অধ্যায় ১১ — মানুষ বনাম কীট-পতঙ্গ
যুদ্ধ এবং যুদ্ধের গুজবের ভেতর, যেখানে নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি এবং অনাক্রমণ চুক্তি মানব বংশের প্রতি অভূতপূর্ব হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেখানে অপর একটি দ্বন্দ্ব, হয়তো সমধিক গুরুত্বপূর্ণ, প্রয়োজনের চেয়ে কম মনোযোগ কাড়ছে। আমি এখানে মনুষ্য ও কীট-পতঙ্গের মধ্যেকার দ্বন্দ্বের ব্যাপারটা বোঝাচ্ছি।
আমরা নিজেদের Lords of Creation বা আদি পুরুষ পদে ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি; গুহামানবের মতো সিংহ, বাঘ, বিরাটকায় হস্তীসদৃশ কোনো প্রাণী বা বন্য শূকরের ভয়ে ভীত হওয়ার আর দরকার করে না আমাদের। আমরা একে অপরকে যে ভয় পাই সেটা বাদ দিয়ে ধরলে নিজেদের নিরাপদই বোধ করি। কিন্তু বৃহৎ জন্তুরা আমাদের অস্তিত্বের জন্য আর হুমকি না হলেও, ক্ষুদ্র জন্তুদের সম্পর্কে সে কথা বলা চলে না। এই গ্রহের প্রাণের ইতিহাসে পূর্বে বৃহৎ জন্তুরা ক্ষুদ্র জন্তুদের একবার জায়গা ছেড়ে দিয়েছিল। বহুকাল ডাইনাসোর নিরুদ্বেগভাবে জলাশয় ও বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়িয়েছে, একটা ডাইনাসোরের অপর একটা ডাইনাসোরকে ভয় করা ছাড়া তাদের আর কোনো ভয়ের ব্যাপার ছিল না। সংশয় ছিল না যে তাদের সাম্রাজ্য নিরঙ্কুশ। মূষিক, ক্ষুদ্র সজারু, ইঁদুরের চেয়ে বড় নয় এমন ক্ষুদ্র ঘোড়া, প্রভৃতি ক্ষুদ্র স্তন্যপায়ী প্রাণীদের জায়গা করে দিয়ে ডাইনাসোর এক সময় বিলুপ্ত হয়। ডাইনাসোরের বংশ কেন ধ্বংস হয় তা জানা যায় না, তবে মনে করা হয় যে ঐ অতিকায় প্রাণীর মাথার মগজ ছিল খুবই সূক্ষ্ম, এবং শিকারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের জন্য অসংখ্য শিং গজানোর কাজে নিজেকে নিয়োজিত করে। ঘটনা যাই হোক, ডাইনাসোরের ধারা অনুসরণ করে জীবনের বিকাশ ঘটেনি।
স্তন্যপায়ী প্রাণী নিরঙ্কুশ প্রাধান্য পাবার পর আকারে বাড়তে লাগল। কিন্তু হস্তীসদৃশ অতিকায় প্রাণীর বিলুপ্তি ঘটেছে। অন্যান্য বৃহৎ আকৃতির প্রাণীও বিরল হয়ে এসেছে। ব্যতিক্রম শুধু মানুষ এবং মনুষ্য-কর্তৃক বশীভূত প্রাণীরা। মানুষ ক্ষুদ্রাকৃতি হলেও বুদ্ধি দ্বারা সফলতার সঙ্গে বিরাট জনসংখ্যার পুষ্টির ব্যবস্থা করেছে। মানুষ নিরাপদ, তবে ক্ষুদ্রকায় প্রাণী, কীট-পতঙ্গ এবং অণুজীব থেকে নয়।
কীট-পতঙ্গাদির প্রাথমিক সুবিধা এই যে, এদের সংখ্যা অগণন। সারা পৃথিবীতে যত মানুষ রয়েছে সেই সংখ্যক পিপীলিকা একটি ক্ষুদ্র বনে সহজেই বাস করতে পারে। কীট-পতঙ্গ আরো একটা সুবিধা ভোগ করে, এরা আমাদের খাদ্য পরিপক্ক হওয়ার আগেই ভক্ষণে সক্ষম। অনেক অনিষ্টকর কীট-পতঙ্গ অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র ভূখণ্ডে বসবাসে অভ্যস্ত ছিল, মানুষ এদের বিনা অভিপ্রায়ে নতুন পরিবেশে স্থানান্তর করে, সেখানে এরা অশেষ ক্ষতিসাধন করেছে। কীট-পতঙ্গ এবং অণুজীবের জন্য ভ্রমণ ও বাণিজ্য অত্যন্ত জরুরি। হলুদ জ্বর আগে শুধু পশ্চিম আফ্রিকায় দেখা গেছে, ক্রীতদাস ব্যবসা এই জ্বর পশ্চিম গোলার্ধে বহন করে আনে। বর্তমানে আফ্রিকার দরজা উন্মুক্ত হওয়ার ফলে ঐ জ্বর ক্রমান্বয়ে উক্ত মহাদেশ পেরিয়ে প্রাচ্যের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। পূর্ব উপকূলে পৌঁছলে এই জ্বর ভারত ও চিনের বাইরে রাখা সম্ভব হবে না। এবং এই জ্বর দেশ দুটির জনসংখ্যার অর্ধেক কমিয়ে ফেলতে পারে বলে আশংকা করা যায়। নিদ্রারোগ সমধিক মারাত্মক আফ্রিকান ব্যাধি, এবং এই রোগ ক্রমান্বয়ে বিস্তারিত হচ্ছে।
সৌভাগ্য এই যে, বিজ্ঞান একটি উপায় উদ্ভাবন করেছে, যা দিয়ে ক্ষতিকর কীট পতঙ্গ দমন করা সম্ভব। অধিকাংশ কীট-পতঙ্গ পরান্নভোজীর হাতে প্রাণ হারায়, যারা বেঁচে যায় তারা গুরুতর কোনো সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে না। আর কীটতত্ত্ববিদগণ এই ধরনের পরান্নভোজী নিয়ে গবেষণা এবং এদের বংশবিস্তার করে চলেছেন। এদের কার্যকলাপের সরকারি প্রতিবেদন অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক; প্রতিবেদনে এ ধরনের বাক্যের সমাবেশ থাকে: ত্রিনিদাদের চাষিদের অনুরোধক্রমে তিনি ব্রাজিল যান ইক্ষুর Froghopper কীটের জৈবশত্রু খোঁজার জন্য। আপনি হয়তো বলবেন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ইক্ষুর Froghopper-এর কোনো সুযোগই থাকবে না। দুর্ভাগ্যক্রমে যুদ্ধ যতদিন চলবে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান দুদিকেই কাটবে বা দুমুখো হবে। উদাহরণত সদ্যপ্রয়াত প্রফেসর ফ্রিৎস হেবার নাইট্রোজেন গ্যাস নিয়ন্ত্রণ বা ব্যবহারের উপায় উদ্ভাবন করেন। তার সাধ ছিল এই গ্যাস ব্যবহার করে জমির উর্বরাশক্তি বৃদ্ধি করবেন। কিন্তু জার্মান সরকার উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরক তৈরির জন্য এটা ব্যবহার করেন এবং সম্প্রতি হেবার সাহেবকে নির্বাসনে পাঠিয়েছিলেন। কারণ তিনি বোমা নয় জমিতে প্রয়োগযোগ্য সার উৎপাদনে অধিক আগ্রহী ছিলেন। পরবর্তী মহাযুদ্ধে এক পক্ষ অপর পক্ষের শস্যক্ষেত্রে ক্ষতিকর কীট লেলিয়ে দেবে এবং যুদ্ধ শেষে এই কীট দমন কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়াবে। আমরা যত বেশি জানব, আমরা একে অপরের ততবেশি ক্ষতি করতে পারব। মানুষ যদি একে অপরের প্রতি ক্রোধবশত কীট-পতঙ্গ এবং অণুজীবদের সাহায্য গ্রহণ করে, এবং আরো একটা মহাযুদ্ধ সূচিত হলে তারা তা করবে, তাহলে এটা কোনো মতেই অসম্ভব নয় যে শেষ পর্যন্ত প্রকৃত বিজয়ী পক্ষ হবে একমাত্র কীট-পতঙ্গেরা। হয়তো মহাজাগতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দুঃখিত হবার কিছু নেই; কিন্তু মানুষ হিসেবে আমি নিজ প্রজাতির জন্য দীর্ঘশ্বাস না ছেড়ে পারি না।
.
অধ্যায় ১২ — শিক্ষা ও শৃঙ্খলা
যে-কোনো গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাতত্ত্বের দুটি দিক থাকতে হবে; জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে একটি ধারণা এবং মনস্তাত্ত্বিক গতিবিদ্যার বিজ্ঞান অর্থাৎ মনের অবস্থার পরিবর্তনের বিধি। যদি দুজন ব্যক্তি জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে ভিন্নমত পোষণ করেন তবে তারা শিক্ষা সম্পর্কেও একমত হওয়ার প্রত্যাশা করতে পারেন না। গোটা পাশ্চাত্য সভ্যতায় শিক্ষাযন্ত্র দুটি নৈতিকতত্ত্ব দ্বারা শাসিত হচ্ছে: খ্রিস্টধর্ম এবং জাতীয়তাবাদ। গুরুত্ব দিয়ে বিচার করলে দেখা যাবে এই দুটি ব্যাপার সহাবস্থান করতে পারে না। এবং এটা জার্মানিতে ক্রমান্বয়ে পরিষ্কার হচ্ছে। নিজের সম্পর্কে বলতে পারি এই দুটি ব্যাপার। যেখানে বিভিন্ন সেখানে খ্রিস্টধর্মের প্রতিই আমি পক্ষপাতী হবো। যেখানে অভিন্ন সেখানে দুটিই প্রমাদযুক্ত বলে আমার ধারণা। শিক্ষার উদ্দেশ্য হিসেবে যে ধারণা আমি বিকল্প হিসেবে পেশ করতে চাই তাহলে সভ্যতা। এবং সভ্যতাকে আমি যে অর্থে বুঝে থাকি তার সংজ্ঞা অংশত ব্যক্তিকেন্দ্রিক, অংশত সামাজিক। ব্যক্তির ক্ষেত্রে এতে অন্তর্ভুক্ত হলো বুদ্ধিগত ও নৈতিক গুণাবলি: বুদ্ধিগত দিক থেকে সুনির্দিষ্ট ন্যূনতম সাধারণ জ্ঞান, নিজের পেশা সম্পর্কে বাস্তবিক দক্ষতা এবং সাক্ষ্যনির্ভর মতামত গঠনের অভ্যাস; নৈতিক দিক থেকে, পক্ষপাতহীনতা, সদয়ভাব, এবং কিছুটা আত্ম-নিয়ন্ত্রণ। এর সঙ্গে আমি আরো একটা গুণ যোগ করব, যা নৈতিকও নয়, বুদ্ধিগতও না। সম্ভবত তা শারীরতাত্ত্বিক: জীবনের প্রতি আগ্রহ ও আনন্দ। সম্প্রদায়সমূহের কাছে সভ্যতা আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দাবি করে, মানুষের সঙ্গে মানুষের কারবারে ন্যায় প্রতিষ্ঠা চায়; এবং এমন লক্ষ্য নির্ধারণ যাতে মানবজাতির কোনো অংশত স্থায়ী ক্ষতি সাধিত না হয়। এবং উপায় ও উপেয়র মধ্যে খোঁজে বুদ্ধিমান অভিযোজন।
এগুলোকেই যদি শিক্ষার উদ্দেশ্য বলতে হয় তাহলে মনোবিজ্ঞানের বিবেচনা করতে হবে এই উদ্দেশ্যগুলো বাস্তবায়নের জন্য কী করা যেতে পারে; বিশেষ করে বিবেচনা করতে হবে কতটা স্বাধীনতা সর্বাধিক কার্যকর প্রমাণিত হওয়া সম্ভবপর।
শিক্ষাক্ষেত্রে স্বাধীনতার প্রশ্নে বর্তমানে তিনটি প্রধান মতবাদী গোষ্ঠী রয়েছে। এই তিনটি গোষ্ঠীর মধ্যে অংশত উদ্দেশ্যগত পার্থক্য রয়েছে, অংশত মনোবৈজ্ঞানিক তত্ত্বের দিক থেকেও তফাত আছে। অনেকে বলে থাকেন শিশুদের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে, তারা যতই মন্দ স্বভাবের হোক না কেন; আবার অনেকে তাদের কর্তৃপক্ষের সম্পূর্ণ অধীনে রাখার পক্ষে মত দেন, তারা যতই সচ্চরিত্র হোক না কেন। আরো এক গোষ্ঠীর অভিমত হলো তাদের স্বাধীনতা দেয়া উচিত, কিন্তু স্বাধীনতা দেয়া সত্ত্বেও তাদের সদাচারী হতে হবে এবং সবসময়ই। শেষোক্ত গোষ্ঠী বৃহত্তর হলেও এদের দাবির যৌক্তিকতা সামান্যই। বয়স্কদের মতোই সব শিশু যদি স্বাধীন হয় তবে পুণ্যবান হবে না। এই যে বিশ্বাস করা হয় স্বাধীনতা নৈতিক সম্পূর্ণতা নিশ্চিত করবে এটা রুশোবাদের ধ্বংসাবশেষমাত্র, পশু ও শিশুদের নিয়ে চর্চা করতে গেলে এই তত্ত্ব টিকবে। যারা এই তত্ত্বে বিশ্বাস করেন তাদের ধারণা হলো শিক্ষার কোনো সদর্থক উদ্দেশ্য থাকা উচিত নয়। শিক্ষা কেবল স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করবে। এ দলের সঙ্গে আমি ঐকমত্য পোষণ করি না, এই দলের মত অতিবেশি ব্যক্তিকেন্দ্রিক এবং অযথা জ্ঞানের গুরুত্বের প্রতি উদাসীন। আমরা যে ধরনের সমাজে বাস করি সেখানে সহযোগিতার দরকার রয়েছে। স্বতঃস্ফূর্ত তাড়না থেকে প্রয়োজনীয় সর্বপ্রকার সহযোগিতা সৃষ্টির প্রত্যাশা অসার কল্পনা মাত্র। সীমাবদ্ধ এলাকায় বিরাট জনগোষ্ঠীর বসবাস বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আশীর্বাদেই কেবল সম্ভবপর: সুতরাং শিক্ষাদর্শকে প্রয়োজনেই যৎকিঞ্চিৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হতে হবে। যে সকল শিক্ষক সর্বাধিক স্বাধীনতা অনুমোদন করেন তাদের সাফল্য নির্ভর করে কিছুটা বদান্যতা, আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং প্রশিক্ষিত বুদ্ধির উপর, যা, যেখানে সকল আবেগ অনিয়ন্ত্রিত, সৃষ্টি হওয়া প্রায় অসম্ভব। সুতরাং তাদের গুণাবলি স্থায়িত্ব পেতে পারে না যদি তাদের পদ্ধতি হয় নির্জলা। সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, শিক্ষাকে বিকাশের সুযোগ সৃষ্টির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না, কিছুটা সদর্থকও হতে হবে। আবার এটা যোগানোর পরও শিক্ষাকে অবশ্যই মানসিক ও নৈতিক মাধ্যমের যোগান দিতে হবে, কারণ শিশুরা নিজ থেকে এগুলো অর্জন করতে পারবে না।
শিক্ষায় বড় রকমের স্বাধীনতা প্রদানের পক্ষে যে যুক্তিগুলো খাড়া করা হয় তার উৎস মানুষের স্বাভাবিক সৎগুণ নয় বরং কর্তৃত্বের প্রতিক্রিয়া এবং এটা কেবল কর্তৃত্বের যারা শিকার তাদের বেলায় খাটে না, যারা কর্তৃত্ব খাটায় তাদের বেলায়ও সমানভাবে খাটে। যাদের কর্তৃত্ব মেনে নিতে হয় তারা হয় অতি বাধ্য অথবা বিদ্রোহী, এবং এই দুটি মনোভাবেরই অনেক ত্রুটি রয়েছে।
অতি-বাধ্যরা উদ্যম হারিয়ে ফেলে, চিন্তা ও কর্ম, উভয় ক্ষেত্রে; উপরন্তু উদ্যমে ব্যাঘাত থেকে যে ক্রোধ জন্মে তা প্রকাশ পায় দুর্বলতরদের উপর খবরদারির ভেতর। এজন্যই নিপীড়নমূলক প্রতিষ্ঠানগুলো স্বরচিত পথে চলে: যে লোক পিতা-কর্তৃক নিপীড়িত হয় সে পুত্রকে নিপীড়ন করে। পাবলিক স্কুলে গ্লানি অর্জনের স্মৃতি নিয়ে সাম্রাজ্য-নির্মাতা হলে নেটিভদের উপর তা চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতা নড়ানো যায় না। এইভাবে অযথা কর্তৃবাদী শিক্ষা ছাত্রদের দুর্বলচিত্ত অত্যাচারীতে পরিণত করে, কথায় বা কাজে মৌলিকতা অর্জন করতে পারে না কিংবা সহ্য করার সমর্থতা লাভ করে না। শিক্ষকদের উপর এর প্রতিক্রিয়া আরো খারাপ হয়। তাদের মধ্যে ধর্ষকামী ও কঠোর নিয়মানুবর্তী হওয়ার ঝোঁক দেখা দেয়। সন্ত্রস্ত করতে পারলে তারা খুশি হয় এবং অন্যকিছু করে সন্তুষ্ট হয় না। এই লোকগুলো যেহেতু জ্ঞানের প্রতিনিধিত্ব করে ফলে ছাত্ররা অর্জন করে জ্ঞানাতংক, এবং ইংরেজ উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণি একে মানব প্রকৃতির হিসেবে ধরে নেয়, অথচ বাস্তবে এটা কর্তৃবাদী পণ্ডিতদের বদ্ধমূল ঘৃণার অঙ্গ।
অপরদিকে বিদ্রোহীরা, যদিও তাদের দরকার রয়েছে, কমই ন্যায়ানুগ হয়। উপরন্তু বিদ্রোহ করার বহু উপায় রয়েছে, এবং বিদ্রোহীদের একটি ক্ষুদ্র সংখ্যার লঘু অংশ মাত্রই কেবল বিজ্ঞ। গ্যালিলিও একই সঙ্গে বিদ্রোহী এবং বিজ্ঞ ছিলেন; যারা সমতল পৃথিবীর তত্ত্বে বিশ্বাস করেন তারাও সমানভাবে বিদ্রোহী, কিন্তু এরা নির্বোধ। প্রথাবিরুদ্ধ মতামত মাত্রেই সঠিক, এই ধরনের অনুমোদনের প্রতি ঝোঁক বিপজ্জনক। অর্থাৎ আলোকবাতির খুঁটি গুঁড়িয়ে দেয়া কিংবা শেক্সপিয়র কোনো কবিই নয় মনে করা কোনো উপকারে আসে না। অবশ্য এই ধরনের অতি-বিদ্রোহী মনোভাব অনেক ক্ষেত্রে প্রাণবান ছাত্রদের উপর অতিরিক্ত কর্তৃত্ব খাটানোর প্রতিক্রিয়া। আর যখন বিদ্রোহীরা শিক্ষকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন অনেক সময় তারা ছাত্রদের অবাধ্য হতে উৎসাহিত করেন। আবার একই সঙ্গে ছাত্রদের জন্য নিখুঁত পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা করেন, অথচ এই দুটি লক্ষ্য কিছুতেই সহাবস্থান করতে পারে না।
দরকার অবাধ্যতাও নয়, বিদ্রোহও নয়, দরকার সৎস্বভাব এবং জনগণ ও নতুন ভাবধারার প্রতি সাধারণ বন্ধুত্বপূর্ণ আনুকূল্য প্রদর্শন। এই গুণগুলো অংশত আসে দৈহিক কারণে, যার প্রতি প্রাচীনপন্থি শিক্ষকরা কমই গুরুত্ব দেন; কিন্তু মানুষের প্রধান প্রবণতাসমূহ বাধাগ্রস্ত হলে যে হতবুদ্ধিকর অথর্বর বোধ জাগে তা থেকে মুক্ত থাকতে পারলে ঐ গুণগুলো অধিক লাভ করা যায়। যুবকদের বন্ধুভাবাপন্ন পূর্ণ বয়স্ক ব্যক্তিতে পরিণত হতে হলে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে দরকার হলো, তাদের অনুভব করতে দিতে হবে। যে তারা বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে বাস করছে। এর জন্য প্রয়োজন হলে শিশুদের গুরুত্বপূর্ণ বাসনাগুলোর প্রতি সুনিশ্চিত সহানুভূতি দেখাতে হবে, এবং কেবল তাকে ঈশ্বর-মহিমা সংকীর্তন কিংবা স্বদেশের মহত্ত্বের গুণগান করার মতো বিমূর্ত উদ্দেশ্যে ব্যবহার করলে চলবে না। এবং শিক্ষা প্রদানের সময় সব রকমের চেষ্টা নিতে হবে যাতে ছাত্ররা বোধ। করে যে যা শেখানো হচ্ছে তা খুবই মূল্যবান-অন্তত যখন কিছু শেখানো হয়। ছাত্ররা যখন স্বেচ্ছায় সহযোগিতা করে তখন তারা দ্বিগুণ দ্রুত শেখে এবং অর্ধেক অবসাদ ভোগ করে। এসবই সব ধরনের স্বাধীনতার পক্ষে বৈধ যুক্তি।
এই যুক্তি সহজেই আরো দূর এগিয়ে নেয়া চলে। এটা বাঞ্ছনীয় নয় যে শিশুরা দাসত্বের দোষ এড়িয়ে চলতে গিয়ে অভিজাতদের দোষ অর্জন করবে। শুধু বড় ব্যাপারে নয়, নিত্যদিনের ছোটখাটো ব্যাপারেও অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা কিংবা সুবিবেচনাবোধ সভ্যতার আবশ্যিক উপাদান, এটি না থাকলে সমাজজীবন অসহনীয় হয়ে উঠবে। এখানে কিন্তু আমি অনুগ্রহপূর্বক এবং ধন্যবাদ বলার মতো শিষ্টতার সাধারণ নিয়ম। সম্পর্কে ভাবছি নাঃ রীতিমাফিক শিষ্টতা বর্বরদের মধ্যেই সম্পূর্ণ বিকশিত হয় এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে উন্নতির সঙ্গে তাল রেখে হ্রাস পায়। আমি বরং ভাবছি দরকারি কাজের ন্যায্য অংশীদার হওয়ার ইচ্ছা সম্পর্কে। মনের অসুস্থতা এক ধরনের শিষ্টতা এবং এটা একেবারেই বাঞ্ছনীয় নয় যে শিশু নিজেদের সর্বশক্তিমান মনে করবে কিংবা যুবকরা মনে করবে যে বয়স্কদের বেঁচে থাকার লক্ষ্যই হলো তাদের সুখী করা। এবং যারা অলস ধনীদের অনুমোদন করেন না তাদের চিন্তার সামঞ্জস্য থাকে না যদি তারা তাদের সন্তানদের কাজ দরকারি এই বোধে আপুত না করেন, এবং এমন অভ্যাস গড়ে দেন যাতে তারা নিয়তির কাজ করা সম্ভব মনে করে।
আরো একটি ব্যাপার: এ ব্যাপারে স্বাধীনতার প্রবক্তারা কমই গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। ভাবুন ছোটদের একটি সম্প্রদায়ের কথা যেখানে বয়স্করা হস্তক্ষেপ করেন না; সেখানে সবলের অত্যাচার হয় প্রবল, এবং এই অত্যাচার বয়স্কদের চেয়েও হিংস্র হতে পারে। যদি দুটি ২/৩ বছরের ছেলেকে এক সঙ্গে খেলতে দেয়া যায়, তবে তারা ঝগড়া করবে, একজন হবে জয়ী, অপরজন পরিণত হবে দাসে। যেখানে তারা সংখ্যায় অধিক সেখানে একজন কি দুজন পূর্ণ প্রভুত্ব অর্জন করবে, বাকিদের স্বাধীনতা অনেক খাটো হয়ে যাবে, অথচ বয়স্করা হস্তক্ষেপ করলে দুর্বল ও কম কলহপ্রিয়দের স্বাধীনতা তুলনামূলকভাবে বেশি হতো। অপরের প্রতি সুবিবেচনা শিশুদের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জাগরিত হয় না, এটা শেখানো উচিত, এবং কর্তৃত্ব খাটানো ছাড়া এটা শেখানো সম্ভব নয়। বয়স্কদের ক্ষমতাচ্যুতির বিরুদ্ধে এটা সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি।
আমি মনে করি না যে শিক্ষাবিদগণ স্বাধীনতার ঈঙ্গিত কাঠামোর সঙ্গে দরকারি ন্যূনতম নৈতিক প্রশিক্ষণের মিলনের সমস্যা সমাধান করতে পেরেছেন। স্বীকার্য যে, সঠিক সমাধান অভিভাবকরাই অসম্ভব করে তোলেন সন্তানদের সংস্কৃতিবান স্কুলে ভর্তি করার আগেই। মনঃসমীক্ষকরা যেমন রোগসংক্রান্ত অভিজ্ঞতা থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে আমরা সবাই উন্মাদ, অনুরূপভাবে আধুনিক স্কুলের কর্তারা, অভিভাবকদের দ্বারা বিশৃঙ্খল হওয়া ছাত্রদের সংশ্রবে এসে সিদ্ধান্ত নেন যে সব শিশু দুরূহ প্রকৃতির এবং অভিভাবকরা একেবারে নির্বোধ। অভিভাবকদের অত্যাচারে যেসব ছেলে বন্য হয়ে গেছে তাদের দীর্ঘ কিংবা স্বল্প সময়ের জন্য পূর্ণ স্বাধীনতা দরকার, তবেই তারা বয়স্কদের নিঃসন্দিগ্ধ মনে করবে। কিন্তু যাদের সঙ্গে গৃহে বিজ্ঞতার সঙ্গে আচরণ করা হয়েছে তারা তদারকি সহ্য করবে। এই শিশুদের বোধ করতে হবে যে তাদের এমন ব্যাপারে সাহায্য করা হচ্ছে যে ব্যাপারকে তারা নিজেরা গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। যে বয়স্ক ব্যক্তি শিশুদের পছন্দ করেন এবং শিশুদের সাহচর্যে স্নায়ুর চাপ বোধ করেন না তারা শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে অনেক দূর অগ্রসর হতে পারেন এবং তা পারেন শিশুদের বন্ধুতাপূর্ণ অনুভূতি না হারিয়ে।
আমার মনে হয় আধুনিক শিক্ষাতাত্ত্বিকরা শিশুদের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার নঞর্থক দিকের প্রতি অতিরিক্ত গুরুত্ব প্রদানের পক্ষপাতী, পক্ষান্তরে শিশুদের সাহচার্য উপভোগের সদর্থক দিকের প্রতি কম গুরুত্ব প্রদানে আগ্রহী। আপনার যদি শিশুদের প্রতি সেই ধরনের অনুরাগ থাকে যে ধরনের অনুরাগ দেখা যায় অনেক লোকের ঘোড়া ও কুকুরের প্রতি, তবে তারা আপনার ইংগিতে সাড়া দেবে, বিধিনিষেধ মানবে, হয়তো কিছুটা আনন্দদায়ক অসন্তোষের সঙ্গে। কিন্তু কিছুতেই ক্ষুব্ধ হবে না। শিশুদের প্রতি সেই ধরনের অনুরাগের কোনো মূল্য নেই যেখানে তাদের সামাজিক কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্র কিংবা ক্ষমতালিপ্সা প্রকাশের সুযোগ গণ্য করা হয়। কোনো শিশুই কৃতজ্ঞ বোধ করবে না যদি তার প্রতি উৎসাহের উৎস হয় আপনার দলের জন্য ভোট লাভ কিংবা রাজা বা দেশের জন্য তাদের উৎসর্গ করা। ঈপ্সিত অনুরাগ হলো শিশুদের মেলায় স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দ, এবং কোনো অন্তর্গত অভীষ্ট না-থাকা। এই গুণ যে শিক্ষকের রয়েছে তার শিশুর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের দরকার করবে না, এবং প্রয়োজনে মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতিসাধন না করেই তিনি হস্তক্ষেপ করতে পারবেন।
দুর্ভাগ্যবশত, কর্মভারাক্রান্ত একজন শিক্ষকের পক্ষে শিশুদের প্রতি হৃদোখিত অনুরাগ বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নয়; তার অনুভূতি দাঁড়ায় প্রবাদের ময়রার মতো; মিষ্টির প্রতি ময়রার যে অনুভূতি, ছাত্রের প্রতি শিক্ষকের অনুভূতির সঙ্গে তার তুলনা চলে। আমি মনে করি না যে শিক্ষা কারো একান্ত পেশা হওয়া উচিত: এই পেশায় নিয়োজিত হবে তারা যারা দুঘণ্টা শিক্ষকতা করে বাকি সময় ছাত্রদের থেকে দূরে কাটাবেন। যুবকদের সমাজ খুবই ক্লান্তিকর, বিশেষত যখন কঠোর শৃঙ্খলা এড়িয়ে যাওয়া হয়। ক্লান্তি বা শ্রান্তি পরিশেষে জন্ম দেয় বিরক্তির, যা এক সময় কোনো না কোনোভাবেই প্রকাশিত হবেই, পেরেশান শিক্ষক নিজেকে যে তত্ত্বেই গড়ে তুলুন না কেন। প্রয়োজনীয় বন্ধুভাবাপন্ন অনুভূতি কেবল আত্মসংযম দ্বারা রক্ষা করা যায় না। কিন্তু যেখানে এটা বর্তমান, সেখানে আগে থেকে দুষ্টু ছেলের প্রতি আচরণের নিয়ম রাখা নিষ্প্রয়োজনীয়, যেহেতু আবেগ সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছায় এবং যে-কোনো সিদ্ধান্ত সঠিক হবে যদি সে অনুভব করে আপনি তাকে পছন্দ করেন। কোনো নিয়মই, যতই বিজ্ঞতাপূর্ণ হোক, স্নেহ কিংবা বিচক্ষণতার বিকল্প হতে পারে না।