১০. কপালবাবার আসনের কাছে

কপালবাবার আসনের কাছে মাথা ঠেকিয়ে যখন উঠে দাঁড়ায়, তখনও আকাশের সব তারা ফুটে ওঠে নি। ফিরে আসবার পথে ডরানির পুল পার হয়ে মধুকুপির মাটির উপর এসে দাঁড়াতেই থমথমে অন্ধকারের মধ্যে শিয়ালের দল আগ-রাতের প্রথম হাঁক হেঁকে ডাঙার উপর দিয়ে ছুটে চলে গেল।

কিন্তু কই মাদলের শব্দ শোনা যায় না কেন? করম পরবের উল্লাস এত তাড়াতাড়ি আগরাতের পহরে ক্লান্ত হয়ে আর নীরব হয়ে যাবে, এ কেমন পরব? বড় বুড়া রতনের কলিজায় না হয় জোর নাই; কিন্তু সনাতন লাইয়ার কি হল? মাদল পিটতে আর হাঁড়িয়া টানতে সনাতনেরও কি সাধ নাই, আর কলিজার জোর নাই? একজনারও কি হুঁশ নাই, দম নাই? হাঁপিয়ে পড়েছে মেয়েগুলিও; গরুচরানী জগমোতি বধুনি আর কালিমণি? ওরাও কি বমি করে করে ঝুমুর গান থামিয়ে দিল, আর নাচ ছেড়ে দিয়ে ভূঁইয়ের উপর লুটিয়ে পড়ল?

না, আখড়াতেই যেতে হবে। সড়ক থেকে নেমে একটা চষা ক্ষেতের আলের উপর দিয়ে হন্তদন্ত করে হাঁটতে থাকে দাশু। চিনতে পারে দাশু, এই ক্ষেত হল ঈশান মোক্তারের সেই ক্ষেত, জেলে যাবার আগে রোজ এক সের চালের সিধা আর চার আনা নগদ পেয়ে যে ক্ষেতে বরবটি বুনেছিল দাশু। কেমন ফলন হয়েছিল, নিজের চোখে দেখে যেতে পারে নি।

কিন্তু এ কি? আবার কাঁদে কে? যেন দুই হাতে মুখ ঢাকা দিয়ে আর লুকিয়ে লুকিয়ে ভয় ক করুণ স্বরের একটা কঁদুনির গান গাইছে কেউ। ওই যে একটা ঘর, ঘরের সামনের Lেট আঙ্গিনায় টিম টিম করে একটা বাতি জ্বলছে। ওটা তো ফুলকি মাসীর ঘর।

হলুদ-ছোপানো শাড়ি পরে, নারকেল তেলে চুল ভিজিয়ে খোপা বাঁধে, লাল গালার রস দিয়ে নখ রাঙায়, সে ফুলকি মাসী আজ কাঁদে কেন? ঈশান মোক্তারের সেবা করবার জন্য জীবনটাকে বাঁধা দিয়েছে যে ফুলকি, কুঠি থেকে বছরের সিধা যার জন্য বরাদ্দ করা আছে, ঈশান মোক্তারের কাছ থেকে জমি খয়রাত পেয়েছে যে, সে ফুলকির প্রাণ আবার কিসের ব্যথায় কাঁদে?

এগিয়ে যেয়ে ফুলকি মাসীর আঙ্গিনার উপর দাঁড়ায় দাশু। ফুলকি মাসীর চাপা কান্নার স্বর ডানাভাঙা চিলের আর্তস্বরের মত আরও করুণ তীক্ষ্ণতায় কেঁপে কেঁপে বেজে ওঠে। আর এ গাঁয়ে থাকবো না দাও।

আবার সেই অভিশাপের শব্দ! কী আশ্চর্য, ফুলকি মাসীও যে পল্টনী আর তেতরির মত সেই এক ধিক্কারের ভাষায় মধুকুপির মাটিকে গালি দিয়ে অপমান করছে।

-তোমার আবার কাঁদতে সাধ হলো কেন মাসী? ফুলকির মুখের দিকে ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে প্রশ্ন করে দাশু।

আবার মুখের উপর আঁচলচাপা দিয়ে কাঁদতে থাকে ফুলকি। ঘরের দাওয়ার এক কোণ থেরে মরা জীবের মত একটা অনড় চেহারা হঠাৎ নড়ে ওঠে। ফুলকির স্বামী খোঁড়া তিনকড়ির গলার স্বরটাও যেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে একটা অদ্ভুত কথা বলে-লালবাবু ফুলকির কোমরে জুতাপায়ে লাথি মেরেছে।

-কেন? গর্জন করে দাশু।

তিনকড়ি বলে-ফুলকি জানে। আমাকে শুধাও কেন?

-কি মাসী? তোমার ঈশান মোক্তারের ছেইলা হয়ে লালবাবু তোমাকেই জুতার ঠোকর মারে কেন? ফুলকির কাছে এগিয়ে এসে আবার প্রশ্ন করতে গিয়ে দাশুর দাঁত কড়মড় করে বেজে ওঠে।

হঠাৎ মুখের উপর থেকে চাপা আঁচল সরিয়ে খোঁড়া তিনকড়ির দিকে হিংস্রভাবে তাকিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে ফুলকি-তুই আমার জ্বালা বুঝবি কি রে খোঁড়া গরু। তোর লেগেই তো আমাকে মরতে হয়েছে রে মড়া! তোকে পূষবার লেগে সিধা মাগতে গিয়ে যে আমার ধরম করম সব গেল রে কপালপোড়া। তুই মানুষ হলে ভিখ মেগে খেতিস, জরুর ভাত খেতিস না।

খোঁড়া তিনকড়ির চেহারাটা আবার একটা মড়া জানোয়ারের মত গুটিয়ে পাকিয়ে অনড় হয়ে যায়। ফুলকি বলে-ঈশান মোক্তারের বেটা আমার সিধা বন্ধ করে দিলে, জমিটাও ছিনে নিলে।

–কেন?

–আমি ওর সেবা করতে রাজী হই নাই।

দু হাতে মুখ ঢেকে ফোঁপাতে থাকে ফুলকি? আমি ভাবি নাই দাশু, বুড়া মোজরের বেটাও আমাকে এমন কথা বলবে। যাকে ছেইলা বলে মানি, সে আমাকে মাগি বলে মনে করে আর গতর ছুঁতে চায়; কী কপাল করেছিলি রে ফুলকি!

দাশুর লাল চোখের কোণে জলের ফোঁটা কাচা রক্তের ফোঁটার মত টলমল করে। ফুলকি মাসীকে সান্ত্বনা দেবার মত কোন ভাষা আর খুঁজে পায় না দাশুর মন। দাশুর পাঁজরের হাড়গুলি যেন পুড়ছে। সারাদিনের একটা ভুয়া আশার নেশা এইবার একেবারে ছাই হয়ে ঝরে পড়ে গিয়েছে। লালবাবু একটা অভিশাপ, দুখনবাবু একটা হিংসা। মধুকুপির কিষাণের প্রাণের সব সুখ শুষে নিয়ে রক্তমাখা জিভ দুলিয়ে নাচবার জন্য দুই পিশাচের মতলব আরও কঠোর হয়ে উঠেছে।

টাঙ্গিটা কাঁধের উপর তুলে, আর নিজের মুখের চেহারাটাকেও একটা আক্রোশের পিশাচের মত বীভৎস করে তখনি একটা দৌড় দিত দাশু, কিন্তু ফুলকি মাসী আগে উঠে এসে দাশুর হাতের টাঙ্গি চেপে ধরে : তুমি ওদিক পানে আর যেও না, দাশু।

দাশু–কি বলছিল মাসী?

ফুলকী—তুমি কুঠিতে যেও না।

দাসু-কেন?

ফুলকি-যেয়ে লাভ নাই। কুঠির দয়া আর চাই না দাশু। আমি এ গাঁয়ে আর থাকবো না।

দাশু–কোথায় যাবে?

ফুলকি-কয়লাখাদে যাব।

আস্তে একবার চমকে ওঠে দাশু। মাথার ভিতরের সব আক্রোশের উত্তাপও যেন হঠাৎ শিউরে ওঠে আর ঠাণ্ডা হয়ে যায়। মাথা হেঁট করে একটা হাঁপ ছাড়ে দাশু ও ছেড়ে দে মাসী, ঘরে যেতে দে।

ঘরের দিকেই এগিয়ে যেতে থাকে দাশু। চযা ক্ষেতের মাটিব তেল মাড়িয়ে, টলতে টলতে সড়কের উপর এসে উঠে একবার পিপুলতলার দিকে চোখ পড়ে দাশুর। অনেক আলো জ্বলছে পিপুলতলায়, আর বেশ নতুন রকমের একটা হত্নার শব্দও বাজছে। বাবু দুখন সিং আবার একটা নতুন অভিশাপের উৎসব মাতিয়ে তুলেছে বুঝি! চোখ ফিরিয়ে নিয়ে ঘরে ফিরে যাবার পথে এগিয়ে যেতে থাকে দাশু।

ঘরের কাছে এসে পোঁছতেই দেখতে পায় দাশু দাওয়ার উপর একটা ছায়া বসে আছে। কে বটে? ডাক দেয় দাশু।

-আমি সনাতন।

–কি বটে সনাতন?

দুখনবাবু নতুন জাতপঞ্চ চালু করলে। যারা ঈশান মোক্তারের জমিতে মনিষ খাটতে রাজী আছে, শুধু তাদের নিয়ে নতুন জাতপঞ্চ হলো। জটা রাখালের দল আছে। সাধু, ভনু আর পচুও আছে। শুন নাহ পিপুলতলার হল্লা?

–শুনেছি। কিন্তু…।

দাশুর হাত ধরে টান দেয় না : না দাশু। আজ আর ওদের কিছু বলতে যেও না। তুমি ঘরে থাক।

দাশু চেঁচিয়ে ওঠে কিন্তু কাল আমাদিগের জাতপঞ্চ ডাকতে হবে সনাতন। ডর করলে চলবে না।

–বেশ, বেশ। তাই হবে দাশু। দাশুকে ঘরের ভিতরে ঠেলে দিয়ে আর দরজার কপাট ভেজিয়ে দিয়ে চলে যায় সনাতন।

ওদিকে পিপুলতলায় চারটে খুঁটির গায়ে চারটে লণ্ঠনের আলোর কাছে বনচণ্ডীর নামে শপথ করে যে নতুন জাতপঞ্চ হেসে আ. চেঁচিয়ে উঠল, সেই জাতপঞ্চের সভার মাঝখানে দুখনবাবুর পাশে তখন আর একটি চৌকির উপর বসেছিল, একজন, বেশ হাসি-হাসি মুখ, বনচণ্ডীর সেবাইত চক্রবর্তী।

দুখনবাবুর প্রাণের আশা উৎসাহ আর প্রতিজ্ঞার সৃষ্টি এই জাতপঞ্চ জাতের সুধার মেনে নিয়েছে। না, ঘরের ব” বেটি বহিন আর নাচবে না। কাজের বয়স হবার আগেই বেটিবহিনের বিয়া দিতে হবে। বিয়ার কাজে বামনে মন্তর পড়বে। কেউ আর কুঁকড়া খাবে না।

তা ছাড়া, জমি চাই না। কুঠির জমিতে বাপদাদারা যেমনটি মনিষ খেটে এসেছে, সবাই তেমনটি মনিষ খাটবে।

আর, আর একটা প্রস্তাব করল দুখনবাবু, আর চক্রবর্তীও বুঝিয়ে দিল। জাতের তিনটা ভাগ দল। জাতিয়া, খাদিয়া, আর কুঁকড়াশী। যারা বামন মানবে তারা জাতিয়া; যারা কয়লাখাদে কাজ নিয়ে মালকাটা আর ময়লাকামিন হবে, তারা খাদিয়া। যারা কুঁকড়া খাওয়া ছাড়বে না, তারা কুঁকড়াশী। ভাত-ভাইয়ারীতে জাতিয়ারা সবার আগের সারিতে বসবে, পরের সারিতে খাদিয়ারা; শেষ সারিতে কুঁকড়াশী। যদি খাদিয়া আর কুঁকড়াশীরা এই নিয়ম না মানে, তবে জাতিয়ারা তাদের সাথে কোন ভাত-ভাইয়ারীতে বসবেই না।

জটা রাখাল বলে বড় ভাল নিয়ম হলো, দুখনবাবু।

বনচণ্ডীর প্রসাদ বিতরণ করে চক্রবর্তী; জাতপঞ্চের সভা যখন ভাঙে, তখন পিপুলতলার ছায়ার অন্যদিকের একটা চৌকির উপর নড়ে চড়ে বসে একটি প্রসন্ন মূর্তি, আর সেঁকুর তুলে নিয়ে সরাবের বোতলটাকে তারই পায়ের কাছে উবু হয়ে বসে থাকা একটি বিনীত মূর্তির এগিয়ে দিয়ে বলে–নে রামাই, একটু তাড়াতাড়ি কর।

পুলিশ মুন্সী চৌধুরীর হাত থেকে সরাবের বোতলটা হাতে তুলে নেয় রামাই দিগোয়ার। আজই দুপুরে লালবাবুকে সঙ্গে নিয়ে গোবিন্দপুর থানাতে গিয়ে এজাহার দিয়েছিল দুখনবাবু, মধুকুপির একদল দুর্দান্ত কিষাণ কুঠির ভাণ্ডার লুট করতে চায়।

কুঠিতে লালবাবু আছে, বন্দুক আছে আর দুটো পালোয়ান চাকরও আছে। আর, এখানে আছে পুলিশ মুলী চৌধুরীজী ও রামাই দিগোয়ার। চৌধুরীর কাঁধেও বন্দুক। আর কিসের পরোয়া? কার ডর? বড়বুড়া রতনের শীর্ণ কণ্ঠের হুংকার, দাশু দাগী আর সনাতন লাইয়ার চিকারকে বার ঘণ্টার মধ্যেই জব্দ করে দিয়েছে দুখনবাবু। চৌধুরীর আশ্বাসে প্রসন্ন আর নির্ভয় হয়ে নতুন জাতপঞ্চ চালু করে ফেলেছে দুখনবাবু। শালুর রুমালে বাঁধা দশটা টাকার নগদ উপহার চৌধুরীর খাকি কোটের পকেটের ভিতরে অনেকক্ষণ হল ঠাঁই পেয়েছে।

-আর কি চাই, আজ্ঞা করেন চৌধুরীজী। চৌধুরীর কাছে এগিয়ে এসে বিনীতভাবে প্রশ্ন করে দুখনবাবু।

—একটা গো-গাড়ি চাই দুখনবাবু।

গো-গাড়ি আসতেও দেরি হয় না। তারপরেই পিপুলতলার সড়কের উপর দিয়ে দুটি ছায়ামূর্তি যেন দুলে দুলে হাঁটতে শুরু করে। চৌধুরীর পায়ের ভারী বুটের শব্দ খট খট করে বাজে। রামাই দিয়োয়ারের খালি পা পথের কাঁকর ঘষে ঘষে চলে। পিছনে গো-গাড়ির চাকাতেও যেন একটা লালসার্ত স্বরের শিহর। চৌধুরী ডাকে-রামাই।

–বলেন হুজুর।

–সরদারিনের হাসিটা বড় মিঠা, নয় কি?

রামাই-হ্যাঁ হুজুর..বা..এই তো ওর ঘর। আপনি এখানে গাড়ির কাছে একটুকু দাঁড়ান; আমি সরদারিনকে ডেকে নিয়ে আসছি।

জীর্ণ জামকাঠের দরজার উপর আস্তে আস্তে টোকা দিয়ে একটা আদুরে আহ্বানের নরম শব্দ বাজিয়ে ডাক দেয় রামাই-সরদারিন; আমরা এসেছি গো। গো-গাড়িও এনেছি।

দরজা খুলে যায়। ঘরের ভিতর বড় অন্ধকার। সেই অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছটফট করছে যে ছায়াটা, তারই দিকে তাকিয়ে রামাই দিগোয়ার বলে–তুমি যেমনটি বলেছিলে, তেমনটি বন্দোবস্ত হয়েছে সরদারিন। গোবিন্দপুর বাজারে তোমার লেগে ঘর নিয়েছেন চৌধুরীজী।

ঘরের ভিতরের ছায়াটা আরও অস্থির হয়ে ওঠে। রামাই হাসে-আরও ভাল খবর আছে, সরদারিন। দাশুর নামে থানাতে অনেক এজাহার পড়েছে। জঙ্গলের শিশাল চুরি, খয়ের চুরি, আর কাঠকয়লা চুরি। গত মাসে থানাতে হাজিরাও দেয় নাই দাগীটা। কাল ওর গেরেপ্তারি হবে। আবার পাঁচ বছর ধরে জেলের ভাত খাবে দাগীটা। তোমার কোন ভাবনা নাই সরদারিন। এসো…চলে এসো। চৌধুরীজী দাঁড়িয়ে আছেন। আর দেরি কর কেন, সরদারিন?

ঘরের ভিতরের ছায়াটা আবার ছটফট করে ওঠে। তার পরেই একেবারে শান্ত হয়ে যায়। দরজার চৌকাঠ পার হয়ে ধীরে ধীরে ঘরের বাইরে দাওয়ার উপর এসে দাঁড়ায় ছায়াটা।

-তুই কে বটিস? চিৎকার করে দু পা পিছিয়ে যায় রামাই দিগোয়ার। তার পরেই একটা প্রচণ্ড আতঙ্কের ডাক ছাড়ে-জলদি আসেন হুজুর। দাগীটা ঘরে আছে।

একটা ঝোলার ভিতর থেকে হাতকড়া আর দড়ি বের করে, কাঁধের বন্দুকটা হাতে তুলে নিয়ে দোলাতে দোলাতে ছুটে আসে চৌধুরী ও শালকে বেঁধে ফেল রামাই।

কোন আপত্তি করে না, নড়েও না দাশু। রামাই দিগোয়ার দাশুর দুটো হাত শক্ত করে চেপে ধরে, হাতকড়া পরিয়ে দেয় চৌধুরী। দাশুর কোমরটাকেও দড়ি দিয়ে দু পাক বেঁধে নিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে চৌধুরী-সরদারিন গেল কোথায়?

দাশু–ঘর ছেড়ে চলে গিয়েছে।

চৌধুরী-যাবেই তো; তোর মত দাগীর ঘরে থাকবে কেন মুরলীর মত মাগি? কিন্তু ভাল ঠগিন বটে মাগিটা!

রামাই বলে-মাগিটা এই দাগীটার চেয়েও চালাক আর বদমাশ বটে হুজুর।

দাশুর কোমরের দড়ি ধরে টান দেয় চৌধুরী ও চল।

গোবিন্দপুর থানার হাজতঘরে সাতটা দিন আর রাত পার করে দেবার পর যেদিন জেল হাজতে চালান হয় দাশু, সেদিন দাশুর প্রাণ যেন একটা দুঃসহ জ্বরের জ্বালা থেকে মুক্তি পেয়ে হাঁপ ছাড়ে। গোবিন্দপুর থানার পিশাচটা, চৌধুরীজী যার নাম, তার ছায়া আর চোখে দেখতে হবে না। ঐ ঘড়ঘড়ে স্বরের হাঁকডাক আর শুনতে হবে না।

যখন তখন এসে মুরলী কিষাণীর নাম করে এক-একটা গালভরা লালসার গালি আর ঠাট্টার বুলি চেঁচিয়ে বলতে ও হেসে উঠতে বড় মজা পায় চৌধুরী। মুরলীর মত কিষাণীর আগুনপারা যৈবনটি, গতরের ঠাটটি, আর বুকটির ও কোমরটির বাহারটি কি এক ভাতারের বশ হতে পারে রে বোকা কিষাণ? মাগি ঘরের বার হয়েছে, বেশ হয়েছে। চৌধুরীজীর কথা শুনে হাজত-ঘরের বন্দী যত কালোকালো মুখগুলিও হো-হো করে হেসে ওঠে।

ভেজা ঠোঁটের সরস হাসিটাকে জিভ দিয়ে চেটে চৌধুরী আক্ষেপ করে? কিন্তু মাগিটা বড় চালাক বটে হে, সরদার। খিরিস্তান পলুস হালদারের সাথে ঢলেছে। মাগি শেষে মেমসাহেব হয়ে যাবে নাকি হে?

হাজত-ঘরের ভিড় আবার হেসে ওঠে। চৌধুরীজীর চোখে হঠাৎ ছোট একটা ভ্রূকুটি শিউরে শিউরে কাতরাতে থাকে বড় শক্ত ঠাঁই নিয়েছে মাগি। খোজ নিয়ে জেনেছি, হারানগঞ্জে গিয়ে সিস্টার দিদির আদরের কবুতরটি হয়েছে মাগি। তা না হলে ওকে টেনে এনে থানার ভাত খাইয়ে ছাড়তাম হে।

–সিস্টার দিদি কওন ছে? হাজত-ঘরের ভিড়ের ভিতর থেকে একটা রুক্ষ মুখ দুটি দাঁতের সাদা বের করে হেসে ওঠে।

চৌধুরী-হারানগঞ্জের সিস্টার দিদির নাম শুনিস নাই মেড়ুয়া? এত বড় লাল মুখ, নীল চোখ, আর সাদা চুলের ঝুঁটি; বিলাতী বুড়ির একটা ভাই যে লাট সাহেব হয়েছিল হে! আজাদী হবার পর বিলাত পালিয়েছে সিস্টার দিদির লাট ভাই। কিন্তু, সিস্টার দিদির উঁটি তবু মরে নাই।

ছোটকালুর বহেড়া জঙ্গলের একটা নেকড়ে একবার উরানির বানভাসির যত মড়ার মাংস খেয়ে খেয়ে পাগল হয়ে গিয়েছিল। নেকড়েটার গলার স্বরও বদলে গিয়েছিল। মনে হয় দাশুর, গোবিন্দপুর থানার এই চৌধুরীর গলার স্বরের মধ্যে সেই পাগল নেকড়েটারই গলার স্বর ঘড়ঘড় করছে। একদিন ধানক্ষেতের আলোর কাছে দেখতে পেয়ে নেকড়েটাকে কাটবার জন্য টাঙ্গি হাতে নিয়ে তাড়া করেছিল দাশু। কিন্তু পালিয়ে গিয়েছিল নেকড়েটা।

সেই ব্যর্থতার আর অক্ষমতার আক্ষেপ তবু সহ্য করা যায়। কিন্তু চৌধুরীজী নামে এই নেকড়েটাকে সেদিন রাতের অন্ধকারে ঘরের দরজার কাছে পেয়েও টাঙ্গির এক কোপে কেটে দু টুকরো করে দেবার ইচ্ছা কেন হয় নি, সে কথা এখন ভাবলে একটা জ্বালাময় আক্ষেপ দাশুর মনের ভিতরে ছটফট করে ওঠে। ভুল হয়েছিল; বড় খারাপ ভুল। সে ভুলেরই শাস্তি। একটা লুচ্চা লোভের ঠোঁট-চাটা নেকড়ে মুরলীর নাম করে যা-খুশি তাই বলে নিচ্ছে; আর দাশুকেও তাই নিজের কানে শুনতে হচ্ছে। আর যে সহ্য করতে পারা যায় না।

তাই জেল হাজতে যাবার দিনে দাশুর প্রাণটা সাত দিনের অভিশাপের গ্রাস থেকে সরে যাবার সৌভাগ্যে খুশি হয়ে ওঠে। গোবিন্দপুরের ছোট জেলখানা; ফটকটা পুরুলিয়ার জেলখানার ফটকের মত দরাজ নয়। কিন্তু গোবিন্দপুরের ছোট জেলখানার ভিতরের সজীবাগানটা দেখতে কী চমঙ্কার! মাটিটা লাল এটেল বটে; কিন্তু পচা হিঞ্চের সবুজ সার দিয়ে মাটি মজানো হয়েছে নিশ্চয়; তা না হলে মাটির রংয়ে এত কালোকালো দানা কেন, আর গন্ধটাও সোঁদা কেন? বাগানের একদিকে পুই আর লাউয়ের লতা মাচান উপচে ঝুলে পড়েছে। আর একদিকে শুধু চষা হয়ে পড়ে আছে মাটি। ওখানে ফুলকপির চারা লাগানো হবে বলে মনে হয়, নয়তো মূলা আর পালং।

জেল-হাজতে প্রথম রাতেই আধা-ঘুমের ঘোরে হেসে ফেলে আর জেগে উঠে কম্বলের উপর কিছুক্ষণ বসে থাকবার পর বুঝতে পার দাশু, কেন হেসে উঠল মনটা, আর মাথার ভিতরে একটা স্বস্তির আরামই বা বোধ হচ্ছে কেন?

মনে পড়েছে দাশুর, নেকড়ের মাংসাশী আত্মাদের চক্রান্তটাকে কী সুন্দর বুদ্ধির খেলায় বেকুব করে দিয়েছে মুরলী! ওর প্রাণের আর গতরের মান বাঁচিয়ে পালিয়ে যেতে পেরেছে। তুই সত্যিই হিসাব জানিস, বড় ভাল হিসাব জানিস, মুরলী।

ভাল হয়েছে। খুব ভাল। দাশুর আধা ঘুমের স্বপ্নটা যেন মুরলীর সৌভাগ্য দেখে খুশি হয়েছে। না, আর আক্ষেপ করার কিছু নেই। মুরলী যখন নিরাপদ, তখন পাঁচ বছরের কয়েদ নির্ভাবনায় সহ্য করতে পারা যাবে।

পাঁচ বছর? সত্যিই কি আবার পাঁচ বছরের শক্ত সাজা হবে? যদি হয়, হেই গো কপালবাবা, দাশু কিষাণের প্রাণটাকে বাঁচিয়ে রাখবে তো? মুরলীর পেটে যে দাশু কিষাণের ছেইলা আছে। দেখতে কেমনটি হল, দেখতে কত ভাল লাগে নিজের ছেইলার মুখটা, সে সুখ জীবনে না বুঝে নিয়ে মরে যেতে ইচ্ছা করে না।

না, মরব কেন? দাশুর জীবনের আশা আর প্রতিজ্ঞা আবার আশ্বস্ত হয়ে তন্দ্রাময় হাসি হাসে; কলঘরের বড় মিস্তিরি খিরিস্তান পলুসের ঘরের সুখের গৌরবকে হার মানতে বাধ্য করবে যে দাশু, সে দাশু মরবে না। জেল থেকে ফিরে এসে ক্ষেতজোত করবে, নতুন মাটির ঘর তুলবে। আঙিনায় খড়ের মাচানের পাশে বসে সাঁঝের চাঁদের দিকে তাকিয়ে যখন মাদল বাজাবে দাশু তখন আঙিনার দিকে মুরলীকে আস্তে আস্তে আর হেসে হেসে এগিয়ে আসতে দেখে একটুও আশ্চর্য হবে না দাশু–আমি তো জানতাম মুরলী, একদিন তোর ফিরে আসতে হবে। কিন্তু…তুই বল এবার, আজ আমি তোকে কেমন করে ঘরে ঢুকতে বলি?

-কেন সরদার? আমার লেগে কি তোমার মনে একটুকও মায়া নাই?

জেল-ফটকে বিউগল বাজে। হাজত-ঘরের দরজার বাইরে ভারী বুটের শব্দ শোনা যায়। দাশু কিষাণের ঘুমভাঙা চেতনার মধ্যে একটা অভিমান যেন নীরবে গুনগুন করে, সত্যিই কি মধুকুপির গরীব কিষাণকে আবার পাঁচ বছরের কয়েদ খাটাবে কপালবাবা?

তারপর আর বেশি দেরি হয় না। জেল ফটকে সকাল নটার ঘন্টা বাজতেই রুটি-গুড় আর জল খেয়ে যখন হাঁপ ছাড়ে দাশু, তখন হাজতঘরের দরজা খুলে যায়। দড়িবাঁধা কোমর নিয়ে দুই সিপাহীর পাহারায় গোবিদপুরের আদালতের পথে এগিয়ে যেতে হয়। তিনটে চুরির অপরাধ, থানায় হাজিরা না দেবার অপরাধ, আর ঈশান মোক্তারের ভাণ্ডার লুট করবার জন্য হাঙ্গামা মাতাবার অপরাধ। পাঁচটি অপরাধের বিচার বরণ করতে হবে। দাশু জানে, চৌধুরীজীই জানিয়ে দিয়েছে এই পাঁচ কসুরের জন্য তোকে চালান করা হয়েছে রে দাগী।

জেল-হাজত থেকে আদালত, দাশুর জীবনটা আবার আসামী হয়ে দুই সিপাহীর পাহারায় আনাগোনা করে। প্রায় রোজই আধ ক্রোশেরও বেশি পথের লাল ধুলো মাড়িয়ে আদালতে যেতে হয়। আসামীর কাঠগড়ায় একবার দাঁড়াতে হয়। কে জানে কি বলেন আর কি লেখেন হাকিম! তারপর আবার কোমরের দড়িতে টান দেয় সিপাহী। কাঠগড়া থেকে নেমে আসতে হয়। আবার জেলের পথে ফিরে যেতে হয়, আবার জেল-হাজতের নিভৃতে কম্বলের উপর শুয়ে বসে শুধু ভাবনা। সেই ভাবনার মধ্যে একটা ক্ষেত আর গুলঞ্চের বেড়া, একটা নতুন মাটির ঘর; মুরলী আর মুরলীর ছেইলা, মাদল আর মহুয়ার মায়া তন্দ্রাময় হয়ে ওঠে। ভোরের বিউগল বাজলে তবে সেই তন্দ্রার ছবি ভাঙে।

কে জানে কবে বিচার শেষ হবে? আদালতের বাইরে একটা আমবাগান। তারই ছায়ায় বসে আসামী দাশুর কোমরের দড়ি ধরে হাঁকের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে নোজই হাঁপিয়ে ওঠে সিপাহী দুজন।

হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে সিপাহী গোকুল সামন্ত-এ অর্জুন সিং?

–কি হে? মাথা ঝেকে ক্লান্ত চোখের আলস্য ঝেড়ে ফেলে উত্তর দেয় অর্জুন সিং।

গোকুল সামন্ত বলে-ভালা পাগল হয়েছে আদালত। এক বেটা দেহাতী চাষার ছুটকা চুরির মামলা খতম করতে আর কতদিন নিবে? রোজ রোজ সাক্ষী রে; সাবুদ রে; তারিখ রে। আর আমাদিগের দিনভর হয়রানি রে! ভালা, এতদিনে যে কোলের ছেইলার মোচ গড়ায়ে যায় হে।

অর্জুন সিং মুখ কুঁচকে দাঁতের ব্যথা চাপতে চেষ্টা করে : মত্ কহে ভাইয়া! হোড়াসা শিশাল, দো-চার সের কথা, ইতনাসা কোয়লা, সাড়ে চার রূপাইয়াকা মাল চোরিকে মামলা; ইসকে লিয়ে শও শও রূপেয়া খরচা! ইয়ে তো মামলা নেহি; তামাশা হ্যায় ভাইয়া!

দাশুর মুখের দিকে তাকিয়ে মাঝে মাঝে একটা রাগের হাঁক ছাড়ে সিপাহী গোকুল সামন্ত-তোমার লাজ লাগে নাই সরদার? মাগের কানে কোন্ সোনার মাকড়ি পরাতে সাধ হয়েছিল যে সাড়ে চার টাকার মাল চুরি করলে? সত্যি চুরি করেছিলে কি?

দাশু হাসে : হ্যাঁ, চুরি বল তো চুরি। ডাকাতি বল তো ডাকাতি, লুঠ বল তো লুঠ! যাদিগের মাল তাদিগের স্কুম না নিয়ে ওই সাড়ে চার টাকার মাল তুলে এনেছিলাম।

অর্জুন সিং–সে তো হলো, কিন্তু ঈশান মোক্তারের ভাণ্ডার লুঠ করবার লেগে তুমি যে…,

গোকুল সামন্ত চেঁচিয়ে ওঠে–দূর দূর! দুখন গুমস্তার মত শয়তানের এজাহার তুমিও বিশ্বাস কর সিংজী?

অর্জুন সিং-কি সরদার? ঝুট বটে কি?

দাশু–হ্যাঁ।

গোকুল সামত্ত-নিশ্চয় তোমার উপর ওর রাগ আছে?

দাশু–হ্যাঁ।

গোকুল-তবে আর তোমার ছাড়া নাই সরদার। চৌধুরী আর দুখনবাবু, ওরা দুজন হল দুটা ভগবান; আর থানাটা ওদের বৈকুণ্ঠ। ওদের দয়া খণ্ডাবে, কারও বাপের এমন জোর নাই।

অর্জুন সিংয়ের চোখ আবার ঢুলুঢুলু হয়। ঘুমের আবেশে মাথা ঝুকিয়ে বিড়বিড় করে অর্জুন সিং-সাড়ে চার রূপৈইয়ার মাল চোরি না করে ভিখ মাংনা যে ভাল আছে রে ভাই। কাজ না মিলে তো ভিখ মাংগো। বাজারে বাজারে রাম নাম হাঁকতে চলল, আউর ভিখ মাংগতে চলো। পুনভি হোবে, ভুখবি মিটবে।

দাশুর চোখ দুটো হঠাৎ ভয় পেয়ে থরথর করে কেঁপে ওঠে। এ কি ভয়ানক অদুষ্টের খবর শুনিয়ে দিয়ে ঘুমের আরামে মাথা ঝুকিয়ে ঢুলতে শুরু করেছে সিপাহীটা! ওর কপালে হলুদ রংয়ের কত বড় তিলক! মধুকুপির কিষাণের জীবনটা কি সত্যিই ভিক্ষুক হয়ে যেতে চলেছে?

দাশু কিষাণের পাথুরে ছাঁদের বুকটাও ধড়ফড় করে ওঠে; সত্যিই একটা ভিক্ষুকের নাকি সুরের চিৎকার আদালতের চারদিকের সব সোরগোলের বুক ভেদ করে উথলে উঠেছে। ভীরু কুকুরের আর্তনাদের মত একটা আবেদনের ভাষা যেন কেউ কেউ করে ভিড়ের ভিতর ঘুরছে।

ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখতে থাকে দাশু, নাকি সুরের গানের মত সুর করে ছড়া কাটছে ভিক্ষুকটা-দাতা দেবতা, দেবতা দাতা। দাতার মাথায সোনার ছাতা।

খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগিয়ে আসছে ভিক্ষুকটা, আর পথের ভিড়ের মানুষগুলির চোখের সামনে একটা টিনের কৌটা দুলিয়ে বুড়ো কুকুরের মত ধুকে ধুকে নাকিসুরের বুলি ছাড়ছে বাবা গো বাবা। একটা পয়সা যে তোমার পানের পিক গো বাবা! দুটা পয়সা যে তোমার চা

পানির থুক গো বাবা! খোঁড়া সাধুকে একটা-দুটো পয়সা দয়া কর গো বাবা!

সড়ক থেকে নেমে আমবাগানের ভিড়ের কাছে এগিয়ে আসে ভিক্ষুকটা; আর, দাশুর চোখের কাছ দিয়ে যেতে যেতে হাঁক দেয় বাবা গো বাবা!

দাশুর বুকের পাঁজরগুলি যেন এক সঙ্গে ছিঁড়ে গিয়ে একটা প্রচণ্ড শব্দ ছাড়ে-মেসো হে, ও তিনকড়ি মেসো!

থমকে দাঁড়ায় ভিক্ষুকটা। হ্যাঁ, মধুকুপির তিনকড়ি মেশোই বটে। বটের আঠা আর ধুলো মাথায় মেখে বড় বড় চুলের জটা করে, গিরিমাটি দিয়ে রঙিন করা এক টুকরো কাপড় কোমরে জড়িয়ে, আর বুকের উপর এক মুঠো ছাই ছড়িয়ে দিয়ে সাধু সেজেছে যে তিনকড়ি, সে তিনকড়িও দাশুর মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে ওঠে। তারপর আস্তে আস্তে খুঁড়িয়ে দাশুর আরও কাছে এগিয়ে আসে।

সিপাহী গোকুল সামন্ত বিরক্ত হয়ে চেঁচিয়ে ওঠে,-না না না, আসামী হয়ে পাব্লিকের সাথে কথা বলবে না সরদার।

অর্জুন সিং চোখ মেলে তাকিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে : হাঁ হাঁ হাঁ; রুল আছে, কারও সাথে বাতচিত করবে না আসামী।

দাশু–-এ আমার গাঁয়ের মানুষ বটে।

সিপাহী গোকুল সামন্ত কি-যেন ভাবে। তারপর নরম স্বরে বলে–আচ্ছা, দুটা একটা কথা বলে নাও।

–তুমি এ কেমন দশাটি করলে মেসো? তিনকড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করতে গিয়ে দাশুর গলার স্বরে একটা রাগের ঝাজ তপ্ত হয়ে ওঠে।

তিনকড়ি বলে-ফুলকিকে আর দুখ দিতে চাই না দাশু, তাই…।

দাশু–তাই ভিখমাগা হয়ে গেলে?

তিনকড়ি-হাঁ রে বাপ।

দাশু–মাসী কি বলে?

তিনকড়ি-তোমার মাসী গাঁ ছেড়েছে, কয়লাখাদে চলে গিয়েছে। আমিও গাঁ ছেড়ে দিলাম দাও।

দাশু–মাসীর সাথে তুমিও খাদে গেলে না কেন?

তিনকড়ি হাসে না দাশু, আর নয়। তোমার মাসী সুখে থাকুক; আমার ভাত আমি করে নিব।

তিনকড়ির ফ্যাকাশে চোখ দুটো হঠাৎ লাল হয়ে ওঠে আর জলে ভরে যায়। তারপরেই মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ব্যস্তভাবে চলতে থাকে তিনকড়ি।

বাবা গো বাবা! বুড়া কুকুরের আর্তনাদের মত শব্দটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে, ধুকতে ধুকতে আর টিনের কৌটা দুলিয়ে দুলিয়ে আদালত এলাকার ভিড়ের ভিতর দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে দাও।

মরেছে, তিনকড়ি মেসো মরেই গিয়েছে! গাঁ ছাড়ল আর ভিখমাগা হল যে, তার আর মরণের বাকি কি আছে? দাশুর বুকের ভিতরের আতঙ্ক আরও ভয়াল হয়ে ওঠে।

দুপুর পার হতে চলল। আমবাগানের ছায়াও গরম হয়ে উঠেছে। আজও কি মামলার রায় দিবে না হাকিম? ছটফট করে দাশু কিষাণের প্রাণ। দাশুর প্রাণটা যেন ভিক্ষুক হয়ে যাবার

ভয় থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এই মূহুর্তে কয়েদ হয়ে যেতে চায়।

জানে না দাশু, কতক্ষণ ধরে এই ভয়াতুর ভাবনার মধ্যে ছটফট করতে করতে ঝিমিয়ে পড়েছিল মন; চোখ বন্ধ করে দুই হাঁটুর উপর মাথা পেতে দিয়ে অনেকক্ষণ বসে থাকবার পর আবার চোখ দুটো একটা ব্যাকুল পিপাসায় চঞ্চল হয়ে ওঠে। এদিক-ওদিক তাকায় দাশু।, জেলে যেতে ইচ্ছে করে না; এক ঝটকা দিয়ে অর্জুন সিংয়ের হাত থেকে কোমরের দড়িটা ছিনিয়ে নিয়ে এই মুহূর্তে ছুটে পালিয়ে যেতে ইচ্ছা করে।

রোদ পড়ে বড়কালুর গায়ের ঝরনা চিকচিক করছে, কাছে গিয়ে দেখে আসতে ইচ্ছে করে। পলাশবনের ছায়ায় তিতির ডাকছে, একবার শুনে আসতে ইচ্ছে করে। জামকাঠের জিরজিরে কপাটের গায়ে ঠেস দিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। ডরানির জল বড় ঠাণ্ডা! ছোটকালুর জঙ্গলের কেঁদ আর পিয়াল বড় মিঠা। সনাতনের মাদলের আওয়াজ আরও মিঠা।, জেল যেতে চাই না কপালবাবা। তোমার দাশু কিষাণকে ছাড়া পাইয়ে দাও। দাশুর যে ঘর আছে, গাঁ আছে; মুরলীও যে একদিন এসে পড়বে; মুরলীর কাছে দাশুর ছেইলা যে আছে!

টিহা টিহা টিহা! আমবাগানের ছায়া আর বাতাস মিটা করে দিয়ে শিউরে ওঠে একটা পাখির ডাক। চমকে ওঠে দাশুর বুক। দাশুর স্বপ্নকে যেন ঠাট্টা করছে পাখিটা। কী সর্বনাশ; এটা কি সেই পাপিয়া?

নিশ্চয় সেই পাপিয়ার ডাক। তা না হলে দাশু কিষাণের এত কাছে এসে দাঁড়িয়ে আর দাশুর মুখের দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠবে কেন সকালী?

বেদেনী সকালীর কালো চোখ দুটোও হাসছে। দেখতে একটু রোগা আর শুকনো হয়েছে সকালী। কিন্তু মুখটা যেন আরও সুন্দর হয়েছে। সকালীর কাকালে একটা ঝুড়ি। ঝুড়িতে লাল টুকটুকে একগাদা পাকা তেলাকুচা। সকালীর হাতে জ্যান্ত তিতিরের একটা মালা। মধুকুপির পলাশবনের একটা বিহুল স্মৃতি এই আমবাগানের ছায়ার ভিতরে ঢুকে দাশুর দড়িবাধা কোমরের দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হাসছে।

–এটা তোমার কে বটে হে সরদার? সকালীর মুখের দিকে তাকিয়ে আবার বিরক্ত হয়, আর প্রশ্ন করে সিপাহী গোকুল সামন্ত।

দাশু বলে-আমার কেউ নয়। কিন্তু…।

গোকুল-কি?

উত্তর দেয় না দাশু। যেন সকালীর হাসির স্বরের জ্বালা সহ্য করবার জন্য মুখ ফিরিয়ে অন্য দিকে তাকায়।

আরও কাছে এগিয়ে আসে সকালী : আমি তো তোমার কেউ নই; কিন্তু মুরলী তোমার কে বটে সরদার? একবার বল শুনি। মুরলীকে নিয়ে কেমন সুখের ঘর করছে, খবরটি একবার বল।

টিহা টিহা টিহা! আমবাগানের পাপিয়া ভয়ানক ঠাট্টার আমোদে আত্মহারা হয়ে পাতার আড়ালে লুটোপুটি করে ডাকতে থাকে।

গোকুল সামন্ত একবার অর্জুন সিংয়ের মুখের দিকে তাকায়। অর্জুন সিং মাথা নেড়ে বলে–হ্যাঁ, দু-চারটি বাতচিত হোবে, এই তো। হোনে দেও ভাই।

গোকুল বলে—তোমরা একটুক আস্তে কথা বল, সরদার।

হাতের দড়ির তিনটে পাক আলগা করে দিয়ে একটু দূরে সরে গিয়ে বসে অর্জুন সিং। গোকুল সামন্ত আরও একটু দূরে। সরদারটার করুণ মুখের চেহারা দেখে দুজনের আপত্তি আর সাবধানতাও যেন একটু করুণ হতে চাইছে।

ফিস ফিস করে চাপা গলার স্বরে যেন একটা আক্রোশের জ্বালা দাশুর কানের কাছে ছড়িয়ে দিয়ে হাসতে থাকে সকালী : যে মুরলীর লেগে আমাকে ঠকালে, সে মুরলী এখন কোথায় আছে সরদার?

মাথা হেঁট করে দাশু।

সকালী—নিজেই ছুটে এসে সকালীর বুক ছুঁয়ে দিলে, শেষে সকালীকে ঠেলে দিয়ে পালিয়ে গেলে সরদার। ছিয়া ছিয়া; মরদে কি মেয়েমানুষকে এমন দুখও দেয়?

দাশু–আমার দোষ হয়েছে। মাপ করবে কি?

হেসে ফেলে সকালীঃ তুমি মুরলীকে চিনেছ কি?

–চিনেছি।

–কিন্তু মুরলীকে ঘিন্না কর কি?

চমকে ওঠে আর বোকা বোবার মত শুধু ঠোঁট নাড়ে দাশু। সকালীর মুখের দিকে অসহায়ের মত তাকিয়ে থাকে।

সকালী হাসে : তবে বল সরদার। আমার মরদ হতে ইচ্ছা হয় কি?

দাশু কিষাণের মাথার রক্তে একটা নেশার স্মৃতি চনচন করে ওঠে। বুকের উপর একটা নগ্ন কোমলতার স্মৃতি তৃপ্ত হয়ে ওঠে। চোখের উপর স্বচ্ছ জলের তরলতা দিয়ে গড়া একটা মধুরতার ছবি টলমল করে।

সকালী বলে–কিসের গাঁ, কিসের ঘর, কিসের বিয়া সরদার? সব ভুলে যাও। আমার সাথে থাক। আমার মরদ হয়ে মন ভরে সুখ কর। আমি তোমাকে ভাত দিব, কাপড় দিব, হাড়িয়া দিব। যেদিন ইচ্ছা হবে চলে যেও। ইচ্ছা হলে সকালীকে টুটি চিপে মেরে রেখে চলে যাও।

–সকালী! আস্তে ডাকতে গিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে দাশু।

কিন্তু সেই মুহূর্তে আদালতের বারান্দার উপর এসে হাঁক দিয়েছে পিয়াদা। দাশু আসামীর মামলার হাঁক।

একটা লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায় সিপাহী গোকুল সামন্ত আর অর্জুন সিং।

–বাস্, আর বাতচিত হোবে না, খবরদার! দাশুর কোমরের দড়ি ধরে টান দেয় অর্জুন সিং।

ঝুড়ির তেলাকুচা সরিয়ে শালপাতায় মোড়া একটা বস্তু বের করে কাতরভাবে মিনতি করে সকালী—একটুক সবুর করেন সিপাহীজী।

-ওটা কি বটে? চোখ বড় করে তাকায় গোকুল সামন্ত।

সকালী-মকাইয়ের খইয়ের দুটা মোয়া বটে। সরদারকে মোয়া দুটা খেয়ে নিতে দেন সিপাহীজী।

-আর না। খবরদার। ধমক দেয় অর্জুন সিং।

আমবাগানের ছায়ার মধ্যে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সকালী। ব্যস্তভাবে হেঁটে দড়িবাঁধা কোমর নিয়ে আদালত ঘরের দিকে চলে যাচ্ছে সরদারের যে পাথুরে ছাঁদের চেহারাটা, সেই দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কালের ঝুড়ির দিকে তাকায় সকালী। লাল হয়ে ওঠে আর চিকচিক করে সকালীর কালো চোখ। সকালীর ভেজা চোখে টুকটুকে লাল পাকা তেলাকুচার ছায়া পড়েছে।

আদালত এলাকার ভিড় বেশ ফাঁকা হয়ে যায়। বিকালের আমবাগানের ছায়া বেশ ঠাণ্ডা হয়ে যায়। কিন্তু চলে যায় না, আর সরেও যায় না সকালী। এক ঠায় দাঁড়িয়ে আদালত ঘরের দিকে তাকিয়ে থাকে।

ঢং ঢং করে চারটা ঘণ্টা বাজল। আদালত ঘর থেকে বের হয়েছে দাশু। দড়িবাঁধা কোমর নিয়ে ব্যস্তভাবে হেঁটে হেঁটে এগিয়ে আসছে। দাশুর কোমরের দড়ি শক্ত করে ধরে আছে অর্জুন সিং। গোকুল সামন্ত প্রকাণ্ড লাঠি ঘাড়ে তুলে আর দাশুর প্রায় গা ঘেঁষে ঘেঁষে মচমচ করে হেঁটে আসছে।

সকালীর হাতে মকাইয়ের মোয়া দুটো কেঁপে ওঠে। সকালীর চোখের কাছ দিয়েই যেতে যেতে হেসে ওঠে দাশু ও তিন বছর কয়েদ হলো সকালী। ফিরে আসি, তারপর তোমার মোয়া যদি খাওয়াতে চাও…।

অর্জুন সিং হাঁকে-খবরদার, আর বাতচিত নেহি।

 

সড়কে দাঁড়িয়ে তাকালে সবার আগে চোখ পড়বে গির্জাবাড়ির চূড়া, তারপরেই চোখ পড়বে তিন হাত উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা একটা সমাধিভূমি। সারি সারি, আবার এদিকে ওদিকে ছড়ানো যত ঢিবি, টিবিগুলির উপর কাঠের ক্রস। কোনটা হেলে পড়েছে, কোনটা ক্ষয়ে গিয়েছে, আবার খাড়া দাঁড়িয়ে আছে কোনটা। সমাধিভুমির ফটক পার হয়ে ভিতরে ঢুকতে গেলেই প্রথমে যে ছায়াময় প্রকাণ্ড একটা আমগাছ চোখে পড়ে, সেটাই বোধহয় এই সমাধিভূমির সব গাজ্ঞে মধ্যে সবচেয়ে বেশি বয়সের গাছ। সে গাছের কাছে পাথরবাঁধানো যে সমাধি আজও শক্ত হয়ে বসে আছে, সেটাই হল সবচেয়ে পুরনো সমাধি। সমাধিক পাথুরে বুকের উপর লেখা আছে সমাহিতের নাম-ফাদার হার্ন।

ফাদার হার্নের নাম নিয়ে পঞ্চাশ বছর আগে গড়ে উঠেছিল যে হার্নগঞ্জ, তারই আজকের নাম হারানগঞ্জ। ডাঙার পর ডাঙা পার হয়ে ছড়িয়ে গিয়েছে ফাদার হার্নের পঞ্চাশ বছর আগের স্বপ্নের উপনিবেশ। একটা কনভেন্ট আছে। দুটো স্কুল আছে। একটা অনাথবাড়ি আছে। আর আছে একটা কুষ্ঠী আশ্রম–লেপার আসাইলাম।

এক-একটা ডাঙার বুকের উপর এক-একটা বসতির রূপও চোখে পড়ে। লাল খাপরার চালা আর চুনকাম করা দেয়াল, ছোট ছোট ঘরগুলি পরিষ্কার ছকের ছবির মত ফুটে রয়েছে। এইসব ঘরে যারা থাকে, তারা সবাই খিরিস্তান। প্রতি রবিবারের সকালবেলায় গির্জাবাড়ির ঘণ্টা যখন ডিং ডাং করে বাজতে থাকে, তখন এইসব ঘরের ভিতর থেকেই ছোট ছোট ভিড় বের হয়ে আসে আর প্রেয়ার সাধবার জন্য গির্জাবাড়ির দিকে এগিয়ে যায়।

এরাও চারদিকের নানা গাঁয়ের নানা জাতের মানুষ। কিন্তু সেইসব গাঁয়ের আর জাতের স্মৃতি ওদের জীবন থেকে মুছে গিয়েছে। আজ ওরা শুধু হারানগঞ্জের মানুষ। একই বিশ্বাস, একই আশ্বাস আর একই প্রীতির শাসনে ঘষামাজা একটা নতুন জীবনের মানুষ। ওদের জীবন মাটি-কোপানো আর লাঙল-ঠেলা জীবন নয়। সকাল হলে কিংবা দুপুর হতেই ওরা সাইকেলের সওয়ার হয়ে চারদিকের দু ক্রোশ তিন ক্রোশ পথ পার হয়ে চলে যায় মতিডিহিতে রেলওয়ের মেরামতি কারখানাতে, এজরা ব্রাদার্সের যত কয়লাখাদের কল-ঘরে, রামনগরের পটারিতে, আর কলিয়াবাগের ফ্যাক্টরিতে। এইসব কল খাদ আর কারখানার বিলাতী মালিকেরা আজও হারানগঞ্জের মানুষকে কাজ দিতে আর কাজের সুবিধা দিতে ভুলে যান না। তা ছাড়া, যে সিস্টার মাদলিনের স্নেহে হারানগঞ্জের খিরিস্তান কলোনি আজও লালিত হয়ে চলেছে, তার ইচ্ছার সুপারিশও কেউ তুচ্ছ করতে পারেন না। সিস্টার দিদির এক চিঠিতে একদিনেই চাকরি হয়ে যায়, এই কথা এই কলোনির বাইরের মানুষও জানে।

খিরিস্তান হোক আর অখিরিস্তান হোক, সিস্টার দিদিকে কে না শ্রদ্ধা করে? এই হারানগঞ্জে আর এই হারানগঞ্জের চারদিকের অন্তত পঞ্চাশটা গাঁয়ের ঘরে ঘরে যেয়ে সুখদুঃখের খবর নিয়ে জীবনের ত্রিশটা বছর এখানেই পার করে দিলেন যিনি, তার মুখে সদাসর্বদা একটা ক্লান্তিহীন আনন্দের শান্ত হাসি ফুটেই রয়েছে। সে হাসি দেখলে নিতান্ত অখিরিস্তান অভক্তের মনেও ভক্তি দেখা না দিয়ে পারে না। সদরের সদরালা থেকে শুরু করে থানার কনস্টেবল পর্যন্ত সকলেই তাকে শ্রদ্ধা করে, আর একটু ভয়ও করে বোধহয়। ঝড় বাদলের দিনেও যখন ষাট বছর বয়সের সিস্টার মালিন তার সেই নীল রঙের ছোট সাইকেলে চড়ে তিন ক্রোশ পথ পার হয়ে জংলী ডিহির এক নতুন খিরিস্তান চাষীকে জ্বরের ওষুধ খাওয়াবার জন্য ছুটে যেতে থাকেন, তখন তার মুখের সেই শান্ত হাসি যেন অদ্ভুত এক জেদের জ্বালায় দপদপ করে জ্বলে। তখন তাঁকে দেখতে একটু অদ্ভুত রকমের লাগে বইকি! যারা দেখতে পায়, তারা আশ্চর্য হতে গিয়ে একটু ভয়ও পায়; সিটার দিদির দয়া যেন একটা একরোখা প্রতিজ্ঞার অভিযান।

বেশি দিন হয় নি, এই তো মাত্র দিন পনর আগে এইরকমই একটা একরোখা প্রতিজ্ঞার আবেগে নীল রঙের সাইকেলে চড়ে এক সকালে হারানগঞ্জ থেকে ভুবনপুরের দিকে ছুটে গিয়েছিলেন সিস্টার দিদি। মধুকুপির সেই সুন্দর চেহারার কিষাণী মেয়েটি গাঁ থেকে তাড়িত হয়ে, বাঘের হামলা থেকে প্রাণ বাঁচিয়ে আর ছুটে এসে এজরা ব্রাদার্সের কয়লাখাদের হাসপাতালে ঠাঁই নিয়েছে, খবর পেয়েই তার সঙ্গে দেখা করতে আর একটি দিনও দেরি করেন নি।

কয়লাখাদের হাসপাতালের ঘরে ঢুকেই মুরলীকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন সিস্টার দিদি? মুরলী, লাভলি মুরলী বহিন, চল, তোমাকে এখনই আমার কনভেন্টে নিয়ে যাব।

সিস্টার দিদির দয়া, আর সিস্টার দিদির হাসি। দেখতে পেয়ে মুরলীর প্রাণটাই হেসে ওঠে। কল্পনা করতে পারে নি মুরলী, এত তাড়াতাড়ি এত বড় সৌভাগ্য এত কাছাকাছি এসে মুরলীর জীবনের আশাকে জড়িয়ে ধরবে।

পলুস হালদারের দিকে চোখ পড়তেই একটু আশ্চর্য হন সিস্টার দিদি? তোমার কি খবর পলুস?

পলুস-খবর ভাল বটে দিদি, এখন শুধু তোমার দয়া চাই।

–বল ভাই, কিরকম দয়া মাংতা হ্যায়! আচ্ছা নোকরি?

পলুস–না দিদি।

-তবে?

হঠাৎ মুরলীর মুখের লাজুক হাসিটা সিস্টার দিদির চোখে পড়ে যায়। সেই মুহূর্তে যেন বিপুল কৃতার্থতার আনন্দে হেসে ওঠে সিস্টার দিদিরও চোখ দুটো : খুব ভাল কথা। মুরলীর সাথে তোমার বিবাহ হবে, অতি ভাল কথা বটে।

সিস্টার দিদির সঙ্গে হারানগঞ্জে চলে যাবার আগে শুধু একবার ক্ষণিকের মত গম্ভীর হয়ে মহেশ রাখালের কাছে এসে দাঁড়িয়ে ছিল মুরলী : তুমি ভাল হয়ে ঘরে চলে যেও বাপ। আমি হারানগঞ্জে চললাম।

-ঝালদা যাবি না? চমকে উঠেছিল বুড়ো মহেশ রাখাল।

–না। হেসে ফেলে মুরলী ও আমার যেথা যাবার ছিল সেথা যাচ্ছি বাপ; তুমি রাগ করো।

মুখ ফিরিয়ে নেয় মহেশ রাখাল। মুরলীর মুখের দিকে আর তাকায় না।

এই হাসিমুখ নিয়েই রওনা হয়ে হারানগঞ্জের কনভেন্টে চলে এসেছে মুরলী। হারাণগঞ্জের কনভেন্টের জীবনও এত ভাল লাগবে, কল্পনা করতে পারে নি মুরলী। সবই নতুন, তাই সবই ভাল লাগে। মুরলীর কালো চোখের চাহনি সব সময় যেন হেসে হেসে ঝকঝক করে। ঘরটা কী সুন্দর! ঘরের দেয়ালে একটা জানলা, সে জানলার কাছে দাঁড়ালে গির্জাবাড়ির চূড়াটা দেখা যায়।

কনভেন্টের মেয়েরা খিলখিল করে হাসে। কী মিষ্টি কলরবের ঝুমুর! মেয়েগুলির খোঁপার ছদও দেখতে কত ভাল লাগে। বার বার দেখতে ইচ্ছে করে। অনেকক্ষণ ধরে অপলক চোখে তাকিয়ে থাকবার পর মুরলীর মনের আশা আবার হেসে ওঠে।

ডিং ডাং, ডিং ডাং, গির্জার ঘণ্টার শব্দ শোনা যায়। শুনতে শুনতে আনমনা হয়ে যায় মুরলী। আর বেশিদিন বাকি নেই, সিস্টার দিদি বলেছে একদিন গির্জাবাড়িতে গিয়ে ঈশাই মানবে মুরলী। তার কয়েক দিন পরেই…।

ভাবতে গিয়ে মুরলীর চোখের চাহনি নিবিড় হয়ে ওঠে, আর ঠোঁট দুটোও নিবিড় হাসির আবেগে ফুলে ফুলে কাঁপে।

সিস্টার দিদি এসে একদিন মুরলীকে বলে গেলেন—যদি ইচ্ছা কর, তবে বিবাহের পর এখানে এসে রোজ লেখাপড়া শিখে যেতে পার বহিন। ওই দেখো ওই মেয়েটি, উহার নাম মেরিয়া, মেয়েটি ছয় মাসের মধ্যে বাইবেল পড়তে শিখে ফেলেছে।

মুরলীর সারা মুখ জুড়ে আবার একটা স্বপ্নময় আশার হাসি ঝিলিক দিয়ে ফুটে ওঠে। হ্যাঁ দিদি, দয়া করে আমাকে লিখাপড়া শিখিয়ে দিও।

সিস্টার দিদি-নিশ্চয়, নিশ্চয়, আমি যে সব সময় খিরিস্তানের সেবার জন্য বলিদান হয়ে আছি।

তারপর আর দেরি হয় না। গির্জাবাড়িতে গিয়ে ঈশাই মেনে নিয়ে সিস্টার দিদির প্রার্থনার গান শুনতে হল; মুরলীর মুখের দিকে তাকিয়ে সস্নেহে আশীর্বাদ করলেন সিস্টার দিদি? ধরম বুঝে করম করবে, ধরমের মান রাখবে, খিরিস্তান বেরাদারী আর সিস্টারীর সেবিকা হবে; সুখী হও জোহানা।

জোহানা! নামটা যেন মুরলীর নতুন অদৃষ্টের জন্মােৎসবের ধ্বনি! বেদীর মোমবাতির আলোর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে মুরলী, এই জীবনটাকে কিষাণীর কষ্টের জীবন বলে আর ধিক্কার দেবার দরকার হবে না। গির্জাবাড়ির ঘরভরা ভিড়ের গলায় একটা আশীর্বাদের গান বেজে চলেছে; শুনতে শুনতে বিভোর হয়ে যায় মুরলীর মন, হাসতে হাসতে গির্জাবাড়ি থেকে কনভেন্টের ঘরে ফিরে এসে জানলার কাছে দাঁড়ায় মুরলী। দেখতে পায়, জানলার দিকে তাকিয়ে আর চোখমুখ হাসিয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে চলে যাচ্ছে পলুস হালদার। হাত তুলে, হাতের পাঁচটা আঙুল দেখিয়ে মুরলীর মনের চঞ্চলতাকে সান্ত্বনা দেয় পলুস। এই তো, আর মাত্র পাঁচটা দিন বাকি।

সেই পাঁচটা দিনও মুরলীর চোখ আর মুখ শুধু হেসে হেসে তৃপ্ত হয়ে যায়। কনভেন্টের মেয়েরা এসে পলুসের নাম ধরে কী সুন্দর আর কত নতুন রকমের ঠাট্টা করে! সে ঠাট্টার ভাষাও নতুন রকমের।

–কে কাকে বেশি ভালবাসে জোহানা?

মেরিয়ার প্রশ্নের হাসি শুনে চমকে ওঠে মুরলী : কি বলছো বহিন?

মেরিয়া-তুমি পলুসকে বেশি বেসেছ, না, পলুস তোমাকে বেশি বেসেছে?

হেসে ফেলে মুরলী : গড জানে!

মেরিয়া-গড তো জানে; কিন্তু তুমি জান কি না?

মুরলী—আমি জানি না।

মেরিয়া-বিয়ার পরে জানতে চাও?

মুরলী-হ্যাঁ।

মেরিয়া-আগে জান নাই?

মুরলী–না।

মেরিয়া মুখ টিপে হাসে ও একবারও না?

-না গো না; ছিয়া! বলতে বলতে মাথা হেঁট করে হাসতে থাকে মুরলী। মুরলীর কোমরে একটা মৃদু চিমটির আদর বুলিয়ে দিয়ে চলে যায় মেরিয়া।

পাঁচদিন পরে মেরিয়া নিজের হাতে মুরলীর খোঁপাটাকে নতুন ঘঁদে বেঁধে দিল। রঙিন ফুলের মালা দিয়ে খোপা জড়িয়ে নিয়ে গির্জাবাড়িতে গিয়ে আবার বেদীর মোমবাতির আলোকের দিকে যখন তাকায় মুরলী, তখন মুরলীর জীবনের আশা পূর্ণ হয়ে গিয়েছে। মুরলীর পাশে দাঁড়িয়ে আছে পলুস হালদার।

আবার সিস্টার-দিদির প্রার্থনার গান শুনে, আর ঘরভরা ভিড়ের আশীর্বাদী গানের কোরাস শুনে যখন গির্জাবাড়ির বাইরে এসে দাঁড়ায় পলুস হালদার আর জোহানা হালদার, তখন ফুলের সাজ পরা একটা গো-গাড়ি গির্জাবাড়ির ফটকের কাছে সড়কের উপর চঞ্চল হয়ে ওঠে।

মেরিয়ার মিষ্টি ঠাট্টার ভাষা শুনে হেসে হেসে আর মুগ্ধ হয়ে গো-গাড়ির ভিতর ঠাঁই নেয় হারানগঞ্জ কলোনির এক নবদম্পতি। চলতে থাকে গো-গাড়ি।

মুরলী-তোমার ঘর কি এখান থেকে ঢের দূর বটে?

পলুস হাসে–না।

লাল খাপরার চালা; আর ইঁটের দেয়াল; একখানি ঘর। ছোট দাওয়া; দাওয়ার উপর ছোট্ট একটা রোয়াভরা আদুরে কুকুর। ঘরের দিকে চোখ পড়তেই হেসে ওঠে মুরলীর কালো চোখের চাহনি।

গো-গাড়ি থেকে নেমে ঘরের দিকে এগিয়ে যায় পলুস আর মুরলী। আদুরে কুকুরটা এক লাফ দিয়ে এগিয়ে এসে মুরলীর কোলের উপর উঠতে চায়। কুকুরটাকে কোলে তুলে নেয় মুরলী। পলুস হাসে : কুকুরটা বড় চালাক বটে!

মুরলী-কেন?

পলুস-তোমাকে চিনে নিয়েছে।

মুরলী হাসে ও কি চিনলে?

পলুস-তোমার কোল নরম বটে।

মুরলীর মুখের হাসি আরও মিষ্টি হয়ে ওঠে। ঘরের ভিতরে ঢুকে মুরলীর মুখের এই মিষ্টি হাসিটাই যেন চমকে ওঠে। এই চমকও একটা নতুন চমক। নিজের এমন রূপের ছবি নিজেই কখনও দেখতে পায় নি মুরলী।

পলুসের ঘরের ভিতরে একটা কাঠের বাক্সের উপর প্রকাণ্ড একটা আয়না। সেই আয়নার বুকে মুরলীর মাথা থেকে পা পর্যন্ত একটা পূর্ণ প্রতিচ্ছবি ঢলটল করছে। মুরলীর চোখ দুটো কত কালো আর কেমন টানা-টানা, আজ এই প্রথম ভাল করে দেখতে পেল মুরলী। মুরলীর ঠোঁটের হাসিটা যে এমন ফুলে ফুলে কাঁপে, তাও আগে কোন দিন দেখতে পায় নি মুরলী। ফুলের মালা জড়ানো খোঁপা, আর রঙিন আঁচলের শাড়ি পরে পলুসের পাশে দাঁড়ালে কেমন দেখায় মুরলীকে, আয়নাতে তারও ছবি দেখতে পেয়ে ধন্য হয়ে যায় মুরলীর দুই চোখের সাধ।

পলুসের পরনে সাদা পেন্টালুন, গায়ে নীল রঙের একটি কামিজ, গলায় রামধনুর মত পাঁচমিশালী রঙের একটা রুমাল জড়ানো। মুরলীর হাত ধরে দাঁড়িয়ে হাসছে পলুস। মনে হয় মুরলীর, এই পলুস হালদার মুরলীকে একটা ভয়ানক বাঘ-ডাকা জঙ্গলের ভয় থেকে উদ্ধার করে নিয়ে এসে মুরলীর স্বামী হয়েছে। পলুসের পাশে দাঁড়াতে পেরেছে, তাই না আজ নিজেকেও এত ভাল করে দেখতে চিনতে আর বুঝতে পারছে মুরলী।

পলুস বলে-আয়নাটা তোমার লেগে কিনেছি, জোহানা।

মুরলী হাসে? কবে কিনলে? যেদিন আমার হাতের জল খেলে, সেদিন কি?

পলুস-না, কাল গোবিন্দপুর বাজার থেকে কিনে এনেছি।

মুরলী আবার চোখ টিপে হাসে এত দেরিতে কিনলে কেন? বিশ্বাস কর নাই বুঝি।

পলুস-বিশ্বাস করেছিলাম জোহানা, তুমি আমার কাছে না এসে পারবে না। সেটা কোন কথা নয়। কথা হলো, বাঘিনটাকে মেরে গোবিন্দপুরের থানা থেকে পঁচিশ টাকা বকশিশ পেলাম। ভাবলাম, বকশিশের টাকা দিয়ে সবার আগে যে জিনিসটা কিনবো, সেটা জোহানার জিনিস হবে। তাই আয়নাটা কিনলাম।

পলুসের কাঁধের উপর মাথা লুটিয়ে দেয় মুরলী। মুরলীর শরীর যেন একটা নেশার আবেশে অলস হয়ে গিয়েছে। মুরলীকে দু হাত দিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে ডাক দেয় পলুস–জোহানা!

উত্তর দেয় না মুরলী। পলুসের বুকে লুটিয়ে পড়ে থাকা নতুন জীবনের ছবিটাকেই আয়নার দিকে তাকিয়ে দুই কালো চোখের পিপাসা মিটিয়ে নিতে থাকে মুরলী।

পলুস বলে–তোমার জ্বর হলো না তো, জোহানা?

মুরলী–না।

পলুস-গা এত গরম কেন?

মুরলী হাসে-গা জানে।

মুরলীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে পলুস হালদার। মুরলীর চোখ দুটো যেন হঠাৎ বিদ্যুতের মত একবার হেসে উঠল। তারপরেই ভিজে গেল।

–কাঁদলে কেন জোহানা? প্রশ্ন করতে গিয়ে পলুস হালদারের গলার স্বরে একটা বিস্ময়ও কেঁপে ওঠে।

মনে মনে একটা প্রবল কুণ্ঠার সঙ্গে লড়তে গিয়ে হেরে গিয়েছে মুরলী; এই চোখের জল বোধহয় সেই পরাজয়ের ব্যথার একটা বানভাসি তরলতা। দাশু কিষাণ নামে একটা মানুষের ছায়াকে যেন হঠাৎ দেখতে পেয়েছে মুরলী, আর সেই ছায়াটাকে জোর করে ঠেলে সরিয়ে দিতে গিয়ে চোখ দুটো ভিজে গিয়েছে।

জোরে একটা হাঁপ ছেড়ে নিয়ে মুরলী বলে–না, কিছু নয় পলুস। মনে পড়েছে, তোমাকে একদিন বড় দুখ দিয়েছিলাম। ভেজা চোখ বন্ধ কবে বিড়বিড় করে মুরলী।

–কবে? আরও আশ্চর্য হয় পলুস।

–তুমি আমাকে ছুঁয়েছিলে বলে গালি দিয়েছিলাম।

হো-হো করে হেসে ওঠে পলুস? সে কথা আজ আবার ম’ কর কেন জোহানা?

মুরলী–তোমার রাগ হয় নাই কি?

পলুস-হ্যাঁ, হয়েছিল।

মুরলী-আজও রাগ আছে কি?

পলুস হাসে-আছে।

মুরলী-তবে?

–আঃ, তোমার প্রাণটাও বড় নরম বটে জোহানা। মুরলীর নরম গতরের অদ্ভুত উষ্ণতার স্বাদ যেন প্রাণের ভিতরে বরণ করে নেবার জন্য মুরলীর এই অভিমানভীরু অথচ ছলনাহীন সরু কোমরটাকে নিবিড় আগ্রহের বাঁধনের মত দু হাতে জড়িয়ে ধরে পলুস হালদারও জীবনের এক নতুন নিঃশ্বাসের নেশায় ফিসফিস করে? আজ আমি যে তোমারই মরদ বটি জোহানা; আমাকে সাতে হবে কেন?

মুরলী বলে—চুপ কর।

চুপ করে পলুস হালদার।

কিন্তু লাল খাপরার চালা আর ইঁটের দেয়াল, এই ছোট ঘরটা যেন দূরন্ত এক নিশ্বাসময় ব্যস্ততার মধ্যে ফিসফাস করতে সুরু করেই হঠাৎ একটা আতঙ্কের রূঢ় চিকার ছেড়ে কেঁপে ওঠে। চেঁচিয়ে ওঠে পলুস-জোহানা!

আর মুরলীও হঠাৎ আতঙ্কে বিব্রত হয়ে নিরাবরণ শরীরটার শিহরিত লজ্জা লুকিয়ে ফেলবার জন্য মেঝের উপর লুটিয়ে পড়ে থাকা রঙিন শাড়ির আঁচলটাকে একটা থাবা দিয়ে আঁকড়ে ধরে; কিন্তু গায়ে জড়াতে পারে না। মুরলীর হাতটাকে শক্ত করে চেপে ধরে পলুস আবার ডাক দেয়-জোহানা! মুরলী ভ্রূকুটি করে-কি?

পলুস—এ তোমার কেমন কোমর বটে?

মুরলীর চোখ দুটো ছলছল করে হাসে : তুমি যা বুঝেছ, তাই বটে পলুস।

পলুস-আমাকে আগে বল নাই কেন?

–মুরলী-আগে না বলে কি কোন দোষ হলো?

পলুস-হ্যাঁ।

মুরলী আশ্চর্য হয়? আগে বললে কি তুমি আমাকে ঘরে নিতে না?

পলুস-তোমাকে নিতাম, কিন্তু সরদারের ছেইলাকে নিতাম না।

ফুঁপিয়ে ওঠে মুরলী-সরদারের ছেইলা ভাবছো কেনে পলুস, ও যে আমার ছেইলা!

পলুসের চোখের হাসিটা যেন কটমট করতে থাকে : তা হয় না জোহানা। কোন পাগলেরও পরের ছেইলার বাপ হতে সাধ হয় না।

কাঁপতে কাঁপতে চেঁচিয়ে ওঠে মুরলী—কিন্তু ও যে আমারও ছেইলা বটে গো! আমাকে এত মায়া কর তুমি, আমার ছেইলার লেগে তোমার মায়া হয় না কেন পলুস?

পলুস-তোমার এই ছেইলাকে ওর বাপের ঘরে রেখে এলে ভাল করতে।

কেঁদে ফেলে মুরলী? তা হলে আমার ছেইলা যে মরে যেত পলুস!

–মরে যেত যদি, তবে মরে যেত। কিন্তু আমি পরের সাধের বোঝা মাথায় নিব কেন?

মুরলীর বুক কাঁপিয়ে দিয়ে একটা করুণ আর্তনাদের তীক্ষ্ণ স্বর ঠিকরে বের হয়? এমন কথা বলতে হয় না পলুস।

মুরলীর হাত ছেড়ে দিয়ে সরে যায় পলুস। শাড়িটাকে তুলে নিয়ে এলোমেলো করে গায়ে জড়িয়ে মেঝের উপর বসে আয়নার দিকে দুটো ভীরু চোখ তুলে দেখতে থাকে মুরলী, পুড়ে গিয়েছে মুরলীর মুখের হাসি। ঠোঁট দুটো কয়লার টুকরোর মত কালো হয়ে গিয়েছে। বিয়ের ফুল খোঁপা থেকে খসে পড়ে গিয়ে মাটিতে ছড়িয়ে পড়েছে।

আস্তে আস্তে মুরলীর কাছে এগিয়ে এসে মুরলীর মাথায় হাত দিয়ে পলুস বলে–যা হবার হয়েছে, কিন্তু তুমি এত ভাবছো কেন জোহানা?

পলুসের কথাগুলি অদ্ভুত এক সান্ত্বনার ভাষার মত মুরলীর কানের কাছে বাজতে থাকে। চমকে ওঠে মুরলী; শুকনো ঠোঁটের পোড়া হাসিটাই আবার সজীব হয়ে ওঠে? কি বলছো?

পলুস-হারানগঞ্জের অনাথবাড়ি আছে; তুমি ভাবছো কেন?

—এমন কথা বলো না পলুস। আবার আর্তনাদের মত শিউরে ওঠে মুরলীর গলার স্বর।

–কিসের ডর জোহানা?

-তুমি বুঝে দেখা তোমার কুকুরটা আমার নরম কোলে বসবে, কিন্তু আমার ছেইলাটা অনাথবাড়িতে যাবে…তোমার পায়ে পড়ি পলুস; একটুক বুঝে দেখ।

পলুস হাসে? আমি বুঝেছি জোহানা; তুমি বুঝছে না।

মুরলী-আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না।

পলুস-সিস্টার দিদিকে একবার শুধিয়ে দেখ; তবে বুঝবে আমি ঠিক কথা বলছি কি না।

সিস্টার দিদি! নাম শুনেই মুরলীর চোখ দুটো চমক দিয়ে হেসে ওঠে। কথায় কথায় হঠাৎ যার নাম করে ফেলেছে পলুস হালদার, তারই দয়া যে আলোকের মত পথ দেখিয়ে মুরলীর জীবনকে নতুন সুখের জগতে নিয়ে এসেছে। এই নামটা মনে পড়লেই নির্ভয় হয়ে যায় মুরলীর জীবনের আশা। সিস্টার দিদির নীল চোখের চাহনির সামনে দাঁড়ালেই মুরলীর কালো চোখে যেন ভরসার বিদ্যুৎ হেসে ওঠে। সাচ্চা দেবী বটে সিস্টার দিদি, ভুবনপুরের মাঈথানের মাটির দেবীর মত মিথ্যা দেবী নয়। মধুকুপির দুধি কিষাণী মাঈথানের দেবীর পায়ের কাছে ফুল আর গুড় রেখে দিয়ে কতবার ছেইলা চেয়েছিল, কিন্তু পেয়েছিল কি? পায় নাই। কাছে গিয়ে চাইলেও মাটির দেবী দয়া করতে জানে না। আর, সিস্টার দিদির কাছে চাও বা না চাও, সাচ্চা দেবীর মত নিজেই ছুটে এসে দয়া করে। যখন ইচ্ছা তখন সিস্টার দিদির হাতের ছোঁয়া কপালে বুলিয়ে নিতে পারা যায়। মুরলীর গালে টোকা দিয়ে, মুরলীর চিবুক টিপে আজই তত বার বার আদর করেছে সিস্টার দিদি? আমি তোমার দুখ মিটাতে সব সময় রেডি আছি বহিন জোহানা! যখনই দরকার হবে, আমাকে ডাকবে।

মুরলীর বুকের ভিতরে মানতের মত একটা আবেদনের ভাষা নীরবে বিড়বিড় করতে থাকে—আমি তোমার কাছে মানত করছি সিস্টার দিদি, আমার ছেইলা আমাকে পাইয়া দাও।

পলুস বলে-আমার কথাটা কানে গেল কি?

হেসে ওঠে মুরলী : শুনেছি।…হা…সিস্টার দিদি যা বলবে, তা তুমি মেনে নিবে তো?

পলুস নিশ্চয় মেনে নিব। কিন্তু…।

মুরলী কি?

পলুস-তুমি মেনে নিবে তো?

মুরলীর কালো চোখের হাসি আবার ঝিলিক দিয়ে ওঠে? নিশ্চয়। সিস্টার দিদির বিচার মেনে নিব তো কার বিচার মেনে নিব, বল?

খুশি হয় পলুস। পলুসের এতক্ষণের গম্ভীর ও করুণ একটু বিষয় যে-মুখের উপর একটা দুশ্চিন্তার ছায়া থমকে ছিল, সেই মুখটাও হেসে ওঠে : ঠিক বলেছো জোহানা; সিস্টার দিদির বিচার বড় ভাল বিচার। হোই পাহাড়টা, ডরানি নদীটা আর হাতিয়া তারাটাও ভুল হয়, কিন্তু আমাদিগের সিস্টার দিদির ভুল হয় না।

মুরলী খিলখিল করে হাসে : বড় ভাল কথা বলেছ, পলুস।

পলুস-হ্যাঁ জোহানা; পাহাড়ের পাথরও ফাটে আর ধুলা হয়ে যায়; ডরানির জল ক্ষেতের ধান মারে, আর হাতিয়া তারাতেও কালা বাদল আনে না। কিন্তু, সিস্টার দিদির দয়া দেখ; যার যেমনটি দুখ, তার লেগে তেমনটি দয়া। তোমাকে দাগী কিযাণের ঘরের দুখ থেকে বাঁচায়; আর আমাকে ক্ষেপী কিষাণের জংলী সাধের মার থেকে বাঁচায়।

মুরলী-বেঁচে থাকুক সিস্টার দিদি; আমাদিগের মত পাপী-তাপীর দুখ মিটাতেও আরও বয়স নিয়ে, শ’ বছরের বুড়া হয়ে বেঁচে থাকুক সিস্টারদিদি।

পলুস–সে আর বলতে হবে না। সিস্টার দিদির সাথে সাথে ইঞ্জেল থাকে; কোন ডেভিলের সাধ্যি নাই সিস্টার দিদির গায়ে একটা ঢেলা ফেলতে পারে। শুনবে তো বলি…বাবুরবাজারে আমি নিজের চোখে দেখেছি..।

ধড়ফড় করে, একটা দূরন্ত কৌতূহলের আমোদে নড়ে-চতে বসে, আর দুই চোখ অপলক করে পলুসের মুখের দিকে তাকায় মুরলী : বল।

পলুস–বাবুরবাজারে দেখেছিলাম, সিস্টার দিদি পথ হেঁটে চলেছে; আর পথের পাশের কাটাঝাড়ের ভিতর হতে একটা গরলের শয়তান…।

মুরলী-কি?

পলুস-তিন হাত লম্বা একটা কালা করাইত ফণা উচা করে সিস্টার দিদিকে কামড়াবার জন্য তেড়ে এল। দেখলাম জোহানা, তখনি একটা চিল এসে ছোঁ মেরে গরলের শয়তানটাকে তুলে নিয়ে চলে গেল।

মুরলীর কালো চোখের বিস্ময় বিশ্বাসের আবেশে একেবারে নিবিড় হয়ে সুস্থির আলোর মত জ্বলতে থাকে।

পলুস বলে-ভুবনপুরের মানঝিদের একটা ওঝা বাজারের ভিড়ের ভিতরে লুকিয়ে থেকে সিস্টার দিদির পিঠের দিকে তাক করে তীর ছেড়েছিল। কিন্তু…।

মুরলীর সুস্থির চোখের চাহনিতে যেন একটা তীর বিধেছে। কেঁপে ওঠে চোখ দুটো; গলার স্বরও কাঁপে-সিস্টার দিদির গায়ে লাগে নাই তো?

পলুস হাসে–না জোহানা; লাগবে কেন? শয়তানের মতলব কি সিস্টার দিদিকে ছুঁতে পারে? তীরটা লেগেছিল এক বেটা মানঝির হাতে; সে বেটা মানঝি হলো ওঝারই ভাইটা।

মুরলী-মরে নাই পাপীটা?

পলুস-কোন্ পাপীটা?

মুরলী-দুটাই, ওঝাটা আর ওর ভাইটা?

পলুস–না, মরে নাই। কিন্তু দুটারই কয়েদ হয়েছিল। ওঝাটা সাত বছর, আর ভাইটার তিন বছ।

মুরলীর চোখের চাহনি ধিকধিক করে। দাঁতে দাঁত চেপে আর নরম ঠোঁট দুটোকে শক্ত করে নিয়ে একটা ধিক্কার ছাড়ে মুরলী-মরলেই ভালো হতো।

পলুস হাসে : হ্যাঁ, মরলে ওদের ভালো হতো। কয়েদ হবার সাজা যে কী কষ্টের সাজা, সেটা সে-ই বুঝে, যার কয়েদ হয়। কয়েদের চেয়ে মরণ ভাল।

চমকে ওঠে মুরলী। হঠাৎ একটা যন্ত্রণার তীর যেন বুকের ভিতরে গিয়ে বিধছে। এদিকে ওদিকে তাকিয়ে, আর বার বার হাঁপ ছেড়ে যেন মনটাকে একটা মিথ্যা স্মৃতির মিথ্যা বেদনা থেকে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করে। কিছুক্ষণ উদাসভাবে তাকিয়েও থাকে, তারপরেই হেসে ওঠে? তোমার কপাল বড় ভাল, এমন সিস্টার দিদির দয়া তুমি পেয়েছ।

পলুস-তুমি কি পাও নাই?

মুরলী হাসে-তুমি বেশি পেয়েছ।

পলুস-কেন? আমার তো মনে হয়, তুমি বেশি পেয়েছ।

মুরলীর ঠোঁট দুটো হঠাৎ শিউরে ওঠে, যেন একটা লাজুক কৌতূহলের পিপাসা চাপতে চেষ্টা করে।

পলুস-কি বটে জোহানা?

মুরলী মুখ ফিরিয়ে বলে—আমার কাছে এসে বসো, তবে বলবো।

উঠে এসে, মুরলীকে দু হাতে জড়িয়ে ধরে, মুরলীর অলস লাজুক শরীরটাকে তুলে নিয়ে একটা চারপায়ার উপর বসিয়ে দেয় পলুস; আর নিজেও মুরলীর গা ঘেঁষে বসে।

মুরলী বলে–মেরিয়া একটা কথা বলেছিল।

—কি?

–তুমি আমাকে বেশি বাস, না, আমি তোমাকে বেশি বাসি?

—এ কথা কেন শুধাও, জোহানা!

–বুঝতে চাই, সিস্টার দিদি কাকে বেশি দয়া করলে?

–আমি বুঝেছি, আমি তোমাকে বেশি পেয়ার করি।

–আমি বুঝেছি আমি।

পলুস কৃতার্থভাবে হাসে? এ তো ভাল ঝগড়া বটে।

পলুসের গলা জড়িয়ে ধরে মুরলী ও বিচার হয়ে যাক না কেন?

–জোহানা! ডাকতে গিয়ে পলুসের গলার স্বরে যেন হঠাৎ-আকুল পিপাসা ছলছল করে।

-চুপ কর পলুস। বলতে গিয়ে পলুসের গলার রামধনু রঙের রুমালের উপর মুরলীর খোঁপাটা ঘষা খায় আর ভেঙে পড়ে।

পলুস বলে-তুমি এখনও কিছু খাও নাই, জোহানা। আগে খেয়ে নাও।

মুরলী-না।

পলুস–আমার কথা শুন।…হোই দেখ, কত খাবার জমা হয়ে রয়েছে।

ঘরের দেয়ালে কাঠের তাকের উপর নানারকমের খাবার, তার নানারকমের রূপ আর রঙ। নানারকমের বাসন; কালো পাথর, সাদা মাটি আর কাসাপিতলের বাসন। মুরলীর চোখে সবই নতুন লাগে। মুরলীর জীবনের জন্য এক নতুন গেরস্থলির বিচিত্র যত উপহার তাকের উপরে সাজানো রয়েছে। চঞ্চল হয়ে ওঠে মুরলীর চোখের দৃষ্টি।

পলুস বলে—হোই দেখ, ওটা হলো কেক, যেটা সিস্টার দিদি দিলে। আর, চিনামাটির বড় বাটিতে কবুতরের তরকারি, আমি নিজের হাতে বেঁধেছি। আর্থারবাবুর বউ থালা ভরে পেঁড়া দিয়ে গেল। আর, হোই দেখ, চারটা পাউরুটি এনে রেখেছি।

-আমি এতটা ভাবি নাই পলুস! বলতে বলতে পলুসের বুকের কাছ থেকে একটু আলগা হয়ে আর ঘরের চারদিকে মুখ ঘুরিয়ে দেখতে থাকে মুরলী। কী সুন্দর ঘর! ওদিকে চৌকির উপর পাতা বিছানা। বিছানার উপর পাশাপাশি একজোড়া বালিশ। দেয়াল ঘেঁষে কাঠের একটা আলনা, তার উপরে পলুসের জামাকাপড় সাজানো। এক কোণে একটা লোহার উনান, তার পাশে ঝুড়ির মধ্যে খাদের কয়লা। দেয়ালের গায়ে পলুসের বন্দুক আর টোটার মালা। ঝকঝক আর তকতক করছে মুরলীর নতুন জীবনের সুখের ঘর।

এ ঘর আমার ঘর, পলুস! চেঁচিয়ে ওঠে মুরলী।

–হ্যাঁ, জোহানা। হাসতে থাকে পলুস।

পলুসের মাথায় হাত বুলিয়ে আস্তে আস্তে ফিসফিস করে মুরলী : এ পলুস আমার পলুস বটে।

পলুস-হ্যাঁ।

মুরলী-এসো।

পলুস-আগে খেয়ে নিবে না?

মুরলী রাগ করে ফুঁপিয়ে ওঠে না। যাকে ছুঁতে গিয়ে তুমি দুই-দুইবার দুখ পেলে, তার উপর তোমার এখনও রাগ হয় না কেন?

পলুস–জোহানা!

মুরলী-না, আগে এসো। আগে আমাকে বুঝে নিতে দাও, এটা আমারই মরদের ঘর বটে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *