১০. আধুনিক প্রকৃতিগত সমরূপতা

অধ্যায় ১০ আধুনিক প্রকৃতিগত সমরূপতা

নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, আমেরিকায় ইউরোপীয় পর্যটকগণ দুটি বিশেষত্ব দেখে চমকে ওঠেন; প্রথমত, গোটা যুক্তরাষ্ট্রের (পুরাতন দক্ষিণাঞ্চল বাদে) সর্বত্র দৃষ্টিভঙ্গির একেবারে অনুরূপতা, দ্বিতীয়ত, প্রত্যেক লোকালয়ের আসক্তিপূর্ণ অভিলাষ এটা প্রমাণ করা যে তাদের এলাকা বিশিষ্ট এবং অন্য যে কোনো এলাকা থেকে ভিন্ন। অবশ্য দ্বিতীয়টির কারণ প্রথমটি। প্রত্যেক জায়গা স্থানীয় গরিমা বোধের কারণ থাকুক এই বাসনা পোষণ করে। সুতরাং ঐতিহাসিক কিংবা ঐতিহ্যগত বিশিষ্টতা থাকলে তারা সেটা খুব যত্নের সঙ্গে লালন করেন। বাস্তবে সমরূপতা যত বেশি হয়, বিভিন্নতা খোঁজার আগ্রহ হয় তত প্রবল ঐ সমরূপতা কিছুটা লঘু করার জন্য। পুরাতন দক্ষিণাঞ্চল বস্তুত অবশিষ্ট আমেরিকা থেকে একেবারে আলাদা, এত আলাদা যে একজনের বোধ হয় সে অন্য কোনো দেশে এসেছে। এই অঞ্চল কৃষিভিত্তিক, আভিজাতিক এবং ভূতাপেক্ষ (retrospective)। অথচ বাকি আমেরিকা শিল্পায়ন, গণতান্ত্রিক এবং ভবিষ্যত্মখীন। যখন আমি বলি যে পুরাতন দক্ষিণাঞ্চলের বাইরে আমেরিকা শিল্পায়ত তখন আমি এমন অঞ্চলের কথাও ভাবি যে অঞ্চল প্রায় সামগ্রিকভাবে কৃষিকর্মে নিবেদিত, কারণ মার্কিন কৃষিজীবীদের মানসিকতা শিল্পপতির। তারা অত্যন্ত আধুনিক যন্ত্রপাতি কাজে লাগায়; রেলওয়ে এবং টেলিফোনের উপর তারা খুব বেশি নির্ভরশীল। এই কৃষক দূরের বাজার-ঘাট সম্পর্কে খুব সচেতন, কারণ এসব বাজারে তার পণ্য যায়; সে আসলে পুঁজিবাদী, এমন হতে পারত যে সে অন্য কোনো ব্যবসায় নিয়োজিত। ইউরোপ বা এশিয়ায় আমরা যে ধরনের কৃষক দেখি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তার অস্তিত্ব নেই। এটা আমেরিকার জন্য বিরাট আশীর্বাদ। এবং সম্ভবত ওল্ড ওয়ার্ল্ডের তুলনায় এক্ষেত্রে তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শ্ৰেষ্ঠতা, কারণ অন্যান্য অঞ্চলের কৃষকরা নির্দয়, লোভী, রক্ষণশীল এবং অদক্ষ। আমি সিসিলি এবং ক্যালিফোর্নিয়ার কমলালেবুর কুঞ্জ দেখেছি; বৈসাদৃশ্য দুহাজার ব্যবধানের প্রতিনিধিত্ব করে। সিসিলির কমলালেবুর কুঞ্জ রেল স্টেশন কিংবা নদী-বন্দর থেকে অনেক দূরে অবস্থিত, গাছগুলোতে বার্ধক্যের ছাপ, গাঁটযুক্ত, দেখতে সুন্দর; আবাদের পদ্ধতি একেবারে পুরাকালীন। লোকগুলো অজ্ঞ ও অর্ধ-বর্বর, রোমক ক্রীতদাস এবং আরব্য আক্রমণকারীদের সংকরজাতীয় উত্তরসূরি; গাছ সম্বন্ধে তাদের বুদ্ধিমত্তায় ঘাটতি তারা পুষিয়ে নেয় জীবজানোয়ারের প্রতি নির্দয় আচরণ করে। নৈতিক অধঃপতন এবং আর্থিক ব্যাপারে অযোগ্যতার সহযোগী হয় সহজাত সৌন্দর্যজ্ঞান যা সব সময় একজনকে মনে করিয়ে দিচ্ছে থিওক্রিটাস এবং হেসপিরাইডিসের উদ্যান সম্পর্কিত উপকথা। ক্যালিফোর্নিয়ার কমলালেবু কুঞ্জে এলে হেসপিরাইডিসের উপকথাকে সুদূর অতীতের মনে হয়। সবগুলো গাছ দেখতে একই রকম লাগে। যত্নের ছাপ সুস্পষ্ট, প্রতিটি গাছ সমান দূরত্বে লাগানো। সবগুলো কমলার আকৃতি সমান নয়। কিন্তু যন্ত্র দিয়ে অতি যত্নে বাছাই হবার পর দেখা যায় একটি বাক্সের সবগুলো কমলালেবু সমান আকৃতির। এগুলো উপযুক্ত জিনিসের সঙ্গে উপযুক্ত স্থানে আনা হয়, অতঃপর উপযুক্ত রেফ্রিজারেটর-গাড়িতে ওঠে এবং উপযুক্ত বাজার এদের শেষ গন্তব্যস্থল। যন্ত্র এদের গায়ে Sunkist কথাটা ছাপ মেরে দেয়। অন্যথায় এমন কোনো লক্ষণ খুঁজে পাওয়া যাবে না যে ওদের উৎপাদনে প্রকৃতির কোনো হাত ছিল। উপরন্তু আবহাওয়া পর্যন্ত কৃত্রিম, কারণ যখন উদ্যান কুয়াশায় ছেয়ে যায় তখন উষ্ণ রাখা হয় ধোঁয়ার আবরণ সৃষ্টি করে। এই ধরনের কৃষিকর্মের সঙ্গে যারা যুক্ত তারা পূর্বকালের কৃষিবিদদের মতো অনুভব করে না যে তারা প্রাকৃতিক শক্তিসমূহের দাস; বরং তারা নিজেদের প্রভু মনে করেন, প্রাকৃতিক শক্তিই তাদের ইচ্ছার কাছে নত হয়। ফলে ওল্ড ওয়ার্ল্ডে শিল্পপতি এবং কৃষিবিদদের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে যে তফাত রয়েছে আমেরিকায় সে ধরনের তফাত লক্ষ্য করা যায় না। মার্কিনী পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ মানবিক; তুলনায় অ-মানবিক অঙ্গ তাৎপর্যহীনতায় তলিয়ে যায়। আমাকে সব সময় দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ায় বলা হতো যে আবহাওয়া লোকগুলোকে পদ্মাভুকে পরিণত করেছে। কিন্তু আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে আমি এর কোনো প্রমাণ পাইনি। আমার কাছে তাদের মিনিয়াপলিস এবং ইউনিপেগের লোকদের মতোই মনে হয়েছে। যদিও দুটি অঞ্চলের মধ্যে আবহাওয়া, দৃশ্যাবলি এবং প্রাকৃতিক অবস্থায় প্রভেদ যতটুকু হওয়া সম্ভব তার কম নয়। নরওয়ে এবং সিসিলির লোকদের পার্থক্য বিষয়ে একজন যখন বিবেচনা করেন এবং এর সঙ্গে তুলনা করেন (ধরুন) উত্তর ডাকোটার একজন লোকের সঙ্গে দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার। একজন লোকের প্রভেদের ঘাটতি, তখন একজন উপলব্ধি করেন ভৌত পরিবেশের দাস না হয়ে প্রভু হয়ে তারা মানবিক ব্যাপারে কতটা বিপ্লব সাধন করেছে। নরওয়ে এবং সিসিল, উভয়ের প্রাচীন ঐতিহ্য রয়েছে; তাদের প্রাক-খ্রিষ্টীয় ধর্ম ছিল, যে ধর্মে আবহাওয়ার প্রতি মানুষের প্রতিক্রিয়া বাস্তব রূপ নেয়। তারপর খ্রিষ্টধর্ম আসে এবং অনিবার্যভাবে দুটি দেশে দুই ভিন্নরূপ পরিগ্রহ করে। নরওয়েবাসীরা ভয় করত বরফ ও তুষার; সিসিলির লোকদের ভয় ছিল লাভা ও অগ্নিগিরির প্রতি। নরক উদ্ভাবিত হয়। দক্ষিণাঞ্চলীয় আবহে; নরক যদি নরওয়েতে উদ্ভাবিত হতো, তাহলে সে নরক হতো। হিমশীতল। কিন্তু উত্তর ডাকোটা কিংবা দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ায় নরক আবহাওয়াগত ব্যাপার নয়; উভয় অঞ্চলে এটা টাকার বাজারে গুরুতর চাপ। এতেই বোঝা যায় আধুনিক জীবনে আবহাওয়ার গুরুত্বহীনতা।

আমেরিকা মনুষ্য-নির্মিত জগৎ; উপরন্তু এই জগৎ মানুষই তৈরি করেছে যন্ত্রের সাহায্যে। আমি কেবল ভৌত পরিবেশের কথা ভাবছি না, সমভাবে চিন্তা এবং আবেগ সম্পর্কেও ভাবছি। একবার ভাবুন তো বাস্তবিক ভয়াবহ একটা খুনের কথা; খুনীর পদ্ধতি আদিকালের হতে পারে, কিন্তু যারা খুনের তথ্য প্রচারিত করে তারা সাহায্য গ্রহণ করে বিজ্ঞানের সর্বশেষ উৎস বা উদ্ভাবনের। শুধু বৃহৎ নগরগুলো নয়, প্রেইরি অঞ্চলের নির্জন খামার এবং রকি অঞ্চলের খনির আখড়ায় রেডিও সর্বশেষ সকল তথ্য প্রচার করে, ফল দাঁড়ায় এই যে, যে কোনো দিন দেশের প্রত্যেক বাড়িতে আলাপ আলোচনার অর্ধেক বিষয় হয় অভিন্ন। ট্রেনে সমতলভূমি অতিক্রমের সময়, লাউডস্পীকার থেকে সাবানের বিজ্ঞাপন শোনা যাচ্ছিল, আমি না শোনার চেষ্টা করছিলাম, এক বৃদ্ধ কৃষক আমার কাছে এসে হাসি মুখে বললেন, আপনি যেখানেই যান না কেন সভ্যতা এড়াতে পারবেন না। হায়! কি সত্য কথা। আমি ভার্জিনিয়া উলফের একটা বই পড়ার চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু সে দিনের জন্য বিজ্ঞাপনের জয় হলো।

জীবনের বাস্তব প্রয়োজনের অনুষঙ্গাদির অনুরূপতা কোনো গুরুতর ব্যাপার নয়। কিন্তু ভাবনা ও অভিমত যদি অভিন্ন হয় সেটা হবে অধিকতর বিপজ্জনক। তবে এটা আধুনিক উদ্ভাবনসমূহের অনিবার্য ফল। বিচ্ছিন্ন ও ক্ষুদ্র আকারে উৎপাদনের চেয়ে সম্মিলিতভাবে এবং বিরাট পরিমাণে উৎপাদন করতে গেলে অনেক সস্তা পড়ে। এটা যেমন অভিমত উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তেমনি প্রযোজ্য সামান্য পিন উৎপাদনের ক্ষেত্রে। আজকের দিনে অভিমত উৎপাদনের প্রধান উৎসসমূহ হলো বিদ্যালয়, গির্জা, পত্র-পত্রিকা, সিনেমা এবং রেডিও। যন্ত্রপাতির ব্যবহার যত বাড়বে প্রাথমিক স্কুলগুলোতে শিক্ষা ততই প্রমিত হবে। ধরে নেয়া যায় যে নিকট ভবিষ্যতে স্কুল শিক্ষায় সিনেমা এবং রেডিও-র ব্যবহার দ্রুত গতিতে বাড়বে। এর অর্থ হলো একটা কেন্দ্রে পাঠ তৈরি করা হবে এবং যেখানে উক্ত কেন্দ্রের পণ্য ব্যবহার করা হবে সেখানে পাঠ হবে অভিন্ন। আমি শুনেছি কোনো কোনো গির্জা আদর্শ ধর্মোপদেশ অপেক্ষাকৃত কম শিক্ষিত যাজকদের কাছে প্রতি সপ্তাহে প্রেরণ করে, এবং এই যাজকরা যদি মানব প্রকৃতির সাধারণ নিয়মে চলেন, তাহলে নিঃসন্দেহে তারা কৃতজ্ঞ বোধ করেন যে তাদের নিজেদের ধর্মোপদেশ তৈরির জন্য কষ্ট করতে হলো না। এই আদর্শ ধর্মোপদেশ অবশ্যই ঐ সময়ের তাজা বিষয়ের উপর আলোকপাত করে, লক্ষ্য হলো দেশের সর্বত্র একই গণআবেগ জাগ্রত করা। এই একই ব্যাপার উচ্চমাত্রায় সংবাদপত্রের বেলায় খাটে। সংবাদ সর্বত্র টেলিগ্রাফের মাধ্যমে আসে এবং ব্যাপক আকারে ব্যবহৃত হয়। পুস্তক সমালোচনা, শ্রেষ্ঠ পত্রিকাদি বাদে, নিউইয়র্ক থেকে সানফ্রানসিসকো, মেইন থেকে টেক্সাসে, একই। তবে একটা ব্যতিক্রম; আপনি যতই উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের দিকে অগ্রসর হবেন দেখতে পাবেন সমালোচনার পরিসর ছোট হয়ে আসছে।

সম্ভবত আধুনিক জগতে অনুরূপতা সৃষ্টির সবচেয়ে বেশি ক্ষমতা রাখে সিনেমা, কারণ সিনেমার প্রভাব শুধু মার্কিন মুলুকে সীমাবদ্ধ নয়। এর অবাধ অনুপ্রবেশ জগতের সর্বত্র। অবশ্য সোভিয়েত ইউনিয়নকে বাদ দিয়ে ধরতে হবে। তবে এখানে আলাদা জাতের অনুরূপতা রয়েছে। বিস্তৃত অর্থে, মিডল ওয়েস্ট কি পছন্দ করে সে সম্পর্কে হলিউডের অভিমত সিনেমায় রূপদান করা হয়। এই ব্যবস্থাপত্রের আলোকে প্রেম, বিবাহ, জন্ম, মৃত্যু সম্পর্কে আমাদের আবেগ প্রমিত হচ্ছে। জগতের সর্বত্র তরুণের কাছে আধুনিকতা সম্পর্কে শেষ কথার প্রতিনিধিত্ব করে হলিউড। একই সঙ্গে হলিউড তুলে ধরে ধনী ব্যক্তিদের সুখ এবং কীভাবে ধনবান হওয়া যায় তার পদ্ধতি। অনুমান করছি, অদূর ভবিষ্যতে সিনেমা সার্বজনীন একটা ভাষা অবলম্বনে বাধ্য করবে এবং সেই ভাষাটা হবে হলিউডের।

আমেরিকার অপেক্ষাকৃত অধিক অজ্ঞদের মধ্যে শুধু অনুরূপতা রয়েছে মনে করলে ভুল হবে। এই ব্যাপারটা খাটে, একটু কম মাত্রায় হলেও, সংস্কৃতির বেলায়। আমি ঐ দেশের সর্বত্র বইয়ের দোকান দেখতে গেছি, লক্ষ্য করেছি সব দোকানেই এই বেস্ট সেলার প্রাধান্য পেয়েছে প্রদর্শনের ক্ষেত্রে। যতটুকু বুঝতে পেরেছি, আমার মনে হয়েছে যে আমেরিকার সংস্কৃতিবান মহিলারা প্রতি বছর ডজন খানেক বই কেনে, এবং ঐ এক ডজন পুস্তকই সর্বত্র বিক্রি হয়। কোনো লেখকের কাছে ব্যাপারটা অত্যন্ত সন্তোষজনক, অবশ্য তিনি যদি ঐ এক ডজন পুস্তকের একটির লেখক হন। কিন্তু এখানে ঘটনা ইউরোপ থেকে আলাদা। ইউরোপে অনেক বই, বিক্রি কম: গুটিকয় বই, বিক্রি অধিক এমন নয়।

আবার এটা ধরে নেয়া ঠিক হবে না যে অনুরূপতার প্রতি ঝোঁক একেবারে খারাপ কিংবা একেবারে ভালো। এর সুবিধা অসুবিধা দুই-ই রয়েছে; অবশ্যই এর প্রধান সুবিধা হলো এতে এমন জনগোষ্ঠী তৈরি হয় যারা শান্তিপূর্ণভাবে সহযোগিতার পরিবেশে বাস করতে সমর্থ। এর বড় অসুবিধা এখানে যে এটা যে জনগোষ্ঠী তৈরি করে তার প্রবণতা হয়ে দাঁড়ায় সংখ্যালঘু অত্যাচারের। এই ত্রুটি হয়তো সাময়িক, কারণ অদূর ভবিষৎতে সংখ্যালঘু বলে কিছু থাকবে না। অবশ্য অনেকটা নির্ভর করে অনুরূপতা কীভাবে অর্জন করা হয় তার উপর। একটা উদাহরণ নেয়া যাক; দক্ষিণ ইতালিবাসীদের প্রতি স্কুলগুলো কী করছে। গোটা ইতিহাস জুড়ে দক্ষিণ ইতালিয়াবাসীরা খুন, অসদুপায়ে অর্থ উপার্জন এবং নান্দনিক সংবেদনশীলতার জন্য বিশিষ্ট। পাবলিক স্কুলগুলো কার্যকরীভাবে এই তিনটির শেষটি থেকে তাদের আরোগ্য করে, এবং এ ক্ষেত্রে তাদের আমেরিকার স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অনুরূপ করে তোলে, কিন্তু বাকি দুটি সুস্পষ্ট গুণ ব্যাপারে স্কুলগুলো চিহ্নিত করার মতো কোনো সাফল্য দেখাতে পারে না। এতে অনুরূপতা লক্ষ্য হওয়ার বিপদগুলোর একটি উপলব্ধি করা যায়; অসদগুণের চেয়ে সদগুণ বিনষ্ট করা সহজতর, সুতরাং মান কমিয়ে দিয়ে সহজেই অনুরূপতা অর্জন করা সম্ভব। অবশ্য এটা পরিষ্কার, যে দেশের বিরাট জনগোষ্ঠী বৈদেশিক সেখানে বিদ্যালয়ের মাধ্যমে বিদেশাগতদের ছেলেমেয়েদের গ্রহণীয় করে তোলার চেষ্টা নেয়া হবেই এবং ফলে নির্দিষ্ট মাত্রায় মার্কিনীকরণ অবশম্ভাবী। সে যাই হোক, দুর্ভাগ্যের ব্যাপার এই যে, এই প্রক্রিয়ার একটা বড় অংশ নগ্ন জাতীয়তাবাদ দ্বারা প্রভাবিত হবে। আমেরিকা ইতঃমধ্যেই জগতের সবচেয়ে শক্তিধর দেশে পরিণত হয়েছে, এবং দেশটির প্রাধান্য দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। এতে স্বভাবতই ইউরোপে ভীতি সঞ্চারিত হয়েছে এবং সবকিছু সমরতন্ত্রী জাতীয়তাবাদী লক্ষণাক্রান্ত বলে ভীতি বৃদ্ধি পেয়েছে। আমেরিকার হয়তো দায়িত্ব হয়ে দাঁড়াবে ইউরোপকে রাজনৈতিক সদবুদ্ধি প্রদান, তবে আমি আশংকিত যে তার ছাত্ররা অবাধ্য প্রমাণিত হবে।

আমেরিকায় অনুরূপতার দিকে ঝোঁকের সঙ্গে, আমার মনে হয়েছে, গণতন্ত্র সম্পর্কে একটা ভুল ধারণা কাজ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে সাধারণভাবে মনে করা হয় যে গণতন্ত্রের জন্য দরকার সব মানুষকে একরকম হওয়া, এবং যদি কোনো ব্যক্তি অন্য একজন ব্যক্তি থেকে আলাদা হন তাহলে ধরা হয় তিনি নিজেকে ঐ ব্যক্তি থেকে উন্নততর বলে জাহির করছেন। ফ্রান্স আমেরিকার মতোই গণতান্ত্রিক অথচ ফ্রান্সে এ ধরনের মত পোষণ করা হয় না। ডাক্তার, উকিল, যাজক, সরকারি কর্মচারী সবাই ফ্রান্সে আলাদা ধরনের। প্রত্যেকটি পেশার নিজস্ব ঐতিহ্য এবং মান রয়েছে, অথচ একটা পেশা অপরাপর পেশা থেকে উন্নততর বলে জাহির করা হয় না। আমেরিকার সকল পেশাজীবীই ব্যবসায়ী শ্রেণির মতো। ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, একজনের ডিক্রি জারি করা উচিত ঐকতানে শুধু কয়েকটি বেহালা থাকবে। এমন বোধ কারো মধ্যে কাজ করে না যে বাস্তবে সমাজ হবে একটা প্যাটার্নের মতো কিংবা প্রাণবান, যেখানে বিভিন্ন অঙ্গ ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকা পালন করবে। কল্পনা করুন চোখ ও কান বিবাদ করছে কোনটা ভালো, দেখা না শোনা, এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে যে কোনোটাই ভালো। কাজ করে না, যেহেতু এর কোনোটিই উভয় কাজ করতে পারে না। গণতন্ত্র সম্পর্কে আমেরিকায় এরকম ধারণাই পোষণ করা হয়। যে কোনো ধরনের চমত্তারিত্ব ব্যাপারে, যা সার্বজনীন হতে পারে না, অদ্ভুত ঈর্ষা বোধ করা হয়, তবে খেলাধুলার ক্ষেত্রে নয়, এখানে আভিজাত্য খুব উৎসাহের সঙ্গে প্রশংসা করা হয়ে থাকে। মনে হয় গড় মার্কিনীরা মস্তিষ্কের চেয়ে পেশির প্রতি বেশি বিনয়। কারণ হয়তো এই যে, তাদের মস্তিষ্কের চেয়ে পেশির প্রতি শ্রদ্ধা গভীরতর এবং বেশি আন্তরিক। আমেরিকায় বিজ্ঞানের জনপ্রিয় গ্রন্থের যে প্লাবন তার অনুপ্রেরণা, অংশত, যদিও অবশ্য গোটাটা নয়, এসেছে একথা স্বীকার করার অনিচ্ছা থেকে যে বিজ্ঞানে এমন কিছু আছে যা শুধু বিশেষজ্ঞরাই বুঝতে পারেন। ধরুন আপেক্ষিকতার তত্ত্ব বোঝার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের দরকার রয়েছে এমন ধারণাই ওদের কাছে বিরক্তিকর। আবার ওদের বলুন প্রথম শ্রেণির ফুটবল খেলোয়াড় হওয়ার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের দরকার করে, কেউ মোটেই বিরক্ত হবে না।

অর্জিত খ্যাতির প্রতি অন্য যে কোনো দেশের চেয়ে আমেরিকায় বেশি শ্রদ্ধা দেখানো হয়, তবে তরুণদের জন্য এ ধরনের খ্যাতি অর্জনের পন্থা কঠিন করে তোলা হয়। কারণ জনগণ কোনো খামখেয়ালি সহ্য করতে পারে না, কিংবা যাকে বলা হয়। একজন নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করছে এটা তাদের কাছে অসহ্য, অবশ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ইতঃমধ্যেই প্রসিদ্ধ বলে চিহ্নিত হয়ে থাকলে আলাদা কথা। ফলে প্রসিদ্ধ ব্যক্তিদের তারা শ্রদ্ধা করলেও দেশে তৈরি করতে পারে না। ইউরোপ থেকে আমদানি করতে হয়। এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রমিতকরণ এবং অনুরূপতা। অসাধারণ মেধা, বিশেষ করে শিল্পের ক্ষেত্রে, তরুণ বয়সে বিরাট বাধার সম্মুখীন হতে বাধ্য। যতদিন সবার কাছে প্রত্যাশা করা হবে তারা সফল নির্বাহী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত প্যাটার্ন অনুসরণ করবে, ততদিন এর ব্যত্যয় হবে না।

অসাধারণ ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রমিতকরণ অসুবিধার কারণ হতে পারে, তবে সম্ভবত গড় মানুষের সুখ বৃদ্ধি করে। কারণ তারা তাদের চিন্তা এতটা নিশ্চয়তার সঙ্গে উচ্চারণ করতে পারে যে তা যেন তার শ্রোতার চিন্তার অনুরূপ। উপরন্তু এটা জাতীয় সংহতির উন্নতি সাধন করে, এবং অন্যত্র মতভেদের পার্থক্য খুব বেশি হলেও এখানে রাজনীতি হয় কম তিক্ত। দাঙ্গাবাজ মনোভাবও কম হয়। আমি মনে করি না যে লাভ ও ক্ষতির মধ্যে ভারসাম্য তৈরি করা সম্ভব, কিন্তু আমি মনে করি, আমেরিকায় আজ যে প্রমিতি লক্ষ্য করা যায়, তা গোটা ইউরোপে অচিরে দেখা দেবে জগৎ আরো যন্ত্রনির্ভর হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে। অতএব যে সব ইউরোপীয় ভদ্রলোক এক্ষেত্রে আমেরিকার ক্রটি দেখতে পান তাদের উপলব্ধি করা উচিত যে তারা তাদের দেশে ভবিষ্যৎ ব্যাপারে অনুরূপ ত্রুটি দেখতে পাবেন। এক্ষেত্রে আমেরিকার ত্রুটি দেখতে পাওয়ার অর্থ হলো সভ্যতার অনিবার্য এবং সার্বিক ঝোঁকের প্রতিকূলে নিজেদের দাঁড় করানো। নিঃসন্দেহে জাতিসমূহের মধ্যে প্রভেদ হ্রাস পাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে আন্তর্জাতিকতা সহজতর হয়ে আসবে এবং একবার আন্তর্জাতিকতা প্রতিষ্ঠিত হলে অভ্যন্তরীণ শান্তি রক্ষায় সামাজিক সংহতির গুরুত্ব খুবই বেড়ে যাবে। অস্বীকার করার উপায় নেই যে শেষের দিকের রোমক সাম্রাজ্যের মতো অচলাবস্থা সৃষ্টির ঝুঁকি এতে থেকে যায়। কিন্তু এর বিরুদ্ধে আমরা আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বৈপ্লবিক শক্তি কাজে লাগাতে পারি। সার্বিক বুদ্ধিগত অবক্ষয় না-ঘটলে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, যা আধুনিক জগতের নতুন বৈশিষ্ট্য, অচলাবস্থা অসম্ভব করে তুলবে এবং সেই ধরনের স্থবিরতা ঠেকিয়ে রাখবে যা ইতিহাসের অনেক সাম্রাজ্য গ্রাস করেছে। বর্তমান ও ভবিষ্যতের ক্ষেত্রে ইতিহাসের যুক্তি প্রয়োগ বিপজ্জনক, কারণ বিজ্ঞান সূচনা করেছে সম্পূর্ণ পরিবর্তন। অতএব আমি অযথা নৈশ্যবাদী হওয়ার কোনো যুক্তি দেখি না, প্রমিতকরণ অনভ্যস্ত ব্যক্তিদের রুচিকে যতই আঘাত করুক না কেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *