১০. আজ চিত্রাঙ্গদার বিয়ে

দশ

মণিপুরের নগর জুড়ে আজ উৎসবের সানাই বেজে উঠেছে। আজ চিত্রাঙ্গদার বিয়ে।

এদেশে ইন্দ্রকে কেউ দেখেনি। তবু, অর্জুনকে দেখে সবাই বলতে লাগল, ছেলে কালো হলে কী হবে, তার রূপ একমাত্র ইন্দ্রের সঙ্গেই তুলনীয়। রাজপোশাকে তাকে কেমন মানিয়েছে দেখো। এ যদি যুদ্ধ করতে যায়, অনেক বীর একে দেখেই পালিয়ে যাবে। আবার মুখখানা কেমন কচি!

প্রদীপকের মতো যারা অর্জুনের নামই শোনেনি, তারা যখন জানল, ত্রিভুবনের সেরা ধনুর্ধরের সঙ্গে তাদের রাজকুমারীর বিয়ে হচ্ছে, তখন, নিজেদের অজ্ঞতা ঢাকার জন্য, তার বীরপনার নানা মনগড়া কথা বানিয়ে বানিয়ে এ ওকে বলতে লাগল। কেউ বলল, ইন্দ্র সাতবার এই তরুণের কাছে যুদ্ধে পরাস্ত হয়েছে। কেউ বলল, জরাসন্ধ, যাকে মান্য করে না এমন রাজা নেই, সে পর্যন্ত এই তরুণ বীরের পরাক্রমে যুদ্ধভূমি ছেড়ে পালিয়েছিল। যে শুনছিল সে ভাবল, জরাসন্ধ যদি এর কাছে হেরে যায় তো কৃষ্ণর হারতে বাধা কোথায়? সে তখন হামবড়াই করে বলতে লাগল, আর লোকে যাকে ভগবান বলে, সেই কৃষ্ণর কী দশা হয়েছিল এর হাতে শুনবে?

সবচেয়ে বড় গলা বেরুল প্রদীপকের। সে বলে বেড়াতে লাগল, আমার দোকানে মেঠাই খেয়ে গিয়েছে। আমি তো দেখেই বুঝেছিলাম, এই ছেলে কেউকেটা না হয়ে যায় না।

যে যতই বানিয়ে বলুক, প্রদীপকই একমাত্র লোক যার সঙ্গে অর্জুনের সরাসরি কথা হয়েছে। তাই তার গুরুত্ব আজ সবচেয়ে বেশি।

অর্জুন সম্পর্কে পল্লবিত গল্পকথা দাসী-বন্ধু-আত্মজনের মুখে মুখে চিত্রাঙ্গদা পর্যন্ত পৌঁছেছে। মণিপুরের বাইরের রাজনীতি নিয়ে তার কোনও আগ্রহ নেই। তাই হস্তিনাপুরের কুরু-পাণ্ডবের রেষারেষির কোনও খবরই সে রাখত না। চিত্রবাহন যতখানি সম্ভব মেয়েকে বলেছে, আর ওই কানাঘুষোর কল্পকাহিনি।

পুরুষের বেশ ছেড়ে আজ চিত্রাঙ্গদা পরেছে মেয়ের পোশাক। বহুমূল্য পোশাক আর সোনাগয়নায় তার রূপ দশগুণ উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। অর্জুন চিত্রাঙ্গদার থেকে চোখ সরাতে পারছিল না। পুরুষের পোশাকে সে ছিল আকর্ষণীয়। এখন, নারীর পোশাকে মোহময়ী। তার ইচ্ছে করছিল চিত্রাঙ্গদাকে নিবিড় করে জড়িয়ে নেয়। কিন্তু কোথায় যেন অপরিচয়ের বাধা থেকে যাচ্ছিল।

যে-ঘরে তারা এখন আছে, তা খুব সুন্দর করে সাজানো। সোনায় রুপোয় রত্নে একেবারে রাজকীয়। ঝলমলে মণিপুরের রাজপ্রাসাদে ঝলমলে ঘরে ঝলমলে মেয়ে চিত্রাঙ্গদা। তার সঙ্গে কোন কথা শুরু করা যায় ভেবে পেল না অর্জুন। অপ্রতিভ হয়ে বসে রইল সে।

চিত্রাঙ্গদা দেশ শাসন করা মেয়ে। অত সহজে কথা হারায় না সে। অর্জুনের দিকে তাকিয়ে সে বলল, “তোমার নাম অর্জুন?”

তার চোখে-মুখে কিশোরীর চপলতা, অর্জুনের ভাল লাগছিল। সে বলল, “হ্যাঁ। আমি অর্জুন।”

“অর্জুন কথার অর্থ কী?”

“সাদা। শুক্লবর্ণ।”

“তুমি তো কালো। তা হলে তোমার নাম অর্জুন কেন?”

“তা জানি না। তবে সবাই চায় মায়ের কোল আলো করা ফুটফুটে ফর্সা ছেলে হোক। আমি হলাম উল্টো। কুচকুচে কালো। তাই হয়তো অর্জুন নাম রেখে সবাই সান্ত্বনা পেতে চেয়েছিলেন।”

“কানা ছেলের নাম যেমন পদ্মলোচন?” চিত্রাঙ্গদা হাসিতে উছলে উঠল। তার একটি গজ দাঁত আছে। হাসলে খুব মিষ্টি দেখায়। ভাল লাগার আবেশে চিত্রাঙ্গদার একটি হাত ধরল অর্জুন। বলল, “চিত্রাঙ্গদা, তুমি খুব সুন্দর।”

“সে আমি জানি। আর নতুন বউকে যে সুন্দরী বলে প্রশংসা করতে হয়, সেও আমার অজানা নেই।” বলল চিত্রাঙ্গদা। চোখের কোণে অর্জুনের দিকে তাকিয়ে বলল, “শুনেছি তুমি নাকি মস্ত বীর।”

“কে বলল?”

“লোকে বলাবলি করছে। বাবাও বলল। বাবা অনেক খবর রাখে। বাবার যেমন ধনরত্ন, তেমনি জ্ঞান, তেমনি বীরত্ব। আমি অবশ্য শিবঠাকুরের কাছে চিরকাল একজন মহাবীর পতি চেয়েছি। আচ্ছা, তুমি আমাকে যুদ্ধে হারাতে পারবে?”

“নারীর সঙ্গে আমি যুদ্ধ করি না চিত্রাঙ্গদা।”

চিত্রাঙ্গদা বেশ গর্বের সঙ্গে বলল, “কেন? করো না কেন? মেয়েদের কাছে হারতে লজ্জা হয় বুঝি?”

অর্জুন খানিক বিপর্যস্ত হয়ে পড়ল। সে এখন কী জবাব দেয়? কৃষ্ণ হলে সকৌতুকে কত কথা বলতে পারত। হয়তো বলত, “মেয়েদের কাছে হার মেনেই তো আমার সুখ।” কিন্তু অর্জুন ওভাবে বলতে পারে না। তার ওপর এই মেয়েটির বেপরোয়া ভঙ্গিটিও তাকে ত্রস্ত করে তুলছে। সে মুখখানা গম্ভীর করে বলল, “মেয়েদের সঙ্গে যুদ্ধ করা আমার ধর্মবিরুদ্ধ।”

ধর্মের মতো গুরুভার শব্দটি এসে যাওয়ায় চিত্রাঙ্গদা আর সে প্রসঙ্গে রইল না। পুরুষ যেমন বাহু ভাঁজ করে, হাত মুঠো করে কাঁধের কাছে এনে পেশি ও বল প্রদর্শন করে, চিত্রাঙ্গদাও তার গয়না-পরা, কুমকুমের আল্পনা আঁকা হাতখানি নিয়ে তেমনি করতে লাগল। সে কতদূর বলশালিনী, অর্জুনকে তাই দেখাবার ইচ্ছা। অর্জুনের হাসি পেল। এই মেয়েটিকে কোলে নিয়ে সে পাহাড়চূড়ায় উঠে যেতে পারে, সাঁতরে যেতে পারে গোটা একটা নদী, একটা যুদ্ধের মোকাবিলা সে করতে পারে চিত্রাঙ্গদাকে কোলে বসিয়ে। এবং এখন, চিত্রাঙ্গদাকে কোলে নেবার বাসনাই তার তীব্র হল। কিন্তু সে চুপ করে রইল। চিত্রাঙ্গদা বলল, “দেখেছ?”

অর্জুন বলল, “কী?”

“আমার বল। জানো, আমি বুনো শুয়োর শিকার করতে পারি? তুমি পারো?”

“চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কী?”

“আচ্ছা আচ্ছা। দেখব।”

“আমি না হয় হরিণ-টরিণ মারব। তুমি শুয়োর মেরো।”

“তা হলে আমার সঙ্গে যুদ্ধ করবে না তুমি?”

“উঁহু!”

“আমার বাবাকে হারাও তো দেখি।”

“চিত্রবাহন আমার শ্বশুর। তাঁর সঙ্গে লড়তে যাব কেন?”

“ভয় পেলে?”

“তুমি যেরকম আমাকে আমারই বউয়ের সঙ্গে শ্বশুরের সঙ্গে লড়িয়ে দিতে চাইছ, তাতে আমার একটু একটু ভয়ই করছে।”

“আচ্ছা, আমার সঙ্গে পাঞ্জা কষতে তোমার আপত্তি নেই তো?”

“না। তবে হারজিতের শর্ত কী হবে?”

“আমি যদি হেরে যাই, কাল আমার রথে চাপিয়ে তোমায় মণিপুর ঘোরাব। আর তুমি যদি হেরে যাও, মণিপুর ঘোরা হবে, কিন্তু আমার রথের সারথি হবে তুমি। রথ চালাতে পারো তো?”

“একটু-আধটু।”

“নাও, ধরো, দেখি আমার হাত।”

অর্জুন মুচকি হেসে চিত্রাঙ্গদার পাঞ্জা ধরল। রাজ্য শাসন করা সবল করতল অর্জুনের বিরাট হাতের নীচে ঢাকা পড়ে গেল। যেন কালো মেঘের দল এসে আড়াল করে দিল চন্দ্রমা।

চিত্রাঙ্গদা বলপ্রয়োগ করছে, অর্জুন কেবল তা প্রতিরোধ করতে লাগল। যতক্ষণ লড়াই চলবে এবং যতক্ষণ চিত্রাঙ্গদা পরাস্ত হবে না, ততক্ষণ সে আনন্দ পাবে। চিত্রাঙ্গদাকে আনন্দ দিতেই চায় অর্জুন। সে বুঝতে পারছে, চিত্রাঙ্গদা যতই বিচার করুক আর বীরত্ব দেখাক, সে এখনও রাজার আদরের দুলালী। এখনও সরল। কুটিল পরিপক্কতা তাকে গ্রাস করেনি।

চিত্রাঙ্গদা হাঁটু মুড়ে বসেছে। ঠোঁট কামড়ানো। এক হাত পিছনে। গয়না ঝনঝনিয়ে কিছুক্ষণ বল প্রয়োগ করে চিত্রাঙ্গদা বলল, “তুমি খেলছ না।”

“খেলছি তো।”

“কোথায়?”

“এটা কী করছি?”

“তুমি নিজেও হেরে যাচ্ছ না, আমাকেও হারাচ্ছ না। আমরা বুঝি সারাক্ষণ সারারাত এভাবে লড়ব?”

অর্জুন হেসে ফেলল। এক লহমায় চিত্রাঙ্গদাকে হারিয়ে দিয়ে তাকে প্রায় শূন্যে তুলে নিল। নিজের কোলে বসিয়ে, তাকে শক্ত করে ধরে বলল, “কী মনে হয়? তোমাকে যুদ্ধে হারাতে পারব? কী মনে হয়? আমি বীর? ঠিক যেমনটা শিবঠাকুরের কাছে চেয়েছ তেমন?”

চিত্রাঙ্গদা অর্জুনের বুকে দু’হাত রেখে ঠেলে দিতে দিতে বলল, “তুমি পুরুষ, নারীর চেয়ে বেশি বলশালী তো হবেই। একটা মেয়ের কাছে গায়ের জোর ফলাচ্ছ? ছি ছি।”

অর্জুন তীব্রকাম হয়ে উঠেছিল। সহসা, একেবারে শান্ত হয়ে গেল সে। চিত্রাঙ্গদাকে কোল থেকে নামিয়ে দিল। চিত্রাঙ্গদা সকৌতুকে যা বলেছে, তাও তার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব হল না। একটা মেয়ের কাছে গায়ের জোর ফলাবে সে? অর্জুন? মেয়েটা তার বউ হলেও নয়।

নিজের গয়নাগাঁটি খুলতে খুলতে অর্জুন বলল, “ক্ষমা করো আমাকে চিত্রাঙ্গদা। আমি গায়ের জোর দেখাতে চাইনি। তোমার যখন বিশ্বাস আসবে আমার ওপর, তুমি এসো।”

ম্লান হয়ে গেল চিত্রাঙ্গদার মুখ। সে বলল, “তুমি কষ্ট পেলে অর্জুন? আমি মজা করছিলাম।”

অর্জুন চুপ করে রইল। চিত্রাঙ্গদা ছুটে এসে অর্জুনকে জড়িয়ে ধরল। দীর্ঘকায় অর্জুন তার লম্বা লম্বা হাত দু’টি দিয়ে চিত্রাঙ্গদাকে জড়িয়ে ধরল ঠিকই কিন্তু তার কামভাব ফিরে এল না। সামান্য কথা। তবু কী ভয়ঙ্কর বিষাদ ঘনিয়ে তুলেছে মনে! অকারণ অভিমানে তার গলার কাছে ব্যথা করে উঠল। উলূপীর কথা দারুণভাবে মনে পড়ল তার। শুধু রমণসুখ নয়, উলূপীর সঙ্গে কথা বলে, তিরন্দাজি অভ্যাস করে, শ্বেতনাগিনীর জলে স্নান করে গভীর আনন্দ পেয়েছিল অর্জুন। চিত্রাঙ্গদাকে বুকে নিয়ে এক আশ্চর্য উপলব্ধি হল অর্জুনের, যার সঙ্গে চিত্রাঙ্গদার কোনও যোগ নেই। দু’টি সমান মাপের মন, সমান মাপের অনুভূতিসম্পন্ন হৃদয় যখন মেলে, কথা বলে পরস্পর পাশাপাশি, মুখোমুখি— তার যে আনন্দ, তা অশেষ, তা অতুলনীয়, চূড়ান্ত রমণসুখের চেয়েও বেশি। কৃষ্ণর কাছে সেই আনন্দ পায় অর্জুন। উলূপীর কাছে পেয়েছিল। তাই কৃষ্ণর কাছে যাবার জন্য তার মন ব্যাকুল। তাই উলূপীর সঙ্গে থাকার সময় সে অত কথা বলে উঠেছিল। চিত্রাঙ্গদা উলূপী নয়। কৃষ্ণ নয়। সেরকম কিছু আশাও করেনি অর্জুন। তবু, বিষাদে কষ্টে অর্থহীন ক্লান্তিতে সে বিধুর হয়ে রইল। এই বিষাদ তাকে সহজে ছাড়বে না।

চিত্রাঙ্গদাকে নিয়ে জানালার কাছে গেল সে। কথা বলতে ভাল লাগছিল না। তবু বলল, “সেদিন তোমার বিচারসভা দেখছিলাম। সেই যেদিন শলকের বিচার করছিলে।”

চিত্রাঙ্গদা অর্জুনের একটি বাহু দু’হাতে জড়িয়ে বলল, “তুমি ছিলে? কোথায়? আমি তো দেখিনি।”

অর্জুনের বাহুতে চিত্রাঙ্গদার স্তন ছুঁয়ে যাচ্ছিল। তা সত্ত্বেও তার কামভাব ফিরে এল না। সে বলল, “তুমি কী করে দেখবে? তুমি ছিলে বিচারকের আসনে। আর আমি জনতার মধ্যে মিশেছিলাম।”

“বলো তো শলককে কী শাস্তি দিয়েছি আমি?”

অর্জুন বলল। তারপর যোগ করল, “বেশ বিচার তোমার। তোমার শাসনে রাজ্যে লোকজন ভাল থাকবে। তুমি যুদ্ধ করেছ কখনও?”

“অনেকবার।”

“কেমন যুদ্ধ?”

“দস্যু তাড়িয়েছি।”

“নারী বলে চিনে ফেলে না তোমায়?”

“বর্ম পরে থাকলে আর নারী-পুরুষ কী? স্তন দুটি ছাড়া বাইরে থেকে নারীকে আর কী দিয়ে আলাদা করা যাবে? বর্মে সব ঢাকা থাকে। আর যদি চিনেও ফেলে কেউ, তাতে কী? রাজা চিত্রবাহনের মেয়ে আমি। আমাকে কে কী বলবে?”

“খুব কম মেয়েই এমন জীবন কাটায়।”

“আমার এসব ভাল লাগে না।”

“ভাল লাগে না?”

“না। বাবা আমার মধ্যে ছেলেকে দেখতে চায়। আমি বাবার ইচ্ছা পূর্ণ করি মাত্র। কিন্তু কোনও মেয়ে কি পুরোপুরি পুরুষোচিত হতে পারে, নাকি তা হতে চায়?”

“তোমার তা হলে কী ভাল লাগে?”

“অন্য মেয়েরা যেমন থাকে, তেমনি। সুন্দর পোশাক পরব, সাজব, বেড়াব, ব্রতপালন করব। ছেলেপিলে মানুষ করব। রাজকোষে অর্থ কোথা থেকে আসবে, কোন প্রজা কর ফাঁকি দিল, কোন গ্রামে দস্যু-তস্করের উপদ্রব বাড়ল, প্রতিবেশী রাজ্যগুলি আমাদের চেয়েও বেশি শক্তিমান হয়ে উঠল কিনা, এসব ভাবতে আমার এতটুকু ভাল লাগে না অর্জুন। অপেক্ষা করে আছি, কবে আমার একটা ছেলে হবে, আর আমি এই পুরুষের জীবন থেকে মুক্তি পাব। আমাকে তুমি একটা ছেলে দিয়ো অর্জুন। পুত্রবতী হতে চাই আমি।”

অর্জুন চিত্রাঙ্গদার কপালে চুমু খেল। তারপর ঘুমোতে গেল দু’জনে।

শেষ রাত্রে অস্ত্র অভ্যাস, পূজা ইত্যাদি রোজকার কাজের জন্য উঠে পড়ল অর্জুন। চিত্রাঙ্গদা গভীরভাবে ঘুমোচ্ছে। তাকে ডাকতে ইচ্ছে করল না। প্রহরীকে বলে রাজপুরী থেকে বেরিয়ে পড়ল অর্জুন। কে যেন তাকে অনুসরণ করছে! অর্জুন ঘুরে দাঁড়াল। একটি ছায়ামূর্তি দ্রুত এগিয়ে এল কাছে। অর্জুন বলল, “অনুপ, তুমি?”

অনুপ বলল, “সজাগ ছিলাম। যদি তোমার কোনও প্রয়োজন হয়। অতিথিশালার আরামে সবাই খুব ঘুম লাগিয়েছে। বিদেশ-বিভুঁইয়ে অন্ধকারে তুমি একা চলেছ, তাই আমিও এলাম। তোমার সঙ্গে যাব তো আমি অর্জুন?”

“চলো।”

তির ছোড়া, যোগাভ্যাস করে ফিরে এল অর্জুন। চিত্রাঙ্গদা তখনও ঘুমোচ্ছে। অর্জুন তাকে জাগিয়ে দিয়ে বলল, “আমাকে স্নান করতে হবে, পুজো করতে হবে। তার ব্যবস্থা কী?”

চিত্রাঙ্গদা বিরক্ত হয়ে বলল, “এর জন্য তুমি আমাকে জাগালে? আমাদের ঘরের বাইরে যে-প্রহরী তাকে বলো। ও চাকর-বাকর পাঠিয়ে দেবে।”

অবশিষ্ট ঘুম পুষিয়ে নিতে শুয়ে পড়ল চিত্রাঙ্গদা।

এগারো

তিনরাত্রি অর্জুনের সঙ্গীরা অতিথিশালায় কাটাল। চিত্রবাহনের পরিচারকরা তাদের সুখে-যত্নেই রেখেছিল। এর বেশি আতিথ্য নেওয়া ঠিক নয় বলেই মনে হল অর্জুনের। অনুপ ও পুরোহিত সহ সবাইকে সে কুটিরে ফিরে যাবার নির্দেশ দিল।

স্বয়ম্বর সভায় পাঞ্চালীকে জিতে নিয়ে নিজেদের আস্তানায় ফিরে এসেছিল ভীমসেন আর অর্জুন। ছোট্ট একটা মেটে ঘর, তাতে মা কুন্তী আর তারা পাঁচ ভাই অতি দীনভাবে থাকত। সেই সময়, ব্রাহ্মণের বেশে, ভিক্ষাই ছিল তাদের ভরসা। ব্রাহ্মণকে ভিক্ষা দিলে পুণ্য হয়। তাই লোকে কিছু না কিছু তাদের দিত। তবু ‘ভিক্ষা দাও’ বলতে ভারী সঙ্কোচ হত অর্জুনের। নকুলেরও। তারা বাটি হাতে চুপচাপ গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত লোকের বাড়ির দরজায়। অর্জুনের এই ইন্দ্রের মতো রূপ, নকুলের অমন দেবদুর্লভ চেহারা— দীনবেশে তার কিছুটা চাপা দেওয়া যায় ঠিকই, সবটা যায় না। লোকে ভিক্ষা দিতে এসে অবাক চোখে তাদের দেখত।

ভিক্ষায় বেরিয়ে সবচেয়ে বেশি মজা করত ভীম। সে এটাকে খেলা হিসেবে নিয়েছিল। গৃহস্থের দুয়ারে গিয়ে বজ্রনাদে বলত, “জয় হোক।” তার ওই মেঘনিন্দিত স্বরের আকর্ষণে লোক ভিক্ষা নিয়ে আসত, অমন পর্বতের মতো বিশাল অথচ সুগঠিত দেবোপম চেহারা দেখে ভিক্ষাও দিত দ্বিগুণ। বেশির ভাগ দিন সহদেবই হত ভীমের সঙ্গী। তাকে লাগত যেন পাহাড়ের ধারে সবুজ পাতাওয়ালা আতাগাছের তরুণ শাখা।

কোন বাড়ির লোক কীভাবে হাঁটে, কীরকম চোখ পিটপিট করে, কার উঁচু দাঁতের ফাঁক দিয়ে কথা বললেই থুতু ছিটকোয়, ভিক্ষা দেবার সময় কোন লোকের কোমরের কষি আলগা হয়ে বসন খুলে পড়ছিল— সেইসব বাড়ি ফিরে অভিনয় করে দেখাত ভীম। খুব হাসত তারা।

তাদের মধ্যে যুধিষ্ঠির ছিল খুবই সংযত। ভিক্ষাকে খেলাচ্ছলেও নেয়নি সে, সঙ্কোচের সঙ্গেও নয়।

অভিনয় করতে অর্জুনও ভাল পারে। তবে, সে মেয়েদের নকল করে চমত্কার। তাদের কোমর দুলিয়ে চলা, ললিত ভাব, চোখের কোণে তাকানো, সুর করে কথা বলা। তার ওই বিশাল সুগঠিত পুরুষোচিত শরীরের মেয়েলি ভাব এতটাই বিপরীত লাগে যে, হাসি পায় বেশি।

জঙ্গলের বাঁশ কেটে বাঁশি বানিয়েছিল নকুল, কুমোরবাড়ি থেকে সহদেব পাখোয়াজ চেয়ে আনত, অর্জুন গান গাইত বাঁশি আর পাখোয়াজ সঙ্গতে। দুঃখ-কষ্টের দিনগুলো এভাবেই আনন্দে ভরে রেখেছিল তারা। পরস্পরকে ভালবেসে, পরস্পরকে আনন্দ দিয়ে, পরস্পরের প্রতি নির্ভর করে।

তারই মধ্যে পাঞ্চালী এসেছিল। সরাসরি রাজপ্রাসাদ থেকে এসে, ওই এক ছোট্ট ঘরে, তাদের ছ’জনের সঙ্গে খড়ের বিছানায় শুয়েছিল পাঞ্চালী। এতটুকু অভিযোগ বা আপত্তি করেনি।

ওই বাড়িতেই কৃষ্ণর সঙ্গে প্রথম কথা হয়েছিল অর্জুনের। তাঁদের পাঁচ ভাই ও কুন্তীর সঙ্গে প্রথম প্রত্যক্ষ সাক্ষাৎ। বলরামও ছিল সঙ্গে। কুন্তী তাদের খুব আদর-যত্ন করছিল।

এরপর অবশ্য দ্রুপদরাজা খুব সম্মান দিয়ে তাদের নিজের কাছে নিয়ে আসে। বেশিদিন রাজার অতিথি হয়ে থাকতে যাতে তাদের খারাপ না লাগে, তাই তাদের জন্য আলাদা বাড়ি তৈরি হয়েছিল।

অর্জুন ভাবল, তিনরাত্রি কেটে গিয়েছে, এবার চিত্রাঙ্গদাকে নিয়ে নিজের কুটিরে চলে যাবে সে। তার প্রস্তাব শুনে চিত্রবাহন একেবারে হাঁ-হাঁ করে উঠল, “তাই কখনও হয় নাকি? চিত্রাঙ্গদা থাকবে পর্ণকুটিরে? সাতপরত তুলোর বিছানা না হলে তার ঘুমই হয় না! তা ছাড়া অর্জুন, আমি তো তোমাকে বলেছিলাম, চিত্রাঙ্গদাকে তুমি নিয়ে যেতে পারবে না।”

অর্জুন বলল, “তাকে আপনার রাজ্যে, এই নগর সীমান্তেই আমি রাখব।”

“অর্জুন, তোমার কি এখানে কোনও অসুবিধা হচ্ছে? তুমি বলতে সঙ্কোচ কোরো না। আমার তো টাকার অভাব নেই। তোমার জন্য দশটা চাকর রেখে দেব আমি। তারা সবাই শুধু তোমার প্রয়োজন সাধন করবে।”

“বিলাস এবং আরামের কোনও অভাব নেই আপনার প্রাসাদে। কিন্তু আপনাকে তো আমি বলেছি, আমি ভ্রমণে বেরিয়েছিলাম। প্রধানত তীর্থগুলোয় যাওয়াই আমার ইচ্ছা। বেশি আরামে থাকলে হয়তো তীর্থদর্শনের ইচ্ছাই চলে যাবে। বেশিদিন শ্বশুরবাড়িতে থাকলে লোকে আমাকে ঘরজামাই বলে নিন্দে করবে তো।”

“কেউ তোমার নিন্দে করবে না। কার এত বড় ক্ষমতা এই রাজ্যে যে, চিত্রবাহনের জামাইয়ের নিন্দে করবে?”

অর্জুন হেসে বলল, “মণিপুরের বাইরেও অর্জুনের একটা জগৎ আছে। মহারাজ, এখানে আসার আগে আমি গঙ্গাদ্বারে অবস্থান করেছিলাম। তারপর অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গ ঘুরে এখানে এলাম। গঙ্গাদ্বারে থাকার সময় নাগরাজ্যের রাজকুমারী কৌরব্য নাগের মেয়ে উলূপীকে আমি বিয়ে করি। খুব অল্প দিন আমি সেখানে ছিলাম। উলূপী গর্ভবতী হওয়ার পরেই আমি তীর্থে বেরিয়ে পড়েছিলাম।”

চিত্রবাহন বলল, “দাঁড়াও, দাঁড়াও। এখানে অনেক কথা আছে। প্রথমত, তুমি তো বলেইছ খুব বেশি হলে তিন বছর তুমি এখানে থাকবে। আজীবন থাকার সঙ্কল্প নেই যখন, কেউ তোমাকে ঘরজামাই বলে অমর্যাদা করবে না। আমার এত বিষয়-আশয় থাকতে কেন আমার মেয়ে-জামাই এত কষ্ট করবে, বলো তো? আর কৌরব্য নাগের কথা শুনে খুব ভাল লাগছে। সে আছে কেমন?”

“আমি তাঁর কুশল দেখে এসেছি।”

“আহা! খুব আনন্দ পেলাম। আমরা দু’জনেই কশ্যপের আশ্রমে লেখাপড়া করেছি। সে আমার প্রাণের বন্ধু। তার মেয়ে উলূপীকেও আমি ভালই চিনি। উলূপীরও এই মণিপুর দেশ অজানা নয়। তার তো একবার, মানে, কৌরব্য নাগের সমস্ত পারিবারিক অনুষ্ঠানে আমি গিয়েছি। চিত্রাঙ্গদার বিয়ে এত অল্প সময়ে হল যে, দূর দেশের আত্মীয়-বন্ধুদের আর ডাকতে পারিনি। আমার নাতি হলে খুব ধুমধাম করে তার অন্নপ্রাশন করব। তা উলূপীকে তুমি বিয়ে করেছ, খুব ভাল। সে ভারী গুণী মেয়ে। তার একটা ছেলে হলে আর কোনও দুঃখ থাকবে না।”

অর্জুন বুঝল, চিত্রবাহন উলূপীর প্রথম বিয়েতে উপস্থিত ছিল, সেই ইঙ্গিত করল। তার প্রথম স্বামীর মৃত্যুসংবাদও যে চিত্রবাহন জানে, তা-ও বোঝাল।

উলূপীর ব্যক্তিগত জীবনের আলোচনায় অর্জুনের এতটুকু রুচি ছিল না। কিন্তু সে যদি নীরব থাকে, এই চিত্রবাহন উলূপী এবং কৌরব্য নাগকে হীন ভাবতে পারে। সব গোপন করে অর্জুনকে প্রবঞ্চিত করেছে তারা— এমন ভাবনার আশ্রয় দেওয়া উচিত নয়। যে ঠকায় সেও যেমন গৌরবের যোগ্য থাকে না, যে ঠকে তারও অগৌরব হয়। সে বলল, “উলূপী অত্যন্ত রূপবতী, গুণী, সত্যনিষ্ঠ এবং কর্তব্যপরায়ণ। কৌরব্য নাগ একজন আদর্শ রাজা এবং আদর্শ পিতাও বটেন। আপনি আপনার যোগ্য বন্ধুই পেয়েছেন।”

কৌরব্য নাগের সঙ্গে তুলনায় তাকেও শংসিত করা হল বলে বেশ আত্মপ্রসাদ হল চিত্রবাহনের। সে বলল, “অর্জুন, তুমি শুধু বীরশ্রেষ্ঠই নও, তোমার বিচার এবং আত্মমর্যাদাবোধ অতি সূক্ষ্ম। তোমাকে আমার জামাই হিসেবে পেয়ে আমার গর্ব হচ্ছে। তুমি আমার জামাই, আমার ছেলের মতো। মণিপুরে যে ক’দিন থাকবে, আমার কাছেই থাকো। অপুত্রকের কষ্ট সমমর্মী না হলে কেউ বোঝে না অর্জুন। আমারই বিভ্রম। চিত্রাঙ্গদাকে ছেলে সাজিয়ে আমি না পেলাম কন্যালাভের পুরো স্বাদ, না পেলাম পুত্রলাভের। দেখো অর্জুন, নারীর বেশে আমার চিত্রাঙ্গদাকে কী অপরূপা লাগছে! আমার মেয়েটা যে এত সুন্দর— এতদিন তা আমি বুঝিনি। আজ বুঝছি আমি অর্জুন, ঈশ্বর যাকে যে-ভূমিকায় পাঠায়, তাই তাকে করতে দেওয়া উচিত। অর্জুন, আমার যদি একটা ছেলে থাকত, সে যেমন সানন্দে স্বাধীনচিত্তে এই রাজপ্রাসাদে, এই মণিপুর রাজ্যে ঘুরে বেড়াত, তুমি তেমনি থাকো। তোমাকে দেখে আমার বুকের জ্বালা অনেকখানি জুড়োবে অর্জুন।”

একটি ছেলের জন্য এই প্রৌঢ় রাজার কী আর্তি! এর ধনসম্পদ, লোকজন, সৈন্যসামন্ত, রাজ্য, সন্তান সব আছে, তবু লোকটা মনে মনে কত দীন! অর্জুনের ভারী কষ্ট হল চিত্রবাহনের জন্য।

আবেগে চিত্রবাহনের চোখে জল এসে গিয়েছিল। চোখ মুছে সে বলল, “মাঝে মাঝে ছদ্মবেশে রাজ্য ঘুরতে যাই আমি। দেখি কে কী করছে। কত দেখি জানো, কত ছোট ছোট ছেলে অবহেলায় পড়ে আছে! ধুলো-মাটি মাখছে, অখাদ্য-কুখাদ্য খাচ্ছে, আকথা-কুকথা শিখছে, মা-বাপের হুঁশ নেই! খুব রাগ হয় তখন। ভগবানের এ কোন বিচার! আমি, আমার এত সম্পত্তি, এত ক্ষমতা, ছেলেকে আমি দেবশিশুর মতো করে মানুষ করতে পারতাম, সেই আমাকে ঠাকুর ছেলে দিল না! দিল এইসব অপগণ্ডদের! তবে আজ আর আমার দুঃখ নেই। চিত্রাঙ্গদা ছিল বলেই তো তোমাকে পেয়েছি। যে-ছেলে এই অতিতরুণ বয়সে ইন্দ্রের সঙ্গে তুলনীয় হয়ে ওঠে, সে সাধারণ নয়। তুমি সাধারণ নও। ঈশ্বর কোনও বিশেষের অভিপ্রায়ে তোমাকে এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। তুমি অমর হবে অর্জুন। অমর অক্ষয় কীর্তি হবে তোমার। তোমার সঙ্গে সঙ্গে এই আমরা, অতি সাধারণ হয়েও যারা তোমার সঙ্গে জুড়ে গেলাম, এমনিতে আমরা মরে গেলে যে আমাদের দু’দিনেই লোকে ভুলে যেত, সেই আমরাও তোমার সঙ্গে সঙ্গে বেঁচে থাকব। তোমাকে, আমার সমস্ত পুণ্য দিয়ে আশীর্বাদ করি আমি অর্জুন। বিয়ের যৌতুক বলতে তুমি কিছুই নাওনি। আমি তোমাকে একটি যৌতুক দেব।”

চিত্রবাহনের আবেগ অর্জুনকে স্পর্শ করেছিল। সে ধরা গলায় বলল, “আমি যে ভীষ্মর আদর্শে, বিদুরের নীতিশিক্ষায় বড় হয়েছি রাজা। ভীষ্ম বিয়েতে পণ বা যৌতুক দেওয়া এবং নেওয়ার অত্যন্ত বিরোধী। সামাজিক রীতি হিসেবে কখনও কখনও তাঁকে এসব মানতে হয়েছে। কিন্তু তিনি নীতিগতভাবে যা সমর্থন করেন না, আমিও তা করতে পারি না। আপনি আমাকে যৌতুক দেবেন না।”

“ধরো যৌতুক নয়। ধরো এ আমার আশীর্বাদ। বাবার আশীর্বাদ ছেলেকে। অর্জুন, তুমি কি মেঘবাণের কথা জানো?”

“আমি বাণ মেরে মেঘাচ্ছন্ন আকাশ থেকে বৃষ্টি আনতে পারি। বাণ মেরে মাটি ফুঁড়েও জল আনতে পারি আমি। মেঘবাণ কি তেমন কিছু?”

“এই বাণ সাময়িক মেঘাচ্ছন্নতা আনয়ন করে সূর্য ঢেকে দেয়। এত ঘন সেই মেঘ যে, পৃথিবী তাতে অন্ধকারে ঢেকে যায়। মনে হবে, সূর্যাস্ত শেষে রাত নামল।”

“এ তো মহান বিদ্যা!”

“সেই বিদ্যাই আমি তোমাকে দেব অর্জুন। আমাদের পূর্বপুরুষ প্রভঞ্জন মহাদেবের কাছ থেকে এই অস্ত্র পেয়েছিলেন।”

“আমি নিশ্চয়ই এই আশীর্বাদী নেব।”

“আমি আনন্দিত অর্জুন। এই বাণ সারাজীবনে একবার মাত্র প্রয়োগ করা যায়। আর একজনকে মাত্র শেখানো যায়।”

“আমি মনে রাখব।”

“তা হলে তুমি আমার বাড়িতেই থাকছ তো অর্জুন? তবু আমি তোমাকে বলব তুমি চিত্রাঙ্গদার মত নাও। সে যদি কুটিরে গিয়ে থাকতে চায়, আমি আপত্তি করব না। পুরুষের পোশাকও আর আমি পরতে বলব না তাকে।”

আজ প্রথম নিজের প্রাসাদে থাকার জন্য অর্জুনকে আন্তরিক আমন্ত্রণ জানিয়েছে চিত্রবাহন। তার ওপর অভিনব একটি অস্ত্র পাবার প্রতিশ্রুতি পেয়ে অর্জুনের আর একটুও বিরূপতা ছিল না চিত্রবাহনের প্রতি। তবু সে চিত্রাঙ্গদাকে জিজ্ঞেস করবে বলেই ঠিক করল। এবং নিজের সঙ্গীদের সে কুটিরেই থাকতে বলবে। চিত্রবাহনকে সে বলল, “চিত্রাঙ্গদাকে পুরুষের কর্তব্যে দীক্ষা দিয়ে আপনি কোনও অন্যায় করেননি মহারাজ। রাজার কাছে প্রজাপালন প্রধান কর্তব্য। সেই কাজে, আপনার অবর্তমানে বা অক্ষমতায় দায়িত্ব নিতে পারে এমন একজনকে তৈরি করাও আপনার কর্তব্য ছিল। আপনি তাই করেছেন।”

“বলছ?”

“নিশ্চয়ই। চিত্রাঙ্গদাও পিতা এবং রাজ্যের প্রতি দায়িত্ববোধে সেই কর্তব্য করে চলেছে। ধন্যবাদ আপনাদের দু’জনেরই প্রাপ্য। মেয়েরাও যে বীর হতে পারে, চিত্রাঙ্গদা তা দেখিয়ে দিয়েছে। মেয়েরা কেন রাজা হবে না? কেন শাস্ত্র জানবে না? কেন হতে পারবে না ভুবনখ্যাত বীর? পুং নরক থেকে মেয়েরা কেন পারবে না বাপ-মাকে ত্রাণ করতে? মেয়ে তো পুত্রী। ত্র শব্দের যে অর্থ, ত্রী শব্দেরও তাই। ত্রাণ। ত্রাতা। তাই বলছি মহারাজ, চিত্রাঙ্গদাকে পুত্রের ক্ষমতা দিয়ে আপনি অন্যায় করেননি।”

অর্জুনের খুব ইচ্ছে করছিল মা কুন্তীর প্রজ্ঞা ও বুদ্ধির কথা বলে। কিন্তু সংযত হল। তা হলে তাদের পারিবারিক হিংসা ও চক্রান্তের কথাও বলতে হয়। কুরুবাড়ির নিন্দা সে কেমন করে করবে? যে-বাড়িতে আজও ভীষ্ম আছে, সে বাড়ির নিন্দা অর্জুন করতে পারবে না।

চিত্রবাহনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অর্জুন চিত্রাঙ্গদার কাছে চলল। যেতে যেতে কুন্তীকে দেখার জন্য মন ব্যাকুল হল তার। কুন্তীর মতো নারী সে বুঝি আর কখনও দেখবে না। কী বিশাল হৃদয় কুন্তীর। মাদ্রীর ছেলেদের সে নিজের ছেলের মতো ভালবাসতে পারে। কী ত্যাগ তার! স্বামীর সঙ্গে বনে চলে গেল সব ভোগসুখ ছেড়ে। পাঁচ-পাঁচটা ছেলেকে একলা মানুষ করতে হবে বলে কুন্তী নিজের পুরনো মর্যাদা খুইয়েও ওই ঈর্ষাতুর পরিবেশে দাঁতে দাঁত চেপে টিকে গিয়েছে। ভীষ্ম, বিদুর প্রমুখ বিরাট মানুষের আদর্শে তারা বেড়ে উঠেছে ঠিকই, কিন্তু তাদের সবচেয়ে বড় শিক্ষয়িত্রী কুন্তী নিজে। নিজের জীবনে, আচরণে, উপদেশে, সহিষ্ণুতায় কুন্তী নিজেই যেন এক শাস্ত্র। আর কী বুদ্ধি তার মায়ের। অধিকার অর্জনের জন্য কী অসীম ধৈর্য। এতটুকু লোভ নেই, এতটুকু ছিনিয়ে নেওয়া, ঠকিয়ে নেওয়ার প্রবণতা নেই। যতটুকু নিজের করে পেয়েছে, কুন্তী তাতেই খুশি। কুন্তীর যে-রাজনৈতিক বুদ্ধি, যে-দৃঢ়তা দেখেছে অর্জুন, আজ যদি হস্তিনাপুরের সিংহাসনে ধৃতরাষ্ট্রর পরিবর্তে কুন্তী বসত, সারা ভারত স্বর্গে পরিণত হত। অনুপের চোখ দিয়ে অর্জুন নতুন করে কুন্তীকে চিনেছে। এত শক্তি কুন্তীর যে, কৃষ্ণ পর্যন্ত কুন্তীকে সমীহ করে। পাঞ্চালে যখন প্রথম দেখা হল, কেমন ছোট বালকের মতো কুন্তীর আদর খাচ্ছিল কৃষ্ণ! বলরাম একটু লাজুক। সে কুন্তীর গা ঘেঁষে বসেছিল ঠিকই, তবে কৃষ্ণর মতো স্নেহের স্পর্শ নিতে কোলে মাথা পেতে দেয়নি। কত জরুরি আলোচনা কৃষ্ণ সেরে নিয়েছিল কুন্তীর কোলে শুয়ে শুয়েই। সেদিন কুন্তী বলেছিল, “কৃষ্ণ, তোমার সঙ্গে অর্জুনের কী মিল দেখো! যেন তোমরা দু’জনে আমারই গর্ভের দুটি যমজ ভাই।”

কৃষ্ণ মধুর হেসে অর্জুনকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, “পিসি কুন্তী, তুমি কি জানো না, নর আর নারায়ণ নামে যে দুই যমজ ঋষি ছিল, দেবতারা পর্যন্ত যাদের শক্তিকে ভয় করত, তারাই মরে কৃষ্ণ আর অর্জুন হয়েছে? অর্জুনের আরেক নাম তো কৃষ্ণই।”

কী সুন্দর গন্ধ কৃষ্ণর গায়ে, কৃষ্ণর মুখে। তার নিজস্ব গন্ধ। কোথায় এখন কৃষ্ণ? কী করছে? কেন সে বুঝতে পারছে না অর্জুন কী গভীরভাবে তাকে চাইছে? অনেক কথা যে তাকে বলার আছে। সেইসব কথা অর্জুন কৃষ্ণ ছাড়া আর কাউকে বলতে পারবে না।

বারো

স্নান করে, সেজেগুজে, লাল টুকটুকে শাড়ি পরে অর্জুনের অপেক্ষায় বসে ছিল চিত্রাঙ্গদা। অর্জুন আসতেই গয়নাগাঁটি ঝনঝনিয়ে সে বলল, “কোথায় ছিলে এতক্ষণ? আমি কখন থেকে বসে আছি!”

অর্জুন চিত্রাঙ্গদার পাশে বসে তার কাঁধ জড়িয়ে বলল, “আমার সঙ্গে কুটিরে গিয়ে থাকবে চিত্রাঙ্গদা?”

“কুটিরে? কোথায়?”

“সেই যেখানে নিচু পাহাড় আর জঙ্গল, যেখানে তোমরা বনভোজনে গিয়ে চাঁদমারিতে লক্ষ্যভেদ করছিলে, সেইখানে আমরা কুটির বেঁধেছি।”

“কেন? কুটিরে থাকব কেন?”

“তুমি আমার বউ, না হয় আমার দীন কুটিরে গিয়ে থাকলেই ক’দিন।”

“দেখো, আমি রাজার মেয়ে, তেমনি থাকতে চাই। তা ছাড়া এই মণিপুর, তার সবকিছুই আমার বাবার। তোমার যে-কুটির বলছ অর্জুন, তা-ও তো আমার বাবারই। তা হলে এই প্রাসাদে থাকতে তোমার আপত্তি কোথায়?”

অর্জুন চুপ করে রইল একটু। চিত্রাঙ্গদা পিতৃগর্বে অতি গরবিনী। পিতা পাণ্ডুকে অর্জুনের অল্পই মনে আছে। একজন লম্বা চওড়া সুদর্শন মানুষ, যে তাকে কোলে নিয়ে বলত, “আমার কালো ছেলে। আমার কৃষ্ণ।” খেলনা ধনুক-বাণ বানিয়ে দিয়েছিল পাণ্ডু তাদের পাঁচ ভাইকে। অর্জুন অন্য সব খেলা ফেলে ধনুক নিয়ে পড়ে থাকত সারাক্ষণ। শোবার সময় মাথার কাছে নিয়ে শুত। একদিন সে আপন মনে তির ছুড়ছে গাছে গাছে। একটি ডালে একটি পাখি ফল খাচ্ছিল। অর্জুন দুষ্টুমি করে সেই ফলে তির ছুড়ল। পাখিটা কিছু বোঝার আগেই ফলটা খসে পড়ল। এবার উড়ে গেল সে।

পাণ্ডু কখন এসে দাঁড়িয়েছিল। বলল, “বাঃ! তোমার লক্ষ্য খুব ভাল অর্জুন। তা, আমার কৃষ্ণসোনা, তুমি ঠিক কী মারতে চেয়েছিলে? পাখি, না ফল?”

“ফল।”

“কেন? পাখি নয় কেন?”

“কুন্তী মা বলেছে, অকারণে বধ করতে নেই। শুধু খাবার জন্য আর নিজেকে বাঁচাবার জন্য প্রাণী মারতে হয়।”

পাণ্ডু অর্জুনকে কোলে তুলে কুন্তীর কাছে গিয়ে বলেছিল, “এই কৃষ্ণ দেবব্রত ভীষ্মর নাম রাখবে কুন্তী। পাণ্ডুর মতোই বীর হবে। এর জন্মের আগে যে আমি কঠোর সংযমে তপস্যা করেছিলাম কুন্তী। তার ফল ফলবেই তুমি দেখো।”

এর দিন কয়েক পরে পাণ্ডু মারা যায়।

ভীষ্মর কাছে এত স্নেহপ্রশ্রয় পেয়েছে অর্জুন যে, পিতৃস্নেহের অভাব তার কখনও মনে আসেনি। তবু মাঝে মাঝে বাবার জন্য বুকের ভিতরে হু হু করে। পাণ্ডু যে তার গর্ব করার মতোই বাবা ছিল।

আজ চিত্রবাহনের আর্তি দেখেছে অর্জুন। একটা ছেলের জন্য আকুলতা দেখেছে। তবু তো তার মেয়ে আছে। সুস্থ সুন্দর বীরাঙ্গনা কন্যা। পাণ্ডুর তাও ছিল না। পাণ্ডু নিঃসন্তান ছিল। কী অসীম অসহনীয় কষ্ট ছিল পাণ্ডুর, অর্জুন অনুমান করতে পারে। জীবনের সমস্ত পুণ্যবলে কুন্তীকে স্ত্রী হিসেবে পেয়েছিল পাণ্ডু।

অর্জুনকে চুপ করে থাকতে দেখে চিত্রাঙ্গদা তার গলা জড়িয়ে মুখের কাছে মুখ নিয়ে কোলে বসে বলল, “রাগ হল বুঝি?”

অর্জুন তার গালে চুমু দিয়ে বলল, “না। রাগ হবে কেন?”

“আচ্ছা, বাবা কি তোমাকে বলেছে আমায় কুটিরে নিয়ে যেতে?”

“না। একেবারেই না। তিনি আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করেছেন এবং রাজপ্রাসাদেই থাকতে বলেছেন।”

“তা হলে? অর্জুন, কেন তুমি বোঝো না, ওখানে আমার কষ্ট হবে? আমার জুতো পর্যন্ত পরিয়ে দেয় আমার দাসী, আমার চুল বেঁধে দেয়, আর তুমি চাও আমি ঘুম ফেলে তোমার অস্ত্রচালনার অভ্যাসে তোমার পাশে থাকি, তোমার পূজার আয়োজন করে দিই। অর্জুন, সেবা নেওয়াই আমার অভ্যাস। তুমি চাইলেই আমি সেবিকা হয়ে উঠতে পারি না। হতে চাই-ও না।”

“না চিত্রাঙ্গদা। আমি তোমাকে সেবিকা বানিয়ে তুলতে চাই না। সেদিন তোমায় ঘুম থেকে তুলে তোমার সাহায্য চেয়েছিলাম কারণ এ বাড়িতে আমি নতুন। আমার প্রয়োজনের কথা আমার বউকে ছাড়া কাকে বলব? তুমি তোমার মতো রাস্তা দেখিয়ে দিয়েছ, আমি আমার মতো করে ব্যবস্থা নিয়েছি।”

“কী ব্যবস্থা?”

“দেখো, আমার পুরোহিত আছে, অনুচরেরা আছে, এই তিনদিন তারা কুটিরে গিয়ে সব আয়োজন করে রাখছিল। আজ থেকে তারা রাজার অতিথিশালা ছেড়ে কুটিরেই গিয়ে থাকবে। আমি সেইরকম নির্দেশ দিয়েছি। ওখানেই তারা রোজ আমার পূজার্চনার ব্যবস্থা করে রাখবে।”

“আমার ওপর রাগ করে তুমি এই ব্যবস্থা করলে অর্জুন।”

“না চিত্রাঙ্গদা, না।”

“তা হলে প্রমাণ দাও।”

“প্রমাণ?”

চিত্রাঙ্গদাকে বিছানায় শুইয়ে দিল অর্জুন। তার দু’চোখ মাতাল হয়ে উঠেছে। সে চিত্রাঙ্গদার দু’টি স্তনে মুখ ঘষতে ঘষতে বলল, “এই নাও প্রমাণ। এই নাও। এই নাও।”

চিত্রাঙ্গদা ভাল লাগায় শিউরে উঠতে উঠতে বলল, “কী করছ অর্জুন!”

“প্রমাণ করছি।”

“কী? কী প্রমাণ করছ?”

“তুমি আমাকে পাগল করেছ। আজ লাল শাড়িতে তুমি আমাকে উন্মাদ করেছ। এখন তোমাকে নগ্ন করব আমি চিত্রাঙ্গদা। তোমার নগ্নতার মাধ্বী পান করে আমি মাতাল হব। আমাকে বাধা দিয়ো না তুমি।”

“অর্জুন, এখন যে দিন। চারদিক আলোকিত।”

“এই আলোয় তোমাকে খুলে খুলে দেখব আমি।”

“অর্জুন আমাকে পাগল কোরো না।”

“তুমি আমাকে পাগল করেছ।”

“অর্জুন, অর্জুন, তুমি লুঠেরা হয়ে উঠেছ।”

“তুমি চাও না আমি লুণ্ঠন করি তোমায়? চাও না?”

“চাই, চাই, চাই অর্জুন। আমাকে ধন্য করো তুমি। আমাদের সঙ্গম ফলপ্রসূ হোক।”

তেরো

যথাসময়ে সন্তান প্রসব করল উলূপী। ছেলে হয়েছে তার।

গত প্রায় ন’মাস কেবল অর্জুনের কথাই ভেবেছে উলূপী। আর পেটের ছেলের যাতে এতটুকু ক্ষতি না হয়, সেদিকে লক্ষ রেখেছে। এই ন’মাস চন্দ্রা তাকে ছেড়ে নিজের বাড়িতে পর্যন্ত যায়নি। সারাক্ষণ উলূপীর দেখাশোনা করেছে। এখান থেকেই সে সমস্ত লোকজন পরিচালনা করছে যারা তার জন্য খবর নিয়ে আসে। প্রত্যেকদিন উলূপীর খাবার আগে নিজে খেয়েছে চন্দ্রা। যদি অশ্বসেন চক্রান্ত করে, যদি খাবারে বিষ থাকে। যদিও রাজপরিবারের প্রত্যেক কর্মচারীকেই উলূপী নিঃসন্দেহে বিশ্বাস করে, কিন্তু চন্দ্রা করে না। পেশাগতভাবে এই শিখেছে চন্দ্রা— একেবারে কাছের লোক ছাড়া কাউকে বিশ্বাস করবে না। আর কাছের লোক দূরে গেলে যতখানি পারো তার গতিবিধি গোচরে রাখবে।

উলূপী বলে, “চন্দ্রা তুই পাগল। তুই বাড়ি যা। আমি ভাল থাকব। দু’দিন বাড়িতে থেকে আয়।”

চন্দ্রা বলেছে, “লূপী, আমার জন্য বাড়িতে কেউ হা-পিত্যেশ করে বসে থাকে না। আমার তো স্বামী ছেলেপিলে নেই।”

“এবার হোক চন্দ্রা। তোর নিজের পরিবার হোক।”

“তুই কি আমার নিজের না? তোর ছেলে হলে সেও কি আমার নিজের হবে না? তা ছাড়া শুভা আছে, জয়া আছে, জয়ার দুই যমজ ছেলেমেয়ে অর্জুনমাল্য-অর্জুনমালিকা আছে। এরপর শুভারও হবে। কত বড় আমার সংসার বল তো!”

“তোর জীবনে কোনও পুরুষ আসবে না? পুরুষের ছোঁয়া, পুরুষের প্রেম না পেয়েই মরে যাবি?”

“আমি তোদের আগেও বলেছি লূপী, পুরুষের আকর্ষণ বোধ করি না আমি। ভগবান সবারই জন্য বেঁচে থাকার একটি উদ্দেশ্য ঠিক করে দেন। আমার উদ্দেশ্য হল তোর সঙ্গে থাকা। তোর দেখাশোনা করা। আমি তোর স্বেচ্ছাদাসী। স্বেচ্ছাপ্রহরিণীও বলতে পারিস। তুই আমায় রাখলে রাখবি, মারলে মারবি।”

উলূপীর মন-প্রাণ জুড়ে আছে অর্জুন। এখন এই তার নিয়তি। অর্জুনের চিন্তা আর তাদের সন্তানের দেখাশোনা। সে বলল, “অর্জুনকে স্বামী হিসেবে পেলেও কি তুই একই কথা বলতিস?”

চন্দ্রা বলেছিল, “অর্জুন তুলনাহীন। যেমন সুন্দর, যেমন বীর, তেমনি বিরাট তার মন। সে বড় আদরকাড়া লূপী। সারাদিন দস্যিপনা করবে, দিনের শেষে বাড়ি ফিরে কোনও স্নেহময়ীর বুকে এলিয়ে আদর খাবে। এই হলেই অর্জুনকে মানায়। সে আমার ভাই হলে বড় আনন্দ হত।”

এসব উলূপীর ছেলে হওয়ার আগের কথা। এখন সে প্রসবশ্রমে ক্লান্ত। ছেলে তার বন্ধুদের কোলে কোলে ফিরছে। ধাত্রী উলূপীকে এবং ছেলেকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে তুলেছে। আয়ুর্বেদাচার্য ভিষক রুদ্র নাগকে সঙ্গে করে কৌরব্য নাগ এল দুহিতা এবং দৌহিত্রকে দেখতে। আজ তাঁর বড় আনন্দের দিন। নিজের গলার অমূল্য রত্নহার শিশুর বুকের ওপর রেখে তাকে কোলে তুলে বলল, “এর নাম কী রেখেছিস মা?”

উলূপী ম্লান হেসে বলল, “আমার শুধু অর্জুনের কথাই মনে আসে।”

“ইরা। ইরা মানে পৃথিবী। আমাদের সেই আদি রাজা ইরাবতের নামে আমি ওর নাম দিলাম ইরাবান। সারা পৃথিবীর অধীশ্বর। পাণ্ডব অর্জুনের ছেলে, ইন্দ্রের ধারায় ওর জন্ম। ইরাবান হবে মস্ত বীর।”

মেয়ের পাশে ইরাবানকে শুইয়ে দিল কৌরব্য। রুদ্র নাগ শিশু এবং প্রসূতিকে পরীক্ষা করে বলল, “মা ছেলে দু’জনেই সম্পূর্ণ সুস্থ। আমি বল বাড়ানোর কিছু ওষুধ পাঠিয়ে দেব, সেসব খেলেই চলবে। তারপর? মা উলূপী? তোমার শিক্ষা এখনও সম্পূর্ণ হয়নি। আমি বুড়ো মানুষ। কখন কী ভুলে যাই, কখন মরে যাই, একটু সেরে উঠলেই তুমি চলে এসো আমার কাছে। সঞ্জীবনী বিদ্যা এখন অতি অল্প লোকই জানে।”

যাবার প্রতিশ্রুতি দিল উলূপী। শিশু ইরাবান কান্নাকাটি করছে না একটুও। তার ছোট্ট জিভ ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে বার করে হাত-পা নাড়ছে। উলূপীর মতো হলদেটে ফর্সা তার রং। অর্জুনের বর্ণ সে পায়নি।

ধাত্রী বলল, “নাও উলূপী। তোমার বুকে দুধের যে প্রথম ধারা এসেছে, ছেলের মুখে দাও। একবিন্দু যেন না পড়ে। এই ওর অমৃত।”

উলূপী নিজের স্তন থেকে ক্ষীরামৃত পান করাতে লাগল ইরাবানকে। আজ অর্জুন এখানে থাকলে তার মুখখানা কতখানি উদ্ভাসিত হত, ভাবতে লাগল।

যে সময় ইরাবানের জন্ম হয়, তার ক’দিন আগেপরে মণিপুরে পৌঁছেছিল অর্জুন। তার গতিবিধির সব খবরই উলূপী পেয়ে যাচ্ছিল চন্দ্রার তত্পরতায়। মণিপুরের রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদাকে বিয়ে করেছে অর্জুন, এ খবরে তার মধ্যে রাগ, দ্বেষ, ঈর্ষা কিছুই এল না। সে বরং খুশি হয়ে বলল, “চিত্রাঙ্গদা আমার পিতৃবন্ধু চিত্রবাহন রাজার মেয়ে। ভালই হল। সে ছিল আমার বোনের মতো। এখন সে আমার বোন হল। ইরাবান নিশ্চয়ই একজন ভাই পাবে সেখানে। চন্দ্রা, খনকদের প্রধান যে ফণীশ্বর নাগ, তাকে একবার ডেকে নিয়ে আয়। অত্যন্ত গোপনে সুড়ঙ্গপথ তৈরি করতে হবে মণিপুর পর্যন্ত।”

জয়া আর শুভাও ছিল তখন। শুভা এখন অন্তঃসত্ত্বা। জয়া তার যমজ দু’টিকে সঙ্গে এনেছে। জয়া বলল, “তা যদি করা যায়, তবে এটাই হবে পৃথিবীর দীর্ঘতম সুড়ঙ্গপথ। তুই তো পাতালজয়ী হয়ে উঠতে চলেছিস উলূপী।”

শুভা বলল, “এ তো অনেকদিন লাগবে। এই উত্তর থেকে সেই দক্ষিণ-পশ্চিমে। কত নদী পড়বে পথে। কত অন্য অন্য দেশ।”

উলূপী বলল, “সুড়ঙ্গ যাবে নদীর তলা দিয়ে। আর দেশের কথা বলছিস? এই যে মাটি, দেশ হচ্ছে তার উপরিতলের ভাগাভাগি। মাটির নীচে পাতালও কারও নয়, মাটির উপরে আকাশও নয় কারও। এই যে গরুড়রা আকাশরথ উড়িয়ে নিয়ে যায় কত দেশের উপর দিয়ে, কাউকে কর দেয় নাকি? আমরা যদি ওদের মতো বায়ুযান বানাতে পারতাম, এত কষ্ট করে, খরচ করে সুড়ঙ্গ করতেই হত না।”

জয়া বলল, “এত যুগ যুগ ধরেও আমরা ওদের বায়ুযানের কারিগরি শিখতে পারলাম না।”

উলূপী বলল, “এত যুগ ধরে ওরাও তো আয়ত্ত করতে পারেনি আমাদের সঞ্জীবনী মন্ত্র। আমরা নাগপাশ বাণ সৃষ্টি করেছি, ওরা পাল্টা বানিয়েছে গরুড়াস্ত্র। ওরা আকাশযান চালায়, আমরা সুড়ঙ্গ কাটি। দু’টি দেশ যদি শত্রু না হত, তবে দক্ষের অখণ্ড দেশ হত দুর্জয়। জ্ঞাতিশত্রুতা মানুষের ক্ষমতা হরণ করে জয়া। এই কুরুবংশকেই দ্যাখ। দুর্যোধন যদি ঈর্ষাপরায়ণ না হত তবে যে-দেশে ভীষ্ম আছেন, বিদুর, দ্রোণাচার্য্য, ধৃতরাষ্ট্রর মতো জ্ঞানী, যুধিষ্ঠিরের মতো ধার্মিক ন্যায়পরায়ণ রাজা, ভীম, অর্জুন, দুর্যোধনের মতো অজেয় বীর, সেইসঙ্গে কৃষ্ণ, বলরাম, সাত্যকিদের মতো যাদব-বৃষ্ণি বীরের আত্মীয়তা— কর্ণের বন্ধুত্ব, ধৃষ্টদ্যুম্নের কুটুম্বিতা— ওদের দেশ হতে পারত স্বর্গের চেয়েও বেশি ক্ষমতাবান। ভাবলে গায়ে কাঁটা দিচ্ছে আমার। কিন্তু তা হতে পারল কই! আজ হস্তিনাপুর ভাগ হয়েছে, কাল কী হবে কে জানে। এখন থেকেই এক বিশাল যুদ্ধের অনুমান করছে অর্জুন।”

শুভা বলল, “তার সঙ্গে তোর সুড়ঙ্গ বানানোর সম্পর্ক কী?”

“অনেক সম্পর্ক। চিত্রবাহনের শর্ত আমি জানি। চিত্রাঙ্গদার ছেলে হলে সে হবে চিত্রবাহনের উত্তরাধিকারী। তার পিতার নয়। তা হলে চিত্রাঙ্গদার সঙ্গে যার বিয়ে হবে, হয় তাকে ঘরজামাই থাকতে হবে, নয় ছেলের অধিকার ছাড়তে হবে। অর্জুন ঘরজামাই থাকার মানুষ নয়। তার অর্থ, ছেলের ওপর কোনও অধিকার থাকবে না, এই দাবি অর্জুন মেনে নিয়েছে।”

চন্দ্রা এতক্ষণ সব কথা শুনছিল। এবার সে অর্জুন এবং চিত্রবাহনের পারস্পরিক শর্ত কী, তা জানাল। উলূপী বলল, “তার মানে, আমি যেমন ইরাবানকে নিয়েই থাকব, তার মধ্যেই অর্জুনকে পাব, চিত্রাঙ্গদাও তাই। আমাদের দু’জনের ভাগ্যই একরকম। ইরাবান যেমন চিত্রাঙ্গদার ছেলে তেমনি অর্জুনের যে-সন্তান পাবে চিত্রাঙ্গদা, সেও আমারই ছেলে হবে। আমারও তো কর্তব্য থাকবে তার ওপর। মায়ের অধিকার নিয়ে গেলে কর্তব্যের গুরুভারও স্বীকার করতে হবে। তা ছাড়া, ইরাবান বড় হলে, যোগ্য হলে, তাকে অর্জুনের কাছে পাঠিয়ে দেব আমি। বাবার পাশে থেকে সে যুদ্ধ করবে। তার কী গতি হবে আমি জানি না। কিন্তু আমার আরেকটি ছেলে রইল। সে চিত্রাঙ্গদার ছেলে। নাই বা তার ওপর দাবি রইল অর্জুনের। তবু, তাকে অর্জুনের যোগ্য করে তুলতে হবে তো। কৌরব্য নাগ এবং চিত্রবাহন, দু’জনেরই বয়স হচ্ছে। দুই সন্তানকে গড়ে তোলার ভার তাই আমাদের দুই মায়ের।”

শুভা বলল, “তা হলে এখন আমাদের কী করণীয়?”

“এমন ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে খুব কম সময়ে এবং গোপনে নিয়মিত মণিপুরে যেতে পারি আমি। সুড়ঙ্গর কথা কেউ জানবে না। মণিপুরে পাহাড়-জঙ্গল ভালই আছে। সুড়ঙ্গের মুখ গোপন রাখা যাবে। এখন আমার চাই গোটা ভারতের এক নিখুঁত মানচিত্র। অঙ্ক কষে বার করতে হবে, কোন পথ হবে সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত।”

“তা হলে কি তুই ইন্দ্রপ্রস্থ পর্যন্ত সুড়ঙ্গপথ বানাবি লূপী? যেখানে যেখানে যাবে অর্জুন, সেই পর্যন্ত নিজের যাওয়া-আসার ব্যবস্থা রাখবি?”

“না। তা কেন? অর্জুনকে অনুসরণ করা আমার লক্ষ্য নয় শুভা। আমি তাকে চেয়েছিলাম। পেয়েছি। যা চেয়েছি, পেয়েছি তার অনেক বেশি। যদি ভাগ্যে লেখা থাকে, কদ্রুর আশীর্বাদে, ঈশ্বরের ইচ্ছায়, আবার তার সঙ্গে আমার দেখা হবে। দেখা পাবার জন্য আমি তাকে ধাওয়া করতে যাব না। চিত্রাঙ্গদা আমার বোনের মতো বলেই আমি অনায়াসে তার কাছে যেতে পারি। তার ছেলেকে আমার ছেলের মতো চড়-চাপড় মেরে শাসন করতে পারি। কিন্তু পাঞ্চালীর গর্ভে যখন অর্জুনের ছেলে হবে, আমি কি মায়ের দাবি নিয়ে অনাহূত সেখানে যেতে পারব? সবার সঙ্গে একই আচরণ করা যায় না শুভা। যতক্ষণ যুধিষ্ঠির আমাকে স্বীকার না করছেন, যতক্ষণ কুন্তী আমাকে বরণ না করছেন, ততক্ষণ, ইন্দ্রপ্রস্থে আমার অধিকার নেই। আমি অর্জুনের বউ হয়েছি। কুলবধূ হইনি এখনও।”

সুড়ঙ্গের উদ্যোগ চলতে লাগল। উলূপীর মনে পড়ল, অর্জুন বলেছিল, ছেলে হলে তাকে নিয়ে একবার হর্যক্ষ নাগের বাড়িতে যেতে। যদি তারা খুশি হয়! যদি অর্জুনের ছেলেকে নিজের নাতি মনে করে আনন্দ পায়। একদিন উলূপী ওই হর্যক্ষ নাগেরই কুলবধূ ছিল তো।

কৌরব্যর অনুমতি নিয়ে ছেলে কোলে উলূপী হর্যক্ষ নাগের বাড়ি রওনা হল। কৌরব্য এক পল ইরাবানকে ছেড়ে থাকতে পারে না। ইরাবান যেন তার রাজকাজের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ এখন। তার চোখে জল ভরে এল। উলূপী চলে যেতেই দিনের বেলাতেই যেন নিশুতি হয়ে এল প্রাসাদ। কৌরব্য সভাসদদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গ্রন্থালয়ে গিয়ে চুপ করে বসে রইল। চন্দ্রা যেতে যেতে উলূপীকে জিজ্ঞেস করল, “তোর কি মনে হয় লূপী, হর্যক্ষ নাগ ইরাবানকে ঘরে নেবে?”

উলূপী বলল, “না নেওয়ারই কথা।”

“অর্জুন কেন এরকম নির্দেশ দিল? শুধু কি পুত্রহারা দুই বুড়োবুড়ির প্রতি অনুকম্পার বশে?”

“অনুকম্পা একটা কারণ। তার চেয়ে বড় কারণ সত্যের মুখোমুখি হওয়া। অর্জুনকে আমি বুঝেছি চন্দ্রা। সে অত্যন্ত সত্যনিষ্ঠ। তার সঙ্গে আমার বিয়ে প্রকাশ্যে হয়নি। আমি আগে ওদের কুলবধূ ছিলাম। ওদের প্রত্যাশা মতো অশ্বসেনকে গুরুত্ব না দিয়ে নাগকুলের কেউ নয় এমন অর্জুনকে বিয়ে করেছি। এখন ওরা বলুক আমি আর ওদের কুলবধূ নই, অর্জুনের স্ত্রী। ওরা বলুক, অর্জুনের সন্তান ওদের কেউ নয় বলেই ওরা ইরাবানকে নেবে না। প্রত্যাখ্যানের মধ্যে দিয়ে ইরাবান যে অর্জুনের বৈধ সন্তান, তার সামাজিক স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে অর্জুন।”

যেমন ভেবেছিল তারা, তেমন হল না প্রথমে। হর্যক্ষ এবং তার বউ একটি শিশু পেয়ে খুশি হয়ে উঠল। কিন্তু কোথা থেকে খবর পেয়ে ছুটে এল অশ্বসেন। উলূপীকে হত্যা করতে গিয়ে যে-অপরাধ সে করেছিল, তিরে বিষ মাখিয়ে যে-অনৈতিক কাজ সে করেছিল, তাতে তার মৃত্যুদণ্ড পাওয়াই উচিত ছিল। কিন্তু তার বাবা-মা একটি পুত্রশোকে ইতিমধ্যেই কাতর। তাই কৌরব্য নাগ অশ্বসেনের প্রাণদণ্ড না দিয়ে তার অস্ত্র ব্যবহারের অধিকার কেড়ে নিয়েছিল। সেইসঙ্গে, দশ বছর সে কোনও সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারবে না।

রাগে কাঁপতে কাঁপতে অশ্বসেন বলল, “কোন সাহসে এ বাড়িতে এসেছ তোমরা? কোন সাহসে পাণ্ডব অর্জুনের ছেলেকে আমার মায়ের কোলে তুলে দিয়েছ? চলে যাও। এখুনি চলে যাও উলূপী। না হলে তোমার ছেলেকে মেরে ফেলব আমি।”

উলূপী বলল, “তোমার মতো নীচ অন্য কথা কী বলবে? তবে জেনে রাখো, তোমার হাত থেকে ছেলেকে বাঁচাবার ক্ষমতা আমার আছে বলেই তাকে এখানে এনেছি।”

হর্যক্ষ নাগ বলল, “হোক এ অর্জুনের ছেলে। কিন্তু এ তো আমাদের উলূপীরও সন্তান। উলূপী আমাদের কুলবধূ। তাই তার ছেলে আমাদের কুলপ্রদীপ।”

“না। ও আমাদের কেউ নয়।” চেঁচিয়ে উঠল অশ্বসেন। “আগুন সাক্ষী করে অর্জুনকে আবার বিয়ে করেছে উলূপী। এই উলূপী তোমার কে বাবা?”

“উলূপী আমাদের যা ছিল, তাই আছে। আমাদের ছেলে বেঁচে নেই। অর্জুনকে বিয়ে করে কিছু অন্যায় করেনি উলূপী। তার জন্য আমাদের পূর্বসম্বন্ধ লোপ পাবে কেন? সে যখন আমার কাছে এসেছে, আমার কাছেই থাকবে।”

বাপের কথায় কান না দিয়ে মায়ের কোল থেকে ইরাবানকে তুলে উলূপীর হাতে প্রায় ছুড়ে দিল অশ্বসেন। বলল, “বেরোও, বেরোও এখান থেকে। তুমি নরকের কীট। তুমি বেশ্যারও অধম। খোলো তোমার বসন। নগ্ন হয়ে হেঁটে যাও রাস্তায়। সেই তোমার যোগ্য কাজ।”

সে উলূপীর আঁচলে টান দিল। অপমানে লাল হয়ে উঠল উলূপী ও চন্দ্রা। উলূপী ইরাবানকে চন্দ্রার কোলে দিয়ে এক ধাক্কায় অশ্বসেনকে মাটিতে ফেলে দিল। ঠিক যেমন করে অর্জুন একদিন দাঁড়িয়েছিল তেমনি দাঁড়াল তার বুকে পা দিয়ে। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল, “যে-হাতে তুমি আমার আঁচল ধরেছ সেই হাত আমি গুঁড়ো করে দিতে পারতাম, কিন্তু তোমার মা-বাবার শ্রাদ্ধ-তর্পণ করার জন্য আমি ছেড়ে দিচ্ছি। আজ থেকে আজীবন তুমি যাতে ঘরবন্দি থাকো, সে ব্যবস্থা আমি করব। আমি কৌরব্য নাগের মেয়ে উলূপী। আমি অর্জুনের বউ। এবং আমি ইরাবানের মা।”

ছেলে কোলে উলূপী বাপের বাড়ি ফিরে চলল। তার মনে একটুও দুঃখ নেই। ইরাবান অর্জুনের পরিচয়ে বড় হলেই উলূপী বেশি খুশি হবে।

চোদ্দো

মণিপুর রাজ্যের সবচেয়ে উঁচু যে-পাহাড়, তারই মাথায় শিবের মন্দির। রাজা প্রভঞ্জনের গড়া এই মন্দিরটির কোনও দেওয়াল নেই। একটিমাত্র বড় পাথর আধা গোলোকের মতো করে কেটে মন্দিরের ছাত হয়েছে। পাথরের গায়ে অপূর্ব কারুকাজ। খুব ভাল লাগে অর্জুনের এই জায়গাটি। প্রথম যেদিন আসে, সেদিনই তার ভাল লেগে গিয়েছিল। পাকদণ্ডী ধরে চূড়া পর্যন্ত ছোট রথ চলার মতো রাস্তা করে দিয়েছে চিত্রবাহন। তরুণদের পক্ষে এই পথ হেঁটে আসা কঠিন নয়। কিন্তু বুড়ো-বুড়ি, অশক্ত, অসমর্থ লোকও যাতে মন্দিরে আসতে পারে, তাই এই ব্যবস্থা।

শিবের মূর্তিটি বেশ উঁচু এবং অত্যন্ত সুন্দর। একজন পুরুষ যতখানি সুন্দর হতে পারে, এই মূর্তি তারই প্রতিরূপ। এই শিবমূর্তি দেখে অর্জুনের প্রথমেই মনে হয়েছিল যেন কৃষ্ণ দাঁড়িয়ে আছে। মূর্তিটি কষ্টিপাথরের। সে যখন অবাক হয়ে মূর্তি দেখছে আর কৃষ্ণর কথা ভাবছে, চিত্রাঙ্গদা বলে উঠল, “অর্জুন, তুমি যখন স্বল্প বসনে বা বসনহীন নগ্নতায় আমার সামনে দাঁড়াও, তোমাকে আমার শিবঠাকুরটি মনে হয়।”

আশ্চর্য! যাকে দেখে অর্জুনের কৃষ্ণর কথা মনে পড়ছে, তাকে দেখেই চিত্রাঙ্গদা ভাবছে অর্জুনের কথা।

একটি দুধগোক্ষুর শিবমূর্তির গলা পেঁচিয়ে ছিল। তারা আসতেই শিবের গা বেয়ে নেমে গেল। প্রতিবারই এমন হয়। চিত্রাঙ্গদা বলেছিল, সেই প্রভঞ্জন রাজার সময় থেকেই এমনটা হয়ে আসছে।

গলায় সাপ জড়ানো সাধুদের গঙ্গাদ্বারে দেখেছে অর্জুন। গয়াতেও দেখেছে। শিব নাকি সাপকেই উপবীত হিসেবে ধারণ করেছে। শিব নটরাজ বলে অর্জুনের তাকে ভারী পছন্দ। এই অপরূপদর্শন দেবতা যখন আত্মভোলা হয়ে নাচে, কী সুন্দরই না দেখায়। অর্জুন কি কোনও দিন তা দেখতে পাবে? শিবের কাছে যে-পাশুপত অস্ত্র আছে, তা পেতে চায় অর্জুন। তার জন্য যত সাধনা করতে হয়, করবে সে। কৃষ্ণর সঙ্গে দেখা হলে, তার ইচ্ছের কথা জানাবে সে কৃষ্ণকে। এখন মহাদেবকে প্রণাম করে সে মন্দিরের চাতালে একেবারে কিনারে এসে দাঁড়াল। এখান থেকে মণিপুর রাজ্যের অনেকখানি দেখা যায়। নজরদার মোতায়েন করলে অনেক আনাগোনার খবর আগাম পেতে পারে চিত্রবাহন।

দেখতে দেখতে এক বছর পার করে দিল অর্জুন এদেশে। যতটুকু সে বুঝেছে, দেশটা ছোট, শান্তিপ্রিয়। খুব বড় কোনও শত্রু এদের নেই। সুরক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে তাই একটা ঢিলেঢালা ভাব আছে। মাঝে মাঝে দস্যুরা আক্রমণ করলে চিত্রাঙ্গদা তার সেনাদল নিয়ে যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে তার মুখোমুখি হয়। অর্জুন নিজে তা দেখেছে।

তাদের বিয়ের ঠিক পরে পরে একদিনের কথা। রাজবাড়ির বাগানে ঘুরে ঘুরে কথা বলছিল অর্জুন আর চিত্রাঙ্গদা। এই আজকের মতোই আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ছিল সেদিন। আজও যেমন ময়ূরেরা ডাকাডাকি করছে, সেদিনও তেমনি করছিল। চিত্রাঙ্গদা বলছিল, শুনলাম উলূপীকে বিয়ে করেছ তুমি।

অর্জুন বলল, “এখানে আসার আগে বেশ কয়েকটি তীর্থে ঘুরেছি আমি। গঙ্গাদ্বারে থাকার সময় উলূপীর সঙ্গে আমার দেখা হয়।”

“আমাকে সে বোনের মতোই ভালবাসে অর্জুন। সে যখন শুনবে, আমি তোমার বউ, খুব খুশি হবে। জানো অর্জুন, এদেশের লোক এবং যারা বাইরে থেকে আসে তারাও আমাকে পুরুষের কাজ করতে দেখে অবাক হয়। অথচ, সেই কোন উঁচু পাহাড়ের দেশে, নাগলোকে, উলূপী যে কত কিছু জানে, জগৎ তার খবর রাখে না। তুমি নিশ্চয়ই তার পরিচয় কিছু কিছু পেয়েছ।”

“হ্যাঁ চিত্রাঙ্গদা। উলূপী অত্যন্ত সুন্দরী, গুণবতী, বুদ্ধিমতী এবং কর্তব্যপরায়ণ।”

“সে কি আমার চেয়েও সুন্দরী? অর্জুন?”

অর্জুন একটু থমকে গেল। এমন প্রশ্ন সে আশা করেনি। তখনও চিত্রাঙ্গদার ধরন সে বুঝে উঠতে পারেনি। সে বোকার মতো বলে ফেলেছিল, “সে কি বলা যায়?”

“নিশ্চয়ই যায়।” ঝেঁঝে উঠেছিল চিত্রাঙ্গদা। চোখ লাল করে বলেছিল, “বলো। বলতেই হবে তোমায়। কে বেশি সুন্দরী? আমি, না উলূপী?”

অর্জুনের মনে হচ্ছিল এত কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি সে কখনও হয়নি। এর চেয়ে বেদের সূক্ত মুখস্থ করা সহজ। তার মনে হল, চিত্রাঙ্গদা নিজের প্রশস্তি শুনতে চাইছে। সে বলল, “তুমি বেশি, মানে, ইয়ে, তোমার রূপে আমার নেশা ধরে যায়, জানো না?”

“মিথ্যে কথা। মিথ্যে বললে তুমি অর্জুন। না। ঠিক মিথ্যেও বলোনি। কথা অসম্পূর্ণ রেখে এড়িয়ে গিয়েছ। আমি জানি উলূপী আমার চেয়ে সুন্দরী। আমি জানি তুমি তাকেই বেশি ভালবাসো।”

অভিমানে চিত্রাঙ্গদার মুখ ভার হয়ে উঠল। অর্জুন বসল তার মান ভাঙাতে। সে যে প্রথম দেখা মাত্রই চিত্রাঙ্গদাকে কামনা করেছিল, তাই বলতে লাগল বারবার। লাল বসনে তাকে দেখায় প্রস্ফুটিত শিমুল ফুলের মতো, নীল বসনে সে যেন ময়ূরের পেখম— যা যা অভিনব তুলনা আসে বলে যেতে লাগল অনর্গল। আর মনে মনে ভাবতে লাগল, কৃষ্ণ হলে কী করত, কী বলত। উলূপী কখনও এমনধারা প্রশ্ন করেনি। কিন্তু চিত্রাঙ্গদা উলূপী নয়।

সহসা একটি যুক্তিসহ কথা জুগিয়ে উঠল তার মনে। সে বলল, “দেখো চিত্রাঙ্গদা, তোমাকে যদি বলি, স্বর্গের ঐরাবত আর উচ্চৈঃশ্রবার মধ্যে কে বেশি সুন্দর? যদি বলি ধুতপাপা নদী আর সরস্বতী নদীর মধ্যে কে বেশি সুন্দর— তুমি কী জবাব দেবে?”

চিত্রাঙ্গদার মুখ একটু হাসিহাসি হল। অর্জুন বলল, “দুই সেরার মধ্যে তুলনা হয় না বলেই তো তারা সেরা। আমি তোমাদের দু’জনকেই ভালবাসি।”

চিত্রাঙ্গদা এবার হাসিতে ঝলমল করে উঠল। বলল, “উলূপীর প্রতি আমার ঈর্ষা নেই অর্জুন। তবে তুমি আমাকেই বেশি ভালবাসবে এমনটাই আমি চাই। এমনকী, তুমি যাকে জয় করেছ বলে শুনলাম, সেই পাঞ্চালীর চেয়েও বেশি ভালবাসা পেতে চাই আমি। সব মেয়েই তাই চায় অর্জুন। তা সে যতই না জ্ঞানী, গুণী, বীরাঙ্গনা হোক। নিজের পুরুষের কাছে সব মেয়েই হতে চায় প্রিয়তমা। তার মানে এই নয় অর্জুন যে, আমি তোমাকে দিয়ে অঙ্গীকার করিয়ে নিতে চাইব, আর কাউকে তুমি আমার চেয়ে বেশি ভালবাসবে না। এমন প্রতিজ্ঞা আমি কাউকে করতে বলি না যা সে রাখতেই পারবে না। আমাকে ছেড়ে তুমি যখন চলে যাবে অন্য কোথাও, কে জানে, আর কাউকে আমার চেয়েও বেশি ভালবেসে ফেলবে কিনা তুমি। তুমি নিজেও যে তা জানো না। কী অদ্ভুত নিয়ম দেখো অর্জুন, তুমি যদি আরও দশটা বিয়ে করো, কেউ তোমাকে কিছু বলবে না। কিন্তু আমি আর উলূপী— এই যে তুমি তাকে ছেড়ে এলে, আমাকেও ছেড়ে যাবে একদিন— তোমাকে ছাড়া থাকা আমাদের অভ্যাস করতে হবে তাই নয়, শরীরের টানে হোক, মনের টানে হোক, আর একজনকে বিয়ে করার কথা আমরা ভাবলেও অধর্ম হবে। উলূপীর অসম্ভব মনের জোর যে, অনেক সামাজিক প্রতিকূলতা ও নিন্দেমন্দ হবে জেনেও সে দ্বিতীয়বার পতি গ্রহণ করেছে। তার প্রথম স্বামী মারা গেছে, এই ছিল তার শাস্ত্রীয় সুবিধা। কিন্তু কী জানো অর্জুন, মেয়েদের ব্যাপারে শাস্ত্রের চেয়েও অনেক বেশি ঘাড়ে চেপে বসে লোকাচার। সুবিধামতো শাস্ত্র আসে, সুবিধামতো দেশাচার। মেয়েরা নিজেরাও তার কবলে। এই আমাকেই দেখো, পুরুষের আচরণ করেও আমি তৃপ্ত নই কারণ আমার সবসময় মনে হয়, আর সব মেয়ে যেমন থাকে, তেমন থাকাই আমার ধর্ম। কেন? আবার পুরুষের চোখে দেখো, ছেলের কাজ করাবে বলে আমাকে পুরুষ সাজিয়ে তুলতে হল বাবার। কাজটা করছে একটা মেয়ে কিন্তু তাকে পুরুষ সাজতে হচ্ছে। এই সেজে ওঠাতেই আমার আপত্তি অর্জুন। আমি যা, তাই নিয়েই আমি যা পারি তা করব না কেন? ওদিকে দেখো, বহুস্বামীকতা অশাস্ত্রীয় নয়। কিন্তু আস্তে আস্তে তা কীরকম নিষেধের পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। পুরুষের কোনও নিষেধ নেই।”

অর্জুন বিমোহিত হয়ে শুনছিল। এই ক’দিনে তার ধারণা হচ্ছিল চিত্রাঙ্গদা চপল, আদুরে, অগভীর। সেদিন বুঝেছিল, তার ধারণায় ভুল ছিল। যে-মেয়ে রাজার মতো জনগণের বিচার করে, নিজে যুদ্ধ করে প্রজারক্ষা করে, সে কি অগভীর হতে পারে? চিত্রাঙ্গদা এখনও কোনও কোনও ক্ষেত্রে ছেলেমানুষ। আদরের বলে তার ছেলেমানুষিও বেশি। অথচ সমাজকে যেভাবে দেখেছে চিত্রাঙ্গদা, যেভাবে বুঝেছে, তা একদম ঠিক। অনুপের কথা তার মনে পড়ল। “মেয়েরা কখনও আচার্য হতে পারবে না,” বলেছিল অনুপের মা ধুতপাপা। সেই কথার মধ্যে একটা গোটা সমাজব্যবস্থা ধরা আছে। সেই কথাই অনুপের মনে সমাজ সম্পর্কে কিছু মৌলিক প্রশ্ন জাগিয়েছে। এমনকী অর্জুনের মনেও। অথচ, অনেক বছর আগে, কশ্যপ কত উদারতায় আচার্য করে তুলেছিল কদ্রুকে। কদ্রুর নামে আলাদা বংশ সৃষ্টি হয়েছিল। মনে মনে কশ্যপকে প্রণাম করল অর্জুন। শুধু জ্ঞান নয়, ঔদার্যের জন্য সাহস লাগে। উদার হতে পারলে তবেই মহান হওয়া যায়।

চিত্রাঙ্গদা বলতে লাগল, “উলূপীর বৈশিষ্ট্য কী জানো অর্জুন? বহু গুণবান পুরুষের চেয়েও সে গুণী। বহু বলবান পুরুষের চেয়েও সে শক্তিমতী। কিন্তু তাকে পুরুষ সাজতে হয় না। নারী হিসেবেই সে স্বাধীনভাবে ঘোরাফেরা করে। আমার গর্ভে যদি তোমার ছেলে হয় অর্জুন, তাকে বড় করার ভার আমি উলূপীর হাতে তুলে দেব। যদি মেয়ে হয়, তাকেও দেব উলূপীর হাতে। ছেলে যতদিন না স্বাবলম্বী হয়, রাজ্যশাসনের ভার নিতে তো হবে আমাকেই। তাই উলূপীর হাতে ছেলের ভার দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত হতে চাই।”

অর্জুনের ভাল লেগেছিল উলূপীর প্রতি চিত্রাঙ্গদার এই নিঃসংশয় নির্ভরতা। মেয়েদের মাতৃশক্তি অসীম। কুন্তীকে দেখেই সে বুঝেছে। কৃষ্ণ তো মানুষই হল যশোদার কাছে। কংসের অত্যাচারে মা দেবকীর বুকের দুধ খাবারও সুযোগ পায়নি কৃষ্ণ। কিন্তু বৃন্দাবনে স্নেহভালবাসার এতটুকু অভাব ছিল না বলেই তো কৃষ্ণ এমন প্রেমবান।

নাগদেশে লোক পাঠিয়ে খবর এনেছিল চিত্রাঙ্গদা। ছেলে হয়েছে উলূপীর। তার নাম ইরাবান। অর্জুনের প্রথম সন্তান।

লোকমুখে উলূপীও খবর পাঠিয়েছে। সে আসবে মণিপুরে। সময় হলেই। কেন এখনই তার সময় হল না? উলূপী নিজে কোলে করে ছেলে দেখাতে আসবে না জানে অর্জুন। সে এমন কিছু করবে না যাতে অর্জুনের মনে হয় উলূপী তাকে বাঁধতে চাইছে। উলূপী তেমন মেয়েই নয়।

সেদিন চিত্রাঙ্গদার সঙ্গে কথায় বিভোর হয়ে ছিল যখন অর্জুন, একজন খবর দিল দেশের পশ্চিম সীমান্তে দস্যুর উপদ্রব হয়েছে। ক্রমশ তারা ঢুকে আসছে ভেতরে। রাজা চিত্রবাহন যুদ্ধে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছে।

“বাবা যাচ্ছে? কেন? আমি থাকতে?” এক পলকে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছিল চিত্রাঙ্গদা। অর্জুন দেখেছিল, এক পলকে এক মোহময়ী স্বপ্নাবিষ্ট প্রেমকাতর মেয়ে কীরকম দৃঢ় হয়ে উঠতে পারে। সে মুগ্ধ হয়েছিল। নারীবেশী চিত্রাঙ্গদার শরীরের ভাষা এক দৃপ্ত বীরের। সে বলেছিল, “যাও। বাবাকে বলো আমি যাচ্ছি দস্যু মারতে। আর আমার যে প্রধান অনুচরী, সেই শিবাঙ্গীকে বলো অস্ত্র, রথ এবং সৈন্য প্রস্তুত করতে।”

এবারে অর্জুনের দিকে তাকিয়ে সে বলল, “আজ আমি নারীবেশেই যুদ্ধে যাব অর্জুন। যাই, বর্ম ও শিরস্ত্রাণ পরে আসি।”

অর্জুন তখন বলে, “যেখানে আমি অর্জুন উপস্থিত আছি চিত্রাঙ্গদা, সেখানে না তুমি যুদ্ধে যাবে, না চিত্রবাহন। যাব আমি। ক’টা দস্যু ঠেকাতে সেনাবাহিনীও আমার দরকার নেই। আমি চললাম তোমাদের অস্ত্রাগারে।”

“দাঁড়াও অর্জুন। তুমি যুদ্ধে গেলেও আমাকে যেতে হবে। কারণ তুমি যখন থাকবে না তখন তো যুদ্ধ করতে হবে আমাকেই। আর আমার বাহিনীকেও নিতে হবে সঙ্গে। না হলে তাদের মনে হতে পারে তারা আর প্রয়োজনীয় নয়। তাদের মনোবল এবং উত্সাহ দুই-ই ভেঙে পড়বে। তাই আমাকে তুমি বাধা দিয়ো না।”

“বেশ। তবে তুমি সারথি নিয়ো না। আমিই হব তোমার রথের সারথি।”

“পাঞ্জা লড়ে তো তুমিই জিতেছিলে অর্জুন।”

“আমি সবসময় তোমার কাছে পরাজিত চিত্রাঙ্গদা।”

“ওই দস্যুরা দুর্ধর্ষ।”

“দেখাই যাক। তুমি তো আছ। আমার মৃগয়ায় শুয়োর-মারা বীরাঙ্গনা।”

সেই দিন থেকে চিত্রাঙ্গদাকে অনেক বেশি ভালবেসেছিল অর্জুন। সে যখন ছোটখাটো বাহিনীর সঙ্গে চিত্রাঙ্গদাকে রথে চাপিয়ে রওনা হয়, আকস্মিক এক আনন্দ অনুভবে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিল। অনেকটা এমন আনন্দই সে পেয়েছিল নাগলোকে, যখন তার পাশাপাশি উলূপীও অস্ত্র অভ্যাস করতে শুরু করেছিল নিপুণ লক্ষ্যে। উলূপীর প্রতি শ্রদ্ধা আরও গভীর হয়েছিল। এক নারী ও এক পুরুষ একই সঙ্গে ধনুর্বাণ তুলে নিচ্ছিল অসামান্য দক্ষতায়। কশ্যপ আর কদ্রু কোন আনন্দে বিভোর ছিল বুঝেছিল সে। সমধর্মী স্ত্রী নিয়ে সমান কাজে যাবার যে কী আশ্চর্য তৃপ্তি তা উপলব্ধি করে অর্জুনের মনে হয়েছিল এত উচ্ছ্বাস এত উল্লাসে সে মাতাল হয়ে যাচ্ছে। তার মনে হচ্ছিল, আনন্দে, এই দুই ঘোড়ার সাধারণ রথখানি সে আকাশে উড়িয়ে দেয়।

ভাবতে ভাবতেই সে দেখল সেনাবাহিনী পিছে ফেলে চিত্রাঙ্গদাকে নিয়ে সে বহুদূরে চলে এসেছে। তার রথ চালনার এই বিস্ময়কর ক্ষমতায় চিত্রাঙ্গদা মুগ্ধ, বিস্মিত। বায়ু কেটে বেরিয়ে যাবার শনশন শব্দ হচ্ছে কানে। ঘোড়াগুলো যেন এমন দক্ষ হাতের চালনায় নাচতে নাচতে উড়তে উড়তে চলেছে। তাদের ঘোড়াজন্মের সেরা দৌড়টাই তারা দৌড়চ্ছে আজ। তাদের সমস্ত পেশিতে আনন্দ খেলা করছে। চিত্রাঙ্গদা হাওয়ার শব্দের ওপর গলা তুলে উঁচু স্বরে বলছে, “অর্জুন, তুমি মহা ধনুর্ধর শুনেছি। এখন মনে হচ্ছে তুমি ঘোড়ার গাড়িটাই বেশি ভাল চালাও।”

যুদ্ধে যেতে যেতেও চিত্রাঙ্গদার কৌতুক, যুদ্ধে সে এতটাই অভ্যস্ত। তার অনিন্দ্যসুন্দর শরীরের অনেক জায়গায় ক্ষতচিহ্ন দেখেছিল অর্জুন। এরপর, প্রত্যেকটি ক্ষতচিহ্নে চুমু খাবে ঠিক করল সে। চিত্রাঙ্গদার কথায় উল্লাসে হাসতে হাসতে সে বলল, “তোমার মতো আরোহী পেলে মোষের গাড়িকেও আমি হাওয়ার গতিতে উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারি।”

“তাতে প্রমাণ হয় তুমি খুব ভাল গাড়োয়ান।”

“আচ্ছা, আজ সব ক’টা দস্যু মেরে প্রমাণ দেব আমি তোমার যোগ্য বীর পতি কিনা।”

“না না অর্জুন। আমাকেও ক’টা মারতে দিয়ো। তোমার কাছে আমার বীরত্বের প্রমাণও যে রাখতে চাই আমি।”

এমনই মজার কথা বলতে বলতে তারা যখন উপদ্রুত এলাকায় পৌঁছল, তখন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নেমেছে। সীমান্তবর্তী গাঁয়ের লোক কান্নাকাটি করছে। দস্যুরা তাদের সমস্ত লুঠ করে নিয়ে গিয়েছে। সোনা গয়না ধান চাল কিছু ছাড়েনি। তার ওপর দু’জন মেয়েকেও তারা তুলে নিয়ে গিয়েছে। একজন কামারের মেয়ে একজন কুমোরের। দু’জনেই তরুণী। দু’জনেরই আগামী মাসে বিয়ে ঠিক হয়ে আছে।

নারীহরণের কথা শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল অর্জুন আর চিত্রাঙ্গদা। অর্জুন দ্রুত রথে উঠে বলল, “চলো বীর, দস্যুদলকে ধাওয়া করি।”

“সেনাদলের জন্য অপেক্ষা করবে না?”

“না।”

দুরন্ত বেগে ঘোড়া চালিয়ে দিয়েছিল অর্জুন। কিছু দূর যেতেই গোটা দলটিকে তারা ধরে ফেলে। দস্যুরা ভাবতেই পারেনি কেউ তাদের এভাবে ধাওয়া করে আসবে। প্রচুর লুঠ করে, কখন এই দুই মেয়েকে ভোগ করবে, সেইসব ইতর রসালাপ করতে করতে তারা ঢিলেঢালাভাবে যাচ্ছিল। অর্জুন চিত্কার করল যাতে দস্যুরা ঘুরে দাঁড়ায়, তারপর ধনুকে বাণ জুড়ল। পেছন থেকে কাউকে মারে না অর্জুন। কোনও বীরই মারে না।

অর্জুনের ইঙ্গিতে ঘোড়া দু’টি শান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে দেখল দস্যুরা ঘুরে দাঁড়ানো মাত্র তির ছুড়ল চিত্রাঙ্গদা। অব্যর্থ লক্ষ্য। একজন মাটিতে পড়ে গেল। দস্যুরা তাড়াতাড়ি নিজের নিজের অস্ত্র তুলছে। সংখ্যায় তারা অন্তত একশো। একসঙ্গে পঁচিশটি তির ছুড়ল অর্জুন। একবার দু’বার তিনবার। কয়েক দণ্ডে একশো দস্যু নিকেশ করল অর্জুন ও চিত্রাঙ্গদা। সাফল্যের আনন্দে অর্জুনের দিকে তাকিয়ে চিত্রাঙ্গদা হাসল। বলল, “একটাও বেঁচে নেই। একটাও পালাতে পারেনি। অর্জুন, তুমি অসাধারণ।”

অর্জুন বলেছিল, “তুমিও অসামান্য চিত্রাঙ্গদা। নির্ভুল তোমার লক্ষ্য। একটি বাণও তোমার লক্ষ্যচ্যুত হয়নি। অত্যন্ত ক্ষিপ্র তোমার হাত। অপূর্ব সুন্দর ধনুকের মতো বাঁকা তোমার ভ্রূ। তোমার চোখ দু’টি দেখে লজ্জা পাবে হরিণী, কলাগাছের ভেতরের দিকটা যেমন মসৃণ ও সাদা তেমনি তোমার গা, তোমার ঠোঁট দু’টি প্রদীপকের সেরা রসাল মিঠাইয়ের চেয়েও সুস্বাদু, মধুভাণ্ড তোমার দুই স্তন যার বৃন্তগুলি পদ্মের কুঁড়ির মতো, যা আমারই স্পর্শের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে, তোমার নাভিগর্তে কত শত রহস্যের হাতছানি।”

চিত্রাঙ্গদা হাসতে হাসতে বলে, “তোমার মতলবটা কী অর্জুন? সত্যি করে বলো তো?”

“মতলবটা এই যে, এখুনি এই মুহূর্তে তোমাকে আদর করার পাগল পাগল ইচ্ছা হয়েছে আমার। আমি আজ আমার বউকে নিয়ে যুদ্ধ করেছি। আমার সহধর্মিণী চিত্রাঙ্গদা, সহযোদ্ধা হিসেবে তোমাকে পাশে পেয়ে রমণসুখের তৃপ্তি পেয়েছি আমি।”

চিত্রাঙ্গদা বলল, “ওহে আমার ধনুকবাজ রমণীরমণ, অপহৃত মেয়ে দু’টি যে এখনও ঘোড়ার সঙ্গে বাঁধা, তাদের কে উদ্ধার করবে?”

“তুমি। তারা তোমারই জাতি। অর্থাৎ স্ত্রীজাতীয়া। যাও, তাদের মুক্ত করো। ততক্ষণ ঘোড়াগুলোর গা টিপে দিই আমি। বড্ড দৌড়েছে।” একসঙ্গে লড়াই করার আনন্দ, পরস্পরের নৈপুণ্য ও পরাক্রম দেখার পরবর্তী মুগ্ধতা, অর্জুন ও চিত্রাঙ্গদার মধ্যে যা কিছু অপরিচয়ের বাধা ছিল, ঘুচিয়ে দিয়েছিল। তারা হয়ে উঠেছিল পরিপূর্ণ স্বামী-স্ত্রী।

একটি ঘোড়ার পিঠে মেয়ে দু’টিকে বসিয়ে দিল চিত্রাঙ্গদা। এদের একজনের নাম মালতী, একজন পার্বতী। নিজের রথের পিছনে ঘোড়াটি জুড়ে দিল সে। দস্যুদের সঙ্গে ছ’টি ঘোড়া মারা পড়েছে। বাকি সব ঘোড়ার পিঠেই লুঠ করা জিনিস। এসব তো পাওয়া গেলই, বেশ কিছু ঘোড়াও পেয়ে গেল তারা। দস্যু তাড়ানোয় এতখানি সফল চিত্রাঙ্গদা আগে কখনও হয়নি। এক ঘোড়ার জিনের সঙ্গে আরেক ঘোড়ার লাগাম আটকে সংবদ্ধ সারি তৈরি করতে লাগল চিত্রাঙ্গদা যাতে সব ক’টাকে রথের সঙ্গে বেঁধে টেনে নিয়ে যাওয়া যায়। মালতী আর পার্বতী বলল, “রাজা চিত্রাঙ্গদা, আমরা কি তোমাকে এ কাজে সাহায্য করতে পারি?”

চিত্রাঙ্গদা হেসে ফেলল। বলল, “নিশ্চয়ই। কিন্তু রাজা চিত্রাঙ্গদা আবার কী ডাক। আমাদের রাজা তো চিত্রবাহন।”

মালতী বলল, “তিনি মহারাজ। আর তুমি রাজা। দেশের লোক তোমাকে এই নামেই ডাকে। রাজ্ঞী বলে একটা শব্দ আছে। কিন্তু সে ভারী শক্ত। তাই তুমি রাজাই হয়ে গিয়েছ।”

পার্বতী বলল, “আজ তোমার দেখা পেয়ে আমরা ধন্য হলাম।”

সমস্ত ঘোড়া বাঁধা হয়ে গেলে অর্জুন আর চিত্রাঙ্গদা সেই গ্রামের দিকে চলল যেখানে দস্যুরা হামলা করেছিল। রথের সঙ্গে বাঁধা একশো ঘোড়ার শোভাযাত্রা।

রসালাপ বা কৌতুক কিছুই তারা করছে না এখন। রথের ঠিক পিছনেই ঘোড়ার ওপর মেয়ে দু’টি রয়েছে। কী সুন্দর শান্ত চারদিক। বেলা পড়ে আসছে। সূর্যোদয়ের সময় ঘুমন্ত গ্রামে আক্রমণ চালিয়ে লুঠমার করেছিল ডাকাতের দল। তারা কি ভেবেছিল পরের দিনের সূর্য আর তাদের দেখা হবে না? অর্জুন জানে এই শাস্তির কথা দিকে দিকে রটে যাবে। কোনও লুঠেরাই অনেকদিন আর মণিপুরে আসতে সাহস পাবে না। চিত্রাঙ্গদা জানে না, দু’লক্ষ সৈন্যের সঙ্গে একা লড়ে যাবার ক্ষমতা রাখে অর্জুন। ভাল সারথি পেলে দশ লাখ সৈন্যের সংহার করতে পারে। আসলে যুদ্ধ জনসংখ্যার সঙ্গে হয় না, হয় সবল ও কৌশলী প্রতিপক্ষর সঙ্গে।

সে মুখ ফিরিয়ে দেখেছিল, চিন্তায় ডুবে আছে চিত্রাঙ্গদা। সে জিজ্ঞেস করল, “কী ভাবছ?” চিত্রাঙ্গদা বলেছিল, “ভাবছি, বিচারসভা শুরু করতে হবে আবার। নগর পরিক্রমা করতে হবে। আমার যত কাজ সব আবার শুরু করতে হবে আগের মতো।”

তখন মালতী ও পার্বতীর কান্না শুনতে পেল তারা। চিত্রাঙ্গদা বলল, “তোমরা কাঁদছ কেন?” মেয়ে দু’টি একে একে বলতে লাগল, দস্যুরা অপহরণ করেছিল তাদের, কে জানে তাদের বিয়ে হবে কিনা।

চিত্রাঙ্গদা বলল, “ভয় নেই। আমার মনে থাকবে তোমাদের কথা। আমি নিজে আসব তোমাদের বিয়ে দিতে।”

গাঁয়ে পৌঁছে তারা দেখে, সেনাবাহিনী সেখানে এসে পৌঁছেছে। শিবাঙ্গী খুবই উদ্বিগ্নভাবে গ্রামবাসীদের কাছে জিজ্ঞাসাবাদ করছে, কোন দিকে গিয়েছে অর্জুন ও চিত্রাঙ্গদা। তাদের দেখে প্রায় দৌড়ে এল সে। ছুটে এল গাঁয়ের লোক। দস্যুরা যে মারা পড়েছে, সঙ্গের ঘোড়া আর মেয়ে দু’টি তার প্রমাণ। কিন্তু ঠিক কী হয়েছে তার বর্ণনা শুনতে চায় সবাই। অর্জুনকেও তারা এখন খুব আগ্রহ নিয়ে দেখছে।

চিত্রাঙ্গদা রথ থেকে নেমে বলল, “আমার ঘোড়াগুলো ক্লান্ত, ওদের দানাপানি দাও তোমরা।”

গাঁওবুড়োর নির্দেশে দু’টি যুবক তাড়াতাড়ি ঘোড়ার ব্যবস্থা করতে লাগল। দু’জন এসে অর্জুনের সামনে হাত জোড় করে দাঁড়াল। গাঁওবুড়ো বলল, “মা চিত্রাঙ্গদা, তুমি আমাদের রাজা। তুমি আমাদের রক্ষক। তোমার স্বামীও তোমার উপযুক্ত। এই অর্জুন, আমি জানি এ মহা বীর পাণ্ডুরাজার ছেলে। সে যখন তোমার সঙ্গে যায়, আমি জানতাম দস্যুরা মারা পড়বে। ধন্য তোমরা। ধন্য তোমাদের বীরত্ব। তোমাদের প্রণাম। আজ তোমরা এ গাঁয়ের অতিথি। তোমাদের জন্য আমরা আমাদের মেয়ে ফিরে পেয়েছি। ধনসম্পদও তোমরা যথেষ্ট এনেছ। আজ তোমরা আমাদের আতিথেয়তা গ্রহণ করো।”

চিত্রাঙ্গদা বলল, “না। আজ নয়। এই মালতী ও পার্বতীর বিয়ের আয়োজন করো। আমি সেই উৎসবের দিনে আসব।”

গাঁওবুড়ো বলল, “তাই হবে। অর্জুন, তুমি আমাদের মহারাজ চিত্রবাহনের জামাই। তুমি আমাদের পরম সমাদরের জন। তোমাকে আমরা নিমন্ত্রণ করলাম। উৎসবের দিনে তুমিই আমাদের মেয়ে চিত্রাঙ্গদাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসবে। যেমন নারায়ণের সঙ্গে থাকেন লক্ষ্মী, যেমন ইন্দ্রের সঙ্গে শচী, সূর্যের সঙ্গে সংজ্ঞা, হরমহাদেবের সঙ্গে পার্বতী।”

বুড়োর তুলনা যেন আর শেষই হতে চায় না। অর্জুন অনেক কষ্টে হাসি চেপে ছিল, কিন্তু চিত্রাঙ্গদাই হেসে ফেলল। তার দিকে তাকিয়ে গাঁয়ের লোকও চেপে রাখা হাসির ফোয়ারা ছুটিয়ে হেসে উঠল তার সঙ্গে সঙ্গে। রাজাকে পেয়ে, হারানো ধন ফিরে পেয়ে আজ তাদের আনন্দের শেষ নেই। অথচ আজ সকালেই তারা ছিল পরম দুঃখী।

পাঁচজন বয়স্ক ও গণ্য সেনার ওপর সমস্ত সম্পদ গ্রামবাসীদের মধ্যে ভাগ করে দেবার দায়িত্ব দিয়ে, ঘোড়াগুলো নিয়ে ফিরে এসেছিল তারা। অর্জুন অশ্বকোবিদ নয়। কিন্তু ক্ষত্রিয় প্রায় জন্ম থেকে ঘোড়া চিনতে শেখে। সে দেখল, দস্যুদের সংগ্রহে বেশ ভাল ভাল ঘোড়া ছিল। হ্রেষী, সৈন্ধব, রাজস্কন্ধ, প্রকীর্ণক, মরুদ্রথ। সবই নিশ্চয়ই হরণ করা।

সেইদিন চিত্রাঙ্গদাকে নতুন করে চিনেছিল অর্জুন। তার ভাবনার প্রসারতা জেনেছিল। দেখেছিল তার বীরত্ব, তার বিচারবুদ্ধি।

চিত্রাঙ্গদাকে দেখে মুগ্ধ হবার পর থেকে তাকে বিয়ে করার পরেও কয়েকদিন পর্যন্ত, এমনকী সেইদিন সকাল পর্যন্ত একটি অতৃপ্তি কাঁটা হয়ে বিঁধেছিল তার মনে। উলূপী বলেছিল, “পার্থ, পারস্পরিক শ্রদ্ধাই হল প্রেমের ধারণপাত্র। শ্রদ্ধা না থাকলে ক’দিনের ব্যবহারে প্রেম ক্ষয়ে যায় মাটির কলসির ঘষায় যেমন ক্ষয়ে যায় পাথর।” উলূপীকে কত সহজে শ্রদ্ধা করতে পেরেছিল অর্জুন। কিন্তু চিত্রাঙ্গদার প্রতি যৌন টান ছাড়া আর কিছুই সে বোধ করছিল না। সেইদিন চিত্রাঙ্গদাকে শ্রদ্ধা করেছিল অর্জুন।

গত এক বছরে অর্জুন আর চিত্রাঙ্গদা অনেক অন্তরঙ্গ হয়ে উঠেছে। কিন্তু আজও চিত্রাঙ্গদার সন্তান সম্ভাবনা হল না কেন? অর্জুন শিবমূর্তির দিকে তাকাল। শিবের পায়ের উপর মাথা রেখে পড়ে আছে চিত্রাঙ্গদা। সেই চিত্রাঙ্গদা। যাকে পুরুষবেশে দেখেও অর্জুনের সঙ্গম লিপ্সা জেগেছিল।

হলুদ রঙের শাড়িতে আজ চিত্রাঙ্গদাকে একগুচ্ছ সতেজ ঝিঙেফুলের মতো লাগছে।

প্রায় প্রতি রাত্রেই চিত্রাঙ্গদাকে রমণ করেছে অর্জুন। প্রতি রাত্রেই তীব্র সুখের চূড়ান্ত তৃপ্তিতে ওই রূপযৌবনবতী রমণীর নরম পিচ্ছিল যোনিতে ঢেলে দিয়েছে তার বীর্যরস। গত একবছরে চিত্রবাহনের কাছে মেঘবাণ শিখে চলেছে অর্জুন। তার মতো সুদক্ষ ধনুকসিদ্ধ মানুষেরও এত সময় লেগে যাচ্ছে এমনই আয়াসসাধ্য এই অস্ত্র। ব্রহ্মশির আয়ও করতেও এত সময় লাগেনি তার।

চিত্রাঙ্গদা এসে দাঁড়াল অর্জুনের পাশে। বলল, “একই সঙ্গে অনেকগুলো বাণ তুমি কেমন করে ছোড়ো অর্জুন? আমাকে শেখাবে?”

খুব খুশি হল অর্জুন। বলল, “কেন শেখাব না চিত্রাঙ্গদা? ভোরবেলা যাবে আমার সঙ্গে?”

“কাল থেকে যাব।”

“তুমি তো সেই ব্রাহ্ম মুহূর্তে উঠতে পারো না।”

“কাল থেকে উঠব।”

“আমি যোগাভ্যাসও করি যে।”

“কাল থেকে আমিও যোগাভ্যাস করব।”

“তারপর আমি স্নান করে পূজা করি।”

“কাল থেকে আমিও পূজা করব তোমার সঙ্গে। এতদিন আমি তোমার নিদ্রাসঙ্গিনী ছিলাম। কাল থেকে তোমার জাগরণের সঙ্গিনীও হয়ে উঠব আমি অর্জুন। আমাদের প্রেম ও যৌনলিপ্ততার সঙ্গে যখন আমাদের আচার ধর্ম পূজা প্রার্থনা এবং হৃদয় মিলে যাবে, তখনি আমার গর্ভ হবে অর্জুন। তুমি দেখে নিও।”

খোলা আকাশের তলায়, মণিপুর দেশের সবচেয়ে উঁচু চাতালে, শিবমূর্তির সামনে পরমানন্দে চিত্রাঙ্গদাকে জড়িয়ে ধরল অর্জুন। কালো মেঘ ভেসে যাচ্ছিল আকাশে। তার মনে হল কৃষ্ণই যেন উড়ে আসছে তার কাছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *