১০. আলি আলি জুলফিক্কার
সকাল আটটার মধ্যেই,–ফজরের সালাতের পর জিহাদিরা বেশি দেরি করে নি, তারা জিহাদে কখনো দেরি করে না; মাদ্ৰাছা-ই-মদিনাতুন্নবির প্রাঙ্গণ ও সামনের সড়ক কয়েক হাজার জিহাদির ‘আল্লাহু আকবর’, ‘আলি আলি জুলফিক্কার’, ‘নারায়ে তকবির’, ‘শ্যামসিদ্ধি হবে আলিগঞ্জ’, ‘শ্যামসিদ্ধির মঠ ধ্বংস করো, ধ্বংস করো’, ‘জামাঈ জিহাদে ইছলাম জিন্দাবাদ’, ‘মালাউন ও তাদের দালালদের কতল করো’, ‘মুরতাদের খতম করো’ আওয়াজে কেঁপে কেঁপে হেলে দুলে উঠতে থাকে; প্রত্যেক জিহাদির কণ্ঠ বজ্র হয়ে উঠেছে—যে-বজ্রের আওয়াজ মানুষ কখনো শোনে নি, তাদের হাত হয়ে উঠেছে খোলা তলোয়ার, যা দিয়ে একদা তারা মিসর সিন্ধু স্পেন বসরা বাগদাদ সমরকন্দ ইরান তুরান বঙ্গ বিশ্ব জয় করেছিলো, এবং আবার জয় করবে।
মোঃ আবু লাদেন ও আমার বডিগার্ডরা আমাকে ঘিরে আছে, তার গার্ডরাও আমাকে ঘিরে আছে; আমি এটাই চাই, চোখ রাখছি। আবু লাদেনের চোখমুখের ওপর, তার ঈমান খতিয়ে দেখছি। না, সে মোঃ হাফিজুদ্দিন হয়ে উঠবে না; এটা আমাকে শান্তি দেয়। আজ ফেস্টুনপ্ল্যাকার্ড আরো বেশি, ষোলোটি নিশানে বড়ো বড়ো লাল অক্ষরে লেখা হয়েছে ‘আলিগঞ্জ’, নিশানগুলো জের জবর পেশসহ মঠ পেরিয়ে আকাশে উঠে যেতে চাচ্ছে, আকাশেও আমি শত শত নিশান উড়তে দেখছি—শুনছি পাক সার জমিন সাদ বাদ।
আমার চিত্ত পুলকে সুখে শান্তিতে তেজে ভ’রে উঠছে, স্পেন বিজয়ের সময় যেমন ভ’রে উঠেছিলো তারিকের চিত্ত, মনে হচ্ছে। আমি একটি সাগর পেরিয়ে উঠবো গিয়ে আরেকটি মহাদেশে, সেটিকে জয় করবো; যদিও এখানে কোনো পাহাড় নেই, যার নাম রাখতে পারি। আমার নামে; তবে আমি ঠিক তারিক হতে চাই না, আফ্রিকার মুর মুছলমান হতে চাই না, মুসা তাকে যেভাবে নিশ্চিহ্ন করেছিলো, সেভাবে আমি লুপ্ত হতে চাই না। মুসাও আমি হ’তে চাই না, খালিদ বিন ওয়ালিদ যো-পুরস্কার দিয়েছিলো মুসাকে, তাও আমি চাই না।
আমি দূর থেকে দেখছি সবুজ শ্যামসিদ্ধি ও তার মঠটি থরথর করে কাঁপছে; কাঁপতেই হবে, ভূমিকম্পে মাটি ও পাথর না কেঁপে পারে না; আর যা ধ্বংস হবে, সে আগেই তা টের পায়; তার ভেতরে রোজকেয়ামতের খবর পৌঁছে যায়। মঠটি টের পেয়ে গেছে আজই তার শেষ দিন; তাই সেটি কাঁপছে, কাপতে কাপতে নিজেই পড়ে যেতে পারে। কিন্তু আমি বাঁকে বাকে পাখি দেখি, উড়ন্ত রঙ দেখি, রঙে রঙে আঁকা ছবি দেখি, পাখিদের সুর শুনি; অনেক বছর আগে থেকে উড়ে আসছে ওই রঙ ওই ছবি ওই সুর। আস্তাগফেরুল্লা, ছবি আমি দেখতে পারি না, ছবি দেখা কাফেরদের কর্ম।
আমি জানি এখন তিনটি মোবাইল কলকল ক’রে বেজে উঠবে, থামতে চাইবে না। ওগুলো আমি বন্ধ রেখেছিলাম, মোবাইলে আবর্জনা শুনে শুনে আমার কান পাচে গেছে; কিন্তু বন্ধ রাখলে আমার নেতারা, মোবারকবাদীরা, শুভার্থীরা, কংগ্ৰেচুলেশন্সীরা হৃদরোগে ভুগবে।
অনেকে সালাত আদায়ের কথা ভুলে বারডেম ইছলামি হাসপাতালে ছুটবে।
তাদের একটু দয়া করা দরকার, তাদের জন্যে আমি ওগুলো অন করি।
আজ ‘আলি দিবস’, আজ বদলে যাবে পুরোনো ইতিহাস, তা শূন্যতায় পরিণত হবে, তার সমস্ত পৃষ্ঠা আগুনে ছাই হয়ে যাবে, মহাকালের ইতিহাসগ্রন্থে লিখিত হবে একটি নতুন, চিরভম্বর, স্বর্ণীক্ষরে লিখিত পৃষ্ঠা। ইতিহাস, আমি জানি, কখনোই শাশ্বত নয়, চিরসত্য নয়; যে জয় করে ইতিহাস তার, ইতিহাস লেখে জয়ীর পরিচারকেরা, খোজা ভৃত্যরা; আমার খোজা ভৃত্যরাও নতুন ইতিহাস লিখবো। আমি শিহরণ উত্তেজনা পুলক বোধ করি, যেমন প্ৰথম ঘোড়ায় চড়ে সিন্ধুর উদ্দেশ্যে বেরোনোর সময় শিহরণ বোধ করেছিলেন মুহম্মদ বিন কাশিম। তবে আমি বিজয়ের পর বিন কাশিমের মতো লুপ্ত হতে চাই না, আমি চাই না কেউ আমাকে পুরস্কার দেয়ার নাম করে ডেকে নিয়ে বেহেশতে পাঠিয়ে দিক, আপতত আমি বেহেশতের থেকে পৃথিবীর জাহান্নামই পছন্দ করি; আমি অজস্র রুঞ্জিন পাখির ওড়াওড়ি দেখি, আর একটি স্বৰ্ণলতা দেখি। কোনো কিছুই চিরকাল চিরউন্নত থাকতে পারে না, তার শীর্ষ যতোই উঁচু হোক, একদিন তাকে ভেঙে পড়তে হয়; আমি সুখ পাই এক সময়ের ঘাসফুল আমি, অত্যন্ত ছোট্ট, একটু লাল একটু হলদে, কিছুক্ষণ পর ধ্বংস করবো তাকে, যে আমার থেকে অনেক বৃহৎ ছিলো।
বৃহৎকে যে ধ্বংস করে সে হয় বৃহত্তর, মহৎকে যে ধ্বংস করে সে হয় মহত্তর। আমি বৃহত্তর হতে চাই, মহত্তর হতে চাই; আমার রক্ত বলছে, ‘তুমি বৃহত্তর হও, মহত্তর হও।’ ধ্বংস না করে আমি বৃহত্তর মহত্তর হতে পারি না। ধবংস আমাকে করতেই হবে।
সবাই প্রস্তুত; আমার জিহাদিরা, ক্ষৌরকারেরা, গোলন্দাজেরা, পদাতিকেরা, এবং বিস্ফোরকবিদেরা। আমিও প্ৰস্তুত। আমি আমার ‘গোলাপ-ই-সাহারা’য় গিয়ে একবার সালাত আদায় করতে চাই; কিন্তু মোবাইল, ও মোবাইল, ও মোবাইল। নাছারারা এটি আবিষ্কার করেছে আমাকে পাগল করার জন্যে।
আমি পাগল হতে থাকি, একটির পর একটি মোবাইল আমাকে পাগল করতে থাকে :
‘আইজ হইছে তোমার শ্ৰেষ্ঠ দিন, তুমি মালাউনগো মঠ ধ্বংস কর, যেমুন লাত মানৎ উজ্জার মূর্তি ধ্বংস করা হইছিল, তোমার দিকে আমরা চাইয়া রাইছি, আমাগো সারা দুনিয়ার ভাইরা চাইয়া রইছে।’
‘তোমার উপর আল্লার রহমত রাইছে, তুমি কাইল আমাগো আগাই দিছ, আইজ আরও আগাই দিবা, তুমি এইখানে পাক স্তান কায়েম করবা, ইনশাল্লা, আমরা আবার পাক সার জমিন সাদ বাদ গামু।’
‘কাফেরগো, মালাউনগো ওই মন্ড পাক স্তানে থাকব না, মড হইল শির্ক, ওইখানে অটব মছজিদ। আল্লা হাফেজ।‘
‘অ্যাডভান্স কংগ্ৰেচুলেশন্স ফর ইউ অ্যান্ড ইউর জিহাদিস, ইউর হোলি ওয়ারিয়ারস, ডেস্ট্রয় দ্যাট ব্লাডি মঠ, দ্যাট টেম্পল অব দি বাস্টার্ডস, অ্যাজ আওয়ার ফোর ফাদারাস ডেস্ট্রয়ড আলেকজান্দ্ৰিয়া, অ্যান্ড দি টেম্পলস ইন স্পেইন, ইন মহেনজোদারো, ইন ইন্ডিয়া। ইউ আর আওয়ার তারিক, আওয়ার ইখতিয়ারউদ্দিন খিলজি, আইচ্ছা আইখানে ইজ দেয়ার এনি হিল, অই মিন এনি পাহাড় লাইক জাবালুক্তারিক?’
‘হোয়াট এ পিটি, উই উইল বিন্ড এ হিল দেয়ার, ইফ ন্যাছেছারি উই উইল ইমপোর্ট এ হিল ফ্রম পাকিস্থান অর আফগানিস্থান, অ্যান্ড নেইম ইট আফটার ইউ, প্লিজ ডু কাম টু মাই প্যালেস টুমরো।’
উই মাস্ট মেইক ইট এ পাক স্তান, ওই শালা মালাউনডার গানডা বন্দ করতে আইব, মাই গোল্ডেন বেঙ্গল অই ফাক ইউ, গোল্ডেন বেঙ্গল, হা হা হা, সেইখানে আমরা সিং করবো পাক সার জমিন সাদ বাদ। হোয়াট এ গ্রেট সং, রিটেন বাই এ পারফেক্ট মুছলমান। কি জানি তার নাম, ডু ইউ রিমেমবার?’
আমি বলি, ‘আব্দুল হাফিজ জলন্ধরি।‘
‘তার বাড়িডা জানি কই আছিল?’
আমি বলি, ‘কাশ্মিরের জলন্ধর।’
‘দ্যাট ইজ হোয়াই সে এই পাক সংড়া লিকতে পারছে, উই শ্যাল মেইক হিম আওয়ার ন্যাশনাল পয়েট।‘
‘বাই দি ওয়ে সে কবে জেন নবেল প্ৰাইজ পাইছিল?’
আমি বলি, ‘পায় নি।’
‘হোয়াট? নবেল প্ৰাইজ সে ডিড নট গেট? ইট মাস্ট বি এ কন্সপিরেছি। অব দি জিয়ানিস্টস; নাউ, তারে একটা নবেল প্ৰাইজ আইন্যা দিতে হবে, উই উইল অ্যাওয়ার্ড হিম এ নবেল পুরুস্কার, ইটস মানি মাস্ট বি ওয়ান বিলিয়ন।’
‘স্যার, এ নিউ আলি আকসা উইল বি দেয়ার, আওয়ার ব্যাংক হ্যাজ স্যাংশন্ড থ্রি ক্রোরস অব টাকাস ফর দিস পারপাস, ইফ নেছেছারি উই উইল স্যাংশন থ্রি ক্রোরস মোউর; আওয়ার গার্ডিয়ান্স ইন অ্যারাবিয়া ওয়ান্ট ইট, একটা আল আকসা বানাইতেই হইব, ইউ ইউরসেল্ফ উইল রিছিভ ওয়ান মিলিয়ন ডলারস।’
‘কতল অ্যাণ্ড কিল অ্যান্ড স্লটার দি মালাউন্স অ্যান্ড দেয়ার দালালস। উই নিড এ পাক জমিন, এপাক ওয়াতান, উই লাইক টু সিং এ পাক সং— পাক সার জমিন সাদ বাদ। ক্যান ইউ প্লিজ টেল মি হোয়াট ইজ দি নেক্সট লাইন? অই ওয়ান্ট টু গেট দি হোউল সং বাই হার্ট।’
‘আওয়ার মেইন পাটিও তোমার দিকে চাইয়া আছে, আমার ডর হইতেছে তারা না আবার তোমারে মিনিস্টার কইর্যা লইয়া যায়, তয় আল্লায় তোমারে আমাগো জামাঈ জিহাদে ইছলামের জইন্যে সৃষ্টি করছেন, তোমার ওপর আল্লার রহমত আছে, আমরা তোমার দিকে চাইয়া রইছি, মিনিস্টার হইতে তোমার দেরি নাই, আমিই তোমারে বড় মিনিস্টার বানামু।’
‘দুই চাইরডারে এমুন রকমে কতল করবা যাতে কেউর বোঝানের সাইদ্য না থাকে, যেমুন কালউকা করছ। ডর ঢুকাইয়া দিবা যাইতে মালাউনরা দ্যাশ ছাইরা যায়, হেরা থাকলে দ্যাশে ইছলাম থাকব না।’
‘জিহাদিগো ছহবত করতে দিও যখন তাহাদের খায়েশ হয়, জিহাদে বন্দী আওরতের লগে ছহবতে গুনাহ্ নাই। গনিমতের মাল ভোগ করনের নিয়ম আছে। মাজেমইদ্যে ছহবত না করলে কুয়ৎ থাকে না।’
‘আমার বয়স নাই, নাইলে গনিমতের মাল আমিও দুই একটা তোমার কেছে চাইতাম, কুলুপ নিতে গিয়া ক্যান যে অইডায় ইনফেকশন অইল।’
‘আচ্ছালামুয়ালাইকুম ইয়া রহমাতুল্লা বরকত হু। ইউ মে নট নো মি, বাট অই নো ইউ অ্যাজ আওয়ার গ্রেট লিডার, অই এম এ মিনিস্টার, অই হেইট দিস ব্লাডি মেইন পার্টি লেড বাই এ মাইয়ালোক, আই শ্যাল জয়েন জামাঈ জিহাদে ইছলাম সুন। উইশ ইউ অল সাকসেস, আল্লা রাহমানির রাহিম ইজ উইথ ইউ, পাক সার জমিন সাদ বাদ।’
‘স্যার, অই এম দি ভিছি অব ছিছিইউ, আমি কনছিডার ইউ গ্রেটার দ্যান ইখতিয়ারউদ্দিন বিন বখতিয়ার খিলজি অ্যান্ড মুহম্মদ বিন কাশিম, রাববুল আলামিন উইল লুক আফটার ইউ, অই প্রে ফর ইউ, আল্লা দি রাহমানির রাহিম হ্যাঁজ সেন্ট ইউ টু ডেলিভার আস ফ্রম দি হ্যাঁন্ডস অব দি মালাউনস অ্যান্ড দেয়ার মুরতাদ দালালস, উই ওয়ান্ট আওয়ার পাক স্তান ব্যাক৷’
‘হেই দোস্ত, কবি আল মুদাব্বির কইতে আছি, তরে লইয়া একটা কবিতা ল্যাকাছি, এককালে ল্যাকতাম শ্রেণীসংগ্রামের কবতে, এখন লেখি সত্যের কবতে, পরম সত্যের বয়াত, আরও লিখুম :
হিরার নুরের দিকে আমাদের যে নিয়ে যাচ্ছে দিন দিন,
তার নামে কোন পাহাড়ের নাম রাখবো আমরা?
হে মরদ, হে রুস্তম, আমার ছালাম লও,
তোমার পবিত্র পাক নামে রাখবো আমরা
হিমালয় কাঞ্চনজংঘার নাম।
দুনিয়ার সব পাহাড় পর্বত দরিয়া তোমার
নামে পরিচিত হবে, তুমি ঘুচাইতেছ আমাগো লানত,
আবাবিল পক্ষি ওড়ে তোমার সহিত
তাদের চঞ্চুতে আল্লার পাথর;
তুমি ঈমানদারদের দাও হিরার জোছনা, কামর ও সুরুজ।’
তারপর আবার পাগলি হয়ে উঠতে থাকে আমার তিনটি পাগল মোবাইল :
‘স্পিকিং ফ্রম কালিফরনিয়া…’
‘স্পিকিং ফ্রম সুইডেন…’
‘স্পিকিং ফ্রম মালয়েশিয়া…’
‘স্পিকিং ফ্রম ইন্দোনেশিয়া…’
‘রিয়াদ থিকা বলতেছি…’
‘করাচি থিকা বলতেছি…’
‘ইসলামাবাদ থিকা বলতেছি…’
‘লন্ডন থিকা বলতেছি…’
‘দিনাজপুর থিকা বলতেছি…’, ‘চাটগাও থিকা বলতেছি।…’, ‘ছিলেট থিকা‘বলতেছি…’, ‘লালমনিরহাট থিকা বলতেছি…’, ‘মাইজদি থিকা বলতেছি…’, ‘চরমনাই থিকা বলতেছি…’, ‘বলতেছি’, ‘বলতেছি’, ‘বলতেছি’, ‘বলতেছি’, ‘বলতেছি’, ‘বলতেছি’, ‘বলতেছি’, ‘বলতেছি’, ‘বলতেছি’, ‘বলতেছি’, ‘বলতেছি’, ‘স্পিকিং’, ‘স্পিকিং’, ‘স্পিকিং’, ’স্পিকিং’, ‘স্পিকিং’, ‘স্পিকিং’, ‘স্পিকিং’, ‘স্পিকিং’, ‘স্পিকিং’, ‘স্পিকিং’, ‘স্পিকিং’, ‘স্পিকিং’, ‘কংগ্রেচুলেশন্স’, ‘মোবারকাবাদ’, ‘কংগ্ৰেচুলেশন্স’, ‘মোবারকবাদ’, ‘কংগ্ৰেচুলেশন্স’, ‘মোবারকাবাদ’, ‘কংগ্ৰেচুলেশন্স’, ‘মোবারকবাদ’, ‘কংগ্ৰেচুলেশন্স’, ‘মোবারকবাদ’, ‘কংগ্ৰেচুলেশন্স’, ‘মোবারকবাদ’, ‘কংগ্ৰেচুলেশন্স’, ‘মোবারকবাদ’, ‘কংগ্রেচুলেশন্স’, ‘মোবারকবাদ’, ‘মারহাবা, মারহাবা’, ‘কংগ্ৰেচুলেশন্স’, ‘মোবারকবাদ’, …
আমি পাগল হয়ে উঠতে থাকি, কিন্তু পাগল না হ’লে কে মহাপুরুষ হয়?
একটি ফোন কি আমাকে ভুলে গেছে?
না কি এই স্পিকিং আর বলতেছির নিচে কতল হয়ে গেছে?
আমিই ফোন করি, ধরেই সে বলে, ‘হুজুর, আমি বিবিজান বলছি, আপনের মোবাইগুলির কি সব দশ মাসের পেট হইয়া রইছে? টিপতে টিপতে আমার আঙ্গুল ব্যাদনা অইয়া গেছে, আপনে না টিপ্পা দিলে আমার আঙ্গুল ভাল আইব না, আমার হাত দুইডা আহনই টিপ্পা দ্যান হুজুর।’
আমি বলি, ‘ওইগুলোকে খালাস করতে পারছিলাম না।’
কণকলতা বলে, ‘হুজুর, আমি মডটার দিকে চাইয়া আপনের লগে কতা কইতে আছি, আপনে কি সত্যই আইজ মডটা গুরাইয়া হালাইবেন?’
আমি বলি, ‘হ্যাঁ, মঠটিও চায় আমি তাকে গুড়িয়ে ফেলি।’
কণকলতা বলে, ‘এর থিকা হুজুর আপনে আমারে গুরাই হালান।’
আমি বলি, ‘দরকার হ’লে তাও করবো।’
কণকলতা বলে, ‘পারবেন, হুজুর?’
আমি বলি, ‘সময় এলে দেখা যাবে।’
কণকলতা বলে, ‘আইজই গুরাইয়া হালাইয়া মডটারে বাচাই দ্যান, হুজুর।’
আমি বলি, ‘তোমাকে গুড়ো করবো ঠোঁট দিয়ে, সেগুলো হবে সোনার গুঁড়ো, কণকচুৰ্ণ, রাখবে আমার হৃদয়ে।’
কণকলতা চুমো খেতে থাকে, আর মোবাইল হুজুরের মতো দৃঢ় হয়ে ওঠে, কাঁপতে থাকে, আমি সহ্য করতে পারি না।
কণকলতা বলে, ‘হুজুর, আপনের হুজুররে চুমা খাইলাম, হুজুর কি গাইল্যা পরছে? না হুজুরের আরো লাগবো? তাইলে আর পাচখান চুমা দেই।’
আমি বলি, ‘সন্ধ্যার পর গাড়ি পাঠাবো, চ’লে এসো। একটি তাঁতের শাড়ি পরে এসো, কণকলতার মতো তাঁতের শাড়ি।’
কণকলতা বলে, ‘আইচ্ছা, হুজুর।’
‘আল্লাহু আকবর’, ‘আলি আলি জুলফিক্কার’, ‘নারায় তকবির’, শ্যামসিদ্ধি হবে আলিগঞ্জ’, ‘শ্যামসিদ্ধির মঠ ধ্বংস করো, ধ্বংস করো’, ‘জামাঈ জিহাদে ইছলাম জিন্দাবাদ’, ‘মালাউন ও তাদের দালালদের কতল করো’, ‘জাহেলিদের কতল করো’ আওয়াজ তুলে আমরা কয়েক হাজার জিহাদি শ্যামসিদ্ধির দিকে এগোতে থাকি। জিহাদিদের হাতে ‘আলিগঞ্জ’-এর নিশান উড়ছে, নিশানে চানতারা ঝলমল করছে, আরবিতে ‘আল্লাহু আকবর’-এর নিশান উড়ছে।
এই নিশান দেখলেই দিল পবিত্র হয়ে ওঠে; কোনো নিশানে সূৰ্য দেখলে আমি সহ্য করতে পারি না, লাল সূর্য হচ্ছে কাফেরদের, বাঁকা চানতারা হচ্ছে ঈমানদারদের। সবাই আমরা জিহাদি, সবাই আমরা অস্ত্ৰসজ্জিত–বিচিত্র রকমের অস্ত্ৰ, যদিও তা দেখা যাচ্ছে না, দরকারের সময় দেখা দেবে ও কাজ শুরু করবে, কাজের কোনো শেষ থাকবে না।
দূর থেকে আমি মঠটি দেখতে পাচ্ছি, মনে হচ্ছে ভয়ে মঠটি এখনই জিহাদিদের পায়ে লুটিয়ে কাঁদবে, বা ‘লাই লাহ’ বলে উঠবে; এবং আমি একটি কাতর কান্নাও শুনতে পাই, ‘এর থিকা আমারে বলি দিয়া দ্যান, হুজুর’; ওটা কিছু না, বলি দেয়ার দরকার হলে দেবো, কিন্তু ওই কাফেরি মঠ ওখানে থাকতে পারবে না। অনেক বছর ছিলো, এখন তার ধ্বংসের সময় এসেছে; খুব বেশি উঁচু হয়ে দাঁড়িয়েছিলো, এখন তাকে খুব নিচু হ’তে হবে, তাকে পুরোপুরি শূন্যতা হতে হবে। ওখানে একটি আল আকসা উঠবে।
একটি সেক্রেটারি ওখানে একটি পাহাড় বিল্ড করার কথা বলেছে।
ওই শ্যালকদের মগজ অত্যন্ত উর্বর, খাঁটি গোবরের মতো, কী চমৎকার প্ৰকল্প তার মাথায় এসেছে, যা আমার মাথায় কখনো আসতো না। আমরা যখন দেশকে স্তান করে তুলবো, দিকে দেকে যখন সবাই গাইবে পাক সার জমিন, তখন ওই বাঞ্চস্তকে বহনফাকারকে মাদারফ্যাকারকে একটা বড়ো প্রমোশন দিতে হবে; বাঞ্চিতটাকে না হয় আমারই সেক্রেটারি করে নেবো। ও ভালো চাকর হবে, চুষতে বললে চুষবে।
আমি দূর থেকে মঠটিকে দেখছি।
আশ্চৰ্য, ওটি এখনো দাঁড়িয়ে আছে, আমাদের ভয় পাচ্ছে না বেতমিজটি। তাতে আমার রাগ হয়; ইচ্ছে হয় ওর বুকে একটা ছুরি ঢুকিয়ে দিই, ওকে বলি দিই। তবে ছুরি বা তলোয়ারে কাজ হবে না, আমাদের বিস্ফোরকবিদদের লাগবে, তারা তাদের প্রতিভায় ধবংস করবে। কাফেরদের প্রতিভা।
পেটমোটা চাকরানিফাকার অসিটা একবার সালাম দিয়ে গেলো কয়েকটা দারোগা নিয়ে, রাস্কেল ইউএনওটাও ফোন করে মোবারক বাদ জানিয়েছে, ডগপুশার ডিসিটাও; তারপরও মঠটি দাঁড়িয়ে আছে!
শ্যামসিদ্ধি ঢুকতেই প্ৰথম দেখি এটি একটি শূন্য গ্রাম, আমাদের মেইন পার্টির কিছু খিলজি ছাড়া কেউ নেই, তারা মালাউন ও মালাউনদের দালালদের গরু বাছুর হাঁস ছাগল মুরগি নিজেদের গোয়ালে নিয়ে তুলছে; ঘরবাড়ি ভাঙা বা ওগুলোতে এখনো পেট্রোল ঢালতে শুরু করে নি। কারণ এই দিনটি আমাদের, এটা আমাদের মহত্ত্বের দিন; খিলজিরা এরা মেনে নিয়েছে, ওদের দিনে যেমন ওরা জয় করে, তেমনি আমাদের দিনে আমরা জয় করি; কেউ কারো জয়ের ওপর হাত দিই না।
তবে এখন খিলজিদের সময়, ওরাই বেশি জয় করছে, ওরাই বেশি ছহবত করছে; ওরাই ঘরবাড়ি বেশি ভরে তুলছে; একদিন ওদেরগুলোও হবে আমাদের। জিহাদিরা ঘুরে দেখে কেউ নেই, ছহবত করার মতো একটি বুড়িও নেই, একটা গেলমানও নেই; আগে বুঝতে পারলে কয়েক দিন আগে থেকেই গ্রামটিকে জিহাদিদের দিয়ে ঘিরে রাখতাম।
জয়ের পর, নতুন সৃষ্টির পর, ছহবত হচ্ছে বেহেশতের রহমত।
জিহাদিরা কয়েকটি ভাঙা ঘরে আগুন লাগায়; আগুন ভালো জ্বলে না।
আমি নিজে শান্তির ঠাণ্ডা আগুন পছন্দ করি।
আমি তাদের বলে দিয়েছি আগুন লাগিয়ে স্তানের সম্পদ নষ্ট করবে না, আর দূর থেকে ষড়যন্ত্রকারীরা তার ছবিও তুলতে পারে, এক-আধটি পত্রিকা তা ছাপতেও পারে; আর বাঞ্চত ওয়েবসাইট ইন্টারনেটের যুগে–আস্তাগফেরুল্লা, এইগুলিও নাছারাদের চক্রান্ত–ওই সব ছবি আজই ইহুদিদের, মালাউনদের, দেশে পৌঁছে যেতে পারে।
যা করতে হবে, তা হচ্ছে তালা ভেঙে ঢুকতে হবে, ঘরবাড়িগুলো দখল করতে হবে, আলিগঞ্জে কোনো মালাউন ও দালাল থাকবে না। জিহাদিরা দখলের কাজ ভালোই করতে পারে, তাদের রক্তে রয়েছে দখলের প্রতিভা; নইলে আরব থেকে আফ্রিকা, হিন্দুস্থান থেকে ইন্দোনেশিয়া আমরা দখল করতে পারতাম না; একদিন এই প্রতিভার গুণেই আমরা ছোট্ট এই পৃথিবীটা দখল করবো, পারলে চানতারাও দখল করবো, পারবো ইনশাল্লা।
দখলি জিহাদির দখল করতে থাকে, আর জিহাদি বৈজ্ঞানিকেরা মঠের চারদিকে তার প্যাচাতে থাকে, বিস্ফোরকের ভূপ সাজাতে থাকে, ডাইনামাইট, গ্রেনেড পাততে থাকে, একশো জিহাদি মঠ বেয়ে ওপরে উঠে গিয়ে রিমোট কন্ট্রোল বোমা স্তরে স্তরে গাথকে থাকে। ওদের প্রতিভা আমাকে মুগ্ধ করে, আমি পিস্তল কাটা রাইফেল রিভলবার ছাড়া আর কিছু চালাতে জানি না, ক্ষুরও না; বোমা বানাতে শিখি নি, একবার শিখতে গিয়ে বিস্ফোরণে আমার প্রধান ও দুই তিন নম্বরের কয়েকজন ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিলো, আল্লা আমাকে বাঁচিয়েছিলেন, তাই তো আমি সর্বহারা ছেড়ে জামাঈ জেহাদে আসতে পেরেছি। জিহাদিদের কুয়ৎ ও চেহারা দুটিই আমাকে মুগ্ধ করে–কুয়তে তারা সবাই সমান, চেহারায় বিপরীত। একদল জিহাদির মুখমণ্ডল সুরমা আঁকা, মুখগুলো শান্তিতে ভরা ভরা, দাড়িগুলো কালো মসৃণ রেশম দিয়ে তৈরি, কথা বলে ফেরেশতার কণ্ঠস্বরে; আরেক দলের চোখ ভেতরে ঢুকে গেছে, সেখানে সব সময় আগুন জ্বলে, তাদের গাল ভাঙা, দাড়িগুলো লোহার জালের মতো, কথা বলে ঘর্ঘর করে।
তবে কাজে, ক্ষৌরকর্মে, আগুন জ্বালানোতে, বোমা নিক্ষেপে, আর শরাবে ও ছহবতে দু-দলই সমান দক্ষ: এক বোতল শরাবের পরও ফজরের সালাতের কথা ভোলে না, সারারাত ছহবতের পরও টলে না। তারা মঠে মহৎ কাজ করছে, আওয়াজ তুলছে আল্লাহু আকবর’, ‘আলি আলি জুলফিকার’, ‘নারায়ে তকবির’, ‘শ্যামসিদ্ধি হবে আলিগঞ্জ’, ‘শ্যামসিদ্ধির মঠ ধ্বংস করো, ধ্বংস করো’, ‘জামাঈ জিহাদে ইছলাম জিন্দাবাদ’, ‘মালাউন ও দালালদের কতল করো’, ‘জাহেলিদের করল করো’, ‘মুর্তাদদের কতল করো’; আর আমি দেখি ঝাঁকে ঝাঁকে লাল নীল খয়েরি হলদে সবুজ পাখি মঠের কোটির থেকে উড়ে যাচ্ছে, আবার এসে বসতে চাচ্ছে; অনেকগুলো বাচ্চা দিয়েছে, বাচাগুলো উড়তে পারছে না, চিৎকার করছে, অনেকগুলো গড়িয়ে নিচে প’ড়ে গেলো, পাখির রঙ আর রোদনে চারদিক সুন্দর ও সঙ্গীতমুখর হয়ে উঠতে থাকে। কে যেনো বলেছিলো আমাদের সবচেয়ে দুঃখের ভাবনাগুলোই সবচেয়ে মধুর সঙ্গীত; পাখিগুলোর ওড়াউড়ি ও মধুর রোদন শুনে এটা আমি প্রথম বুঝতে পারি, এবং হঠাৎ শুনতে পাই, ‘হুজুর, এর থিকা আমারে ভাগ দিয়ে দ্যান।’
পাখিগুলো আর মঠটির জন্যে হঠাৎ আমার কষ্ট হয়, মঠটিকে আমিও আর দেখতে পাবো না; যদি আমি আবার বালক হয়ে যাই, ঘাসফুল হয়ে যাই, বিকেলে যদি মঠটিকে আমার দেখতে ইচ্ছে করে, এক মাইল দৌড়ে এসে যদি দেখি মঠটি নেই, তাহলে কি আমার বুক ফেটে কান্না আসবে না? আমি কি চোখে অন্ধকার দেখবো না? আমি কি শূন্যতায় হারিয়ে যাবো না? আমার কি বাড়িতে ফিরতে ইচ্ছে হবে? একবার আমি ‘লা হাওলা’ পড়ি, হয়তো শয়তান আমার ওপর ভর করেছে, তাই আমি মঠ দেখছি, ভবিষ্যৎ আল আকসা দেখছি না। একবার আমার মহান নেতাকে মনে পড়ে, যিনি বায়তুল মোকাররমের দিকে তর্জানি নির্দেশ করে, অনেককক্ষণ স্তব্ধ থেকে, উচ্চারণ করেছিলেন মহাবাণী’চ্ছিল-না’, তিনিই সেটিকে ‘চ্ছিল’ করেছিলেন; আমিও কি তাঁকে, মহান নেতাকে, অনুসরণ করবো?
মঠটিকে না ভেঙে এটিকে মসজিদ বানিয়ে এর মাথার ওপরের ত্রিশুলটিকে ফেলে দিয়ে উড়িয়ে দেবো ‘আল্লাহু আকবর’ নিশানটি?
না, তা আমি পারি না; এটা উঁচু, কিন্তু এর ভূমিতে বেশি জায়গা নেই, দশজনও সালাত আদায় করতে পারবে না; এর নিয়তি হচ্ছে ধ্বংস হওয়া। রাহমানির রাহিম যাকে ধ্বংস করতে চান, তাকে আমি রক্ষা করতে পারি না। কিন্তু এর আগে এটিকে আমি এতো কাছে থেকে দেখি নি, দূর থেকে এটাকে স্বপ্ন মনে হতো, কাছে থেকে তা মনে হচ্ছে না; এর ধ্বংস অনিবাৰ্য।
মোবাইল বেজে ওঠে, ‘হুজুর, আমি মডটার দিকে চাইয়া আছি, আপনে কি আমাকে দ্যাকতে পাইতেছেন?’
আমি বলি, ‘না, অতো দূর দেখা যায় না।’
কণকলতা বলে, ‘দূরে থিকাও আমি আপনেরে দেখতে পাইতেছি, মড়টার থিকাও আপনেরে উচা লাগতেছে।’
আমি বলি, ‘তুমি ভুল দেখছো।‘
কণকলতা বলে, ‘ভুল দেখছি না, হুজুর, আপনে আমার বুকের ভিতর শ্যামসিদ্ধির মডের থিকাও উচা, তাই আপনেরে দেখতে পাইতেছি, আমি যুদি আপনের বুকে অই রকম উচা থাকতাম, তাইলে আপনেও আমারে দেখতে পাইতেন, আমি ত আপনের রাইভের জিনিশ।’
আমি বলি, ‘তুমি আমার সব সময়ের।’
কণকলতা বলে, ‘হাচা কইতেছেন, হুজুর? কন, হুজুর, হাচা কইতেছেন?’
আমি বলি, ‘হ্যাঁ।‘
কণকলতা বলে, ‘তাইলে আর অইডা খামু না।‘
আমি বলি, ‘কী খাবে না?’
কণকলতা বলে, ‘হুজুর, পাচ পুরিন্দা বিষ আইন্যা রাকিছিলাম, মনে করছিলাম যহন মডটা ভাইঙ্গা পরব, তখন খামু; আমি যুদি আপনের সব সোমের অই, তাইলে আর খামু না।’
আমি বলি, ‘কণকলতা, তুমি আমার জীবনলতা, মনে রেখো।’
কণকলতা বলে, ‘তাইলে দুনিয়ার সব মড ধ্বংস আইলেও আমি বিষ খামু না, হুজুর, আমি আপনের কেছে আহুম।’
আমি বলি, ‘সন্ধ্যার পর পাজেরো যাবে, তুমি তাঁতের শাড়ি পরে আসবে, এক কৌটো সিঁদুর নিয়ে এসো।’
কণকলতা বলে, ‘আইচ্ছা, হুজুর, আমি আপনের পায়ে পইর্যা রইলাম।’