১০. এবার যারা এল

এবার যারা এল কে জানে তারা বন্ধু না শত্রু। তবু মনে হল ঘরের এরা দু-জন ওদের চাইতে ঢের ভালো। বুড়ি কি ভালো রান্না করে।

বাইরে থেকে ধাক্কাধাকি, আর সে কী চাঁচামেচি! কিন্তু ওই বিশাল দরজা, তার এমনি ভারী পাল্লা, ভাঙে কার সাধ্যি!

এমনি সময় ঘরের ভেতর থেকেই কানে এল ঘড়-ঘড় ঘোঁৎ-ঘোঁৎ! পিলে চমকে উঠল। ইকী-রে-বাবা। বুড়ি গিয়ে অমনি দাড়িওয়ালার পেছনে লুকিয়ে পড়ল।

আমি কী করি? বড়ো একটা বাক্সের ঢাকনি খুলে তার ভেতরেই লুকোতে গেলাম। কী সর্বনাশ! বাক্সে ঠ্যাং গলিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলাম–

বাক্সে একটা মড়া নাকি! বুড়োবুড়ি তো প্রায় অজ্ঞান!

এমনি সময় মড়াটা আস্তে আস্তে উঠে বসল। আমিও তাড়াতাড়ি ঠ্যাংটা টেনে নিলাম।

মড়াটা একদৃষ্টে আমার দিকে চেয়ে রইল। আস্তে আস্তে আমার বুদ্ধিসুদ্ধি ফিরে এল। বুড়ো একটা দেশলাই জ্বালাতেই চিনলাম সে বিরিঞ্চিদা। উফ, বাঁচা গেল! আরেকটু হলে ভয়ের চোটে মরে গেছলাম।

বিরিঞ্চিদা বাক্স থেকে বেরিয়ে এসে প্রথমে বেড়ালের মতো গা মোড়ামুড়ি দিল, তারপর জামা কাপড় ঝেড়েঝুড়ে কাষ্ঠহাসি হাসল।

তখনও কিন্তু সামনে ঘড়-ঘড় ঘোঁৎ-ঘোঁৎ শুনতে পাচ্ছিলাম। তবে আমার সাহস বেড়ে গেছিল, ঢকঢক করে আর দুটো বাক্সের ঢাকনা খুলে দিলাম।

দেখি একটার মধ্যে ঠানদিদি মুচ্ছো গেছেন, আরেকটিতে শ্যামাদাসকাকা দিব্যি কুণ্ডলী পাকিয়ে নাক ডাকাচ্ছে। মনে হল সত্যি সত্যি ঘুমুচ্ছে।

বিরিঞ্চিদা খোঁচা মারতেই সে উঠে বসে, চোখ না খুলেই বলল, মালা পাওয়া গেছে?

–মালা দিয়ে কী হবে? সে তো তোমাদের নয়।

শ্যামাদাসাকা চোখ খুলে বললে, তোমাদেরও নয়।

আমি বললাম, বাইরে কিন্তু বিরিঞ্চিদার পিসেমশাই, সেজোদাদামশাই, পুলিশ পেয়াদা। তার কী হবে?

তাই শুনে যে যেখানে পারল একেবারে বসে পড়ল!

বিরিঞ্চিদা ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল, পিসেমশাই কি একাই এসেছেন?

বললাম, বলছি সঙ্গে সেজোদাদামশাই, পুলিশ-টুলিশ মেলা লোক খাপেঝাঁপে।

বিরিঞ্চিদা একটু আমতা আমতা করে বলল, সবাই কি পুরুষ মানুষ?

দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে বিরিঞ্চিদা কি পাগল হয়ে গেল শেষটা?

বুড়ি বললে, মালাটা কোথায়? ওর তো একটা ব্যবস্থা করা দরকার।

দাড়িওয়ালা বিরক্ত হয়ে উঠল, মালা তো আর তোমাদের নয়।

এই বলে যে বাক্সে মালা ছিল, তার ওপর চেপে আরাম করে পা উঠিয়ে বসে পড়ল।

আমি বললাম, ঠান্‌দিদির মুচ্ছো ভাঙানোর কিছু হবে না?

শ্যামাদাসকাকা বললে, থাক-না, কী দরকার। উঠলেই তো বাজে বকবেন।

বলবামাত্র ঠানদিদি তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বাক্স থেকে বেরিয়ে বললেন, ব্যাটা লক্ষ্মীছাড়া, তোমার সব কথা যদি বলে না দিই–

শ্যামাদাসকাকা বলল, সাবধান, শেষটা নিজে সুদ্ধু না জড়িয়ে পড়।

তখন কী রাগ সকলের! দেখতে দেখতে ঘরের মধ্যে দুটো দল হয়ে গেল। এক দিকে বিরিঞ্চিদা, শ্যামাদাসকাকা, ঠানদিদি; অন্যদিকে বুড়ি আর দাড়িওয়ালা। মাঝখানে আমি।

বিরিঞ্চিদা আবার জিজ্ঞেস করল, সেজোদাদামশাইকে কি একলা দেখলি নাকি? সঙ্গে বামুন-টামুন কিংবা লাল শাড়িপরা মেয়ে-টেয়ে নেই তো?

বললাম, কই না তো। তবে পুলিশরা সব আছে।

বুড়ি খানিক এপার-ওধার খুঁজে বলল, বল-না মালাটা কোথায়?

বুড়ো আবার বললে, বলছি মালা তোমার নয়।

বুড়ি বসে পড়ে বলতে লাগল, নয়ই-বা কেন বলো? জমিদারগিন্নিরই-বা হবে কেন? কতবার দেখেছি তার ফর্সা মোটা গলায় ছোটো ছোটো পায়রার ডিমের মতো শোভা পাচ্ছে। মাঝখানে একটা এই বড়ো সাদা পাথর ধুকধুক করছে। আচ্ছা তুমিই বলো, রংটাই যা ফর্সা, নইলে আমার চাইতে কোন বিষয়ে উনি ভালোটা তাই বলল।

বুড়ো কাষ্ঠহাসি হাসল।

–তোমার যা বুদ্ধি। ইয়ে তা ছাড়া মাঝখানের পাথরটা মোটেই সাদা রং নয়, সেটা নীল। বুড়ি তো অবাক।

–বল কী? আমি জানি না কী রঙের? কতবার দেখেছি পুজোর সময় ঠাকুরবাড়িতে। যতবার দেখেছি ততবার মনে হয়েছে আমিও ওইরকম চওড়া লাল পাড়ের গরদ পরে, কপালে এই বড়ো সিঁদুরের ফেঁটা এঁকে, পায়রার ডিমের মতো বড়ো বড়ো মুক্তোর ওই মালা গলায় ঝুলিয়ে, ঠাকুরবাড়ির সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসি, আর সবাই দেখতে থাকুক আর হিংসেয় ফুলে ফুলে উঠুক।

দাড়িওয়ালা চেঁচিয়ে বলল, যা খুশি বললেই তো আর হল না। মালার রংই তো জানো না। বিশ্বাস না হয় এই দেখো।

বলে বাক্সের ডালাটা খুলে ফেলে দিয়ে মালা বের করে তুলে ধরল।

আধ-অন্ধকার ঘরে মুক্তোর ছড়া জ্বলজ্বল করতে লাগল।

বুড়ো আবার একটা ছোটো মোমবাতি জ্বালতেই বুড়ি অবাক হয়ে দেখল মধ্যিখানের পাথরটা সত্যিই নীল।

অনেকক্ষণ তার কথা বলবার শক্তিই ছিল না, তারপর বলে উঠল, না না, এ সে মালা নয়। এর জন্য আমি সারা রাত জেগে কাটাইনি। তোমরা ভুল মালা এনেছ।

ঠিক এই সময় ঘরের ছাদে কী যেন মড়মড় করে উঠল। ছোটো মোমবাতি, তার আলো ছাদ অবধি পৌঁছোয় না। দারুণ ঘাবড়ে গেলুম সবাই।

ঠিক সেই সময় ঘরের ছাদ থেকে কীসব ভেঙে-টেঙে, ঝুপ করে একটা জিনিস মাটিতে পড়ল।

অবাক হয়ে দেখলাম সেই খোঁচা-দাড়ি রোগা ভদ্রলোক, যাকে পুলিশরা ভুল করে ধরেছিল।

চিঁ চিঁ করে বললেন, বাবা। ঝুলে ঝুলে হাতের মাসিলগুলো সব টেনে লম্বা হয়ে গেছে। ভাগ্যিস হাসতে হাসতে পড়েই গেলাম। মনে হল ঘরের ভিতরটা বেশ গরম হয়ে উঠেছে, বোধ। করি লোকের ভিড়ে।

বুড়ি বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল, অত হাসির কারণটা কী, শুনতে পারি?

ভদ্রলোক বললেন, তুমি গো গিন্নি, তুমি। লালপাড় গরদ পরে, মুক্তোর মালা গলায় ঝুলিয়ে, তোমার কেমন ধারা রূপ খুলবে ভেবে, হাসতে হাসতে প্রায় মরেই গেছলাম।

আমি কান খাড়া করে ছিলাম, এবার না জানি কী হবে।

বুড়ি কিন্তু কোনো উত্তর দিল না। মালার দিকে চেয়ে ঘুম ঘুম সুরে বলতে লাগল, সমুদ্রের তলায় বালির ওপর ঝিনুক পোকা পড়ে থাকে। খোলার ভেতরে সমুদ্রের বালির কণা ঢুকে যায়। ওর গা কুটকুট করে, তাই সাদা চকচকে রস বের করে, তাই দিয়ে বালির গা ঢেকে দেয়, বালির গা মোলায়েম হয়ে যায়। ঝিনুক পোকার আরাম লাগে। তারপর একদিন, মাথার ওপর কাচ-লাগানো বালটি-মুখোশ পরে, বাতাসের নল নাকে লাগিয়ে, জলের তলায় নেমে গিয়ে, ডুবুরিরা ওই মুক্তো তুলে আনে। তাই দিয়ে মালা গাঁথিয়ে, জমিদার গিন্নি পরেন। কিন্তু এ-মালা সে-মালা নয়।

কেন যেন বাইরের গোলমাল থেমে গিয়েছিল। সবাই একটু আশ্বস্ত হল, মালাটা বুড়োর হাতে রইল।

বিরিঞ্চিদা ব্যাপারটাকে বুঝিয়ে বললে, অন্ধকার গর্ত দিয়ে যখনি পড়ে গেলাম, তখনি জানি আমাদের কপালে দুঃখ আছে। তার ওপর ঠানদিদি পড়লেন আমার ঠিক পেটের ওপর। উঃ, নাড়িভুঁড়ি যে এলিয়ে যায়নি সেই যথেষ্ট। দেখতে রোগা হলে কী হবে, কম ওজন ওঁর!– যাক গে, গলি দিয়ে হাঁটছি, তো হাঁটছি, আবার পেছনে শুনি কীসের পায়ের শব্দ। পাঁই পাঁই করে ছুটে, এ-ঘরে ঢুকে, যে যেখানে পারলাম সেঁধোলাম। ওই গলিতে ডালকুত্তা ছাড়া আছে। তার চোখ জ্বলছে দেখলাম। আর তোরা এখানে খাওয়া-দাওয়া করলি।

বুড়ো বললে, ধেৎ, কীসের বীরপুরুষ। ও ডালকুত্তো হতে যাবে কেন, ও তো টেঁপির বাচ্চা।

–টেঁপি আবার কে?

-কেন আমাদের গোরু।

তাই শুনে সবাই খানিক চুপ করে রইল।

তখন শ্যামাদাসকাকা বলতে লাগল, আচ্ছা, এত জিনিস এরা পেল কোত্থেকে?

কারো মুখে রা নেই। আমরা মোমবাতি নিয়ে ঘরময় ঘুরে ঘুরে সব দেখতে লাগলাম। একসঙ্গে এত ভালো ভালো জিনিস আমি কখনো দেখিনি।

হঠাৎ বাইরে বিকট চিৎকার। বাঁচাও! বাঁচাও! মেরে ফেললে রে। ওরে বাবা রে। মরে গেলাম রে।

এ আবার কী? বুড়ির দয়া হল, ঠানদিদির বার বার মানা সত্ত্বেও দিল দরজা খুলে। হুড়মুড় করে এসে ঢুকলেন ফর্সা, মোটা, কোঁকড়াচুল, সম্পূর্ণ এক অচেনা ভদ্রলোক। মিহি ধুতি পরা, কোচ-দোলানো, হাতে হিরের আংটি, সামনের চুল বেজায় লম্বা, এলোমেলো হয়ে কপালের ওপর পড়েছে, ভয়ে সারা গা বেয়ে ঘাম ঝরছে, চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে, হাত-পা কাঁপছে।

ধপ করে একটি বাক্সের ওপর বসে পড়তেই, ইনি আবার কোনো নতুন বিপদের কথা বলেন, তাই শোনবার জন্য, আমরা সব ঘিরে দাঁড়ালাম।

ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ছেড়ে তিনি বললেন, ভাগ্যিস প্রাণটা রক্ষা করলেন! আরেকটু হলেই যে গোরুতে খেয়ে ফেলেছিল আমাকে। এতকাল মা কালীকে ফি-বছর জোড়া পাঁঠা দেওয়া সত্ত্বেও আরেকটু হলেই গোরুর পেটে গেছিলাম।

বুড়ি তখন দাড়িওয়ালাকে সে কী ধমক। আবার টেঁপিকে ছেড়ে দিয়েছ? এখন বাচ্চা যদি সব দুধ খেয়ে ফেলে, কাল সকালে কী করে চা হবে শুনি? মোটা ভদ্রলোক কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, কাল সকাল অবধি বাঁচলে পর তবে তো চা খাওয়া হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *