১০. অবিশ্বাস্য গুরুর অবিশ্বাস্য শিষ্যেরা

অবিশ্বাস্য গুরুর অবিশ্বাস্য শিষ্যেরা

আর্ত ও পীড়িতদের সেবায় সবধর্মের, বিশেষ করে বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান সন্ন্যাসীদের ভূমিকার কথা আজও মানুষের হৃদয় হরণ করে। এঁদের একজন সন্ন্যাসী উপগুপ্তর সেবাকাহিনি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের লেখনীতে অমর হয়ে রয়েছে। খ্রিস্টান সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীদের সেবাকাহিনি খ্যাত অখ্যাত নগরে ও জনপদে আজও নিঃশব্দে ঘটে চলেছে। আমরা মাদার তেরেজার অমৃতপ্রেমের কথা কিছুটা জানি, কিন্তু জানি না অখ্যাত আরও সব সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীদের আত্মত্যাগের কথা। যেমন ঊনিশ শতকের কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ প্রাঙ্গণের কথা। একজন অস্ট্রেলীয় গবেষক কিছুকাল আগে এই হাসপাতালে এক শীর্ণতনু লরেটো সন্ন্যাসিনীর কথা লিপিবদ্ধ করেছেন। যাঁর সেবা তিনি করছেন তাঁর সমস্ত শরীরে সিফিলিসের ঘা–দেহের মাংস খসে খসে পড়ছে।

স্বামীজির সেবাধর্মে অনুপ্রাণিত কয়েকজন সন্ন্যাসীর বিচিত্র ত্যাগের কথাও আমরা বিস্মৃত হয়েছি। এঁদের নাম স্বামী শুভানন্দ (আদি ঠিকানা কলকাতার মুসলমানপাড়া লেন), স্বামী কল্যাণানন্দ (আদি নিবাস বরিশাল বানারিপাড়া), স্বামী নিশ্চয়ানন্দ যাঁর জন্ম মহারাষ্ট্রে, স্বামী স্বরূপানন্দ (জন্ম কলকাতায়) এবং স্বামী অচলানন্দ (আদি ঠিকানা কাশী)। জীবিতকালে যাঁদের হাতে নিগৃহীত হয়ে স্বামীজি জীবনের শেষ পর্বে বেশ মনোকষ্ট পেয়েছেন তাদের মধ্যে তার প্রিয় শিষ্য, শিষ্যা, অনুরাগী এবং অনুরাগিনীরা আছেন, জ্ঞাত অজ্ঞাত কারণে তারা ভক্তের আসন ত্যাগ করে প্রবাসের মাটিতেও প্রাক্তন গুরুর তিক্ত বিরোধিতা করেছেন। এঁদের কয়েকজনকে বিড়ম্বিত বিবেকানন্দ পর্বে আমরা দেখেছি, যেমন, স্বামী কৃপানন্দ, অভয়ানন্দ, মিস হেনরিয়েটা মুলার ও বহুদিনের ভারতপ্রেমী ই টি স্টার্ডি। বিদেশের মাটিতে চারজন অনুরাগী যেমন তিক্ত বিচ্ছেদের সৃষ্টি করলেন তেমন কয়েকজনের কথা বলা যেতে পারে যাঁরা গুরুনির্দেশে প্রতিটি কথা মান্য করার জন্য অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলতে দ্বিধা করলেন না। কোন্ মন্ত্রে বিবেকানন্দ তাদের এমনভাবে অনুপ্রাণিত করলেন তা তিনিই জানেন।

মনে রাখতে হবে, প্রিয়জনদের অপ্রত্যাশিত শত্রুভাব এবং অনুরাগীর প্রশ্নাতীত প্রেম দুই-ই বিবেকানন্দকাহিনিকে অবিশ্বাস্য মহিমায় আলোকিত করেছে।

এবারের নিবন্ধেআমরা স্বদেশের চারজনঅনুরাগীর গুরুনির্দেশেঅবিশ্বাস্য ত্যাগের অনুসন্ধান করবো। তার আগে, অনেকের কৌতূহল, এদেশে শ্রীরামকৃষ্ণের নামাঙ্কিত যেক’টি আরোগ্যনিকেতন রয়েছে তার কোনটিকে হাসপাতাল বলা হয় না কেন? কলকাতার সেবাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত এক প্রবীণ সন্ন্যাসী আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, পৃথিবীর প্রথম হাসপাতাল বহু শত বর্ষ আগে বৌদ্ধ যুগে এই দেশেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তার আরও নিবেদন, শুধু চিকিৎসাতেই আরোগ্য হয় না, মস্ত বড় ভূমিকা রয়েছে সেবার। নার্সিং কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা বুঝে সারা বিশ্ব এখন এই প্রফেশনের জয়গানে মুখর,কিন্তু সেবকও সেবিকাদের আচরণবিধি বৌদ্ধযুগের ভারতীয় সন্ন্যাসীরাই রচনা করেছিলেন। অঙ্কটা এইরকম : চিকিৎসা + সেবা = আরোগ্য।

রামকৃষ্ণ মিশন হাসপাতালগুলি তাই ‘সেবাশ্রম’ অথবা ‘সেবা প্রতিষ্ঠান’।

কনখলের সেবাশ্রমের আদিযুগের এক গল্প বলা যেতে পারে। বরিশালের বানারিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করে এক গোঁয়ার বাঙাল স্রেফ স্বামীজির ইচ্ছায় হাজির হয়েছিলেন হরিদ্বারের লাগোয়া জনপদ কনখলে। সেখানে একবার কয়েকজন কর্মী চাইলেন, এটাকে হাসপাতাল বলা হোক এবং কাজের সময় নির্দিষ্ট হোক।

সন্ন্যাসী তার উত্তরে বললেন, “দেখ, আমাদের তো আর হাসপাতাল নয়। স্বামী বিবেকানন্দ পাঠিয়েছেন সেবা করবার জন্য। এটা হচ্ছে সেবাশ্রম। এখানে বাপু ঘড়ি ধরে কাজ চলবে না। আমাদের হল সেবা ভাব।” অর্থাৎ হাসপাতাল নয়, সাধন-ক্ষেত্র–ভগবদুপাসনার স্থান।

ঘুরে-ফিরে কয়েকজন স্মরণীয় শিষ্য ও অনুরাগীর নাম এতদিন পরেও খুঁজে পাওয়া যায়। এঁদের একজনের জন্ম মহারাষ্ট্রের দক্ষিণ কানাড়ায়, একজনের ভবানীপুরে, একজনের চব্বিশ পরগণা ইছাপুরে, একজনের বেনারসে এবং আর একজনের বরিশাল উজিরপুরের হানুয়া গ্রামে। কী ছিল বিধাতার মনে, এঁদের মানবপ্রেমের প্রকাশ ঘটল কাশিতে এবং কনখলে।

তৃতীয় জনের বিবেকানন্দ অনুরাগের উৎস কাব্যপাঠ। সদ্য প্রকাশিত ‘উদ্বোধন’ পত্রিকায় স্বামীজি অবিশ্বাস্য একটি কবিতা লিখেছিলেন। অধুনালুপ্ত আর একটি পত্রিকায় বিশেষ সংখ্যায় স্বামীজির হস্তক্ষরে কবিতাটি পুনর্মুদ্রিত হয়েছিল। এবারের নাম ‘আঁধারে আলোক’।উদ্বোধনে নাম ছিল ‘সখার প্রতি’। কবি বিবেকানন্দের রচনাটি কলকাতায় ছাপা হয়ে সুদূর কাশীধামে পৌঁছে তার জীবিতকালেই কী কাণ্ড করেছিল তা যথাস্থানে নিবেদন করবো।অনুপ্রাণিত ভক্তরা বলে থাকেন, এমন কবিতা পৃথিবীতে আর লেখা হয়নি।

কবিতার শেষ দুটি লাইন- বহুরূপে সম্মুখে তোমার, হাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর? জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।–বোধ হয় আমাদের পরমপ্রিয় মহামানবের মহত্তম বাণী, কিন্তু বাকি কবিতাটি কি সন্ন্যাসী বিবেকানন্দের অকপট স্বীকারোক্তি? এবার বসুমতী পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায় ফেরা যাক। “শ্রীমদ্ স্বামী বিবেকানন্দের হস্তলিপির নতুন শিরোনাম ‘আঁধারে আলোক’।” এই নামটি কোথা থেকে এল? এই নামেই কি প্রথম কবিতাটি লেখা হয়েছিল? না পরে নামের পরিবর্তন হয়? এই পরিবর্তনের মালিকানা কি স্বয়ং কবির? না পরবর্তীকালের সম্পাদকের? কিন্তু এই কবিতা তো কবির জীবিতকালেই প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। বসুমতীতে মুদ্রিত এই হস্তলিপিটিই কি কবি বিবেকানন্দের প্রথম পাণ্ডুলিপি? কারণ, যা এখন আমরা ছাপার অক্ষরে পঞ্চাশ লাইনে পড়তে অভ্যস্ত তা স্বামীজির নিজস্ব হস্তলিপিতে অর্ধেক আকারে পঁচিশ লাইনে আবদ্ধ হতে দেখা যাচ্ছে।

বিবেকানন্দর এই কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয় উদ্বোধন পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যায়। উদ্বোধন প্রথম সংখ্যার প্রকাশ ১৪ জানুয়ারি ১৮৯৯।

এই সময়কার ঘটনা শুনুন। পাঠকের নাম চারুচন্দ্র দাস, কলকাতার ঠিকানা মুসলমানপাড়া লেন, রিপন কলেজে পড়াশোনা। একসময় কলকাতার অ্যাটর্নি ফার্ম সোইলহ এন্ড চন্দ্রতে কেরানি হিসেবে সকাল দশটা থেকে চারটে পর্যন্ত কাজ করতেন। স্বামীজি যেদিন পাশ্চাত্যদেশ জয় করে প্রথমবার স্বদেশে ফিরলেন, সেদিন (১৮৯৭, ২১ ফেব্রুয়ারি) শিয়ালদহে স্বামীজির ঘোড়ার গাড়ি টেনে চারুচন্দ্র ভেবেছিলেন পুরীতে জগন্নাথদেবের রথ টানছেন। পরের বছর পিতা শ্যামশঙ্কর দাস ও মা কাশীবাসী হলে চারুচন্দ্রও কাশীবাসী হন, ওখানে একটা স্কুলে মাস্টারি করেন, মাইনে নেই তবে বিনামূল্যে মধ্যাহ্নভোজন আছে।

“কলিকাতা হইতে ডাকযোগে উদ্বোধন’ আসিয়া চারুচন্দ্রের হাতে পৌঁছাইল। উদ্বোধন’ খুলিয়াই চারুচন্দ্রের চোখে পড়িল স্বামীজিরচিত অগ্নিগর্ভ কবিতা ‘সখার প্রতি। বার বার কবিতাটির শেষ পঙক্তি চারিটি তিনি পড়িতে লাগিলেন :

ব্রহ্ম হতে কীট-পরমাণু, সর্বভূতে সেই প্রেমময়, মন প্রাণ শরীর অর্পণ কর সখে, এ সবার পায়। বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর? জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর। “কবিতার প্রতি ছত্র চারুচন্দ্রের ভাবজগতে মহাবিপ্লবের সূচনা করিল। পড়িতে পড়িতে তাঁহার দেহ রোমাঞ্চিত হইল, অন্তরে এক অননুভূতপূর্ব পুলক অনুভব করিলেন। স্বামীজির আহ্বানে তিনি শিহরিয়া উঠিতেছিলেন–আনন্দের আতিশয্যে অস্থির হইয়া উদ্বোধন’ খানি হাতে লইয়া জনৈক বন্ধুর গৃহে তখনই ছুটিয়া যান।…

“সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছিল তখন। বন্ধুটি তাহার ঘরের কোণে বসিয়া একান্তে ভগবচ্চিন্তা করিতেছিলেন। চারুচন্দ্র ঘরে ঢুকিয়াই তাহাকে আসন হইতে তুলিয়া, পঠিত ‘উদ্বোধন’-এর সেই পৃষ্ঠাটি খুলিয়া উদাত্তস্বরে তাহার কাছে পাঠ করিতে থাকিলেন। আনন্দে আবেগে বন্ধুর পিঠ চাপড়াইয়া বলিয়াছিলেন, “আরে স্বামিজীর কথা শোন। কি তুমি ঘরের কোণে চোখ বুজে আছ! এই শোন স্বামিজীর বেদান্তবাণী। ঐ যে সম্মুখে ব্যাধি-পীড়িত বুভুক্ষু দরিদ্রদের দেখছ, ওরাই আমাদের ঈশ্বর–আমাদের নারায়ণ–আমাদের শিব।’

চারুচন্দ্রের কাশীপ্রবাসী এই ধর্মপ্রাণ বন্ধুটির নাম যামিনীরঞ্জন মজুমদার। পরবর্তীকালে স্বামীজি এঁকেও মন্ত্রদীক্ষা দেন। উভয় বন্ধুই যেন তাঁহাদের বহুপ্রতীক্ষিত আদর্শ-পথকে এতদিনে খুঁজিয়া পাইলেন। চারুচন্দ্র আবার বলিতে থাকিলেন, “শোন যামিনী, স্বামীজি বলেছেন, ঈশ্বর বা ব্রহ্ম এই জগতের প্রত্যেক জীবের মধ্যেই অধিষ্ঠান করছেন। সর্বভূতে ব্রহ্ম রয়েছেন–এই ভাবটিকে জাগিয়ে তোলাই সকল ধর্মের, সকল সাধনার এবং সকল কর্মের সারকথা। আজ স্বামিজী আমাদের এই কথাই বুঝিয়ে দিলেন। এইভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে ব্যক্তিগত জীবনকে উন্নত ও শক্তিসম্পন্ন করাই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ ধর্মসাধনা।” যামিনীরও প্রতি শিরায় শিরায় তখন বিবেকানন্দ-তড়িৎপ্রবাহ ছুটতে শুরু করেছিল। স্বামিজীর ভাবাদর্শে দীক্ষাগ্রহণ চারুচন্দ্রের এইভাবেই হয়েছিল।

“অবিমুক্ত বারাণসী-সনাতন ভারতের প্রাচীনতম তীর্থ। যুগ যুগ ধরিয়া এই তীর্থভূমিতে কত মানুষের ভিড় কত সাধু সন্ন্যাসী পরিব্রাজকের আনা-গোনা এখানে চলিতেছে! মুক্তিকামী অসংখ্য নরনারী জীবনের সন্ধ্যায় আসিয়া শ্রীশ্রীবিশ্বনাথ-অন্নপূর্ণার চরণ আশ্রয় করিয়া পড়িয়া থাকেন। তখনকার দিনে সুবিধাবাদী পাণ্ডারা তীর্থযাত্রীদের উপর নানাভাবে নির্যাতন করিত। যাত্রীদের মধ্যে কেহ অসুস্থ হইলে তাহার টাকাকড়ি সব কাড়িয়া লইয়া তাহাকে অসহায় অবস্থায় ধর্মশালা হইতে পথে বাহির করিয়া দিত। যাত্রীটি যদি বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা হইতেন, তবে তাহার যে কী শোচনীয় পরিণতি হইত, তাহা ভাষায় প্রকাশ করা চলে না। অসহায় এইসব যাত্রীরা পথে পড়িয়াই মরিতেন।

“চারুচন্দ্রের পূর্বোক্ত বন্ধু যামিনীরঞ্জন অনুরূপ একটি বৃদ্ধাকে পথের ধারে মরণোন্মুখ দেখিয়া, স্বহস্তে তাঁহার শুশ্রূষা করিয়াছিলেন। সেদিন ছিল ১৩ই জুন–অর্থাৎ চারুচন্দ্রের মুখে ‘সখার প্রতি’ আবৃত্তি শুনিবার ঠিক পরের দিন। যামিনী ছত্রের ভিক্ষায় জীবন ধারণ করিতেন, আর নিত্য গঙ্গাস্নান, বিশ্বনাথ অন্নপূর্ণাদর্শন এবং সাধন-ভজন লইয়াই দিন কাটাইতেন। সেদিন অতি প্রত্যুষে গঙ্গাস্নানান্তে ফিরিবার পথে মুমূর্ষ এই বৃদ্ধাকে দেখিতে পাইয়া তাহার প্রাণ ব্যথায় কাঁদিয়া উঠিয়াছিল।

“মৃতপ্রায় বুড়ীর সর্বাঙ্গ মল-মূত্রে ঢাকিয়া ছিল–যামিনীরঞ্জন বিনা দ্বিধায় নিজ হাতে তাহার দেহ পরিষ্কার করিয়া, পরম যত্নে তাহাকে তুলিয়া আনিয়া একটি বোয়াকে শোয়াইয়া দিয়া পথ্যের সন্ধানে বাহির হইয়াছিলেন। পথ্য সংগ্রহ তিনি করিবেন কোথা হইতে? তিনি নিজে তো ভিক্ষাজীবী। তাই পথচারী জনৈক ভদ্রলোকের নিকট হাত পাতিয়া চার আনা পয়সা ভিক্ষা লইয়াছিলেন–উহা দিয়া একটু গরম দুধ কিনিয়া বুড়ীর মুখে দিয়া তখনকার মতো তাহার জীবনরক্ষা করিয়াছিলেন। পরে অবশ্য অনেক চেষ্টায়, অনেক বাধা-বিপত্তি ও পরীক্ষা অতিক্রম করিয়া বৃদ্ধাকে ভেলুপুর হাসপাতালে ভর্তি করাইয়া দিয়া শুশ্রূষাদির ব্যবস্থাও করিয়া দিয়াছিলেন। নিজেরাই চাঁদা তুলিয়া হাসপাতালের ঔষধ-পথ্যাদির খরচ বহন যামিনীপ্রমুখ যুবকরাই করিয়াছিলেন।

“যামিনীর এই সেবাকার্যে সেদিন চারুচন্দ্ৰই ছিলেন প্রধান উৎসাহদাতা। যামিনীর পশ্চাতে চারুচন্দ্র, কেদারনাথ প্রভৃতি যুবকরা আসিয়া একে একে দাঁড়াইতেই, তাহারও বুকে বল-ভরসা আরও বাড়িয়া গিয়াছিল। যাহা হউক, যামিনীরঞ্জনের উদ্যোগে ও চারুচন্দ্র-কেদারনাথের মিলিত উৎসাহ ও সমর্থনে এবং তাহাদের আর আর যুবক বন্ধুদের সক্রিয় সহযোগিতায় সেদিনের এই ক্ষুদ্র সেনুষ্ঠানেই বর্তমান কাশী সেবাশ্রমের বিরাট সেবাযজ্ঞের সূচনা। সেদিক দিয়া বলা যায়, ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের ১৩ই জুন সেবাশ্রমের প্রারম্ভ-দিবস।

“চারুচন্দ্র ও তাঁহার বন্ধুমণ্ডলী পরম উৎসাহের সহিত বারাণসীর গলিতে গলিতে ঘুরিয়া আর্ত, পীড়িত, অসহায়, কাহাকেও দেখিলে, প্রাণপণ করিয়া নারায়ণজ্ঞানে তাঁহার সেবাদি করিতে আরম্ভ করিলেন।– “অনাথাশ্রম বা Poor Men’s Relief Associationনামে একটি সমিতি এইভাবে ধীরে ধীরে চারুচন্দ্রের নেতৃত্বে গঠিত হইয়া উঠিল। নিজেরা চাঁদা দিয়া এবং ভিক্ষা করিয়া রোগী-নারায়ণদের জন্য ঔষধ-পথ্য ও বিছানা কম্বল এবং হাসপাতালের খরচ ইত্যাদি নির্বাহ করিতেন। কেদারনাথের বাড়ীতেই এই সমিতির কার্যালয় ছিল। ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে মাসিক পাঁচ টাকা ভাড়ায় রামপুরায় ডি ৩২৮২ জঙ্গমবাড়িতে একটি ঘরে এবং পরে ক্রমান্বয়ে কার্যের পরিবিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে, ২২৭ দশাশ্বমেধ ঘাটে (১৯০১-এর ১৯শে ফেব্রুয়ারি), ও ডি ৩৮১৫৩ রামপুরায় (১৯০১-এর ২রা জুন) উহা স্থানান্তরিত হয়। অনাথাশ্রম সমিতির কার্যক্রমশঃ শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে সক্ষম হয়। চারুচন্দ্রও সংসারের সংস্রব ধীরে ধীরে ত্যাগ করিয়া অনাথাশ্রমের সেবাকার্যেই সম্পূর্ণ আত্মনিয়োগ করিলেন।…”।

সকলের বিস্ময় স্বামীজির একটি কবিতা থেকে কি করে বিশাল এক সেবাযজ্ঞের সূচনা হতে পারে। নৃত্যকালী দাসী সম্পর্কে আরও কিছু জানা যায় স্বামী অচলানন্দ (পূর্বশ্রমে কেদারনাথ মৌলিক) ও যামিনী মজুদারের জীবনকথা থেকে। “পথের ধারে একটি অনাথা বৃদ্ধাকে মরোণন্মুখ দেখিয়া তাঁহারা নিজেরাই ডুলি করিয়া বহন করিয়া ভেলপুরার হাসপাতালে লইয়া যান। বৃদ্ধার অবস্থা এতই শোচনীয় যে হাসপাতাল তাহাকে ভর্তি করিতে রাজি হইল না, নিরুপায় যুবকগণ পুনরায় ডুলি করিয়া বৃদ্ধাকে চৌকাঘাট হাসপাতালে ভর্তি করিয়া, সেবা-শুশ্রূষার সকল বন্দোবস্ত করিয়া দিলেন।”

১৯০২ সালে স্বামী বিবেকানন্দ যখন বারাণসীতে এসেছিলেন তখন এই সেবাকর্মের কথা তিনি ভালভাবে জানতেন। একদিন স্বামীজি বললেন, তোমরা কিন্তু তোমাদের কর্মজীবনে দয়াকে উচ্চস্থান নির্দেশ করেছ। মনে রেখো, দয়া প্রদর্শনের অধিকার তোমাদের নেই। যিনি সর্বভূতের ঈশ্বর তিনিই দয়া প্রদর্শনের অধিকারী। যে দয়া করতে চায়, সে নিশ্চই গর্বিত ও অহঙ্কৃত। কারণ সে অপরকে নিজের চেয়ে নীচ ও হীন মনে করে। দয়া নয়–সেবাই তোমাদের জীবনের নীতি হোক।” শেষ পর্যন্ত নাম রাখা হলো রামকৃষ্ণ হোম অফ সার্ভিস। স্বামীজির দেহাবসানের চারমাস পরে (নভেম্বর ১৯০২) সেবাশ্রমের সেবকগণ এই প্রতিষ্ঠানকে রামকৃষ্ণ মিশনের হাতে তুলে দেবার সিদ্ধান্ত নেন।

জীবনের শেষপর্বে অসুস্থ অবস্থায় স্বামীজি তার ভক্তদের বলেছিলেন, “কাশীর কাজই আমার শেষ কাজ।” আরও একটা আশ্চর্য ঘটনা, কাশীতে শ্রীরামকৃষ্ণ অদ্বৈত আশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয় স্বামীজির দেহাবসানের দিনেই–৪ঠা জুলাই ১৯০২।

সম্প্রতি ছোট্ট একটি ইংরিজি বই হাতে এসে গেল। বইয়ের নামটা–তুমি একদিন পরমহংস হবে’। লেখক আমার পরিচিত নন। কিন্তু খবর পেলাম, স্বামী সর্বগতানন্দর বয়স ৯৩ (জন্ম ১৯১২), বহুদিন বিদেশে আছেন, আগস্ট ২০০৫-এ বোস্টন, ইউ এস এ নিবাসী। পূর্বাশ্রমে মুসিভিভারমে (অন্ধ্রপ্রদেশে) থাকতেন, ডাকনাম নারায়ণ।

নারায়ণ মহারাজেরও জীবন নাটকীয়, শ্রীরামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের জীবনে বিশেষ আগ্রহী হয়ে তিনি সারগাছিয়া আশ্রমে ঠাকুরের সাক্ষাৎশিষ্য, বিবেকানন্দর গুরুভাই এবং পরবর্তীকালে মঠমিশনের সভাপতি স্বামী অখণ্ডানন্দর সান্নিধ্যে আসেন। এই প্রেমিক পুরুষই প্রথম শিবজ্ঞানে জীবসেবার বাস্তব রূপায়ণের পথিকৃৎ হিসেবে অমর হয়ে আছে। পরিব্রাজক জীবন থেকেই অখণ্ডানন্দ শুরু করেন তার সেবাব্রত। রামকৃষ্ণ মিশনের সূচনা ১ মে ১৮৯৭। ঠিক ১৫ দিন পরে মুর্শিদাবাদের কেদারমাটি– মহুলায় মৃত্যুঞ্জয় ভট্টাচার্যের চণ্ডীমণ্ডপে অনাহারী মানুষকে বাঁচাবার জন্যে স্বামী অখণ্ডান শুরু করেন দুর্ভিক্ষত্রাণ।

সারগাছিতে বসে অখণ্ডানন্দ বলতেন, স্বামী বিবেকানন্দই প্রথম সেবার মাধ্যমে নিজের মুক্তিসাধনা করবার পরামর্শ সন্ন্যাসীদের দিলেন। আগে ধারণা ছিল কাজকর্মের মাধ্যমে ভগবান লাভ করা সম্ভব নয়। ভগবান লাভের জন্য নিবাত-নিষ্কম্প দীপশিখার মত মনকে একাগ্র করে রাখতে হয়। কাজকর্ম করতে গেলে মনের বিক্ষেপ হওয়াই স্বাভাবিক। সেই জন্য সন্ন্যাসীরা আগে কর্মত্যাগ করতেন।

সন্ন্যাসী জীবনের পূর্বাহ্নে স্বামীজি তার গুরুভাই গ্যাঞ্জেসকে লিখেছিলেন, “যে আপনি নরক পর্যন্ত গিয়েও জীবের জন্য কাতর হয়, চেষ্টা করে, সেই রামকৃষ্ণর পুত্র। যে এই মহাসন্ধিক্ষণের সময় কোমর বেঁধে খাড়া হয়ে গ্রামে গ্রামে ঘরে ঘরে তার সন্দেশ বহন করবে সেই আমার ভাই–সেই তাঁর ছেলে। এই পরীক্ষা–যে রামকৃষ্ণের ছেলে সে আপনার ভাল চায় না। প্রাণত্যাগ হলেও পরের কল্যাণাকাঙ্ক্ষী তারা।”

.

বিবেকানন্দের দেহাবসানের অনেক পরে তিরিশের দশকে সারগাছি আশ্রম থেকে সুদূর কনখলে লেখা স্বামী অখণ্ডানন্দের একটা চিঠি থেকেই নারায়ণ মহারাজ ওরফে স্বামী সর্বগতানন্দর স্মৃতিচারণার শুরু।

তারিখটা ৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৫, স্থান হরিদ্বার। “বাজারের কাছে এসে যখন আমি জিজ্ঞেস করতে লাগলাম, রামকৃষ্ণ মিশনের স্থানীয় কেন্দ্রটা কোথায় তখন কেউই আমার কথাটা বুঝতে পারছে না। খুঁজতে খুঁজতে শেষ পর্যন্ত গঙ্গা খালের ধারে একটা সুন্দর বাড়ি নজরে এলো, সেখানে সাইনবোর্ড আঁটা ‘ম্যাড্রাসি ধর্মশালা। ভিতরে ঢুকে গিয়ে এক স্বামীকে জিজ্ঞেস করলাম; রামকৃষ্ণ মিশন সেন্টারটা কোথায়? সন্ন্যাসী বলল, ও! তুমি বাঙালি হাসপাতালের কথা জিজ্ঞেস করছ! তাই হবে নিশ্চয়। সন্ন্যাসী জানতে চাইল, কেন আমি ওখানে যেতে চাইছি? আমি বললাম, আমি মিশনে যোগ দিতে এসেছি। আমি কোথা থেকে এসেছি জানতে চাইলেন সন্ন্যাসী, আমি বললাম। সন্ন্যাসী আমাকে নিরুৎসাহ করে বললেন, আমাদের এখানে যোগ দাও। না, আমি রামকৃষ্ণ মিশনে যোগ দেব সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি।

এবার সন্ন্যাসীর কাছ থেকে পথের নিশানা মিলল। “ব্রিজ পেরিয়ে কনখল রোড ধরে এগিয়ে যাও।” . তরুণ ছেলেটি হাঁটতে হাঁটতে নিজের ঠিকানার কাছাকাছি এসে পড়েছে। বড়রাস্তা থেকে একটা ছোটরাস্তা ডানদিকে বেঁকে গিয়েছে। সেখানেই মস্ত এক কম্পাউন্ড দূর থেকেই দেখা যাচ্ছে। সম্পত্তিটার একটা নয় পাঁচটা গেট। ওইখানেই এসে থমকে দাঁড়ালেন অন্ধ্রের যুবক নারায়ণ।

ভিতরে ঢোকা বেশ শক্ত, কারণ প্রত্যেকটা গেটই বন্ধ, দেখলেই বোঝা যায় নিয়মিত খোলা হয় না। একটা ছোট্ট গেটকে চালু অবস্থায় মনে হলো, সেইটা দিয়েই আগন্তুকের অবশেষে বাঙালি হাসপাতালের প্রাঙ্গণে প্রবেশ। কেউ কোথাও নেই। আরও একটু হেঁটে, একটা বেড়া টপকাতে হলো, কারণ গেট খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এবার একটা প্রাঙ্গণ এবং সুন্দর বাড়ি দেখতে পাওয়া গেল। পরবর্তী দৃশ্য: হাফ হাতা শার্ট পরে এক সন্ন্যাসী দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁর সঙ্গী বিরাট সাইজের এক কুকুর। কুকুর দেখে রক্ত হিম হয়ে যাচ্ছে নবাগতের, তবু সাহস ভর করে এগোতে হলো।

অবাক কাণ্ড! সন্ন্যাসী এই ছেলেটিকে বেশ ভালো করে দেখে নিয়ে বললেন, “তুমিই কি নারায়ণ?” “হ্যাঁ, মহারাজ।” সন্ন্যাসী বললেন, কিছুদিন আগে স্বামী অখণ্ডানন্দর চিঠি থেকে জানলাম, তুমি আসছ।”

ইনিই স্বামী কল্যাণানন্দ। “মহারাজ খুব খুশি হলেন, আমাদের মধ্যে কথা হচ্ছে দেখে কুকুরটা ধরে নিল, মহারাজের চেনাজানা লোক আমি, তাই সন্তুষ্ট হয়ে, সব সন্দেহ বিসর্জন দিয়ে সে খুব বন্ধুভাবে গা ঘেঁষে দাঁড়াল এবং ল্যাজ নাড়তে লাগল।”

আগন্তুক তখনও সব খবর দেয়নি। শুধু বলেছে, “আজই হরিদ্বারে পৌঁছনো গেছে।” মহারাজ এবার ব্রহ্মচারী বাসুদেবকে ডেকে বললেন যে বাড়িতে মহারাজ থাকেন সেখানেই একটা থাকার ব্যবস্থা করে দিতে। বাংলায় আরও বললেন, ওর স্নানের ব্যবস্থা, খাওয়া দাওয়া এবং সেই সঙ্গে কিছু জামাকাপড়ও দিতে হবে। তিরানব্বই বছরের সর্বগতানন্দ পরবর্তীকালে তার স্মৃতিকথায় স্মরণ করছেন, ব্রহ্মচারীটি খুবই মধুর স্বভাবের, কথাবার্তা ভারি মিষ্টি। এবার আরও একজন ব্রহ্মচারীর সঙ্গে দেখা হলো, “তাদের আচরণে এমন ভাব যেন আমার সঙ্গে কতদিনের চেনাশোনা।”

নবাগত স্নান সেরে বেরিয়ে এসে দেখলেন একপ্রস্থ পরিষ্কার জামাকাপড় অপেক্ষা করছে, জামাটা এমন ফিট করে গেল যেন ওঁর মাপ নিয়েই তৈরি! এই ব্রহ্মচারীরা বিছানাও তৈরি করে দিল। তারপর যত্ন করে খাওয়াদাওয়া।

এবার মহারাজের কাছে প্রত্যাবর্তন। “আমাকে খুঁটিয়ে দেখে তিনি বললেন, তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে।” আত্মকথার এই পর্যায়ে ছোট্ট একটি ব্র্যাকেটের মধ্যে লেখক সর্বগতানন্দ লিখছেন, “আমার পায়ে খুব কষ্ট, শরীরও এমন অসুস্থ যে পরেরদিনই হাসপাতালে ভর্তি হতে হলো।”

মহারাজের দয়ার শরীর, এই মন্তব্যটুকু করেছেন সন্ন্যাসী সর্বগতানন্দ, কিন্তু যা উল্লেখ করেননি তা আমাকে অন্য সূত্র থেকে সংগ্রহ করতে হলো। অন্ধ্রপ্রদেশের এই তরুণটি মানুষের সেবা করবার উদ্দেশে স্বামী অখণ্ডানন্দের সঙ্গে দেখা করলে, গঙ্গাধর মহারাজ তাকে দীক্ষা দেন। তারপর একসময় বললেন, “এখান থেকে হাজার মাইল দূরে কনখল, সেখানে মিশনের একটা সেবাশ্রম আছে। সেখানে তোমাকে যেতে হবে, কিন্তু পায়ে হেঁটে, পারবে তো?” এমন কথা তার মুখেই সাজে, খালি পায়ে যিনি এই উপমহাদেশের হাজার হাজার মাইল চষে বেড়িয়েছেন। বাইশ বছরের নারায়ণ পায়ের জুতো খুলে ফেললেন, তারপর (ডিসেম্বর ১৯৩৪) শুরু হলো সুদূর হরিদ্বারের উদ্দেশে পদযাত্রা। নানা তীর্থ অতিক্রম করে হাঁটতে-হাঁটতে কপর্দকহীন নারায়ণ ফেব্রুয়ারির ৭ তারিখে হরিদ্বারে এসে পৌঁছলেন।

এবার শুনুন লেখকের নিজের মুখেই। “স্বামী কল্যাণানন্দ আমাকে আমার অতীত সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলেন, জানতে চাইলেন অখণ্ডানন্দজীর সঙ্গে আমার কিভাবে আলাপ হলো? তারপরে মহারাজের চিঠিটা পড়ে শোনালেন, এই ছেলেটিকে তোমার কাছে পাঠাচ্ছি, ওকে দেখাশোনা কোরো। আর কিছু বিবরণ নেই, এমন কি আমি যে সন্ন্যাস নিতে আগ্রহী তারও উল্লেখ নেই। পরে বিবেকানন্দের সাক্ষাৎ শিষ্য একসময় কল্যাণানন্দজী বলেছিলেন, সারাজীবনে কেউ আমার কাছে কাউকে পাঠায়নি যার দায়িত্ব আমাকে নিতে হবে।

“মাত্র কয়েকমাস আগে অখণ্ডানন্দজী মহারাজের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। তিনি জিজ্ঞেস করেছেন, আমি কি হতে চাই? আমি বলেছি, আমি বিবেকানন্দ বাণী ও রচনা পড়েছি, অরবিন্দ ও রমণ মহর্ষি সম্পর্কেও কিছু জেনেছি, মহাত্মা গান্ধির সঙ্গে দেখা করে তার আশ্রয়ে কিছু সমাজসেবাও করেছি। অখণ্ডানন্দজীকে বলেছি, এমন একটা জায়গার সন্ধান করছি যেখানে মানুষের সেবা এবং নিজের সাধনা একই সঙ্গে চলবে। স্বামী অখণ্ডান বললেন, তুমি যেরকমটি চাইছ ঠিক সেইরকম একটা জায়গায় তোমাকে পাঠাব। জায়গাটা তোমার ভালো লাগবে, কারণ ওখানে একজন যোগ্য লোক রয়েছেন। এইভাবেই আমার কনখলে উপস্থিত হওয়া এবং স্বামী কল্যাণানন্দকে খুঁজে পাওয়া স্বামী বিবেকানন্দের সাক্ষাৎ শিষ্যটি এইখানেই তার সেবাকর্ম ও সাধনা একসঙ্গে চালিয়ে যাচ্ছেন। মানুষটিকে আমার খুব ভালো লেগে গেল, এমন একজন আদর্শ পুরুষকেই তো আমি খুঁজে মরছিলাম।”

স্বামী কল্যাণানন্দের অবিশ্বাস্য জীবনকথার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়ার সময় এবার উপস্থিত হয়েছে। কিন্তু তার আগে কনখলে স্বামী সর্বগতানন্দের প্রথম কয়েকদিনের অভিজ্ঞতার কথা বলে নেওয়া যেতে পারে, এইসব কথা তিরানব্বই বছরের সন্ন্যাসী সুদূর আমেরিকার প্রবাসে বসেও ভুলতে সমর্থ হননি।

“কনখলে পৌঁছবার কদিনের মধ্যেই কল্যাণানন্দজীকে বললাম, হাসপাতালের কাজে আমি সাহায্য করতে চাই। তিনি বললেন, করা তো সহজ, কিন্তু জানাটা সহজ নয়। কি জানতে হবে রে বাবা? আমি ভেবে পাচ্ছি না। ওদের বেশ লোকাভাব, অথচ হাসপাতালে এত কিছু করার রয়েছে। আমি ওদের সাহায্য করতে চাই। হাতগুটিয়ে বসে থাকবার জন্যে আমি তো এখানে আসিনি।”

“এখানে আসবার আগে তুমি কি করতে?” কল্যাণানন্দজী একদিন জিজ্ঞেস করলেন। আমি বললাম ব্যাংকিং এবং অ্যাকাউন্টিং-এ যৎকিঞ্চিৎ অভিজ্ঞতা আছে।

“এইটাই তো আমি চাইছিলাম!” ওঁর সহযোগী স্বামী নিশ্চয়ানন্দ কিছুদিন আগে শরীর রেখেছেন। তারপর কয়েকমাস অ্যাকাউন্টিং-এর কিছুই করা হয়নি। এবার এসবের দিকে নজর দাও।” তারপরেই মহারাজের রসিকতা : জীবনকালে চুন-সুরকির ব্যবসা করত এমন একজন লোক স্বর্গে গেলেন। স্বর্গে মানুষটা কি করবে? ওখানে অবশ্যিই চুন-সুরকি বেচবে। তুমিও সাক্ষাৎ স্বর্গে এসেছ, কিন্তু তোমার ভাগ্যেও একই অবস্থা হতে চলেছে।”

মহারাজ কাজের ব্যাপারটা নবাগতকে বোঝাতে বসলেন খুবই গম্ভীরভাবে। তার নির্দেশ, সহযোগী স্বামী নিশ্চয়ানন্দ যেভাবে হিসেব রাখতেন ঠিক সেইভাবে হিসেব রাখতে হবে, একচুল হেরফের চলবে না। মহারাষ্ট্রীয় সন্ন্যাসী সুরজ রাওয়ের (১৮৬৫) সামান্য পরিচয় প্রয়োজন। আপাতত জেনে রাখা ভালো, গুরু স্বামী বিবেকানন্দের দেহাবসানের পরে বেলুড়মঠ ছেড়ে পরিব্রাজকরূপে নানা তীর্থ ঘুরতে ঘুরতে সেনাবিভাগের প্রাক্তন কর্মী স্বামী নিশ্চয়ানন্দ এই কনখলে হাজির হন, তারপর একত্রিশ বছর ধরে গুরুভাই স্বামী কল্যাণানন্দের সঙ্গে এই হাসপাতালে সাক্ষাৎ নারায়ণের বিরামহীন সেবা করেছেন। পদ্মাসনে ধ্যানযোগে তার দেহাবসান ২২ অক্টোবর ১৯৩৪।

“অ্যাকাউন্টসের ব্যাপারে কল্যাণানন্দজী যা বলেছেন তা সত্য, ছ’মাস কিছু হয়নি, কিন্তু হিসেব নিকেশ হাল আমল পর্যন্ত করে ফেলতে সময় লাগল না আমার। মহারাজকে জানালাম, আমি বকেয়া কাজ সেরে ফেলেছি। এবার মহারাজ নির্দেশ দিলেন, বেলুড়মঠে পাঠানোর জন্যে পাকা অ্যাকাউন্ট তৈরি করো। বেলুড়ে পাঠানোর অ্যাকাউন্ট খুবই মজার। মহারাজের অফিস দেওয়ালে একটা ক্যালেন্ডার ঝোলানো থাকত, যে মাসটা শেষ হয়ে গিয়েছে সেই পাতাটা ছিঁড়ে নিয়ে তার পিছনে হিসেবপত্তর লেখা হতো। তারপর ফাঁইনাল ফিগারগুলো বেলুড় মঠের অ্যাকাউন্টিং নিয়মকানুন অনুযায়ী লিখে পাঠিয়ে দেওয়া হতো। ক্যালেন্ডারের ছেঁড়া পাতাটাই আমাদের অফিস কপি! মহারাজের নীতি, যথাসাধ্য কম দিয়ে যতসম্ভব বেশি কাজ করতে হবে।

“আমি একসময় সুযোগ বুঝে বললাম, ঠিক মতন অ্যাকাউন্টসের জন্যে একটা জার্নাল, লেজার বই এবং কিছু কাগজপত্তর লাগবে। মহারাজ ব্যাপারটা মেনে নিতে পারলেন না, জিজ্ঞেস করলেন, এসব আমাদের দরকার হবে কেন? আমি পঁয়ত্রিশ বছর হাসপাতাল চালিয়েছি এইসব ছাড়াই, এখন তুমি এসে বলছ, এসব ছাড়া কাজ চলবে না।

“মহারাজ এসব থাকলে আমাদের হিসেব-নিকেশের খুঁটিনাটি স্বচ্ছ থাকবে!”কল্যাণানন্দজী এই সময় আমার নজরদারিতে স্থানীয় পোস্টাপিস থেকে কিছু বাড়তি টাকা ফেরত পান, তাতে খুব খুশি হয়ে নতুন হিসাববিশারদের উপযোগিতা তিনি বুঝতে পারলেন এবং খুশি হয়ে অনুমতি দিলেন, যা যা তোমার দরকার তা কিনে নাও।

তরুণ সর্বগতানন্দের চোখ দিয়ে আমরা বিবেকানন্দের সৃষ্টি কল্যাণানন্দজীর অবিশ্বাস্য কাহিনি অনুসরণ করব। এদেশের ইতিহাস কত বিচিত্র মানবপ্রেমী-সাধকের নিঃশব্দ দানে পরিপূর্ণ হয়ে আছে তার কিছুটা আমরা জানতে পারব। বেলুড়মঠে স্বামী বিবেকানন্দর অন্ত্যলীলার শেষ দু’বছরে স্বামীজির দুই সন্ন্যাসী শিষ্যের আদিকথার সামান্য কিছু জেনে রাখলে মন্দ হয় না। আরও কয়েকজন বিবেকানন্দশিষ্যকে বিস্মৃতির অতল গর্ভ থেকে তুলে আনতে হবে। এই পাঁচজন হলেন: কল্যাণানন্দ (পূর্বাশ্রমে দক্ষিণারঞ্জন গুহ), নিশ্চয়ানন্দ (পূর্বাশ্রমে সুরজ রাও), স্বরূপানন্দ (পূর্বাশ্রমে অজয়হরি বন্দ্যোপাধ্যায়), অচলানন্দ (পূর্বাশ্রমে কেদারনাথ মৌলিক) এবং অবশ্যই শুভানন্দ (চারুচন্দ্র দাস)। এঁরা কি পেয়েছিলেন স্বামীজির কাছ থেকে, কোন মন্ত্রে তিনি এমনভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন এঁদের তা শুনলেও বিশ্বাস হয় না।

বরিশাল উজিরপুরের হানুয়াগ্রামের আদর্শপরায়ণ সংসারবিরাগী দক্ষিণারঞ্জন গুহ মহাশয় ২৪ বছর বয়সে (১৮৯৮) বেলুড়ে নীলাম্বর মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে উপস্থিত হয়েছিলেন। ইতিমধ্যে তিনি ঢাকা মেডিক্যাল স্কুলে দু’বছর ডাক্তারি পড়েছেন, স্বামীজি স্বয়ং তখন বেলুড়মঠে উপস্থিত।

গ্রাম থেকে আসা সরল যুবকটিকে রসিকতাচ্ছলে স্বামীজি জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা, ধর আমার কিছু টাকা দরকার, তার জন্যে যদি তোকে চা-বাগানের কুলী বলে বিক্রি করি–তুই রাজী আছিস তো?” বরিশালের বানারিপাড়া স্কুল থেকে পাশ করা দক্ষিণারঞ্জন এক কথায় রাজী!

স্বামীজি ঠিক কবে দক্ষিণারঞ্জনকে সন্ন্যাস দিয়ে কল্যাণানন্দ নাম দেন তা স্পষ্ট নয়। দ্বিতীয়বার পশ্চিমে যাবার আগে ১৮৯৯ সালে কোনোসময় ব্যাপারটা ঘটেছিল। স্বামী সর্বগতানন্দ ভ্রমক্রমে সন্ন্যাসের বছরটি ১৯০০ বলে চিহ্নিত করেছেন। বেলুড়ে সন্ন্যাস দিয়ে স্বামীজি বললেন, “কল্যাণ, আমাকে কি গুরুদক্ষিণা দেবে?” কল্যাণের কাছে কিছুই ছিল না, তিনি বললেন, “আমি নিজেকেই আপনার দাসরূপে আপনাকে নিবেদন করছি। আপনি যা আদেশ করবেন আমি তাই করব।”

স্বামীজির দ্বিতীয়বার বিদেশযাত্রার পরে কল্যাণানন্দ তীর্থভ্রমণে বেরিয়ে পড়লেন। সঙ্গে ছিল স্বামী শুদ্ধানন্দের (পরবর্তীকালে মঠের অধ্যক্ষ) একটি পরিচয়পত্র। কাশীতে কল্যাণানন্দের দেখা হলো স্বামীজির আর এক ভক্ত (পরে স্বামী অচলানন্দ) কেদারনাথ মৌলিকের সঙ্গে। এঁর জন্ম শিক্ষা-দীক্ষা সব বারাণসীতে। স্বামী শুদ্ধানন্দের পরিচয়পত্র দেখে কেদারনাথ তাঁকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গেলেন। নিজের মোক্ষের জন্য জগতের উদ্ধার মন্ত্রটি কল্যাণের কাছে অহর্নিশ শুনে সংসার ত্যাগের জন্য কেদারনাথও অস্থির হয়ে উঠলেন। যামিনী মজুমদারের সঙ্গে মিলে আর্তের সেবায় এঁরা সবাই মেতে উঠলেন।

কাশী থেকে এলাহাবাদ। সেখানেও কল্যাণানন্দের সেবাকার্য। তারপর জয়পুর। রেল স্টেশনে স্বামীজির অপর এক প্রিয় শিষ্য স্বরূপানন্দের সঙ্গে দেখা হলো।

পূর্বাশ্রমে অজয়হরি বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন বহুশাস্ত্রবিদ, স্বামীজির নির্দেশে কিছুদিন সিস্টার নিবেদিতাকে বাংলা শেখান এবং পরবর্তীকালে স্বামীজির রচনাবলী প্রকাশের প্রধান উদ্যোক্তা। স্বরূপানন্দও তীর্থযাত্রায় বেরিয়েছিলেন, কিন্তু খবর এল রাজপুতানার কিষেণগড়ে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছে। সেখানেই ছুটলেন দু’জনে, সেবাকার্যের নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হলো কিষেণগড়ে।

ভিক্ষে করে এঁরা দু’জন প্রতিদিন তিনশ ক্ষুধার্তের মুখে অন্ন জোগাতেন। যেসব শিশুর বাবা মা দুর্ভিক্ষে দেহরক্ষা করেছেন তাদের জন্যে একটা সাময়িক অনাথ আশ্রমও তাদের ঘাড়ে চাপলো। এই কাজে পরে তাদের সঙ্গী হলেন স্বয়ং কেদারনাথ মৌলিক। পরবর্তী সময়ে স্বরূপানন্দ চলে গেলেন মায়াবতীতে, আরও প্রায় একবছর কল্যাণানন্দ থেকে গেলেন কিষেণগড়ে। অনাথ শিশুদের নিয়ে কল্যাণানন্দ ঘটস্থাপন করে যখন দুর্গাপূজা করেন তখন ৫০টি বালক ও ২০টি বালিকা সেখানে প্রতিপালিত হচ্ছে।

ডিসেম্বর মাসে বেলুড় থেকে চিঠি এল, স্বামী বিবেকানন্দ বিদেশ থেকে ফিরেছেন, “ইচ্ছে করলে স্বামীজিকে তোমরা এখন দর্শন করতে পার।”

বেলুড়মঠে একবার পাঁচ টাকা দিয়ে বরফ আনতে বললেন স্বামীজি। কল্যাণানন্দ হাওড়া স্টেশন থেকে আধমণ বরফ মাথায় করে পায়ে হেঁটে বেলুড়ে ফিরে এলেন। দেখে তো স্বামীজির বিস্ময় কাটে না। এত বরফ তুই মাথায় করে এনেছিস! ভক্তের ভক্তি ও সহ্যশক্তি দেখে স্বামীজি আশীর্বাদ করলেন, “কল্যাণ একদিন তুই পরমহংস হবি।” স্বামীজি জানতেন কীভাবে ভক্তের মনে অনুপ্রেরণার প্রদীপশিখাঁটি জ্বেলে দিতে হয়।

একদিন বেলুড় মঠে কল্যাণকে ডেকে স্বামীজি তাঁর বিশেষ ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। “দেখ কল্যাণ, হৃষীকেশ-হরিদ্বার অঞ্চলের অসুস্থ রুগ্ন সাধুদের জন্যে কিছু করতে পারিস? ওদের দেখবার কেউ নেই। তুই গিয়ে ওদের সেবায় লেগে যা।”

গুরুনিদের্শ শিরোধার্য করে নিলেন কল্যাণানন্দ। স্বামী সর্বগতানন্দের ভাষায়, স্বামীজি নির্দেশ দিলেন, “কিছু পয়সা জোগাড় করে হরিদ্বারে যাও। কিছু জমি কিনে জঙ্গল পরিষ্কার করে নাও। হরিদ্বারে তীর্থযাত্রীরাও বিনা চিকিৎসায় মারা যায়। আমি যখন ওখানে ছিলাম তখন চিকিৎসার জন্য একশ মাইল দূরে মীরাটে গিয়ে ডাক্তারের সন্ধান পেয়েছিলাম। ওখানে একটা হাসপাতাল আছে, কিন্তু ক’জন আর সেখানে যেতে পারছে? হরিদ্বারেই কিছু একটা খাড়া করো। যদি দেখো কোনো রোগী পথের ধারে পড়ে আছে তাহলে তাকে নিজের কুঠিতে তুলে নিয়ে এস চিকিৎসা করো।”

সহায়-সম্বলহীন অবস্থায় গুরুনিদের্শ কিভাবে পালন করা যায় তা স্থির করবার জন্যে বন্ধু স্বামী স্বরূপানন্দের সন্ধানে মায়াবতীতে হাজির হলেন কল্যাণানন্দ। স্বামীজির ইচ্ছা শুনে তা বাস্তবায়িত করার জন্যে তিনি তো এক পা বাড়িয়ে আছেন। প্রথম পদক্ষেপ অনতিদূরে নৈনিতালে দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা। প্রায় দেড়মাস এইভাবে ভিক্ষা করে সামান্য কিছু অর্থ সংগ্রহ করে কল্যাণের হাতে তুলে দিলেন স্বরূপানন্দ।

১৯০১ সালে জুন মাসে হরিদ্বারের কাছে কনখলে স্বামীজির ইচ্ছাপূরণের জন্য প্রতিষ্ঠিত হলো সেবাশ্রম। এর পরে স্বামী স্বরূপানন্দ মাত্র পাঁচবছর বেঁচেছিলেন। ১৯০৬ সালের ২৭ জুন নৈনিতালে ভক্ত অমরশাহের বাড়িতে স্বরূপানন্দ নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। এক শোকলিপিতে সিস্টার নিবেদিতা লেখেন, “পরমাত্মার মিলন-আকাঙ্ক্ষী বরেণ্য সেই আত্মা, আজ তাহার চিরঈপ্সিত ধামে উপনীত। চরম আত্মত্যাগে অর্জিত সেই মৃত্যুর সহসন্ন্যাস নিশ্চয়ই আবার নবজন্মে অভ্যুদয় লাভ করবে–পরিপূর্ণ তেজে, নবীন প্রাণে ও দানে, প্রেমে ও জ্ঞানে–যখনই মর্তের মানুষের জন্য তার আবির্ভাবের প্রয়োজন দেখা দেবে।”

সেবাধর্মের জন্য হরিদ্বারের কাছে কনখলকেই নির্বাচন করেছিলেন স্বামী কল্যাণানন্দ। হিমালয় প্রবেশের প্রথম ধাপ এই হরিদ্বার। মাত্র ১৫ মাইল দূরে পুণ্যতীর্থ হৃষীকেশ। তিন মাইল উত্তরে লছমনঝোলা–অসংখ্য তীর্থযাত্রী ও সাধু এইখানে সারাবছর সমবেত হন।

রামকৃষ্ণ মিশন সেবাশ্রমগুলির একের পর এক প্রতিষ্ঠিত হবার সময়সরণী এইরকম : বারাণসী রামকৃষ্ণমিশন সেবাশ্রম ১৯০০। কনখল ১৯০১। বৃন্দাবন ১৯০৭। এলাহাবাদ ১৯১০। সুজাগঞ্জ, মেদিনীপুর ও নারায়ণগঞ্জ ১৯১৫।

১৯০১ সালে জুন মাসে হরিদ্বারে নির্বাণী আখড়ার বারকুঠারি নামক বাড়ির দোতলায় মাসিক তিনটাকা ভাড়ায় দু’খানা ঘর জোগাড় করলেন কল্যাণানন্দ। এই দুইটি ঘরের মধ্যেই অসুস্থ সাধুদের জন্য শয্যা, চিকিৎসালয়, তার নিজের বাসস্থান ইত্যাদি সবকিছুর ব্যবস্থা ছিল। হোমিওপ্যাথি ঔষধের একটি ছোট বাক্স, চিকিৎসা সংক্রান্ত কিছু যন্ত্রপাতিও ইতিমধ্যে সংগ্রহ হয়েছিল। প্রত্যহ সাধুদের কুঠিয়াতে কুঠিয়াতে ঘুরে তিনি পীড়িত বা বৃদ্ধসাধুদের খোঁজ নিতেন এবং ঔষধ পথ্যাদির ব্যবস্থা করে আসতেন। আবার আবশ্যক হলে রুগ্ন সাধুদের নিজের আস্তানায় নিয়ে এসে স্বয়ং সেবা-শুশ্রূষা করতেন, অথচ নিজে সম্পূর্ণ মাধুকরীর ওপর নির্ভর করে শরীরযাত্রা নির্ভর করতেন।

আদিপর্বে কনখলের কাজকর্মের একটি চমৎকার ছবি পাওয়া যাচ্ছে সেবাশ্রমের প্রথম প্রতিবেদন থেকে। সেপ্টেম্বরে অন্তর্বিভাগের ছ’জন রুগীই সাধু, একজনের চিকিৎসা তখনও চলেছে, অন্যেরা বিপদ কাটিয়ে ক্রমশ সুস্থ হচ্ছেন। বহির্বিভাগে রোগীর সংখ্যা ৪৮, এর মধ্যে ৩৬ জন রোগমুক্ত, দশ জনের চিকিৎসা চলেছে আর দু’জন রোগনিরাময়ের আগেই বহির্বিভাগে আসা বন্ধ করে দিয়েছেন। মোট মাসিক খরচা ২৭ টাকা ১৩ আনা ১১২ পাই। অর্থাৎ পাই পয়সার হিসাবও সযত্নে রক্ষিত হচ্ছে। টাকা পয়সা ছাড়াও ভিক্ষা করে দান পাওয়া গিয়েছে আড়াই মণ গম, আধমণ ডাল এবং তিন সের লবণ। খরচটাও জেনে রাখা ভাল :

পথ্য ১২ টাকা ১৫ আনা ১.৫ পাই

ওষুধ ৮ টাকা ১৪ আনা ৪.৫ পাই

ঘরভাড়া ৩ টাকা ০ আনা ৪ পাই

আশ্রম-ব্যয় ১ টাকা ১ আনা ০ পাই

আলো ৩ টাকা ৬ আনা ৬ পাই

বেতন মজুরী ১ টাকা ০ আনা ৬ পাই

ডাকখরচ ০ টাকা ৬ আনা ০ পাই

বিবিধ ১ টাকা ১ আনা ৭.৫ পাই

বলা বাহুল্য এর মধ্যে কল্যাণানন্দের এক আধলা ব্যক্তিগত খরচ নেই, কারণ তিনি মাধুকরী অথবা কোনো ছত্রে গিয়ে খেয়ে আসতেন। ছত্রে গিয়ে ক্ষুধানিবৃত্তি সে যুগেও যে খুব সুখের ছিল না তা আমরা স্বামীজির শেষ সন্ন্যাসী শিষ্য কেদারনাথের (পরে স্বামী অচলানন্দের) অভিজ্ঞতা থেকে জানতে পারি। কনখলে মহানন্দ মিশনের সামনে একসময় কেদারনাথ থাকতেন, তারও ভিক্ষান্নে ক্ষুধানিবৃত্তি। একদিন তিনি দুপুরে ছত্রে ভিক্ষা করতে গিয়েছেন। ছত্রের কুঠারী বললেন, বসে থাকো এখন। সাধুদের ভিক্ষা দিয়ে যদি কিছু বাঁচে তো, কাঙালিদের দেবার সময় পাবে। “অভিমানে চোখ ফাটিয়া জল আসিয়াছিল,…সেদিন ছত্র হইতে ভিক্ষা না লইয়াই তিনি ফিরিয়া আসিয়াছিলেন–প্রায় পাঁচ ছয়দিন আর ছত্রে যান নাই।”

বিবেকানন্দশিষ্য কল্যাণানন্দ কিন্তু কিছুতেই হাসপাতালের খরচে খাবেন না, বহুদিন তিনি এই ভিক্ষাবৃত্তি চালিয়ে গিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে তার দুই সহকারী স্বামী জপানন্দ ও ব্রহ্মচারী সুরেনকেও এইভাবে জীবন চালাতে হতো। হাসপাতালের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর ভিক্ষায় বেরুতে বেশ অসুবিধা হয় এই রিপোর্ট বহুবছর পরে স্বামী জপানন্দ বেলুড়ের হেড অফিসে পাঠিয়েছিলেন। স্বামী সারদানন্দ তখন জেনারেল সেক্রেটারি, তিনি একই সঙ্গে সেবা ও মাধুকরীর প্রয়োজন নেই এই নির্দেশ পাঠালেন কনখলে–এতে কল্যাণানন্দ এবং তাঁর সহযোগী স্বামী নিশ্চয়ানন্দ কিন্তু মোটেই খুশি হলেন না। তারা মনে করলেন, ভিক্ষে করার চমৎকার সুযোগ থেকে সাধুরা কেন অকারণে বঞ্চিত হবেন। প্রসঙ্গত বলা যায়, জীবনের শেষপ্রান্তে স্বামীজি সন্ন্যাসীর প্রব্রজ্যা ও ভিক্ষাচর্যা সম্পর্কে মতের সামান্য পরিবর্তন করেছিলেন। একজন সাধুর পক্ষে এদুটি খুবই হিতকর, কিন্তু মাধুকরী বৃত্তি ইত্যাদি তখনই সহজবোধ্য ছিল যখন গৃহস্থগণ… ধর্মশাস্ত্রগণের নির্দেশ সুচারুরূপে অনুশীলন করে প্রতিদিন নিজ নিজ অন্নের একাংশ সাধু-অতিথিদের জন্য ভিন্ন করে রাখত। এখন সমাজে বিপুল পরিবর্তন উপস্থিত হয়েছে। বিশেষ করে বঙ্গদেশে মাধুকরী প্রায় অপ্রচলিত।…অরূপ পরিস্থিতিতে ভিক্ষাবৃত্তি ও মুদ্রাস্পৰ্শত্যাগের ব্রত অবলম্বন করে তোমরা কোন সুফল পাবে না।

এদিকে হৃষীকেশের সাধুদের জন্যেও একটা শাখা সেবাশ্রম খুলে ফেলা হলো। ১৯০২ সালের মার্চ মাসের কিছু খবরাখবর পুরনো রেকর্ডে পাওয়া যাচ্ছে। ওই মাসে বহির্বিভাগে ৭০ জন সাধু এবং অন্তর্বিভাগে ৭ জনের চিকিৎসা হয়। একমাসে ৫ টাকা ১ আনা ৯ পাই খরচ হয় তার মধ্যে পথ্যের খরচ ২ টাকা ১৫ আনা। ভিক্ষা করে দান পাওয়া গিয়েছিল ৫ সের ২ ছটাক চাল, ৯ সের ২ ছটাক ডাল, ১৮ সের ১২ ছটাক গম, ১ সের ৮ ছটাক লবণ। ২ টাকা ৯ আনার দুধও পাওয়া গিয়েছিল। দুটি সেবাশ্রমের মধ্যে দূরত্ব বেশ কমাইল, কিন্তু গাড়ি ভাড়া করে সেবাশ্রমের অর্থব্যয় স্বপ্নেরও অতীত, তাই নিবেদিত প্রাণ সন্ন্যাসীরা সূর্য ওঠার আগেই পায়ে হেঁটে বেরিয়ে পড়তেন। ফিরতেনও পায়ে হেঁটে, তারপর বেরুতে হতো মাধুকরীতে।

প্রিয় শিষ্য কল্যাণানন্দের অবিশ্বাস্য কাজকর্মের খবর বেলুড়ে স্বামী বিবেকানন্দর কাছে পৌঁছত। গুরুদর্শনের জন্যে কল্যাণানন্দ নিজেও ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন। প্রিয় শিষ্যকে সন্ন্যাসে দীক্ষিত করার পরে স্বামীজি বেলুড় থেকে বিদেশে যাবার আগে একবার সমবেত ব্রহ্মচারীদের কাছে বক্তৃতা করেছিলেন। সেই বক্তব্য আজও হৃদয় কাঁপায়। “বহু জনহিতার বহুজনসুখায় সন্ন্যাসীর জন্ম। পরের জন্য প্রাণ দিতে, জীবের গগনভেদী ক্রন্দন নিবারণ করতে, বিধবার অশ্রু মুছাতে, পুত্ৰবিয়োগ-বিধুরার প্রাণে শান্তিদান করতে, অজ্ঞ ইতরসাধারণকে জীবন-সংগ্রামের উপযোগী করতে, শাস্ত্রোপদেশ-বিস্তারের দ্বারা সকলের ঐহিক ও পরমার্থিক মঙ্গল করতে এবং জ্ঞানালোক দিয়ে সকলের মধ্যে প্রসূত ব্রহ্ম-সিংহকে জাগরিত করতে জগতে সন্ন্যাসীর জন্ম হয়েছে।”

শেষ যেবার বেলুড়ে স্বামীজির সঙ্গে কল্যাণানন্দের দেখা হলো তখন তার কয়েকটি কথা ভক্তমহলে মুখে মুখে প্রচারিত হয়েছে। স্বামী অচলানন্দ একদিন দাঁড়িয়ে আছেন তখন তার সামনেই প্রিয় শিষ্যকে স্বামীজি বললেন, “দেখ কল্যাণ, আমার কেমন ইচ্ছা হয় জান? একদিকে ঠাকুরের মন্দির থাকবে, সাধু ব্রহ্মচারীরা তাতে ধ্যান-ধারণা করবে, তারপর যা ধ্যান-ধারণা করলে তা ব্যবহারিক জগতে কাজে লাগাবে।” স্বামী অচলানন্দ পরে বলতেন, “স্বামীজির আসল ভাব ছিল প্র্যাকটিকাল বেদান্ত। শুধু থিওরি নয়, বেদান্তকে কাজে পরিণত করতে হবে। শুধু কথায় বা বিচারে চলবে না।”

স্বামীজি যে কল্যাণানন্দকে আরও কিছু পরামর্শ ও নির্দেশ দিয়েছিলেন তা শিষ্যের পরবর্তী জীবনযাত্রা এবং সর্বগতানন্দের স্মৃতি থেকে স্পষ্ট হচ্ছে। মারাত্মক নির্দেশ: “বাংলাকে ভুলে যা। আর ফিরিস না। এখান থেকে চলে যা।” এই নির্দেশের হেরফের হয়নি, স্বামীজিকে শেষ দেখে শিষ্য সেই যে কনখলের কর্ম ও সাধনাক্ষেত্রে ফিরে গেলেন তারপর পুরো পঁয়ত্রিশ বছর তিনি একবারও বাংলায় ফেরেননি। বেলুড় থেকে বহুবার আমন্ত্রণ এসেছে, কিন্তু তার অনিচ্ছা থেকে যা স্পষ্ট-গুরুর নির্দেশ তিনি মাথা পেতে নিয়ে আর কখনও পিছনে ফিরে তাকাবেন না। বাংলায় না ফেরার এই প্রতিজ্ঞা তিনি মেনে চলেছেন ২০ অক্টোবর ১৯৩৭ ডেরাডুনে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত।

কনখলে কল্যাণানন্দ কী করেছেন তার মনোগ্রাহী ছবি এঁকেছেন স্বামী সর্বগতানন্দ। হিসেবের খাতা ও রোগীর পরিসংখ্যান থেকে কোনো সেবা প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায় না। আমরা অবশ্যই বিভিন্ন বর্ণনার সুযোগ নেব, কিন্তু তার আগে দীর্ঘ সময় ধরে তার সাধনা ও কর্মের সাথী স্বামী নিশ্চয়ানন্দের কথা একটু বলে নেওয়া যেতে পারে।

.

শিষ্য সুরজ রাওয়ের (১৮৬৫-১৯৩৪) সঙ্গে স্বামীজির প্রথম সাক্ষাৎ ১৯০১ সালে বেলুড়ে। সেদিন মধ্যাহ্ন আহারের পর স্বামীজি বিশ্রাম করছেন এমন সময় খবর গেল একজন মারাঠি যুবক দেখা করতে চান। স্বামীজি বললেন, “এখন তাকে স্নানাহার সেরে নিতে বলল, আমি পরে দেখা করব।” যুবকটি বিনীতভাবে জানালেন, “আমি স্নানাহারের প্রত্যাশী নই। আমি বহুদূর থেকে স্বামীজিকে দর্শন করতে এসেছি। তাঁকে প্রণাম না করে আমি স্নানাহার করব না।” অগত্যা স্বামীজি নেমে এলেন এবং যুবকটি তাঁকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করল। “তুমি কী চাও?” স্বামীজি জিজ্ঞেস করলেন। “কিছুই চাই না। শুধু আপনার দাস হতে চাই।” দূরদর্শী স্বামীজি তখনই যুবকটিকে মঠে থাকার অনুমতি দিলেন।

বিবেকানন্দপ্রাণ নিশ্চয়ানন্দ সম্পর্কে কত মজার গল্প যে ছড়িয়ে আছে! গুরুর নির্দেশ মানবার জন্যে যদি প্রাণসংশয় হয় তো হোক।

নিশ্চয়ানন্দ প্রতিদিন নদীর ওপারে বরাহনগরের একটা টিউবওয়েল থেকে স্বামীজির জন্যে বেলুড়ে জল আনতেন। একদিন জলভরা কলসি নিয়ে গঙ্গা পেরিয়ে মঠে প্রবেশ করতে দেখে এক বিদেশিনী ভক্তিমতী বলে উঠলেন, “সোয়ামী আপনি এই জল আনার দায়িত্বটা কোনো কাজের লোককে দিচ্ছেন না কেন?” ভক্ত নিশ্চয়ানন্দ চটে গিয়ে ইংরিজিতে বললেন, “ইউ আর এ ফুলিশ লেডি!” নির্বোধ মহিলা বলায় বিদেশিনী মহিলা অভিমানভরে স্বামীজির কাছে অভিযোগ জানালেন। আমি কি এমন অন্যায় করেছি যে আপনার শিষ্যটি আমাকে এইভাবে ভৎর্সনা করল? স্বামীজি তাকে বোঝালেন, “এটা ভারতবর্ষ। গুরু সেবাকে এখানে প্রধান ধর্মসাধনা মনে করা হয়।” ভুল বুঝতে পেরে বিদেশিনী স্বামীজির পরামর্শে নিশ্চয়ানন্দের কাছে অনুতাপ প্রকাশ করতে যান। নিশ্চয়ানন্দ তখন স্বামী অদ্বৈতানন্দের সঙ্গে বেলুড়ের সজীবাগানে মাটি কোপাতে ব্যস্ততার পরনে কৌপীন ছাড়া কিছু নেই। সরল সাধু পরিস্থিতি এড়ানোর জন্যে জবাব দিলেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ তোমাকে ক্ষমা করেছি। এখন দয়া করে এখান থেকে যাও।”

স্বামীজির অফুরন্ত ভালোবাসা পেয়েছিলেন এই শিষ্য। তিনি একদিন নিশ্চয়ানন্দকে ডেকে বলেছিলেন, “দেখ নিশ্চয়, সাধু হয়ে অপরের গলগ্রহ হওয়া উচিত নয়। কারুর কাছ থেকে অন্ন গ্রহণ করলেই প্রতিদান দিতে হয়। সাধুসমাজ অন্যের অন্ন খেয়ে খেয়ে জড় হয়ে গেছে। সমস্ত দেশটা অপরের উপর নির্ভর করে জড়বৎ হয়ে গিয়েছে। এতে দেশের উন্নতি না হয়ে, অবনতি হয়েছে। তুমি কখনও এমন কাজ করবে না। যদি বড় কিছু কাজ করতে নাও পার–অন্তত এক পয়সায় একটা মাটির কলসি কিনে রাস্তার ধারে বসে তৃষ্ণাতুর পথিকদের জলপান করাবে। নিষ্ক্রিয় হয়ে অপরের অন্ন ধ্বংস করা দূষণীয়।”

গুরুর প্রতি স্বামী নিশ্চয়ানন্দের আনুগত্যের আরও কয়েকটি গল্প আজও লোকমুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিশেষ করে বেলুড়ে গোরু নিয়ে আসার গল্প। এই গোরুটি আড়িয়াদহের এক গোয়ালার কাছ থেকে স্বামীজির জন্যে কেনা হয়। এবার শুনুন মহেন্দ্রনাথ দত্তের অনুধ্যান।

“রাওজীর গুরুভক্তি ও কর্মতৎপরতা সম্বন্ধে একটি ঘটনা যাহা আমি শুনিয়াছিতাহার উল্লেখ করিতেছি। একবার কলিকাতার নিকট ‘আড়িয়াদহ’ নিবাসী জনৈক গোয়ালার নিকট স্বামীজির জন্য একটি দুগ্ধবতী গাভী ক্রয় করা হয়। পূজ্যপাদ স্বামাজি–স্বামী নিশ্চয়ানন্দ, স্বামী নির্ভয়ানন্দ (কানাই মহারাজ) ও মঠের অপর জনৈক সাধুকে সেই গরুটি আনিতে পাঠাইয়াছিলেন। গরুটি ক্রয় করিয়া আনিবার কালে তথা হইতে মঠে আসিবার রাস্তায় গঙ্গা অতিক্রম করিতে হয়। তাহারা সকলে গরু ও বাছুরের সহিত নৌকায় উঠিলেন। তখন বর্ষাকাল, মা গঙ্গা ভীষণ বেগবতী। গঙ্গার ধারা একটানায় প্রবলবেগে বহিতেছে। নৌকাটি মাঝ-গঙ্গায় আসিয়াছে, এমন সময় হঠাৎ উহা ভীষণভাবে দুলিতে আরম্ভ করিল। তখন সেই গরুটি ভয়ে জলে ঝাঁপাইয়া পড়িল। এই আকস্মিক দুর্ঘটনায় সকলেই হায় হায় করিয়া উঠিলেন। স্বামী নিশ্চয়ানন্দ কিন্তু ছাড়িবার পাত্র নহেন। তিনি গুরুবাক্য স্মরণ করিয়া তৎক্ষণাৎ গঙ্গায় ঝাপাইয়া পড়িলেন। ইহাতে সকলে আরও উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিলেন।

“স্বামী নিশ্চয়ানন্দ জল ছিটাইয়া গরুর মুখটি কিনারার দিকে করিয়া দিতে লাগিলেন। তিনি গরুটির সহিত স্রোতে ভাসিয়া চলিলেন। অতঃপর গরুটি লইয়া বহু কষ্টে পূর্বকূল হইতে পশ্চিমকূলে আসিলেন; কিন্তু কিনারায় এত কাদা যে সেখানে গরুটি তোলা বড়ই দুঃসাধ্য। তিনি নিজে অতি কষ্টে উঠিলেন, কিন্তু গরু আর উঠে না। ইহাতে তিনি বিশেষ চিন্তান্বিত হইলেন। সৌভাগ্যক্রমে সে স্থানে কয়েকটি ভাঙা নৌকার কাঠ পড়িয়া আছে দেখিতে পাইয়া তিনি উহা সংগ্রহ করিয়া গরুটির পায়ের নীচে দিয়া অতি কষ্টে উহাকে ডাঙায় উঠাইয়া মঠে লইয়া যাইলেন। মঠে পৌঁছাইতে সকলে তাহাকে নানারূপ তিরস্কার করিতে লাগিলেন।

“স্বামী নিশ্চয়ান গরু লইয়া আসিয়াছেন ক্রমে এই কথা স্বামীজির কাছে পৌঁছাইল। তিনি তাঁহাকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। স্বামী নিশ্চয়ানন্দ তথায় উপস্থিত হইলে গরুটির জন্য তিনি মূখের মতো নিজের জীবনটা কেন দিতে গিয়াছিলেন, স্বামীজি এই কথা জিজ্ঞাসা করিলেন। স্বামী নিশ্চয়ানন্দ বলিলেন, মহারাজ, আপনি আমাকে গরু আনতে পাঠিয়েছিলেন, গরুটি ছেড়ে কেমন করে আসি?’ এ কথায় স্বামীজি বিশেষ সন্তুষ্ট হইলেন ও বলিলেন, ঠিক ঠিক! আমি গরু আনতে বলেছি, তুমি কেন তাকে ফেলে আসবে!”

স্বামীজির আকস্মিক এবং অপ্রত্যাশিত দেহত্যাগে স্বামী নিশ্চয়ানন্দ এমন শোকার্ত হলেন যে ৪ঠা জুলাই-এর কয়েকদিনের মধ্যে তিনি মঠ ছেড়ে চলে যাবেন। একদিন বিকেলে স্বামী সারদানন্দ, মহেন্দ্রনাথ দত্ত (স্বামীজির ভাই) ও আরও কয়েকজন মাঠের দিকের রকটিতে বসে আছেন। সবাই শোকার্ত। “স্বামী নিশ্চয়ানন্দ সেখানে আসিয়া বলিলেন, ‘আমি যাঁর সম্পর্কে এখানে এসেছিলুম, তিনি যখন চলে গেছেন–তখন আমি আর এখানে থাকব না। আমি নিশ্চয় চলে যাব। যেখানে মন যায় সেখানে গিয়ে থাকব। স্বামী সারদানন্দ অনেক অনুরোধ করিয়া বুঝাইলেন যে, তিনি সহসা চলিয়া যাইলে লোকে অন্যরকম ভাবিবে। তিনি অনুরোধ করিলেন যেন স্বামী নিশ্চয়ানন্দ অন্তত একমাসকাল মঠে থাকিয়া পরে অন্যত্র গমন করেন।”

আরও এক বিবরণ অনুযায়ী, শোকসন্তপ্ত নিশ্চয়ানন্দকে সারদানন্দ মহারাজ জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “কোনদিকে যেতে ইচ্ছে কর?” নিশ্চয়ানন্দের উত্তর: “যেদিকে দুচোখ যায়।”

একমাস যেদিন পূর্ণ হলো নিশ্চয়ানন্দ ঠিক সেদিনই বেলুড় থেকে বেরিয়ে পড়েছিলেন, স্বামী কল্যাণানন্দের মতন তিনিও আর কখনও সেখানে ফিরে আসেননি, অথচ স্বামীজির নির্দেশিত কাজে জীবনের বাকি বছরগুলো নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন।

মাধুকরী বৃত্তি অবলম্বন করে সন্ন্যাসী নিশ্চয়ানন্দ নানা তীর্থ পর্যটন করলেন, তারপর ১৯০৩-এ কুম্ভমেলার সময় হরিদ্বারে হাজির হলেন। ‘রমতা’ সাধুর মতন ঘুরতে ঘুরতে একদিন এক যুবক সাধুর সঙ্গে পরিচয় হলো৷ মহেন্দ্রনাথ লিখেছেন, “কথাবার্তায় বুঝিতে পারিলেন যে, তিনিও স্বামী বিবেকানন্দর শিষ্য বৎসরাধিক পূর্বে বেলুড় মঠ হইতে আসিয়াছেন এবং কনখলের বাজারের নিকট একটি ভাড়াটিয়া ঘরে ঔষধপথ্যাদি দ্বারা নিরাশ্রয় সাধুগণের সেবায় নিযুক্ত আছেন। উভয়ের উদ্দেশ্য এক হওয়ায় এখন হইতে তাহারা একত্রে বাস করিতে লাগিলেন। যুবকটির নাম কল্যাণানন্দ।”

একজন সুযোগ্য গুরুভাইকে খুঁজে পেয়ে কল্যাণানন্দের মনোবল ও উৎসাহ খুব বেড়ে গেল। এই সময়কার কিছু ইতিহাস কনখল সেবাশ্রমের তখনকার বার্ষিক বিবরণী ও অ্যাকাউন্টসে থেকে গিয়েছে। কনখলের প্রথম রিপোর্ট প্রকাশিত হয় ১৯০৪ সালে, এতে সই করেছেন মঠ মিশনের সভাপতি স্বামী ব্রহ্মানন্দ। অ্যাকাউন্টসে সই করেছেন মঠমিশনের জেনারেল সেক্রেটারি স্বামী সারদানন্দ এবং অডিটর শ্রী বৈকুণ্ঠনাথ সান্যাল। এই বৈকুণ্ঠনাথ ১৮৯০ সালে তপস্যা করার জন্য স্বামীজির সঙ্গে হৃষীকেশে আসেন। সঙ্গে স্বামী তুরীয়ানন্দ ও স্বামী সারদানন্দ। চণ্ডেশ্বর মহাদেবের মন্দিরের কাছে এক কুঁড়েঘরে সাধনায় মগ্ন থাকতে থাকতে স্বামীজি স্বয়ং জ্বরবিকারে আক্রান্ত হন। চিকিৎসকের অভাব, স্বামীজি সংজ্ঞাহীন হলে সঙ্গীরা হায় হায় করতে লাগলেন, সেই সময় এক সাধু এসে মধুসহ পিপুল-চূর্ণ রোগীর জিভে দিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে আনেন। এরপর তারা স্বামীজিকে নিয়ে হরিদ্বারে হাজির হন। স্বামী ব্রহ্মানন্দ তখন কনখলে তপস্যা করছিলেন, খবর পেয়ে তিনি হরিদ্বারে হাজির হলেন। স্বামীজি যখন প্রিয় শিষ্য কল্যাণানন্দকে হরিদ্বারে সেবাশ্রম খুলতে নির্দেশ দিয়েছিলেন তখন চণ্ডেশ্বরের স্মৃতি অবশ্যই তার মনে স্পষ্ট ছিল।

কনখলের প্রাচীন নাম মায়াপুর। মহাভারতে এই অঞ্চলের নাম কুরুজাঙ্গল’। হরিদ্বারের নাম ছিল গঙ্গাদ্বার।

সেবাশ্রমের প্রথম ছাপানো রিপোর্টের নিবেদন, ডিসেম্বর ১৯০২ পর্যন্ত ১৮ মাসে ১০৫৪ রোগী সেবা পেয়েছে। কনখলে ইনডোর রোগী ১২৮, আউটডোর ৫৩৬, হৃষীকেশে ইনডোর ৩৬ এবং আউটডোর ৩৫৪। হৃষীকেশ শাখা খোলা হয় ১৯০২-এর গোড়ার দিকে। ১৯০৩ সালে মোট রোগীর সংখ্যা ২৭০২। তার পরের বছর রোগীর সংখ্যা ২৫০০, এর মধ্যে প্লেগের রোগী ২২ জন। রিপোর্টে জানানো হচ্ছে, হাসপাতালের যাবতীয় দায়িত্ব পালনে রয়েছেন মাত্র দু’জন সন্ন্যাসী ও একজন ব্রহ্মচারী। আর আছে একজন পাঁচক, একজন সাফাইকর্মী ও একজন ভৃত্য।

এপ্রিল ১৯০৩ সালে সেবাশ্রমের জন্য যে জমি কেনা হলো তার পরিমাণ ১৫ বিঘা–মূল হরিদ্বারে জমির দাম অনেক, সুতরাং কনখলই ভরসা। এই জমি কেনার দাম দিয়েছিলেন কলকাতার এক ভদ্রলোক, কিন্তু সেই সময় তিনি নাম প্রকাশে অনিচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন।

তিন টাকা ভাড়ার তিনখানি ঘর ছেড়ে সেবাশ্রম উঠে এলো শেখপুরার নিজের জমিতে, রোগীর সেবার জন্য তিনখানা চালাঘর তৈরি হয়েছে। সেবাশ্রমের প্রথম নকশা তৈরি করেন স্বামী বিজ্ঞানানন্দ (পরে মঠ মিশনের সভাপতি), তৈরির খরচ ৬০১৭ টাকা দেন বাবু ভজনলাল লোহিয়া।

কনখল ও হৃষীকেশ সেবাশ্রমের মধ্যে দূরত্ব ১৫ মাইল। দুটি সেবাকেন্দ্র চালানো একা কল্যাণানন্দের পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠেছিল, তাই হৃষীকেশ সেবাশ্রম কিছুদিন বন্ধ ছিল। নিশ্চয়ানন্দ আসায় বন্ধ-হওয়া কেন্দ্রটি আবার প্রাণবন্ত হলো। খুব ভোরবেলায় ১৫ মাইল পাহাড়ি পথ হেঁটে নিশ্চয়ানন্দ প্রতিদিন হৃষীকেশে যেতেন, তাঁর সাথী অবশ্যই কল্যাণানন্দ। সঙ্গে থাকত ওষুধের বাক্স এবং রোগীদের খাবার। দুপুরবেলায় এঁরা দু’জনে বেরোতেন মাধুকরীতে, কারণ রোগীর বরাদ্দ খাবারে তাদের কোনো অধিকার নেই। প্রয়োজনে কোনো ছত্রে গিয়ে নিজেদের ক্ষুধানিবৃত্তি করে দুই সন্ন্যাসী আবার ফিরে আসতেন রোগীদের খবরাখবর নিতে এবং সন্ধ্যায় ক্লান্ত শরীরে নিজেদের ডেরায় ফিরতেন। এই ব্যবস্থা চলত দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর, গ্রীষ্ম শীত বর্ষায় কোনো পরিবর্তন নেই। এছাড়াও বড় কাজ ছিল সেবাশ্রম চালানোর জন্য সকলের কাছ থেকে দান ও ভিক্ষা সংগ্রহ করা।

মর্তলোকের এই অশ্বিনীকুমারদ্বয় সম্বন্ধে মহেন্দ্রনাথ লিখেছেন : “উভয়ে রোগীদের মলমূত্র পরিষ্কার ও নানাপ্রকার সেবা করিতেন। রোগী গতায়ু হইলে একটি মাচার উপর স্থাপন করিয়া নগ্নপদে, প্রচণ্ড রৌদ্রে, উত্তপ্ত পাথরের উপর হোঁচট খাইতে খাইতে নীলধারায় বা গঙ্গায় যেখানে স্রোত থাকিত সেইখানে শবটিকে ভাসাইয়া দিয়া আসিতে। তাহারা কখনও নিজেদের শরীরের দিকে দৃষ্টিপাত করিতেন না। অতি কঠোর সেবার ভার তাহাদের মনে প্রদীপ্ত হইয়াছিল এবং তাহার দ্বারা অনুপ্রাণিত হইয়া অতিমানুষিক কঠোর তপস্যা তাহারা করিতে লাগিলেন। কনখলে অবস্থানকালে পরবর্তী সময়েও দেখিয়াছি অভিমানশূন্য, প্রাধান্যস্পৃহাশূন্য, বিলাসিতার রেখামাত্র বর্জিত, জীর্ণ পরিধান ও ছিন্ন পাদুকাতেই তৃপ্ত হইয়া ইহারা দিনযাপন করিতেছে। প্রথম অবস্থায় যেমন সর্বস্বত্যাগী, সেবাপরায়ণ সাধুভাবশেষ অবস্থাতেও সেইরূপ। এই সেবারূপ তপস্যায় তাহারা সমস্ত মনঃপ্রাণ ঢালিয়া দিয়াছিলেন।”

পুরাতনপন্থী সাধুমহলে মিশনের নবীন কর্মধারা যে সবসময় মনঃপুত হয়নি তারও ইঙ্গিত রয়েছে মহেন্দ্রনাথের অনুধ্যানে। “আজও অনেক সাধু রামকৃষ্ণ মিশনের সাধুদের ‘মশিন সাধু’ বলিয়া অবজ্ঞা করিয়া থাকেন–অর্থাৎ ‘মশিন সাধুরা’ জাতবিচার না করিয়া সাধারণের সেবা করেন।”

শুধু বাইরের সাধু নন, ভিতরের অনেকেরও মনেও যে এই সেবাকাজ সম্পর্কে সন্দেহ ছিল তা স্বামী নিশ্চয়ানন্দ কনখলে থাকার সময়ে বুঝেছিলেন। মহেন্দ্রনাথ এই ঘটনা লিখতে দ্বিধা করেননি বলে আমরা জানতে পারি, এক শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি সেইসময় কনখল সেবাশ্রমে গিয়ে বাস করেন। “একদিন এই শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি স্বামী নিশ্চয়ানন্দকে ডিস্পেনসারি ঘরের দিকে লইয়া যাইয়া বলিতে লাগিলেন, ‘এইসব ডাক্তারখানা, হাসপাতাল করে কি ফল আছে? শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন, ভগবানলাভ হলে তুমি কি বলবে যে এত ডাক্তারখানা করেছি–হাসপাতাল করেছি? সাধনভজন করে ভগবানলাভ করাই হলো জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য। এইরূপ নানা কথায় তিনি উপদেশ দিতে লাগিলেন স্বামী নিশ্চয়ানন্দ কর্মী, সারা জীবনপাত করিয়া অসুস্থদিগের সেবার জন্য কনখলের জঙ্গলের ভিতরে সেবাশ্রম স্থাপিত হয়েছে। এই সকল কথায় তাহার প্রাণে বড় আঘাত লাগিয়াছিল।”

মহেন্দ্রনাথ নীরব থাকলেও অন্য সূত্র থেকে জানা যায় এই শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিটি শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃতের স্রষ্টা শ্ৰীম। তার কথায় নিশ্চয়ানন্দ আর অশ্রু-সংবরণ করতে পারেননি, করজোড়ে মাস্টারমশায়কে বলেছিলেন, “দেখুন আমি স্বামীজির গোলাম। সাধন-ভজন কিছুই জানি না। তার কাজ করাই আমার জীবনব্রত।”

নিষ্ক্রিয় ত্যাগ ও বৈরাগ্য সম্বন্ধে বিবেকানন্দ-বিশারদরা গত একশতকে যথেষ্ট আলোচনা করেছেন। কথাপ্রসঙ্গে অবশ্যই ভগবান বুদ্ধের সক্রিয় ত্যাগ ও বৈরাগ্যও উল্লেখ হয়, বিশেষ করে তার বাণী বহুজন হিতায়, বহুজন সুখায়। মহেন্দ্রনাথের মতে, ভগবান বুদ্ধের পরে স্বামী বিবেকানন্দই দ্বিতীয় ব্যক্তি যিনি এই উদারভাব প্রসারণ করেছেন। বুদ্ধ কমণ্ডলু হস্তে মুণ্ডিত মস্তকে স্থির নেত্রে বলছে, জাতির পুরাতনভাব আমি সম্মান করিব, নিস্তেজভাব, সঙ্কীর্ণভাব, রোরুদ্যমানভাব আমি সমূলে উৎখাত করিব…আজ হইতে আমি জগতের সমস্তভার গ্রহণ করিলাম। মুণ্ডিত মস্তকে, দণ্ড ও কমণ্ডলু হাতে গৈরিকবসনধারী বিবেকানন্দও বলেছেন, “আমি প্রাচীন ভাবকে সম্মান করিব, কিন্তু মুমূর্ষ রোরুদ্যমানভাব, সঙ্কীর্ণভাব,হীনভাব সমূলে উৎখাত করিব–আমি ডালপালা শিকড় পর্যন্ত উপড়াইয়া ফেলিব– নূতন ভারত নূতন জগৎ সৃষ্টি করিব–আজ হইতে আমি সমস্ত জগতের ভার গ্রহণ করিলাম।”

স্বামী নিশ্চয়ানন্দের জীবনীকার হিসেব করে দেখিয়েছে, একপর্যায়ে তাকে প্রতিদিন ছত্রিশ মাইল হাঁটতে হতো। আরও একটা ব্যাপার, নিশ্চয়ানন্দ কনখলেও মশারি ব্যবহার করতেন না। বেলুড় মঠে থাকার সময় থাকতেই এই সন্ন্যাসী মশারিবিহীন। বড় বড় মশার কামড়ে শরীর ক্ষতবিক্ষত। বিছানায় রক্তের চিহ্ন দেখে স্বামীজি একদিন বেলুড়ে বকাবকি করেছিলেন। নিশ্চয়ানন্দ বলেছিলেন, “স্বামীজি আমি তো ভোগ করতে আসিনি।” স্বামীজি তাঁর শিষ্যকে বুঝেছিলেন এবং বলেছিলেন, “বেশ এখন তবে এমনই চলুক, তবে যখন প্রয়োজন হবে তখন কিন্তু মশারি ব্যবহার করবে।” কনখলেও একই অবস্থা, মশারি নেই। মহাপ্রয়াণের (১৯৩৪, ২২ অক্টোবর) মাত্র কয়েকদিন আগে কল্যাণানন্দ তাকে স্বামীজির নির্দেশ মনে করিয়ে দিয়ে মশারি ব্যবহারে রাজী করিয়েছিলেন।

স্বামী নিশ্চয়ানন্দের গুরুভক্তির যত গল্প ছড়িয়ে আছে তা ঠিকমতন সংগ্রহ করলে পুরো একটা বই হয়ে যায়। কনখলে সকালে শয্যাত্যাগ করে স্বামী নিশ্চয়ানন্দ যখন বেরিয়ে আসতেন তখন তার মুখটা গামছায় ঢাকা থাকত। ওই অবস্থায় চলে যেতেন গুরুজির ছবির কাছে, স্বামীজিকে প্রণাম করে তবে অবগুণ্ঠনমুক্ত হতেন এই ভক্ত।

আরও একটা মজার ব্যাপার। বয়সে নিশ্চয়ানন্দ তার গুরুভাই কল্যাণানন্দের থেকে প্রায় ন’বছর বড় ছিলেন, কিন্তু ছোটকেই দাদার মতন সম্মান করতেন। হরিদ্বার কনখলের লোকদের কাছেও তিনি ছিলেন ‘ছোট স্বামী’। বড় স্বামীটি অবশ্যই তার কনিষ্ঠ গুরুভাই কল্যাণানন্দ।

নিশ্চয়ানন্দের কাজ ছিল খুব গুছনো। গুরুদেব স্বামী বিবেকানন্দ যে হিসেবের ব্যাপারে ভীষণ খুঁতখুঁতে ছিলেন তা তার কোনো শিষ্যের অজানা ছিল না। কাশীর সেবাশ্রম প্রসঙ্গে স্বামীজি শুধু সেবাযত্নের খোঁজখবর নিতেন না, সবাইকে সেবাশ্রমের সঠিক হিসাবপত্তর রাখতে বলেছিলেন। তার কঠোর নির্দেশ : “যিনি যে উদ্দেশ্যে অর্থ দেন, তার সেই অর্থ সেই উদ্দেশ্যেই ব্যয়িত হওয়া উচিত।”

নিরন্তর পরিশ্রম এবং অত্যধিক কঠিন জীবনযাত্রা শেষপর্যন্ত নিশ্চয়ানন্দের শরীরের ওপরেও ছায়া ফেলেছিল। শুতেন একটা খাঁটিয়ায়, তার ওপরে একটি চাদর, খাওয়া দাওয়াও যৎসামান্য। একদিনও কাজ থেকে ছুটি নয়, সেই যেদিন সেবাশ্রমে উপস্থিত হয়েছেন সেদিন থেকে একদিনও ছুটি নেবার কথা ভাবেননি নিশ্চয়ানন্দ।১৯৩২ সালের বর্ষাকালে গ্যাসট্রিক আলসারে তিনি মরণাপন্ন। সেই সময় কল্যাণানন্দর শরীরও ভালো নয়, স্বাস্থ্যসন্ধানে তাকে জোর করে পাঠানো হয়েছে মায়াবতী আশ্রমে। ফলে সেবাশ্রমের দায়িত্ব এসে পড়েছে সন্ন্যাসী নিশ্চয়ানন্দের ওপরে।

খাওয়া দাওয়া তো ভিক্ষানির্ভর। একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। একসময় স্থানীয় কৈলাসমঠে তিনি নিত্যভিক্ষা নিতে যেতেন। মঠের অধ্যক্ষ গিরিজী মহারাজ তাঁর অনুরাগী। তিনি উপস্থিত থাকলে কোনো অসুবিধা হতনা। একবার তিনি দলবলসহ ক’দিনের জন্য অন্যত্র গিয়েছে, যাবার সময় নিশ্চয়ানন্দের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশ নতুন কুঠারীর কাছে রেখে গিয়েছেন। প্রথম দিনে কুঠারী তাকে চিনতে পারল না। তার ওপর তিনি নগ্নপদ, দীনহীন মলিন বসন, উপরন্তু কাঁধে ওষুধের একটা ভাঙা বাক্স। কুঠারী নির্দ্বিধায় কাঙালবেশি সাধুকে জানিয়ে দিলেন, এখানে বাইরের সাধুকে ভোজন করানোর ব্যবস্থা নেই। ”অভিমানশূন্য নিশ্চয়ানন্দ অম্লানবদনে ফিরে গিয়ে কালীকমলী ছত্রে ভিক্ষা গ্রহণ করলেন। অতঃপর তিনি আর কৈলাস মঠে যান নাই।”

অধ্যক্ষ ধনরাজগিরি ফিরে এসে নিশ্চয়ানন্দকে প্রত্যহ আসতে না দেখে খোঁজখবর করলেন এবং কুঠারীকে তিরস্কার করে তাকে পাঠালেন, যে করেই হোক তাকে ফিরিয়ে আনতে হবে। কুঠারী এরপর নিশ্চয়ানন্দের সঙ্গে দেখা করে তার পায়ে ধরে অপরাধ মার্জনা প্রার্থনা করেন। “নিশ্চয়ানন্দ তখন মহা অপ্রস্তুত হইয়া, কুঠারীর অনুরোধে পুনরায় কৈলাসমঠে গেলেন এবং সেইদিন হইতে পূর্ববৎ কৈলাসেই ভিক্ষা লইতে লাগিলেন।”

দেহত্যাগের দুসপ্তাহ আগেও কাজ-পাগল নিশ্চয়ানন্দের ছোট্ট বিবরণ আমাদের কাছে আছে। মোটা কম্বলে দুটো পা ঢেকে বসে তিনি সেবাশ্রমের হিসেবপত্তর দেখছে। কেন বিশ্রাম নিচ্ছেন না এই প্রশ্ন করায় নিশ্চয়ানন্দ বললেন, “এ তো ঠাকুরের সেবা। স্বামীজির কাজ। আমাদের এখনও তো সব কর্ম ক্ষয় হয়নি। মাটি কাদা অবস্থায় থাকলে সবটুকু ওঠে না–কিন্তু শুকিয়ে গেলে সব আপনিই খসে যাবে।” হিসেবপত্তরের ওপর নিশ্চয়ানন্দের সারাক্ষণ নজর। “আশ্রমের তহবিলে একদিন একটা আধলা উদ্বৃত্ত পাওয়া যায়। তহবিলরক্ষক সাধুটিকে নিশ্চয়ানন্দ এই আধলার হিসেবটিও প্রতিমাসে নিয়মিত জিজ্ঞাসা করতেন।”

কনখলে ১৫ বিঘা জমি দেড়হাজার টাকায় খরিদ হলেও, গোড়ায় বাড়ি তৈরির অর্থ ছিল না। তাই তিনটি কুঁড়েঘর তৈরি করে কাজ চলত। সন্ন্যাসীরা শুধু অস্পৃশ্য চামারদের বস্তিতে ঘুরে বেড়াতেন তা নয়, অসুস্থ মানুষের মলমূত্র নিজের হাতে পরিষ্কার করতে দ্বিধা করতেন না। এর ফলে যেমন প্রশংসা মিলেছে তেমন দুর্নামও রটেছে। দু’জনের নাম হয়ে যায় ভাঙ্গী সাধু’, কারণ মলমূত্র পরিষ্কার মেথরের কাজ। এর ফলে এমন সেবা করেও দুই সন্ন্যাসী প্রায় একঘরে হয়ে গিয়েছিলেন, সাধুদের কোনো অনুষ্ঠানে এঁরা আমন্ত্রিত হতেন না।

স্বামী সর্বগতানন্দ এই অস্পৃশ্য ভাঙ্গী সাধুজীবনের একটি স্মরণীয় বর্ণনা দিয়েছেন। এই কাহিনীর মূলে আর একজন উদারহৃদয় সন্ন্যাসী শ্রীমৎ স্বামী ধনরাজ গিরি, শঙ্করাচার্যের হৃষীকেশস্থ কৈলাস মঠের মণ্ডলেশ্বর। স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দ হৃষীকেশে থাকার সময় শ্রীমৎ ধনরাজ গিরিজীর সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন এবং দু’জনের মধ্যে শাস্ত্রালোচনা হয়েছিল। পরবর্তীকালে স্বামী অভেদানন্দও তার কাছে গিয়েছিলেন এবং কিছুকাল বেদান্ত অধ্যয়ন করেছিলেন। ভজনলাল লোহিয়া ও হরসহায়মল শুকদেবদাস নামক দুই ধনপতি এঁর সঙ্গে কনখলে দেখা করে একটি মঠ বা ধর্মশালা তৈরি করে দেবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। প্রসন্নহৃদয় ধনরাজ গিরি তাদের পরামর্শ দিলেন বিবেকানন্দর দুই শিষ্য এখানে কী কাজ করছে একটু খোঁজখবর করুন। দুই বন্ধু সেবাশ্রমের কাজ দেখে অবাক হয়ে সেবাশ্রমের বাড়ি তৈরির খরচ বহন করেন। এই ভবনের উদ্বোধন হয় ১৯০৫ সালের প্রথম দিকে।

ভাঙ্গী সমস্যার কথা আবার উঠল ১৯১০ সালে–সেবারে ধনরাজ গিরির আগমন উপলক্ষে তার মঠে বিশেষ ভাণ্ডারার ব্যবস্থা হয়েছে। কাছাকাছি যেখানে যত সন্ন্যাসী আছেন সবাই ভাণ্ডারার মহাভোজে নিমন্ত্রিত। ধনরাজ গিরি তার সন্ন্যাসীদের জিজ্ঞেস করলেন, শুনেছি স্বামী বিবেকানন্দর দুই শিষ্য কাছাকাছি থাকেন, তাদের জানো? “হ্যাঁ, এঁরা কাছাকাছি থাকেন, কিন্তু ব্যাপারটা সুবিধের নয়, এঁরা ভাঙ্গী সাধু, এমন সব নিচু কাজকর্ম করেন।” ধনরাজ জানতে চাইলেন, “কী করেন এঁরা?” “এঁরা মেথরের কাজও করেন।” “নিচু কাজ! অসুখ করলে তোমরা কোথায় যাও? তোমরা হাসপাতালে যাও না?” “হ্যাঁ আমরা যাই।” ধনরাজ বললেন, “তার মানে প্রয়োজনে ওঁদের সেবাশ্রমে যাও, চিকিৎসা নাও, আর তোমরাই বলো এঁরা ভাঙ্গী সাধু! যাও ওঁদের ভাণ্ডারায় নেমন্তন্ন করে এসো,” এই দু’জন অতিথিকে ধরে আনবার জন্যে ধনরাজ গিরি তার এক সন্ন্যাসীকে পাঠালেন।

স্বামী কল্যাণানন্দ যেতে রাজি হলেন, কিন্তু নিশ্চয়ানন্দ টলবার মানুষ নন। তিনি সোজা বললেন, “আমি যাচ্ছি না। ফলে কল্যাণানন্দও ভাণ্ডারায় যেতে পারলেন না। দূত ফিরে গিয়ে ধনরাজ গিরিকে জানালেন, দুই সন্ন্যাসী এই ভোজে আসতে রাজি নন। ধনরাজ গিরি ছাড়বার পাত্র নন। দূতকে বললেন, “আবার যাও, বলো আমি চাই ওঁরা আসুন।” এই কথা শুনে কল্যাণানন্দ তার গুরুভাইকে বললেন, “ধনরাজ গিরিকে আঘাত করা ঠিক হবে না। চলো আমরা যাই।” নিশ্চয়ানন্দের সাফসুফ উত্তর, “কেন যাব? আমরা তো ওঁদের ওপর নির্ভর করি না। কেন আমরা যাব? একদিন ভূরিভোজ, কাল থেকে আবার শুকনো রুটি।”

তরুণ সন্ন্যাসী হতাশ হয়ে ফিরে যাওয়ায় ধনরাজ গিরি সব খবর পেলেন। তিনি এবার তার সেক্রেটারিকে যেতে নির্দেশ দিলেন। “ওঁদের যে করে হোক নিয়ে এসো। ওঁদের বলল, ওঁরা না এলে এখানে উৎসব বন্ধ।” সাধুটি এসে দুই গুরুভাইকে বললেন, “দয়া করে চলুন। আপনারা এলে মহারাজ অনুষ্ঠান আরম্ভই করবেন না।” ইতিমধ্যে দেরি হয়ে যাচ্ছে, ঘড়িতে দুটো বাজে। নিশ্চয়ানন্দ তখনও যেতে রাজি নন, কিন্তু কল্যাণানন্দ বললেন, “ধনরাজগিরি মহারাজের মুখ চেয়ে আমাদের যাওয়াটাই ভালো–একজন ভালো সন্ন্যাসী আমাদের নিমন্ত্রণ পাঠিয়েছেন, তার সম্মান আমাদের রাখা উচিত।” এবার ফল হলো এবং দুই ভাই ভাণ্ডারায় যোগ দেবার জন্য সেবাশ্রম থেকে বেরিয়ে পড়লেন।

মঠের দ্বারপ্রান্তে স্বয়ং ধনরাজ গিরি এই দুই বিবেকানন্দশিষ্যকে স্বাগত জানালেন। সবাইকে বিস্মিত করে মণ্ডলেশ্বর প্রথমে দু’জনকে আলিঙ্গন করলেন এবং তারপর নতজানু হয়ে প্রণাম করলেন। এই দেখে উপস্থিত সাধুরা অবাক হয়ে গেলেন, তারা তাদের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। এবার দুই বিবেকানন্দ শরণাগতকে নিয়ে তিনি মঠের মধ্যে ঢুকে গেলেন এবং ভাণ্ডারা প্রাঙ্গণে দু’জনকে তার দুধারে বসালেন। সমবেত সাধুজনদের উদ্দেশে তিনি বললেন, “আপনারা সবাই ভাবছেন আপনারা মস্ত সাধু। যদি প্রকৃত সাধুর খোঁজ করতে হয় তা হলে এঁরা দু’জন। এঁরা দরিদ্রনারায়ণের সেবায় এক আশ্চর্য জীবন যাপন করেন, এঁদের আদর্শ হচ্ছেন স্বামী বিবেকানন্দ। নব যুগের নতুন আদর্শ এঁরা। আপনারা রোগাক্রান্ত হলে এঁরা আপনাদের সেবা করেন, আর তার বদলে আপনারা এঁদের ভাঙ্গী সাধু বলেন!” এইভাবে ভর্ৎসনা করে তিনি কল্যাণানন্দ ও নিশ্চয়ানন্দকে উদ্দেশ করে বললেন, “যেসব অপমানের বোঝা আপনাদের বহন করতে হয়েছে তার জন্য আমাকে ক্ষমা করুন।” তিনি নিজে ক্ষমা ভিক্ষা করছে! এবার সন্ন্যাসী ভ্রাতৃদ্বয় বললেন, “মহারাজ এইভাবে আমাদের লজ্জা দেবেন না। আমরা এখানকার অপমান অপবাদ গায়ে মাখিনি।”

সেবাশ্রমের আরও একটি গল্প স্বামী সর্বতানন্দ আমাদের শুনিয়েছেন। নিশ্চয়ানন্দের দেহাবসানের ৬ মাস পরে (৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৫) তরুণ নারায়ণ ব্রহ্মচারী কনখলে সেবাশ্রমের কাজ শুরু করেছেন। হিসেব খাতা পরীক্ষা করতে গিয়ে তিনি দেখলেন, নিশ্চয়ানন্দের সাধ ছিল তাঁর গুরু বিবেকানন্দের মর্মরমূর্তি এখানে স্থাপন করবেন। কল্যাণানন্দজিকে জিজ্ঞেস করতে তিনি বললেন, নিশ্চয়ের খুব সাধ ছিল উঁচু একটা বেদীর ওপর চমৎকার মূর্তিটি শোভা পাবে, কিন্তু নিশ্চয় টাকা জোগাড় করতে পারেনি। কোনোক্রমে হাজার দুয়েক টাকা সংগ্রহ করেছিল।

“আমি কিছু কিছু টাকা ওই ফান্ডে সুযোগ পেলেই দিতে আরম্ভ করলাম। আস্তে আস্তে চারপাঁচ হাজার টাকা হলো। এই সময় আমি (১৯৪৩) কনখল থেকে করাচি সেন্টারে বদলি হলাম। সেখানে খবর পেলাম এই ফান্ডকে জেনারেল ফান্ডের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি প্রতিবাদ জানালাম। এটা করবার অধিকার আমাদের নেই। একজন মহান সন্ন্যাসী চেয়েছিলেন স্বামীজির মর্মর মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হোক। আমাদের উচিত তার ইচ্ছার প্রতি সম্মান জানানো। ফান্ড আলাদা থাকুক, কিছু কিছু সুদ জমা পড়ুক। পরে কোনো সময়ে কেউ পরিকল্পনাটা বাস্তবায়িত করতে পারবেন। এসব ১৯৪৪-৪৫ এর ঘটনা। ১৯৬০ সালে বিবেকানন্দ শতবর্ষ উদযাপন পর্বে এই তহবিলের কথা মনে পড়ে গেল। যাঁরা স্বামী নিশ্চয়ানন্দকে জানতেন এবং খুব ভালোবাসতেন তারা বললেন, আমরা এই মূর্তি তৈরির জন্য টাকা তুলে দেব। তারা কথা রেখেছিলেন এবং স্বামীজির চমৎকার একটি মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হলো শেষপর্যন্ত।”

.

নিশ্চয়ানন্দপর্বে তার ছবি আঁকতে গিয়ে কল্যাণানন্দজির কথা আমরা একটু কম বলেছি। উপকরণের অভাব নেই, বিভিন্ন স্মৃতিকথা ছাড়াও, আমাদের হাতের গোড়ায় রয়েছে স্বামী সর্বগতানন্দের বিবরণ। তার বিবরণ কল্যাণানন্দের শেষ জীবনের কথা, টাকা আনা পাই ও বিভিন্ন পরিসংখ্যানের বাইরেও আশ্চর্য একটি মানুষকে দেখতে পাই এই রচনায়। কোথায় অতি অল্পবয়সে পিতৃহারা বরিশালের হানুয়া গ্রামের উমেশচন্দ্র গুহের একমাত্র সন্তান দক্ষিণারঞ্জন, কোথায় বেলুড় মঠ, আর কোথায় কনখল। ভাগ্যের খেয়ালে কি বিচিত্র জীবনলীলা, যা পড়তে গেলে অবিশ্বাস্য মনে হয়। দু’জন সংসারবিরাগী একইদিনে স্বামীজির কাছে থেকে সন্ন্যাস পেয়েছিলেন–অপরজন স্বামী আত্মানন্দ (শুকুল মহারাজ)। সেবাকার্যের হাতেখড়ি অন্তিমশয্যায় শায়িত স্বামীজির গুরুভাই স্বামী যোগানন্দর সেবা। একমাস এই কাজ করে তরুণ দক্ষিণারঞ্জনের চোখ খুলে গিয়েছিল।

স্বামীজির নির্দেশ খুব স্পষ্ট ছিল। নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে তরুণ সন্ন্যাসীশিষ্যকে তিনি মিরাটের অভিজ্ঞতার কথা বলেছিলেন। সেখানে হাসপাতাল আছে, কিন্তু ক’জনই বা সেখানে ঢোকবার সুযোগ পায়? হরিদ্বারে হাসপাতাল স্থাপনের পরামর্শটা স্বামীজিরই। বলেছিলেন, রাস্তায় অসুস্থ লোক দেখলে তাকে নিজের কুঁড়েঘরে তুলে নিয়ে এসো, চিকিৎসা করো।

কনখলে জমি কেনার কারণ, হরিদ্বার তখনই ঘিঞ্জি, খোলা এবং খালি জায়গা পাওয়া কঠিন। কনখলে জমি কিনে যখন ওখানে কঁচাঘর তৈরি আরম্ভ হল তখনও লোকে বুঝতে পারছে না ওখানে কী হবে। কল্যাণমহারাজ জানিয়ে দিলেন ওখানে ডাক্তারি ক্লিনিক হবে যাতে মানুষ চিকিৎসার সুযোগ পায়। স্থানীয় লোকদের কেউ কেউ সাহায্যের হাত এগিয়ে দিয়েছিল। তিনি সুন্দর কুঁড়েঘর তৈরি করলেন, একটা বড় ঘর রোগীদের জন্যে, আর ছোটটা নিজের থাকবার জন্যে।

এই সময় ঠাকুরের সাক্ষাৎ-শিষ্য স্বামী নিরঞ্জনানন্দ হরিদ্বারে এসেছিলেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর সম্বন্ধে বলেন, দেখ না, নিরঞ্জন কিছুতেই লিপ্ত নয়, নিজের টাকা নিয়ে গরীবদের ডাক্তারখানায় নিয়ে যায়। তারই লুকিয়ে রাখা ঠাকুরের ভস্মাস্থি পরে আত্মারামের কৌটায় স্থান পায়। আমেরিকা থেকে ফিরবার পথে স্বামীজিকে অভ্যর্থনা জানাতে নিরঞ্জনানন্দ কলকাতা থেকে কলম্বোতে হাজির হয়েছিলেন। একসময় স্বাস্থ্যের জন্য হরিদ্বারে থাকার সিদ্ধান্ত নেন।

হরিদ্বারে কল্যাণানন্দের খবর পেলেন স্বামী নিরঞ্জনানন্দ। সুদেহী ও শক্ত শরীরের মালিক তিনি, বড় বড় কাঠের কড়ি বরগা তিনি অনায়াসে তুলে নিয়ে নিজের হাতে যথাস্থানে লাগিয়ে নিতে পারতেন। কনখলে কাজের জায়গায় একটা বিরাট কাঠের বিম পড়েছিল। তুলবার লোক পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন দু’জনে মিলে সহজেই ওটা তুলে ফেলে যথাস্থানে লাগিয়ে দিলেন। হরিদ্বারেই আকস্মিক কলেরায় মারা গেলেন স্বামী নিরঞ্জনানন্দ। তার কয়েকমাস পরেই নিশ্চয়ানন্দ কনখলে হাজির। তিনিও প্রভূত বলশালী এবং কাজে ভয় পান না। তিনি সানন্দে কল্যাণানন্দের সহকারী হয়ে গেলেন। ভিক্ষায় বেরুলে তিনি কল্যাণানন্দের জন্যে খাবার সংগ্রহ করে আনতেন, কারণ কল্যাণানন্দ প্রায়ই কাজ সেরে ভিক্ষায় বেরোতে পারতেন না।

স্বামী সর্বগতানন্দ তাঁর প্রথম কয়েকদিনের কনখল-অভিজ্ঞতা সহজভাবে লিখে ফেলেছেন। “হাসপাতালের হিসেব রাখা ছাড়াও আমি প্রায় সারাক্ষণ কল্যাণানন্দকে ছায়ার মতন অনুসরণ করতাম। তিনি যেখানে যেতেন, যা কিছু করতেন সব কিছুর নীরব সাক্ষী আমি। আমাকে অন্য কোনো কাজ বা দায়িত্ব তখনও দেওয়া হয়নি। কয়েক সপ্তাহ এইভাবে কাটিয়ে আমি তাকে আবার বললাম, আমি হাসপাতালে কাজ করতে চাই।

“ঠিক আছে, তুমি ওখানে যাও, জিজ্ঞেস করো ওরা তোমাকে কী কাজ দিতে চায়। স্বামী কল্যাণানন্দ বললেন।

“আমাকে ওখানে নির্দেশ দেওয়া হলো, ওয়ার্ডটা পরিষ্কার করো। আমি সুইপার মেয়েটির কাছ থেকে শিখে নিলাম কেমন করে পিকদানি পরিষ্কার করতে হয়, বেডপ্যান পরিষ্কারের জন্যে একধরনের বুরুশ কীভাবে ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু মহারাজ যখনই চাইবেন তখনই আমাকে তার সঙ্গী হতে হয়। যখন তিনি রোগী দেখার জন্যে রাউন্ডে বেরোবেন তখন আমাকে অবশ্যই সঙ্গে থাকতে হবে।

“যখন তিনি বাগান দেখতে বেরোবেন তখনও সঙ্গে আমি। তিনি চাইছেন, সেবাশ্রমের সব কিছু যেন আমার জানা থাকে রোগীরা কারা, বাগানে কী হচ্ছে, সমস্ত কিছু।

“একদিন তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আজকে আশা করি তুমি বাগানে গিয়েছিলে, ছোট্ট ম্যাগনোলিয়া গাছটায় কটা ফুল দেখলে? আমি বলতে পারলাম না, অতো খুঁটিয়ে লক্ষ্য করিনি।

“জানো, ওটা একটা স্পেশাল গাছ। এসবের দিকে নজর রাখার চেষ্টা করলে ভাল হয়। কল্যাণমহারাজের প্রশ্নের ধারা এমন যে আমি সব কিছু খুঁটিয়ে দেখি।

“আর একদিন তিনি একজন রোগী সম্বন্ধে খবরাখবর জানতে চাইলেন। আমি উত্তর দিতে পারলাম না। তার মন্তব্য : ‘তুমি কি রাউন্ডে বেরিয়ে নজর রাখো না হাসপাতালের কোথায় কী হচ্ছে?

“আমি সঙ্গে সঙ্গে ছুটে হাসপাতালে গেলাম, খবর নিতে। এইভাবে আমি মহারাজ রাউন্ড দেবার আগেই নিজের একটা রাউন্ড দেওয়া শিখে নিলাম।

“অভিজ্ঞ আমি বুঝে গিয়েছি, আমাকে প্রত্যেক রোগীর খোঁজ নিতে হবে, সিরিয়াস রোগীদের সমস্ত খবরাখবর আমাকে আগাম দিতে হবে মহারাজকে।

“এই পর্বে মহারাজ নিজেই ডায়াবিটিস রোগের শিকার হয়েছেন, ফলে যদি কখনও রাউন্ড দিতে পারলেন না, আমাকে সমস্ত খবরের খুঁটিনাটি সরবরাহ করতে হবে। এইভাবে ধীরে ধীরে মহারাজ আমাকে শিখিয়ে দিলেন, কিভাবে তিনি হাসপাতালের সব কাজ সারেন।”

মহারাজের দৈনন্দিন রুটিন মনে রাখার মতন।

“সকালের জলখাবারের পর আমাকে মহারাজের ঘরে যেতে হবে। সেখান থেকে আমি ওঁর সঙ্গী। বিভিন্ন হাসপাতাল ওয়ার্ড, বাগান, গোয়ালঘর, লাইব্রেরি, মন্দির।

“তারপর আমাদের লক্ষ্যস্থল রান্নাঘর, সেখানে রাঁধুনির সঙ্গে কিছু কথাবার্তা, এবার মহারাজের ঘরে ফিরে আসা। আবার হাসপাতালে যাবার আগে মহারাজ কিছু খেয়ে নেবেন। ডাক্তাররা তো রোগীদের ভিজিট করেন, কিন্তু মহারাজ প্রত্যেক রোগীর বেডের কাছে যাবেনই, জানতে চাইবেন তার অবস্থা। কেমন আছে? কি কি ওষুধ এবং পথ্য সে পাচ্ছে? গতরাত্রে ভাল ঘুম হয়েছে তো? হাসপাতালের ৩৫-৪৫ জন ইনডোর রোগীর সঙ্গে তিনি বেশ কিছু সময় ব্যয় করবেন। কখনও তিনি রোগীর পাশে গিয়ে বসবেন, তার কথাবার্তায় দয়া এবং ভালবাসা দুইই ঝরে পড়ে অঝোরে। রোগীর বিশেষ কিছু প্রয়োজন থাকলে ডাক্তারকে ডেকে পাঠাবেন, অথবা আমাকে নির্দেশ দিয়ে দেবেন। এই হচ্ছে কল্যাণ মহারাজের প্রাত্যহিক রুটিন।

“বেশি কথা বলবার মানুষ ছিলেন না কল্যাণ মহারাজ। কথায় নয় কাজে, বিশেষত নিজের আচরণের মধ্য দিয়ে আধ্যাত্মিক শিক্ষা দেওয়ার বিশ্বাসী ছিলেন এই মিতভাষী মানুষটি। আমরা তাই মানুষটিকে সারাক্ষণ পর্যবেক্ষণ করতাম খুব কাছ থেকে খুব খুঁটিয়ে। একদিন সকালে কয়েকজন ব্রহ্মচারী হাঁটতে হাঁটতে ডিসপেন্সারির দিকে চলেছে, মহারাজ লক্ষ্য করলেন একজন ব্রহ্মচারীর মুখ গোমড়া।

“মহারাজের নজর এড়ানো শক্ত, তিনি তাকে ডাকলেন, জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার? মুখ ভারী কেন? কী হয়েছে? রাত্রে ভাল করে ঘুমোতে পেরেছ তো? আজ সকালে জলখাবার খেয়েছ তো?”

“ব্রহ্মচারীটির মুখ তখনও মেঘলা। মহারাজ এবার বললেন, ‘শোনো, তুমি হাসপাতালের সেবক, সেখানে মানুষরা অসুস্থ হয়ে শুয়ে আছে। তোমার কাজ তাদের মুখে হাসি ফোঁটানো, রোগীকে চাঙ্গা করে তোলা। কিন্তু নিজের মুখটাই হাঁড়ি হয়ে থাকলে তুমি সে কাজটা করবে কী করে? নিজের এই গোমড়া মুখ নিয়ে রোগীদের কাছে যেও না। বরং মন্দিরে চলে যাও, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণর কাছে প্রার্থনা করো। তারপর মুখে হাসি ফুটিয়ে আনন্দিত মনে ডিসপেন্সারিতে যাও।

কল্যাণ মহারাজ চাইতেন না কেউ খুশির ভাব না নিয়ে বেজার মুখে হাসপাতালের কাজে যায়। তিনি প্রায়ই বলতেন, “তোমরা সকলে এখানে মনের আনন্দে এসেছো। আনন্দে থাকো, অপরকে আনন্দ দাও। এইটাই এখানকার সবচেয়ে বড় কথা।”

মহারাজ এই প্রসঙ্গে যীশুর কথা টেনে আনতেন। যীশু বলেছেন, মুখে দুঃখের ভাব প্রকাশ করে উপবাস কোরো না। “তুমি হয়ত কঠোর আত্মসংযমী ক্লিষ্ট জীবন যাপন করছে, কিন্তু তার জন্যে তোমাকে বিষয় অবসাদগ্রস্ত দেখাবে কেন?”

হাসপাতালে সন্ন্যাসীদের কাজে পাঠাবার আগে মহারাজ প্রায়ই নানা কথা বলতেন। চাইতেন তারা চাঙ্গা হয়ে উঠে, অনুপ্রাণিত হয়ে নিজেদের কাজে যান।

মহারাজের কথা বলার ভঙ্গিটাই ছিল অনন্য। তিনি বলতেন, “দেখো, আমাদের এখানে মন্দিরও আছে, হাসপাতালও আছে। তোমরা মন্দিরে যাও ফুল নিয়ে, ফল নিয়ে, সঙ্গে স্তবগান, নামগান, স্তোত্রপাঠ, মন্ত্রপাঠ। আর হাসপাতালে তোমার সঙ্গে রয়েছে খাবার ও ওষুধ। দুটোর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই– একেবারে এক ব্যাপার। মন্দিরে আমরা যা করি, আর হাসপাতালে আমরা যা করি দুটো আলাদা জিনিস নয়। এই হচ্ছে স্বামী বিবেকানন্দর আদর্শ। তাই দু’জায়গাতেই একই রকম মানসিকতা নিয়ে যেতে হবে।”

মহারাজ আরও বলতেন, “সবকিছু অত্যন্ত সাবধানে সচেতনভাবে পরিষ্কার রাখবে। রোগীকে ভালবাসা, করুণা সহানুভূতি দেখাও। তোমাদের সাহায্য ওদের প্রয়োজন।”

আরও একদিনের কথা মনে আছে। তিনি ব্যাখ্যা করলেন, কেন ‘রোগীনিবাস’ না বলে হাসপাতাল’ বলে। আমাদের অবশ্যই অতিথিপরায়ণ অর্থাৎ হসপিটেল’ হতে হবে। মানুষ যখন আমাদের কাছে আসে আমাদের যেটা দেবার সেটা হলো হসপিটালিটি বা অতিথিসেবা। এই ব্যাপারটা কখনও ভুললে চলবে না।”

এরপরেই মহারাজ জিজ্ঞেস করলেন, “ইংরিজি ‘পেশেন্ট’ (রোগী) শব্দটার অর্থ কী? ওদের সঙ্গে ব্যবহারে আচরণে আমাদের ধৈর্ষ অর্থাৎ ‘পেশেন্স দেখাতে হবে। রোগীদের পেশেন্ট বলা হয় এই জন্যে যে ওরা আমাদের শেখায় কীভাবে ধৈর্যশীল হতে হয়।”

কনখলের সেবাশ্রমের রোগী প্রসঙ্গে সন্ন্যাসীরা যা বলজেতার কাছাকাছি ভাবধারা প্রবাহিত হয়েছিল বারাণসীর রামকৃষ্ণ সেবাশ্রমেও। সেখানকার অন্যতম প্রাণপুরুষ ছিলেন স্বামী অচলানন্দ, স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর এই প্রিয় শিষ্যকে কেদারবাবা বলে ডাকতেন। বারাণসী সেবাশ্রমের এক প্রবীণ সন্ন্যাসী কেদারবাবার কিছু স্মৃতি আমাদের উপহার দিয়েছেন :

“সহকর্মী আরও একজন নবাগত সাধু সঙ্গে রয়েছে- কেদারবাবাকে প্রণাম করতে গিয়েছি।

আমরা সম্মুখে গিয়ে দাঁড়াতেই জিজ্ঞেস করলেন–এসো, আজ কটি নারায়ণ এলেন? কী সেবা করেছ তাদের বলো।‘

আমি হাতজোড় করে নিবেদন করলাম, মহারাজ, আজ চারজন নারায়ণ ভর্তি হয়েছে।

বললাম, তাদের কার কী অসুখ। আমার বন্ধু সাধুটি পরে জানান–আমার ওয়ার্ডে দু’জন পেশেন্ট’ (রোগী) এসেছে।

লক্ষ্য করলাম, কেদারবাবা বন্ধুর এই কথা শুনেই গম্ভীর হয়ে রইলেন–আর একটিও কথা বললেন না। খানিকক্ষণ বাদে আমার দিকে তাকিয়ে বলতে থাকেন, তোমরা সেবা করবে খুব ভাব নিয়ে। তাতে তোমার নিজের কল্যাণ হবে, যার সেবা করছ তারও কল্যাণ হবে। তুমি ভাববে নারায়ণের সেবা করছ। আর যার সেবা করছ, সে দেখবে–ভগবান আমারও জন্য ব্যবস্থা রেখেছেন–আমাকেও দেখবার জন্য ভগবান কাউকে নিযুক্ত রেখেছেন। মনে মনে সে বলবে–হে ভগবান তুমি আমাকেও দেখছ!’

আর খুব খোঁজ নিতেন–কখন তুমি বলতে পার? ভগবানের চিন্তা কতক্ষণ করতে পার?

কেদারবাবা প্রায়ই মনে করিয়ে দিতেন–”যখনই সময় পাবে, তখনই বসবে এবং ভগবানের নাম করবে। ভগবানের নাম জপ, তার ধ্যান এবং তারই নারায়ণ মূর্তির সেবা–এই দুই সাধনই সমান ভাবে রাখবে।”

কনখল সেবাশ্রমের নারায়ণ প্রসঙ্গে ফেরা যাক। কল্যাণানন্দের জীবন দর্শন বুঝতে এই অভিজ্ঞতাটি সকলকে সাহায্য করবে। ”কয়েকজন লোক এক গুরুতর অসুস্থ মানুষকে কনখল সেবাশ্রমে নিয়ে এল। ভরদুপুর বেলা, হাসপাতাল তখন বন্ধ। যারা মানুষটিকে বয়ে এনেছিল তারা হাসপাতালের বাইরে রাস্তায় মানুষটিকে ফেলে রেখে অদৃশ্য হয়েছে। গঙ্গাস্নান করে ফেরবার পথে মানুষটিকে পড়ে থাকতে দেখে আমি ডাক্তার ডেকে আনলাম, ডাক্তার রোগী পরীক্ষা করে বললেন, ভিতরে নিয়ে গিয়ে লাভ নেই, রোগী এখনই মারা যাবে।

“এই বলে ডাক্তারবাবু তো চলে গেলেন, কিন্তু আমি রোগী ছেড়ে নড়তে পারছি না। আমি প্রায় অসহায়ভাবে মানুষটির দিকে তাকিয়ে আছি, কি করব ভেবে উঠতে পারছি না। এমন সময় দেখি, ভিতর থেকে কল্যাণ মহারাজ আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন, ইঙ্গিতে জানতে চাইছেন কি হয়েছে?

“আমি সমস্ত ব্যাপারটা বললাম। সব শুনে মহারাজ বললেন, “না, একটা বেড রেডি কর, রোগীকে ভিতরে নিয়ে এস। যদি মৃত্যু অবধারিত হয়, তা হলে শান্তিতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করুক মানুষটি। তুমি অন্তত কিছুক্ষণ সেবা করবার সুযোগ পাবে।”

“আমি সঙ্গে সঙ্গে লেগে পড়লাম। দুটি বালকের সাহায্য নিয়ে রোগীকে ভিতরে নিয়ে এলাম। এবার মহারাজ স্বয়ং চলে এলেন, রোগী দেখলেন এবং দু’একটা ওষুধ লিখে দিলেন। বললেন, গ্লুকোজের জল ও লেবুর রস দাও। চার ঘণ্টা পরে মানুষটি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করল। ইতিমধ্যে যারা এই রোগীকে হাসপাতালের সামনে ফেলে চলে গিয়েছিল তাদের দু’জন ফিরে এসেছে।”

রোগীর সঙ্গী মানুষ দুটি সন্ন্যাসীদের আচরণ দেখে মুগ্ধ। দাহের সব দায়িত্ব ঘাড়ে নিয়ে মহারাজ যে বিষয়টার গুরুত্ব আমাদের বোঝালেন তা ভুলবার নয়–সেবা কতক্ষণ ধরে করা হলো সেটাই বড় কথা নয়, যা যতক্ষণ দরকার তা করতেই হবে, খুব সামান্যক্ষণের জন্যে হলেও সেই সেবার গুরুত্ব অসীম।

আরও একবার প্রায় একই পরিস্থিতি। খুব সঙ্কটাপন্ন রোগী এসেছে। কল্যাণ মহারাজ পিছপাও হতে চান না, কাউকে ফেরাতে চান না। তিনি বললেন, “ধর তোমার নিজের ভাই এই অবস্থায় রয়েছে। তার জন্যে তুমি কি না করবে! অপরের সম্বন্ধে একই রকম ভাবতে হবে আমাদের।”

এবার মহারাজ ডাক্তারকে বললেন, “নারায়ণকে না জানিয়ে কোনো রোগীকে ফিরিয়ে দেবেন না।” পরের নির্দেশ : “ওকে না জানিয়ে কোনো রোগীকে ছুটি দিয়ে দেবেন না।”

এই ছুটি দিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে কল্যাণ মহারাজের নিজস্ব কিছু ভাবনাচিন্তা ছিল। রোগ সেরে যাওয়ায় ডাক্তার হয়ত ছেড়ে দিতে আগ্রহী, কিন্তু মহারাজ জানেন গরীব রোগীর বাড়ির লোক প্রয়োজনীয় পথ্য দিতে পারবে না যাতে সুস্থ হয়ে সে আবার রুজিরোজগার শুরু করতে পারে।

হাসপাতালে যেসব রোগী আসত তাদের বেশিরভাগই অত্যন্ত দরিদ্র। পেট চালানোর জন্যে তাদের প্রচণ্ড দৈহিক শ্রম করতে হয়। তাই মহারাজ চাইতেন হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবার আগে তাদের শারীরিক ক্ষমতা কিছুটা ফিরে আসুক। এক একজন রোগী দেখে মহারাজ বলতেন, “একে আরও কদিন রেখে দাও এবং খুব ভাল করে খাওয়াও। একটু শক্তি ফিরে পাক, তারপর ওকে বাড়ি পাঠিও।”

“হাসপাতাল থেকে ছাড়বার সময় মহারাজ শুধু এদের কয়েকদিনের ওষুধ দিয়ে দিতেন তানয়, রান্নাঘর থেকে বেশ কিছু খাবার গুছিয়ে দিতেন। এর জন্যে রামকৃষ্ণ মিশন’ মার্কা বিভিন্ন সাইজের বেশ কিছু শিশিবোতল আমাদের স্টকে থাকত।

“ওখানে ডাক্তার বোস বলে একজন নামকরা প্রাইভেট চিকিৎসক ছিলেন, তার সাহায্যে আমরা চাইলেই পেতাম। অর্থাৎ প্রত্যেক রোগীর জন্য আমাদের পক্ষে যা যা সম্ভব তা না করা পর্যন্ত কল্যাণ মহারাজ ক্ষান্ত হলে না। এর পরে অনেকের কাছে কল্যাণ মহারাজ যে দেবতার মতন হয়ে উঠকেন তাতে আশ্চর্য কি?

“স্থানীয় লোকদের মুখে নিশ্চয়ানন্দ মহারাজ সম্পর্কেও একই ধরনের কথা শুনতাম। একেবারে নিজের মতন করে নিয়ে তিনি যেভাবে মানুষের সেবা করতেন তা স্থানীয় মানুষদের মনে ছিল। যখনই মানুষের মুখে নিশ্চয়ানন্দের প্রশস্তি শুনতাম তখনই ভাবতাম, আমরা কখনই কি ওঁদের স্তরে উঠে আসতে পারব?”

আরও একটা কথা কল্যাণ মহারাজ সুযোগ পেলেই শুনিয়ে দিতেন। “তোমরা, এখানে সেবা দিতে এসেছ, সেবা নিতে নয়। সুতরাং নিজেরা অসুখে পড়ে যেও না।” ফলে আমাদের অসুখ-বিসুখ করলে, বিশেষ করে ম্যালেরিয়া হলে, মহারাজ প্রায়ই তা জানতে পারতেন না। শরীর খারাপ হলে ওঁকে না জানিয়ে, চুপি চুপি ওষুধপত্তর খেয়ে আমরা কাজে লেগে থাকতাম।”

গুরুর মন্ত্রে তখন কল্যাণীনন্দ কথা নয় কাজে বিশ্বাস করতেন। কাজের মূর্ত বিগ্রহ এই মানুষটি গভীর রাতে হাসপাতালে সামান্য আওয়াজ হলেও ঘুম থেকে উঠে পড়ে, দ্রুত জুতো পরে হাসপাতালের দিকে এগোতেন। সঙ্গের সাথী বিশ্বস্ত কুকুরটি। “আমার ঘরটা ছিল মহারাজের ঘরের ঠিক পাশেই। আমিও ততক্ষণে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে মহারাজের পিছন পিছন হাসপাতালে হাজির হয়েছি। মহারাজ বুঝতে পারতেন আমি এসে গিয়েছি। যদি তিনি কোনো ওষুধের কথা বলতেন আমি তা সঙ্গে-সঙ্গে হাজির করতাম।

“কল্যাণানন্দ মহারাজের শান্তস্বভাব উল্লেখ করার মতন, তাঁকে চটানো বা উত্তেজিত করা প্রায় অসম্ভব ছিল। একবার এক টাইফয়েডের রোগী প্রচণ্ড জ্বরে বিকারগ্রস্ত হয়ে মহারাজকে এমনভাবে আঘাত করল যে তিনি পড়ে গিয়ে চশমা ভেঙে ফেললেন। আমরা তোকটাকে সামাল দেবার জন্যে তার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়তে মহারাজ বললেন, “ওকে কিছু করো না। ওকে বসে থাকতে দাও।” মেঝে থেকে উঠে দাঁড়িয়ে মহারাজ এবার রোগীকে একহাতে জড়িয়ে ধরে সস্নেহে জিজ্ঞেস করলেন, “এখন ভাল বোধ করছ তো?” এরপর ডাক্তারকে খবর পাঠালেন। আমরা মহারাজের ওই অবস্থা দেখে উত্তেজিত, কিন্তু মহারাজ একেবারে শান্ত, তার মধ্যে কোনো উত্তেজনা নেই।”

স্বামী সর্বগতানন্দ লিখেছেন, “সেবা ও আত্মদানের নিবেদনের মূর্ত পরিগ্রহ এই স্বামী কল্যাণানন্দ। এক আধ বছর নয়, দীর্ঘ সাঁইত্রিশ বছর তাঁর এই সেবার নিঃশব্দ পরিচয় তিনি রেখে গিয়েছেন। এই সময়ের মধ্যে একবারও তিনি কলকাতায় যাবার কথা মনের মধ্যে আনেননি। থেকে গিয়ে সেবা করবার জন্যেই তো তিনি এসেছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দ তাকে বলেছিলেন বাংলাকে ভুলে যাও’ এবং সেই নির্দেশ সারাক্ষণ মহারাজের মনের মধ্যে থেকে গিয়েছিল। অন্তত তিনজন সঙ্ঘসভাপতি (স্বামী ব্রহ্মানন্দ, স্বামী শিবানন্দ ও স্বামী অখণ্ডানন্দ) চেষ্টা করেও তাকে বেলুড়ে নিয়ে যেতে পারেননি। চতুর্থ সভাপতি স্বামী বিরজানন্দ যখন বেলুড়ে শ্রীরামকৃষ্ণ মন্দির তৈরি হলো তখন কল্যাণানন্দকে মস্ত চিঠি লিখলেন,একবার বেলুড় ঘুরে যাবার জন্যে। তিনি রাজি হলেন না। ১৯৩৭ সালে মহারাজ আমাকে বেলুড় ঘুরে আসতে বললেন, কিন্তু আমি বললাম, “আপনি না গেলে আমি যাব না, আমি এখানে থেকে যাব।”

বিবেকানন্দ নির্দেশিত সেবা সত্যিই বড় কঠিন ব্রত। অবিচলিত নিষ্ঠাই এই পথে এগিয়ে যাওয়ার একমাত্র উপায়।

মঠ ও মিশনের কিংবদন্তি সন্ন্যাসীদের অনেকেই হরিদ্বার ও কনখলে গিয়েছেন। এঁদের জন্যে স্বামী কল্যাণানন্দের দ্বার ছিল অবারিত। প্রেসিডেন্ট স্বামী ব্রহ্মানন্দ ১৯০৪ সালে কনখলে এসেছিলেন। সেই সময়ে যে চেয়ারে তিনি বসতেন তা সযত্নে রেখে দিয়েছিলেন কল্যাণানন্দ। সকলের সামনেই থাকত এই চেয়ার, কিন্তু কেউ বসতেন না। প্রতিদিন সকালে মন্দির থেকে বেরিয়ে কল্যাণানন্দ একবার এই চেয়ারটি স্পর্শ করতেন শ্রদ্ধাভরে। সর্বতানন্দ একবার জানতে চাইলেন, চেয়ারটা রঙ করতে পারি কি?

“রঙ করতে পারো, কিন্তু চেয়ারটা চোখের সামনে থেকে সরিয়ে রেখো না।” ফলে সর্বগতানন্দ চেয়ারটা পরিষ্কার করলেন, রঙ লাগালেন এবং একটা বিজ্ঞপ্তি ঝুলিয়ে দিলেন, “দয়া করে এই চেয়ারটা ব্যবহার করবেন না।”

১৯১৬ সালে স্বামী ব্রহ্মানন্দ আবার কনখলে এসেছিলেন। তখন সেবাশ্রমে যক্ষ্মা রোগীদের জন্যে একটা আলাদা বাড়ি তৈরি হচ্ছে। সুন্দর বাড়ি, বেশ জায়গা রয়েছে, একটা বড় হলঘরও রয়েছে। তখনও গৃহপ্রবেশ হয়নি, রাজা মহারাজ বললেন, “চমৎকার বাড়ি, এখানে দুর্গাপুজো করা যাক।” সেই মতো ওখানেই দুর্গাপুজো হলো, সবাই উৎসবে অংশগ্রহণ করল।

এরপরে প্রেসিডেন্ট মহারাজ বললেন, “কল্যাণ, মন্দিরের পক্ষে এটা উপযুক্ত স্থান। অনেক লোক আসতে পারবে।”

মহারাজ কনখল থেকে চলে যাবার পরে বেশ কয়েকজন সন্ন্যাসী কল্যাণানন্দকে মনে করিয়ে দিলেন, স্বামী ব্রহ্মানন্দ চেয়েছেন এটিকে পূজালয়ে রূপান্তরিত করতে। কল্যাণানন্দ সোজা উত্তর দিলেন, “শোনো, যক্ষ্মা রোগীদের ওয়ার্ড করবার জন্যে আমি লোকের কাছ থেকে ডোনেশন নিয়েছি। অন্য কোনো কাজে আমি কখনোই এটা ব্যবহার করতে পারব না। প্রেসিডেন্ট মহারাজ ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন সে সম্বন্ধে সন্দেহ নেই, কিন্তু যে কাজের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমরা টাকা তুলেছি সেটা পালন করা আরও গুরুত্বপূর্ণ।”

অনেকদিন পরে, শ্রীরামকৃষ্ণশতবর্ষ উদযাপনের বছরে, সরকারি নির্দেশ জারি হলো, যক্ষ্মারুগি ও অন্য রুগিদের একসঙ্গে রাখা যাবে না। গভর্নমেন্ট ইতিমধ্যে আলাদা একটা যক্ষ্মা হাসপাতাল তৈরি করে ফেলেছে। এর ফলে সেবাশ্রমে যক্ষ্মা চিকিৎসা বন্ধ হয়ে গেল।

আরও অজস্র অভিজ্ঞতার কথা বিভিন্নভাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে। মৃতদেহ সম্বন্ধে তরুণ এক সন্ন্যাসীর ভীষণ ভয় ছিল। কল্যাণানন্দ তা জানতেন।

“একদিন আমার সারারাত ডিউটি পড়েছে। কল্যাণ মহারাজ শান্তভাবে নিঃশব্দে হাসপাতালের চলে এলেন সেই রাত্রে। একের পর এক ওয়ার্ড ঘুরছেন তিনি, আমি সঙ্গে রয়েছি। এরপর আমরা মড়িঘরের কাছে চলে এলাম। শবদেহ সম্বন্ধে আমার ভীষণ ভয় ছিল। যখন ছোট ছিলাম তখন আমাদের মৃতদেহর কাছে যেতে দেওয়া হতো না। যখন বড় হয়েছি তখনও মৃতদেহের কাছাকাছি যাবার সুযোগ ঘটেনি। সেবাশ্রম থেকে যখন মৃতদেহ সরানোর প্রয়োজন হত তখন অন্যরা এই কাজ করতেন। আমাকে কখনও শবানুগমন করতেও বলা হয়নি। ফলে হাসপাতালের মড়িঘরে আমি কখনও ঢুকিনি।

কিন্তু সেই রাত্রে হাসপাতালের মড়িঘরের দিকে ধীরে ধীরে এগোতে এগোতে কল্যাণ মহারাজ এক জন রোগী সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন। আমাকে বলতে হলো সে আর বেঁচে নেই, দেহটা মড়িঘরে চলে গিয়েছে। মহারাজ তখন আমার সামনে, আমি পিছনে। তিনি মড়িঘরের দরজা খুললেন, আলো জ্বাললেন এবং ভিতরে ঢুকে গেলেন। আমাকেও পিছন পিছন যেতে হলো। উনি সঙ্গে থাকলে আমার ভয় পাবার অবকাশ নেই। আমারও সাহস বেড়ে যাচ্ছে। মহারাজ মৃতদেহের খুব কাছে এগিয়ে গিয়ে, মুখের কাপড়টা সরিয়ে দিলেন এবং দেহটিকে দেখতে লাগলেন। এবার আমার দিকে মুখ ফেরালেন মহারাজ, বললেন, “কিছু লোক শব দেখলে ভয় পায়। পৃথিবীতে নিতান্ত নিরাপদ বলতে যদি কিছু থাকে তা হলো মৃতদেহ। একটা আঙুল পর্যন্ত তোলে না, একটা কথা পর্যন্ত বলে না, তবু মানুষ ভয় পায়। যেখানে ভয় পাবার কিছুই নেই সেখানে মানুষ ভয় পায়।”

“আপনি ঠিক বলেছেন, আমার উত্তর। আমার মুখ থেকে এই কথা শুনে, মহারাজ ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে গেলেন, হাত ধুলেন, এবার চলে যেতে প্রস্তুত তিনি। কিন্তু আমাকে মৃতের মুখের কাপড়টা টেনে দিতে হলো। আমি করলাম। তারপর আমি হাত ধুলাম। এবার আমরা দুজনে ওখান থেকে চলে গেলাম।

“সেই শেষ, এরপর মৃতদেহ থেকে আমি জীবনে কখনও ভয় পাইনি।

“কল্যাণানন্দ জানতেন কি করে ভুল ভাঙিয়ে শিক্ষা দিতে হয়। সেবার মড়িঘরে ঢুকে তিনি সোজাসুজি আমার সমালোচনা করেননি, সাবধানে শুধু বলেছেন, “মানুষ ভয় পায়।”

কনখলকে বিবেকানন্দ ভাবনার আদর্শ স্থান হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন কল্যাণানন্দ। কনখলের নটি বছরের মধ্যে আড়াই বছর স্বামী সর্বগতানন্দ কাটাতে পেরেছিলেন স্বামী কল্যাণানন্দের সান্নিধ্যে।

সেই দুর্লভ অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে তিনি লিখেছেন, সন্ন্যাসীর দৈনন্দিন জীবনে থাকে কাজ, পূজা, পাঠ ও উপাসনা। মঠের দৈনন্দিন জীবনে অন্য কিছুর অনুপ্রবেশ নেই, মঠ থেকে বেরিয়েই হাসপাতালের কাজ অথবা সন্ধ্যায় ছোটদের পড়াশোনা করানো। এখানে তীর্থযাত্রী এবং রোগীরা আছে, কিন্তু ভক্তরা অনুপস্থিত। ফলে ভক্তদের জন্য সময় ব্যয় করার কোনো প্রয়োজন নেই।

কল্যাণানন্দের দেহাবসানের কিছুদিন আগে কনখলের গ্রন্থাগারে বসে কয়েকজন তরুণ সন্ন্যাসী গল্প করছেন। একজন বললেন, “আমরা সবকিছু ত্যাগ করেছি, এখন কল্যাণানন্দ মহারাজের স্নেহময় সান্নিধ্যে এবং শিক্ষায় বেশ ভালো আছি।”

মহারাজ সেইসময় ওই পথ ধরে হাঁটছিলেন, তরুণদের কথা শুনে ভিতরে ঢুকে পড়ে একটা চেয়ারে বসলেন। উপস্থিত সকলে উঠে দাঁড়ালেন।

মহারাজের প্রশ্ন, “কে বলেছে তোমরা সবকিছু ত্যাগ করেছ? কী তোমরা ত্যাগ করেছ? বাবা, মা, ভাই, বোন, বাড়ি? প্রথমেই বল এসবের মালিকানা কী তোমার? তুমি যার মালিক তার কিছু ত্যাগ করেছ কি? তুমি কীসের মালিক? তোমার অহং, তোমার স্বার্থবোধ! স্বামী বিবেকানন্দ বলতেন, ত্যাগ এবং সেবা। নিজের অহং ও স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে প্রেমময় সেবা কর। এর নাম ত্যাগ।”

এরপর মহারাজ একজনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এইটা লিখে নাও–স্বামীজির নিঃস্বার্থ প্রেমময় সেবাই আমাদের মন্ত্র।” এরপর তিনি বেরিয়ে গেলেন, তরুণ সংসারত্যাগীরা স্তম্ভিত হয়ে বিবেকানন্দশিষ্যের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

একবার কল্যাণানন্দ রোগী দেখতে বেরিয়েছে, তখন তরুণ সন্ন্যাসীদের কেউ কাছাকাছি ছিল না। পরিস্থিতি মোটেই আশাপ্রদ নয়। মহারাজ নিজের হাতে সমস্ত জায়গাটা পরিষ্কার করলেন, কিন্তু কাউকে ডাকতে পাঠালেন না। বিছানায় কাঁচা চাদর নতুন করে বিছিয়ে দিলেন। কাছেই একটা টব ছিল, সেখানকার জলে রোগীর জামাকাপড় ভিজিয়ে দিলেন। তারপর নিজের হাতে সেগুলো কেচে বাইরে এনে রোদে শুকোতে দিলেন। “সহযোগীরা যখন ওয়ার্ডে এলেন, তখন এইসব দেখে তারা রোগীদের জিজ্ঞেস করলেন, কে এসব কাজ করেছে? কেউ ঠিকমতন বলতে পারল না। সবাই তাকে চিনতো না।

সেবাকার্যের জন্যে কনখলে অনেকে এসেছেন, কিন্তু কাজের প্রবল চাপ সহ্য না করতে পেরে কিছুদিন পরে চলে গিয়েছেন। কল্যাণানন্দ কিন্তু কারও ওপর জোরজার করতেন না। অনেক সময় তাকে না বলেই সেবকরা আশ্ৰম ছেড়ে চলে গিয়েছে।

কর্মীরা সন্ধেবেলা প্রত্যেকে বেড়াতে বেরোতে চাইতেন। অথচ এই সময়েই হাসপাতালে কাজের চাপ তুঙ্গে। সর্বগতানন্দকে সান্ধ্যভ্রমণে বেরুতে হতো না। কল্যাণানন্দ বলতেন, “শুধু শুধু বেড়াতে বেরোবে কেন? এসব যারা কুঁড়ে অথবা বৃদ্ধ তাদের জন্যে, যারা কমবয়েসি তাদের হাতে তো হাজার রকম কাজ।”

বেড়াতে যাবার মতন সময় কল্যাণ মহারাজেরও হাতে থাকত না। স্বামী নিশ্চয়ানন্দের কাছেও এই বেড়ানো ছিল বিলাস। সন্ধ্যায় লোকে হাঁটতে-হাঁটতে গঙ্গা আরতি বা ব্রহ্মকুণ্ড দেখতে যেতে চাইতেন। আমাদের বিশ্বাস ছিল স্বয়ং ঠাকুর আমাদের মন্দিরে রয়েছেন, যা কিছু আমাদের দুরকার সব এখানেই পাওয়া যাবে। এসব ছেড়ে গঙ্গায় গিয়ে আরতি দেখার কী প্রয়োজন?

কল্যাণানন্দ যা সরলভাষায় সোজাভাবে বলতেন, তা হলো, “পূজা, প্রার্থনা ও জপের জন্যে এখানে মন্দির রয়েছে, আর সেবার জন্যে হাসপাতাল রয়েছে। সবই তো এক। এসব ছেড়ে সান্ধ্যভ্রমণের বিলাসিতা কেন?”

আশ্রমের কর্মীরা যে কী কঠিন অবস্থায় দিন কাটাতেন তার বিবরণ এখন পড়লে অবিশ্বাস্য মনে হয়। প্রত্যক্ষদর্শী জানাচ্ছেন, দু’বছর আমাদের কোনো সকালের জলখাবার বা প্রাতরাশ ছিল না। কারণ আমাদের সেই আর্থিক সঙ্গতি ছিল না। দুপুরে বারোটার সময় আমাদের জুটতো দুটি ভাত এবং ঝোল বা ডাল, রাত্রে দুটি রুটি এবং সামান্য সবজি, ওইটাই আমাদের ডিনার।

সন্ন্যাসী ও ব্রহ্মচারীদের খাওয়াদাওয়ার জন্যে হাসপাতালের অর্থ স্পর্শ করা হত না। যদি কেউ সাধুদের জন্যে কিছু অর্থ দান করতেন, কেবল সেই টাকাই খরচ করা যেত। অবস্থা দেখে একজন ভক্ত বেশ কিছু অর্থ সাধুদের সেবার জন্য দান করেন। এর পরেই বাইরে থেকে কোনো সাধু কনখলে এলে তাকে সঙ্গে থাকতে আমন্ত্রণ জানাতে সাহস হত।

তবু সুদূর হেড অফিসের খবরদারি থেকে সেবাশ্রমের মুক্তি ছিল না। একবার হিসেব পরীক্ষার জন্যই বেলুড় মঠ থেকে এলেন স্বামী শুদ্ধানন্দ। সবে তিনি জেনারেল সেক্রেটারির দায়িত্ব থেকে ছুটি পেয়েছে (পরে সঙ্ঘ সভাপতির পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন)। তারও আগের আর এক বিশিষ্ট অতিথি স্বামী বিবেকানন্দের গুরুভাই স্বামী তুরীয়ানন্দ।

হরিমহারাজের প্রতি কল্যাণানন্দের ছিল প্রবল ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা। হরিমহারাজ এ অঞ্চলে এসে যখন শুনলেন কল্যাণ এখানে রয়েছে তখন তিনি সেবাশ্রমে থাকবার জন্যে চলে এলেন। কোনোরকম কষ্টকে ভয় পেতেন না ঠাকুরের এই ত্যাগী সন্তান।

সেই সময় কনখলের চারদিকে জঙ্গল। একটা পাগলা ষাঁড় সমস্ত রাত ছোটাছুটি করে সবকিছু তছনছ করত। পাগলা ষাঁড়টা খুব কাছে এসে পড়লে কল্যাণানন্দ ও নিশ্চয়ানন্দ দু’জনে মিলে তাকে তাড়াবার ব্যবস্থা করতেন। আশ্চর্য ব্যাপার, তুরীয়ানন্দজী আগে থেকে বুঝতে পারতেন এবং বলতেন, “কল্যাণ, ষাঁড়টা আসছে এদিকে।” ওখানে মস্ত একটা ঢাক ছিল, সেটা খুব জোরে বাজিয়ে ষাঁড়কে ভয় পাইয়ে দেওয়া হতো।

কদিন পরপর এই ঘটনা ঘটলো। তখন কল্যাণানন্দ জিজ্ঞেস করলেন তুরীয়ানন্দকে, “মহারাজ, আপনি কী রাত্রে ঘুমোন না? সামান্য একটু শব্দে আপনি জেগে ওঠেন।”

তুরীয়ানন্দ মুখ টিপে হেসে বলনে, “ঘুমোই, তবে তোমাদের মতন নয়।” হরিমহারাজের এই কথাটি কল্যাণমহারাজ তার ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করেছিলেন।

কল্যাণমহারাজের দেহত্যাগের পর ওঁর জিনিসপত্তর গুছোতে গুছোতে এই ডায়েরিটা তরুণ সন্ন্যাসীর হাতে আসে। তখন ১৯৩৭ সালের শেষ দিক। স্বামী জগদানন্দকে স্বামী সর্বগতানন্দ বললেন, “কল্যাণমহারাজ তার ডায়েরিতে এই মধ্যরাতের মত্ত যণ্ডের কথা লিখে রেখেছে। সেই সঙ্গে

তুরীয়ানন্দ বললেন, আমি তোমাদের মতন ঘুমোই না।

এর অর্থ কী, জানতে চেয়েছিলেন সর্বতানন্দ। স্বামী জগদানন্দের ব্যাখ্যা উনি অন্য সকলের থেকে আলাদা। উনি অবশ্যই ঘুমোতন, কিন্তু সবসময় চেতনা থাকত–পূর্ণ চেতনা। রামকৃষ্ণদেব একবার বলেছিলেন, “ঘুমকে আমি ঘুম পাড়িয়েছি।”

আরও একজন অতিথির আগমন ও ট্র্যাজেডির সঙ্গে জড়িয়ে আছে কনখলের স্মৃতি। তিনিও কম লোক নন, রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের প্রথম সেবাশ্রম বারাণসীতে প্রতিষ্ঠার ও লালনপালনের দুর্লভ কৃতিত্ব তার। পূর্বাশ্রমে তার নাম চারুচন্দ্র দাস, বহুবছর সংসারে সন্ন্যাসীর মতন বসবাস করে জীবনের শেষপ্রান্তে তিনি স্বামী শুভানন্দ হয়েছিলেন।

টাকাকড়ি বিষয়সম্পত্তি সম্বন্ধে বিবেকানন্দশিষ্য কল্যাণানন্দের কী আচরণ তা-ও একালের ম্যানেজমেন্ট বিশারদর্দের চিন্তার খোরাক হতে পারে। এটি জানা না থাকলে পুরো মানুষটিকে বোঝা অসম্ভব।

স্বামী বিবেকানন্দের প্রদর্শিত পথে বেলুড় হেড অফিস হিসেবপত্তর সম্বন্ধে সর্বদা সাবধান। স্বামী শুদ্ধানন্দ শুধু বিশ্রাম নিতে এবং তপস্যা করতে কনখলে আসেননি। ইনি বিবেকানন্দের সাক্ষাৎশিষ্য, তাই গুরুভাইয়ের সঙ্গে অনেকদিন পরে দেখা হওয়ায় খুবই আনন্দিত।

যথাসময়ে স্বামী শুদ্ধানন্দ গুরুভাইকে তার কনখলে আসার অন্যতম উদ্দেশ্য জানালেন, কর্তৃপক্ষ তাকে সেবাশ্রমের আর্থিক দিকটা দেখে আসতে বলেছেন। খরচপত্তর কীভাবে হচ্ছে, যেসব টাকা এককালীন দান হিসেবে এসেছে তা কোথায় কীভাবে বিনিয়োগ হচ্ছে, ইত্যাদি হিসেবপত্তরের প্রশ্ন। এর একটা কারণ হতে পারে, নিজেকে নিষ্ঠুরভাবে খরচাপত্তরের বাইরে রাখলেও, বেলুড় হেডকোয়ার্টার কখনও তার কাছ থেকে বিস্তারিত আর্থিক বিবরণ পাননি। একজন তরুণ সন্ন্যাসী কাছেই দাঁড়িয়েছিলেন যখন শুদ্ধানন্দজী বললেন, “কল্যাণ, ওঁদের ইচ্ছা আমি তোমার আর্থিক ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে আসি। তুমি কোথায় কীভাবে টাকা বিনিয়োগ করেছ?”

কল্যাণানন্দ অ্যাকাউন্টস নিয়ে অযথা মাথাব্যথা করতেন না, যদিও একটা আধলা বাজে খরচের উপায় নেই। বারাণসীর সেবাশ্রমে বিবেকানন্দশিষ্য চারুচন্দ্র দাসও (স্বামী শুভানন্দ) ছিলেন এই ব্যাপারে অত্যন্ত সাবধানী। তাঁর জীবনীকার স্বামী নরোত্তমানন্দ লিখে গিয়েছেন, একবার রাতের খাবারের পর একটি লবঙ্গ হাতে পেলেন। তিনি আর একটা লবঙ্গ চাইতে, চারুচন্দ্র মুখের ওপর যদিও সবিনয়ে বললেন, এখানকার নিয়মাবলীতে খাবার পরে একটি করে লবঙ্গ দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া আছে! শুনলে অবাক হতে হয়, কিন্তু এমনি করেই সংসারত্যাগী সন্ন্যাসীরা পরের কাছ থেকে ভিক্ষে করা অর্থের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছেন।

স্বামী শুদ্ধানন্দের হিসেবঘটিত প্রশ্নের উত্তরে কল্যাণানন্দ বললেন, “মহারাজ আপনি এই সব ব্যাপারে নিয়ে দুশ্চিন্তা করছেন কেন? আপনার শরীর খারাপ, আপনি এখানে এসেছেন বিশ্রাম নিতে, এখন তো আপনি অবসর জীবন যাপন করছেন। আপনি এখানে আসছেন তাই আপনাকে ওরা একটু কাজে লাগাতে চায়। এসব ব্যাপারে ব্যস্ত হবেন না, আপনি ভালো করে বিশ্রাম নিন, তারপরে আমরা মুসৌরি যাব, সেখানে খুব হৈ হৈ হবে।”

টাকাকড়ির ব্যাপারে প্রচণ্ড সাবধানী এবং প্রচণ্ড উদাসী, এই হচ্ছে বিবেকানন্দশিষ্যদের স্বভাব। অনেকে ভাবত কল্যাণমহারাজ ভীষণ কৃপণ, না হলে তিনি কেন রোগীদের বিছানার চাদর এবং বালিশের খোল নিজের হাতে সেলাই করতেন? কী অসীম ধৈর্যের সঙ্গে তিনি এই সেলাই করতেন, কোথাও সামান্য একটু খুঁত খুঁজে পাওয়া যেত না তার সেলাইকর্মে।

মহারাজ প্রচণ্ডভাবে নীতিনির্ভর ছিলেন, যা করবেন ঠিক করেছেন তা তিনি করবেনই। শোনা যায় বরিশালের মানুষরা এমন একটু গোঁয়ার হয়। অন্ধ্রের ছেলে সর্বগতানন্দ একদিন কথাবার্তার মধ্যে জিজ্ঞেস করে বসলেন, মহারাজ আপনি কি বাই এনি চান্স’বরিশালের লোক? তিনি উত্তর দেননি, কিন্তু তরুণ সহকারী পরে অন্য সূত্রে খবরটির সমর্থন পেয়েছেন। মহারাজ কিন্তু ভোলেননি যে সর্বগতানন্দ তাকে এই প্রশ্নটা করেছিলেন।

অর্থ সম্পর্কে স্বামী কল্যাণানন্দের মানসিকতা অনেকটা গল্পের মতন। সর্বগতানন্দ যখন হিসেবপত্তর রাখা শুরু করেছেন তখন এক ভদ্রলোক সেবাশ্রমকে প্রতি মাসে এক টাকা ডোনেশন দেবেন বলে কথা দেন। কয়েকমাস তিনি টাকাটা পাঠাচ্ছেন না।

টাকা আদায়ের কথা ভেবে তরুণ হিসেব রক্ষক একদিন কল্যাণানন্দকে জিজ্ঞেস করলেন, “মহারাজ, লোকটিকে প্রায়ই বাজারে দেখতে পাই, ওঁকে কি টাকার কথাটা মনে করিয়ে দেব?”

“তাই নাকি! যখন তুমি এখানে এলে তখন অখণ্ডানন্দজী কি তোমাকে টাকা তুলতে বলেছিলেন?”

সর্বৰ্গতানন্দ বললেন, “না।”

“আমি কি তোমাকে কিছু বলেছিলাম?”

“না, মহারাজ।”

“তা হলে তুমি কেন ব্যস্ত হয়ে উঠছ? যা আসছে ঠাকুরের আশীর্বাদে তাতেই চালিয়ে দেওয়া যাবে। আজকে তুমি টাকা তুলতে চাও, তহবিল বাড়াতে চাও, নতুন নতুন ঘরবাড়ি করতে চাও। এর ফল কি হবে? মনটা ওসবেই পড়ে থাকবে, অধ্যাত্মজীবনটা উবে যাবে। ওই জীবনের পিছনে লেগে থাক, যোগ্যজীবন যাপন কর; ওটারই বেশি প্রয়োজন। টাকাকড়ি বাড়িঘর দোর এসব নিয়ে চিন্তা কম কর। লোকের যদি ইচ্ছে হয় দান করুক, যদি না করে তা হলেও কিছু এসে যাবে না।”

কল্যাণানন্দবলনে,”কাজটা ভালো করে কাটাই জরুরি। শ্রীরামকৃষ্ণের দয়ায় যতটুকু আসছে সেইটাই আমরা যেন ভালো করে ব্যবহার করি। কত বেশি কাজ হলো তার থেকে কত ভালো কাজ হলোটাই গুরুত্বপূর্ণ। যা হাতের গোড়ায় রয়েছে, তা যত ছোটই হোক তা করে ফেলা যাক। না হলে মনের মধ্যে সব পরিকল্পনা গজাবে, তোমার সারাজীবনটাই নষ্ট হয়ে যাবে। ওসব জিনিস যেমন চলছে তেমন থাকতে দাও।”

আধ্যাত্মিক জীবনে এ এক বিচিত্র আদর্শ। আমরা এখানে টাকা তুলতে এবং একের পর এক বাড়ি তৈরি করতে আসিনি। আমরা এসেছি আদর্শ আধ্যাত্মিক জীবন যাপন করতে। “মাঝে মাঝে এই ধরনের পথ নির্দেশ দরকার, না হলে আমাদের পথ হারিয়ে যাবে,” লিখেছেন স্বামী সর্বগতানন্দ।

আর অর্থ! একবার একজন পাঁচশ টাকা চুরি করল। স্বামী কল্যাণানন্দ শান্তভাবে, কোনোরকম দুশ্চিন্তা না করে বললেন, আমার মনে হয়, টাকাটা ওর দরকার ছিল।

একবার একটা লোক বাগানে কাজের খোঁজে এল। যে-সন্ন্যাসী বাগানের দায়িত্বে ছিলেন, তিনি তাকে দেখেই বললেন, “হতভাগা, তুই অমুক জায়গা থেকে অমুক জিনিস চুরি করে পালিয়েছিলি, আর এখন এসেছিস কাজের খোঁজে! দূর হয়ে যা এখান থেকে।”

এমন সময় স্বামী কল্যাণানন্দ সেখানে হাজির হলেন। তিনি লোকটিকে বললেন, “যাও, তুমি বাগানে ফিরে গিয়ে কাজ করগে যাও।”

“কিন্তু, স্বামীজি আমাকে চলে যেতে বলেছেন।”

কল্যাণানন্দ মহারাজ এবার হেসে ফেললেন। ”স্বামীজি জানেন না যে তুমি অন্যায় করলেও, আমার কাছে অপরাধ স্বীকার করেছ।”

মহারাজ লোকটিকে নিয়ে বাগানে গেলেন এবং ওখানকার স্বামীকে বললেন, “শোনো, এ অন্যায় করেছে বটে, কিন্তু তার জন্যে অনুতাপ হয়েছে।”

কল্যাণ মহারাজ ক্ষমা করলেন বটে, কিন্তু বাগানের স্বামী এই ক্ষমা করাটা তেমন পছন্দ করলেন না। পরে খাবার ঘরে এই স্বামী বললেন, “লোকটা আবার কী করবে কে জানে।”

“হয় দুশ্চিন্তা করে যেতে হয়, না হয় লোকটাকে একটা সুযোগ দিতে হয়।

“আমি জানি না।”

বাগান স্বামীর এই মন্তব্য শুনে নারায়ণ মহারাজ বললেন, “আমিও জানি না, তবে কল্যাণ মহারাজের আদর্শটা আমাদের থেকে ভাল। মহারাজ যখন চাইছে, তখন চোরকেও আর একটা সুযোগ দেওয়া ছাড়া উপায় নেই।”

অদ্ভুত ঘটনা আরও আছে। একটা লোক প্রায়ই কল্যাণ মহারাজের কাছে এসে পয়সা চাইত। কিছু পেলেই সে চলে যেত। অনেকবার ব্যাপারটা ঘটেছে। একদিন মহারাজকে জিজ্ঞেস করা হলো, “লোকটা কে? আপনার কাছে আসে, টাকা নেয়, আর চলে যায়। কোনো কাজও করে না।” মহারাজ প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলেন না।”

লোকটি আর একদিন এল। মহারাজ যে দেহরক্ষা করেছে সে খবর লোকটা পায়নি, সে সোজা মহারাজের সঙ্গে দেখা করতে চাইল।

“কত টাকা তোমার প্রয়োজন?” জিজ্ঞেস করলেন তরুণ সন্ন্যাসী।

“আমি টাকা চাই না, আমি জানতে চাই মহারাজ কোথায়?”

মহারাজ পৃথিবী থেকে চলে গিয়েছেন শুনে লোকটি ভেঙে পড়ল এবং শিশুর মতন কাঁদতে লাগল। তারপর বলল, “আপনারা জানেন না, উনি আমার জন্যে কি করেছেন।”

“কী করেছেন তিনি?”

“সে অনেক ঘটনা। একদিন বাজারে গিয়েছি, আমার কাছে একটা পয়সা ছিল না, আমি একটা দোকান থেকে কিছু জিনিস চুরি করেছিলাম। ওরা ধরে ফেলল, পুলিশ এসে গেল এবং আমাকে বেদম মারতে শুরু করল। মহারাজ এই পথ দিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে যাচ্ছিলেন। উনি গাড়ি থামিয়ে পুলিশকে বললেন, মারা বন্ধ করুন। তারপর জানতে চাইলেন, কী হয়েছে? সবাই বলল, লোকটা এইসব জিনিস চুরি করে পালাচ্ছিল। ‘জিনিসগুলোর কত দাম?’ জিজ্ঞেস করলেন মহারাজ। তারপর তিনি দাম মিটিয়ে দিয়ে আমাকে ডাকলেন। বললেন, ভবিষ্যতে টাকার দরকার হলে আমার কাছে আসবে। চুরি করবে না। তোমাকে দেখে তো ভালো লোক বলে মনে হচ্ছে, তুমি কেন চুরি করবে?’ এরপর থেকে আমি যথাসম্ভব খাটাখাটনি করতাম, যখন খুব আটকে যেতাম তখন মহারাজের কাছে আসতাম, তিনি কিছু দিতেন। বাজারের ওই ঘটনার পরে আমি আর চুরি করিনি। আমার সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করতেন মহারাজ। আমাকে কখনও প্রশ্ন করতেন না, শুধু দিতেন।”

সর্বগতানন্দ লিখেছেন, “লোকটিকে বললাম, আমি আপনাকে কিছু অর্থসাহায্য করব। কিন্তু আশ্চর্য, লোকটি না বলল, কিছুতেই আমার অর্থ নিল না।”

অদ্ভুত সব আগন্তুকদের বর্ণনা পাওয়া যাচ্ছে। কল্যাণানন্দের কাছে একজন বোবা আসত, চুপচাপ বসে থাকত, কিছু খাবার খেত। তারপর চলে যেত। আর একজন উন্মাদ আসত, মাঝে মাঝে ক্ষেপেও যেত। কিন্তু সবাইকে খাওয়াতেন মহারাজ। তবে এই উন্মাদটিকে খাবার দেওয়ার সময়ে সবাইকে সাবধান থাকতে হতো।

একজন সাধুর উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে। এঁর বুকে একটা গুলি ঢুকেছিল, বার করা যায়নি। এঁর প্রবল মাথার যন্ত্রণা হতো, মহারাজের ইচ্ছা অনুযায়ী প্রতিদিন তার মাথায় চন্দন তেল মালিশ করতে হতো। কল্যাণ মহারাজ নিজে এঁদের সবার দেখভাল করতেন।

গুলিবিদ্ধ এই মহারাজের বিস্তারিত বিবরণ অন্যত্র পাওয়া যাচ্ছে। হৃষীকেশের কাছে ঘন অরণ্যে ঢাকা স্বর্গাশ্রমে যোগীরা আসতেন তপস্যার জন্য। রামকৃষ্ণ মিশনের বিশিষ্ট সন্ন্যাসীরা, যেমন স্বামী প্রেমেশানন্দ এখানে তপস্যা করেছেন। একবার এলেন তারকেশ্বরানন্দজী। স্বর্গাশ্রমের ঘন অরণ্যের মধ্যে তিনি একাকী পরিভ্রমণ করছেন, এমনসময় এক শিকারী হরিণ মনে করে তার দিকে গুলি ছুড়লেন। যে লোকটি গুলি ছুঁড়েছিল তাকে তারকেশ্বরানন্দজী চিনতেন, কিন্তু পুলিশের শত অনুরোধও তার নাম বললেন না। অথচ মিথ্যাও বললেন না, তার সোজা সরল উত্তর: “নাম আমি জানি, কিন্তু বলব না।” বুক থেকে গুলি বার করা যায়নি, ওই অবস্থাতেই তাকে কনখল সেবাশ্রমে আনা হলো, তার শরীরে প্রবল যন্ত্রণা, মুখ বুজে সহ্য করতেন সব, কিন্তু কে গুলি করেছিল তা কখনও মুখে আনলেন না।

অর্থের ব্যাপারে বিবেকানন্দ-শিষ্য কল্যাণানন্দের চিন্তাধারার আর একটি কাহিনি আজও বেঁচে আছে। সেবাশ্রমে গভীর যত্নের সঙ্গে তিনি একশ পঁচিশটি আমগাছ লাগিয়েছিলেন। যখন এইসব গাছে ফল ধরতে আরম্ভ করল তখন একজন সন্ন্যাসী বললেন, “কয়েক হাজার আম ফলেছে। এগুলো বিক্রি করে টাকা পাওয়া যেতে পারে।”

কল্যাণানন্দের উত্তর খুবই সোজা। শান্তভাবে তিনি বললেন, “টাকা রোজগারের জন্যে আমি এই গাছগুলি পুঁতিনি। যে যত পার খাও, আর দুটি করে আম প্রত্যেক সাধু যখন ভিক্ষা করতে আসবেন তাদের দাও।” তিনি চাইতেন মানুষ এই ফল খেয়ে আনন্দ পাক।

কল্যাণানন্দ প্রত্যেক বছর স্থানীয় সাধুদের নিমন্ত্রণ করতেন আমের উৎসবে, সেই সঙ্গে পায়েস। শেষপর্যন্ত এমন হয়ে গিয়েছিল যে প্রত্যেক বছর আমের সময় সাধুরা খোঁজ নিতেন কবে মহারাজের নেমন্তন্ন আসবে।

মানুষকে আনন্দ দাও, যারা ভুল করেছে দোষত্রুটি মুক্ত করে তাদের নতুনভাবে গড়ে নাও, গুরুর অনুপ্রেরণায় এই ছিল কল্যাণানন্দের সাধ। সেবার সঙ্ঘের জেনারেল সেক্রেটারি স্বামী মাধবানন্দ কনখলে এসেছে, (পরে তিনি সঙ্ঘসভাপতি হয়েছিলেন) মাধবানন্দ সেবাশ্রমে এক ব্রহ্মচারীকে দেখে কল্যাণানন্দকে বললেন, “এই ছেলেটিকে চেনেন?”

“হ্যাঁ, জানি,” মহারাজের সংক্ষিপ্ত উত্তর।

মাধবানন্দজি খবরাখবর রাখতেন। মঠ মিশনের জেনারেল সেক্রেটারি হিসেবে তিনি বললেন, “তিনটে সেন্টার থেকে ওকে তাড়িয়ে দিয়েছে। কোনো কম্মের নয়। ওকে এখানে রাখবেন না।”

কল্যাণানন্দ মোটেই বিচলিত না হয়ে বললেন, “ছেলেটি আমাকে সব কথা বলেছে। সব অন্যায় স্বীকার করতে করতে সে কেঁদে ফেলেছে এবং আমাকে কথা দিয়েছে, এখানে আমি ভালো হবার চেষ্টা করব, আপনি যা বলবেন আমি তাই শুনব। আমি খুব সাবধানে থাকব।”

এরপর গলাটা একটু উঁচু করে মঠের ভাবী সভাপতিকে বিবেকানন্দশিষ্য বললেন, “সোনা থেকে সোনা করবার জন্যে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ মর্তধামে আসেননি। তিনি নিম্নস্তরের ধাতুকে সোনা করে দিতে পারতেন। আমরা যদি এই ধরনের ছেলেকে পাল্টে দিতে পারি তা হলে সেটাই আমাদের সেরা কাজ হবে। তুমি কি শুধু ভাল ছেলে চাইছ? তারা তো ভালো হয়ে আছে!”

পরবর্তী সময়ে এই ছেলেটির মধ্যে অবিশ্বাস্য পরিবর্তন এসেছিল। এখানে আসবার আগে ভীষণ মেজাজ ছিল, রাগে অন্ধ হয়ে জিনিসপত্তর একবার নয় তিনবার ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। কিন্তু কনখলে সে সত্যিই নতুনভাবে জীবন আরম্ভ করল।

.

স্বামী কল্যাণানন্দের মর্মস্পর্শী মহাসমাধির বর্ণনা তাঁর অনুগতের চোখ দিয়ে (২০শে অক্টোবর ১৯৩৭) আমরা এই নিবন্ধের শেষ অংশে দেখব। কিন্তু তার আগে আজব স্বামীজির আরও একজন আজব অনুরাগী চারুচন্দ্র দাস (পরে স্বামী শুভানন্দ) এবং তার প্রাণপ্রিয় বারাণসী সেবাশ্রমের কিছু কথা বলে নেওয়া যেতে পারে।

অন্য অনেক তথ্যসূত্রের সঙ্গে এই পর্বের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় স্বামী নরোত্তমানন্দের ‘সেবা’ বইতে। বইটির বাংলা অনুবাদ হাতের গোড়ায় ছিল না, ফলে নির্ভর করেছি ইংরিজিতে প্রকাশিত একই নামের বইয়ের ওপরে।

প্রাক সন্ন্যাসজীবনে বিবেকানন্দশিষ্য স্বামী শুদ্ধানন্দ একবার কলকাতায় চারুচন্দ্রের পাঁচু খানসামা লেনের বাড়িতে এসেছিলেন,সঙ্গী ছিলেন জনৈক ক্ষিরোদবাবু। বারাণসীতে আবার দেখা হয়ে গেল শুদ্ধানন্দর সঙ্গে–এইখানে শুদ্ধানন্দ অসুস্থ হয়ে পড়ায় কিছুদিন সেবাযত্নের সুযোগ পেয়ে যান চারুচন্দ্র। শুদ্ধানন্দ তাকে সদ্যপ্রকাশিত উদ্বোধন পত্রিকার কথা বলেন এবং এই পত্রিকার প্রচারের অনুরোধ জানান। এই প্রচারে বেরিয়েই হরিনাথ ও কেদারনাথ মৌলিক (পরে স্বামী অচলানন্দের) সঙ্গে চারুচন্দ্রের জানাশোনা হয়। একসময়ে স্বামী কল্যাণানন্দ বারাণসীতে এসে কেদারনাথের অতিথি হন। এঁদের আলোচনার প্রধান বিষয় স্বামী বিবেকানন্দ, জ্ঞান, ভক্তি ও কর্মের সমন্বয়ের যে সাধনা রামকৃষ্ণ সঙ্ঘে শুরু হয়েছে তা এঁদের বিশেষভাবে আকৃষ্ট করল।

কেদারনাথ মৌলিক এই সময় সংসার ত্যাগ করতে ব্যাকুল। চারুচন্দ্র দাস পরামর্শ দিলেন ঠাকুরের শিষ্য নিরঞ্জনানন্দ এখন হরিদ্বারে রয়েছে, ওখানে যাও। কেদারনাথ বললেন দাদু এবং বাবা বুঝতে পারলে আমাকে ছাড়বেন না। তখন মতলব হলো, কেদারনাথ কতকগুলো পোস্টকার্ড লিখে দিয়ে যাবেন, সেগুলো মাঝে মাঝে কলকাতা থেকে ডাকে দেওয়া হবে, যাতে মনে হয় কাজকর্মের সন্ধানে কেদারনাথ কলকাতায় রয়েছেন।

বিবেকানন্দ-অনুরাগী যে কয়েকজন বন্ধু মিলে বারাণসীতে সেবা কার্য আরম্ভ করেছিলেন তাদের একজনের নাম যামিনীরঞ্জন মজুমদার। উদ্বোধন পত্রিকায় স্বামীজির কবিতা সখার প্রতি পড়েই তারা উদ্বুদ্ধ।

যামিনীরঞ্জন প্রত্যুষে বাঙালীটোলার মধ্য দিয়ে গঙ্গাস্নানে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ চমকে শুনলেন–কার যেন অস্ফুট কাতরধ্বনি! অন্য সময় হলে হয়ত পুণ্যার্থীদের ধর্মধ্বনি ঐ কাতর শব্দটুকুকে আচ্ছন্ন রাখত–কিন্তু গত রাত্রে যে যামিনীরঞ্জন নবধর্মমন্ত্র লাভ করেছেন! সুতরাং তিনি চোখ চেয়ে দেখলেন–পথের পাশে আবর্জনার মধ্যে পড়ে রয়েছে মুমূর্ষ এক বৃদ্ধা, মলমূত্রে সর্বাঙ্গ পূর্ণ।

স্বামীজির কবিতা পাঠ করে উদ্বুদ্ধ যামিনীরঞ্জন বৃদ্ধার গা পরিষ্কার করে, নিজের উত্তরীয় দিয়ে তাঁকে ঢেকে, পথের ধারে কোলে তুলে নিয়ে বসলেন, এবং তার মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে ভাবতে লাগলেন–এখনি যদি এঁকে আশ্রয়, ঔষধ ও পথ্য দেওয়া না যায় তাহলে মৃত্যু সুনিশ্চিত। কিন্তু যামিনীরঞ্জন নিজে ভিক্ষাজীবী, এখন কপর্দকশূন্য, কী করবেন?

অগত্যা বৃদ্ধাকে এক বাড়ির রকে শুইয়ে ভিক্ষার সন্ধানে বেরুলেন। এক সহৃদয় ব্যক্তির অনুগ্রহে চার আনা পয়সা পেলেন তা দিয়ে দুধ কিনে এনে বৃদ্ধাকে খাওয়ালেন, তারপর বৃদ্ধা কিছু সুস্থবোধ করলে পুঁটিয়ারাণীর ছত্রে গেলেন বৃদ্ধার জন্য অন্নভিক্ষা করতে। এই ছত্রের অন্নেই যামিনীরঞ্জনের উদরপূর্তি হত–সেই বরাদ্দ অন্নই তিনি চাইলেন, নিয়ে যাবেন বলে। ছত্রের নিয়ম সেখানে বসে খেতে হবে। বহু বাক্যব্যয়ের পরে যামিনীরঞ্জন বরাদ্দ অন্ন আদায় করে এনে বৃদ্ধাকে খাওয়ালেন, তাতে কিছু সুস্থ হয়ে বৃদ্ধা যে কাহিনি বললেন তা অতি ভয়াবহ, মানবিক নিষ্ঠুরতার চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত।

বৃদ্ধা মাসাধিকাল আগে যশোহরের পল্লী-অঞ্চল থেকে কাশীবাস করতে এসেছেন ১০৮ টাকা সম্বল করে। এক ব্রাহ্মণের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তারপর কঠিন রক্ত-আমাশয়ে পড়েন। বিনা চিকিৎসা ও বিনা পথ্যে যখন তাঁর মরণাপন্ন অবস্থা তখন ব্রাহ্মণ তাঁকে গঙ্গাতীরে ফেলে আসে। বৃদ্ধার জ্ঞান ছিল কিন্তু কথা বলার শক্তি ছিল না। ব্রাহ্মণটি প্রথমত, বৃদ্ধার অবশিষ্ট টাকাগুলি আত্মসাতের মতলবে ছিল। দ্বিতীয়ত, বুড়ি মরলে হয়ত পুলিশী হাঙ্গামা হতে পারে–তার হাঙ্গামাতে সে পড়তে চায়নি। বৃদ্ধা চারদিন গঙ্গাতীরে পড়েছিলেন, কেউ তাকে সাহায্য করেনি, বা ক্ষতিও করেনি। তারপরে নিরুপায়ে তিনি নিজেই কোনোক্রমে পথের মাটি-পাথর খাচে-খাচে হামাগুড়ি দিয়ে পূর্বোক্ত স্থানে এসে মূৰ্ছিত হয়ে পড়েছিলেন। জ্ঞান ফিরলে যেটুকু গোঙাতে পেরেছিলেন, তারই শব্দ যামিনীরঞ্জনকে আকৃষ্ট করেছিল।

পরের ইতিহাস সংক্ষেপে এইরকম : যামিনীরঞ্জন ছুটলেন চারুচন্দ্রের কাছে; দু’বন্ধু গেলেন হরিদ্বার থেকে সদ্য-প্রত্যাগত কেদারনাথের কাছে। এঁরা ও অন্য বন্ধুরা মিলে বৃদ্ধার শুশ্রূষার ও আশ্রয়ের সাময়িক ব্যবস্থা করলেন। পরে চাঁদা তুলে বৃদ্ধাকে ভেলুপুর হাসপাতালে রাখলেন। এই বৃদ্ধার নামই নৃত্যকালী দাসী।

আর থামা সম্ভব ছিল না। এই বন্ধুগোষ্ঠী “বারাণসী-দরিদ্র-দুঃখ প্রতিকার-সমিতি” গঠন করে ফেললেন। সমিতির জুলাই ১৯০১ থেকে জুন ১৯০২ সময়ের রিপোর্ট সমাজতাত্ত্বিকদের জ্ঞাতব্য বহু বিষয় আছে। এই রিপোর্ট স্পষ্ট দেখিয়ে দেয়, কোন্ সামাজিক ভেদবুদ্ধির মধ্যে বিবেকানন্দের ভাবানুপ্রাণিত যুবকেরা সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে সেবা করে গিয়েছিলেন।

রিপোর্টে সমিতির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’এইরকম:”পরম পবিত্র অবিমুক্ত বারাণসীক্ষেত্র হিন্দুমাত্রেরই সর্বপ্রধান তীর্থ বলিয়া শাস্ত্রে বর্ণিত আছে। এ কারণে সমগ্র ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশ হইতে সমাগত মুমুক্ষু সাধু সন্ন্যাসী, ব্রহ্মচারী, গৃহস্থ প্রভৃতি নানাবিধ নরনারী, যাঁহাদের অন্নবস্ত্রের কোনোরূপ সংস্থান নাই তাহারাও অন্নপূর্ণা বিশ্বনাথের উপর নির্ভর করতঃ কাশীবাস করিয়া অক্ষয় পুণ্য অর্জন করিতেছেন।

“এই অসহায়, ভরণপোষণ সংস্থানহীন ব্যক্তিগণের এবং গ্রাসাচ্ছাদন বিষয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন ধর্মনিরত সাধু-সন্ন্যাসিগণের সাহায্যার্থে অনেক মহোদয় অন্নসত্রাদি স্থাপন করিয়াছেন। কিন্তু সেইসকল অন্নসত্রাদির অন্নদান কেবল ব্রাহ্মণবর্ণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকায় এবং ব্রাহ্মণবর্ণেরও যাঁহারা স্বয়ং দানস্থলে উপস্থিত হইয়া দানগ্রহণে সমর্থ হইবেন তাহারা প্রাপ্ত হইবেন, উপস্থিত হইতে অসমর্থ ব্যক্তিবর্গ পাইবেন না, ইত্যাদি অনুদার নিয়ম থাকায় প্রকৃত অভাবগ্রস্ত দুর্বল অসমর্থ ব্যক্তিগণের অতিশয় কষ্ট হয়। বিশেষতঃ এইসকল ব্যক্তি পীড়িত হইলে ঔষধ-পত্রাদি ও সেবাশুশ্রূষাভাবে কেহ বা অসময়ে কালকবলে পতিত হন, আর অনেকেই সম্পূর্ণ আশ্রয়শূন্য অবস্থায় রাস্তায় ও গঙ্গাতীরে পতিত হইয়া মানবলীলা সংবরণ করেন।

“এই অবিমুক্ত বারাণসী বৈদিক ধর্মের কেন্দ্রস্থল। এই স্থানেই ভগবান্ শঙ্করাচার্য জীব ব্রহ্মের অভেদত্ব সর্বপ্রথমে ঘোষণা করিয়াছিলেন। আর আজ এই স্থলে লক্ষ-লক্ষ নরনারী প্রত্যহ অন্নপূর্ণা বিশ্বনাথের অর্চনা করিয়াও বিশ্বনাথের সাক্ষাৎ মূর্তিস্বরূপ জীবগণ যে অনাথা-অন্যরা, অন্ধ, পঙ্গু, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা রূপ ধারণপূর্বক রাস্তায় পতিত আছে, ইহা বুঝিতেছেন না। কেহই তাহাদের সেবা করিতেছেন না।

“এই সকল অবস্থা দেখিয়া, রাস্তায় নিপতিত ব্যক্তিগণের ক্লেশ দূরীকরণপূর্বক তাহাদের সেবাদ্বারা মানবজীবনের সার্থকতা সম্পাদন করিতে কৃতসংকল্প হইয়া রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীমৎ বিবেকানন্দ স্বামীর কয়েকজন ব্রহ্মচারী-শিষ্য সেবাকার্য আরম্ভ করিয়া এই ‘দরিদ্র দুঃখ-প্রতিকার সমিতি’ গঠন করেন। পরে ১৯০০ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর তারিখে স্থানীয় বাঙালীটোলা স্কুলভবনে এক সাধারণ সভার অধিবেশন হয়। সমিতির কার্যাদি উত্তরোত্তর বর্ধিত করিয়া সুশৃঙ্খলরূপে সম্পন্ন করিবার জন্য উক্ত সভায় নিম্নলিখিত ব্যক্তিবর্গ কার্যনির্বাহক সমিতির সভ্যরূপে নির্বাচিত হন।”

‘আশ্রমের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে রিপোর্টে বলা হয় :

“যাঁহারা অসহায় পীড়িত অবস্থায় রাস্তায় পতিত থাকেন, সমিতি তাঁহাদিগকে রাস্তা হইতে উঠাইয়া আশ্রমবাটীতে আনিয়া সেবাশুশ্রূষা করেন ও ঔষধপথ্যাদি দান করেন।

“ঐ রাস্তায় পতিত ব্যক্তিদিগের মধ্যে যাঁহারা হাসপাতালে যাইতে ইচ্ছুক এবং হাসপাতালের কর্তৃপক্ষগণ যাঁহাদিগকে রাখেন, সমিতি তাহাদিগকে হাসপাতালে রাখিয়া আশ্রমবাটী হইতে পথ্যাদি পৌঁছিয়া দেন ও সেবা করেন এবং আবশ্যক হইলে হাসপাতালেও খোরাকী জমা দিয়া থাকেন।

“যাঁহারা অন্ধ বা অথর্ব বা বৃদ্ধ বলিয়া ভিক্ষাদি করিতে অসমর্থ, সমিতি তাহাদের বাসস্থলে যাইয়া আবশ্যকীয় অন্ন-বস্ত্র, বাসাভাড়া ইত্যাদি দিয়া থাকেন।

“যাঁহারা কায়িক পরিশ্রমে বা আত্মীয়স্বজনের সামান্য সাহায্যে কোনোরূপে কায়ক্লেশে গ্রাসাচ্ছাদন সম্পন্ন করেন, তাহারা পীড়িত হইলে চিকিৎসিত হইবার উপায় থাকে না বা সেবাশুশ্রূষা করিবারও কেহ থাকে না। সমিতি এইসকল ব্যক্তিগণের বাটীতে ডাক্তার কবিরাজ লইয়া গিয়া ঔষধ-পত্রাদির ব্যবস্থা করেন এবং সমিতির সেবকগণ বাটীতে যাইয়া সেবা করেন।

“যে-সকল ভদ্রবংশীয় ব্যক্তি অদৃষ্টবশে অতি নিঃস্ব হইয়া প্রাণত্যাগে প্রস্তুত কিন্তু সাধারণ দান-স্থলে উপস্থিত হইবেন না বা ভিক্ষাপ্রার্থনা করেন না, সমিতি বিশেষরূপে তাহাদের অবস্থা অবগত হইয়া তাঁহাদিগকে সাধ্যানুযায়ী সাহায্য করিয়া থাকেন।

“অভাবগ্রস্ত ব্যক্তি যে-কোনো জাতি হউন বা যে-কোনো ধর্মাবলম্বী হউন, তিনি স্ত্রীই হউন বা পুরুষই হউন, সমিতি তাহাদের সেবা করেন।”

রিপোর্ট থেকে আরও জানা যায়, ৮ জন সেবক বা কর্মী কাজ চালাচ্ছেন। “সেবকগণ সমিতি বাটীস্থ রোগীদের সেবাশুশ্রষা, এমনকি মলমূত্রাদি পর্যন্ত স্বহস্তে পরিষ্কার করিয়া থাকেন। সমিতির প্রথম অবস্থায় সাত মাস কাল পর্যন্ত সেবকগণ মেথরের সাহায্য না লইয়া কার্যনির্বাহ করেন। পরে আর্থার রিচার্ডসন সাহেব-মহোদয় দয়াপ্রকাশ করিয়া জনৈক মেথর নিযুক্ত করিয়া দিয়া সমিতিকে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করিয়াছেন।”

ঐকালে সেবাপ্রাপ্ত কয়েকজন রোগীর বিবরণ আমরা উপস্থিত করছি, কাশীর দুঃস্থ মানুষদের অবস্থা কোন পর্যায়ে পৌঁছেছিল তা স্মরণ করিয়ে দেবার জন্য :

“পঞ্চানন হাজরা নামক ৩৫ বৎসর বয়স্ক জনৈক ব্রাহ্মণসন্তান গলিতকুষ্ঠ রোগগ্রস্ত হইয়া রোগযন্ত্রণা ও দরিদ্রতা-নিবন্ধন স্বদেশ বাঁকুড়া জেলা হইতে বারাণসীতে আসিয়া ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ সংক্রামক রোগগ্রস্ত বলিয়া ভিক্ষা দেওয়া দূরে থাকুক, কেহ তাহাকে জলবিন্দু পর্যন্ত দান করেন নাই। তিনি চারদিন অনশনে নারদঘাটে পড়িয়া থাকেন। তাঁহার আর্তনাদে জনৈক ভদ্রলোক করুণার্দ্র হইয়া সমিতির সেবকদিগকে সংবাদ দেন। সেবক-সভ্যরা ভেলুপুরের অ্যাসিট্যান্ট সার্জন ডাক্তার মন্মথনাথ বসু মহোদয়কে লইয়া নারদঘাটে উপস্থিত হইয়া রোগীর ঔষধাদির ব্যবস্থা করিয়া দেন, এবং দুইবেলা সমিতি হইতে অন্নপথ্যাদি প্রস্তুত করিয়া তাহার সেবা করাইয়া আসিতেন। দুর্ভাগ্যক্রমে উক্ত রোগীর কলেরা হয়। তখন যে কী শোচনীয় অবস্থা হইয়াছিল, তাহা সকলেই অনায়াসে বুঝিতে পারেন। এই অবস্থায়ও জনৈক সেবক তাঁহার সেবা ত্যাগ করেন নাই। উক্ত কলেরা হইতে আরোগ্যলাভ হইবার পরও তাঁহাকে অন্নাদি দেওয়া হইত।”

সরয়ু তেওয়ারী নামে ১৪ বছরের একটি বালকের বাবা-মা থাকা সত্ত্বেও তাদের এমন দারিদ্র্য যে সরযূ দারুণ জ্বরে আক্রান্ত হয়ে অন্ধকূপের মতো একটা জায়গায় পড়েছিল–চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা হয়নি। রাজলক্ষ্মী দেবী নিঃস্ব মহিলা, ডবল নিউমোনিয়া হলেও বিনা চিকিৎসায় পড়েছিলেন। গিরিবালা দেবী ‘আমরক্ত, প্রদর প্রভৃতি জটিল রোগগ্রস্ত হওয়ায় বাড়িওয়ালা তাকে রাস্তায় বের করে দেন। আশি বছরের বৃদ্ধা মুন্না বাঈ ‘অতি সম্ভ্রান্ত ধনী মহারাষ্ট্র-পরিবারের মানুষ, ‘অদৃষ্টচক্রে পথের ভিখারিণী। বাঁকুড়ার গোপীনাথ দত্ত পক্ষাঘাতগ্রস্ত, কাশীতে নিরুপায়ে কোনোক্রমে এসেছেন ভিক্ষাদ্বারা জীবনধারণ করবেন এই ইচ্ছায়, কিন্তু শূদ্র বলে সত্রে ভিক্ষা মেলেনি, আত্মহত্যা করতে গঙ্গায় ঝাঁপ দেন, এক সহৃদয় ব্যক্তি তাকে উদ্ধার করেন।

.

১৯০২ ফেব্রুয়ারিতে স্বামীজি যখন কাশী আসেন, তখন স্বভাবতই তার কাছে ভিড় করে এসেছিলেন তাঁরই আদর্শে জাগ্রত যুবকের দল। চারুচন্দ্রসহ তাঁদের অনেককে স্বামীজি দীক্ষা দেন, পূর্ণ মনুষ্যত্বের যথার্থ রূপ সম্বন্ধে তাদের মনে সচেতনতা এনে দেন, এবং—’দরিদ্র-দুঃখ-প্রতিকার-সমিতির’ কাজে বিশেষ সন্তোষ প্রকাশ করেও কর্মীদের আদর্শের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের নামের যে-ভাববিরোধ ঘটছে, তাও দেখিয়ে দেন। তিনি বলেন :

“দরিদ্রের দুঃখ প্রতিকার করবার তুমি কে? সেবাতেই শুধু তোমাদের ।অধিকার।…যখনই কর্মীর মনে কর্তৃত্বাভিমান আসে, অধঃপতনের কারণ সেই মুহূর্তে ঘটে। কর্তৃত্ব ও ভোগস্পৃহা কায়মনোবাক্যে পরিত্যাগ করে, সত্যানুরাগে, শিবোহ হম্‌ বোধে জীবসেবারূপ কর্মের অনুষ্ঠান করো। এইরূপ কৌশলে কর্ম করলে শুধু যে ব্যক্তিগত জীবন ধন্য হয় তাই নয়, সমাজ ও দেশের প্রকৃত কল্যাণ হবে, এবং জীবজগতের সঙ্গে ভগবানের একত্ব অনুভব করে তোমরা কৃতার্থ হয়ে যাবে। তোমরা কর্মের মধ্যে দয়াকে স্থান দিয়েছে কিন্তু কখনো বাক্যে, কার্যে বা মনে মানুষ যেন দয়া করবার স্পর্ধা না রাখে।”

স্বামীজীর নির্দেশে দরিদ্র-দুঃখ-প্রতিকার-সমিতির’ নূতন নাম হল সেবাশ্রম।

সমিতি গঠনের কিছুদিন পরেই একটি ষোলো বছরের টাইফয়েড রোগীর দায়িত্ব ঘাড়ে চাপল, তাকে কোথায় রাখা যায়? প্রথমে একটা ভাড়াকরা ঘরের সন্ধান পাওয়া গেল, কিন্তু সেটায় নানা অসুবিধা থাকায় শেষপর্যন্ত কেদারনাথের বাড়িতে তাকে আনা হলো। বন্ধুদের দিবারাত্র সেবায় এবং স্থানীয় বিশিষ্ট চিকিৎসকদের দয়ায় গিরীন্দ্রনাথ সুস্থ হয়ে নিজের দেশ ফরিদপুরে ফিরে গেলেন। ইনিই কাশী সেবাশ্রমের প্রথম ইনডোর রোগী!

পরে মাসিক পাঁচটাকা ভাড়ায় জঙ্গমবাড়ীতে একটা ছোট্ট বাড়ি পাওয়া গেল। এইসময়কার তিনজন সারাসময়ের কর্মী কেদারনাথ, যামিনীরঞ্জন ও চারুচন্দ্র।

সেবাকার্যের নাম ক্রমশই ছড়িয়ে পড়ছে। সেবাব্রতী যুবকগণ কেমন করে তার ভাব গ্রহণ করে আশ্চর্য সব কাজ করছেন, নানা সূত্র থেকে এ সংবাদ স্বামী বিবেকানন্দের কানে পৌঁছয়। এবিষয়ে স্বামীজির পদপ্রান্তে গ্রন্থ (স্বামী অজজানন্দ) থেকে কিছু উদ্ধৃতি অপ্রাসঙ্গিক হবে না।

“স্বামীজী তখন বেলুড় মঠে অবস্থান করিতেছেন। কাশীর সেবাব্রতী যুবকগণ তাঁহার ভাব গ্রহণ করিয়া কেমন আশ্চর্য সব কার্য সেখানে করিতেছেন, এ-সংবাদ নানা সূত্রে তাহার কর্ণগোচর হইয়াছিল। কাশী হইতে কেহ মঠে গেলে, তিনি খুব আগ্রহ সহকারে এই নবীন অনুরাগীদের খোঁজখবর লইতেন, তাহাদের কার্যেরও প্রশংসা করিতেন। এই তরুণদলের অন্যতম যামিনী মজুমদার একদা স্বামীজীকে দর্শন করিতে মঠে গিয়াছিলেন। যামিনীর সহিত কথা বলিয়া, তাঁহার আদর্শানুরাগ দেখিয়া তিনি অত্যন্ত প্রসন্ন হইয়াছিলেন এবং কৃপা করিয়া তাহাকে মন্ত্র দীক্ষাদানও করিয়াছিলেন। যামিনীর মুখে স্বামীজী কাশীর অনাথাশ্রম ও কর্মী ছেলেদের সম্পর্কে সবিশেষ সব শুনিয়া খুব আশীর্বাদ করিয়া বলিয়াছিলেন, “এমন আশ্ৰম ভারতের প্রত্যেক তীর্থস্থানে হওয়া উচিত।”

স্বামীজীর কৃপাদৃষ্টি এই যুবকদের উপর এতখানি বর্ষিত হয়েছিল যে, মঠ থেকে একবার নির্মলানন্দকে প্রেরণ করে কাশীর অনাথাশ্রম সম্পর্কে তিনি বিস্তারিত সব সংবাদ নিয়েছিলেন। আর একবার তিনি মন্তব্য করেছিলেন, “ছোঁড়ারা কেউ কিছু করলে না। যাই হোক, তবু কাশীর ছেলেরা আমার spirit-এ কিছু কাজ করছে।” কাশীতে যুবকগণ এতদিন “যাঁকে শুধু কল্পনার বিগ্রহ করে রেখেছিলেন, এখন যেন তার সাক্ষাৎ সংস্পর্শ তাহাদের সকলের হৃদয়কে আলোড়িত করে তুলল। “যাঁরে না দেখে নাম শুনেই কানে, মন গিয়ে তাঁর লিপ্ত হল।” না-দেখা সেই আশ্চর্য বৈদ্যুতিক আকর্ষণ কেদারনাথকেও এবার বেলুড়ের দিকে নিশ্চিত টানল তিনি অনাথাশ্রম থেকে দু’সপ্তাহের অবকাশ নিয়ে বেলুড়ে চলে এলেন। তখন ১৯০১ খ্রিস্টাব্দ। শারদীয়া মহাপূজার ষষ্ঠীর দিন কেদারনাথ মঠে এসে পৌঁছলেন।

কেদারনাথ মঠে এলে, স্বামী ব্রহ্মানন্দজী তাকে সঙ্গে নিয়ে স্বামীজির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। মঠবাড়ীর দোতলায় স্বামীজি নিজের ঘরেই তখন ছিলেন– কেদারনাথ তাঁর চরণপ্রান্তে উপস্থিত হয়ে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করলেন। মুণ্ডিতশির, কেবলমাত্র কৌপীনধারী, অনন্যভূষণ, জ্যোতির্ময় সদাশিবের মতো স্বামীজির সেদিনের দিব্যমূর্তি কেদারনাথের মানসপটে নিত্যকালের জন্য অঙ্কিত হয়েছিল।

কেদারনাথ পরম আনন্দে স্বামীজির পবিত্র সান্নিধ্যে মঠবাস করতে লাগলেন। স্বামীজিও তার ত্যাগ-বৈরাগ্য ও সাধননিষ্ঠা দেখে তাকে একটু বিশেষ স্নেহই দেখিয়েছিলেন। আদর করে তাকে তিনি ‘কেদার বাবা বলে ডাকতেন। কাশী থেকে মাত্র দুই সপ্তাহের কথা বলে কেদারবাবা মঠে এসেছিলেন, কিন্তু স্বামীজির ভালবাসার টানে দুই সপ্তাহ কবে উত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছে কিছুই ঠিকঠিকানা ছিল না–স্বামীজিও অনুরক্ত ভাবী শিষ্যকে নিজের কাছে আরও কিছুদিন থেকে যেতে আদেশ করেছিলেন। কেদারবাবার এই যাত্রায় প্রায় নয় মাস মঠবাসী হয়েছিলেন। স্বামীজির ব্যক্তিগত সেবাধিকারলাভও তার এই কালের স্মরণীয় ঘটনা। পরবর্তী জীবনে অতীতের এই দিনগুলি স্মরণ করে কেদারবাবা রোমাঞ্চিত হতেন। স্বামীজির কথা বলতে বলতে তাকে আত্মহারা হতে দেখা যেত। তার স্বামীজির স্মৃতি-প্রসঙ্গ থেকে কিছু উদ্ধৃতি :

“পূজ্যপাদ স্বামীজি মহারাজের আমাদের প্রতি যে কী গভীর ভালবাসা ছিল–তাহা ভাষায় বর্ণনা করিবার নয়।”

মঠে থাকাকালে কেদারবাবা একবার সামান্য অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। স্বামীজির কাছে তাই দুই চার দিন আসতে পারেন নি। কিন্তু তার প্রতি স্বামীজির কী অহেতুক স্নেহ ছিল! অন্য সেবকের হাত দিয়ে কেদারবাবার জন্য বেদানা বা কোন ফল পথ্য নিজেই পাঠিয়ে দিতেন। হয়তো আহার করছিলেন, এমন সময়ে মনে পড়ে গিয়েছে, অমনিই সেই খাবার কোন সেবকের হাতে পাঠিয়ে, কেদারবাবাকে দিয়ে আসতে বললেন। স্বামীজির এই শিষ্যবৎসলতার কথা স্মরণ করে কেদারবাবা পরে একদা বলেছিলেন, “একবার কানাই মহারাজ (নির্ভয়ানন্দ) তার সেবা করতে করতে তার বুকে মাথা রাখে ঘুমিয়ে পড়েন। পাছে তাঁর নিদ্রাভঙ্গ হয় এই ভয়ে স্বামীজি অনেকক্ষণ পর্যন্ত একভাবে শান্ত হয়ে শুয়ে থাকেন। পরে কানাই মহারাজ আপনা থেকে নিদ্রোথিত হলে, তবে তিনি উঠলেন।”

স্বামীজি একদিন কেদারবাবাকে বলেছিলেন, “বাবা তুই আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারিস? তুই যা চাস্, তোকে আমি তাই দেব।”

স্বামীজি ছিলেন অহেতুক কৃপাসিন্ধু। একদিন মঠবাড়ির একতলার বারান্দায় তিনি বেঞ্চের উপর বসে আছেন কাছেই স্বামী শিবানন্দজিও ছিলেন। কেদারবাবা সামনে যেতেই, স্বামীজি সহসা বলে উঠলেন, “যা তোর কিছুই করতে হবে না। তোর সব আপনি আপনি হয়ে যাবে।”

কেদারবাবা তার মঠবাসের স্মৃতিকথা-প্রসঙ্গে একবার বলেছিলেন– “আমি স্বামীজির খুব কাছাকাছি থাকতুম–কিন্তু কিছু জিজ্ঞাসা করতুম না। কতলোক সব আসছেন–নিবেদিতা, ওলি বুল, ওকাকুরা প্রভৃতি কত সব কথা হচ্ছে। আমি মুখ লোক, অত বুঝতুম না। স্বামীজি যখন তাঁর গুরুভাইদের নিয়ে ফষ্টিনষ্টি বা কখনও বকাবকি করছেন, আমি তখন হাতের কাজ সেরে রাখতুম। হয়তো বা তিনি দুই-একবার নিজেই বলতেন, ‘কেদার বাবা, তামাক নিয়ে আয়’, নয়তো সবই তার ইঙ্গিতে বুঝে নিতুম। আহা, মাকে দেখলুম, আবার স্বামীজিকেও দেখলুম! সবাই যাকে পৌঁছে না, তারা তাকেই বেশি ভালবাসেন। তার খবরই বেশি নিতেন, যত্ন নিতেন। দেখ, আমার কি গুণ আছে? আমার দ্বারা তাদের কোন কাজই হবার নয়। অথচ তাদের এত অহৈতুকী স্নেহ-ভালবাসা কেন জানি না! আমাদের মধ্যে কী যে দেখেছেন তারা তাও বুঝি না।…স্বামীজির প্রতি এমনই একটি আকর্ষণ অনুভব করি যে সে এক অদ্ভুত ব্যাপার। তার এতটুকু সেবা করবার জন্য মন তখন উদগ্রীব হয়ে থাকত। সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নামা লাফিয়ে লাফিয়ে করতুম।…একদিন বাবু আমাকে খুব উৎসাহিত করছেন তার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর-তীর্থে যাবার জন্য। আমি তো মহারাজকে না বলে কিছুই করি না। তাকে জিজ্ঞাসা করাতে, তিনি বললেন, ‘আরে বলছ কি! স্বামীজি রয়েছেন মঠে। তাকে ছেড়ে কোথায় যাবে? দক্ষিণেশ্বর চিরকালই থাকবে–ওসব পরে ঢের হবে, এখন থাক। সত্যিই মহারাজ আমার চঞ্চল মতিকে স্থির রেখে আজ আমায় স্বামীজির কৃপালাভে ধন্য করেছেন। তানা হলে সন্ন্যাসও হত না, আর কোথায় গিয়ে কোন ভাগাড়ে পচে মরতুম কে জানে! তখন সকাল থেকে রাত দশটা অবধি স্বামীজির কাছেই থাকতুম। দিনে বিশ্রাম করতুম না–স্নান করতে, খেতে যা একটু সময় নষ্ট হত।”

কেদারবাবা বলতেন, “ধ্যানধারণা সম্বন্ধে স্বামীজি খুব স্ট্রিক্ট ছিলেন।…প্রত্যেককেই ভোর চার ঘটিকায় উঠে ঠাকুরঘরে এসে ধ্যান করতে হত। তিনি নিজেও এসে বসতেন।..কেউ না আসলে তিনি প্রথম প্রথম বিদ্রূপচ্ছলে বলতেন,–”ওহে সন্ন্যাসিবাবুরা, আর কতক্ষণ নিদ্রা যাবে?

স্বামীজির অগ্নিময় সংস্পর্শে বাস করতে করতে বৈরাগ্যের উত্তপ্ত প্রেরণা কেদারবাবাকে বেশিদিন আর নীরব থাকতে দেয় নাই। স্বামীজিকে একদিন একান্তে পেয়ে, তারই পদপ্রান্তে আশ্রয়ভিক্ষা করে সন্ন্যাসের জন্য তিনি মুখ ফুটে প্রার্থনা জানালেন। স্বামীজি বললেন, “দশবাড়ি ভিক্ষা করে খেতে পারবি?” কোদারবাবা যুক্ত করে উত্তর দিলেন, “আপনার আশীর্বাদ হলেই পারব।” উত্তর শুনে প্রসন্ন হয়ে স্বামীজি বলেছিলেন, “আচ্ছা এখানেই পড়ে থাক–সব ঠিক হয়ে যাবে।”

অবশেষে পরবর্তী বৈশাখ মাসের বুদ্ধপূর্ণিমাতে (মে, ১৯০২) স্বামীজি কেদারবাবার মনস্কাম পূর্ণ করেন। স্বামী বোধানন্দকে স্বামীজি আদেশ করেছিলেন, সন্ন্যাসানুষ্ঠানের আবশ্যকীয় সব ব্যবস্থাদি করতে। নির্দিষ্ট সেই রাত্রে আনন্দে ও উদ্বেগে কেদারবাবার চোখে ঘুম নেই রাত্রি ২-২০ মিনিটেই ভোর হয়ে গেছে মনে করে, নিশ্চয়ানন্দ স্বামীকে ঘণ্টা বাজাতে বলেছিলেন। নিশ্চয়ানন্দও তাঁর কথায় ঘণ্টা দিলে, বোধানন্দ উঠে ঠাকুরঘরের দিকে যাচ্ছিলেন। এমন সময় স্বামীজি খোঁজ নিলেন, “এত রাত্রে ঠাকুরঘরে কে যায় রে?” বোধানন্দ যখন ঘণ্টার কথা বললেন, তখন স্বামীজি সস্নেহে বলেছিলেন, “ছোঁড়াটা খুব নার্ভাস হয়ে পড়েছে।”

কিছুক্ষণ পরে স্বামীজি স্বয়ং ঠাকুরঘরে গিয়ে যথানির্দিষ্ট আসনে উপবেশন করে কেদারবাবাকে সন্ন্যাসদীক্ষা প্রদান করলেন। শিষ্য বিরজা হোমাগ্নিতে পূর্ণাহুতি দেবার পরে, ব্রহ্মবিদ আচার্য তাঁকে ‘বহুজনহিতায় বহুজনসুখায়’ শ্রীরামকৃষ্ণ-চরণে অর্পণ করলেন। অচলা ভক্তি বিশ্বাসের আশীর্বাদ প্রদান করে শ্রীগুরু তার নাম দিলেন অচলানন্দ। অচলানন্দ সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করে উঠতেই, স্বামীজি বললেন, “আজ হতে তোর সমস্ত সাংসারিক কর্ম নাশ হয়ে গেল।” স্বামী অচলানন্দই স্বামীজির শেষ সন্ন্যাসি-শিষ্য– অতঃপর তিনি আর কাকেও সন্ন্যাস-দীক্ষা দেননি।

এরপরেই ১৯০২ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে স্বামীজি সদলবলে বারাণসীতে হাজির হলেন। পরবর্তী বর্ণনার জন্য আমরা স্বামী অজজানন্দর কাছে নির্ভরশীল।

বারাণসীতে স্বামীজি একদিন চারুচন্দ্রকে বলেছিলেন, “সেবাধর্ম সহায়ে সর্বভূতের সহিত ঈশ্বরের ঐক্য সহজে অনুভবগম্য। তোমরা কি তোমাদের কর্মজীবনে দয়াকে উচ্চ স্থান নির্দেশ করেছ। মনে রেখো, দয়া প্রদর্শনের অধিকার তোমাদের নেই। যিনি সর্বভূতের ঈশ্বর তিনিই দয়া প্রদর্শনের অধিকারী।

“যে দয়া করতে চায়, সে নিশ্চয়ই গর্বিত ও অহষ্কৃত। কারণ সে অপরকে নিজের চেয়ে নীচ ও হীন মনে করে। দয়া নয়–সেবা-ই তোমাদের জীবনের নীতি হোক। দেবমূর্তিজ্ঞানে জীবসেবা দ্বারা কর্মকে ধর্মে পরিণত কর। ঈশ্বর ব্যতীত অন্য কেউ জীবের দুঃখ দূর করতে পারে না।

স্বামী শিবানন্দ একদিন চারুচন্দ্রের ও তার দু’একটি বন্ধুর জন্য স্বামীজির কাছে প্রার্থনা জানালেন যাতে তিনি কৃপা করে যুবকগণকে দীক্ষা প্রদান করেন। স্বামীজিও প্রসন্ন হয়ে চারুচন্দ্রকে মন্ত্র-দীক্ষা প্রদান করেছিলেন।

সেই সময়ে আরও একটি ঘটনা, চারুচন্দ্রের অনুরোধে সেবাশ্রমের প্রচারের জন্য স্বামীজি স্বয়ং একটি বিজ্ঞাপনপত্র লিখে দিলেন। এই আবেদনপত্রটির মূলভাষা ইংরিজি এবং এখনও সেবাশ্রমের বার্ষিক বিবরণীর শুরুতে স্বামী বিবেকানন্দর স্বাক্ষরসহ ছাপা হয়।

.

এবার ভক্ত চারুচন্দ্রের শেষ পর্বের কথা। ১৯২৬ এপ্রিল মাসে স্বামী সারদানন্দ নিমন্ত্রণ পাঠালেন শুভানন্দাকে বেলুড়ে শ্রীরামকৃষ্ণ কনভেনশনে যোগ দিতে এবং তারপর স্বাস্থ্যোদ্ধারে পুরী যেতে। শেষ মুহূর্তে শুভানন্দ বারাণসী ছেড়ে বেলুড় রওনা হতে রাজি হলেন না। ছোটছেলের মতো বললেন, “আমার এই দেহ আর বেশিদিন স্থায়ী হবে না, আমি বাকি ক’টা দিন মায়ের বুকের কাছে থেকে যেতে চাই।”

স্বামী সারদানন্দ সব খবর পেয়ে বুঝলেন শুভানন্দর শরীর সত্যিই ভেঙে পড়েছে, তাকে কোনো স্বাস্থ্যকর জায়গায় পাঠানো প্রয়োজন। তখন এক চিঠিতে সারদানন্দ তাকে কনখলে স্বাস্থ্যোদ্ধারে যাবার পরামর্শ দিলেন। একই সঙ্গে তিনি কল্যাণানন্দকে লিখলেন, শুভানন্দের যথাযোগ্য অভ্যর্থনার জন্য।

চিঠিটি পেয়ে শুভানন্দ মাথায় ঠেকালেন। বললেন, “ভেবেছিলাম এই নশ্বর দেহটা গঙ্গাতেই বিসর্জন দেওয়া হবে। কিন্তু বিশ্বনাথ অন্যরকম ভেবে বসে আছেন। তাই হোক, দেহটা কনখলেই চলুক।’

গাড়িতে উঠে শুভানন্দ ডাকলেন প্রিয় স্বামী অমরানন্দকে। বললেন, “আমি যাচ্ছি, বোধ হয় আর ফিরবো না। পোস্টাপিস সেভিংস ব্যাংকে আমার কিছু টাকা আছে, তার ব্যবস্থা কোরো। যখন শুনবে এই দেহটা আর নেই তখন এটাকার একটা অংশ মা সারদাদেবীর পূজায় খরচ করবে এবং সাধুদের জন্য ভাণ্ডারায়। বাকি সবটা যাবে দরিদ্রনারায়ণের সেবায়।”

কনখলে সেদিন ছিল বাংলা বছরের প্রথম দিন। খুব ভোরবেলায় সহকারী চৈতন্যানন্দকে নিয়ে তিনি অজানা উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লেন।

শুভানন্দ হেঁটে চলেছেন হরিদ্বারের পথ ধরে। হঠাৎ তিনি গতিপরিবর্তন করে গঙ্গার স্নানের ঘাটের দিকে চলতে লাগলেন। ঘাটের সিঁড়িতে তিনি কিছুক্ষণ বসলেন। তারপর গায়ের চাদর ও পায়ের চটি খুলে ফেলে স্রোতের মধ্যে গিয়ে পড়লেন হাত জোড় করে। একবার তিনি কোমর পর্যন্ত জলে চলে গেলেন, আবার একটু উপরে উঠলেন। এইরকম কয়েকবার করলেন তিনি।

চৈতন্যানন্দ জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কি এখানে স্নান করবেন?”

স্বামী শুভানন্দ উত্তর দিলেন, “না।”

চৈতন্যানন্দ জানেন প্রতিদিন স্নানের আগে তিনি শরীরে তেল মাখেন। আজ তো তা সম্ভব নয়, তিনি ইতিমধ্যেই জলে নেমে পড়েছেন। তার ধারণা হলো শুভানন্দ অবশ্যই স্নান করবেন। তারপর একটা শুকনো কাপড়ের দরকার হবে। সুতরাং উনি যতক্ষণ স্নান করছেন ততক্ষণে আশ্রম থেকে একটা কাপড় নিয়ে আসাই ভাল। দ্রুতপায়ে তিনি সেবাশ্রম মুখো হলেন।

একটু পরেই চৈতন্যানন্দ ফিরে এসে আঁতকে উঠলেন। স্বামী শুভানন্দ সেখানে নেই। তার স্যান্ডাল রয়েছে, চাদর রয়েছে, কিন্তু তিনি নেই। কয়েকবার হাঁক দিয়ে ডাকলেন তিনি কিন্তু কোথাও থেকে কোনো উত্তর এলো না। হঠাৎ মনে পড়ল শুভানন্দ সাঁতার কাটতে জানেন না।

স্রোতের নিশানা ধরে পাগলের মত ছুটছেন চৈতন্যানন্দ। কোথায় তিনি। একসময় গঙ্গা ও খাল যেখানে মিশেছে সেখানে যাঁরা স্নান করেছিলেন তাদের জিজ্ঞেস করলেন, কোনো সাধুকে স্রোতে ভেসে যেতে দেখেছেন?

তারা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, হ্যাঁ একজন বাঙালি সাধু ভেসে যাচ্ছিলেন। আমরা তাকে উদ্ধার করে দেখলাম, এখনও বেঁচে আছেন। তাকে বাঙালি হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছি। চারজন সাধু তাঁকে বয়ে নিয়ে গিয়েছে। সেবাশ্রমে ফিরে গিয়ে চৈতন্যানন্দ দেখলেন, একজন ডাক্তার ও কয়েকজন সেবক তার জ্ঞান ফিরিয়ে আনবার চেষ্টা করছে। চৈতন্যানন্দের একটি চিঠিতে বিবরণ দিয়েছেন : “জল সমস্ত বাহির হইল। কিন্তু ধমনীতে আর প্রাণের স্পন্দন হইল না।”

কাশী সেবাশ্রমের কর্তা শুভানন্দ নিজের সম্পর্কে বলতেন, “আমি সেবাশ্রমের তত্ত্বাবধান করি মাত্র, কর্তা আমি নই।”

তাঁর একটি আশ্চর্য অভ্যাস ছিল। যখনই কাশীর পথে বার হতেন তখনই কিছু চাল, ডাল বা কোনো খাবার জিনিস সঙ্গে নিতেন। কাউকে অভুক্ত দেখলে তাকে নিজে হাতে কিছু দিতেন।

.

যে আলোতে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে বারাণসী সেবাশ্রমের কয়েকজন বিবেকানন্দ-শরণাগত বিশ শতকের শুরুতে নতুন ইতিহাস তৈরি করলেন সেই একই আলোয় নিজেদের প্রদীপ্ত করে আর এক অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন দুই বিবেকানন্দ শিষ্য কল্যাণানন্দ ও নিশ্চয়ানন্দ। গুরু তাদের উৎসমুখে ফিরতে বারণ করেছিলেন, তারা গুরুর আদেশ অমান্য করেন নি। চিন-জাপান যুদ্ধের সময় আহতদের সেবার জন্য মেডিক্যাল মিশনের সভ্য হয়ে ভারতীয় ডাক্তার কোটনিস চিনে গিয়েছিলেন, আর ফেরেননি। তার জীবনগাথা যে বইতে ধরে রাখা হয়েছে, তার নাম ‘ফেরে নাই শুধু একজন। কনখলের অবিশ্বাস্য কাহিনি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় স্বামীজির আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে, তার ইচ্ছার প্রতি সম্মান জানিয়ে একজন নয়, ফেরে নাই কয়েকজন।

নিজেদের সম্পূর্ণ মুছে ফেলে গুরু বিবেকানন্দের ভাবধারাকে প্রাণবন্ত রাখাটাই ছিল দুই সন্ন্যাসীর ব্রত। এতই অহংকে অবহেলা যে ১৯৪০ সালে দেখা গেল যে-মানুষটি প্রায় চারদশক ধরে কনখল সেবাশ্রমের আকাশবাতাস প্রাণবন্ত রেখেছিলেন সেই নিশ্চয়ানন্দ মহারাজের কোনো ছবিই নেই সেবাশ্রমে। সেই সময় সেবাশ্রমে এসেছেন আমেরিকান সন্ন্যাসী স্বামী অতুলানন্দ। শুনে তিনি বললেন, মার্কিনী ফক্স ভগ্নীরা সেবার যখন কনখলে এসেছিলেন তখন নিশ্চয় তারা নিশ্চয়ানন্দকে কোনো না কোনো ছবির ফ্রেমে বন্দি করে রেখেছিলেন। তিনি মার্কিন দেশে চিঠি লিখে দিলেন। ফক্স ভগ্নীদের একজন তখনও বেঁচে ছিলেন, তিনি একটা ছবি পাঠালেন, সেই অস্পষ্ট ছবিটাই এখন আমাদের একমাত্র স্মৃতি।

একই বিবেকানন্দ-শিলা থেকে কুঁদে বার করা কল্যাণানন্দ। বরাবর দশ আনা দামের জুতো ব্যবহার করতেন। দারুণ ঠাণ্ডাতেও পশম নয়, তুলোর জামাই ছিল তাঁর ভরসা।

শেষ পর্বে কল্যাণানন্দের শরীর ভাল যাচ্ছিল না। শত সহস্র মানুষকে ব্যাধিমুক্তিতে সাহায্য করাই যাঁর জীবনব্রত তিনি নিজেই এবার ভগ্নস্বাস্থ্য হলেন। কিন্তু শয্যাশায়ী হয়ে অপরের বোঝা বাড়ানোর মানসিকতা নিয়ে তিনি এই দূরদেশে গুরু বিবেকানন্দের নির্দেশ পালন করতে আসেননি। অতএব রোগ যতই হোক, কাজের বিরাম নেই। এই শরীরই যে ব্যাধিমন্দির তা তার থেকে ভাল কি আর বুঝতো? সেই সঙ্গে প্রবল মানসিক ও আধ্যাত্মিক শক্তি।

মৃত্যুকে ভয় পাবার জন্য মানুষ সন্ন্যাসী হয় না, মরণের সঙ্গে আগাম মোকাবিলার জন্যই তো জীবিতকালে আদ্যশ্রাদ্ধ, তবু ব্যাধির বিরুদ্ধে সংগ্রাম শেষ হতে চায় না। মৃত্যুও বোধ হয় তাদের প্রতি সন্তুষ্ট নয় যাঁরা ব্যাধিগ্রস্ত মানুষকে দেবজ্ঞানে দিবারাত্র সেবা করে মৃত্যুকে এবং দেহযন্ত্রণাকে বাধা দেয়। এক বছর দু’বছর নয়, সহায়হীন সম্পর্কহীন অচেনা অজানা দেশে দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছর ধরে ভিক্ষাবৃত্তিতে ক্ষুধানিবৃত্তি করে নরনারায়ণের সেবা করে গুরুনির্দেশ পালন করেছেন মুখ বুজে। জগতের ইতিহাসে এমন জিনিস যে আজও ঘটে তা কল্যাণানন্দের জীবনী জানলে বিশ্বাস হয় না।

জীবনের শেষ পনেরো বছর কল্যাণানন্দ বিভিন্ন ব্যাধির শিকার হয়েছেন, কিন্তু তাই বলে থেমে যাওয়া নয়, প্রতিকূল পরিস্থিতির কাছে আত্মসমর্পণ অবশ্যই নয়। স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দ সন্ন্যাস-লক্ষণকে চিহ্নিত, করে গিয়েছেন। তার অনুগত শিষ্যরা জানেন, সন্ন্যাসের অর্থ মৃত্যুকে ভালবাসা। “সংসারী জীবনকে ভালবাসবে, সন্ন্যাসী মৃত্যুকে ভালবাসবে, আমাদের অঙ্গের গৈরিকবাস তো যুদ্ধক্ষেত্রের মৃত্যুশয্যা।”

তবু গুরুর নির্দেশে মৃত্যুকে জয় করবার কি বিরামহীন ব্রত। সেবা দিয়ে, শুশ্রূষা দিয়ে মৃত্যুর কাঠিন্যকে যথাসাধ্য কোমল কর মানুষের জন্য। কল্যাণানন্দ তাই নিজের শরীরের জন্য মাথাব্যথা করতে রাজি নন। প্রতি মুহূর্তের রণক্ষেত্রে তিনি সেনানায়কের যে দায়িত্ব স্বেচ্ছায় গ্রহণ করেছেন সেখানে ছুটি নেই, অবসর নেই, পদত্যাগও নেই।

১৯৩৭। চিকিৎসকদের পরামর্শে কল্যাণানন্দকে মুসৌরি যেতে হলো, শেষবার যাত্রার সময় মহারাজ তার আয়রন সেফের চাবি এক তরুণ সন্ন্যাসীর হাতে দিয়ে বললেন, আমার অনুপস্থিতিতে সব যেন ঠিক ভাবে চলে। ২৫শে অক্টোবর মুসৌরি থেকে তিনি সেবক সর্বগতানন্দকে লিখলেন, একটা হওয়াটার বটল ও কিছু ওষুধ নিয়ে এখানে এসো।

ইতিমধ্যে একদিন বিকেলে তাঁর শরীরে অসহ্য জ্বালা দেখা গেল। স্মিতহাস্যে সন্ন্যাসী বললেন, “ডাক্তার কী আর হবে? আই অ্যাম ডায়িং, আই অ্যাম ডায়িং।” গভীর রাতে অতিশয় স্পষ্টভাবে তিনবার ‘মা’ নাম উচ্চারণ করতে করতে বিবেকানন্দের প্রিয় শিষ্য, চির-অনুগত স্বামী কল্যাণানন্দ মহাসমাধিতে মগ্ন হলেন।

কনখলে যথোচিত মর্যাদা সহকারে তাকে জাহ্নবীগর্ভে সমাহিত করা হয়।

মৃত্যু তার ছোবল না দিলেও সময় কারও জন্যে অপেক্ষা করে থাকে না। কপর্দকশূন্য অবস্থায় অজানা দেশের দুর্গম পথ ধরে হাঁটতে-হাঁটতে গুরুর নির্দেশে প্রবাসে এসে ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করে বিবেকানন্দ মন্ত্রে মুগ্ধ শিষ্য যে প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছিলেন তা আজও বেঁচে রয়েছে। যথাসময়ে কনখল সেবাশ্রমের বিপুল বিস্তৃতি ঘটেছে, বহু রোগী আজও সেখানে সেবিত হচ্ছেন। সেবাশ্রমের পথ ধরে হাঁটতে-হাঁটতে কোনো পাঠকের যদি কখনও বহুযুগ আগের এক বরিশাল যুবকের অবিশ্বাস্য সাধনার কথা মনে পড়ে যায় তা হলে আশ্চর্য হওয়ায় কিছু থাকে না। যদি প্রশ্ন জাগে, গুরুর কোন্ লোকাতীত শক্তিতে এই আমৃত্যু সাধনা সম্ভব হলো, তা হলে স্মরণ করা যেতে পারে ক্ষণজন্মা সেই সন্ন্যাসীটির কথা যিনি অকালপ্রয়াণের আগে তাঁর প্রিয় শিষ্যকে দূরদেশে গিয়ে রোগীর সেবা করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং সেই সঙ্গে অগস্তযাত্রার বিধিনিষেধ এঁটে দিয়ে বলেছিলেন, কিন্তু আর ফিরবি না। অনুগত শিষ্য সেই কথা রেখেছে, গুরুর নির্দেশ মান্য করে সে আর জন্মভূমিতে ফেরেনি।

যারা ফেরে না তাদের কথাও মাঝে মাঝে স্মৃতির পটে ফিরে আসে। জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে হয়, স্বামীজির কোন্ অলৌকিক শক্তিতে যেমন গুরু তেমন-শিষ্য কথাটি আজও এই পৃথিবীতে এমনভাবে ধ্রুবসত্য হয়ে রইল?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *