধিয়া, “আমার বাড়িতে একটু কাজ আছে। আসলে ঠাকুমাকে নিয়ে একটু বেরোব। ঠাকুমা বলেছিল, আমি ভুলে গেছি একদম।”
“যা,” পলি মাথা নাড়ল, “আমি জানি তুই মিথ্যে বলছিস। এত ঘরকুনো কেন রে তুই?”
“না রে, সত্যি বলছি,” রাধিয়া বলল, “ঠাকুমা একবার দোকানে যাবে জুতো কিনতে। আমাকেও যেতে হবে!”
“ও,” পলি চুপ করে গেল।
আচমকা গাড়িটা কেমন যেন নিঃশব্দ হয়ে গেল। গাড়ির কাচ তোলা। গুনগুন করে এসি চলছে। গাড়িটা টিপু সুলতান মসজিদের সামনের সিগনালে এসে দাঁড়িয়েছে!
বিকেল এবার ক্রমশ নরম হয়ে আসছে। সামনে গাড়ি আর বাস এমন করে গিঁট পাকিয়ে আছে, মনে হচ্ছে আর জীবনেও এই গিঁট খুলবে না!
জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল রাধিয়া। আর তখনই চমকে উঠল! আরে ওটা কে? বাবা না!
রাধিয়া ভাল করে ঘুরে বসল এবার। সত্যি দেখছে তো? বাবা-ই তো? হ্যাঁ, ঠিক। বাবা-ই! একটা সাদা সেডানের পেছনে বসে রয়েছে বাবা। কালো টি-শার্ট পরে আছে। আর পাশে ওটা কে? একজন মহিলা! ছোট করে, প্রায় ন্যাড়ার মতো করে কাটা চুল। শার্প ফিচার! বাবা মহিলার দিকে ফিরে কথা বলছে। কিন্তু বাবা এই শেষ বিকেলে কী করে কলকাতায় থাকতে পারে? বাবা তো বলেছে যে, ব্যাবসার কাজে নাগপুর গেছে। গত কালকেই তো বেরোল। তা হলে?
রাধিয়া কী বলবে বুঝতে পারল না। ও সিগনালের দিকে তাকাল। এখনও লাল। ওঃ, কিছুতেই সিগনালটা খুলছে না! মনখারাপের সঙ্গে কেমন একটা টেনশনও হচ্ছে ওর। মধুদা যদি দেখে ফেলে! কী হবে তা হলে! কী লজ্জা, কী লজ্জা!
এসির মধ্যে বসেও নিমেষে ঘেমে গেল রাধিয়া! মুখ-চোখ ভয় আর কষ্টে লাল হয়ে গেল! বাবা মিথ্যে বলে এমন করে বাড়ির বাইরে আছে কেন? ওই মহিলাই-বা কে? বাবাকে সারাক্ষণ গম্ভীর দেখে! কিন্তু ওই গাড়িতে বসে বাবা তো রীতিমতো হাসছে! আশপাশে কিছু খেয়ালই করছে না। দু’জন মানুষকে দেখলে বোঝা যায় তাদের সম্পর্কের ধাঁচটা কী। এখানে বাবাকে ‘মোর ইগার’ লাগছে! মহিলাটি তো শান্ত মুখে বসে আছে। চোয়াল শক্ত করে রইল রাধিয়া। মনে মনে ঠাকুরকে ডাকতে থাকল। বুকের ভেতরটা কেমন যেন ধড়াস ধড়াস করছে! এসব কতদিন ধরে চলছে? বাবা যে কাজে নেই সেটা তো স্পষ্টই। কাজে থাকলে আউট স্টেশন যাওয়ার নাম করে কলকাতায় থাকত না। এসব তো মা, ঠাকুমা জানে না। জানলে কী হবে! বাবা কি ওদের ছেড়ে চলে যাবে! আর মা? মা কী করবে?
“কী হয়েছে রে রাধি?” পলি পাশ থেকে জিজ্ঞেস করল।
রাধিয়া উত্তর দেওয়ার আগেই গাড়ি ছেড়ে দিল। ও ঘাড় না ঘুরিয়েও চোখের আড় দিয়ে দেখার চেষ্টা করল গাড়িটা কোথায়। নাঃ, গাড়িটা পিছিয়ে আছে। সামনের বড় দুটো বাস গড়িমসি করছে স্টার্ট নিতে। ও মনে মনে বলল, গাড়িটা আরও পিছিয়ে যাক।
ও মধুদাকে বলল, “জোরে চালাও মধুদা। আমায় তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে।”
“হোয়াটস রং?” পলি এবার রাধিয়ার হাত ধরে জিজ্ঞেস করল।
সামান্য হেসে মাথা নাড়াল রাধিয়া। ওর এত কষ্ট হচ্ছে যে, মনে হচ্ছে বুকের পাঁজরগুলো ইমপ্লোড করবে এখনই! মনে হচ্ছে কেউ ওকে জলে ডুবিয়ে দিয়েছে! এটা কী দেখল ও? এত বছর তা হলে যে বাবা ওদের সঙ্গে আছে, সেটা অভিনয়? নাকি… নাকি অন্য কোনও গল্প আছে? মানে ও যা ভাবছে, সেটা ঠিক নয়। মানে… কী মানে? রাধিয়ার হাত-পা ঘেমে উঠেছে। এটা বাড়িতে জানাজানি হয়ে গেলে সাংঘাতিক ব্যাপার হবে। তাই কাউকেই বলা যাবে না। কিন্তু ওকে তো জানতে হবে ব্যাপারটা কী! না জানলে ও নিজে শান্তি পাবে না। বাবাকে যে মুখোমুখি জিজ্ঞেস করবে, সেটাও ওর দ্বারা হবে না। বাবা এমন রাগী আর এমন করে নিজের রাগটা প্রকাশ করে যে, সেটার সামনে দাঁড়ানো ওর পক্ষে কঠিন।
এমন সুন্দর একটা বিকেল এক নিমেষে কী করে নষ্ট হয়ে গেল! সত্যি কোনও দিক দিয়েই জীবনে নিশ্চয়তা নেই। গাড়িটা যখন গিয়ে সিগনালে দাঁড়াল, তখনও কি ও বুঝতে পেরেছিল সামনে, এক মুহূর্ত পরে কী আসতে চলেছে ওর জীবনে?
পলি আরও কিছু জিজ্ঞেস করেছিল। বুদাও সামনের সিট থেকে পেছন ফিরে কিছু বলছিল। কিন্তু মাথায় কিছু ঢুকছে না রাধিয়ার। সারা শরীরে যেন লক্ষ লক্ষ ঝিঁঝি পোকা ডাকছে ওর! ব্যাপারটা কী! ওকে জানতেই হবে। কিন্তু কীভাবে জানবে?
কালীঘাট ট্রাম ডিপোর কাছে গাড়ি থেকে বুদা আর পলি নেমে গেল। অন্য সময় হলে পলি হয়তো জোর করেই রাধিয়াকে টেনে নামাত। কিন্তু আচমকা রাধিয়ার পরিবর্তন দেখে আজ আর কিছু বলল না। শুধু বুদা একবার বলল, “আমি তোকে বাড়ি অবধি পৌঁছে দিয়ে আসব?”
“আয়াম ওকে,” রাধিয়া ছোট্ট করে বলে গাড়ির দরজাটা বন্ধ করে দিল।
রাধিয়া খুবই শান্ত ধরনের। কখনও কারও সঙ্গে রূঢ় ব্যবহার করে না। কিন্তু আজ কিছুতেই রাধিয়া নিজেকে সামলাতে পারছে না। কেবলই মনে হচ্ছে এটা কী দেখল ও!
কালীঘাট ট্রাম ডিপো থেকে আলিপুর খুব কিছু দূর নয়। কিন্তু যেহেতু অফিস ছুটি হয়েছে এখন, লোকজন গিজগিজ করছে কলকাতায়, তাই গাড়িটা গোঁত্তা খেতে-খেতে চলছে। কিন্তু রাধিয়ার কিছুই যেন মনে আসছে না।
আকাশে আলো কমে এসেছে বেশ। বাড়ি ফেরার তাড়ার মাঝে শহরের চোখে-মুখে কেমন যেন একটা মনমরা ভাব। ভিড়ে নুইয়ে যাওয়া বাস, বদমেজাজি অটোর যেখানে-সেখানে নাক গলানো আর মোটরবাইকের ছোঁকছোঁক। অন্যদিন এসব দেখে রাধিয়া, কিন্তু আজ মনে হচ্ছে ওর সামনের শহরটাকে কে যেন একটা ধূসর জলরং করে দিয়েছে!
জাজেস কোর্টের সামনে দিয়ে গাড়িটা ডান দিকে বাঁক নিল। হর্টিকালচার ছাড়িয়ে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে বাঁ দিকে ওদের বাড়ি।
মধুদা গাড়িটাকে গেটের সামনে দাঁড় করিয়ে হর্ন দিল। আর তার শব্দে কেঁপে উঠল রাধিয়া। বাড়ি চলে এসেছে। আরে গালে কী? হাত দিয়ে দেখল রাধিয়া। জল। ও কাঁদছে। কিন্তু মাথা তো পুরো খালি হয়ে ছিল। তা হলে চোখে জল এল কেন? চিরদিন মনে মনে বাবাকে একটু বেশি ভালবেসেছে বলেই কি আজ এমন একটা শূন্যতা এসে ঢুকে পড়েছে ওর মধ্যে!
গেটটা খুলে দেওয়ায় গাড়িটা ঢুকে গেল ভেতরে।
পাথর বিছানো রাস্তায় ধীরে-ধীরে গাড়িটা থামল পোর্টিকোর তলায়। মধুদা নেমে দরজা খুলে দেওয়ার আগেই ও নিজে দরজা খুলে গাড়ি থেকে নেমে গেল। অন্যদিন বাড়িতে ঢোকার আগে মধুদাকে ‘আসছি’ বলে। কিন্তু আজ সেটাও বেরিয়ে গিয়েছে মাথা থেকে।
চারটে শ্বেতপাথরের ধাপ পেরিয়ে বড় হলঘরটায় ঢুকল রাধিয়া। ওর মন খুব অস্থির হয়ে আছে। সোজা স্নান করবে ও। অন্য কোনওদিকে তাকাবে না।
বড় হলঘরের একপাশ থেকে সিঁড়ি উঠে গিয়েছে দোতলার দিকে। রাধিয়া প্রায় দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গেল।
“রাধিদি,” পেছন থেকে বুজু ডাকল ওকে।
রাধিয়া দাঁড়িয়ে পড়ল। মাথা রীতিমতো টলছে ওর। সব কেমন যেন ঝাপসা লাগছে। গাড়ির ভেতর বসে থাকা খুব ছোট করে কাটা চুলের মহিলার মুখটা বারবার মনে পড়ছে ওর। কেন মনে পড়ছে? কেন আমরা যা ভুলতে চাই তাই বারবার মনে পড়ে? কেন খারাপ লাগাগুলো বস্তায় ভরে পার করে দেওয়া বিড়ালের মতো আবার ঠিক পথ চিনে ফিরে আসে আমাদের কাছে? কেন বারবার খারাপ দৃশ্য বিরক্তিকর বিজ্ঞাপনের মতো মনের মধ্যে ভেসে ওঠে? আমাদের মন, কিন্তু আমাদেরই পোষ মানতে চায় না। কেন? কষ্টের মধ্যে জীবনের কোন মাহাত্ম্য লুকিয়ে আছে? কী শেখাতে চায় সে আমাদের?
রাধিয়ার মনে হচ্ছে ও যেন এক অদৃশ্য জালে পেঁচিয়ে গিয়েছে। এই বাড়ি, এই বাবা-মা, এই সম্পর্ক। সব কিছুই যেন হাওয়ার তৈরি মনে হচ্ছে ওর।
“রাধিদি,” বুজু আবার ডাকল।
“ক-কী?” রাধিয়া কোনওরকমে পেছনে ঘুরল।
বুজু বলল, “দু’জন এসেছেন ঠাকুমার সঙ্গে দেখা করতে। এই এলেন। ঠাকুমা তো পুজোয় বসেছে, আমি গেলে বকবে এখন। তুমি যদি একবার বলে…”
রাধিয়া সিঁড়ির ওপর থেকে বসার ঘরে দূরে বসে থাকা দু’জনের দিকে তাকাল। কিন্তু কিছুই মাথায় ঢুকছে না ওর।
বুজু বলল, “একজন বললেন তোমায় চেনেন। ওই দূরে বসে আছেন। নাম বললেন…”
“আমি পারব না,” রাধিয়া কথাটা ছুড়ে দিয়ে কোনওরকমে দোতলায় নিজের ঘরের কাছে গেল। পেছন থেকে বুজু কিছু বলছিল, কিন্তু সেসব কথা কেমন যেন হাওয়ায় ভেসে গেল এদিক-ওদিক।
ঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে কাঠের পাল্লায় মাথা দিয়ে দাঁড়াল রাধিয়া। এবার কী করবে ও? মায়ের সামনে যাবে কেমন করে? কার কাছে গিয়ে বলবে এসব কথা! এমন অবস্থায় কি অন্য কিছু মাথায় ঢোকে! বুজুদি কি ওকে দেখে বুঝতে পারেনি ওর মনের মধ্যে কী চলছে! সেখানে কারা এসেছে সেই নিয়ে… আচমকা থমকে গেল রাধিয়া। বুজু কী বলল? দু’জন এসেছে নীচে আর তার মধ্যে একজন ওকে চেনে? আর নামটা? নামটা যেন কী বলল? রাধিয়া দুদ্দাড় করে চলে এলেও বুজুর কথার একটা খণ্ড কী করে যেন কানে ঢুকে পড়েছে ওর।
হতভম্বের মতো ঘরের অন্যদিকে রাখা বিশাল বড় আয়নায় নিজেকে দেখল রাধিয়া! এমন একটা দিনে কে এল ওদের বাড়িতে! বুজু যে নামটা বলল, সেই কি এসেছে? নিশান কি এসেছে আজ ওদের বাড়ি?
.
১৩. মাহির
কোথাও একটা ট্রান্সফরমার বার্স্ট করেছে! সারা পাড়া ডুবে আছে রোঁয়াওঠা ফুটো কম্বলের মতো অন্ধকারের তলায়।
বোচনদার দোকানে একটা ব্যাটারির লাইট জ্বলছে। সামনের ধোপা বাড়িতেও হারিকেনের আলো দেখা যাচ্ছে! পরানদার দোকানে জ্বলছে ইমার্জেন্সি ছোট টিউব। এ ছাড়া আশপাশের বাড়ি থেকে ছিটকে আসা মোমবাতির আলোর কুচি ভেসে আছে দূরে।
আকাশে মেঘ করে আছে বেশ। জুনের আট তারিখ আজ। বর্ষা আসার কথা। কিন্তু আকাশে মেঘটুকুই করে আছে শুধু, বৃষ্টির দেখা নেই।
ক’দিন খুব ভ্যাপসা গরম পড়েছে। ওদের নিচু সিলিং-এর টালির বাড়িটা পুরো ফার্নেস হয়ে আছে যেন। ভাইয়ের এত কষ্ট হচ্ছে!
ওদের পাড়ায় বেশির ভাগই টালির বাড়ি। কিন্তু আজকাল দেখছে অনেকেই এসি লাগিয়ে নিচ্ছে। কোথা থেকে টাকা পায় এরা? এসি লাগায় কী করে? ওর তো নিজের হাতখরচ তুলতে কালঘাম ছুটে যায়!
কিটব্যাগটা এক কাঁধ থেকে অন্য কাঁধে নিল। আজ ম্যাচ ছিল। ড্র হয়েছে। সেকেন্ড ডিভিশনে এখন ওরা চতুর্থ হয়ে আছে। আজ ভালই খেলেছে মাহির। শুধু ম্যাচ শেষের একটু আগে ওদের ন’নম্বরটা এমন করে পা চালাল! শিন বোনের কাছে বেশ লেগেছে। কালশিটে পড়ে গিয়েছে।
মাহির শেষমুহূর্তে পা-টা সরিয়ে নিয়েছিল, কিন্তু তাতে খুব লাভ হয়নি কিছু।
ম্যাচের পরে মাঠের ধারে বসে কালশিটে পড়া জায়গাটা দেখছিল মাহির। বুট খুলে রেখেছিল পাশে। সুমিত টাকা না ধার দিলে এটা কিনতেই পারত না। দেখেছিল, পতাদা এগিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে সামনে।
মাহিরের মাথাটাই গরম হয়ে গিয়েছিল। এই এসে গিয়েছে ঢপবাজ! সারাক্ষণ বাতেলা! স্পনসর! রিক্রুট! শালা যেন নির্বাচনের আগের প্রতিশ্রুতি! আর এমন মাথার ওপর এসে দাঁড়ানোর কী হয়েছে? বুকে উঠে পড়বে নাকি?
পতাদা বলেছিল, “কী করিস? পা-টা সরাতে পারলি না? চোট খেয়ে গেলি? পরের ম্যাচে নামতে পারবি তো?”
“পরের ম্যাচ তো সামনের সপ্তাহে,” বিরক্তিটাকে লুকিয়ে কোনওমতে বলেছিল মাহির।
পতাদা মাথা নেড়ে বলেছিল, “তোদের ফিটনেস এত কম! আমাদের সময়ে আমরা যা ফিট ছিলাম না! দুটো-তিনটে ভল্ট মারা কোনও ব্যাপারই ছিল না! একবার সেই মজিদ বাসকারের পা থেকে এমন করে বল কেড়ে নিয়েছিলাম যে, মজিদ পরে বলেছিল আমায়, এমন স্ট্যান্ডার্ডের প্লেয়ার ও খুব বেশি দেখেনি!”
মাহির কী বলবে বুঝতে না পেরে পতাদার পেছনে বসা সুমিতকে দেখছিল। সুমিত মাটিতে শুয়ে পেটে হাত চেপে হাসছিল! পতাদা যে মারাদোনার নাম করেনি, এটা ওদের চোদ্দো পুরুষের ভাগ্য!
মাহিরের হাসি পাচ্ছিল না। পায়ের ব্যথা, বাড়িতে টেনশন, এসবের মাঝে এইসব আলুছালু কথা ভাল লাগছিল না ওর!
ও বলেছিল, “তোমার ক্লাবের স্পনসরের কী হল? সেই সিমেন্ট কোম্পানি আসবে না? আমরা তো জান-প্রাণ দিয়ে খেলছি। সেই বারো নম্বর থেকে চারে উঠে এলাম। প্লাস যারা ট্রায়াল দেখতে এসেছিল, তারা কই? এভাবে আর কতদিন যাবে পতাদা?”
পতাদা ভুঁড়িটাকে জামা দিয়ে ঢাকতে ঢাকতে বলেছিল, “আরে, আসবে, হবে। এখনই অস্থির হলে চলবে? ফুটবল হল তপস্যা। সেখানে ফলের আশা করতে নেই। ধর্মকথায় পড়িসনি?”
মাহির মাথা নেড়ে উঠে পড়েছিল। একে বলে লাভ নেই। শালা, গোটা জীবনটা বেকার হয়ে গেল! এই ছাব্বিশেই মনে হয় ছেচল্লিশ হয়ে গিয়েছে ওর! সকালে ঘুম ভাঙলে মনে হয় আজ কেন ঘুম ভাঙল? মনে হয়, আজকের দিনটা ও বাঁচবে কেন?
ওদের পাড়ায় ওর বয়সি ছেলেদের দেখে মাহির! সারাক্ষণ রাস্তায় দাঁড়িয়ে গুলতানি করছে। নানারকম স্টাইলে মাথার চুল কাটা। হাতে-পায়ে ট্যাটু। চোখে সন্ধেবেলাতেও সানগ্লাস! সারাক্ষণ হ্যা-হ্যা করে চলেছে।
ওর মাঝে মাঝে রাগ হয়। কেন ও এমন হতে পারে না? এমন হতে পারলে কী যে ভাল হত! স্যার বলতেন, “অগভীর মানুষ অমানুষের মতো!”
এটা সত্যি না মিথ্যে জানে না মাহির, শুধু এটুকু মনে হয়, সেটা হতে পারলে ও হয়তো বেঁচে যেত। নিজের গভীরতায় মানুষ অধিকাংশ সময় নিজেই ডুবে মরে!
পতাদা আরও কিছু বলেছিল। কিন্তু সেসব আর ভাল করে শোনেনি! কী হবে শুনে? পেট ভরবে?
আজ সুমিত ওকে বাইকের পেছনে বসিয়ে লিফট দিয়েছিল। ময়দান থেকে বেরিয়ে হরিশ মুখার্জি দিয়ে ফিরছিল ওরা।
নিজের কথা অন্যকে বলতে খারাপ লাগে মাহিরের। কিন্তু একটা-একটা করে দিন চলে যাচ্ছে, এদিকে কিছুই হচ্ছে না! প্রতিটা দিন যেন ইটের মতো ওকে গেঁথে ফেলছে দেওয়ালের সঙ্গে!
বাইকের পেছনে বসে ও সুমিতকে বলেছিল, “আমার কোনও কাজকর্ম হতে পারে রে?”
মাথা না ঘুরিয়েই সুমিত বলেছিল, “কী কাজ করতে চাস?”
“যা বলবি,” মাহির বলেছিল, “আমার যা হোক একটা কাজ পেলেই হবে। তোর দাদার ফ্যাক্টরিতে কিছু একটা করে দে ভাই। ঝাঁট-টাট দিতে হলেও আমার আপত্তি নেই!”
“কী সব বলছিস তুই?” সুমিত অবাক হওয়ার চেয়ে বেশি বিরক্ত হয়েছিল যেন!
“বাড়িতে খুব ঝামেলা রে। মানে টাকাপয়সার এমন অবস্থা! ভাইটা… ভাইটার কিডনির অসুখ ধরা পড়েছে। খালি ঘুরে-ঘুরে জ্বর আসছিল। ডাক্তার পরীক্ষা করতে দিয়েছিল নানারকম। সেখানেই ধরা পড়েছে। কিডনি কাজ করছে না। ডায়ালিসিস করাতে হবে। তারপর সম্ভব হলে কিডনি বদলাতে হবে।”
“সে কী রে!” সুমিতের গলা শুনে মাহির বুঝতে পেরেছিল যে ও সত্যি চমকে গিয়েছে!
সুমিত বলেছিল, “এসব কবে হল? বলিসনি তো!”
মাহির দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল, “সারাক্ষণ আর কত খারাপ কথা বলি বল তো!”
সুমিত বলেছিল, “আমি দাদাকে বলছি। আমার এত খারাপ লাগছে শুনে! অন্য কোনও কাজ পাচ্ছিস না?”
সামনে বাঁকটা ঘুরলেই বাঁ হাতে মাহিরের বাড়ি। আজকাল বাড়িতে ফিরতে কষ্ট হয় ওর। ভাইটাও এমনিতেই স্বাভাবিক নয়। তারপর এমন অসুস্থ! পা ফুলে যাচ্ছে! চোখ-মুখ ফুলে যাচ্ছে! চোখে দেখা যায় না!
মায়ের আয়ার কাজ থাকে। সংসারের মূল রোজগার সেটাই। তাই মাকে তো বেরোতেই হয়। পাশের বাড়ির তুয়াদি ভাইয়ের কাছে থাকে।
তুয়াদি সেলাইয়ের কাজ করে। বিয়ে করেনি। প্রায় পঁয়ত্রিশ হল। আর বিয়ে করবে বলে মনেও হয় না। তুয়াদির একটা পা আর-একটা পায়ের চেয়ে সামান্য ছোট। দেখতে সুন্দর হলেও ওই কারণে তুয়াদির বিয়ে হয়নি।
তুয়াদি মুখরা খুব। কিন্তু ভাইকে ভালবাসে। তাই ভাইয়ের শরীর খারাপের কথা শুনে নিজেই বলেছিল যে, মা যতক্ষণ থাকবে না, ও ভাইয়ের কাছে থাকবে!
তুয়াদির ব্যপারাটা ঠিক বোঝে না মাহির। একদিকে মাহিরকে বকাঝকা করে। এই যে ফুটবল খেলে! এই যে এখনও ভাল করে কাজকর্ম পায়নি, এটা নিয়ে তুয়াদি খুব কথা শোনায়। আবার অন্যদিকে কেমন করে যেন তাকায়। গায়ে হাত দেয়। বুকে হাত বোলায়! আচমকা নিজের ভরাট বুকটা চেপে ধরে মাহিরের শরীরের সঙ্গে!
মাহিরের রাগ হয়। কিন্তু কিছু বলে না! এসব নিয়ে বলা যায় না কিছু। আর সত্যি বলতে কী, আজকাল কাউকেই কিছু বলতেও আর ইচ্ছে করে না ওর। কারও সঙ্গে দরকারের চেয়ে একটা বেশি শব্দও খরচ করতে ইচ্ছে করে না। যে যা বলে মেনে নেয়।
এখনও তুয়াদি ভাইয়ের কাছে আছে। আজ মায়ের দুটো দশটার কাজ। আসতে দেরি হবে। তুয়াদি আবার ওকে একা পেয়ে গালাগাল দেবে সেভাবে কাজের চেষ্টা করছে না বলে। নাকি অন্য কিছু করবে, জানে না!
মাহিরের আবার সুমিতের কথাটা মনে পড়ল। কাজ কি একদম পাচ্ছে না? পাচ্ছে, কিন্তু সেটা কেমন কাজ মাহির ভাল করে জানে!
রিতুদা ওকে আজকাল প্রায়ই ডেকে পাঠায়। সব সময় না গেলেও মাঝে মাঝে তো যেতেই হয়। তখন খুচখাচ কাজ করে দিতে বলে ওকে।
এই তো কিছুদিন আগে টিটির সঙ্গে ওকে রাজারহাটের ওদিকে যেতে হয়েছিল। একটা পেমেন্ট আনার ব্যাপার ছিল।
রিতুদা নিজেই ডেকে বলেছিল টিটির সঙ্গে যেতে।
মাহিরের ভাল লাগছিল না। কিন্তু ও বোঝে, রিতুদার মতো মানুষেরা ‘না’ শব্দটা শুনতে পছন্দ করে না।
তাও মাহির অনিচ্ছার গলায় বলেছিল, “দাদা, আমার তো আজ বিকেলে প্র্যাকটিস আছে… তাই…”
“তাতে কী?” রিতুদা হেসেছিল খুব। পান-খাওয়া দাঁতগুলো বেরিয়ে পড়েছিল। কাঁধ থেকে তোয়ালেটা নিয়ে মুখ মুছে বলেছিল, “ওই তো বালের খেলা তোদের! তার আবার প্র্যাকটিস! এতদিন খেলে কী করলি মাহির? আমাদের দেশে ইনডিভিজুয়াল স্পোর্টস ছাড়া কেউ কোনও কিছুতে সাকসেস পাবে না। ক্রিকেট টিম গেম হলেও দ্যাখ, ইন্ডিভিজুয়াল কিন্তু আসলে। এত চুকলিবাজি! এত পলিটিক্স! সেখানে ফুটবল! নিম্নমধ্যবিত্তদের খেলা! ছাড়, আজ যাবি টিটির সঙ্গে। আমার বাকি ছেলেপুলেরা আজ নেই। তুই যাবি, টাকাটা নিবি, তারপর মোবাইলে গাড়ি বুক করে চলে আসবি। ক্লিন কাজ। লাফড়া নেই। বুঝলি?”
টিটি বসেছিল ঘরের এক কোণে। ও বলেছিল, “হ্যাঁ রিতুদা, কোনও চাপ নেই। ও যাবে। আমরা ঠিক নিয়ে আসব!”
মাহির অনিচ্ছার সঙ্গে রাজি হয়েছিল।
রিতুদা একটা পাঁচশো টাকার নোট ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিল, “ধর এটা। আর-একটা জিনিস।”
কথাটা শেষ না করে রিতুদা পাশের ড্রয়ার টেনে তাতে হাত ঢুকিয়েছিল। তারপর হাতটা বের করে এনে টেবিলে রেখেছিল একটা খাপ। তার থেকে পিস্তলের বাঁটটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল মাহির! ওর বুকের ভেতরটা কেঁপে গিয়েছিল! এসব কী!
“অনেক টাকা… এটা রাখ, চালিয়েছিস কোনওদিন?” রিতুদা এমন করে জিজ্ঞেস করছিল যেন স্কুলপাঠ্যে এসব শেখানো হয়।
“না, না,” মাহির আঁতকে উঠেছিল, “এসব… প্লিজ় না…”
“যাঃ শালা! সতীপনা করছিস কেন? প্যান্টে মুতে দিলি নাকি যন্ত্র দেখে?”
“এর দরকার নেই রিতুদা, আমি এমনি নিয়ে আসব,” মাহির নিজেকে শান্ত করে কেটে-কেটে বলেছিল কথাগুলো।
রিতুদা তাকিয়েছিল মাহিরের দিকে। তারপর বলেছিল, “ডাইনোসর থেকে ম্যামথ থেকে সেবর টুথড টাইগার, সবাই এত শক্তিশালী হয়েও কেন বল তো পৃথিবী থেকে হাপিশ হয়ে গেল? কারণ, কেউ ওরা সময়ের সঙ্গে নিজেদের পালটাতে পারেনি। কেউ পারেনি। মানুষ এই একমাত্র একটা কারণে নিজেকে এত ভয়ংকর জন্তু আর প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে বাঁচিয়ে সারা পৃথিবীকে কবজা করেছে। নিজেকে পালটাতে শেখ মাহির। না হলে জাস্ট হাওয়া হয়ে যাবি। বুঝলি!”
কাজটাতে গিয়েছিল মাহির। কোনও অসুবিধে হয়নি। ক্যাশ গুনে হিসেব মিলিয়ে টাকা নিয়ে ফেরার গাড়ি ধরেছিল।
টিটি ওর নতুন কেনা ফোন থেকে বুক করেছিল একটা গাড়ি। শেয়ারের গাড়ি। তারপর সারাটা পথ পুটুরপুটুর করে রিতুদার গুণকীর্তন করতে-করতে এসেছে! ওঃ, এত বিরক্ত লাগছিল মাহিরের!
মাঝপথে একজন খুব সুন্দরী স্টাইলিশ দেখতে ভদ্রমহিলা উঠেছিল গাড়িতে। মাহির সংকুচিত হয়ে বসেছিল। মেয়েদের দেখলেই কেমন যেন নার্ভাস হয়ে যায় ও। আসলে রেশমি চলে যাওয়ার পর থেকেই মেয়েদের ব্যাপারে নড়বড়ে হয়ে গিয়েছে মাহির!
টিটিকে চাপা গলায় সাবধান করেছিল, টিটি যাতে গালাগালি না দেয়! কিন্তু টিটি কি আর ওর কথা শোনার ছেলে! এমন সব কথা বলছিল যে, কান লাল হয়ে গিয়েছিল মাহিরের। তবে কাজ সেরে ফেরার পর রিতুদা আরও পাঁচশো হাতে দিয়েছিল ওর। এবার আর আপত্তি করেনি মাহির। বুঝতে পারছিল, আপত্তি করে লাভ নেই।
দরজায় টোকা দেওয়ার একটু পরে তুয়াদি এসে খুলে দিল দরজাটা। লোডশেডিং-এর জন্য ঘরে একটা মোমবাতি জ্বলছে। ভাই পাশের খাটে চুপ করে শুয়ে আছে। দেওয়ালের দিকে মুখ। ঘুমোচ্ছে বোধহয়। পাশে রাখা হাতপাখা দেখে মাহির বুঝল তুয়াদি ভাইকে হাওয়া করছিল।
ওদের দুটো ঘর। এই ঘরটা বড়। পাশের ছোট ঘরে মাহির থাকে। সেখানে একটা চৌকি আছে। আর একটা আলনা। চৌকিটা একটু উঁচু। তার তলায় লোহার ট্রাঙ্কে মাহিরের জিনিসপত্র থাকে। বারবার ট্রাঙ্ক খুলে জিনিস বের করতে হয়। খুব অসুবিধে হয় মাহিরের। কিন্তু উপায় নেই।
বড় ঘরে ঢুকে একপাশে চটিটা খুলে রাখল। তারপর কিটব্যাগটা টিনের ভাঁজ করা চেয়ারের মাথায় ব্যালেন্স করে বসিয়ে তুয়াদিকে জিজ্ঞেস করল, “কারেন্ট কখন গেল তুয়াদি?”
তুয়াদি সেটার উত্তর না দিয়ে বলল, “তোর মোবাইল খারাপ?”
“কেন?” অবাক হল মাহির।
“আরে, ওই টিটিটা এসেছিল। তোকে নাকি মোবাইলে ফোন করে পাওয়া যাচ্ছে না!” তুয়াদির গলায় হালকা বিরক্তি।
আসলে তুয়াদি টিটিকে পছন্দ করে না। কারণ, টিটি একবার মদ খেয়ে এসে তুয়াদিকে প্রপোজ় করে বসেছিল!
তুয়াদি এত রেগে গিয়েছিল যে, পায়ের চটি খুলে ছুড়ে মেরেছিল টিটিকে।
টিটির তাতে অবশ্য হেলদোল খুব কিছু হয়নি! টিটির নেশা কেটে যাওয়ার পরে মাহির খুব বকেছিল টিটিকে। বলেছিল, “এটা কী করেছিস তুই? এমন অসভ্যতা কেউ করে? কত বড় বল তো তোর চেয়ে?”
টিটি হেসে বলেছিল, “আরে, খচে যাচ্ছিস কেন? বড় তো কী হয়েছে! আজকাল ম্যাক্সিমাম ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা বড়ই হয়! এতে তো অসুবিধে নেই। প্লাস ভাবলাম, বিয়ে-টিয়ে করেনি। বয়স বয়ে যাচ্ছে। ওসবের ইচ্ছে-ফিচ্ছে তো সবারই হয়। ওরও নিশ্চয় হয়। তাই আমি… মানে এটা সোশ্যাল ওয়ার্ক বলতে পারিস! আমার থোবড়টা আমির খানের মতো না হলেও ফিলিংস-এ আমি কিন্তু দিলীপ কুমার! তাই ওর কষ্টের কথা ভেবে…”
মাহির জানে টিটির সঙ্গে কথা বলা বৃথা!
“কী রে, কী বলছি?” তুয়াদি এসে ধাক্কা দিল।
“না গো, আসলে,” মাহির ঢোঁক গিলল, “আমার মোবাইলটা গেছে। এতদিন গার্টার বেঁধে কাজ চালাচ্ছিলাম। কিন্তু আজ আর কিছুতেই কাজ করছে না!”
“অপদার্থ একটা!” তুয়াদি দাঁতে দাঁত ঘষল।
মাহির মনে মনে বলল, নাও, শুরু হল আজকে! তুয়াদির ক্রিটিকাল অ্যাপ্রিশিয়েশান চালু!
তুয়াদি বলল, “এমন গাবুরের মতো চেহারা, কিন্তু একটা অপদার্থ! এখন তোর রেশমি কোথায়? যার জন্য সব ছেড়ে ক্যালানে হলি সে কোথায়! আমাদের বস্তিতে কেউ তোর মতো লেখাপড়ায় ছিল? ছিল না… শালা, একটা মেয়ের পাল্লায় পড়ে… আমি তোকে নিয়ে যে কী করব!”
“তুয়াদি, ভাই ঘুমোচ্ছে!” মাহির আর কীভাবে তুয়াদিকে চুপ করাবে ভেবে পেল না।
তুয়াদি অনেক কষ্টে নিজেকে আটকাল। আঁচল দিয়ে মুখের ঘামটা মুছে আচমকা এগিয়ে এসে প্যান্টের চেনের কাছটা খপ করে চেপে ধরে বলল, “তোর চেহারাটা এমন, কিন্তু ভেতরটা এমন ম্যাদামারা কেন? তোর সব যন্ত্রপাতি ঠিক আছে তো?”
এসব কী বলছে তুয়াদি! মাহির চমকে উঠে পিছিয়ে এল। দেখল, তুয়াদি কেমন অদ্ভুতভাবে তাকাচ্ছে ওর দিকে!
তুয়াদি চোয়াল শক্ত করে বলল, “একদিন দেখব তোর সব ঠিক আছে কি না। কতদিন পালিয়ে থাকবি! এখন আর না বসে ওই রিতুদার অফিসে যা একবার। ডেকেছে। টিটি সেই কথাটাই বলতে এসেছিল।”
মাহির কী বলবে বুঝতে পারল না! এটা কী বলল তুয়াদি! কী করল! দিনকে দিন কেমন হয়ে যাচ্ছে সব মানুষজন!
তুয়াদি বলল, “কী হল যা। দাঁড়িয়ে কী দেখছিস? যা।”
মাহির আর কথা বাড়াল না। আবার বেরিয়ে পড়ল রাস্তায়। খিদে পেয়েছে ওর। আগে খেলার শেষে ওদের ক্লাব থেকে খাওয়াত। এখন সেটাও কয়েকটা ম্যাচ হল বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সুমিত বলেছিল রোল খাওয়ার কথা। কিন্তু বারণ করেছিল মাহির। এর আগেও দু’দিন রোল আর মোমো খাইয়েছে সুমিত। রোজ-রোজ একজনের কাছ থেকে খাওয়া যায় নাকি?
কিন্তু এখন পেটের ভেতর বেজি ঘুরছে মনে হচ্ছে। কেমন একটা চাপ লাগছে। কিন্তু পকেটে পড়ে আছে আঠারো টাকা। দু’টাকার মুড়ি আর একটু বাদাম খাওয়া যেতে পারে। মা এখনও মাইনে পায়নি এই মাসের।
মাহিরের মাঝে মাঝে মনে হয় বোমার মতো ও যদি ফেটে পড়তে পারত! শরীরে এত বারুদ জমে আছে! এত যন্ত্রণা ঠেসে ভরা আছে! তাই মনে হয় মাথাসমেত গোটা শরীরটা ফেটে পড়লে বেঁচে যেত ও। মনে হয় তা হলে হয়তো এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পেত।
আগে ভগবানে বিশ্বাস ছিল না মাহিরের। মনে হত ওসব দুর্বল মানুষের লাঠি! ভণ্ডদের ব্যাবসা করার হাতিয়ার! কিন্তু আজকাল কেবলই মনে হয় কেউ একটা তো আছে! না, সে ছেলে না মেয়ে সেটা জানে না, কিন্তু আছে তো কেউ!
যেদিন ভাইয়ের রোগটা ধরা পড়ল, সেদিন রাতে নিজের ওই খুপরিমতো ঘরের জানলার পাশে শুয়ে বাইরের দিকে তাকিয়েছিল মাহির। ছোট টালির একতলা বাড়ি পাশাপাশি গাদাগাদি করে আছে। তাই জানলা থেকে এখনও আকাশ দেখা যায়।
সেই ধোঁয়াটে আকাশের দিকে তাকিয়ে শুয়ে ছিল মাহির। সামান্য কিছু জেদি তারা ওই ধুলোর চাদর ভেদ করেও যে-সামান্য আলো পাঠাচ্ছিল, সেই আলোর দিকে তাকিয়ে মাহিরের মনে হয়েছিল, ভগবান নিশ্চয়ই আছে! এই ছাব্বিশ বছরের জীবনেই এমন নানা কষ্ট, যন্ত্রণা আর কঠিন সময় কখনও এমনি-এমনি হতে পারে না। নিশ্চয়ই এর পেছনে কারও সুপরিকল্পিত ব্যবস্থা আছে। কথাটা ভেবে ওই অন্ধকারে, ওই বিপদের সময়ও হাসি পেয়েছিল মাহিরের। মনে হয়েছিল, মানুষ কিছু পেয়ে বা কোনও বিপদ থেকে বেরিয়ে এসে ভগবানের উপস্থিতিতে বিশ্বাস করে, কিন্তু ওর জীবনে অসাফল্য, কষ্ট আর খারাপ হওয়ার পর ওর ঈশ্বরবিশ্বাস এল!
এখনও রাস্তায় বেরিয়ে আকাশের দিকে তাকাল মাহির। লালচে হয়ে আছে আকাশ। তাই আগের চেয়ে অন্ধকার কিছুটা হলেও কেটেছে। ওদের অঞ্চলের লাগোয়া একটা বিহারি বস্তি আছে। এই আধো-অন্ধকারে কয়েকটা বাচ্চা রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে এলোমেলোভাবে। দাঁড় করিয়ে রাখা গাড়ি ঘিরে ওরই বয়সি কয়েকটা ছেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বিরক্তি লাগল মাহিরের। সবাই জানে ওই ছেলেগুলো মদ আর গাঁজা খায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে, কিন্তু কারও কোনও হুঁশ নেই। প্লাস্টিকের বোতলে জলের সঙ্গে মিশিয়ে রাখা মদ সকলের সামনেই খায়। হল্লা করে। কেউ কিছু বলে না ওদের। আসলে কে কী বলবে, এই ছেলেগুলোর মাথার ওপর রিতুদার হাত আছে!
ওর বাড়ি থেকে রিতুদার অফিস খুব কিছু দূর নয়। মাহির ধীরেসুস্থে হাঁটতে লাগল। খিদেটা চাগাড় দিচ্ছে ভালই। শরীরটাও বুজে আসছে ক্লান্তিতে! এখন কার ভাল লাগে এইসব লোকের সামনে যেতে! মা-ও জানলে রাগ করবে। মা কিছুতেই ওকে রিতুদার কাছে যেতে দেয় না। বলে, “একবেলা না খেয়ে থাকব, কিন্তু তুই যাবি না!” কিন্তু একবেলা না খেয়ে থাকা এক জিনিস, আর ভাইয়ের চিকিৎসা আর-এক জিনিস। টাকা খুব দরকার এখন ওদের।
মাহির আকাশের দিকে তাকাল। সেই জন কি সত্যি বসে, দাঁড়িয়ে বা শুয়ে আছে আকাশের ওপারে? ওকে কি দেখতে পাচ্ছে? কেন শুধু ওকে বাঁশ দিয়ে আনন্দ পায় মানুষটি? ওর জীবনে ভাল কিছু কি হতে পারে না? এমন কিছু কি ঘটতে পারে না, যার ফলে ওর মনে হবে সামান্য হলেও ওরও বেঁচে থাকার একটা মানে আছে? একটা কারণ আছে?
অফিসের বাইরে একটু দূরে টিটি দাঁড়িয়েছিল। আবছায়া হলেও মাহিরের চিনতে ভুল হল না। ওরকম ঝাঁকড়া চুল আর পাঁকাটির মতো শরীর কলকাতায় আর কারও আছে কি না সন্দেহ!
টিটিও দেখেছে ওকে, “ওই মাহির!” হাত তুলে ওর কাছে প্রায় দৌড়ে এল ছেলেটা। তারপর ওর হাত ধরে বলল, “শালা, তুই কী করছিস? তোকে ফোন করলে পাওয়া যায় না কেন?”
“জানিস না, খেলা ছিল আজ আমার?”
মাহির দেখল টিটির হাতে একটা রোল। সবে দু’-এক কামড় খেয়েছে।
টিটি বলল, “তোর ওই বেকার খেলা! আর খেলছিস তুই, তো ফোনটা অফ করে রেখেছিস কেন?”
মাহির সময় নিল একটু তারপর টিটির হাত থেকে রোলটা নিয়ে নিল আচমকা। কামড় মেরে বলল, “ফোনটা ভোগের বাসি হয়েছে! পরানদাকে দেখাব একবার।”
টিটি প্যান্টে হাত মুছে বলল, “শালা, হবে না? সিপাহি বিদ্রোহের সময়কার ফোন! একটা নতুন মোবাইল কিনে ফেল আমার মতো।”
“বোকার মতো কথা বলিস না!” মুখভরতি খাবার নিয়ে কোনওমতে বলল মাহির।
টিটি হাসল, “তোর খিদে পেয়েছে?”
মাহির রোলটা শেষ করে বলল, “আচ্ছা, মানুষ অন্য জিনিস এতগুলো করে খায়, কিন্তু কোল্ড ড্রিঙ্ক এক বোতল আর রোল একটা খায় কেন?”
“সে আমি কী জানি!” টিটি বলল, “তোকে ফোন করতে-করতে দিমাগ ঘেঁটে গিয়েছে আমার! ওদিকে নকুর শালা এক লোচা হয়েছে।”
নকু! মাহিরের সামান্য সময় লাগল ব্যাপারটা মনে করতে। ও, সেই ছেলেটা। বাইকে করে ওকে একদিন নিয়ে এসেছিল। সামনের চুলটা ব্রোঞ্জ রঙে রাঙানো!
“কী হল আবার?”
টিটি বলল, “আরে, নকুর এক আধপাগলা দাদা আছে। বই বিক্রি করে। তাকে আজ পুলিশে ধরেছে। লেক মার্কেটে বই নিয়ে ঘুরছিল। কে একটা লোক নাকি বই কিনে কম পয়সা দিয়েছে। তাকে কলার ধরে মেরেছে পাগলাটা! কাছেই পুলিশ ছিল, মালটাকে ধরে থানায় নিয়ে গিয়েছে। জানিস, লেখাপড়া করা মানুষ, কিন্তু মাথাটা মায়ের ভোগে পুরো! এইমাত্র ফোন করল নকু। রিতুদাকে বলতে হবে।”
মাহির কী বলবে বুঝতে পারল না!
“যাক গে,” টিটি বলল, “চল। রিতুদা একটা কাজ দেবে তোকে। একজন এসেছে।”
ওই রোলটা খেয়ে খিদেটা যেন আরও চাগাড় দিয়ে উঠল। খিদে পেলে মাহিরের কষ্ট হয় খুব। ওর মনে হল আশপাশের গাছপালাগুলোকে ধরে ধরে খেয়ে নেয়! কিন্তু তারপরেই মনে হল, ভাই কি কিছু খেয়েছে! ওর তো খাবারের এখন খুব কড়াকড়ি। সব কিছু তো খেতে পারে না। মা রান্না করে রেখে যায়, কিন্তু তুয়াদি কি দিয়েছে খাবার?
“আর দাঁড়াস না, চল…” টিটি মাহিরকে ঠেলল।
আশপাশের অন্ধকারের মধ্যে রিতুদার অফিসটা যেন বিয়েবাড়ির প্যান্ডেল! দুটো ইনভার্টার আছে অফিসে। বেশ বড়। এসিও চলে। তবে এসিটা আছে রিতুদার ঘরে।
সত্যি বলতে কী, এইসব দেখে তাক লেগে যায় মাহিরের। ক্লাস নাইন পাশ রিতুদা। আগে ট্যাক্সি চালাত। সেখান থেকে কী করে যে আজ এই জায়গায় এল কে জানে! চারিদিকে এত মানুষের এত সাফল্য দেখে খুব অবাক হয় মাহির। কী করে লোকজন টাকা রোজগার করে ও জানে না। কোন পথে হাঁটলে বাধ্য ছেলের মতো টাকাপয়সা ঢোকে পকেটে?
অফিসের ভেতরে ঢুকল মাহির। আজও কয়েকজন বসে আছে। তবে বাইরে গুমোট বলে, আজ ভেতরে ফ্যানের তলায় বসে রয়েছে লোকজন।
মাহিরের বড়সড় চেহারাটা সবাই চেনে। সবাই জানে রিতুদা বিশেষ পছন্দ করে মাহিরকে। লোকজন একটু খাতিরের চোখে তাকাল মাহিরের দিকে। মাহির পাত্তা দিল না। এগুলোকে দেখলে গা জ্বলে! কাজের কাজ কিছু নেই শুধু বসে বসে বিনে পয়সায় চা-মুড়ি খাওয়ার ধান্দা! ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে শুধু নিজেদের মাতব্বর ভাবা!
মাহির রিতুদার চেম্বারের বাইরে দাঁড়িয়ে দরজায় নক করল।
“আয়,” রিতুদার গলা পেল মাহির।
দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকল ও। আর সঙ্গে-সঙ্গে শরীর জুড়িয়ে গেল যেন। চেম্বারের ভেতরটা কী ঠান্ডা! নিজের অজান্তেই চোখ যেন বুজে এল মাহিরের। কিন্তু তারপর চোখ খুলেই কেমন একটা ধাক্কা লাগল! আরে বাবা, সামনে কে বসে রয়েছে! সেই মেয়েটা!
মাহিরের গলা শুকিয়ে গেল নিমেষে। মেয়েটা ওকে মাথা ঘু্রিয়ে দেখল। মেয়েটাকে দেখেছিল বেশ কিছুদিন আগে গড়িয়াহাটার কাছে। টিটির অটোয় বসে ছিল ও। আর মেয়েটা আরও কয়েকজন মেয়ের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিল রাস্তায়! মেয়েটা ওর দিকে তাকিয়েছিল। মাহিরের মনে হয়েছিল মেয়েটা চিনতে পেরেছে নিশ্চয়ই। তাই দোনোমোনো করে, সামান্য হেসেছিল মাহির। আর অবাক হয়ে দেখেছিল মেয়েটা মুখ ঘুরিয়ে নিল। এত অপমান লেগেছিল ওর! মনে হচ্ছিল চলন্ত অটো থেকে লাফ মেরে মাটির তলায় ঢুকে যায়!
মনের ভেতরে বিষ ছড়িয়ে পড়েছিল যেন! নিজেকে চড়াতে ইচ্ছে করছিল। পাশে বসা টিটিকে নিচু স্বরে বলেছিল কথাটা, “শালা, আমায় চিনল না!”
টিটি হলদে দাঁত বের করে বলেছিল, “কেন চিনবে? শালা, কুম্ভকর্ণের নাতির মতো বিলা জিয়োগ্রাফি! বার্নিশ করা মেয়েদের দিকে হিড়িক দিতে গিয়েছে! আবার অভিমান হচ্ছে! শোন, আমাদের মতো মালেদের কাছে অভিমান মানে অমিতাভ-জয়ার সিনেমা। বুঝেছিস?”
“তুই থাকিস কোথায়?” রিতুদার গলায় বিরক্তি টের পেল মাহির।
মাহির বলল, “খেলা ছিল রিতুদা।”
“তো, ফোনটা অফ রেখেছিলি কেন?”
এবার মাহির কিছু বলার আগেই টিটি বলল, “ওর মোবাইলটা ভোগের বাসি হয়েছে রিতুদা।”
সামনে একটি মেয়ে বসে রয়েছে। টিটির এমন ভাষায় রিতুদা বিরক্ত হল, “তুই এসেছিস কেন ভেতরে? বাইরে যা। ডেকেছি মাহিরকে, তুই এসে কী করছিস?”
টিটি থতমত খেল, “না মানে… রিতুদা ওই ইয়ে… নকুর দাদার ওই…”
রিতুদা চোয়াল শক্ত করে তাকাল টিটির দিকে, “বাইরে পানু আছে, ওকে বল। সব আমি করব? বেরো এখন ঘর থেকে।”
টিটি আর সময় নষ্ট না করে হেসে বেরিয়ে গেল। মাহির অবাক হল। ভাবল, এটাই হল স্ট্রেংথ! সবার সামনে খিস্তি খেয়েও পাবলিক ধন্য হয়ে যাচ্ছে!
রিতুদা সময় নষ্ট না করে মাহিরকে বলল, “শোন, ইনি হচ্ছেন পলি দে। নানা সমাজসেবামূলক কাজে জড়িয়ে আছেন। তার মধ্যে একটা হল, ওল্ড এজ হোম। কালীঘাট ট্রাম ডিপোর কাছে ওঁদের হোম। কিছু ফিনানশিয়াল এড লাগবে ওঁদের। আমার তো যাওয়ার সময় নেই। তাই তুই যাবি ওঁদের ওখানে। সব দেখে আসবি।”
“আমি?” মাহির ঘাবড়ে গেল।
“পারবি না? শুনেছি তুই টুয়েলভ অবধি পড়েছিস। ইংরেজিতে ভাল ছিলি। আমার কাছে যেগুলো আছে সব টিটিএমপি!”
“মানে?” মাহির অবাক হল। দেখল, পলিও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
“মানে টেনে-টুনে মাধ্যমিক পাশ। তাই তুই যাবি। বুঝলি?”
মাহির মাথা নাড়ল।
“ওর সঙ্গে কথা বলে নে কবে যাবি। গিয়ে সব দেখে এসে আমায় রিপোর্ট করবি। ভরসা করছি মাহির, ডোবাবি না!” শেষের কথাগুলো সামান্য শক্ত গলায় বলল রিতুদা।
মাহির পলির দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি বলুন কবে…”
“এখানে নয়, বাইরে গিয়ে কথা বলবি,” রিতুদা মাহিরকে এককথায় চুপ করিয়ে দিয়ে তাকাল পলির দিকে, “আপনি কাইন্ডলি একটু বাইরে গিয়ে বসবেন প্লিজ়? ওর সঙ্গে একটু কথা আছে আমার। সেরে নিয়ে ও বাইরে আপনার সঙ্গে কথা বলবে।”
“শিয়োর,” পলি মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়াল। টেবিলে রাখা নিজের ফাইলটা গুছিয়ে বেরিয়ে গেল। শুধু যাওয়ার আগে সামান্য হাসল মাহিরের দিকে তাকিয়ে।
মাহির মাথা নামিয়ে নিল। সেই বিকেল। ভিড়ে ঝুঁকে যাওয়া গড়িয়াহাট আর একটা মেয়ের গম্ভীরভাবে মাথা নামিয়ে নেওয়া আবার মনে পড়ে গেল ওর।
মাহিরের মাথা নামিয়ে নেওয়ায় পলির ভুরুটা সামান্য কুঁচকে গেল।
পলি বেরিয়ে যাওয়ার পর ঘরটাকে অসম্ভব রকম নিস্তব্ধ মনে হল মাহিরের। শুধু এসির গুঞ্জন। ও দেখল রিতুদা তাকিয়ে আছে ওর দিকে। একদৃষ্টে।
মাহির কী করবে বুঝতে পারল না।
রিতুদা বলল, “তোর ভাইয়ের ডায়ালিসিস দরকার? কিডনি গেছে?”
মাহির মাথা নাড়ল শুধু।
রিতুদা মাথায় হাত বোলাল। তারপর একটু সময় নিয়ে বলল, “আমার একটা ভাই ছিল, জানিস। কথা বলতে পারত না। খুব ভালবাসত আমায়। আমি তেমন কিছু করতাম না তখন। বাবা তো অসুস্থ ছিল। মা লোকের বাড়িতে রান্না করত। ভাইয়ের টাইফয়েড হয়েছিল। সেটার ভাল করে চিকিৎসা করাতে পারিনি। এগারো দিনের মাথায় ভাইটা চলে গিয়েছিল। আজ আমার কী নেই বল! নেই, ভাইটা নেই আমার! তোর টাকার দরকার মাহির। আমার কাজের দরকার। যেসব ছেলে আমার আছে তাদের দিয়ে সবকিছু হবে না। প্লাস মনা পান্ডের কাছেও কেউ-কেউ যায়। তুই প্লেয়ার। প্লেয়াররা দু’মুখো হয় না বলে আমার বিশ্বাস। একটা বিশ্বাসযোগ্যতা তোর আছে। তুই কাজ কর আমার কাছে। মারামারি করতে বলছি না। মাসে-মাসে টাকা পাবি। ভাইয়ের চিকিৎসা যাতে কম টাকায় হয় আমি দেখব। কী বলিস?”
মাহির তাকাল রিতুদার দিকে। ভাবল বলবে কি না। তারপর মনস্থির করে সব সংকোচ ঝেড়ে বলল, “আসলে মা রাগ করে। পার্টির কাজে রিস্ক। তাই… একটা প্লেয়ার কোটায় চাকরি পেলে সুবিধে হয়। বা যদি ফার্স্ট ডিভিশনে একটা চান্স…”
“ভাইটাকে হারাতে চাস? সোনাঝুরিতে হাউজ়িং-এর প্রসপেক্ট খুব ভাল। অত জায়গা! সঙ্গে আমাদের পার্টিরও ইন্টারেস্ট আছে। ওখানে তারক চক্রবর্তী বলে আমাদের একজন আছে। কিন্তু খুব ঘোড়েল জিনিস। আমায় বলা হয়েছে ওর ওপর নজর রাখতে। আমি যাব মাঝে মাঝে, কিন্তু আমি চাই তুই ব্যাপারটায় থাক। এটা আমার লাস্ট অফার। জোর করছি না। লজিকাল হতে বলছি। আর কিন্তু আমি ডাকব না। আবার ভরসা করছি তোর ওপর।”
“আমার ওপর?” মাহির কী বলবে বুঝতে পারল না।
আগে খিদের জন্য পেটটা কেমন করছিল, এখন টেনশনে করছে। ও কী করবে? কোথায় জড়িয়ে পড়ছে? টেনশন কি খিদের মতোই কিছু!
রিতুদা বলল, “দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় এর চেয়ে বড় প্রজেক্ট নেই। অনেক টাকার ব্যাপার। ওখানে একটা বাড়ি আছে। বিশাল বড়। জুটমিল, বড় জায়গা, প্লাস ওই বাড়ি। নানা কোম্পানি যাচ্ছে। চড়চড় করে দাম বাড়ছে। তারকের পোয়াবারো। তাই আমায় ওটা দেখার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বুঝতে পারছিস? এই নে।”
মাহির দেখল রিতুদা টেবিলে ওর সামনে কয়েকটা পাঁচশো টাকার নোট রাখল।
“কী হল, নে!”
স্যার বলতেন, “সততার চেয়ে বড় কিছু হয় না মাহির। আর সততা আসে মনের শুদ্ধ ইচ্ছে থেকে। মন যাতে সায় দেয় না সেটা না করাই ভাল। আমাদের অজ্ঞাত মন, জ্ঞাত মনের চেয়ে শক্তিশালী! তাই তার ইশারা মানতে হয়। জানবি, কোনও কিছুর জন্য সততা বিসর্জন দেওয়া যায় না!”
স্যার মারা গিয়েছেন। কিন্তু আসলে স্যার এখনও বেঁচে আছেন মাহিরের মনের মধ্যে। সামান্য এদিক-ওদিক হলেই মুখ বাড়ান। কিন্তু স্যার, আপনি কি দেখতে পান আমার ঘরটা? আমার মাকে? স্যার, আপনি কি জানেন আমার ভাইয়ের কী হয়েছে? কত টাকা লাগবে ভাইকে বাঁচাতে? ওই স্টার, লেটার এসব পাওয়া আমার খুব ভুল হয়ে গিয়েছে স্যার! ইংরেজিতে ওই নাম্বারটা পাওয়াও ঠিক হয়নি একদম। যারা এসব পায়নি, যারা নিজেদের বিজ্ঞাপন করতে পারে, হ্যাংলার মতো নিজেদের ঢাক পেটাতে দ্বিধা করে না, যারা পয়সা আর ক্ষমতা ছাড়া কিছু বোঝে না, তাদের মতো হতে পারলে খুব ভাল হত স্যার! আমার মাকে এই রাত অবধি আয়ার কাজ করতে হত না। আমার ভাইকে বাঁচাতে পারব কি না এই নিয়ে এত ভাবতে হত না। বন্ধুত্বের আড়ে অন্যের এঁটো খাবার খেয়ে খিদে মেটাতে হত না!
স্যার, আমাদের মতো যাদের কেউ ভালবাসেনি, যাদের মনে এত-এত সেন্টিমেন্ট, এত লজ্জা, যারা অভিমান করে আর কিছু করলই না জীবনে, তাদের ইংরেজিতে একাশি পাওয়া ঠিক নয়। তাদের আপনার মতো স্যার পাওয়াও মস্ত বড় ভুল। আপনি আমার মনের মধ্যে বসে এবার থেকে যতই চিৎকার করুন স্যার, আমি আপনার কথা আর শুনছি না। কিছুতেই আর আপনার কথায় কান দিচ্ছি না।
রিতুদার দিকে তাকাল মাহির। মোটা মানুষটা হাসছে ওর দিকে তাকিয়ে। সামনে, এসি থেকে আসা ঠান্ডা হাওয়ায় ফুরফুর করে উড়ছে নতুন পাঁচশো টাকার কয়েকটা নোট!
মাহিরের মনে পড়ল নিজের ঘরের জানলা দিয়ে দেখা সেই আকাশটাকে। ধুলোটে আকাশ। জেদি কিছু তারা মুখ বাড়িয়ে রেখেছে! জীবনও কি এমন? জেদি মানুষরাই কি তবে এই আবছা পৃথিবীর ধূলি-মলিন চাদর ছিঁড়ে মুখ দেখাতে পারে? আর ওই অনেক ওপরের সেই অলক্ষ্যে বসে থাকা মানুষ, সে কি দেখছে মাহিরকে? ফড়িঙের মতো সে-ই কি ফড়ফড় করে উড়ছে সামনে?
মাহির চোয়াল শক্ত করল। তারপর হাত বাড়াল এক জীবন থেকে অন্য একটা জীবনের দিকে।
.
১৪. পেখম
শ্রীকৃষ্ণ বস্ত্রালয় থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়াল পেখম। বিকেল শেষ হচ্ছে সোনাঝুরিতে। এই রাস্তা ধরে সামনে গেলে গঙ্গার ঘাট। সেখানে নৌকো লেগেছে নিশ্চয়। পিলপিল করে মানুষ আসছে।
অধিকাংশই নিম্নবিত্ত মানুষ। রুজির জন্য গঙ্গার ওই পারে যায়। ওই পারে ইটখোলা আছে কিছু। একটা কটন মিলও আছে।
পেখম একটু সরে দাঁড়াল। রিকশা যাচ্ছে। সাইকেলও। ঘাটের পাশে সাইকেল রাখার একটা বড় জায়গা রয়েছে। ও জানে আর-একটু পরেই আবার সব ফাঁকা হয়ে যাবে।
ও আকাশের দিকে তাকাল। ওই ওপরে একটা তারা জ্বলজ্বল করছে। ঠাকুরদা বলেন একটা তারা দেখে ঘরে ঢুকতে নেই। অমঙ্গল হয়।
পেখম এদিক-ওদিক তাকাল, আর-একটা তারা যদি চোখে পড়ে! কিন্তু না, আর কিছু ফোটেনি এখনও। একটা মাত্র তারা মিতুকাকিমার নাকছাবির মতো জ্বলজ্বল করছে আকাশে!
পশ্চিমে মেঘ ঘনাচ্ছে! বৃষ্টি হবে কি? এই শীতের শেষটায় মাঝে মাঝে বৃষ্টি হয়। মা বলে এতে নাকি পুণ্য হয় খুব!
কীসের যে ভাল, কীসের যে পুণ্য, পেখম বুঝতে পারে না। আশপাশে আর কী ভাল হতে পারে। ওর তো সারাক্ষণ মনমেজাজ খারাপ হয়ে থাকে আজকাল। সারাক্ষণ মনে হয় বুকের ভেতর কে যেন পাথর বেঁধে রেখেছে। শরীরে যেন ঝিঁঝি পোকা ডাকে। একটা এমন বড় জঙ্গল যে শরীরের ভেতর ঘাপটি মেরে ছিল, সেটা এতদিন বুঝতেই পারেনি। পড়ায় মন বসে না। রাতে ঘুম হয় না ভাল। ভাল করে খেতে ইচ্ছে করে না। সাজতে ইচ্ছে করে না। বাড়িতেও আজকাল কারও সঙ্গে কথাই বলে না পেখম। ইচ্ছেই করে না।
টেটু এসে মাঝে মাঝে জ্বালায়। কেন চুপ করে আছে, সেই নিয়ে খোঁচায়। কিন্তু সামান্য হেসে দু’-একটা কথা বলে টেটুকে কাটিয়ে দেয় পেখম। এই কুড়ি বছর বয়সেই মনে হয় অনেকটা ক্লান্তি এসে গিলে নিয়েছে ওকে!
মা যে কাজুকে সরাসরি রাস্তায় ধরে ডেকে ওকে পড়াতে আসতে বারণ করে দেবে, সেটা ভাবতে পারেনি পেখম!
“কী রে, বললাম দোকানের ভেতরে দাঁড়াতে! না শুনে বাইরে এসে কী করছিস?”
নয়নার কথায় ওর দিকে ফিরল পেখম। আজ একটা পঞ্চো পরে আছে নয়না। শাড়ির ওপর ক্রুশের কাজ করা পঞ্চো। সুন্দর দেখতে। পুরী থেকে কিনে নিয়ে এসেছে। কিন্তু শুধু নিজের জন্য নয়, পেখমের জন্যও এমন একটা কিনে এনেছে!
পেখম নিতে চায়নি। ও কিছু দিতে পারে না নয়নাকে। কখনও কিছু দিতে পারে না। সেখানে কী করে ওর কাছ থেকে এটা-ওটা নেবে ও?
কিন্তু নয়না শোনেনি কথা। আসলে নয়না কারও কথাই শোনে না। এত জেদি একটা মেয়ে যে, বলার নয়!
নয়না বলেছিল, “তুই নিবি না তো? ঠিক আছে আমারটাও তা হলে জ্বালিয়ে দেব। তোরটা আমারটা একসঙ্গে জ্বালিয়ে দেব। খুব দেমাক হয়েছে তোর, না? সব ঘুচিয়ে দেব একবারে!”
পেখম নয়নার সঙ্গে জেদ করে পেরে ওঠে না। আসলে কারও সঙ্গেই ও ঠিক জেদাজেদি করে পেরে ওঠে না। পারলে কি আর মা এমন করে কাজুকে আসতে বারণ করে দিতে পারত!
তাই নিয়েছিল পঞ্চো। কিন্তু আজকাল কিছুই যেমন ভাল লাগে না, কিছুতেই যেমন মন নেই, তেমন ওই পোশাকটাও পড়েই রয়েছে বাড়িতে।
“কী হল তোর? এমন মুখ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কেউ মরে গিয়েছে নাকি?” নয়না ঠেলল ওকে।
পেখমের মনে হল বলে, হ্যাঁ, মরে গিয়েছে! পেখম মরে গিয়েছে!
নয়না আবার বলল, “কাজুদাকে কাকিমা বাড়িতে আসতে বারণ করেছে, তো কী হয়েছে? আচ্ছা, সব কিছুতে মেলোড্রামা না করলে তোর হয় না, না? আমি দেখেছি, যারাই প্রেম করে তাদেরই নানারকম ঝামেলা থাকে। আর ফ্র্যাঙ্কলি, কাকিমা ঠিকই করেছেন।”
“কী বললি?” পেখম ঘুরে তাকাল নয়নার দিকে। এটা কী বলল নয়না?
নয়না বলল, “ঠিক বলেছি। কাজুদা কে এমন যে, এভাবে হেদিয়ে মরছিস? কলেজে পড়িস, ওই বাংলা পড়ানোর জন্য কাজুদার দরকার হয় নাকি? কাকিমা ঠিক করেছেন। আর ভেবে দেখ, কোথায় তোরা আর কোথায় কাজুদা! কাজুদাদের ফ্যামিলি দেখেছিস? ওদের জোনাক-বাড়িতে গিয়ে দেখেছিস? কী চাস তুই এই সম্পর্ক থেকে? প্রেম প্রেম করে মাথা খারাপ করিস? আর কিছু নেই জীবনে? এমন করছিস যেন কী না কী হয়ে গিয়েছে!”
পেখম মাথা নিচু করে নিল। নয়নার গলায় অবিকল মায়ের গলাটা শুনতে পেল ও! সেদিন মা ঠিক এমন করেই বলেছিল।
পেখম ঘরে বসে হারিকেনের আলোয় পড়ছিল সন্ধেবেলা। মা ঘরে ঢুকে পাশে মুড়ির বাটি রেখে দিয়ে বলেছিল, “খেয়ে নে। আর, একটা কথা। কাজুকে আমি আসতে বারণ করে দিয়েছি। মাসে পনেরো টাকা করে আর দিতে পারব না।”
“মানে?” পেখম প্রথমে ঠিক বুঝতে পারেনি, “কী বলছ মা?”
মা শাড়ির আঁচলে হাত মুছে বলেছিল, “বলছি, ওই কলির কেষ্টটিকে আমি আসতে বারণ করে দিয়েছি। কী করবে ও এসে? বেকার টাকার শ্রাদ্ধ! আর এই নিয়ে বাবার কাছে গিয়ে দরবার করবি না। আমি বাবাকেও বলে দিয়েছি, উনি যেন এ ব্যাপারে আর কোনও কথা না বলেন।”
পেখমের গা-হাত-পা কাঁপছিল। এটা কী করেছে মা? এটা কেন করেছে? কাজুর টাকার দরকার। আর সেখানে ওর মা কাজুকে আসতে বারণ করে দিয়েছে!
মা বলেছিল, “প্রেম করা বের করছি তোর! ওই মাকাল ফল একটা! চাকরি-বাকরির নাম নেই! পার্টি করে। আমাদের কুল গোত্রের কেউ নয়। সেখানে প্রেম! পেখম, তোকে বলে দিচ্ছি, আর যদি ওর সঙ্গে দেখা করিস, তবে দেখিস কী হয়!”
পেখম কিছু বলতেই পারছিল না। মাথা নিচু করে বসেছিল ওই হলুদ আলোর বলয়ের পাশে। চোখ ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল। পেখম ঝগড়া করতে পারে না। চিৎকার করতে পারে না। কাজু বলে, পেখম এক্সপ্লোড করে না, ইমপ্লোড করে!
এখানেও তাই হচ্ছিল। ভেতরে-ভেতরে যেন ভেঙে পড়ছিল ও। তুবড়ে যাচ্ছিল। আর মাইলের পর মাইল ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিল জনপদ! বুকের ভেতর জ্বালা করছিল পেখমের। কয়েক হাজার মোম যেন একসঙ্গে পুড়ে যাচ্ছিল নিমেষে! আর তার গলন্ত ফোঁটা টপটপ করে খসে পড়ছিল খুলে রাখা বইয়ে, কাঠের টেবিলে!
মা পায়ের শব্দ তুলে এগিয়ে এসে তুলে ধরেছিল ওর মুখ। ঝাঁজালো গলায় বলেছিল, “এত বাড় বেড়ে গেছিস? এত নোংরা হয়ে গেছিস? এই বয়সেই এত! আর এমন মরাকান্না জুড়েছিস কেন? কে মারা গিয়েছে তোর?”
পেখম মাকে বোঝাতে পারে না, মানুষ বেশির ভাগ সময় অন্যের মৃত্যুতে কাঁদে না! কাঁদে নিজের মৃত্যুশোকে!
নয়না হাত তুলে একটা রিকশা দাঁড় করাল। তারপর নিজে তাতে উঠে পেখমের হাত ধরে টেনে তুলল।
পেখম বসতেই রিকশাটা চলতে শুরু করল।
নয়না বলল, “আমি দাদার দোকানে নেমে যাব। একটা কাজ আছে। তুই বাড়ি চলে যাস। আমি পরে দোকান থেকে তোর বাড়িতে যাব, কেমন?”
দাদা মানে পেখমের জ্যাঠার ছেলে। বারুদা। স্টেশন-রোডের ওপর ফোটোর দোকান আছে বারুদার। সোনাঝুরিতে বারুদার দোকানটাই একমাত্র ফোটো তোলার জায়গা। স্টুডিয়োকে এখানকার লোকজন ফোটোর দোকানই বলে।
নয়নার নতুন শখ হয়েছে ফোটো তোলা শিখবে। বারুদার দোকানে পেখমও গিয়েছে। দুটো ক্যামেরা আছে বারুদার। একটা রোলেইফ্লেক্স, আর-একটা পাজটাস। রোলেইফ্লেক্সটা দেখেছে পেখম। কেমন একটা ছোট বাক্সের মতো ক্যামেরা। মাথার ওপর একটা ঢাকনা খোলা যায়। তারপর সেটা দিয়ে উঁকি মেরে দেখতে হয় ভেতরে। অদ্ভুত লাগে পেখমের। বাইরের ছবি উলটো হয়ে যেন জলের ওপর ভেসে থাকে ক্যামেরার মধ্যে। বারুদা তো ছবিও তুলে দিয়েছে ওর। সাদা-কালো বড় ছবি। পেছনে স্টুডিয়োর দেওয়ালে আঁকা ঝরনা, পাহাড় আর নানা গাছ।
নয়না বলে, বারুদার দোকান দারুণ চলছে। অনেকে নাকি আসে ছবি তোলাতে। বিয়ের ছবিই নাকি বেশি। ও বলে, “ভাল করে শিখে নিই, তারপর দেখবি তোর বিয়ের ছবি আমিই তুলে দেব।”
স্টেশন রোড ধরে রিকশা চলেছে। শীতের শেষ। আশপাশের গাছেদের গায়ে খুব বেশি পাতা নেই আর। সবে সরস্বতী পুজো শেষ হয়েছে। সোনাঝুরিতে অনেক সরস্বতী পুজো হয়। কিন্তু সব ছোট-ছোট। রাস্তার ওপরে কয়েকটা প্যান্ডেল দেখতে পাচ্ছে ও। এখনও খোলা হয়নি।
তারই একটার সামনে ঝিকুদাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল পেখম। মলিন পোশাক, এলোমেলো চুল-দাড়ি। শূন্য প্যান্ডেলের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে ঝিকুদা।
পেখমের বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে উঠল দৃশ্যটা দেখে। এটাই তো ঝিকুদার জীবনের সত্যি! মেলা ভেঙে যাওয়া, প্রতিমা বিসর্জন হয়ে যাওয়ার পরের শূন্য প্যান্ডেল। এমনটাই তো বুকের মধ্যে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ঝিকুদা! ওকেও কি এমন শুনশান একটা ম্যারাপবাঁধা শূন্যতা বুকে করে বেড়াতে হবে? মানুষের জীবনে এমন কেন হয়? যাকে সে চায়, তাকে না পেলে এমন ভেঙে যায় কেন সব? সব কিছু অর্থহীন হয়ে পড়ে কেন? কেন মনে হয় এক-একটা দিনের ওজন বিশাল পাথরের মতো? কেন মনে হয় সেই পাথর রোজ ঠেলে তুলতে হচ্ছে পাহাড়ের মাথায়? ভাঙা মানুষ কি আসলে সিসিফাস?
“ওই দেখ বিলকিস!” হিহি করে হাসল নয়না, “শালাটা প্রেম করে মায়ের ভোগে গেছে! ভাইরাও লাথি মেরে বের করে দিয়েছে!”
“তুই হাসছিস!” পেখম অবিশ্বাস নিয়ে তাকাল নয়নার দিকে। আগে তো মেয়েটা এমন ছিল না! আজকাল কী হয়েছে ওর! কেমন যেন মুখের ভাষা! আর কেমন একটা চাপা হিংস্রতা কাজ করে কথাবার্তায়! মাঝে মাঝে এই নয়নাকে চিনতে পারে না ও।
“দেখ পেখম,” নয়না বলল, “জীবনে কেউ তোকে প্লেটে সাজিয়ে কিছু দেবে না। সব কিছুর একটা দাম দিতে হয়। বিনেপয়সায় কিছু হবে না। ঝিকুদার যা গল্প আমি শুনেছি, তাতে লোকটা ক্যালানে ছাড়া আর কিছু নয়।”
পেখম আর কথা বাড়াল না। ও একটা জিনিস আজকাল বুঝতে পারে— জীবনটা বীজগণিত বা পাটিগণিত নয়! লোককে বুঝিয়ে লাভ হয় না। যে যেটা ভাল মনে করে, সেটাই করে।
“কী হল, চুপ করে আছিস কেন?” নয়না খোঁচা দিল, “দিনকে দিন কেমন যেন হয়ে যাচ্ছিস তুই! কী হয়েছে তোর? কাজুদার কথা বাদ দে। কাকিমা বারণ করল আর ব্যস, সেও লেজ গুটিয়ে পালিয়ে গেল! বোঝ, মানুষ কেমন বোঝ!”
কথাটা যে ঠিক নয়, সেটা জানে পেখম। কারণ, মায়ের ওই কথার পরে একদিন সোনাঝুরি পাম্প হাউসের পাশে কাজুর সঙ্গে দেখা করেছিল পেখম। মা বেরোতে দিচ্ছিল না। কিন্তু বিজনের সঙ্গে যাচ্ছে বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিল ও।
পাম্প হাউসের মাঠটা শেষ বিকেলে নির্জন থাকে। বিজনকে দিয়ে আগেই কাজুর কাছে খবর পাঠিয়েছিল ও। কাজু এসে অপেক্ষা করছিল পাম্প হাউসের কাছে।
বিজন ছেলেটার বয়স খুব বেশি না হলেও পরিণত অনেক। পেখমকে বলেছিল, “পেখমদি তুমি যাও, আমি ওই সামনের সিনেমা হলের কাছে তেলেভাজার দোকানে আছি। কথা হয়ে গেলে এসো ওখানে।”
পাম্প হাউসের কাছে পেখমকে ছেড়ে দিয়ে বিজন ওই চপের দোকানের দিকে চলে গিয়েছিল।
সেদিন কাজু কেমন যেন একটু গম্ভীর হয়ে ছিল। দেওয়ালে হেলান দিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়েছিল। আশপাশে খোলা মাঠ পেরিয়ে শীত শেষের হাওয়া এসে এলোমেলো করে দিচ্ছিল ওর চুল।
“কেন ডেকেছ?” কাজু দূরের দিকে তাকিয়েই মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করেছিল।
“কেন মানে? তুমি জানো না কেন? আগে সপ্তাহে একদিন দেখা হত তোমার সঙ্গে আর এখন… এখন কী করে দেখা করব?”
কাজু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল, “পেখম আমাদের সম্পর্ক নিয়ে সবার যখন এত আপত্তি তখন আর কী হবে?”
“মানে?” পেখম স্থান কাল ভুলে এগিয়ে গিয়ে কাজুর হাত ধরে টান মেরেছিল, “এটা কী বলছ তুমি? কার মা-বাবা এসব মেনে নেয়? সবাই প্রথমে আপত্তি করে। পরে দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।”
কাজু এবার তাকিয়েছিল পেখমের দিকে। হাওয়া এসে মিশে যাচ্ছিল ওর চুলে। ওর কোঁকড়া চুলগুলো নেমে আসছিল কপালে। পেখম বলেছিল, “সামনের বছর আমি পাশ করে যাব। তারপর একটা চাকরি দেখে নেব ঠিক। তুমিও কিছু চেষ্টা কোরো। অর্থনৈতিক স্বাধীনতাই তো আমাদের সমাজে দরকার। সেটা আমাদের থাকলে দেখবে, কেউ কিচ্ছু করতে পারবে না। আমরা নিজেদের মতো করে সংসার করব।”
কাজু বলেছিল, “আমার পরিবার? তাদের কী হবে? তাদের তো ছেড়ে আমি যেতে পারব না! আর তোমার বাবা মা…”
“ছাড়তে বলছি না তো! আমরা থাকব একসঙ্গে। আর আমার বাবা-মা কড়া মানুষ। কিন্তু খারাপ নয়। ওরা ঠিক মেনে নেবে।”
কাজু কিছু না বলে হেসেছিল, “জীবন কি উত্তম কুমারের সিনেমা, পেখম?”
পেখম এগিয়ে গিয়ে কাজুর বুকের কাছে দাঁড়িয়েছিল। হাওয়া এসে আরও যেন মিশিয়ে দিচ্ছিল ওদের। অদ্ভুত এক সুন্দর গন্ধ পাচ্ছিল পেখম। ও মুখ তুলে তাকিয়েছিল কাজুর দিকে। ওই বড়-বড় চোখ। বাদামি মণি। নরম পশমের মতো দাড়ি। পেখম যেন অতল এক কুয়োয় পড়ে যাচ্ছিল! বুকের ভেতরে কেমন একটা করছিল! মনে হচ্ছিল হাজার হাজার হরিণ দৌড়ে যাচ্ছে ওর শরীর দিয়ে! মনে হচ্ছিল কোথায় যেন ঝনঝন করে রুপোর বাসন পড়ে যাচ্ছে হাত ফসকে!
কাজু আচমকা সরে গিয়েছিল, তারপর হাত দিয়ে পেখমকেও সরিয়ে দিয়ে বলেছিল, “আমার সামনে অনেক দায়িত্ব পেখম। অনেক-অনেক দায়িত্ব। অনেক কাজ। তা ছাড়া এভাবে হয় না। এত হোস্টিলিটি তোমার মায়ের! তোমার বাবা-মায়ের একটা মানও তো রয়েছে। আমার মনে হয় এভাবে কিছু করতেও নেই। তুমি এসো এখন।”
মাথা ঘুরিয়ে আবার ঝিকুদাকে দেখল পেখম। ঝিকুদা এখনও তাকিয়ে রয়েছে ফাঁকা প্যান্ডেলের দিকে। আসলে ঝিকুদা নয়, যেন নিজেকেই দেখল ও!
নয়না বলল, “সোজা হয়ে বোস। আর মুখের ওরকম জিয়োগ্রাফি চেঞ্জ কর। তোকে তো যা বলার বলেই দিয়েছে কাজুদা। আর ভাবিস না। তোকে এত সুন্দর দেখতে! সোনাঝুরির প্রায় সবাই তোর পেছনে লাইন দেবে বলে ইট হাতে ঘুরছে! আর সেখানে এমন বাংলার পাঁচের মতো মুখ করে বসে আছিস?”
পেখম কিছু বলল না। এই নয়নাকে ওর কাজুর সঙ্গে দেখা হওয়া আর কথা হওয়ার ব্যাপারটা বলাই ভুল হয়েছে। ও ভেবেছিল নয়না কিছু উপায় করবে। কিন্তু নয়না যেন পাত্তাই দিচ্ছে না। পেখমের মনে হল, এভাবে সবার বিরুদ্ধে একা কী করবে ও?
বারুদার স্টুডিয়োর সামনে নেমে গেল নয়না। বলল, “আমার প্যাকেটগুলো তুই নিয়ে যা তো! আমি সাতটা নাগাদ আসব তোদের বাড়ি।”
প্যাকেটগুলো নিয়ে মাথা নাড়ল পেখম। কিছু জামাকাপড় কিনেছে নয়না। কেন কিনেছে কে জানে! মাঝে মাঝেই এসব কেনে ও। জিনিসপত্র কেনাটা ওর বাতিক। ওর বাবা হোমিওপ্যাথি ডাক্তার। পশার খুব বেশি নয়। কিন্তু নয়নার দাদা খুব ভাল চাকরি করে মার্চেন্ট নেভিতে। অনেক টাকা রোজগার করে। বোনের সব শখআহ্লাদ দাদাই মেটায়।
বাড়ির সামনে রিকশা ছেড়ে দিয়ে ভেতরে ঢুকল পেখম। আজ সদর দরজা খোলা। কোলাপসিবল গেটটাও পুরো হাট করা। কী ব্যাপার! একটু যেন অবাকই হল ও। সেভাবে ওদের সদর বন্ধ করা না হলেও কোলাপসিবল গেটটা টানাই থাকে। আজ সেটা খোলা কেন?
গেট দিয়ে ঢুকে থমকে গেল পেখম। সামনের লম্বা করিডরের এক পাশে খুলে রাখা জুতো দেখে বুঝল মিতুকাকিমা এসেছে!
কাকিমা সাধারণত সন্ধেবেলা সাড়ে সাতটা-আটটা নাগাদ আসে। এমন ছ’টার সময় তো আসে না! আর এলেও চুপচাপ কথা হয় মায়ের সঙ্গে। এভাবে জোরে-জোরে হাসি-ঠাট্টা তো কোনওদিন শোনেনি!
জুতোটা খুলে নিজের ছোট ঘরের দিকে গেল পেখম। হাতের কাগজের প্যাকেটগুলো রেখে গায়ের পাতলা চাদরটা খুলে রাখল। একটু পরে পড়তে বসবে। মানে, পড়ার চেষ্টা করবে আর কী। আজকাল কিছুতেই পড়ায় মন বসে না! তাও বসে, চেষ্টা করে।
পেখমের ঘরের জানলার সামনেই অনেকটা ঝোপের মতো। তারপরই পুকুর। সর্দারদের পুকুর।
ওর ঘরে একটা চল্লিশ পাওয়ারের বাল্ব জ্বলছে। কিন্তু বাইরেটা বেশ অন্ধকার। পুকুরের ওই পাড়ে কলাবাগান। তার আড়ালে একটা বাড়ি আছে। সেখানে অন্যদিন আলো থাকে। কিন্তু আজ ওই বাড়িতেও আলো জ্বলছে না।
অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইল পেখম। কীসের যে টান অন্ধকারের, ও বোঝে না! কিন্তু এমন করে তাকিয়ে থাকতে খুব ভাল লাগে ওর। মাথাটা কেমন যেন ফাঁকা হয়ে যায় ক্রমশ। অন্ধকার যেন ধীরে-ধীরে গুলে যেতে থাকে ওর মধ্যে। ওর সব মনখারাপ কেমন যেন আলোহীনতার সঙ্গে মিলেমিশে এক হয়ে যায়।
আর তখনই ওদের চোখে পড়ল পেখমের। দুটো-চারটে করে অন্ধকারের পরদা সরিয়ে উঁকি দিয়ে বেরিয়ে আসছে ওরা। জোনাকিরা। সবুজ-হলুদ আলো জ্বেলে সামনের ঝোপ থেকে লাজুক মুখে বেরিয়ে আসছে জোনাকিরা। যেন আকাশ থেকে নেমে এসেছে তারা! যেন মনের না-মেটা ইচ্ছের আলোবিন্দু! যেন সন্ধে নামক নারীর ফেলে যাওয়া টিপ!
পেখম তাকিয়ে রইল ওই আলোর বিন্দুর দিকে। ওর মনে পড়ে গেল কাজুর কথা। এমনই এক সন্ধেবেলা কাজু জোনাকি দেখে বলেছিল:
‘অন্ধ আমার জীবন জুড়ে রাত্রি একা নামে
তোমার বাড়ির মাথায় এসে কাদের আকাশ থামে?
কাদের শহর চমকে ওঠে তোমার ধ্রুবতারায়
কোথায় কারা ভিজল, যখন বৃষ্টি তোমার পাড়া
সাজিয়ে তোলে বর্ষাতি আর একলা বকুল দিয়ে?
তোমার মুখের হলুদ আভা নিজের পিঠে নিয়ে
বন্ধু নামের বিন্দু যেন আলোর মতো ভাসে
তোমার কথা ভাবলে আমার জোনাক মনে আসে!
“দিদি, তুই এসে গেছিস?”
পেখম সামান্য চমকে উঠল টেটুর ডাকে। ও চট করে হাতের উলটো পিঠ দিয়ে চোখটা মুছে নিল। তারপর নিজেকে সামলে তাকাল টেটুর দিকে।
টেটু কিছু বলতে গিয়েও থমকে গেল এবার, “তুই কাঁদছিস দিদি?”
“কই, না তো!” পেখম হাসার চেষ্টা করল।
টেটু ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল পেখমের দিকে। তারপর বলল, “আমি জানি তুই কাঁদছিস। আমি কি বুঝি না? আমিও বড় হয়েছি।”
পেখম হাত বাড়িয়ে ওর গাল টিপে দিয়ে বলল, “হ্যাঁ, খুব বড় হয়েছিস! রাতে একা বাথরুমে যেতে ভয় পায়, আবার বড় হয়েছে!”
টেটু বলল, “আরে, সে তো সবাই ভয় পায়। তাতে কেউ ছোট হয়ে যায় নাকি? এই যে জেঠু পুলিশে আছে। সেই জেঠুও তো ভয় পায় পাগলা কুকুর দেখলে। আমার বাবা যে বাবা, বাবা তো ভয় পায় মাসের শেষ এলে। আর আমার মা, সেদিন আচমকা ঘুম ভেঙে শুনি মা বাবাকে ফিসফিস করে বলছে, ‘এমন শুধু-শুধু কোরো না, আচমকা কিছু হয়ে গেলে… আমার ভয় লাগে।’ তা হলে?”
এই সেরেছে! টেটু কীসব বলছে! পেখম উঠে গিয়ে ওর মুখ চেপে ধরল। ছেলেটা এখনও বাচ্চাই আছে। বলল, “কী বলবি বল।”
“জেমা ওই ঘরে ডাকছে তোকে। খুব দরকার বলল।”
“মা ডাকছে?” অবাক হল পেখম।
“চল, দেখ না কীসব হচ্ছে তোকে নিয়ে…” টেটু আর না দাঁড়িয়ে দৌড়ে চলে গেল!
ওকে নিয়ে! ওকে নিয়ে আবার কী হচ্ছে! পেখম ধীরে-ধীরে মায়ের ঘরের দিকে গেল।
পেখম দেখল ঘরে মা, মিতুকাকিমা, ছোটকাকিমা ছাড়াও বাবা রয়েছে আজ।
ও জানে আজ বাবার অফ ডে। কিন্তু অফ থাকলে তো বাবা দোকানে যায়। আজ যায়নি?
“আয় আয়,” পেখমকে ডেকে ধরে নিয়ে নিজের পাশে মোড়ায় বসাল ছোটকাকিমা। পেখম বুঝতে পারল না কী হয়েছে। এভাবে ওকে ধরে-ধরে বসাচ্ছে কেন?
পেখম অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল মায়ের দিকে।
মায়ের মুখটা ঝলমল করছে। মা হাসছে। কতদিন পরে মা হাসছে। আর বাবা? বাবা কেমন যেন একটা মুখ করে বসে রয়েছে! ব্যাপারটা কী?
মিতুকাকিমা নিজের জায়গা থেকে উঠে এসে পেখমের পাশের টুলে বসল। তারপর বলল, “এভাবে পাগলির মতো থাকিস কেন? একটু সাজগোজ করতে পারিস না?”
“কেন?” পেখম অবাক হয়ে তাকাল মিতুকাকিমার দিকে।
ছোটকাকিমা বলল, “সাজগোজ না করেই তো এই! আর সাজলে কী যে হবে!”
“তা ঠিক…” মিতুকাকিমা হাসল, “এমনি-এমনি কি আর এটা হয়েছে?”
“কী হয়েছে?” পেখম বুঝতে পারল না।
মা ঝলমল করে বলল, “মিতুদি তোর বিয়ের সম্বন্ধ এনেছে!”
“আমার? বিয়ের?” পেখমের মনে হল কেউ যেন ঠাস করে ওকে একটা চড় মেরেছে!
মিতুকাকিমা ওর হাত দুটো নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলল, “হ্যাঁ রে, তোর। জানিস, কে তোকে বিয়ে করতে চেয়েছে?”
পেখম কিছু না বলে তাকিয়ে রইল মিতুকাকিমার মুখের দিকে।
মিতুকাকিমা হেসে বলল, “সুদর্শন মালিকের ছেলে সুজিত মালিক। ওই জুট মিলের মালিক, ওই জোনাক-বাড়ির মালিক। বুঝতে পারছিস?”
পেখম স্থির হয়ে গেল নিমেষে। মিতুকাকিমার মুখটাও মায়ের মতো হয়ে উঠছে ক্রমশ। ঘরের আলোয় কাকিমার ছোট্ট নাকছাবিটা চকচক করছে। পেখমের সামনে থেকে সব কেমন যেন অদৃশ্য হয়ে যেতে লাগল। শুধু চোখের মধ্যে যেন বিঁধে আছে ওই নাকছাবিটা। একলা তারার মতো নাকছাবিটা। পেখম মনে মনে আরও অনেক তারা খুঁজল। কিন্তু আর তারা নেই। আর কোনও তারা নেই। শুধু ওই একটা তারা জ্বলজ্বল করছে আকাশে।
পেখমের মনে পড়ল, একটা তারা দেখে ঘরে ফিরতে নেই। অমঙ্গল হয়। পেখম বুঝল ঠাকুরদা ঠিকই বলেন।