ইংরেজিতে লেখা একটি চিঠি পেয়েছি। হাতের লেখা যেমন চমৎকার, ইংরেজিও খুব সুন্দর। চিঠির শেষে নাম নেই, শুরুতেই তার জন্যে পত্র লেখিকা ক্ষমা চেয়ে নিয়েছেন। নিজের পরিচয় প্রসঙ্গে বলেছেন–আমি মোটামুটি সম্মানজনক একটি চাকরি করছি। আমার বয়স ৪০। আমার আদি নিবাস বিহার প্রদেশে। মোহাজের হয়ে বাবা-মা-ভাইবোন সহ ১৯৫০ সনে তদানীন্তন পাকিস্তানের সৈয়দপুরে চলে আসি।
একটি দীর্ঘ চিঠি। ভদ্রমহিলা জানাচ্ছেন, তিনি সাপ্তাহিক বিচিত্রায় আমার এক সাক্ষাৎকারে পড়েছেন যে, আমি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে দীর্ঘ একটি উপন্যাস লেখার পরিকল্পনা নিয়েছি। তিনি চাচ্ছেন যেন সেই উপন্যাস একপেশে না হয়। যেন বিহারী মোহাজেরদের কথা লেখা হয়–যারা একটি দেশ ছেড়ে অন্য একটি দেশে এসেছিল, সেই দেশও তাদের রইল না। পাকিস্তানও তাদের দেশ নয়। এখন তারা এমন এক মানবগোষ্ঠী যাদের কোন দেশ নেই।
এই পত্ৰলেখিকা জেনেভা ক্যাম্পে তিন মাস ছিলেন। তিনি সেই তিন মাসের অভিজ্ঞতা এবং জেনেভা ক্যাম্পে আসার আগের অভিজ্ঞতা, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তাঁর এবং তাঁর পরিবারের অভিজ্ঞতা খোলাখুলি বর্ণনা করেছেন। যেই অভিজ্ঞতার কিছু কিছু অংশ ভয়াবহ। বর্ণনাতীত।
চিঠির শেষ পর্যায়ে তিনি লিখছেন–প্রিয় লেখক, আমি কিছুই আপনার কাছে গোপন করি নি। সব লিখলাম এই আশায়, যখন আপনি লিখবেন তখন আমাদের কথাও মনে রাখবেন। আপনারা একটা স্বাধীন দেশ পেয়েছেন–আমরা কি পেলাম?
চিঠিতে কোন ঠিকানা নেই বলে আমি চিঠির জবাব দিতে পারি নি। এই লেখায় জবাব দিচ্ছি। জানি না তিনি পড়বেন কি-না। না পড়লেও আমার মনের শান্তির জন্যে চিঠিটার জবাব দেয়া দরকার।
আমি ভদ্রমহিলাকে জানাচ্ছি যে, তাঁর চিঠি আমি গভীর মমতা এবং গভীর বেদনার সঙ্গে পড়েছি। যে অন্যায় তাঁর উপর এবং তাঁর পরিবারের উপর করা হয়েছে। তার জন্যে আমি এদেশের মানুষের হয়ে তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
সেই সঙ্গে তাঁকে মনে করিয়ে দিচ্ছি যে, সমগ্র জাতির উপর যখন পাকিস্তানী মিলিটারী নির্মম অত্যাচার শুরু করেছে তখন মোহাজের বিহারীদের আমরা পাশে পাই নি। তারা যোগ দিয়েছেন হানাদার বাহিনীর সঙ্গে। অথচ তাঁরা বাংলাদেশের জল-হাওয়ায় বড় হচ্ছেন। মাটি আমাদের মা। তাঁরা বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন মায়ের সঙ্গে। এই বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি তো পেতেই হবে। ভয়াবহ দুঃসময়ে সব এলোমেলো হয়ে যায়। একজনের অপরাধে দশজন নিরপরাধী শাস্তি পায়। আমরা বাঙালিরা কোন অপরাধ না করেই কঠিন শাস্তি পেলাম। তাঁরাও খানিকটা পেয়েছেন। আমাদের চরম দুঃসময়ের কথা মনে করে তাঁরা তাদের পুরানো ব্যথা ভোলার চেষ্টা করবেন–এই কামনাই করছি।
দেশ স্বাধীন হয়েছে অনেক দিন হল। পদ্মা, মেঘনায় অনেক জল প্রবাহিত হয়েছে–১৯৭১-এর স্মৃতি সেই বিপুল জলরাশি মুছে ফেলতে পারে নি। পত্রলেখিকা তাঁর জীবনের ভয়ংকর কিছু সময়ের কথা লিখেছেন–আমিও খানিকটা লিখলাম। এই লেখাটায় ঈশপের গল্পের মত শেষের দিকে একটু চমক আছে। আশা করি পত্র–লেখিকা সেই চমকটি ধরতে পারবেন এবং আমার দুঃখের তীব্রতা খানিকটা হলেও বুঝবেন–
জায়গাটার নাম গোয়ারেখা।
পিরোজপুর শহর থেকে পনেরো-ষোল মাইল দূরের অজ পাড়া গাঁ। নদীর পাশে ছোট্ট গ্রাম। নদীর নাম মনে নেই–বলেশ্বর বা রূপসা হতে পারে। নদী যেমন সুন্দর গ্রামটা তার চেয়েও সুন্দর। নারিকেল আর সুপারি গাছ দিয়ে অতি যত্নে কেউ যেন এই গ্রাম সাজিয়ে দিয়েছে। ভরা বর্ষা–থৈ থৈ করছে নদী। জ্যোৎস্না রাতে আলোর ফুল ঝরে ঝরে পড়ে। কিছু ফুল আটকে যায় গাছের পাতায়। সব মিলিয়ে পুরো ব্যাপারটা স্বপ্নদৃশ্যের মত। এই স্বপ্নদৃশ্যে আমি আমার মা এবং ভাইবোনদের নিয়ে বাস করছি। আমাদের মধ্যে কোন স্বপ্ন নেই।
মা ক্রমাগত কাঁদছেন। কারণ খবর পাওয়া গেছে, পাক মিলিটারী আমার বাবাকে হত্যা করেছে। শুধু তাই না, তারা এখন খুঁজে বেড়াচ্ছে আমাকে এবং আমার ছোট ভাই জাফর ইকবালকে। দুজনই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। দুজনই রাইফেল নিয়ে প্রচুর ছোটাছুটি করেছি। ভেবেছি, পয়েন্ট টু টু বোরের রাইফেলে মিলিটারীদের আটকে দেয়া যাবে। বাস্তবে তা হয় নি। পাক আর্মির গানবোট বিনাবাধায় পিরোজপুরের হুলারহাটে ভিড়েছে। তাদের একটি দল মার্চ করে ঢুকেছে পিরোজপুর শহরে। শুরু হয়েছে ধ্বংস এবং হত্যার উৎসব।
আমরা তখন পলাতক। প্রথমে যেখানে ছিলাম সেখান থেকে আমাদের তাড়িয়ে দিয়েছে। বিপদজনক মানুষ হিসেবে আমাদের কোথাও জায়গা হচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত আশ্রয় দিলেন গোয়ারেখার জনৈক মৌলানা। তিনি সর্ষিনার পীর সাহেবের ভক্ত খাদেম। মনেপ্রাণে পাকিস্তানী। পাকিস্তান যাতে টিকে যায় সেই দোয়া তিনি প্রতি নামাজেই করছেন। তারপরেও আমাদের আশ্রয় দিয়েছেন। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। মাকে বারবার আশ্বাস দিচ্ছেন–জোর গলায় বলছেন, কোন ভয় নাই। মিলিটারী আপনার ছেলেদের ধরতে পারবে না। উপরে আছেন আল্লাহ পাক, নিচে আমি। আমাকে গুলি না করে তারা আপনার ছেলেদের গুলি করতে পারবে না।
মা তাঁর কথায় খুব ভরসা পাচ্ছেন না। কারণ আশেপাশে মিলিটারী অপারেশন শুরু হয়ে গেছে। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে। নির্বিচার হত্যাকাণ্ড ঘটে যাচ্ছে। এইসব হত্যাকাণ্ডের খবর আবার মৌলানা সাহেব নিজেই নিয়ে আসছেন এবং আমাদের সবাইকে একত্র করে খুব উৎসাহের সঙ্গে বলছেন।
আজ কাউখালিতে বিশটা মানুষ লাইন করে দাঁড়া করেছে। ব্রাশ ফায়ার। সব শেষ।
আজ দুইটা মানুষরে খেজুর গাছে তুলে বলল–জয় বাংলা বোল। তার পরেই ডিম ডিম গুলি।
আজ কুড়াল দিয়ে এক কোপ দিয়ে হিন্দু কম্পাউন্ডারের কল্লা আলাদা করে ফেলেছে।
হত্যাকাণ্ডের বর্ণনার সময় মৌলানা সাহেবের মুখে এক ধরনের আনন্দময় আভাও দেখতে পাই। আমি কিছুতেই হিসাব মেলাতে পারি না। ভদ্রলোক নিতান্তই ভালমানুষ। তিনি শুধু যে আমাদের আশ্রয় দিয়েছেন তাই না, কয়েকজন হিন্দু যুবককেও আশ্রয় দিয়েছেন।
হিন্দুদের জন্যে তখন সব পথ বন্ধ। হিন্দু জানলেই দ্বিতীয় কোন কথা বলার সুযোগ নেই–গুলি। হিন্দু পরিবারগুলি বাড়ি-ঘর ছেড়ে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছে জঙ্গলে। বর্ষাকালের সাপ-খোপ ভর্তি জঙ্গল। দিন-রাত বৃষ্টি পড়ছে। বর্ণনার অতীত সব দৃশ্য। এরা পালিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করতেও পারছে। যেতে হবে সুন্দরবন হয়ে। নদীতে ঘুরছে মিলিটারী গানবোট। সাহায্য করবার জন্য মুক্তিবাহিনী তখনো শক্তি সঞ্চয় করে উঠতে পারে নি।
আমরা আমার নিজের দেশের অপূর্ব সুন্দর একটি গ্রামে আটকা পড়ে গেছি। পালিয়ে যেতে চাচ্ছি অন্য একটি দেশে। চারপাশে মৃত্যু ঘোরাফেরা করছে। তীব্র আতংকে কাটছে আমাদের দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী।
এই রকম সময়ে গোয়ারেখার মৌলানা সাহেব চিন্তিত মুখে মাকে বললেন, আপনার ছেলে দুটাকে সরিয়ে দেয়া দরকার। আর দেরি করা যায় না।
মা চমকে উঠে বললেন, কেন?
অবস্থা ভাল দেখতেছি না।
ভাল দেখতেছেন না কেন?
জোয়ান ছেলেপুলে সব ধরে ধরে মেরে ফেলতেছে।
ওদের কোথায় সরিয়ে দিতে চান?
এমন জায়গায় সরাব যে মিলিটারী কোন সন্ধান পাবে না।
এমন জায়গা কি আছে?
অবশ্যই আছে। ওদের রেখে আসব সর্ষিনা পীর সাহেবের মাদ্রাসায়। ওরা মাদ্রাসার হোস্টেলে থাকবে। দরকার হলে ওদের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দেব–
জামাতে ছওম ক্লাসে।
মা বললেন, আপনার হাতে আমি ছেলে দুটাকে তুলে দিলাম। আপনি যা ভাল মনে করেন …।
আমরা দুভাই লুঙ্গি-পাঞ্জাবী পরলাম। মাথায় দিলাম গোল বেতের টুপি। রওনা হলাম সর্ষিনা। যেতে হবে নৌকায়। পথ মোটেই নিরাপদ না। মিলিটারীর গানবোট চলাচল করছে। আতংকে অস্থির হয়ে যাত্রা। এই নৌকা ভ্রমণ মনে হচ্ছে। কোনদিন শেষ হবে না। ইঞ্জিনের বিজবিজ শব্দ হতেই অতি দ্রুত নৌকা কোন খাড়িতে ঢুকিয়ে অপেক্ষা করতে হয়। মাঝে মাঝে মৌলানা সাহেব বলেন, বাবারা ডাইনে তাকাবা না। আমরা ডাইনে তাকাই না, কারণ তখন ডানে গলিত মৃতদেহ ভেসে যাচ্ছে।
সর্ষিনার পীর সাহেবের আস্তানা চমৎকার। জায়গাটা নদীর তীরে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। মাদ্রাসার ছাত্রদের থাকার জন্যে বিশাল হোস্টেল। পাড়া গা মত জায়গায় বিরাট কর্মযজ্ঞ। আর হবে নাই বা কেন। পাকিস্তানের সব রাষ্ট্রপ্রধানই এখানে এসেছেন। কিছু সময় কাটিয়েছেন।
আমরা ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত হয়ে সর্ষিনা পৌঁছলাম বিকেলে। মাদ্রাসার ছাত্ররা দুধে রুটি ছিড়ে চিনি মাখিয়ে খেতে দিল। গপাগপ করে খেলাম। তাদেরকে যে মিলিটারীরা কিছুই বলছে না এ জন্যে তাদের মধ্যে আনন্দ ও উল্লাসের সীমা নেই। তাদের কাছেই জানলাম, পিরোজপুরের সঙ্গে সর্ষিনার পীর সাহেবের সরাসরি টেলিফোন যোগাযোগের ব্যবস্থা আছে। ক্যাপ্টেন সাহেব দিনের মধ্যে তিন-চার বার টেলিফোন করেন। অপারেশনে যাবার আগে পীর সাহেবের দোয়া নিয়ে যান। আমরা দুভাই মাদ্রাসায় ভর্তি হতে এসেছি শুনে তারা যথেষ্ট আনন্দ প্রকাশ করল। আমরা আমাদের পরিচয় প্রকাশ করলাম না।
সঙ্গের মৌলানা সাহেব সন্ধ্যার আগে আগে আমাদের দুজনকে পীর সাহেবের কাছে উপস্থিত করলেন। পীর সাহেব চারদিকে কিছু লোকজন নিয়ে গল্প করছেন। কাছে যাওয়ার সাহস হল না। শুনলাম, মৌলানা পীর সাহেবকে নিচু গলায় কিছু বলছেন এবং পীর সাহেব রেগে যাচ্ছেন। সব কথা বুঝতে পারছি না। পীর সাহেব বেশির ভাগ কথার জবাব দিচ্ছেন উর্দুতে। আমার বাবার প্রসঙ্গে কি কথা যেন বলা হল। পীর সাহেব বললেন, আমি এই লোকের কথা জানি। বিরাট দেশদ্রোহী। ক্যাপ্টেন সাহেবের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। যাও যাও, তুমি চলে যাও।
মৌলানা সাহেব আরো নিচু গলায় সম্ভবত আমাদের দুভাই সম্পর্কে কিছু বললেন। পীর সাহেব ভয়ংকর রেগে বললেন–না, না। এদের কেন এখানে এনেছ?
মৌলানা সাহেব আমাদের নিয়ে ফিরে চললেন। কি কথাবার্তা তাঁর হয়েছে তিনি কিছুই ভেঙে বললেন না। নৌকায় করে ফিরছি এবং প্রার্থনা করছি খুব তাড়াতাড়ি যেন চারদিক অন্ধকার হয়ে যায়। অন্ধকারে মিলিটারীরা গানবোট নিয়ে বের হয় না। ভোলা নৌকার পাটাতনে বসে আছি। ভরা জোয়ার, আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। হঠাৎ মাঝি বলল–দেহেন দেহেন। তাকালাম। দুটি মৃতদেহ ভাসতে ভাসতে যাচ্ছে। এমন কোন দৃশ্য নয় যে অবাক বিস্ময়ে দেখতে হবে। খুবই সাধারণ দৃশ্য। রোজই অসংখ্য দেহ নদীতে ভাসতে ভাসতে যায়। শকুনের পাল দেহগুলির উপর বসে বসে ঝিমোয়। নরমাংসে তাদের এখন আর রুচি নেই। কিন্তু আজকের মৃতদেহ দুটির উপর শকুন বসে নেই। আমি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। চোখ ফেরাতে পারছি না। সবুজ শার্ট গায়ে দেয়া ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বছরের একজন যুবকের মৃতদেহ। তার গলা জড়িয়ে ধরে আছে সাত আট বছরের একটি বালিকা। বালিকার হাত ভর্তি লাল কাঁচের চুড়ি। মৃত্যুর আগ মুহূর্তে হয়ত পরম নির্ভরতায় এই বালিকা তার বাবার গলা জড়িয়ে ধরে রেখেছিল।
এখন আমরা বাস করছি স্বাধীন দেশে। স্বাধীন বাংলাদেশ। এই দেশের সবচে সম্মানিত, সবচে বড় পদকটির নাম–স্বাধীনতা পদক। বঙ্গবীর আতাউল গণি ওসমানী, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, মুনীর চৌধুরী, রনদা প্রসাদ সাহা, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন এই পদক পেয়েছেন।
১৯৮০ সনে, মুক্তিযুদ্ধের ন বছর পর মহান বিজয় দিবসে রেডিও ও টেলিভিশনের খবরে শুনলাম–স্বাধীনতা পদক দেয়া হয়েছে–সর্ষিনার পীর মৌলানা আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহকে।
হায়, এই দুঃখ আমি কোথায় রাখি?