১০. আচার, অনাচার ও ভক্ষ্যাভক্ষ্য বিষয়

আচার, অনাচার ও ভক্ষ্যাভক্ষ্য বিষয়

অথ দশম-সমুল্লাসারন্থঃ
অথা চার নাচার ভক্ষ্যাক্ষ্য বিষয়ান ব্যাখ্যাস্যামঃ

এক্ষণে ধর্মযুক্ত কর্মানুষ্ঠান, সুশীলতা, সৎসংসর্গ ও সদ্বিদ্যাগ্রহণে রুচি প্রভৃতি আচার এবং তদ্বিপরীত যাহাকে অনাচার বলে তৎসম্বন্ধে লিখিত হইতেছে —

বিদ্বদ্ভিঃ সেবিতঃ সদ্ভিনিত্যমষেরাগিভিঃ ॥ হৃদয়েনাভ্যনুজ্ঞাতো য়ো ধর্মস্তন্নিবোধত ॥১॥ কামাত্মতা প্রশস্তান চৈবেহাস্ত্যকামতা। কামোহি বেদাধিগমঃ কর্মযোগশ্চ বৈদিকঃ ॥ ২ ॥ সঙ্কল্পমূলঃ কামো বৈ অজ্ঞা সঙ্কল্পসম্ভবাঃ। ব্ৰতানিয়মধর্মাশ্চ সর্বে সঙ্কল্পজাঃ স্মৃতাঃ ॥৩ ॥ অকমাস্য ক্রিয়া কাচিদ দৃশ্যতে নেহ কৰ্হিচিৎ। যদ্যদ্ধি কুরুতে কিঞ্চিৎ তত্তৎ কামস্য চেষ্টিত ॥ ৪) বেদোখিলো ধর্মমূলং স্মৃতিশীলে চ তদ্বিদা। আচারশ্চৈব সাধুনামাত্মনস্তুষ্টিরেব চ ॥ ৫ ॥ সর্ব সমবেক্ষ্যেদং নিখিলং জ্ঞানচক্ষুষা। শ্ৰতিপ্রামাণ্যতো বিদ্বান স্বধর্মে নিবিশেত বৈ৷ ৬ ॥ তিস্মৃত্যুদিতং ধর্মমনুতিষ্ঠহি মানবঃ। ইহ কীৰ্ত্তিমবাপ্নোতি প্রেত্য চানুত্তমংসুখ ॥ ৭ ॥ গোবমন্যেত তেমূলে হেতুশাস্ত্রাশয়াদ্বিজাঃ। স সাধুভিবহিষ্কায়ো নাস্তিকো বেদনিন্দকঃ ॥ ৮ ॥ বেদঃ স্মৃতিঃ সদাচারঃ স্বস্য চ প্রিয়মাত্মনঃ। এতচ্চতুৰ্ব্বিধং প্ৰাহুঃ সাক্ষাদ্ধর্মস্য লক্ষণম্ ॥ ৯ ॥ অর্থকামেম্বসক্তানাং ধর্মজ্ঞানংবিধীয়তে। ধর্মং জিজ্ঞাসমানানাং প্রমাণং পরমং শ্রুতিঃ ॥১০ ॥ বৈদিকৈঃ কর্মভিঃ পুণ্যের্নিফেকাদিৰ্বিজন্মনাম্। কাৰ্য্যঃ শরীরসংস্কারঃ পাবনঃ প্ৰেত্য চেহ চ ॥১১ ॥ কেশান্তঃ যোড়শে বর্ষে ব্রাহ্মণস্য বিধীয়তে। রাজন্যবন্ধোর্ঘাবিংশে বৈশ্যস্য দ্ব্যধিকে ততঃ ৷১২ ॥ মনু অ০ ২ ॥

সর্বদা মনুষ্যের এ বিষয়ে লক্ষ্য রাখা আবশ্যক, যে রাগ দ্বেষ রহিত বিদ্বান্ ব্যক্তিগণ যাহা নিত্য সেবন করেন এবং হৃদয় অর্থাৎ আত্মা দ্বারা যাহা সত্য ও কর্তব্য বলিয়া জানেন,সেই ধর্মই মাননীয় ও আচরণীয় ॥ ১

কেননা এ সংসারে অত্যাধিক সকামতা অথবা নিষ্কামতা প্রশস্ত নহে। কারণ কামনা দ্বারাই বেদার্থ জ্ঞান ও বেদোক্ত কর্ম সিদ্ধ হইয়া থাকে ॥ ২ ॥ ৷

যদি কেহ বলেন, “আমার কোন ইচ্ছা নাই এবং আমি নিষ্কাম হইয়াছি বা হইব, তবে তাহা। কখনও হইতে পারে না। কারণ সকল কাম-অর্থাৎ যজ্ঞ, সত্যভাষণাদি ব্রত, যম নিয়মরূপী ধর্ম প্রভৃতি সমস্তই সঙ্কল্প হইতে হইয়া থাকে ॥ ৩ ॥

কেননা হস্ত, পাদ, নেত্র ও মন প্রভৃতি কামনা দ্বারাই চালিত হয়। এ সব কামনা দ্বারা চলে। ইচ্ছা ব্যতীত চক্ষুর উন্মীলন, নিমীলনও হইতে পারে না ॥ ৪ ॥

এই জন্য সম্পূর্ণ বেদ, মনুস্মৃতি, অন্যান্য ঋষি প্রণীত শাস্ত্র সৎপুরুষদিগের আচার এবং নিজ আত্মার প্রীতিকর কাৰ্য্য যে কাৰ্যে অর্থাৎ ভয়, সংশয় ও লজ্জা উৎপন্ন হয় না, সেই সব কর্মানুষ্ঠান করাই কর্তব্য। দেখ, যখনই কেহ মিথ্যা কথা বলে এবং চৌৰ্য্য আদি কুকর্ম করিতে ইচ্ছা করে তখনই তাহার আত্মায় ভয়, সংশয়, লজ্জা অবশ্যই উৎপন্ন হয়। সুতরাং ঐ সকল কর্ম করা উচিত নহে ॥ ৫ ॥

মনুষ্য উত্তমরূপে বিচার করিয়া জ্ঞাননেত্রের সাহায্যে সমগ্র শাস্ত্র, বেদ, সৎপুরুষদিগের আচার এবং নিজ আত্মার অবিরুদ্ধ ধর্মে প্রবেশ করিবে। সেই ধর্ম শ্রুতি–প্রমাণ অনুসারে নিজ আত্মার অনুকূল হওয়া আবশ্যক ॥ ৬ ॥

যিনি বেদোক্ত ও বেদানুকূল স্মৃতিশাস্ত্রোক্ত ধর্মের অনুষ্ঠান করেন, তিনি ইহলোকে কীৰ্ত্তি এবং পরলোকে সর্বোত্তম সুখ ভোগ করেন ॥ ৭ ॥

শ্রুতি বেদ এবং স্মৃতি ধর্মশাস্ত্র নামে কথিত। তদ্বারা কর্তব্যাকর্তব্য নির্ণয় করা আবশ্যক। যে বেদ এবং বেদানুকূল আপ্তগ্রস্থ সমূহের অপমান করে তাহাকে শ্রেষ্ঠ লোকেরা সমাজচ্যুত করিবেন, কারণ বেদনিন্দককে নাস্তিক বলে ॥ ৮ ॥

সুতরাং বেদ, স্মৃতি, সৎপুরুষদিগের আচার নিজ আত্মার জ্ঞানের অনুকূল প্রিয় আচরণ ধর্মের এই চারি লক্ষণ অর্থাৎ ইহাদের দ্বারাই ধর্ম লক্ষিত হইয়া থাকে ॥ ৯ ॥

কিন্তু যিনি ধনলোভে এবং কাম অর্থাৎ বিষয়ভোগে আসক্ত না হন, তাহারই ধর্মজ্ঞান হইয়া থাকে। যিনি ধর্ম জানিতে ইচ্ছা করেন, তাহার পক্ষে বেদই পরম প্রমাণ ॥১০ ॥

অতএব বেদোক্ত পুণ্যকর্মের অনুষ্ঠান করা মনুষ্যমাত্রেরই কর্তব্য। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্য সন্তানদের কল্যাণের জন্য নিষেকাদি সংস্কার করিবেন। এই সকল সংস্কার ইহজন্মে ও পরজন্মে। পবিত্রকারী ॥১১।

ব্রাহ্মণ বর্ণের ষোড়শ বর্ষে, ক্ষত্রিয়ের দ্বাবিংশ বর্ষে এবং বৈশ্যের চতুবিংশ বর্ষে কেশান্ত কর্ম = ক্ষৌর মুণ্ডন হওয়া আবশ্যক অর্থাৎ এই বিধির পর কেবল শিখা রাখিয়া অন্যান্য কেশ অর্থাৎ শ্মশ্রু, গুম্ফ এবং মস্তকের কেশ সর্বদা মুণ্ডন করিতে থাকিবে, অর্থাৎ পুনরায় কখনও রাখিবে না। আর যদি শীতপ্রধান দেশ হয়, তাহা হইলে ইচ্ছানুসারে কাৰ্য্য করিবে, ইচ্ছামত কেশ রাখিবে। আর যদি উষ্ণপ্রধান দেশ হয় তাহা হইলে সমস্ত শিখা সহিত ছেদন করা উচিত। কারণ মস্তকে কেশ থাকিলে উষ্ণতা অধিক হইয়া থাকে। তাহাতে বুদ্ধির হ্রাস হয়। শ্মশ্রু গুম্ফ রাখিলে পান-ভোজন। উত্তমরূপে করা যায় না এবং উচ্ছিষ্টও থাকিয়া যায় ॥১২ ॥

ইন্দ্রিয়াণাংবিচরতাং বিষয়েপহারিযু। সংয়মে য়ত্নমাতিষ্ঠেদ্বিদ্বায়ন্তে বাজিনা ॥ ॥ ইন্দ্রিয়াণাং প্রসঙ্গেন দোষমৃচ্ছত্যসংশয়। সন্নিয়ম্য তু নেব ততঃ সিদ্ধিং নিয়চ্ছতি ॥ ২ ॥ ন জাতু কামঃ কামানামুপভোগেন শামতি। হবিষা কৃষ্ণবয়েঁব ভূয় এবাভিবর্ধতে ॥ ৩ ॥ বেদাস্ত্যাগশ্চয়জ্ঞাশ্চ নিয়মাশ্চ তপাংসি চ ॥ নবিদুষ্টভাবস্য সিদ্ধিং গচ্ছন্তি কহিঁচিৎ ॥ ৪ ॥ বশে কৃত্বেন্দ্রিয়গ্রামং সংয়ম্য চ মনস্তথা। সর্বান্ সংসায়েদৰ্থানক্ষিন্ য়োগতস্তম্ ॥ ৫ ॥ শ্ৰুত্ত্বা স্পৃষ্টা চ দৃষ্টা চ ভুক্তা ঘ্রাত্বা চ য়ো নরঃ। ন হৃষ্যতি গ্লায়তি বা সবিজ্ঞেয়ো জিতেন্দ্রিয়ঃ ॥ ৬ ॥ নাপৃষ্টঃ কস্যাচিব্রুয়ান্ন চান্যায়েন পৃচ্ছতঃ। জানন্নপিহি মেধাবী জডবল্লোক আচরেৎ ॥ ৭ ॥ বিত্তং বন্ধুবয়ঃ কর্ম বিদ্যা ভবতি পঞ্চমী ॥ এতানি মান্যস্থানানি গরীয়োয়দ্যদুত্তরম্ ॥ ৮ ॥ অজ্ঞো ভবতি বৈ বালঃ পিতা ভবতি মন্ত্রঃ। অজ্ঞং হি বালমিত্যাহুঃ পিতেত্যেব তু মন্ত্রদ ॥ ৯ ॥ ন হায়নৈর্ন পলির্নৈবিত্তেনন বন্ধুভিঃ। ঋষয়শ্চক্রিরে ধর্মং মিেচনুচানঃ স নো মহান্ ॥১০ ॥ বিপ্রাণাং জ্ঞানত জৈষ্ঠ্যং ক্ষত্রিয়াণাং তুবীয়তঃ। বৈশ্যানাং ধান্যধনতঃশূদ্রাণামেব জন্মতঃ ॥১১ ॥ ন তেন বৃদ্ধো ভবতি য়েনাস্য পলিতং শিরঃ। যো বৈয়ুবাপ্যধীয়ানস্তং দেবাঃ স্থবিংবিদুঃ ॥ ১২ ॥ য়থা কাষ্ঠময়ে হস্তী য়থা চর্মময়ো মৃগঃ। য়শ্চবিপ্রোS নধীয়ানস্ত্রয়স্তে নাম বিভ্রতি ॥১৩ ॥ অহিংসয়ৈব ভূতানাংকায়ং শ্রেয়োচনুশাসন। বাক্ চৈব মধুরা শ্লক্ষণা প্রয়োজ্যা ধর্মমিচ্ছতা ॥১৪ ॥ মনু০ অ০ ।২। ॥

যে সকল ইন্দ্রিয় চিত্তহরণকারী বিষয় সমূহ মনকে প্রবৃত্ত করে, সেই সকলকে নিরোধ করিতে চেষ্টা করা মনুষ্যের মুখ্য কর্তব্য। যেরূপ সারথী অশ্বকে সংযত করিয়া শুদ্ধ মার্গে চালিত করে, সেইরূপ ইন্দ্রিয় সমূহকে বশীভূত করিয়া অধমর্মার্গ হইতে নিবৃত্ত এবং সর্বদা ধর্মমার্গে চালিত করিবে ॥ ১ ॥

কারণ, ইন্দ্রিয় সমূহকে বিষয়াসক্তি ও অধর্মে চালিত করিলে, মনুষ্যের নিশ্চয়ই দোষ ঘটে, কিন্তু এই সকলকে জয় করিয়া ধর্মপথে চালিত করিলে, অভীষ্ট সিদ্ধি হয় ॥ ২ ॥

ইহা নিশ্চিত যে, যেরূপ অগ্নিতে ইন্ধন ও ঘৃত নিক্ষেপ করিলে অগ্নি বৃদ্ধি পাইতে থাকে, সেইরূপ কামোপভোগ দ্বারা বিষয় বাসনার উপশম কখনও হয় না, বরং উহা কেবল বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়। এইজন্য মনুষ্যের কখনও বিষয়াসক্ত হওয়া উচিত নহে ॥৩॥

যিনি জিতেন্দ্রিয় নহেন, তাহাকে ‘বিপ্ৰদুষ্ট’ বলে। তাঁহার কাৰ্য্য দ্বারা বেদজ্ঞান, ত্যাগ, যজ্ঞ, নিয়ম এবং ধর্মাচরণ সিদ্ধ হয় না। কিন্তু যিনি জিতেন্দ্রিয় তাঁহারই এই সকল সিদ্ধি হইয়া থাকে ॥ ৷ ৪ ॥

অতএব পাঁচ কর্মেন্দ্রিয়, পাঁচ জ্ঞানেন্দ্রিয় এবং একাদশ মনকে নিজের বশীভূত করিয়া যুক্ত আহার-বিহার ও যোগানুষ্ঠান দ্বারা শরীর রক্ষা করিয়া সবার্থ সিদ্ধ করিবে ॥ ৫ ॥

যিনি স্তুতি শ্রবণে হর্ষ এবং নিন্দা শ্রবণে দুঃখ করেন না; তিনি প্রীতিকর স্পর্শে সুখ এবং অপ্রীতিকর স্পর্শে দুঃখ অনুভব করেন না; যিনি সুন্দর রূপ দেখিয়া প্রসন্ন এবং দুষ্টরূপ দেখিয়া অপ্রসন্ন হন না; যিনি উত্তম ভোজনে আনন্দিত ও নিকৃষ্ট ভোজনে দুঃখিত হন না এবং যিনি সুগন্ধে রুচি ও দুর্গন্ধে অরুচি প্রকাশ করেন না তাহাকে ‘জিতেন্দ্রিয়’ বলে ॥ ৬ ৷

জিজ্ঞাসিত না হইলে অথবা কপটভাবে জিজ্ঞাসিত হইলে উত্তর দিবে না। বুদ্ধিমান ব্যক্তি তাঁহার সম্মুখে জড়ের ন্যায় থাকিবে। অবশ্য অকপট জিজ্ঞাসুকে জিজ্ঞাসিত না হইয়াও উপদেশ প্রদান করিবে ॥ ৭ ॥

প্রথম ধন; দ্বিতীয় বন্ধু, কুটুম্ব, ও কুল; তৃতীয় আয়ু, চতুর্থ উত্তম কর্ম এবং পঞ্চম শ্রেষ্ঠ বিদ্যা-এই পাঁচটি সম্মানস্পদ। কিন্তু ধন অপেক্ষা বন্ধু, বন্ধু অপেক্ষা আয়ু, আয়ু অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ কর্ম এবং (শ্রেষ্ঠ) কর্ম অপেক্ষা পবিত্র বিদ্যা, উত্তরোত্তর অধিক সম্মানস্পদ ॥ ৮ ॥

কেননা শত বৎসর হইলেও বিদ্যাও বিজ্ঞানরহিত ব্যক্তি ‘বালক’ এবং বিদ্যা ও বিজ্ঞানদাতা। সে বালক হইলেও ‘বৃদ্ধ’ জ্ঞান করা উচিত। কারণ, সকল শাস্ত্র এবং আপ্ত বিদ্বানেরা অজ্ঞানীকে ‘বালক’ ও জ্ঞানীকে ‘পিতা’ বলিয়া থাকেন ॥৯।

অধিক আয়ু এবং শ্বেত কেশ হইলেই এবং বহু ঐশ্বৰ্য্য ও বহু আত্মীয়স্বজন থাকিলেই কেহ বৃদ্ধ হয় না। কিন্তু ঋষি-মহাত্মাদিগের সিদ্ধান্ত এই যে, যিনি আমাদের মধ্যে বিদ্যায় এবং বিজ্ঞানে শ্রেষ্ঠ তিনিই ‘বৃদ্ধ’ ॥১০ ॥

ব্রাহ্মণ জ্ঞানে, ক্ষত্রিয় বলে, বৈশ্য ধন-ধান্যে এবং শূদ্র জন্মে অর্থাৎ অধিক আয়ু দ্বারা বৃদ্ধ হইয়া থাকে ॥ ১১ ॥

মস্তকের কেশ শ্বেত হইলেই কেহ বৃদ্ধ হয় না কিন্তু কৃতবিদ্য যুবককে জ্ঞানিগণ মহান বলিয়া থাকেন ॥ ৷ ১২ ॥

বিদ্যাহীন ব্যক্তি কাষ্ঠ নির্মিত হস্তী ও চর্ম নির্মিত মৃগের ন্যায়। এতাদৃশ বিদ্যাহীন মনুষ্যকে। জগতে নাম মাত্র মনুষ্য বলা হয় ॥ ১৩ ॥

অতএব বিদ্যাধ্যয়ন দ্বারা বিদ্বান ও ধর্মাত্মা নিবৈরভাবে সকল প্রাণীর কল্যাণার্থে উপদেশ। দিবে। উপদেশ কালে কোমল ও মধুর বাক্য বলিবে। যাঁহারা সত্যেপদেশ দ্বারা ধর্মের বৃদ্ধি ও

অধর্মের নাশ করেন সেই সব ব্যক্তিই ধন্য ॥ ১৪ ॥

নিত্য স্নান করিবে। বস্ত্র, অন্ন, পানীয় ও বাসস্থান সমস্ত পবিত্র রাখিবে। কারণ এসকল পবিত্র থাকিলে চিত্তশুদ্ধি ও আরোগ্যলাভ হয় এবং তদ্বারা পুরুষকার বৃদ্ধি পায়। ময়লা ও দুর্গন্ধ দূরীভূত না হওয়া পর্যন্ত ঐ সমস্ত পরিষ্কার করিবে।

আচারঃ পরমো ধর্মঃ শ্রুত্যক্তঃ স্মাৰ্ত্ত এব চ ॥ মনু-০

সত্যভাষণাদি আচরণকেই বেদ ও স্মৃতিশাস্ত্রোক্ত ‘আচার’ বলে।

মা নো বধীঃ পিতরং মোত মাতরম্ ৷ যজু০১৬।১৫ আচার্য্য উপনয়মানো ব্রহ্মচারিণমিচ্ছতে ॥ অর্থব০ ১১ । ৫ । ১৭

মাতৃদেবো ভব। পিতৃদেবো ভব আচার্য্যদেবো ভব।
অতিথিদেবো ভব ॥ তৈত্তিরী।

মাতা-পিতা, আচাৰ্য্য এবং অতিথি সেবা করাকে ‘দেবপূজা’ বলে। জগতের হিতকর কর্ম করা এবং অনিষ্টকর কর্ম পরিত্যাগ করাই মানুষের প্রধান কর্তব্য কর্ম। নাস্তিক, লম্পট, বিশ্বাসঘাতক, চোর, মিথ্যাবাদী স্বার্থপর,কপট এবং প্রতারক প্রভৃতি অসৎ লোকের সংসর্গ কখনও করিবে না। সর্বদা ‘আপ্ত’ যিনি সত্যবাদী, ধর্মাত্মা এবং পরোপকার প্রিয় তাহাদের সংসর্গ করা শ্রেষ্ঠাচার।

প্রশ্ন –আৰ্য্যাবর্তের বাহিরে বিভিন্ন দেশে গমন করিলে আৰ্য্যাবৰ্ত্তবাসীদের আচার নষ্ট হয়। কিনা?

উত্তর –ইহা মিথ্যা কথা। কারণ, যে কোনো স্থানে অন্তর বাহির পবিত্র করা ও সত্যভাষণাদি আচরণ করা হউক না কেন, তদ্বারা কাহারও কখনও আচার ধর্ম ভ্রষ্ট না হয়। কিন্তু কেহ যদি আর্যাবর্তে থাকিয়াও দুরাচারী হয় তাহাকে ধর্ম ও আচার- ভ্রষ্ট বলা হয়। যদি ভিন্ন দেশে গমন করিলে আচার নষ্ট হইত, তাহা হইলে এইরূপ লিখিত হইত নাঃ–

মেরোহরেশ্চ দ্বে বর্ষে বর্ষং হৈমবতং ততঃ। ক্রমেণৈব ব্যতিক্রম্য ভারতং বর্যামাসদৎ ॥ ১ ॥ স দেশান্ বিবিধান্ দেশাচী হূণনিষেবিতা ॥ ২ ॥

এই শ্লোকগুলি মহাভারতের শান্তিপর্বে মোক্ষধর্ম বিষয়ে ব্যাস-শুক সংবাদে লিখিত আছে। অর্থাৎ এক সময়ে ব্যাসদেব তাঁর পুত্র শুক এবং শিষ্যের সহিত ‘পাতাল’অর্থাৎ আধুনিক আমেরিকায় বাস করিতেন। শুকাঁচাৰ্য্য পিতাকে একটি প্রশ্ন করিলেন যে, আত্মবিদ্যা কি এই পৰ্য্যন্ত অথবা আরও অধিক? ব্যাসদেব জানিয়াও উত্তর দিলেন না। কারণ, তিনি পূর্বে এ বিষয়ে উপদেশ দিয়াছিলেন। অপরকে সাক্ষী করিবার জন্য তিনি পুত্র শুকদেবকে বলিলেন, “হে পুত্র! তুমি মিথিলা নগরীতে যাইয়া জনক রাজাকে এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিও। তিনি ইহার সমুচিত উত্তর দিবেন।

পিতার বাক্য শুনিয়া শুকাঁচাৰ্য পাতাল হইতে মিথিলাভিমুখে যাত্রা করিলেন। প্রথম মেরু অর্থাৎ হিমালয়ের ঈশান, উত্তর ও বায়ব্য কোণে অবস্থিত যে দেশ তাহার নাম হরিবর্ষ। বানরকে হরি বলে। ঐ দেশের অধিবাসীগণ এখনও বানরের রক্তমুখ ও পিঙ্গলনেত্র। বর্তমান সময়ে যে দেশের নাম ইউরোপ’, সংস্কৃত ভাষায় তাহার নাম হরিবর্ষ। তিনি সেই দেশ, হূণ, ইহুদী’ দেশও পরিদর্শন করিয়া চীনদেশে আগমন করিলেন। অনন্তর চীন হইতে হিমালয়ে এবং হিমালয় হইতে মিথিলা পুরীতে আগমন করিলেন।

শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুন ‘অশ্বতরী’ অর্থাৎ অগ্নিযানে আরোহণপূর্বক পাতালে যাইয়া সেখান হইতে উদ্দালক ঋষিকে লইয়া মহারাজা যুধিষ্ঠিরের যজ্ঞে উপস্থিত হইয়াছিলেন। গান্ধার অর্থাৎ কান্দাহারের রাজকন্যার সহিত ধৃতরাষ্ট্রের বিবাহ হইয়াছিল। পাণ্ডুর স্ত্রী মাদ্রী ‘ইরাণের’ রাজকন্যা ছিলেন। ’পাতাল’ অর্থাৎ আমেরিকার রাজকন্যা উলোপীর সহিত অৰ্জ্জুনের বিবাহ হইয়াছিল। দেশ-দেশান্তর ও দ্বীপ-দ্বীপান্তরে যাতায়াত না থাকিলে এ সকল ঘটনা কীরূপে সম্ভব হইত? মনুস্মৃতিতে সমুদ্রগামী জলযানের উপর যে কর আদায়ের উল্লেখ আছে, তাহাও আৰ্য্যাবৰ্ত্ত হইতে দ্বীপান্তরে যাইবার কারণ। আর মহারাজ যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে সমস্ত পৃথিবীর রাজন্যবর্গকে নিমন্ত্রণ করিবার জন্য ভীম, অর্জুন, নকুল ও সহদেব চতুর্দিকে গমন করিয়াছিলেন। তাহাতে দোষ মনে করিলে তাহারা কখনও যাইতেন না। পূর্বে আৰ্য্যাবৰ্ত্তৰ্বাসিগণ ব্যবসায়, রাজকার্য্যে এবং ভ্রমণ উপলক্ষ্যে সমস্ত পৃথিবী পরিভ্রমণ করিতেন। আজকাল যে স্পর্শদোষ ও ধর্মনাশের উদ্ভব হইয়াছে, মূর্খদিগের ভ্রম এবং অজ্ঞানতাবৃদ্ধিই তাঁহার মূল।

কারণ যাহারা দেশ দেশান্তরে গমন করিতে শঙ্কা বোধ করেন না, তাঁহারা নানা দেশে নানা জনসংসর্গে আসিয়া ও নানাবিধ রীতি-নীতি দেখিয়া স্বরাজ্য বিস্তার করেন এবং নির্ভীক শৌর্যবীৰ্য্যশালী হইয়া উত্তম রীতি নীতি গ্রহণ ও দুর্নীতিবর্জনে তৎপর হইয়া মহান ঐশ্বৰ্য্য লাভ করেন। ভ্রষ্টাচারিণী ম্লেচ্ছকুলোৎপন্না বেশ্যাদি সমাগমেও যাহাদের আচার ধর্মভ্রষ্ট হয় না, তাহারাই দেশ দেশান্তরে সৎ পুরুষদের সংসর্গে স্পর্শদোষ ঘটে বলিয়া মনে করেন। ইহা কেবল মুর্খতা নহে ত কী?

অবশ্য এইটা কারণ আছে যে, যাহারা মাংস ভক্ষণ এবং মদ্যপান করে তাহাদের শরীর এবং বীৰ্য্যাদি ধাতুও দুর্গন্ধাদি দোষে দূষিত হয়। এই জন্য তাহাদের সংসর্গ করিলে আৰ্যদিগের মধ্যেও ওই দোষ ঘটিতে পারে, ইহা যথার্থ বটে। কিন্তু তাহাদের সহিত মেলামেশায় ও তাহাদের গুণগ্রহণে কোন দোষ অথবা পাপ হয় না,তখন তাহাদের মদ্যপানাদি দোষ বর্জন পূর্বক তাহাদের গুণগ্রহণ। করিতে কোন ক্ষতি নাই। মুখেরা তাহাদিগকে স্পর্শ এবং দর্শন করাও পাপ মনে করে। তজ্জন্য ইহারা তাহাদের সহিত যুদ্ধ কখনও করিতে পারিবে না, কেননা যুদ্ধ করিতে হইলে দেখা এবং স্পর্শ করা আবশ্যক হয়।

রাগ-দ্বেষ অন্যায় এবং মিথ্যাভাষণাদি দোষ বৰ্জন করিয়া নির্বৈরভাব, প্রীতি, পরোপকার । এবং সৌজন্য প্রভৃতি অবলম্বন করাই সজ্জনদিগের পক্ষে উত্তম ‘আচার’। ইহাও জানা আবশ্যক। যে, ধর্ম আমাদের আত্মা ও কর্তব্যের সহিত সম্বন্ধযুক্ত। যদি আমরা উত্তম কর্ম করি, তবে আমাদের দেশে-দেশান্তর এবং দ্বীপ-দ্বীপান্তরে গমনে কোন দোষ স্পর্শ করিতে পারে না। দোষ কেবল। পাপকর্মেই ঘটিয়া থাকে। হ্যাঁ, বেদোক্ত ধর্মের প্রতিপাদন এবং অসত্য মতের খণ্ডন অবশ্যই শিক্ষা। করিতে হইবে, যেন কেহ আমাদের মধ্যে মিথ্যা প্রতীতি জন্মাইতে না পারে। দেশ-দেশান্তর ও দ্বীপ-দ্বীপান্তরে রাজত্ব অথবা বাণিজ্য করা ব্যতীত কখনও কি স্বদেশের উন্নতি হইতে পারে? যদি কোনো দেশের অধিবাসীগণ কেবল স্বদেশেই বাণিজ্য করে এবং বিদেশীয়গণ তাহাদের দেশে আসিয়া বাণিজ্য ও রাজত্ব করে তবে সে দেশে দারিদ্র্য ও দুঃখ ব্যতীত অন্য কিছুই হইতে পারে না।

ভণ্ড ও ধূর্তগণ জানে যে, জনসাধারণকে বিদ্যাশিক্ষা ও দেশ-দেশান্তর গমনের অনুমতি দেওয়া হইলে তাহারা বুদ্ধিমান হইয়া উঠিবে এবং প্রতারণার জালে পতিত হইবে না। তাহাদের মর্যাদা ও জীবিকা নষ্ট হইবে। এইজন্য তাহারা গ্রাসাচ্ছাদন সম্বন্ধে গোলোযোগ বাধাইয়া থাকে, যেন কেহ বিদেশে যাইতে না পারে। অবশ্য এইরূপ ব্যবস্থা হওয়া উচিত যে, কেহ যেন কখনও ভ্রমক্রমেও মদ্যমাংস গ্রহণ না করে।

যাঁহারা বুদ্ধিমান তাঁহারা কি নিশ্চিতরূপে জানেন না যে, যুদ্ধকালে রাজপুরুষদিগের মধ্যে ‘চৌকা’ (প্রত্যেক ব্যক্তির পৃথক পৃথক্‌ সীমাবদ্ধ ভোজন-স্থান) রচনা করিয়া পৃথক্‌রন্ধন ও ভোজন। ব্যবস্থা করা অবশ্যই পরাজয়ের হেতু? কিন্তু এক হস্তে ভোজন ও জলপান করিতে থাকা, আর । হস্তী অথবা রথের উপর আরোহণ বা পদব্রজে গমন করিয়া অন্য হস্তে শক্র বিনাশ করিতে করিতে বিজয়লাভ করাই ক্ষত্রিয়দিগের পক্ষে ‘আচার’ এবং পরাজিত হওয়াই ‘অনাচার’।;

মূঢ়তাবশতঃ এই সকল লোক ‘চৌকা’ লাগাইয়া ও পরস্পর বিরোধ করিয়া, অপরের সহিত বিরোধ বাঁধাইয়া সর্বপ্রকার স্বাধীনতা, আনন্দ, ধন, রাজা, বিদ্যা ও পুরুষকারের উপর ‘চৌকা’ রচনা করিয়া নিশ্চেষ্ট ভাবে বসিয়া ইচ্ছা করিতেছে যে, ‘যদি কিছু আহাৰ্য্য পাওয়া যায়, তবে রন্ধন করিয়া ভোজন করিব’ কিন্তু তাহা হয় না। এইরূপে তাহারা সমস্ত আৰ্য্যাবর্তকে ‘চৌকায় পরিণত করিয়া সর্বনাশ করিয়াছে।

অবশ্য ভোজনের স্থান ধোয়া, মোছা ও পরিষ্কার করিয়া আবর্জনা দূর করা বিষয়ে যত্নবান হওয়া কর্তব্য। মুসলমান এবং খ্রীষ্টানদিগের ন্যায় কদৰ্য্য পাকশালা রাখা উচিত নহে;

প্রশ্ন –সখরী ও নিখরী কাহাকে বলে?

উত্তর –জলাদিতে অন্ন পাক হইলে ‘সখরী’ হয়, আর ঘৃত ও দুগ্ধে পাক করা হইলে ‘নিখরী’ অর্থাৎ চোখী (শুদ্ধ ও উত্তম) হয়। ইহাও ধূর্তদিগের প্রচলিত ছলচাতুরী মাত্র। কারণ অধিক ঘৃত ও দুগ্ধ মিশ্রিত বস্তু খাইতে সুস্বাদু এবং অধিক মাত্রায় স্নেহজাতীয় পদার্থ উদরে দিবার জন্য তাহারা এই প্রপঞ্চ রচনা করিয়াছে। অগ্নিতে অথবা কালক্রমে পক্ক বস্তুতে ‘পাকা’ এবং যাহা রন্ধন করা হয় না তাহাকে কাঁচা’ বলে। পভোজ্য, আর অপক্ক অভোজ্য–এইরূপ সাধারণ নিয়ম চলে না। কারণ ছোলা প্রভৃতি কঁচাও আহার করা হইয়া থাকে।

প্রশ্ন –দ্বিজগণ স্বহস্তে পাক করিয়া খাইবেন, না–শূদ্রের হস্ত পাক করাইয়া ভোজন করিবেন?

উত্তর –শুদ্রের হস্তে প্রস্তুত অন্ন ভোজন করিবেন। কারণ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যবর্ণের নরনারী বিদ্যাধ্যয়ন, রাজ্যপালন, পশুপালন, কৃষি এবং বাণিজ্যে তৎপর থাকিবেন। শূদ্রের পাত্রে বা তাহার গৃহে পক্ক অন্ন আপৎকাল ব্যতীত ভোজন করিবে না। প্রমাণ শুনুন–

আয়াধিষ্ঠিতা বা শূদ্রাঃ সংস্কর্তারঃ স্যুঃ ॥ ইহা আপস্তম্ব সূত্র।

আৰ্যদের গৃহে শূদ্র’অর্থাৎ মুখ স্ত্রীপুরুষেরা রন্ধন প্রভৃতি সেবাকাৰ্য্য করিবে। কিন্তু তাহাদের শরীর ও বস্ত্রাদি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা আবশ্যক। আর্যদের গৃহে রন্ধন করিবার সময় মুখে কাপড় বাঁধিয়া রন্ধন করিবে। যেন মুখ হইতে উচ্ছিষ্ট এবং নির্গত প্রশ্বাস অন্নে না পড়ে। প্রত্যেক অষ্টম দিবসে ক্ষৌর কর্ম ও নখচ্ছেদন করাইবে।(প্রতিদিন) স্নান করিয়া রন্ধন করিবে। আৰ্যদের সকলকে ভোজন করাইবার পর নিজে ভোজন করিবে।

প্রশ্ন– যখন শূদ্রসৃষ্ট অন্নভোজনও দোষজনক তখন তাহার হস্তে পক্ক অন্ন কীরূপে ভোজন করা যাইতে পারে?

উত্তর –ইহাও কপোল কল্পিত মিথ্যা কথা। কেননা, যিনি গুড়, চিনি, ঘৃত, দুগ্ধ, আটা, শাক এবং ফলমূল ভোজন করিয়াছেন তিনি জগতের সমস্ত লোকের হস্তে প্রস্তুত খাদ্য ও উচ্ছিষ্ট ভোজন করিয়াছেন জানিবেন। কারণ, যখন শূদ্র, চামার (চর্মকার) মেথর, মুসলমান এবং খৃষ্টান প্রভৃতি ভূমি হইতে ইক্ষু কাটে, ছাড়ায় এবং পেষন করিয়া রস বাহির করে, তখন মল-মূত্র পরিত্যাগ করিবার পর হাত না ধুইয়াই উহা স্পর্শ করে ও পাত্র বাহির করে এবং ধরে। এবং ইক্ষুদণ্ড অর্ধেক চুষিয়া রস পান করিয়া বাকী অর্ধেক তন্মধ্যে নিক্ষেপও করে। রস পাক করিবার সময় ঐ রসে রুটিও সিদ্ধ করিয়া ভোজন করে।

চিনি প্রস্তুত করিবার সময় পুরাতন জুতা দ্বারা উহা ঘর্ষণ করে। সেই জুতোর তলায় মল-মূত্র গোবর এবং ধূলা লাগিয়া থাকে। তাহারা দুগ্ধের মধ্যে তাহাদের গৃহের উচ্ছিষ্ট পাত্রের জল ঢালে, সেই উচ্ছিষ্ট পাত্রে ঘৃতাদি রাখে; আটা পিষিবার সময় সেইরূপ উচ্ছিষ্ট হস্তে উত্তোলন করে। তখন আটায় ঘর্ম বিন্দু পড়িতে থাকে ইত্যাদি। ফল-মূল কন্দেও ঐরূপ লীলা হইয়া থাকে। এই সকল সামগ্রী ভোজন করা হইলে, সকলের হস্তের অন্ন ভোজন করা হয়।

প্রশ্ন –ফল-মূল-কন্দ-রস প্রভৃতি অদৃষ্ট বস্তুতে দোষ মনে করি না।

উত্তর –তবে কোন মেথর অথবা মুসলমান অন্য স্থানে স্বহস্তে কোন খাদ্য প্রস্তুত করিয়া আনিয়া দিলে ভোজন করিবে কি না? যদি বল “না”, তবে অদৃষ্টে দোষ আছে। অবশ্য মুসলমান, খৃষ্টান প্রভৃতি মাংসাহারী ও মদ্যপায়ীদের হস্তে প্রস্তুত অন্নভোজনে আর্যদের মদ্যপান ও মাংসাহারের অপরাধ হইতে পারে। কিন্তু আৰ্যদের পরস্পরের মধ্যে একরূপ ভোজন হওয়া বিষয়ে কোন দোষ দৃষ্ট হয় না। যতদিন পরস্পরের মধ্যে এক মত, এক লাভ-ক্ষতি এক সুখ-দুঃখ বোধ না হইবে ততদিন পর্যন্ত উন্নতি হওয়া সুকঠিন। তবে কেবল একরূপ খাদ্য পানীয় হইলেই উন্নতি হইতে পারে না। যতদিন কুকর্ম পরিত্যাগ ও সৎকর্ম গ্রহণ না করা হয় ততদিন উন্নতির পরিবর্তে অনিষ্ট হইয়া থাকে।

আৰ্যদের পরস্পরের মধ্যে অনৈক্য, মতভেদ, ব্রহ্মচর্য ও পঠনপাঠনে অভাব, বাল্যকালে অস্বয়ংবর বিবাহ, বিষয়াসক্তি, মিথ্যাভাষণ প্রভৃতি দোষ এবং বেদ-বিদ্যা প্রচারের অভাব ইত্যাদি কুকর্ম আর্যাবর্তে বিদেশীয় রাজত্বের কারণ। যখন ভাই ভাই পরস্পরের মধ্যে কলহ বিবাদে লিপ্ত থাকে,তখনই তৃতীয় পক্ষ বিদেশী আসিয়া মোড়ল হইয়া বসে ॥

পাঁচ সহস্র বৎসর পূর্বে মহাভারতের যে ঘটনা তাহা কি তোমরা ভুলিয়া গিয়াছ? দেখ! মহাভারতের যুদ্ধে সকলে যুদ্ধস্থলে বাহনের উপর থাকিয়াই পান-ভোজন করিতেন। পরস্পরের মধ্যে অনৈক্যবশতঃ কুরু-পাণ্ডব এবং যাদবদিগের সর্বনাশ ঘটিয়াছিল। কিন্তু এখনও সেই রোগ পিছনে লাগিয়াই আছে। জানিনা, এইভীষণ রাক্ষস কখনও ছাড়িয়া যাইবে কিনা? অথবা ‘আৰ্যদিগকে

সর্বসুখে বঞ্চিত করিয়া দুঃখ সাগরে ডুবাইয়া মারিবে। আৰ্য্যগণ আজ পর্যন্তও সেই জাতিহন্তা, স্বদেশনাশক, নীচ দুর্যোধনের দুষ্টমার্গের অনুসরণ করিয়া দুঃখ বৃদ্ধি করিতেছে। পরমেশ্বর কৃপা করুণ যেন আৰ্য্যদিগের এই রাজরোগ বিনষ্ট হয়।

ভক্ষাভক্ষ্য দ্বিবিধ। প্রথম–ধর্মোশাস্ত্রোক্ত, দ্বিতীয়–চিকিৎসা শাস্ত্রোক্ত। ধর্ম শাস্ত্রোক্ত, যথাঃ

অভ্যাণি দ্বিজাতীনামমেধ্য প্রভবাণি চ ॥ মনু দ্বিজ অর্থাৎ ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ এবং শুদ্রদেরকেও অপবিত্র ও মল-মুত্রাদির সংসর্গজাত শাক, ফলমূল ভোজন করা উচিত নহে ॥

বর্জয়েন্মধুমাংসং চ ॥ মনু

মদ্য, গঞ্জিকা, সিদ্ধি এবং অহিফেন প্রভৃতি বিবিধ মাদক দ্রব্য পরিত্যাজ্য।

বুদ্ধিং লুম্পতি য়দ্রব্যং মদকারী তদুচ্যতে ॥

বুদ্ধিনাশক দ্রব্য কখনও সেবন করিবে না। পচা, বিকৃত, দুষিত, কুপক্ক এবং মদ্যমাংসাহারী শ্লেচ্ছদিগের হস্তে প্রস্তুত অন্ন ভোজন করিবে না। কারণ তাহাদের শরীর মদ্য মাংসের পরমাণুতে পরিপূর্ণ।

উপকারক প্রাণীর হিংসা অর্থাৎ যেরূপ একটি গাভীর শরীর হইতে দুগ্ধ, ঘৃত, বৃষ এবং অন্য গাভী উৎপন্ন হওয়ায় এক পুরুষে চারি লক্ষ পঁচাত্তর সহস্র ছয় শত মানুষকে সুখ দেয়, এরূপ পশুকে হত্যা করিবে না এবং হত্যা করি তে দিবে না। যদি কোন একটি গাভী হইতে প্রতিদিন কুড়ি সের এবং অন্য একটি গাভী হইতে দুই সের দুধ পাওয়া যায়, তবে প্রত্যেকটি গাভী হইতে প্রতিদিন গড়ে এগার সের দুগ্ধ হয়। কোন কোন গাভী ১৮ মাস এবং কোন কোন গাভী ছয় মাস পর্যন্ত দুগ্ধ দেয়, তাহাতে গড়ে বার মাস হয়। সুতরাং প্রত্যেক গাভীর আজীবন দুগ্ধ দ্বারা ২৪,৯৬০ জন (চব্বিশ সহস্র নয় শত ষাট) মনুষ্য একেবারে তৃপ্ত হইতে পারে। যদি এক একটি গাভীর ছয়-ছয়টি করিয়া বৎস ও বৎসা হইয়া থাকে এবং যদি দুইটি মরিয়াও যায়, দশটি অবশিষ্ট থাকে। তন্মধ্যে পাঁচটি গাভীর সারাজীবনের দুগ্ধ একত্রে করিলে, ১,২৪,৮০০ (এক লক্ষ চব্বিশ হাজার, আট শত) মনুষ্য তৃপ্ত হইতে পারে। অবশিষ্ট পাঁচটি বৃষ সমস্ত জীবনে ন্যূনপক্ষে ৫০০০ (পাঁচ হাজার) মণ অন্ন উৎপন্ন করিতে পারে। যদি তাহা হইতে প্রত্যেক মনুষ্য তিন পোয়া করিয়া অন্ন ভোজন করে, তবে আড়াই লক্ষ মানুষ্যের তৃপ্তি হয়। সুতরাং দুগ্ধ এবং অন্ন একত্র করিলে ৩,৭৪৮০০ (তিন লক্ষ চুয়াত্তর হাজার আট শত) মনুষ্যের তৃপ্তি হয়। উভয় সংখ্যা একত্র করিলে একটি গাভীর দ্বারা উহার এক জীবনে ৪,৭৫,৬০০ (চারি লক্ষ পঁচাত্তর হাজার ছয় শত) মনুষ্য একেবারে পালিত হয়। যদি বংশানুবংশের বৃদ্ধি হিসাবে গণনা করা হয়, তাহা হইলে অসংখ্য মনুষ্যের পালন হয়। এতদ্ব্যতীত বৃষ গাড়ী টানে, বাহন এবং ভারবাহন প্রভৃতি কাৰ্য্য করে। তদ্বারা মনুষ্যের অনেক উপকার হয়। বিশেষত গোদুগ্ধ অধিক উপকারী। বৃষের ন্যায় মহিষও উপকারী; কিন্তু গোদুগ্ধ এবং গব্য ঘৃত দ্বারা বুদ্ধি বৃদ্ধি হওয়াতে যত লাভ হয়, মহিষের দুগ্ধ হইতে তত হয় না। এইজন্য আৰ্য্যগণ গাভীকে সর্বাপেক্ষা অধিক হিতকারী গণনা করিয়াছেন। অন্য বিদ্বান্ ব্যক্তি ও এইরূপ জানিবেন।

ছাগদুগ্ধ দ্বারা ২৫,৯২০ (পঁচিশ হাজার নয়শত কুড়ি) মনুষ্যের পালন হয়। সেইরূপ হস্তী, অশ্ব, উষ্ট্র, মেষ এবং গর্দভ প্রভৃতি পশু দ্বারা মহোপকার হইয়া থাকে। যাহারা এই সকল পশুকে হত্যা করে, তাহাদিগকে নরহত্যাকারী বলিয়া জানিবে।

দেখ! আৰ্যদিগের রাজত্বকালে এই সকল মহোপকারী গবাদি পশুকে হত্যা করা হইত না। সে সময়ে আর্যাবর্তে এবং পৃথিবীর অন্যান্য দেশে মনুষ্যাদি সকল প্রাণী আনন্দে বাস করিত। কারণ দুগ্ধ, ঘৃত এবং বৃষ প্রভৃতি পশুর আধিক্য বশতঃ প্রচুর অন্ন ও দুগ্ধ পাওয়া যাইত। যখন মাংসাহারী, মদ্যপায়ী এবং গবাদিপশুর হত্যাকারী বিদেশীয় রাজ্যাধিকারী হইল, তখন হইতে আৰ্যদিগের ক্রমশঃ দুঃখ বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। কারণ–

নষ্টেমূলে নৈব ফলংন পুষ্পম॥ বৃদ্ধচাণক্য।

যখন বৃক্ষের মূলই কর্তিত হয় তখন ফুল-ফল কোথা হইতে আসিবে?

প্রশ্ন –সকলেই অহিংসক হইলে ব্যাঘ্রাদি পশু এতই বৃদ্ধি পাইবে যে, তাহারা গবাদি পশুকে হত্যা করিয়া ভক্ষণ করিবে এবং তোমাদের পুরুষকার ব্যর্থ হইবে।

উত্তর –অনিষ্টকারী পশু ও মনুষ্যদিগকে দণ্ডদান করা এবং বধ করা রাজপুরুষের কর্তব্য।

প্রশ্ন –তবে কি এ সকল পশুর মাংস ফেলিয়া দিবে?

উত্তর –ইচ্ছা হয় ফেলিয়া দিবে, কুকুরাদি মাংসাহারী পশুদের সকলকে ভক্ষণ করাইবে, জ্বালাইয়া দিবে অথবা কোন মাংসাহারীকে ভোজন করাইবে। তাহাতে সংসারের কিছুমাত্র ক্ষতি হইবে না, কিন্তু সেই মাংসাহারী মনুষ্যের স্বভাব হিংস্র হইতে পারে।

যে সকল ভোজ্য বস্তু হিংসা,চৌর্য্য, বিশ্বাসঘাতকতা এবং ছল-শঠতাদি দ্বারা প্রাপ্ত হওয়া যায়, তাহা ‘অভক্ষ্য এবং যাহা অহিংসা ধর্ম প্রভৃতি কর্মাদি দ্বারা প্রাপ্ত হওয়া যায়, তাহাই ‘ভক্ষ্য। যে সকল বস্তু দ্বারা স্বাস্থ্যলাভ, রোগনাশ, বুদ্ধি-বল-পরাক্রম এবং আয়ু বৃদ্ধি পায় হয়, সেই তণ্ডুল, গোধূম, ফল-মূল-কন্দ-ঘৃত-দুগ্ধ-মিষ্টান্ন ইত্যাদি যথোচিত ভাবে পাক ও মিশ্রিত করিয়া যথাসময়ে পরিমিত ভোজন করাকে ‘ভক্ষ্য’ বলে। আর যে সকল পদার্থ নিজ প্রকৃতি বিরুদ্ধ ও বিকার। উৎপাদনকারী, সেই সকল সর্বদা পরিত্যাগ করিবে। যাহার পক্ষে যে বস্তু বিহিত সেই পদার্থ গ্রহণ করাও ‘ভক্ষ্য’।

প্রশ্ন— এক সঙ্গে ভোজনে কি কোন দোষ আছে?

উত্তর –দোষ আছে। কারণ একজনের সহিত অপর জনের স্বভাব ও প্রকৃতির মিল হয় না। কুষ্ঠরোগীর সহিত ভোজনে সুস্থ ব্যক্তির শোণিতও বিকৃত হয়। সেইরূপ অন্য লোকের সহিত ভোজন করিলেও শোণিতে কিছু না কিছু বিকৃতি ঘটে, সংশোধন হয় না।

এইজন্যঃ—-

নোচ্ছিষ্টংকস্যচিদদ্যানুদ্যাচ্চৈব তথান্তরা। ন চৈবাত্যশনং কুয়ান্নচোচ্ছিষ্টঃ চিজেৎ ॥ মনু।

কাহাকেও নিজের উচ্ছিষ্ট দিবে না। কাহারও সহিত এক পাত্রে ভোজন করিবে না। অধিক ভোজন করিবে না। ভোজনের পর মুখ হাত না ধুইয়া ইতস্ততঃ যাতায়াত করিবে না।

প্রশ্ন –তাহা হইলে “গুরোরুচ্ছিষ্ট ভোজন” এই বাক্যের কী অর্থ হইবে?

উত্তর –উক্ত বাক্যের অর্থ এই যে, গুরুর ভোজনের পর পৃথক্‌ রক্ষিত শুদ্ধ অন্ন ভোজন। করিবে। অর্থাৎ গুরুকে ভোজন করাইবার পর শিষ্যের ভোজন করা উচিত।

প্রশ্ন –যদি উচ্ছিষ্ট মাত্রই নিষিদ্ধ হইল, তবে মধুমক্ষিকার উচ্ছিষ্ট মধু, গোবৎসের উচ্ছিষ্ট দুগ্ধ, নিজের একগ্লাস ভোজনের পর নিজের যে উচ্ছিষ্ট তাহাও ভোজন করা উচিত নহে।

উত্তর –মধু নামে উচ্ছিষ্ট মাত্র। উহা অনেক ঔষধির সার হইতে গৃহীত হয়। গোবৎস উহার মাতার নিঃসৃত দুগ্ধ বাহির হইতে পান করে, ভিতরের দুগ্ধ পান করিতে পারে না, সুতরাং উহা উচ্ছিষ্ট নহে। গোবৎসরের দুগ্ধ পানের পর জল দ্বারা উহার মাতার স্তন প্রক্ষালন করিয়া শুদ্ধ পাত্রে দুগ্ধ দোহন করা উচিত। নিজের উচ্ছিষ্ট নিজের পক্ষে বিকারজনক হয় না।

দেখ! ইহা স্বাভাবিক যে, কাহারও উচ্ছিষ্ট কেহ ভোজন করিবে না। নিজের মুখ, নাসিকা, কর্ণ, চক্ষু, উপস্থ এবং গুহ্যেন্দ্রিয়ের মলমূত্রাদি স্পর্শে ঘৃণা হয় না, কিন্তু অপরের মলমূত্র স্পর্শ করিতে ঘৃণা হয়। এতদ্বারা সিদ্ধ হইতেছে যে, এই ব্যবহার সৃষ্টিক্রমের ব্যতিক্রম নহে। অতএব মনুষ্য মাত্রেই কেহ কাহারও উচ্ছিষ্ট বা ভুক্তাবশেষ ভোজন করিবে না।

প্রশ্ন –ভাল, স্বামী স্ত্রীরও কি পরস্পরের উচ্ছিষ্ট ভোজন করা উচিত নহে?

উত্তর –না। কারণ তাহাদেরও শরীর ভিন্ন প্রকৃতির।

প্রশ্ন –বলুন মহাশয়! মনুষ্যমাত্রেরই হস্তপক্ক দ্রব্য ভোজনে দোষ কী? ব্রাহ্মণ হইতে আরম্ভ করিয়া চণ্ডাল পৰ্য্যন্ত সকলের শরীর অস্থি, মাংস ও চর্মনির্মিত। ব্রাহ্মণের শরীরে যেরূপ শোণিত আছে, সেইরূপ চণ্ডালাদির শরীরেও শোণিত আছে। তবে মনুষ্যমাত্রেরই হস্তপক্ক অন্ন ভোজনে দোষ কী?

উত্তর –দোষ আছে। কারণ যে সকল উত্তম সামগ্রী ভোজন ও পান দ্বারা ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণীর শরীরে দুর্গান্ধাদি দোষ বিহীন রজো-বীৰ্য্য উৎপন্ন হয় চণ্ডাল ও চণ্ডালীর শরীরে সেরূপ হয় না। তাহাদের শরীর যেমন দুর্গন্ধের পরমাণুতে পূর্ণ থাকে ব্রাহ্মণাদির বর্ণের সেরূপ থাকে না। এইজন্য ব্রাহ্মণাদি উত্তম বর্ণের হস্তে ভোজন করিবে। চণ্ডাল, মেথর, চামার প্রভৃতি নিম্নস্তরের লোকদিগের হস্তে ভোজন করিবে না। ভাল, যদি কেহ তোমাকে জিজ্ঞাসা করে যে, মাতা, শ্বশ্র, ভগ্নী, কন্যা এবং পুত্রবধূ প্রভৃতির শরীর যেরূপ চর্ম নির্মিত, তোমার স্ত্রীরও সেইরূপ। তবে কি তুমি মাতা এবং অন্যান্য স্ত্রীলোকের সহিতও নিজ স্ত্রীর ন্যায় ব্যবহার করিবে, তখন তোমাকে সঙ্কুচিত হইয়া চুপ করিয়া থাকিতেই হইবে। যেরূপ উত্তম হস্ত ও মুখ দ্বারা ভোজন করা হয়, সেইরূপ যদি দুর্গন্ধ অন্নও ভোজন করা যাইতে পারে, তবে কি মলাদিও ভক্ষণ করিবে? তাহাও কি হইতে পারে?;

প্রশ্ন –যদি গোময় দ্বারা আহারস্থান লেপন করা হয়, তবে নিজের মল দ্বারা তাহা করা হইবে না কেন? আর গোময় লেপনে রন্ধনশালা অপবিত্র হয় না কেন?

উত্তর –মনুষ্যের মলে যেরূপ দুর্গন্ধ আছে, গোময়ে সেইরূপ নাই। গোময় মসৃণ বলিয়া শীঘ্র উঠিয়া যায় না। তাহাতে বস্ত্র বিকৃত বা মলিন হয় না। মৃত্তিকা হইতে যেরূপ ময়লা জন্মে, শুষ্ক গোময় হইতে সেরূপ জন্মে না। মৃত্তিকা ও গোময় দ্বারা যে স্থান লেপন করা হয়, তাহা দেখিতে অতি সুন্দর। রন্ধনশালায় ভোজন করিলে ঘৃত, মিষ্ট এবং উচ্ছিষ্ট পড়িয়া থাকে। তাহাতে মক্ষিকা, কীট এবং অন্যান্য অনেক জীব অপরিষ্কৃত স্থান হইতে আসিয়া বসে। প্রতিদিন ঝাড়ু দিয়া সে স্থান পরিষ্কার করিয়া লোপন করা না হইলে উহা পায়খানার ন্যায় হইয়া উঠিবে। অতএব প্রত্যহ গোময়, মৃত্তিকা এবং সম্মার্জনী দ্বারা উক্ত স্থান পরিষ্কার রাখিবে। পাকা বাড়ী হইলে জল দ্বারা ধুইয়া শুদ্ধ করিয়া রাখিবে। তাহাতে পূর্বোক্ত দোষসমূহের নিবৃত্তি হয়।

মিঞসাহেবদের রন্ধনশালা দেখা যায়, কোথায়ও কয়লা, কোথায়ও ছাই, কোথায়ও কাষ্ঠ, কোথায়ও ভগ্ন মৃৎপাত্র, কোথায়ও উচ্ছিষ্ট রেকাব এবং কোথায়ও বা হাড় ও অন্যান্য পদার্থ পড়িয়া থাকে। মক্ষিকার ত কথাই নাই। স্থানটি এমন জঘন্য মনে হয় যে, কোন ভদ্রলোক যাইয়া সে স্থানে বসিলে তাহার বমন হইবার উপক্রম হয় এবং স্থানটি পূর্বোক্ত দুর্গন্ধময় স্থানের ন্যায় দেখায়। ভাল, যদি কেহ ইহাদিগকে জিজ্ঞাসা করে, যদি গোময় দ্বারা লেপন করাকে দোষজনক মনে কর, তবে চুল্লীতে ঘুঁটে পুড়াইয়া সেই অগ্নিতে তামাক খাইলে এবং গৃহের প্রাচীরে লেপন করিলে সম্ভবতঃ মিঞা সাহেবদের রন্ধন ও ভোজনশালা অপবিত্র হইয়া যাইবে। ইহাতে সন্দেহ আছে কি?

প্রশ্ন –রান্নাঘরে বসিয়া ভোজন করা উচিত, –না রান্নাঘরের বাহিরে ভোজন করা উচিত?

উত্তর –উত্তম ও রমণীয় স্থানে ভোজন করা উচিত। কিন্তু যুদ্ধাদি স্থলে ও অন্যান্য যানবাহনের উপর বসিয়া ও দাঁড়াইয়াও পান-ভোজন করা অত্যন্ত আবশ্যক।

প্রশ্ন –কেবল স্বপাক অন্নই কি ভোজন করা উচিত? অন্যের দ্বারা রন্ধিত অন্ন ভোজন করা কি উচিত নহে?

উত্তর –আৰ্যদিগের দ্বারা শুদ্ধ রীতি অনুসারে রন্ধিত অন্ন আৰ্য্যদের সহিত ভোজন করিতে কোন দোষ নাই। কারণ ব্রাহ্মণবর্ণের স্ত্রী পুরুষেরা রন্ধন, লেপন এবং পাত্র মার্জন প্রভৃতি কাৰ্য্যে সময় নষ্ট করিতে থাকিলে বিদ্যোন্নতি এবং অন্যান্য শুভগুণের বৃদ্ধি কখনও হইতে পারে না।

মহারাজ যুধিষ্ঠিরদের রাজসূয় যজ্ঞে পৃথিবীর রাজন্যবর্গ ও ঋষি-মহর্ষিগণ আগমন করিয়াছিলেন। তাহারা সকলেই একই রন্ধনশালা হইতে ভোজন করিয়াছিলেন। যখন খ্রীষ্টান, মুসলমান প্রভৃতি মতমতান্তর প্রচলিত হইল, তখন হইতে আৰ্যদের মধ্যে বৈরভাব ও বিরোধ হইতে লাগিল। তাহারই মদ্যপান এবং গোমাংস প্রভৃতি ভোজন করিতে স্বীকার করিল। সেই সময় হইতে ভোজনাদিতে গোলযোগ উপস্থিত হইল।

দেখ! আৰ্য্যাবৰ্ত্তদেশীয় নৃপতিগণ কাবুল, কান্দাহার, ইরাণ, আমেরিকা এবং ইউরোপ প্রভৃতি। দেশের রাজকন্যা গান্ধারী, মাদ্রী এবং উলোপী প্রভৃতির সহিত বৈবাহিক সম্বন্ধ করিয়াছিলেন। শকুনি প্রভৃতি কৌরব ও পান্ডবদিগের সহিত পান ভোজন করিতেন। তাঁহাদের মধ্যে কোন প্রকার বিরোধ ছিল না। কারণ সেই সময়ে সমস্ত পৃথিবীতে কেবল বেদোক্ত একই মত প্রচলিত ছিল। এবং তাহাতেই সকলের নিষ্ঠা ছিল। সকলেই পরস্পরের সুখ-দুঃখ লাভ ক্ষতি নিজের মনে। করিতেন। তখনই পৃথিবীতে সুখ ছিল। এখন অনেক ভিন্ন ভিন্ন মতাবলম্বী হওয়াতে দুঃখ ও বিরোধ বৃদ্ধি পাইতেছে। ইহার নিবারণ করা বুদ্ধিমান্ ব্যক্তিদের কর্তব্য।

পরমাত্মা সকলের মনে সত্য মতের এমন অঙ্কুর রোপণ করুন, যেন মিথ্যা মত সমূহ শীঘ্রই বিলুপ্ত হয়, যাহাতে বিদ্বন্মণ্ডলী বিচার পূর্বক বিরুদ্ধ ভাব পরিত্যাগ করতঃ অবিরুদ্ধমত স্বীকার করিয়া আনন্দ বৃদ্ধি করিতে পারেন।

আচার-অনাচার ও ভক্ষাভক্ষ্য বিষয়ে যৎকিঞ্চিৎ লিখিত হইল। এই গ্রন্থের পূর্বাৰ্দ্ধ এই দশম সমুল্লাসের সহিত সম্পূর্ণ হইল। এ সমস্ত সমুল্লাসে বিশেষ খণ্ডন-মণ্ডন লিখিত হয় নাই। ইহার কারণ এই যে, যতদিন মনুষ্য সত্যাসত্যের আলোচনায় কিঞ্চিৎ সামর্থ্য অর্জন করে না, ততদিন পৰ্য্যন্ত সে স্থূল ও সূক্ষ্ম খণ্ডনের অভিপ্রায় বুঝিতে পারে না। এইজন্য সকলকে সত্যাসত্য বিষয়ের উপদেশ দানের পর উত্তরার্ধে অর্থাৎ পরবর্তী চারি সমুল্লাসে বিশেষ খণ্ডন-মণ্ডন লিখিত হইবে। এই চারটি সমুল্লাসের মধ্যে প্রথম আৰ্য্যাবৰ্ত্তীয় মতমতান্তরের, দ্বিতীয়ে জৈন মতের, তৃতীয়ে খ্রীষ্টান মতের এবং চতুর্থে মুসলমান মতের খণ্ডন লিখিত হইবে। চতুর্দশ সমুল্লাসের অন্তে স্বমতও লিখিত হইবে। যদি কেহ বিশেষ খণ্ডন-মণ্ডন দেখিতে ইচ্ছা করেন তিনি এই চারটি দেখিয়া লইবেন। অবশ্য পূর্ববর্তী দশ সমুল্লাসেও স্থলবিশেষ সাধারণভাবে যৎকিঞ্চিৎ খণ্ডন-মণ্ডন। করা হইয়াছে।

যিনি পক্ষপাত পরিত্যাগ পূর্বক ন্যায়দৃষ্টি সহকারে চতুর্দশ সমুল্লাস গুলি পাঠ করিবেন, তাহার আত্মায় সত্যার্থের প্রকাশ হইবে এবং তদ্বারা তিনি আনন্দ অনুভব করিবেন। কিন্তু যিনি। হঠকারিতা, দুরাগ্রহ এবং অন্তরে ঈষা পোষণ করিয়া ইহা পাঠ ও শ্রবণ করিবেন তাঁহার পক্ষে উহার যথার্থ অভিপ্রায় জ্ঞাত হওয়া অত্যন্ত কঠিন। সুতরাং যিনি এই গ্রন্থ সম্বন্ধে যথোচিত বিচার করিবেন না, তিনি ইহার অভিপ্রায় বুঝিতে না পারিয়া হাবুডুবু খাইবেন। সত্যাসত্যের নির্ণয় করিয়া সত্যগ্রহণ ও অসত্য মার্জন পূর্বক পরমানন্দ লাভ করা বিদ্বান ব্যক্তিদের কর্তব্য। সেই সমস্ত গুণগ্রাহী পুরুষই বিদ্বান্ হইয়া ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষরূপ ফলপ্রাপ্ত হন ও আনন্দে থাকেন।

ইতি শ্রীমদ্দয়ানন্দ সরস্বতীস্বামীকৃতে সত্যার্থপ্রকাশে
সুভাষাবিভূষিতে আচারনাচার ভক্ষাভক্ষবিষয়ে
দশমঃ সমুল্লাসঃ সম্পূর্ণঃ ॥ ১০ ॥

সমাপ্তোভয়ংপূর্বাৰ্দ্ধঃ

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *