১০. আগামীর পথ
গোলযোগ, অভিবাসন আর দেশ দখলের পটভূমিতে অ্যাক্সিয়াল যুগের আধ্যাত্মিক বিপ্লব ঘটেছিল। প্রায়শঃই দুটো সাম্রাজ্যসুলভ প্রয়াসের ভেতর এটা ঘটেছে। ঝোউ রাজবংশের পতনের ঠিক ঠিক পরপরই চীনের অ্যাক্সিয়াল যুগ শুরু হয়েছিল আর শেষ হয়েছে কিন যুদ্ধমান রাজ্যগুলোকে সংগঠিত করার পর। হরপ্পার সভ্যতার বিনাশের পর ভারতীয় অ্যাক্সিয়াল যুগ শুরু হয়, শেষ হয় মৌর্য সাম্রাজ্যের পত্তনের ভেতর দিয়ে; মাইসিনিয় রাজ্য ও মেসিদোনিয় সাম্রাজ্যের মধ্যবর্তী সময়ে গ্রিক পরিবর্তন ঘটেছিল। অ্যাক্সিয়াল সাধুরা তাদের নোঙর থেকে বিচ্ছিন্ন এক সমাজে বাস করেছেন। কার্ল জেস্পারস মত প্রকাশ করেছেন যে, ‘অ্যাক্সিয়াল যুগকে দুটো মহান সাম্রাজ্যের মধ্যবর্তী অরাজক কাল, মুক্তির জন্যে ক্ষণিক বিরতি, সাবলীলতম সচেতনতাকে এক করার জন্যে এক গভীর নিঃশ্বাস হিসাবে আখ্যায়িত করা যেতে পারে।” এমনকি মধ্যপ্রাচ্যে সাম্রাজ্যবাদী প্রয়াসের ফলে চরম দুর্ভোগের শিকার ইহুদিরাও স্বদেশভূমির ধ্বংস ও অতীতের সঙ্গে সকল সম্পর্ক ঘুচিয়ে সবকিছু নতুন করে শুরু করতে বাধ্যকারী অভিবাসনের আঘাতের পর পর আবির্ভূত ভীতিকর মুক্তির ভেতর দিয়ে নিজস্ব অ্যাক্সিয়াল যুগে পা দিয়েছিল। কিন্তু দ্বিতীয় শতাব্দীর মাঝামাঝি নাগাদ পৃথিবী স্থিতিশীল হয়ে আসে। নতুন রাজনৈতিক একীভবনকে নিশ্চিত করার মতো আধ্যাত্মিকতার খোঁজ পাওয়াই ছিল অ্যাক্সিয়াল যুগের পরবর্তী সময়ে গড়ে ওঠা বিভিন্ন সাম্রাজ্যে চ্যালেঞ্জ।
চীনারা দীর্ঘ কাল ধরে শান্তি ও সমন্বয়ের আকাঙ্ক্ষা করে গেছে। ২২১ সালে কিন অবশিষ্ট সাতটি রাজ্য দখল করে একটি কেন্দ্রীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করলে অনেকেই নিশ্চয়ই স্বস্তি পেয়েছিল, তবে সাম্রাজ্যবাদী শাসনের বিহ্বলকারী অভিঘাতও লাভ করেছিল তারা।
কিন-এর জয় আইনপন্থীদের পক্ষে এক বিরাট বিজয় ছিল। এমনকি সামন্তবাদী অধিরাজ ছিলেন এমন কিংবদন্তীসম সাধু রাজারাও এই ধরনের সাম্রাজ্যের অধিকারী হননি। চীনে এর কোনও পূর্ব নজীর না থাকার কথা জানা ছিল কিনের, ফলে রাজা নিজেকে ‘প্রথম সম্রাট’ নামে অভিহিত করেছিলেন। উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন দরবারের ইতিহাসবিদ: ‘এখন চার সাগরের সর্বত্র নিয়ন্ত্রণ ও প্রশাসন কেন্দ্র আর আছে, একটি নির্দিষ্ট কেন্দ্র থেকে আইন জারি হচ্ছে, সুদূর অতীতেও এমনটা হতে দেখা যায়নি।’২ নতুন যুগ ছিল এটা, স্বৰ্গ থেকে ক্ষমতা লাভ করার দাবি করেননি সম্রাট। তার বদলে ঐতিহ্য ভেঙে চীনা অ্যাক্সিয়াল যুগে অংশ না নেওয়া একদল দার্শনিকের শারণাপন্ন হয়েছেন। দরবারী গণক, বিশ্লেষক ও জ্যোতিবিজ্ঞানীরা সম্ভবত সবসময় বিশাল প্রতিদ্বন্দ্বী রাজ্যগুলোর শাসকদের কাছে মোহিস্ট বা কনফুসিয়দের চেয়ে ঢের বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন, এবার কিন শাসনের পক্ষে একটি যৌক্তিক ভিত্তি গড়ে দিয়েছিলেন তাঁরা।
পরে এই সৃষ্টিতত্ত্ব-এক ধরনের জাদুকরী আদিরাষ্ট্রের রূপ-ইন ও ইয়াঙ মতবাদ হিসাবে পরিচিত হয়ে ওঠে এবং তৃতীয় প্রথম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে চীনাদের কল্পনায় শক্ত ভিত্তি লাভ করে। আমরা যেমন দেখেছি, ইন ও ইয়াং ধারণা সম্ভবত চীনের ক্ষেতমজুর সম্প্রদায়ের সঙ্গে সঙ্গে সংগঠিত হয়েছিল এবং কিন-এর আপেক্ষিক সম্পর্কযুক্ত সৃষ্টিতত্ত্বকে নব্য প্রস্তর কালপর্ব পর্যন্ত চিহ্নিত করা যেতে পারে। এই পর্যায়ে এর পুনরুত্থানকে অ্যাক্সিয়াল যুগের চ্যালেঞ্জিং চাহিদা থেকে বুদ্ধিবৃত্তিক পিছু হটা, প্রায় পলায়ন তুলে ধরে। মানবীয় ও প্রাকৃতিক বিভিন্ন ঘটনার ভেতর সম্পর্ক আবিষ্কার করা ছিল এর লক্ষ্য। দরবারী দার্শনিকরা চলমান ঘটনাপ্রবাহকে অনুমানযোগ্য এবং একটি বৃহত্তর, স্বর্গীয় আইনে নিয়ন্ত্রিত বলে দাবি করেছেন, এই বিরাট পরিবর্তনের সময়ে মানুষকে তা ‘ওয়াকিবহাল থাকার’ এক ধরনের স্বস্তিদায়ী বোধ যুগিয়েছিল। চতুর্থ শতাব্দীর দার্শনিক যোউ ইয়ান পাঁচটি মূল উপাদান মাটি, কাঠ, ধাতু, আগুন ও পানি-পরস্পরকে কঠোর পর্যায়ক্রমে অনুসরণ করেছে বলে যুক্তি দেখিয়ে এই মতবাদ প্রণয়ন করেছিলেন: কাঠ আগুন সৃষ্টি করে; আগুন ছাই ও মাটি সৃষ্টি করে; মাটি দেয় ধাতু; ধাতু জন্ম দিয়েছে পানির। প্রতিটি উপাদান কোনও একটি ঋতুর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং প্রতিটি ঠিক শরৎকাল যেভাবে গ্রীষ্মকে অনুসরণ করে সেভাবে তার আগেরটির উপর শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছে। উদাহরণ স্বরূপ, আগুন কাঠকে গ্রাস করে নেয়, কিন্তু মাটি আগুন নেভায়। অ্যাক্সিয়াল দার্শনিকদের এই ধরনের আঁচ-অনুমানের কোনও ফুরসত ছিল না। মোহিস্টরা সোজাসাপ্টা যুক্তি দেখিয়েছিলেন: ‘পাঁচটি উপাদান সবসময় একটি অন্যটির উপর আধিপত্য বিস্তার করে না।’৪ অবশ্য যোউ ইয়ান মহান রাজবংশসমূহের ঐতিহাসিক পর্যায়ক্রমের ক্ষেত্রেও এই প্রকল্প কাজে লাগাতে পারবেন বলে বিশ্বাস করতেন। ইয়েলো সাম্রাজ্য চীনের হলদে রঙ মাটির সঙ্গে, যিয়া বনের সঙ্গে, শ্যাঙ ছিল ব্রোঞ্জ ধাতুর সঙ্গে আর ঝোউ আগুনের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। সুতরাং, নতুন কিন সাম্রাজ্য অবশ্যই শীতের ঋতুর সঙ্গে সম্পর্কিত পানির আধিপত্যের অধীনে থাকবে।
প্রথম সম্রাট এই ধারণাকে তাঁর শাসনের পক্ষে সমর্থন হিসাবে আঁকড়ে ধরেছিলেন। শীতের রঙ কালো রংয়ের পোশাক পরতেন তিনি, আইনবাদের ‘নির্মম কঠোরতা, আইনের মাধ্যমে সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং কোনওরকম বদান্যতা, ঔদার্য, নমনীয়তা বা ন্যায়ের বালাই ছাড়াই সবকিছু নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার’” অন্ধ, শীতল নীতির সঙ্গে মানানসই মনে হয়েছে একে। একই সময়ে জীবনের আরকের সন্ধানে নতুনতম পরীক্ষাকে সমর্থন দিয়েছেন তিনি। কিন রাজদরবারে যোউ ইয়ানের শিষ্যদের কেউ কেউ অমরত্বের জন্যে ভেষজ ও ধাতুর রেসিপি তৈরির প্রয়াস পাচ্ছিল-পরবর্তীকালে দার্শনিক দাওবাদের সঙ্গে সম্পর্কিত জাদুবিদ্যার একটি অপভ্রংশ। এই আদি বিজ্ঞানীদের কেউ কেউ ওষুধ বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করেছেন; অন্যরা শ্বাসপ্রশ্বাস ও জিমন্যাস্টিক শরীরচর্চার ভেতর দিয়ে দীর্ঘায়ুর চর্চা করেছেন; এমনকি সুবিধাপ্রাপ্ত মানুষ চিরকাল বাস করতে পারবে বলে মনে করা চীনের উত্তর উপকূলে আইলস অভ রেস্তের খোঁজে ভৌগলিক অভিযানেরও সূচনা করা হয়েছে। এসবই নিয়ন্ত্রণ লাভ, ভবিষ্যৎ অনুমান ও আধ্যাত্মিক উপায়ের বদলে বরং শারীরিক কৌশলে মৃত্যুকে দূরে ঠেলে রাখার আকাঙ্ক্ষা তুলে ধরেছে, তবে এটা আবার এ জাতীয় স্থায়িত্ব ও নিরাপত্তার অনুসন্ধান অপরিপক্ক ও অবাস্তববাদী বলে বিশ্বাস করা অ্যাক্সিয়াল সাধুদের দর্শন থেকে পিছু হটাও ছিল।
প্রথম সম্রাটকে তাঁর অধিকৃত বিপুল এলাকা সংগঠিত করার পদ্ধতি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। তিনি কি ঝোউদের মতো ছেলেদের হাতে সামন্ত জমিদারি তুলে দেবেন? তাঁর প্রধানমন্ত্রী যুনযির পুরোনো শিষ্য লি সি ছেলেদের জমির বদলে ভাতা দিয়ে সাম্রাজ্যের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার পরামর্শ দিয়েছিলেন। ২১৩ সালে এক দরবারী ইতিহাসবিদ ঐতিহ্যের এই বিচ্যুতির সমালোচনা করলে সাম্রাটের কাছে এক ভয়াল স্মারক তুলে দেন লি সি। প্রাচীন কালে, যুক্তি দেখান তিনি, লোকে স্বাধীন পণ্ডিতদের সঙ্গে পরামর্শ করেছে এবং বিভিন্ন মতবাদ অনুসরণ করেছে, কিন্তু সেটাকে আর চলতে দেওয়া যায় না :
জাঁহাপনা জগৎ-কে সংগঠিত করেছেন। তবুও কেউ কেউ তাদের নিজস্ব শিক্ষা দিয়ে পরস্পরকে সাহায্য করছে এবং আমাদের আইন ও রীতিকে হেয় করছে। এই ধরনের অবস্থাকে নিষিদ্ধ করা না হলে সাম্রাজ্যাবাদী শক্তির পতন ঘটবে এবং নিচ থেকে উপদলীয় কোন্দল শুরু হবে।৭
সুতরাং, লি সি পরামর্শ দিয়েছেন, ‘কেবল কিনেরগুলো বাদে সকল ঐতিহাসিক দলিল, সরকারী পণ্ডিতদের হেফাযতে থাকাগুলো ছাড়া শত শত মতবাদের সকল রচনা এবং কৃষি, ওষুধবিজ্ঞান, ভবিষ্যদ্বাণী, ও বৃক্ষবিদ্যা সংক্রান্ত কিছু রচনা ছাড়া অন্য সমস্ত সাহিত্য সরকারের হাতে তুলে দিতে হবে এবং সেগুলো পুড়িয়ে ফেলতে হবে।” শুধু বিপুল পরিমাণ গ্রন্থ পোড়ানোর ব্যাপারই ঘটেনি, বরং ৪৬০ জন শিক্ষককেও আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছিল। চীনের অ্যাক্সিয়াল দার্শনিকরা সকল বস্তুর ঐক্যের আধ্যাত্মিক উপলব্ধিতে পৌঁছেছিলেন। লি সির কাছে ঐক্যের মানে ছিল বিরোধিতার নিষ্ঠুর বিনাশ। এক পৃথিবী, এক ইতিহাস আর একটিমাত্র মতাদর্শই অস্তিত্ববান ছিল।
সৌভাগ্যক্রমে সত্তর জন সরকারী দার্শনিককে চীনা ধ্রুপদী সাহিত্যের অনুলিপি রেখে দেওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন সম্রাট, নইলে হয়তো সবই শেষ হয়ে যেত। কিন্তু এইসব বর্বর নীতি উল্টো ফলদায়ী ছিল। ২০৯ সালে প্রথম সম্রাটের মৃত্যুর পর সাম্রাজ্যের জনগণ বিদ্রোহ করে বসে। বিশৃঙ্খলাময় তিন বছর পর স্থানীয় প্রশাসক হিসাবে জীবন শুরু করা লিউ ব্যাঙ নিজ বাহিনীকে বিজয়ের দিকে নিয়ে যান এবং হান রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন। কিন-এর কেন্দ্রীভূত রাজনৈতিক ব্যবস্থা অটুট রাখতে চেয়েছিলেন তিনি এবং এমনকি লি সি-র নীতি ভুল পথে চালিত হয়েছিল বুঝতে পারলেও মানসিক বিকাশের উপযোগী মতাদর্শের পাশাপাশি সাম্রাজ্যের আইনপন্থীদের বাস্তববাদের প্রয়োজনের কথাও জানতেন। আইনবাদ ও দাওবাদের সংশ্লেষ হুয়াঙ লো নামে পরিচিত এক সমন্বয়ের দর্শনে আপোসের খোঁজ পান তিনি। এদুটি মতবাদ সবসময় নৈকট্য বোধ করে এসেছে, এবং কখনওই কনফুসিয় বা মোহিস্টদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন না বলে সম্ভবত কিংবদন্তীর ইয়েলো সম্রাট হুয়াং দি-কেই পৃষ্ঠপোষক হিসাবে বেছে নিয়েছিল। খামখেয়ালি সাম্রাজ্যবাদী শাসনে মানুষ ক্লান্ত হয়ে উঠেছিল, এবং বলা হয়ে থাকে যে, হুয়াঙ দি ‘কিছুই না করে’ শাসন করেছেন। সম্রাটকে অবশ্যই তাঁর মন্ত্রীদের হাতে দায়িত্ব দিয়ে ব্যক্তিগতভাবে সরকারী নীতিতে হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকতে হবে; একটি যৌক্তিক শাস্তি বিধি থাকবে, তবে কোনওরকম ভয়াল শাস্তির বিধান থাকবে না।
অ্যাক্সিয়াল যুগের শেষ চীনা সাধুরা কোনও একটি একক সনাতনী অবস্থানের গোঁড়া অনুসরণের ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন, সমন্বয় বাদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তাঁরা। কিন্তু বহু লোকই বিভ্রান্ত বোধ করেছে ও বিভিন্ন মতবাদের ভেতর থেকে কোনও একটিকে বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়েছে। সম্ভবত হান-এর গোড়ার দিকে বছরগুলোয় রচিত ‘আন্ডার দ্য এম্পায়ার’ নিবন্ধের রচয়িতা চীনের আধ্যাত্মিক বিশ্ব ভেঙে পড়ছে বলে মনে করেছেন। সাধু রাজাদের শিক্ষা ছিল স্ফটিক স্বচ্ছ। কিন্তু এখন:
স্বর্গের নিচে সর্বত্র মহা বিশৃঙ্খলা, গণ্যমান্য ও সাধুদের কাছে এখন আর বিলোনোর মতো আলো নেই, তাও ও গুণ [দে] এখন আর একসঙ্গে নেই, গোটা বিশ্ব কেবল একটি বিষয়ই যেন দেখতে চায়, তারা সম্পূর্ণ ব্যাপারটাই অনুভব করতে পেরেছে বলে মনে করে।১০
চীনারা অ্যাক্সিয়াল যুগের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাকে আত্মস্থঃ করেছিল। দাও দুৰ্জ্জেয় ও অনির্বচনীয় হওয়ায় তারা জানত কোনও মতবাদেরই সত্যের উপর একচেটিয়া অধিকার থাকতে পারে না। এই সময় দাওবাদ ছিল তুঙ্গে। “আন্ডার দ্য এম্পায়ার’-এর লেখকের চোখে প্রায় সকল সাধুরই গুরুত্বপূর্ণ অন্তর্দৃষ্টি ছিল, তবে ঝুয়াংঝি ছিলেন সবচেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য। তিনি ‘নিজে যা বিশ্বাস করতেন তাই শিক্ষা দিয়েছেন, কিন্তু কখনওই পক্ষপাতদুষ্ট ছিলেন না, একটিমাত্র দৃষ্টিকোণ থেকেও বিভিন্ন জিনিস দেখেননি। সম্পূর্ণ মনখোলা ও মানবীয় সনাতনী বিশ্বাস থেকে মুক্ত ছিলেন বলেই ‘দাও অনুযায়ী চলেছেন ও সর্বোচ্চ অবস্থানে” পৌছতে পেরেছিলেন তিনি।
কিন্তু ক্রমশঃ কনফুসিয়বাদের যোগ্যতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।১২ হান সম্রাটরা সবসময় আনুষ্ঠান ও আচারের গুরুত্বকে উপলব্ধি করেছেন। প্রথম হান সম্রাট স্থানীয় শাস্ত্রজ্ঞদের দরবারী শাস্ত্রাচার রচনার নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং সেটা প্রথমবারের মতো পালিত হওয়ার সময় চেঁচিয়ে বলে উঠেছিলেন: “এখন বুঝতে পারছি স্বর্গের সন্তান হওয়ার মাহাত্ম্য!১৩ সাধারণ মানুষ কিন ইনকুইজিশনের আঘাত থেকে বেরিয়ে আসার পর দাওবাদ অবাস্তব মনে হতে শুরু করেছিল। সবসময় এর ভেতর অরাজকতা ও আইনহীনতার আভাস ছিল এবং লোকের কোনও ধরনের নৈতিক দিক নির্দেশনার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে হতো। উউ ওয়েই-এর সুবিধা যাই হোক, সম্রাটরা শূন্যতা’ দিয়ে শাসন করতে পারতেন না। হান সম্রাট ওয়েন (১৭৯-১৫৭) এর শাসনামলে হুয়াঙ লো-র জনপ্রিয়তা তুঙ্গে পৌঁছে। এবং এর পর শাসকগোষ্ঠী পরিবর্তনের জন্যে প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল।
১৩৬ সালে দরবারের পণ্ডিত দোঙ যোঙশু সম্রাট উউ (১৪০-৮৭)-এর কাছে প্রতিদ্বন্দ্বী মতবাদের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে যুক্তি দেখিয়ে কনফুসিয়দের শিক্ষা দেওয়া ছয়টি ক্লাসিককে রাষ্ট্রের সরকারী শিক্ষায় পরিণত করতে হবে বলে একটি স্মারকপত্র দাখিল করেন। সম্রাট সম্মতি দেন, কিন্তু কিন যেমনটা করেছিল, অন্য সকল মতবাদ বিলোপ করার বদলে অন্যান্য মতবাদকেও টিকে থাকতে দেন তিনি। কনফুসিয় দর্শন এখন সরকারী পরীক্ষার ভেতর দিয়ে সরকারী কর্মচারীদের নির্বাচন করার হানদের মেধাতান্ত্রিক ব্যবস্থার স্বীকৃতি দিয়েছিল। জন্ম পরিচয় নির্বিশেষে একজন গুণবান ও বিদ্যার্থীরই সরকারের উচ্চ পর্যায়ে স্থান পাওয়া উচিত বলে কনফুসিয়রা সবসময় বিশ্বাস করত। তারা সমাজের মৌল উপাদান পরিবারের ভরণপোষণ করে এবং সবার উপরে একাধারে পণ্ডিত ও চিন্তাবিদ এবং চীনা জাতীয় পরিচয়ের জন্যে অপরিহার্য সাংস্কৃতিক ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিত।
সুতরাং, প্রথম শতাব্দী নাগাদ কনফুসিয় মতবাদ যারপরনাই সম্মানিত ছিল, কিন্তু চীনারা তখনও অ্যাক্সিয়াল যুগের অন্য সব দর্শনের মূল্য দিয়েছে। চীনের প্রধান মতবাদ সংক্রান্ত বিবরণে ইতিহাসবিদ লিউ যিন (সি. ৪৬ বিসিই-২৩ সিই) শাস্ত্রজ্ঞদের পথ ‘সবচেয়ে উন্নত’ থাকার যুক্তি দেখান। তাঁরা “হিতাকাঙ্ক্ষা ও ন্যায়ের সীমানার ভেতর নির্মিত, ইয়াও ও শানদের ঐতিহ্যের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ছয়টি ক্লাসিকের চমৎকারিত্বে আনন্দ পেতেন এবং রাজা ওয়েন ও উউ- কে তাদের কর্তৃপক্ষ এবং কনফুসিয়াসকে প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে পেয়েছেন।’ কিন্তু কনফুসিয়বাদে সম্পূর্ণ সত্যির অস্তিত্ব ছিল না: ‘অন্যান্য মতবাদের সাহায্যে পূরণ করার মতো সম্ভব ফাঁক ছিল এর জ্ঞানে। প্রতিটি দর্শনেরই নিজস্ব শক্তি ও দুর্বলতা রয়েছে। দাওবাদীরা আধ্যাত্মিক জীবনের কেন্দ্রে যাওয়ার উপায় জানত, ‘গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উপলব্ধি করে, মূল বিষয়কে আঁকড়ে ধরে স্পষ্টতা ও শূন্যতা দিয়ে কাউকে ধরে রাখতে আর বিনয় ও পরাজয় স্বীকারের ভেতর দিয়ে নিজেকে উন্নত রাখতে জানত,’ কিন্তু নৈতিকতার নিয়ম ও আচারের ভূমিকাকে খাটো করে দেখেছে তারা। সৃষ্টিবিজ্ঞানীরা সাধারণ মানুষকে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান শিক্ষা দিতে পারেন, কিন্তু এই মতবাদ কুসংস্কারে মিলিয়ে যেতে পারে। আইনপন্থীরা জানতেন, সরকার আইন ও বিধিনিষেধের উপর নির্ভর করে; তাদের ব্যর্থতা ছিল ঔদার্য ও নৈতিকতাকে বিসর্জন দেওয়া। মোহিস্টদের বাড়াবাড়ির প্রতি নিন্দাবাদ ও অদৃষ্টবাদ এবং তাদের ‘সকলের প্রতি উদ্বেগ’ মূল্যবান ছিল, কিন্তু লিউ যিন তাদের আচারের প্রত্যাখ্যান ও আত্মীয় ও আগন্তুকদের পার্থক্যকে’১৪ উপেক্ষা করা পছন্দ করেননি।
চীনারা বুঝতে পেরেছিল, সত্যির বেলায় চূড়ান্ত কথা বলার মতো কেউ নেই; যত মহানই হোক, কোনও প্রচল বিশ্বাসই কারও সম্পূর্ণ আনুগত্য দাবি করতে পারে না। কোনও একক, অনির্বচনীয় দর্শনে পৌঁছানোর চেয়ে অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা ঢের বেশি গুরুত্বপূর্ণ। চীনের অন্তর্ভুক্তিমূলক চেতনা ছিল অনন্য।১৫ পরে চীনারা তাদের নিজস্ব মাটিতে জন্ম নেওয়া আধ্যাত্মিকতার পাশাপাশি বুদ্ধ ধর্মমতকেও আত্মস্থঃ করে নিতে সক্ষম হবে। ভারত ও পাশ্চাত্যে বিভিন্ন ধর্ম প্রায়শঃই আগ্রাসীভাবে প্রতিদ্বন্দ্বীসুলভ ছিল, কিন্তু প্রায়ই বলা হয়ে থাকে যে, চীনে একজন ব্যক্তি দিনের বেলায় কনফুসিয়বাদী আর রাতে দাওবাদী হতে পারে। এমনকি আইনবাদকেও বিসর্জন দেওয়া হয়নি। সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটার সঙ্গে সঙ্গে চীনাদের বিভিন্ন দর্শনের এতটাই প্রয়োজন ছিল যে গোঁড়া কনফুসিয়বাদীরা প্রায়শঃই তাদের শাসকদের বিরুদ্ধে ‘মুখে কনফুসিয়বাদী আর কাজে আইনপন্থী হওয়ার’ অভিযোগ তুলেছেন।১৬ সাধারণভাবে এটা স্বীকার করে নেওয়া হয় যে প্রতিটি ধর্মবিশ্বাসেরই নিজস্ব সঠিক বলয় রয়েছে-একটি অ্যাক্সিয়াল প্রবণতা, আমাদের নিজস্ব সময়ে যারা নিদারুণ প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।
২৩২ সালে অশোকের মৃত্যুর পর ভারতে মৌর্য সাম্রাজ্য দ্রুত ভেঙে পড়ে। দক্ষিণে আঞ্চলিক রাজ্য গড়ে ওঠে। মগধ হারিয়ে যায় অস্পষ্টতায়, অন্যদিকে উত্তর আফগানিস্তানের বাকত্রিয়ার গ্রিকো-পারসিয়া থেকে গ্রিক হানাদাররা সিন্ধু উপত্যকার নিয়ন্ত্রণ লাভ করে। প্রথম শতাব্দীর মাঝামাঝি গ্রিকরা ইরান ও মধ্য এশিয়া থেকে আগত সিচিয়ান ও পারথিয়ান গোত্রের হাতে উৎখাত হয়। এই বিদেশী শাসকরা ভারতীয় ধর্মের প্রতি বৈরী ছিলেন না, বরং ব্রাহ্মণরা তাদের অশুচি বিবেচনা করত বলে অ-বৈদিক গোষ্ঠীগুলোর প্রতি ঝুঁকে পড়ছিলেন। বিসিই ২০০ থেকে সিই ২০০ সালের ভেতর বুদ্ধমতবাদ ও জৈনবাদ সম্ভবত ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় ধর্ম ছিল। আরও পরিপক্ক, ব্যক্তিগত ও আবেগ নির্ভর আধ্যাত্মিকতার আকাঙ্ক্ষা তুলে ধরা ভক্তি বিশ্বাসের একটি জোরাল বিস্ফোরণও ঘটেছিল, বলা চলে জনপ্রিয় বিপ্লবের শামিল ছিল তা।
মৌর্য রাষ্ট্রের পতন পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে আমরা বিক্ষিপ্তভাবেই জানি কেবল, কারণ উত্তরাঞ্চলীয় মথুরায় গুপ্ত রাজবংশ (৩১৯-৪১৫ সিই) ও দক্ষিণ ভারতে পাহুভি রাজবংশের (৩০০-৮৮৮ সিই) উত্থানের ফলে ভারত তথাকথিত ধর্মদ্রোহী সব আন্দোলনকে ভাসিয়ে দেওয়া এক অন্ধকার যুগে প্রবেশ করেছিল। অবশ্য শ্রীলঙ্কা, জাপান, দাক্ষিণ পূর্ব এশিয়া ও চীনে বুদ্ধধর্মমত শেকড় বিস্তার করেছিল। ভারতে সনাতন হিন্দুধর্মমত প্রাধ্যান্য লাভ করলেও অ্যাক্সিয়াল যুগের বৈদিক ধর্মের চেয়ে সেটা সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। ভীষণভাবে প্রতিমাবিরোধী ধর্মবিশ্বাস চোখ ধাঁধানো বর্ণিল দেবিনচয়, প্রতিমা আর মন্দিরের মাধ্যমে প্রতিস্থাপিত হয়েছিল। ঈশ্বরকে শব্দে অনুভবকারী ভারতীয়রা এবার দেবতাদের ভৌত সত্তাকে ধারণ করে বলে বিশ্বাস করে পবিত্রকে প্রতিমায় দেখতে চাইছিল। ঈশ্বর অসীম, তাই কোনও একটি নির্দিষ্ট অভিব্যক্তিতে তাঁকে ধারণ করা সম্ভব নয়; প্রতিটি দেবতা নৈর্ব্যক্তিক ব্রাহ্মণের বিশেষ গুণ প্রকাশ করে থাকেন। কিন্তু ভক্তির দেবতা শিব আর বিষ্ণু ছিলেন সবচেয়ে জনপ্রিয়। কোনও কোনও দিক থেকে মনে হয়েছিল যে বেদের অভিজাত ধর্ম সাধারণ মানুষের স্বল্প বিকশিত ধর্মের নিচে হারিয়ে গেছে।
তবে ভারতীয় ধর্মের বিকাশ নিয়ে খুব বেশি ছকবদ্ধভাবে কিছু বলা বিচক্ষণ হবে না। দক্ষিণ ভারতের সিন্ধু উপত্যকার সভ্যতা বা অনার্য দ্রাবিড়িয় সভ্যতায় এইসব আপাত ‘নতুন’ ভক্তি খুঁজে পাওয়া সম্ভব।” এবং দেখে যাই মনে হোক, বৈদিক ধর্মবিশ্বাস মোটেই হারিয়ে যায়নি। প্রকৃতপক্ষে, মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্ম উল্লেখযোগ্যভাবে বিকশিত হয়েছিল।১৮ নতুন শাস্ত্রাচার অ্যাক্সিয়াল ধারায় গৃহস্থের উৎসর্গের নতুন ব্যাখ্যা দিয়েছে। সেসবকে আর সরকারী আচারের ম্লান ছায়া মনে হয়নি, বরং সেগুলোর সারৎসার বলে মনে হয়েছে। কি করছেন গৃহস্থের সেটা জানা থাকলে পবিত্র আগুনে এক পেয়ালা দুধ ছুঁড়ে ফেলার মতো সামান্য কাজই গোটা উৎসর্গের জটিল আনুষ্ঠানিকতাকে মূর্ত করে তুলতে পারত এবং তার সকল উৎসর্গের দায়িত্ব পালন করতে পারত। খুব কম মানুষেরই ব্যয়বহুল বৈদিক আনুষ্ঠানিকতা পালন করার মতো ক্ষমতা ছিল। কিন্তু যেকারও পক্ষেই তার ‘আত্ম-উৎসর্গের’ প্রতীক হিসাবে আগুনে জ্বালানি কাঠ ছুঁড়ে দেওয়ার সামর্থ্য ছিল। এমনকি কেবল ওম শব্দাংশও হলেও অবশ্যই বেদের একটি অংশ পাঠ করতে হবে তাকে। এটাই ব্রাহ্মণের কাছে উৎসর্গকে পূর্ণতা দেয়।” এইসব ন্যূনতম কাজের ভেতর দিয়ে গৃহস্থ কেবল দেবতাদের প্রতি তার ‘ঋণ’ই শোধ করতেন না, বরং দৈনন্দিন জীবনের অনিবার্য সহিংসতার ক্ষতিপূরণও করেছেন। অহিংসার অ্যাক্সিয়াল আদর্শ এখন ভারতীয় ধর্মীয় চেতনায় গভীরে প্রোথিত ছিল। লোকে প্রবলভাবে আপাত অচল বস্তুতেও আঘাত হানার সম্ভাব্য ক্ষতি সম্পর্কে সজাগ ছিল। এইসব নতুন টেক্সট গৃহস্থের বাড়িতে তাকে প্রতিদিন ‘হত্যা’র পাপে অন্ধ করে রাখা পাঁচটি ‘কসাইখানা’ থাকার কথা উল্লেখ করেছে-অগ্নিকুণ্ড যাঁতাকল, ঝাড়, হামানদিস্তা ও কলসী। এইসব পরিমিত পারিবারিক আচার ‘মুক্তির’ তৎপরতা গড়ে তুলেছিল।২০
এইসব টেক্সট আবার অ্যাক্সিয়াল আদর্শ থেকে তীক্ষ্ণভাবে সরে আসা পরিবর্তনকেও তুলে ধরেছে।`১ ভারতে সম্ভবত দীর্ঘদিন ধরে একটি ‘অস্পৃশ্য’ গোষ্ঠী ছিল; বলা হয়ে থাকে যে, ক্ষমতাকাঠামোর বিপরীত বিন্দু হিসাবে মোটামুটি একই সময়ে ব্রাহ্মণ ও ‘অস্পৃশ্য’ শ্রেণী গড়ে উঠেছিল। কিন্তু মনুর বিধান এই প্রাচীন ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করেনি, তিনটি নিম্নতর শ্রেণীর অবনমন নিশ্চিত করেছে। ছুতোর, খোদাইকারী ও ভয়ঙ্কর ‘অস্পৃশ্যরা’ (চণ্ডাল) যথাক্রমে বৈশ্য, ক্ষত্রিয় এবং ব্রাহ্মণদের মিশ্র বিয়ের ফল ছিল। তাদের অবশ্যই বৈদিক সমাজ থেকে বহিষ্কার করতে হবে, গ্রামের সীমানায় বাস করবে তারা এবং চামড়ার কাজ, আর গ্রামের গোবর ঝাড়ু দেওয়ার মতো তুচ্ছ ও দূষণমূলক কাজ করবে। ২৩
ভক্তি বিপ্লব ব্রাহ্মণা ও গৃহত্যাগীদের কঠোর ধর্মকে সাধারণ মানুষের সঙ্গে অভিযোজিত করতে চেয়েছিল। এই নিবেদনমূলক গোষ্ঠীগুলো ঈশ্বরবাদের প্রতি নতুন তৃষ্ণাই তুলে ধরেছে। সবাই নৈর্ব্যক্তিক ব্রাহ্মণের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেতে চায়নি, বরং সহজেই সম্পর্কিত হওয়ার মতো আরও মানবীয় দেবতাদেরই পছন্দ করেছে তারা। ভক্তিকে ‘কারও অন্তর থেকে প্রভুকে আকাঙ্ক্ষা’ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে; প্রভুর প্রতি ভালোবাসা মানুষকে স্বার্থপরতার অতীতে নিয়ে গিয়ে তাদের ‘সম্পূর্ণ, সন্তুষ্ট, ঘৃণা, গর্ব আর স্বার্থপরতা থেকে মুক্তি দেবে।২৪ সুতরাং, ভক্তি হচ্ছে অহমবাদ ও আগ্রাসী মনোভাব থেকে হৃদয়কে শূন্য করার আরেক কৌশল। মনকে যারা মনুষত্ব্যের অন্তস্থ বুদ্ধিবৃত্তিক আদর্শের আদলে গড়ে তুলতে পারেনি তারা এমন এক দেবতার অনুকরণ করতে পারে যার প্রেম ও স্বার্থহীনতা সহজেই দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। এভাবে ভগবদ-গীতায় অর্জুনকে নির্দেশনা দিয়েছেন কৃষ্ণ :
আমার প্রতি মনোযোগ দাও,
তোমার উপলব্ধিকে আমার মাঝে প্রবেশ করতে দাও;
তাহলে সন্দেহাতীতভাবে আমার মাঝে
তুমি বেঁচে থাকবে।
আমার দিকে ভাবনাকে
স্থির করতে না পারলে
শৃঙ্খলা অনুশীলনের ভেতর দিয়ে
আমার কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করো, অর্জুন। ২৫
ভক্তি ধর্মগুলো সবার একই রকম মনোনিবেশের শক্তি না থাকার কথা স্বীকার করে নিয়েছে; কেউ হয়তো দৈনন্দিন জীবনে কৃষ্ণের অনুকরণকে দীর্ঘ সময়ের ধ্যানের চেয়ে সহজ আবিষ্কার করতে পারে।
এটা কোনও ভীতিকর ধর্ম ছিল না; সহজ ভক্তির ভেতর দিয়ে সময় নিয়ে এর চর্চা করা সম্ভব ছিল। অনুসারীরা বিষ্ণু/কৃষ্ণের আলোচনা শুনে শুরু করতে পারত; তারপর মানবজাতির প্রতি তাঁর মহান ভালোবাসার কৃতিত্বের কথা চিন্তা করার পাশাপাশি তাঁর নাম জপ করতে পারত। সকলে খুব বেশি কষ্ট ছাড়াই তাঁর কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করতে সক্ষম হয়ে না ওঠা পর্যন্ত তাঁর মন্দিরে সামান্য উৎসর্গ করে তাঁকে বন্ধু ভাবা শিখতে পারত। ২৬ আত্মসমর্পণই ছিল ভক্তির মূল কাজ; এটা ছিল ব্যক্তিকে ভক্তে পরিণত করা কোনোসিসের তৎপরতা। এই পর্যায়ে উপাসক প্রভুকে প্রতিহত করার বদলে তাঁর মতো করে অন্যদের ভালোবাসার আচরণ করতে শিখত। ভগবদ-গীতা ‘অন্যকে ভালোবাসা’ নামে অভিহিত কনফুসিয়দের শু-র চর্চার শিক্ষা করা সেই ভক্তকেই সবচেয়ে বেশি প্রশংসা করেছে।
আনন্দ বা কষ্টই হোক
যখন সে সবকিছুতেই
সত্তার সঙ্গে তুলনার মাধ্যমে
পরিচয় প্রত্যক্ষ করে
তখন সে খাঁটি অনুশীলনের
পাত্র হিসাবে বিবেচিত হয়। ২৭
ভক্তি উপাসককে নিজের অসহায়ত্ব আর প্রয়োজনকে মেনে নিতে উৎসাহ যোগায় এবং নিজের দুর্বলতার এই অভিজ্ঞতা অন্যের সঙ্গে সহানুভূতি বোধ করা সম্ভব করে তোলে। সুতরাং, নতুন আধ্যাত্মিকতা অ্যাক্সিয়াল যুগের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত ছিল।
খোদ প্রভুই ভালোবাসার নজীর সৃষ্টিকারী ছিলেন। বিষ্ণুর প্রথার মূলে ছিল অবতার, পার্থিব বা মানব রূপে দেবতার ‘প্রকাশ’ বা ‘অবতরণ’। ঐতিহাসিক সঙ্কটকালে বিশ্বকে রক্ষার স্বার্থে স্বর্গীয় আনন্দ বিসর্জন দেন বিষ্ণু।২৮ বলা হয়েছে যে, এইভাবে দশ বার অবতারে রূপ নিয়েছেন তিনি। এইসব অবতারের ভেতর কৃষ্ণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু মাছ, ভালুক, বামন এবং কচ্ছপ রূপেও আবির্ভূত হয়েছিলেন বিষ্ণু-এইসব প্রাণী হয়তো এভাবে বৈদিক ব্যবস্থায় স্থাপন করা স্থানীয় দেবতাদের প্রতীক হয়ে থাকবে। অবতারবাদের বিকাশ জটিল: সম্ভবত নানাধরনের প্রথার সম্মিলনের ভেতর দিয়ে এর উদ্ভব হয়েছে, যেগুলোর কোনওটা কোনওটা খুবই প্রাচীন কাল অতীতের হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু ভক্তিতে অ্যাক্সিয়াল তাৎপর্য অর্জন করেছে এগুলো। দুর্দশাগ্রস্ত মানবজাতিকে উদ্ধার করার জন্যে নিজ অবতারের ভেতর প্রেমময় ‘অবতরণ’ করে ঐশ্বরিকতার বাহ্যিক সজ্জা পাশে ঠেলে রাখা যথার্থ ঈশ্বরের মতোই নিজেকে প্রকাশ করেছেন বিষ্ণু!
বিষ্ণুর বরাবরই এই সম্ভাবনা ছিল। ঋগ বেদে কেবল বিক্ষিপ্তভাবে তাঁর কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তবে সম্ভবত বিষ’প্রবেশ করা—২৯ থেকে তাঁর নামটি নেওয়া হয়ে থাকবে: তিনি কেবল জগতে অংশগ্রহণ ও জগৎ-কে ব্যাপ্তই করে থাকেন না, বরং তিনিই ছিলেন ক্লান্তিহীন নিজের কাঁধে এই পৃথিবীকে ধারণ করা অ্যাক্সিস মান্দি। তিনি আবার স্রষ্টা ঈশ্বরও, কিন্তু ইন্দ্রের বিপরীতে সহিংসতা ও প্রতারণার মাধ্যমে বিশৃঙ্খলা থেকে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেননি। বরং দেবতা ও মানবজাতির জন্যে গোটা মহাবিশ্বকে আবৃত করা ‘মুক্তি ও জীবনের জন্যে তিনটি পদক্ষেপে বিশাল পায়ে পৃথিবীর রাজ্য ছাড়িয়ে তিনটি বিশাল পদক্ষেপের মাধ্যমে বিশ্বকে জয় করেছেন। একজন উদার দেবতা হিসাবে তিনি মানবজাতির বন্ধু, অজাতশিশুর রক্ষাকারী।১ ব্রাহ্মণরা উৎসর্গের উপশমকারী শক্তির সঙ্গে তাঁকে একাত্ম করেছে; বৈদিক কাহিনীতে বিশ্বকে অস্তিত্ব দেওয়ার জন্যে স্বেচ্ছায় নিজের জীবন বিসর্জনকারী এবং এভাবে আত্ম-শূন্যকরণের নীতিকে ধারণ করা আদিম সত্তা পুরুষার সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলেন তিনি।
ভক্তির আরেক দেবতা শিব ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের।২ লোকে যাঁকে তাদের বসতি ও গবাদিপশু থেকে দূরে থাকার জন্যে মিনতি করত সেই রহস্যময় পাহাড়ী দেবতা ভয়াল রুদ্রের সঙ্গে সম্পর্কিত সমান ভয়ঙ্কর ও মহান ছিলেন তিনি। তাঁর মিথোসে সহিংসতা ছিল, কিন্তু বিপুল সুখেরও উৎস ছিলেন তিনি। তাঁর উপাসনা না করলে শিব কৃপাহীন, কিন্তু ভক্তকে সবসময় রক্ষা করবেন। তবু ঈর্ষাপরায়ণ দেবতা ছিলেন তিনি। অতি প্রাচীন এক কাহিনীতে বিষ্ণুর এক ভক্ত দকশ শিবকে তাঁর উৎসর্গ অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণে অস্বীকৃতি জানানোয় তাঁকে হত্যা করেন তিনি; দুই গোত্রের ভেতর ভীষণ বৈরিতা ছিল। অবশ্য, পার্বতীর প্রেমিক হিসাবে নাচের মুগ্ধকারী দেবতা ও মুক্তির প্রতীকে পরিণত হন শিব: শিবের পায়ের কাছের বামন তাঁর কাছে পরাস্ত এক অশুভের প্রতিমূর্তি; তাঁর প্রসারিত হাত দয়ার প্রতীক; উত্থিত পা মুক্তির চিহ্ন আর গলায় পেঁচিয়ে থাকা সাপটি অমরত্বের প্রতীক। শিব হলেন স্রষ্টা এবং ধ্বংসকারী, গৃহস্থ আবার মহান যোগীও। সত্তায় আধ্যাত্মিক জীবনের আপাত সব বৈপরীত্যের সংশ্লেষ ঘটিয়েছেন তিনি এবং উপাসকদের পার্থিব পরিচয়ের অতীত দুর্জ্ঞেয় ও ঐক্যের বোধ যুগিয়েছেন।
ভক্তির ক্ষেত্রে প্রতিমা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল: শিব, বিষ্ণু বা কৃষ্ণের প্রতিরূপ (মূর্তি) তাঁদের মূর্ত প্রকাশ’, ঐশী সত্তার বাস্তব ও দৈহিক প্রকাশকে ধারণ করে বলে মনে করা হতো। পবিত্রকরণের মুহূর্তে দেবতা এর মাঝে অবতরণ করেছিলেন বলে সেটা ঈশ্বরের আবাসে পরিণত হয়েছে। কোনও কোনও প্রাচীন মন্দিরে একে ‘পাওয়া গেছে’ বলা হয়ে থাকে, কোনও দেবতা কর্তৃক পাঠানো হয়েছে বা স্বপ্নে এর সন্ধান জানানো হয়েছে। সুতরাং, খোদ মূর্তিটিই দেবতার আত্ম-উৎসর্গের ভালোবাসা প্রকাশকারী অবতার ছিল। কোনও কোনও টেক্সট এমনকি মানবজাতির প্রতি সহানুভূতি থেকে মানুষের তৈরি মূর্তির মাঝে স্থান করে নিতে সঙ্কুচিত হওয়ার সময় দেবতার কষ্টের কথাও বলেছে। ধ্যানের মূল বিন্দুতে পরিণত হলে মূর্তি এভাবে পরার্থপরতার আদর্শে পরিণত হয়। বুদ্ধ ও জৈন ধর্মাবলম্বীরাও নতুন হিন্দু ভক্তির ধারণায় প্রভাবিত হয়েছিল। প্রথম সিই শতাব্দীতে, এর আগে কখনও এমন হয়নি, বুদ্ধ এবং আলোকনের পথ তৈরির লক্ষ্যে মহাবীরের আগে আগত চব্বিশজন আধ্যাত্মিক নেতা তীর্থঙ্কর-এর (‘তীরনির্মাণকারী’) মূর্তি নির্মাণ শুরু করেছিল তারা। উত্তর পশ্চিম ভারতের গান্ধারা ও যমুনা নদীর তীরে মথুরায় প্রথম এই মূর্তিগুলো আবির্ভূত হয়।
বুদ্ধ সবসময় ব্যক্তিক কাল্টকে নিরুৎসাহিত করেছেন এবং শিষ্যদের নিজের বদলে তাঁর বাণী ও শেখানো পদ্ধতির প্রতি মনোযোগী করে তোলার সর্বাত্মক প্রয়াস পেয়েছেন। মানুষের প্রতি ভক্তি নির্ভরতা ও সংশ্লিষ্টতার অনালোকিত স্বভাবকে উৎসাহিত করা ‘শৃঙ্খলে’ পরিণত হতে পারে। তাঁর মৃত্যুর পরবর্তী শতকগুলোয় বৌদ্ধরা বুদ্ধের কোনও মূর্তিকে সম্মান করা অসঙ্গত মনে করত, কেননা তিনি নিব্বানার পরম সুখে প্রস্থান করেছেন। কিন্তু বুদ্ধের প্রতিমূর্তি যারপরনাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। তাঁর মুখায়ববের প্রশান্তি ও পরিপূর্ণতার দিকে তাকানোর সময় মানুষ কি হতে পারে তার সম্পর্কে সজাগ হয়ে ওঠে লোকে। তিনি আলোকিত মানুষের ইমেজ ছিলেন, অবর্ণনীয় নিব্বানার সঙ্গে নিবিড়ভাবে মিশে গিয়ে এর সমার্থকে পরিণত হয়েছেন। সুতরাং, এক গুরুত্বপূর্ণ অর্থে তিনিই ছিলেন নিব্বানা এবং মানব রূপে দুর্জ্ঞেয় বাস্তবতাকে প্রকাশ করেছেন।
এই সময় নাগাদ বুদ্ধ ধর্মমত দুটো ভিন্ন মতবাদে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল, দুটোকেই বিশ্বাসের খাঁটি রূপ মনে করা হয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে এদের ভেতর তেমন একটা শত্রুতা বা বৈরিতা ছিল না। অধিকতর কঠোর ও সন্ন্যাব্রত প্রবণ থেরাভেদা জগৎ থেকে প্রত্যাহৃত হয়ে নির্জনতায় আলোকনের খোঁজ করেছে। মহায়ন ছিল অধিকতর গণতান্ত্রিক এবং সহানুভূতির গুণের দিকে জোর দিয়েছে। আলোকনের পর বাজার এলাকায় ফিরে এসেছিলেন বুদ্ধ, জীবনের সর্বক্ষেত্রে বিরাজ করা বেদনাকে সামাল দেওয়ার কৌশল শেখাতে চল্লিশ বছর কাজ করেছেন, যুক্তি দেখিয়েছে তারা। সিই প্রথম শতাব্দীতে নতুন বৌদ্ধ বীরের আবির্ভাব ঘটিয়েছিল সেটা: বোধিসত্তা, এমন এক জন যিনি আলোকন লাভের উপান্তে পৌঁছে গেছেন। অবশ্য, নিব্বানার সুখে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার বদলে সাধারণ মানুষের স্বার্থে নিজেদের সুখ বিসর্জন দিয়েছেন তাঁরা এবং অন্যদের মুক্তি লাভের শিক্ষা দিতে সামসারার বিশ্বে ফিরে এসেছেন। ভক্তির স্বর্গ থেকে দুর্দশাগ্রস্ত মানুষকে সাহায্য করার জন্যে নেমে আসা দেবতাদের চেয়ে ভিন্ন ছিলেন তাঁরা। এই প্রথম শতাব্দী টেক্সট যেমন ব্যাখ্যা করেছে, বোধিসত্তারা একান্ত নিব্বানা লাভে আগ্রহী ছিলেন না!
বরং উল্টো সত্তার দারুণ বেদনাময় বিশ্ব জরিপ করেছেন এবং তারপরেও পরম আলোকন লাভের আকাঙ্ক্ষী হয়েও জন্ম-ও-মৃত্যুতে কম্পিত হননি। জগতের প্রতি করুণাবশতঃ তাঁরা বিশ্বের উপকারের লক্ষ্যে পথে নেমেছেন।
তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন: “আমরা বিশ্বের আশ্রয়ে, পৃথিবীর বিশ্রামের স্থান, বিশ্বের চূড়ান্ত মুক্তি, বিশ্বের দ্বীপ, বিশ্বের আলো আর বিশ্বের মুক্তির উপায়ের পরিচালকে পরিণত হব। ৩৪
প্রাচীন অ্যাক্সিয়াল যুগ আদর্শকে এক নতুন রূপে অনুবাদ করা সহানুভূতির নতুন মডেল ছিল বোধিসত্তা।
.
স্থানচ্যুতি ও পুনর্বাসনের নানা সমস্যার কারণে ইহুদি অ্যাক্সিয়াল যুগ সম্ভবত অকালেই অবলুপ্ত, অবসিত হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু অসাধারণ দ্বিতীয় তৃতীয় পর্যায়ের বিকাশের ভেতর দিয়ে পূর্ণতা পেয়েছে। সিই প্রথম শতাব্দীতে পবিত্র ভূমি রোমান সাম্রাজ্যের দখলে থাকার সময় দেশটি গোলযোগপূর্ণ ছিল। একদল রাজনৈতিক ইহুদি ধর্মান্ধ ভীষণভাবে রোমান শাসনের বিরোধিতা করে ৬৬ সিই- তে অবিশ্বাস্যভাবে চার বছর রোমান সোনাবাহিনীকে প্রতিরোধ করে রাখা এক বিদ্রোহের সংগঠিত করে। ইহুদি ডায়াসপোরায় এই বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ার ভয়ে রোমান কর্তৃপক্ষ নিষ্ঠুরভাবে তাকে দমন করে। ৭০ সিই-তে সম্রাট ভেস্পাসিয়ান জেরুসালেম দখল করে মন্দির মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেন। দ্বিতীয় ধ্বংস ছিল তিক্ত আঘাত, কিন্তু পেছনে তাকিয়ে এখন মনে হয় যে ডায়াসপোরার ইহুদিদের চেয়ে বেশি রক্ষণশীল প্যালেস্তাইনের ইহুদিরা আগে থেকেই এই বিপর্যয়ের জন্যে তৈরি ছিল। জেরুসালেম মন্দির কলুষিত হয়ে পড়েছে বিশ্বাস নিয়ে এসীন কামরান গোষ্ঠী ইতিমধ্যেই মূল ধারার সমাজ থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছিল; তাদের পরিশুদ্ধ সম্প্রদায়ই হবে আত্মার নতুন মন্দির। অ্যাক্সিয়াল যুগের পরবর্তী সময়ে বিকশিত প্রলয়বাদী ধার্মিকতাকে ধারণ করেছে তারা; এবং তাদের সময়ের সহিংসতাকে আত্মস্থঃ করে পবিত্র সত্যায়ন দিয়ে জরাথ্রুস্টীয়দের মতো সময়ের শেষে আলো ও অন্ধকারের সন্তানদের ভেতর অনুষ্ঠেয় মহাযুদ্ধের অপেক্ষায় দিন গুনছিল।
কিন্তু ফারিজিরা প্যালেস্তাইনের সবচেয়ে প্রগতিশীল ইহুদি ছিল, ইহুদি অ্যাক্সিয়াল যুগের সবচেয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও প্রাগ্রসর আধ্যাত্মিকতার বিকাশ ঘটিয়েছিল এরা। গোটা ইসরায়েল পুরোহিতদের পবিত্র জাতি হিসাবে পরিচিত এবং মন্দিরের মতোই সামান্য বাড়িতেও ঈশ্বরকে অনুভব করা সম্ভব বলে বিশ্বাস করত। দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটি বিষয়েও তিনি উপস্থিত আছেন; জাঁকাল আচার ছাড়াই ইহুদিরা তাঁকে স্মরণ করতে পারে। পশু বলীর বদলে বরং প্রেমময় ভালোবাসা দিয়ে নিত্যদিনের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে পারে। পরহিতই আইনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা ছিল। বাবিলোনিয়া থেকে প্যালেস্তাইনে পাড়ি জমানো র্যাবাই হিল্লেল (সি. ৮০ বিসিই-৩০ সিই) সম্ভবত সবসেরা ফারিজি ছিলেন। তাঁর চোখে আইনের কথা নয়, বরং তার চেতনাই তোরাহর মূল বিষয়; একে স্বর্ণ বিধিতে সারাংশ করেছেন তিনি। এক বিখ্যাত তালমুদিয় কাহিনীতে বলা হয়েছে যে, একদিন জনৈক মূর্তিপূজক র্যাবাইয়ের কাছে এসে সে একপায়ে দাঁড়ানো অবস্থায় তিনি তোরাহ শিক্ষা দিতে পারলে ইহুদি ধর্মে দীক্ষা নেওয়ার শপথ করেছিল। সহজ কণ্ঠে জবাব দিয়েছেন হিল্লেল: ‘তোমার কাছে যা ঘৃণ্য, সতীর্থ কারও সঙ্গে সেটা করো না। এটাই গোটা তোরাহ আর বাকিটা ব্যাখ্যা মাত্র। যাও, শেখো গিয়ে।’ ৩৫
ফারিজিরা তাদের চারপাশে বিস্ফোরিত হয়ে চলা সহিংসতায় অংশ নিতে আগ্রহী ছিল না। রোমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সময় হিল্লেলের মহান শিষ্য র্যাবাই ইয়োহানান বেন যাক্কাই তাদের নেতা ছিলেন। ইহুদিরা হয়তো রোমানদের পরাস্ত করতে পারবে না, উপলব্ধি করেছিলেন তিনি, তাই জাতীয় স্বাধীনতার চেয়ে ধর্মের রক্ষা ঢের বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে যুদ্ধের বিরুদ্ধে যুক্তি তুলে ধরেছিলেন। তাঁর পরামর্শ নাকচ হয়ে গেলে স্বয়ং তিনি নগর তোরণ পাহারায় থাকা ইহুদি ধর্মান্ধদের চোখে ধুলো দিতে কফিনে লুকিয়ে জেরুসালেম থেকে চলে যান। তারপর রোমান শিবিরে গিয়ে ভেস্পাসিয়ানের কাছে দক্ষিণ প্যালেস্তাইনের উপকূলে জাভনের পণ্ডিতদের সঙ্গে বাস করার অনুমতি চান। মন্দির ধ্বংসের পর ইহুদি ধর্মের নতুন রাজধানীতে পরিণত হয় জাভনে। রাব্বিনিয় ইহুদিবাদে ইহুদি অ্যাক্সিয়াল যুগ সাবালক হয়ে উঠেছিল।
স্বর্ণবিধি, সহানুভূতি এবং প্রেমময় দয়া ছিল এই নতুন ইহুদিবাদের কেন্দ্রীয় বিষয়; মন্দির ধ্বংস হতে হতে ফারিজিদের কেউ কেউ বুঝে গিয়েছিল যে ঈশ্বরের উপাসনার জন্যে তাদের মন্দিরের প্রয়োজন নেই, এই তালমুদিয় কাহিনী যা স্পষ্ট করে দিচ্ছে:
ব্যাপারটা ছিল এমন, আর. ইয়োহানা বেন যাক্কাই জেরুসালেম থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন এবং আর. জোশুয়া তাঁকে অনুসরণ করেছেন; মন্দিরের ভস্মীভূত ছাই দেখে বলে উঠেছিলেন: ‘আহা এখানেই ইসরায়েলের পাপের প্রায়শ্চিত্ত হতো, এখন শেষ হয়ে গেছে।’ আর. ইয়োহানান তখন বলেন, “শোক করো না, আমাদের মন্দিরের সমান প্রায়শ্চিত্ত রয়েছে, প্রেমময় কর্মকাণ্ড, যেমন বলা হয়েছে,”আমি প্রেম চাই, কোনও উৎসর্গ নয়”। ৩৬
দয়াই ছিল ভবিষ্যতের চাবিকাঠি; ইহুদিদের অবশ্যই যুদ্ধের কালের সহিংসতা ও বিভাজন থেকে দূরে সরে আসতে হবে এবং ‘এক দেহ এক মনের’৩৭ ঐক্যবদ্ধ সম্প্রদায় গড়ে তুলতে হবে। যখন দুই বা তিনজন ইহুদি একসঙ্গে বসে সুরে সুরে পাঠ করে, তখন তাদের ভেতর ঐশী সত্তা অবস্থান করেন।৩৯
১৩২ সিই-তে রোমানদের হাতে নিহত র্যাবাই আকিবা ‘প্রতিবেশীকে নিজের মতো করে ভালোবাসার’ নির্দেশনাটিকে ‘তোরাহর মহান নীতি বলে শিক্ষা দিয়েছিলেন। ঈশ্বরের প্রতিরূপে সৃষ্ট কোনও মানুষের প্রতি অসম্মান দেখানো র্যাবাইদের চোখে খোদ ঈশ্বরের প্রত্যাখ্যান এবং নাস্তিক্যবাদেরই শামিল ছিল। হত্যা ছিল অপবিত্রকরণ: ‘ধর্মশাস্ত্র আমাদের বলছে যে, মানুষের রক্তপাত যাই ঘটাক না কেন তাতে যেন স্বর্গীয় রূপেরই অসম্মান ঘটেছে বলে মনে করা হয়।৪১ একটি মানব জীবন ধ্বংস করা গোটা বিশ্বজগৎ-কে ধ্বংস করে দেওয়ারই সমান, আবার একটি জীবন বাঁচানো মানে গোটা মানবজাতিকেই রক্ষা করা,৪২ আমাদের এই শিক্ষা দিতে সময়ের সূচনায় ঈশ্বর মাত্র একজন মানুষ সৃষ্টি করেছিলেন। কাউকে অসম্মান করা—এমনকি কোনও দাস বা অ- ইহুদিকেও-হত্যাকাণ্ডের সমান, ঈশ্বরের ইমেজের কলঙ্কিত বিকৃতি। কেলেঙ্কারীর বিস্তার ঘটানো, অন্য কারও সম্পর্কে মিথ্যা কাহিনী ছড়ানোর মানে ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করা।” ধর্ম অন্য সকল মানুষের প্রতি স্বভাবগত সম্মানের চর্চার অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। স্বর্ণবিধির অনুশীলন এবং আপনার সতীর্থ মানুষটি যেই হোক না কেন তাকে সম্মান না করলে না করলে আপনি ঈশ্বরের উপাসনা করতে পারেন না।
রাব্বিনিয় ইহুদিবাদে অন্যান্য ঐতিহ্যের ধ্যানের মতো পড়াশোনা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আধ্যাত্মিক অন্বেষা ছিল এটা: পড়াশোনার সমার্থক শব্দ দারাশ-এর মানে ছিল ‘অনুসন্ধান করা’, ‘কোনও কিছুর পেছনে যাওয়া’। অন্য কারও বুদ্ধিবৃত্তিক ধারণার উপলব্ধি নয় বরং নতুন অন্তর্দৃষ্টির দিকে নিয়ে গেছে এটা। সুতরাং, রাব্বিনিয় মিদ্রাশ (‘তফসীর’) মূল পাঠের চেয়ে বেশ দূরে অগ্রসর হতে পারত, যা বলেনি তা আবিষ্কার করতে পারত, এবং একটি রাব্বিনিয় টেক্সটের ব্যাখ্যা অনুযায়ী সম্পূর্ণ নতুন তফসীর আবিষ্কার করতে পারত: ‘মোজেসের কাছে প্রকাশিত হয়নি এমন সব বিষয় র্যাবাই আকিবা ও তাঁর প্রজন্মের কাছে প্রকাশ করা হয়েছে।১৪৫
১৪৫ পাঠ আবার কর্ম থেকেও অবিচ্ছেদ্য ছিল। সংশয়বাদী মূর্তিপূজকের কাছে স্বর্ণবিধি ব্যাখ্যা করার সময় র্যাবাই হিল্লেল বলেছিলেন, ‘যাও, পড়ো গিয়ে।’ আপনি কেবল দৈনিন্দিন জীবনে চর্চার করলেই স্বর্ণবিধির সত্যি উন্মোচিত হবে।
পাঠ ছিল ঈশ্বরের সঙ্গে গতিশীল সাক্ষাৎ। র্যাবাই আকিবার কাছে একদিন এক লোক এসে র্যাবাই বেন আযযাই ধর্মশাস্ত্র ব্যাখ্যা করার সময় তাঁর চারপাশে আগুন ঝলক দিচ্ছে বলে জানাল। তদন্ত করতে গেলেন র্যাবাই আকিবা। বেন আযযাই কি তবে অতীন্দ্রিয় ঝোঁক বিশিষ্টকে নিজস্ব স্বর্গে আরোহণে অনুপ্রাণিতকারী ইযেকিয়েলের রথ দর্শন নিয়ে আলোচনা করছিলেন? না, জবাব দিয়েছেন বেন আযযাই।
আমি শুধু তোরাহর কথাগুলো পরস্পরের সঙ্গে জুড়ে দিচ্ছিলাম, এবং সেগুলো আবার ধর্মগুরুদের বাণীর সঙ্গে যুক্ত করছিলাম, ধর্মগুরুদের কথাগুলো আবার জুড়ে দিচ্ছিলাম লিখিত বিবরণীর সঙ্গে আর তখন শব্দগুলো সিনাইতে অবতীর্ণ হওয়ার সময়ের মতো পুলকিত হয়ে উঠছিল এবং আদি উচ্চারণের মতোই সুমধুর ছিল সেগুলো।৪৬
শাস্ত্রগ্রন্থ কোনও রুদ্ধ কিতাব ছিল না আর প্রত্যাদেশও দূরবর্তী সময়ে ঘটে যাওয়া কোনও ঐতিহাসিক ঘটনা ছিল না। একজন ইহুদি যতবার টেক্সটের মুখোমুখি হয়, নিজেকে এর প্রতি উন্মুক্ত করে দেয় এবং নিজের অবস্থায় একে প্রয়োগ করে, ততবার তার নবায়ন ঘটে। এই গতিশীল দর্শন গোটা বিশ্বে আগুন ধরিয়ে দিতে পারে।
সুতরাং, ‘সনাতন’ বিশ্বাস বলে কিছু ছিল না। কেউই—খোদ ঈশ্বরের কণ্ঠও নয়-ইহুদিকে কি ভাবতে হবে বাৎলে দিতে পারে না। এক সূচনামূলক কাহিনীতে র্যাবাই এলিয়েজার বেন হিরানাস সহকর্মীদের সঙ্গে ইহুদি বিধান সম্পর্কিত কঠিন বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন। তাদের নিজের মতের স্বপক্ষে আনতে পারছিলেন না বলে কোনও অলৌকিক ঘটনার ভেতর দিয়ে সাহায্য করার জন্যে ঈশ্বরের কাছে নিবেদন করলেন। একটা শুটি গাছ আপনাআপনি চার শো কিউবিট দূরে সরে গেল; একটা নালার পানি গড়িয়ে গেল পেছনে; পাঠগৃহের দেওয়াল এমন নাটকীয়ভাবে কেঁপে উঠল যে মনে হলো বুঝি দালানটাই ধসে পড়বে। কিন্তু বেন এলিয়েজারের সহকর্মীরা মুগ্ধ হলেন না। অবশেষে মরিয়া হয়ে নিজের পক্ষে ‘স্বর্গীয় বাণী’ (বাত কোল) কামনা করলেন তিনি। নিমেষে স্বর্গীয় কণ্ঠে ঘোষিত হলো: ‘র্যাবাই এলিয়েজারের সঙ্গে তোমাদের তর্ক কি নিয়ে? আইনি সিদ্ধান্ত সবসময় তাঁর মতানুযায়ী হবে।’ কিন্তু র্যাবাই জোশুয়া উঠে দাঁড়িয়ে দ্বিতীয় পুস্তক থেকে পাঠ করলেন : “ইহা স্বর্গে নহে।’ ঈশ্বরের শিক্ষা আর স্বর্গীয় বলয়ে সীমাবদ্ধ ছিল না। সিনাই পাহাড়ে ঘোষিত হয়েছিল বলেই প্রতিটি ইহুদির অবিচ্ছেদ্য অধিকারে চলে এসেছে। এখন আর তা ঈশ্বরের অধিকারে নেই, ‘সুতরাং, বাত কোল-এর দিকে মনোযোগ দিচ্ছি না আমরা।’
পরম বাস্তবতা দুর্জ্জেয় ও অনির্বচনীয় হওয়ার সেই অ্যাক্সিয়াল নীতিই গ্রহণ করেছিলেন র্যাবাইরা। ঈশ্বরের প্রসঙ্গে শেষ কথা বলার নেই কেউ। ঈশ্বরকে প্রকাশ করার যেকোনও প্রয়াসই ব্লাসফেমাস হয়ে ওঠার মতো যারপরনাই অপর্যাপ্ত হওয়ার জোরাল স্মারক হিসাবে ইহুদিদের উপর ঈশ্বরের নাম উচ্চারণে নিষেধাজ্ঞা ছিল। র্যাবাইরা এমনকি ইসরায়েলিদের তাদের কথা স্রেফ ত্রুটিপূর্ণ হতে পারে বলে প্রার্থনায় ঘনঘন ঈশ্বরের প্রশংসা করার ব্যাপারেও সতর্ক করে দিয়েছিলেন। পৃথিবীতে ঈশ্বরের উপস্থিতির কথা বলার সময় ঈশ্বর আমাদের যেসব গুণ দেখতে দিয়েছেন সেগুলো থেকে সবসময় আমাদের কাছে দুর্বোধ্য থেকে যাওয়া স্বর্গীয় গুণের পার্থক্য করার বেলায় সতর্ক ছিলেন তাঁরা। তাদের অনুভূত বাস্তবতা পরমেশ্বরের (গডহেড) মূল সত্তার সঙ্গে না মেলার অবিরাম স্মারক হিসাবে ঈশ্বরের বদলে বরং ঈশ্বরের ‘প্রতাপ’ (কাভোদ); ‘শেকিনা’, স্বর্গীয় উপস্থিতি, এবং ‘পবিত্র আত্মা’র মতো শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছেন। কোনও ধর্মতত্ত্বই পরিপূর্ণ হতে পারে না। র্যাবাইরা বারবার পরামর্শ দিয়েছেন যে, সিনাই পাহাড়ে প্রতিটি ইসরায়েলি ঈশ্বরকে ভিন্নভাবে উপলব্ধি করেছে। বলা হয়ে থাকে, ঈশ্বর নিজেকে প্রতিটি মানুষের সঙ্গে ‘প্রত্যেকের উপলব্ধি অনুযায়ী ৮ খাপ খাইয়ে নিয়েছেন। আমরা যাকে ‘ঈশ্বর’ বলি, সবার কাছে তিনি এক নন। ব্যক্তিত্ব ঈশ্বরের ধারণার ক্ষেত্রে প্রভাবিত করায় প্রত্যেক পয়গম্বরই ভিন্ন ‘ঈশ্বর কে অনুভব করেছেন। এই গভীর মিতভাষ ইহুদি ধর্মতত্ত্ব ও অতীন্দ্ৰিয়বাদকে বৈশিষ্ট্যায়িত করে চলবে।
প্রথম শতাব্দী সূচিত অন্য একটি আন্দোলন ক্রিশ্চানিটি ইহুদি হওয়ার নুতন উপায়ের খোঁজ করেছে। আনুমানিক ৩০ সিই-তে রোমানদের হাতে ক্রুশবিদ্ধ হয়ে নিহত জনৈক গালিলিয় ওঝার জীবন ও মৃত্যুর উপর ভিত্তি করে এটা গড়ে উঠেছে; অনুসারীরা তিনি মৃত্যু থেকে পুনরুজ্জীবিত হয়েছেন বলে দাবি করেছে। নাযারেথের জেসাসই দীর্ঘ প্রতীক্ষিত মেসায়া ছিলেন বলে বিশ্বাস করত তারা, যিনি পৃথিবীর বুকে ঈশ্বরের রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্যে অচিরেই আবার প্রতাপের সঙ্গে ফিরে আসবেন। ‘ঈশ্বরের পুত্র,’ ছিলেন তিনি; ইহুদি পরিভাষায় একথা দিয়ে ঈশ্বর কর্তৃক বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং তাঁর সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক উপভোগকারী কাউকে বোঝানো হতো। প্রাচীন রাজকীয় ধর্মতত্ত্ব ইসরায়েলের রাজাদের ইয়াহওয়েহর পুত্র ও ভৃত্য হিসাবে দেখেছে; জেসাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দ্বিতীয় ইসায়ার দুর্দশাগ্রস্ত দাসও তাঁর সতীর্থ মানুষের জন্যে অপদস্থ হয়েছিলেন এবং ঈশ্বর কর্তৃক অসাধারণ উচ্চস্থানে উন্নীত হয়েছিলেন ৪৯ একটি নতুন ধর্ম প্রবর্তনের কোনও ইচ্ছা জেসাসের ছিল না এবং গভীরভাবে ইহুদি ছিলেন তিনি। গস্পেলে লেখা তাঁর বহু বাণী ফারিজিদের শিক্ষার অনুরূপ। হিল্লেলের মতো স্বর্ণবিধির একটি ভাষ্য শিক্ষা দিয়েছেন তিনি।° র্যাবাইদের মতো ঈশ্বরকে সম্পূর্ণ হৃদয় ও আত্মা দিয়ে এবং প্রতিবেশীকে নিজের মতো ভালোবাসার নির্দেশনাই তোরাহর সবচেয়ে বড় মিত্যভোত বলে বিশ্বাস করতেন তিনি। ৫১
ক্রিশ্চান ধর্মকে জেন্টাইল ধর্মে পরিণতকারী প্রথম ক্রিশ্চান লেখক হলেন পল; জেসাস মেসায়াও, মনোনীত জন (গ্রিকে, ক্রিস্তোস) বলে বিশ্বাস করতেন তিনি। সিলিসিয়ার তরাসের একজন ডায়াসপোরা ইহুদি ছিলেন পল; সাবেক ফারিজি হওয়ায় লিখতেন কোইন গ্রিকে। দুটি শব্দকে মিলিয়ে গোয়িম-বিদেশী জাতিসমূহ—দের প্রতি তাঁর একটা মিশন রয়েছে বলে বিশ্বাস করে বসেছিলেন পল: জেসাস ইহুদিদের পাশাপাশি জেন্টাইলদেরও মেসায়া ছিলেন। সর্বজনীন-’অপরিমেয়’-অ্যাক্সিয়াল যুগ দর্শন ছিল পলের। ঈশ্বর ‘সকলের জন্যে সহানুভূতি’ বোধ করেছেন। জেসাসের মৃত্যু ও পুনরুত্থান গোটা মানবজাতির প্রতি উন্মুক্ত এক নতুন ইসরায়েলের সৃষ্টি করেছে বলে বিশ্বাস করেছিলেন তিনি।
মধ্য পঞ্চাশের দশকে জেসাসের পরলোকগমনের প্রায় পঁচিশ বছর পর মেসিদোনিয়ার ফিলিপির ধর্মান্তরিতদের উদ্দেশে লেখার সময় একেবারে প্রথম থেকেই ক্রিশ্চানরা জেসাসের মিশনকে কেনোসিস হিসাবে দেখেছে বলে তুলে ধরা আদি ক্রিশ্চান স্তোত্রগীতির উদ্ধৃতি দিয়েছেন পল।৫২ জেসাস অন্য সব মানুষের মতোই ঈশ্বরের প্রতিরূপ থাকলেও, এই উচ্চ মর্যাদা আঁকড়ে থাকেননি, এযুক্তি তুলে ধরে স্তোত্রগীত শুরু হয়েছে,
বরং দাসের অবস্থা ধারণ করার জন্যে
নিজেকে শূন্য[হিউতোন ইকেনোসেন] করেছেন…
এবং এমনকি ক্রুশে মৃত্যুকে বেছে
নেওয়ার সময়ও ছিলেন বিনয়ী।
কিন্তু এই বিনয়ী ‘অবনমনে’র কারণেই ঈশ্বর তাঁকে উচ্চতর মর্যাদায় উন্নীত করেছেন এবং তাঁকে সর্বোচ্চ উপাধী কিরিওস (‘প্রভু’), পিতা ঈশ্বরের মহিমা দেওয়া হয়েছে। এই দৃষ্টিভঙ্গি দুর্দশাগ্রস্ত মানব জাতির জন্যে স্বেচ্ছায় নিজের নিব্বানার পরম আনন্দ একপাশে ঠেলে দেওয়া বোধিসত্তার আদর্শ থেকে খুব বেশি ভিন্ন ছিল না। ভালোবাসার কারণে মানবজাতিকে রক্ষা করতে বেদনাদায়ক ‘অবতরণ’ করা ঈশ্বরের অবতার হিসাবে জেসাসকে দেখবে ক্রিশ্চানরা। কিন্তু নিজের অবতারবাদের মতবাদ ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে স্তোত্রগীত উদ্ধৃত করেননি পল। সাবেক ফারিজি বলে তিনি জানতেন যে, ধর্মীয় সত্যকে কাজে পরিণত করতে হয়। তাই স্তোত্রের সঙ্গে ফিলিপির ক্রিশ্চানদের প্রতি নির্দেশনাও জুড়ে দিয়েছিলেন: ‘খ্রীষ্ট যীশুতে যে ভাব ছিল, তাহা তোমাদিগতেও হউক।’ তাদের অবশ্যই ‘এক প্রাণ এবং এক ভাববিশিষ্ট’৫৩ হয়ে ভালোবাসায় ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
প্রতিযোগিতায় কিম্বা অনর্থক দর্পে কিছুই করিও না, বরং নম্রভাবে প্রত্যেক জন আপনা হইতে অন্যকে শ্রেষ্ঠ জ্ঞান কর; এবং প্রত্যেক জন আপনার বিষয়ে নয়, কিন্তু পরের বিষয়ে লক্ষ্য রাখ।৫৪
এভাবে অন্যদের নিঃস্বার্থ সম্মান দিলে জেসাসের কোনোসিসের মিথোস উপলব্ধি করতে পারবে তারা।
ক্রিশ্চানদের আদর্শ নজীর ছিলেন জেসাস। তাঁকে অনুকরণ করে ঈশ্বরের ‘পুত্র’ হিসাবে উন্নত জীবনের অভিজ্ঞতা লাভ করবে তারা। নতুন গির্জার আচারে দীক্ষা নেওয়ার সময় খৃস্টের সঙ্গে সমাধিতে প্রতীকী অবতরণ করেছে তারা, মৃত্যুর সঙ্গে একাত্ম হয়ে এখন ভিন্ন ধরনের জীবন যাপন করছে।৫৫ লৌকিক সত্তাকে পেছনে ফেলে কিরিওসের উন্নত মানবসত্তায় অংশ নেওয়ার অভিজ্ঞতা লাভ করবে তারা।৫৬ স্বয়ং পল তাঁর সীমিত ব্যক্তি সত্তাকে ছাপিয়ে যাওয়ার দাবি করেছেন: ‘আমি আর জীবিত নই, কিন্তু খ্রীষ্টই আমাতে জীবিত আছেন।১৫৭ এক নতুন অ্যাক্সিয়াল যুগ আদলে ভালোবাসার গুণে প্রবল প্রাচীন আদিআদর্শ ধর্ম ছিল এটা। পরে ক্রিশ্চানরা শেষপর্যন্ত ধর্মবিশ্বাসকে আস্থার সঙ্গে মিলিয়ে ফেলবে। কিন্তু পলের পক্ষে সেটা উপলব্ধি করা কষ্টকর হতো। পলের কাছে ধর্ম ছিল কোনোসিস ও ভালোবাসা। পলের চোখে এদুটো অবিচ্ছেদ্য ছিল। পাহাড় টলিয়ে দেওয়ার মতো বিশ্বাস আপনার থাকতে পারে, কিন্তু ভালোবাসা ছাড়া তা অর্থহীন, যার জন্যে প্রয়োজন অহমবাদের অব্যাহত বিসর্জন :
প্রেম চিরসহিষ্ণু, প্রেম মধুর, ঈর্ষা করে না, প্রেম আত্মশ্লাঘা করে না, গৰ্ব্ব করে না, অশিষ্টাচরণ করে না, স্বার্থ চেষ্টা করে না, রাগিয়া উঠে না, অপকার গণনা করে না, কিন্তু সত্যের সহিত আনন্দ করে; সকলই বহন করে, সকলই বিশ্বাস করে, সকলই প্রত্যাশা করে, সকলই ধৈর্য্য পূর্ব্বক সহ্য করে।
ভালোবাসা আত্ম-গুরুত্বে ফেটে পড়ে না, সত্তার স্ফীত ধারণায় আঁকড়ে থাকে না, বরং তা শূন্য, আত্মবিস্মৃত ও অন্যের প্রতি সীমাহীন সম্মান দেখায়।
৭০ থেকে আনুমানিক ১০০ সিই সময়কালে লেখা গস্পেলগুলো পলের মতই অনুসরণ করেছে। এগুলো জেসাসকে ট্রিনিটি বা আদি পাপের মতো পরে চলতি প্রবণতা হয়ে ওঠা মতবাদ শিক্ষা দিচ্ছেন বলে তুলে ধরেনি। তার বদলে মোজি যাকে জিয়ান আই বলতেন-’সকলের জন্যে উদ্বেগ-তারই চর্চা করতে দেখিয়েছে এসব। তাঁর কোনও কোনও সমসাময়িককে হতাশ করে জেসাস নিয়মিত ‘পাপীদের’-পতিতা, কুষ্ঠরোগী, মৃগীরোগী আর রোমকদের পক্ষে কর আদায়ের কারণে সমাজচ্যুত-সঙ্গে মিশতেন। তাঁর আচরণ প্রায়ই বুদ্ধের ‘অপিরমেয়’র প্রেরণের কথা মনে করিয়ে দেয়, কেননা তিনিও যেন তাঁর উদ্বেগের আওতা থেকে কাউকেই বাদ দেননি। তিনি জোর দিয়েছেন যে, তাঁর অনুসারীরা যেন অন্যদের বিচার না করে। যারা বাস্তব সহানুভূতির আচরণ করেছে, ক্ষুধার্তকে খাবার দিয়েছে এবং অসুস্থ বা কারাগারে আটক লোকদের দেখতে গেছে তাদেরই রাজ্যে স্থান দেওয়া হবে। তাঁর অনুসারীদের দরিদ্রদের ভেতর সম্পদ বিলিয়ে দিতে হবে।৬১ ভালো কাজের জন্যে তারা গর্ব করবে না, বরং ভদ্র, আত্ম-শূন্যকরণের জীবন যাপন করবে। ৬২
মানুষ হিসাবে জেসাস অহিংসাবাদীও ছিলেন বলে মনে হয়। ‘তোমরা শুনিয়াছ, উক্ত হইয়াছিল, “চক্ষুর পরিশোধে চক্ষু ও দত্তের পরিশোধে দত্ত,” কিন্তু আমি তোমাদিগকে বলিতেছি, তোমরা দুষ্টের প্রতিরোধ করিও না; বরং যে কেহ তোমার দক্ষিণ গালে চড় মারে, অন্য গাল তাহার দিকে ফিরাইয়া দেও। গ্রেপ্তার হওয়ার পর অনুসারীদের তাঁর পক্ষে লড়াই করতে দেননি তিনি: ‘যে সকল লোক খড়গ ধারণ করে, তাহারা খড়গ দ্বারা বিনষ্ট হইবে।১৬৪ জল্লাদদের ক্ষমা করেই মারা গিয়েছিলেন তিনি। তাঁর সবচেয়ে চমকপ্রদ—পণ্ডিতরা বলেন যে, সম্ভবত সবচেয়ে খাঁটি-নির্দেশনায় সকল ঘৃণাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে:
তোমরা শুনিয়াছ, উক্ত হইয়াছিল, “তোমরা প্রতিবেশীকে প্রেম করিবে,” এবং “তোমার শত্রুকে দ্বেষ করিবে”, কিন্তু আমি তোমাদিগেকে বলিতেছি, তোমরা আপন আপন শত্রুদিগকে প্রেম করিও, এবং যাহারা তোমাদিগকে তাড়না করে, তাহাদের জন্য প্রার্থনা করিও; যেন তোমরা আপনাদের স্বর্গস্থ পিতার সন্তান হও, কারণ তিনি ভাল মন্দ লোকদের উপরে সূর্য উদিত করেন, এবং ধার্ম্মিক অধার্মিকগণের উপরে জল বর্ষাণ। কেননা যাহারা তোমাদিগকে প্রেম করে, তাহাদিগকেই প্রেম করিলে তোমাদের কি পুরস্কার হইবে? কর গ্রাহীরাও কি সেই মত করে না? আর তোমরা যদি কেবল আপন আপন ভ্রাতৃগণকে মঙ্গলবাদ কর, তবে অধিক কি কর্ম্ম কর? পরজাতীয়েরাও কি সেইরূপ করে না? অতএব তোমাদের স্বর্গীয় পিতা যেমন সিদ্ধ, তোমরাও তেমনি সিদ্ধ হও। ৬৬
সম্ভবত প্রবল ধাক্কায় দর্শকদের নতুন দর্শনে প্রবেশ করানোর লক্ষ্যে শত্রুদেরও ভালোবাসিবে’ এই আপাত স্ববিরোধী কথাটি নির্মিত ছিল; এর জন্যে দরকার ছিল কোনোসিস, কারণ প্রতিদানের কোনও আশাহীন কোনও জায়গাতেই আপনার উদারতা দেখানোর ছিল।
হিজাজের জনগণের কাছে পয়গম্বর মুহাম্মদ (স) স্বর্গীয় অনুপ্রাণিত গ্রন্থ কুরা’ন নিয়ে এলে সপ্তম শতাব্দীর আরবে অ্যাক্সিয়াল যুগের চূড়ান্ত বিকাশ ঘটে। মুহাম্মদ (স) অবশ্যই কখনও অ্যাক্সিয়াল যুগের কথা শোনেননি, কিন্তু হয়তো ধারণাটুকু উপলব্ধি করতেন। কুরা’ন নিজেকে নতুন প্রত্যাদেশ হিসাবে দাবি করেনি, বরং মানবজাতির পিতা, যিনি আবার প্রথম পয়গম্বর, আদমকে দেওয়া বাণীরই পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে। এখানে জোরের সঙ্গে বলা হয়েছে যে, মুহাম্মদ (স) অতীতের পয়গম্বরদের প্রতিস্থাপিত করতে আবির্ভূত হননি, বরং তোরাহ এবং গস্পেলের আগে-অর্থাৎ ঈশ্বরের ধর্ম যুদ্ধমান বিভিন্ন গোষ্ঠীতে ভাগ হয়ে যাওয়ার আগে—জীবন যাপন করে যাওয়া আব্রাহামের আদি ধর্মে প্রত্যাবর্তন করতে চেয়েছেন।৬৭ ঈশ্বর পৃথিবীর বুকে প্রতিটি জাতির কাছে বার্তাবাহক পাঠিয়েছেন। এবং আরবরা বুদ্ধ বা কনফুসিয়াসের কথা জানলে কুরা’ন তাঁদের শিক্ষাকেও সমর্থন জানাত বলে বর্তমান কালের মুসলিম পণ্ডিতরা যুক্তি দেখিয়েছেন। কুরা’নের মৌলিক বার্তা কোনও মতবাদ নয়-প্রকৃতপক্ষে, এটা ধর্মতাত্ত্বিক যেকোনও ধরনের আঁচ-অনুমানের বেলায় সমালোচনামুখর, যাকে যান্নাহ বা ‘স্বপ্রাণোদিত অনুমান’ বলা হয়েছে-বরং বাস্তব সমবেদনার নির্দেশ। অন্যের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে স্বার্থপরের মতো ব্যক্তিগত সম্পদ গড়ে তোলা ভুল, আপনার সম্পদ ন্যায্যভাবে ভাগ করা এবং দরিদ্র ও দুর্বল লোকজনের সঙ্গে সম্মানের সঙ্গে আচরণ করা হয় এমন একটি ন্যায়বিচার ভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলাই মঙ্গলজনক।
সকল মহান অ্যাক্সিয়াল সাধুর মতো এক সহিংস সমাজের মানুষ ছিলেন মুহাম্মদ (স), যখন প্রাচীন মূল্যবোধসমূহ ভেঙে পড়ছিল। গোত্রীয় সংঘাতের ভয়াল চক্রে আটকা পড়েছিল আরব, যেখানে একটি প্রতিশোধের ঘটনা অনিবার্যভাবে অন্য প্রতিশোধের সৃষ্টি করত। অর্থনৈতিক ও বস্তুগত প্রগতিরও সময় ছিল এটা। আরবীয় পেননিসূলার কর্কশ পরিবেশ ও জলবায়ু আরবদের বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল, কিন্তু সিই ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষদিকে মক্কা নগরী এক বৃদ্ধিশীল বাজার অর্থনীতি গড়ে তুলেছিল, এর বণিকরা পারস্য, সিরিয়া আর বাইযান্টিয়ামের উন্নত অঞ্চলে পণ্যবাহী কারাভান নিয়ে যেত। স্বয়ং মুহাম্মদও (স) সফল ব্যবসায়ী ছিলেন, এক খুনে পুঁজিবাদী ও চড়া : অর্থনীতিতে মক্কাবাসীদের সামনে নিজের বাণী তুলে ধরেছিলেন তিনি। মক্কাবাসীরা এখন তাদের অবিশ্বাস্য কল্পনার চেয়েও ধনী হয়ে উঠলেও সম্পদের উন্মত্ত প্রতিযোগিতায় গোত্রের দুর্বল সদস্যদের যত্ন নেওয়ার দাবি ছিল যেখানে সেই প্রাচীন গোত্রীয় মূল্যবোধ বিস্মৃত হয়ে যাওয়া হয়েছে। ব্যাপক বিস্তৃত অস্থিরতা ছিল, যাযাবর জীবনে উপকারে এলেও প্রাচীন প্যাগান বিশ্বাস এখন আর আরবদের পরিবর্তিত অবস্থায় কোনও কাজে আসছিল না।
আনুমানিক সিই ৬১০ সালে মুহাম্মদ (স) তাঁর প্রথম প্রত্যাদেশ লাভ করার সময় বহু আরব বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল যে তাদের দেবনিচয়ের পরম ঈশ্বর আল্লাহ* এবং ইহুদি ও ক্রিশ্চানদের ঈশ্বর আসলে একই। প্রকৃতপক্ষে আরবের ক্রিশ্চানরা প্যাগানদের পাশাপাশি প্রায়শঃই সাধারণভাবে মক্কায় আল্লাহর উপাসনালয় হিসাবে বিবেচিত কাবায় হজ্জ তীর্থযাত্রা করত। মুহাম্মদ (স) তাঁর অনুসারীদের প্রথম যে কাজগুলো করতে বলেছিলেন তার একটি ছিল ইহুদি ও ক্রিশ্চানদের-এখন যাদের ঈশ্বরের উপাসনা করতে যাচ্ছে তারা শহর জেরুসালেমের দিকে মুখ করে প্রার্থনা করা। নিজস্ব বৈধ প্রত্যাদেশ লাভ করেছিল বলে ইচ্ছা না করলে কোনও ইহুদি বা ক্রিস্টানের নতুন আরব ধর্মে যোগ দেওয়ার প্রয়োজন-এমনকি আমন্ত্রণও জানানো হয়নি। কুরান-এর আল্লাহ মুসলিমদের বলেছেন, তাদের অবশ্যই আহল আল-কিতাব বা ‘অতীতের প্রত্যাদিষ্ট জাতি’র সঙ্গে সম্মান ও সৌজন্যের সঙ্গে আচরণ করতে হবে:
তোমরা কিতাবিদের সঙ্গে তর্কবিতর্ক করবে, কিন্তু সৌজন্যের সাথে, তবে ওদের মধ্যে যারা সীমা লঙ্ঘন করে তাদের সঙ্গে নয়। আর বলো, ‘আমাদের ওপর ও তোমাদের ওপর যা অবতীর্ণ হয়েছে তাতে আমরা বিশ্বাস করি। আর আমাদের উপাস্য ও তোমাদের উপাস্য তো একই, আর তারই কাছে আমরা আত্মসমর্পণ করি।’ ৬৮
মুহাম্মদের (স) পরলোকগমনের দীর্ঘদিন পরেও মুসলিম সাম্রাজ্যের নীতি তাই ছিল। সিই অষ্টম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের আগপর্যন্ত ইসলামে ধর্মান্তরকরণ উৎসহিত করা হয়নি। ইসলাম আব্রাহামের ছেলে ইশমায়েলের বংশধর আরবদের ধর্ম বলে মনে করা হয়, যেমন ইহুদি ধর্ম ছিল ইসাক ও জাকবের সন্তানদের আর ক্রিশ্চানিটি গস্পেলের অনুসারীদের জন্যে। আজকের দিনে কোনও কোনও মুসলিম ইহুদিবাদ ও ক্রিশ্চান ধর্মকে হেয় করে, এবং কোনও কোনও চরমপন্থী গোটা বিশ্বকে ইসলামের জন্যে অধিকার করে নেওয়ার মুসলিমদের দায়িত্বের কথা বলে, কিন্তু এসব শত শত বছরের পবিত্র ঐতিহ্যের লঙ্ঘন নতুন উদ্ভাবন।
শেষপর্যন্ত মুহাম্মদের (স) ধর্মকে ইসলাম (‘আত্মসমর্পণ’) হিসাবে আখ্যায়িত করা হবে; ‘মুসলিম’ হচ্ছেন সেই নারী-পুরুষ যারা তাদের জীবনকে আল্লাহর কাছে সমস্ত সত্তা দিয়ে সমর্পণ করেছেন। এটা আমাদের চট করে অ্যাক্সিয়াল যুগে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। মুহাম্মদ (স) তাঁর অনুসারীদের দিনে কয়েক বার প্রার্থনায় (সালাত) নত হতে বললে রাজতন্ত্রকে অস্বীকার করা এবং দাসের মতো পাথরে মাথা ঠোকাকে অসম্মানজনক মনে করা আরবদের পক্ষে সেটা মানা কঠিন ছিল। কিন্তু যৌক্তিকের চেয়ে আরও গভীর স্তরে ইসলাম কি চায় বোঝাতেই দৈহিক ভঙ্গি প্রণয়ন করা হয়েছিল: অস্থির, অলঙ্কারময় এবং অবিরাম নিজের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে চলা অহমকে অতিক্রম করে যাওয়া।
[* আরবীতে আল্লাহ মানে স্রেফ “ঈশ্বর’।]
মুসলিমদের আয়ের একটি নির্দিষ্ট অংশ দরিদ্রদের বিলিয়ে দেওয়ারও প্রয়োজন ছিল। এই যাকাত (‘পরিশুদ্ধকরণ’) তাদের হৃদয়কে স্বভাবগত স্বার্থপরতা থেকে শুদ্ধ করে তুলবে। এটা মনে হয় যে প্রথমে মুহাম্মদের (স) ধর্মকে অস্পষ্ট শব্দ তাযাকা (যাকাতের সঙ্গে সম্পর্কিত) নামে অভিহিত করা হতো, যার অনুবাদ করা কঠিন: ‘পরিমার্জনা’, ‘বদান্যতা’, ও ‘সৌজন্য’—এসবই ইংরেজি সমমান হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে, কিন্তু কোনওটাই যথেষ্ট নয়। তাযাকা বলে মুসলিমদের সহানুভূতি ও বদান্যতার চাদরে নিজেদের আবৃত্ত করার কথা ছিল। যত্নশীল ও দায়িত্ববান চেতনা গড়ে তুলতে অবশ্যই বুদ্ধিমত্তার চর্চা করতে হবে, তাদের যা কিছু আছে সবই আল্লাহর সৃষ্টির জন্যে বিলিয়ে দিতে সক্ষম করে তুলবে সেটা। অবশ্যই যত্নের সঙ্গে প্রকৃতিতে ‘নিদর্শনসমূহ’ (আয়াত) পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে মানুষের প্রতি আল্লাহর উদার আচরণের প্রতি লক্ষ রাখতে হবে তাদের:
তিনি সৃষ্ট জীবের জন্য পৃথিবীকে বিছিয়ে দিয়েছেন। সেখানে রয়েছে ফলমূল, খেজুর গাছে নতুন কাঁদি, খোসায় ঢাকা শস্যদানা আর সুগন্ধি গাছগাছড়া।
সৃষ্টির রহস্য নিয়ে ধ্যান করার ভেতর দিয়ে মুসলিমদের অবশ্যই একই ধরনের ঔদার্যের আচরণ করা শিখতে হবে। আল্লাহর দয়াতেই বিশৃঙ্খলা ও বন্ধ্যাত্বের জায়গায় শৃঙ্খলা ও ফলপ্রসুতার অস্তিত্ব রয়েছে। মুসলিমরা তাঁর নজীর অনুসরণ করলে তাদের নিজস্ব জীবনও বদলে গেছে বলে আবিষ্কার করবে। স্বার্থপর বর্বরতায় বৈশিষ্ট্যায়িত না হয়ে আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধতা অর্জন করবে।
নতুন ধর্ম এর সাম্যবাদী চেতনার অনুমোদন না দেওয়া মক্কার প্রতিষ্ঠানকে ক্রুদ্ধ করে তোলে; সবচেয়ে সফল পরিবারগুলো মুসলিমদের উপর নির্যাতন চালিয়েছে, পয়গম্বরকে হত্যার প্রয়াস পেয়েছে এবং শেষপর্যন্ত মুহাম্মদ (স) ও সত্তরটি মুসলিম পরিবার উত্তরে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার দূরে মদিনায় পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। প্যাগান আরবের প্রেক্ষাপটে, যেখানে রক্তের সম্পর্কই সবেচেয়ে পবিত্র মূল্যবোধ ছিল, সেখানে এটা ব্লাসফেমির শামিল ছিল। আত্মীয়স্বজন ছেড়ে সম্পর্কহীন কোনও গোত্রের সঙ্গে বসবাস করার মতো ব্যাপার ছিল অশ্রুতপূর্ব। অভিবাসনের (হিজরা) পর মুসলিমরা আরবের সবচেয়ে শক্তিশালী শহর মক্কার বিরুদ্ধে যুদ্ধের সম্ভাবনার মুখোমুখি হয়। বেঁচে থাকার জন্যে পাঁচ বছর ধরে মরিয়া হয়ে যুদ্ধ চালিয়ে গেছে তারা। প্রাক ইসলামি আরবে যোদ্ধারা ছিল নিষ্ঠুর। মুসলিম সম্প্রদায়কে পরাস্ত করতে পারলে মক্কাবাসীরা নিশ্চিতভাবেই প্রতিটি পুরুষকে হত্যা করে নারী ও শিশুদের দাসে পরিণত করত।
এই অন্ধকার সময়ে কুরানের কোনও কোনও প্রত্যাদেশ মুসলিমদের যুদ্ধক্ষেত্রের আচরণ শিক্ষা দিয়েছে। ইসলাম অহিংসার ধর্ম ছিল না, কিন্তু কুরান কেবল আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধেরই অনুমোদন দিয়েছে। যুদ্ধকে কুরান ‘ভয়ঙ্কর অশুভ’ হিসাবে নিন্দা করেছে ও মুসলিমদের উপর বৈরিতা শুরু করার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। আগ্রাসন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ; আগাম কোনও আক্রমণ করা চলবে না। তবে অনেক সময় শোভন মূল্যবোধ রক্ষার খাতিরে দুঃখজনকভাবে যুদ্ধ করা অনিবার্য হয়ে পড়ে। আক্রান্ত হলে নিজেকে রক্ষার অনুমতি রয়েছে এবং যুদ্ধ চলার সময় মুসলিমদের অবশ্যই পূর্ণ আন্তরিকতার সঙ্গে লড়তে হবে, পরিস্থিতিকে আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে শত্রুপক্ষকে সম্মত করতে হবে। কিন্তু প্রতিপক্ষ শান্তির প্রস্তাব মেনে নেওয়ামাত্র বৈরিতার অবসান ঘটাতে হবে এবং মুসলিমদের অবশ্যই যেকোনও শর্ত মেনে নিতে হবে।৭২ বিরোধের মোকাবিলার জন্যে যুদ্ধই সেরা উপায় নয় বরং আলোচনায় বসে শত্রুকে ‘সবচেয়ে উদার উপায়ে’ যতক্ষণ সম্ভব যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করাই শ্রেয়। ক্ষমা করে দেওয়া ও ভুলে যাওয়া ভালো, ‘যেহেতু তার পথ ছেড়ে যে বিপথে যায় তার সম্মন্ধে তোমার প্রতিপালক ভালো করেই জানেন। ৭৩
জিহাদ শব্দটি ‘পবিত্র যুদ্ধ’ বোঝায়নি। এর প্রাথমিক অর্থ ছিল ‘সংগ্রাম’। নিষ্ঠুর, বিপজ্জনক পৃথিবীতে আল্লাহর ইচ্ছা বাস্তবায়ন করা কঠিন, এবং মুসলিমদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও আধ্যাত্মিক সকল ক্ষেত্রে প্ৰয়াস পেতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অনেক সময় যুদ্ধ করা প্রয়োজন হয়ে উঠতে পারে, তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও দারুণ প্রভাবশালী হাদিস যুদ্ধবিগ্রহকে দ্বিতীয় সারিতে রেখেছে। বলা হয়ে থাকে যে এক যুদ্ধ থেকে ফেরার সময় মুহাম্মদ (স) তাঁর অনুসারীদের বলেছেন: ‘আমরা ছোট জিহাদ [যুদ্ধ] থেকে বড় জিহাদে ফিরে যাচ্ছি,’ আমাদের নিজেদের সমাজের ও আমাদের নিজেদের মনের সংস্কারের সীমাহীন গুরুত্বপূর্ণ জরুরি চ্যালেঞ্জ। পরে মুসলিম আইন এইসব কুরা’নিক নির্দেশনার ভিত্তিতে বিস্তৃতি পেয়েছে। আত্মরক্ষার প্রয়োজন ছাড়া মুসলিমদের যুদ্ধ করার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে; প্রতিশোধ অবশ্যই সমানুপাতিক হতে হবে; মুসলিমরা স্বাধীনভাবে ধর্ম পালন করতে পারে এমন দেশের বিরুদ্ধে হামলা চালানো যাবে না; বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা অবশ্যই এড়িয়ে যেতে হবে; গাছপালা কাটা যাবে না; এবং দালানকোঠা অবশ্যই পোড়ানো চলবে না।
ইসলামপূর্ব আরবের রক্তস্নানে রেওয়াজ মোতাবেক মক্কার বিরুদ্ধে পাঁচ বছর মেয়াদী যুদ্ধের সময় উভয় তরফ থেকেই নিষ্ঠুরতা ঘটানো হয়েছে। মৃতদেহকে বিকৃত করা হয়েছে এবং মদিনার একটি ইহুদি গোত্র পয়গম্বরকে হত্যার চেষ্টা ও এক অবরোধের সময় মক্কাবাসীদের কাছে নগরের দ্বার খুলে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করলে ক্ল্যানের পুরুষ সদস্যদের হত্যা করা হয়। কিন্তু ভারসাম্য তাঁর অনকূলে চলে আসামাত্র আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণের বিধ্বংসী চক্র ভেঙে দেন মুহাম্মদ (স) এবং বিস্ময়কর বেপরোয়া সহিংসতাহীন নীতি অনুসরণ করেন।
সিই ৬২৮ সালে হজ্জ তীর্থযাত্রার ইচ্ছার কথা ঘোষণা করেন তিনি; তাঁকে সঙ্গ দেওয়ার জন্যে মুসলিম স্বেচ্ছাসেবীদের আমন্ত্রণ জানান। দারুণ বিপজ্জনক ছিল সেটা। হজ্জের সময় আরব তীর্থযাত্রীরা অস্ত্র বহন করতে পারত না; মক্কার স্যাঙ্কচ্যুয়ারিতে সব ধরনের সহিংসতা নিষিদ্ধ ছিল। তীর্যক মন্তব্য করা বা কোনও কীট হত্যাও ছিল নিষিদ্ধ। সুতরাং নিরস্ত্র অবস্থায় মক্কায় যাওয়ার কথা বলে মুহাম্মদ (স) আসলে সিংহের খাঁচার দিকেই এগিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন। তাসত্ত্বেও হাজার খানেক মুসলিম তাঁকে সঙ্গ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। তীর্থযাত্রীদের হত্যার জন্যে অশ্বারোহী বাহিনী পাঠাল মক্কাবাসীরা। কিন্তু স্থানীয় বেদুঈন গাইডরা ভিন্ন পথে তাদের স্যাঙ্কচ্যুয়ারিতে নিয়ে আসে। পবিত্র স্যাঙ্কচ্যুয়ারিতে ঢোকার পর মুসলিমদের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে অবস্থান গ্রহণ করালেন মুহাম্মদ (স)। জানতেন মক্কাবাসীদের এক কঠিন অবস্থানে ফেলে দিচ্ছেন তিনি। ধর্মদ্রোহীতার মতো কাবার পবিত্রতা লঙ্ঘন করে আরবের পবিত্রতম স্থানে তীর্থযাত্রীদের ক্ষতি করলে তাদের আদর্শ নিরাময় অযোগ্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শেষপর্যন্ত মক্কাবাসীরা আলোচনার লক্ষ্যে একজন দূত পাঠায়; এবং উপস্থিত মুসলিমদের সন্ত্রস্ত করে মুহাম্মদ (স) কুরানের নির্দেশনা পালন করে এমন সব শর্ত মেনে নেন যেগুলোকে কেবল অসম্মানজনকই নয় বরং মুসলিমরা যুদ্ধ ও প্রাণ দিয়ে যত সুবিধা আদায় করে নিয়েছিল সেসবের বিসর্জন বলেও মনে হয়েছে। তাসত্ত্বেও চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন মুহাম্মদ (স)। ভয়ানক ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল মুসলিম তীর্থযাত্রীরা। এমনকি অল্পের জন্যে বিদ্রোহ এড়ানো গেলেও গম্ভীর স্তব্ধ চেহারায় বাড়ির পথ ধরেছিল তারা।
কিন্তু ফিরতি পথে যাত্রার সময় মুহাম্মদ (স) আল্লাহর কাছ থেকে এই আপাত পরাজয়কে ‘প্রকাশিত বিজয়” বলে আখ্যায়িতকারী প্রত্যাদেশ পান। মক্কাবাসীরা যেখানে তাদের প্রাচীন ধর্মে অনুপ্রাণিত হয়ে তাদের হৃদয়ে ‘একগুঁয়ে ঘৃণা ধারণ করে রেখেছে,’ যেখানে আল্লাহ মুসলিমদের জন্যে অন্তস্থঃ শান্তি [সাকিনা]-র উপহার প্রেরণ করেছেন, ফলে প্রসন্ন প্রশান্তির সঙ্গে প্রতিপক্ষের প্রতি সাড়া দিতে পেরেছে তারা।৭৫ আল্লাহর প্রতি সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণের ভেতর দিয়ে মর্যাদা লাভ করেছে এবং সেটা তাদের মক্কাবাসীদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে আমরা যাকে অ্যাক্সিয়াল যুগের ধর্ম বলব তার সঙ্গে সম্পর্কিত করেছে। শান্তির চেতনাই, বলেছে কুরা’ন, তোরাহ ও গস্পেলের সঙ্গে তাদের সংযোগ: ‘তাদের উপমা একটি চারাগাছ যা থেকে কিশলয় গজায়, তারপর তা দৃঢ় ও পুষ্ট হয় এবং পরে কাণ্ডের উপর শক্ত হয়ে দাঁড়ায়-চাষিকে আনন্দ দেয়।’৭৬ একেবারেই সম্ভাবনাহীন মনে হওয়া চুক্তিই শেষপর্যন্ত চূড়ান্ত শান্তি বয়ে এনেছে। দুই বছর পরে মক্কাবাসীরা স্বেচ্ছায় মুহাম্মদকে (স) তাদের দুয়ার খুলে দিয়েছিল, বিনা রক্তপাতে নগরে প্রবেশ করেছিলেন তিনি।
অ্যাক্সিয়াল যুগের প্রতিটি ধর্মে ব্যক্তি তাদের উচ্চ আদর্শের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে ব্যর্থ হয়েছে। এইসমস্ত ধর্মে লোকে প্রায়শঃই বর্জনবাদ, নিষ্ঠুরতা, কুসংস্কার এবং এমনকি নিষ্ঠুরতার শিকারে পরিণত হয়েছে। কিন্তু তাদের অন্তস্তলে অ্যাক্সিয়াল ধর্মবিশ্বাস সহানুভূতি, সম্মান ও সর্বজনীন উদ্বেগের আদর্শ বহন করেছে। সাধুদের সকলেই ঠিক আমাদের সমাজের মতোই সহিংস সমাজে বাস করেছেন। তারা স্বাভাবিক শক্তিকে এই আগ্রাসন মোকাবিলায় কাজে লাগানো আধ্যাত্মিক প্রযুক্তি সৃষ্টি করে গেছেন। তাদের ভেতর সবচেয়ে প্রতিভাবানরা বুঝতে পেরেছিলেন যে, নিষ্ঠুর, স্বেচ্ছাচারী আচরণকে বেআইনি করতে চাইলে স্রেফ বাহ্যিক নির্দেশনা জারি করে কোনও ফায়দা হবে না। ঝুয়াংঝি যেমন উল্লেখ করেছিলেন, শাসককে নিষ্ঠুর আচরণের দিকে ঠেলে দেওয়া হৃদয়ের অবচেতন পক্ষপাতকে স্পর্শ করবে না বলে কনিফুসিয়বাদের মহৎ নীতিমালার শিক্ষা দিয়ে ওয়েই-এর রাজকুমারকে সংস্কার করার ইয়ান হুইয়ের প্রয়াস অর্থহীন।
বর্তমানে অ্যাক্সিয়াল যুগের ধর্মসমূহ।
বিশ্ব জনসংখ্যা
ক্রিশ্চান – ১,৯৬৫,৯৯৩,০০০
মুসলিম – ১,১৭৯,৩২৬,০০০
হিন্দু – ৭৬৭,৪২৪,০০০
বৌদ্ধ – ৩৫৬,৮৭৫,০০০
শিখ – ২২, ৮৭৪,০০০
দাওবাদী – ২০,০৫০,০০০
ইহুদি – ১৫,০৫০,০০০
কনফুসিয় – ৫,০৬৭,০০০
জৈন – ৪,১৫২,০০০
জরাথ্রুস্টীয় – ৪৭৯,০০০
সমাজে যুদ্ধবিগ্রহ ও সন্ত্রাস প্রবল হয়ে উঠলে জনগণের সমস্তকিছুকেই প্রভাবিত করে। ঘৃণা ও ত্রাস তাদের স্বপ্নে, সম্পর্কে, আকাঙ্ক্ষায় আর উচ্চাশায় হানা দেয়। অ্যাক্সিয়াল সাধুরা নিজেদের সমসাময়িকদের মাঝে এসব ঘটতে দেখেছেন এবং এথেকে উত্তরণে তাদের সাহায্য করার জন্যে সত্তার গভীরে অপেক্ষাকৃত কম সচেতন স্তরে প্রোথিত শিক্ষা নির্মাণ করেছেন। তাদের সবার এত বেশি ভিন্ন ভিন্ন পথে এত গভীরভাবে একই ধরনের সমাধানে পৌঁছানোর ব্যাপারটি একথাই বোঝায় যে প্রকৃতপক্ষে মানুষের মনের ক্রিয়াকর্মের প্রকৃতি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ একটা কিছু জানতে পেরেছিল তারা। ধর্মতাত্ত্বিক ‘বিশ্বাস’ নির্বিশেষে আমরা যেমন দেখেছি, সাধুদের তেমন একটা মাথাব্যথার কারণ ছিল না সেটা-লোকে নিজেদের নতুন করে শিক্ষিত করে তোলার লক্ষ্যে শৃঙ্খলাপূর্ণ প্রয়াস পেলে মানবতার বর্ধিত সত্তার বোধ লাভ করবে বলে উপসংহারে পৌছেছিলেন তারা সবাই। যেভাবেই হোক, আমাদের সহিংসতার জন্যে ব্যাপকভাবে দায়ী অহমবাদকে দূর করার লক্ষ্যেই তাদের কর্মসূচি প্রণীত ছিল এবং স্বর্ণবিধির সহানুভূতির আধ্যাত্মিকতাকে উৎসাহিত করেছে। মানুষকে এটা মানবীয় অভিজ্ঞতার এক ভিন্ন মাত্রায় পৌঁছে দেয় বলে আবিষ্কার করেছেন তারা। এটা তাদের তারা যে বাস্তবতাকে ‘ঈশ্বর,’ নিব্বানা, ব্রাহ্মণ, আত্মা বা পথ বলে থাকেন তাকে উপলব্ধিতে সক্ষম করে তোলা একতাসিস, স্বভাবজাত, আত্মমুখী সচেতনতা থেকে ‘বাইরে পা রাখা’র অনুভূতি দিয়েছে। প্রথমে ‘ঈশ্বরে’ বিশ্বাস আবিষ্কার এবং তারপর সহানুভূতির জীবন যাপন করার প্রশ্ন ছিল না এটা। খোদ শৃঙ্খলাময় সহানুভূতির চর্চাই দুয়ের বোধ নিয়ে আসে। মানুষ সম্ভবত আত্মরক্ষার বোধের শর্তাধীন। আমরা গুহায় বাস করার সময় থেকেই পশু আর মানুষ শিকারীদের হুমকির মোকাবিলা করে এসেছি। এমনকি আমাদের নিজস্ব সম্প্রদায় ও পরিবারেও অন্য লোকজন আমাদের স্বার্থের বিরোধিতা করে ও আমাদের আত্মসম্মানকে ক্ষতিগ্রস্ত করে বলে পাল্টা আক্রমণ ও আগাম হামলার জন্যে আমরা চিরন্তনভাবে-মুখে, মানসিকভাবে, ও শারীরিকভাবে তৈরি থাকি। কিন্তু আমরা যদি পদ্ধতিগতভাবে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের মানসিক অবস্থার চর্চা করি, সাধুরা আবিষ্কার করেছে যে, তখন বিকল্প সচেতনতার অভিজ্ঞতা লাভ করি আমরা। অ্যাক্সিয়াল সাধুরা যে সামঞ্জস্যতার সঙ্গে—একেবারেই স্বাধীনভাবে—স্বর্ণবিধিতে ফিরে গেছে সেটা হয়তো আমাদের নিজস্ব প্রকৃতি সম্পর্কে কিছু জানাতে পারে।
উদাহরণ স্বরূপ, আমরা আমাদের কোনও সহকর্মী, ভাইবোন বা কোনও শত্রু সম্পর্কে বৈরী কিছু বলার কথা ভাবতে গেলে, তখন কেউ আমাদের নিয়ে এই ধরনের মন্তব্য করলে কেমন লাগত সেটা ভাবলে-এবং বিরত থাকলে—সেই মুহূর্তে আমরা আমাদের ঊর্ধ্বে উঠে যাব। এটা হবে দুয়ের একটা মুহূর্ত। এই ধরনের প্রবণতা স্বভাবে পরিণত হলে অদ্ভুত ঘোরে আটকা পড়ে যাওয়ার কারণে নয় বরং অহমের সীমার বাইরে বাস করবে বলে লোকে অবিরাম একতাসিসের অবস্থায় অবস্থান করবে। সকল অ্যাক্সিয়াল কর্মসূচি এই প্রবণতাকে অনুপ্রাণিত করেছে। র্যাবাই হিল্লেল যেমন এটাই ধর্মের মূল কথা বলে যুক্তি দেখিয়েছিলেন। অন্যের প্রতি সম্মান চর্চা করার লক্ষ্যে ‘পরাস্ত’ হওয়ার কনফুসিয় আচার প্রণীত হয়েছিল। শিক্ষাব্রতী কোনও একটি যোগ অনুশীলন বেছে নেওয়ার আগে অহিংসা, সহিংসতাহীনতায় দখল অর্জন করতে হতো তাকে, কোনও কথা বা ভঙ্গিতে কখনও বিদ্বেষ প্রকাশ করতে পারত না। এটা তার দ্বিতীয় স্বভাবে পরিণত না হওয়া পর্যন্ত গুরু ধ্যান করার অনুমতি দিতেন না তাকে—কিন্তু এই ‘সহিংসতাহীনতা’ অর্জনের প্রক্রিয়ায়, টেক্সট ব্যাখ্যা করেছে, ‘অবর্ণনীয় আনন্দ’ ভোগ করত সে।
অ্যাক্সিয়াল সাধুরা স্বার্থপরতার বিসর্জন ও সহানুভূতির আধ্যাত্মিকতাকে সবার উপরে স্থান দিয়েছে। তাদের কাছে ধর্ম ছিল স্বর্ণ বিধি। মানুষের কিসের উর্ধ্বে ওঠার কথা-লোভ, অহমবাদ, ঘৃণা আর সহিংসতা-সেদিকে মনোযোগ দিয়েছে তারা। তারা কিসের দিকে অতিক্রম করতে যাচ্ছিল সেটা সহজ সংজ্ঞায়িত স্থান বা ব্যক্তি নয় বরং এখনও অহমের নীতিমালার ফাঁদে আটকে থাকা অনালোকিত লোকের কাছে দুর্বোধ্য স্বর্গসুখসম একটি অবস্থা ছিল। লোকে তারা কোন জিনিসটা অতিক্রম করে যাওয়ার আশা করছে সেদিকে মনোযোগ দিলে এবং তাতে একগুঁয়ে হয়ে উঠলে বৌদ্ধ পরিভাষায় যা ‘অদক্ষ’ এক ধরনের অনুসন্ধানমূলক কঠোরতা গড়ে তুলবে।
সকল ধর্মতত্ত্বকে বাতিল করে দিতে হবে বা ঈশ্বর বা পরম সম্পর্কে প্রচলিত বিশ্বাস ‘ভুল’, এটা বলা যাবে না। কিন্তু একেবারে সহজভাবে-এগুলো সম্পূর্ণ সত্যকে প্রকাশ করতে পারে না। দুয়ে মূল্যবোধ এমন কিছু, খোদ প্রকৃতির কারণেই যাকে সংজ্ঞায়িত করা যায় না-এমন একটি শব্দ যার মূল অর্থ ‘সীমা আরোপ করা’। উদাহরণ স্বরূপ, ক্রিশ্চানিটি মতবাদগত গোঁড়া বিশ্বাসের বিরাট পসরা সাজিয়ে বসেছে, অনেক ক্রিশ্চানই তাদের প্রচলিত বিশ্বাস বাদে ধর্মকে কল্পনা করতে পারে না। এইসব গোড়ামী প্রায়শঃই এক গভীর আধ্যাত্মিক সত্যি প্রকাশ করে বলে এটা খুবই চমৎকার। পরীক্ষাটা সহজঃ লোকের বিশ্বাস-সেক্যুলার বা ধর্মীয়-তাদের উদ্ধত, অসহিষ্ণু এবং অন্য লোকদের বিশ্বাসের প্রতি দয়াহীন করে তুললে সেগুলো ‘দক্ষ’ নয়। অবশ্য, বিশ্বাস তাদের সহানুভূতির সঙ্গে আচরণ ও আগন্তুকদের সম্মান করতে বাধ্য করলে সেগুলো সঠিক, সাহায্যকারী ও সুস্থ। প্রতিটি প্রধান ঐতিহ্যে এটাই সত্যিকারের ধার্মিকতার পরীক্ষা।
ধর্মীয় সমস্ত মতবাদকে বাতিল করার বদলে আমাদের সেগুলোর আধ্যাত্মিক সারৎসারের খোঁজ করা উচিত। একটি ধর্মীয় শিক্ষা কখনওই বস্তুগত তথ্যের বিবৃতি ছিল না: এটা কর্ম পরিকল্পনা। ফিলিপিয়দের উদ্দেশে অবতারবাদের আইন জারি করার লক্ষ্যে নয়, বরং তাদেরকে কোনোসিসের চর্চা করার তাগিদ দিতেই সেই আদি ক্রিশ্চান স্তোত্রগীত উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন পল। খ্রিস্টের মতো আচরণ করলে তাঁর সম্পর্কে বিশ্বাসের সত্যি আবিষ্কার করতে পারবে তারা। একইভাবে অংশত ট্রিনিটির মতবাদের মানে ছিল ক্রিশ্চানদের একথা মনে করিয়ে দেওয়া যে ঈশ্বরকে একটি একক সত্তা হিসাবে ভাবতে পারবে না তারা, এবং স্বর্গীয় সত্তা তাদের আয়ত্তের বাইরে অবস্থান করেন। ট্রিনিটির মতবাদকে কেউ কেউ সম্পর্ক বা সম্প্রদায়ের প্রেক্ষিতে ঈশ্বরকে দেখার প্রয়াস হিসাবে দেখেছেন; অন্যরা ট্রিনিটির মূলে এক ধরনের কেনোসিস লক্ষ করেছেন। কিন্তু ধ্যান ও নৈতিক কর্মকাণ্ডকে উৎসাহিত করাই ছিল এই মতবাদের লক্ষ্য। সিই চতুর্দশ শতাব্দীতে গ্রিক সনাতন ধর্মতাত্ত্বিকরা ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কে আমাদের অ্যাক্সিয়াল যুগের মূলে নিয়ে যাওয়া একটি নীতিমালা স্থির করেন। ঈশ্বর সংক্রান্ত যেকোনও ধরনের বিবৃতির, বলেছেন তাঁরা, দুটি গুণ থাকতে হবে: ঈশ্বর আমাদের সীমিত মানবীয় হিসাবে ধরা দেন না, আমাদের একথা মনে করিয়ে দিতে একে অবশ্যই আপাত স্ববিরোধী; এবং আমাদের নীরবতার দিকে নিয়ে যেতে নেতিবাচক হতে হবে। সুতরাং কোনও ধর্মতাত্ত্বিক আলোচনার অনির্বচনীয় উপাস্য সম্পর্কে আমাদের সকল প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কথা নয়, বরং প্রতিযোগিদের বাকরহিত ভীতিতে পর্যবসিত করা ব্রাহ্মোদ্যের মতো হওয়া উচিত।
শত শত বছরের প্রাতিষ্ঠানিক, রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ধর্মে সহানুভূতির গুরুত্বকে অস্পষ্ট করে দিতে চেয়েছে। প্রায় সবসময় সাধারণের আলোচনায় যে ধর্ম প্রাধান্য বিস্তার করে থাকে তাও যেন প্রাতিষ্ঠানিক অহমবাদই প্রকাশ করে: আমার ধর্মই তোমার ধর্মের চেয়ে উন্নত! ঝুয়াংঝি যেমন উল্লেখ করেছিলেন, লোকে তাদের বিশ্বাসে নিজেদের প্রক্ষিপ্ত করে বসলে ঝগড়াটে, কর্তৃত্বপরায়ণ বা এমনকি দয়াহীনও হয়ে উঠতে পারে। আমাদের গভীরতম সত্তার সঙ্গে একাত্ম করে রাখা অহমকে ত্যাগ করার দাবি করে বলে সহানুভূতি জনপ্রিয় গুণ নয়; তো লোকে প্রায়শঃই সহানুভুতিশীল হওয়ার চেয়ে সঠিক হওয়ার ব্যাপারটাকে ঠিক মনে করে। মৌলবাদী ধর্ম আমাদের কালের সহিংসতাকে আত্মস্থঃ করেছে এবং একটি মেরুকৃত দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলেছে, ফলে আদি জরাথ্রুস্টীয়দের মতো মৌলবাদীরা অনেক সময় মানবজাতিকে যুদ্ধে লিপ্ত বিশ্বাসীরা ‘দুষ্কৃতকারীদের’ বিরুদ্ধে জীবন-পণ লড়াই করে চল দুটি বৈরী শিবিরে বিভক্ত করে থাকে। আমরা যেমন নিজেদের ক্ষতি স্বীকার করেই লক্ষ করেছি, এই প্রবণতাও উল্টোফলদায়ী। দাওদেজিং যেমন তুলে ধরেছেন, যতই ভালো উদ্দেশ্যেই সারা হোক না কেন সহিংসতা সাধারণত উদ্গাতার দিকেই ফিরে যায়। আপনি মানুষকে আপনার ইচ্ছেমতো আচরণে বাধ্য করতে পারেন না। আসলে সংশোধনমূলক ব্যবস্থার বরং তাদের ঠিক উল্টোদিকেই ঠেলে দিতে পারার সম্ভাবনা রয়েছে।
সকল বিশ্ব ধর্ম এই ধরনের জঙ্গী ধার্মিকতার বিস্ফোরণ প্রত্যক্ষ করেছে। ফলে কেউ কেউ খোদ ধর্মই অনিবার্যভাবে সহিংস, বা সহিংসতা ও অসহিষ্ণুতা কোনও একটি বিশেষ ট্র্যাডিশনের বেলায় সহজাত, এমন উপসংহারে পৌঁছেছে। কিন্তু অ্যাক্সিয়াল যুগের কাহিনী দেখায়, আসলে বরং উল্টোটাই সত্যি। এইসব ধর্মবিশ্বাসের সবগুলোই তাদের কালের নজীরবিহীন সহিংসতা থেকে নীতিগত ও আন্তরিক পশ্চাদপসরণ থেকেই সূচিত হয়েছিল। ভারতে আচরিক সংস্কারকরা উৎসর্গের প্রতিযোগিতা থেকে বিরোধ ও আগ্রাসনকে রহিত করা শুরু করার সময়ই অ্যাক্সিয়াল যুগ শুরু হয়েছিল। জেরুসালেমের বিনাশ ও বাবিলোনিয়ায় নির্বাসিতদের জোর করে দেশান্তরীকরণের পর জোরেসোরে ইসরায়েলের অ্যাক্সিয়াল যুগ সূচিত হয়েছিল, যেখানে পুরোহিত গোষ্ঠীর লেখকরা সমন্বয় ও অহিংসার আদর্শ গড়ে তুলতে শুরু করেছিলেন। যুদ্ধরত রাজ্যগুলোর আমলে চীনের অ্যাক্সিয়াল যুগের বিকাশ ঘটে, এই সময় কনফুসিয়, মোহিস্ট এবং দাওবাদীদের সবাই ব্যাপকবিস্তৃত আইনহীনতা, মারাত্মক আগ্রাসনের মোকাবিলা করার উপায় খুঁজে পেয়েছিলেন। গ্রিসে সহিংসতাকে যেখানে পোলিসগুলো কর্তৃক প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়েছিল, অ্যাক্সিয়াল যুগের কিছু উল্লেখযোগ্য অবদান সত্ত্বেও বিশেষ করে ট্র্যাজিডির ক্ষেত্রে-সেখানে শেষপর্যন্ত কোনও ধর্মীয় পরিবর্তন ঘটেনি।
তাসত্ত্বেও, হোমো রিলিজিয়াসরা সবসময় জীবনের নিষ্ঠুরতায় আচ্ছন্ন থাকায় ধর্ম ও সহিংসতার ভেতর একটি সম্পর্ক তুলে ধরার ক্ষেত্রে ধর্মের সমালোচকরা সঠিক। আমাদের সহজাত আগ্রাসনকে প্রবাহিত ও নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে পরিকল্পিত পশুবলী-প্রাচীন কালের সর্বজনীন রেওয়াজ—বিশেষভাবে সহিংস কাজ ছিল। হয়তো প্রাচীন প্রস্তর যুগে সতীর্থ সৃষ্টিকে হত্যাকারী শিকারীদের অপরাধবোধ থেকে এর উদ্ভব হয়ে থাকতে পারে। শাস্ত্রগ্রন্থ প্রায়ই তাদের আবির্ভাবের বিরোধপূর্ণ প্রেক্ষিত তুলে ধরে। হত্যার পক্ষে ধর্মীয় যুক্তি তুলে ধরা কঠিন নয়। সামগ্রিক ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখা হলে, বিচ্ছিন্ন টেক্সট, যেমন হিব্রু বাইবেল, নিউ টেস্টামেন্ট বা কুরা’নকে সহাজেই অনৈতিক সহিংসতা ও নিষ্ঠুরতার পক্ষে কাজে লাগানো যেতে পারে। ধর্মগ্রন্থগুলো অবিরাম এভাবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে এবং বেশির ভাগ ধর্মীয় ঐতিহ্যেরই অতীতে অসম্মানজনক কাহিনী রয়েছে। আমাদের নিজস্ব কালে সারাবিশ্বের মানুষ ধর্মীয়ভাবে অনুপ্রাণিত সহিংসতার দিকে ঝুঁকে পড়ছে। অনেক সময় তারা ভীতি, নৈরাশ্য ও হতাশায় তাড়িত হয়; অনেক সময় অ্যাক্সিয়াল যুগের আদর্শকে সম্পূর্ণ লঙ্ঘন করা ঘৃণা ও ক্রোধে প্ররোচিত হয়। ফলে ধর্মকে সাম্প্রতিক ইতিহাসের কিছু অন্ধকার পর্বে সংশ্লিষ্ট করা হয়েছে।
আমাদের সাড়া কি হওয়া উচিত? অ্যাক্সিয়াল যুগের সাধুরা আমাদের দুটো গুরুত্বপূর্ণ উপাদেশ দিয়েছেন। প্রথমত: অবশ্যই আত্মসমালোচনার অস্তিত্ব থাকতে হবে। ‘অপর পক্ষ’কে স্রেফ ভর্ৎসনা না করে মানুষকে অবশ্যই তাদের নিজেদের আচরণ পরখ করতে হবে। ইহুদি পয়গম্বররা এখানে বিশেষভাবে জোরাল সূত্রের যোগান দিচ্ছেন। ইসরায়েল ও জুদাহ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হুমকির স্বীকার হচ্ছে, এমন একটা সময়ে আমোস, হোসেয়া এবং জেরেমিয়া নিজেদের আচরণ নিরীখ করতে বলেছেন তাদের। এক ধরনের বিপজ্জনক ন্যায্যতাকে উৎসাহ দেওয়ার বদলে জাতীয় অহমকে নষ্ট করতে চেয়েছেন তাঁরা। ঈশ্বরকে আপনাআপনি নিজের পক্ষে ও আপনার প্রতিপক্ষের বিরোধিতা করছেন কল্পনা করা পরিপক্ক ধর্মীয় প্রবণতা নয়। পদ্ধতিগত অবিচার ও সামাজিক দায়িত্বহীনতার কারণে অসিরিয়াকে ব্যবহার করে স্বর্গীয় যোদ্ধা ইয়াহওয়েহ ইসরায়েল রাজ্যকে শাস্তি দিচ্ছেন বলে প্রত্যক্ষ করেছেন আমোস। বাবিলোনে নির্বাসনের পর নির্বাসিতরা ব্যাপক রাষ্ট্রীয় আগ্রাসনের শিকারে পরিণত হলে ইযেকিয়েল জোরের সঙ্গে বলেছেন যে জুদাহর মানুষ যেন তাদের নিজস্ব সহিংস আচরণের দিকে তাকায়। পরে অনুসারীদের ভাইয়ের চোখে কুটা দেখার আগে নিজের চোখের কড়িকাঠ দেখার কথা বলবেন জেসাস।৭৮ অ্যাক্সিয়াল যুগের ধার্মিকতা মানুষের নিজস্ব আচরণের দায়িত্ব নেওয়ার দাবি জানিয়েছে। ভারতীয় কর্ম মতবাদ আমাদের সকল কাজেরই দীর্ঘ, স্থায়ী পরিণতি থাকার প্রতি জোর দিয়েছিল; নিজের ব্যর্থতা পরখ না করে অন্যদের দোষ ধরা হয়তো বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সৃষ্টিতে অবদান রাখতে পারে, যা ‘অক্ষ’, অবাস্তব এবং অধার্মিক। আমাদের বর্তমান দোলাচলের ক্ষেত্রেও অ্যাক্সিয়াল সাধুরা হয়তো বলতেন, সংস্কার অবশ্যই ঘর থেকেই শুরু হতে হবে। অন্য ধর্ম তার কাজকর্ম শোধন করার কথা জোরের সঙ্গে বলার আগে আমাদের উচিত হবে নিজেদের ঐতিহ্য, ধর্মগ্রন্থ আর ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি ফেরানো-এবং নিজেদের আচরণ শোধরানো। আমরা নিজেরা সংস্কার না হওয়া পর্যন্ত অন্যদের সংস্কার করার আশা করতে পারি না। ধর্ম প্রত্যাখ্যানকারী সেক্যুলারিস্টদেরও সেক্যুলার মৌলবাদের লক্ষণের সন্ধান করা উচিত। সেক্যুলারিজমের নিজস্ব সংক্ষিপ্ত ইতিহাসে বিভিন্ন বিপর্যয় রয়েছে: হিটলার, স্তালিন ও সাদ্দাম হুসেইন দেখিয়েছেন যে, সরকারী নীতি থেকে ধর্মের উগ্র বর্জন যেকোনও ধার্মিক ক্রুসেডের মতোই মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে।
দ্বিতীয়ত, আমাদের উচিত হবে অ্যাক্সিয়াল সাধুদের নজীর অনুসরণ করা এবং বাস্তব ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া। নিজস্ব ঐতিহ্যে আগ্রাসন মোকাবিলার সময় তাঁরা এর অস্তিত্ব না থাকার ভান করেননি, বরং নিজেদের ধর্মকে বদলানোর জোর প্রয়াস পেয়েছেন, বছরের পরিক্রমায় পুঞ্জীভূত সহিংসতাকে দূর করার লক্ষ্যে তাদের আচার ও শাস্ত্রকে নতুন করে লিখেছেন, সংগঠিত করেছেন। ভারতের আচার সংস্কারকরা উৎসর্গ থেকে বৈরিতা দূর করেছেন; কনফুসিয়াস লি-কে বিকৃতকারী জঙ্গী অহমবাদকে বাদ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন এবং P প্রাচীন সৃষ্টি কাহিনী থেকে অগ্রাসনকে বাদ দিয়ে এমন এক সৃষ্টিতত্ত্ব তৈরি করেছেন যেখানে ইয়াহওয়েহ প্রাচীন কাহিনীতে হত্যা করা লেভিয়াথানসহ তাঁর সকল সৃষ্টিকে আশীর্বাদ করেছেন।
চরমপন্থীরা এখন শত শত বছরের পরিক্রমায় যারা সহানুভূতি ও অন্যদের পবিত্র অধিকারের প্রতি সম্মান দেখানোর কথা বলেছেন তাদের ক্ষতি করে গড়ে ওঠা যুদ্ধংদেহী উপাদানকে জোরাল করে অ্যাক্সিয়াল ঐতিহ্যকে বিকৃত করেছে। নিজেদের বিশ্বাসকে নতুন করে প্রতিষ্ঠা করার জন্যে তাদের সহধর্মাবলম্বীদের উচিত হবে শৃঙ্খলিত ও সৃজনশীল গবেষণা, আলোচনা, চিন্তাভাবনা ও কর্মপরিকল্পনার কর্মসূচি নেওয়া। প্রতিষ্ঠানের ‘অখণ্ডতা’ রক্ষার জন্যে অস্বস্তিকর ধর্মগ্রন্থ ও ঐতিহাসিক বিপর্যয়সমূহ ঝাড়ু দিয়ে গালিচার নিচে চাপা দেওয়ার বদলে পণ্ডিত, যাজক এবং সাধারণ মানুষের উচিত হবে কঠিন টেক্সটসমূহ পাঠ করা, অনুসন্ধানী প্রশ্ন করা ও অতীতের ব্যর্থতার পরীক্ষা করা। একই সময়ে আমাদের সবারই সহানুভূতিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি পুনরুদ্ধারের জন্যে সংগ্রাম করতে হবে এবং একে উদ্ভাবনী, অনুপ্রেরণামূলক উপায়ে প্রকাশের চেষ্টা নিতে হবে-ঠিক অ্যাক্সিয়াল সাধুরা যেমন করেছিলেন।
একে খাঁটি বুদ্ধিবৃত্তিক অভিযান হওয়ার দরকার নেই: একে আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়াও হতে হবে। এই বিপজ্জনক সময়ে আমাদের এক নতুন দর্শন প্রয়োজন, কিন্তু অ্যাক্সিয়াল সাধুরা ক্লান্তিহীনভাবে যেমন ব্যাখ্যা করেছেন, ধৰ্মীয় উপলব্ধি স্রেফ ধারণাগত নয়। অনেকেই চতুর, উপরিগত জ্ঞান দিতে পারে, এই ভয়ে লিখিত শাস্ত্রগ্রন্থের বিরোধিতা করেন। একটি আত্মবিলোপকারী, সহানুভূতিপূর্ণ এবং অহিংস জীবনযাত্রা মূলপাঠের পাঠের মতোই সমান গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি ইন্দ্রকে যুদ্ধংদেহী জীবন বদলে ঐতিহ্যের গভীরতম সত্যি উপলব্ধির আগে বিনয়ী বৈদিক ছাত্রের জীবন যাপন করতে হয়েছে। অনেক সময়ও লেগেছিল তাঁর। অব্যাহত যোগাযোগের সমাজে বাস করি বলে আমরা আমাদের ধর্মকেও চট করে উপলব্ধি করার আশা করি, এমনকি এও ভাবি যে চট করে বুঝে উঠতে না পারলে কোথাও সমস্যা আছে। কিন্তু অ্যাক্সিয়াল সাধুরা প্রকৃত জ্ঞান সবসময়ই অধরা বলে ক্লান্তিহীনভাবে ব্যাখ্যা করে গেছেন। সক্রেটিস বিশ্বাস করতেন, যুক্তিবাদী গ্রিকদের এ ব্যাপারে সজাগ করে তোলার দায়িত্ব রয়েছে যে আমরা সবচেয়ে জোরালভাবে যুক্তিবাদী থাকার মুহূর্তেও সত্যির কোনও কোনও দিক সবসময় আমাদের এড়িয়ে যাবে। কেবল বুদ্ধিবৃত্তিক কোনোসিসের পরেই উপলব্ধির সৃষ্টি হয়, যখন আমরা বুঝতে পারি যে আমরা কিছুই জানি না এবং আমাদের মন গৃহীত ধারণা থেকে ‘শূন্য’ হয়ে যায়। অ্যাক্সিয়াল সাধুরা মৌলিক ধারণার ব্যাপারে প্রশ্ন তোলায় ম্রিয়মান ছিলেন না। আমরা যখন নিজেদের কালের সমস্যার মোকাবিলা করছি, অবিরাম নতুন নতুন ধারণার প্রতি উন্মুক্ত, এমন একটা মনের প্রয়োজন রয়েছে আমাদের।
আমরা এখন দারুণ ভীতি ও বেদনার কালে বাস করছি। অ্যাক্সিয়াল যুগ আমাদের মানব জীবনের অনিবার্য বাস্তবতা ভোগান্তির মোকাবিলা করতে শিখিয়েছে। কেবল নিজেদের ব্যথা-বেদনাকে স্বীকার করেই আমরা অন্যের সমব্যথী হতে শিখতে পারি। আজকের দিনে অতীতের যেকোনও প্রজন্মের চেয়ে আমরা ভোগান্তির অনেক বেশি ইমেজে আক্রান্ত: যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দুর্ভিক্ষ, দারিদ্র্য আর রোগশোক আজ রাতের অন্ধকারে আমাদের শোবার ঘরে এসে উঁকি দেয়। জীবন সত্যিই দুঃখ। এমনি সর্বব্যাপী ত্রাস থেকে পালানো, এর সঙ্গে আমাদের কোনও সম্পর্ক অস্বীকার করা এবং নিজের বাদে অন্য কারও কষ্ট থাকার বিষয়টি ইচ্ছাকৃতভাবে বর্জন করার একটি ‘ইতিবাচক’ প্রবণতা গড়ে তোলার ব্যাপারটা লোভনীয়। কিন্তু অ্যাক্সিয়াল সাধুরা জোর দিয়ে বলেছেন, এটা কোনও পছন্দ নয়। যারা জীবনের দুর্ভোগকে অস্বীকার করে ও উটপাখির মতো বালিতে মুখ গুঁজে রাখে, তারাই ‘মিথ্যা পয়গম্বর’। চারপাশে চলমান ভোগান্তিকে আমাদের চৈতন্যে প্রবেশ করতে না দিলে নিজেদের আধ্যাত্মিক অন্বেষা শুরু করতে পারব না। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের এই যুগে আমাদের যেকারও পক্ষেই বুদ্ধের প্রমোদ উদ্যানে বাস করা সম্ভব বলে বিশ্বাস করা কঠিন। আগে হোক বা পরে ভোগান্তি আমাদের সবার জীবনে, এমনকি প্রথম বিশ্বের সুরক্ষিত সমাজগুলোতেও, আঘাত হানবেই।
প্রতিরোধ করার বদলে, অ্যাক্সিয়াল সাধুরা আমাদের বলতেন, একে ধৰ্মীয় সুযোগ বলে বিবেচনা করা উচিত। বেদনাকে তিক্ত হতে দিয়ে সহিংসতা, অসহিষ্ণুতা ও ঘৃণায় বিস্ফোরিত হতে না দিয়ে একে সাহসিকতার সঙ্গে কাজে লাগানোর প্রয়াস নেওয়া উচিত আমাদের। অসন্তোষকে লাগামহীন করে দেওয়া কোনও কৌশল নয়, নির্বাসিতদের বলেছিলেন জেরেমিয়া। প্রতিশোধ কোনও জবাব ছিল না। নিজেদের ভেতর আগন্তুককে সম্মান দেখাও, ইহুদি নির্বাসিতদের বলেছিলেন P, কারণ মিশরে তোমরাও আগন্তুক ছিলে। অতীতের দুর্দশার স্মৃতি আমাদের স্বর্ণবিধিতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়; অন্যদের দুঃখকষ্ট—এমনকি (সম্ভবত বিশেষভাবে ) আমাদের প্রতিপক্ষের যন্ত্রণাকে-আমাদের দুঃখকষ্টের মতোই গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে দেখা আমাদের পক্ষে উপকারী হতে পারে। অ্যাথেনিয় দর্শকরা যাতে মাত্র কয়েক বছর আগে তাদের শহর ধ্বংস করে দেওয়া পারসিয়দের জন্যে সহানুভূতি বোধ করতে পারে সেজন্যে মানবীয় দুর্ভোগকে মঞ্চে উপস্থিত করেছিল গ্রিকরা। ট্র্যাজিডিতে কোরাস সাধারণত ঘৃণায় পরিপূর্ণ করে তুলত তাদের।
ট্র্যাজিডিকে অস্বীকার করা যায়নি। একে শহরের পবিত্র প্রাণকেন্দ্ৰে নিয়ে আসতে হয়েছে এবং মঙ্গলের উপায়ে পরিণত করতে হয়েছে—যেমনটা অরেস্টসিয়ার শেষে প্রতিশোধ পরায়ণ এরিনিসদের ইউমেনিদিস-ভালো আচরণকারীজন’-এ পরিণত করে অ্যাক্রোপোলিসে মন্দির দান করা হয়েছিল। আমরা যাদের ঘৃণা ও ক্ষতি করেছি তাদের সঙ্গে একাত্ম হতে শিখতে হয়েছে আমাদের; ইলিয়াডের শেষে অ্যাকিলিস ও প্রিয়াম একসঙ্গে কেঁদেছেন। ক্রোধ ও ভয়ঙ্কর অসন্তোষ আমাদের অমানুষ করে তুলতে পারে; কেবল অ্যাকিলিস প্রিয়ামের সঙ্গে দুঃখ ভাগাভাগি করে তাঁকে নিজে প্রতিবিম্ব হিসাবে দেখতে পাওয়ার পরেই হারিয়ে যাওয়া মানবতা আবার ফিরে পেয়েছিলেন।
আমাদের অবশ্যই সবসময় নিজেদের মনে করিয়ে দিতে হবে যে অ্যাক্সিয়াল সাধুরা এক ভীতিকর ও সন্ত্রাসময় পরিবেশে তাদের সহানুভূতিমূলক নীতিমালা গড়ে তুলেছিলেন। গজদন্ত মিনারে বসে ধ্যানে মগ্ন ছিলেন না তাঁরা, বরং প্রাচীন মূল্যবোধগুলো হারিয়ে যাচ্ছে, এমন ভয়ঙ্কর, যুদ্ধবাজ সমাজে বাস করেছেন। আমাদের মতোই তাঁরাও শূন্যতা ও মহাগহ্বর সম্পর্কে সজাগ ছিলেন। সাধুরা ইউটোপিয় স্বাপ্নিক ছিলেন না, বাস্তববাদী মানুষ ছিলেন তাঁরা! অনেকেই রাজনীতি ও সরকারে ব্যস্ত ছিলেন। তাঁরা বিশ্বাস করেছিলেন যে, সহানুভূতি কেবল কথায় নয় বরং সত্যিই নৈতিক উন্নতি সাধনে কাজ দিয়েছে। সকলের জন্যে সহানুভূতি ও উদ্বেগ ছিল সেরা নীতি,। তাঁদের দর্শন গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া উচিত আমাদের, কেননা তাঁরা ছিলেন বিশেষজ্ঞ। শুভের প্রকৃতি সম্পর্কে জানতে অনেক সময় ও শ্রম ব্যয় করেছেন তাঁরা। মানুষের আধ্যাত্মিক অস্থিরতার একটা প্রতিশেধক বের করার লক্ষ্যে আজকের দিনের বিজ্ঞানীদের ক্যান্সারের চিকিৎসা আবিষ্কারের প্রয়াসের মতোই অনেক শক্তি ব্যয় করেছেন। আমাদের ভিন্ন ব্যস্ততা রয়েছে। অ্যাক্সিয়াল যুগ ছিল আধ্যাত্মিক মেধার কাল; আমরা বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তির মেধার কালে বাস করছি, আমাদের আধ্যাত্মিক শিক্ষা প্রায়শঃই অবিকশিত রয়ে গেছে।
মানবজাতি সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক অগ্রসর পদক্ষেপ নিয়েছিল বলে অ্যাক্সিয়াল যুগের একটি নতুন দর্শন গড়ে তোলার প্রয়োজন ছিল। লোকে আবিষ্কার করেছিল যে প্রতিটি ব্যক্তিই অনন্য। দলের টিকে থাকা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সাম্প্রদায়িক মানসিকতার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা প্রাচীন গোত্রীয় নীতি এক নতুন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদে প্রতিস্থাপিত হয়েছিল। একারণেই অ্যাক্সিয়াল যুগের বহু আধ্যাত্মিকতা সত্তার আবিষ্কারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল। বণিকদের মতো সাধুরাও স্বনির্মিত মানুষ ছিলেন। সাধুরা দাবি করেছিলেন যে, প্রতিটি ব্যক্তিকে আত্ম-সচেতন, নিজের কাজ সম্পর্কে সজাগ হয়ে উঠতে হবে; প্রতি উৎসর্গকারীকে আচারের উপলব্ধি করতে হবে এবং ব্যক্তিকে তার কাজের দায়দায়িত্ব নিতে হবে। আজকের দিনে আমরা আরেকটি অগ্রসর পদক্ষেপ নিতে চলেছি। আমাদের প্রযুক্তি বৈদ্যুতিক, সামরিক, আর্থিক ও রাজনৈতিকভাবে সম্পর্কিত বিশ্ব সমাজ গড়ে তুলেছে। আমাদের একটি বৈশ্বিক ঐক্যমত গড়ে তুলতে হবে, কারণ আমরা পছন্দ করি বা না করি, একই বিশ্বে আমাদের বাস। আমাদের সমস্যা অ্যাক্সিয়াল যুগ থেকে ভিন্ন হলেও আমাদের তারা সাহায্য করতে পারেন। একইভাবে আমাদেরও উচিত হবে অ্যাক্সিয়াল যুগের দর্শন গড়ে তোলা।
সহানুভূতি যে আমাদের নিজেদের গোষ্ঠীর ভেতরেই সীমিত রাখা যাবে না সেটা বোঝার বেলায় সাধুরা অনেক এগিয়ে ছিলেন। বৌদ্ধরা যাকে উদ্যোগের আওতা থেকে কোনও একটি সৃষ্টিকেও বাদ না দিয়ে পৃথিবীর শেষপ্রান্ত পর্যন্ত প্রসারিত হওয়া ‘অপরিমেয়’ দৃষ্টিভঙ্গি বলে আমাদের তার চর্চা করতে হবে। স্বর্ণবিধি অ্যাক্সিয়াল যুগের অনভিজ্ঞ লোকদের একথা মনে করিয়ে দিয়েছিল যে আমি তোমার সত্তার মতোই নিজের সত্তাকে মূল্য দিই। নিজের সত্তাকে পরম মূল্যে পরিণত করলে মানব সমাজ অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে, সুতরাং আমাদের অবশ্যই অন্যের কাছে ‘পরাজিত’ হতে শিখতে হবে। এই দর্শন গড়ে তুলে তাকে বৈশ্বিক তাৎপর্য দেওয়াই আমাদের চ্যালেঞ্জ। পবিত্রতার বিধিতে P জীবিত কোনও প্রাণীই অপবিত্র নয় এবং প্রত্যেকেই-এমনকি একজন দাসও-সার্বভৌম স্বাধীনতার অধিকারী বলে জোর দিয়েছিলেন। প্রতিবেশীকে আমাদের নিজেদের মতো করে ‘ভালোবাসতে’ হবে। আমরা যেমন দেখেছি, প্রত্যেকের জন্যেই আমাদের সাহনুভূতিপূর্ণ দয়ায় পরিপূর্ণ হয়ে থাকতে হবে, P এটা বোঝাননি; তাঁর আইনি পরিভাষায় ‘ভালোবাসা’র মানে ছিল সহায়ক, আনুগত এবং প্রতিবেশীকে বাস্তব সহযোগিতা দান। আজকের দিনে এই গ্রহের সবাই আমাদের পড়শী। মোজি তাঁর কালে রাজকুমারদের বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন যে জিয়ান আই-এর-বাস্তব অর্থবোধক, ‘সবার জন্যে’ ইচ্ছাকৃত ও পক্ষপাতহীন ‘সহানুভূতি’-চর্চা করা ভালো। মোজি যুক্তি দেখিয়েছেন, এতে আমাদের সেরা স্বার্থ রক্ষিত হবে। এখন আমরা জানি এটাই আসল ব্যাপার। আজ ইরাক বা আফগানিস্তানে যা ঘটছে কোনওভাবে আগামীকাল লন্ডন বা ওয়াশিংটনে তার প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে। শেষ উপায় হিসাবে ‘ভালোবাসা’ এবং ‘উদ্বেগ’ স্বার্থপর বা স্বল্পদর্শী নীতিমালার চেয়ে সবাইকে ঢের বেশি উপকৃত করবে।
দ্য ব্যাশে-এ ইউরিপিদিস দেখিয়েছেন যে ‘আগন্তুক’-কে প্রত্যাখ্যান করা বিপজ্জনক। তবে বিদেশী ও অচেনাকে মেনে নিতে সময় প্রয়োজন; আমাদের বিশ্বদৃষ্টির কেন্দ্র থেকে সত্তাকে স্থানচ্যুত করার জন্যে জোরাল প্রয়াসের প্রয়োজন। বৌদ্ধরা ভিন্ন মানসিকতার চর্চা করার জন্যে ‘অপরিমেয়’র উপর ধ্যানের পরামর্শ দিয়েছে। কিন্তু যাদের যোগের সময় বা মেধা কোওনটাই নেই, তারা বুদ্ধের কবিতা ‘জগতের সকল প্রাণী সুখী হউক’ আবৃত্তি করতে পারে-এই প্রার্থনার জন্যে কোনও ধর্মতাত্ত্বিক বা উপদলীয় বিশ্বাসের প্রয়োজন নেই। কনফুসিয়বাদীরাও আত্ম-চর্চার কর্মসূচির গুরুত্ব স্বীকার করেছিলেন। অন্যদের অযত্নে, অবহেলায় বা স্বার্থপরের মতো আচরণ করে না, এমন একজন পরিপক্ক, সম্পূর্ণ বিকশিত মানুষ জুনযি সৃষ্টির জন্যে আচারের প্রণয়ন করা হয়েছিল। কিন্তু সেগুলো আচারের মনোযোগের বিষয় ব্যক্তিকে বদলে দেয় এবং তার অন্তস্থঃ পবিত্রতাকে বের করে আনে। অন্যের প্রতি বাস্তবিক সম্মানের প্রকাশ সম্ভবত একটি শান্তিপূর্ণ বৈশ্বিক সমাজের জন্যে অপরিহার্য ও সম্ভবত দুর্বৃত্ত রাষ্ট্রকে ‘সংস্কার’ করার একমাত্র উপায়। তবে এই সম্মান অবশ্যই আন্তরিক হতে হবে। দাওদেজিং যেমন যুক্তি তুলে ধরেছিল, লোকে সবসময় আমাদের কাজের পেছনের উদ্দেশ্য বুঝে যায়। বিভিন্ন জাতিও তারা স্বার্থপরতা থেকে শোষিত হচ্ছে নাকি পরিহাসের স্বীকার হচ্ছে সে ব্যাপারে সজাগ হয়ে উঠবে। দুর্ভোগ পরিচ্ছন্ন, যৌক্তিক ধর্মতত্ত্বকে বরবাদ করে দেয়। ইযেকিয়েলের ভীতিকর, বিভ্রান্তিকর দিব্যদর্শন ডিউটেরোনমিস্টদের অধিকতর শৃঙ্খলিত মতাদর্শ থেকে বেশ ভিন্ন ছিল। অশউইয, বসনিয়া এবং বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রের ধ্বংস মানুষের মনের অন্ধকার দিক তুলে ধরেছে। আজকের দিনে আমরা এক করুণ পৃথিবীতে বাস করছি যেখানে, গ্রিকরা যেমন জানত, সহজ কোনও সামাধান থাকতে পারে না; ট্র্যাজিডির ঘরানা দাবি করে যে আমাদের অন্য লোকের চোখে ঘটনা দেখতে হবে। আমাদের ভাঙা জগতে ধর্মকে আলো বয় আনতে হলে, মেনসিয়াস যেমন পরামর্শ দিয়েছিলেন, আমাদের সকলের ঐতিহ্যের মূলে অবস্থান করা হারিয়ে যাওয়া হৃদয়, সহানুভূতির চেতনার খোঁজে নামা প্রয়োজন।