১০৪
ছোট ফিয়াট গাড়ির মধ্যে তারা দুজন সামনের সিটে পাশাপাশি বসা। চারদিকে বৃষ্টির ঝরোখা, সামনের উইন্ডস্ক্রিনে বৃষ্টির লহর খেলছে। চারদিক আবছা, মেঘলা আলোয় কিছু অপ্রসন্নতা। কিন্তু পৃথিবীর ঋতুচক্রের নিয়ম অনুযায়ী বাদলার সময় বৃষ্টিও তো হবে। আজ বুঝি এই বৃষ্টির আলাদা কোনও প্রয়োজন ছিল? কে জানে কী!
কলকাতার বৃষ্টি এরকম, নিশিপুরে কিন্তু অন্যরকম।
অনেকক্ষণ বাদে গাড়ির ভিতরকার নিস্তব্ধতায় এই একটামাত্র কথা শোনা গেল।
ঝুমকি বাঁ দিকে কাচের ভিতর দিয়ে বাইরে চেয়েছিল, চোখ ফিরিয়ে বলল, কিরকম?
কলকাতার বৃষ্টি কি কারও ভাল লাগে? শান বাঁধানো শহরে বৃষ্টির কোনও ভূমিকাই নেই, সৌন্দর্য তো নয়ই, প্যাচপ্যাচে, নোংরা শহরটা যেন আরও কুচ্ছিত হয়ে যায়।
আর নিশিপুরে?
দেখেননি তো! মস্ত নদীর ওপর যখন মেঘলা আকাশের ছায়া পড়ে আর বৃষ্টির শব্দ মাদলের মতো বাজতে থাকে টিনের চালে, মাটির কোষে কোষে, ঘাসে, গাছে সব জায়গায় যখন বৃষ্টি নেমে আসে তখন মন ভরে যায়। কী দামাল বাতাস!
ছোট্ট একটু গলা খাঁকারি দিয়ে ঝুমকি বলল, কলকাতায় কি বৃষ্টির দরকার নেই? বৃষ্টি হলে শহরের রাস্তাঘাট ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে যায়, আবহাওয়া ঠাণ্ডা হয়, শুনেছি নাকি অসুখবিসুখও কমে যায়।
গাড়ি খুব ধীরে আর সাবধানে চালাতে চালাতে, হেমাঙ্গ বলে, বৃষ্টির প্রয়োজন শহরেও আছে, কিন্তু বৃষ্টিকে তেমন করে উপভোগ করা যায় না। এখানে রাস্তায় জল জমে যায়, ট্র্যাফিক জ্যাম হয়।
আমার কিন্তু কলকাতার বৃষ্টি বেশ লাগে।
নিশিপুরে বষাকালে গিয়ে কয়েকদিন থেকে আসলে আর কলকাতার বৃষ্টি তত ভাল লাগবে না।
ঝুমকি একটু হেসে হঠাৎ বলল, আচ্ছা, চারুমাসির বাড়ি যেতে আজ আমাদের এত সময় লাগছে কেন বলুন তো! আমি তো রোজ হেঁটেই চলে যাই।
উৎকণ্ঠ হেমাঙ্গ বলে, একটু ঘুরপথে যেতে হচ্ছে। সোজা রাস্তায় একটা ট্রাক ব্রেকডাউন হয়ে পড়ে আছে। সেখানে জ্যাম।
ও।
তাছাড়া রাস্তায় জল জমে আছে। বেশি জোরে চালালে ইঞ্জিনে জল ঢুকে যাবে। তখন গাড়ি ঠেলা ছাড়া উপায় থাকবে না।
ও বাবা!
হেমাঙ্গ একটু হাসল, যন্ত্র নিয়ে ওইটেই তো অসুবিধে।
আপনি ঠিক কৃষ্ণজীবনবাবুর মতো হয়ে যাচ্ছেন, না?
হেমাঙ্গ আহত হল। সে কারও মতো, একথা শুনতে তার ভাল লাগার কথা নয়। সে গম্ভীর গলায় বলল, আমি আমার মতোই।
কৃষ্ণজীবনবাবুও খুব যন্ত্রবিরোধী লোক। উনিও খুব প্রকৃতি আর গ্রাম ভালবাসেন।
বুদ্ধিমান বিবেচক মানুষদের পক্ষে সেটাই তো স্বাভাবিক!
আচ্ছা, আমার তো শহরই বেশি ভাল লাগে। শহর কত ইন্টারেস্টিং। রোজ কত ঘটনা ঘটছে আর গ্রাম যেন থেমে আছে। দিনের পর দিন একইরকম।
হেমাঙ্গ ফের একটু চুপ করে থেকে বলল, গ্রামেও ঘটে। অনেক কিছু ঘটে। চোখ থাকলে ঠিকই দেখা যায়।
কী ঘটে সেখানে?
খুব ছোট ছোট ঘটনা। জোঁক কিভাবে চলে জানেন?
না। আমি জোঁক দেখিইনি। কিরকম হয় বলুন তো?
আপনার জন্য শিশিতে ভরে কয়েকটা নিয়ে আসব।
একটু বিবর্ণ হয়ে ঝুমকি বলল, কামড়ায় তো!
কামড়ে ধরে থাকে। সহজে ছাড়ে না।
ও বাবা!
জোঁকের কাছ থেকেও কিন্তু আমাদের শেখার আছে।
ঝুমকি হেসে ফেলল, জোঁকের কাছ থেকে আবার কী শেখার আছে?
টেনাসিটি। ওই কামড়ে ধরে থাকাটা। সকলে কি পারে ধরে থাকতে?
আমার শিখে দরকার নেই বাবা।
হেমাঙ্গ হাসল, ভয় পেলেন? প্রকৃতিতে কিছুই ভয়ের নেই। শহুরে লোকেরা যে কোনও পোকামাকড় সরীসৃপ দেখলেই ভয় পায়। আমিও পেতাম। এখন ভয়ের বদলে আনন্দ হয়। আমার উঠোন দিয়ে কত সাপ যাতায়াত করে জানেন?
মা গো!
কিন্তু আমার আর ভয় করে না। বেশিরভাগ সাপেরই বিষ নেই। বিষধরদেরও না ঘাঁটালে কিছু করে না। ওদের মতো ওদের থাকতে দিন ওরাও আপনাকে আপনার মতো থাকতে দেবে। আর সাপ কী সুন্দর প্রাণী বলুন তো! অমন চিত্রল শরীর ক’টা প্রাণীর আছে?
উঃ, সাপের কথা শুনেই আমার গা সিরসির করছে। প্লিজ, আর বলবেন না।
হেমাঙ্গ গাড়িটা চারুশীলার বাড়ির ভিতরে ঢুকিয়ে থামাল। তারপর স্বগতোক্তির মতো বলল, ইট ওয়াজ এ সুইট জার্নি। আসুন, সবাই আপনার জন্য বসে আছে।
মুখখানা কেন যে হঠাৎ রাঙা হয়ে গেল ঝুমকির কে বলবে!
ঝুমকির ওই লালিমাটুকু লক্ষ করল হেমাঙ্গ, যখন নেমে ঘুরে গিয়ে বাঁদিকের দরজাটা ঝুমকির জন্য খুলে দিয়ে দাঁড়াল। একটু ভাবল সে, কোনও অন্যায্য কথা বলে ফেলেনি তো! তাদের কথা হয়েছে শহর, গ্রাম, বৃষ্টি, জৈাঁক আর সাপ নিয়ে। লজ্জা পাওয়ার মতো বিষয়বস্তু তো একটাও নয়!
যখন তারা দোতলার হলঘরে ঢুকল তখন একটা কর্ডলেস টেলিফোনে চারুশীলা কাকে যেন এক্ষুনি চলে আসার জন্য খুব করুণ গলায় অনুনয় করছিল, চলে আসুন না, প্লিজ…না না, এতে কিছু হবে না। জার্নি করে এসেছেন তো কী হয়েছে? আপনি তো দারুণ হার্ডি মানুষ। …দেখুন না আমি তো প্ল্যান করে কিছু করিনি আজ। হঠাৎ মনে হল এই বৃষ্টির দিনে সবাই মিলে একটু আড্ডা দেওয়া যাক…..আচ্ছা, আপনি আমাদের অপছন্দ করেন না তো! …..তা হলে চলে আসুন। প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ!
টেলিফোন রেখেই চারুশীলা দৌড়ে এসে ঝুমকিকে ধরল, এসেছিস? উঃ বাঁচলাম।
কিন্তু তুমি তো আমাকে আগে বলোনি মাসি! আমার খুব রাগ হয়েছে।
আহা, এ বাড়িতে তোর আবার নেমন্তন্নের দরকার হয় নাকি? আগে থেকে ঠিক করা ছিলও না। হ্যাঁ রে, তোকে আজ এত সুন্দর দেখাচ্ছে কেন?
যাঃ! আমি আবার সুন্দর নাকি?
কেন, তুই বুঝি জানিস না যে তুই সুন্দরী? ন্যাকা!
বেশি বোলো না তো, শুনলেও লজ্জা করে।
না রে, তোকে আজ ভারি মিষ্টি দেখাচ্ছে। আয়, আজ তোকে একটা জিনিস দিই।
অনেক তো দিয়েছে মাসি! আর কেন?
আহা, কী আবার দিলাম তোকে?
তিনখানা জাপানি শাড়ি, দুটো দামী সেন্ট, এক ডজন লিপস্টিক আর মেক আপ, ভ্যানিটি ব্যাগ, কলম।
তাতে কি? আরও দেবো। আয় আমার সঙ্গে।
ভিতরের ঘরে হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে কাবার্ড থেকে একটা নতুন স্প্রে সেন্ট বের করে তাকে দিয়ে বলল, নে।
আবার সেন্ট!
এটা এলেবেলে সেন্ট নয়। যাকে চাইবি এই সেন্ট মেখে তার কাছে গেলেই সে তোকে ভালবেসে ফেলবে।
ঝুমকি একটু হেসে বলল, তাই নাকি? তাহলে এটা আমার আর দরকার নেই মাসি। আমি কাউকে হিপনোটাইজ করতে চাই না।
ইগোতে লাগল বুঝি? সেভাবে বলিনি রে বোকা! ঠাট্টা করছিলাম। এটা একটা এক্সকুসিভ পারফিউম। এক বুড়ো ফরাসি নাকি নিজের হাতে বানায়। কিরকম জিনিস তা আমিও জানি না। মাখিনি কখনও। তোর ওপর দিয়ে একটু এক্সপেরিমেন্ট করছি।
আমি বুঝি তোমার গিনিপিগ?
নে না বাবা, যাই দিতে চাই তাইতেই সবসময়ে আপত্তি করিস কেন?
ঝুমকি মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, সবসময়ে এত দিও না তো। এত দিলে ভাল লাগে বলো? তোমাকে আমি কী দিই?
চারুশীলা চোখ পাকিয়ে বলে, আমাকে দিবি! সাহস তো কম নয়। আমি তোর বড় না? আর দেখ তত ভাই, জিনিসে জিনিসে বাড়িটাকে আমি কিরকম ওয়্যারহাউজ করে ফেলেছি! আমাকে জিনিস দিতে কি লোকের মায়া হয় না? কোথায় রাখব বল তো!
ঝুমকি হেসে ফেলে বলে, ঠিকই বলেছে। মাঝে মাঝে তোমাকে কিছু দিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু ভাবি, চারুমাসিকে দিয়ে লাভ কি? সবসময়েই তো কেনাকাটা করছে।
ওইটেই তো আমার রোগ। এই রোগটা হেমাঙ্গরও আছে। কী জিনিস কেনে ভাবতে পারবি আমাদের দুজনের ওই একটা ব্যাপারে খুব মিল।
জানি মাসি।
তবে আজকাল আর ওর কেনাকাটার ঝোঁকটা নেই। বলতে বলতে চারুশীলা একটু আনমনা হয়ে গেল।
কী হল মাসি?
চারুশীলা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কি যে হল হেমাঙ্গর! ও কি সাধু হয়ে যাবে রে?
ঝুমকি ফের একটু লাল হল। বলল, যাক না।
সাধু হবে? তাতে ভালটা কি হবে?
সাধু হওয়া কি খারাপ?
খারাপই তো। সাধুরা যে ভিক্ষে করে খায়!
ঝুমকি হেসে ফেলে। বলে, তাতেই বুঝি তোমার ভয়?
হেমাঙ্গ ভিক্ষে করে খাবে! বলিস কি!
দেখ মাসি, তোমার ভাইটি অত সহজে সাধু হবেন না।
কি করে জানলি?
জানবো কি করে আবার! মনে হল তাই বললাম।
না রে, তুই জানিস না। ওর কুষ্ঠিতে আছে কত বছর বয়সে যেন সন্ন্যাস-যোগ।
তুমি বুঝি কুষ্ঠি মানো?
মানি কিনা জানি না। কিসে কি হয় কে জানে বাবা! আমি যখন সুব্রতকে বিয়ে করি তখন তো ও ভেরেন্ডা ভাজে আর বিপ্লব করে বেড়ায়। এক জ্যোতিষী ওর মাকে বলেছিল, একদিন নৃপতুল্য টাকা হবে। কে বিশ্বাস করেছিল সে কথা? অথচ দেখ ফলে তো গেল!
আমার ওসব বিশ্বাস হয় না।
অনেকেরই হয় না। আসলে কি জানিস, ভালটা না ফললেও খারাপটা ঠিকই ফলে যায়।
ঝুমকি ফের হাসল। বলল, সেটা নিজের-জন সম্পর্কে সবসময়েই মনে হয়।
চারুশীলা খুব বিষণ্ণ মুখ করে বলল, কে জানে হেমাঙ্গর জীবনটা আমিই নষ্ট করে দিলাম কিনা।
কেন মাসি, তুমি নষ্ট করবে কেন!
সুব্রত বলেছে, রশ্মির সঙ্গে হেমাঙ্গর সম্পর্কটা ধীরে ধীরে আপনা থেকেই গাঢ় হত। আমি বিয়ের জন্য নানারকম প্রেশার ক্রিয়েট করাতেই নাকি ব্যাপারটা কেঁচে গেল।
ঝুমকি সবেগে মাথা নেড়ে বলল, তুমি কিছু বোঝে না।
বুঝি না!
একটুও না। তুমি বড্ড সরল। তোমাকে আগেই বলেছি রশ্মি একদম অন্য ধরনের মেয়ে। হেমাঙ্গবাবুর সঙ্গে ওকে ঠিক মানায় না।
আমাকে এরকম কথা আরও কেউ কেউ বলেছে। কিন্তু কেন বল তো! আমার তো রশ্মি আর হেমাঙ্গকে মনে হত মেড ফর ইচ আদার।
তুমি তোমার ভাইকে সংসারী করার জন্য এত বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলে যে, তখন তোমার অত খুঁটিয়ে বোঝার মতো মনই ছিল না। সুন্দর দেখেই ঢলে পড়েছিলে।
খুব অসহায় মুখ করে চারুশীলা বলল, তাহলে হেমাঙ্গর এখন কী হবে বল তো!
কী আর হবে! সাধু হয়ে যাবে।
চারুশীলা হাসল না। বিষণ্ণ গলায় বলল, রশ্মির বিয়ের খবরটা পাওয়ার পর থেকেই কেমন যেন হয়ে গেছে। একদম উদাস, বৈরাগী। ওর কথা ভাবলেই এত ভয় করে! ভয়ে আমি আর বিয়ের কথাও তুলি না। ওর বাড়ির লোকও হয়রান হয়ে যাচ্ছে।
তুমি ওঁকে নিয়ে এত ভাবছো কেন? কিছু তো করতে পারবে না। কিছু ভেবো না, ওঁকে ওঁর মতো থাকতে দাও।
তাই তো দিচ্ছি। কিন্তু কি হচ্ছে বল তো! বিডন স্ট্রিটের বাড়িতে ওর মা দুশ্চিন্তায় শুকিয়ে যাচ্ছে! রোজ আমাকে ফোন করে। কত মেয়ে দেখেছে তার ঠিক নেই। গাদা গাদা ফটো জমে গেছে। কী সুন্দর সুন্দর সব মেয়ের ছবি এসেছে দেখলে মাথা ঘুরে যায়!
কেমন যেন হঠাৎ ম্লান হয়ে গেল ঝুমকির মুখখানা। বলল, বেশ তো। চেষ্টা করতে করতে একদিন ঠিক রাজি হয়ে যাবে। ছেলেরা তো আসলে হ্যাংলা।
যাঃ। হেমাঙ্গ আর পাঁচজনের মতো নয়। হ্যাংলা একদম নয়। অত সুন্দর চেহারা, কিন্তু কখনও মেয়েদের দিকে ফিরেও চাইত না। ওকে তুই চিনিস না।
ঝুমকি হেসে বলল, নিজের ভাইকে সবাই একটু বেশি সুন্দর দেখে।
চারুশীলা চোখ পাকিয়ে বলল, এই পাজি! হেমাঙ্গ কি দেখতে খারাপ?
তাই কি বললাম?
সুন্দর নয়?
তেমন কিছু নয়।
হেমাঙ্গ ম্যাসকুলিন, ছমছমে শরীর। মুখটার কাট দেখেছিস? ফটোজেনিক নয়, লালটুও নয়। কিন্তু ওর হল পুরুষালি চেহারা।।
একটু বুনো-বুনো, তাই না? বলেই ঝুমকি হেসে ফেলল।
ইয়ার্কি হচ্ছে? হেমাঙ্গর নিন্দে করবি তো ফাটাফাটি হয়ে যাবে। আয়, ভাল করে দেখে যা।
বলেই তার হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে চলল চারুশীলা।
ভয় খেয়ে ঝুমকি চাপা আর্তনাদ করতে লাগল, ছাড়ো! ছাড়ো! আচ্ছা, ভুল বলেছি মাসি, কান মলছি। আর করব না।
না। আয়, দেখ ভাল করে। তুই কি অন্ধ যে হেমাঙ্গকে সুন্দর দেখিস না!
কাতর গলায় ঝুমকি বলল, খুব সুন্দর মাসি। কী বড় বড় দাঁত, কী সুন্দর কেষ্ট ঠাকুরের মতো গায়ের রং…আচ্ছা মাসি, আর ইয়ার্কি করব না। ছাড়ো না প্লিজ!
ছাড়ব? দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা!
হলঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অতিথিরা বসা। বাচ্চারা হইচই করছে। হেমাঙ্গ ঘরে নেই।
এই, হেমাঙ্গ কোথায় গেল রে?
কেউ বলতে পারল না। চারুশীলা হাত ধরে ঝুমকিকে টানতে টানতে এঘর ওঘর ঘুরে বেড়াল। কোথাও হেমাঙ্গ নেই।
আশ্চর্য! কোথায় গেল বল তো!
ঝুমকি সামান্য হাঁফ-ধরা গলায় বলল, চলে যাননি তো?
আমাকে না বলে? চল তো দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করি।
বাইরে হেমাঙ্গর গাড়িটা ছিল না। দারোয়ান বলল, হেমাঙ্গবাবু একটু আগেই চলে গেছে।
কাঁদো-কাঁদো হয়ে চারুশীলা বলল, দেখলি! ওর আজকাল এরকম অদ্ভুত স্বভাব হয়েছে। কখন কী করে তার ঠিক নেই। একটু আগে যখন বলেছিলাম তোকে গিয়ে নিয়ে আসতে খুব রাজি হয়ে চলে গেল। বেশ হাসিখুশি ছিল। আবার হঠাৎ কী খেয়াল হল কে জানে, দুম করে কাউকে না বলে-কয়ে চলে গেল!
ঝুমকির চোখে বিবর্ণ দিনটা হঠাৎ আরও বিবর্ণ হয়ে মরে গেল। বুকের ভিতরটা কেমন নিথর। হতাশায় তারও চোখে জল আসার উপক্রম হল।
চল যাই ভিতরে।
স্তিমিত গলায় ঝুমকি বলল, চলো।
যখন দুটি হতাশ রমণী ঘরে ফিরে আসছিল ধীর পায়ে তখন পূর্ণ দাস রোড থেকে গোল পার্ক হয়ে ডান দিকে মুখ ফেরাল হেমাঙ্গর ছোট্ট ফিয়াট। চারদিকে আজ জলপ্রপাতের মতো বৃষ্টি নেমেছে। তার ছোট গাড়ি যে-কোনও মুহূর্তে ফেঁসে যাবে।
সাদার্ন অ্যাভেনিউতে লেকের রেলিং ঘেঁষে প্রায় হাঁটু জলের মধ্যে গাড়ি দাঁড় করাল হেমাঙ্গ। তারপর চুপ করে বসে রইল।
কতবার ভুল করবে সে! আর কতবার? তার কেন ওকে ভাল লাগছে? কেন এত বেশি ভাল লাগছে ওকে? এটা কি সঙ্গত? এটা কি হওয়া উচিত?
নিজের সঙ্গে একটা লড়াই দরকার হয়েছে তার। এ লড়াই হেরে গেলে তার চলবে না। গাড়িটা খুব ধীরে, সাবধানে নিজের বাড়ির দিকে ফেরাল হেমাঙ্গ।
জলে গাড়ি বিশ্বাসঘাতকতা করল না এবারও।
হেমাঙ্গ ঘরে ঢুকে চুপচাপ শুয়ে রইল বিছানায়। টেলিফোন টানা বেজে যেতে লাগল। হেমাঙ্গ ধরল না। টেলিফোন থেমে গেল ধৈর্যহারা হয়ে।
ও মেয়েটিকে এবার থেকে অ্যাভয়েড করতে হবে হেমাঙ্গ, বুঝেছো?
বুঝেছি।
শি ইজ টেকিং ইউ ওভার। বি কেয়ারফুল।
হ্যাঁ।
কিন্তু কী করবে হেমাঙ্গ!
দেখা যেন না হয় আর।
কিন্তু চিন্তায় হানা দেবে। সেটাও খারাপ।
খুব খারাপ।
ওর ডিফেক্টগুলো খুঁজে বের করো হেমাঙ্গ। ট্রাই টু হেট হার।
শক্ত কাজ। কারও প্রতি দুর্বলতা এলে ডিফেক্টগুলো নজরে পড়তে চায় না।
খুব সত্যি কথা, তা হলে!
চেষ্টা করতে হবে। এখনই এটা অঙ্কুরে বিনাশ না করলে পরে কষ্ট পেতে হবে।
খুব ঠিক কথা।
তুমি আর কিছুদিন এখন চারুশীলার বাড়িতে যেও না।
হুঁ। কিন্তু চারুদি কি ছাড়বে! খোঁজ নেবে।
আজ নিশিপুরে চলে গেলে ভাল করতে তুমি।
এবার থেকে কোনও উইক এন্ড বাদ দেবো না।
পালাতেই হবে।
খুব ধীরে ধীরে ঘুম চলে এল। কিন্তু ঘুমটাও নিপাট হল না। কত হিজিবিজি স্বপ্ন এল।
ঘুম ভাঙল হঠাৎ টেলিফোনের শব্দে। সতর্ক ছিল না হেমাঙ্গ, ঘুম-চোখে উঠেই টেলিফোন ধরল, হ্যালো!
ওপাশে কিছুক্ষণ চুপচাপ।
হ্যাল্লো! হ্যাল্লো!
খুব চাপা একটা নারীকণ্ঠ বলল, ওভাবে চলে এলেন যে!
হেমাঙ্গর বুকের মধ্যে হৃৎপিণ্ড একটা বিট মিস করল। তারপর হঠাৎ রেলগাড়ির মতো চলতে শুরু করে দিল। হেমাঙ্গর একটু স্বাসকষ্ট হচ্ছিল। তার ভিতর থেকে কে যেন বলে উঠল, ঘৃণা করো ওকে।
আমার জন্যই চলে এলেন?
কে বলল?
আমি জানি। যদি আমাকে অ্যাভয়েডই করার ইচ্ছে তা হলে নিয়ে এলেন কেন?
অ্যাভয়েড করতে চাইনি বলেই।
মোটেই না। বলতে বলতে একটা কান্নার সম্ভাবনায় গলাটা স্বলিত হয়ে গেল একটু।
আপনি কেন ইনসাল্টেড ফিল করছেন? আমি তো এমনিতেই একটু খেয়ালি।
শুধু খেয়ালি?
আরও কিছু?
জানি না। মাঝে মাঝে আপনি এমন করেন যে—
আমি খুব শান্তিতে নেই। আপনাকে যদি বলতে পারতাম!
জানি। আপনি রশ্মির কথা ভেবে—
কিছু জানেন না। রশ্মির কথা আমি কদাচিৎ ভাবি। ভাববই বা কেন? কোনও কারণ ছিল না। তাহলে?
কথাটা আপনাকেই বলা যায় না।
কেন যায় না?
আমি সত্যিই আপনার কাছ থেকে দূরে থাকতে চাই।
তাই তো আছেন। আমি কী এমন করলাম?
জানেন না?
না তো!
নাকি জানেন, স্বীকার করতে পারেন না!
কি করে জানব?
হেমাঙ্গ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।