১০. অনিসলামি মুসলমান

অধ্যায় দশ – ‘অনিসলামি মুসলমান

. স্পর্শকাতর মুসলমান

আগেই বলিয়াছি আমি যতই মোল্লা-বিরোধী, গোঁড়ামি-বিরোধী হইয়া উঠিতে লাগিলাম, মুসলমানদের প্রতি দরদ ও টান আমার ততই বাড়িতে লাগিল। বাড়িতে লাগিল বলিলাম এই জন্য যে মুসলমানি চেতনা আমার ছেলেবেলা হইতেই ছিল। আভাসে-ইঙ্গিতেও যদি কেউ মুসলমানের নিন্দাসূচক কথা বলিতেন, তবে আমি ক্ষেপিয়া উঠিতাম। আমি যখন ধানীখোলা পাঠশালার ছাত্র, সেই সময় বৈলরের জমিদারের ম্যানেজার বাবু কেশব চন্দ্র চক্রবর্তী একবার আমাদের পাঠশালার বার্ষিক সভায় সভাপতিত্ব করিয়াছিলেন। কেশব বাবু দয়ালু উদার-হৃদয় অসাম্প্রদায়িক লোক বলিয়া পরিচিত ছিলেন কিন্তু সভাপতির অভিভাষণের এক জায়গায় তিনি বলিলেন : ‘ভদ্রলোকদের দেখাদেখি আজকাল মুসলমানরাও বিদ্যাশিক্ষার দিকে মন দিয়াছে দেখিয়া আমি যারপরনাই আনন্দিত হইয়াছি।’ এতে মুসলমানদিগকে ভদ্রলোক বলা হইল না বলিয়া সাত-আট বছরের শিশু আমি ক্ষেপিয়া গিয়াছিলাম এবং সভাশেষে ম্যানেজার বাবুর সাথে তর্ক করিতে গিয়াছিলাম। আমাদের শিক্ষক ও মুরুব্বিরা আমাকে নিরস্ত করিয়াছিলেন। তৎকালের শ্রেষ্ঠ সাপ্তাহিক খবরের কাগজ বঙ্গবাসীতে একবার এক সভার খবর এই রূপে বাহির হইয়াছিল : সভায় কতিপয় ভদ্রলোক ও অনেক মুসলমান যোগ দিয়াছিলেন। আমি উক্ত সংবাদপত্রে ইহার প্রতিবাদ পাঠাইয়াছিলাম। ছাপা হয় নাই বলিয়া উক্ত পত্রিকার গ্রাহক আমার মুরুব্বিকে ঐ কাগজ না কিনিতে উপদেশ দিয়াছিলাম। তিনি হাসিয়াছিলেন এবং ভবিষ্যতে আর টাকা দিবেন না বলিয়া আমাকে শান্ত করিয়াছিলেন। মুসলমান মাতব্বর প্রজাদেরেও জমিদারের কাঁচারিতে বসিতে দেওয়া হয় না বলিয়া আমি শৈশবেই জমিদারদের বিরুদ্ধে। মুরুব্বিদের উস্কাইতাম। ময়মনসিংহ শহরে পড়িতে আসিয়া যখন দেখিলাম, হিন্দু মিঠাইর দোকানে মুসলমান খরিদ্দারকে ঢুকিতে দেওয়া হয় না, তখন মিঠাই খাওয়ার লোভ অতি কষ্টে নিবারণ করিলাম। এসবই স্বাভাবিক ছিল। তখন আমি চালে-চলনে, মনে-মস্তিষ্কে পাক্কা মুসলমান।

কিন্তু আমি যখন মনের দিক দিয়া ঘোরতর নাস্তিক, পোশাকে-পরিচ্ছদে যখন আমাকে বাঙ্গালী হিন্দু যুবক হইতে আলাদা করিয়া চিনিবার কোনও উপায় ছিল না, তখন আমি কথাবার্তায় মুসলমান যবান যাহির করিয়া গৌরব বোধ করিতাম। ইসলাম ধর্ম ও মুসলমান জাতিকে নিন্দা করিলে আমি সঙ্গে সঙ্গে নিন্দুকের সঙ্গে ঝগড়া বাধাইয়া দিতাম। আমি নিজের ঘরে বসিয়া ইসলাম ধর্ম ও মুসলমান সমাজের চৌদ্দপুরুষ উদ্ধার করিতাম। কিন্তু কোনও অমুসলমান সে কাজ করিলে তার দিকে মুষ্টি উঁচাইয়া যাইতাম। আমি যখন ঘোরতর নাস্তিক সেই সময় যদি কোনও ইউরোপীয় পণ্ডিতের বইয়ে ইসলাম ধর্ম ও পয়গম্বর সাহেবের নিন্দা করিতাম তবে ঐ পণ্ডিতকে মূর্খ আখ্যা দিয়া তার বই ছুড়িয়া ফেলিয়া দিতাম। এমনকি যদি কোনো দর্শনের বইয়ে ধর্ম প্রবর্তকদের নামের মধ্যে যিশুখৃষ্ট ও বুদ্ধের নামের পাশে মোহাম্মদের নাম অথবা বড়-বড় ধর্মের নামের মধ্যে বৌদ্ধ, হিন্দু ও খৃষ্টধর্মের সাথে ইসলামের নাম না দেখিতাম, তবে ঐ দার্শনিকের প্রতি আমি এক মুহূর্তে শ্রদ্ধা হারাইতাম। ঘোরতর নাস্তিক্যের অবস্থায়ও আমি বরাবরের অভ্যাস-মত উঠিতে-বসিতে, রাস্তায় বাহির হইতে, খাইবার সময় প্রথম নওলা মুখে দিতে, গাড়ি-ঘোড়ায় চড়িতে ‘বিসমিল্লাহ’ বলিতাম। খানা শেষ করিয়া, কোনও আনন্দসংবাদ পাইয়া ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলিতাম। কাকেও উৎসাহ দিতে গিয়া ‘মাশা আল্লাহ’ বলিতাম। কাছে বসিয়া কেউ হাঁচি মারিলে ‘আরহামাকুমুল্লাহ’, বিস্ময় প্রকাশে ‘সোবহানাল্লাহ’, ঘৃণা প্রকাশে নাউযুবিল্লাহ’ বলিতাম। আমার এই পাক্কা মুসলমানি ব্যবহার দেখিয়া অনেক বন্ধু আমার নাস্তিক্য বা মুক্ত-বুদ্ধি অথবা র‍্যাশনালিযম সম্বন্ধে, এমনকি আমার অসাম্প্রদায়িক উদারতা সম্বন্ধেও সন্দিহান ছিল। অনেক বন্ধু আড়ালে আমার নিন্দা করিয়া বলিত : আরে, কে বলে আহমদ নাস্তিক? ও আসলে একটা মোল্লা। নিজেকে একজন ফ্রি-থিংকার প্রমাণ করার জন্যই সে নাস্তিক্যের ভণ্ডামি করিয়া থাকে।

.

. চাল-চলনে গোঁড়ামি

আমার কংগ্রেসি জীবনে আমি দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টাই হিন্দু বন্ধু ও সহকর্মীদের সাথে কাল কাটাইতাম। তাদের বাড়িতে চা-বিস্কুট-মিঠাই খাইতাম। হিন্দু মহিলাদের সাথে কথা বলিতাম। তাদের হাতেও খাইতাম। কিন্তু কদাচ তাঁদের কাছে ‘জল’ চাই নাই। বরাবর পানি’ চাহিয়াছি। তাঁদের বাড়িতে আমি কদাচ ‘ডিম’ ও ‘মাংস খাই নাই। বরাবর ‘আন্ডা’ ও ‘গোশত খাইয়াছি। প্রথম-প্রথম অনেক হিন্দু বন্ধু বিশেষত মহিলা আমার এই ব্যবহারে মনে মনে চটিতেন। এটাকে আমার গোঁড়ামি মনে করিতেন। কিন্তু তাতে আমার ব্যবহার বদলায় নাই। বরঞ্চ উল্টা ফল হইয়াছে। ওরা আমার এই সব শব্দ ব্যবহারে অসন্তুষ্ট হয় বুঝিয়া আমার মুসলমানি আদব-কায়দা আরো বাড়ায়াছিলাম। আমার নাস্তিক্যের ও ধর্মীয় উদারতার আমলে, বিশেষত কলিকাতার জীবনে, বন্ধুবর মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, বন্ধুবর আয়নুল হক খ এবং আরো অনেক মুসলমান বন্ধুর প্রভাবে একসময় তহবন্দের বদলে ধুতি পরা শুরু করিয়াছিলাম। কিন্তু তহবন্দ বা লুঙ্গি পরা নিয়াই হিন্দুরা মুসলমানদেরে অবজ্ঞা করে বুঝিয়া ধুতি ছাড়িয়া দিলাম। অতঃপর লুঙ্গি ছাড়া আর কিছু পরিতামই না। খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করিয়াই যে দাড়ি রাখিয়াছিলাম, তার কারণ এই যে হিন্দু কংগ্রেসি বন্ধুরা দাড়ির নিন্দা করিত।

.

. মিঠাই বর্জন

মফস্বলে হিন্দু মিঠাইর দোকানে মিঠাই না খাওয়া তেমন বড় ত্যাগ ছিল না। কিন্তু কলিকাতায় এটা সত্যই খুব বড় রকমের ত্যাগ ছিল। বাগ বাজারের রসগোল্লা, কলেজ স্কোয়ারের পুটিরামের মিঠাই ও বৌবাজারের ভীম নাগের সন্দেশ যে না খাইয়াছে, তার কলিকাতা-জনম বৃথা। দাড়ি-মুখে লুঙ্গি পরিয়া এইসব দোকানে মুসলমান ঢুকিতে পারে না বলিয়া আমি এমন লোভনীয় মিষ্টান্ন হইতে নিজেকে বঞ্চিত রাখিতাম। শ্রদ্ধেয় বন্ধু ইয়াকুব আলী চৌধুরী পাকা নামাজি-মোত্তাকী-পরহেযগার মুসলমান ছিলেন। তিনিও দাড়ি রাখিতেন। আচকান-পাজামা ও টুপি ছাড়া কদাচ রাস্তায় বাহির হইতেন না। তিনি পর্যন্ত ঐসব মিঠাই বর্জন করিতেন না। তিনি আমার এই আত্মসম্মানবোধের গালভরা প্রশংসা করিয়াও শেষ পর্যন্ত ঐ মিঠাই খাইতে জোর-যবরদস্তি করিতেন। তিনি বলিতেন : নিজে ঐসব দোকানে মিঠাই কিনিতে যাইও না; কিন্তু অপরে কিনিয়া আনিয়া দিলে বাড়িতে বসিয়া খাইও। অনেক দিন পরে চৌধুরী সাহেবের এই বাস্তববাদী যুক্তি গ্রহণ করিয়া তারই কিনা মিঠাই তাঁরই সিটে বসিয়া খাইয়াছিলাম।

.

. বেশ্যা-বর্জিত

আরেকটি মজার ব্যাপার এখানে উল্লেখ না করিয়া পারিতেছি না। বন্ধুবান্ধবের কাছে শুনিতাম, কলিকাতার বেশ্যারাও মুসলমান খরিদ্দার গ্রহণ করে না। পরে এই কথার এইরূপ ব্যাখ্যা শুনিলাম যে মুসলমান খরিদ্দারদিগকেও ‘হিন্দু বেশে অর্থাৎ ধুতি পরিয়া বেশ্যাবাড়ি যাইতে হয়। প্রথমে হিন্দুদের মুসলিম বিদ্বেষের গভীরতা ও ব্যাপকতা দেখিয়া স্তম্ভিত হইলাম। হিন্দুদের মুসলিম ঘৃণা বেশ্যাদের মধ্যে পর্যন্ত প্রসারিত হইয়াছে? শ্রদ্ধেয় বন্ধু ডা. লুৎফর রহমান এই সময় পতিতা উদ্ধারিনী সমিতি’ চালাইতেছিলেন এবং এই উপলক্ষে বেশ্যাদের মধ্যে সভা করিয়া মূল্যবান সদুপদেশ দিতেছিলেন। তাঁর মুখে শুনিলাম, স্বয়ং বেশ্যাদের মধ্যেও অনেক মুসলমান মেয়ে আছে। কিন্তু তারা হিন্দু নামে ব্যবসা করিতেছে বলিয়া তাদেরে চিনিবার উপায় নাই। এর কারণ জিজ্ঞাসা করিয়া জানিতে পারিলাম মুসলমান বেশ্যার বাড়িতে কোনও হিন্দু খরিদ্দার যাইবে না; এমনকি ভদ্রবেশ্যা পল্লিতে তারা বাড়ি পাইবে না। তাই তারা হিন্দু নাম গ্রহণ করিয়া ব্যবসা করিতেছে। দিন-রাত পাপের মধ্যে ডুবিয়া আছে যে বেশ্যারা তারা পর্যন্ত মুসলমানকে ঘৃণা করে? কথাটা যে সত্যতার প্রমাণ নিজের চোখে দেখিতাম। যেসব মুসলমান বন্ধু-বান্ধব ও পরিচিত লোক কার্য বা চাকুরি উপলক্ষে দিনের বেলা কোট-প্যান্ট, পাজাম-পাঞ্জাবি পরিয়া থাকিতেন, তাঁদেরে দেখিতাম সন্ধ্যার সময়ে ফিনফিনা ধুতি ও সিল্কের পাঞ্জাবি পরিয়া অ্যাসেন্স লাগাইয়া বেড়াইতে বাহির হইতেছেন। তাঁহার অনেকের মুখেই এই স্বীকারোক্তি পাইতাম যে, পাঞ্জাবি-পাজামা পরিয়া গেলে বেশ্যারা বসিতে দিবে না বলিয়াই তারা ঐ পোশাকে যাইতেছেন।

ঘৃণা-লজ্জায় আমার তালু-জিহ্বা লাগিয়া গিয়াছিল। কিন্তু বেশ্যাদের চেয়ে আমার রাগ হইল এই সব আত্মসম্মানবোধহীন বেহায়া ও বেশরম মুসলমানদের উপরে। আমি এই সময় মেসে থাকিতাম। তার কয়েকটা ছিল খুবই বড় মেস। সেসব মেসে চল্লিশ-পঞ্চাশ জন করিয়া নানা কাজের ও নানা বয়সের লোক থাকিতেন। তাঁদের মধ্যে বেশ্যাবাড়ি যাইবার অভ্যাস কারো কারো ছিল। তাঁরা অসংকোচে, অনেকে সগৌরবে, বেশ্যাবাড়ির অভিজ্ঞতা বর্ণনা করিতেন। নিজেদের মুসলমানি গোপন করিয়া বেশ্যাবাড়ি যাওয়ার সমর্থনে তারা বলিতেন : মুসলমান পুরুষরা যে মুসমানি বেশে বেশ্যাবাড়ি যায় না এবং মুসলমান মেয়েরা যে মুসলমানি নামে বেশ্যাবৃত্তি করে না, তাতে আমার দুঃখিত না হইয়া বরঞ্চ আনন্দিত হওয়া উচিৎ। কারণ দুনিয়ার লোক জানিতেছে, কলিকাতার হাজার হাজার বেশ্যার মধ্যে একজনও মুসলমান। মেয়ে নাই এবং লক্ষ-লক্ষ বেশ্যাগামীর মধ্যে একজন মুসলমান পুরুষও নাই। যতই চিন্তা করিলাম, ততই বুঝিতে পারিলাম বন্ধুদের যুক্তিটা একেবারে ফেলিয়া দিবার মত নয়। শেষ পর্যন্ত বন্ধুদের ঐ যুক্তিতে আমি যথেষ্ট সান্ত্বনা পাইলাম। আস্তে আস্তে আমার রাগ কমিয়া গেল। কিন্তু ঐ ব্যাপার হইতে একটা শিক্ষা গ্রহণ করিলাম এবং জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার পাইলাম। যত দিন। অবিবাহিত অবস্থায় কলিকাতা থাকিলাম, দাড়িও ফেলিলাম না, লুঙ্গিও ছাড়িলাম না। কলিকাতার মত অসংখ্য প্রলোভনের বিশাল নগরীতে লুঙ্গি ও দাড়ি আমার চরিত্রের রক্ষাকবচ হইয়া থাকিল। বেশ্যাদিগকে বেশ্যা হিসাবে আমি ঘৃণা করিতাম বটে, কিন্তু নারী হিসাবে আমি তাদেরে সম্মান করিতাম। ডা. লুত্যর রহমানের সংশ্রবে আসিয়াই যে আমি এই মত অবলম্বন করিয়াছিলাম, তা নয়। তার অনেক আগে হইতেই আমার এই মত ছিল। ১৯২২ সালের ঘটনা। তখন ময়মনসিংহ শহরে কংগ্রেস-খেলাফত নেতাদের। অখণ্ড প্রতাপ। আমরা তখন একদলে পনের-বিশজন নেতা দল বাঁধিয়া রাস্তায় টহল দিতাম। সকল শ্রেণীর পথচারীরা আমাদেরে পথ ছাড়িয়া দিত। পথ চলিতে-চলিতেও আমরা তর্কবিতর্ক, আলাপ-আলোচনা করিতাম। এমনি একদিন তর্কের জোশে আমি বন্ধুদের দিকে ঘাড় ফিরাইয়া-ফিরাইয়া পথ চলিতেছিলাম। অপর দিক হইতে দুই-তিন জন বেশ্যা আসিতেছিল। ওরা আমাদেরে রাস্তা ছাড়িয়া এক পাশ হওয়া সত্ত্বেও আমি বেখায়ালে উহাদের। একজনের পায়ে পাড়া মারি। উহ’ শুনিয়া আমার হুঁশ হয়। আমি তার দিকে ফিরিয়া নিজের অপরাধ বুঝিতে পারি এবং মাফ করিবেন’ বলিয়া আমি মাথা ফিরাইয়া জোড় হাতে হিন্দু-মতে নমস্কার করি। কারণ আমার ধারণা ছিল সব। বেশ্যাই হিন্দু। আমার সাথীরা সকলে হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিলেন। একজন বলিলেন : ‘ছি ছি, তুমি একটা বেশ্যাকে নমস্কার করিলে। বিনা-দ্বিধা সংকোচে চট করিয়া আমার মুখ হইতে বাহির হইয়া গেল : যারা বেশ্যাবাড়ি যায়, তাদের জন্যই ইনি বেশ্যা। আমার জন্য ইনি একজন মহিলা মাত্র।

মুহূর্তে সকলের হাসি বন্ধ হইয়া গেল। আর বেশ্যা বলিয়া কথিত মেয়েটির চোখ দুইটা ছলছল করিয়া উঠিল। পলকে আমাদের দিক হইতে চোখ ফিরাইয়া সঙ্গিনীদের সাথে চলিয়া গেল।

শুধু মুসলমানদের পোশাক-পাতি নয়, তাদের নাম লইয়াও যদি কেউ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বিদ্রূপ করিত তবে আমি চটিয়া যাইতাম। নামে অশুদ্ধ উচ্চারণ বা বিকৃতিকরণকে আমি এইরূপ বিদ্রূপ মনে করিতাম। হিন্দু বন্ধুদের সাথে এই লইয়া আমার অসংখ্য ঝগড়াঝাটি হইয়াছে। এসব ক্ষেত্রেই আমি হিন্দু বন্ধুদিগকে টিট-ফর-ট্যাট বা ঢিলের বদলে পাটকেল মারিয়া প্রতিশোধ নিতাম। এখানে দুইটা মাত্র ঘটনার উল্লেখ করিব :

.

. ফ্যাসটিডিয়াস

ময়মনসিংহের কংগ্রেস-নেতা বাবু সূর্য কুমার সোম উদার অসাম্প্রদায়িক নেতা ছিলেন। তাকে আমি পিতার ন্যায় ভক্তি করিতাম। তিনিও আমাকে আপন ছেলের মতই স্নেহ করিতেন। কিন্তু তিনি মওলানা শওকত আলীকে মৌলানা ‘সৈকত আলী (ইংরাজি এস দিয়া) এবং আমাকে মশুর (ইংরাজি এস-এইচ দিয়া) উচ্চারণ করিতেন। এই নিয়া তার সঙ্গে প্রায়ই আমার কথা-কাটাকাটি হইত। তিনি নিজের নাম সূর্য কুমার (এস-এইচ দিয়া) ঠিকই উচ্চারণ করিতেন। কিন্তু শওকতের উচ্চারণে তিনি শুধু এস দিয়া সৈ’ উচ্চারণ করিতেন। অর্থাৎ মনসুরে’ ‘স’-এর স্থলে শ’ এবং শওকতে’ ‘শ’-এর স্থলে ‘স’ উচ্চারণ করিতেন। আমার পুনঃপুন প্রতিবাদে তিনি উত্ত্যক্ত হইয়া আমাকে ধমক দিলেন। বলিলেন : নামের উচ্চারণ লইয়া আমার অমন ফ্যাসটিডিয়াস হওয়া উচিৎ নয়। আমি এটাকেও সূর্যবাবুর সাম্প্রদায়িক মুসলিম-অবজ্ঞা মনে করিয়া দুঃখিত হইলাম। কিন্তু বেআদবি না করিয়া টিট ফর-ট্যাট মারিবার সন্ধানে থাকিলাম।

সেকালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির বৈঠক শুধু কলিকাতায় না হইয়া ঘুরিয়া ঘুরিয়া বিভিন্ন জিলায় হইত। সেবারে ঐ বৈঠক ছিল ময়মনসিংহে। সেক্রেটারি সুভাষচন্দ্র বসু, সূর্যবাবুর মেহমান। তিনি বন্ধুবান্ধব লইয়া গল্প-গুযারি করিতেছেন। আমিও সেই বৈঠকে আছি। আলাপে আলাপে সুভাষবাবু আমার দিকে চাহিয়া হঠাৎ বলিলেন : সূর্যবাবু গেলেন। কোথায় মনসুর সাব? তাকে দেখি না কেন?

আমি আসন হইতে উঠিয়া বাড়ির ভিতরদিককার বারান্দায় দাঁড়াইয়া চিৎকার করিলাম : ‘সূর্যবাবু, ও সূর্যবাবু, সুভাষবাবু আপনারে ডাকতেছেন।’ ‘সূর্য’ ও ‘সুভাষ’ দুইটি শব্দই আমি এমন স্পষ্টভাবে ‘এস’ উচ্চারণ করিলাম, যাতে দুইটা শব্দই প্রায় ‘ছুর্য’ ও ‘ছুভাছ’ শোনা গেল।

ঘরের মধ্যে দৃষ্টিপাত করিয়া বুঝিলাম, আমার ঔষধে ক্রিয়া করিয়াছে। সুভাষবাবু ও তাঁর সঙ্গীরা বিস্ময় বা বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকাইয়াছেন। বারান্দার দিকে দৃষ্টি ফিরাইয়া দেখিলাম, সূর্যবাবু প্রায় আমার কাছে আসিয়া পড়িয়াছেন এবং বলিতেছেন : তুমি আমার নাম লৈয়া ঠাট্টা করতেছ কেন?

সুভাষবাবু ব্যাপার কী জিজ্ঞাসা করিলেন। সভার মধ্যেই আমি সূর্যবাবুর বিরুদ্ধে অভিযোগ করিলাম। সূর্যবাবুও আমার বিরুদ্ধে বলিলেন। উচ্চ হাসিয়া সুভাষবাবু বিচার করিলেন। বিচারে সূর্যবাবু অপরাধী সাব্যস্ত হইলেন। আমি বেকসুর খালাস পাইলাম। সকলে অনেকক্ষণ ধরিয়া হাসাহাসি করিলেন।

আরেক দিনের ঘটনা। ময়মনসিংহ টাউন হলে এক কংগ্রেসি সভার সভাপতি রূপে আমি নাকি খুব ভাল বক্তৃতা করিয়াছিলাম। এ জিলার প্রাচীনতম সংবাদপত্র চারু-মিহির এই প্রসঙ্গে আমার প্রশংসায় একটা সম্পাদকীয় লিখিয়া ফেলিল। তাতে আমাকে খ্যাতনামা সাহিত্যিক, জনপ্রিয় কংগ্রেস-নেতা, উদীয়মান উকিল মি. মনসুর আলী সাহেব’ বলিয়া উল্লেখ করা হইল। উক্ত পত্রিকার সম্পাদক মি. মধুসূদন সরকার ময়মনসিংহ বারের প্রবীণ উকিল। কাগজ বাহির হইবার পর দিনই তাঁর সাথে আমার দেখা। সগর্বে তিনি আমাকে বলিলেন : পড়ছেন এবারের সম্পাদকীয়টা? কেমন লাগল?

আমি হাসিয়া বলিলাম : ধন্যবাদ। আমাকে ত বাঁশ দিয়া অনেক উঁচায় তুলছেন। কিন্তু সামান্য একটু ভুল হইছে।

মধুবাবু কিছুটা বিস্মিত এবং তার চেয়ে অসন্তুষ্ট হইয়া বলিলেন : আমি ভুল করছি? কী ভুল?

আমি হাসিমুখে বলিলাম : আমার নাম আবুল মনসুর, মনসুর আলী নয়।

মধুবাবু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিয়া বিজ্ঞের হাসি হাসিয়া বলিলেন : ও! এই কথা! এতে ভুলটা কী হইল? নামের মধ্যে ‘মনসুর’ ত আছে।

আমি বিরক্তি গোপন করিয়া বলিলাম : তা আছে বটে, তবে নামটা আমার আবুল মনসুর আহমদ, মনসুর আলী নয়।

মধুবাবু আমার বোকামিতে কৃপা প্রদর্শন করিয়া সান্ত্বনার সুরে বলিলেন : নাম সম্বন্ধে অত ফ্যাসটিডিয়াস হইবেন না। যাহা আবুল মনসুর তাহাই মনসুর আলী। আমি ত কোনও পার্থক্য দেখি না।

এই বলিয়া মধুবাবু আমাকে পাত্ৰাধার তৈল ও তৈলাধার পাত্র এবং ‘টুইডলডাম’ ও ‘টুইডলডি’র চুলচেরা হিসাবের অন্যাবশ্যকতা বুঝাইবার চেষ্টা করিলেন।

আমি আর কী করিতে পারি? অগত্যা নিরস্ত হইলাম এবং টিট-ফর ট্যাট’-এর সন্ধানে থাকিলাম। সৌভাগ্যবশত সুযোগের অপেক্ষায় আমাকে বসিয়া থাকিতে হইল না।

সেই দিনই বিকালে কোর্ট-ফেরতা ডি বি বিল্ডিংয়ের মধ্যবর্তী রাস্তা দিয়া বাসায় ফিরিতেছিলাম। সেদিন ডি বির মিটিং ছিল। মিটিং শেষে চেয়ারম্যান শরফুদ্দিন সাহেব কতিপয় মেম্বর লইয়া রাস্তায় দাঁড়াইয়া বোধ হয় মিটিং-এরই কোনও আলোচিত বিষয়ের পুনরালোচনা করিতেছিলেন। আমাকে দেখিয়া ডাকিলেন। আমিও তাদের আলাপে শামিল হইলাম। আলাপ করিতে-করিতে হঠাৎ চেয়ারম্যান সাহেব মাথা উঁচা করিয়া বলিলেন : ওটা চারু-মিহির-এর এডিটর মধুবাবু যাইতেছে না?

আমিও চেয়ারম্যান সাহেবের দৃষ্টি অনুসরণ করিয়া দেখিলাম, খানিক দূর দিয়া মধুবাবু যাইতেছেন। বলিলাম : মধুবাবুই বটে।

চেয়ারম্যান : আপনার সাথে ত মধুবাবুর খুব খাতির, একটু ডাকুন না। তার সাথে আমার কথা আছে।

আমি অমনি জোরে চিল্লাইয়া উঠিলাম : সূদনবাবু ও সূদনবাবু।

মধুবাবু একবার ঘাড় ফিরাইয়া এদিক-ওদিক তাকি-তুকি করিয়া আবার পথ চলিতে লাগিলেন। দেখিলাম, চেয়ারম্যান সাহেব আমার ভুল সংশোধনের জন্য কী বলিতে যাইতেছেন। আমি তাকে কোনও কথা বলিতে না দিয়া গলার সুর আরো উঁচা করিয়া চিৎকার করিলাম : ও সূদনবাবু ও চারু মিহির, চেয়ারম্যান সাহেব আপনার সাথে একটা কথা কইতে চান।

এবার মধুবাবু আমাদের দিকে ফিরিয়া চাহিলেন। আমার পাশে চেয়ারম্যান সাহেবকে দাঁড়ান দেখিয়া আমাদের দিকে রওয়ানা হইলেন। তিনি ঘন-ঘন পা ফেলিয়া আমাদের নিকটবর্তী হইয়াই আমার দিকে চোখ পাকাইয়া বলিলেন : মানুষের নাম নিয়া মশকরা করেন কেন?

আমি বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলিয়া বলিলাম : কী কইতেছেন? আপনি মুরুব্বি মানুষ। আপনার নাম নিয়া মশকরা করব আমি?

মধুবাবু জেংরা মারিয়া বলিলেন :বাকি রাখলেন আর কী? আমারে সূদনবাবু বইলা ডাকলেন কেন? আপনি ত জানেন আমার নাম শ্রী মধুসূদন সরকার।

আমি হাসিয়া বলিলাম : আপনার নামের মধ্যে সূদন’ ত আছে। তবে ভুলটা কী করলাম? যাহা মধু তাহা সূদন। নাম সম্বন্ধে আপনি অত ফ্যাসটিডিয়াস কেন? এ ত দেখতেছি ‘তৈলাধার পাত্র ও পাত্ৰাধার তৈল’ অথবা টুইডলডাম’ ‘টুইডলডি’র ব্যাপার।

এতক্ষণে মধুবাবুর চৈতন্য হইল। তিনি আমার কাঁধে একটা থাপ্পড় মারিয়া বলিলেন : আপনে বড় বজ্জাত।

আমি তখন চেয়ারম্যান ও অন্যান্য মেম্বারদের ব্যাপারটা বলিলাম। সকলে অনেকক্ষণ ধরিয়া হাসিয়া মধুবাবুকে একদম তুলাধুনা করিলেন।

আমি এইরূপে একদিকে মুসলমানদের চাল-চলন, কৃষ্টি-তমদুন ও পোশাক-পাতি লইয়া অমুসলমানদের, বিশেষত, প্রতিবেশী হিন্দুদের সাথে অহরহ ঝগড়া করিয়া বেড়াইতাম। অপরদিকে মুসলমান সমাজের, বিশেষত, বাংলার মুসলমান সমাজের দুঃখ-দুর্দশা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা-কুশিক্ষা, অনাচার, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে দিন-রাত খিচ্‌-খি করিতাম।

মুসলমানদের এই সার্বিক অধঃপতনের জন্য আমি তাদের অহেতুক ধর্মীয় গোঁড়ামি, শরা-শরিয়তের নামে তাদের বাড়াবাড়ি ইত্যাদিকেই দায়ী করিতাম। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আত্মঘাতী মনে হইত মুসলমানদের পর্দা প্রথা ও ভিক্ষা-প্রথা।

.

. মুসলমানদের পর্দা-প্রথা

পর্দা-প্রথার কথাটাই আগে বলিতেছি। এই পর্দা-প্রথা মুসলমান সমাজকে পঙ্গু অথর্ব, অসভ্য ও কৃষ্টিহীন করিয়া রাখিয়াছে। নারী জাতির পর্দার কড়াকড়ির সমর্থনে দিন-রাত শত হাদিস-কোরআন আওড়ান হইতেছে। যেন একমাত্র পর্দা-প্রথার উপরই ইসলামের অস্তিত্ব নির্ভর করিতেছে। অথচ কার্যত এই পর্দা-প্রথা শিক্ষিত উচ্চ ও মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। চাষি-শ্রমিক, কুলি-মজুর ও ভিক্ষুক যারা মুসলমান সমাজের বিপুল মেজরিটি, তাদের মধ্যে। পর্দা-প্রথা নাই। এ সম্বন্ধে আলেম সম্প্রদায়ের মনোভাব অদ্ভুত। একজন মধ্যবিত্ত গৃহস্থ বা অফিসারের চৌদ্দ বছরের মেয়েকে পায় হাঁটিয়া বা রিকশায় চড়িয়া খোলামুখে স্কুলে যাইতে দেখিলে এঁরা ইসলাম গেল’ ইসলাম গেল’ বলিয়া আসমান-জমিন কাঁপাইয়া তুলিবেন। কিন্তু জুম্মাবারে বা ঈদের দিনে রাস্তা-ঘাটে হাজার হাজার আধ-ল্যাংটা ভিখারিনী মেয়েকে হৈ-হল্লা করিতে দেখিয়াও ইসলামের বিপদ সম্পর্কে এঁরা টু-শব্দটি করেন না। এঁদের ভাব গতিকের সহজ অর্থ এই যে মুসলমান মেয়েরা লাখে-লাখে রাস্তার বাহির হইয়া ভিক্ষা করিলেও ইসলাম নষ্ট হইবে না; কিন্তু দু-দশ জন মেয়ে স্কুলে-কলেজে গেলেই ইসলাম ধ্বংস হইবে। ফল হইয়াছে এই যে ইসলামি পর্দা উচ্চ ও মধ্য শ্রেণীর মধ্য সীমাবদ্ধ হইয়াছে। তা-ও আবার কিশোরী ও যুবতীদের মধ্যে। কেবলমাত্র এই শ্রেণীরই ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া শিখাইবার সংগতি আছে কৈশোর ও যৌবনই মধ্য ও উচ্চশিক্ষার সময়। কাজেই অবস্থাপন্ন মুসলমানরাও তাদের মেয়েদেরে লেখাপড়া শিখাইতে পারিতেছেন না। শিক্ষা ও অশিক্ষা দুইটাই জ্যামিতিক প্রগ্রেশনে বাড়িয়া যায়। মার শিক্ষাহীনতা এই নিয়মকে আরো জোরদার করিয়া থাকে। এই কারণে প্রতিবেশী সমাজের মোকাবিলা বাংলার মুসলমান সমাজ শিক্ষার দিকে, সুতরাং জীবনের সকল ক্ষেত্রে, জ্যামিতিক প্রগ্রেশনে তলাইয়া যাইতেছে। অথচ এত বড় সর্বনাশের হেতু যে পর্দা-প্রথা, সে পর্দার পর্দা তুলিয়া দেখা হইতেছে না ওটা কী বস্তু। পর্দা জারি করা হইতেছে যে হাদিসের নামে তাতে বয়স ও শ্ৰেণী-নির্বিশেষে সব নারীর কথাই লেখা হইতেছে। কিন্তু কার্যত দেখা যাইতেছে, ওটা শুধু ধনী যুবতীর জন্য। পর্দার জন্য বাড়ির চারিদিকে উঁচা প্রাচীর তোলা হইতেছে হাজার টাকা খরচ করিয়া। কিন্তু পাঁচ সিকার কাপড় দিয়া এই পর্দানশীনকে একটি কোর্তা পরান হইতেছে না। এইরূপ যুক্তিহীন স্ববিরোধী পৰ্দাই মুসলমান সমাজের অর্ধেক মানুষকে পঙ্গু, অসহায় ও পুরুষের কাঁধের বোঝ করিয়া রাখিয়াছে। এর জন্য দায়ী মোল্লাদের বিকৃত ইসলাম।

.

. ভিক্ষা-বৃত্তি

পর্দা সম্বন্ধে যা, ভিক্ষা সম্বন্ধেও তাই। দান-খয়রাত-চ্যারিটি-দক্ষিণা সব দেশে সব জাতির মধ্যেই আছে। কিন্তু মুসলমান সমাজে ঐ সব প্রথা ভিক্ষাবৃত্তি যে কুৎসিত কার্যের আত্মঘাতী রূপ ধারণ করিয়াছে, এমনটি দুনিয়ার আর কোথাও দেখা যাইবে না। এক পয়সা দান করিলে পরকালে সত্তর পয়সা পাওয়া যায়, ‘সায়েলকে কদাচ না বলিও না’, ‘ভিক্ষুক ভিক্ষা চাওয়ামাত্র তোমার ধন-সম্পদ ক্রোক হইয়া গেল, তাকে কিছু দিয়া সন্তুষ্ট না করা পর্যন্ত ঐ ক্রোক ছুটিবে না : দিনরাত এই ধরনের ওয়াস-নসিহতই মুসলমান সমাজের এই দুর্গতি ঘটাইয়াছে। গোড়াতে মোল্লারা নিজেদের অর্জিত জীবিকা নিশ্চিত করিবার জন্যই ভিক্ষাদানের উপকারিতার এই চমৎকার ও মনোহারিণী রূপ বর্ণনা করিয়াছিলেন। তখন তাঁদের আশা ছিল, তারা একাই এর ফল ভোগ করিবেন। কিন্তু পরিণামে তাঁদের এত শরিক জুটিয়া গিয়াছে যে বিপুল ভিড়ে তারা দাঁড়াইতে পারিতেছেন না। ফলে মুসলমান জাতির জন-বলের এক বিরাট অংশ নিষ্কর্মা, গলগ্রহ হইয়া গিয়াছে। এর জন্যও দায়ী মোল্লাদের বিকৃত ইসলাম।

এ অবস্থায় সকল বুদ্ধিমান মুসলমানই ইসলামকে এই সব আবর্জনা মুক্ত করিবার চেষ্টা করিবেন ইহাই স্বাভাবিক। এই শ্রেণীর লোককে ধর্ম সংস্কারক বলা হইয়া থাকে। খৃষ্টানদের মধ্যে মার্টিন লুথার, হিন্দুদের মধ্যে রামমোহন রায় ও স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী, মুসলমানদের মধ্যে স্যার সৈয়দ আহমদ, মওলানা সৈয়দ আহমদ বেরেলভী, সৈয়দ আমির আলী ও মির‍্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর নাম উল্লেখ করা যাইতে পারে। উহাদের মোকাবিলা আমি ক্ষুদ্রাদপি ক্ষুদ্র নগণ্য ব্যক্তি। সে কারণেই হউক, অথবা মত-বিভিন্নতার দরুনই হউক, আমার চিন্তা ওদিকে গেল না। আমার মন ও চিন্তা ঘুরিয়া ফিরিয়া ইসলামের চেয়ে মুসলমানদের দিকেই বেশি ঝুঁকিয়া পড়িল। এর অর্থ শেষ পর্যন্ত এই দাঁড়াইল যে আমি মুসলমানদের পরকালের ভাবনার চেয়ে ইহকালের ভাবনাই বেশি ভাবিতে লাগিলাম।

.

. মুসলিম-হিত বনাম হিন্দু-অহিত

মুসলমানদের এই হিত-চিন্তা কার্যত আমাকে অমুসলমানদের অহিতকামী করিয়া তুলিতেছে কিনা, তার পরীক্ষা অল্পদিনের মধ্যেই শুরু হইল। রাজনীতিতে আমি কংগ্রেসি ছিলাম। কংগ্রেসি হিন্দু বন্ধুদের কাছে আমার জাতীয়তাবাদ স্বভাবতই সন্দেহের ব্যাপার হইয়া দাঁড়াইল। আমার রাজনীতিক মতামত ও তার ক্রমবিবর্তনের কথা আমি অন্যত্র বলিয়াছি। এখানে শুধু এইটুকু বলিয়া রাখিতেছি যে মুসলমান সমাজের এই চরম অধঃপতিত অবস্থা আমাকে এ ব্যাপারে অতিশয় স্পর্শকাতর করিয়া ফেলিয়াছিল। ফলে প্রায়ই আমি বলিতাম : মুসলমানের এটা হইল, মুসলমানের ওটা হইল না ইত্যাদি। এতে হিন্দু বন্ধুরা খুব সংগতভাবেই মনে করিতে পারিত এবং করিত যে আমি সমস্ত রাজনৈতিক ব্যাপারও শুধু মুসলমানদের ভাল-মন্দের মাপকাঠি দিয়া বিচার করিয়া থাকি। কাজেই আমি আসলে সাম্প্রদায়িকতাবাদী, জাতীয়তাবাদী আমি নই। আমি হিন্দু বন্ধুদের এই সন্দেহের প্রতিবাদ করিতাম এবং আন্তরিকতার সাথেই করিতাম। হিন্দুর অহিত কামনা না করিয়াও মুসলমানের হিত কামনা করা যায়, সুতরাং নিজের সম্প্রদায়কে ভালবাসিয়াও জাতীয়তাবাদী হওয়া যায়, ইহাই ছিল আমার রাজনৈতিক মতবাদ। এ মতবাদ আমি জনাব মুজিবর রহমান সাহেবের নিকট শিখিয়াছিলাম। মৌলবী মুজিবর রহমান ও তার রাজনৈতিক মতবাদ সম্পর্কে আমি অন্য অধ্যায়ে আরো বিস্তারিত আলোচনা করিব। এখানে শুধু এইটুকু বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে, আমার মুসলিম-প্রীতির সঙ্গে ইসলাম-প্রীতির কোনও সম্পর্ক ছিল না। বস্তুত ইসলামের প্রতি আমার কোনও প্রীতিই ছিল না। কাজেই আমি হিন্দু ধর্মের প্রতি কোনও বিরূপ। ভাবও পোষণ করিতাম না। মানুষের দৈহিক ও মানসিক পরম কল্যাণই ধর্মের মূল উদ্দেশ্য। এই হিসাবে আমি ধর্মকে ঔষধের সাথে তুলনা করিতাম। মোটামুটি এখন পর্যন্ত আমার মত তাই। মাত্র চার-পাঁচ বছর আগেকার একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করিব।

.

. ইসলাম বনাম মুসলমান

ইসলাম ও মুসলমান সম্বন্ধে গভীর ও গুরুতর চিন্তা যারা করিয়া থাকেন। বন্ধুবর আবুল হাশিম তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর ক্ষুরধার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, বলিষ্ঠ চিন্তা ও জোরাল প্রকাশ-ক্ষমতা আমাকে মুগ্ধ করিয়াছে। তাঁর চিন্তায় ও আমার চিন্তায় আশ্চর্য রকম মিল রহিয়াছে। এই কথার উল্লেখ করিয়া একদিন। আমি হাশিম সাহেবকে তর্কে-তর্কে বলিয়াছিলাম : আপনার সাথে চিন্তায় আমার পনের আনা মিল থাকা সত্ত্বেও ঐ এক আনার কোথাও এমন একটা বুনিয়াদি বিরোধ আছে, যার ফলে আপনি ও আমি এক সাথে চলিতে পারি না। সেটা কি বলিতে পারেন?

হাশিম সাহেব সরলভাবে বলিলেন : প্রশ্নটা আমারও মনে জাগিয়াছে। কিন্তু কোনও উত্তর পাই নাই।

আমি বলিলাম : আমার মনে একটা উত্তর জাগিয়াছে।

কৌতূহলের সুরে হাশিম সাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন : কী বলুন ত।

আমি বলিলাম : আপনি ইসলামকে ভালবাসেন আমি মুলমানকে ভালবাসি।

হাশিম সাহেব প্রথমে একটু হতভম্ব হইয়া গেলেন। খানিকক্ষণ পরে বলিলেন : আপনি আমাকে চিন্তায় ফেলিয়াছেন। আজ এ কথার উত্তর দিতে পারিলাম না। পরে দিব, কিছুদিন পরে হাশিম সাহেব আমাকে বলেন : আপনার ঐ কথার জবাব দিবার জন্য আপনাকে কিছুদিন যাবৎ তালাশ করিতেছি। এইবার জবাবটা নিন।

আমি বলিলাম: দেন।

হাশিম সাহেব প্রতি কথায় জোর দিয়া বলিলেন : আমি যে শুধু মুসলমানদের ভালবাসি না তা নয়, আমি তাঁদেরে ঘৃণা করি।

আমি হাশিম সাহেবের উষ্ণতায় হাসিয়া বলিলাম : তা হইলে দাঁড়াইতেছে। এই যে, আপনি ঔষধটাকেই ভালবাসেন, রোগীকে আপনি ঘৃণা করেন।

হাশিম সাহেব অসাধারণ প্রত্যুৎপন্নমতির লোক। তিনি আমার উপমা গ্রহণ করিয়া বলিলেন : যে রোগী ইসলামের মত এমন মূল্যবান ঔষধ নষ্ট করিয়াছে, তাকে ঘৃণা করিব না ত কী করিব?

আমি নিশ্চিত জয়ের আশায় বলিলাম : ঔষধ-মূল্যবান কি না, তার, পরিচয় রোগ নিরাময়ে।

কিছুমাত্র না দমিয়া হাশিম সাহেব বলিলেন : যে উন্মাদ রোগী ঔষধে ভেজাল দিয়া খায়, তার রোগ না সারিলে কি ঔষধের দোষ?

হাশিম সাহেবকে তর্কে হারান খুব শক্ত কাজ। কাজেই সেদিন আমিই হারিলাম।

.

১০. ধর্ম ও ঔষধ

কিন্তু হাশিম সাহেবের কথা ঠিক নয়। তাঁর ঐ কথা লা-জবাব নয়। কারণ রোগী যে ঔষধে ভেজাল মিশাইয়া ডাক্তারকে ফাঁকি দেয়, এটাও তার একটা রোগ। এ রোগও সারাইতে হইবে ঔষধ দিয়াই। রোগীর দোষ দিয়া ঔষধের তারিফ করিতে পারে কেবলমাত্র ঔষধ-ব্যবসায়ী। ঠিক তেমনি যে ধর্ম যত বেশি মানুষের যত বেশি কল্যাণ করিতে পারিল, আমার বিবেচনায় এবং নিরপেক্ষ সকলের বিবেচনায়, সেই ধর্মই শ্রেষ্ঠ ধর্ম। কিন্তু ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব-নিকৃষ্টত্ব বিচার আমার কাজ নয়। আমার একমাত্র চিন্তা আমার রোগী। আমার একমাত্র কামনা তার রোগ সারা। যে ঔষধ খাওয়াইলে আমার রোগী ভাল হয়, সেই ঔষধই খাওয়াইব। যদি ওভার মেডিক্যাটেড হইয়া যাওয়ার দরুন রোগ জটিল হইয়া থাকে, তবে ঔষধ খাওয়ান বন্ধ করিব। ঔষধের জন্য রোগী নয়, রোগীর জন্যই ঔষধ। ঠিক তেমনি, এ কথাও সর্বজনস্বীকৃত। যে ধর্মের জন্য মানুষ নয়, মানুষের জন্যই ধর্ম। যে ঔষধ রোগীর কাজে লাগিল না, তা যেমন বর্জনীয়; তেমনি, যে ধর্ম মানুষের কল্যাণ করিল না, তা বর্জনীয়।

.

১১. শাঁস ও খোসা

কিন্তু ঔষধের সঙ্গে ধর্মের তুলনা মাত্র একদিক হইতে সত্য। উপাদান ও অনুপান লইয়াই ঔষধ। ঐসব উপাদানের সবগুলিই ফান্ডামেন্টাল। তার কোনও একটা বাদ দিলে ঔষধ আর ঔষধ থাকিবে না। তেমনি বিশ্বাস ও ক্রিয়া-কর্ম লইয়াই ধর্ম। কিন্তু সে বিশ্বাস ও ক্রিয়া-কর্মের সবগুলি ফান্ডামেন্টাল নয়। একমাত্র সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসই ধর্মের ফান্ডামেন্টাল। বিশ্বাসের অবশিষ্ট অংশ এবং সমস্ত ক্রিয়া-কর্মই ধর্মের অনুষঙ্গ মাত্র। এগুলিকে ঔষধের অনুপানের সঙ্গে তুলনা করা যাইতে পারে। রোগী-ভেদে ও রোগীর দেশ-ভেদে এইসব অনুপান ইতর-বিশেষ করা যাইতে পারে এবং করা উচিতও। ঠিক তেমনি মানুষের দেশ ও অবস্থাভেদে ধর্মের এইসব নন ফান্ডামেন্টাল অনুপানগুলির ইতর-বিশেষ করা যাইতে পারে এবং করা উচিতও। এই দিক হইতে বিচার করিলে খোরাক, পোশাক, নাম-নিশানা, উপাসনা-প্রণালি, পার্সনাল ‘ল’, এ সমস্ত ধর্মের নন-ফান্ডামেন্টাল। ধর্মের মূল ঈমানের সাথে-সাথে এসব নন-ফান্ডামেন্টালকেও যদি সকল দেশের সকল যুগের সকল বিশ্বাসীদের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়, তবে সেটা হইবে অবাস্তব ও ইমপ্র্যাকটিক্যাল। তাতে অনাবশ্যকরূপে ঐ ধর্ম হইতে মানুষকে এবং মানুষ হইতে ধর্মকে দূরে রাখা হইবে; অনাবশ্যককে অত্যাবশ্যক ঘোষণা করিয়া ঐ ধর্মকেই লোক-চক্ষে হেয় করা হইবে। একটা ছোট দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। যদি বলা হয়, খোরমা না খাইলে বা দাড়ি না রাখিলে কেউ মুসলমান হইতে পারিবে না; অথবা যদি কেউ বলে, গলায় টাই না বাধিলে বা ক্রস না ঝুলাইলে কেউ খৃষ্টান হইতে পারিবে না; কিম্বা যদি বলা হয় টিকি না রাখিলে বা গলায় রুদ্রাক্ষের মালা না পরিলে কেউ হিন্দু হইবে না, তবে তাতে যথাক্রমে ইসলাম, খৃষ্টধর্ম ও হিন্দুধর্ম হইতে ঐ ঐ ধর্ম-বিশ্বাসীদেরে অনাবশ্যকরূপে দূরে ঠেলিয়া রাখা হইবে। এইসব পোশাক-পাতি ও আচার ব্যবহারের মতই উপাসনা-প্রণালিও ধর্মের নন-ফান্ডামেন্টাল। গির্জা, মন্দির মসজিদকে সৃষ্টিকর্তার একমাত্র উপসনাস্থল মনে করাও তেমনি অনাবশ্যককে অত্যাবশ্যক গণ্য করা। এ সব যারা করেন, তাঁরা নিজের ধর্মের মান-মর্যাদা না বাড়াইয়া হীন করিয়াই থাকেন।

আমার মনে হয়, মুসলমানদের ধর্মীয় নেতারাই এই ধরনের ভুল করিয়াছেন সবচেয়ে বেশি। এঁরা নামাজ-রোযা, অযু-গোসল ও তসবিহ তেলাওয়াতকে ধর্মের ফান্ডামেন্টাল খাড়া করিয়া ঐ সব দিয়া মুসলমানদেরে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধিতে চেষ্টা করিয়াছেন। এটা করিতে গিয়া তারা নিজেদের যুক্তির ফাঁদে নিজেরাই ধরা পড়িয়াছেন। যার ফলে নামাজে বুকের উপর ও নাভির নিচে তহরিমা বাঁধা লইয়া, যানাযার নামাজে মাইয়াতের বুক বরাবর বা শির বরাবর দাঁড়ান লইয়া, বার-তকবির ছয়-তকবির লইয়া, জোরে বা আস্তে আমিন বলা লইয়া মুসলমানে-মুসলমানে খুনাখুনি ঘটাইয়াছেন। এর প্রতিকার একমাত্র টলারেন্স। কিন্তু টলারেন্সকে এরা ভয় পান এই জন্য যে, তাতে ধর্ম থাকে বটে, কিন্তু ধর্মীয় দল থাকে না।

.

১২. ধর্ম বনাম ধর্মীয় দল

অতএব দেখা যাইতেছে, মুসলমানদের মধ্যে যে ধর্মীয় কড়াকড়ি সেটা ইসলামের খাতিরে নয়, মযহাব বা ধর্মীয় দলের খাতিরে। আমার চাচাজীর মত সব খাঁটি মুসলমানরাই মনে করেন, তাঁর নিজের মযহাব না টিকিলে ইসলাম টিকিবে না। ফলে সব মযহাবের মুসলমানরাই অন্য মযহাবের মুসলমানদের মোকাবিলায় নিজেদেরই ইসলামের একমাত্র রক্ষক মনে করিয়া থাকে।

ঠিক তেমনি বড় বড় সব ধর্মের উম্মতেরাই নিজেদেরে আল্লাহর বডিগার্ড মনে করিয়া থাকে। বৌদ্ধ, খৃষ্টান, ইসলাম ও হিন্দু ধর্ম এই চারটি ধর্মই বিশ্বের বড় ধর্ম। এই সব ধর্মের শাস্ত্রেই লেখা আছে : ‘ধর্মে যবরদস্তি নাই; ‘তোমার ধর্ম তোমার, আমার ধর্ম আমার। অথচ এই উচ্চস্তরের নৈতিক শিক্ষা সত্ত্বেও ধর্মে-ধর্মে যুদ্ধ-বিগ্রহ চলিতেছে। কিন্তু এটাই এদেরে বড় দুর্বলতা নয়। এর চেয়েও বড় ত্রুটি এদের মধ্যে রহিয়াছে। সে ত্রুটি এই যে, বহু ধর্মের বিশ্বাসীরা মনে করে এদের অন্তর্ভুক্ত যারা নয়, তারা সবাই অর্ধামিক, কেবলমাত্র এরাই আল্লার রক্ষক। ভাবটা এই যে, এই সব ধর্ম না থাকিলে আল্লায় বিশ্বাসী আর কেউ থাকিবে না। বিশ্বাসী না থাকিলে কাজেই আল্লাও থাকিবে না।

.

১৩. ধর্ম বনাম আল্লাহ

কিন্তু এটা সত্য নয়। ধর্ম-বিশ্বাসের সঙ্গে আল্লা-বিশ্বাসের কোনও প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নাই। কোনও ধর্মে বিশ্বাস করিতে গেলে একজন সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করিতে হয় সত্য, কিন্তু একজন সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করিতে গেলেই একটি ধর্মে বিশ্বাস করিতেই হইবে, তার কোনও মানে নাই। ধর্ম ও আল্লার মধ্যে ফান্ডামেন্টাল পার্থক্য এই যে ধর্ম পরিবর্তনশীল, আল্লাহ শাশ্বত, তার কোনও পরিবর্তন নাই। সেজন্য ধর্ম অনেকগুলি, আল্লাহ এক। ধর্মকে রক্ষা করিতে হয় মানুষের, আল্লাহ নিজেকে নিজেই রক্ষা করেন। মানুষ ধ্বংস হইলে ধর্মের অবসান হইবে। কিন্তু আল্লাহ থাকিবেন। ধর্ম মনের জিনিস, আল্লাহ অন্তরের জিনিস। ধর্ম বুঝিতে হয় বুদ্ধি দিয়া, আল্লাহ অনুভব করিতে হয় অন্তর দিয়া। ধার্মিকরা যে মনে করেন, আল্লাহকে মানুষের মনে তাঁরাই জিয়াইয়া রাখিয়াছেন, এটা তাদের দেমাগ-তুকাব্বরি। এটা তাদের অহংকার। এ অহংকার নাস্তিকের অহংকারের চেয়ে কোনও অংশে কম দাম্ভিক নয়। আল্লার অস্তিত্ব এমনি একটা বস্তু যা সাধারণ মানুষ সব সময় দেখে না; শুধু বিশেষ অবস্থায় দেখিতে পায়। একটা মামুলি দৃষ্টান্ত দেই। সাহসী মানুষ ভয় কাকে বলে জানে না। কিন্তু ভয় বলিয়া কোনও বস্তু নাই, এ কথা সেও বলিতে পারে না। অবস্থা-বিশেষে খুব সাহসী মানুষও ভয় পায়। সাধারণ মানুষও শুধু অবস্থা-বিশেষেই আল্লাহকে দেখিয়া থাকে। আল্লাহ অরূপ, নিরঞ্জন, নিরাকার। কাজেই এই রূপহীন আল্লাকে মানুষ যার-তার অন্তরের ব্যাপ্তি দিয়াই অনুভব করিবে। যার-তার অন্তরের ব্যাপ্তির পরিধির সাথে মিল রাখিয়াই সেই অরূপ রতন রূপবিশেষে ধরা দিবেন। সে রূপ আসলে আল্লার রূপ নয়, দর্শকের সসীম অন্তদৃষ্টির ‘গোস্পদে বিম্বিত যথা অনন্ত আকাশ। আল্লাহ দার্শনিক জালালুদ্দিন রুমীর বিশাল অন্তরেও ধরা দিতে পারেন, তাঁর কল্পিত নাপিতের ছোট্ট অন্তরেও ধরা দিতে পারেন। এটাই আল্লার কুদরত, তার অপূর্ব মহিমা। এই মহিমার জোরেই তিনি সকল মানুষের মনে জাগ্রত আছেন। কোনো ধর্মের অনুগ্রহে বা প্রচার-বলে নয়।

কিন্তু সকল অবস্থায় মনে রাখিতে হইবে, ধর্মের সবচেয়ে বড় গুণ হইতে হইবে পরমতসহিষ্ণুতা। হইতে হইবে মানে ধর্ম-বিশ্বাসীদের আচার-ব্যবহারে প্রযুক্ত ও প্রকট হইতে হইবে। আমাদের কোরআন শরিফের দুইটি সুস্পষ্ট উক্তি: ‘ধর্মে কোনও যবরদস্তি নাই’ ও ‘তোমার ধর্ম তোমার, আমার ধর্ম আমার এই বাঞ্ছিত পরমতসহিষ্ণুতার অমর বুনিয়াদ। উক্তিদ্বয়ের যে মর্মার্থই যিনি করুন না কেন, তার মধ্যেও এই পরমতসহিষ্ণুতার নীতিই বলবৎ থাকিবে। ধর্মের ব্যাপারে যে কথাটা শাশ্বত সত্য এবং যে সত্যটা অভিজ্ঞতায় প্রমাণিত হইয়াছে, তা এই যে পরমতসহিষ্ণুতাই ধর্মের শক্তি, অসহিষ্ণুতাই তার দুর্বলতা।

কাজেই আমার মন বলিল, ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য অথবা তার ত্রুটি সংশোধনের জন্য সময় ও শ্রম নষ্ট না করিয়া মুসলমানদেরে কেমন করিয়া সাধু, সৎ ও সুন্দর মানুষরূপে গড়িয়া তোলা যায়, সেদিকে মনোযোগ দেওয়াই সৎ মুসলমানের প্রধান কর্তব্য।

.

১৪. মানব বনাম মুসলমান

আমার এই মতবাদ কি সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক নয়? শুধু মুসলমানদের কল্যাণ চিন্তা করার কারণ কী? অমুসলমানদের প্রতি কি আমার কোনও কর্তব্য নাই? কথাটা যে-কেউ বলিতে পারিতেন–কোনও অমুসলমান বন্ধু ত নিশ্চয়ই। কিন্তু এটা বলিলেন আমার বিশেষ অন্তরঙ্গ এক মুসলমান বন্ধুই। তিনি আমাকে কোনও জবাব দিবার সুযোগ না দিয়াই বলিয়া গেলেন : দেখ, তুমি একজন সাহিত্যিক, তুমি চিন্তাবিদ, আজীবন কৃষক-প্রজা আন্দোলন করিয়াছ। মযলুমের পক্ষে যালিমের বিরুদ্ধে জিভ ও কলম চালাইয়াছ। এই দেখিয়া আমার ধারণা হইয়াছিল, ধর্ম-সম্প্রদায়-নির্বিশেষে সকল মানুষেরই তুমি খাদেম, মানবতাই তোমার ধর্ম। কিন্তু আজ একটি কথা তোমার মুখে শুনিয়াতেছি?

কিন্তু আমার বন্ধু একা ছিলেন না। তাঁরা ছিলেন তিনজন। তিনজনের দুইজনই ধর্মবিরোধী। মানবপ্রেমী। ধর্মবিরোধী কথাটা ঠিক নয়। দুইজনই মানব-ধর্মী। তাদের কাছে হিউম্যানিযমই শ্রেষ্ঠ ধর্ম। একজন বিপ্লবী মুসলমান।

অসুবিধা এই যে আমি বন্ধুদের নাম উল্লেখ করিতে পারিতেছি না। তাঁরা যে পজিশন ও পরিবেশে আছেন, তাতে বোধ হয় এই ধরনের কথা সহকর্মীদের বলিতে পারেন না; বলিলে বোধ হয় তাঁদের অনিষ্ট হইতে পারে। তাই বোধ হয় তাঁদের রুদ্ধগতি স্বাধীন চিন্তার স্রোত বাঁধ ভাঙ্গিয়া আমাকে ভাসাইয়া নিবার উপক্রম করিয়াছে।

আমি তর্কে না নামিয়া বলিলাম : মানবপ্রেম অতি বড় কথা। মানবসেবা অতি বড় কাজ। সে কাজ শুরু করিবার আগে মুসলমানদের সেবার হাত মশ করিতেছি মাত্র। আর মানবধর্ম কথাটা অর্থহীন হিউম্যানিযম একটি মেটাফিজিকস মাত্র।

এইবার বন্ধু স্বরূপে প্রকাশ পাইলেন। বলিলেন : ইসলাম সম্পর্কে ভুল ধারণা হইতেই তুমি এ কথা বলিতেছ। ইসলামের ভ্রাতৃত্ব মুসলিম-ভ্রাতৃত্ব নয়, ওটা মোমিন-ভ্রাতৃত্ব। মুসলমান সমাজের বাহিরেও মোমিন আছে এবং আমার অভিজ্ঞতা হইতেই বলিতেছি, অমুসলমান মোমিনের সংখ্যাই বেশি।

আমি হাসিয়া বলিলাম : আমিও তোমার পথেরই পথিক। তুমিও বিপ্লবী নও রিফর্মিস্ট, আমিও তাই। তোমার চিন্তার ক্ষেত্রও সীমাবদ্ধ, আমারও তাই। তুমি ইসলামকে সংশোধন করিতে চাও, আমি মুসলমানকে সংশোধন করিতে চাই। ইসলামকে সংশোধন করিতে পারিলে তার পরে তুমি অন্য ধর্ম সংশোধনে হাত দিবা। মুসলমানকে সংশোধন করিতে পারিলে পরে আমিও অন্যান্য ধর্মের লোকদেরে সংশোধন করিতে চেষ্টা করিব। কেতাব সংশোধনের চেয়ে মানুষ সংশোধন, মনের চিকিৎসার চেয়ে দেহের চিকিৎসাই অনেক ছোট ও সহজ কাজ বলিয়াই আমি এ কাজ করিতে চাই। বড় কাজকে সত্যই বড় কাজ মনে করি বলিয়াই প্রথম চোটেই তাতে হাত দিতে সাহস পাই না।

বন্ধুরা সমস্বরে বলিলেন : কিন্তু যত ছোট এলাকা লইয়াই তুমি সেবার কাজ শুরু কর না কেন, তোমার সেটা শুধু মুসলমানদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখিবে কেন?

আমি জবাব দিলাম : মুসলমানরাই সবার থনে বেশি নির্যাতিত, নিপীড়িত, দরিদ্র ও নিরক্ষর বলিয়া সেবার প্রয়োজন তারারই বেশি।

সকলে মাথা নাড়িয়া বলিলেন : অমুসলমানদের মধ্যে দরিদ্র, নির্যাতিত, নিরক্ষর লোক নাই বলিতে চাও?

আমি : নিশ্চয়ই আছে। নাই বলিব কেন? তবে তাদের মধ্যে সেবক ও সংস্কারকও আছেন অনেক। তাঁদের মধ্যে রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, মহাত্মা গান্ধী ও প্রফুল্ল চন্দ্র আছেন অনেক। তাদের শিক্ষা-স্বাস্থ্যের জন্য দান করিবার মত দাতাও আছেন বেশ কিছু।

তাঁরা : আমাদের মধ্যেও ত ধনী আছেন, তাঁরাও ত দান-খয়রাত করেন?

আমি : আছেন। কিন্তু তারা তোমাদের মতই ইসলাম সংস্কার লইয়া ব্যস্ত। মুসলমানদের কল্যাণের কথা তারা ভাবেন না। তাঁরা মসজিদ নির্মাণে তাদের টাকা ব্যয় করেন যাতে মুসলমানরা বেহেশতে যাইতে পারেন। মুসলমানদের শিক্ষা-স্বাস্থ্যের জন্য তারা স্কুল-কলেজ ও হাসপাতাল দাওয়াখানার টাকা খরচ করেন না।

তাঁরা : কেন হাজী মোহাম্মদ মহসিন?

আমি: এবার তোমরা ঠিক কথা বলিয়াছ। যে কারণে হাজী সাহেব মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষা প্রসারের জন্য সম্পত্তি ওয়াফ করিয়া গিয়াছেন, ঠিক সেই কারণে আমিও আমার নিজের কর্ম-শক্তিতে মুসলমানদের সেবায় লাগাইবার দায়িত্ববোধ করিতেছি। আমার এই মুসলিম-প্রীতির মধ্যে হিন্দু বিদ্বেষ নাই, সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতাও নাই। প্রধানত মুসলমানদের সেবা করিতে গিয়া যদি দেখি তাতে হিন্দুরও সেবা হইয়া যাইতেছে, তবে তাতে সুখীই হইব। হাজী মহসিনের টাকায় হিন্দুদের ‘ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র’ও শিক্ষা লাভ করিয়াছিলেন। আমরা যখন কৃষক-প্রজা আন্দোলন শুরু করি, তখন আমাদের সামনে ছিল মুসলমান রায়তরাই। কিন্তু পরিণামে হিন্দুরাই তার ফল ভোগ করিয়াছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *