অধ্যায় ১০
উপসংহার
গত চার শতক ধরে ধর্মতত্ত্ব এবং বিজ্ঞানবিদদের মধ্যে অধিকতর উল্লেখযোগ্য সংঘাত-সমূহের উৎস সংক্ষিপ্ত রূপরেখায় পূর্ববর্তী অধ্যায়সমূহে আলোচনা করেছি। এবং আমরা বর্তমান ধর্মতত্ত্বের উপর বর্তমান বিজ্ঞানের প্রভাবও মূল্যায়নের চেষ্টা করেছি। আমরা দেখেছি যে, কোপার্নিকাসের সময় থেকে যখনই বিজ্ঞান ও ধর্মতত্ত্বের মধ্যে কোনো বিষয়ে মতানৈক্য ঘটেছে, সেক্ষেত্রে বিজ্ঞানই জয়ী হয়েছে। আমরা এটাও দেখেছি যে, ডাকিনীবিদ্যা এবং ভেষজবিদ্যার মতো বাস্তব বিষয় যেখানে যুক্ত ছিল, সেখানেও বিজ্ঞান দুঃখকষ্টের হ্রাসপ্রাপ্তির পক্ষে দাঁড়িয়েছে। আর ধর্মতত্ত্ব প্রাকৃতিক আদিমতাকে উৎসাহিত করেছে। ধর্মতত্ত্বের বিপরীতে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি এ পর্যন্ত সংশয়াতীত ভাবে মানুষের সুখের ব্যবস্থাই করেছে।
বিষয়টা এখন পুরোপুরি একটা নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করছে। এটা করছে প্রধানত দুটো কারণে। প্রথমত, মানসিকতার বৈজ্ঞানিক মেজাজের চেয়ে, প্রয়োগের ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া অধিকতর গুরুত্ব পাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, নতুনতর ধর্মসমূহ খ্রিস্টধর্মের স্থলাভিষিক্ত হচ্ছে এবং যে সব ভুলের জন্য খ্রিস্টধর্ম অনুতাপ করেছে, সেসব ভুলগুলোই এসব ধর্ম পুনরাবৃত্তি করছে।
মনের বৈজ্ঞানিক মেজাজ সতর্ক, সন্ধিগ্ধ এবং আংশিক। এটা এমন কল্পনা করে না যে, এটা সমগ্র সত্যকেই জানে অথবা এর সর্বোত্তম জ্ঞানটা সম্পূর্ণ সত্য। এই বৈজ্ঞানিক মেজাজ এটা জানে যে, প্রতিটি মতবাদেরই, আগে কিংবা পরে, সংশোধনের প্রয়োজন হয়। এমন সংশোধনের জন্য অনুসন্ধানের এবং আলোচনার স্বাধীনতা দরকার। কিন্তু তত্ত্বীয় বিজ্ঞান থেকেই একটা বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া বিকশিত হয়েছে। এবং বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ার এ-ধরনের কোনো তত্ত্বগত সন্ধিগ্ধতা নেই। বর্তমান শতকে পদার্থবিদ্যা আপেক্ষিকতা এবং কোয়ান্টাম তত্ত্বের সাহায্যে বৈপ্লবিক হয়ে উঠেছে। কিন্তু পূর্বতন পদার্থবিদ্যাভিত্তিক সমুদয় আবিষ্কার আজও সন্তোষজনক অবস্থায় রয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্র, সম্প্রচার এবং বৈদ্যুতিক আলো, এসব অন্তর্ভুক্ত করে শিল্পে এবং দৈনন্দিন জীবনে বিদ্যুতের ব্যবহার ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েলের কাজের উপর ভিত্তি করে ষাট বছর আগেই প্রকাশিত হয়েছে। এবং এসব আবিষ্কারের কোনোটিই অকার্যকরী হয়নি। এর কারণ এখন আমরা জানি যে, অনেক ক্ষেত্রে ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েলের মতামত অপর্যাপ্ত ছিল। এভাবে প্রয়োগকুশলী বিশেষজ্ঞগণ যাঁরা বৈজ্ঞানিক কৌশল প্রয়োগ করেন এবং আরও বিশদে সরকার ও বৃহৎ ফার্মগুলো, যারা প্রয়োগকুশলী বিশেষজ্ঞদের নিয়োগ করে, এতে এসব বিশেষজ্ঞরা বিজ্ঞানবিদদের থেকে পুরোপুরি পৃথক মেজাজ অধিগত করেন। এই মেজাজটি সীমাহীন দক্ষতার ধারণা, স্পর্ধিত নিশ্চয়তা এবং মানসিক বস্তুর কৌশলী হস্তচালনার আনন্দের যোগফলে তৈরি করা। এটি কার্যত বৈজ্ঞানিক মেজাজের বিপরীত কিন্তু এটা অনস্বীকার্য যে, বিজ্ঞান এটার বিকাশে সহায়তা করেছে।
বৈজ্ঞানিক প্রয়োগের প্রত্যক্ষ ফলাফলও কোনো ক্রমেই পুরোপুরি কল্যাণদায়ী হয়নি। একাধারে এরা যুদ্ধাস্ত্রের ধ্বংসকারিতা বাড়িয়েছে, এবং শান্তিপূর্ণ শিল্পে জনসংখ্যার একাংশকে যুদ্ধ ও গোলাবারুদ তৈরির জন্য ব্যবহার করেছে। পক্ষান্তরে, শ্রমের উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে তারা পুরানো আর্থিক ব্যবস্থা তৈরি করেছে, যে-ব্যবস্থা নির্ভর করত দুম্পাপ্যতা, কাজ করার প্রবল অসুবিধা এবং নতুন মতবাদের প্রবল প্রভাবে তারা প্রাচীন সভ্যতা বাতিল করেছে, চীনকে বিশৃঙ্খলার মধ্যে এবং পাশ্চাত্য মডেলের নিষ্ঠুর সাম্রাজ্যবাদের খপ্পরে জাপানকে ঠেলে দিয়েছে। রাশিয়াকে একটা নতুন আর্থিক ব্যবস্থা গড়ার প্রবল প্রচেষ্টার মধ্যে এবং জার্মানিকে পুরাতন আর্থিক ব্যবস্থা বজায় রাখতে বেপরোয়া প্রচেষ্টার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। আমাদের সময়ের এইসব অকল্যাণের আংশিক কারণ বৈজ্ঞানিক প্রয়োগ, সুতরাং পরিশেষে বিজ্ঞান।
বিজ্ঞান ও খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্বের সংঘাত, মাঝে মাঝে এখানে-ওখানে খণ্ডযুদ্ধ সত্ত্বেও এখন প্রায় পরিসমাপ্তির দিকে। আমি মনে করি, বেশিরভাগ খ্রিস্টানরা এটা স্বীকার করবেন যে, তাদের ধর্ম এ-কাজে উৎকৃষ্টতর। আদিম যুগ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত বস্তুসত্তাহীনতা থেকে খ্রিস্টধর্মকে বিশুদ্ধ করা হয়েছে এবং ধর্মীয় কারণে নিগ্রহ করার ইচ্ছা থেকেও মুক্ত করা হয়েছে। অধিকতর উদার খ্রিস্টানদের মধ্যে একটা নৈতিক মতবাদ রয়েছে যেটা মূল্যবান। এই মতবাদের কথা, আমাদের প্রতিবেশীকে আমাদের ভালোবাসা উচিত, এই সংক্রান্ত খ্রিস্টের শিক্ষা, এটাকে আর ‘আত্মা’ বলে মনে না করলেও, প্রতিটি ব্যক্তির মধ্যে এমন কিছু আছে যা শ্রদ্ধার উপযুক্ত, এই বিশ্বাস। গির্জাসমূহে ক্রমবর্ধমান এই বিশ্বাস যে, খ্রিস্টানদের উচিত যুদ্ধের বিরোধিতা করা।
কিন্তু পুরাতন ধর্ম যখন এভাবে বিশুদ্ধিকৃত হলো এবং অনেকভাবে কল্যাণকর হয়ে উঠল, তখন বলিষ্ঠ যৌবনের শক্তিসহ ধর্মীয় কারণে নির্যাতনের উদ্দীপনা নিয়ে নতুন ধর্মসমূহের আবির্ভাব ঘটল। গ্যালিলিওর সময়ের ধর্ম-আদালতের বিজ্ঞান বিরোধিতার বৈশিষ্ট্যকে কার্যকরী করে তুলতে চাইছে এইসব নতুন ধর্ম। জার্মানিতে যদি আপনি বলেন যে, খ্রিষ্ট একজন ইহুদি ছিলেন কিংবা রাশিয়াতে থেকে যদি বলেন যে, পরমাণু তার বস্তুময়তা হারিয়ে কেবল ঘটনার ক্রম হয়ে দাঁড়িয়েছে, তাহলে আপনাকে ভয়ংকর শাস্তি পেতে হবে। সম্ভবত, আইনি শাস্তির চেয়ে আর্থিক শাস্তি। কিন্তু এক্ষেত্রে কোনো শাস্তিটাই মৃদুতর হবে না। জার্মানিতে এবং রাশিয়ায় বুদ্ধিজীবীদের উপর নিগ্রহ গত আড়াইশো বছরে গির্জাসমূহের দ্বারা সংঘটিত যে কোনো নির্যাতনের প্রচণ্ডতাকে অতিক্রম করে গেছে।
বর্তমান সময়ে বিজ্ঞান যা নির্যাতনের অত্যন্ত প্রত্যক্ষ আঘাত বহন করে সেটি হলো অর্থনীতি। ইংল্যান্ড বর্তমানে, যেমনটা সব সময়ে, একটি ব্যতিক্রমী সহনশীল দেশ। সেখানেও একজন মানুষ, অর্থনীতি সম্পর্কে যার মতবাদ সরকারের পক্ষে আপত্তিকর, তিনিও সমুদয় শাস্তি এড়াতে পারেন, যদি তিনি কেবল নিজের মধ্যেই এই মতবাদ সীমিত রাখেন কিংবা কোনো পুস্তকে সেটা ব্যক্ত করেন। কিন্তু সেই ইংল্যান্ডেও, কেউ যদি তাঁর বক্তব্যে কিংবা সস্তা প্রচারপত্রে কম্যুনিস্ট মতবাদ ব্যক্ত করেন তাহলে সেই মানুষটিকে তার জীবিকা হারাতে এবং মাঝে মাঝে কারাগারে থাকতে হবে। একটা সাম্প্রতিক আইনে, যদিও এ পর্যন্ত আইনটির পরিপূর্ণ ব্যবহার ঘটেনি, বলা হয়েছে, সরকার যে-লেখাকে রাজদ্রোহসূচক বলে মনে করে এমন লেখার লেখককেই শুধু নন, যার অধিকারে এসব লেখা থাকবে, তিনিও শাস্তিযোগ্য হবেন এই কারণে যে, তিনি এসব লেখা সম্রাটের প্রতি আনুগত্যের ভিত্তিকে দুর্বল করার জন্য ব্যবহারের চিন্তা করতে পারেন।
জার্মানি এবং রাশিয়ায় ধর্মান্ধতার প্রশস্ত সুযোগ রয়েছে এবং ধর্মান্ধহীনতার জন্য শাস্তি ভিন্নতর প্রচণ্ড ধরনের। ওইসব দেশে সরকার নিযুক্ত অন্ধ মতবাদ অনুযায়ী একটি কর্তৃত্ব থাকে এবং যারা খোলাখুলি ভিন্নমত পোষণ করে, তারা তাদের জীবন রক্ষা . করতে পারলেও কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে বাধ্যতামূলক শ্রমদানে বাধ্য হয়। এটা সত্য যে, এক দেশে যেটা ধর্মদ্বেষিতা, অন্য দেশে সেটা ধর্মান্ধতা। একজন মানুষ যিনি যে কোনো একটা দেশে নির্যাতিত, তিনি যদি অন্য দেশটাতে চলে যেতে পারেন, তাহলে তিনি বীর বলে সমাদৃত হন। যাই হোক, এরা ধর্ম-আদালতের মতবাদ সংরক্ষণের ব্যাপারে সমগোত্রীয়। সত্য বিকশিত করার পথ সত্য কি, সেটা চিরকালের জন্য বর্ণনা করা এবং যারা এই সত্যে অসম্মতি জানাবে তাদের শাস্তি প্রদান করা। বিজ্ঞান এবং গির্জাসমূহের মধ্যে সংঘাত এই মতবাদের মিথ্যাত্ব প্রমাণ করেছে। আমরা সবাই এখন সুনিশ্চিত যে, গ্যালিলিওর নির্যাতনকারীরা সমুদয় সত্য জানতেন না, কিন্তু আমাদের কেউ কেউ হিটলার অথবা স্ট্যালিন সম্পর্কে কম সুনিশ্চিত বলে মনে হয়।
এটা দুর্ভাগ্যজনক যে, অসহনশীলতাকে প্রশ্রয় দেবার সুযোগ দুটো বিরুদ্ধ দিক থেকেই উঠে এসেছে। এমন কোনো দেশ যদি থাকত যেখানে বিজ্ঞানবিদগণ খ্রিস্টানদের নিগ্রহ করতে পারতেন, সম্ভবত গ্যালিলিওর বন্ধুরা ‘সমুদয়’ অসহনশীলতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেন না, প্রতিবাদ করতেন কেবলমাত্র বিরুদ্ধ দলের অসহনশীলতার বিরুদ্ধে। এমন হলে গ্যালিলিওর বন্ধুরা তাঁর মতবাদকে একটা অন্ধবিশ্বাসের অনুশাসনে গৌরবান্বিত করতেন। আইনস্টাইন, যিনি দেখিয়েছিলেন যে, গ্যালিলিও এবং ধর্ম-আদালত উভয়ই ভ্রান্ত ছিল, তিনি তো উভয় পক্ষ কর্তৃক নির্বাসিত হতে পারতেন এবং কোথাও আশ্রয় খুঁজে পেতে ব্যর্থ হতেন।
এটা নিবেদন করা যেতে পারে যে, আমাদের সময়ে অতীত থেকে ভিন্নতর নির্যাতনের স্বরূপ হলো রাজনৈতিক এবং আর্থিক, কিন্তু ধর্মতাত্ত্বিক নয়। কিন্তু এ ধরনের যুক্তি অনৈতিহাসিক। অসংযমী মতবাদের উপর লুথারের আক্রমণের ফলে পোপের বিশাল আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। অষ্টম হেনরীর বিদ্রোহে পোপকে প্রভূত রাজস্ব হারাতে হয়েছে যা তিনি তৃতীয় হেনরীর সময় থেকে ভোগ করে আসছিলেন। স্কটের মেরি কুইন অথবা দ্বিতীয় ফিলিপের দ্বারা এলিজাবেথকে ক্ষমতাচ্যুত করতে চাওয়াতে তিনি রোমান ক্যাথলিকদের উপর নির্যাতন চালিয়েছিলেন। মানুষের মন থেকে গির্জার আধিপত্যকে দুর্বল করেছে বিজ্ঞান। এবং পরিণামে অনেক দেশে গির্জার সম্পত্তিকে বাজেয়াপ্ত করার দিকে ঘটনাকে পরিচালিত করেছে। আর্থিক এবং রাজনৈতিক অভিপ্রায়ই নির্যাতনের আংশিক কারণ, সম্ভবত প্রধান কারণ।
যাই হোক, মতামতের নির্যাতনের বিরুদ্ধে যুক্তি, নির্যাতনের যে-কোনো কারণের উপর নির্ভর করে না। যুক্তিটা হলো আমরা কেউ-ই সমুদয় সত্য জানি না, নতুন সত্যের আবিষ্কার মুক্ত আলোচনা দ্বারা উন্নীত, এবং দমনে সত্য জানা খুবই কষ্টসাধ্য। পরিণামে সত্যের আবিষ্কারে মানবিক কল্যাণ বর্ধিত হয় এবং ভ্রমাত্মক কাজে এটা বাধাপ্রাপ্ত হয়। নতুন সত্য স্বার্থান্বেষীদের পক্ষে প্রায়ই অসুবিধাজনক। শুক্রবারে উপবাস প্রয়োজনীয় নয়, প্রোটেস্টান্টদের এই মতবাদ প্রবলভাবে প্রতিহত হয়েছিল এলিজাবেথীয় মাছ-ভক্ষকদের দ্বারা। কিন্তু বৃহত্তর সম্প্রদায়ের স্বার্থে নতুন সত্য স্বাধীনভাবে প্রচারিত হবে। একটা নতুন মতবাদ সত্য কিনা সেটা তো প্রথমে জানা যায় না। নতুন সত্যের স্বাধীনতার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হতে হবে ভুলের স্বাধীনতাকেও। এইসব মতবাদ যেগুলো বহুল প্রচলিত, সেগুলো এখন জার্মানি এবং রাশিয়ায় গর্হিত এবং অন্যত্র যথেষ্ট পরিণামে স্বীকৃত নয়।
১৬৬০ সাল থেকে যে-কোনো সময়ের চেয়ে আমাদের সময়ে বৌদ্ধিক স্বাধীনতার প্রতি হুমকিটা ব্যাপকতর। কিন্তু এটা এখন খ্রিস্টীয় গির্জা থেকে আসছে না। এটা সরকারের তরফে আসছে, যে-সরকার নৈরাজ্য এবং বিশৃঙ্খলার আধুনিক বিপদের কারণে যাবতীয় বিরোধিতা থেকে সুরক্ষিত গির্জার কর্তৃপক্ষের চরিত্র উত্তরাধিকারী হিসাবে পেয়েছে। বিজ্ঞানবিদ এবং যারা বৈজ্ঞানিক জ্ঞানকে মূল্য দেন, তাঁদের সকলের এটা একটি স্বচ্ছ কর্তব্য, এই নতুন ধরনের নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা। পুরাতন ব্যবস্থার পতনে নিজেদেরকে সন্তোষজনকভাবে অভিনন্দিত করার চেয়েও এটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এবং এই কর্তব্যের পরিমাণ কমে যায় না এমন কোনো নতুন মতবাদের প্রতি আনুগত্যে, যে-মতবাদের সমর্থনে নির্যাতন যুক্ত হয়ে পড়ে। সাম্যবাদের প্রতি কোনো অভিরুচি আমাদের অনিচ্ছুক করবে না রাশিয়ায় কোনো অসংযমকে চিনতে। অথবা এটা বুঝতেও অনিচ্ছুক করবে না যে, একটা শাসনব্যবস্থা যা তার গোঁড়ামির কোনো সমালোচনাকে অনুমতি দেয় না, আখেরে এই ব্যবস্থা নতুন জ্ঞানের আবিষ্কারের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বিপরীতক্রমে, সাম্যবাদ অথবা সমাজতন্ত্রের প্রতি বিরাগ আমাদের চিন্তায় এই মতবাদ দমনে জার্মানিতে সংঘটিত বর্বরতাকে ক্ষমার যোগ্য করে তুলবে না। যে-সব দেশে বিজ্ঞানবিদরা তাদের কাঙ্ক্ষিত বৌদ্ধিক স্বাধীনতা জয় করে নিতে পেরেছেন, পক্ষপাতিত্বহীন প্রতিবাদ সহ তাদের দেখানো উচিত যে, যে-কোনো স্থানে সে-স্থানের মতবাদের জন্য এই স্বাধীনতা দমিত হলেও, তারা এ-ধরনের স্বাধীনতা খর্ব করার চেষ্টাকে অপছন্দ করছেন।
যাদের কাছে ব্যক্তিগতভাবে এই বৌদ্ধিক স্বাধীনতা গুরুত্বপূর্ণ তাঁরা জন সম্প্রদায়ের মধ্যে সংখ্যালঘিষ্ঠ হতে পারেন, কিন্তু এঁদের মধ্যেই ভবিষ্যতের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ মানুষেরা আছেন। মানবেতিহাসে আমরা কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও এবং ডারউইনের গুরুত্ব দেখেছি। এবং এটা ধরে নেওয়া ঠিক নয় যে, ভবিষ্যৎ এ-ধরনের ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটাবে না। তারা যদি তাদের কার্যসাধনে বাধাপ্রাপ্ত হন এবং তাঁদের প্রাপ্য গুরুত্ব না পান তাহলে মানবজাতি বন্ধ্যা হয়ে যাবে এবং নতুন অন্ধকার যুগ পরম্পরাক্রমে শুরু হবে, যেমন উজ্জ্বল প্রাচীন যুগের পরম্পরায় পূর্বতন অন্ধকার যুগ শুরু হয়েছিল। নতুন সত্য প্রায়শই অস্বস্তিদায়ক, বিশেষত ক্ষমতাবানদের কাছে। তা সত্ত্বেও, নিষ্ঠুরতা এবং ধর্মান্ধতার দীর্ঘ নিদর্শনের মধ্যেও, এটাই আমাদের বুদ্ধিশীল কিন্তু দূরন্ত প্রজাতির সর্বোত্তম গুরুত্বপূর্ণ প্রাপ্তি।