১০. কাগজ ছেঁড়ার শব্দ

কাগজ ছেঁড়ার শব্দে আনিসের ঘুম ভেঙেছে। চোখ না মেলেই সে বলল, তরু কি করছ?

তরু বলল, কাগজ ছিঁড়ছি। গল্প-উপন্যাস যা লিখেছিলাম সব কুটি কুটি।

আনিস ঘুম ঘুম চোখে একবার তাকাল। তরু চেয়ারে বসে আছে। তার সামনে মোমবাতি। সে শুধু যে কাগজ ছিড়ছে তা-না, কাগজ পুড়াচ্ছেও। আগুন ধরিয়ে টেবিলে রাখা এলুমিনিয়ামের গামলায় ফেলে দিচ্ছে। আগুনের হলুদ আভা পড়ছে তরুর চোখে-মুখে। কি সুন্দরই না তাকে লাগছে। মনে হচ্ছে পৃথিবীর সব রূপ নিয়ে বসে আছে রাঙা রাজকন্যা। আনিস বলল, লেখা ছিঁড়ে ফেলছ কেন?

তরু বলল, লেখক হবার অনেক যন্ত্রণা। কত কিছু জানতে ইচ্ছ করে। আমি এখন শুধু তোমাকেই জানব। আর কিছু জানব না। বুঝতে পারছ আমার কথা?

আনিস জবাব দিল না। তরু বলল, ঘুমিয়ে পড়েছ?

কোনো উত্তর নেই। তরু কাগজ ভেঁড়া বন্ধ করে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল আনিসের দিকে। ঘুমন্ত মানুষের সঙ্গে কথা বলা খুব আনন্দের ব্যাপার। যার সঙ্গে কথা বলা হচ্ছে সে পাশেই আছে অথচ কিছুই শুনছে না।

তরু বলল, আমি নানান জটিলতায় বাস করেছি। এখন জটিলতামুক্ত জীবনযাপন করতে চাচ্ছি। কি জটিলতা জানতে চাও? বাবাকে নিয়ে জটিলতা। তিনি প্রতি বছর মা এবং খালার মৃত্যুদিনে তওবা করেন কেন?

পঙ্গু চাচাকে নিয়ে জটিলতা। তিনি কেন আমাকে এমন একটা ডিটেকটিভ উপন্যাস লিখতে বললেন যেখানে এক ভদ্রলোক তার দুই স্ত্রীকে হত্যা করেন। তিনি কি কিছু জানেন? পঙ্গু ভদ্রলোক এই বাড়িতে কেন পড়ে আছেন? তার অতি প্রিয় কেউ কি এই বাড়িতে বাস করে? সেই অতি প্রিয়জনটা কে? তরু নামের মেয়েটি? যাকে তিনি মিস্ট্রি ডাকেন? মেয়েটির মধ্যে রহস্য আছে এই জন্যেই কি তার নাম মিস্ট্রি? রহস্যটা কি?

এই নাই? আমার কথা শুনছ?

আনিস পাশ ফিরতে ফিরতে অস্পষ্ট গলায় বলল, হুঁ।

সুখে বাস করার সাধারণ নিয়ম জানো?

হুঁ।

তুমি ঘুমের মধ্যেই হুঁ হুঁ করছ। আমার কথা কিছু শুনছ না। শুনলেও বুঝতে পারছ না। আচ্ছা বলো তো, এমন কি হতে পারে আমি পঙ্গু ভদ্রলোকটার মেয়ে?

হুঁ।

তরু বলল, সম্ভাবনা আছে। তিনি লম্বা, গায়ের রঙ দুধে আলতায়। আমিও তাই। একজন ঔপন্যাসিকের জন্যে চমৎকার সাবজেক্ট। আমি এখন আর ঔপন্যাসিক না, কাজেই এইসব নিয়ে ভাবব না। মুন্সিগঞ্জের হেমন্ত এসেছিল। সনজু তাকে এনেছিল গান শুনাতে। তার গলা আসলেই সুন্দর। চোখ বন্ধ করে শুনলে মনে হয় হেমন্ত বাবুই গাইছেন–শিকল চরণে তার হয়েছে নূপুর। আমি মুগ্ধ হয়ে তার গান শুনেছি। একবারও জিজ্ঞেস করি নি, আপনার সঙ্গে কি ক্ষুরটা আছে? একটু দেখি তো!

আজ দুপুরে বাবাকে দেখেছি গলা নিচু করে সনজুর বোনের সঙ্গে কথা বলছেন। বাবার মুখ হাসি হাসি। ঐ মহিলার মুখ হাসি হাসি। ঐ মহিলার কোথাও যাবার জায়গা নেই বলে আমাদের সঙ্গেই থাকেন। প্রায়ই ইন্টারেস্টিং রান্না করে বাবাকে খাওয়ান। আজ দুপুরে তিনি বেঁধেছেন কলার থোড়ের বড়া। বাবা এখনো খান নি। খেলেই বলবেন–অসাধারণ।

আমার বাবাকে বলতে ইচ্ছা করে—বাবা তুমি কি এই মহিলাকে বিয়ে করবে? এবং কিছুদিন পর এই মহিলার একটি পেইনটিং আমার মা এবং খালার পেইনটিং-এর পাশে শোভা পাবে?

আমি কিছুই জিজ্ঞেস করি নি। যে তরু প্রশ্ন করত সে নেই। আমি অন্য তরু। আমার চক্ষে তৃষ্ণা। ভালোবাসায় ড়ুবে থাকার তৃষ্ণা। ড়ুব দিতে হয় চোখ বন্ধ করে। আমি চোখ বন্ধ করেছি।

1 Comment
Collapse Comments
হামিদুল August 21, 2021 at 5:38 am

লেখালেখির কিছু ভালো টিস্প আছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *