ইরতাজুদ্দিন সাহেব তাঁর শোবার ঘরে ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে আছেন। তাঁর মুখ জানালার দিকে। দোতলার জানালা বলে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। তিনি শাহানাকে ভিজতে ভিজতে হাওড়ের দিকে যেতে দেখলেন–আবার ফিরে আসতেও দেখলেন। তার মধ্যে কোন রকম বাহ্যিক চাঞ্চল্য দেখা গেল না। তিনি যে ভাবে আধশোয়া হয়ে বসেছিলেন ঠিক সে ভাবেই রইলেন। ইজিচেয়ারের হাতলে পেতলের বাটিতে পেঁপে কেটে দেয়া হয়েছে। তিনি তা স্পর্শও করেননি। সকাল ৯টার মত বাজে। এই সময়ে তাঁর এক বাটি পাকা পেঁপে খাবার কথা। কবিরাজের পরামর্শমত দীর্ঘদিন ধরে খাচ্ছেন–আজ তার ব্যতিক্রম হল।
তিনি দুই নাতনীকে দেখে যে প্রবল আনন্দ পেয়েছিলেন সেই আশপ স্থায়ী হয়নি। তিনি মেয়ে দুটির সঙ্গে মিশতে পারছেন না। মেয়ে দুটিও তাঁর সঙ্গ তেমন পছন্দ করছে না। নীতু সারাক্ষণ ঘুরছে পুষ্পকে নিয়ে। প্রবল উৎসাহে তাকে লেখাপড়া শেখানো হচ্ছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে জ্ঞান বিতরণের মহৎ উদ্দেশ্যেই তার সুখানপুকুর আগমন। গল্প করার জন্যে তাকে যখনই ডাকা হয় তখনি সে বলে–একটু পরে আসব দাদাজান। এখন কাজ করছি। সেই একটু পর আর আসে না।
নীতুর যেমন পুষ্প জুটেছে শাহানার তেমন কেউ জুটেনি। ইরতাজুদ্দিন সাহেব, নিশ্চিত হয়েছেন–এই মেয়েটি একা থাকতেই বেশি পছন্দ করে। বেড়াতে এসেছে, কোথায় হৈ-চৈ করবে তা না, বেশির ভাগ সময়ই হাতে মোটা একটা বই। সেটা গল্পের বইও না, ডাক্তারি বই। অথচ মেয়েটা এমনভাবে বইটা পড়ে যে মনে হয় দারুণ মজার কোন গল্পের বই পড়ছে।
ইরতাজুদ্দিন সাহেব ভেবে রেখেছিলেন, মেয়ে দুটিকে তিনি নিজে গ্রাম ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাবেন–কিন্তু মেয়েদের তাতে কোন উৎসাহ দেখা গেল না। ছোটটি ঘর থেকেই বের হতে চায় না–বড় জন বেড়াতে চায়–কিন্তু একা একা। মেয়ে দুটি তাঁকে পছন্দ করছে না।
এ সময়ের আধুনিক মেয়েদের মন পাবার কলা-কৌশল তার জানা নেই। তিনি চেষ্টা করেছেন নিজের মত। ছাদে উঠতে চেয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে ছাদে ওঠার সিড়ি বানিয়ে দিয়েছেন। কাঁঠাল গাছে চওড়া দোলনা লাগিয়ে দিয়েছেন। হাওড় দেখার জন্যে বড় একটা বজরা নৌকা আনিয়ে ঘাটে বেঁধে রেখেছেন। মেয়ে দুটি তার আন্তরিক চেষ্টার কোন মূল্য দিচ্ছে না। তারা আছে নিজেদের মত।
ইরতাজুদ্দিন সাহেবের এখন মনে হচ্ছে, তিনি সামান্য ভুল করেছেন। এরা দুদিন থাকার জন্যে এসেছিল, দুদিন থেকে চলে গেলেই ভাল হত।
জোর করে আটকে রেখে তিনি এদেরও কষ্ট দিচ্ছেন, নিজেও খুব সূক্ষভাবে হলেও কষ্ট পাচ্ছেন। তিনি মেয়েদের কষ্টটা বুঝতে পারছেন, কিন্তু মেয়ে দুটি তার কষ্ট বুঝতে পারছে না। দিনের পর দিন একটা বিশাল বাড়িতে একা থাকার কষ্ট মেয়ে দুটি জানে না।
তার বয়স হয়েছে। মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করার মত বয়স। এই অপেক্ষা প্রিয় ও ঘনিষ্ঠজনদের চারপাশে নিয়ে করা যায়–কিন্তু একা একা নির্বান্ধব পুরীতে বসে অপেক্ষা করা যায় না।
ইরতাজুদ্দিন চামচে করে এক টুকরা পেঁপে মুখে দিলেন। খুব মিষ্টি পেঁপে। ফজলি আমের মত মিষ্টি–নীতু আর শাহানকে কি পেপে দেয়া হয়েছে? তিনি ভারি গলায় ডাকলেন–রমিজের মা।
রমিজের মা ঘরে ঢুকল না। ঢুকল শাহানা। সে এর মধ্যে ভেজা শাড়ি পাল্টেছে। টাওয়েল জড়িয়ে মাথায় চুল শুকাচ্ছে। শাহানা বলল, আপনার কি কিছু চাই দাদাজান?
ইরতাজুদ্দিন বললেন, না।
ঐ মহিলার একজন মেয়ে হয়েছে। খুব সুন্দর ফুটফুটে মেয়ে। শেষ সময়ে সহজ ডেলিভারি হয়েছে।
তোর ডাক্তারি বিদ্যা কাজে লেগেছে?
হুঁ লেগেছে। আপনার কি শরীর খারাপ?
না।
শাহানা খাটের এক মাথায় বসতে বসতে বলল, আপনার নিষেধ অমান্য করে আমি গিয়েছি, সে জন্যে কি আপনি আমার উপর রাগ করেছেন?
না।
আমার উপর রাগ করার আপনার নিশ্চয়ই নিজস্ব কিছু কারণ আছে যদিও আমি তা ধরতে পারছি না। আপনি দয়া করে আমার উপর রাগ করবেন না।
রাগ করছি না।
যাই দাদাজান?
আচ্ছা যা।
যাই বলার পরেও শাহানা খাটের পাশে বসে রইল। সে একটা বিশেষ কথা বলার জন্যে আসছে, কথাটা এতই মুহূর্তে বলবে, পরে বলবে বুঝতে পারছে না। বিশেষ কোন কথা বলার জন্যে বিশেষ বিশেষ মুহূর্ত লাগে। কোন কোন মানুষ সেই মুহূর্তগুলি ধরতে পারে। অনেকেই পারে না। যেমন সে পারে না।
দাদাজান।
হুঁ।
আপনার এই সুন্দর বাড়িটার কোন নাম নেই কেন?
আপনার বাড়ি বলছিস কেন? বাড়িটা তোদেরও না? এটা আমাদের সবার বাড়ি।
বাড়িটার সুন্দর একটা নাম থাকলে ভাল হত।
ইরতাজুদ্দিন উৎসাহের সঙ্গে বললেন, দে একটা নাম দে। সুন্দর নাম দে। ময়মনসিংহ থেকে সাইনবোর্ড বানিয়ে এনে তোরা থাকতে থাকতে লাগিয়ে দেব।
শাহানা আরেকটু ঝুঁকে এসে বলল–এই বাড়িটাকে একটা হাসপাতাল বানিয়ে ফেললে কেমন হয় দাদাজান?
ইরতাজুদ্দিন তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইলেন। শাহনা উৎসাহের সঙ্গে বলল, বাড়িতে পা দেয়ার পর থেকেই আমার মনে হচ্ছে–এখানে খুব সুন্দর একটা হাসপাতাল হয়।
আমাদের পঁচপুরুষের ভিটাকে তুই হাসপাতাল বানাতে চাস? এইসব বুদ্ধি কে মাথায় ঢুকিয়েছে? তোর বাবা?
বাবা কিছু বলেননি–যা বলার আমি নিজ থেকে বলছি।
ইরতাজুদ্দিন আহত গলায় বললেন–পূর্বপুরুষের কত স্মৃতি জড়ানো ভিটা, তার কোন মূল্য নেই তোর কাছে?
তাঁর মাথার শিরা দপদপ করছে। তিনি বুকের উপর চাপ ব্যথাও অনুভব করছেন। সূক্ষ এক আতংকও অনুভব করছেন। তার দিন শেষ হয়ে এসেছে তিনি আর অল্প কিছু দিন বাঁচবেন, তারপর এরা তার এই অসম্ভব সুন্দর বাড়িটা নিয়ে ছিনিমিনি খেলবে। মৃত্যুর আগে বাড়িটা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিলে কেমন হয়?
শাহানা লক্ষ্য করল, তার দাদাজান হাসছেন। আন্তরিকভাবেই হাসছেন। সে বলল, হাসছেন কেন দাদাজান?
ইরতাজুদ্দিন বললেন, এম্নি হাসছি।
তিনি পেঁপের বাটি হাতে নিতে নিতে বললেন, রমিজের মাকে বল তোদের পেঁপে কেটে দিতে। খুব মিষ্টি পেঁপে। আমি নিজে এত মিষ্টি পেঁপে কখনো খাইনি।
ইরতাজুদ্দিন চামচ দিয়ে পেঁপের গায়ে লেগে থাকা কালো বিচি আলাদা করছেন। বিচিগুলি পুঁতে দিলে হয়। পেঁপে গাছ ফলবতী হতে বেশি সময় লাগে না–কে জানে তিনি হয়ত এই পেঁপে খেয়ে যেতে পারেন।