১০. আপনার বক্তব্য কীভাবে পরিষ্কার বোঝাবেন
একজন খ্যাতনামা ইংরেজ ধর্মযাজক প্রথম বিশ্বযুদ্ধ কালে আপটন শিবিরে একদল অশিক্ষিত সৈন্য সমাবেশে বক্তৃতা করেছিলেন। তারা তখন যুদ্ধে যাচ্ছিল কিন্তু তাদের মধ্যে অতি সামান্য কয়জনই, জানতেন তাঁদের কোথায় পাঠান হচ্ছে, এইসব সৈন্যদের সমাবেশে ধর্মযাজক ”আন্তর্জাতিক বন্ধুত্ব” এবং সার্ভিয়ার অধিকারের কথা বলেন। সৈন্যদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি জানত না সার্ভিয়া কোনো শহর অথবা রোগের নাম কিনা। এতৎসত্ত্বেও তিনি তাদের সামনে একটি অর্ধোন্মাদময় বক্তৃতা করেন। তিনি যখন বক্তৃতা করছিলেন তখন হলের সব দরজায় রিভলবার হাতে সামরিক পুলিশ প্রহরারত ছিল, যাতে কোনো শ্রোতা হল ছেড়ে বেরিয়ে যেতে না পারে।
আমি ধর্মযাজককে ছোট করতে চাই না। তবুও সত্যি কথা এই যে শিক্ষিত সম্প্রদায়ের কাছে বললে তার যে বক্তব্য ফলপ্রসূ হত, এসব সৈনিকদের কাছে তা ব্যর্থ হয়। সৈনিকরা বুঝতে পারেন না, তাদের কেন এসব কথা বলা হচ্ছে, আর বক্তাও বুঝতে পারেন না, কেন তিনি এসব বলছেন।
আমাদের মতে একটি বক্তৃতার অর্থ কী? যে কোনো বক্তৃতায় বক্তার মুলত চারটি লক্ষ্য থাকে। সে গুলো কী?
১। কোনো একটি বিষয় পরিষ্কার করা।
২। শ্রোতাদের স্বমতে আনা।
৩। উদ্দীপ্ত করা।
৪। আনন্দ দান।
কতিপয় বাস্তব উদাহরণ দিয়ে তা ব্যাখ্যা করা যাক।
কারিগরি কাজের প্রতি লিংকন সব সময় আগ্রহী ছিলেন। একবার বালিতে আটকা পড়া নৌকা উদ্ধারের জন্যে তিনি একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। তাঁর আইন দপ্তরের সন্নিকটে অবস্থিত একটি কারিগরি কারখানায় বসে তিনি অনেক খেটে, পরিশ্রম করে তার উদ্ভাবিত যন্ত্রের একটি মডেল তৈরি করেন। তাঁর এই পরিকল্পনা পরিশেষে ব্যর্থ হলেও তিনি ছিলেন এ সম্পর্কে অত্যন্ত আশাবাদী। যখন বন্ধুরা তার কাছে আসতেন মডেল দেখতে, তিনি মডেল সম্পর্কে ব্যাখ্যা করতে কখনো ক্লান্তি বোধ করতেন না। তার মূল লক্ষ্য ছিল সকলের কাছে তার ধারণা পরিষ্কার ভাবে তুলে ধরা।
যখন তিনি তার গেটিসবার্গের অমর ভাষণ দান করেন, যখন তিনি তার প্রথম দ্বিতীয় উদ্বোধনী ভাষণ দান করেন এবং যখন তিনি হেনরী ক্লের মৃত্যুর পর তার জীবনী আলোচনা করে বক্তৃতা করেন, লিংকনের মূল লক্ষ্য ছিল নিজের বক্তব্য পরিষ্কার ভাবে বলে, শ্রোতাদের স্বমতে আনা। অবশ্য এসব বক্তৃতার বক্তব্য পরিষ্কার করে তুলে ধরার চাইতে শ্রোতাদের স্বমতে আনার উপরই জোর পড়েছিল বেশি।
জুরিদের সাথে আলোচনা কালে লিংকন তাদের স্বমতে আনতে চাইতেন। রাজনৈতিক আলোচনায় তিনি নিজের পক্ষে ভোট প্রাপ্তির চেষ্টা চালাতেন। সুতরাং তার লক্ষ্য ছিল শ্রোতাদের উদ্দীপ্ত করা, কর্মমুখী করে তোলা।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার দু’বছর আগে লিংকন উদ্ভাবন (আবিষ্কার) সম্পর্কে একটি বক্তৃতা প্রস্তুত করেন। এই বক্তৃতা প্রস্তুতিতে তার লক্ষ্য ছিল শ্রোতাদের আনন্দ দান করা। অন্তত এই লক্ষ্যস্থল নির্ধারণ করেই তিনি বক্তৃতা প্রস্তুত করেছিলেন, কিন্তু লক্ষ্য অর্জনে তিনি সফল হতে পারেন নি। জনপ্রিয় হিসাবে তার জীবন এই ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছিল। একটি শহরে একজন শ্রোতাও তার বক্তৃতা শুনতে আসে নি।
কিন্তু অন্যান্য বক্তৃতায় তিনি অব্যাহতভাবে সাফল্য লাভ করেছিলেন, যার কথা আমি উল্লেখ করেছি। কিন্তু কেন? কারণ এসব ক্ষেত্রে তিনি তার লক্ষ্যের কথা জানতেন এবং জানতেন কী ভাবে লক্ষ্যে পৌঁছতে হবে। তিনি জানতেন কোথায় তিনি যাবেন এবং কীভাবে যাবেন। এবং বহু বক্তা এটা ঠিক ভাবে জানেন না বলে মাঝ পথে হাবুডুবু খান।
উদাহরণ স্বরূপ–আমি একদা যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের একজন সদস্যকে বক্তৃতা কালে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে নিউইয়র্কে হিপাড্রোম (ঘোড়া দৌড়ের মাঠ) ত্যাগ করে চলে যেতে দেখেছি। কারণ, তিনি যে বক্তৃতা শুরু করেছিলেন, তাতে তার লক্ষ্য ছিল শ্রোতাদের কাছে তা পরিষ্কার করে তোলা। লক্ষ্য নির্ধারণ ছিল তাঁর অবিবেচনা প্রসূত, তাই তিনি হন ব্যর্থ। এটা ছিল যুদ্ধের সময়। তার বক্তব্যের বিষয় ছিল যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। শ্রোতারা যুদ্ধ সম্পর্কে কোনো নির্দেশ শুনতে আগ্রহী ছিলেন না। তাদের লক্ষ্য ছিল আনন্দ লাভ। শ্রোতারা দশ মিনিট থেকে পনেরো মিনিট পর্যন্ত অত্যন্ত ধৈর্য সহকারে তাঁর বক্তব্য শোনেন এবং আশা করেন যে এরপর আনন্দ দিয়ে তার বক্তব্য শেষ হবে। কিন্তু তা হয় না, বক্তা বার-বার যুদ্ধের প্রস্তুতি ব্যাখ্যা করতে থাকেন, শ্রোতারা আস্তে-আস্তে অধৈর্য হয়ে পড়েন, একে একে তারা চলে যেতে শুরু করেন? কেহ-কেহ স্বতস্ফূর্ত ভাবে ধ্বনিও প্রদান করতে শুরু করে একসাথে। বক্তা শ্রোতাদের মনোভাব বুঝতে ব্যর্থ হয়ে বক্তৃতা অব্যাহত রাখেন। এর ফলে শ্রোতারা আরো বিরক্ত হয়। হাসাহাসি শুরু হয়ে যায়। তারা বক্তাকে থামিয়ে দিতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়। তাদের ধ্বনি উচ্চ থেকে উচ্চগ্রামে পৌঁছে। পরিশেষে এমন অবস্থা হয় যে বক্তার কথা নয়, শ্রোতার কথাই শুধু শোনা যেতে থাকে। সুতরাং বক্তা ব্যর্থ হয়ে, পরাজিত হয়ে অপমানিত হয়ে বক্তৃতা শেষ করেন।
এই উদাহরণ থেকে শিক্ষা নিন। আপনার লক্ষ্যের কথা জানুন, বক্তৃতা প্রস্তুতের আগেই লক্ষ্যস্থল সঠিক ভাবে নির্ধারণ করে নিন। কীভাবে লক্ষ্যে পৌঁছতে হবে তা ঠিক করে নিন। অতঃপর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণে লক্ষ্যে উপনীত হবার প্রস্তুতি নিন।
তুলনার মাধ্যমে বক্তব্য পরিষ্কার করুন :
কোনো বিষয় পরিষ্কার করার, বোধগম্য করার গুরুত্ব অথবা বাধাবিঘ্ন ছোট করে দেখা উচিৎ নয়। একদা আমি একজন আইরিশ কবিকে এক দিন বিকেলে তার নিজের লেখা থেকে পাঠ করে শোনাতে দেখেছি। শ্রোতাদের মধ্যে শতকরা দশজন তিনি কী বলতে চান তা বুঝতে পারেন নি।
বক্তাদের মধ্যে অধিকাংশই প্রকাশ্য সভায় অথবা ঘরোয়া পরিবেশে বক্তৃতায় এরূপ ব্যর্থতার পরিচয় দেন।
একবার আমি স্যার অন্সিভারলজ-এর সাথে জনসভায় বক্তৃতার সাফল্য সম্পর্কে আলোচনা করি। তিনি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস এবং জনসভায় বক্তৃতা দানে ৪০ বছরের অভিজ্ঞ বক্তা। আমার জিজ্ঞাসার উত্তরে তিনি জানান যে বক্তৃতায় সাফল্য অর্জন করতে হলে প্রথম প্রয়োজন জ্ঞান এবং প্রস্তুতি এবং দ্বিতীয় প্রয়োজন হচ্ছে, বক্তব্য পরিষ্কার করার জন্যে কষ্ট স্বীকার করা।
ফ্রাঙ্কো প্রসীয় যুদ্ধের প্রারম্ভে জেনারেল ভন মল্টকী তাঁর অফিসারদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, “ভদ্রমহোদয়গণ, স্মরণ রাখবেন, যে কোনো নির্দেশকে ভুল বলে গ্রহণ করা হলে তা ভুলই থাকবে।”
নেপোলিয়ন একই বিপদে স্বীকৃতি দিয়েছেন। সচিবদের প্রতি তাঁর বহুল আলোচিত নির্দেশ ছিল, পরিষ্কার ভাবে বুঝে নিন, পরিষ্কারভাবে বুঝে নিন।
এবং যখন আপনি এমন একটি বিষয়ে কথা বলবেন যা আপনার শ্রোতাদের কাছে পরিচিত নয় আপনি কীভাবে আশা করবেন যে তারা বুঝবে?
সুতরাং এই ধরনের ব্যাপারে আমরা কী করতে পারি? এই ধরনের অবস্থায় পড়লে আপনি কী করবেন? স্বাভাবিক পদ্ধতিতে এই সমস্ত সমাধানের সহজ পথ হচ্ছে, মানুষ চেনে না এই বিষয়টি চেনাতে হলে যে জিনিসটি চেনে তার সাথে তুলনা করে আপনার বক্তব্য পেশ করুন। স্বর্গরাজ্য। এটা কিরূপ? কীভাবে এই বিষয়টি মানুষের সামনে পরিষ্কার করে তুলে ধরা যায়? যিশুখ্রিস্ট মানুষের সামনে বস্তুর উদাহরণ দিয়ে স্বর্গরাজ্য সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন :
স্বর্গরাজ্য হচ্ছে তাই যেখানকার খাবার আমাদের চাইতে অনেক উপাদেয়, খমির মিশালে যা হয়ে ওঠে আরো উপাদেয়।
এবং স্বর্গরাজ্য হচ্ছে তাই যেখানে মূল্যবান মণিমুক্তার প্রাচুর্যের সীমা নেই।
এবং স্বর্গরাজ্যে হচ্ছে তাই যা সমুদ্রের জলের চাইতে বহুমূল্যবান জল দিয়ে ঘেরা।
প্রতিটি গৃহকর্ত্রী রুটি প্রস্তুতে রুটি ফোলানোর জন্যে খমির ব্যবহার করে। জেলেরা প্রতিদিন সমুদ্রে জাল ফেলে মাছ ধরে এবং ব্যবসায়ীরা মূল্যবান মণিমুক্তার সন্ধান রাখে। সুতরাং এরূপ বর্ণনা হৃদয়গ্রাহী ও বোধগম্য বর্ণনা।
এবং ডেভিড জেহোভাব দয়া সম্পর্কে কিরূপ বর্ণনা দিয়েছিলেন?
প্রভু আমাকে মেঘপালক বানালেন। তিনি আমাকে সবুজ ঘাসে ঘুরে বেড়াতে দিলেন। যেখানে পানির অভাব ছিল।
প্রায় একটি গাছপালাহীন দেশে সবুজ মাঠ সৃষ্টি করলেন।পানির অভাব থাকলেও আমার মেষেদের পানীয় জলের অভাব ছিল না সেখানে।
এটা একটা আনন্দদায়ক উদাহরণ। কেহ-কেহ আফ্রিকায় বসবাসকারীদের জীবনের সাথে তুলনা করে বাইবেলের ব্যাখ্যা করেন। তারা বলেন, “আপনার পাপ অত্যুজ্জ্বল লাল হলে তা বরফের মতো শুভ্র হয়ে যেতে পারে।” এটা কী ধরনের অনুবাদ। সাহিত্য অর্থে অর্থহীন। অবান্তর। আফ্রিকাবাসীরা বরফের সাথে তেমনভাবে পরিচিত নয়। তারা তুষার এবং কোলতারের তুলনা বোঝে না। কিন্তু তারা দীর্ঘ নারিকেল গাছে মধ্যাহ্ন ভোজের জন্যে নারিকেল সংগ্রহ করতে অভ্যস্ত। সুতরাং মিশনারিরা বাইবেল সেখানে এভাবে ব্যাখ্যা করেন, “তোমাদের পাপ অত্যন্ত লাল হলেও তা নারিকেলের মাংসের মতো সাদা হয়ে যেতে পারে।”
এই পরিস্থিতিতে অবস্থার উন্নতি বিধান কষ্টসাধ্য, তা নয় কি?
মিশোরীর ওয়ারেনবুর্গের টিচার্স কলেজে আমি একবার আলাস্কা সম্পর্কে একটা বক্তৃতা শুনেছি। বক্তা এই ক্ষেত্রে তার বক্তব্য পরিষ্কার করতে ব্যর্থ হন। তাঁর অবস্থাও হয় আফ্রিকান মিশনারিদের মতো। তিনি বলেন, আলাস্কা ৫,১০,৮০৪ বর্গ মাইল এলাকা নিয়ে গঠিত এবং জনসংখ্যা হচ্ছে ৬৪,৩৫৬ জন।
অর্ধমিলিয়ন বর্গ মাইল বললে মানুষের মনে কী কোনো দাগ কাটে। মোটেই না। এর দ্বারা বাস্তব কোনো ছবি ফুটে ওঠে নি। মেইন অথবা টেক্সাসের আকারও যে অর্ধমিলিয়ন বর্গমাইল বক্তা তা জানতেন না। যদি বক্তা বলতেন যে, আলাঙ্কার উপকূল দ্বীপসমুহের বিশ্বে সব চাইতে দীর্ঘ এবং এক এলাকা ভারমন্ট, নিউহ্যাম্পশায়ার মেইন মাসাসুসেটস, রোডে দ্বীপ; কনেটিকাট, নিউইয়র্ক নিউজার্সি, প্যানসিলভানিয়া, দেলাওয়ার, মেরীলা পশ্চিম ভার্জিনিয়া, উত্তর ক্যারোলিনা, দক্ষিণ ক্যারোলিনা, জর্জিয়া, ফ্লোরিডা, মিসিসিপি, এবং টেনেসীর সম্মিলিত এলাকার চাইতে বেশি, তা হলে তা হত আকর্ষণীয়। এরূপ বললে কি শ্রোতারা আলাস্কা সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা পেতেন না।–
তিনি বলেছিলেন যে জনসংখ্যা ৬৪,৩৫৩। কিন্তু দশজন শ্রোতাও পাঁচ মিনিট কি এক মিনিট কালও এই সংখ্যা স্মরণ রাখতে পারেন নি। কেন? কারণ চৌষট্টি হাজার তিনশত ছাপান্ন বাক্যটি শ্রোতামনে তেমন দাগ কাটতে পারে নি। সমুদ্রকূলের বালুতে পরিব্রাজকদের লেখা যেমন অন্যের মনে তেমন দাগ কাটে না। এই বাক্যও ঠিক তেমনি। এর প্রতি কারো অন্তদৃষ্টি পড়ে না। তুলনামূলক ভাবে সংখ্যার কথাটা প্রকাশ করলে কী তা আকর্ষণীয় হত না? উদাহরণ স্বরূপ, সেন্ট জোসেফ মিশোরীর এই ছোট শহরটি থেকে খুব দূরে নয়। আজকের শ্রোতাদের অনেকে সেন্ট জোসেফ পরিভ্রমণ করেছেন। আজকের আলাস্কার জনসংখ্যা হচ্ছে সেন্ট জোসেফ থেকে দশ হাজার কম। আরো সুস্পষ্ট ভাবে বলতে গেলে, আপনি যে শহরে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন সে শহরের সাথে আলাস্কার তুলনা করছেন না কেন? ”আলাস্কা নিশৌরীর চেয়ে আটগুণ বড়, কিন্তু এর জনসংখ্যা হচ্ছে উয়ারেনবুর্গ এর চাইতে তেরোগুণ বেশি। একথা বললে কি বক্তার বক্তব্য আরো সুস্পষ্ট এবং পরিষ্কার হতো না।–
নিম্নবর্ণিত উদাহরণ এটা আরো পরিষ্কার করে –
(ক) আমাদের সবচাইতে নিকটবর্তী তারকার দূরত্ব হচ্ছে ৩৫ ট্রিলিয়ন মাইল।
(খ) একটি রেলগাড়ি প্রতি মিনিটে এক মাইল করে চললে আমাদের নিকটবর্তী তারকার পৌঁছতে লাগবে ৪ কোটি ৮০ লাখ বছর। সেখান থেকে গান গাওয়া হলে তার ধ্বনি আমাদের কর্ণগোচর হতে লাগবে ত্রিশলাখ আটশত হাজার বছর? একটা মাকড়সার জাল সেখানে পৌঁছতে হলে তার ওজন হবে ৫০০ টন।
(গ) সেন্ট পিটারস হচ্ছে বিশ্বের বৃহত্তম গির্জা, যার দৈর্ঘ্য ৩৬৪ গজ ও প্রস্থ ২৩২ ফুট।
(ঘ) ওয়াশিংটনের দুটি ভবনের একটির ওপর অপরটি দাঁড় করালে যে সাইজ হবে এটির সাইজ তাই।
অণু সম্পর্কে বক্তৃতাকালে স্যার অলিভার লজ এই পদ্ধতি অনুসরণ করতেন। ইউরোপীয় শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতাকালে আমি তাকে বলতে শুনেছি, একবিন্দু পানিতে যত অণু আছে ভূমধ্য সাগরেও তত বিন্দু পানি আছে, তার শ্রোতাদের মধ্যে এরূপ অনেকে ছিলেন যারা জিব্রাল্টার থেকে সুয়েজখাল পর্যন্ত ভ্রমণ করেছেন, এতৎসত্ত্বেও বিষয়টি আরো পরিষ্কার করার জন্যে তিনি আরো বলেছিলেন, একবিন্দু পানিতে যত অণু আছে সমগ্র বিশ্বের বুকে ঘাসের পরিমাণ হবে তাই।
রিচার্ড হার্ডিং ডোভিস নিউইয়র্কের শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতাকালে বলেছিলেন, সেন্ট সোকিয়ার মসজিদের আকার হচ্ছে ৫ম অ্যাভিনিউ থিয়েটারের সমান, তিনি বলেন, নিকট থেকে দেখলে তাকে আপনার কাছে একটি দ্বীপ নগরী বলে ভ্রম হবে।
অতপর আপনার বক্তৃতায় এই নীতি অনুসরণ করুন। পিরামিড সম্পর্কে বলতে হলে প্রথমে বলুন, এটি ৪৫১ ফুট, অতঃপর তার উচ্চতা শ্রোতারা যে সব গৃহ প্রতিদিন দেখেছে তার সাথে তুলনা করে বোঝন। বলুন এটি নগরীর কতটুকু অংশ জুড়ে আছে। এত হাজার গ্যালন এটা অথবা অতশত হাজার ব্যারল সেটা বলে কিছু বর্ণনা করবেন না, বলবেন, এই তরল পদার্থ দিয়ে কতটা ঘর ভর্তি করা সম্ভব। ২৫ ফুট উচ্চ বলার চাইতে এই সিলিং হতে দেড়গুণ উঁচু বলা কি শ্রেয় নয়। মাইলে দূরত্ব বর্ণনা করার চাইতে নির্দিষ্ট স্থান হতে কতদূরে অথবা ঐ সড়ক হতে এত দূরে একথা বলা কি ভালো নয়? লিংকনের বক্তব্যের স্পষ্টতার রহস্য : লিংকনের শ্রোতাদের কাছে তাঁর বক্তব্য পরিষ্কার করে তোলার জন্যে সাধারণত জনপ্রিয় ফ্রেইজ ব্যবহার করতেন। কংগ্রেসে প্রদত্ত তাঁর প্রথম ভাষণে তিনি ”চিনি আচ্ছাদিত” ফ্রেজ ব্যবহার করেন। খ্যাতনামা মুদ্রাকর ও লিংকনের ব্যক্তিগত বন্ধু মি. ডেফ্রিজ বলেছিলেন যে, এই ফ্রেজটি ইলিনয়েস এ জনসভার জন্যে এটি যথোপযুক্ত হলেও রাষ্ট্রীয় ঐতিহাসিক রেকর্ডের জন্যে এটি উপযুক্ত নয়। প্রত্যুত্তরে মি. লিংকন বলেন, “তুমি যদি মনে কর এমন সময় আসবে যখন জনগণ ”চিনি আচ্ছাদিত” শব্দের অর্থ বুঝবে না, আমি তা ব্যবহার পরিত্যাগ করব, অন্যথা আমি এটি প্রয়োগ অব্যাহত রাখব।”
তিনি কীভাবে সহজ ভাষা শেখেন তা একবার কনক্স কলেজের প্রেসিডেন্ট ড. গ্যালিভারের কাছে ব্যাখ্যা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন :
আমার ছোট বেলায় কেহ আমরা সাথে কোনো বিষয়ে আলোচনা করলে আমি বিষয়বস্তু বুঝতে না পারলে উত্তেজনা অনুভব করতাম। তবে আমি মোটে ক্রুদ্ধ হতাম না। তবে সময়-সময় তা আমার ধৈর্যচ্যুতি ঘটাত। আমি যখন রাতে শুতে যেতাম তখন আমি সেদিন বিকেলে প্রতিবেশী যে বিষয়টি নিয়ে আমার পিতার সাথে আলোচনা করছেন তা ভাবতে-ভাবতে যেতাম। শুয়ে-শুয়ে ভাবতাম। অনেক সময় বিষয়টি ভাবতে-ভাবতে আমার ক্ষুদ্র কক্ষে পায়চারী করতাম। বিষয়টি বোঝার জন্যে, উপলব্ধি করার জন্যে অনেক সময় বিদ্রি রজনী যাপন করতাম। বিষয়টি বুঝতে পারলেও আমার মনে হত আমি যেন তা সঠিকভাবে বুঝি নি। তাই আবার চিন্তা করতাম।
আমি বিষয়টিকে প্রাঞ্জলও সরল ভাষায় রূপ দিতে না পারা পর্যন্ত শান্তি পেতাম না, এটাই ছিল আমার সেদিনের আবেগ প্রবণতা। এবং এই আবেগ প্রবণতা দিয়েই আমি একটি বিষয় বুঝতে পারতাম এবং এভাবেই আমি সহজ ভাষা আয়ত্ত্ব করি।
আসক্তি? হ্যাঁ এটা সেভাবেই বিবেচিত হওয়া উচিত। নিউসালেম এর স্কুল শিক্ষক মেন্টার গ্রাহাম বলেছেন, “আমি লিংকনকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে লেখাপড়া করতে দেখেছি। তবে তার পাঠাভ্যাসের মূল লক্ষ্য ছিল কীভাবে সহজে তা প্রকাশ করা যায়।”
এই ক্ষেত্রে সাধারণ বক্তার ব্যর্থতার মূল কারণ হচ্ছে এই যে, তারা যে বিষয়টি পরিষ্কার করে তুলে ধরতে চান সে বিষয়টি নিজেরাও বোঝে না। অস্পষ্ট ধারণা ভাসা-ভাসা জ্ঞান দিয়ে কোনো কিছু অন্যকে বোঝানো অসম্ভব। এর ফল কী হয়? কুয়াশায় ক্যামেরায় ছবি আসে না। এই রূপ ক্ষেত্রে বক্তার বক্তব্যও হয় কুয়াশাচ্ছন্ন। লিংকনের পদ্ধতি অনুসরণে বিষয় পরিষ্কার করা নিশ্চিতভাবে সহজ।
দৃশ্য বস্তুর প্রতি ইঙ্গিত :
চতুর্থ পরিচ্ছেদে আমরা বলেছি, যে সব মাংসপেশী কান থেকে মাথায় গিয়েছে তার চাইতে চোখ থেকে মাথা পর্যন্ত বিস্তৃত মাংসপেশী অনেক বেশি বড় এবং বিজ্ঞানের মতে আমরা কানে যা শুনি তার চাইতে চোখে যা দেখি তার প্রতি ২৫ গুণ বেশি দৃষ্টি দিই।
একটা প্রাচীন প্রবাদ আছে, “একবার দেখা শতবার বলার চাইতে উত্তম।” সুতরাং আপনার বক্তব্য পরিষ্কার করতে চাইলে ছবিকে কেন্দ্র করে বক্তব্য প্রকাশ করুন। খ্যাতনামা ন্যাশনাল ক্যাশ রেজিস্টার কোম্পানির প্রেসিডেন্ট জন এইচ, প্যাটারসন এই পদ্ধতি অনুসরণ করতেন। কর্মচারীদের প্রতি তার বক্তব্য সম্পর্কে একবার তিনি সিস্টেম ম্যাগাজিনে একটি প্রবন্ধ লেখেন :
আমি বিশ্বাস করি কোনো ব্যক্তি শুধুমাত্র বক্তৃতা শুনে সবকিছু বুঝতে পারে না অথবা বক্তৃতা সকল শ্রোতারে দৃষ্টি একইভাবে আকর্ষণ করতে পারে না। এই ক্ষেত্রে বক্তৃতার সাথে একটি নাটকীয় বিকল্প প্রয়োজন। যে ক্ষেত্রে সম্ভব সে ক্ষেত্রে বক্তৃতার সাথে ছবি প্রদর্শন করা বাঞ্ছনীয়। শব্দের চাইতে নক্সার প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় বেশি এবং নক্সার চাইতে ছবি অধিকতর আকর্ষণীয়। একটি বিষয়ের আদর্শ উপস্থাপন হচ্ছে বিষয়টি সম্পর্কে সামগ্রিক ছবি প্রদর্শন করে ছবিসমূহের সংযোগ বিধানের জন্যে শব্দ বা বাক্য ব্যবহার। এটা আমার বাস্তব অভিজ্ঞতায় আমি দেখেছি যে, আমার বক্তব্যের চাইতে প্রদর্শিত ছবি দেখে শ্রোতারা অনেক সহজে বিষয়টি বুঝতে পারেন।
অদ্ভুত নকশা অনেক বেশি আকর্ষণীয়। –আমি সব বিষয়ে কাটুন বা চার্ট করে বোঝাবার চেষ্টা করি। ডলার চিহ্নিত একটি সার্কেলের অর্থ একটি টাকা আর ডলার অংকিত একটি থলের অর্থ কিছু টাকা। চন্দ্রমুখ অনেক সুফল প্রদানে সক্ষম। একটি সার্কেলে চোখ, নাক, মুখ, কান আঁকুন। নবীন এবং প্রবীণেরা নিজ-নিজ চিন্তাধারানুযায়ী তার অর্থ করবে। খ্যাতনামা কাটুনিস্ট এর হাতে আঁকানো হলে তার অর্থও হবে সেরূপটি। ব্যাগ একটি বড় ও একটি ছোট পাশাপাশি আঁকা হলে এটা কারো বুঝতে কষ্ট হবে
যে, একটিতে বেশি এবং অপরটিতে কম টাকা আছে। কথার সাথে-সাথে এসব ছবি প্রদর্শিত হলে শ্রোতা আপনার কথা সহজে বুঝবে আপনার পরবর্তী বক্তব্যের প্রতি তার দৃষ্টি আকৃষ্ট হবে? তবে অদ্ভুত ছবি মানুষকে আনন্দও দান করবে।
আমি আমার দোকানে পোশাদার শিল্পী দিয়ে ছবি এবং নক্সা অঙ্কন করাই। লোক এসব ছবি দেখে। কাগজ থেকে পর্দায় ছবি আঁকাই, পরে তা মুভি পিকচারে রূপান্তরিত হয়।
সব বিষয়ে ছবি করা, নক্সা করা সম্ভব নয়, তবে যেগুলো সম্ভব সেগুলো করা উচিৎ। এসব ছবিতে অন্যের দৃষ্টি পড়ে, আগ্রহ বাড়ায় অর্থ সহজে পরিষ্কার হয়?
মি. রকফেলার কলোরোডো জ্বালানী ও লৌহ কোম্পানির অর্থনৈতিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে সিস্টেম ম্যাগাজিনে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে তিনি কীভাবে মুদ্রা প্রদর্শন করে অবস্থা বিশ্লেষণ করতেন তা ব্যাখ্যা করছেন :
আমি এটা উপলব্ধি করলাম যে, কলোরোডা জ্বালানী ও লৌহ কোম্পানির কর্মচারীরা মনে করেছেন যে, রকফেলার গোষ্ঠী তাদের (কর্মচারীদের) স্বার্থের বিনিময় প্রচুর অর্থ আয় করেছেন। সাধারণ লোকের ধারণাও তাই! আমি তাদের কাছে এটা প্রদান করছি যে, এই কোম্পানির দায়িত্ব গ্রহণের চৌদ্দ বছরের মধ্যে কোম্পানি তার ডিভিডেন্ড খাতে একটি সেন্টও জমা দেয় নি।
আমার একটি সভায় আমি কোম্পানির অর্থনৈতিক অবস্থা বিশ্লেষণ করি। আমি টেবিলে কতিপয় মুদ্রা রাখি। অতঃপর বক্তৃতা কালে আমি কিছু মুদ্রা নিয়ে তা তাদের বেতন বলে দেখাই। অতঃপর আরো কিছু বেশি মুদ্রা নিয়ে তা অফিসারদের বেতন হিসাবে দেখাই। অবশিষ্ট অর্থ পরিচালকদের বেতন হিসাবে প্রদর্শন করি। এতে আমার সমস্ত মুদ্রা খরচ হয়ে যায়, স্টক হোল্ডারদের জন্যে আর কোনো মুদ্রাই পড়ে থাকে না। অতঃপর আমি প্রশ্ন করি আমারা কোম্পানির অংশীদার কর্মকর্তা এবং পরিচালক, সমস্ত আয়–আমরাই ভাগ করে নিই, চতুর্থের জন্যে কিছু থাকে কি?
যে কোনো বিষয়ের ওপর সুস্পষ্ট দৃষ্টি নিবদ্ধ করুন। ডুবন্ত সূর্যের প্রতি মানুষের দৃষ্টি যেভাবে নিবন্ধ হয় বিষয়টির প্রতি ঠিক সেরূপ নজর দিন। উদাহরণ স্বরূপ ”কুকুর” বললে মানুষের চোখের সামনে একটা বিশেষ জন্তুর ছবি ভেসে ওঠে। বুলডগ বললে আর একটি ছবি ভেসে ওঠে এবং দুটোর সাদৃশ্য বৈসাদৃশ্য সকলেই বোঝে। টাটু ঘোড়া আর ঘোড়ার তুলনাও অনুরূপ নয়। এমনিভাবে অপর দুটি পশুর তুলনা করলে কি অবস্থাটা আরো পরিষ্কার হয় না?
আপনার বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করুন :
নেপোলিয়ন বলেছিলেন যে, কোনো কিছু সুস্পষ্টভাবে বোঝাতে হলে পুনরাবৃত্তি প্রয়োজন। তিনি জানতেন যে, তিনি যা কিছু বোঝেন তা অন্যেরাও একই ভাবে বুঝবে, এটা সঠিক নয়? তিনি এটা উপলব্ধি করেছিলেন যে, কোনো নূতন বিষয় বোঝাতে হলে মনের সামনে তা তুলে ধরা প্রয়োজন। সংক্ষেপে বলতে গেলে একটা বিষয়ে বার-বার পুনরাবৃত্তি অবশ্যই প্রয়োজন। সব বারে একই ভাষায় পুনরাবৃত্তি নয়। একই ভাষায় পুনরাবৃত্তি করলে শ্রোতারা বিদ্রোহ করবে। কিন্তু ভাষার ভিন্নতা থাকলে, নতুন-নতুন শব্দ ও ফ্রেইজ প্রয়োগ করলে শ্রোতারা তা সহৃদয়তার সাথে গ্রহণ করবে।
এ সম্পর্কে একটা বাস্তব উদাহরণ দিচ্ছি। মি. ব্রয়ান বলেছেন : আপনি কোনো একটা বিষয় নিজে না বুঝলে তা অন্যকে বোঝাতে পারবেন না। যে বিষয়টি আপনি ভালোভাবে বুঝেছেন সে বিষয়টি আপনি অন্যকেও ভালোভাবে বোঝাতে সক্ষম হবেন।
শেষ বাক্যটি হচ্ছে প্রথম বাক্যের পুনরাবৃত্তি। কিন্তু এটা বলার পর কেহ এটাকে পুনরাবৃত্তি বলে মনে করে না। এই বাক্য দ্বারা বিষয়টি আরো পরিষ্কার হয়।
আমি আমার ক্লাসে এই পুনরাবৃত্তি পদ্ধতি বার-বার অনুসরণ করেছি। এতে বিষয় সহজে পরিষ্কার হয়েছে। পুনরাবৃত্তি পদ্ধতি অনুসরণে সত্যিই বক্তব্য সহজতর ও স্বচ্ছ হয়ে পড়ে।
সাধারণ ব্যাখ্যা ও বিশেষ উদাহরণ :
কোনো একটি বিষয় পরিষ্কারভাবে তুলে ধরার নিশ্চিত ও সহজতর পথ হচ্ছে সাধারণ ব্যাখ্যা ও বিশেষ উদাহরণ প্রদান। এ দুটির মধ্যে পার্থক্য কী? একটি হচ্ছে সাধারণ ও অপরটি হচ্ছে বিশেষ।
এক্ষেত্রে আমরা বিশেষ উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি ব্যাখ্যা করছি। ”কর্মক্ষেত্রে এরূপ পুরুষ ও মহিলা আছেন যাদের আয় আশ্চর্যজনকভাবে অনেক বেশি।” এই বিবৃতিটিকে আমরা উদাহরণ রূপে গ্রহণ করি। না। এই বিবৃতিটি কি সবার কাছে পরিষ্কার? বক্তা এতে কী বলতে চেয়েছেন তা কি আপনি পরিষ্কার ভাবে বুঝেছেন। না। এবং বক্তাও এটা বুঝতে পারছেন না যে, এই বিবৃতি থেকে শ্রোতারা কি বুঝেছেন? এই বিবৃতির শ্রোতা দেশীয় ডাক্তার হলে ও জরাক পাহাড়ে কর্মরত চিকিৎসক হলে তিনি মনে করবেন বার্ষিক আয় পাঁচ হাজার ডলার, খনি ইঞ্জিনিয়ার হলে তিনি নিজের পেশার লোকের সাথে তুলনা করে বার্ষিক আয় বার্ষিক সাত হাজার ডলার মনে করবেন। সুতরাং এই বিবৃতিটি অত্যন্ত অস্পষ্ট। এটাকে স্পষ্ট করা প্রয়োজন। বক্তা ”আশ্চর্যজনকভাবে বেশি” বলে কি বোঝাতে চেয়েছেন এবং কি পেশায় নিয়োজিতদের সম্পর্কে বলেছেন যে সম্পর্কে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা প্রয়োজন।
দেশে এমন আইনজীবী, গান লেখক, উপন্যাসিক, নাট্যকার,শিল্পী, নায়ক, গায়ক আছেন যাদের আয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের চাইতে বেশি।
এখানে বক্তার বক্তব্য বিষয়টি কি আরো স্পষ্ট হল না? তিনি কিন্তু এক্ষেত্রেও বিশেষ উদাহরণ দেন নি। তিনি সাধারণ ব্যাখ্যা দিয়েছেন, বিশেষ উদাহরণ দেন নি। তিনি ”গায়কের” কথা বলেছন কিন্তু গায়ক হিসাবে রোমা পানসেলা, কিরিস্টেন ফ্লাগস্টাড অথবা লিলি পনস এর নামোল্লেখ করেন নি।
সুতরাং এখনও বিবৃতিটি অনেকটা অস্পষ্ট রয়েছে, এটাকে আমরা বিশেষ বিষয় বা সৃষ্ট বিষয় রূপে উল্লেখ করতে পারি না। নিম্নলিখিত অনুচ্ছেদে যেভাবে বিশেষ উদাহরণ দেয়া হয়েছে সেরূপ বিশেষ উদাহরণ দিলে কি অবস্থাটা আরো স্পষ্ট হত না?
খ্যাতনামা আইনজীবী স্যামুয়েল উটার মেয়ার ও শ্ৰাক্স স্টেওয়ার-এর বার্ষিক আয় দশ লাখ ডলারেরও বেশি। জেক ডেমসের বার্ষিক আয় পাঁচ লাখ ডলারের বেশি। অশিক্ষিত নিগ্রো গায়ক জো লুইসের বয়স মাত্র ২২ বছর হলেও তার বার্ষিক আয় পাঁচ লাখ ডলারের বেশি। বার্লিনের নায়ক ইভিং এর বার্ষিক আয় পাঁচ লাখ ডলার। সিডনী কিংমলী তাঁর নাটকের জন্যে সপ্তাহে ১০ হাজার ডলার রয়েলটি পান। এইচ. জি, ওয়েলস তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন যে, তিনি তার লেখনী থেকে অর্থাৎ প্রকাশিত বই থেকে ত্রিশ লাখ ডলার পেয়েছেন। দিয়োগো বাইভেরা তাঁর ছবি থেকে বার্ষিক পাঁচ লাখ ডলার আয় করতেন। কেথারিন কর্নেল কখনো সপ্তাহে পাঁচ হাজার ডলারে মঞ্চে অভিনয় করতে সম্মত হতেন না।
সুতরাং বক্তব্য হওয়া উচিত বিশেষ উদাহরণ মূলক। নির্দিষ্ট বিশেষ বিষয়ক। এরূপ হলে শ্রোতাদের কাছে তা শুধু স্পষ্ট হয় না, শ্রোতা তা পরিষ্কার বুঝতে পারেন, আগ্রহী হয়।
একেবারে অধিক পয়েন্ট বলবেন না :
শিক্ষকদের এক সমাবেশে বক্তৃতা প্রসঙ্গে অধ্যাপক উইলিয়াম জেমস একদা বলেছিলেন যে, একজন বক্তা একবার বক্তৃতায় শুধুমাত্র এক পয়েন্ট আলোচনা করতে পারেন এবং একটি পয়েন্ট ভিত্তিতে একঘণ্টা ধরে বক্তৃতা করা সম্ভব। সম্প্রতি আমি একজন বক্তাকে দেখেছি যিনি স্টক ওয়াচ সম্পর্কে তিন মিনিট বলার পর বলেন যে তিনি আরো এগারোটি পয়েন্ট আলোচনা করবেন। এটা কোনো বুদ্ধিমান বক্তার জন্যে সঠিক বা যথোপযুক্ত নয়। এই ধরনের বক্তব্য হয় ভাসা-ভাসা। পাঁচক যে ভাবে মানুষকে প্যারিস দেখায় এটিও সেরূপ বক্তব্য। এটা আমেরিকার মানবিক ইতিহাসের জাদুঘর ত্রিশ মিনিট ধরে পরিভ্রমণের মতো। এতে সব কিছু পরিষ্কার হয় না, তেমন আনন্দও পাওয়া যায় না। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বক্তা অনেক কিছু বলতে চান বলে বক্তব্য পরিষ্কার হয় না। তিনি এক পয়েন্ট থেকে অন্য পয়েন্টে সরে যান, কোনো পয়েন্টই ক্লিয়ার করতে পারেন না।
কাপড় অনুযায়ী কোট তৈরির মতো বক্তব্য সংক্ষিপ্ত হওয়া উচিত। উদাহরণ স্বরূপ আপনি যদি শ্রমিক ইউনিয়ন সম্পর্কে বলতে চান তাহলে কীভাবে শ্রমিক ইউনিয়নের জন্ম হল, কীভাবে ইউনিয়ন কাজ করে, তারা কী ভালো করেছেন, কীভাবে খারাপ কাজ প্রতিরোধ করেছেন, কীভাবে শিল্পবিরোধ মীমাংসা করা যায় তার সব কিছু বলবেন না। আপনি যদি সেভাবে সব কিছু বলতে চান কেহই আপনার বক্তব্য পরিষ্কার বুঝবেন না। এরূপ বললে বিষয় পরিষ্কার না হয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে।
শ্রমিক ইউনিয়ন সম্পর্কে একটি পয়েন্ট বলে তা পরিষ্কার করার, শ্রোতাদের বোধগম্য করার চেষ্টা করা কি শ্রেয় নয়? হ্যাঁ, এটাই উত্তম পন্থা। এই ধরনের বক্তব্য শ্রোতাদের মনে প্রভাব বিস্তার করে। এধরণের বক্তব্য হয় আকর্ষণীয়, অর্থবহ এবং তা সহজে স্মরণ রাখা যায়।
যা হোক, আপনি যদি আপনার বক্তব্যে বহু পয়েন্ট ব্যাখ্যা করতে যান তবে তা পরিশেষে সংক্ষেপে বলুন, সংক্ষিপ্ত ভাবে বললে অবশ্য শ্রোতাদের বুঝতে এবং মনে রাখতে কিছুটা সহজতর হতে পারে।
সংক্ষিপ্ত সার :
(১) কোনো বিষয় সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং জটিল ও যিশুখ্রিস্ট বলেছিলেন যে, তাহাকে উদাহরণ দিয়ে বক্তব্য পেশ করতে হয়। কারণ, তাঁর শ্রোতারা দেখেও দেখে না, শুনেও শোনে না এবং বুঝেও বোঝে না।
(২) যিশুখ্রিস্ট দৃশ্য বিষয় উল্লেখ করে অদৃশ্য জিনিস সম্পর্কে বোঝাতেন। স্বর্গের কথা বোঝাতে তিনি বলতেন যে স্বর্গ রাজ্য হচ্ছে এমন স্থান যেখানে মূল্যবান সম্পদের কোনো অভাব নেই। আলাস্কার কথা বোঝাতে হলে তার আকার এবং জনসংখ্যার কথা না বলে যেখানে দাঁড়িয়ে আপনি কথা বলছেন তার সাথে তুলনা করুন।
(৩) সাধারণ জনসমাবেশে বক্তৃতা কালে কারিগরি বিষয় পরিহার করুন। লিংকনের মতো সহজ সরল ভাষায় কথা বলুন যাতে যে কোনো ছেলে অথবা মেয়ে সহজে তা বুঝতে পারে।
(৪) যে বিষয়টি সম্পর্কে আপনি বলবেন সে বিষয়টি আপনার মনে দিবালোকের মতো পরিষ্কার কিনা সে সম্পর্কে নিশ্চিত হোন?
(৫) সম্ভব ক্ষেত্রে ছবি, কার্টুন প্রভৃতি প্রদর্শন করুন। যা বলবেন তা নিশ্চিত ভাবে বলুন। শেয়ালের কথা বোঝাতে কুকুর এর কথা উল্লেখ করবেন না।
(৬) কোনো বিষয় পুনরুল্লেখ করবেন না, একটা ফ্রেজ দু’বার ব্যবহার করবেন না। তবে যা বলবেন তা গুরুত্ব দিয়ে বলুন।
(৭) উদাহরণ দিয়ে আপনার বক্তব্য পরিষ্কার করুন। এই ক্ষেত্রে বাস্তব ও দৃষ্টিগোচর উদাহরণ দিন।
(৮) বহু পয়েন্ট আলোচনা করবেন না। সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় এক বা দুটি পয়েন্টের বেশি আলোচনা করা যায় না।
(৯) পরিশেষে আপনার আলোচনার সংক্ষিপ্ত সার উপস্থাপন করুন।