১০.
ডাক্তার বললেন, আমার খুব ছেলেবেলায় এ বাড়ির দু তিনজন অতি বৃদ্ধ মুরুব্বির কোলে বসে তাঁদের আদর পেয়েছি, আর মনে আছে, আমাকে আদর করতে করতে হঠাৎ তারা কেঁদে ফেলতেন। আমি তখন এই বিরাট বাড়ির বিরাট গোষ্ঠীর একমাত্র সন্তান। আপনি যে-সব প্রশ্ন শুধালেন, এর অধিকাংশের উত্তর এই মুরুব্বিরা নিশ্চয়ই জানতেন, কিন্তু আমি তখন এতই অবোধ শিশু যে আমাকে তারা প্রাচীন দিনের কোনও কাহিনীই বলেননি।
একটু অপ্রতিভ হাসি হেসে বললেন, কিন্তু এই বৃদ্ধেরা একটা গভীর পরিতৃপ্তি সঙ্গে নিয়েই ওপারে গেছেন। ওই নিতান্ত শিশুবয়সেই আমি ওঁদের নামাজের সময় তাদের পাশে দাঁড়িয়ে, বসে, সজদা দিয়ে তাঁদের অনুকরণ করতুম, তাঁদের কোলে বসে মসজিদে যেতুম, আর বাড়িতে শিরনি বিলোবার সময় সদর দরজায় তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতুম। আমাকে তারা তখন একটা খুব উঁচু কুর্সিতে বসিয়ে জমায়েত গরিব দুঃখী, নায়েব-গোমস্তা সবাইকে বলতেন, ইনিই বাড়ির মালিক; এঁর হুকুমমতো চললে আমাদের দোওয়া তোমাদের ওপর থাকবে। আর সবচেয়ে মজার কথা কি জানেন, সৈয়দ সাহেব, আমার আপন ঠাকুদ্দার বড় ভাইসাহেব, যিনি তখন বাড়ি চালাতেন, তিনি প্রায় প্রতিদিন আমার পড়ার ঘরে এসে বলতেন ভাইয়া, শোনো। মির্জাপুর (উনি অবশ্য মীরজাফর-ই বলতেন) অঞ্চলে আজ আরেকটা বাড়ি কেনা হল। ঠিক আছে তো? কিংবা ওই ধরনের ব্যবসায় সংক্রান্ত কিছু-একটা। আজ ওই ছবিটা যখন চোখের সামনে ভেসে ওঠে তখন হাসি পায়। ঠাকুদ্দা খবরটা দেবার সময় ভাবখানা করতেন, যেন তিনি আমার নায়েব, কিছু একটা করে এসে হুজুরের পাকা সম্মতি চাইছেন! এরকম একাধিক ছবি আমার চোখের সামনে এখনও আবছা-আবছা ভাসে।
ছ মাসের ভিতর তিন ঠাকুদ্দাকেই গোরস্তানে রেখে এলুম। আমার তখনকার শিশুমনের অবস্থা আপনাকে বোঝাবার চেষ্টা করব না।
ওই যে পুরো একটা উইং জুড়ে রোজ সন্ধ্যায় সাজানো-গোছানো ঘরে আলো জ্বলে তাঁরা ওইখানে বাস করতেন, তাঁদের আপন আপন শ্বশুরবাড়ির কিংবা ওই ধরনের কিছু কিছু জ্ঞাতি-গোষ্ঠী নিয়ে। বহু বৎসর পরে আমাদের প্রাচীন দিনের নায়েব সাহেব আমাকে বলেন, ওই বুড়া ঠাকুদ্দারা তাদের মৃত্যুর বছরখানেক আগে কলকাতার অন্যত্র পুষ্যিদের জন্য ভালো ব্যবস্থা করে দেন, ঠাকুন্দারা নাকি চাননি যে তাঁরা এ বাড়িতে পরবর্তীকালে আমার কোনও অসুবিধার সৃষ্টি করেন।
আমি শুধালুম, এই নায়েব নিশ্চয়ই বৃদ্ধ বয়সে মারা যান। তিনি আপনাকে প্রাচীন দিনের কোনও কাহিনী বলেননি? পাড়ার আর পাঁচ বুড়ো?
কী করে বোঝাই, ডাক্তার সাহেব, বাপ-মা, আমার আপন ঠাকুন্দা নিয়ে চারজন ঠাকুদ্দা– আমার আপন ঠাকুদ্দা আর পাঁচজন চাচা মারা যান আমার জন্মের পূর্বে এদের সবাইকে হারিয়ে ছ বছর বয়েস থেকে আমি একা এই বিশাল বাড়িতে একা। শুধু নায়েব সাহেবের ক্ষুদ্র পরিবার এবং তাঁর এক বিধবা পুত্রবধূ- ইনিই আমাকে মানুষ করেন আপন ছেলের মতো করে। কিন্তু আমার এমনই কিস্মাৎ, এঁরাও সবাই চলে গেলেন ওপারে– ততদিনে আমি মেডিকেল কলেজের ফাইনাল ইয়ারে। বাকি রইলেন, শুধু আমার ওই মা-টি। তাঁকেও হারালুম এমন এক সময় যে আমি রাত্রে হাউ হাউ করে কেঁদেছি। এই মা আমার আত্মগোপন করে শহর-ইয়ারকে গোপনে দেখে এসে আমাকে বললেন, জুলফিকার, আমি নিজে দুলহিন দেখে তোর বিয়ে ঠিক করে এসেছি। এইবারে তুই রাজি হলেই আমি পাকা খবর পাঠাই। আমি জানতুম, ওই নিঃসন্তান বৃদ্ধার ওই একটিমাত্র শেষ শখ। তার সঙ্গে আমার কোনও রক্তসম্পর্ক নেই, সুদূরতম আত্মীয়তাও নেই, অথচ তিনি আমাকে দিনে দিনে মানুষ করে তুলেছেন সামান্যতম প্রতিদানের চিন্তা পর্যন্ত না করে– ঘোর নেমকহারামি হত এর শেষ আশা পূর্ণ না করলে। আর বিয়ে তো করতেই হবে একদিন– বংশরক্ষা করার জন্য, অন্য কোনও কারণ থাক আর নাই বা থাক্। বিয়ে না করলে আমার পিতৃপুরুষ পরলোক থেকে আমাকে অভিসম্পাত দেবেন, এ কুসংস্কার আমার নেই; কিন্তু তারা যতদিন এ লোকে ছিলেন ততদিন আমিই, একমাত্র আমিই যে তাদের শেষ আশা, আমিই তাঁদের বংশরক্ষা করব– সে আশা যে এ বাড়ির বাতাসের সঙ্গে গিয়ে মিশে প্রতি মুহূর্তে আমার প্রতিটি নিশ্বাসের সঙ্গে আমাকে প্রাণবায়ু দিচ্ছে। এক মুহূর্ত চিন্তা না করে সম্মতি দিলুম।
আমি শুধালুম, ইতোমধ্যে আপনি প্রেমেট্রেমে পড়েননি? কলকাতার ডাক্তারি শিক্ষাবিভাগ পাছে আমার বিরুদ্ধে মানহানির মোকদ্দমা করে তাই সভয়ে বলছি, অন্যদের তুলনায় প্রেমট্রেম করার সুবিধে আপনাদেরই তো বেশি। আর আপনার চেহারা, ধনদৌলত–।
হেসে বললেন, প্রেমট্রেম হয়নি তবে মাঝে মাঝে যে চিত্তচাঞ্চল্য হয়নি একথা অস্বীকার করলে গুনাহ্ হবে। তবে কি জানেন, আমি যে মুসলমান সে বিষয়ে আমি সচেতন এবং তাই নিয়ে আমার গর্ববোধ আছে। ওদিকে হিন্দুরা নিজেদের মুসলমানের চাইতে শ্রেষ্ঠতর মনে করেন। সেটা নিতান্তই স্বাভাবিক। প্রত্যেক জাতই একট্রিম এবনরমেল কন্ডিশন না হলে নিজেকে অন্য জাতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে করে। অবশ্য এসব বাবদে সম্পূর্ণ উদাসীন মহাজনও কিছু কিছু সবসময়ই পাওয়া যায়। আমার সহপাঠী-সহকর্মী প্রায় সবাই হিন্দু, কিছু কিছু অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান, যে দু একজন মুসলমান তারা থাকেন হোস্টেলে। কয়েকজন হিন্দুর সঙ্গে অন্তরঙ্গতা হয়– এখনও আছে এবং তারা অত্যন্ত সজ্জন বলে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে মা-বোনদের সঙ্গে আলাপও করিয়ে দেন। সেখানে প্রেম করে হিন্দু পরিবারে বিপর্যয় কাণ্ড বাধাবার কোনও বাসনাই আমার ছিল না– তদুপরি কোনও হিন্দু তরুণী যে আমার প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়েছেন সেটাও আমার গোচরে আসেনি।
আমি বললুম, অত অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা করে প্রেম হয় না। তার পর কী হল, বলুন।
ডাক্তার বললেন, পাক্কা হক্ কথা বলেছেন। আচ্ছা, তবে এখন পুরনো কথায় ফিরে যাই। বিয়ের সম্মতি পেয়ে আমার মা তো আসমানের চাঁদ হাতে পেলেন। বাড়ির লোকজন পাড়াপড়শি সবাইকে বারবার শোনান যা দিনকাল পড়েছে, আপন গর্ভের সন্তান মায়ের মরার সময় মুখে এক ফোঁটা জল দেয় না। আর আমার জুলফিকার একবার একটা প্রশ্ন পর্যন্ত জিগ্যেস করল না, দুহিন কোথাকার, লেখাপড়ি করেছে কি না, দেখতে কী রকম। বললে, মা, তুমি যখন পছন্দ করেছ, তখন নিশ্চয়ই ভালো হবে। আর সঙ্গে সঙ্গে সম্মতি দিল।
তার পর বুড়ির দিনগুলো কাটল বিয়ের ব্যবস্থা করতে।
আমাদের বিয়ের ঠিক সাত দিন আগে তিনি হার্টফেল করে বিদায় নিলেন।
ডাক্তার অনেকক্ষণ ধরে চুপ করে থাকার পর বললেন, হ্যাঁ, ওই প্রাচীন যুগের নায়েব সাহেবের কথা হচ্ছিল যিনি যখের মতো এ গোষ্ঠীর বিষয়-সম্পত্তি জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আগলিয়েছেন। তিনি নিশ্চয়ই অনেককিছু বলতে পারতেন, কিন্তু বলেননি কারণ আমার দিক থেকে তিনি কখনও কণামাত্র কৌতূহল দেখতে পাননি। আর তিনিই-বা এসব কথা আমার স্মরণে এনে কী আনন্দ পাবেন? ঠাকুদ্দাদের বয়েসী নায়েব সাহেব আমার ঠাকুদ্দার বাবাকেও তার ছেলেবেলায় দেখেছেন, তাঁর জন্ম হলে নাকি আকবরি মোহর দিয়ে তিনি তার মুখ দেখেছিলেন। কারণ তার বাপ ছিলেন আমার ঠাকুন্দার ঠাকুর্দার নায়েব। এবং সেই ঠাকুদ্দার ঠাকুদ্দার আব্বা বানান এই বাড়িটা। তিনি তার ভাই বেরাদর ভাতিজা ভাগিনা, আপন এবং ভাই-ভাতিজাদের শালা-শালাজ জ্ঞাতি-গোষ্ঠী পুষ্যি, মসজিদের ইমাম সায়েব, মোয়াজ্জিন (যে আজান দেয়), পাশের মকতবের গোটা চারেক মৌলবি মকতবটা বহুকাল উঠে গেছে বিষয়-আশয় দেখবার দু পাঁচজন কর্মচারী, ডজনখানেক মাদ্রাসার গরিব ছাত্র নিয়ে এ বাড়িতে থাকতেন। এইটুকু ভাসা-ভাসাভাবে শুনেছি।
কিন্তু মোদ্দা কথা এই : ঠাকুদ্দাদের গোর দেবার সময় আমার অতীত এবং এ বাড়ির অতীতকেও আমি যেন আমার অজান্তে সঙ্গে সঙ্গে গোর দিলুম। বুদ্ধিসুদ্ধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার অতীতের প্রতি কৌতূহল, আকর্ষণ দুটোই যেন আরও নিভে যেতে লাগল, বরঞ্চ উল্টো অতীতের প্রতি যেন আমার একটা রোষ জন্মাল। মনে হল সে আমার প্রতি ভয়ঙ্কর অবিচার করেছে। আমাকেও তো সে অনায়াসে মেরে ফেলতে পারত। আমি কি তার যক্ষ যে এ বাড়ি ভূতের মতো আগলাব?
আমার মনে হয়, বুড়ো নায়েব এবং পাড়ার পাঁচবুড়ো আমার চোখেমুখে অতীতের প্রতি আমার বিতৃষ্ণা দেখতে পেতেন এবং তাই স্বেচ্ছায় ওই পাঁক ঘ্যাঁটাতেন না।
আর বলতে গেলে তারা বলবেনই-বা কী? সেই ১৮২৫-এর গমগমে বাড়ি কী করে একজনাতে এসে ঠেকল। একজন একজন করে সক্কলের বংশলোপ পেল– এ ছাড়া আর কী? আপনিই বলুন, সে-সব শুনতে কার ইচ্ছে যায়?
তবে হ্যাঁ, কারও যদি ইচ্ছে যায় পুরো ইতিহাসটা গড়ে তোলবার, তবে সে সেটা করতে পারে কিন্তু বিস্তর তকলিফ বরদাশত করার পর। নিচেরতলায় এল উইঙের শেষ দু খানা ঘরে আছে, যাকে বলতে পারেন আমাদের পারিবারিক আরকাইভ অর্থাৎ মহাফেজখানা। ১৭৮০ বা ৯০ খ্রিস্টাব্দ থেকে আজ পর্যন্ত যেমন যেমন দলিল-দস্তাবেজ, চিঠিপত্রের আদান-প্রদান, জমা-খরচের হিসেব-নিকেশ, কর্মচারীদের রিপোর্ট, মোকদ্দমা সংক্রান্ত কাগজ এবং আরও শত রকমের ভিন্ন ভিন্ন কাগজপত্র, টুকিটাকি প্র্যাকটিক্যাল কারবার-ব্যবসায়ের জন্য বেকার হয়ে গেল, সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো রেখে দেওয়া হয় ওই দু খানা ঘরে। বেশ যত্নের সঙ্গেই রাখা হয়েছে, এবং পুরুষানুক্রমে নায়েবরাও সেগুলোর যত্ন নেন। শহর-ইয়ারও মাস তিনেক অন্তর অন্তর সেগুলোর তদারক করে। আমার লজ্জা পাওয়া উচিত, আমার কিন্তু মাষা পরিমাণ দিল-চপি এসব কাগজপত্রের প্রতি নেই।
আমি চুপ করে ভাবলুম এবং ডাক্তারকে মোটেই কোনও দোষ দিতে পারলুম না। যে অতীত তাঁর গোষ্ঠীর সবকিছু নির্মমভাবে কেড়ে নিয়েছে তাকে আবার যত্নআত্তি করে পুঁথির পাতায় লেখার কী প্রয়োজন? এবং এর সঙ্গে আরেকটা তত্ত্ব বিজড়িত আছে। পরিবারের অতীত ইতিহাস নিয়ে যারা নাড়া-চাড়া করে তাদের বেশিরভাগই কেমন যেন পূর্ব ইতিহাসের স্মরণে বেশকিছুটা দম্ভী হয়ে যায়। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে আমাদের ডাক্তার তো ফকির, সুফির বিনয় আচরণ ধরেন, সংসারে থেকে, গৃহীরূপে।
একটু প্র্যাকটিক্যাল বুদ্ধি দেখিয়ে শুধালুম, এই যে শূন্য অন্ধকার একতলা, দোতলার একটা পুরো উইং, তেতলা–এগুলোর একটা ব্যবস্থা করেন না কেন?
কী ব্যবস্থা? ভাড়া দেওয়া ছাড়া আর গতি কী? কলকাতায় আমার যেসব বাড়ি ভাড়ায় খাটছে তার আমদানিই আমাদের দু জনার পক্ষে যথেষ্টেরও ঢের ঢের বেশি। পরিবার যে অনতিবিলম্বে বৃহত্তর হবে তার সম্ভাবনাও তো দেখছিনে।
এর পর ডাক্তার কী বলেছিলেন সেটা আমি সম্পূর্ণ মিস করলুম, কারণ আমার মনে তখন অদম্য ইচ্ছা যে তাঁকে শুধাই : দশ বছর হল তাদের বিয়ে হয়েছে, এখনও কোনও বংশধর না আসার কারণ কী? তিনি স্বয়ং ডাক্তার, তিনি তো সর্বশ্রেষ্ঠ বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নিতে পারেন, প্রয়োজন হলে বিদেশে যেতে পারেন, কিন্তু ইচ্ছেটা অতি কষ্টে দমন করলুম। আমি ভীরু; যদি কোনও অপ্রিয় সংবাদ শুনতে হয়।
আবার কান পেতে শুনলুম, বলছেন, অতি বিশ্বস্ত আমাদেরই প্রাচীন নায়েব বংশের ছেলে এখন নায়েব আছেন, কর্মচারীরাও বিশ্বস্ত, তবু আমার জান পানি পানি। নায়েবকে আমি সর্ব ডিসিশন নেবার ভার কমপক্ষে সাতান্নবার বলেছি, বিরক্ত হয়ে কাগজ লিখে ডাকে তার বাড়িতে পাঠিয়েছি। কোনও ফল হয়নি। সে কাজ করে যায় তার আব্বার কাছ থেকে ঐতিহ্যগত যে পদ্ধতিতে কাজ শিখেছে। দু দিন অন্তর অন্তর এ বাড়িতে এসে সভয় নয়নে উঁকিঝুঁকি মারে– হুজুরকে কখন বিরক্ত না করে দুটো ডিসিশন ফাইনেলাইজ করে নেওয়া যায়। এই উঁকিঝুঁকিটা আমাকে বিরক্ত করে আরও বেশি। আমি কি বাঘ, তাকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলব! যদ্দিন তার বাপ বেঁচেছিলেন, আমি ছিলুম সুখে। সপ্তাহে একদিন এসে দশ মিনিট ধরে গড়গড় করে যা কিছু করেছেন সেগুলো বলে নিয়ে শুধোতেন, ঠিক আছে তো, মিয়া? অনেকটা আমার সেই ঠাকুন্দার রিপোর্ট দেওয়ার মতো। অবশ্য প্রায় দুটি বচ্ছর সর্ব আপত্তি, প্রতিবাদ, চিৎকার সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে, বলতে গেলে প্রায় আমার কানে ধরে সব কটা বাড়ি বার বার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখিয়েছেন, সব কাজ শিখিয়েছেন। ওইসব বাড়ি আর তাদের ভাড়াটে আমার জন্য দুনিয়ার দোজখরূপে অবতীর্ণ হয়েছেন।
এখন যদি একতলা আর তিনতলাটা ভাড়া দিই তবে সেটা খাল কেটে ঘরে কুমির আনা নয়, সেটা হবে ক্লাইভ এনে ব্রিটিশ রাজত্ব স্থাপন করা। সিরাজ-উদদৌলার মতো আমার মুণ্ডটি যাওয়াও বিচিত্র নয়।
অন্য কোনও ব্যবস্থার কথা যে একেবারেই ভাবিনি তা নয়, কিন্তু আমার সময় কোথায়?
.
১১.
আল্লাতালা যাকে খুশি তোলেন, যাকে খুশি নামান– এ সত্যটি পাপীতাপী আমরা প্রায়ই ভুলে যাই।
ডাক্তারের ভাগ্নির বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে। তার অবতরণিকায় যে কৃতিত্ব সব-কিছু দুরুস্ত-সহি করেছিলুম তাই নিয়ে বেশ একটু আত্মপ্রসাদ–এমনকি দম্ভ বললেও বাড়িয়ে বলা হয় না– অনুভব করছিলুম। অবশ্য বরপক্ষ যদি একটুখানি লড়াই দিত তা হলে তাদের ঘায়েল করে কৃতিত্ব ও আত্মপ্রসাদ হত পরিতৃপ্তি ভরা। তা ওরা যদি লড়াই না দেয়, তবে আমি তো আর ডকুইকসটের মতো উইন্ডমিল আক্রমণ করতে পারিনে!
কিন্তু শুয়ে শুয়ে সব-কিছু বিচার-বিবেচনা করার পরও যে সুখ পাচ্ছিলুম, সেটা অস্বীকার করব না।
এমন সময় মুচকি মুচকি হেসে শহর-ইয়ার খাটের পৈথানে দাঁড়াল।
বিজয়ী সেনাপতি যেরকম পদাতিকের প্রতি প্রসন্ন দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, আমিও ঠিক তেমনি শহর-ইয়ারকে যেন মেহেরবানি মন্জুর করে বললুম, বসতে পারেন।
তার পরই ফাটল আমার ঢাউস বেলুনটা!
শহর-ইয়ার হসিমুখে বললে, বলুন তো, আমরা কতবার আলোচনা করেছি– মুসলমান মেয়েদের পর্দার আড়াল থেকে বেরুনো নিয়ে। পাল্লায় তুলেছি একদিকে সুবিধাগুলো, অন্যদিকে অসুবিধাগুলো এবং যেহেতু আমরা উভয়ই শেষত্তিত ইমানদার সদাগর তাই কখনও আপনি বাটখারার পর বাটখারা চাপিয়ে গেছেন একদিকে, আমি আর অন্য পাল্লায় চাপিয়ে গেছি মালের পর মাল। তার পর হয়তো আপনি চাপিয়েছেন মাল আর আমি বাটখারা। তার অর্থ, আমাদের আলোচনার স্বপক্ষে বিপক্ষে যা যা যুক্তি আমরা বের করেছি কেউ কোনওটা লুকিয়ে রাখিনি। নয় কি?
আমি বললুম, নিশ্চয়ই। এ নিয়ে তো আমরা কেউ কোনওপ্রকারের সন্দেহ এযাবৎ প্রকাশ করিনি। আপনার মনে কি কোনও সন্দেহের উদয় হচ্ছে!
শহর-ইয়ার জিভ কেটে বললে, উপরে আল্লা; সন্দেহের অবকাশ নেই।
আমি শুধু এসেছিলুম আরেকটি অতি সদ্য আবিষ্কৃত যুক্তি নিয়ে যেটা মুসলমান মেয়েদের অন্দর-ত্যাগের সপক্ষে যায়। আপনি তো সেদিন আমাদের ভাগ্নির জন্য অবিশ্বাস্য অঙ্কের স্ত্রীধন, প্রচুর গয়না, এমনকি শেষ পর্যন্ত আইনে টেকে কি না টেকে এমন একটি শর্তও ভাগ্নির সুবিধার জন্য আপনার সুললিত রসনা সঞ্চারণ করে বিস্তর দৌলত জয় করে, রূপকার্থে বলছি, লোহার সিন্দুকে তুলে রাখলেন। আপনার ডাক্তার সে কেরানি দেখে অচৈতন্য। পাছে আপনার ন্যাজ মোটা হয় তাই তার সবিস্তর প্রশস্তিগীতি আর গাইব না। তবে একটি বাক্য আপনাকে শোনাই। তিনি বললেন, এরকম মধুর, ললিত বিদগ্ধ ভাষা ব্যবহার করে মানুষ যে নিষ্ঠুর কাবুলিওলার মতো তার প্রাপ্যের অগুনতি গুণ বেশি চাইতে পারে– এ আমি স্বকর্ণে না শুনলে কখনও বিশ্বাস করতুম না। তা সে যাক্। এইবারে আসল তত্ত্বটি অবহিত চিত্তে শ্রবণ করুন।
আমাদের ভাগ্নি তো তার প্রাচীনপন্থি চাচার সঙ্গে ঝগড়া-কাজিয়া করে যেতে আরম্ভ করল কলেজে অবশ্যই কালো তাবু নামক বোরকা সর্বাঙ্গে লেপ্টে নয়। মেয়েটি যে বেহেশতের হুরীর মতো খাপসুরত, তা নয়– তবে সুশ্রী, স্বাস্থ্যবতী আর চলাফেরায়, কথাবার্তা বলায় হায়া-শরম আছে। লেখাপড়ায় খুব ভালো, প্লেস পাবার সম্ভাবনাও কিছুটা আছে, এবং গোঁড়া চাচাটিকে না জানিয়ে হিন্দু বান্ধবীদের বাড়িতে রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুল ইসলাম ও অতুলপ্রসাদের গানও বেশ খানিকটে আয়ত্ত করে ফেলল। গলাটি মিষ্টি, তাই গানের ভুলচুকগুলো ওরই তলায় চাপা পড়ে যায়। চাচাটি অবশ্য এসব কীর্তিকলাপের কিছুই জানেন না, শুধু মাঝে মাঝে দেরিতে বাড়ি ফিরলে একটু-আধটু চোটপাট করেন। তা-ও খুব বেশি না, কারণ তিনি কখনও কলেজে পড়েননি, তদুপরি কুনো মানুষ তাই কলেজের কায়দা-কেতা, এমনিতে কখন কলেজ ছুটি হয়, ফাশন থাকলেই-বা কখন, সে-বিষয়ে সম্পূর্ণ বে-খবর।
কিন্তু বাদবাকি দুনিয়াটা তো আর বেখেয়াল নয়। একটি এম.এ. ক্লাসের ছেলে তাকে লক্ষ করছিল বছর দুই ধরে। কারণ ভাগ্নিটি যে-বান্ধবীর বাড়িতে গিয়ে গান শিখত ছেলেটি থাকে তার সামনের বাড়িতেই। প্রথমে মুগ্ধ হয়েছিল ভাগ্নির মিষ্টি গলাটি শুনে, তার পর সামান্য অনুসন্ধান করে তার সম্বন্ধে বাদবাকি খবর যোগাড় করল। বিবেচনা করি ছোকরা আকাশ-ছোঁয়া লক্ষ মেরেছিল যখন জানতে পারল মেয়েটি তারই মত মুসলমান। ইতোমধ্যে সে আবার এম. এ. পাস করে কোন একটা কলেজের লেকচারার হয়ে গিয়েছে। তাকে তখন ঠেকায় কে?
ভাগ্নির নামঠিকানা, তার সম্বন্ধে যাবতীয় বৃত্তান্ত তার চাচাতো ভাবীকে বয়ান করে বললে, বিয়ের প্রস্তাব পাঠাও- অবশ্য সোজাসুজি না, কনেপক্ষের এক দূর আত্মীয়ের কাছে। আলাপচারী বেশ খানিকটে এগিয়ে যাওয়ার পর স্থির হল, অমুক দিন বরপক্ষ থেকে অমুক অমুক মুরুব্বি মহ ইত্যাদি স্থির করবার জন্য আমাদের বাড়িতে আসবেন। ইতোমধ্যে অবশ্য ভাগ্নির চাচা খবর নিয়ে জেনেছেন ছেলেটি সত্যই অত্যুত্তম দুলহার পর্যায়ে পড়ে।
আমাদের এখানে এসে আলোচনা করার আগের দিন সেই দুই ভদ্রলোক যাদের সঙ্গে পরে আপনি কথাবার্তা কইলেন– দুলহার বাপ-মা এবং অতিশয় অন্তরঙ্গ আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে বসে আলোচনা করে জেনে নিলেন, মহর, গয়নাগাঁটি, ফালতো শর্ত যদি আমরা চাই ইত্যাদি তাবৎ আইটেমে তারা কতখানি মেকসিমামে উঠতে পারেন। এবং আকছারই এসব ক্ষেত্রে যা হয় তার ব্যত্যয়ও হল না। রাত দুটো না তিনটে অবধি দফে দফে আলোচনা করার সময় বিস্তর মতভেদ, প্রচুর তর্কাতর্কি ততোধিক মনোমালিন্য হল। দুলহার চাচার অনেকগুলি ছেলে। তার বক্তব্য এবং সে বক্তব্য অতিশয় যুক্তিসঙ্গত যে, তোমরা যদি আজ দরাজদিলে, মুক্তহস্তে বরপক্ষের দাবিদাওয়া মেনে নাও তবে আমার ছেলেগুলোর বিয়েতেও দুহিন পক্ষ এই বিয়ের নজির দেখিয়ে এরই অনুপাতে দাবি করে বসবে প্রচণ্ড মহর অষ্ট-অলঙ্কারের বদলে অষ্টগণ্ডা এবং খুদায় মালুম আর কী কী। অতএব সর্বাবদে ম্যাসিমামটা আরও নিচে নামাও, কলকাতায় দুলহিনের অভাব নেই, তারই পরিচিতদের ভিতরে এন্তার ডানা-কাটা হুরীপরী রয়েছে।
সবাই তাঁকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন, তাঁর ভয় সম্পূর্ণ অমূলক। অর্থনৈতিক চাপেই হোক বা সামাজিক যে কোনও কারণেই হোক, এখন মুসলমান মেয়ের অবস্থা প্রায় হিন্দু মেয়েরই মতো। তাদেরই মতো এখন বরপক্ষই জোরদার পক্ষ। দুহার চাচা তার এতগুলো ছেলে নিয়ে তো রীতিমতো ম্যারেজ-মার্কেট কর্নার করবেন এবং ওই ধরনের আরও কত কী।
তা সে যা-ই হোক, রাত প্রায় দুটো না তিনটের সময় রফারফি হয়ে দফে দফে ম্যাকসিমামগুলো পিন্ ডাউন করা হল।
এ সভাতে দুলহার থাকার কথা নয়। সে ছিলও না। কিন্তু সামনের ঘরে তার চাচাতো ভাবীর সঙ্গে বসে আলোচনার প্রত্যেকটি শব্দ বুঝতে তার কোনও অসুবিধা হয়নি। সে গুম হয়ে বসে রইল।
পরদিন অতি ভোরে ভাবীর মারফত সে তার আব্বাকে খবর পাঠাল, দুলহিন পক্ষের সব দাবিদাওয়া যেন তাদের চাহিদামাফিক মেনে নেওয়া হয়। দুলহা পক্ষের দর-কষাকষির দরুন যদি শাদি ভেস্তে যায় তবে সে স্কলারশিপ নিয়ে নাকবরাবর বিলেত চলে যাবে এবং কস্মিনকালেও এদেশে ফিরবে না। পক্ষান্তরে শাদি যদি হয়ে যায় তবে সে চাচাতো ভাইদের পরিবারের পছন্দমতো জায়গায় তাদের শাদির জিম্মাদারি এইবেলাই আপন স্কন্ধে নিচ্ছে।
প্রথমটায় তো লেগে গেল হৈ হৈ রৈ রৈ। কিন্তু বাপ-মা জানতেন, ছেলেটা ভয়ঙ্কর একগুয়ে এবং চাচাও জানতেন তার কথার নড়চড় হয় না। ভাইদের বিয়ে সম্বন্ধে যে প্রতিজ্ঞা করেছে সেটা রাখবেই। অতএব শেষটায় সেই দুই ভদ্রলোককে সর্ববাবদে আকাশে-ছোঁয়া ম্যাকসিমামের সর্ব এখতেয়ার দেওয়া হল।
অবশ্য আপনার কেরানি কিছু কম নয়।
আমি চটে গিয়ে বললুম, ব্যস, ব্যস্ হয়েছে।
শহর-ইয়ার আমার কপালে হাত বুলোতে বুলোতে বললে, আহা! আপনি কেন বিরক্ত হচ্ছেন? আপনি না থাকলে আপনার ডাক্তার সাহস করে পাঁচ হাজারেরও ময়ূর চাইতে পারতেন না। আর বরপক্ষ যে সুবোধ বালকদ্বয়ের ন্যায় আপনার সব তলব মেনে নেবে, এ তত্ত্বটা না জেনেই তো আপনি কনের জন্য বেস্ট টার্মস গুছিয়ে নিলেন। আচ্ছা, আমি কী বলি আর কী কই সে আপনি বাদ দিয়ে শুধু এইটুকু শুনে রাখুন ডাক্তারের ভাগ্নিবাড়িতে আপনার খ্যাতি রটেছে যে আপনি এমনই ত্রিকালজ্ঞ পীরসাহেব যে বরপক্ষের ওপর এক ঝলক চোখ বোলাতে না বোলাতেই সাফসুতরো অতিশয় পরিপাটিরূপে মালুম করে নিয়েছিলেন যে ওঁরা আপনার তলব মাত্র আপনার খেদমতে পেশ করার জন্য সঙ্গে ফ্লাস্কে করে বাঘের দুধ নিয়ে এসেছিল।
বললুম, আপ্যায়িত হলুম এবং আজ সন্ধের গাড়িতেই আমি বোলপুর চললুম।
শহর-ইয়ার সেদিকে খেয়াল না দিয়ে বললে, কিন্তু আসল কথাটা যে এখনও বলা হয়নি। আমি কোন কথা দিয়ে আমার বয়ান আরম্ভ করেছিলুম মনে আছে? মুসলমান মেয়ে অন্দরমহল ত্যাগ করলে তার সুবিধে-অসুবিধের কথা। এইবারে দেখুন, ডাক্তার সাহেবের ভাগ্নি যদি জনানা ত্যাগ করে কলেজ যাওয়া আরম্ভ না করত তবে কি এরকম একটি উৎকৃষ্ট বরের নজরে পড়ত, এবং এরকম সসম্মানে তার বিয়ের ব্যবস্থা হতে পারত? ও যদি ম্যাট্রিকের পর চাচার সঙ্গে ফসাদ করে না বেরিয়ে পড়ে অন্দরমহলে বসে বসে দিন কাটাত তবে কি তার চাচা মাথা খুঁড়েও এরকম একটি বর জোটাতে পারতেন?
আমি বললুম, গ্রামাঞ্চলের সঙ্গে সেই কবে যে আমার যোগসূত্র ছিন্ন হয়ে গিয়েছে সেটা স্মরণেই আসছে না। এদিকে আবার কলকাতা আর রাঢ়ের মুসলমানদের সঙ্গেও যোগাযোগ হয়নি। তাই জানতে ইচ্ছা করে, আপনাদের ভিতরও মেয়ের জন্য বর যোগাড় করা কি একটা সামাজিক সমস্যা হয়ে উঠেছে?
আমাদের আত্মীয়স্বজন তো নেই বললেই হয়; তবু যেটুকু খবর কানে আসে তার থেকে মনে হয়, কলকাতার মুসলমান সমাজের প্যাটার্ন ক্রমেই হিন্দু প্যাটার্নের কাছাকাছি এসে যাচ্ছে। আর্থাৎ মুসলমান যুবকও চায়, তার স্ত্রী যেন শিক্ষিতা হয়, গানটান জানলে তো আরও ভালো, এবং সে নিজে যদি লেখাপড়ার নাম করে থাকে তবে হয়তো মনে মনে এ আশাও পোষণ করে যে শ্বশুর তাকে বিলেত পাঠাবে। তবে যতদূর জানি, এদের খাইগুলো এখনও রূঢ় কর্কশরূপে সমাজে প্রকাশ করা হয় না।
আমি বললুম, সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে হিন্দু সমাজও তার প্যাটার্ন বদলে বদলে আমাদের কাছে চলে আসছে। আমার ছেলেবেলায় হিন্দুর পণপ্রথা যতখানি নির্দয় ছিল আজ তো নিশ্চয়ই ততখানি নয়। আর লভ ম্যারেজের সংখ্যা যতই বাড়বে, পণপ্রথা ততই বাতিল হতে থাকবে।
শহর-ইয়ার বললে, আমার কিন্তু ভারি কৌতূহল হয়, এই যে হিন্দুরা ডিভোর্স, মনোগেমি, বাপের সম্পত্তিতে মেয়ের অধিকার এসব আইন চালু করল তার ফল আখেরে হিন্দু সমাজকে কীভাবে পরিবর্তন করবে?
গ্রামাঞ্চলে কিছুই হবে না। মনোগেমি ছাড়া আর দুটো আইন তো মুসলমানদের ছিলই। তবু আমাদের সমাজে ডিভোর্স হত কটা? বাপের সম্পত্তির হিস্যে নিয়ে কটা মেয়ে ভাইদের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা লড়েছে। আর মনোগেমি আইন না থাকা সত্ত্বেও বাঙলা দেশের কটা মুসলমান ভদ্রলোক দুটো বউ পুষেছে। হিন্দুদের বিধবা-বিবাহ আইনসম্মত হয়েছে প্রায় একশো বছর আগে। দ্র হিন্দু সমাজে তার ফলে প্রতি বৎসর কটা বিধবা-বিবাহ হয়? না, দিদি, এদেশের অদৃশ্য, অলিখিত আইন–মেয়েরা যেন মাথা তুলে না দাঁড়াতে পারে। তা সে মুসলমানই হোক, আর হিন্দুই হোক।
শহর-ইয়ার অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললে, বোধ হয় আপনার কথাই ঠিক।
আমি কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলুম, কিন্তু যা বললুম, তার সঙ্গে আমার আরেকটা কথা যোগ না দিলে আমার বক্তব্য অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। সেটা সোজা বাঙলায় এই, বলি তো অনেক কথা, কিন্তু যখনই চিন্তা করি তখনই দেখি, আমাদের সমাজ যে কোন দিকে চলেছে তার কোনওকিছুই অনুমান করতে পারছি না।
শহর-ইয়ার আমার সর্বশেষ মন্তব্যটি বোধ হয় শুনতে পায়নি; দেখি দৃষ্টি যেন দেয়ালের ভিতর দিয়ে দূর-দূরান্তর চলে গিয়েছে। হঠাৎ বললে, এদেশের মেয়েরা আপন পায়ে দাঁড়িয়ে উঠে সামান্যতম প্রতিবাদ জানাবে কী করে? তার জন্য তো আপনার ওই শ্রীরাধাই দায়ী। বৈষ্ণব কবিরাই তো তাঁকে শত শত গানে সহিষ্ণুতার সাক্ষাৎ মূর্তিমতী প্রতিমারূপে নির্মাণ করে তুলেছেন। কৃষ্ণ তার প্রতি যে অবিচার করে চলে গেলেন তাই নিয়ে তাঁর রোদনক্রন্দন হাহাকার আছে শত শত গানে, কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কিংবা বিদ্রোহ, অভিসম্পাত না-হয় বাদই দিলুম, আছে কি কোনওখানে উল্টো তিনি তো বসে রইলেন গালে হাত দিয়ে ঠাকুরের প্রতীক্ষায়। যদি তিনি কোনওদিন ফিরে আসেন! এই শ্রীরাধাই তো হলেন আমাদের হিন্দু প্রতিবেশিনীর আদর্শ।
শহর-ইয়ার গরম। অবশ্য মাত্রাধিক নয়।
আমি বললুম, সুন্দরী, আপনি এখন যা বললেন তার উত্তরে আমাকে একখানা পূর্ণাঙ্গ থিসিস ঝাড়তে হয়। অতিশয় সংক্ষেপে উত্তর দিই।
ইসলাম অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে আরবদের অন্ধকার যুগে– জাহিলিয়ায়– অতি উচ্চাঙ্গের কাব্য রচিত হয়েছিল। বলা বাহুল্য, সে কাব্যে ইসলামের একেশ্বরবাদ তো নেই, যা আছে সে-সব জিনিস কেউ বিশ্বাস করলে তাকে আর মুসলমান বলে গণ্য করা যাবে না, অথচ এসব কাব্য পড়েন শিক্ষিত আরব মাত্রই তা সে তিনি ধার্মিক মৌলানাই হোন, আর সাদামাটা কাব্য-রসিক হোন– কিন্তু বিশুদ্ধ কাব্যরূপে, অতি অবশ্যই তার থেকে ধর্মানুপ্রেরণা পাবার জন্য নয়। তাই আমার তাজ্জব লাগে, যখন এদেশের গোড়ারা আপত্তি তোলেন কোনও মুসলমান বালক বাঙলা সাহিত্যের গভীরে প্রবেশ করার জন্য রামায়ণ-মহাভারত, পদাবলী, মঙ্গলকাব্য পড়লে। মধ্যযুগের একাধিক মুসলিম কবি বাণী-বন্দনা দিয়ে তাঁদের কাব্য রচনার গোড়াপত্তন করেছেন। অথচ কাব্যের গভীরে প্রবেশ করলেই দেখা যায়, এঁদের প্রায় সকলের উদ্দেশ্য ছিল, ইসলামের মূল সরল নীতি বাঙলার মাধ্যমে প্রচার করা। আরেকটা উদাহরণ নিন। পরধর্ম বাবদে খ্রিস্টান মিশনারিরা যে অত্যধিক সহিষ্ণু একথা তাঁদের পরম শত্রুরাও বলবে না। অথচ এদের অধিকাংশই গ্রিক শেখার সময় ওই ভাষাটি না শিখে নিউ টেস্টামেন্ট মূলে পড়ার উপায় নেই বিস্তর দেবদেবীতে ভর্তি প্রাক-খ্রিস্ট গ্রিকসাহিত্য গভীরতম শ্রদ্ধার সঙ্গে পড়েন। হাতের কাছের আর একটা উদাহরণ নিন। ইরানে ইসলাম আগমনের পূর্বে যেসব রাজা, বীর, প্রেমিক-প্রেমিকার কাহিনী লোকমুখে প্রচলিত ছিল, সেগুলো নিয়ে মুসলমান ফিরদৌসি লিখলেন তাঁর মহাকাব্য শাহনামা –সে কাব্য পড়েন না কোন মৌলানা?
আপনি হয়তো বলবেন, পদাবলী সাহিত্য বৈষ্ণব ধর্মের অঙ্গবিশেষ; অতএব সে সাহিত্য থেকে হিন্দু তার জীবনাদর্শ গ্রহণ করেন। উত্তম প্রস্তাব। আপনি ভাবছেন বাঙলার হিন্দু রমণী শ্রীরাধার কাছ থেকে তার সহিষ্ণুতা শিখেছে। কিন্তু কই, সে তো তারই অনুকরণে আপন স্বামী ত্যাগ করে অন্য পুরুষে হৃদয় দান করে না। এদেশের কোনও মেয়েরই প্রশংসা করতে হলে আমরা সর্বপ্রথমই বলি, আহা, কী সতীলক্ষ্মী মেয়েটি!
অবশ্য এর সঙ্গে আরেকটি তত্ত্ব যোগ না করলে সম্পূর্ণ সত্য বলা হয় না।
রাধাকৃষ্ণের প্রেম অনেকেই রূপকরূপে গ্রহণ করেন। রাধা মানবাত্মার প্রতীক। কৃষ্ণ পরমাত্মার। কৃষ্ণমিলনের জন্য রাধার হাহাকার আর পরমাত্মার কামনায় মানবাত্মার হাহাকার একই ক্রন্দন।
সুফিদের ভিতরে ওই জিনিসটি আছে। আপনি পাঁচজন মৌলানাকে জিগ্যেস করলে তার অন্তত চারজন বলবেন, হাফিজ যেখানে মদ্যপানের উল্লেখ করছেন সে মদ্য মদ্য নয়। সে মদ্য আল্লার প্রতি মহব্বত- ভগবদ্প্রেম। যে সাকি মদ্য বিতরণ করেন তিনি মুর্শিদ অর্থাৎ শুরু। তিনি শিষ্যকে মদ্যপানে আসক্ত করান গুঢ়ার্থে আল্লার প্রেমে অচৈতন্য হতে, সেই চরম সত্তা পরমাত্মায় আপনা সত্তা সম্পূর্ণ বিলীন করে দিতে শিক্ষা দেন।
পার্থিব প্রেমকে আধ্যাত্মিক প্রেমের স্তরে নিয়ে যাবার জন্য খ্রিস্টান এবং ইহুদি মিস্টিক– রহস্যবাদী– ভক্তও ওই প্রতাঁকের শরণাপন্ন হন।
কিন্তু আপনি-আমি– আমরা সাধারণ মানুষ। আমরা কাব্য পড়ি কাব্য-রসের জন্য আর কোনওদিন যদি আপনার ধর্মানুরাগ নিবিড়তর হয় তবে আপনার ভাবনা কী? আপনার ঘরেই তো দেখলুম ইমাম গজ্জালির সৌভাগ্য স্পর্শমণি বাঙলা অনুবাদে।
.
১২.
পরিপূর্ণ সুখশান্তির উপর অকস্মাৎ কীভাবে বজ্রপাত হয়– এই আমার বিকটতম অভিজ্ঞতা।
ইতোমধ্যে আমি অভিমন্যুকে হার মানিয়ে, শহর-ইয়ার ও ডাক্তার নির্মিত চক্রব্যুহ ভেদ করে মোকামে ফিরে এসেছি।
আবার সেই খাড়াবড়ি-উচ্ছেতে যখন অধরোষ্ঠ পরিপূর্ণ বিতিক্ত তখন হঠাৎ একদিন লক্ষ করলুম, ডাক্তার পরিবার আমাকে যেন কটু করেছে। আমি পরপর দু খানা চিঠি লিখলুম, শহর-ইয়ারকে। কোনও উত্তর পেলুম না। এ যে নিদারুণ অবিশ্বাস্য! তখন লিখলুম ডাক্তারকে। অবিশ্বাসের তারতম্য হয়? হয়। এ যেন আরও অবিশ্বাস্য! এ যেন সেই প্রাচীন যুগের টেলিফোনে নো রিপ্লাই মিস?
আমি কী হীন, নীচ! যাক গে চুলোয়। বলে যেই বারান্দায় বেরিয়েছি, দেখি, দূর থেকে মাঠ ঠেঙিয়ে আসছে ডাক্তার। আর তাকে অভ্যর্থনা জানাতে ছুটে যাচ্ছে আমার আলসেশিয়ান মাস্টার তার রিজার্ভ স্পিডও ছেড়ে দিয়ে।
আমি বারান্দা ছেড়ে যেই রোদ্দুরে নামতে যাচ্ছি এমন সময় লক্ষ করলুম, দূর থেকে ডাক্তার হাত নেড়ে বোঝাবার চেষ্টা করছে, আমি যেন অযথা এই কড়া রোদ্দুরে না নামি।
ডাক্তার পৌঁছল। লগেজ দূরের কথা, হাতে একটি এটাচি পর্যন্ত নেই।
এ বাড়ির কর্তা দিলবরজান–কুকুশে-মেজরডমো– দুই মিনিটের ভিতর বালতি করে জল সাবান গামছা ধুদুল ডাক্তারের পায়ের কাছে রাখল। ডাক্তার তার আপনজন। মনে নেই, কখন কোন বারে সে দিলবরের কোন এক মাসিকে বাঁচিয়ে দ্যায়!
ডাক্তারের চুল উস্কোখুস্কো। হাতদুটো অল্প অল্প কাঁপছে। কপালে ঘামের ফোঁটা।
শুধু দেহের দিক দিয়ে, এ ধরনের অপ্রমত্ত, শান্তসমাহিতচিত্ত লোকও যে রাতারাতি হঠাৎ মৃগী রুগীর মতো চেহারা ধারণ করতে পারে, এ যেন সুফি-সাধুর অকস্মাৎ মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞা পেয়ে নীরব আর্তনাদ!
আমি এমনই হতবুদ্ধি হয়ে গেলুম যে তাকে কুশল প্রশ্নও শুধোতে পারলুম না। কিংবা হয়তো আমার মগ্নচৈতন্য তার অতল থেকে কোনওপ্রকারে প্রতিক্রিয়া আমার চৈতন্যলোকে পাঠাতে সম্মত হল না। আর কুশল প্রশ্ন শুধোবই-বা কী? যা দেখছি সে তো জড়ভরতও লক্ষ করত। আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম।
আল্লা যেন হঠাৎ আমাকে আদেশ দিলেন। দিলবরজানকে বললুম, এখানে না। ওঁকে বাথরুমে নিয়ে গিয়ে নিজের হাতে চান করিয়ে, তাজা জামাকাপড় পরিয়ে নিয়ে আয়।
যে ডাক্তার কারও কোনওপ্রকারের সাহায্য নিতে সদাই কুণ্ঠিত, বিব্রত বিদ্রোহী পর্যন্ত বলা চলে– সেই ডাক্তার কলের পুতুলের মতো দিলবরের পিছনে পিছনে চলে গেল।
আমি বাথরুমের দরজার কাছে গিয়ে শুধালুম-কী করে শুধালুম জানিনে–শ-ইয়ার?
যেন পৃথিবীর অন্য প্রান্ত থেকে উত্তর এল, ভালো আছে। না, ভুল বললুম। শুধু ঘাড় নাড়িয়ে ওই সংবাদটুকু দিল।
তা হলে কী হয়েছে?
এর পর তাকে খাওয়াবার চেষ্টা, শোওয়াবার চেষ্টা, কথা বলার চেষ্টা– এসব নিষ্ফল প্রচেষ্টার পীড়াদায়ক বর্ণনা দিয়ে কে কাকে পীড়া দিতে চায়!
কোথা থেকে মানুষ কখন কী অনুপ্রেরণা পায় কে জানে? দিলবরকে বললুম, যাও, রিকশা নিয়ে এসো। আমরা কলকাতা যাচ্ছি। আর ডাক্তারের কোট-পাতলুন আমার সুটকেসেই ভরে দাও। এ লোকটাকে আবার কাপড় ছাড়ানো– সে তো হবে আলট্রামডার্ন সোসাইটি লেডির রুগ্ণ বাচ্চাকে সায়েবি কায়দায় বেকার পাঁচবার কাপড় বদলানো।
আমি অন্ধভাবে বুঝতে পেরেছি, এখানে ডাক্তারকে আটকে রেখে কোনও লাভ নেই। যা হবার হবে কলকাতায়। ডাক্তারের জীবন বলতে বোঝায় তার দুটি শ্বাস-প্রশ্বাস তার শহর-ইয়ার আর তার রিসার্চ এবং যেহেতু শহর-ইয়ারকে সঙ্গে নিয়ে আসেনি অতএব নিশ্চয় সে-ই। আর যে ডাক্তার ঘাড় নেড়ে জানাল সে ঠিক আছে–ও, না, সে তো আমার অনুমান।
সঙ্গে নিলুম গজ্জালির কিমিয়া আর হুজবেরির কশফ-অল-মহজুব।
রিকশাতে উঠে ইচ্ছে করেই আরম্ভ করলুম, বকর-বকর। কিন্তু সেটা মোটেই সহজ কর্ম হয়নি। আর সহজ-কঠিন যাই হক, ফল হল সম্পূর্ণ বেকার। এ যেন ধুয়োর সঙ্গে কুয়াশার লড়াই। এমনকি তাতে করে ধুয়াশাও তৈরি হল না।
ডাক্তার আচারনিষ্ঠ মুসলিম। তাই আরম্ভ করলুম ধর্মতত্ত্ব নিয়ে যেন কিছুটা আত্মচিন্তা কিছুটা বক্তৃতা। একটা বিশেষ মতলব নিয়ে।
বললুম, আপনি তো ইমাম গজ্জালির ভক্ত। তার জীবনটাও ভারি অদ্ভুত। তিনি ছিলেন বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাস্থবির যে আমলে কি না, হয়তো এক চীন ছাড়া অন্য কোথাও ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের জুড়ি ছিল না– আমি অবশ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিদ্যাপীঠের সমন্বয়কে বিশ্ববিদ্যালয় অর্থে ধরছি না। একে তো সর্বজনমান্য রেক্টর, তদুপরি শাস্ত্রীরূপে তিনি মুসলিম জগতে সর্বপ্রখ্যাত। রাজদত্ত অত্যুত্তম পোশাক পরিধান করে যেতেন রাজদরবারেও।
হঠাৎ একদিন তার খেয়াল গেল, এসব তাবৎ কর্ম অর্থহীন বর্বরস্য শক্তিক্ষয়– ভ্যানিটি অব ভ্যানিটিস, অল ইজ ভ্যানিটি, বাইবেলের ভাষায়। সেই রাত্রেই মাত্র একখানা কম্বল নিয়ে বাগদাদ থেকে অন্তর্ধান। পৌঁছলেন গিয়ে সিরিয়ার দমশকশে আশ্রয় নিলেন মসজিদে, ছদ্মনামে। সেই মসজিদের ইমাম ছিলেন উচ্চস্তরের পণ্ডিত। তাঁর সঙ্গে একদিন শাস্ত্রালোচনা হতে হতে সেই পণ্ডিত বললেন, এ আবার আপনি কী বলছেন! স্বয়ং ইমাম গজালির মতো সর্বশ্রেষ্ঠ পণ্ডিত বলেছেন ঠিক তার বিপরীত বাক্যটি!
গজ্জালি ভাবলেন, আর এ স্থলে থাকা নয়। কোনদিন এরা জেনে যাবে আমার প্রকৃত পরিচয়। আর সঙ্গে সঙ্গে লোপ পাবে আমার ধ্যানধারণার সর্ব অবসর।
সেই রাত্রেই অন্তর্ধান করলেন বয়তুল মুকস- জেরুজালেমের দিকে। সেখান থেকে গেলেন ইহুদি, আরব, খ্রিস্টান তিন কুলের পূর্বপুরুষ হজরত ইব্রাহিমের পুণ্য সমাধি দর্শন করে অশেষ পুণ্যলাভার্থে। ভারতবর্ষে হিন্দুরা যেরকম পুণ্যতীর্থে দেবতাকে কোনওকিছু প্রিয় খাদ্য বা অন্য কিছু দান করে, ঠিক সেইরকম ইব্রাহিমের মোকামে মুসলমানরা একটা বা একাধিক শপথ নেয়। ইমাম নিলেন তিনটি। তার মধ্যে সর্বপ্রধান ছিল, এ জীবনে আমি কোনও বিতর্কমূলক বাক্য (কন্ট্রভার্সিয়াল) উত্থাপন করব না।
এখানে এসে আমি চুপ করে গেলুম। স্বেচ্ছায় এবং অতিশয় কূট উদ্দেশ্য নিয়ে।
জয় হোক ভারতীয় রেলের! শতম জীব, সহস্রং জীব– ভারতীয় রেলের কর্মকর্তাগণ।
বোলপুর স্টেশন আমাকে দু খানা ফার্স্ট ক্লাস টিকিট বেচল।
দার্জিলিং মেল পৌঁছল- এই অতি সামান্য নস্যবৎ- দু ঘন্টা লেটে, যাকে বলে বিলম্বিত গাড়িয়াদের একটি হয়ে। তাতে আমার আপত্তি নেই, কিন্তু ফার্স্ট ক্লাস সব কটা কামরা যে দাজিলিং থেকেই প্রতি আউনস্ ভর্তি, সে খবর না জেনে খুব সম্ভব জেনেই- বোলপুর স্টেশন টিকিট বেচেছে। দার্জিলিঙের কগণ্ডা মেয়ে-স্কুলের ছুটি হয়েছে জানিনে– নীলে নীলে উর্দিপরা মেয়েরা কাঁঠাল-বোঝাই করে ফেলেছে সব কটা কামরা।
সে দুঃস্বপ্ন আজ আর আমার নেই–কী করে কোন কামরায় উঠেছিলম। খুব সম্ভব ক্যাটল ট্রাকে, কিংবা হয়তো এঞ্জিনের ফারনেসে। একদিক দিয়ে ভালোই হল। সে সঙ্কটময় অভিযানে দু জনা দুই কোণে ছিটকে পড়েছি। ডাক্তারের মনটাকে পুনরায় সজীব করার গুরুভার থেকে রেহাই পেলুম বটে, কিন্তু আমার মনটা ক্রমেই নির্জীব হতে লাগল।
দিলবরকে বলেছিলুম কলকাতায় ট্রাঙ্ক-কল করতে। ডাক্তারদের সেই প্রাচীন দিনের গাড়িটা এতদিনে আমার বড় প্যারা হয়ে গিয়েছিল। সে-ও স্টেশনে আসেনি। দুঃখের দিনে নির্জীব প্রাণীও প্রিয়জনকে ত্যাগ করে বলেই কবি হাহাকার করেছেন–
তঙ্গ দস্তিমে কৌ কিসকা সাথ দেতা হৈ।
কি তারিকি ঘেঁ সায়া ভি জুদা হোতা হৈ ইসে।
দুর্দিনে বল, কোথা সে সুজন হেথা তব সাথি হয়?
আঁধার ঘনালে আপন ছায়াটি সেও, হেরো, হয় লয়।
অন্ধকার, অন্ধকার, অন্ধকার। যে পুরো সম্পূর্ণ ফাঁকা উইংটি ঠাকুর্দাদের স্মরণে ডাক্তারের আদেশানুযায়ী চিরন্তন দেয়ালি উৎসব করত সেটিও অন্ধকার। আমি আমার ঘরে গিয়ে ঢুকলুম। স্পষ্ট বোঝা গেল বেয়ারাই সেটা গোছগাছ করেছে। শহর-ইয়ার কোথায়? কে জানে? আমি শুধালুম না। ডাক্তার বললেন, তিনি খাবেন না। ট্রেনের ভিড়ে সন্ধ্যায় নামাজ পড়তে পারেননি। এখন এশার নামাজ পড়ে ঘুমুবেন। কিন্তু শহর-ইয়ার কোথায়, যার পরম পরিতৃপ্তি ছিল স্বহস্তে তার নামাজের ব্যবস্থা করে দেবার?
আমি স্থির করলুম, ডাক্তার যতক্ষণ না নিজের থেকে কথা পাড়ে আমি কিছু শুধাব না।
বিছানায় শুয়ে বই পড়ছি। এমন সময় আমার প্যারা বেয়ারা শহর-ইয়ারেরও –ঘরে ঢুকল। অন্য সময় তার মুখে হাসিই লেগে থাকত, আজ সে যন্ত্রের মতো তার নৈমিত্তিক কর্তব্যগুলো করে যেতে লাগল।
আমি খুব ভালো করেই জানি গৃহস্থের পারিবারিক ব্যাপার কারকুন-কর্মচারী সহচর-সেবকদের শুধাতে নেই, তবু বড় দুঃখে মনে পড়ল শহর-ইয়ার দিলবরজানকে আমার আচার-অভ্যাস সম্বন্ধে একদা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুধিয়েছিল, যাতে করে আমি তাদের কলকাতার বাড়িতে এলে আমার কোনও অসুবিধা না হয়।
তবু দ্বিধাভরা মনে জমিল শেখকে শুধালুম, আমাদের ট্রাঙ্ক-কল সময়মতো পৌঁছয়নি?
জি হ্যাঁ, সে তো সন্ধ্যা সাতটার সময়ই। আমিই ধরেছিলুম।
তবে?
প্রশ্নটার তাৎপর্য ঠিক বুঝেছে। বললে, মাজি বাড়িতে ছিলেন না। তিনি তো দুপুরবেলাই গাড়ি নিয়ে তাঁর পীর সাহেবের বাড়ি চলে গিয়েছিলেন, আমি
শহর-ইয়ারের পীর! বলে কী! হাবার মতো শুধালুম, পীর!
জমিল ঘাড় ফিরিয়ে যেন অতি অনিচ্ছায় অত্যন্ত আফসোস করে আস্তে আস্তে বললে, সেখানেই তো প্রায় সমস্ত দিন কাটান। তার পর যতদূর সম্ভব আদব-ইনসানিয়ৎ বাঁচিয়ে সালাম হুজুর, গরিবের বেয়াদবি মাফ করবেন বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
আল্লার কসম খেয়ে বলছি, জমিল যদি বলত, শহর-ইয়ার আত্মহত্যা করেছে তা হলেও আমি এরকম বুড়ব বনে যেতুম না! শহর-ইয়ার পীর ধরেছে! এ যে বাতুলের বাতুলতার চেয়েও অবিশ্বাস্য। সাধারণতম মুসলমান মেয়েরও নামাজ-রোজার প্রতি যেটুকু টান থাকে সেটুকুকে ধুয়ে-মুছে সাফ করে দিলেও যেটুকু থাকার সম্ভাবনা তা-ও তো আমি শহর-ইয়ারের কথাবার্তা চাল-চলনে কখনও দেখিনি। সে নিজেই আমাকে একাধিকবার বলেছে, তার দি তার জান্, তার সব কিছুর এমারৎ দাঁড়িয়ে আছে– চৌষট খাম্বার উপর নয়, রবীন্দ্রনাথের তিন হাজার গানের তিন হাজার স্তম্ভের উপর। সেখানে গুরুবাদই-বা কোথায়, আর পীর সাহেব তো সেই হাজারো স্তম্ভের কোনও একটার পলস্তরা পর্যন্ত নন।
আর এই রমণীর মণি মমতার খনি– সে তো কিছু পাগলা গারদের ইমবেসাইল নয় যে চায়ের কাপে জল ভরে, পেন্সিলের ডগায় সুতো-বঁড়শি লাগিয়ে মাছ ধরার চেষ্টা করবে! শুরু বুঝি তা হলে চায়ের কাপ, আর শহর-ইয়ারের ভক্তি সেই পেন্সিলের বঁড়শি! তাই দিয়ে সে ধরবে ভগবদ্-প্রেম, জাৎ-মোক্ষ!
তা-ও বুঝতুম যদি তার বাউলদের দেহতত্ত্ব গীতে, লালন ফকিরের রহস্যবাদ-মারিফতি জনপদসঙ্গীতের প্রতি মমতা থাকত! এমনকি এই যে রবীন্দ্রনাথের ধর্মসঙ্গীত, বাউল-গান– তার প্রতিও শহর-ইয়ারের বিশেষ কোনও মোহ নেই– সে-কথাও তো সে আমাকে স্পষ্ট বলেছে!
খাটে শুয়ে, বই হাতে নিয়ে পড়ছি, পাতার পর পাতা উল্টে যাচ্ছি–তার এক বর্ণও মাথায় ঢুকছে না; ভাবছি শুধু শহর-ইয়ারের কথা, যাকে আল্লাহ মেহেরবানি করে আমার কাছে এনে দিলেন, যে আমার বোনের চেয়েও বোন, প্রিয়ার চেয়েও প্রিয়া!
রাত তখন এগারোটা। শহর-ইয়ার ঘরে ঢুকল।
তাকে কীভাবে দেখব, সে নিয়ে আমার মনে তোলপাড় হচ্ছিল যখন থেকে শুনতে পেয়েছি, সে গুরুলাভ করেছে।
যেমনটি ছিল, তেমনটিই আছে। শুধু পূর্বেকার মতো যখন খাটের পৈথানে এসে খাড়া কাঠের টুকরো ধরে দাঁড়াল তখন স্পষ্ট লক্ষ করলুম, চোখদুটোর উপর যেন অতি হাল্কা স্বচ্ছ দ খানা ফিলমের মতো কীরকম যেন কুয়াশা-কুয়াশার মতো আবরণ। এ জিনিসটে আমি বুঝিয়ে বলতে পারব না। কারণ কুয়াশাভাব থাকা সত্ত্বেও তাতে রয়েছে কেমন যেন একটা বিভ্রান্ত দ্যোতি।
পীর-ভক্ত হওয়ার পূর্বে শহর-ইয়ারের হার্দিক ও দৈহিক সৌন্দর্য একদিনে আমার কাছে স্বপ্রকাশ হয়নি। তার হাসি, তার গান, দূরে থেকে দেখা তার আপন মনে মনে একা একা তালসারির গা ঘেঁষে ভ্রমণ, আমার বাড়ির দেড়তলাতে তার আবাস নির্মাণ, মুসলমান রমণীর স্বাতন্ত্র নিয়ে তার অভিমান– তার আরও কতশত আহারশয্যাসনভোজন, কতকিছুর ভিতর দিয়ে তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে। দিনে দিনে সে আমার কাছে সুন্দরের চেয়ে সুন্দর, মধুরের চেয়ে মধুর হয়ে বিভাসিত হয়েছে।
আর আজ? আজ থেকে আবার তাকে নতুন করে চিনতে হবে। এ যদি একেবারে নতুন মানুষ হত তবে তো কোনও ভাবনাই ছিল না। নতুন মানুষের সঙ্গে তো আমাদের জীবনভর পরিচয় হয়। কোনও পুরনো মানুষকে আবার নতুন করে চেনা? সামান্য লেখক হিসেবে বলতে পারি :নতুন লেখা তো দু দিন অন্তর-অন্তরই লিখতে হয়, কিন্তু কোনও একটা লেখা যদি হারিয়ে যায় এবং সেইটেই আবার নতুন করে লিখতে হয়, তখন যা যন্ত্রণার ভিতর দিয়ে যেতে হয় সে-তত্ত্বটা শুধোন গিয়ে আমাকে না– খ্যাতনামা লেখকদের।
এর চেয়েও সোজা উদাহরণ দিই। আপনি রইলেন পড়ে দেশে। বন্ধু বিলেত থেকে ফিরলেন পাঁচ বছর পূরে। তার সঙ্গে ফের বন্ধুত্ব জমাতে গিয়ে খাননি মার?
আশ্চর্য! এখনও শুধাল না, আমার কোনও অসুবিধা হয়নি তো, খাওয়া-দাওয়া কীরকম হয়েছে কিছুই না। না, আমি আশ্চর্য হইনি। আমি ব্যাপারটা কিছু বুঝতে পেরেছি।
আমি স্থির করেছি আমি কোনও ফরিয়াদ করব না– চিঠির উত্তর দিলে না কেন, আপন হাতে প্রত্যেকটি জিনিস বেছে বেছে– বহুত কিছু কলকাতা থেকে সঙ্গে এনে– আমার বাড়ির দেড়তলাতে যে তোমার বাড়ি বানালে সেটা এরকম ছেঁড়া চটিজুতোর মতো না বলে না কয়ে হঠাৎ এরকম উৎখাত করে দিলে কেন; না না, কিছু শুধাব না। আমি ভাবখানা করব, সে হঠাৎ যেন কোনও এতিমখানা বা নাইট স্কুলে এমনই মেতে গিয়েছিল যে আমার তত্ত্বতাবাশ করতে পারেনি। সমস্তটা সহজভাবেই গ্রহণ করব। কিন্তু হায়, সহজ হওয়া কি এতই সহজ? সহজিয়া ধর্মের মূলমন্ত্র সহজ হবি, সহজ হবি–সেটা যদি অতই সহজ হবে তবে বিশ্বসংসারের তাবৎ ধার্মিক-অধার্মিক সর্বধর্ম পরিত্যাগ করে ওই ধর্মই গ্রহণ করল না কেন?
ওদিকে হৃদয় ভরে আসে অভিমানের বেদনায়।
এ রমণীর সঙ্গে যদি আমার সম্পর্ক প্রণয়ের হত তবে তার আজকের অবহেলা আমার হৃদয়ে অন্য প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করত। প্রেম তো পূর্ণচন্দ্র। তাই তার চন্দ্রগ্রহণও হয়। কিন্তু বন্ধুত্বও শুক্লপক্ষের চন্দ্রমার মতো রাতে রাতে বাড়ে এবং চতুর্দশীতে এসে থামে। পূর্ণিমাতে পৌঁছয় না। তাই তার গ্রহণ নেই, ক্ষয়ও নেই, কৃষ্ণপক্ষও নেই। তবে আমাদের বন্ধুত্বের ওপর এ কিসের করাল ছায়া!
কিন্তু অতশত চিন্তা করার পূর্বেই প্রাচীন দিনের অভ্যাসমতো মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, কী পড়ছ, আজকাল? ওইটেই ছিল আমাদের প্রিয় অবতরণিকা- যা দিয়ে মুখবন্ধ নয়, মুখ খোলা হত।
বললুম, বসো।
কেমন যেন সঙ্কোচের সঙ্গে খাটের বাজুতে বসল।
এই মেয়েই না একদিন স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে আমার পদসেবা করতে চেয়েছিল।
তবে কি পীরের মানা– গুরুর বারণ–পরপুরুষস্পর্শ বিষবৎ বর্জনীয়?
নিকুচি, নিকুচি। পীরের গুষ্টি আর গুরুর দঙ্গল!
অভিমানের বদলেতে নেব তোমার মালা এসব মরমিয়া মাল আমার তরে নয়। আমার হল রাগ। এই নিষ্পাপ শিশুটিকে কে শেখাল এইসব কাল্পনিক পাপ? কে সে পীর? তাকে একবার দেখে নিতে হবে। কিন্তু পীরের নিকুচি যতই করি না কেন, আমার ঠাকুরদা থেকে ঊধ্বতম ক পুরুষ যে পীর ছিলেন সে তত্ত্ব অদ্যাপিও বিলক্ষণ অবগত আছে তর পরগণার কিছু কিছু চাষাভূষো, মোল্লামুনশি। এরা বংশানুক্রমে আমাদের পরিবারের শিষ্য। কিন্তু আমার পিতা এবং আমার অগ্রজেরা পীর হতে রাজি হলেন না বলে এদের অধিকাংশই অন্য পীরের আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু গুরুভক্তি শুধু শুরুতেই সীমাবদ্ধ থাকে না, সে-ভক্তি শুরুর বংশধরগণকেও নিষ্কৃতি দেয় না; তাই এদের কয়েকটি পরিবার অন্য পীর বরণ না করে দু তিন পুরুষ ধরে অবিশ্বাস্য ধৈর্য ধরে বসে আছে, আমার দাদাদের বা আমার বেটা-নাতি যদি সদয় হয়ে কোনও একদিন এদের বেটা-নাতিদের শার্গিদ (সাকরেদ) রূপে গ্রহণ করেন। ইতোমধ্যে যে-পীর বাঙলাদেশে এসে আমাদের বংশ স্থাপনা করেন তাঁর দর্গাতে এইসব প্রতীক্ষমাণ সাকরেদরা শিরনি চড়াচ্ছে, ফুল সাজাচ্ছে, মানত মানছে।
মাত্র এই দুপুরুষ– আমার পিতা আর আমরা তিন ভাই পীর হতে রাজি হইনি। তাই বলে চোদ্দপুরুষ যে সব ধ্যানধারণা করেছে, সাকরেদদের দীক্ষা দিয়েছে, ধর্মপথে চালিয়েছে সেটা কি দু পুরুষেই আমার রক্ত থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে? হাঁসকে দু পুরুষ খাঁচায় বন্ধ রাখার পর তৃতীয় পুরুষের বাচ্চাদের জলে ছেড়ে দিলে কি তারা সাঁতার না কাটতে পেরে পাথর-বাটির মতো জলে ডুবে মরবে!
এই তো মাত্র দু তিন বৎসর পূর্বে শান্তিনিকেতনের কর্তৃপক্ষ আমার ওপর হামলা করে অনুরোধ– আদেশও বলতে পারেন– করলেন, পৌষমেলা ও সমাবর্তন উৎসবের প্রাক্কালে যে সাম্বৎসরিক উপাসনা করা হয় তাতে আচার্যের আসন গ্রহণ করতে। আমি সাতিশয় সবিনয় সবিস্তর অনিচ্ছা প্রকাশ করেছিলুম। ওঁদের বলিনি কিন্তু আমি মনে মনে জানি এসব কর্ম করে পুরুত-মোল্লারা পেটের অন্ন জোটায়– অবশ্য এ স্থলে এরা আমাকে একটি কানাকড়িও দেবেন না, সে-কথা আমি বিলক্ষণ অবগত ছিলুম। আবার এ তথ্যও তো জানি যে, বিপদে-আপদে কাছেপিঠে নিতান্তই কোনও মোল্লা-মুশি ছিল না বলে আমার পিতৃপুরুষ এসব ক্রিয়াকর্ম কালেকস্মিনে অত্যন্ত অনিচ্ছায় সমাধান করেছেন। পূর্বেই বলেছি, তবুও আমি আপত্তি জানিয়েছিলাম। তখন কর্তৃপক্ষ তাদের আখেরি মোক্ষম বজ্রবাণ ছেড়ে বললেন, আমারই ওপর ভরসা করে তাঁরা অন্য কোনও ব্যবস্থা করেননি; এই শেষ মুহূর্তে অন্য ব্যবস্থা সম্পূর্ণ অসম্ভব। আমার সন্দেহপিচেশ মন অনুমান করল, অন্য কোনও ডাঙর চাঁইকে হয়তো কর্তারা কাবু করে রেখেছিলেন এবং তিনি শেষ মুহূর্তে তার অক্ষমতা জানিয়ে খবর পাঠিয়ে কত্তাদের সমূহ বিপদে ফেলেছেন। বিপদে পড়লে শয়তানও মাছি ধরে ধরে খায়। তাই এসেছেন অধমের কাছে। অবশ্য এনারা শয়তান নন, আমো মাছি নই। আমি শুধু রিলেটিভিটি সিপ্লিফাইড গ্রু প্রভাব বোঝাবার জন্য এই প্রবাদটি উদ্ধৃত করলুম।
তখন অবশ্য আমি তিন কবুল পড়ে মুসলমান যে রকম বিয়ে করে সে রকম ধারা আমার সম্মতি দিলুম।
এটা আমার পীরত্ব প্রমাণ করার জন্য শহর-ইয়ারকে বলবই বলব। সে কোন দম্ভভরে চিত্তপ্রসাদ অনুভব করছে যে তার পীরই ইহলোক-পরলোকের একমাত্র পীর! আমি সপ্রমাণ করে ছাড়ব, বেলাভূমিতে তার পীরই একমাত্র নুড়ি নন, আরও বিস্তরে বিস্তর আছে, এবং আমি তো রীতিমতো একটা বোল্ডার– অ্যাব্বড়া পাথরের চাই।
অবশ্য সে-ও ধুরন্ধরী। সে যদি শুধায়, শান্তিনিকেতনে আচার্যের কর্ম আমি কীভাবে সমাধান করলুম তখন আমি কিচ্ছুটি না বলে সাক্ষী মানব কলকাতার একখানি অতি প্রখ্যাত দৈনিকের সম্পাদক মহাশয়কে। তিনি সে-উপাসনায় উপস্থিত ছিলেন।
গতানুগতিক সাধারণ অবস্থায় আমি আত্মচিন্তার জন্য এতখানি ফুরসত পেতুম না। ইতোমধ্যে শহর-ইয়ারের সফেন বুদবুদিত চিত্ত কথায় কথায় বকবকানিতে ফেটে পড়ত। কিংবা তিনখানা রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে ফেলত– তার অভ্যাস অনুযায়ী প্রত্যেকটি অসমাপ্ত রেখে।
এমনকি, এদানির সে কী পড়ছে, আমার সেই প্রথম প্রশ্নের উত্তরও এ তাবৎ সে দেয়নি।
আমি বললুম, জানো, শহর-ইয়ার, আমার চতুর্দশ পুরুষ কিংবা ততোধিক ছিলেন পীর– সুফি?
এতক্ষণ অবধি শহর-ইয়ার ছিল আপন মনের গভীর গহনে আত্মচিন্তায় নিমগ্ন। পীর, সুফি এ দুটি শব্দ তার কানে যেতেই সে ধড়মড়িয়ে জেগে উঠল। তার নিষ্প্রভ, কুয়াশা-মাখা চোখ দুটি সঙ্গে সঙ্গে প্রাচীন দিনের মতো জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠল।
কিন্তু মুখ দিয়ে কথা ফুটল যেন হোঁচট খেতে খেতে।
শুধলো, সে– সে সে কী? আপনি আপনি আপনি তো আমাকে কখনও বলেননি। কী বললেন? –সুফি?
আমি তন্মুহূর্তেই বুঝে গেলুম, শহর-ইয়ারের পীর তাকে সুফিমার্গে দীক্ষিত করেছেন। কিংবা চেষ্টা করেছেন।
আমি কিন্তু অত সহজে ধরা দেব না। তুমি কি আমার কানু যে, বাঁশি শুনেই উদোম হয়ে ছুটব!
আমি প্রাচীন দিনের চটুলতা আনবার ভান করে বললুম, তা, আমি তো কখনও বলিনি- তুমি শুধোনি– আমি প্রথম যৌবনে কবার প্রেমে পড়েছিলুম, তুমি তো কখনও শুধোওনি–
কিন্তু একটা বিষয় লক্ষ করে মনে মনে কিছুটা তৃপ্তি পেলুম। শহর-ইয়ারের গুরু তাকে অজগরের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে পেঁচিয়ে ধরতে পারেননি। নইলে অন্য গুরু অন্য সুফি সম্বন্ধে সে কণামাত্র কৌতূহল দেখাত না। বরঞ্চ এ স্থলে কুরুচিরা মাত্রই অন্য গুরুর কথা উঠলেই তাকে নস্যাৎ করবার জন্য উঠেপড়ে লেগে যায়। প্রাচীন দিনের আপ্তবাক্য মনে এল– অন্যের পিতার নিন্দাবাদ না করেও আপন পিতার প্রশংসা করা যায়।
ওদিকে দেখি, শহর-ইয়ার আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আর এই সর্বপ্রথম দেখলুম, আমার রসিকতা প্রতিক্রিয়া স্বরূপ তার সদাশান্ত ভালের এক প্রান্তে, আঁখিকোণে যেন সামান্যতম অসহিষ্ণুতার কুঞ্চন পরশ লাগিয়ে চলে গেল।
আর দুঃখ হল এই দেখে যে, যে শহর-ইয়ার আমার ভোঁতা রসিকতাতেও একটুখানি সদয় স্মিতহাস্য করত– দু একবার বলেছে, এটা কিন্তু জুৎসই হল না– সে আজ রসিকতার পুকুরে (মানছি ঘোলা জলের এদোপুকুর) যেন সাক্ষাৎ পরমহংসিনী হয়ে গিয়েছে!
এ অভিজ্ঞতা আমার বহুকালের। যে কোনও-কিছুতেই মানুষ মজে গিয়ে সিরিয়স হলেই সবচেয়ে সর্বপ্রথম তার লোপ পায় রসবোধ। এর প্রকৃষ্টতম উদাহরণ প্রেমের বেলা। রসে টইটম্বুর পাড়ার সুকুমার যখন প্রথম প্রেমে পড়ে– ইংরেজিতে যাকে বলে কাফ ল– তখন তাকে যদি আপনি কোনও কিছু না জেনেশুনে নিতান্ত হামলেসলি শুধোন, কী হে, মুখখানা এত শুকনো কেন? সে তখন সেই কাঠিয়াওয়াড়ি চাষার মতো তেড়ে বলবে, শুখ-শুকে লকড়ি বন্ জাউংগা তেরা ক্যা শালা।
ধর্মরাজ্যে আমাদের অখণ্ডসৌভাগ্যবতী খাজিস্তে-বানু মুসম্মৎ বেগম শহর-ইয়ার আল্লা তাঁর শান্-শওকৎ লুৎফ-নজাফৎ হাজার চনদ বৃদ্ধি করুন!–কোন গৌরীশঙ্করের শীর্ষদেশে তথাগতা হয়েছেন সে জানেন তার অধুনালব্ধ পীর সাহেব; আমার কিন্তু এ তত্ত্ব বিলক্ষণ মালুম হচ্ছে, বিবিজান তার স্বামী এস্তেক বাড়ির খানসামা-বাবুরচি এবং আর পাঁচজনের লবেজান করে এনেছেন তো বটেই, আমার সঙ্গে তার যে রসে রসে ভরা রসের মিতালি দিনে দিনে গড়ে উঠেছিল, সেই শিশু নীপতরুটি অধুনা অবহেলার খর তপনে বিবর্ণ পাণ্ডুর; আসন্ন কালবৈশাখীতে ধূলিদলিতা এবং শ্রাবণে হবে কর্দমমদিতা।
শান্তকণ্ঠে বললুম, তুমি তো আমাকে একাধিকবার বলেছ– এখন মনে হচ্ছে, তাতে হয়তো সামান্য বিষাদের সুর মাখানো ছিল– যে, রবীন্দ্রনাথের ধর্মসঙ্গীতে তোমার বুকে তুফান তোলে না। অথচ তার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবারই শ্লাঘার সঙ্গে নিজেকে ধন্য মেনেছ যে রবীন্দ্রনাথের প্রেম-প্রকৃতির গান তোমার অস্থিমজ্জা, তোমার অনিন্দ্যমোহন চিন্ময় ভুবন নির্মাণ করেছে।
রবীন্দ্রনাথের সেই ধর্মসঙ্গীত এবারে একটু কান পেতে শোনো তো।
আমাদের পরিবারে একাধিক সাধক সুফিমার্গ অবলম্বন করেছিলেন। এ পন্থার শেষ পথচারিণী ছিল আমার ছোট বোন সৈয়েদা হবিবুন্নেসা, সে এখন ওপারে। আমার এক ভাগ্নি ঢাকাতে বাংলার অধ্যাপনা করে। সে তার সম্বন্ধে প্রামাণিক প্রবন্ধ লিখেছে। আমার এই বোনটি আবার ছিল সিলেটের পীরানী। প্রতি ভোরে তার বাড়ির সামনে জমে যেত মেয়েছেলেদের ভিড়। তারা এসেছে বোনের দোওয়া নিতে, কাচ্চাবাচ্চাদের অসুখ সারানোর জন্য, বন্ধ্যারা এসেছে মা হবার জন্য, আরও কত কী! আমার বোন তাবিজ-কবজ পানি-পড়া কিচ্ছুটি দিত না। এক একজন করে মেয়েরা ঘরে ঢুকত আর সে শুধু আশীর্বাদ করত। বহুকাল ধরে, কেন জানিনে, সে শয্যাগ্রহণ করেছিল। শুয়ে শুয়ে গুন গুন করে গান গাইত। সুফিতত্ত্বের মারিফতি গান। এবং নিজেই সুর দিয়ে অনেকগুলি গান রচেছিল। ঢাকা বেতার মাঝে মাঝে সেগুলো শোনায়। তার একটা গীতিসঙ্কলন আমার আব্বা প্রকাশ করেন। কিন্তু সে কথা থাক। আমি বলছিলুম।
শহর-ইয়ার প্রাচীন দিনের দৃঢ়কণ্ঠে বাধা দিয়ে বললে, না। আপনার বোনের কথা বলুন।
আমি দৃঢ়তর কণ্ঠে বললুম না। আমিও এখন তপ্ত গরম। তুমি যদি গুরু নিয়ে মেতে উঠে আপন-জন, বেগানা-জন সর্বজনকে স্বচ্ছন্দে অবহেলা করতে পার, তবে আমিও তোমার ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে তারও বেশি অবহেলা করতে পারি।
বললুম তুমি প্রশ্ন শুধিয়েছিলে, আমাদের পরিবারের সুফিদের সম্বন্ধে। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও কিছু কিছু বললুম। নইলে কোথায় রবীন্দ্রনাথের বিশ্বজনমান্য ধর্মসঙ্গীত–আফটার অল গীতাঞ্জলির ধর্মসঙ্গীতই তো তাঁকে নোবেল প্রাইজ পাইয়ে দেয় আর কোথায় আমার ছোট বোনের মারিফতি সুফিগীতি!
আমি কিন্তু তখন মনে মনে বেশ খানিকটে আত্মপ্রসাদ উপভোগ করছি। বিবিকে যে তাঁর আকস্মিক ধর্মোন্মত্ততার কচ্ছপের খোল থেকে (তওবা! তওবা!! কাছিম আমাদের কাছে হারাম-পাপবিদ্ধ অপবিত্র না হলেও মকরূহ, অর্থাৎ বর্জনীয়) বের করতে পেরেছি সেটাও তো কিছু হেলাফেলার ফেলনা নয়।
যদিও আমি না শান্তা সুফি-কন্যার অগ্রজ তবু তুর্ক-সিপাহির মোগলাই কণ্ঠে আদেশ দিলুম, ওই রেকর্ডটা বাজাও তো–
তাই তোমার আনন্দ আমার পর
তুমি তাই এসেছ নীচে।
আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর,
তোমার প্রেম হত যে মিছে।
শহর-ইয়ার রেকর্ডটি লাগাল। এতদিন অন্য গানের বেলা মাঝে মাঝে সে যে-রকম গুনগুন করত, এ গানে সে সেটা করল না। ধর্মসঙ্গীত তার মনে কী প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করছে সেটা ঠিক ঠিক বুঝতে পারলুম না।
গান শেষ হলে বললুম, জানো শহর-ইয়ার এ গানেরই একটি লোকায়ত রূপ আছে :
জ্ঞানের অগম্য তুমি, প্রেমের ভিখারি।
দ্বারে দ্বারে মাগো প্রেম নয়নেতে বারি ॥
কোথায় তোমার ছত্রদণ্ড কোথায় সিংহাসন।
পাতকীর চরণতলে লুটায় আসন ॥
শহর-ইয়ার কোনওকিছু বলার পূর্বেই আমি আদেশ দিলুম, অনেক রাত হয়েছে; ঘুমুতে যাও।
আসলে শহর-ইয়ার এখন ধর্মপথে স্বপনচারিণী। পরিপূর্ণ সুষুপ্ত অবস্থায় কোনও কোনও মুদ্রিতাখি নারী-পুরুষ দৃঢ় পদক্ষেপে ভয়-নির্ভয়াতীত অবস্থায় ভ্রমণ করে সংকীর্ণতম আলিসার উপর দিয়ে কোন বিধাতা বা অপদেবতার অদৃশ্য করাঙ্গুলি সঙ্কেতে কে জানে? এই স্বপনচারীর হাল তখন বড়ই নাজুক এবং সঙ্কটময়। অকস্মাৎ কেউ তখন তার নাম ধরে ডেকে উঠলে বা তার গাত্ৰস্পর্শ করলে সে তার সম্মোহিত ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে এবং সেই মুহূর্তেই কোনও একটা মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে ওঠাটা মোটেই অসম্ভব নয়।
শহর-ইয়ার এখন সে ক্ষুরস্য ধারা সুফিরহস্যের কেশ-পরিমাণ সংকীর্ণ পথের উপর দিয়ে এই নব-অভিযানে বেরিয়েছে অর্ধসম্মোহিত অর্ধসচেতনাবস্থায় তাকে এখন আকস্মিক তর্ক-মুদার দ্বারা সচকিত জাগরণে ফিরিয়ে আনা কি আদৌ সমীচীন হবে? যদ্যপি সেটা আদপেই সম্ভবে।
কিন্তু প্রশ্ন, তাকে জাগাতে যাব কেন? নিতান্ত জড়বাদী চার্বাকপন্থি ভিন্ন এ দায়িত্ব নেবে কোন সবজান্তা প্যাকম্বর! হয়তো সে সত্য পথেই চলেছে। তদুপরি আমার জানা আছে, খ্রিস্টান-মুসলিম, জৈন, বৌদ্ধ, হিন্দু, ভক্তিতত্ত্বের, বহু তথাগত মহাত্মা বলে গেছেন, এ মার্গে পদার্পণ করার প্রথম অবস্থায় অবতরণিকায় প্রায় প্রত্যেক সত্যসাধকই অম্লাধিককাল মোহাচ্ছন্ন অবস্থায় কাটায়। সামান্য মানবীর প্রেমমুগ্ধ দান্তেও নাকি মোহাচ্ছন্ন অবস্থায় দিভ্রান্তের মতো যত্রতত্র ঘুরে বেড়াতেন। আর এ নারী তো মুগ্ধা সবচেয়ে সর্বনেশে প্রেমে।
কিংবা এ নারী কি এখন দ্বিতীয় মনজিলে খ্রিস্টান মিষ্টিকরা যাকে বলে মেনশনঃ এখানে নাকি আসে অ্যারিডিটি– ঊষরতা, অনুর্বরতা। জগদ্বল্লভ নাকি ভক্তকে গোড়ার দিকেই এক ঝলক দর্শন দিয়ে মিলিয়ে যান। শ্রীরাধা তার বল্লভ রসরাজের সঙ্গসুখ কতকাল পেয়েছিলেন সেটা পরবর্তীকালে অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের মথুরা গমনের পর তিনি নিজেই বলতে পারতেন না। সিলেটের একাধিক গ্রাম্যগীতিতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, আমার মরম তাঁর স্মরণে বলে আমি তাকে পেয়েছি ওইটুকু সময়ের তরে, বিদ্যুতার পৃথ্বীতলে পৌঁছতে যতখানি সময় লাগে। তার পরই আরম্ভ হয় আকুলি-বিকুলি।
বৃন্দাবন ত্যাগ করে শ্রীকৃষ্ণের মথুরা-গমন এবং সাধককে একবার ক্ষণতরে দর্শন দিয়ে জগদ্বল্লভের অন্তর্ধান সম্পূর্ণ একই ঘটনা।
তখন সেই ঊষরকালে সর্ব প্রেমিক-প্রেমিকাই আর গৃহবাসিনী হয়ে থাকতে চায় না, তার তখন কোন প্রয়োজন রজত কাঞ্চন, সে তখন গেরুয়া বসন অঙ্গেতে ধরে তার স্নেহময়ী মাতাকে পর্যন্ত ত্যাগ করে।
শহর-ইয়ার যে আত্মজন প্রিয়জনকে অবহেলা করেছে সেটা তো সজ্ঞানে স্বেচ্ছায় নয়।
বৌদ্ধ ভিক্ষুণীদের জন্য, ক্যাথলিক নাদের জন্য যেরকম সংঘ-মনাস্টরি আছে, মুসলমান রমণীর জন্য সে রকম কিছু একটা থাকলে এতদিনে হয়তো সে সেখানে আশ্রয় নিয়ে নিত। জীবন কাটাত ধ্যানধারণায়, উপবাস-কৃচ্ছ্বসাধনে, জনসেবায়—
সেবা?
আমি যে এতক্ষণ শহর-ইয়ারের সমর্থনে যুক্তিতর্ক দিয়ে মহলের পর মহল গড়ে তুলছিলুম সেই চিন্ময় এমারৎ এক লহমায় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে ধূলিদলিত মাত্র একটি শব্দের অনধিকার প্রবেশে। সেবা!
সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল, নবীন সাধকের প্রতি সুফি সম্প্রদায়ের প্রধান গুরু হুজবেরির প্রত্যাদেশ :
সাধনার প্রথম বত্সরে মানুষের সেবা করবে,
দ্বিতীয় বৎসরে আল্লার সেবা করবে,
তৃতীয় বৎসরে আত্মদর্শনে নিয়োজিত হবে।
ডাক্তার, আমি, বাড়ির এত যে খেদমতগার সুবো-শাম শহরু-ইয়ারের মুখের পানে তাকিয়ে থাকে, তাকে সত্যকার মা জেনে আম্মা বলে ডাকে আমরা কি মানুষ নই? সাধনার প্রথম বৎসরে তো মানুষের সেবা করারই প্রত্যাদেশ।
একদা শহর-ইয়ারকে বলেছিলুম, তোমার সর্বাঙ্গসুন্দর বেশভূষা হবে তোমার স্বামীর জন্য। আর আজ যদি তুমি সর্বসুন্দরের সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত করো, তবে তার সর্বপ্রথম সর্বোত্তম সেবা পাবে তোমার স্বামী।
.
১৩.
খুব বেশিক্ষণ আত্মচিন্তা করিনি। দেহের ক্লান্তি তো ছিলই, তদুপরি ডাক্তারের বিপাক বিহ্বলতা, শহর-ইয়ারের দূরত্ব-দূরত্ব ভাব আমার মনকেও অসাড় করে তুলেছিল। ঘুমিয়ে পড়েছিলুম অল্পক্ষণের মধ্যেই। হজরত পয়গম্বর বলেছেন– যদিও তাঁর বাক্যটি কোনও শাস্ত্রগ্রন্থে আমি স্বচক্ষে দেখিনি– মূর্থের উপাসনা অপেক্ষা পণ্ডিতের ন্দ্রিা শ্রেয়ঃ। কিন্তু মূখের নিদ্রা কোন পর্যায়ে পড়ে সে সম্বন্ধে কোনও আপ্তবাক্য আমি এ তাবৎ শুনিনি, শাস্ত্রেও দেখিনি। আমি মূর্খ। জাগ্রতাবস্থায় আমার পাপাত্মা সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করে না। তাই বোধ হয় তিনি নিদ্রিতাবস্থায় তাঁর নামগান শুনিয়ে দেন।
ধড়মড়িয়ে জেগে উঠে সম্পূর্ণ সচেতন হলুম।
শুনতে পেলুম, বেশ কিছুটা দূর থেকে অতি মধুর কণ্ঠে জপগীতি :
ইয়া লতিফুল/তুফবি না।
নাহন্য বিদক/কুল্লি না ॥
আরবি ভাষার দোঁহা।
হে সুন্দর, তোমার সৌন্দর্য আমাদেরকে দাও।
(কারণ) আমরা তোমার পূজারি, আমরা সকলেই।
আমার মনে ধোঁকা লাগল, শহর-ইয়ার কি এ দোহাটির গভীরে পৌঁছে পুরোপুরি মর্মার্থটি হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছে?
যে আল্লাকে এ স্থলে আহ্বান করা হচ্ছে তিনি লতিফ। শব্দটি সুন্দর এবং করুণাময় দুই অর্থই ধরে। অর্থাৎ একই শব্দে তাঁকে শিবম্ ও সুন্দর বলা হচ্ছে। এখানে তার কাছে প্রার্থনা করা হচ্ছে উতুফ!
এর একটি অর্থ সরল- তুমি করুণাময় হও (বি না– আমাদের প্রতি) কিন্তু অন্য অর্থ– তোমার সৌন্দর্য আমাদের প্রতি বিকিরণ করো কিংবা/এবং আমাদেরকেও সুন্দর করে তোলো।
আল্লার বহু গুণ বোঝাবার জন্য মানুষ তাকে বহু নাম দিয়েছে। কিন্তু সুফিদের কাছে তিনি হক, অর্থাৎ সত্যম্। প্রখ্যাত সুফি মনসুর অল্-হল্লাজ আনা হক, অর্থাৎ আমিই সত্য আমিই ব্রহ্ম প্রচার করার দরুন মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন। কথিত আছে, যখন তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে কর্তিত হয় তখন প্রতি খণ্ড থেকে রব ওঠে আনাল হ, আনা হক!
শহর-ইয়ার সত্যের সন্ধানে বেরিয়েছে, না সুন্দরের সন্ধানে?
তার ললিত কণ্ঠের করুণ জপের (জির) :
— সুর
লাগিছে আমার কানে অসাথে মিলিত মধুর
….. আছে তাহে সমাপ্তির ব্যথা,
আছে তাহে নবতম আরম্ভের মঙ্গল-বারতা।
কিন্তু আপন অনিচ্ছা সত্ত্বেও লক্ষ করলুম শহু-ইয়ারের কণ্ঠস্বর তাদের শোবার ঘর থেকে আসছে না। তবে কি সে স্বামীসঙ্গ ত্যাগ করেছে। ইসলামের আইন-অনুযায়ী সে তো তা পারে না, তার স্বামীও পারে না।
কিন্তু আমিই-বা ঘামের ফোঁটায় কুমির দেখছি কেন?
হয়তো ত্রিমাযামিনীব্যাপী তার জি স্বামীর ন্দ্রিাকে ব্যাঘাত করবে বলে সে অন্য কামরায় আশ্রয় নিয়েছে।
অবসন্ন মনে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালুম। রাত্রির কলকাতার আকাশ যেন নির্ধণ ব্রহ্ম। কোনওরকম পরিবর্তন তার হয় না। সদাই একই, কেমন যেন হিমানীর গ্লানি-মাখা পাণ্ডুর ধূসর। শুনেছি, যুদ্ধের সময় নাকি ব্ল্যাক-আউটের কল্যাণে কলকাতার মডার্ন কবিরা জীবনে প্রথম চন্দ্ৰমা দেখতে পান, এবং ভয়ে আঁতকে উঠেছিলেন।
এটা কাল সকালেই শহর-ইয়ারকে বলতে হবে। সে আকছারই গবিতা নিয়ে টকঝাল ফোড়ন কাটে– ওদিকে এসব আবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েও। একদিন বিষাদমাখা সুরে আমাকে বলেছিল, আমি যে এসব কবিতাতে রস পাইনে তার জন্য কি আমার দুঃখ হয় না? আমি এরই মধ্যে এত বুড়িয়ে গেলুম কী করে যে নবীনদের সুর আমার প্রাণে সাড়া জাগাতে পারে না?
তখন হঠাৎ মনে ব্যথা জাগল, সেসব ঊষা-রসের নিশা তো তার আর নেই।
এসব ব্যথার উপশমের জন্য বিধাতা সৃষ্টি করেছেন নিদ্রা।
বেলাতে ঘুম ভাঙল। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললুম, বাঁচালে, বাবা। এতক্ষণে নিশ্চয়ই ডাক্তার চলে গেছেন কর্মস্থলে এবং শহর-ইয়ার গেছেন তার পীরের আস্তানায়। কে যেতে চায় ওই নিরানন্দ ডাইনিংরুমে? আর এই তো প্রথম আমরা তিনজন একসঙ্গে মুখোমুখি হব। কী হবে গিয়ে ওই আড়ষ্ট মূক সমাজে। আমি তো আর বান্দেবী নই যে, মূককে বাঁচাল করে তুলব।
কিন্তু শান্তি কোথায়? কৌটিল্য যে বলেছেন, উৎসবে-ব্যসনে, দুর্ভিক্ষে-রাষ্ট্রবিপ্লবে যে সঙ্গ দেয় সেই ব্যক্তিই বান্ধব– তার কী?
ব্যসন মানে অত্যধিক আসক্তিজনিত বিপত্তি। শহর-ইয়ারের এই অত্যধিক ধর্মাসক্তিও একপ্রকারের ব্যসন। কিন্তু এটাই-বা দীর্ঘস্থায়ী হবে কে বলতে পারে? অবশেষে সে হয়তো তার ভারসাম্য ফিরে পাবে এবং সর্বশেষে সে শব্দার্থে ডাক্তারের সহধর্মিণী হবে। ভুল বললুম, এতদিন ধরে ডাক্তার তো ভেবেছে, সে যে ক্রিয়াকর্ম করে যাচ্ছে সেখানেই তার ধর্মজীবনের পরিসমাপ্তি- সেই শুষ্ক আচারানুষ্ঠানের বিশীর্ণ তরুমূলে বরঞ্চ শহর-ইয়ার তখন সিঞ্চন করবে সুফি-সন্তদের প্রেম-উৎস থেকে আহরিত নব মন্দাকিনীধারা। ধর্মবাবদে কৌতূহলী অথচ সেটাকে বাস্তবে পরিণত করতে হলে যে ধ্যানধারণা সাধনা-উপাসনার প্রয়োজন সে-খাতায় সম্পূর্ণ রিক্ত এই যে অধম–সে-ও উপকৃত হবে।
গুড মর্নিং, গুড মর্নিং, গুড মর্নিং হেঁকে খানা-কামরায় ঢুকলুম।
ডাক্তারকে অপেক্ষাকৃত প্রফুল্লতর দেখাচ্ছে। তবে কি এই খোদার-সিধে লোকটা ওই দুরাশা নিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছে যে, আমি আসার দরুন তার সব মুশকিল আসান হয়ে যাবে। মূর্খ, মূর্খ, মূর্খ! আমি কি টেলিফোনের 199 যে, হোয়েন ইন্ ট্রবল-এ নম্বর রিং করলেই সর্ব ঝামেলা ফৈসালা হয়ে যাবে, না আমি পীরপ্যাকম্বর-গুরুগোসাঁইয়ের খ্যাট?–যদ্যপি শহর-ইয়ারের নবলব্ধ গরিমা রোওয়াবটাকে কঞ্চিৎ ঘায়েল করার জন্য কাল রাত্রে আমি মুখে মুখে হাইজাম্প লঙজাম্প মেরেছি বিস্তর শহর-ইয়ারের জিকরের সেই লতিফ তাঁর লু (দাক্ষিণ্য) বর্ষণ করে বর্বরতম আমার এ মদদর্প যেন ক্ষমা করে দেন।
ডাক্তারকে শুধালুম, কই, আজ যে এত্তা ল্যাটে? তবে কি যে-সব কঙ্কাল নিয়ে রিসার্চ করছেন তারা সরকারি ধর্মঘট করেছে, না রবিঠাকুরের কঙ্কালের মতো মোলায়েম মোলায়েম গল্প বলার জন্য মহিলা-মহলের প্যাটার্নে কঙ্কাল-মহল প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তাবৎ কঙ্কাল বেতার থেকে দাওয়াত পেয়েছ?
অনুমান করলুম, ডাক্তার সজ্ঞানে কর্মস্থলে যেতে বিলম্ব করছে। বউকে যতখানি পারে ঠেকিয়ে রাখছে।
ডাক্তার বললেন, তা আর বিচিত্র কী? শহর-ইয়ারই কিছুদিন পূর্বে বলছিল বেতারের হাঁড়িতে যা চাল বাড়ন্ত, আমার কঙ্কালের না ডাক পড়ে?
শহর-ইয়ার তখন ডাক্তারের লাঞ্চের জন্য স্যালাডে যে মায়োনেজ দেবে তার জন্য ডিমের কুসুম, সরষের তেল আর নেবু নিয়ে বসেছে।
আমি তার দিকে তাকিয়ে বললুম, তবেই দেখ, ইয়ার, শুধু যে গ্রেট মাইন্ডজ থিন্ক এলাইক তাই নয়, দৈবাৎ কখনও-সখনও কোনও নীলমণি-চন্দ্রমায় তোমার মতো গ্রেট মাই আর আমার মতো স্মল মাইড়ও একইরকম চিন্তা করে। আর তুমি যে বেতার তথা কঙ্কালতত্ত্ব ডাক্তারকে বলেছ সেটি আমি একটি ব্যঙ্গচিত্রেও দেখেছি। গত যুদ্ধে হিটলারের যখন তাবৎ সৈন্য খতম, তখন আমাদেরই ডাক্তারের মতো এক ডাক্তার বার্লিনের যাদুঘরে গিয়ে একটা কঙ্কালের পাঁজরার উপর স্টিতস্কোপ রেখে পাশের রংরুট আপিসারকে বলছেন, হ্যাঁ, ফিট ফ দি আর্মি!
তার পর কথা ঘুরিয়ে নিয়ে বললুম, আমি তো শুনেছি, মায়োনেজ তৈরি হয় অলিভ অয়েল আর সিরকা দিয়ে।
শহর-ইয়ার আমার দিকে না তাকিয়েই বললে, ঠিকই শুনেছেন, কিন্তু অনেকেই তো মায়োনেজের ধক্ বাড়াবার জন্য ফিকে অলিভ অয়েলে ঝাঁজালো মাস্টার্ড পাউডার দেয়। ও দুটোতে মিশে তা হলে তো সর্ষের তেলেই দাঁড়াবে। আর ইয়োরোপে টক নেবু নেই বলেই তো শুনেছি, তারা ভিনিগার ব্যবহার করে। নেবু অনেক তাজা।
ইতোমধ্যে জমিল এসে শুধল, কী খাব?
উদাত্ত কণ্ঠে বললুম, ব্রাদার, আমি তো ব্রেকফাস্ট খাইনে। কিন্তু কাল রাত্রের খানাতে ঠিক রুচি ছিল না বলে মেকদারে একটু কমতি পড়ে গিয়েছিল।… দাও কিছু একটা। শেষ কথা দুটি বললুম ঈষৎ অবহেলা-ভরে।
আমার মতলব, শহর-ইয়ারকে ইঙ্গিতে অতি মোলায়েম একটি খোঁচা দেওয়া। ভাবখানা এই, তুমি সামনে বসে ভালো করে খাবার জন্য চোটপাট করবে, রসালাপের মধুসিঞ্চন করবে, তবে তো আমার জিভে জল, পেটে জারক রসের ছয়লাপ জাগবে। নইলে আমার কি আর অন্যত্র অন্ন জোটে না?
এবারে শহর-ইয়ার মুখ তুলে আমার দিকে তাকাল। আমি যেন দেখতে পেলুম, কেমন যেন একটা বেদনা-ভরা নৈরাশ্য।
তবে কি সে বলতে চায়, সে খেয়ালখুশিতে আমাকে অবহেলা করেনি; আমাকে, তার স্বামীকে সেবা করার মতো শক্তি তার আর নেই।
তার পর ধীরে ধীরে জমিলের কাছে গিয়ে বললে, আমি খাবার তৈরি করছি, তুমি কমলালেবুর রস ঠিক করো।
আমার আপসোস হল। কী দরকার ছিল আমার এ অভিমান দেখাবার। আমি না স্থির করেছিলুম, আমি অভিমান করব না। আমি, অগা, কী করে জানব এ মেয়ের বুকের ভিতর কী তুফান উঠেছে? আমি কী করে বুঝব ওর মনের কথা? আপন মা-ই কী সবসময় বুঝতে পারে, তার সন্তানের আশা-আকাঙ্ক্ষার দ্বন্দ্ব? আমার তরুণ বয়সে দেখেছি, একাধিক সুশিক্ষিতা মাতা পুত্রকে স্বাধীনতা সংগ্রামে নামতে বাধা দিয়েছেন। হয়তো সন্তানের অবশ্যম্ভাবী ভবিষ্যৎ কারাবাসের দুঃখ-যন্ত্রণা মাতাকে হ্রাসাতুর করে তুলেছিল। যাই হোক যাই থাক, মা তো তখন বুঝতে পারেনি ছেলে বিভীষিকা দেখছে, সে যদি তার আদর্শ ত্যাগ করে কারাগারের বাইরে থেকে যায় তবে সেই মুক্ত পৃথিবী তখন তার পক্ষে হয়ে দাঁড়াবে বৃহত্তর, বৃহত্তম কারাগার!
শহর-ইয়ার আমার কে, যে, আমি তার হৃদয়মনের আশা-আকাক্ষার দ্বন্দ্ব আপন হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে পারব? মুসলমান সমাজের ভিতর আমাদের দু জনার মধ্যে যে সম্পর্ক দিন দিন ক্রমশ বিকশিত হচ্ছিল, সেরকম সম্পর্ক আমাদের সমাজে কিছুদিন পূর্বেও ছিল সম্পূর্ণ অসম্ভব, এখনও সাতিশয় বিরল। খুদ আরব দেশ, ইরান-তুরান, আফগানিস্তান এমনকি এদেশের হরিয়ানা-মধ্যপ্রদেশও তো এসব বাবদে বাঙালি মুসলমান সমাজের ঢের ঢের পিছনে। ওসব দেশে আমাদের সম্পর্ক নিয়ে হদিস খুঁজতে যাওয়া বিলকুল বেকার। বরঞ্চ শহর-ইয়ার ও আমার উভয়ের অনুভূতিক্ষেত্রে যিনি আবাল্য রসসিঞ্চন করেছেন, সেই রবীন্দ্রনাথকে শুধোই। তিনি এই সম্পর্ক নিয়ে চিন্তা করে করে পৌঁছেছিলেন কবি বাণভট্টের কাদম্বরী আখ্যানে। সেখানে পত্রলেখা নাম্নী তরুণী কুমারী যুবরাজ চন্দ্ৰাপীড়ের পত্নী নয়, প্রণয়িনীও নয়, কিংকরীও নয়, পুরুষের সহচরী।
কিন্তু শহর-ইয়ার আমার সহচরী কেন, নমসহচরীও তো নয়।
তদুপরি সে বিবাহিতা, স্বামীর প্রতি অনুরক্তা; আমিও একদারনিষ্ঠ।
কবিগুরুর তীক্ষ্ণদৃষ্টির খরতর শর কিন্তু আমাদের এই নাজুক বা ডেলিকেট সম্পর্কের অন্তত একটি সূক্ষ্মতম কেন্দ্রবিন্দুকে লক্ষ্যভেদ করতে পেরেছে। পত্রলেখা যেখানে (চন্দ্ৰাপীড়ের সান্নিধ্যে) আসিয়া যে অতি অল্প স্থানে আশ্রয় লইয়াছে সেখানে তাহার আসিবার কোনওপ্রকার প্রয়োজন ছিল না। স্থানটি তাহার পক্ষে বড় সংকীর্ণ, একটু এদিকে ওদিকে পা দিলেই সংকট।
পরিস্থিতিতে অবশ্য পার্থক্য আছে। পত্ৰলেখা ছিলেন চন্দ্ৰাপীড়ের তাম্বুল করঙ্কবাহিনী পরিচারিকা; চন্দ্ৰাপীড় যুবরাজ। যুবরাজকে তো সাবধানে পা ফেলতে হয় না। কিন্তু শহর-ইয়ার ও আমার সম্পর্ক তো বরাবরেষু।
তাই শহর-ইয়ারের স্থানটি তাহার পক্ষে যেমন বড় সংকীর্ণ আমারও একটু এদিকে ওদিকে পা ফেলিলেই সংকট।
তার প্রতি আমার সহানুভূতি, তার প্রতি আমার ভালোবাসা, তার অন্তরের দ্বন্দ্বে তাকে সহায়তা করা– এ সবই যেন একটু এদিকে ওদিকে পা না ফেলে! তা হলেই সংকট।
আমার চিন্তাধারায় বাধা পড়ল। ডাক্তার আসন ছেড়ে উঠে বললে, তা হলে আসি; আজ বড্ড দেরি হয়ে গেছে। আমিও সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালুম, অর্ধসমাপ্ত ব্রেকফাস্ট টেবিলে রেখে। বললুম, আমাকেও একটুখানি বাইরে যেতে হবে। আপনি আমাকে ড্রপ করতে পারবেন?
উভয়েই আশ্চর্য! কারণ আমি এ বাড়ি থেকে মাত্র একবার বেরিয়েছিলুম– তা-ও ওদেরই সঙ্গে।
ডাক্তার বললে, নিশ্চয়, নিশ্চয়! কিন্তু আপনি ব্রেকফাস্ট শেষ করুন।
আমি তাচ্ছিল্য-ভরা কণ্ঠে বললুম, ওহ! ব্রেকফাস্ট! সে বালাই যা আমি কালেকস্মিনে খাই, সে তো বুড়ি ছোঁওয়ার মতো।
এটা নিছক শহর-ইয়ারকে খুশি করার জন্য। সে যেন না ভাবে যে, সত্যসত্যই কাল রাত্রে আমি অভুক্ত ছিলাম।
ওষুধ কিছুটা ধরল, শহর-ইয়ার আমার দিকে যেন একটুখানি কৃষ্ণনয়নে তাকাল। মেয়েটি সর্বার্থে অতুলনীয়া।
ওরা কিছু শুধোয়নি। আমি নিজের থেকেই বললুম, চললুম, অভিসারে। আমার সিঁথির সিঁদুরের সন্ধানে।
ডাক্তার তো বিস্ময়বিহ্বল, সিঁথির সিঁদুর? সে আবার কী? শহর-ইয়ারও তদ্বৎ।
একগাল হেসে বললুম, আমার পাবলিশার গো, আমার পাবলিশার। উনি আছেন বলেই তো দু পয়সা পাই, মাছ-মাংস খাই। সিঁথির সিঁদুর না তো কী? ওদের প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষা না করেই বললুম, আমার ফিরতে দেরি হবে। আমার পাবলিশার রীতিমতো খানদানি মনিষ্যি। সায়েসুববাদের মতো পয়লা নম্বরি হোটেলে লাঞ্চ খান। বিজনেস টকম যা-কিছু সেসব হোটেলের বার-এ পিজি (পিং জিন) গেলাশের থারমোমিটার সাইজের ডাঁটাটি ঘোরাতে ঘোরাতে।… আমার গাড়ির দরকার নেই।
আমার ইচ্ছা, শহর-ইয়ারের এদানীংকার প্রোগ্রাম ডিস্টার্ব না করা। মুরশিদমঞ্জিলে যাবার জন্য তার যদি নিত্যিনিত্য পারিবারিক গাড়ির প্রয়োজন হয় তবে তাই হোক। আমি রাত না করে ফিরব না।
আমি আশা করেছিলুম, সে বুঝে যাবে এটা আমার কোনও অভিমানজাত প্রত্যাখ্যান নয়। কিছুটা প্রসন্ন নয়নে আমার দিকে মুহূর্তেক তাকাবে।
রহস্যময়ী এ নারী। শুধু বললে, আমারও তো গাড়ির দরকার নেই।
আমার খুশি হওয়ার কথা, কারণ এ যুগে মায় ড্রাইভার চোপ্পর দিনের জন্য মোটরপ্রাপ্তি যেন চৌরঙ্গিতে সোঁদরবনের কেঁদো বাঘ-সওয়ার গাজী পীরের ইয়ার দক্ষিণ-রায়ের দাক্ষিণ্যপ্রাপ্তি! কিন্তু আমার উল্টো হল গোশশা। ওহ! তুমি বুঝি ধরে নিয়েছ, যানাভাবে দ্বিপ্রহর রৌদ্রে, ঘর্মাক্ত কলেবরে যত বেশি ঠেঙিয়ে ঠেঙিয়ে গুরুর পদপ্রান্তে পৌঁছবে সেই অনুপাতে তোমার মুরশিদসেবার পুণ্যধ্বজা মনুমেন্ট ছাড়িয়ে আল্লাতালার কুর্সিপানে ধাওয়া করবে! তলিফ বরদাস্ত করাতেই সওয়াব কৃচ্ছ্বাধনেই পুণ্য– অর্ধসিদ্ধ বৈরাগ্যবিলাসীদের মুখে এ জাতীয় জনপদসুলভ নীতিবাক্য শুনে শুনে এক কামিল্ সুফি বিরক্তিভরে বক্রোক্তি করেছিলেন, তবে চড়ো না গে প্রতি ভোরে হিমালয়ের চুড়ো, সেখানে পড়ে গে ফজরের নামাজ বেহেশতের বেবাক ফেরেস্তা সেই হুদো হুদো পুণ্যের খতেন রাখতে গিয়ে হিমসিম খেয়ে যাবেন। আর চূড়ো চুড়ার বেপথে যদি ফেঁসে যাও তবে তা তো হাজার দফে বেতর। তখন তুমি পাবে শহিদের উচ্চাসন। পূর্বকৃত সর্বপাপভার থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে সরাসরি চলে যাবে বেহেশতে!
না গো, শহর-ইয়ার, তোমার পুণ্যপন্থা আমি অত সহজে নিষ্কণ্টক করে দেব না। দুপুরে বাড়িতে খাবও না। তোমার প্রোগ্রাম-প্ল্যান আমি এতই নর্মাল সহজ করে দেব যে তুমি কৃসাধন করার রন্ধ্রটি পর্যন্ত খুঁজে পাবে না। আমি সতী বেহুলার চেয়ে ঢের বেশি চালাক।
উপস্থিত আমি স্রেফ একটি বারের তরে তোমার মুরশি-বিরিঞ্চ-বাবার মুখারিদ রুচিটির দর্শনলাভ করে যে পুণ্যসঞ্চয় হবে সেইটে মনিঅর্ডার করে পাঠিয়ে দেব স্বর্গের পোস্টাপিসে হোথায় সিট রিজার্ভেশনের জন্য ইনসিওরেনসের পয়লা কিস্তি!
আহা, শহর-ইয়ার, তুমি দর্শন পেয়ে গেলে, তুমি ভাগ্যবতী :
অদ্যাপিও সেই খেলা খেলে গোরা রায়।
মধ্যে মধ্যে ভাগ্যবানে দেখিবারে পায় ॥
এবং ততোধিক বিস্ময় মানতে হয় যে আবাল্য ধর্মশাস্ত্র, এমনকি ধর্মসঙ্গীতও উপেক্ষা করে কোন মন্ত্রবলে কোন পুণ্যফলে নিরঙ্কুশ অব্যবহিত পদ্ধতিতে আজ অকস্মাৎ হৃদয়ঙ্গম করে ফেললে,
যদ্যপি আমার গুরু বেশ্যাবাড়ি যায়।
তথাপি আমার গুরু নিত্যানন্দ রায় ॥
.
১৪.
সর্বপ্রকারের বাদ-প্রতিবাদ অখণ্ড উপেক্ষা করে গেলুম শোবার ঘরে। চীনাংশুক অঙ্গবাসটি স্কন্ধোপরি লম্বমান করে দৃঢ়পদক্ষেপে দৃকপাত না করে সোপান অবরোহণান্তে রাজসিক পদ্ধতিতে আরোহণ করলুম সেই মান্ধাতাতাতযুবনাশ্ব সমসাময়িক স্বতশ্চলশকটে।
ডাক্তার সভয় সবিনয় কণ্ঠে অনুরোধ করলেন, গাড়িটা রাখুন না সমস্তদিন আপনার সঙ্গে। আমি ভারি খুশি হব। আর জানেন তো কলকাতায় যানবাহনের হাল।
আমি স্থির কণ্ঠে বললুম, আপনাকে কোনও বাবদেই না বলতে আমার বড় বাধে। কিন্তু ক্ষণতরে বিবেচনা করুন, আমি বেরিয়েছি চতুর্বর্গের দ্বিতীয় বর্গের অর্থাৎ অর্থের সন্ধানে; পক্ষান্তরে শহর-ইয়ার বেরুবেন চতুর্থ বর্গ অর্থাৎ মোক্ষের সন্ধানে। কার সেবাতে এস্থলে নিয়োজিত হবে এই শকট? তার পর মৃদুহাস্য করে বললুম, অপরাধ নেবেন না, শকটটিও মুমূর্ষ তথা মুমুক্ষু তারও তো ভূত-ভবিষ্যৎ আছে। সেই-বা যাবে না কেন রাজেন্দ্রাণী সঙ্গমে দেবদর্শনে?
ডাক্তার নিম-সম্মতি জানিয়ে বললেন, এ গাড়ি আমি অতি অবশ্যই স্ক্রেপরূপে বিক্রি করব না। তাকে তার আপন গারাজচ্যুতও করব না। এবং নিশ্চয়ই রাখব নিত্য রানিং অর্ডারে, আপনার ভাষায় স্বতশ্চলাবস্থায়।
আমি প্রসন্ন বদনে বললুম, আর আপনার নাতি সেটি চড়ে ভিনটেজ কার রেসে নামবে।
বলতে পারব না, হয়তো আমার দৃষ্টিভ্রম– কিন্তু আমার যেন মনে হল ডাক্তার অন্যদিকে অতি সামান্য মুখ ফেরালেন।
আমি সে কুহেলি কাটাবার জন্য শুধালুম, ডাক্তার, আপনার মনে আছে, গত বর্ষারম্ভে আপনারা যখন শান্তিনিকেতনে বেড়াতে এসেছিলেন তখন একদিন অপরাহ্নে ওঠে প্রচণ্ড কালবৈশাখীর ঝড়, তার পর মুদগরধারে শিলাবৃষ্টিপাত এবং সর্বশেষে রুপালি ঝালরের মতো ঝিমঝিম বরষন? শহর-ইয়ার বৃষ্টিতে ভিজবে বলে একা চলে যায় আদিত্যপুরের দিকে।
আমরা দু জনাতে তখন বারান্দায় বসে অনেকক্ষণ ধরে ইসলামের প্রচার ও প্রসার নিয়ে আলোচনা করি। শেষের দিকে আপনি ইসলাম সম্বন্ধে ভালো ভালো রেফরেনস বইয়ের একটি ফিরিস্তি আমার কাছে চান। সে-নির্ঘন্ট শেষ করার পূর্বেই শহর-ইয়ার বাড়ি ফেরে। তাই তখন দশ খণ্ডে অসমাপ্ত একখানি অতুলনীয় গ্রন্থের কথা আমার আর বলা হয়ে ওঠেনি।
বইখানির– বরঞ্চ বলা উচিত এই ইসলামবিশ্বকোষ-এর নাম আন্নালি দেল ইসলাম অর্থাৎ অ্যানালস্ অব ইসলাম, ইতালীয় ভাষায় লেখা। কিন্তু তার পূর্বে এই অজাতশত্রু বিশ্বকোষের একক স্রষ্টার পরিচয় কিছুটা দিই। এর নাম প্রিন্স– ডিউকও বলা হয়– লেওনে (অর্থাৎ সিংহ) কাতানি। ইতালির তিনটি পরিবারের যদি নাম করতে হয়, যাদের সঙ্গে রাজপরিবারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে তা হলে কাএতানি পরিবারের নাম বাদ যাবে না। কিন্তু এহ বাহ্য।
আসলে এ পরিবারের যশ-প্রতিপত্তি আরম্ভ হয় যখন ত্রয়োদশ শতাব্দীতে এ পরিবারেরই একজন বনিফাতিযুস নাম নিয়ে তদানীন্তন খ্রিস্ট-জগতের পোপ নির্বাচিত হন। ইনি ছিলেন অসাধারণ পণ্ডিত ও কূটনীতিতে চাণক্য! ওদিকে যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী। ডেনমার্কের রাজাকে তিনি পদানত করেন এবং ফ্রান্সের সম্রাটকেও প্রায় শেষ করে এনেছিলেন। কিন্তু এসব তথ্য বলার কোনও প্রয়োজন নেই– এইটুকু বললেই যথেষ্ট যে তাঁর সমসাময়িক অমর কবি দান্তে তাকে তার বিশ্ববিখ্যাত কাব্যে যিশুখ্রিস্টের সঙ্গে তুলনা করেছেন। কিন্তু এহ বাহ্য। তত্ত্ব কথা এই যে বনিফাতিয়ুস সে-যুগের সর্বোত্তম দার্শনিক স্পেনের মুসলমান আবু রুশদের দর্শন প্রায় সর্বাংশে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন। এটা প্রায় অবিশ্বাস্য। কারণ আবু রুশদ (ওই যুগেই তার দর্শন একাদশ খণ্ডে লাতিন ভাষায় অনূদিত হয়- লাতিনে রুশদের নাম আভেরএস) যুক্তিতর্ক দ্বারা প্রমাণ করতেন যে মৃত্যুর পর মানবাত্মা অনন্ত স্বৰ্গভোগ বা অনন্ত নরকযন্ত্রণা সহ্য করতে পারে না। তার কারণ অনন্ততা, আনন্ত্যগুণের অধিকারী একমাত্র মহান আল্লা। মানবাত্মা নয়, এবং অনন্ত স্বর্গ অনন্ত নরকের আনন্ত্যগুণ স্বীকার করলে এরা সকলেই সেই মহান আল্লার (বেদান্তের ভাষায় একমেবাদ্বৈত ব্রহ্মের) প্রতিদ্বন্দী হয়ে যাবে- এ ধারণা কিম্ভুতকিমাকার অশ্বডিম্ব–আটারলি এবসার্ড। তাই আবু রুশদের মতে মৃতাত্মারা স্বর্গ-নরক যথোপযুক্ত কাল ভোগ করার পর আল্লাতালা অবশেষে সর্ব আত্মা, স্বর্গ, নরক সব, সবকিছু নিজের মধ্যে আপনাতে সংহরণ করে নেবেন। তখন তিনি আবার এক, অদ্বৈতম্।
ডাক্তার বাধা দিয়ে বললেন, এই মতবাদটা আমি ঠিক ঠিক বুঝতে পারিনি। একটু সবিস্তার বলুন।
আমি বললুম, নোঃ! আমি দর্শন প্রচার করিনে। আমি শোনাই কাহিনী। একটি করুণ কাহিনী শোনাবার জন্য আমি এস্থলে অতি সংক্ষেপে একটি পটভূমি নির্মাণ করলুম মাত্র। তৎপূর্বে আরও আধ মিলিগ্রাম দর্শনবিলাস করতে হবে। এদিকে আবার খ্রিস্টান মাত্রেরই অটল অচল বিশ্বাস পুণ্যাত্মা অনন্ত স্বর্গসুখ এবং পাপাত্মা অনন্ত নরকযন্ত্রণা পাবে। ওদিকে পোপ, খ্রিস্টজগতের পিতা, যার পুণ্যাস্যনির্গত প্রতিটি বাক্য শাম্রাতিশাস্ত্র আপ্তবাক্য, সেই সর্বশাস্ত্রবিশারদ পোপ বনিফাতিয়ুস ম্লেচ্ছ যবন দার্শনিক আবু রুশদের মতবাদ এমনই আকণ্ঠ গিলে বসে আছেন যে তিনি তাঁর সহকর্মী কার্ডিনালদের সমক্ষে গোপন রাখতেন না যে, তিনি মৃতাত্মার অনন্ত স্বৰ্গনরক-ভোগাদিতে বিশ্বাস করেন না। তাই পূর্বেই বলেছি, এটা প্রায় অবিশ্বাস্য। খুদ বাইবেলের বিরুদ্ধে এই ম্লেচ্ছ যাবনিক মতবাদ প্রচার করার জন্য পোপকে দণ্ডভোগ করতে হয়েছিল। তারই উল্লেখ করে কবি দান্তে বিলাপ করে তাঁর মহাকাব্যে লিখেছেন, যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করে তার জল্লাদরা যেরকম তাঁকে শুনিয়ে শুনিয়ে ব্যঙ্গপি করেছিল ঠিক সেইরকম প্রভু যিশুকে দ্বিতীয় বারের মতো ব্যঙ্গবিদ্রূপ করা হল।
কিন্তু এহ বাহ্য।
যে কাএতানি পরিবারে এই পোপর জন্ম সে-পরিবারে যুগ যুগ ধরে বহু পণ্ডিত, বহু গবেষক জন্ম নিয়েছেন। এ পরিবারের শেষ পণ্ডিত, আমার অতিশয় শ্রদ্ধেয় ঐতিহাসিক লেওনে কাএতানি। আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস, কিন্তু আমি প্রমাণ করতে পারব না যে, এই পোপের ওপর আরব দার্শনিক আবু রুশদের প্রভাব সম্বন্ধে তাঁর পারিবারিক ও পোপদের প্রচলিত ইতিহাস অধ্যয়ন করার ফলে তিনি আরবি ভাষা ও মুসলিম সভ্যতার প্রতি আকৃষ্ট হন।
পরপর দু খানি অত্যুত্তম গ্রন্থ প্রকাশ করে তিনি ইয়োরোপ তথা মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম ভূখণ্ডে নব শমসু–উলেমা (জ্ঞান-ভাস্কর) রূপে আন্তরিক অভ্যর্থনা ও অকুণ্ঠ প্রশস্তি লাভ করলেন। তখন তিনি স্থির করলেন, এসব উটকো বই না লিখে তিনি তাঁর সম্পূর্ণ জীবন নিয়োজিত করবেন ইসলামের একখানা পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনা করাতে। বিদ্বজ্জন সোল্লাসে হর্ষধ্বনি তথা সাধুবাদ প্রকাশ করলেন।
ইতোমধ্যে লক্ষ করলুম, মেডিকেল কলেজ আর বেশি দূরে নয়। বললুম, এবার আমি আমার মোদ্দা কথাতে চলে এসেছি।
রাজপরিবারের অংশবিশেষ, অসাধারণ সুপুরুষ, সঙ্গীতচিত্রভাস্কর্য ইত্যাদির সক্রিয় সমঝদার কাএতানি প্রেমাবদ্ধ হলেন এক পরমা সুন্দরী, সর্বগুণান্বিতা রোমান রমণীর সঙ্গে। সৌভাগ্যক্রমে প্রেমটি হল উভয়ত ও গভীরতম।
বিবাহ হয়ে গেল। তাবৎ ইতালি এককণ্ঠে বললে, তাদের দেশের নীলাম্বুজের ন্যায় গভীর নীলাকাশের সঙ্গে চক্রবালবিস্তৃত ইন্দ্রধনুর এহেন পূর্ণাঙ্গ আলিঙ্গন ইতোপূর্বে তাদের এবং সর্ববিশ্বপূজ্য রোমেও জুলিয়েতের প্রেমভূমিতেও হয়নি।
তার পর আমাদের লেওনে– নরসিংহ ডুব দিলেন তার ইসলামের ইতিহাস –তার আন্নালি বা অ্যানালস্ গ্রন্থে।
বউ এসে বললেন, ওগো, শুনছো, কাল সন্ধ্যায় আমাদেরই তসকানিনি আসছেন সঙ্গীত পরিচালনা করতে। ওই দেখো টিকিট পাঠিয়েছেন। অন্য লোকে হন্যে হয়ে ধন্না দিচ্ছে সুন্ধুমাত্র ওঁর দর্শন পাবার জন্য।
লেওনের মুখ বিবর্ণ। অপরাধীর মতো বললেন, কিন্তু আমার আন্নালি– এ অধ্যায়টা শেষ না করে– আচ্ছা, কাল দেখব।
কিন্তু কাল ও সেই দেখবটা দেখা হয়ে উঠল না। লেওনে ডুব মেরেছেন আন্নালির গভীর অরণ্যে।
তার পর এলেন দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ টেনর গাওয়াইয়া কারুজো। ফল তদ্বৎ।
মাঝে মাঝে বলতেন, তা তুমি, ডার্লিং (দিলেত্তো), দিনোর সঙ্গে যাও না কেন? সে তো সর্বসঙ্গীতে আমার চেয়ে ঢের ঢের বেশি সমঝদার। আমার আন্নালি–
বউ ঠোঁট চেপে বললেন, দিনো তার প্যতিত আমির (প্রিয়া বান্ধবী-র) সঙ্গে যাচ্ছে।
আকাশপানে হানি যুগল ভুরু লেওনে অবাক হয়ে শুধোলেন, সে কী? দিনোর তো সুন্দরী বউ রয়েছে। এই হালেই বিয়ে করেছে। এরই মধ্যে প্যতিত আমি?
যা শুনেছি, তারই স্মরণে যতটুকু মনে আসছে তাই বলছি, বউ নাকি ঠোঁট দুটি আরও কঠিনভাবে চেপে চলে যাচ্ছিল–
লেওনে তোলাতে তোলাতে তিনি ছিলেন লক্ষ্মীট্যারার মতো অতিশয় যৎকিঞ্চিৎ লক্ষ্মী-তোলা– বললেন, কিন্তু, কিন্তু ডার্লিং, আমার আন্নালি, আ
আন্নালি, আন্নালি– আবার সেই আন্নালি।
প্রেমিক, রসিক, ললিতকলার বিদগ্ধ সমঝদার লেওনে এখন হয়ে গিয়েছেন সুদ্ধমাত্র পণ্ডিত। পণ্ডিতেরও বউ থাকে। কিন্তু এ স্থলে লেওনের একটি প্যতিত আমি তার হৃদয়াসন জুড়ে বসে গেছেন। আন্নালি।
লেওনে যে তার বউকে সর্ব হৃদয় দিয়ে ভালোবেসে তার পদপ্রান্তে তার সর্বাত্মা নিবেদন করেছেন এ তত্ত্ব তাইবেরিয়া রোমবাসী জেনে গিয়েছে। বস্তুত লেডিকিলার রোমান নটবররা তখন ফিসফিস্ গুজগুজ করতে আরম্ভ করেছে, লেওনেটা একটা স্ত্রৈণ, ভেড়য়া ভাড়য়া (পূর্ববঙ্গের ভাষায় বউয়ের দেওয়া ভাত না পেলে যে ক্লীবের দিন গোজরান হয় না), আস্ত একটা নপুংসক।
এদিকে লেওনে তাঁর সর্বসত্তা স্ত্রীর কাছে নিবেদন করে নিশ্চিন্ত। তার দেবী যে তার আন্নালিকে তার সপত্নী, তার প্যতিত আমি রূপে কস্মিনকালেও ধরে নিতে পারে সেটা তার সুদূরতম কল্পনারও বাইরে। কিন্তু ডাক্তার, এই দ্বন্দ্ব জগতে কত ঢপবেটপেরই না সতীন হয়। সেই যে হিংসুটে দ্বিতীয়পক্ষ দেখল তার স্বামী একটা মড়ার খুলি বেড়ার কঞ্চির উপরে রাখছে, সঙ্গে সঙ্গে মীমাংসা করে ফেলল, এটা নিশ্চয়ই তার মৃত সপত্নী সীমন্তিনীর সীমন্ত-বহনকারী মস্তকের খুলি! তাই না মিনষের পরানে এত সোহাগের বান জেগেছে! দাঁড়াও, দেখাচ্ছি। তনুহর্তেই না, বরঞ্চ বলব– তনুহূর্তেরও তিন মিনিট আগে, রাষ্ট্রভাষায় যাকে বলে ফৌরনকে পাঁচ মিনট পেহলে, সেই খুলিটা ফেলে দিল বাড়ির পিছনের বিষ্ঠাকুণ্ডে। সে কেচ্ছা থাক, ডাক্তার, এ বাবদে আমি বিস্তর গবেষণা করেছি– সুবিধে-কুবিধে মতো কোনও এক সময়ে সেটা হবে। শুধু একটি আপ্তবাক্য বলি, এ দেশের হরিপদ কেরানি যে তার কুল্লে জীবনের দশটা-পাঁচটা বেচে দিয়েছে তার জন্য তার বউ খেদ করে না। কিন্তু বাবদ-বাকি ষোল-সতেরো ঘন্টা সেই পদী-বউ হয়ে যায় রাজরাজ্যেশ্বরী পট্টমহিষী রানি পদ্মিনী পদ্মাবতী — শাহ-ই-শাহ বাদশা আলাউদ্দীনও সেখানে ইতর জন।
আমাদের পণ্ডিত লেওনে একটি আস্ত মূর্খ।
এই সামান্য তত্ত্বটুকু পর্যন্ত জানেন না, গভীর, উভয়পাক্ষিক প্রেমের পর, বিয়ে হওয়ার পরও অনেক কিছু করার থাকে। সেগুলো অতি ছোটখাটো জিনিস। কিন্তু ছোট হলেই কি ছোট জিনিস সর্বাবস্থাতেই ছোট, বড় জিনিস বড়? পিপীলিকা অতিশয় ক্ষুদ্র প্রাণী; হাতি বৃহত্তম। চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু বানানের বেলা? সেখানে পিপীলিকার বানান ঢের বেশি শক্ত হাতির তুলনায়।
লেওনে মূর্খ। তিনি বুঝতে পারেননি, এসব ছোটখাটো অনেক ব্যাপার আছে। বউকে কনসার্টে নিয়ে যাওয়া, তার জন্মদিন বা নামকরণ দিন স্মরণে রেখে ভালোমন্দ কিছু-একটা সওগাত নিয়ে আসা, বিবাহের বর্ষাবর্তনের দিন হৈ-হুঁল্লোড় করে বন্ধুবান্ধবকে নিমন্ত্রণ করে উত্তমরূপে সমাধান করা– এসব কিছুই লেওনের স্মৃতিতে আসে না। আন্নালির গভীর গর্ভে এসব জিনিস ডুবে গিয়ে সম্পূর্ণ নিরুদ্দেশ।
হঠাৎ এক সকালে লেওনে ব্রেকফাস্ট খেতে এসে দেখেন, তাঁর প্লেটের উপর ছোট্ট একটি চিরকুট।
এবং ইতোমধ্যে তাঁর মতো আপন-ভোলা লোকও লক্ষ করলেন, যে-বউ সদাসর্বদা তার ব্রেকফাস্ট তৈরি করে দিত, সে-ও সেখানে নেই।
চিরকুটটি খুলে পড়লেন, আমি তোমার ভবন পরিত্যাগ করলুম। অপরাধ নিয়ো না।
ডাক্তার হতভম্ব।
তার পর রাম-গবেটের মতো ভোলাতে ভোলাতে যা শুধাল তার বিগলিতাৰ্থ, এরকম একটি সর্বগুণসম্পন্না মহিলা যিনি তার আপন দয়িতের পরিপূর্ণ আত্মনিবেদন পেয়েছেন, তাঁকে ত্যাগ করে চলে গেলেন।
আবার নতুন করে বুঝতে পারলুম, আমাদের এই মাইডিয়ার লার্নেড় ডাক্তারটি হয়তো তার চিকিৎসাশাস্ত্রজ্ঞানপ্রসাদাৎ মড়াকে জ্যান্ত করতে পারেন, কিন্তু জ্যান্ত লোক যে দৈহিক মৃত্যু ভিন্ন অন্য নানাভাবে মরতে পারে– কএস যেরকম লায়লিকে ভালোবেসে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গিয়ে লোকমুখে প্রচারিত মজনুন (যার স্কন্ধে জিন্ = ভূত চেপেছে) উপাধি পান– এ সবের কোনও এনট্রি তাঁর জীবনের খাতাতে নেই। তার কাছে সবকিছুই সরল সিলজিমে প্রকাশ করা যায় :
ডাক্তার শহর-ইয়ারকে সম্পূর্ণ আত্মনিবেদন করেছেন।
শহর-ইয়ার ডাক্তারকে সম্পূর্ণ আত্মনিবেদন করেছে।
অতএব এদের মধ্যে কোনও বিচ্ছেদ আসতে পারে না।
কিউ ই ডি!!!
প্রভু যিশু নাকি বলেছেন, শুধু রুটি খেয়েই মানুষ বাঁচে না, ঠিক তেমনি বলা যেতে পারে দাম্পত্যজীবনে শুধু প্রেম দিয়েই পেট ভরে না।
কিন্তু এসব তত্ত্বকথা ডাক্তারকে এখন বলে আর কী লাভ? মেঘে মেঘে যে বেলা হয়ে গিয়েছে।
বললুম, ডাক্তার, আমাকে অনেকেই শুধায় বিশেষ করে আমার মস্তান চেলারা শুধায়, কোন দেশের রমণী আমাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছে। কী প্রশ্ন! আমি কি দেশে দেশে কান্তা, দেশে দেশে প্রিয়া করে বেড়িয়েছি না কি যে, এর পাকি উত্তর দেব! তবে নিতান্ত হাইকোর্ট মাত্রই দেখিনি বলে চোখ-কান খোলা ছিল। এবং লক্ষ করেছি, স্পেন আর ইতালির মেয়েরা হয় তেজি আর স্বামী হোক প্রেমিক হোক, তার ওপর যে হক বর্তায় সে সম্বন্ধে তাদের জ্ঞানটি হয় খুবই টনটনে ভয়ঙ্কর জেলাস। অভিমান শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ নেই, ইতালি ভাষায়ও খুব সম্ভব নেই। তবু ইতালির নিম্নশ্রেণিতে হিংসুটে রমণী প্রতি গলিতে গণ্ডায় গণ্ডায়, আর ভদ্রসমাজে অভিমানিনীরা অভিমানের চূড়ান্তে পৌঁছে আত্মহত্যাতে বোধ করি জাপানিদের হার মানায়। কাএতানির বউ এক অর্থে আত্মহত্যাই করলেন, এবং করলেন একটি জলজ্যান্ত খুন। কিন্তু এহ বাহ্য।
লেওনের মনে এর কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল সে-সম্বন্ধে সবিস্তর সংবাদ কেউই দিতে পারেনি। তবে তার পরবর্তী আচরণ থেকে এ সম্বন্ধে কিছুটা অনুমান করা যায়।
আন্নালির দশাংশের একাংশ তখনও শেষ হয়নি।
তার পর একদিন লেওনে ইতালি থেকে উধাও। কেউ জানে না কোথায় গেছেন।
তার কিছুদিন পরে খবর এল লেওনে তার বিরাট জমিদারি বিষয়-সম্পত্তি বিক্রি করে চলে গেছেন দূরের চেয়ে দূর সুদূর ক্যানাডায়। সেখানে সামান্য জমি-জমাসহ একটি কুটির খরিদ করেছেন। বনের ভিতর।
সেখানে দিন কাটান কী করে?
সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি জলের ধারে, বঁড়শি ফেলে।
কে জানে মাছ ধরা পড়ত কি না।
আর তার হাজার হাজার বই– অন্তত ত্রিশটি ভাষায়– যার ওপর নির্ভর করে, যেসব ইট-সুরকি দিয়ে তিনি তাঁর আন্নালি কুত্ত্বমিনার গড়ে তুলেছিলেন?
জানিনে। কিন্তু এ কথা জানি, তিনি ক্যানাডা যাবার সময় একখানা বইও সঙ্গে নিয়ে যাননি।
ডাক্তার বললেন, সে কী কথা? তাঁর সমস্ত সাধনা বিসর্জন দিলেন?
তাই তো বললুম, লেওনের বউ তাকে ছেড়ে যাবার সময় খুন করে গেলেন, পণ্ডিত লেওনেকে। আর যেহেতুক পণ্ডিত লেওনেই ছিলেন লেওনের চোদ্দ আনা সত্তা তাই বলা যেতে পারে, তিনি লেওনেকেই খুন করলেন।
তিনি যেন যাবার সময় বলে গেলেন, আন্নালিই যদি তোমার আরাধ্য দেবী হন, তবে আমার স্থান কোথায়?
লেওনে যেন উত্তরে বললেন, তুমিই ছিলে আমার জীবনের আরাধ্যা। আন্নালি নয়। প্রমাণ? সেই অসমাপ্ত আন্নালি-প্রতিমাকে ভেঙে চুরমার করে চললুম, নিরুদ্দেশে।
এবং আমার মনে হয়, লেওনে যেন পত্নীর উদ্দেশে বলতে চেয়েছিলেন, তুমি রোমান সমাজের উচ্চশিক্ষিতা রমণী হয়েও বুঝতে পারলে না, আমি কাকে কোন জিনিসকে কতখানি মূল্য দিই!
এ কাহিনীর সমাপ্তি এখানেই নয়।
লেওনে কিন্তু তার তাবৎ পাণ্ডুলিপি বিনষ্ট করতে পারেননি বা তার সেদিকে হুঁশ ছিল না। কাজেই দশ-দশ বিরাট ভলুমে বেরুল তাঁর আন্নালির অতিশয় অসমাপ্ত অংশ। আরবি প্রাচ্যবিদ্যামহার্ণবরা সেটিকে রাজমুকুটের কুহ্-ই-নূরের মতো সম্মান দেন।
সঙ্গে সঙ্গে প্রাচ্যবিদ্যামহার্ণবরা আন্দেশা করতে লাগলেন, লেওনেকে কী করে সেই পাণ্ডববর্জিত ক্যানাডা থেকে ফিরিয়ে এনে পুনরায় তাকে সুস্থ স্বাভাবিক করা যায়– তাতে করে অন্তত তিনি তাঁর আন্নালি সমাপ্ত করে যান।
এক প্রাচ্যবিদ্যামহার্ণবদের সাধারণ সম্মেলনের পর পণ্ডিতরা গোপন বৈঠকে বসে স্থির করলেন কয়েকজন সমঝদার গেরেম্ভারি বৃদ্ধ পণ্ডিতকে পাঠাতে হবে, ডেপুটেশন, লেওনের কাছে। এঁদের সবাইকে বিনয়ী লেওনে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন। এঁরা আপন আপন খরচে পৌঁছলেন, পৃথিবীর সেই সুদূর অন্য প্রান্তে ক্যানাডার ভ্যানকুভারে– বিন নোটিশে। লেওনে সবাইকে তার সরল অনাড়ম্বর কায়দায় অভ্যর্থনা জানালেন।
ডেপুটেশন ডিনারের পর কফি-লিকোর খেতে খেতে অতিশয় যুক্তিসম্মত পদ্ধতিতে, তাদের সমস্ত ধার, সমস্ত ভার, লেওনের স্কন্ধে নামিয়ে কী সব উপদেশ দিয়েছিলেন, কী সব অনুনয়বিনয় করেছিলেন তার কোনও প্রতিবেদন বা রিপোর্ট নেই, তবে আমি কল্পনা-রাজ্যে উড্ডীন হয়ে কিছুটা অনুমান করতে পারি। কিন্তু আমার অনুমানে কী যায় আসে! এ যে এক বিরাট ট্র্যাজেডি। এ তো শুধু দুটি নরনারীর ব্যক্তিগত মান-অভিমান বিরহ-মিলন এবং সর্বশেষে অন্তহীন বিচ্ছেদের কাহিনী নয়– যেটা হর-আকছারই হচ্ছে এখানে যে তার বাড়া রয়েছে, অকস্মাৎ অকালে একটি প্রজ্ঞাপ্রদীপের অন্ধকারে নিলয়। শুধু পণ্ডিতজন না, ইউরোপের বহু সাধারণ জনও আশা করেছিল, লেওনের আন্নালির জ্যোতি ইসলাম-ইতিহাসের বহু অন্ধকার গুহাগহ্বর প্রদীপ্ত করে তুলবে– কারণ লেওনে লিখতেন অতিশয় সাদামাটা সরল ইতালীয় ভাষা।
ডেপুটেশনের সর্ব বক্তব্য লেওনে অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও মনোযোগের সঙ্গে শুনে বললেন, কয়েকদিন চিন্তা করে তিনি ডেপুটেশনকে তাঁর শেষ মীমাংসা জানাবেন।
ডেপুটেশন দেশে ফিরে গেল। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পরও তারা লেওনের তরফ থেকে কোনও চিঠি পাননি।
লেওনে কাএতনি তাঁর খোলস দেহটি ত্যাগ করে ইহলোক ছাড়েন ক্যানাডাতেই, খ্রিস্ট জন্মদিবসে, বড়দিনে, ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর জন্ম রোম শহরে ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে। আমার গুরু আমাকে এ কাহিনীটি বলেন লেওনের মরজগৎ ত্যাগ করার প্রায় এক বৎসর পূর্বে।
যুদ্ধে মিসিং জওয়ানের মা যেরকম বছরের পর বছর নিস্তব্ধ, সহিষ্ণু প্রতীক্ষা করে, তার দুলাল একদিন নিশ্চয়ই ফিরে আসবে, আমার গুরু আরবি শাস্ত্রে অতুলনীয় পণ্ডিত, স্নেহময়ী মাতার ন্যায় বহু বৎসর ধরে প্রতীক্ষা করতেন, লেওনে একদিন আবার তাঁর ক্যানাডার অরণ্যানীর বনবাস ত্যাগ করে ফিরে আসবেন তাঁর মাতৃভূমি ইতালিতে। তার পর অধ্যাপক গুনগুন করে যেন আপন মনে বলতেন, লেওনের মতো এরকম স্পর্শকাতর লোক কি আমৃত্যু বিদেশ-বিভুঁইয়ে পড়ে থাকবে? নাঃ, হতেই পারে না। সে নিশ্চয়ই মৃত্যুর পূর্বে রোমে ফিরে আসবে। যাতে করে তার হাড়িগুলো তার মায়ের হাড়িগুলোর পাশে শেষ-শয্যায় শয়ন করা হয়। কিন্তু আমার গুরুর এ দূরাকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয়নি।
ততক্ষণে ডাক্তার আবার খানিকটে সংবিদে ফিরে এসে কী যেন শুধাচ্ছে। আমি ঈষৎ উত্তপ্ত কণ্ঠে বললুম, ব্যস, আমরা মেডিকেল কলেজে পৌঁছে গিয়েছি। এবারে আমি পাবলিশার্সদের কাছে যাচ্ছি।
মনে মনে বললুম, বুদ্বুটা এখনও যদি না বোঝে আমি কোনদিকে নল চালাচ্ছি, তবে ঝকমারি, ঝকমারি, হাজার বার ঝকমারি।