১০৮. চারদিকে কত গাছ

১০৮

চারদিকে কত গাছ, তবু চড়াইপাখি সব সময়ে মানুষের ঘরে কেন বাসা বাঁধে বল তো!

বাসন্তী মশলা বাটছিল। বলল, তোমার সব ঊদ্ভুটে প্রশ্ন বাপু। চড়াইপাখি কোথায় বাসা করে তাই নিয়ে সকালেই কেন ভাবতে বসলে বলো তো!

তুই কখনও লক্ষ করিস না যে অন্য পাখিরা গাছে বাসা বাঁধে কিন্তু চড়াই নয়?

কে জানে বাপু চড়াইয়ের বৃত্তান্ত। ঘরের মধ্যে বাসা করেছে নাকি? তা হলে ভেঙে দাও। ওরা ঘরদোর বড্ড নোংরা করে।

ভেঙে দেবো কি রে? ওরা আমার বন্ধু যে।

এখন কাক বক চড়াই শালিখ তোমার বন্ধু হচ্ছে নাকি? তুমি না পারো আমিই চড়াইয়ের বাসা ভেঙে দিয়ে যাবো।

খবরদার না, বাসায় যদি ডিম থাকে?

বাসন্তী অবাক হয়ে বলে, থাকলে কী হল? হাঁস-মুরগির ডিম ভেঙে দুনিয়াসুদ্ধ লোক খাচ্ছে না?

তোর মায়া-দয়া একটু কম আছে বাসন্তী। এত নিষ্ঠুর কেন তুই?

বাসন্তী ফিক করে হেসে বলল, রাগ করলে নাকি? তোমার যে সব অদ্ভুত কাণ্ড! অত মায়া করছ, কিন্তু দুনিয়াতে মানুষের খাওয়ার জন্যও তো ভগবান কিছু জীবকে পাঠিয়েছেন। জলের মাছ, ডাঙার পাঁঠা, খাসী, মুরগি এদের সৃষ্টিই তো খাওয়ার জন্য।

ভগবানের সঙ্গে তোর এসব নিয়ে কথা হয় নাকি?

আহা, সংসারের যা নিয়ম তাই বলছি।

সংসারের যে কি নিয়ম তা কেউ জানে না। যার যেমন প্রবৃত্তি সে সেরকম নিয়ম করে নেয়। বুঝেছিস?

বুঝেছি গো বুঝেছি। এখন তেনারা কখন আসবেন বলো। সকাল তত আটটা বাজে।

অস্থির হচ্ছিস কেন? আসবে। কলকাতা কি আর এক দৌড়ের রাস্তা? ধামাখালি পৌঁছতেই কত সময় লাগে। তারপর ভটভটি।

আমার খুব আনন্দ হচ্ছে কিন্তু।

তোর তো সব তাতেই আনন্দ।

গাঁয়ে বড় একঘেয়ে জীবন, জানো তো! নতুন মানুষজন দেখলে একটু ভাল লাগে। সেই মেয়েটা আসবে তো!

হেমাঙ্গ সামান্য হেসে বলল, খুব পেকেছিস।

আহা, তাকে আমার প্রথম দেখেই ভীষণ ভাল লেগেছিল যে।

তোর কাকে ভাল না লাগে? সাজগোজ করা শহুরে মেয়ে দেখলেই তো তুই হাঁ হয়ে যাস। তখন তোর চোখের পলক পড়ে না।

কী বলে গো মিথ্যে কথা! বলে বাসন্তী হি হি করে হাসল।

রাস্তার দিক থেকে বাঁকা মিঞাকে আসতে দেখা গেল। পিছনে দুটো লোকের মাথায় একটা চৌকি। তারও পিছনে ফজল। তার মাথায় শতরঞ্চিতে বাঁধা একটা বিছানা।

একমুখ হাসি নিয়ে বাঁকা আগর ঠেলে ঢুকল, সব নিয়ে এলাম।

হেমাঙ্গ বলল, বেশ করেছ।

আপনি একটু ঘাটপানে যান। ততক্ষণে ফজল ঘরটা গুছিয়ে দিক।

এখনই ঘাটে গিয়ে কী হবে? তাদের আসতে দেরি আছে।

কিছু বলা যায় না। হয়তো খুব ভোর-ভোর রওনা হয়ে পড়েছেন।

হেমাঙ্গ একটু হাসল। এ যাবৎ নিশিপুরে কম লোক আসেনি তার বাড়িতে। কিন্তু আজ যারা আসছে তাদের জন্য বাঁকা মিঞা আর বাসন্তী একটু যেন বেশিই তটস্থ। কারণটা কিছু ধরতে পারছে না হেমাঙ্গ। কোথাকার জল কোথায় গড়াচ্ছে কে জানে।

হেমাঙ্গ উঠে পড়ল এবং পায়ে পায়ে ঘাটের দিকেই এগোতে লাগল। ভারি বৃষ্টির পর শরৎকালটা ফুটে উঠছে সবে। এ সময়ে চারদিকে প্রকৃতির ঐশ্বর্য যেন থরে-বিথরে ফুটে ওঠে। এত সুন্দর ঋতু আর হয় না। তার উঠোনে শিউলিফুল ছড়িয়ে থাকে অজস্র। গন্ধে যেন বাতাস শুদ্ধ হয়ে যায়।

নদীর ধারটায় এসে দাঁড়াতেই মুগ্ধ সম্মোহিত হয়ে গেল হেমাঙ্গ। জল আকাশ আর আদিগন্তের প্রসার যেন তাকে টেনে নেয় বুকের মধ্যে।

আশ্চর্যের বিষয়, ঘাটে এসে দাঁড়ানোর দশ মিনিটের মধ্যেই যে ভটভটিটা এসে ভিড়ল সেইটে থেকেই নামল মণীশ, অপর্ণা, অনু আর—না, আর কেউ নয়।

মৃত পায়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল হেমাঙ্গ। মৃত ঠোঁটে হাসল। মৃত গলায় বলল, আসুন, আসুন! কোনও কষ্ট হয়নি তো!

ঘাটে চাঙড় ফেলা। পাথরের চ্যাটালো চাতালটুকু সাবধানে ডিঙিয়ে, মাটি আর ইঁটের পিছল ধাপ ভেঙে ভারসাম্য রাখতে রাখতে উঠে আসছিল অপর্ণা। হেসে বলল, কষ্ট নয় তো কি? বাব্বাঃ, যা দূর!

অপর্ণার তুলনায় অনেক বেশি সপ্রতিভভাবে উঠে এল মণীশ আর অনু। ঘাটে দাঁড়িয়ে চারদিকে চেয়ে মণীশ বলল, বাঃ, এ তো দারুণ সুন্দর ল্যান্ডস্কেপ!

হেমাঙ্গ বলল, ক্যামেরা এনেছেন?

না।

অনু বলল, আমি এনেছি।

একজন আসেনি। সেই না-আসাটা নিয়ে কোনও প্রশ্ন করতে পারল না হেমাঙ্গ। অথচ প্রশ্ন করাটাই তো স্বাভাবিক ছিল। চারজনের একজন কেন এল না? সেই অনুপস্থিতি যে এই তিনজনের আসার চেয়েও অনেক বেশি গুরুতর সেটা হেমাঙ্গ টের পেল নিজের ভিতরে। তার চোখে এই শরতের সুন্দর সকাল, এই মায়াবী আলো, আদিগন্ত অফুরান বিস্তার সব যেন কেমন মিথ্যে-মিথ্যে লাগছে। সুর কেটে গেল, তালে ভুল।

অতিথিদের ঘরে নিয়ে এল হেমাঙ্গ, এই আমার জঙ্গলবাড়ি। দেখুন কেমন লাগে!

সৌজন্যের বশেই হবে, অপর্ণা উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, বাঃ, কী সুন্দর বাড়ি আপনার! লাউডগা বুঝি চালের ওপর?

অনেক কিছু আছে। দেখবেন।

মণীশ চারদিকটা দেখে-টেখে বলল, আপনি এখানে প্রায়ই থাকেন, না?

হ্যাঁ। আর তাই নিয়েই আমার আত্মীয়স্বজনের অশান্তি।

কেন? তাঁরা আপত্তি করেন নাকি?

খুবই করেন। বিশেষ করে মা। মায়ের ধারণা আমি সাধুসন্ত হয়ে যাচ্ছি।

মণীশ একটু হাসল, আজকাল অনেকেই কলকাতার বাইরে পলিউশন-ফ্রি এলাকায় বাড়ি-টাড়ি করে রাখে। ফুসফুস পরিষ্কার করার এর চেয়ে ভাল পন্থা আর কী আছে? শান্তিনিকেতনে ভিড় বাড়ছে তো এই জন্যই। কত টাউনশিপ হচ্ছে সেখানে।

বাঁকা মিঞা আর ফজল চলে গেছে। তারা ফের দুপুরে মুরগি বেঁধে দিয়ে যাবে। বাসন্তী ঘরের শেষ ঝাড়পোছ সাঙ্গ করে বেরিয়ে এল। একমুখ হাসি।

হেমাঙ্গ বলল, এ হল বাসন্তী। এখানে ওই আমার সব দেখাশোনা করে।

বাসন্তী টিপ-টিপ করে সবাইকে প্রণাম করে চায়ের জল চড়িয়ে দিল স্টোভে।

অনু বলল, আমি চা খাবো না। একটু ঘুরে আসি মা।

হেমাঙ্গ বলল, আরে দাঁড়াও। আমার সঙ্গে যাবে।

আচ্ছা।

ব্যাগ থেকে একটা ক্যামেরা বের করে অনু টুক করে বাড়িটার একটা ছবি তুলে নিল। অনু একটা খুব নরম ভুষো নীলচে রঙের চুড়িদার পরে এসেছে। ফর্সা ও লম্বা মেয়েটিকে দেখাচ্ছে ভারি সুন্দর। দুই বোনের মুখশ্রীর তেমন মিল নেই। কিন্তু অনুর চটক বেশি। সহজেই নজরে পড়ে।

বাসন্তী বারান্দায় চেয়ার সাজিয়ে রেখেছিল। মণীশ আর অপর্ণা বসল; অপর্ণা বলল, ঝুমকিটা এল না। আজ ও চারুশীলার সঙ্গে কোথায় যেন যাবে। চারুর তো রোজ একটা না একটা কিছু আছেই।

হেমাঙ্গ হেসে বলল, জানি।

ঝুমকিকে ভীষণ ভালবাসে তো! ঝুমকি বলল, আমি তো নিশিপুর ঘুরে এসেছি মা, তোমরা যাও।

এসব কথা শুনছে হেমাঙ্গ, বুঝছে অন্যরকম। কেন আসেনি সেটা এরা কেউ জানে না। জানবেও না কোনও দিন। হেমাঙ্গ জানে। গভীরভাবে জানে।

চা খাবার ইত্যাদির পর্বটা কোনও রকমে পার হল হেমাঙ্গ। তারপর ভদ্রতা করে বলল, আপনারা কি একটু বেড়াতে যাবেন?

অপর্ণা বলল, আমার কিন্তু টায়ার্ড লাগছে।

মণীশ বলল, আমারও। একটু জিরিয়ে নিই, তারপর দেখা যাবে। বেরোনোর খুব একটা দরকার আছে কি? উঠোন থেকেই তো নদীটা দেখা যায়। ওইটেই যথেষ্ট। সামনে একটা নদী থাকলে আর কী চাই?

অনুকে নিয়ে হেমাঙ্গ বেরোলো।

রাস্তায় পা দিয়ে অনু বলল, আপনি খুব ডিজহার্টেনড, না?

কেন বলো তো!

অনু হি হি করে হেসে বলে, দিদি আসেনি বলে!

হেমাঙ্গ গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করে বলে, তা কেন? অনেকের অনেক জরুরি কাজ থাকতে পারে।

আচ্ছা, আপনি এরকম পিকিউলিয়ার কেন বলুন তো!

কি রকম?

দিদিকে কি আপনি একদিন ফোনে বলেছিলেন যে ওকে আপনি অ্যাভয়েড করতে চান?

তোমাকে কে বলল?

শুনুন, দু’জন বোন যখন কাছাকাছি হয় তখন কেউ কারও কাছে কথা লুকোতে পারে না। উই শেয়ার আওয়ার সিক্রেটস। বলুন না, বলেছিলেন!

হেমাঙ্গ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আনফরচুনেটলি, ইয়েস।

দেন হোয়াই ডু ইউ ল্যামেন্ট?

ল্যামেণ্ট! কই ল্যামেন্টের কী দেখলে?

ইউ আর ক্রেস্টফলেন, ইউ আর কিপিং মাম, ইউ লুক স্যাড। ইউ আর ল্যামেন্টিং সাইলেন্টলি।

তুমি একটি বিচ্ছু মেয়ে।

হি হি করে হাসল অনু। তারপর ফের গম্ভীর হয়ে বলল, আমার দিদিটা বড্ড সেকেলে। একদম ব্যাকডেটেড। এখনকার দিনে কেউ অত রোমান্টিক আর লাজুক আছে নাকি?

এক-আধজন থাকলে দোষ কি?

রোমান্টিক, লাজুক, পেটে খিদে মুখে লাজ এসব কি আজকাল চলে? আমার যদি কাউকে ভাল লাগে আমি স্ট্রেট বলে দেবো, ডিয়ার ম্যান, আই লাইক ইউ।

হেমাঙ্গ একটু হাসল।

অনু তার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে একটু চেয়ে বলল, আপনিও ওল্ড ফ্যাশনড আর রোমান্টিক, তাই না?

কেন? আমি আবার কী করলাম?

দিদিকে আপনি এত ভয় পান কেন? মধ্যযুগীয় নায়কদের মতো বুক-টুক কাঁপে নাকি?

হেমাঙ্গ মৃদু একটু হাসল। বলল, তোমার দিদির সঙ্গে আমার এখনও কোনও সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। আই অ্যাম স্টিল এ ভেরি মাচ লোনার।

মিথ্যুক।

কেন, মিথ্যেটা কী বললাম?

তা হলে বোকা।

গালমন্দ করছ কেন?

ইউ কান্ট কল এ স্পেড এ স্পেড।

আমাকে নিয়ে কেন যে এত ভুল বোঝাবুঝি হয় কে জানে!

অনু ভ্রূ কুঁচকে বলল, ভুল বোঝাবুঝি! মাই গড! আর ইউ ট্রায়িং টু সে দ্যাট ইউ আর নট ইন লাভ উইথ দ্যাট রেচেড সিস্টার অফ মাইন ঝুমকি?

হেমাঙ্গ মুচকি হেসে বলল, তোমার ডান দিকে দেখ। এখান থেকে রাতে নদীর ওপর জ্যোৎস্না দেখলে তোমার মাথা খারাপ হয়ে যাবে।

ওপেন আপ ম্যান! আরন্ট ইউ ইন লাভ?

হেমাঙ্গ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, শোনো অনু, আমি নিজেকে ঠিক বুঝতে পারি না। শী ইজ এ গুড গার্ল। বাট…

রাবিশ। ভীষণ বোকা আপনি।

হেমাঙ্গ কাষ্ঠহাসি হেসে বলল, বোধ হয় কথাটা ঠিক।

তবু স্বীকার করবেন না? আচ্ছা গোঁয়ার লোক বাবা!

স্বীকার করার কিছু নেই। ঝুমকি তোমাকে কী বলেছে?

বলব কেন? আফটার হোয়াট আই হ্যাভ হার্ড ফ্রম ইউ, আমি দিদিকে সাবধান করে দেবো। শী মে বি হ্যাচিং অ্যান আইডিয়া অফ লাভ অ্যাণ্ড ম্যারেজ। শী ইজ কমিটিং এ ব্লান্ডার।

বলবে এ কথা?

বলাই উচিত।

হেমাঙ্গ চুপ করে রইল। বাঁধের ওপর দিয়ে ধীর পায়ে তারা হাঁটছে। দুজনেই নিঃশব্দ, দুজনেই কিছু গম্ভীর। চারদিকের প্রকৃতি মিথ্যেই নানা সৌন্দর্য প্রদর্শন করার চেষ্টা করছে তাদের। তারা দেখছে না কিছু।

অনু থমথমে মুখে হঠাৎ বলল, চলুন, ফিরি। আমার আর ভাল লাগছে না।

বলেই অ্যাবাউট টার্ন হল অনু। উল্টোদিকে হাঁটতে লাগল। হেমাঙ্গ অপ্রস্তুত বোধ করল। মেয়েটা বড্ড জ্বালাচ্ছে তো!

অনু, শোনো। রেগে যাচ্ছ কেন?

অনু মুখ ফিরিয়ে বলল, রাগব কেন?

শোনো শোনো। কথা আছে।

অনু হাঁটার গতি কমিয়ে দিল, কিন্তু মুখের গাম্ভীর্য বজায় রেখেই বলল, বলুন।

তোমাকে আমি বোঝাতে পারছি না হয়তো।

কী বোঝাবেন?

ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড। আমার মন এখনও স্থির নয়।

ইউ হ্যাভ অলরেডি টোল্ড দ্যাট।

কখন বললাম?

নট ইন সো মেনি ওয়ার্ডস, বাট ইউ হ্যাভ হিন্টেড ইট।

তা হলে রেগে যাচ্ছ কেন?

আপনার ওপর রাগব কেন? আমি রেগে যাচ্ছি দিদিটার ওপর। ও কেন এত রোমান্টিক আর বোকা? ও কেন যা নয় তাই মনে করে বসে আছে?

ঝুমকি তোমাকে কী বলেছে অনু?

বারবার জিজ্ঞেস করবেন না, প্লিজ! আমাদের মধ্যে অনেক কথা হয়। সব কথা সবাইকে বলা যায় না।

হেমাঙ্গ যেন একটা থাপ্পড় খেয়ে চুপ করে গেল। অনুর পাশাপাশি বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে তার ভিতরে ভিতরে একটা যন্ত্রণা আর গ্লানি হচ্ছিল। কী করবে সে? কী করবে এখন?

তাদের দেখেই অপর্ণা বলে উঠল, এ কী! অনু, ফিরে এলি যে!

ভাল লাগছে না মা। বিচ্ছিরি জায়গা। চলো, কলকাতায় ফিরে যাই।

ও মা! এই তো এলাম! আজকের দিনটা থাকব না?

তোমরা থাকো, আমি একা ফিরে যাবো।

হঠাৎ তোর হল কি?

হেমাঙ্গ ভীষণ অস্বস্তি বোধ করছিল। মেয়েটা পরিস্থিতি খারাপ করে দিচ্ছে।

অনু বলল, আমার কিছু হয়নি মা। জায়গাটা ভীষণ গ্লুমি, ভীষণ নোংরা। আমি থাকব না।

মণীশ চুপ করে মেয়ের দিকে চেয়ে বসেছিল। এবার বলল, তোর মেজাজ বিগড়েছে বুঝতে পারছি। আমার কাছে আয়।

না বাবা। আমার কিছু ভাল লাগছে না। লীভ মি অ্যালোন। বলে অনু নদীর দিকটায় চলে গেল। আড়ালে।

অপর্ণা হেমাঙ্গর দিকে চেয়ে বলল, আপনি কিছু মনে করবেন না যেন। ও একটু মুডি। হয়তো কিছুক্ষণ পর সব ঠিক হয়ে যাবে।

হেমাঙ্গ একটু কাষ্ঠহাসি হেসে বলল, ও কিছু নয়।

মেয়ের যা মুড দেখছি আজ হয়তো ফিরে যেতে হবে।

তা কেন? আমি একটু বাদে মাথা ঠাণ্ডা হলে ওকে বোঝাবো। আপনাদের জন্য সব অ্যারেঞ্জমেন্ট করা হয়েছে। আজ কেন ফিরবেন?

মণীশ বলল, আগেকার দিনে ছেলেমেয়েরা বাপ-মায়ের কথা শুনে চলত বা তাদের চলতে বাধ্য করা যেত। এখন বাপ-মাকেই ছেলেমেয়েরা চালায়। বুঝলেন? উই আর নাউ ইন এ হোপলেস টাইম। পেরেন্টহুড বলে কিছু আর নেই। আপনি যদি কখনও বিয়ে করেন তা হলে প্রথম থেকেই সাবধান হবেন।

অনুকে ঘণ্টাখানেক বাদে ঘরের পিছনকার বাগানে গিয়ে একা পেয়ে গেল হেমাঙ্গ।

অনু, আই অ্যাম সরি।

অনু ঘাসের ওপর হাঁটু মুড়ে চুপ করে বসেছিল। মুখখানা গম্ভীর, চোখ দূরের দিকে। জবাব দিল না।

হেমাঙ্গর সাহস হচ্ছিল না ওর পাশে গিয়ে বসতে। একটু পিছনে দূরত্ব রেখে বসে সে নরম গলায় বলল, ওঁরা তোমার ভয়ে আজই ফিরে যেতে চাইছেন। কেন যে আমাকে তুমি এত অপমান করছ!

অনু মুখ না ফিরিয়ে বলল, আমার দিদি খুব বোকা। তাই তাকে অপমান করাও খুব সোজা।

ঝুমকিকে আমি একটুও অপমান করিনি। তুমি জানো না বোকা মেয়ে, ঝুমকি আমাকে কিরকম হিপনোটাইজ করে ফেলেছে। কিন্তু আমি তো বিয়ে করব না কখনও। সেই জন্য আমি ওর কাছ থেকে দূরে থাকতে চাই।

সেই কথাটা আমার দিদিরও জানা দরকার। দিদি হয়তো এতটা জানে না। আমি আজই গিয়ে দিদিকে বলব শী ইজ ইন পারসুট অফ এ ওয়াইল্ড গুজ।

হেমাঙ্গ হঠাৎ সামান্য রেগে গেল। চাপা গলায় বলল, তুমি কেন আমাদের মধ্যে আসছ বলো তো! আমাদের ব্যাপারটা আমাদেরই সেটল করতে দাও না কেন?

আমি আমার দিদিকে ভীষণ ভালবাসি। শী ইজ এ ভেরি সিম্পল টাইপ গার্ল। ও হয়তো আপনার ফিলজফিটা বুঝতেই পারেনি। আই মাস্ট কশান হার।

হেমাঙ্গ আর কথা খুঁজে পেল না। চুপ করে রইল।

দুপুরে খাওয়ার পর একটু বেলা থাকতে থাকতেই ফিরে গেল ওরা। মণীশ যাওয়ার সময় গম্ভীর মুখে বিষন্ন গলায় বলল, ডোন্ট মাইন্ড। এর পর যদি কখনও আসি একা আসব। তখন থাকব। ইউ আর এ নাইস ম্যান।

ওরা চলে যাওয়ার পর এত ফাঁকা লাগল হেমাঙ্গর যে সে সহ্য করতে পারছিল না। বড্ড একা, বড্ড অসহায়। একটা তিক্ততায় ভরে আছে মনটা।

রাতটা কাটিয়ে পরদিন সকালেই সে ফিরল কলকাতায়। ধামাখালিতে রাখা থাকে তার গাড়ি। ঝড়ের গতিতে গাড়ি চালিয়ে সে দুপুরের আগেই পৌঁছে গেল চারুশীলার বাড়ি।

চারুদি, প্রবলেম।

কি হয়েছে তোর? এরকম দেখাচ্ছে কেন?

আমি একটা সমস্যায় পড়েছি।

বোস। তোর তো সব সময়ে সমস্যা। কী হয়েছে ধীরে ধীরে বল।

হেমাঙ্গ বসল। ভাবল। তারপর বলল, মণীশবাবুর মেয়ে অনুকে তো চিনিস! মেয়েটা কেমন?

খুব ভাল মেয়ে। লেখাপড়ায় খুব ভাল। কেন?

মেয়েটা একটু পাজি, না?

না তো। কি সব বলছিস!

মেয়েটা নিশিপুরে গিয়ে এমন একটা সিন ক্রিয়েট করল যে, মণীশবাবু সস্ত্রীক চলে এলেন।

দু’দিন থাকার কথা ছিল। থাকলেন না।

তাই বুঝি? দাঁড়া তো, আমি ঝুমকির সঙ্গে ফোনে একটু কথা বলি।

না। এখন থাক।

থাকবে কেন? অসভ্যতা কেন করেছে জানা দরকার।

তুই তো এখনও সবটা জানিস না, কী বলবি ঝুমকিকে?

কিছু বলব না, ডেকে পাঠাবো। ও এলে শুনবো।

তোকে কিছু বলতে হবে না। ঝুমকিকে বলিস আমাকে যেন সুবিধেমতো একটা ফোন করে।

আমি বাড়িতে থাকব।

কিন্তু কি হয়েছে বলবি তো!

আজ নয়। আজ আমি টায়ার্ড। কাল-পরশু এসে বলব।

বাড়ি ফিরে হেমাঙ্গ কিছুক্ষণ ঘুমোলো। রাতে তার একদম ঘুম হয়নি কাল। মাথা গরম, অপমানে গা রি-রি করেছে।

ফোনটা এল রাত সাড়ে দশটায়। হেমাঙ্গ তখন বসে আকাশ-পাতাল ভাবছিল।

আমি ঝুমকি বলছি। আপনি ফোন করতে বলেছিলেন?

হ্যাঁ।

বলুন।

অনু আপনাকে কিছু বলেছে?

অনু! না তো!

কাল নিশিপুরে গিয়েছিল। রাগ করে ফিরে এসেছে। কিছুই বলেনি?

না। তবে মা বলছিল ওর নাকি মুড অফ হয়ে গিয়েছিল।

হেমাঙ্গ একটু চুপ করে থেকে বলল, ঘটনাটা আপনাকে আর আমাকে নিয়ে।

আমাদের নিয়ে! কী ঘটনা একটু বলবেন?

শী থিংকস্ দ্যাট উই আর ইন লাভ।

ঝুমকি কোনও জবাব দিল না।

শুনছেন?

ঝুমকি ক্ষীণ গলায় বলল, শুনছি।

আপনি তো জানেন, আমি একটু একা টাইপের লোক। একা থাকতে ভালবাসি। জলে-জঙ্গলে ঘুরি। খেয়ালি। জানেন তো!

জানি।

আমাকে মাঝে মাঝে ভূতে পায়। আমি যে কী করি তা বুঝতে পারছি না। অনু কাল আমাকে খুব অপমান করেছে। হয়তো করাই উচিত।

আমি অনুর হয়ে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। ওকে যা বলার আমি বলব।

প্লিজ, বলবেন না। অনুর নামে নালিশ করার জন্য ফোন করতে বলিনি। আর একটু গভীর কথা আছে।

কী কথা?

গলা শুনে মনে হচ্ছে আপনারও মুড আজ ভাল নেই। কথাটা বলার জন্য একটু ভাল মুড দরকার।

ঝুমকি একটু হাসল। বলল, মুড ভালই আছে। বলুন।

বলব? না কি আর একটু সময় নেবো?

আপনার ইচ্ছে।

আমি আপনাকেই জিজ্ঞেস করতে চাই। কারণ আমার চেয়ে আপনিই হয়তো ভাল বুঝবেন।

কি জিজ্ঞেস করতে চান?

অ্যাম আই ইন লাভ উইথ ইউ?

ঝুমকি খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর প্রায় ফিসফিস করে বলল, তার আমি কী জানি!

হেমাঙ্গ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমিও জানি না।

ঝুমকি চুপ করে রইল।

হেমাঙ্গ সামান্য বিষন্ন গলায় বলল, এই কথাটাই অনুকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম। ও ভুল বুঝল।

আপনি বারবার অনুর কথা বলছেন কেন? ও ছেলেমানুষ, ওর কথা ধরবেন না।

হেমাঙ্গ স্বগতোক্তির মতো করে বলল, আমি যে কী ভীষণ সমস্যায় আছি তা বোঝাতে পারব না।

কিসের সমস্যা?

আগে বলুন আপনি নিশিপুরে গেলেন না কেন?

ঝুমকি একটু চুপ। তারপর খুব নিচুগলায় বলল, আপনি আমাকে অ্যাভয়েড করতে চান বলে যাইনি।

জানি। কিন্তু অ্যাভয়েড করতে চাইলেও পারছি না কেন? আপনি যাননি বলে আমার খুব খারাপ লেগেছিল। দিনটাই মাটি হয়ে গেল যেন।

ঝুমকি চুপ।

আমি আপনাকে নিয়েই প্রবলেমে পড়েছি। রশ্মিকে নিয়ে আমার এই প্রবলেম ছিল না। আই নেভার মিস্‌ড্‌ হার। কিন্তু আপনাকে মিস করি কেন?

ঝুমকি চুপ।

কিছু বলুন, প্লিজ!

ঝুমকি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কী বলব?

তা হলে অন্য দিক দিয়ে বলুন, আমার সম্পর্কে আপনার মনোভাব কিরকম?

ঝুমকি চুপ।

বলবেন না?

ঝুমকি খুব ক্ষীণগলায় বলে, বলে কী লাভ?

আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে।

আপনি ভাল থাকুন। ছাড়ছি।

না, প্লিজ!

ঝুমকি ফোন ছাড়ল না। ধরে রইল। ফোন ধরে রইল হেমাঙ্গও। কেউ আর কোনও কথা বলতে পারছিল না। কিন্তু টের পাচ্ছিল দুজনেই ফোন ধরে আছে।

পাঁচ মিনিট পর হেমাঙ্গ বলল, আমার কথা আসছে না।

ঝুমকি মৃদুতম স্বরে বলল, আমি কী করব?

আপনি আমাকে একটু গাইড করতে পারেন তো, নাকি?

ঝুমকি চুপ।

হেমাঙ্গ একটু ধৈর্য হারিয়ে বলল, আপনি কিচ্ছু পারেন না।

কী পারতে হবে তাই তো বলেননি।

আচ্ছা, কাল একবার দেখা হতে পারে?

কোথায়?

কোথাও।

পারে! কিন্তু কোথায় দেখা হবে না জানলে যাবো কি করে?

আপনি বিকেল তিনটের সময়ে আপনাদের বাড়ির কাছে ন’ নম্বর বাস টার্মিনাসে থাকতে পারবেন?

পারব।

কিছু মনে করলেন না তো!

মনে করার মতো কিছু তো নয়।

আপনি কি সাদা রং পছন্দ করেন?

সাদা?

হ্যাঁ। সাদা খোলের শাড়ি?

ঝুমকি একটু হাসল, কেন?

এমনি।

আপনি পছন্দ করেন?

হ্যাঁ। সাদা রঙে মেয়েদের এত মানায়!

তাই বুঝি?

কিছু মনে করলেন না তো!

না।

বিরক্ত করলাম। ছাড়ছি।

ঝুমকি ক্ষীণ গলায় বলল, আচ্ছা।

ফোনটা রেখে দেওয়ার পর কৃতকর্মের অনুশোচনায় তার মন ভরে গেল। এ কী করল সে! ঝুমকিকে কাল সে কেন ডাকল? কী বলবে? অস্থির হেমাঙ্গ কিছুক্ষণ ঘরের মধ্যেই পায়চারি করল। তারপর ধীর পায়ে উঠে এল ছাদে। চাঁদ নেই। এক ঝুড়ি তারা কলকাতার ম্লান আকাশে ছড়িয়ে রয়েছে বিশৃঙ্খলভাবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *