ক্রিং ক্রিং করে কলিংবেল বাজছে।
আমাদের বাসায়তো কলিংবেল ছিল না। কলিং বেল কোথেকে এল? নতুন কলিং বেল লাগিয়েছে না-কি? আমি অবাক হয়েই দরজা খুললাম। কে এসেছে সেটা দেখার চেয়ে কলিং বেলটা দেখার জন্যেই আমার আগ্রহ বেশি।
দরজা খুলে দেখি সফিক সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। আজো তাঁর গায়ে নীল হাফ সার্ট। তিনি কি নীল রঙের সার্ট ছাড়া আর কিছু পরেন না? তিনি চোখের সানগ্লাস খুলতে খুলতে বললেন, কেমন আছ নবনী!
আমি বললাম, ভাল।
কর্তা কোথায়?
ও বাজারে গেছে। কাঁচা বাজারে।
আমি কি অপেক্ষা করব তার জন্যে?
জ্বি বসুন। ওর আসতে মনে হয় দেরি হবে। হেঁটে গেছে। হেঁটে ফিরবে।
সফিক সাহেব ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, হোক একটু দেরি। এই ফাঁকে আমি বরং তোমার হাতের চা খাই। নোমানের ধারণা এই পৃথিবীতে তোমার চেয়ে ভাল চা আর কেউ বানাতে পারে না।
তিনি সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকলেন। বসলেন বারান্দায়। আমি বললাম, আপনি ভেতরে গিয়ে বসুন। বারান্দায় বসেছেন কেন?
কারো শোবার ঘরে ঢুকতে ভাল লাগে না। শোবার ঘর হচ্ছে খুবই ব্যক্তিগত ব্যাপার। বাইরের লোকের সেখানে প্ৰবেশাধিকার থাকা উচিত না। তোমাদের বারান্দাটা সুন্দর।
আমি চা বানিয়ে দিয়েছি। একটু অস্বস্তি লাগছে কারণ শুধু চা দিতে হয়েছে। ঘরে কিছু নেই। একটা কিছু থাকলে ভাল হত। আমি দেখেছি খুব যারা বড়লোক তারা সাধারণ খাবার বেশ আগ্রহ করে খায়। তিনি চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললেন, নবনী! আমি নোমানের কাছে আসি নি। আমি আসলে তোমার কাছেই এসেছি। অফিস থেকে দেখলাম নোমান বাজারের ব্যাগ হাতে বেরুল। আমিও সঙ্গে সঙ্গে তোমার কাছে চলে এসেছি। যাতে ওর সঙ্গে দেখা না হয়।
আমি শঙ্কিত গলায় বললাম, আমাকে কিছু বলবেন?
হ্যাঁ। লম্বা বক্তৃতা দেব। ধৈর্য ধরে তোমাকে শুনতে হবে। কথার মাঝখানে হাই তুলতে পারবে না। দেখ নবনী, আমি নোমানকে খুব পছন্দ করি। সে হচ্ছে জটিলতা বিহীন একজন মানুষ এবং ইন্টারেস্টিং মানুষ। স্কুলে একসঙ্গে পড়েছি তারপর আর কোন যোগাযোগ ছিল না। একদিন গাড়ি কিনতে বিজয় নগরের একটা শো রুমে গিয়েছি। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম এক ভদ্রলোক গম্ভীর ভঙ্গিতে লেটেস্ট মডেলের গাড়ির দরদাম করছে। আমি কাছে গিয়ে বললাম, নোমান না? এখানে কি করছিস?
সে লজ্জিত গলায় বলল, কিছু করছি না।
আমাকে চিনতে পারছিস তো?
পারছি। সফিক।
চাকরি বাকরি কি করছিস?
কিছু করছি না।
বেকার?
হুঁ বেকার।
গাড়ি দাম করছিস কি জন্যে?
সে হাসল। আমি বললাম, দে তুই পছন্দ করে একটা গাড়ি কিনে দে। আজ তোর পছন্দেই কিনব।
সেই থেকে সে আমার সঙ্গে আছে। Unconditional loyalty বলে একটা ব্যাপার আছে যা মানুষের মধ্যে দেখা যায় না। নিম্ন শ্রেণীর প্রাণী কুকুরের মধ্যে খানিকটা আছে। সেই শর্তহীন আনুগত্য আছে নোমানের মধ্যে। পাশবিক গুণ হলেও এটা অনেক বড় গুণ। নোমানকে পছন্দের আমার এই একটা কারণ।
সম্প্রতি তার মধ্য আমি একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করছি। সে আমার কাছে অনেক কিছু গোপন করছে। যেটা আমার একেবারেই পছন্দ না। আমি খুব রাগ করেছি। অসম্ভব রাগ করেছি।
সফিক সাহেব থামলেন। সিগারেট ধরালেন।
আমি বললাম, আপনি কি ওকে বিদেয় করে দিচ্ছেন?
হ্যাঁ দিচ্ছি। সে জানে আমি অহানার চিন্তায় অস্থির হয়ে আছি। তারপরেও সে তাকে তার বাসায় লুকিয়ে রাখে। অথচ আমাকে কিছুই বলে না। সে আমাকে বোকা ভাবে। মনে করে আমার বুদ্ধিও তার স্তরে। অথচ আমি তার ঘরে পা দিয়েই বুঝেছি, অহনা এখানেই ছিল। বেগুনি ওর প্রিয় রঙ। বেগুনি রঙের পর্দা নোমানের ঘরে ঝুলবে আর আমি কিছুই বুঝব না?
আমি বললাম, সফিক ভাই আপনি এসব কথা ওকে সরাসরি না বলে আমাকে বলছেন কেন?
তোমাকে বলছি তার কারণ আছে। অহনা একটা ভয়ঙ্গর খেলা খেলার চেষ্টা করছে। এই খেলায় নোমানের একটা ভূমিকা আছে। সে তা জানে না। সে কিছুই বুঝতে পারে না। সে জানে না যে অহনা তার ভ্যানিটি ব্যাগে ইদানীং একটি ছোট পিস্তল রাখে। এই পিস্তলটিা সে কেন রাখে? সেলফ প্রটেকসনের জন্যে না। তার উদ্দেশ্য অন্য।
উদেশ্যটা কি?
আমি পরিষ্কার জানি না। একটা অনুমান আমার আছে। অনুমানটা স্পষ্ট নয়। অস্পষ্ট। ওকে ওর জীবনের শুরুতে আমি নানানভাবে ব্যবহার করেছি। আমি ফেরেশতা না–আমার অনেক দোষ ত্রুটি আছে। অহনার উপর কিছ অন্যায় আমি শুরুতে করেছি। পরবর্তী সময়ে সে অন্যায় আমি দূর করার চেষ্টা করেছি। ওকে বিয়ে করেছি। ভালবাসায় ভালবাসায় ডুবিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছি। তুমি বোধহয় জান না— আমার যাবতীয় বিষয় সম্পত্তি ওর নামে লিখে দেয়া হয়েছে। সবটা অবশ্যি ভালোবাসা থেকে করা না টেক্স ফাকি দেয়াও একটা উদ্দেশ্য।
বুঝলে নবনী! অহনা হচ্ছে পারদের মত, যত তাকে ধরতে যাওয়া যায় ততই সে পিছলে যায়। আঙুলের ফাঁক দিয়ে সহস্র খণ্ড হয়ে ঝড়ে পড়ে। আমি অঞ্জলি পেতেই তাকে ধরতে চেয়েছিলাম। সম্ভব হল না। সে এখন যেটা চাচ্ছে তা হচ্ছে আমাকে কঠিন শাস্তি দেয়া। কিভাবে সে তা দেবে আমি জানি না। নোমান জানে, সে আমাকে বলবে না। অহনা নোমানের উপরও পুরোপুরি ভরসা করছে না। তার আরো লোক আছে। প্ৰাইভেট ডিটেকটিভ ধরনের লোকজন। ওরা আমার পেছনে পেছনে ঘুরছে। শুধু যে আমার পেছনে ঘুরছে তাই না–তারা আরো কিছু কাণ্ড কারখানা করছে যার কারণ আমি ধরতে পারছি না। যেমন তারা এতিমখানায় এতিমখানায় ঘুরছে। শুনতে পাচ্ছি আমার ধানমণ্ডির বাড়িটায় অহনা একটা মহিলা দুঃস্থ কেন্দ্র করবে। এটা কি অদ্ভুত পাগলামি না?
সফিক সাহেব চুপ করলেন। হাতের আধখাওয়া সিগারেট ফেলে দিয়ে আরেকটা ধরালেন। তাঁকে খুব অস্থির লাগছে। আমি বললাম, আপনি কি আরেক কাপ চা খাবেন?
হ্যাঁ খাব।
আমি চা ঢেলে দিলাম। তিনি বললেন, থ্যাংকস–রাগের মাথায় হড়মড় করে তোমাকে অনেক কথা বলে ফেললাম।
এখন কি আপনার রাগ কমেছে?
আমার স্বভাব অহনার মত না। আমি যেমন চট করে রাগী না, তেমনি চট করে আমার রাগ পড়েও না। যাই হোক নবনী শোন— আমি নোমানকে আমার কাছে আর রাখব না। তোমার জন্যে সবচে ভাল হবে তুমি যদি ওকে নিয়ে দূরে কোথায় চলে যাও। অহনার Sphere of Influence এর বাইরে। আমি কিছু টাকা পয়সা দিয়ে দেব যাতে ও ছোটখাট ব্যবসা ট্যাবসা করে খেতে পারে।
সফিক সাহেব ওঠে দাঁড়ালেন। আমি বললাম, আমি কি নোমানকে আপনার সিদ্ধান্তের কথা আজই বলব?
না। আজ না। আমার ছবির অল্প কিছু কাজ বাকি আছে। কাজটা শেষ হোক। তারপর বলবে। নবনী যাই। ভাল কথা তোমার যে ছবি তুলেছিলাম সেই ছবি খুব সুন্দর এসেছে। আমি বাঁধিয়ে রেখেছি— আজি সন্ধ্যায় পাঠিয়ে দেব। আরেকটা কথা অহনা এখন আমার বাসায়। কাল তাকে নিয়ে সুটিং এ যাব। নোমানকে বলবে যেন যায় এবং আমি চাচ্ছি তুমিও থাক। ছবি শেষ করাটা আমার জন্য খুব জরুরি। এই জীবনে আমি কোন কাজই আধাআধি করে রাখি নি। তোমার চা খুব ভাল হয়েছে। মেনি মেনি থ্যাংকস!
যাই বলেও সফিক সাহেব দাঁড়িয়ে রইলেন। মনে হচ্ছে। এতগুলো কথা বলার তার ইচ্ছা ছিল না। বলার পর বিব্রত বোধ করছেন। আমার স্তরের একটি মেয়েকে তাঁর এত কথা বলার প্রয়োজনও নেই। তিনি ইতস্তত করে বললেন, নবনী একটা শেষ কথা না বললে তুমি অহনাকে ভুল বুঝতে পার। তুমি ভাবতে পার আহনা বোধহয় পিস্তল নিয়ে ঘুরছে আমাকে মারার জন্যে।
আমি এ রকম কিছু ভাবছি না।
না ভাবাই ঠিক। ঘৃণা থেকেও ভালবাসা জন্মায়। আমার প্রতি ওর যে প্রবল ভালবাসা তা উঠে এসেছে ঘৃণা থেকে। সমস্যা এইখানেই। এই পৃথিবীতে দুধরনের মানুষ খুন হয়। প্রবল ঘৃণার মানুষ এবং প্রচণ্ড ভালবাসার মানুষ। কাজেই অহানা যদি আমাকে মেরেও ফেলে তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, উল্টাটাওতো হতে পারে। তিনি তৎক্ষণাৎ বললেন, হতে পারে। অবশ্যই হতে পারে।