দশম পরিচ্ছেদ
আপনি তর্কে জিততে পারবেন না
যুদ্ধের ঠিক পরেই লন্ডন শহরে এক রাতে আমি মহামূল্যবান একটা শিক্ষালাভ করেছিলাম। সে সময় আমি স্যার রস স্মিথের ম্যানেজার ছিলাম। যুদ্ধের সময় স্যার রস প্যালেষ্টাইনে অস্ট্রেলিয়ার একজন দক্ষ বৈমানিক ছিলেন। তারপর যুদ্ধ থেমে যাওয়ার ঠিক পরেই, পৃথিবীর প্রায় অর্ধেকটা মাত্র ত্রিশ দিনে উড়ে এসে তিনি সবাইকে তাজ্জব করে দেন। এরকম কাজ করার কথা আগে প্রায় কেউ ভাবেইনি। ব্যাপারটা দারুণ উত্তেজনা জাগিয়েছিল। অস্ট্রেলিয়া সরকার তাঁকে পঞ্চাশ হাজার ডলার পুরস্কার দেন আর ইংল্যাণ্ডের রাজা তাঁকে নাইট উপাধি দান করেন। বেশ কিছুদিন তিনি ইউনিয়ন জ্যাকের নিচে সবচেয়ে আলোচিত মানুষ হয়ে ওঠেন। তিনি হয়ে ওঠেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের চার্লস লিণ্ডবার্গ। আমি এক রাতে স্যার রসের সম্মানে দেওয়া এক অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলম। নৈশভোজ চলার সময় আমার ঠিক পাশেই যে ভদ্রলোক বসেছিলেন তিনি একটা গল্প শোনালেন আমায়। তাতে একটা উদ্ধৃতি ছিল।
ভদ্রলোক বললেন কথাটা বাইবেলে আছে। তাঁর ভুলই হয়েছিল। এটা আমি ভালো করেই জানতাম, একেবারে নিশ্চিত এতে কোন সন্দেহই ছিল না। অতএব নিজেকে খুব জ্ঞানী গুণী প্রমাণ করার জন্য আমি একটা ব্যাপার করলাম। আমি তার ভুল ধরানোর চেষ্টা করলাম। তিনি নিজের কথাতেই আঁকড়ে রইলেন। কি? শেক্সপীয়ার থেকে? অসম্ভব! অসম্ভব! এটা নিশ্চয়ই বাইবেলের। এটা তার জানা আছে!
ভদ্রলোক আমার ডানদিকে বসেছিলেন। আমার বাঁ পাশে ছিলেন আমার একজন পুরনো বন্ধু, মিঃ ফ্রাঙ্ক গ্যামণ্ড। মিঃ গ্যামও বহু বছর ধরে শেক্সপিয়রকে নিয়ে গবেষণা করে আসছেন। অতএব সেই ভদ্রলোক আর আমি দুজনেই মি. গ্যামন্ডকেই সাক্ষী মানতে রাজি হলাম। মি. গ্যামন্ড সব শুনে যাওয়ার পর টেবিলের তলা দিয়ে আমার পায়ে ধাক্কা মারলেন, তারপর বললেন : ‘ডেল, তুমিই ভুল করছ। ভদ্রলোকের কথাই ঠিক। এটা বাইবেলেই আছে।’
সেই রাতে বাড়ি ফেরার সময় আমি গ্যামণ্ডকে বললাম : ‘ফ্রাঙ্ক, তুমি জানতে ওই উদ্ধৃতিটা শেক্সপীয়ার থেকে নেওয়া।’
তিনি জবাব দিলেন, হ্যাঁ, জানতাম বইকি, ‘হ্যামলেটের পঞ্চর পর্ব দ্বিতীয় দৃশ্য। কিন্তু প্রিয় ডেল আমরা একটা আনন্দ অনুষ্ঠানের অতিথি। লোকটি যে ভুল বলছে কেন তা প্রমাণ করব? তাতে কি তিনি তোমায় পছন্দ করতেন? তাঁর মুখ রক্ষা করতে দেওয়াই উচিত, তাই না? সে তোমার কোন মতামত চায়নি, তাহলে তাঁর সঙ্গে তর্কের দরকার কি? সব সময় বাঁকা পথ এড়িয়ে চলবে।
‘সব সময় বাঁকা পথ এড়িয়ে চলবে।’ কথাটা যিনি বলেছিলেন তিনি আজ আর বেঁচে নেই। কিন্তু যে শিক্ষা তাঁর কাছ থেকে পেয়েছি তা আজও ভুলিনি।
এরকম একটা শিক্ষা আমার দরকার ছিল কারণ আমি প্রায়ই এরকম তর্ক করতাম। ছেলেবেলায় আমার ভাইয়ের সঙ্গে নানা রকম তর্ক করতাম। যখন কলেজে ভর্তি হলাম, তখন আমার একটা বিষয় ছিল তর্কশাস্ত্র। অতএব তর্ক করতে আমার ভালই লাগত, তাই বিতর্ক সভাতেও যোগ দিতাম। আমার জন্ম হয় মিসৌরীতে। আমি পরে তর্ক নিয়ে পড়াই। বলতে লজ্জা করছে এ নিয়ে আমার একটা বই লেখার ইচ্ছেও ছিল। তখন থেকেই আমি কথাবার্তা শুনেছি, সমালোচনা করেছি আর হাজার হাজার মানুষের উপর তার প্রতিক্রিয়াও লক্ষ্য করেছি। তার ফলশ্রুতিতে আমি এটাই উপলব্ধি করেছি যে তর্ক থেকে সবসেরা যে ফল লাভ করা যায় তা হল সেটা এড়িয়ে চলা। তাই তর্ক ব্যাপারটা বিষধর সাপ বা ভূমিকম্পের মত এড়িয়ে চলাই শ্রেয়।
দশ বারের মধ্যে নবারই কোন তর্কের শেষ পরিণতিতে দুপক্ষই আরও জোরের সঙ্গে ভেবে নেয় তাদের কথাটাই ঠিক।
আপনি তর্কে কখনই জিততে পারবেন না। পারবেন না তার কারণ হল আপনি হেরে গেলে তো হেরেই গেলেন কিন্তু আপনি জিতলেও হারবেন। সেটা কিভাবে? আপনি যদি প্রমাণ করেন কারও কথা ষোল আনাই ভুল তাতেই বা কি হবে? আপনার দারুণ ভাল লাগবে। কিন্তু অপর লোকটার কি রকম হবে? তাকে আপনি ছোট প্রমাণিত করেছেন। আপনি তাঁর অহমিকায় আঘাত করেছেন। সে আপনার ওই জয় মেনে নেবে না। তাছাড়া একটা কবিতাতেই বলা আছে–
কোন ব্যক্তিকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু মেনে নিতে বাধ্য করলেও সে তার মত পাল্টায় না।
পেন মিউচুয়াল বীমা প্রতিষ্ঠান তাদের বিক্রেতাদের জন্য একটা বিশেষ নীতি ঠিক করে দিয়েছে—’কখনও তর্ক করবেন না।’
সত্যিকার বিক্রেতার কাজ কিন্তু তর্ক করা নয়। তর্কের কাছাকাছিও নয়। তর্ক করে মানুষের মন বদলান যায় না।
একটা উদাহরণ দিচ্ছি। বেশ কবছর আগে একজন তার্কিক আইরিশ আমার ক্লাসে যোগ দেয়, নাম প্যাট্রিক জে, ওহেয়ার। তার লেখাপড়া তেমন ছিল না বটে তবে তর্ক করতে সে বেশ ভালোবাসতো! একসময় সে শোফারের কাজ করতো, সে আমার কাছে এসেছিল এই জন্য যে, সে কিছুট্রাক বিক্রির চেষ্টা করছিল। কথায় কথায় প্রকাশ পেল যে, সে যাদের কাছে ট্রাক বিক্রির চেষ্টা করছিল তাদের সে প্রায় তর্ক করে ওর শত্রু বানিয়ে ফেলেছিল। কেউ যদি তার ট্রাকের কোন নিন্দে করতো তাহলেও ক্ষেপে গিয়ে তার প্রায় গলা টিপতে বাকি রাখত। সে আমায় পরে বলেছে কোন অফিস ছেড়ে আসার সময় ও বলত : ‘ব্যাটাকে আচ্ছা করে কথা শুনিয়ে দিয়েছি, তবে কিছু বিক্রি করতে পারিনি।’
আমার প্রাথমিক সমস্যা অবশ্য প্যাট্রিককে কথা বলানো ছিল না। আমার প্রথম কাজ হল তার কথা বলানো বন্ধ করে তর্ক এড়িয়ে চলার উপদেশ দান।
মিঃ ওহেয়ার এখন নিউ ইয়র্কের হোয়াইট মোটর কোম্পানির একজন সেরা বিক্রেতা। কি করে এটা করলেন তিনি? তাঁর নিজের কথাতেই শুনুন : আমি কোন প্রতিষ্ঠানে গিয়ে যদি শুনি; কি? সাদা ট্রাক? ওগুলো একটুও ভাল না। বিশ পয়সায় দিলেও নেব না। আমরা অমুক কোম্পানীর লরী কিনব। আমি তার জবাব দিতাম : ভাই একটু শুনুন। ওই ট্রাক সত্যিই ভাল। ওটা কিনলে ভুল করবেন না। ওই কোম্পানীর লোকেরাও চমৎকার।
‘ভদ্রলোক প্রায় বোবা হয়ে যেতেন, তাঁর তর্ক করার আর সুযোগ থাকত না। তিনি যাদের ট্রাক সেরা বললেন আমি সেটাই সমর্থন করলাম। আর তর্ক করার সত্যিই কোন অবকাশ রাখিনি। আমি অপরের জিনিসকেই সেরা ব্যাখ্যা দিয়েছিলাম।
‘আগে কিন্তু এরকম ব্যাপার ঘটতই না, আমি ক্ষেপে উঠতাম, আর তর্ক জুড়ে দিতাম। অন্য কোম্পানীর নিন্দাও করতাম।
‘পুরনো দিনের কথা যখন ভাবি তখন মনে হয় কিভাবে সব বিক্রি করতে পারলাম। তর্ক করতে গিয়েই তো কত বছর অপব্যয় করেছি। এখন আমি মুখ বন্ধ রাখি। তাতে কাজ হয়।
জ্ঞানী বুড়ো বেনজামিন ফ্রাঙ্কলিন যেমন বলতেন :
‘প্রতিবাদ, তর্ক ইত্যাদি করলে মাঝে মাঝে জয় হয় বটে–সে জয় বিরাট শূন্যতায় ভরা, তাতে অপরের হৃদয় পাওয়া যায় না কখনও।’
অতএব হিসেবটা নিজেই করে দেখুন আপনি কোটা চান : সাধারণভাবে নাটকীয় কোন জয় না মানুষের শুভেচ্ছা? দুটো একসঙ্গে কদাচিতই মেলে।
বোস্টন ট্রান্সকিপ্টে একবার একটি কবিতা ছাপা হয়। কবিতাটির মর্মার্থ এই রকম।
‘এখানে সমাধিস্থ রয়েছেন উইলিয়াম জে, যিনি তাঁর পথ চলার অধিকার বজায় রাখতে গিয়ে মারা যান। তিনি নির্ভুল কাজ করেছিলেন-মৃত্যুর মতই নির্ভুল-তবু তিনি মৃত, যেন ভুলই করেছিলেন।‘
.
আপনি হয়তো ঠিক, একদম ঠিক থাকবেন তর্কের পথে চলতে গিয়ে। তবে অপর ব্যক্তির মন নিয়ে কথা বললে সেটা হয়তো একেবারেই নিরর্থক হবে।
প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনের অর্থ সচিব উইলিয়াম জি ম্যাকাড়ু একবার বলেন যে রাজনীতিতে তাঁর দীর্ঘকালের অভিজ্ঞতায় তিনি দেখেছেন কোন অজ্ঞকে কোনভাবেই তর্ক করে হারানো যায় না।
‘কোন অজ্ঞকে? আপনি খুব নরম করেই বলেছেন মিঃ ম্যাকাণ্ডু। আমার অভিজ্ঞতা হলো–যে কোন লোককেই–তার বুদ্ধির মান যাই হোক না কেন–তর্ক করে হারানো যায় না।
যেমন ধরুন ফ্রেডারিক এস, পার্সন নামে আয়করের একজন অভিজ্ঞ মানুষ একবার একঘন্টা ধরে সরকারী কোন পরিদর্শকের সঙ্গে তর্ক করছিলেন। প্রায় ন’ হাজার ডলার এতে জড়িত ছিল। মিঃ পার্সন বোঝাতে চাইছিলেন ওই ন’ হাজার ডলার তার দেবার কথা নয়–কারণ এ টাকা তিনি পাননি আর পাবেনও না অতএব সেটা কর হিসেবে ধরা হবে কেন?
‘পাওয়া যাবে না! বাজেকথা। এ টাকা দিতেই হবে!’ পরিদর্শকও তর্ক জুড়লেন।
ভদ্রলোকটি বেশ ঠাণ্ডা মাথার এবং কড়া প্রকৃতিরই লোক ছিলেন; অহঙ্কারী মি. পার্সন ঘটনাটির কথা আমার ক্লাসে বলেছিলেন। তাই যুক্তির ব্যাপার যতই বলি কাজে আসবে না…যতই তর্ক করবো ততই উনি একগুঁয়ে হয়ে উঠবেন। আমি তাই ঠিক করলাম বিষয়বস্তু পরিবর্তন করে ওর প্রশংসা করব।
আমি তাই বললাম, আমরা তুচ্ছ ব্যাপারেই তর্ক করছি। বরং আপনাকে অনেক জরুরী কাজ করতে হবে। কঠিন কাজও বটে। আমি নিজে করের ব্যাপারে নিয়ে পড়াশোনা করেছি, বইতেও পেয়েছি। অথচ আপনি সরাসরি কাজের থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। মাঝে মাঝে ভাবি আপনার মত কাজ পেলে করতাম, তাতে অনেক শিখতে পারতাম। আন্তরিকতার সঙ্গেই কথাগুলো বললাম।
‘পরিদর্শক তাঁর চেয়ারে সোজা হয়ে বসলেন। ঝুঁকে পড়ে তাঁর কাজ সম্পর্কে আমায় অনেক কথা শোনালেন। কত রকম জালিয়াতি দেখেছেন তাও জানালেন। আস্তে আস্তে তার গলার স্বর বন্ধুত্বপূর্ণ হয়ে এলো। তিনি এবার তাঁর ছেলেমেয়েদের কথাও বললেন। যাওয়ার সময় তিনি বলে গেলেন আমার সমস্যা নিয়ে ভেবে চিন্তে তাঁর মতামত কদিন পরে জানাবেন।
‘তিনি তিনদিন পরে আমাকে এসে জানালেন আমার আয়করের রিটার্ন যেমন দিয়েছি তাই মেনে নিচ্ছেন।’
এই আয়কর পরিদর্শক যা করেছেন সেটা সাধারণ মানুষের দুর্বলতা অনুযায়ীই করেছেন। তিনি চাইছিলেন নিজের গুরুত্ব বোঝাতে। যতক্ষণ মি. পার্সন তর্ক করেছেন ততক্ষণ তিনিও ছাড়েননি নিজের গুরুত্ব বোঝাতে। কিন্তু যখনই তার গুরুত্ব মেনে নেওয়া হলো, তর্কেরও শেষ হল, আর তিনি সন্তুষ্ট হয়ে সহৃদয়ভাবে কথা বলতে লাগলেন।
সম্রাট নেপোলিয়নের প্রধান ভূত্য কনস্টান্ট প্রায়ই জোসেফাইনের সঙ্গে বিলিয়ার্ড খেলত। সে তার লেখা ‘নেপোলিয়নের’ ব্যক্তিগত জীবনীতে লিখে গেছে যে, সে ওই খেলায় দক্ষ হলেও ইচ্ছে করেই জোসেফাইনের কাছে হার স্বীকার করতো। আর তাতে জোসেফাইন আনন্দ পেতেন।
.
আসুন, আমরা কনস্টান্টের কাছ থেকে একটা ধারাবাহিক শিক্ষা নিই। আমাদের খরিদ্দার, প্রেয়সী আর স্বামী এবং স্ত্রীদের কাছে এবার থেকে ছোটোখাটো সমস্ত ব্যাপারে হার স্বীকার করি।
বুদ্ধ বলেছিলেন : ‘ঘৃণাকে কখনও ঘৃণা দিয়ে জয় করা যায় না, যায় ভালোবাসা দিয়ে।‘ এইরকম ভাবে ভুল বোঝাবুঝিও তর্কের মধ্য দিয়ে সমাধান হতে পারে না বরং সেটা হতে পারে কূটনীতি, আলোচনা আর সহানুভূতি দিয়ে অন্যের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে।
লিঙ্কন একবার একজন তরুণ সামরিক অফিসারকে তার সহকর্মীর সঙ্গে প্রচণ্ড তর্ক করার জন্য তীব্র ভর্ৎসনা করেছিলেন। লিঙ্কন বলেছিলেন : ‘যে মানুষ নিজের উন্নতির চেষ্টা করতে ইচ্ছুক তার ব্যক্তিগতভাবে কখনও ঝগড়া করার সময় থাকে না। যে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না বা মাথা গরম করে ফেলে তার পক্ষে উন্নতি করা আর ও কঠিন। কোন কুকুরের কামড় খাওয়ার চাইতে তাকে পথ ছেড়ে দেওয়াই ভালো। কারণ কুকুরটাকে মেরে ফেললেও তার কামড় তো আর ফিরিয়ে দেওয়া যাবে না।
অতএব এক নম্বর নীতি হলো :
তর্কে জেতার সব সেরা উপায় হল তর্ক না করা।