১০. ইয়াজউদ্দিন সাহেব

ইয়াজউদ্দিন সাহেব বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসেছিলেন।

শুভ্র এসে বলল, বাবা আমি যাচ্ছি। ইয়াজউদ্দিন বিস্মিত হয়ে বললেন, এখন যাচ্ছ মানে? এখন বাজে রাত নটা।

গাড়িতে স্টেশনে যেতে তোমার সময় লাগবে পাঁচ মিনিট।

আমাদের সবারই একটু আগে যাবার কথা। তাছাড়া আমি গাড়ি নিচ্ছি না। রিকশা করে যাচ্ছি।

রিকশা করে যাচ্ছ?

জ্বি।

কেন জানতে পারি?

নিজের মতো করে যেতে চাচ্ছি বাবা।

গাড়ি নিয়ে গেলে বুঝি পরের মতো করে যাওয়া হবে?

শুভ্র কিছু বলল না।

ইয়াজউদ্দিন সাহেব বললেন, সত্যি করে বলতো, তুমি কি কোনো কারণে আমার উপর বিরক্ত?

বিরক্ত হব কেন?

প্রশ্ন দিয়ে প্রশ্নের উত্তর আমার পছন্দ না। তুমি আমার উপর বিরক্ত কি বিরক্ত না সেটা বল। হ্যাঁ অথবা না।

হ্যাঁ।

ইয়াজউদ্দিন অনেকক্ষণ ছেলের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। শুভ্ৰ হ্যাঁ বলেছে এটা বিশ্বাস করতে তার সময় লাগছে।

তুমি বিরক্ত কেন?

এখনতো আমার সময় নেই বাবা পরে গুছিয়ে বলব।

স্টেশনে যেতে তোমার লাগবে পাঁচ মিনিট।

আমিতো রিকশা করে যাচ্ছি।

রিকশাতেও কুড়ি মিনিটের বেশি লাগার কথা না। শুভ্ৰ স্বাভাবিক গলায় বলল, তোমার উপর কেন বিরক্ত সেটা বলতে আমার সময় লাগবে। আমি ফিরে এসে বলব।

অনেক দীর্ঘ কথাও খুব সংক্ষেপে বলা যায়। তিন পাতার যে রচনা তার সাবসটেন্স সাধারণত দুই তিন লাইনের বেশি হয় না।

শুভ্র বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি তোমার উপর বিরক্ত কারণ তুমি আমাকে অবিকল তোমার মতো করতে চাও।

সব বাবাই কি তাই চায় না?

চাওয়াটা ঠিক না। এটা চাওয়া মানে ছেলেদের উপর চাপ সৃষ্টি করা। অন্যায় প্রভাব ফেলা।

আমি তোমার উপর অন্যায় প্রভাব ফেলছি?

চেষ্টা করছ কিন্তু পারছ না।

মনে হচ্ছে মানুষ হিসেবে তুমি আমাকে তেমন পছন্দ কর না।

পছন্দ করি, কিন্তু তুমি সব সময় নিজকে অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি বুদ্ধিমান মনে কর। এটা আমার পছন্দ না।

তোমার ধারণা আমি অন্যদের চেয়ে বুদ্ধিমান নই?

আমার তাই ধারণা বাবা। তুমি অন্যদের চেয়ে কৌশলী, কিন্তু বুদ্ধিমান নও।

কিভাবে বুঝলে আমি বুদ্ধিমান নাই?

এক জন বুদ্ধিমান মানুষ অন্যদের বুদ্ধি খাটো করে দেখে না। এক জন বোকা লোকই তা করে। তুমি সব সময় আমার বুদ্ধিকে খাটো করে দেখেছ। মাকে খাটো করে দেখেছ। আমি যে যথেষ্ট বুদ্ধিমান সেটা তুমি এখন বুঝতে পারছ- আগে না। এর আগ পর্যন্ত তোমার ধারণা ছিল আমি পড়ুয়া এক জন ছেলে। বই পত্র ছাড়া কিছুই বুঝি না। আমি জগতের বাইরে এক জন মানুষ যে পরীক্ষায় প্রথম হওয়া ছাড়া আর কিছুই পারে না।

শুভ্ৰ তুমি বস। তোমার সঙ্গে কথা বলি।

আমারতো সময় নেই বাবা।

এক কাজ করলে কেমন হয়। আমি বরং তোমার সঙ্গে রিকশা করে যাই। অনেক দিন রিকশা চড়া হয় না। যেতে যেতে কথা বলি।

আমি একাই যেতে চাই বাবা।

তোমার মনে যে এতটা চাপা ক্ষোভ ছিল তা আমি বুঝি নি।

বুদ্ধি কম বলেই বোঝ নি। অন্য যে কোন বাবা সেটা বুঝতেন।

আই এ্যাম সরি। আই এ্যাপোলোজাইজ।

শুভ্ৰ হেসে ফেলে বলল, এ্যাপোলোজি একসেপটেড। বাবা যাই।

বন ভয়াজ মাই ডিয়ার সান। বন ভয়াজ।

শুভ্ৰ নিচু হয়ে বাবাকে পা ছুঁয়ে সালাম করতে গেল। ইয়াজউদ্দিন সাহেব ছেলেকে তা করতে দিলেন না, জড়িয়ে ধরলেন।

শুভ্র বলল, আমি যদি তোমাকে কষ্ট দিয়ে থাকি তাহলে ক্ষমা করে দিও। আমি তোমাকে অসম্ভব ভালোবাসি বাবা। এই ভালোবাসার মধ্যে কোনো রকম খাদ নেই। একজন মানুষ অন্য এক জনকে তার গুণের জন্যে ভালোবাসে। আমি ভালোবাসি তোমার দোষগুলোর জন্যে। তুমিই আমার দেখা একমাত্র মানুষ যার দোষগুলোকে গুণ বলে মনে হয়।

ইয়াজউদ্দিন সাহেব ছেলেকে রিকশায় তুলে দিয়ে রিকশাওয়ালাকে বললেন, খুব ধীরে টেনে নিয়ে যাও। বলেই তাঁর কি মনে হলো তিনি বললেন, না ঠিক আছে তুমি যে ভাবে যাও সেভাবেই যাবে। ধীরে যেতে হবে না।

রিকশাওয়ালা উল্কার বেগে ছুটল। কমলাপুর রেলস্টেশানের কাছাকাছি এসে স্পীড-ব্রেকার ধাক্কা খেয়ে রিকশা উল্টে গেল। লোকজন ছুটে এসে আজকে টেনে তুলল। শুভ্র বলল, আমার কিছুই হয় নি। শুধু চশমাটা ভেঙ্গে গেছে।

শুভ্র কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। আলো এবং ছায়া তার চোখে ভাসছে। চশমা ছাড়া সে সত্যি সত্যি অন্ধ।

শুভ্র বলল, আপনার কেউ কি আমাকে দয়া করে কমলাপুর রেল স্টেশনে নিয়ে যাবেন। আমি চশমা ছাড়া কিছুই দেখতে পাই না। প্লীজ আপনারা কেউ আমাকে একটু সাহায্য করুন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *