১০. অ্যালান-এ-ডেল
লিটল জন ফিরে আসার বেশ কিছুদিন পরের কথা। শেরউডে ভোজের জন্যে অতিথি পাওয়া যাচ্ছে না। এদিক-ওদিক লোক পাঠিয়ে যখন তেমন সুবিধে হচ্ছে না, শুকনো মুখে ফিরে আসছে সবাই, তখন একদিন রবিন ঠিক করলো নিজেই বেরোবে সে। শাঁসালো কোন মক্কেল সঙ্গে না নিয়ে ফিরবে না। সবাইকে বলে গেল, ‘ভোজের আয়োজন সম্পূর্ণ করে রাখো, আমি ফিরলেই চড়িয়ে দেবে রান্না।’
আস্তানা থেকে অনেকদূর সরে এসে রাস্তার ধারের জঙ্গলে একটা জুতসই ঝোপ বেছে নিয়ে তার আড়ালে বসে রইলো সে। সেকেণ্ড গড়িয়ে মিনিট হচ্ছে, মিনিট গড়িয়ে ঘন্টা কিন্তু ভাল কোন শিকারের দেখা আর মেলেই না। বিরক্ত হয়ে উঠলো সে মনে মনে। এক দুই করে ঘন্টার সংখ্যাও বেড়ে চললো। রাস্তা দিয়ে লোকজন আসছে যাচ্ছে, কিন্তু সবই খেটে-খাওয়া কৃষক বা শ্রমিক। একবার যদিও বা একটা ঘোড়াগাড়ির সাক্ষাৎ পাওয়া গিয়েছিল, মহিলা যাত্রী দেখে এগোয়নি সে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো, তবু দেখা নেই কোন মক্কেলের। অনুচরদের টিটকারি কিভাবে সামাল দেবে সেই চিন্তায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লো রবিন।
এমনি সময়ে অপূর্ব মিষ্টি একটা সুর কানে এলো ওর। গান গাইতে গাইতে এগিয়ে আসছে কে যেন। সাথে টুং টাং হার্পের তারে নিপুণ টোকার শব্দ। কে লোকটা? বড় আশ্চর্য গলা তো! ঝোপের আড়াল থেকে মুখ বের করে রাস্তার দিকে চাইলো রবিন।
চমৎকার দেখতে এক যুবক, কাঁধ পর্যন্ত লম্বা সোনালী চুল, মাথায় ছোট একটা টুপি, টুপির একপাশে গোঁজা রয়েছে মোরগের পালক, পরনে উজ্জ্বল লাল রঙের সুন্দর পোশাক; হাঁটছে, মৃদু আঙুল বুলাচ্ছে হার্পের তারে, সেইসাথে গাইছে অপূর্ব এক উচ্ছল প্রেমের গান। এত ভাল লাগলো গানটা যে রবিনের মনে হলো গোটা জঙ্গলটা কাঁপছে খুশির কাঁপনে। জাদু বুঝি একেই বলে! আনন্দের জোয়ার যেন এসে পৌঁছেছে শেরউড জঙ্গলে। বুকের ভিতরটা কাঁপছে রবিনের। কী অদ্ভুত গলা! কী আশ্চর্য গান!
পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইলো রবিন, সামনে দিয়ে হেঁটে চলে গেল ভ্রাম্যমাণ চারণ-যেন মধু বর্ষণ করে গেল। যতক্ষণ শোনা গেল, কান পেতে শুনলো রবিন; ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো যতক্ষণ না অস্পষ্ট হতে হতে মিলিয়ে গেল গানটা অনেক দূরে। আহা, এত মিষ্টি গান জীবনে শোনেনি সে আর কোন দিন।
পুবদিকে চাইলো রবিন। দেখলো দূরের জঙ্গলে সন্ধ্যার ছায়া নামছে। নাহ্, আজ আর কেউ যাবে না এই পথে। ফিরে চললো সে আস্তানার দিকে অপটু কণ্ঠে একটু আগে শোনা গানের কলি ভাঁজতে ভাঁজতে 1
ওকে একা ফিরে আসতে দেখে কনুই দিয়ে পাশের জনকে ধাক্কা মারলো কেউ কেউ, দেখেও দেখলো না রবিন। সবিনয়ে জানতে চাইলো কেউ কেউ, ভোজের আয়োজন হয়েছে, রান্নাটা চড়িয়ে দেবে কিনা, শুনেও শুনলো না রবিন। মনটা আজ ভরে আছে খুশির গানে, গায়ে মাখলো না সে কারও কোন টিটকারি, চুপচাপ খেয়ে নিয়ে ঘুম দিল সেঁটে।
পরদিন সকাল দশটার দিকে বুড়ো ওকের গায়ে হেলান দিয়ে বসে আছে রবিন, ওর একপাশে মাথার নিচে দু’হাত রেখে চিত হয়ে শুয়ে আকাশ দেখছে উইল স্কারলেট, আরেক পাশে বসে ছুরি দিয়ে চেঁছে ক্র্যাবটীর ডাল দিয়ে একটা লাঠি তৈরি করছে লিটল জন, ওদের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে-বসে আছে আরো কয়েকজন সবাই গল্প শুনছে উইল স্কেদলকের মুখে। ইনিয়ে-বিনিয়ে চমৎকার গল্প বলে স্কেদলক, পুরানো কালের রাজা-বাদশা আর নাইটদের কত কাহিনী যে ওর মুখস্থ আছে, সে-হিসেব ওর নিজেরও জানা নেই। আজকের কাহিনী রাজা আর্থারের সময়কার এক ন্যায়নিষ্ঠ নাইট স্যার ক্যারোডকের বীরত্ব, ত্যাগ ও মহানুভবতা; একটি মেয়ের প্রতি তাঁর গভীর প্রেম; এবং তাঁরা একে অপরের জন্যে কী অপরিসীম কষ্ট স্বীকার করেছেন তাই নিয়ে। গল্প শুনতে শুনতে মস্ত বড় দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছে কয়েকজন, চোখে পানি এসে যাচ্ছে কারও কারও।
‘মানুষের মনটাকে অনেক বড় করে দেয় এইসব গল্প,’ কাহিনী’ শেষ হতে মন্তব্য করলো রবিন। ‘এইসব মহান পুরুষদের আত্মত্যাগের কথা শুনলে মনে হয় আমরাও আমাদের ছোট্ট গণ্ডীর বাইরে বেরিয়ে তাদের মতো মহৎ কিছু করি। আমাদের মতো সাধারণ মানুষের পক্ষে অবশ্য অতটা বড় হওয়া সম্ভব নয়, কিন্তু চেষ্টা করলে কিছুটা তো হওয়া যায়। চাঁদ ধরার জন্যে যে শূন্যে লাফিয়ে ওঠে, চাঁদকে সে পায় না, তবে যে-লোক কাদা থেকে একটা পয়সা তোলার জন্যে ঝুঁকে রয়েছে নিচে, তার চেয়ে তো অনেক ওপরে উঠতে পারে।
‘তা ঠিক, সাথে সাথে বললো বাস্তববাদী উইল স্টিউটলি। ‘তবে একজন একটা পয়সা পাচ্ছে, অপরজন ক্যাঁচকলা। পয়সা ছাড়া খালি পেটে থাকতে হচ্ছে ভাববাদীকে। এসব গল্প শুনতেই ভাল, আমার মনে হয় এইসব মহান নায়কদের পদাংক অনুসরণ করতে যাওয়া নেহায়েতই বোকামি।’
‘কী পদের মানুষ রে বাবা!’ ভুরু কুঁচকে বললো রবিন। সব সময় আকাশ-ছোঁয়া ভাবনাগুলো ধরে টেনে এনে ধুলোয় নাক ঘষায়! যাই হোক, তোমার সঙ্গে এইসব চুলচেরা তর্কে পারবো না আমি; টেনে যখন বাস্তব দুনিয়ায় নামিয়েছো, তখন রওনা হয়ে যাও, বাছা, বাস্তব কাজে। সম্মানীয় অতিথি ছাড়া আর কদিন বাদেই আমাদের টাকা-পয়সার টান পড়বে। জনা ছয়েক লোক নিয়ে ফস্ ওয়ের দিকে রওনা হয়ে যাও, বা যেদিক খুশি যাও, সন্ধের সময় আজ আমার একজন অতিথি চাই-ই চাই।’
‘বেশ তো, যাচ্ছি,’ বললো উইল স্টিউটলি। গল্প-গুজব থেকে এইভাবে উঠিয়ে দেয়ায় ক্ষুণ্ন হয়েছে সে। মিষ্টি হেসে বললো, ‘ছয় জনের মধ্যে মিজ দ্য মিলার আর আর্থার এ ব্যাণ্ড—এই দুজনকে নেব ভাবছি, কারণ, তুমি তো ভাল করেই জানো, লাঠি- পেটা করায় ওদের জুড়ি নেই। ঠিক বলিনি, লিটল জন?’
রবিন আর লিটল জন ছাড়া বাকি সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। লিটল জনের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে রবিন বললো, ওদের একজনের কথা আমি বলতে পারি। দু’জন সম্পর্কেই ওয়াকিফহাল, এমন আমাদের মধ্যে শুধু একজনই আছেন…নাম বলতে চাই না।’
আবার একচোট হাসির হুল্লোড় উঠলো, তাতে যোগ দিল না একমাত্র লিটল জন। ভুরু কুঁচকে দূরের দিকে চেয়ে রয়েছে সে, যেন কতই চিন্তামগ্ন।
উইল স্টিউটলির বাছাই করা ছয়জন তৈরি হয়ে রওনা দেবে, ঠিক এমনি সময়ে দূর থেকে ভেসে এলো একটা গানের সুর। গান গাইতে গাইতে এগিয়ে আসছে কে যেন। চট করে গত কালকের সেই কোকিল-কণ্ঠি যুবকের কথা মনে পড়ে গেল রবিনের। কিন্তু সুরের এ কী আশ্চর্য পরিবর্তন! সেই যুবক, নাকি এ অন্য কোন গায়ক? গলাটা তো সেই ছেলেটিরই মনে হচ্ছে! আজ এত করুণ গান কেন ওর কণ্ঠে?
একটু পরেই দেখা গেল যুবকটিকে। সত্যিই, চেহারাতেও আশ্চর্য পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। ধীর ক্লান্ত পায়ে হাঁটছে যুবক, মাথাটা নুয়ে আছে সামনে, চলার ভঙ্গিতে মনে হচ্ছে কেউ যেন এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দিয়েছে ওর জীবন থেকে সব আনন্দ-উচ্ছ্বাস। ভাবাই যায় না, এই ছেলেটিই কাল গোটা জঙ্গলকে প্রাণতরঙ্গে নাচিয়ে দিয়ে, চারদিকে খুশির বন্যা বইয়ে দিয়ে হেঁটে গিয়েছিল এই রাস্তা ধরে। আর আজ মনে হচ্ছে শেরউডের বিশাল ওকগুলোও যেন স্তব্ধ হয়ে শুনছে বিলাপ, গোটা জঙ্গল কাঁদছে যুবকের দুঃখে। অদ্ভুত করুণ সুরের মূর্ছনায় ডুকরে উঠছে যেন বিশ্ব চরাচর। চোখে পানি এসে গেল বিশাল দৈত্য লিটল জনের। মাথাটা এপাশ-ওপাশ নেড়ে বললো, ‘আহা! এত দুঃখ কেন ছেলেটার?’
‘অথচ গতকাল দেখেছি আমি একে, সম্পূর্ণ অন্য রকম,’ বললো রবিন। ‘কিছু একটা হয়েছে ওর। যাও তো, চট করে ডেকে নিয়ে এসো ওকে। কি হয়েছে শোনা দরকার।
লিটল জন আর মাচ এগিয়ে গেল। দেখা গেল, বিষণ্ণবদনে করুণ গান গাইছে বটে, কিন্তু মোটেও কাপুরুষ নয় যুবক, হেঁড়ে গলায় থেমে দাঁড়াবার নির্দেশ আসতেই ঝট্ করে ফিরলো সে লিটল জন আর মার্চের দিকে। চট্ করে একটা তীর যোজনা করলো ধনুকে, প্রয়োজন হলে আত্মরক্ষা করবে।
একটা হাত তুললো লিটল জন। কোন ভয় নেই, হে। তোমার কোন ক্ষতি করতে আসিনি। ওই দেখো, বসে রয়েছে আমার দলপতি, তোমার সাথে কথা বলতে চায়।’
খুবই আদর করে কাছে বসালো ওকে রবিন। অত্যন্ত ভদ্রভাবে বললো, ‘বুঝতেই পারছো, আমরা ডাকাত। দিয়ে যাবার মত বাড়তি কিছু পয়সা-কড়ি আছে তোমার কাছে?’
‘পাঁচ শিলিং আর এই আংটি ছাড়া আর কিছুই নেই আমার কাছে।’ পকেট থেকে যা ছিল সব বের করে দিল সে রবিনের হাতে।
বিয়ের আংটি মনে হচ্ছে?’ জিজ্ঞেস করলো রবিন
‘হ্যাঁ,’ মাথা নিচু করে ফেললো যুবক। ‘সাত বছর ধরে সাথে সাথে রেখেছিলাম ওটা, ভেবেছিলাম কাজে লাগবে আজ। নাহ্! এখন আর আমার কাছে কোন দাম নেই ওটার, যার খুশি নিতে পারো।’
‘দাম নেই কেন?’
‘মেয়েটাকে কেড়ে নিয়েছে ওরা আমার কাছ থেকে।’
‘তাই তো বলি, কাল যাকে দেখলাম খুশির বন্যা তুলে লাফিয়ে চলছে, আজ এই আশ্চর্য পরিবর্তন কেন তার! কি হয়েছে খুলে বলো দেখি?’
কি? তুমি দেখেছিলে কাল আমাকে? ঠিকই বলেছো, কাল খুশি মনে চলেছিলাম আমি অপূর্ব মিষ্টি, দুনিয়ার সেরা সুন্দরী এক মেয়েকে বিয়ে করবো বলে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো যুবক। হলো না! চুরমার হয়ে গেছে কলজেটা। আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে বুড়ো এক ধনী নাইটের সাথে বিয়ে দেয়া হচ্ছে তার।
‘হঠাৎ বুঝি মত পাল্টেছে মেয়েটা?’
‘না, না!’ প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো যুবক। ও মত পাল্টাবে কেন? ও তো আমাকে ভালবাসে। কিন্তু ওর আত্মীয়স্বজন ওকে বিয়ে দেবে না আমার সাথে। টাকা-পয়সা, জমি-জমা, বাড়ি-ঘর কিছুই তো নেই আমার। তাই আজ ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে এক বুড়ো নাইটের সাথে বিয়ে হচ্ছে ওর। চলে যাচ্ছি আমি।’
‘কি নাম তোমার?’ জানতে চাইলো রবিন।
‘আমার নাম অ্যালান-এ-ডেল।’
‘আরে! তোমার নাম তো আমি শুনেছি! তাহলে তুমিই সেই বিখ্যাত গায়ক, ফুলের সুবাসের মত যার সুনাম ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে! রদারস্ট্রীমের অ্যালান না তুমি?’
মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল যুবক। ওর কাঁধে হাত রাখলো রবিন। বয়স কত তোমার?’
‘বিশ বছর।’
‘মেয়েটিকে সত্যিই তুমি ভালবাসো?’
‘নিজের প্রাণের চেয়েও।’
এসব কথা বলবে আমাদের? মনটা অনেক হালকা হয়ে যাবে তাহলে,’ নরম গলায় বললো রবিন।
অবাক হয়ে চাইলো যুবক রবিনের মুখের দিকে। ‘তোমাকে দস্যু মনে হচ্ছে না আমার। মনে হচ্ছে, তোমার মত ভাল মানুষ আর হয় না। ঠিক আছে, শোনো তাহলে…’ গড় গড় করে বলে গেল অ্যালান, কিভাবে পরিচয় হলো ওর এলেনের সাথে, কিভাবে পরস্পরকে ভালবাসলো ওরা, কিভাবে মন জানাজানি হলো, গোপনে দেখা হলো, সৃষ্টি হলো কত মধুর স্মৃতির।
ভালবাসার এক অপূর্ব কাহিনী মন দিয়ে শুনলো ওরা চুপচাপ। শুনতে শুনতে গলার কাছে কি যেন ঠেকে গেছে বলে মনে হলো লিটল জনের। এত গভীর দুঃখের কথা এমন সহজ সরল ভাষায় বর্ণনা করে গেল যুবক যে চোখের পানি ধরে রাখা কষ্টকর হয়ে পড়লো উইল স্কারলেটের পক্ষেও। ‘বাবা-মার অবাধ্য সে হবে না,’ সবশেষে বললো অ্যালান-এ-ডেল, ‘হয়তো বিয়ে সে করবে বুড়ো নাইটকে, কিন্তু আমি জানি, দাউ দাউ করে জ্বলবে ওর হৃদয়টা। আমার জন্যে ও…আমি-’ আর কোন কথা বলতে পারলো না যুবক। বসে রইলো মাথা নিচু করে।
অনেকক্ষণ পর আবার ওর কাঁধে হাত রাখলো রবিন। ‘আচ্ছা, অ্যালান-এ-ডেল, আমি যদি তোমাকে সাহায্য করি, যেমন করে হোক ব্যবস্থা করতে পারি তোমাদের বিয়ের, তাহলে কি দেবে তুমি আমাকে?’
টাকা নেই আমার যে দেব,’ বললো অ্যালান। কিন্তু সত্যিই পারবে তুমি? পারলে বাকি জীবন তোমার কেনা গোলাম হয়ে থাকবো আমি। তুমি যা বলবে তাই করবো।’
‘কেনা গোলাম হওয়ার দরকার নেই। কিন্তু আমি যদি বলি, তোমার গান আমার খুব ভাল লাগে, থাকবে তুমি আমাদের সাথে এই শেরউড জঙ্গলে?’
এলেনকে পেলে আমি দুনিয়ার যে কোন জায়গাতেই থাকতে পারবো মনের আনন্দে।’
‘বেশ। এবার বলো দেখি বিয়েটা কোথায় হতে যাচ্ছে?’
‘এখান থেকে মাইল পাঁচেক দূরের একটা গির্জায়। এই জঙ্গল থেকে বেরিয়ে…’
‘চিনতে পেরেছি, আর বলতে হবে না। ঠিক সময় মতো পৌঁছে যাব আমি।’ একটু চিন্তা করে হাত বাড়ালো রবিন অ্যালানের দিকে, ‘তোমার হাপটা ধার দিতে হবে আমাকে।’
সমস্ত অস্ত্র খুলে লিটল জনের হাতে দিল রবিন, হাপটা হাতে তুলে নিয়ে একটু দূরে ডেকে নিয়ে গেল তাকে। লিটল জনের কানে কানে কিছু নির্দেশ দিয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে চলে গেল গির্জার পথ ধরে, একা।
গির্জার কাছাকাছি এসে টুং টাং মিষ্টি আওয়াজ তুললো রবিন হার্পে। শব্দ শুনে দরজায় এসে দাঁড়ালেন দামী পোশাক পরা একজন বিশপ। বললেন, ‘ও, তুমি! আমি ভেবেছিলাম বিয়ে-পার্টির লোকজন এসে গেছে বুঝি। তা, কি করছো তুমি এখানে? ‘কে তুমি?’
মাথা থেকে টুপিটা খুলে লম্বা করে কুর্নিশ করলো রবিন বিশপকে। বললো, ‘আমি একজন ভবঘুরে হার্প-বাদক, হুজুর। লোকে বলে, আমার চেয়ে ভাল বাদক নাকি এদিকের গোটা অঞ্চলে আর নেই। শুনলাম আপনার এক বাল্যবন্ধুর বিয়ে পড়াবেন আজ আপনি। এই খুশির দিনে বাজনা শুনিয়ে যদি দু’চারটে পয়সা···
‘বেশ তো,’ খুশি হলেন বিশপ। ‘ভিতরে এসো। বাজাও দেখি, শোনা যাক তোমার বাজনা
‘এখন বাজানো কি ঠিক হবে?’ বললো রবিন। গুরুজনরা বলেন, বর-কনে এসে পৌঁছবার আগে বাজনা বাজালে অমঙ্গল হয়। হুজুর যদি বলেন, আমি শুরু করতে পারি এক্ষুণি, কিন্তু আমাদের ওদিকে একটা কথা আছে-
‘থাক, থাক। অমঙ্গল হলে এক্ষুণি শুরু করার দরকার নেই। তবে চট্ করে তৈরি হয়ে নাও, ওদের আসার দেরিও নেই বিশেষ।’
কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পৌঁছলো বুড়ো বর, তার পিছনে পরমা সুন্দরী এক তরুণী।
বিয়ের অনুষ্ঠান দেখবার জন্যে প্রচুর লোক জড়ো হয়েছিল গির্জায়, বর-কনেকে ঢুকতে দেখে পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি শুরু করলো তারা। এত বুড়ো একটা লোকের সঙ্গে অমন ফুটফুটে সুন্দর বাচ্চা এক মেয়ের বিয়ে হতে যাচ্ছে দেখে অসমর্থনের একটা মৃদু গুঞ্জন উঠলো দর্শকদের মধ্যে। কারণ, পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, নাইটটি কেবল থুথুড়ে বুড়োই নয়, বাম কাঁধে তার মস্ত এক কুঁজ, তার ওপর একটা চোখ আবার কানা। অথচ নিষ্পাপ তাজা গোলাপের মত দেখাচ্ছে মেয়েটিকে।
কিন্তু জোব্বা পরা ধর্মযাজক আর ধনী নাইটের পোশাকের জাঁকজমক দেখে কেউ জোরে কিছু বলতে সাহস পেল না। সবার মনের কথা বেরিয়ে এলো রবিনের বিস্মিত উচ্চকণ্ঠ থেকে।
‘আশ্চর্য!’ বলে উঠলো সে। ‘অনেক অনেক বিয়ে দেখেছি, বাবা; কিন্তু এমন বেমানান জোড়া তো আর দেখিনি!’
‘চুপ করো!’ ধমকে উঠলেন বিশপ। ‘বর-কনে হাজির হয়ে গেছে, এক্ষুণি শুরু হবে বিয়ের অনুষ্ঠান।’
তা হোক,’ বললো রবিন, ‘কিন্তু এই বুড়ো হাবড়ার সঙ্গে না। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, বাধ্য হয়ে এই বিদঘুটে বিয়েতে রাজি হয়েছে কনে। তাকে নিজের পছন্দ মত বর বেছে নেয়ার সুযোগ দেয়া উচিত।’
‘আবার বক বক করে!’ রেগে উঠলেন বিশপ। ‘বকশিশ যদি পেতে হয়, বক বক বন্ধ করে বাজনা শুরু করো। এক্ষুণি বেদির দিকে পা বাড়াবে কনে।
‘বাজনা?’ হেসে উঠলো রবিন হুড। ঠিকই বলেছেন, হুজুর, এখন বাজনা বাজানোই উচিত। তবে, সত্যি বলতে কি, হার্পের চেয়ে শিঙাটাই আমি বেশি ভাল বাজাতে পারি।’ এই বলে কাপড়ের নিচ থেকে বিউগলটা বের করে মুখে তুললো সে।
তীক্ষ্ণ তিনটে আওয়াজ বেরোলো শিঙা থেকে। পরমুহূর্তে কোত্থেকে দৌড়ে এসে হুড়মুড় করে গির্জায় ঢুকলো চব্বিশ জন সশস্ত্র তীরন্দাজ। তাদের পুরোভাগে অ্যালান-এ-ডেল।
মহা হৈ-হট্টগোল রেধে গেল গির্জার ভিতর। রাগে নীল হয়ে গেছেন বিশপ। রাগে কাঁপছে বুড়ো নাইটও। কারণ, অ্যালান-এ-ডেলকে দেখামাত্র ছুটে গিয়ে তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে কনে। এগোতে গিয়ে সামলে নিল নিজেকে নাইট, অ্যালানের দলবলের চেহারা-সুরত দেখে সাহস হলো না কিছু করতে। গোটা গির্জার উপস্থিত সবাই এবার ফিরলো রহস্যময় হার্প-বাদকের দিকে যার শিঙাধ্বনি ডেকে এনেছে অবস্থার এই আশ্চর্য পরিবর্তন।
একটা হাত মাথার উপরে তুলে সবাইকে চুপ করার নির্দেশ দিল রবিন। মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে গেল শোরগোল। সবাই শুনতে চায় কি বলার আছে ওই রহস্যময় যুবকটির।
‘অ্যালান-এ-ডেল,’ উঁচু গলায় জানতে চাইলো রবিন, ‘তুমি এলেনকে ভালবাসো?’
‘সমস্ত অন্তর দিয়ে ভালবাসি,’ জবাব দিল অ্যালান, ‘চিরকাল বাসবো।’
‘বেশ,’ বললো রবিন, ‘এবার এলেনের বক্তব্য শোনা যাক। এলেন, তুমি অ্যালান-এ-ডেলকে ভালবাসো?’
‘বাসি!’ ছোট্ট করে জবাব দিল এলেন।
‘তোমরা পরস্পরকে বিয়ে করতে রাজি আছো?’ আবার জানতে চাইলো রবিন।
‘আছি,’ সমস্বরে বললো দু’জন।
‘বেশ। এবার আমার দু’টো কথা শুনুন, উপস্থিত দর্শক ও সুধিবৃন্দ!’ গলার স্বর আরও একটু চড়িয়ে দিল রবিন। আমরা সবাই জানতে পারলাম, এই দুটি তরুণ- তরুণী পরস্পরকে ভালবাসে। ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোর করে মেয়েটিকে বিয়ে দেয়া হচ্ছে এক ধনকুবের, কুৎসিত, বৃদ্ধ নাইটের সাথে। আমি মনে করি, টাকার জোরে নিষ্পাপ এক প্রেমকে পায়ের তলায় পিষে মারার, দু’টি তরুণ জীবনকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়ার মত এমন নির্মমতা, এত বড় নিষ্ঠুর অধর্ম আর হয় না। আমি প্রস্তাব করছিঃ বুড়ো পাত্রকে বাদ দিয়ে আজই অ্যালানের সাথে এলেনের বিয়েটা সর্বসমক্ষে সুসম্পন্ন হয়ে যাক।’ বিশপের দিকে ফিরলো সে, ‘নিন, শুরু করুন।’
‘কে রে ব্যাটা তুই!’ রেগেমেগে হুঙ্কার ছাড়লেন বিশপ, ‘বাজনা বাদকের ছদ্মবেশে গির্জায় ঢুকে এখন রাজার মত হুকুম করা হচ্ছে!’
‘ঠিকই বলেছেন, বিশপ, শান্ত গলায় বললো রবিন। সাত-কুড়ি দুর্ধর্ষ, দুঃসাহসী যুবক আমাকে রাজার সম্মান দিয়ে থাকে। আমি রবিন হুড।’
রবিন হুড! নামটা শুনে বিস্ময়ে বোবা হয়ে গেল গির্জার সবাই। দু’চোখ ভরে দেখে নিচ্ছে সবাই লোকের মুখে মুখে বিখ্যাত হয়ে ওঠা স্বনামধন্য দুর্দান্ত যুবকটিকে। ভয়ে অন্তরাত্মা শুকিয়ে গেল নাইটের, ঠক ঠক করে কাঁপতে লেগেছেন বিশপও।
‘এইবার, বিশপ,’ মৃদু হেসে বললো রবিন, ‘বিয়েটা পড়িয়ে দিন।’
‘না,’ দুই হাঁটু ঠকাঠক বাড়ি খাচ্ছে বিশপের, কিন্তু মুখে একটা একগুঁয়ে ভাব বজায় রাখার চেষ্টা করছেন তিনি।
‘কেন নয়, জানতে পারি?’
‘এ দেশের আইন অনুযায়ী তিনবার জানতে হবে এ বিয়েতে কারও কোন আপত্তি আছে কিনা,’ বললেন বিশপ। তা নইলে সিদ্ধ হবে না বিয়ে।’
‘বেশ তো, চট্ করে জিজ্ঞেস করে ফেলুন তিনবার।’
‘না। পবিত্র গির্জার মধ্যে তুমি জোর করে ঢুকে গায়ের জোরে যা খুশি তাই…’
‘পবিত্র গির্জার মধ্যে যা খুশি তাই অধর্মের কাজ করার অধিকার আপনিই বা কোথায় পেয়েছেন, বিশপ?’ রেগে গেল এবার রবিন। শুনুন, গায়ে আমার অনেক জোর আছে, কিন্তু সেটা আপনার মত দুর্বলের ওপর প্রয়োগ করতে চাই না। খুবই ছোট মনের মানুষ আপনি, লোকে মানছে আপনাকে শুধু ওই পোশাকটার জন্যে। আপনি রাজি না হলে টেনে খুলে নেয়া হবে আপনার ওই পোশাক, আমার লোক সেটা গায়ে চড়িয়ে নিয়ে যা করার করবে।’
দ্বিধায় পড়ে গেছেন বিশপ। তাই দেখে মৃদু হাসলো রবিন। বুঝলো, আর একটু ভয় না দেখালে কাজ হবে না। চোখের ইঙ্গিতে নির্দেশ দিল সে। সাথে সাথে দু’জন এগিয়ে এসে খুলে ফেললো বিশপের জোব্বা। উঁচু গলায় হাঁক ছাড়লো রবিন, ‘লিটল জন, এদিকে এসো। এই কাপড় পরে বিশপ হয়ে যাও দেখি!’
একগাল হেসে আলখেল্লাটা গায়ে চড়ালো লিটল জন। ওকে ওই পোশাকে এমন বিদঘুটে লাগলো দেখতে যে গোটা গির্জার সবাই হাসতে শুরু করলো। কিন্তু লিটল জন গম্ভীর। অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নিয়েছে সে কাজটা। বিশপের জায়গায় বিশপের পোশাকে বিশপের গাম্ভীর্য নিয়ে কাজ শুরু করলো সে। হাসতে হাসতে খুন হয়ে যাচ্ছে সবাই, সেদিকে খেয়াল নেই, তিনবার যদি যথেষ্ট না হয়, সেই ভয়ে সাতবারের আগে থামলো না সে, তাও থামতো না, রবিন যদি হাঁক ছেড়ে থামতে না বলতো।
এইবার বিশপের দিকে ফিরলো রবিন হুড। ‘বিয়েটা ভালোয় ভলোয় পড়িয়ে দেবেন,’ জানতে চাইলো সে, ‘না, বন্দী হয়ে শেরউডে যাবেন আমাদের সাথে? চটপট ভেবে বলুন, কোন্টা করবেন।
শেরউডে ধরে নিয়ে যাওয়ার কথা শুনে পিলে চমকে গেল বিশপের। শিউরে উঠলেন তিনি। চট্ করে রাজি হয়ে গেলেন বিয়ে পড়াতে। আলখেল্লা খুলে দিল লিটল জন। শুরু হলো অনুষ্ঠান।
কনে সম্প্রদানের প্রশ্ন উঠতেই এগিয়ে এলো রবিন হুড।
‘আমি সম্প্রদান করছি এলেনকে অ্যালান-এ-ডেলের হাতে। তোমরা সুখী হও, এই আমার কামনা। যদি কেউ তোমাদের সুখের পথে কাঁটা হয়, কেউ কোনো গোলমাল করতে চায়, আগে বোঝাপড়া করতে হবে তাকে আমার সাথে।’
তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্য দিয়ে শেষ হলো বিয়ের অনুষ্ঠান। যেমন এসেছিল, তেমনি ঝড়ের মত বেরিয়ে গেল দস্যুদল গির্জা থেকে তাদের সাথে শেরউডের পথে পা বাড়ালো নব-দম্পতি।
চলতে চলতে এক সময় রবিনের পাশে চলে এলো অ্যালান-এ-ডেল, ওর একটা হাত তুলে নিয়ে আলতো করে চুমো খেলো তাতে। কৃতজ্ঞ, মৃদুকণ্ঠে বললো, ‘ধন্যবাদ!’