১০.
আজও সুবিনয় আন্ডারওয়্যার আর গেঞ্জি পরা চেহারা নিয়ে তার ফ্ল্যাটের বাইরের ঘরের সোফায় চিতপাত হয়ে পড়ে ছিল। সামনে সেন্টার টেবিলে টেপ-রেকর্ডার চলছে।
রেকর্ড শেষ হলে সুবিনয় ধোঁয়া ছেড়ে বলল, নট ব্যাড। তবে আর-একটু ডিরেক্ট অ্যাপ্রোচ না করলে ম্যাচিওর করতে দেরি হবে।
সুবিনয় খোলা জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। হাতে নিট হুইস্কির গেলাস। টপ করে তলানিটুকু গিলে ফেলে আমার দিকে ফিরে বলল, শোন উপল, প্রেমের ভান করলে হবে না। ইউ হ্যাভ টু ফল ইন লাভ উইথ হার। সিরিয়াসলি।
শ্বাস ফেলে বললাম, চেষ্টা করব।
পরশুর অ্যাসাইনমেন্টটা মনে আছে তো? মেট্রোতে।
আমি মাথা নাড়লাম। মনে আছে।
মেট্রোতে সোয়া ছ’টার শোতে পাশের সিটে সুবিনয়ের বদলে আমাকে দেখে ক্ষণা অবাক। বলল, ও কোথায়?
আমি কৃচ্ছসাধনের মতো করে হেসে বললাম, মিটিং
আবার মিটিং। কিন্তু তা বলে ওর বদলে আপনাকে কেন পাঠাল বলুন তো!
নইলে একটা টিকিট নষ্ট হত।
না হয় বেচে দিত।
বাড়ি ফেরার জন্য আপনার একজন এসকর্টও তো দরকার। যখন শো ভাঙবে তখন হয়তো ভিড়ে আপনি বাসে-ট্রামে উঠতেই পারবেন না। তার ওপর আপনি আবার একা ট্যাক্সিতে উঠতে ভয় পান।
ক্ষণার মুখখানা রাগে ক্ষোভে অভিমানে ফেটে পড়ছিল। খানিক চুপ করে থেকে আস্তে করে বলল, ওর সময় কম জানি। কিন্তু এত কম জানতাম না।
এ সময়টায় কথা বলা বা সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা বোকামি। আমি ক্ষণাকে সুবিনয় সম্বন্ধে ভাবতে দিলাম। আজও আমার কাঁধে ঝোলানো একটা শান্তিনিকেতনি চামড়ার ব্যাগ। তাতে টেপ-রেকর্ডার। ব্যাগে হাত ভরে সুইচে সতর্ক আঙুল ছুঁইয়ে রেখেছি।
অনেকক্ষণ বাদে বললাম, পান খাবেন?
ও মাথা নাড়ল। খাবে না।
আরও খানিক সময় ছাড় দিয়ে বললাম, খিদে পেয়েছে, দাঁড়ান কাজুবাদাম কিনে আনি। শো শুরু হতে আরও পাঁচ মিনিট বাকি।
বলে উঠে আসছি, ক্ষণাও সঙ্গে সঙ্গে উঠে এসে আমার পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বলল, বাইরে কোথাও চা পাওয়া যাবে?
গলার স্বরে বুঝলাম, একটু সময়ের মধ্যেই কখন যেন ও একটু কেঁদে নিয়েছে। গলাটা সর্দি লাগার মতো ভার।
যাবেন? চলুন।
বাইরের একটা রেস্টুরেন্টে ক্ষণাকে বসিয়ে বললাম, একটু তাড়াতাড়ি করতে হবে, সময় বেশি নেই।
ও মাথা নেড়ে বলে, আমি ছবি দেখব না। ভাল লাগছে না।
তা হলে?
আপনি দেখুন। আমি চা খেয়ে বাড়ি চলে যাব।
আমি ওর দিকে চেয়ে থাকি। জীবনে কোনও কাজই আমি শেষ পর্যন্ত করে উঠতে পারিনি। এটাও কি পারব না?
একটু ভেবে বলি, এ সময়টায় ট্রামে বাসে উঠতে পারবেন না। বরং একটু বসে বা বেড়িয়ে সময়টা কাটিয়ে যাওয়া ভাল।
বেয়ারা আসতেই ক্ষণাকে জিজ্ঞেস করলাম, চায়ের সঙ্গে কী খাবেন? আজ আমি খাওয়াব।
ক্ষণা অবাক চোখে আমার দিকে চেয়ে বলল, আপনি খাওয়াবেন? কেন, চাকরি পেয়েছেন না কি?
পেয়েছি। মৃদু হেসে বললাম।
কবে পেলেন? কই, চাকরিতে যেতেও তো দেখি না আপনাকে।
একটা শ্বাস ফেলে বললাম, সব চাকরিতে কি আর দূরে যেতে হয়। এই ধরুন না, আপনার সঙ্গে বসে থাকাটাও তো একটা চাকরি হতে পারে।
ক্ষণা কথাটার একটু অন্য রকম মানে করে বলল, আমার সঙ্গে বসে থাকাটা যদি চাকরি বলেই মনে হয় তবে বসে থাকবার দরকার কী?
কথাটা দারুণ রোমান্টিক। টেপ-রেকর্ডারটা চালু আছে ঠিকই, তবু ভয় হচ্ছিল কথাটা ঠিকমতো উঠবে তো! ব্যাটারি কিছুটা ডাউন আছে। সুবিনয় নতুন ব্যাটারি কিনে লাগিয়ে নিতে বলেছিল। আমি ব্যাটারির টাকাটা কিছু বেশি সময় সঙ্গে রাখবার জন্য কিনিনি। যতক্ষণ টাকার সঙ্গ করা যায়। এই সুদিন তো চিরস্থায়ি নয়।
আমি আনন্দে প্রায় স্খলিত গলায় বললাম, চাকরি কী বলছেন? আপনার সঙ্গে এ রকম বসে থাকার চাকরি হয় তো আমি রিটায়ারমেন্ট চাই না।
ক্ষণা রাগ করল না। একটু হেসে বলল, আপনার আজকাল খুব কথা ফুটেছে।
হৃদয় ফুটে উঠলেই মুখে কথা আসে।
এটা পেনাল্টি শট। গোল হবে তো!
ক্ষণা মাথাটা উঁচু রেখেই বলল, হৃদয় ফোটাল কে?
বোঝেন না?
না তো!
তা হলে থাক।
গোল হল কি না তা বুঝবার জন্য আমি উগ্র আগ্রহে ওর মুখের দিকে চেয়ে ছিলাম।
আমাদের কথাবার্তা বলতে দেখে বেয়ারা চলে গিয়েছিল। আবার এল। বিরক্ত হয়ে বললাম, দুটো মাটন রোল, আর চা।
বেয়ারা চলে গেল। তখন হঠাৎ লক্ষ করি, ক্ষণার মুখখানা নত হয়েছে টেবিলের দিকে। নিজের কোলে জড়ো করা দুখানা হাতের দিকে চোখ নেমে গেল।
গোল! গোল! গোল।
আনন্দে বুক ভেসে যাচ্ছিল আমার। দুইদিনে অগ্রগতির পরিমাণ সাংঘাতিক। আমার ইচ্ছে করছিল, এক্ষুনি সুবিনয়ের ফ্ল্যাটে ছুটে গিয়ে ওকে বিবরণটা শোনাই।
কিন্তু তা তো হয় না। তাই বসে বসে মাটন রোল খেতে হল। ক্ষণা মৃদু আপত্তি করে অবশেষে খেল আধখানা। বাকি আধখানা প্লেটে পড়ে ছিল, আমি তুলে নিলাম। দামি জিনিস কেন নষ্ট হয়?
ক্ষণা বলল, এ মা, পাতেরটা খায় নাকি?
সকলের পাতেরটা খাব আমি তেমন কাঙাল নই। তবে কারও পাতের জিনিস আমার খুব প্রিয় হতে পারে।
যাঃ–ক্ষণা বলল, আপনি একটা কীরকম যেন। আগে কখনও এত মজার কথা বলতেন না তো।
আপনাকে ভয় পেতাম।
কেন, ভয়ের কী?
সুন্দরী মেয়েদের আমি বরাবর ভয় করি।
যাঃ! আমি নাকি সুন্দরী!
প্রতিবাদ করলেও কথাটা ওর মনের মধ্যে গেঁথে গেছে, টের পাই।
ট্যাক্সিতে ফেরার সময়ে আমি বিস্তর মজার কথা বললাম। সুবিনয় মেট্রোয় আসেনি বলে যে দুঃখ ছিল ক্ষণার তা ভুলে গিয়ে ও খুব হাসতে লাগল।
বলল, বাবা গো, হাসতে হাসতে পেটে ব্যথা ধরে গেল।
ক্ষণাকে পৌঁছে দিয়ে সুবিনয়ের ফ্ল্যাটে এসে দেখি সুবিনয় বেশ খানিকটা মাতাল হয়ে বসে আছে। আমাকে দেখে বলল, সামথিং নিউ বাডি?
আমি অনেকটা মার্কিন অনুনাসিক স্বরে বললাম, ইয়াপ।
সুবিনয় টেপ-রেকর্ডারের জন্য হাত বাড়িয়ে বলল, হেল অফ এ গুড।
টেপ শোনা হয়ে গেলে সুবিনয় মাথা নেড়ে বলল, কাল থেকে ওকে তুমি তুমি করে বলবি। আর-একটু ইন্টিম্যাসি দরকার। ইঁদুরের বিষটা আমি প্রায় তৈরি করে ফেলেছি। ভিসা পেয়ে যাচ্ছি শিগগির। স্টেটসের চারটে বিগ অ্যাপয়েন্টমেন্ট এসে পড়ে আছে। মেক ইট হেসটি চাম। কাল কোথায় যেন?
চিড়িয়াখানা। সেখানে প্রথম ফোটোগ্রাফ নেওয়ার চেষ্টা করব।
সুবিনয় চিন্তিত হয়ে বলে, বাট দ্য চিলড্রেন উইল বি দেয়ার। দোলন আর ঘুপটু।
তাতে কী! ওদেরও তুলব, আমাদেরও তুলব।
দ্যাটস এ গুড বয়।
পরদিন চিড়িয়াখানায়। আমি আর ক্ষণা পাশাপাশি হাঁটছি। দোলন আর ঘুপটু হাত ধরাধরি করে সামনে। ক্ষণা ঘড়ি দেখে বলল, এখনও দোলনের বাবা আসছে না কেন বলুন তো! বেলা দুটোর মধ্যে আসবে বলেছিল।
আসবে। আচ্ছা ক্ষণা, আপনার বয়স কত?
মেয়েদের বয়স জিজ্ঞেস করা অভদ্রতা না! মৃদু হেসে ক্ষণা বলে।
আমি আগের থেকে অনেক সাহসী আর চতুর হয়েছি। ঠিক সময়ে ঠিক কথা মুখে এগিয়ে আসে।
সিরিয়াস মুখ করে বলি, আপনাকে এত বাচ্চা দেখায় যে, ছেলেমেয়ের মা বলে বোঝা যায় না।
আপনি আজকাল খুব কমপ্লিমেন্ট দিতে শিখেছেন দেখছি!
ক্ষণা একটু বিরক্তির ভান করে বলল। ভান যে সেটা বুঝলাম ওর চোখের তারায় একটু চিকিমিকি দেখে।
এটা কি কমপ্লিমেন্ট?— আমি উদবেগ চাপতে পারি না গলার স্বরে।
ক্ষণা হেসে বলে, মেয়েরা এ সব বললে খুশি হয় সবাই জানে। কিন্তু আমার বয়স বসে নেই উপলবাবু। পঁচিশ চলছে।
আমি একবার ক্ষণার দিকে পাশ চোখে তাকিয়ে দেখলাম। দুঃখের বিষয়, ক্ষণাকে পঁচিশের চেয়ে বেশিই দেখায়।
আমি খুব বাজে অভিনেতার মতো অবাক হওয়ার ভাব করে বললাম, বিশ্বাস করুন, অত মনেই হয় না। বাইশের বেশি একদম না। আমার কত জানেন?
সত্যিকারের বয়সের ওপর আরও চার বছর চাপিয়ে বললাম, চৌত্রিশ।
ক্ষণা অবাক হয়ে বলে, কী করে হয়? আপনার বন্ধুর বয়স তো মোটে ত্রিশ, আপনারা তো ক্লাসফ্রেন্ড? একবয়সিই হওয়া উচিত।
সে কথায় কান না দিয়ে বললাম, শোনো ক্ষণা, আমার চেয়ে তুমি বয়সে অনেক ছোট। তোমাকে আপনি করে বলার মানেই হয় না।
এটা গিলতে ক্ষণার একটু সময় লাগল। কিন্তু ভদ্রতাবশে সে না-ই বা করে কী করে! তাই হঠাৎ ‘ঘুপটু, ঘুপটু’ বলে ডেকে কয়েক কদম দ্রুত এগিয়ে গেল।
আমি ওকে সময় দিলাম। সিগারেট ধরিয়ে আনমনে ঘাসের ওপর হাঁটি। ডাক্তার দত্ত আমার শরীরের সব চেক-আপ করেছেন। তাঁর মতে আমার অনেক রকম চিকিৎসা দরকার। পেট, বুক, চোখ কিছুই সাউন্ড নয়। দত্ত পেল্লায় ডাক্তার, বিলেতফেরত, আধহাত ডিগ্রি, পুরো সাহেবি মেজাজের লোক। আমাকে দেখেই প্রথম দিন বলে দিয়েছিলেন, ব্লাড, ইউরিন, স্টুল, স্পুটাম সব পরীক্ষা করিয়ে তবে আসবেন। সে এক বিস্তর ঝামেলার ব্যাপার। সব রিপোর্ট দেখে দেখে পরে একদিন বললেন, ম্যালনিউট্রিশনটাই মেইন। এই বলে অনেক ওষুধপত্র, টনিক লিখে দিলেন। এক কোর্স ইঞ্জেকশন নিতে হচ্ছে। পেরিয়াকট্রিন ট্যাবলেট খেয়ে খিদে আরও বেড়েছে। ঘুমও। অল্প একটু মোটা হয়েছি কি! আত্মবিশ্বাসও যেন আসছে!
পাখির ঘর দেখা হয়ে গেলে আমরা জলের ধারে এসে বসলাম। ক্ষণা আর বাচ্চাদের গুটি ছয়-সাত ছবি তোলা হয়ে গেছে। কিন্তু এখনও ভাইটাল ছবিটা বাকি। ক্ষণার আর আমার একটা। যুগল ছবি। এভিডেন্স।
দোলন আর ঘুপটু টিফিন বাক্স খুলে ছানা আর বিস্কুট খাচ্ছে। রোদে ঘুরে ঘুরে ওদের মুখ-চোখ লাল, আনন্দে ঝিকিমিকি চোখ। ক্ষণা একটু দুশ্চিন্তার ভাব মুখে মেখে শ্রান্ত গা ছেড়ে দিয়ে বসে থেকে বলল, উপলবাবু, আজও ও এল না। আজকাল একটা অ্যাপয়েন্টমেন্টও রাখছে না। কেন বলুন তো?
কাজের মানুষ। বলতে বলতে আমি চার দিকে আলোর পরিমাপ দেখে ক্যামেরার অ্যাপারচার ঠিক করি, শাটারের স্পিড নির্ণয় করি। সবই আনাড়ির মতো। ঠিকঠাক করে ক্ষণাকে বললাম, তোমার এই দুঃখী চেহারাটা ছবিতে ধরে রাখি।
এই বলে টাইমার টেনে দিয়ে ক্যামেরাটা একটু দূরে ফ্লাক্সের ওপর সাবধানে উঁচুতে বসাই। শাটার টেপার পর মাত্র দশ সেকেন্ড সময়। তার মধ্যেই আমাকে দৌড়ে গিয়ে ক্ষণার পাশে বসতে হবে।
একটু দ্বিধায় পড়ে যাই। আমি ওর পাশে বসব গিয়ে, সেটা কি ওকে আগে বলে নেব? না কি আচমকা ঘটাব কাণ্ডটা! ব্যাপারটা যদি ও পছন্দ না করে? যদি শেষ মুহূর্তে সরে যায়!
ক্ষণা হতাশ গলায় বলল, ছবি তুলে কী হবে? আমার অনেক ছবি আছে।
আমার নেই। আমি বললাম। কথাটা সত্যি। ছেলেবেলায় বৈকুণ্ঠ ফোটোওলা তুলেছিল, বড় হয়ে আর ছবি তোলা হয়নি।
ক্ষণা হাত বাড়িয়ে বলল, ক্যামেরাটা দিন, আমি আপনার ছবি তুলে দিচ্ছি।
আমি ভিউ ফাইন্ডারে ক্ষণাকে খুব যত্নে ফোকাস করছিলাম। ওর বাঁ দিকে একটু জায়গা ছেড়ে দিলাম যাতে আমার ছবি কাটা না পড়ে যায়। বেশ খানিকটা দূর থেকে তুলছি, কাটা পড়বে না। তবু ভয়।
ও ছেলেমানুষের মতো ক্যামেরার জন্য হাত বাড়িয়ে আছে। হাসি মুখে বলছে, আমি অবশ্য আনাড়ি। আপনি সব যন্ত্রপাতি ঠিক করে দিন, আমি শুধু শাটার টিপব।
হঠাৎ মাথায় বুদ্ধি চিড়িক দিয়ে উঠল। ক্যামেরায় যে সেলফ টাইমার আছে তা ক্ষণার জানার কথা নয়। পৃথিবীর খুব বেশি কিছু জানা নেই ক্ষণার। আমি শাটার টিপে উঠে গিয়ে ওর পাশে বসলে ও হয়তো টেরও পাবে না যে ছবি উঠল।
কিন্তু অসম্ভব নার্ভাস লাগছিল শেম মুহূর্তে। পারব তো! ক্ষণা কিছু সন্দেহ করবে না তো!
ভাবতে ভাবতেই শাটারটা টিপে দিলাম। চিড় চিড় করে টাইমার চলতে শুরু করে। আমি দ্রুত পায়ে জমিটা পার হয়ে ক্ষণার কাছে চলে আসি।
কিন্তু সময়টা ঠিকমতো হিসেব করা হয়নি। যে মুহূর্তে আমি ক্ষণার পাশে এসে হুমড়ি খেয়ে বসেছি ঠিক সেই সময়ে দোলন আধখানা কেক হাতে দৌড়ে এসে ক্ষণার ঘাড়ের ওপর উপুড় হয়ে কানে কানে বলল, মা। বাথরুমে যাব।
টাইমারের শেষ ক্লিক শব্দটা শুনতে পেলাম। হতাশা।
ক্ষণা উঠে গিয়ে দোলনকে বাথরুম করিয়ে আনল। ততক্ষণে আমি ক্যামেরাটা আবার তৈরি করে রেখেছি।
ক্ষণা এসে ঘাসের ওপর রাখা ব্যাগ, টিফিন বাক্সর পাশে তার আগের জায়গায় বসল। কিন্তু এবার তার কোলে এসে বসল ঘুপটু। অসম্ভব অধৈর্য বোধ করতে থাকি।
দোলন জলের ধারে গিয়ে হাঁস দেখে। ঘুপটু একটু বাদে তার দিদির পাশে গিয়ে দাঁড়াল। ক্ষণা ব্যাগট্যাগ গোছাতে গোছাতে বলে, ওর আজও বোধহয় মিটিং। এল না। চলুন, আমরা চলে যাই।
আমি দাঁতে দাঁত টিপে রাখি। এবার আমাকে সত্যিই বেপরোয়া কিছু করতে হবে। সময় চলে যাচ্ছে।
হিংস্র আঙুলে শাটারটা টিপে টাইমার চালু করেই আমি দুই লাফে ক্ষণার পাশে এসে পড়ি। ক্ষণা অবাক হওয়ারও সুযোগ পায় না। আমি ক্ষণার গালে গাল ঠেকিয়ে বসেই ওর কাঁধে হাত রেখে বলি, ক্ষণা, দেখো!
ক্ষণা আমার দিকে অবাক মুখ ফিরিয়ে বলল, কী দেখব?
ওই যে, একটা অদ্ভুত পাখি উড়ে গেল।
ক্ষণা খুব বিস্মিত, বিরক্ত। আমি ক্ষণার কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে বললাম, বোধহয় চিড়িয়াখানার সেই ম্যাকাও পাখিটা পালিয়ে গেল।
ক্ষণা সরে বসে ব্যাগ গোছাতে গোছাতে বলল, আপনার কী হয়েছে বলুন তো? এমন সব কাণ্ড করছেন।
অনেকক্ষণ আগে সেলফ টাইমার শেষ হয়েছে। আমার সারা শরীরে ঘাম দিচ্ছে। হাত পা কাঁপছে উত্তেজনায়। অবসাদে শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে।
.
পরদিন প্রিন্টটা দেখল সুবিনয়। ছবিটা ব্লো-আপ করা হয়েছে বিরাট করে।
নট ব্যাড চাম। ইউ হ্যাভ মেড প্রোগ্রেস। – বলে হাসল।
ছবিটা অসম্ভব ভাল হয়েছে। পিছনে মস্ত একটা খেজুর গাছের মতো ঝুপসি গাছ, সেই পটভূমিতে আমাদের স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আমার গালের সঙ্গে প্রায় ছুঁয়ে ক্ষণার গাল, ওর কাঁধে আমার হাত। দু’জনেই দুজনের দিকে হেলে বসে আছি। কী সাংঘাতিক স্ক্যান্ডালাস ছবি! অথচ কত মিথ্যে!
সুবিনয় হুইস্কির গেলাস হাতে নিয়ে ঘরের এক কোণ থেকে অন্য কোণ পর্যন্ত পায়চারি করছিল। মুখে মৃদু একটু হাসি, আর অন্যমনস্কতা। এক সময়ে দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল, হ্যাভ ইউ ফলেন ইন লাভ উইথ হার বাড়ি?
আমি মাথা নেড়ে বললাম, জানি না।
ইউ লুক ডিফারেন্ট। কাঁধ ঝাঁকিয়ে সুবিনয় বলে।
আমি শ্বাস ছাড়লাম। হয়তো সত্যিই আমাকে অন্য রকম দেখাচ্ছে। আমি কি একটু মোটা হয়েছি! আজকাল ঘুম হয়। খিদের চিন্তায় কষ্ট পাই না।
ঠিক আগের দিনের মতো সুবিনয় আজও একশো টাকার পাঁচখানা নোট ছুড়ে দিল আমার দিকে। বলল, এক্সপেন্সেস।
মাথা নাড়লাম। উত্তেজনায় শরীর গরম হয়ে ওঠে।
জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে চেয়ে হাঃ করে সুবিনয় একটা শব্দ করল। তারপর বলল, আমি কাউকে বিশ্বাস করি না উপল। আই বিলিভ নান, অ্যান্ড দ্যাট মেকস মি ভেরি লোনলি।
কথাটা আমি বুঝতে পারলাম না। কিন্তু চিন্তা করতে লাগলাম। অনেকক্ষণ ধরে চিন্তা করলাম। তারপর উঠে চলে এলাম এক সময়ে। সুবিনয় এখন অনেক রাত পর্যন্ত মদ খাবে।
দু দিন পর সুবিনয় তার সুটকেস গুছিয়ে দিল্লি গেল। আসলে কোথাও গেল না। শুধু আমি জানলাম, সুবিনয় সাউথ এন্ড পার্কের ফ্ল্যাটে ক’দিন লুকিয়ে থাকবে। আমাকে গোপনে বলল, নাউ ইউ উইল বি ইন এ ফ্রি ওয়ার্ল্ড। বোথ অব ইউ।
দীর্ঘ খরার পর সেই রাতে অসম্ভব বৃষ্টি নামল। কী যে প্রবল বৃষ্টি। গ্রিলের ফাঁক দিয়ে অবিরল ছাঁট আসতে লাগল। ঘুমের চটকা ভেঙে উঠে বসলাম। গহিন মেঘ সিংহের মতো ডাকছে। জলপ্রপাতের মতো নেমে আসে জল।
বিছানা গুটিয়ে প্যাকিং বাক্সগুলো যত দূর সম্ভব দেওয়ালের দিকে সরিয়ে আনতে থাকি। একটু-আধটু শব্দ হয়। বিছানাটা পেতেও কিন্তু শোয়া হয় না, বৃষ্টির ছাঁট হু হু করে সমস্ত বারান্দাকে ছেয়ে ফেলছে।
আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে চুপ করে বসে থাকি বাতি নিবিয়ে। কিছু করার নেই। ঝড় বৃষ্টি আমাকে অনেক বার সহ্য করতে হয়েছে। আজও বসে বসে গাড়লের মতো ভিজতে থাকি।
সুবিনয় আর ক্ষণার ঘরের দরজা খোলবার শব্দ হল। আমার পাঁজরার নীচে ভিতু খরগোশের মতো একটা লাফ দিল হৃৎপিণ্ড। কোনও কারণ নেই। তবু।
ঘরের আলোয় দরজার চৌখুপিতে ক্ষণা ছায়ামূর্তির মতো দাঁড়িয়ে অন্ধকারে বারান্দাটা একটু দেখে নিয়ে সাবধানে ডাকল, উপলবাবু।
ক্ষীণ উত্তর দিলাম, উ!
আপনি কোথায়?
এই তো।
ক্ষণা বারান্দার আলো জ্বেলে আমাকে দেখে অবাক হয়ে বলল, এ কী! ছাঁট আসছে না কি!
মৃদু হেসে বললাম, ও কিছু নয়। বৃষ্টি থেমে যাবে।
ক্ষণা হাত বাড়িয়ে বাড়িয়ে বারান্দার বৃষ্টির ঝাপটা দেখল, আমার বিছানায় একবার হাত ছুঁইয়েই বলল, এ মা! বিছানাটা ভিজে গেছে।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, একটু।
একটু নয়, ভীষণ ভিজে গেছে। এ বিছানায় কেউ শুতে পারে না।
এ কথার উত্তর হয় না। চুপ করে থাকি।
ক্ষণা খুব সহজভাবে বলল, আপনার বন্ধুর বিছানা তো খালি পড়ে আছে, আপনি ঘরে এসে শোন। আমি আমার শাশুড়ির ঘরে যাচ্ছি।
কেঁপে উঠে বলি, কী দরকার!
আসুন না!
সন্তর্পণে উঠে আলো-জ্বলা ঘরের উষ্ণতায় চলে আসি। বগলে বিছানা। কাঁধের ব্যাগে গুপ্ত টেপ-রেকর্ডার। সুইচ টিপে রেকর্ডার চালু করি। ঠিক এ রকমটাই কি সুবিনয় চেয়েছিল? ওর ইচ্ছাপূরণ করতেই কি বৃষ্টি নামল আজ!
ক্ষণা দরজা বন্ধ করে দিয়ে বলল, ও এত বড় চাকরি করে, তবু এই বিচ্ছিরি বাসায় যে কেন থাকা আমাদের বুঝি না। একটা এক্সট্রা ঘর না থাকলে কি হয়! ছেলেমেয়ে বড় হচ্ছে, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব আসছে যাচ্ছে। কেন এ বাসা ছাড়ে না বলুন তো?
ছাড়বে।–সংক্ষেপে বললাম।
ছাড়বে, আমি মরলে।
ক্ষণা সুবিনয়ের শূন্য বিছানার স্ট্যান্ডে দ্রুত হাতে মশারি টাঙিয়ে দিল। তারপর নিজের বিছানা থেকে বালিশ আর ঘুমন্ত ঘুপটুকে কোলে নিয়ে বলল, দোলন রইল।
থাক।
আসছি। বলে ও ঘরে গেল ক্ষণা। আলো জ্বালাল। শাশুড়ির সঙ্গে কী একটু কথা বলল সংক্ষেপে। আবার এসে দোলনের পাশে বালিশ ঠেস দিয়ে বলল, বড় ছটফট করে মেয়েটা। পাশ ফিরতে গিয়ে পড়ে না যায়।
ক্ষণা?–আমি ডাকলাম।
বলুন।
এত কাণ্ড না করলেই চলত না? আমি তো বরাবর বারান্দায় শুই। শীতে, বর্ষায়।
ক্ষণা হঠাৎ সোজা হয়ে আমার দিকে তাকাল। মুখখানা লজ্জায় মাখানো। আস্তে করে বলল, দোষ কি শুধু আমার? আপনার বন্ধু কেন এইটুকু ছোট্ট বাসায় থাকে?
বাসাটা ছোট নয়। আমি জানি, ইচ্ছে করলে বাইরের ঘরের মেঝেতেও ওরা আমাকে শুতে বলতে পারত। বলেনি। আর আজ কত আদর করে বাড়ির কর্তার বিছানা ছেড়ে দিচ্ছে আমাকে। আমি হেসে বললাম, তবে কি আমি থাকব বলেই তোমাদের একটা বড় বাসা দরকার ক্ষণা?
শুধু সেজন্যই নয়। কত জিনিসপত্রে ঠাসাঠাসি আমাদের ঘর দেখছেন না? বাচ্চাদের একটা পড়াশুনো করার ঘর নেই।
এগুলো কাজের কথা নয়। আমি বললাম, আমার তো এ বাড়িতে থাকবার কথা নয়। অনেক দিন হয়ে গেল। তুমি কষ্ট করছ দেখে মনে হচ্ছে, আর এখানে আমার থাকা ঠিক হচ্ছে না।
ক্ষণা মৃদু হেসে বলল, থাক, এত রাতে আর কাব্য করতে হবে না। ঘুমোন।
ক্ষণা, আমার ধারণা ছিল তুমি আমাকে একদম দেখতে পারো না। তোমাকে ভীষণ অহংকারী বলে মনে হত।
ক্ষণা একটু ইতস্তত করে বলল, আপনাকেও আমার অন্য রকম মনে হত যে।
কীরকম?
মনে হত, আপনি ভীষণ কুঁড়ে।
এখন?
এখন অন্য রকম।
কীরকম ক্ষণা?
খুব মজার লোক। বলে ক্ষণা হাসল। বেশ হাসিটি। চমৎকার দেখাল ওকে।
কবে থেকে?
যেদিন সেই হনুমানের নাচ দেখিয়েছিলেন। ও মা, আমি তো দেখে অবাক! ওইরকম একটা ভিতু গোছের লোক যে অমন কাণ্ড করতে পারে ধারণাই ছিল না।
আমি কি কেবলই মজার লোক?
ভীষণ মজার।
করুণ মুখ করে বলি, তার মানে কি আমার ব্যক্তিত্ব নেই?
ক্ষণা হাই তুলে বলল, পরে বলব।
চলে গেল।