১০. উপাধি-বিতরণ উপলক্ষে কবিকঙ্কণের ভাষণ

১০. উপাধি-বিতরণ উপলক্ষে কবিকঙ্কণের ভাষণ

কবিতার ক্লাস অদ্য হৈল সমাপন,
কিছু উপদেশ দিব, শূন ছাত্ৰগণ।
বহুবিধ কৰ্ম আছে জগৎসংসারে,
তেমতি কর্মীও আছে হাজারে-হাজারে।
কেহ তেজারিতি করে, কেহ-বা মোক্তারি,
কেহ-বা দালালি করে, কেহ ঠিকাদারি।
কেহ-বা সাজায় যত্নে ইষ্টকের পাঁজা,
কেহ-বা পিষ্টক গড়ে, কেহ তেলেভাজা।
কেহ-বা পড়ায় ছাত্র, বিদ্যালয়ে যায়,
রাস্তার উপরে কেহ বান্দর নাচায়।
কেহ কৃষিকর্ম করে, কেহ ধান ভানে,
কেহ-বা চালায় টেমপে, কেহ রিকশা টানে।
পানের বোটাটি হস্তে, নাহি-ক সময়,
চলেছে দপ্তরে কেহ, ব্যস্ত অতিশয়।
কেহ-বা ডাক্তারি করে, বত্ৰিশ টাকার
ভিজিটে ছত্রিশ-তলা বাড়ি ওঠে তার।
কেহ করে রাজনীতি, অন্যের মাথায়
কৌশলে কঁঠাল ভেঙে মহানন্দে খায়।
কেহ তৈল বেচে, কেহ তেলা মস্তকের
উপরেই তৈল ঢেলে গুছায় আখের।
কেহ করে জনসেবা, ধন্য হয় দেশ;
কেহ-বা কাজের মধ্যে উলটায় গণেশ।
এইমতো নানা লোকে নানা কর্ম করে,
কর্মী নামে খ্যাত হয় বিশ্ব-চরাচরের
কর্মযোগী কৰ্মবীর নানা আখ্যা পায়,
কর্মের জাতাটি তারা অক্লেশে ঘুরায়।
তেমতি কবিতা লেখা কর্ম যদি হয়,
কবিকেও লোকে কমী বলিত নিশ্চয়।
কিন্তু যে কবিতা লেখে,- শিশু বৃদ্ধ নারী
সকলেই বলে তাকে ‘অকর্মর ধাড়ি’।
অশান্তিতে জ্বলে সদা কবির সংসার,
ভাই বন্ধু সকলেই নিন্দা করে তার।
“এইবারে ত্যাজ্যপুত্ৰ করিব ব্যাটাকে।”
জায়াও সর্বদা কয় মুখ করি কালো,
“ইহাপেক্ষা ডাকতের হাতে পড়া ভালো।”
বাড়িওলা শোনে যদি, নূতন ভাড়াটে
পদ্য লেখে, তবে তার ভয়ে দিন কাটে।
ইদানীং মুদিরাও হয়েছে সেয়ানা,
কবিকে বাকিতে তারা কিছুই দেয় না।
অধিক কবি কী, কোনো কাবুলিওলাও
কবিকে দেয় না কার্জ বলে, “ভাগ যাও।”
এইসব ভেবেচিন্তে ছাত্ৰগণ সবে
ঠিক করো, কবি কিংবা কৰ্মবীর হবে।
পিতার ধমক, মুদি যাবদের তাড়া,
বন্ধুদের ব্যঙ্গ, গৃহিণীর মুখনাড়া,
কোনোদিকে কিছুমাত্র দৃষ্টি নাহি হেনে,
সবকিছু ললাটস্য লিখনং’ জেনে
তবু পদ্য লিখিবার ইচ্ছা যদি হয়
মাঝে-মাঝে দুই ছত্র লিখিবা নিশ্চয়।
নিত্যও লিখিতে পারো, তবে কথা এই,
যত কবি বঙ্গে, তত পাঠক তো নেই।
আর যদি পাঠকের না করো পরোয়া,
তাহলে উত্তম কথা, সে তো বারো পোয়া।
সকালে লিখিয়ো তবে, দুপুরে লিখিয়ো,
বিকালে লিখিয়ো, শুধু রাত্রে ঘুম দিয়ে।
লিখিবার অন্ধিসন্ধি জেনেছ সবাই,
কবিতার ক্লাসে, তাই চিন্তা আর নাই।
শিখছ ছন্দের রীতি, বাক্যের কায়দা,
এইবারে তাহাতেই উঠিবে ফায়দা।
স্নাতক-উপাধি আমি দিলাম সকলে।
(জানি না কী ধুধুমার হবে তার ফলে।)
কবিকঙ্কণের কথা শেষ হৈল, আর
কথা নাই কিছু, যাও, সকলে এবার
তত পদ্য লেখো বাছা, যত ইচ্ছা হয়,
শুধু এক অনুরোধ, রাখিবা নিশ্চয়।
দৈনিক কাগজে পদ্য নাহি যায় ছাপা—
নিতান্ত সহজ কথা, মনে রেখে বাপা।
সুতরাং লেখো পদ্য হাজারে হাজারে,
কিন্তু তাহা পাঠিয়ো না ‘আনন্দবাজারে’।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *