১০৩. রবিবারের এক সকালে

১০৩

হ্যাঁ গো, গৃহপ্রবেশে আমরা কাকে কাকে নেমন্তন্ন করব? রবিবারের এক সকালে বিষন্ন মণীশকে কথাটা জিজ্ঞেস করল অপর্ণা।

বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। মেঘলা আকাশ নিবিড় মেঘে ছাইরঙা হয়ে আছে। মণীশ বসে আছে আবছা অন্ধকার ঘরে, জানালার ধারে তার পলকা ইজিচেয়ারে। পাশে একখানা টেবল। ইংরেজি-বাংলা দুটো খবরের কাগজ জড়ো হয়েছে তার ওপর। মণীশ কাগজদুটো একটু উল্টে পাল্টে রেখে দিয়েছে, যেন পৃথিবীর কোনও খবরেই তার আর কোনও প্রয়োজন নেই। বিষন্ন দুটি চোখ জানালার বাইরে স্থাপন করে সে চুপ করে বসে আছে।

ক্রমে ক্রমে মণীশের এই চুপ হয়ে যাওয়া ভাল লাগছে না অপর্ণার। আজকাল রাতে বিছানায় শুয়ে আগেকার মতো কিছুক্ষণ গল্প করার অভ্যাসটাও কমে যাচ্ছে তাদের। অপর্ণার অনেক কথা থাকে। বলেও, কিন্তু মণীশ নীরবে শশানে। জবাব দিতে চায় না। মণীশের কাছ থেকে কথা বের করতে না পেরে অপর্ণার নিঃসঙ্গ লাগে, ভয় হয়। ভয় জিনিসটার কোনও মাথামুণ্ডু নেই। কতরকম ভয়, কত রকম যে অমঙ্গলের কথা মনে হয় সব সময়ে!

হ্যাঁগো, কী হল তোমার? বলে মণীশের মাথায় সস্নেহে হাত রাখল অপর্ণা।

মণীশ চোখ দুখানা তার দিকে তুলল। মুখে বিমর্ষতা ছাড়া আর কোনও এক্সপ্রেশন নেই। শুধু ছেলে হোস্টেলে গেছে বলেই কি এতটা মনখারাপ হয় কারও!

মণীশ একটু জোর করেই হাসল। বলল, কিছু হয়নি। আজকাল একটু গুটিয়ে যাচ্ছি নিজের মধ্যে। কী বলছিলে?

আমি বলছিলাম, গৃহপ্রবেশে কাকে কাকে ডাকা হবে?কার্ড ছাপিয়ে নেমন্তন্ন করতে হবে কি না। ক্যাটারার কাকে ঠিক করবে। অনেক কথা আছে যে তোমার সঙ্গে। অমন চুপ করে থাকলে তো আমার চলবে না!

মণীশ একটু উঠে সোজা হয়ে বসার চেষ্টা করে বলল, এগুলো তো সব তোমার ব্যাপার। আমার তো কয়েকজন অফিস কলিগ ছাড়া ঢাকার কেউ নেই। আত্মীয়স্বজনই বা কে বলো! একটা ভাই, তা সেও বিকানিরে। তাকে নেমন্তন্ন করলেও আসতে পারবে না। আমি বলি, তুমি যাকে ইচ্ছে ডাকো। আমি আমার কলিগদের কয়েকজনকে ডাকতে পারি।

তোমার অনেক বন্ধু ছিল একসময়ে। যখন খবরের কাগজে কাজ করতে তখনকার কলিগরাও তো আছে! ডাকবে না তাদের?

মণীশ প্রস্তাবটা মাছি তাড়ানোর মতো হাতের ঝাপটায় উড়িয়ে দিল। বলল, আরে না না, ও চ্যাপটার কবেই ক্লোজড হয়ে গেছে। কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে? পুরনো আমল ধরে টানাটানি কেন ভাই!

কেমন দেখাবে বলল তো সেটা! আমার বাপের বাড়ির লোকেরা আসবে, তোমার কেউ আসবে না?

মুখটা করুণ করে মণীশ বলল, আমার কেউ নেই যে অপু! কবে মা-বাবা মরে গেছে। এক কাকা ছিল, বছর পাঁচেক হল নেই। তার ছেলে নয়ন দিল্লিতে চাকরি করে, মেয়ে রাউরকেল্লায়। বহুকাল যোগাযোগ নেই। এদের ডাকার কোনও মানেই হয় না! কেউ আসবে না।

তাই তো বলছি, পুরনো বন্ধুদের ডাকো!

সেটাও অর্থহীন হবে। সম্পর্কই নেই, হঠাৎ নেমন্তন্ন করার মানে হয়?

আচ্ছা, একটা কথা বলবে?

কি কথা?

তুমি এক সময়ে দারুণ আড্ডাবাজ ছিলে। কিন্তু ধীরে ধীরে সব ছেড়ে দিলে কেন?

আবার জোর করে একটু হাসে মণীশ, মেজাজটা হারিয়ে গেছে।

কেন হারাল?

বিয়ে করার পর থেকেই কেন যেন বাইরে বাইরে কাটাতে ভাল লাগত না। তখন ফটোগ্রাফির জন্য খুব ঘুরে বেড়াতে হত। একটা ক্লান্তি ছিল। তোমাকে পেয়ে ঘরমুখো হলাম। তারপর নতুন একটা ভাল চাকরি পেয়ে আড্ডাটা ছাড়তে হল। ছেলে-মেয়ে হওয়ার পর আরও সরে এলাম। এরকম সবারই অল্পবিস্তর হয়।

না গো, তুমি বড্ড বেশি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছো! তোমাকে এতখানি ঘরকুননা আড্ডাছাড়া করতে কি আমি চেয়েছিলাম, বলো তো?

একটু অবাক হয়ে মণীশ বলে, তুমি করেছো বলিনি তো! আমার নিজেরই ভাল লাগত না।

কাজটা বোধহয় ভাল করেনি। তোমার একটা বাইরের জগৎ থাকলে বোধহয় ভালই হত।

ম্লান একটু হাসল মণীশ, এই-ই ভাল আছি।

বুবকার জন্য কি তোমার খুব বেশি কষ্ট হয়?

মণীশ মাথা নেড়ে বলে, না, বুবকা বড় হয়ে গেল, এখন তো দূরে সরে যাবেই। ওটা মেনে নিয়েছি। অত ভাবছো কেন?

তোমার মুখখানা যে ভীষণ করুণ দেখায় আজকাল।

ও এমনিই। আমার মনের কোনও ব্যালান্স নেই। এই ভাল, এই খারাপ।

অফিসে কিছু হয়নি তো?

আরে না, অফিসে কী হবে!

তাহলে এমন মেলাঙ্কলিক হয়ে যাচ্ছো কেন? আগে তো ঝুমকি বুবকা আর অনুর সঙ্গে আড্ডা মারতে, মেয়ে দুটো তো আছে।

মণীশ হাসল, হ্যাঁ আছে। তবে ওরা পরভৃৎ। ভাব করে কি হবে! কিছুদিন পরেই তো অন্যের ঘরে পালিয়ে যাবে।

উঃ, তোমাকে নিয়ে আর পারি না। নিজের মেয়ে পরের ঘরে যাবে বলে তো খুব দুঃখ, আর পরের মেয়েকে যে তুলে এনেছে নিজের ঘরে! তার বেলা?

তা বটে। কিন্তু আমি তো জীবনের নিয়ম পাল্টে দিতে চাই না অপু। যা ঘটবার তা ঘটবেই! বুবকা বড় হল, হস্টেলে গেল, এরপর হয়তো বিদেশে চলে যাবে। মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাবে। এসব ঘটনা তো স্থির হয়েই আছে। আমি শুধু একটু গুমরে মরব এই যা!

ইজিচেয়ারের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে অপর্ণা বলল, ওগো ওরকম করতে নেই। তুমি ওরকম করলে আমি যে ভীষণ দুর্বল হয়ে যাই। তুমি আগের মতো একটু হই-চই করলে আমার বুকটা ঠাণ্ডা হবে।

স্তিমিত গলায় মণীশ বলে, আমার ভিতর থেকে হৈ-চৈ ভাবটা উঠে আসছে না অপু। তোমাকে যদি আমার ভিতরটা দেখাতে পারতাম! যেন একটা অন্ধকার ঘর। শব্দ নেই, আলো নেই, কিছু নেই।

ও মা গো! শুনলে বুকটা কেমন করে।

ভয় পেও না। হয়তো একটা ডিপ্রেশন চলছে। ঠিক হয়ে যাবে।

বরং বুবকাকে তাড়াতাড়ি আসতে বলে চিঠি লিখে দিই।

না না, এই তো সামার ভ্যাকেশন কাটিয়ে গেল। ওসব করতে যেও না। বুবকার জন্য নয় অপু। বুবকাও একটা ফ্যাক্টর বটে। কিন্তু আসলে হার্ট অ্যাটাকটাই আমার ভিতরে মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছে। আজকাল কেবল এই বৃথা জীবনযাপনের অর্থটা হাতড়ে বেড়াই, কিছু পাই না।

তোমাকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে এবার ঠিক আমার হার্ট অ্যাটাক হবে। কী করলে তুমি ভাল থাকবে বলো তো?

তা তো জানি না। মাঝে মাঝে মনে হয় বেশ তপোবনের মতো যদি একটা জায়গা খুঁজে পেতাম। শান্ত, পবিত্র, নির্জন, চারদিকে নিবিড় গাছপালা, তাহলে বোধহয় সেখানে গিয়ে থাকতে ভাল লাগত।

সেরকম জায়গা বোধহয় খুঁজলে পাওয়া যাবে। ক’দিন ছুটি নিয়ে চলো ঘুরে আসি।

খুব উৎসাহ দেখাল না মণীশ। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ওরকম জায়গা হয়তো পাওয়া যাবে, কিন্তু গিয়ে হয়তো আমার আর ভাল লাগবে না।

হঠাৎ অপর্ণা বলল, আচ্ছা, আমার মনে পড়ল, চারুশীলার ভাই হেমাঙ্গ এরকমই একটা কোন জায়গায় যেন গিয়ে মাঝে মাঝে থাকে। চারুশীলার সঙ্গে ঝুমকিও একবার গিয়েছিল। সুন্দরবনের দিকে বোধহয়। সে নাকি নদীর ধারে খুব সুন্দর নির্জন একটা জায়গা। দাঁড়াও, ঝুমকিকে ডাকি।

থাক অপু। ওসব পরে হবে। তুমি তোমার গৃহপ্রবেশের কথা কী বলছিলে?

অর্পণা ম্লান হয়ে বলে, আমার গৃহপ্রবেশের কথা তো কেউই শুনতে চাইছে না। বাড়িটা যেন একা আমার। কী সুন্দর দেখতে হয়েছে বাড়িটা! যে দেখছে সেই পছন্দ করছে। চারুশীলার বর সুব্রত নিজে ডিজাইন দেখে দিয়েছে! কত বড় আর্কিটেক্ট! শুধু এবাড়ির কারোরই গাল উঠছে না।

তা নয় অপু। আমার এখন আর জাগতিক কিছুর প্রতিই আকর্ষণ নেই। তোমার বাড়ি খুব সুন্দর হয়েছে সন্দেহ নেই। আমার ভালও লেগেছে। তবে আমার আরও গভীর চিন্তার কারণ ঘটেছে বলেই বাড়িটা নিয়ে ভাববার বা আনন্দ করার মেজাজটা নেই।

সেইজন্যই তো আমার মন খারাপ। তোমার আনন্দ না হলে ও বাড়ি দিয়ে আমার কী হবে? আমার এত পরিশ্রম বৃথা গেল।

মণীশ মৃদুস্বরে বলল, আচ্ছা, আমি কি ইচ্ছে করে ডিপ্রেসড হয়ে আছি? মানুষের জীবনে মাঝে মাঝে এমন তো হতেই পারে যখন সে নিজের মনের সঙ্গে লড়াই করে হেরে যায়।

আমি শুধু কারণটা জানতে চাই।

কারণটা যদি আমিও জানতাম! নিজের মনে পাঁতি পাঁতি করে খুঁজে দেখছি রোজ, বুঝতে পারছি না।

আমার মনে হয়, বুবকার জন্যই।

হতে পারে। তবে কি জাননা, আজকাল আমার একা চুপচাপ থাকতে ভাল লাগে। আমি বরাবর হৈ-চৈ হুল্লোড় ভালবাসি। নির্জনতা বরং সইতে পারতাম না। আজকাল কেন লোনলিনেস ভাল লাগে!

তুমি কি ইনট্রোভার্ট হয়ে যাচ্ছো?

তাও জানি না। কিছুই জানি না। শুধু তোমাকে বলি, প্লীজ, আমাকে নিয়ে অত দুশ্চিন্তা কোরো না।কয়েকদিন যাক, স্পেলটা হয়তো কেটে যাবে।

অপর্ণার দু’চোখ টলটল করছিল জলে, এবার উপচে পড়ল। স্বলিত গলায় বলল, তোমাকে এরকম দেখলে আমার কত কষ্ট হয় তা জানো?

জানি অপু। আমি তো তোমার কাছেই আছি।

কোথায় কাছে আছে! কত দূর মনে হয় তোমাকে তা কি জানো?

তাও জানি। বিয়ার উইথ মি। আমার সঙ্গে এই সময়টা পার করে দাও।

আমার গৃহপ্রবেশের কী হবে?

গৃহপ্রবেশ হতে বাধা কি? হোক।

তুমি পার্টিসিপেট করবে তো?

কেন করব না? শুধু একটা অনুরোধ, অফিস থেকে এ বাড়িটার ভাড়া দিচ্ছে। আপাতত আমরা এ বাড়ি ছাড়ব না। কেমন?

নিজের বাড়ি থাকতে আর পরের বাড়িতে কেন?

এখান থেকে অফিসে যাতায়াতের সুবিধে বেশি। তাছাড়া এ জায়গাটা আমার বেশ ভদ্র বলে মনে হয়।

গৃহপ্রবেশের পর কি বাড়ি তালাবন্ধ পড়ে থাকবে?

তাই থাক না কিছুদিন।

অপর্ণা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তাই থাক।

আজ মেঘলা বৃষ্টির দিনের চাপা অন্ধকারে অপর্ণার সকালটা মাটি হয়ে গেল। সে ধীর পায়ে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। হল পেরিয়ে সামনের বারান্দায় এসে বৃষ্টির দিকে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। তার এখনও কত অপূর্ণ সাধ রয়ে গেছে। বাড়িটা হল, এরপর ছিল বাড়ি সাজানোর পালা। এখনও রং হয়নি ভিতরে। প্লাস্টার অফ প্যারিস দিয়ে পলেস্তারা পড়েছে। ওপরে হবে হাল্কা খুশিয়াল রঙের প্ল্যাস্টিক পেইন্ট। সামনের ঘরে ওয়াল পেপার লাগাবে বলে পছন্দও করে রেখেছিল একটা আরণ্যক দৃশ্য। কী যে চমৎকার হত। নতুন কিছু আসবাব দিয়ে সামনের হলঘরটা ছবির মতো সাজাবে।

কিন্তু কী হবে আর? যাকে নিয়ে, যাকে ঘিরে তার জীবনের সব সাধ-আহ্লাদ, সে কেন এরকম মনমরা হয়ে যাচ্ছে?

কী হয়েছে মা? এনিথিং রং? কাঁদছে নাকি?

অপর্ণা ফিরে অনুকে একটু দেখল। অনু আর ছোটোটি নেই। তার কাঁধ ছাড়িয়ে উঠছে। লকলক করছে বয়স। ওদের আর ভুলিয়ে রাখা যায় কি?

অপর্ণা চোখ মুছল। ধরা গলায় বলল, বাপির কাছে যা। কথা বলিস না। কাছে বসে থাক। মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দে, যা।

অনু একটু চিন্তা করল যেন। তারপর বলল, বাপি ইজ ব্রুর্ডিং। ভেরি মাচ ইন এ ট্রান্স। বাপিকে ডিস্টার্ব কেন করবো মা?

তোর বাবার কী যে হয়েছে বুঝতে পারছি না।

বোধহয় হি ইজ মিসিং দাদা ভেরি মাচ।

তাই তো ভাবছি। কিন্তু এতটা কি স্বাভাবিক? ছ’ মাসের বেশীই তো হয়ে গেল। এখনও কেন মিস করবে?

বাবা যে দাদাকে ভীষণ ভালবাসে। কিন্তু তুমি এত আপসেট কেন মা? হোয়াই ইউ?

আমার ভাল লাগছে না। গৃহপ্রবেশে কত আনন্দ হবে বলে ভেবেছিলাম। কিছু করতে ইচ্ছে করছে না।

অনু বেশ সুন্দরী। ফরসা, স্বাস্থ্য বেশ চমৎকার, মুখখানা চটক-সুন্দর। ঝুমকির সৌন্দর্য অন্যরকম। সে রোগার দিকে, লাবণ্যই বেশী। তাকে চোখে পড়ে না, কিন্তু একটু তাকিয়ে থাকলে ঝুমকি যে কত সুন্দর তা বোঝা যায়। অনু চট করে চোখে পড়ে। নিচের ঠোঁটটা ঝকঝকে সুন্দর দাঁতে একটু কামড়ে ধরে সে বলল, আচ্ছা আমি বাপির কাছে যাচ্ছি।

শোন, বেশি কথা বলিসনি।

আচ্ছা মা। আমি আজকাল বাপিকে অন্য ধরনের কম্প্যানি দিই। কবিতা শোনাই, শেক্সপীয়র শোনাই, বিটোফেন শোনাই। বুঝেছো?

বুঝেছি, তুমি তো পাকা মেয়ে।

ঠিক কথা। আমি ম্যাচিওরড।

শোন, বরং এক কাপ কফি করে নিয়ে যা। তোর বাবা এসময়ে একটু কফি খায় ছুটির দিনে। আজ বৃষ্টিও হচ্ছে।

ঠিক আছে।

ঝুমকি উঠেছে?

কখন! শী ইজ অলসসা ব্রুডিং।

কেন?

আজকাল দিদিও তো চুপচাপ মা। অল অফ ইউ আর কিপিং মাম।

অনু চলে যাওয়ার পর আরও কিছুক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখল অপর্ণা। তারপর হলঘর পেরিয়ে এল ঝুমকির ঘরে।

ঝুমকি এই সাতসকালে একটা মোটা বই খুলে পাশে রেখে টেবিলে খাতা খুলে কী লিখছে।

কী করছিস?

ঝুমকি তার ঠাণ্ডা হাসি হেসে বলল, একটু কাজ।

কিসের কাজ?

একটা প্রোগ্রামিং। যা শিখেছিলাম সব প্র্যাকটিসের অভাবে ভুলে যাচ্ছি।

তোর বাবা এত চুপচাপ হয়ে গেছে যে আমার মনটা ভাল নেই।

ঝুমকি একটু অবাক হয়ে বলল, ঠিক বলেছো তো মা! বাবা আগের মতো আমাদের সঙ্গে ঠাট্টা-ইয়ার্কিও করছে না আজকাল, তাই না?

এতদিনে সেটা টের পেলি?

ঝুমকি একটু লজ্জা পেয়ে বলে, আমি ভাবছিলাম, বুবকার জন্য বোধহয় মন খারাপ।

যদি তাই হয় তবে কি আমাদের উচিত হবে না লোকটাকে একটু আনন্দের মধ্যে রাখা।

সে তো ঠিক কথা। আচ্ছা, আমি বাবার কাছে যাচ্ছি।

এখন দরকার নেই। অনুকে পাঠিয়েছি। এখন আবার তুই গেলে ভাববে আমিই দুজনকে পাঠিয়েছি।

তাহলে থাক। আমি বরং পরে যাবো। বাবাকে নিয়ে তুমি কি খুব চিন্তায় পড়েছো?

পড়ব না?

অত চিন্তা করো না, আমার বাবা একজন কারেজিয়াস সেলফ্‌-মেড ম্যান। একটু সেন্টিমেন্টাল আছে, কিন্তু আমার বাবা সহজে কাবু হওয়ার লোক নয়।

অপর্ণা মেয়ের দিকে একটু চেয়ে থেকে বলে, আমার সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল একটা ট্রামের মধ্যে। সামনে একটা রক্তমাখা লাশ পড়ে আছে, তখনও ভাল করে মরেনি। ভয়ে কাঠ হয়ে আছি। অধচৈতন্য। তোর বাবা ক্যামেরা ঝুলিয়ে উঠে এল। পটাপট ছবি তুলল, তারপর আমাকে দেখে খুব অবাক হয়ে কী যেন বলল। আমি জবাবও দিতে পারিনি। তখন আমাকে হাত ধরে টেনে নামিয়ে আনল। চারদিকে কাঁদানে গ্যাস, গুলি। এসপ্ল্যানেড ইস্টে পুলিশ লাঠিচার্জ করছে। কী সাহস ছিল লোকটার!

গল্পটা তারা বহুবার শুনেছে। ঝুমকি বলল, ছিল নয় মা, আমার বাবা এখনও সাহসী। বাবার মতো এরকম পুরুষ দেখাই যায় না। বাবা এই ফেজটা কাটিয়ে উঠবে।

তোমরা দুই বোন বাবাকে একটু সঙ্গ দিও। ছেলের জন্য তাহলে আর ততটা মন খারাপ করবে না।

আচ্ছা মা।

হ্যাঁ রে, হেমাঙ্গবাবুর একটা বাড়ি আছে না কোন গ্রামে যেন!

ঝুমকি হঠাৎ যেন একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। তারপর বলল, হ্যাঁ, নিশিপুর।

তুই একবার গিয়েছিলি না চারুশীলার সঙ্গে?

হ্যাঁ তো।

তোর বাবাকে সেখানে কয়েকদিন রাখা যায়?

ঝুমকি একটু ভেবে বলল, তার কি দরকার আছে মা?

কথাটার জবাব আগে দে। উল্টে প্রশ্ন করছিস কেন?

রাগ করলে?

তোর বাবা একটা নির্জন জায়গা চাইছে।

ঝুমকি ইতস্তত করে বলে, বলে দেখা যায়। হেমাঙ্গবাবু প্রতি উইক-এণ্ডে সেখানে চলে যান বলেই শুনেছি।

এক সপ্তাহ যদি আমি আর তোর বাবা গিয়ে সেখানে থাকতে চাই তাহলে রাজি হবে হেমাঙ্গ?

তা হবে বোধহয়।

একটু বলে দেখ না। হেমাঙ্গ তো চমৎকার মানুষ। যেমন বিনয়ী, তেমনি ভদ্রতাবোধ, ওর বাড়িতে ফোন আছে, ফোন করে দেখবি?

আজ রবিবার। বোধহয় আজ সেখানেই গেছে।

দেখ না একবার! যা বৃষ্টি হচ্ছে কদিন। হয়তো যায়নি।

নম্বর দিচ্ছি, লাইনও না হয় ধরে দিচ্ছি, তুমিই কথা বলো মা।

আমি! আমার সঙ্গে তো ততটা পরিচয় নেই। একটু আলাপ।

ঝুমকি ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলে, আমার বড় লজ্জা করছে মা। গুছিয়ে বলতে পারব না।

ওমা! মেয়ের লজ্জা দেখ। যখন চাকরি করতে গিয়েছিলি তখন এ লজ্জা কোথায় ছিল? দুটো মাত্র কথা জিজ্ঞেস করবি, অত লজ্জার কী?

ঝুমকি কাতর গলায় বলে, প্লীজ মা। আচ্ছা, আমি না হয় চারুমাসীকে দিয়ে বলিয়ে দিচ্ছি।

তবু নিজে বলবি না? ঠিক আছে, চারুকেই বল। সেটাই ভাল হবে বোধহয়।

ঝুমকি উঠল এবং চারুশীলার নম্বর ডায়াল করল।

তার গলা শুনেই চারুশীলা চেঁচিয়ে উঠল, এই ঝুমকি! শীগগির চলে আয়। আজ শাহী পোলাও করা হচ্ছে। সঙ্গে আলু মটর আর মুগীর দোপেঁয়াজা। আসবি?

না মাসী। এ বৃষ্টিতে বেরোলে মরে যাবো।

আচ্ছা বাবা, গাড়ি পাঠাচ্ছি।

ঝুমকি হাসল, ফের বাড়াবাড়ি শুরু করেছ! তুমি কি একটুও একা থাকতে পারো না?

একা কী রে? জয়েন দ্য ক্রাউড। আমার বাড়িতে এই বৃষ্টিতেও কারা আজ এসেছে জানিস?

কারা?

রিয়া উইথ চিলড্রেন, মলয় নামে সুব্রতর এক বন্ধু উইথ ফ্যামিলি অ্যাণ্ড দেয়ার ইজ অ্যানাদার পারসন। গেস হু?

কি জানি বাবা।

দূর বোকা! পারলি না? হেমাঙ্গ! দ্যাট গ্রেট সন্ন্যাসী ব্রাদার অফ মাইন। চলে আয়।

শোনো মাসী, আমার একটা কাজ করে দেবে?

কি কাজ রে?

আমার মা আর বাবা এক সপ্তাহের জন্য একটা আউটিং-এ যেতে চায়। হেমাঙ্গবাবুর সেই নিশিপুরের বাড়িটায় ওদের ব্যবস্থা করে দিতে পারবে?

ধুস! এটা একটা কাজ হল?

দাও না তাহলে বলে।

তুই নিজেই বল না। ঐ তো হেমাঙ্গ ক্যারম খেলছে।

না মাসী। আমার লজ্জা করছে।

আচ্ছা তাহলে বলছি। কিন্তু কণ্ডিশন আছে।

কী কণ্ডিশন?

গাড়ি পাঠাচ্ছি, চলে আয়। এ বাড়িতে আসতে তো তোর নেমন্তন্নের দরকার নেই।

না, আজ থাক।

অবজেকশন ওভাররুলড্‌। গাড়ি যাচ্ছে। পাঁচ মিনিটে তৈরি হয়ে নে।

আচ্ছা বাবা, গাড়ি লাগবে না। দু’ মিনিটের তো হাঁটাপথ। আমিই যাচ্ছি।

না বাবা, তোর ঠাণ্ডার ধাত। ভিজলে আবার গণ্ডগোল হবে। গাড়ি তো বসেই আছে। তৈরি হয়ে নে।

ফোনটা রেখে মায়ের দিকে চেয়ে ঝুমকি বলল, হল তো! ফোন করে ফ্যাসাদ ডেকে আনলাম। এখন ও বাড়িতে যেতে হবে।

হেমাঙ্গর বাড়িটা পাওয়া যাবে?

তা যাবে। কিন্তু এখন আমাকে তৈরি হতে হবে যে! নেমন্তন্ন।

তা যা না। চার বড় ভাল মেয়ে।

ঝুমকি তৈরি হচ্ছিল। বুক কাঁপছে। গলা শুকোচ্ছে। সে নিজের কাছে ধরা পড়ে গেছে অনেক দিন। মনে মনে অনেক লড়াই করেছে। হেরে গেছে। কী করবে ঝুমকি? তার যে কিছুই করার নেই।

প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে সদরে একটা গাড়ি এসে থামল। দরজা খোলা ও বন্ধের শব্দ হল। তারপরই ডোরবেল।

দরজা খুলে অপর্ণা একটু অপ্রতিভ। সামনে এক গাল হাসি নিয়ে হেমাঙ্গ দাঁড়িয়ে।

আরে, আপনি এসেছেন! আসুন।

গায়ের পাতলা বর্ষাতিটা খুলে হেমাঙ্গ ঘরে ঢুকে বলল, মণীশবাবু কোথায়?

বসুন, ডাকছি।

মণীশ এল। প্রসন্ন মুখে বলল, কী খবর?

আপনাকে আমার গাঁয়ের বাড়িতে নেমন্তন্ন করতে এলাম। কবে যাবেন বলুন!

মণীশ অপ্রস্তুত, বলল, যাবোখন। তাড়া কি?

না, আমার তাড়া আছে। আমি আমার বাড়িটা কয়েকজন সজ্জনকে দেখাতে চাই।

মণীশ হাসল।

অপর্ণা বলল, হেমাঙ্গবাবুর বাড়িটা নাকি খুব সুন্দর জায়গায়। চলোই না কয়েকদিন বেড়িয়ে আসি।

মণীশ মাথা নেড়ে বলল, ছুটি নেই যে।

ছুই দরকার নেই। চাকরি যাবে না। চলো।

ভিতরের ঘরে ঝুমকি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। চারুমাসীটা যে কী? ওকেই পাঠাল কেন নিতে? ঝুমকির বুঝি লজ্জা করে না?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *