॥ ১০ ॥
অমরকুমার এখন কেঁচো। সিমলা ফেরার পথে গাড়িতেই ও সব স্বীকার করেছে। ফেলুদা অবিশ্যি ওর নিজের রিভলভারটা উদ্ধার করে নিয়েছিল, আর সেটা হাতে থাকায় প্রবীরবাবুকে দিয়ে সত্যি কথা বলাতে সুবিধে হয়েছিল। ভদ্রলোকের মাথায় বুমের্যাঙের বাড়ি মেরে আবার লালমোহনবাবুই রাস্তা থেকে খানিকটা বরফ তুলে সেখানটায় লাগিয়ে দিয়েছিলেন। অবিশ্যি ভদ্রলোকের তাতে উপকার হয়েছিল কিনা জানি না। বেহুঁশ ড্রাইভারও এখন অনেকটা সুস্থ। তাকে টাকার লোভ দেখিয়ে দলে টানতে না পেরে শেষটায় গায়ের জোরে ঘায়েল করেন প্রবীরবাবু।
অশরীরী ছবি থেকে বাদ যাবার পর থেকেই প্রবীরবাবুর মাথাটা বিগড়ে যায়, কারণ ওর বিশ্বাস ছিল ফিল্মে অভিনয় করে ওর অনেক পয়সা ও নাম-ডাক হবে। ব্যাগড়া দিল ওর গলার স্বর। সিধে রাস্তায় কিছু হবে না জেনে বাঁকা রাস্তার কথা ভাবেন। সেই সময় বেরোয় নেপালী বাক্স। সেই বাক্স ঘেঁটে প্রবীরবাবু, পেয়ে গেলেন একটা পলকাটা পাথর। যাচাই করে দাম জেনে চোখ কপালে উঠে যায়। এবার স্বপ্ন দেখেন নিজেই ছবি প্রডিউস করে নিজেই হবেন তার হিরো, কেউ তাকে বাদ দিতে পারবে না। তার পরের যে ঘটনা, সেটা তো আমাদের জানাই।
আপাতত প্রবীরবাবুকে রাখা হয়েছে সিমলায় হিমাচল প্রদেশ স্টেট পুলিশের জিম্মায়। হীরেটা পাবার পর থেকেই ফেলুদার প্রবীরবাবুকে সন্দেহ হয়েছিল, তাই সিমলায় এসেই দীননাথবাবুকে টেলিফোন করে চলে আসতে বলে—যদিও কারণটা বলেনি। উনি কাল এগারোটার গাড়িতে এসে ভাইপো সম্বন্ধে যা ভালো বোঝেন করবেন। হীরেটা বোধহয় দীননাথবাবুরই হাতে চলে যাবে, কারণ সেটা এসেছিল তাঁর জ্যাঠামশাইয়ের সঙ্গে।
আমি সব শুনেটুনে বললাম, ‘হীরের ব্যাপারটা তো বুঝলাম, কিন্তু শম্ভুচরণ বোসের ভ্রমণকাহিনীটা কোথায় গেল?’
ফেলুদা বলল, ‘ওটা হল দু’ নম্বর রহস্য। দোনলা বন্দুক হয় জানিস তো? সেইরকম আমাদের এই বাক্স-রহস্যটা হল দোনলা রহস্য।’
‘এই দ্বিতীয় রহস্যটার কিছু কিনারা হল?’ আমি জিগ্যেস করলাম।
‘হয়েছে, থ্যাঙ্কস্ টু খবরের কাগজ অ্যান্ড জলের গেলাস।’
শম্ভুনাথের খাতার রহস্যের চেয়ে ফেলুদার এই কথার রহস্যটা আমার কাছে কিছু, কম বলে মনে হল না।
বাকি রাস্তাটা ফেলুদা আর কোনো কথা বলেনি।
এখন আমরা ক্লার্কস হোটেলের উত্তর দিকের খোলা ছাদে রঙীন ছাতার তলায় বসে হট চকোলেট খাচ্ছি। সবসুদ্ধ আটটা টেবিলের মধ্যে একটাতে আমরা তিনজন বসেছি, আরেকটাতে দুজন জাপানী আর আরেকটা দূরের টেবিলে বসেছেন সেই কানে তুলোওয়ালা ভদ্রলোক (এখন অবিশ্যি তাঁর কানে আর তুলো নেই)। আকাশে মেঘ কেটে গেলেও সন্ধ্যা হয়ে এসেছে বলে আলো এমনিতেই কম। পূব দিকে পাহাড়ের গায়ে সিমলা শহর বিছিয়ে রয়েছে, শহরের রাস্তায় আর বাড়িগুলোতে একে একে আলো জ্বলে উঠছে।
লালমোহনবাবু এতক্ষণ চুপচাপ ছিলেন। দেখে বুঝতে পারছিলাম কী যেন ভাবছেন। অবশেষে চকোলেটে একটা বড় রকম চুমুক দিয়ে বললেন, ‘সব মানুষের মনের মধ্যেই বোধহয় একটা হিংস্রতা বাস করে। তাই নয় কি ফেলুবাবু? বুমের্যাঙের বাড়িটা মারতে ভদ্রলোক যখন পাক খেয়ে পড়ে গেলেন, তখন ভেতরে একটা উত্তেজনা ফীল করছিলুম যেটাকে উল্লাস বললেও ভুল হবে না। আশ্চর্য!’
ফেলুদা বলল, ‘মানুষ যে বাঁদর থেকে এসেছে সেটা জানেন তো? আজকাল একটা থিওরি হয়েছে যে শুধু বাঁদর থেকে নয়, আফ্রিকার এক ধরনের বিশেষ জাতের খুনে বাঁদর থেকে। কাজেই প্রবীরবাবুর মাথায় বুমের্যাঙের বাড়ি মেরে আপনার যে আনন্দ হয়েছে, সেটার জন্য আপনার পূর্বপুরুষরাই দায়ী।’
আমরা যতই বাঁদর আর বুমের্যাং নিয়ে কথা বলি না কেন, আমার মন কেবল চলে যাচ্ছে শম্ভুচরণের ভ্রমণকাহিনীর দিকে। কোথায়, কার কাছে রয়েছে সেই লেখা? নাকি কারুর কাছেই নেই, আর কোনোদিনও ছিল না?
শেষ পর্যন্ত আমি আর থাকতে না পেরে বললাম, ‘ফেলুদা, ধমীজা মিথ্যে কথা বলছেন, না দীননাথবাবু?’
ফেলুদা বলল, ‘দুজনের কেউই মিথ্যে বলছে না।’
‘তার মানে লেখাটা আছে?’
‘আছে।’ ফেলুদা গম্ভীর। ‘তবে সেটা ফেরত পাওয়া যাবে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ।’
আমি ভয়ে ভয়ে জিগ্যেস করলাম, ‘কার কাছে আছে জানো?’
‘জানি। এখন সবই জানি, সবই বুঝতে পারছি। তবে সে লোককে দোষী প্রমাণ করা দুরূহ ব্যাপার। তুখোড় বুদ্ধি সে লোকের। আমাকেও প্রায় বোকা বানিয়ে দিয়েছিল।’
‘প্রায়?’
প্রায় কথাটা শুনে আমার ভালোই লাগল। ফেলুদা পুরোপুরি বোকা বনছে এটা ভাবাই আমার পক্ষে কষ্টকর।
‘মিত্তির সাহাব—’
একজন বেয়ারা ছাদের দরজার মুখটাতে এসে দাঁড়িয়ে ফেলুদার নাম ধরে ডেকে এদিক-ওদিক দেখছে।
‘এই যে এখানে’—ফেলুদা হাত তুলে বেয়ারাটাকে ডাকল। বেয়ারা এগিয়ে এসে ফেলুদার হাতে একটা বড় ব্রাউন খাম দিল।
‘মৈনেজার সাহাবকে পাস ছোড় গিয়া আপ্কে লিয়ে।’
খামের উপর লাল পেনসিলে লেখা—মিস্টার পি সি মিটার, ক্লার্ক্স হোটেল।
খামটা হাতে নিয়েই ফেলুদার মুখের ভাব কেমন জানি হয়ে গিয়েছিল। সেটা খুলে ভিতরের জিনিসটা বার করতেই একটা চেনা গন্ধ পেলাম, আর ফেলুদার মুখ হয়ে গেল একেবারে হাঁ।
‘এ কী—এ জিনিস—এখানে এল কী করে?’
যে জিনিসটা বেরোল সেটা একটা বহুকালের পুরোন খাতা। এরকম খাতা আমাদের দেশে আর কিনতে পাওয়া যায় না। খাতার প্রথম পাতায় খুদে খুদে মুক্তোর মতো অক্ষরে লেখা A Bengalee in Lamaland, তার তলায় লেখকের নাম Shambhoo Churn Bose, আর তার তলায় মাস ও সাল June 1917.
‘এ যে সেই বিখ্যাত ম্যানুস্প্রিণ্ট!’ বলে উঠলেন লালমোহনবাবু। ভদ্রলোকের ইংরিজি শুধরে দেবার মতো মনের অবস্থা আমার নেই। আমি দেখছি ফেলুদার দিকে। ফেলুদার দৃষ্টি এখন আর খাতার উপর নেই। সে চেয়ে আছে তার সামনের দিকে। ফেলুদা কি তাহলে সত্যিই পুরোপুরি বোকা বনে গেল নাকি?
এবারে বুঝতে পারলাম ফেলুদা একটা বিশেষ কিছুর দিকে দেখছে। আমারও দৃষ্টি সেই দিকে গেল। জাপানীরা উঠে চলে গেছে। এখন আমরা ছাড়া শুধু একটি লোক ছাদে বসে আছে। সে হল এককালে কানে তুলোওয়ালা কালো চশমা পরা নেপালী টুপি পরা বুড়ো ভদ্রলোক।
ফেলুদা একদৃষ্টে ওই ভদ্রলোকটির দিকেই দেখছে।
ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। তারপর ধীরে ধীরে আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। আমাদের টেবিল থেকে তিন হাত দূরে দাঁড়িয়ে প্রথমে চশমা, আর তারপর টুপিটা খুললেন। এ চেহারা এখন চেনা যাচ্ছে, কিন্তু তাও কোথায় যেন একটা খটকা রয়ে গেছে।
‘ফল্স টীথ পরবেন না?’ ফেলুদা প্রশ্ন করল।
‘সার্টন্লি!’
পকেট থেকে এক জোড়া বাঁধানো দাঁত বার করে ভদ্রলোক উপরনীচ দু’পাটি ভরিয়ে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তার গালের তোবড়ানো চলে গেল, চোয়াল শক্ত হয়ে গেল, বয়স দশ বছর কমে গেল। এখন আর চিনতে কোনই কষ্ট হয় না।
ইনি হলেন ল্যান্সডাউন রোডের চ্যাম্পিয়ন খিট্খিটে শ্রীনরেশচন্দ্র পাকড়াশী।
‘কবে করিয়েছেন দাঁত?’ ফেলুদা প্রশ্ন করল।
‘অর্ডার দিয়েছিলাম বেশ কিছুদিন হল, হাতে এসেছে দিল্লী থেকে ফেরার পরের দিন।’
এখন বুঝতে পারলাম দীননাথবাবু কেন নরেশবাবুকে বুড়ো ভেবেছিলেন। ট্রেনে ওর ফলস্ টীথ ছিল না। তারপর আমরা যখন তাঁকে ল্যান্সডাউন রোডে দেখেছি ততদিনে উনি দাঁত পরা শুরু করে দিয়েছেন।
ফেলুদা বলল, ‘বাক্সটা যে আপনা থেকে বদলি হয়নি, ওটা যে কেউ প্ল্যান করে বদল করিয়েছে, এ সন্দেহ আমার অনেক আগে থেকেই হয়েছে। কিন্তু সেটা যে আপনার কীর্তি সেটা ভেবে বার করতে সময় লেগেছে।’
‘সেটা স্বাভাবিক’, নরেশবাবু, বললেন, ‘আমি ব্যক্তিটিও যে নেহাত মূর্খ নই, সেটা নিশ্চয়ই আপনি স্বীকার করবেন।’
‘একশোবার। কিন্তু আপনার গলদটা কোথায় হয়েছিল জানেন? ওই খবরের কাগজগুলো ধমীজার বাক্সে পোরাতে। এটা কেন করেছিলেন তা জানি। খাতাটা থাকায় দীননাথবাবুর বাক্সের যা ওজন ছিল, ধমীজার বাক্স ছিল তার চেয়ে হালকা। সে বাক্স হাতে নিলে দীননাথের খটকা লাগতে পারত। তাই সেটায় কাগজ পুরে ওজনটাকে একটু বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু ট্রেনে পড়া কাগজ কে আর কষ্ট করে ভাঁজ করে বাক্সে পোরেন বলুন!’
‘রাইট! কিন্তু সেইখানেই তো আপনার বাহাদুরি। অন্য কেউ হলে সন্দেহ করত না।’
‘এবার একটা প্রশ্ন আছে’, ফেলুদা বলল, ‘আপনি বাদে সকলেই সে রাত্রে বেশ ভালো ঘুমিয়েছিলেন, তাই না?’
‘হুঁ—তা বলতে পারেন।’
‘অথচ দীননাথ সচরাচর ট্রেনে মোটেই ভালো ঘুমোন না। তাকে কি ঘুমের ওষুধ খাইয়েছিলেন?’
‘রাইট!’
‘জলের গেলাসে ঘুমের বড়ি গুঁড়ো করে ঢেলে দিয়েছিলেন?’
‘রাইট। সেকোনাল। ওটা সর্বদাই আমার সঙ্গে থাকে। ডিনারের আগে প্রত্যেককেই খাবার জল দিয়ে গিয়েছিল, এবং ধমীজা বাদে অন্য দুজনই বাথ্রুমে হাত ধুতে গিয়েছিল।’
‘তার মানে ধমীজাকে খাওয়াতে পারেননি?’
‘উঁহু। তার ফলে রাতটা আমার মাঠে মারা যায়। ভোর ছটায় উঠে ধমীজা দাড়ি কামায়, তারপর তার জিনিসপত্র বাক্সে রেখে বাথরুমে যায়। সেই সুযোগে আমি আমার কাজ সারি। তখনও অন্য দুজন অঘোরে ঘুমোচ্ছেন।’
‘তবে আপনার সবচেয়ে চালাকি কোনখানে জানেন? লেখাটা হাত করার পরেও আমার কাছে এসে সেটার জন্য টাকা অফার করা।’
মিস্টার পাকড়াশী হো হো করে হেসে উঠলেন। ফেলুদা বলল, ‘সিমলা যেতে বারণ করে টেলিফোন ও কাগজে লেখা হুমকি—এও তো আপনারই কীর্তি?’
‘ন্যাচারেলি। প্রথম দিকে তো আমি মোটেই চাইনি আপনি সিমলা আসেন। তখন তো আপনি আমার পরম শত্রু। আমি তো ভাবছি—ফেলু মিত্তির যখন বাক্সের ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েছে, তখন আমার এমন পারফেক্ট ক্রাইমটা ফাঁস হয়ে যাবে। প্লেনে পর্যন্ত আমি আপনার ওই বন্ধুটির পকেটে হুম্কি কাগজ গুঁজে দিয়েছি তারপর ক্রমে, এই সিমলায় এসে, মনে হল লেখাটা আপনাকে ফেরত দেওয়াই উচিত।’
‘কেন?’
‘কারণ খাতা ছাড়া বাক্স ফেরত দিলে আপনার ঘাড়েও তো খানিকটা সন্দেহ পড়ত। সেটা আমি চাইনি। আপনি-লোকটাকে তো এ ক’দিনে কিছুটা চিনেছি!’
‘থ্যাঙ্ক ইউ, নরেশবাবু। এবারে আমি আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি কি?’
‘নিশ্চয়ই।’
‘লেখাটা যে ফেরত দিলেন—আপনি ইতিমধ্যে এর একটা কপি করে রেখেছেন, তাই না?’
নরেশবাবুর মুখে এক মুহূর্তে শুকিয়ে গেল। বুঝলাম ফেলুদা একটা ওস্তাদের চাল চেলেছে। ও বলে চলল, ‘আমরা যখন আপনার বাড়ি গেলাম, তখনই আপনি এটা কপি করছিলেন টাইপ করে, তাই না?’
‘কিন্তু…আপনি…?’
‘আপনার ঘরে একটা গন্ধ পেয়েছিলাম, সেটা শম্ভুচরণের নেপালী বাক্সে পেয়েছি, আর আজ পাচ্ছি এই খাতাটায়।’
‘কপিটা কিন্তু—’
‘আমাকে বলতে দিন, প্লীজ!—শম্ভুচরণ মারা গেছেন টোয়ান্টিওয়ানে। অর্থাৎ একান্ন বছর আগে। অর্থাৎ এক বছর আগে তার লেখার কপিরাইট ফুরিয়ে গেছে। অর্থাৎ সে লেখা আজ যে কেউ ছাপাতে পারে—তাই না?’
‘আলবৎ পারে!’ নরেশবাবু উত্তেজিত ভাবে বললেন। ‘আপনি কি বলতে চান এটা করে আমি কিছু অন্যায় করেছি? এ তো অসাধারণ লেখা—দীননাথ কি এ লেখা কোনোদিন ছাপাত? এটা আমিই ছাপব, এবং আমার এ অধিকারে কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।’
‘হস্তক্ষেপ না করলেও, প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে তো?’
‘তার মানে? কে করবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা? কে?’
ফেলুদার ঠোঁটের কোণে সেই হাসি। আরেকবার হ্যাণ্ডসেক করার জন্য নরেশবাবুর দিকে ডান হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল—
‘মীট ইওর রাইভ্যাল, মিস্টার পাকড়াশী। এই বাক্স-রহস্যের ব্যাপারে আমি দীননাথবাবুর কাছে কেবল একটি পারিশ্রমিকই চাইব—সেটা হল এই খাতাটা।’
‘বুমের্যাং’, বলে উঠলেন জটায়ু।
যদিও কেন বললেন সেটা এখনও ভেবে বের করতে পারিনি।
—
|| সমাপ্ত ||