১০. একা পেয়ে সেদিন বংশী এসে ধরলো

একা পেয়ে সেদিন বংশী এসে ধরলো। রবিবার। বললে— আজকে আপনাকে যেতেই হবে শালাবাবু-ছোটমা আমাকে রোজ বলেন—তোর শালাবাবুকে একবার ডেকে দিলিনে, আমি আপনাকে সুযোগ মতো ধরতেই পারিনে, আপনি ছুটুকবাবুর আসরে গিয়ে বসেন, আর রাত হয়ে যায়।

ভূতনাথ বললে-কী দরকার কিছু শুনিসনি তুই?

—তা তত ছোটমা আমাকে বলেন নি আজ্ঞে।

–কিন্তু ব্ৰজরাখালকে জিজ্ঞেস না করে যাই কি করে—তা ছাড়া বাড়ির মধ্যে, অন্দর মহলে…আমি অচেনা পুরুষমানুষ—যদি কেউ কিছু বলে—তখন?

—সে ছোটমা ডেকেছেন, আপনি কী করবেন? তা ছোটবাবু তো আর জানতে পারছেন না হুজুর—ছোটবাবু সন্ধ্যের সময় বেরিয়ে গিয়েছেন–আসবেন সেই আবার কাল ভোর বেলায়।

—কোথায় যান তোর ছোটবাবু?

–আজ্ঞে, সেই পিশেচ-মাগীর কাছে, জানবাজারে, ছোটমা বলেন—বামুনের শাপে নাকি অমন হয়েছে, আর জন্মে বামুনকে অপমান করেছিলেন—তাই এ জন্মে এই ভোগ।

–তুই তাকে দেখেছিস নাকি বংশী?

—দেখিনি আবার, ছোটমার পায়ের যুগ্যি নয় সে—তাতেই আবার কত ঠ্যাকার, নিজের হাতে এক ঘটি জল পর্যন্ত গড়িয়ে খান না। বাবু যেদিন আসেন না, সেদিন ছোটম পাঠায় কিনা আমাকে, মরতে মরতে যাই—এই এতটুকু বেলা থেকে দেখে আসছি তাকে, কী ছিল আর কী হয়েছে। ওই যে যদুর মা বাটনা বাটে, ওই কাজ আগে করত ওর মা—আমরা ডাকতুম রূপা বলে

—সেই রূপো দাসীর মেয়ে চুনী, তখন ছিল আট বছর বয়েস। তারপর কেমন করে ছোটবাবুর নজরে পড়ে গেল, তখন ছোটবাবুর। বিয়ে হয়নি, তারপর যখন ছোটমা এ-বাড়িতে এলেন, তখন রূপোর মেয়ের বয়েস তেরো। তখন থেকে আলাদা বাড়ি করে দিলেন ছোটবাবু, রূপো এ-বাড়ির কাজ ছেড়ে দিয়ে মেয়েকে নিয়ে উঠলো জানবাজারের নতুন বাড়িতে—তা সমস্তই ছোটমা’র কপালের লিখন শালাবাবু, রূপোরই বা কি দোষ, আর তার মেয়েরই বা কী দোষ—তারপর বললে—তা হলে ওই কথাই রইল, খাওয়া-দাওয়া সেরে নিন—আমি ঠিক সময়ে আসবে খন।

তারপর সন্ধ্যে হলো। গেটের পেটা ঘড়িতে ছ’টা বাজলো, সাতটা বাজলল, আটটাও বাজলো। তখনও ঘরের মধ্যে চুপচাপ বসে ভূতনাথ। অনেকবার অনেক রকম করে ভাবতে লাগলো ব্ৰজরাখালকে না বলে কি বাড়ির বউ-এর সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া ভালো। তাও আবার ছোটবাবুর অসাক্ষাতে। যে-সে বাড়ি নয়, রাজা-রাজড়ার বাড়ি। এতদিন ধরে এ-বাড়িতে আছে, কোনোদিন বউদের মুখ দেখা দূরে থাক, চেহারাও দেখেনি সে। পেছনের দরজা দিয়ে মেয়েদের যাওয়া-আসার রাস্তা। সে গেট চাবি বন্ধই থাকে। যখন গাড়ি ঢোকে, তখন চাবি খোলা হয়। বড়বউ যখন কোনো শুভ-তিথিতে গঙ্গায় স্নান করতে যান, তখন খোলা হয় মাঝে মাঝে। মেজবউ বাপের বাড়ি যান মাঝে মাঝে। তাঁর মা আসেন, রাঙামা আসেন।

আর ছোটবউ?

বংশী বলে—ছোটমার তো মা নেই যে আসবে, গরীবের ঘরের মেয়ে, বাপের একটি মাত্তোর মেয়ে, ছোটমা’র রূপ দেখে বড়বাবু এ-বাড়িতে বউ করে এনেছিলেন, তা বাপও এখন মারা গিয়েছেন, যখন বেঁচে ছিলেন তখনও চলা-হাঁটা করতে পারতেন না, ধম্ম কম নিয়ে থাকতেন, এক গুরু ছিল, গুরুর আশ্রমই ছিল তার ভরসা।

ছোটবউকে দেখেনি ভূতনাথ। কোনো বউকেই দেখেনি। কিন্তু ভূতনাথের মনে হয় যেন তাদের প্রত্যেককে সে চেনে। রাজাবাহাদুর বৈদূর্যমণি চৌধুরী মারা গেলেন জমিদারীতে। একলাই যেতেন তিনি। নিজে গিয়ে দেখা শুনো করে আসতেন। নদীর ধারে চৌধুরীদের বিরাট কাছারি-বাড়ি। মাসের মধ্যে একবার করে তার যাওয়া চাই-ই। প্রজাদের নালিশ শোনা, তাদের খাজনা মকুব করা, এমন কত কাজ তাঁকে করতে হতো। গাঁয়ের পালোয়ানদের ডেকে তাদের কুস্তি দেখতেন। কুস্তিগীর হলে সাত খুন মাফ! সময় সময় লড়তেন তাদের সঙ্গে। তার কুস্তির আখড়ায় হনুমানজীর মস্ত একটা মূতি আজো আছে। তেল-সিঁদুর মাখানো মানুষ সমান মূর্তি। বদরিকাবাবু বলে—কিন্তু মরবার সময় এক ফোঁটা জল পর্যন্ত পেলে না–ও রাজাবাহাদুর নয় রে, রাজসাপ।

তা অত রাত্রে কে-ই বা জল দেয়। আর কে-ই বা খবর নেয়। আর কেউ জানতে পারলে তবে তো! সকালবেলা সবাই টে পেলে। অনাদি মৌলিক বুড়োমানুষ। তিন পুরুষের গোমস্তা। তিনি দেখলেন। দারোয়ান, সেপাই, বরকন্দাজ, সবাই দেখলে।

অতখানি লম্বা-চওড়া দশাসই শরীর বড়বাবুর। কুঁকড়ে নীল হয়ে পড়ে আছে উঠোনের মধ্যিখানে। আর পায়ের কাছেই আর একটা জিনিষ পড়ে আছে। সেটাও কম লম্বা-চওড়া নয়। উল্টে পাল্টে চিত হয়ে পড়ে আছে সেটা। দুটোই প্রাণহীন—অনাদি মৌলিক অন্ধকারে দেখেই সাত হাত পেছিয়ে এসেছিলেন। এক শনিবার, তায় জাত কালকেউটে।

সে সব পুরোনো ইতিহাস। ওই ছুটুকবাবু তখন ছোট। বড়বউ ছিলেন বড় ধর্মশীল। সাতদিন জলস্পর্শ করলেন না। তারপর যখন উঠলেন ভূমিশয্যা ছেড়ে, তখন আর সে মানুষ নন। এখন ভাত খাবার পর চৌষটিবার সাবান দিয়ে হাত না ধুলে শুদ্ধ হয় না শরীর। একটা সাবানকে কেটে চৌষট্টি টুকরো করতে হয়। সিন্ধু। সেই চৌষট্টি টুকরো সাবান আর চৌষট্টি ঘটি জল ঢেলে হাত ধুয়ে দেয় বড়বউ-এর। ঠাকুরবাড়ির প্রসাদের সন্দেশ, তা-ও ধুয়ে খেতে হবে। এমনি বিচার তাঁর।

বৈদূর্যমণি চৌধুরীর পর জমিদারীর ভার পড়লো হিরণ্যমণির ওপর। কিন্তু বড়মাঠাকরুণ ছাড়লেও, মেজবাবই বা ছাড়বেন কেন তাকে। বরং সুবিধেই হলো। দুজনের দুটো বাড়ি হলো। তারপর এল হাসিনী। হাসিনীরও কাঁচা বয়েস। অনাদি মৌ লক টাকা পাঠান। সে টাকাও কম পড়ে। চিঠি যায় জোর তাগাদা দিয়ে। বিধু সরকার নিজে যায় তাগাদা করতে।

মেজবাবুর পানসি গঙ্গার বুকে পাল তুলে বরানগরের দিকে ভেসে চলে। আশে পাশের গ্রামের লোক শুনতে পায় গানের সুর, ঘুঙুরের শব্দ। নৌকোর ভেতর সুতীব্র বাতি জ্বলে, গঙ্গার বুকের একটা অংশ আলোয় আলো হয়ে যায়।

ছোটবাবু কৌস্তুভমণি চৌধুরীর তখন কম বয়েস। ওই ছুটুকবাবুর মতো। সবে লেখাপড়া ছেড়েছেন। ল্যাণ্ডোতে উঠতে যাবেন বিকেলবেলা। সিঁড়ি দিয়ে নামছেন। হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই মাথায় একটা আঘাত লাগলো সজোরে।

সর্বনাশ! একটা বাতাবি নেবুর খোসার টুকরো মাথায় লেগে পায়ের কাছে মাটিতে ছিটকে পড়লো।

প্রথমে রেগে গিয়ে ছলেন ছোটবাবু। তারপর বললেন—কে রে ও?

তোষাখানার সর্দার মধুসূদন যাচ্ছিলো সেখান দিয়ে। বললে–আজ্ঞে ও রূপো দাসীর মেয়ে চুনী।

–রূপো দাসী কে?

–আজ্ঞে বাটনা বাটে আর ডাল ঝড়ে ওই কোণের ঘরে বসে।

–ও-বলে বেরিয়ে গেলেন যেমন যাচ্ছিলেন। কিন্তু মধুসূদন ছাড়লে না। পাঁচ টাকা জরিমানা হয়ে গেল। মধুসূদনের জরিমানা। এ ওর প্রাপ্য। ওর আর নড় চড় নেই। মাইনেই তো পায় রূপো এক টাকা মাসে আর মা-মেয়ের খাওয়া পরা। মার কাছে বারো বছরের চুনী ঢিপ ঢিপ করে কিল খেলে গোটা কতক। চুলের মুঠি ধরে টেনে হিচড়ে নাকালের একশেষ করলে রূপো দাসী। শেষে কান্না–শতেক খোয়ারীর জন্যে আমার কি মরেও শান্তি নেই মা, কবে মরবি তুই, যম কি ভুলে গিয়েছে নিতে। পোড়া পেটের জন্যে ভূতের মতন খাটি—তাতেও শান্তি নেই।

মধুসূদনের কাছে আর্জি গেল।

মধুসূদন বলে—ছোটবাবুর হুকুম, আমি কি করবে তার। কিন্তু রূপোর সাহস আছে বলতে হবে বৈকি। পাঁচটা টাকা তত কম কথা নয়। কেঁদে কেটে ছোটবাবুকেই ধরে পড়লো সে। চুনী ছিল সঙ্গে। বারো বছর বয়সের চুনীবালা। কাঁদা কাটার ফল ফললল দিন কতক পরেই। রঙিন শাড়ি উঠলো চুনীবালার গায়ে, কানে মাকড়ি। পায়ে আবার আলতা। মাইনে বেড়ে এক টাকা থেকে দু’ টাকা হলো। রূপো দাসীর মুখে কথা ছিল না আগে। সেই মুখের ঝাল বাড়লো।

সৌদামিনী আনাজ কুটতে কুটতে সব দেখে। অত যে মুখ তার, তাও কিছু বলতে পারলে না। তবু স্বভাব যায় না মরলে। গজ গজ করে বলতে থাকে—চোক গেল তত তিভুবন গেল—ভোলার বাপ তাই বলতো-ফুলবউ, চোক কান থাকতে থাকতে তিভুবন চিনে নাও। কপাল না কপাল, ছি ছি, গলায় দড়ি জোটে না তোদর।

এ সব পুরোনো দিনের কথা। ওই ওরা সব জানে। ওই মধুসূদন, লোচন, বংশী, বেণী, শশী, সিন্ধু, গিরির দল।

রাত আটটা বাজলো অথচ বংশী তখনও এল না। কিন্তু এল অনেক পরে, যখন ছুটুকবাবুর আসরে ভূতনাথ তবলা বাজাচ্ছে।

গান তখন জমে উঠেছে। হঠাৎ বংশী পেছন থেকে আস্তে আস্তে ডাকলে–শালাবাবু—

ভূতনাথ পেছনে ফিরে দেখে বললে–দাঁড়া।

কিন্তু ছুটুকবাবু দেখতে পেয়েছে। বললে—কী বলছিস রে-বংশী?

–আজ্ঞে ছোটমা একবার শালাবাবুকে ডাকছেন।

–কেন?

বংশী বললে— জানিনে।

ছুটুকবাবুর তখন খোশ মেজাজ। একটু আগেই নিধুবাবুর টপ্পা শুনেছে। নেশার ঘোর রয়েছে। বললে—যাও না ভাই, ছোটমা ডাকছে, যাও না, দোষ কী।

কান্তিধরকে তবলা দিয়ে ভূতনাথ উঠলো। বললে—আমি আসছি এখনি।

অন্দর মহলের সিঁড়ির কাছে এসে ভুতনাথের যেন কেমন সঙ্কোচ হলে।

বংশী বললে—চলে আসুন শালাবাবু, দাঁড়ালেন কেন-বলে একবার গলা খাকরি দিলে। তারপর সে-সিঁড়ির শেষে দোতলার সিঁড়ি পড়লো। সিঁড়ির মাথায় তেলের আলো জ্বলছে টিম টিম করে। লম্বা বারান্দায় একটা কাকাতুয়া চিৎকার করে ডেকে উঠলো। একটু ভয় করতে লাগলো ভূতনাথের। তারপর কোথা দিয়ে কোন্ বারান্দা পেরিয়ে কোন সিঁড়ি দিয়ে উঠে তেতলার মহলে গিয়ে পড়েছিল সেদিন চিনতে পারেনি।

তেতলার বউদের মহলে পড়তেই সিন্ধুর গলা—কে?

– আমি বংশী।

-এখন একটু সবুর করতে হবে, বড়মা হাত ধুচ্ছে।

বংশী পেছন ফিরে বললে—একটু দাঁড়ান শালাবাবু।

একটু মানে যার নাম এক ঘণ্টা। ঠায় দুজনে দাঁড়িয়ে সেখানে। কী হলো!

বংশী বললে—বড়মা’র ছুচিবাই কিনা, হাত ধুতে একটু দেরি লাগবে।

সিন্ধুর গলা শোনা গেল—বড়মা আপনি ঘুমিয়ে পড়েছেন, উঠুন, উঠুন।

বড়মার গলা শোনা গেল অনেক ডাকাডাকির পর। বললেন —কবার হলো?

—আর তিন বার। কথাটা কানে যেতেই বংশী বললে—আর দেরি নেই, হয়ে এসেছে, একষট্টি বার হয়েছে—আর তিনবার হলেই শেষ।

তারপর অনুমতি পাওয়া গেল। সিন্ধু বড়মা’কে তখন ঘরে উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছে। বললে—এবার এসো গা

ভূতনাথ সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে হাজির হলো একেবারে শেষ ঘরখানার সামনে।

ডাকলে—চিন্তা, ও চিন্তা—

কালো কুচকুচে একখানা মুখ বাইরে এসেই হঠাৎ ভূতনাথকে দেখে ঘোমটায় ঢেকে গেল।

বংশী বললে–হ্যাঁ রে, তোর ছোটমা কী করছেন?

মুখ নিচু করে চিন্তা কী বললে বোঝা গেল না। কিন্তু ভেতরে ঢুকে দুজনকেই আসতে বলে একপাশে সরে দাঁড়ালো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *