১০. আওয়ামী লীগ হরতাল ডেকেছে

আওয়ামী লীগ হরতাল ডেকেছে। রাস্তাঘাট ফাঁকা। তবে রিকশা চলছে, কিছু প্রাইভেট কার চলছে। এখনকার হরতাল আগের মতো কঠিন হচ্ছে না। কেমন ঢিলেঢালা ভাব। রাস্তায় পুলিশও কম।

আমি বাবার সঙ্গে হাঁটছি। ফুটপাত ছেড়ে রাস্তায় নেমে এসেছি। হরতালের দিনগুলিতেই মূল রাস্তায় হাঁটা যায়। নির্বিঘ্নে যে হাঁটা যায় তা-না। রাস্তায় ক্রিকেট খেলা হয়। যে-কোনো সময় বল এসে গায়ে লাগতে পারে। কিছু ক্রিকেট খেলা ভালো জমে যায়। চারপাশে উৎসাহী দর্শক জুটে যায়। আমরা এরকম একটা জম্পেশ ক্রিকেট খেলা পার হলাম। বাবা বললেন, বাবলু, তুই ক্রিকেট খেলিস?

আমি বললাম, না।

কোনো খেলাধুলাই করিস না?

এটা ঠিক না। খেলাধুলা করতে হবে। খেলাধুলার অনেক উপকারিতা oni

বাবাকে বিপর্যস্ত লাগছে। তিনি কুঁজো হয়ে হাঁটছেন। মুখভর্তি দাড়ি-গোঁফ। মাথার চুল আউলা-ঝাউলা। কিছুদিন হলো তিনি চশমা পরছেন। চশমায় এখনো অভ্যস্ত হন নি। কিছুক্ষণ পর পর তিনি দাঁড়িয়ে পড়েন। চশমা খুলে নিয়ে পাঞ্জাবির খুঁট দিয়ে অনেকক্ষণ ঘষাঘষি করেন। এই সময় তিনি চারদিকে অসহায়ের মতো তাকান।

আমরা যাচ্ছি হন্টন পীরের খোঁজে। বাবা হন্টন পীরের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিবেন। তিনি নিজেও পীর সাহেবের কাছ থেকে দোয়া নিবেন। তাঁর মামলা সতেরো তারিখ কোর্টে উঠছে।

বাবলু!

জি।

খেলাধুলার কথা মনে রাখবি। ইনডোর গেমস না, আউটডোর গেমস। ফুটবল, ভলিবল, ক্রিকেট, এইসব।

জি আচ্ছা।

মূল কথা একসারসাইজ। হাঁটাহাঁটিও একটা একসারসাইজ। এই যে আমরা হাঁটছি, আমাদের একসারসাইজ হচ্ছে। ব্লাড সারকুলেশন বাড়ছে। ফ্যাট কাটা যাচ্ছে। শরীরের জন্যে ফ্যাট অতি ভয়াবহ। হাঁটা মানে ফ্যাটের দফারফা।

আমি বললাম, তোমার হণ্টন পীর সাহেবের শরীরে নিশ্চয়ই কোনো ফ্যাট নেই। তিনি তো হাঁটার উপরই আছেন।

সাধারণ মানুষের সঙ্গে উনাদের মিলাবি না। উনারা হলেন মজনুন।

মজনুন কী?

মজনুন হলো দিওয়ানা। আল্লাহর প্রেমে দেওয়ানা। এরা হাঁটলেও যা, এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলেও তা। চাঁদপুরের এক পীর সাহেবের সন্ধান পেয়েছি, তিনি এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। তাঁর নাম বগা পীর। বক যেমন এক পায়ে দাঁড়ায় উনিও তাই। সূর্য ওঠার আগে দাঁড়ান। সূর্য ডোবার পর পা নামিয়ে আস্তানায় চলে আসেন। ঠিক করেছি তাকে একবার দেখতে যাব। এই জাতীয় মহাপুরুষদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হবার মধ্যেও পুণ্য আছে। তুইও চল। বাপ বেটা একসঙ্গে দেখে আসি। যাবি?

হুঁ।

গুড বয়। মামলায় যদি খালাস পেয়ে যাই তাহলে যেদিন খালাস পাব সেদিনই রওনা দেব। লঞ্চে যেতে দুই আড়াই ঘণ্টা লাগে, কোনো ব্যাপারই না! ভালো কথা, বাসায় মামলা নিয়ে তোর মা কিছু বলে?

না।

তোদের মধ্যে মিটিং-টিটিং হয় না?

আমার সঙ্গে হয় না। ভাইয়ার সঙ্গে হয়তো হয়। আমি জানি না।

কোনো আলাপই না?

না।

মনে হয় শেষ মুহূর্তে তোর মা মামলা তুলে নেবে। পৃথিবীর কোনো মা তার সন্তানদের বাবাকে জেলে পাঠায় না। মার কাছে সন্তানের চেয়ে বড় কিছু নাই। সন্তানের বাবাও এই কারণে তুচ্ছ না। বুঝলি?

হুঁ।

মামলা তোর মা শেষ মুহূর্তে উঠিয়ে নেবে, এই বিষয়ে আমি একশ পারসেন্ট নিশ্চিত। স্বপ্নে পেয়েছি।

স্বপ্নে কী পেয়েছ?

স্বপ্নে তোর মাকে দেখলাম। সে ছড়তা দিয়ে সুপারি কাটছে। মুখের দৃষ্টি কঠিন। আমি বললাম, তুমি তো পান খাও না। সুপারি কাটছ কী জন্যে?

সে কিছুই বলল না। তারপর দেখি পান বানাচ্ছে। আমি আশ্চর্য হলাম, কার জন্যে পান বানাচ্ছে? তারপর সে পানটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিল।

আমি বললাম, এর থেকে তোমার ধারণা হলো যে মা মামলা তুলে নেবে?

অবশ্যই।

বাবা কিছুক্ষণের জন্যে চুপ করলেন। অনেকখানি হাঁটা হয়েছে। পীর সাহেবকে পাওয়া যাচ্ছে না। বাবাকে খুবই ক্লান্ত লাগছে। যখনই কোনো খালি রিকশা দেখছেন আগ্রহ নিয়ে তাকাচ্ছেন। উনার কাছে টাকা থাকলে রিকশায় উঠে পড়তেন। বুঝতে পারছি, টাকা নেই। আমার কাছে আছে। আমি রিকশা ভাড়া করলে বাবা লজ্জা পাবেন। এই লজ্জাটা তাকে দেবার প্রয়োজন নেই।

বাবলু!

জি।

হাঁটার বিরাট উপকারিতা আছে, এটা মাথায় রাখবি।

জি আচ্ছা।

অতিরিক্ত হাঁটাও আবার ঠিক না। কোনো জিনিসই অতিরিক্ত ভালো না। ইংরেজিতে বলে— Too much of everything is bad. বাগধারা। ইংরেজি বাগধারা।

বাবা, তুমি মনে হয় ক্লান্ত হয়ে পড়েছ। চল কোথাও বসি, বিশ্রাম করি।

আইডিয়া খারাপ না। পাঁচ-দশ মিনিট বসে এক কাপ চা আর একটা সিগারেট খেয়ে রওনা দিতে পারলে ভালো হতো। নবউদ্যমে যাত্রা। নজরুলের গানের মতো। গান আছে না–চল চল চল… ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল…। গানটার মধ্যে যে ভুল আছে, খেয়াল করেছিস?

কী ভুল?

ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল– এই কথাটাই তো ভুল। গগন হলো আকাশ। আকাশে মাদল বাজবে কীভাবে? ভুল বলেছি?

রাস্তার মোড়ে ফ্লাক্সে করে চা-কফি দুটাই বিক্রি হচ্ছে। বাবা মা lে ভালো মতো দেখলেন। আমিও আড়চোখে দেখলাম। মানিব্যাগে দশ।

একটা নোট। এই তাঁর সম্বল।

দুটাকা করে কাপ। দুকাপ চা এবং বাবার একটা সিগারেটে চলে গেল। ছয় টাকা। বাবার তৃষ্ণা মিটে নি। তিনি উসখুস করছেন। আমি বললাম, চা অরে কাপ খাও।

বাবা বললেন, খাওয়া যেতে পারে। এরা চা-টা ভালো বানিয়েছে। তুই খাবি? আমার কাছে চার টাকা আছে। দুই কাপ চা হবে।

আমি বললাম, তুমি এক কাপ চা এবং একটা সিগারেট খাও। আমি খাব না।

বাবা বললেন, ঠিক আছে খাই। খেয়ে পুরোপুরি নিঃস্ব। তবে নিঃস্ব হবার মধ্যেও আনন্দ আছে। পৃথিবীর সমস্ত সাধু-সন্ন্যাসীও নিঃস্ব। নিঃস্ব অবস্থায় পথ চলা আনন্দের, আবার মানিব্যাগ ভর্তি টাকা নিয়ে পথ চলাও আনন্দের।

বাবা, তোমার টাকা-পয়সার অবস্থা কি খারাপ?

একটু ইয়ে যাচ্ছে। মানুষের জীবনে উন্থানপতন আছে না? এই বিষয়েও একটা ইংরেজি বাগধারা আছে। এখন ভুলে গেছি।

এখন কি তোমার পতন?

হুঁ। ভাটা চলছে। সমুদ্রের জীবনে যেমন জোয়ার-ভাটা আছে, মানুষের জীবনেও আছে। মানুষের সঙ্গে এই জায়গাতেই সমুদ্রের মিল।

 

পীর সাহেবকে শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল। উনি আজ বের হন নি। আস্তানায় ছিলেন। আমরা শুধু শুধুই উনার খোজে পথে পথে ঘুরেছি।

পীর সাহেবের চেহারায় বালক-ভাব আছে। ফর্সা মুখ, বড় বড় চোখ। চোখ জ্বলজ্বল করছে। মুখভর্তি দাড়ি থাকবে ভেবেছিলাম, দাড়ি নেই। তার পরনে অতি নোংরা এক কথা। কাধের ওপর আরেক কথা। সেটাও নোংরা। হাতপায়ের নখ মনে হয় তিনি কাটেন না। নখ বড় হয়ে পাখির ঠোঁটের মতো বেঁকে গেছে। পায়ের তলার চামড়া ফেটে ফেটে গেছে। ভেতরের লাল মাংস দেখা যাচ্ছে। পীর সাহেবের কোলে অ্যালুমিনিয়ামের লোটা। মাঝে মাঝে লোটা মুখে নিয়ে চুমুক দিচ্ছেন। লোটায় কী আছে কে জানে। ভালো কিছু নিশ্চয়ই না। লোটার জিনিস মুখে দেয়ার পর পর তার চোখ-মুখ কিছুক্ষণের জন্যে কুঁচকে যাচ্ছে। তাঁর বাঁ হাতে সিগারেট। হঠাৎ হঠাৎ তিনি সিগারেটে টান দিচ্ছেন। মনে হয় সিগারেটের প্রতি তার তেমন আগ্রহ নেই। পীর সাহেবকে ঘিরে চৌদ্দপনেরোজন মানুষের একটা জটলা। এর মধ্যে বোরকা পরা দুজন মহিলাও আছেন।

বাবা পীর সাহেবকে কদমবুসি করলেন। আমাকেও ইশারা করলেন কদমবুসি করতে। আমি তাঁর নির্দেশ পালন করলাম। বাবা হাত জোড় করে বললেন, আমার ছেলে, নাম বাবলু, আপনি একটু দোয়া করে দেন।

পীর সাহেব কিছুক্ষণ মাথা নাড়লেন। এটাই মনে হয় তাঁর দোয়া।

বাবা বললেন, আমার জন্যেও হুজুর একটু দোয়া করতে হবে। মামলা মোকদ্দমায় পড়ে গেছি।

পীর সাহেব আগ্রহী গলায় বললেন, কী মামলা? ফৌজদারি না দেওয়ানি?

ফৌজদারি। জেল হয়ে যেতে পারে। জেলে যাওয়াটা আটকান।

পীর সাহেব বললেন, দুনিয়াটাই তো জেল। এক জেল থেকে আরেক জেলে যাবি, অসুবিধা কী?

পীর সাহেবের অতি জ্ঞানগর্ভ কথায় অনেকেই অভিভূত হলো। বুঝদারের মতো মাথা নাড়তে লাগল। বাবা করুণ গলায় বললেন, আপনার দরবারে এসেছি, আমার জেলে যাওয়াটা আটকান।

পীর সাহেব বললেন, আল্লাহপাকের নাম কয়টা জানিস?

নিরানব্বইটা।

কোরআন শরীফে নাম আছে নিরানব্বইটা। কিন্তু উনার নাম সর্বমোট তিন হাজার। এক হাজার নাম জানে ফেরিশতারা। এক হাজার জানেন পয়গম্বররা। নয়শ নিরানব্বইটা আছে চাইর কিতাবে। বাকি থাকল কত?

একটা বাকি।

যে নামটা বাকি সেটা ইসমে আজম। এই পাক নাম আল্লাহ গোপন রেখেছেন। কেউ কেউ সেই নামের সন্ধান পায়। যারা পায় তারা…

পীর সাহেব চোখ বন্ধ করে ফেললেন। ইসমে আযমের সন্ধান তিনি পেয়েছেন এরকম মনে হলো।

পীর সাহেব একসময় চোখ মেলে ইশারায় বাবাকে কাছে আসতে বললেন। বাবা তার কাছে গেলেন। পীর সাহেব তার পাখির ঠোঁটের মতো নখ দিয়ে বা হাতে বাবার কপালে কী যেন কাটাকাটি করে হৃষ্ট গলায় বললেন, যা তোর কপালে আসল জিনিস লিখে দিয়েছি। এর নাম ইসমে আযম। হাকিম একবার যদি তোর দিকে তাকায়, তোর কপালের দিকে তাকায়, তাহলে ইসমে আযম তার দিলে ধাক্কা দিবে। তোরে খালাস করা ছাড়া তার কোনো পথ নাই।

ভুড়িওয়ালা বেঁটে এক লোক বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, হুজুরের আজকে দিলখোশ বলে এত বড় জিনিস পেয়ে গেলেন। আপনি বিরাট ভাগ্যবান। বসে আছেন কেন? হুজুরকে কদমবুসি করেন।

বাবা কদমবুসি করলেন। আমিও করলাম। ইসমে আযম যিনি জানেন তাঁকে কদমবুসি না করে উপায় আছে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *