আগামী বৃহস্পতিবার তিথির বিয়ে।
মারুফ চাচ্ছিল উৎসব টুসব কিচ্ছু হবে না। উৎসবের কোন দরকার নেই অর্থহীন সামাজিকতা। জাফর সাহেব রাজি হন নি। তাঁর প্রথম মেয়ের বিয়ে। তিনি ক্যুনিটি সেন্টারে বিয়ের ব্যবস্থা করেছেন। বিয়ের কার্ড ছাপা হয়েছে একদিনে। কার্ডে তিথির নাম ভুল ছাপা হয়েছে তিথির জায়গায় তিতি। এ নিয়ে শায়লার সঙ্গে তাঁর একটা খণ্ড যুদ্ধ হয়ে গেল। যুদ্ধ শায়লা একাই করলেন, জাফর সাহেব যুদ্ধ শুরুর আগেই পরাজয় স্বীকার করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন।
নামের বানানেই ভুল। আসল জায়গাতেই গণ্ডগোল–এটা তোমার চোখে পড়ল না। এতগুলো টাকা খরচ করলে একটা ভুল কাজে?
ঠিক করে দেব।
কি ভাবে ঠিক করবে?
নুরুজ্জামান ঠিক করে দেবে বলেছে।
সে কি ভাবে ঠিক করবে?
জানি না। বলেছেতো ঠিক করে দেবে।
তিথির আনন্দ লাগছে এই কারণে যে বাবা-মার ঝগড়া নেই। তাঁদের দেখে মনে হচ্ছে না কোন কালে তাদের কোন সমস্যা ছিল। তিথি মাকে নিয়ে বাসায় ফিরে দেখে বাসা খালি। জাফর সাহেব খাবার টেবিলের উপর চিঠি রেখে গেছেন। চিঠিতে লেখা
শায়লা,
তুমি যেহেতু চাচ্ছ না আমি এ বাড়িতে থাকি সেহেতু চলে গেলাম। মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে প্রয়োজন মনে করলে আসব। আমার ঠিকানা হল–৩১ কলতা বাজার।
শায়লা তৎক্ষণাৎ স্বামীর ঘেঁজে গেলেন। তিথি সঙ্গে যেতে চাচ্ছিল, তাকে নিলেন না। ঠিকানা খুঁজে পেতে সমস্যা হতে পারে ভেবে নুরুজ্জামানকে সঙ্গে নিলেন। এবং ঘণ্টা খানিকের মধ্যে জাফর সাহেবকে নিয়ে ফিরে এলেন। তিথি তার ২৩ বছরের জীবনে বাবাকে এত আনন্দিত দেখেনি। অবশ্যি ক্রমাগত বাবাকে ধমকে যাচ্ছেন। কিন্তু জাফর সাহেব কিছুই গায়ে মাখছেন না। বরং তাঁর ভাব দেখে মনে হচ্ছে স্ত্রীর বকা খেতে তার খুব ভাল লাগছে।
সবচে বড় পরিবর্তন যা হয়েছে তা হল এ বাড়িতে নুরুজ্জামানের অবস্থান। শায়লা শুরু থেকেই তাকে এ বাড়ির একজন সদস্য হিসেবে নিয়েছেন। সেও ক্রমাগত বকা খাচ্ছে। কিছুক্ষণ আগেই তিথি শুনল মা নুরুজ্জামানকে বকছেন— বুঝলে নুরুজ্জামান, এই পৃথিবীতে তোমার মত এবং তিথির বাবার মত অপদার্থ আমি এখনো দেখিনি। তোমরা দুজনই একপদের। তোমাকে আমি কি বলেছিলাম? রেন্ট এ কার থেকে সারাদিনের জন্যে একটা গাড়ি ভাড়া করতে বলেছিলাম। দাওয়াতের চিঠি বিলি করতে হবে। গাড়ি ভাড়া করেছ?
জ্বি না।
কেন করনি জানতে পারি?
দাওয়াতের চিঠিতে বানান ভুল। এইগুলা ঠিক করে তারপর যাব।
সেই ঠিকতো তুমি সকাল থেকে করছ। কতক্ষণে শেষ হবে? হাসছ কেন? যখন তখন বোকার মত দাঁত বের করে হাসবে না।
জি আচ্ছা।
আমার সামনে থেকে যাও তো। গরমের মধ্যে এই হলুদ কোটটা গায়ে দিয়ে আছ কেন? এটা গা থেকে খোল। আর কোন দিন যেন এই যন্ত্রণা গায়ে না দেখি।
জি আচ্ছা।
নুরুজ্জামান গভীর মনোযোগে বানান ভুল ঠিক করছে। তাকে সাহায্য করছে মীরা এবং ইরা। প্রথমে হোয়াইট ইংক দিয়ে একটা ত মুছে ফেলা হচ্ছে। মীরা ও হরার দায়িত্ব হচ্ছে ফুঁ দিয়ে দিয়ে কালি শুকানো। কালি শুকানোর পর ত টাকে চায়নিজ ইংক দিয়ে থ করা হচ্ছে। এই কাজটি করছে নুরুজ্জামান। কাজটা খুব সাবধানে করতে হচ্ছে। যেন ছাপার অক্ষরের মত দেখা যায়। কালি লেপটে না যায়।
ইরা বলল, নুরুজ্জামান ভাই আপনি না থাকলে আমাদের কি যে সমস্যা হত। আপনি থাকায় মার রাগটা দুভাগ হয়ে বাবার এবং আপনার উপর পড়ছে। আপনি না থাকলে অর্ধেকটা রাগ আমার আর মীরার উপর পড়তো। বড় আপার উপরতে মা এখন রাগ করতে পারবে না। তার বিয়ে হচ্ছে। ঠিক বলছিনা নুরুজ্জামান ভাই?
নুরুজ্জামান বলল, কথা বলবে না কাজ কর।
জাফর সাহেব তিথির পাসপোর্ট নিয়ে এসেছেন। এখন ভিসার ব্যাপারটা ঠিক করতে পারলে তিথিকে মারুফের সঙ্গেই পাঠিয়ে দেয়া যায়। হাতে বেশ কিছু ডলার দিয়ে দিতে হবে। যাতে বিদেশের মাটিতে পা দিয়েই বিব্রত হতে না হয়। জাফর সাহেব প্রভিডেন্ট ফাণ্ড থেকে ডলার করার জন্যেই এক লাখ কুড়ি হাজার টাকা তুলেছেন। এতে প্রায় তিন হাজার ডলার হবে। এত ডলার কি ভাবে সঙ্গে দেয়া যায় সেও সমস্যা। মারুফের সঙ্গে ব্যাপারটা আলাপ করা দরকার। তাকে পাচ্ছেনও না। সেও বোধহয় ছুটোছুটির মধ্যে আছে।
মারুফের বাবার সঙ্গে তার এখনো কথা হয়নি। অথচ কথা বলা খুব দরকার। শুধু যে মারুফের বাবার সঙ্গেই কথা হয়নি তা না, তার আত্মীয় স্বজন কারোর সঙ্গেই কথা হয়নি।
গতকাল মারুফের দূর সম্পর্কের এক চাচা-চাচী এসেছিলেন দুজনই বেশি কথা বলেন। স্ত্রী কোন কথা বলতে গেলে স্বামী তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে কথা শুরু করেন। আবার স্বামী কিছু বলতে গেলে স্ত্রী আগ বাড়িয়ে তা বলে ফেলেন। তাদের সঙ্গে কাজের কথা কিছুই হয়নি। অথচ অনেক কিছু বলার আছে। মারুফের সঙ্গে সিটিং হওয়া দরকার। তাকে পাওয়াই যাচ্ছে না। নুরুজ্জামানকে দিয়ে তার ঘরে চিঠি লিখে ফেলে রাখা হয়েছে। চিঠিতে অবিলম্বে বাসায় এসে দেখা করতে বলা হয়েছে। তাতেও লাভ হচ্ছে না। সে আসছে না।
জাফর সাহেব ভেবে রেখেছেন গভীর রাতে নুরুজ্জামানকে নিয়ে একবার যাবেন। নুরুজ্জামানকেও পাওয়া যাচ্ছে না। সে চরকির মত ঘুরছে। একটা বিয়ে বাড়ির কাজতো অল্প না। হাজারো কাজ। মজার ব্যাপার হল জাফর সাহেব তেমন কোন কাজ পাচ্ছেন না। তিনি অফিস থেকে ছুটি নিয়ে ঘরে বসে আছেন। অথচ করার কিছু নেই। কমুনিটি সেন্টার ভাড়ার ব্যাপারটা নিজে করতে চেয়েছিলেন, শায়লা ধমক দিয়েছেন তুমি চুপ করে থাকতো। এসবের তুমি কি বোঝ?
বিয়ের ব্যাপারটা তিথির বন্ধু-বান্ধব বা আত্মীয় স্বজনরা এখনো কেউ জানেন। তিথি কাউকেই জানায়নি। মারুফের বিশেষ অনুরোধ ছিল যেন জানানো না হয়। মারুফের এ ব্যাপারটাও তিথি বুঝতে পারছে না। কেন কাউকে জানানো হবে না। বিয়ে নিশ্চয়ই কোন সামাজিক অপরাধ না যে কাউকে বলা যাবে না চুপি চুপি সারতে হবে। মারুফের যুক্তি হচ্ছে, বিয়ে শুধু মাত্র দুজনের ব্যাপার। এই দুজনের বাইরে কারোর কিছু নয়। কাজেই ঢাক ঢোল পিটালো কেন? তা ছাড়া সে এই বিয়েতে কিছু দিতে পারছে না। লোকজন এসে দেখবে ফকিরি বিয়ে। কি দরকার?
মারুফের কোন যুক্তিই তার কাছে গ্রহণ যোগ্য মনে হয়নি। তিথির মনে হয়েছে মারুফ নানান সমস্যায় বিব্রত। সমস্যাগুলি কি তাও পরিস্কার করে বলছে না। বললে সমস্যার সমাধান না দিতে পারলেও মানসিক ভরসা সে দিতে পারত। মারুফ বোধ হয় তা চায় না। কিছু কিছু মানুষ আছে যারা নিজের সমস্যা নিজের মধ্যেই রাখতে চায়। অন্যকে সমস্যায় জড়াতে চায় না। মারুফ কি তাদের একজন? তিথি এখনো পুরোপুরি জানে না।
সেদিন মারুফের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে সে বেশ কষ্ট পেয়েছে। নিজের জন্যে কষ্ট না মারুফের জন্যে কষ্ট। মারুফকে মনে হচ্ছে মহাচিন্তিত। মুখ টুখ শুকিয়ে কি হয়েছে। চোখের নিচে কালি। তিথি বলল, কি হয়েছে তোমার? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?
আমার পেটে গ্যাস হচ্ছে।
মনে হচ্ছে তুমি খুব চিন্তিত।
পেটে গ্যাস হলে চিন্তিত হব না? পেটের গ্যাস থেকে কত কি যে হতে পারে তা তুমি জান?
এ ছাড়া অন্য কোন সমস্যা নেই।
আছে সামান্য সমসয়। সেই সমস্যার সমাধান তুমি করতে পারবে না।
সমাধান না করতে পারি সমস্যা শুনতে তো বাধা নেই।
মিনিষ্ট্রি অব এড়ুকেশন ঘাপলা করছে। ভয়ে ভয়ে আছি হয়ত দেখা যাবে শেষ মুহুর্তে একটা ফ্যাকড় তুলবে। নো অবজেকশন সার্টিফিকেট দিল না। প্লেনে উঠতে পারলাম না।
এরকম সম্ভাবনা কি আছে?
না নেই। তবে এদেশে সবই সম্ভব। এরকমও হয়েছে যে স্কলারশীপ পেয়েছে একজন, চলে গেছে অন্যজন। এর নাম হল বঙ্গদেশ–সেলুকাস কি বিচিত্র এ দেশ।
তিথি বলল, এ রকম সম্ভাবনা থাকলে আমি বাবাকে বলি। বড় মামাকে বলি। তারা একটু খোঁজ খবর করুক। বড় মামা অনেক গুরুত্বপূর্ণ লোকজনদের চেনেন।
মারুফ বিরক্ত স্বরে বলল, অনেক গুরুত্বপূর্ণ লোকজনকে আমিও চিনি। বাংলাদেশ খুব ছোট্ট জায়গা। এই জায়গায় সবাই সবাইকে চেনে। খোদ যে এড়ুকেশন মিনিষ্টার তাকে আমি নিজে চিনি না কিন্তু আমার বাবা চেনেন। তিনি আমার বাবার ছাত্র ছিলেন। আমি যতদূর জানি তার পড়াশোনার মূল খরচ আমার বাবা চালিয়েছেন।
তাহলে তোমার সমস্যা কি?
আছে সমস্যা আছে। আমি পুরানো প্রসঙ্গ টেনে সুবিধা কেন নেব? ধর কোন কারণে যদি মিনিষ্ট্রি অব এড়ুকেশন আমার স্কলারশীপ বাতিলও করে দেয় আমিতো তা নিয়ে মন্ত্রীকে বলতে যাব না। নিজের জন্যেতো কখনোই না। অন্যের জন্যে যাওয়া যায়, নিজের জন্যে যাওয়া যায় না।
তিথি বলল, তুমি তাহলে আমাদের নুরুজ্জামান সাহেবের একটা কাজ যদি পার করে দিও। বেচারা ঢাকায় এসেছেই শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার জন্যে। প্রথম প্রথম বাবাকে অনুরোধ করেছে। এখন আর করে না। বুঝে ফেলেছে বাবাকে বলে কিছু হবে না।
ঐ ব্যাটা শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে কি করবে?
মেয়েদের একটা স্কুল দেবে।
এইসব ফালতু ব্যাপার নিয়ে আমাকে চিন্তা করতে বলবে নাতো। আমার হয়েছে–মাথার ঘায়ে কুত্তা পাগল অবস্থা।
তবু তোমার সামান্য পরিশ্রমে যদি অন্য একজনের উপকার হয়।
দেখি।
দেখ আর না দেখ। মরার মত বিছানায় শুয়ে থাকবে না। উঠে বসতো। আজ আবার দাড়ি কামাওনি ব্যাপার কি?
ব্রণ।
তুমি এক কাজ কর দাড়ি রেখে ফেল। দাড়িতে তোমাকে খারাপ দেখায় না। হি হি হি।
হাসবে না তিথি। কারোর হাসিই আমার এখন সহ্য হয় না।
আচ্ছা যওি হাসব না। এসো দুজনে মিলে কাদি।
মারুফ হাসল। তিথি বলল, আমার পাসপোর্ট হয়ে গেছে। বাবা ২৪ ঘণ্টায় পাসপোর্ট বের করেছেন, তিন হাজার টাকা ঘুস দিয়ে। চিন্তা কর–বাবার মত সৎ মানুষ ঘুস দিচ্ছে।
মারুফ হাই তুলতে তুলতে বলল, সৎ মানুষরাই বেশি ঘুস দেয়। ঘুস ব্যাপারটা টিকে আছে সৎ মানুষদের কল্যাণে।
তুমি কি যে সিনিকেল কথা বল।
গভীর দুঃখ ও বেদনা থেকে বলি বুঝলে? এই যে তুমি পাসপোর্ট টাসপোর্ট করে বসে আছ–তোমার যাওয়াতো দূরের কথা দেখা যাবে আমি নিজেই যেতে পারছি না।
না যেতে পারলে নেই। বিদেশ এমন কোন বড় ব্যাপার না। তুমি এমন গ্রুমি ভাব ধরে বসে থাকবে না। বল আমি কি করলে তোমার মনটা ভাল হবে।
চুমু খেয়ে দেখতে পার।
তিথি লজ্জিত গলায় বলল, ছিঃ নির্বিকার ভাবে কি করে এরকম কথা বল।
মারুফ বলল, বাইরে কাউকে বলি না। আমি আমার স্ত্রীকে বলি। শুনুন মাই ডিয়ারেস্ট–আমার মন ভাল করার একটা অষুধই আছে। এই অষুধ ব্যবহার করুন। খুব বেশি লজ্জা লাগলে দরজা ভিজিয়ে দিন।
তিথি দরজা ভিজিয়ে দিল।
মারুফ হাসি মুখে বলল, শোন তিথি তোমার এই act of kindness এর কারণে তোমার হলুদ কোটের কাজটা করে দেব। মন্ত্রীকে বলব তার কথা।
তিথি কোমল গলায় বলল, থ্যাংক য়্যু।