১০. আপনি একা থাকেন

আপনি একা থাকেন?

না। এইত এখন আপনি আছেন। আপনাকে নিয়ে দুজন।

আখলাক সাহেব হাসলেন। ভদ্রলোকের দাঁত সুন্দর। টুথপেস্টের বিজ্ঞাপনের মত না হলেও সুন্দর। যারা খুব সিগারেট খায় তাদের দাঁত এত পরিষ্কার থাকে না। হলুদ ছোপ পড়ে— স্ম্যোকারস টিথ। আখলাক সাহেব খুব সিগারেট খান। দশ মিনিটও হয় নি শুভ্র এ বাড়িতে এসেছে। এর মধ্যেই আখলাক সাহেব তিনটা সিগারেট শেষ করে চতুর্থ সিগারেট ধরাচ্ছেন। তাঁর দাঁত এত পরিষ্কার থাকার কথা না।

শুভ্ৰ আমার বাড়িটা কেমন?

খুব সুন্দর। আপনি যদি কখনো বাড়ি বানান তাহলে কি এরকম একটা বাড়ি বানাবেন?

না।

বাড়িটা যদি খুব সুন্দর হয়ে থাকে তাহলে এমন বাড়ি বানাবেন না কেন?

শুভ্র বলল, বাড়িটা অচেনা লাগছে।

আখলাক সাহেব বললেন, কিছুদিন বাস করলে কি চেনা লাগবে না?

না লাগবে না। যে বাড়ি প্রথমদিন অচেনা লাগে সেই বাড়ি শেষ দিনও অচেনা লাগে।

আখলাক সাহেব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে শুভ্রর দিকে তাকিয়ে ছিলেন। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে সহজ গলায় বললেন, আপনার কথা ঠিক। পেতলের ঘণ্টায় আপনি বাড়ি দিলেন। একটা শব্দ হল। প্ৰথম বাড়িতে যে শব্দটা হবে, শেষবাড়িতেও একই শব্দ হবে।

শুভ্র বলল, আমি কি অনেক আগে চলে এসেছি?

আখলাক সাহেব বললেন, না, আপনি ঠিক সময়মতই এসেছেন। আমি একেকজনকে একেক সময়ে আসতে বলেছি।

পার্টি শুরু হবে কখন?

পার্টি শুরু হয়ে গেছে। যেই মুহুর্তে আপনি কলিং বেলে হাত দিলেন, পার্টি শুরু হয়ে গেল। আপনাকে সবার আগে আসতে বলেছি কারণ আপনার সঙ্গে আমি বেশি সময় কাটাতে চাই।

পার্টিতে কারা আসবেন?

অনেকেই আসবেন। একজন দুজন ছাড়া আপনি কাউকে চেনেন বলে মনে হয় না। এটাই মজার। কেউ কাউকে চেনে না, আবার সবাই সবাইকে চেনে। আচ্ছা শুভ্ৰ আপনি কি পাঁচ মিনিট একা একা বসে থাকতে পারবেন?

পারব।

আমি গত তিনদিন ধরে মেশকাত নামের একজনকে ধরার চেষ্টা করছি। তাকে পার্টিতে হাজির করতে পারলে দারুণ ব্যাপার হবে। মেশকাত ভবিষ্যৎ বলতে পারে। একটা মোবাইল নাম্বার কিছুক্ষণ আগে পেয়েছি, চেষ্টা করে দেখি। আপনি বরং কফি খান। কফি পটে কফি আছে। আমি বানিয়ে দেব?

না আমি বানিয়ে নেব। You take your time.

আখলাক সাহেব দোতলায় উঠে গেলেন। বাড়িটা ড়ুপ্লেক্স টাইপ। একতলা দোতলা মিলিয়ে থাকার ব্যবস্থা। একতলায় রান্নাঘর এবং হলঘরের মত বড় একটা বসার ঘর। বসার ঘর জাপানি কায়দায় সাজানো। সোফা নেই- কার্পেট এবং কার্পেটের উপর নানান ধরনের বাহারি গদি। দেয়ালে কিছু পেইনটিং আছে– সবই জাপানি ছবি। চেরী ফুল ফুটেছে। জাপানি ললনা কিমানো পরে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের ছোট ছোট চোখে রাজ্যের বিস্ময়! পাতলা ঠোঁটে রহস্যময় হাসি।

বসার ঘরের সঙ্গেই খাবার ঘর। খাবার ঘরটা তুলনামূলকভাবে ছোট। ঘরের মাঝখানে বড় একটা ডাইনিং টেবিল। ডাইনিং টেবিলের সঙ্গে কোনো চেয়ার নেই। টেবিল ভর্তি স্নেকস জাতীয় খাবার, পটেটো চিপস, পনীর, শুকনো মাংস, নানান ধরনের ভাজ্যভুজি। ডাইনিং রুমের দেয়ালে দামি ফ্রেমে একটাই ছবি। যে কারণে চট করে ছবির দিকে চোখ যায়। ছবিটা জয়নুল আবেদিনের দুর্ভিক্ষের ছবি। ডাষ্টিবিনে মানুষ এবং কুকুর একসঙ্গে খাবার খুঁজছে। খাবার ঘরে এ রকম একটা ছবি ঝুলিয়ে রাখার পেছনে আখলাক সাহেবের নিশ্চয়ই কোনো উদ্দেশ্য আছে। ভদ্রলোক উদ্দেশ্যহীন কোনো কাজ করেন বলে মনে হয় না। কিংবা হয়ত উদ্দেশ্যহীনভাবেই সব কাজ করেন। অথচ মনে হয় কাজটার পেছনে কোনো উদেশ্য আছে!

বাড়িটা বেশ বড় হলেও লোকজন নেই। এপ্রন পরা একটি মেয়েকে রান্নাঘরে দেখা যাচ্ছে। মেয়েটা আখলাক সাহেবের কোন আত্মীয়া না কাজের মেয়ে তা শুভ্র ঠিক বুঝতে পারছে না। মেয়েটা দেখতে সুন্দর। চেহারায় মায়া ভাব অত্যন্ত প্রবল। শুভ্রর সঙ্গে একবার মেয়েটির চোখচুখি হল। মেয়েটি ভুরু কুঁচকে এমনভাবে তাকাল যার অর্থ – এই যে ভদ্রলোক! আপনি এভাবে আমাকে দেখছেন কেন? আমি আমার কাজ করছি। আপনি আপনার কাজ করুন। শুভ্ৰ লজ্জা পেয়ে কফির মগ হাতে বসার ঘরে চলে এল।

শুভ্র।

শুভ্ৰ তাকালো। আখলাক সাহেব ঘরে ঢুকেছেন। ভদ্রলোক এর মধ্যেই পোশাক বদলেছেন। কালো প্যান্টের উপর লাল টকটকে হাফ শার্ট। হাফ শার্টের উপর সামার কোটের মত কোট। সামার কোটি পরার মত গরম নেই। কিন্তু ভদ্রলোককে সুন্দর লাগছে। লাল রঙের শার্টটা না পরলে তাঁকে এত সুন্দর লগত বলে মনে হয় না।

শুভ্র আপনার ভাগ্যটা খুব ভাল। মেশকাতকে পাওয়া গেছে।

আমার শুভাগ্য ভাল বলছেন কেন? তিনি কি বিশেষ করে আমার ভাগ্য বলার জন্যেই আসছেন?

উনি সবার ভাগ্য বলবেন। তাকে নিয়ে কড়াকড়ি পড়ে যাবে। পার্টি জমানোর জন্যে এ রকম দুএকজন মানুষ দরকার।

উনি কি সত্যি ভাগ্য বলতে পারেন?

আরে দূর। ভাগ্য কোথেকে বলবো? তবে যা বলে খুবই বিশ্বাসযোগ্যভাবে বলে। শুনলেই বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে। মজাটা এই খানেই। একজন অন্ধ মানুষ। সাদা চুল, সাদা দাড়ি। ঋষি ঋষি চেহারা। গলার স্বরও অদ্ভুত। সব কিছু মিলিয়ে একটা রহস্য তৈরি হয়। রহস্যের কারণে সে কথা বললেই শুনতে ইচ্ছা করে।

পার্টি জমানোর জন্যে আপনি সব সময় এরকম কিছু মানুষ রাখেন?

হ্যাঁ রাখি। রাখতে হয়। ময়মনসিংহ অঞ্চলে বিয়ের কথাবার্তা অনুষ্ঠানে কিছু লোক ভাড়া করে আনা হয়। তাদের কাজ হচ্ছে গল্পগুজব করে আসর জমিয়ে দেয়া। এদের নাম— আলাপী। কাজেই দেখতে পাচ্ছেন পার্টি জমানোর ব্যাপারটা আমাদের কালচারেরই অংশ।

শুভ্ৰ হাসল। আখলাক সাহেব বললেন, আমি একা থাকি। আমার জন্যে পার্টি খুব দরকার। প্রচুর লোকজন, প্রচুর হৈচৈ। পার্টি যখন খুব জমে। তখন আমি আবারো একা হয়ে যাই। জনতার মধ্যেই আছে নির্জনতা। সেই নির্জনত রকম। আমার খুব পছন্দের নির্জনতা।

আখলাক সাহেব ঘড়ি দেখলেন। শুভ্ৰ বলল, আপনার লোকজন কখন আসবে?

দেরি আছে! আচ্ছা শুভ্ৰ আমিতো বয়সে অনেক বড়। আমি তোমাকে তুমি করে বলি?

বলুন। প্রথম যেদিন আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছিল সেদিনও শুরুতে আপনি আপনি করে বললেন পরে তুমিতে চলে গেলেন।

তাহলে তো ঠিকই আছে। তাহলে তুমি শুরু করা যাক। কেমন আছ শুভ্ৰ?

ভাল।

তোমাকে অনেক আগে আসতে বলেছি কেন আন্দাজ করতে পার?

জ্বি না। আমার অনুমান শক্তি ভাল না।

তোমাকে মীরা সম্পর্কে দুএকটা কথা জিজ্ঞেস করার জন্যেই আরো আগে আসতে বলেছি। তুমি ইচ্ছা করলে জবাব দিতে পার। আবার নাও দিতে পার। প্রশ্নগুলি করব?

জ্বি করুন।

প্রথম প্রশ্ন, তুমি কি মীরাকে বিয়ে করছ?

শুভ্ৰ খুবই অবাক হয়ে বলল, এই প্রশ্নটি করার কারণ কী?

কারণ হচ্ছে মীরাকে আমার দিকে আকৃষ্ট করার জন্যে আমি নানান ধরনের কায়দা কানুন করছি। কোনোটিই তেমন কাজ করছে না বলে আমার ধারণা হয়েছে সম্ভবত তুমি সূত্রধর।

সূত্রধর মানে?

সূত্রধর মানে, মীরার সুতা অনেকখানি তোমার হাতে। তুমি সুতা নাড়ছ বলে সে নড়ছে।

আপনার এরকম মনে করার কোনো কারণ নেই। কারোর সুতাই আমার হাতে নেই। এমন কি আমার নিজেরটাও না।

এটাতো ভালই বলেছ।

আর কিছু জিজ্ঞেস করবেন?

না। আমার প্রশ্নের জবাব সহজভাবে দেবার জন্যে ধন্যবাদ। এখন তুমি যদি কোনো প্রশ্ন করতে চাও করতে পার।

আমি কোনো প্রশ্ন করতে চাচ্ছি না। এবং পার্টিতেও থাকতে চাচ্ছি না। যে জন্যে আমাকে ডেকেছিলেন সেটা তো হয়েছে। আমাকেতো আর দরকার নেই।

খুব দরকার আছে। আমাকে মীরা একটি দায়িত্ব দিয়েছে, সেই দায়িত্ব এখনো পালন করতে পারি নি। পার্টি জমে উঠলে সেই দায়িত্ব পালন করব। কাজেই তোমাকে থাকতে হবে।

কলিং বেল বাজছে। আখলাক সাহেব বললেন, মীরা এসেছে। বলেই তিনি শুভ্রর দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার নিম্ন ধরনের কিছু আধ্যাত্মিক ক্ষমতা আছে। বেলের শব্দ শুনে কে বেল টিপছে তা ধলে দিতে পারা হচ্ছে তার একটি। শুভ্ৰ তুমি কি আমার হয়ে দরজাটা খুলবে? মীরা দরজা খুলেই তোমাকে দেখে খুব খুশি হব এই জন্যে বলছি। I want to make her happy.

শুভ্র দরজা খুলল, মীরা আসে নি মোটাসোটা এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। হাতে দুটা শপিং ব্যাগ। শুভ্ৰ তাকাল আখলাক সাহেবের দিকে। তিনি হাসছেন। তাঁর আধ্যাত্মিক ক্ষমতা কাজ করে নি দেখে মনে হচ্ছে তিনি খুশি।

পার্টি জমে উঠেছে। শুভ্র গুণে দেখেছে সব মিলিয়ে মোট আঠারো জন মানুষ। আঠারো জনের মধ্যে মীরাকে নিয়ে সাতজন মেয়ে। এই সাতজনের মধ্যে দুজনের বয়স খুবই কম। কিছুতেই সতেরো আঠারোর বেশি না। একজন মহিলার বয়স পঞ্চাশের উপরে। ইনি খুবই হাসি খুশি। সারাক্ষণ হাসছেন। গায়ে হাত না দিয়ে তিনি মনে হয় কথা বলতে পারেন না; যার সঙ্গে কথা বলছেন তারই হাত ধরে বা কাঁধে হাত রেখে কথা বলছেন; শুভ্ৰর সঙ্গেও তার কথা হল। শুভ্রের পিঠে হাত রেখে বললেন, এক্সকিউজ মি। আপনার নাম শুভ্ৰ না?

জ্বি।

আপনার সঙ্গে আগে কখনো দেখা হয় নি কেন? এই বাড়ির পার্টিতে যারা আসেন তাদের সবার সঙ্গেই আমার পরিচয়। আমার নাম এলা।

 

আমার যখন ত্ৰিশ বছর বয়স তখন আমার স্বামী মারা যান। তারপর আর বিয়ে করি নি। কারণ আমার কাছে মনে হয়েছে অভিজ্ঞতার জন্যে একটা মেয়ের একটি পুরুষই যথেষ্ট। একটা পুরুষকে চেনা মানে সব পুরুষকে চেনা।

সবাই এক রকম?

অবশ্যই। আপনার পরিচয়টা বলুন।

আমার কোনো পরিচয় নেই। আমার নাম শুভ্ৰ। নামতো আপনি এর মধ্যেই জেনেছেন। মীরার সঙ্গে আমি এ বছর পাশ করেছি।

তাহলে তো তোমাকে কিছুতেই আপনি বলা যায় না। মীরা আমাকে রাগাবার জন্যে গ্রান্ড মা ডাকে। ইচ্ছা করলে তুমিও গ্রান্ড মা ডাকতে পার। ভাল কথা, আখলাকের পার্টিতে যারা আসে তাদের সবারই কোনো-না-কোনো স্পেশালিটি থাকে। তোমার স্পেশালিটি কী?

আমার কোনো স্পেশালিটি নেই।

অবশ্যই আছে। যাই হোক যদি কিছু থাকে তাহলে জানা যাবে। দোষ এবং গুণ দুটার কোনোটাই মানুষ লুকিয়ে রাখতে পারে না।

আপনার স্পেশালিটি কী?

আমার স্পেশালিটি হচ্ছে। আমি আখলাকের খালা। আখলাকের অনেক আত্মীয়স্বজনের মধ্যে একমাত্র আত্মীয় যে আখলাককে পছন্দ করে। আখলাক কোনো পার্টি দিয়েছে সেখানে আমি নেই তা কখনো হয় নি।

ও আচ্ছা।

আমাকে দেখে মনে হচ্ছে না আমি মদ্যপান করি, নানান রকম হুল্লোর করি? তা কিন্তু না। আমি মদ্যপান করি না। স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে এক ওয়াক্তও নামাজ কাজ হয় নি। তোমার সঙ্গে পরে আবারো কথা হবে।

জ্বি আচ্ছা।

তুমি চুপচাপ বসে আছ কেন? সবার সঙ্গে গল্প গুজব করা। আজকের পার্টির স্পেশাল ফিচার কী তুমি জান?

জানি না।

আমিও জানি না। আখলাক বলেছে স্পেশাল ফিচার রাত দশটার দিকে বলবে। এতক্ষণ আমি থাকতে পারব না। আমার এক কাজিন আসছে, তাকে রিসিভ করতে হবে।

উনার পার্টিতে কি সবসময় কোনো স্পেশাল কিছু থাকে?

হ্যাঁ থাকে। এবং প্রতিবারই আখলাক আমাকে আগে ভাগে বলে শুধু আজ কিছু বলছে না। স্পেশাল ফিচার না জেনে চলে গেলে মনে খুঁতখুঁতানি থাকবে।

আপনি টেলিফোন করে জেনে নেবেন।

টেলিফোন তো ও ধরবে না। তুমি বোধহয় আখলাককে চেন না। আখলাক বাসায় কখনো টেলিফোন ধরে না। যত ইমার্জেন্সিই হোক ও টেলিফোন ধরবে না।

এলা এগিয়ে গেলেন। তিনি যাচ্ছেন। মীরার দিকে। শুভ্রর ধারণা তিনি মীরার কাছে যাচ্ছেন কারণ মীরার কাছ থেকে তথ্য সংগ্ৰহ করবেন। শুভ্ৰ বিষয়ক তথ্য। একদল মানুষ আছেন তথ্য সংগ্রহেই যাদের আনন্দ। ভ্রমর ফুল থেকে মধু সংগ্ৰহ করে চাক ভর্তি করে। এরা সংগ্রহ করেন তথ্য।

 

অন্ধ মেশকাত সাহেব জমিয়ে বসেছেন। পার্টির মূল কেন্দ্ৰবিন্দু মনে হচ্ছে তিনি। ধবধবে সাদা পায়জামা পাঞ্জাবিতে তাকে ঋষি ঋষি লাগছে। পায়জামা পাঞ্জাবির মত তার চুল দাড়ি সবই সাদা। তিনি একটা পাতলা চাঁদর মাথার উপর দিয়ে রেখেছেন। অন্ধ মানুষ সাধারণত সানগ্লাস পরে চোখ ঢেকে রাখে। তাঁর চোখ খোলা। অন্ধদের চোখের মণি খুব একটা নড়াচড়া করে না। প্রয়োজন নেই বলেই নড়াচড়া করে না। যে-কোনো একটি দিকে দৃষ্টি স্থির হয়ে থাকে। এই ভদ্রলোকের দৃষ্টি সে রকম না। সাধারণ মানুষের মত তাঁর দৃষ্টি এদিক ওদিক ঘুরছে। দৃষ্টিহীনের চোখের অস্বাভাবিকতা তার চোখে নেই।

ব্যাপার কী ঘটছে দেখার জন্যে শুভ্ৰ এগিয়ে গেল। মেশকাত সাহেবের সামনে এক ভদ্রলোক কর্পেটে হাঁটু গেড়ে বসে আছেন। ভরিক্কী শরীরের মানুষ। চেয়ারে বসতে অভ্যস্ত বলে কার্পেটে বসে ঠিক আরাম পাচ্ছেন না। তার চোখে মুখে এক ধরনের শঙ্কার ভাব। ডেন্টিসের কাছে রোগী গেলে যেমন হয় তেমন।

মেশকাত সাহেব সামান্য বুকে এসে বললেন, জনাব আপনার নাম?

আমার নাম সাজ্জাদ। সাজ্জাদ হোসেন।

দেখি জনাব আপনার হাতটা।

ভদ্রলোক হাত বাড়িয়ে দিলেন। মেশকাত সেই হাত ধরলেন। অন্ধের হাতড়ে হাতড়ে ধরা না; সরাসরি ধরা। মেশকাত সাহেব হাত ধরেই ছেড়ে দিয়ে বললেন, এই হাত না জনাব। ডান হাত।

সাজ্জাদ সাহেব অপ্ৰস্তুত গলায় বললেন, সরি। আমি লেফট হ্যান্ডেড বলে সব সময় বাঁ হাত এগিয়ে দেই।

তিনি ডান হাত বাড়ালেন। এবার মেশকাত সাহেব হাত ধরলেন না; বাড়িয়ে রাখা ডান হাতের উল্টো পিঠে আতর মাখিয়ে দিলেন।

জনাব আতরের গন্ধটা কেমন বলুন তো?

আতরের গন্ধ যে রকম হয়। সে রকম। কড়া গন্ধ।

এই আতরের নাম মেশকাতে আম্বর।

সাজ্জাদ সাহেব একটু নড়েচড়ে বসে বললেন, এখন আমার সম্পর্কে কিছু কলুন।

কী বলব?

এই ধরুন আমার স্বভাব চরিত্র এই সব।

আপনার স্বভাব চরিত্রতো আপনি সবচে ভাল জানেন। আমি নতুন করে কী বলব?

আচ্ছা ঠিক আছে আমার অতীত সম্পর্কে কিছু বলুন।

আপনার অতীতও তো আপনি জানেন। এমনতো না যে আপনার অতীত আপনি জানেন না।

আমি জানলেও আপনার কাছ থেকে শুনি। আপনার ক্ষমতা সম্পর্কে অনেক শুনেছি। পরীক্ষা হয়ে যাক।

জনাব আমিতো পরীক্ষা দেবার জন্যে আসি নাই। আমি ছাত্র না, আর আপনারাও শিক্ষক না।

পাশের একজন বললেন, এ রকম করছেন কেন। দুএকটা কথা বলুন আমরা শুনে মজা পাই। ফর ফানস সেক।

একটু পরে বলি?

না না এখনি বলুন।

দেখি আপনার ডান হাতটা আরেকবার।

সাজ্জাদ সাহেব ডান হাত বাড়ালেন। মেশকাত দুহাতে ডান হাত ধরে চোখ বন্ধ করে কিছু সময় স্থির হয়ে থাকলেন।

আপনার ছেলে মেয়ে কী?

দুই মেয়ে।

ছোট মেয়েটির নাম কী?

সীমা।

সীমা কোন ক্লাসে পড়ে?

সে এ বছর ইন্টারমিডিয়েট দেবে।

সীমা কেমন আছে?

ভাল।

কেমন ভুল?

এ বয়সের মেয়েরা যতটা ভাল থাকে ততটা ভাল। গান শুনছে। হৈচৈ করছে। কলেজে যাচ্ছে।

সে কি গতকাল কলেজে গিয়েছিল?

আমার পক্ষেতো মেয়ে রোজ রোজ কলেজে যাচ্ছে কি যাচ্ছে না। সেই খোঁজ নেয়া সম্ভব না। হয়ত গিয়েছে।

সেতে গত কয়েকদিন ধরেই বিছানায় পড়ে আছে। তার তো বিছানা থেকে নামার শক্তি নেই।

কী বলছেন আপনি? আমার নিজের মেয়ে অসুস্থ আর আমি জানব না!

আপনি জানবেন না কেন আপনি জানেন। খুব ভাল করেই জানেন। এখন না জানার ভান করছেন।

সাজ্জাদ সাহেব বিস্মিত এবং খানিকটা ভীত চোখে তাকাচ্ছেন। শুভ্রের কাছে মনে হচ্ছে মেশকাত নামের অন্ধ মানুষটি পুরো পরিস্থিতি তার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে। তার সামনে বসা সবাইকে খানিকটা অসহায় লাগছে। মেশকাত গম্ভীর স্বরে বললেন, সাজ্জাদ সাহেব! আপনার সঙ্গে টেলিফোন আছে না। মোবাইল টেলিফোন।

জ্বি।

সেই টেলিফোনে মেয়ের সঙ্গে কথা বলেন না কেন? কথা বলে তারপর আমাদের জানান—সে কেমন আছে?

আমি তার দরকার দেখি না; আমার মেয়ে কেমন আছে, না আছে সেটা আমার ব্যাপার। You have no business there.

আমিও আপনাকে শুরুতে তাই বলছিলাম। আপনি মানুষটা কেমন? আপনার অতীত কী? তা আপনার ব্যাপার। সেই নিজের ব্যাপার অন্যের কাছ থেকে জানতে চাওয়া ঠিক না।

সাজ্জাদ সাহেব উঠে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর মুখ থমথম করছে। মনে হচ্ছে তিনি পার্টি ছেড়ে চলে যাবেন। শুভ্ৰ লক্ষ করল দূর থেকে আখলাক সাহেব পুরো ব্যাপারটা দেখছেন। তার ঠোঁটের কোণায় অস্পষ্ট হাসির রেখা। আখলাক সাহেবব এগিয়ে এসে বললেন, যাদের গলা শুকিয়ে গেছে তারা প্রয়োজন বোধ করলে গলা ভেজাতে পারেন। মিনি বার অপেন হয়েছে। একটা পাঞ্চ আমি নিজে বানিয়েছি ভারমুখ– অরেঞ্জ জুস- টাকিলা এবং গোলমরিচ দিয়ে বানানো এক চামুচ করে হলেও সবাই চেখে দেখবেন।

লোকজন সবাই যেন একটু নড়েচড়ে বসল। শুভ্রর কাঁধে কে হাত রেখেছে। এলা নামের সেই মহিলা না-কি? শুভ্ৰ অস্বস্তির সঙ্গে মাথা ফিরিয়ে দেখে মীরা। মীরার মুখ হাসি হাসি। এর অর্থ মীরা রেগে আছে। তার মুখ যখন খুব হাসি হাসি থাকে তখন বুঝতে হবে সে রেগে আছে। হাসি দিয়ে সে রাগ চাপার চেষ্টা করছে।

শুভ্র আমার সঙ্গে একটু আয়তো।

শুভ্র মীরাকে অনুসরণ করল। মীরা নিতান্ত পরিচিত ভঙ্গিতে সিঁড়ি বেয়ে একতলা থেকে দোতলায় উঠছে। অন্য কোন অতিথিকে শুভ্ৰ দোতলায় উঠতে দেখে নি। দোতলায় উঠেই খানিকটা ফাঁকা জায়গা। বড় টিভি আছে। টিভিতে কার্টুন চলছে। মিকি ইদুর তাড়া করছে। টিভিতে কোনো শব্দ নেই। টিভির কোনো দর্শকও নেই।

মীরা বলল, তোকে এ বাড়িতে দেখে আমি খুবই অবাক হয়েছি।

শুভ্র বলল, কেন?

তুই এখানে এসেছিস কেন?

তুমি যেমন নিমন্ত্রণ পেয়ে এসেছ আমিও তাই।

তুই এ বাড়িতে কখনো আসবি না। নেভার এভার… বুঝতে পারছিস?

না।

এটা খুব স্ট্রেঞ্জ একটা জায়গা। এখানে আসা ঠিক না।

তুমিতো আসছ।

আমি এসেছি বলেই আমি জানি।

চলে যেতে কলছ?

হ্যাঁ।

পার্টিটা শেষ পর্যন্ত দেখে যেতে ইচ্ছা করছে।

কিছু দেখতে হবে না। তুই এক্ষুণি আমার সঙ্গে রওনা হবি। আমি তোকে তোর বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসব।

মীরা সিঁড়ি বেয়ে নামছে। মীরার পেছনে পেছনে নামছে শুভ্ৰ। দরজার কাছে আখলাক সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। মীরা বলল, আমি শুভ্ৰকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসি, ওর প্রচণ্ড মাথা ধরেছে।

আখলাক সাহেব বললেন, তুমি কি ফিরে আসছ?

মীরা বলল, হ্যাঁ ফিরছি।

আখলাক সাহেব শুভ্রর দিকে তাকিয়ে বললেন, আবার দেখা হবে।

 

গাড়ি চালাচ্ছে মীরা। তার মুখ থমথম করছে। শুভ্র মীরার পাশে বসেছে। রাস্তাঘাট ফাঁকা না। প্রচুর ট্রাফিক। মীরা গাড়িতে স্পীড় দিতে পারছে না। তাকে খানিকটা বিরক্ত দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে তার ইচ্ছা অতি দ্রুত শুভ্ৰকে নামিয়ে দিয়ে চলে আসা।

শুভ্র বলল, আমাকে এখানে কোথাও নামিয়ে দিলেই হবে। আমার বাড়ি পর্যন্ত গেলে ফিরতে রাত হয়ে যাবে। দেখবে পার্টি শেষ।

মীরা জবাব দিল না। শুভ্র বলল, আচ্ছা মেশকাত নামের ঐ লোকটাকে তুমি কি আগে দেখেছ?

মীরা বলল, হ্যাঁ। শুভ্র বলল, লোকটার কি কোনো অতিন্দ্রীয় ক্ষমতা আছে?

মনে হয় আছে।

লোকটা কি অন্ধ?

হ্যাঁ।

শুভ্ৰ বলল, আমার মনে হয় না। সাজ্জাদ সাহেব নামের এক ভদ্রলোকের হাতে তিনি আতর দিয়ে দিলেন। যেখানে আন্তর মাখানো হয়। তিনি ঠিক সেখানে আন্তর মাখালেন; হাতের তালুতে না উল্টো পিঠে। কোনো অন্ধ এই কাজটা পারবে না।

মীরা বিরক্ত মুখে বলল, লোকটা অন্ধ।

ও।

শুভ্ৰ তোর সঙ্গে আমার খুব জরুরি কিছু কথা আছে। তুই কি কোনো একদিন আমাদের বাড়িতে চলে আসবি?

হ্যাঁ আসব।

তুই আছিস কেমন?

ভাল।

বাবার ব্যবসা দেখছিস?

হ্যাঁ।

কোনো সমস্যা বোধ করছিস?

এখনো না।

তোর কী মনে হয়— তোর কোনো সাহায্য বা পরামর্শ দরকার? প্রশ্নটা আগে একবার করেছিলাম। এখন আবার করলাম।

না মনে হয় না। সমস্যাগুলি আমার কাছে ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে। সমস্যাগুলিকে আমি দেখছি সেকেন্ড অর্ডার ডিফারেনশিয়েল ইকুয়েসনের মত। যার দুটা সলিউশন- দুটা উত্তর। একটা উত্তর রিয়েল আরেকটা ইমাজিনারি। অর্থাৎ একটা সত্যি উত্তর একটা মিথ্যা। আমার কাজ হচ্ছে কোন উত্তরটা সত্যি তা বের করা।

তোর কাছে পুরো ব্যাপারটা খুব একসাইটিং লাগছে?

হ্যাঁ।

তোর বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছি- একটা অস্বস্থিকর প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করছে। করব?

হ্যাঁ কর।

যে বাহান্নজন মেয়ের কথা বলেছিলি তাদের সঙ্গে কি তোর দেখা হয়েছে?

বাহান্ন না এখন তিপান্ন- আমরা নতুন একটা মেয়ে কিনেছি।

মেয়ে কিনেছি মানে?

এগারো হাজার টাকায় অল্প বয়েসী একটা মেয়ে কিনেছি। আমাদের এ ধরনের ব্যবসায় সব সময় নতুন মুখ দরকার।

ও আচ্ছা।

মীরা হাত বাড়িয়ে গাড়ির ক্যাসেট চালু করল। তবলা এবং পাখোয়াদের যুগলবন্দি। শুনতে ইন্টারেস্টিং লাগছে। কিছুক্ষণ পর পর একজন আবার মুখে বোল দিচ্ছে। মূল তবলার চেয়ে বোলগুলি শুনতে ভাল লাগছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *