অক্টোবর মাস। বরফ পড়ার সময় নয়, কিন্তু আবহাওয়া অফিস বলেছে তুষারপাত হতে পারে। সম্ভাবনা শতকরা বিশ ভাগ। আকাশ অবশ্যি পরিষ্কার। ঝকঝকে রোদ। সন্ধ্যার আগে আগে দেখা গেল সব ঘোলাটে হয়ে আসছে। সাড়ে ছটা থেকে ঝুরঝুর করে বরফ পড়তে শুরু করল। বৎসরের প্রথম বরফ, খুশির ঢেউ খেলে গেল চারদিকে। ছেলে-বুড়ো সবাই চোখ বড়ো বড়ো করে বলছে–আহ! কী চমৎকার তুষার পড়ছে। হাউ লাভলি!
রাত নটার খবরে বলল–কানাডা থেকে ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে আর উষ্ণ হওয়া আসছে সাউথ থেকে, কাজেই সারা রাত ধরে ব্লিজার্ড হতে পারে। ইতোমধ্যে এক ফুটের মতো বরফ পড়েছে। রাস্তা ঘাট পিছল। কেউ যেন বিনা প্রয়োজনে বাইরে না। যায়। হাইওয়ে আই নাইন্টি বন্ধ। বড়োই ফুর্তির সময় এখন। শুরু হবে ব্লিজার্ড পাটি। উপকরণ সামান্য–বিদ্যার, বাদাম ভাজা এবং চড়া মিউজিক। বৎসরের প্রথম ব্লিজার্ডকে স্বাগত জানানরা এই হচ্ছে ফার্গোর সনাতন পদ্ধতি।
আনিস মোটা একটি কম্বল গায়ে জড়িয়ে সোফায় আরাম করে বসল। ঘরে একটি ফায়ারপ্লেস আছে। ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বালানির কায়দা-কানুন তার ভালো জানা নেই। চিমনি পরিষ্কার আছে কিনা কে জানে। এর চেয়ে কম্বল জড়িয়ে থাকাই ভালো। কফি-পটে কফি, গরম হচ্ছে। টিভিতে দেখাচ্ছে ডেভিড কপারফিন্ডের ম্যাজিক। হাতের কাছে দুটি রগরগে ভূতের বই। একটি ষ্টিফান কিংয়ের সাইনিং। নিউইয়র্ক টাইমস-এর মতে কোনো সুস্থ লোক এই বই একাএকা পড়তে পারবে না। অন্যটি ডিমস কিলেনের দি আদার নুন। পিশাচ নিয়ে লেখা রক্ত-জল—করা উপন্যাস। রিজার্ডের রাতের জন্যে এর চেয়ে ভালো প্রস্তুতি কল্পনাও করা যায় না।
আনিস জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাল। বরফে সমস্ত ঢেকে গেছে। বাতাসের সঙ্গে উড়ছে বরফের কণা। গাছের পাতায় মাখনের মতো থরে থরে তুষার জমতে শুরু করেছে। একটি ধবধবে সাদা রঙের প্রকাণ্ড চাদর যেন ঢেকে ফেলেছে। শহরটিকে। হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই সাদা চাদর নৌকার পালের মতো কাঁপছে তিরতির করে। অপূর্ব দৃশ্য! চোখ ফেরান যায় না। আনিস মন্ত্রমুগ্ধের মতো জানালার পাশে দাঁড়িয়ে রইল। মালিশা গিলবার্ড এসে উপস্থিত হল এই সময়।
প্রচণ্ড ঠাণ্ডাতেও তার গায়ে পাতলা একটা উইণ্ড ব্রেকার ছাড়া আর কিছুই নেই। কালো একটা স্কাফে কান দুটি ঢাকা। হাতে খাবারের একটি প্যাকেট। মালিশা বলল, আমি ভাবলাম কেউ নেই। অনেকক্ষণ ধরে কড়া নাড়ছি, ঘরে তোমার বান্ধবীরা কেউ আছে বুঝি?
আনিস বলল, ভেতরে এস। এ রকম দিনে বেরুলে কী জন্যে?
মালিশা বলল, তুমি কথার জবাব দাও নি। ঘরে কি তোমার বান্ধবীরা কেউ আছে?
না, তা নেই।
যাক, আমি শুধু দু জনের জন্যে খাবার এনেছি।
মালিশ খানিকটা কুণ্ঠিত ভঙ্গিতে প্যাকেট খুলতে শুরু করল।
আনিস বলল, স্কার্ফটা খুলে মাথা মুছে নাও। এত তাড়া কিসের মালিশা?
তাড়া আছে। দুপুরে খাই নি কিছু। খাবার সব ঠাণ্ডা হয়ে আছে। গরম করতে দিয়ে তারপর হাত মুখ ধোব।
খাবার বিশেষ কিছু নয়। বড়ো একটি প্যান পিজা, কয়েকটি মেক্সিকান টেকো এবং এক বোতল সস্তা বারগাণ্ডি।
আনিস বলল, কোনো বিশেষ উপলক্ষ আছে কি মালিশা?
আজ আমার জন্মদিন।
আনিস হাসিমুখে বলল, দু মাস আগে এক বার তুমি জন্মদিনের খাবার খাইয়েছি।
ঐ দিন মিথ্যা বলেছিলাম। তোমাকে কোথাও নিয়ে যেতে ইচ্ছা হচ্ছিল। জন্মদিনের অজুহাত দিয়ে নিয়ে গেলাম।
এমনি বললে বুঝি যেতাম না?
না। আমি ভালো মেয়ে নই। আমার সঙ্গে বেরুতে হয়তো তোমার সংকোচ হত।
মালিশ দ্রুত হাতে খাবার ওভেনে ঢুকিয়ে মাথার চুল মুছতে শুরু করল।
হঠাৎ করে এসেছি বলে রাগ কর নি তো? টেলিফোন করব ভেবেছিলাম। পরে ভাবলাম টেলিফোনে তুমি বলে বসতে পোর।–আমি ব্যস্ত। সামনাসামনি কেউ এমন কথা বলতে পারবে না। আনিস, তুমি কি বিরক্ত হচ্ছে?
বিরক্ত হব কেন? কিন্তু জন্মদিনের কেক কোথায়?
কেক কেনা গেল না। টাকা কম পড়ে গেল, তাছাড়া কেক আমার ভালোও লাগে না।
আনিস লক্ষ করল মালিশার চোখ ঈষৎ রক্তাভ। একটু যেন ঢুলছে।
তুমি কি প্রচুর ড্রিংক করেছ মালিশা?
প্রচুর নয়, তবে করেছি। একা-একা ভালো লাগছিল না।
টেলিফোন করলেই একটা কেকের ব্যবস্থা করা যায়। কিন্তু আবহাওয়ার যা ধরনধারণ, কেউ কি অর্ডার নেবে? চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে। আনিস বসবার ঘরে চলে এল। গলা উঁচু করে বলল, তুমি খাবার সাজাও মালিশা। আমি একটা টেলিফোন সেরে আসছি। অর্ডার ওরা নিল। বলল এক ঘণ্টার মধ্যে দিয়ে যাবে। শুধু কেক নয়, দশটি লাল গোলাপের একটি তোড়াও আসবে সেই সঙ্গে। আনিসের মনে হল, সে নিজেও খুব নিঃসঙ্গ। মালিশ হঠাৎ করে আসায় তার খুবই ভালো লাগছে। একটা কেমন যেন অন্য ধরনের আনন্দ।
আনিস, পিজা তোমার ভাল লাগে তো?
খুব লাগে।
সস্তার মধ্যে খুব ভালো খাবার, তাই না?
তা ঠিক।
মালিশ হাসিমুখে বলল, আমার বয়স একুশ। একুশ বছরের একটি মেয়ের জন্মদিনে কোনো লোকজন নেই, কেউ বিশ্বাস করবে একথা? জন আসবে বলেছিল, আমি এইসব কিনেছিলাম জন এবং আমার জন্যে। তার নাকি হঠাৎ মাইগ্রেন পেইন শুরু হয়েছে।
আনিস বলল, জন কে?
আমার এক জন বন্ধু। সিয়ার্সে কাজ করে। তোমার কি মনে হয় ওর সত্যি সত্যি মাইগ্রেন পেইন?
আনিস উত্তর দিল না। মালিশা বলল, জনের এক জন নতুন বান্ধবী হয়েছে। একটি মেক্সিকান মেয়ে। ও নির্ঘাত ওর সঙ্গে ঝোলাঝলি করছে। তোমার কী মনে হয়?
আমার পক্ষে বলা মুশকিল। নির্ভর করে জনের সঙ্গে তোমার পরিচয় কী রকম তার ওপর।
পর পর চার শনিবার ডেট করেছি। জন নিজেও ডেট চেয়েছে। দু রাত ঘুমিয়েছি ওর সঙ্গে। ওটা ঠিক হয় নি। ওতে দাম কমে যায়। তাছাড়া ঐ মেক্সিকান মেয়েটিকে তো তুমি দেখ নি। দারুণ ফিগার। পুরুষদের কাছে ফিগারটাই আসল।
আনিস প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্যে বলল, তোমার মা কেমন আছে?
ভালোই। গত সপ্তাহে চিঠি পেয়েছি। বুড়ির শখ হয়েছে বিশ্বভ্রমণের। একজন সঙ্গীও পেয়েছে–জিম ডগলাস। মনে হয় ঐ বুড়ো ফুসলেফাসলে নিয়ে যাচ্ছে। টাকার গন্ধ পেয়েছে, বুঝলে না? দু জনে ফিট করে বিয়েও করে বসতে পারে। তাহলে বড়োই ঝামেলা হবে। হয়তো দেখা যাবে কিছুই পেলাম না। আমার যা ভাগ্য!
কোথায় যাচ্ছেন তোমার মা?
কে জানে কোথায়? আমি লিখেছি।–যাও মা, ঘুরে আসা। তোমার ভালো লাগাই আমার ভালো। এবং ডগলাস সাহেব যখন যাচ্ছেন, তখন তো তোমার খুব ফান হবে। মনের কথা নয় বুঝতেই পারছি, সবই বানান।
মালিশা খাবার কিছুই স্পর্শ করল না। চকচক করে এক গ্লাস বারগাণ্ডি খেয়ে ফেলল। তার মনে হয় নেশা হয়েছে। চোখের কোণ লালাভ।
শোন আনিস, আমার মনে হয় আমি তোমাকে ভালোবাসি। হাসছ কেন? তোমার কি ধারণা, আমার নেশা হয়েছে? মোটেই নয়।
আনিস বলল, কফি খাবে?
না। শোন আনিস। আমার মিলিওনিযর হবার সম্ভাবনা খুব বেশি। তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে? ভালোই হবে তোমার।
আনিস হাসতে-হাসতে বলল, টাকার জন্যে তোমাকে বিয়ে করতে হবে কেন? তোমার নিজের দাম তো কিছু কম নয়।
আমাকে খুশি করার জন্যে বলছ?
না। নিশানাথ বাবুর কথা মনে নেই, তিনি বলেছিলেন তোমাকে দেখতে ইণ্ডিয়ান গডেসের মতো লাগে।
আমার মনে আছে। আনিস, আমার যখন টাকা হবে, তখন আমি ঐ ইণ্ডিয়ান ভদ্রলোককে একটি বুইক স্কাইলার্ক গাড়ি কিনে দেব। ওর কি বুইক স্কাইলার্ক গাড়ি আছে?
না, ওর সে-সবের বালাই নেই।
ম্যাকের স্কাইলার্ক গাড়ি ছিল। ম্যাক ছিল দারুণ বড়লোক। ওর সঙ্গে আমি অনেক বার ডেটে গিয়েছি। ও আমাকে একটা ড্রেস কিনে দিযেছিল, যার দাম দু শ পাঁচাত্তর ডলার। আমি তোমাকে দেখাব।
আনিস চুপ করে রইল। মালিশা মনে হল একটু টলছে। আনিস বলল, আর খেও না, মালিশা।
কেন? খাব না কেন?
বেশি হয়ে যাচ্ছে। তোমার হাত কাঁপছে।
হাত কাঁপছে, কারণ আমার জ্বর আসছে। আমার শরীর বেশি ভালো নয়।
ডাক্তার দেখিয়েছ?
না। ডাক্তার দেখাবার মতো কিছু নয়, তা ছাড়া আমার হেলথ ইনসুরেন্স নেই। ডাক্তারের কাছে গেলেই গাদাখানিক ডলার লাগবে। সেটা কে আমাকে দেবে? তুমি নিশ্চয়ই দেবে না। হা হা হা।
কেক চলে এল দশটার দিকে। সিলোফেন কাগজে মোড়া দশটি লাল টুকটুকে গোলাপ। মালিশা অনেকক্ষণ অবাক হয়ে দেখল ফুলগুলি। আনিস হাসিমুখে বলল, শুভ জন্মদিন, মালিশা।
মালিশা জবাব দিল না। তার চোখে জল আসছে। সে তা গোপন করবার জন্যে অন্য দিকে তাকিয়ে রইল।