দশম সর্গ
এইভাবে তারা বিনয়ের সঙ্গে অনুতপ্ত চিত্তে দাঁড়িয়ে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করে যেতে লাগল। ক্রমে স্বর্গের ঊর্ধ্বলোকে বিরাজিত ঈশ্বরের আসন থেকে এক মহিমা তাদের অনুতাপে বিচলিত হয়ে নেমে এসে তাদের অন্তর হতে প্রস্তরকঠিন উপাদানটিকে অপসারিত করে সেখানে এক মেদুর মাংসল নূতন উপাদান ভরে দিল। এক অব্যক্ত বেদনা ও প্রার্থনা সমন্বিত তাদের অনুচ্চারিত দীর্ঘশ্বাস উচ্চকণ্ঠের বাগ্মিতার থেকেও দ্রুতগতিতে যেন পাখা মেলে উড়ে গেল স্বর্গলোকে। অতীতে পুরাণপুরুষ নোয়া ও তার স্ত্রী পইরা বিচারের দেবী থেমিসের বেদীর সামনে দাঁড়িয়ে সারা জগদ্ব্যাপী মহাপ্লাবনের কবল থেকে মানবজাতিকে উদ্ধার করার জন্য যে কাতর আবেদন জানিয়েছিল, আদম ও ঈভের আবেদন তাদের সেই আবেদনের থেকে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না।
আদম ও ঈভের সেই প্রার্থনা প্রতিকূল বাতাসের দ্বারা কোনভাবে বিঘ্নিত বা প্রতিহত না হয়ে, পথ ভুল না করে অভ্রান্ত অপ্রতিহত গতিতে স্বর্গলোকে উঠে গেল। নিরাবয়ব নিরালম্ব সেই প্রার্থনার অমূর্ত ধ্বনি অনায়াসে স্বর্গদ্বারে প্রবেশ করে ধূণাবাসিত ঈশ্বরের স্বৰ্গবেদীতে গিয়ে পুঞ্জীভূত হয়ে রইল।
পরম পিতার সিংহাসনের সম্মুখে বিরাজিত ঈশ্বরপুত্র তা দেখে মানবজাতির পরিত্রাতা হিসাবে বলতে লাগলেন, দেখ পিতা, মানবজাতির মধ্যে তুমি তোমার যে অনুগ্রহের বৃক্ষরোপণ করেছিলে পৃথিবীতে, সেই বৃক্ষ হতে প্রথম ফল ফলেছে। তাদের দীর্ঘশ্বাস ও প্রার্থনা এখানে এসে ধূপের গন্ধের সঙ্গে মিশ্রিত হয়েছে, আমি পুরোহিতের মতো তা তোমার সামনে উপস্থাপিত করেছি। তাদের অন্তরে তোমার হাতে বপন করা অনুতাপের বিশুদ্ধ বীজ হতে যে উপাদেয় ফল উৎপন্ন হয়েছে, তাদের পতনের আগে তাদের হাতে সার দেওয়া বর্ধিত স্বর্গোদ্যানের সব গাছগুলি একসঙ্গে মিলিত হয়েও সে ফল উৎপন্ন করতে পারত না।
এখন তাদের প্রার্থনা ও আবেদনের কথা শোন। তাদের ভাষাহীন দীর্ঘশ্বাসের মধ্যে অব্যক্ত অনুচ্চারিত বেদনার কথা বোঝ। আমি তার ভাষা বুঝিয়ে দিচ্ছি। আমিই। তাদের প্রবক্তা ও পরিত্রাতা। তাদের সকল কাজ আমারই গুণের দ্বারা পূর্ণতা লাভ করবে। তাদের পাপজনিত সকল ক্ষতি মৃত্যুর মধ্য দিয়ে পূরণ করে দেব আমি।
আমার কথা শোন। আমার মধ্য দিয়ে তাদের প্রেরিত সুবাসিত শান্তির আবেদন গ্রহণ করো। তোমার সঙ্গে পুনর্মিলিত হয়ে তারা জীবন-যাপন করুক। তাদের জীবন সীমাবদ্ধ। জীবনের দিনগুলি গোণা। মৃত্যু না আসা পর্যন্ত এমন একটি স্থানে তাদের উন্নত জীবন-যাপনের ব্যবস্থা করে দাও যেখানে আমার সমস্ত পাপমুক্ত মানবাত্মারা। বাস করতে পারে। তাদের পরম সুখ মূর্ত হয়ে উঠবে আমার মধ্যে। অনাবিল সুখ আর আমি অভিন্ন হয়ে উঠব।
তখন পরম পিতা বললেন, মানবজাতির জন্য তুমি যে সব অনুরোধ আমায় করেছ তা সবই আমি রক্ষা করব একে একে। এটাই আমার বিধান। কিন্তু মানুষ আর স্বর্গোদ্যানে বাস করতে পারবে না। প্রকৃতিকে যে নিয়মের বিধান দান করেছি তাতে তার আর স্থান হবে না সেখানে।
প্রকৃতিজগতের সব বস্তুই পবিত্র এবং শাশ্বত। কিন্তু মানুষ পাপকর্মে লিপ্ত হয়ে কলুষিত হয়ে পড়ায় পচনশীল দূষিত খাদ্যের মতোই প্রকৃতি তাকে প্রত্যাখ্যান করবে। মানুষ থাকলে তার কলুষিত সংসর্গে প্রকৃতির উপাদানগুলিও দূষিত হয়ে পড়বে। মানুষ সৃষ্টি করার সময় পরম অনন্তসুখ আর অমরত্ব এই দুটি দানে ভূষিত করি আমি তাকে। এই দুটি দান হারিয়ে ফেলায় তারা মৃত্যু আর অন্তহীন দুঃখের অধিকারী হয়েছে। মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত দুঃখভোগ করে যেতে হবে তাদের। একমাত্র মৃত্যুতেই তাদের সকল দুঃখের শেষ।
কঠোর দুঃখকষ্টের মহাপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ঈশ্বরবিশ্বাস, ন্যায় ও ধর্মলাভ প্রভৃতি সৎকর্ম করে সারাজীবন যাপন করলে তাদের মধ্যে সত্যোপলব্ধি জাগবে এবং মৃত্যুর পর তারা দ্বিতীয় জীবন লাভ করবে। তখন তারা স্বর্গগমন করবে। পৃথিবী নূতন হয়ে উঠবে।
এখন স্বর্গে এক সভা আহ্বান করো। আমি আমার বিচারের কথা সকলকে বলব। এখন দেবদূতরা গিয়ে দেখবে তারা কি করছে এবং কি অবস্থায় আছে। তাই দেখে আমি মানবজাতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করব।
এই বলে ঈশ্বর চুপ করতেই ঈশ্বরপুত্র ভেরী বাজিয়ে সংকেত দান করলেন। তখন দেবদূতেরা এসে সমবেত হলো। তারা এসে জীবননদীর ধারে ছায়াচ্ছন্ন স্থানগুলিতে উপবেশন করলে সর্বশক্তিমান ঈশ্বর তাঁর সিংহাসন হতে বলতে শুরু করলেন, হে আমার পুত্রগণ, মানুষ সেই নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণ করার পর থেকে আমাদের মতোই ভাল-মন্দের জ্ঞান লাভ করেছে। কিন্তু শুধু ‘ভাল’র জ্ঞানের বড়াই করতে গিয়ে সে জ্ঞান হারিয়ে শুধু মন্দের জ্ঞান লাভ করেছে। সব কিছুর মধ্যে তাই শুধু মন্দ দেখছে। কিন্তু ভালর জ্ঞান লাভ করলে তারা সুখী হত।
এখন তারা কৃতকর্মের জন্য দুঃখবোধ করছে। অনুশোচনা করছে, অনুতপ্ত চিত্তে আমার প্রার্থনা করছে। এইভাবে বিভিন্ন রকমে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে। কিন্তু আমি মানুষের অন্তরের অবস্থা ও প্রকৃতির কথা জানি। তাদের অন্তর-প্রকৃতি বড়ই পরিবর্তনশীল, বড়ই ক্ষণভঙ্গুর। তাদের স্বাধীন ইচ্ছার দ্বারা তা নিয়ন্ত্রিত হয়। আমি ভাবছি জ্ঞানবৃক্ষের ফল ভক্ষণ করার পর পাছে তাদের সাহস বেড়ে যায় এবং তারা তাদের দুঃসাহসী হস্ত প্রসারিত করে জীবনবৃক্ষের ফল ভক্ষণ করে চিরজীবি হয়ে ওঠে অথবা চিরকাল বাঁচার স্বপ্ন দেখে তার জন্য সেখান থেকে তাদের অপসারিত করার বিধান দিচ্ছি। স্বর্গোদ্যান ইডেন থেকে তাদের সরিয়ে নিয়ে গিয়ে সেই জায়গায় নিয়ে যাও যেখানে তারা ভূমি কর্ষণ করে জীবিকা অর্জন করবে। সেটাই হবে তাদের বসবাসের উপযুক্ত জায়গা।
মাইকেল, তোমাকেই এ কাজের ভার নিতে হবে। তুমি চেরাবিম জাতীয় দেবদূতদের মধ্য হতে তোমার পছন্দমত দেবসেনাদের নিয়ে যাও। কারণ শয়তান আবার মানবজাতির পক্ষ হয়ে খালি জায়গা দেখে সেই স্থান দখল করতে এলে গোলমাল বাধাতে পারে।
সুতরাং তাড়াতাড়ি চলে যাও। ঈশ্বরনির্মিত সেই স্বর্গোদ্যান হতে দ্বিধাহীনভাবে সেই পাপিষ্ঠ দম্পতিকে বিতাড়িত করো। সেই পবিত্র স্থানে তাদের মত অপবিত্র চরিত্রের লোকের আর স্থান হবে না। মানবজাতি ও তাদের ভবিষ্যৎ বংশধরগণ চিরতরে সেই স্বর্গোদ্যান হতে নির্বাসিত হলো একথা ঘোষণা করবে তুমি। যেহেতু এখন তারা অনবরত চোখের জল ফেলে অনুতাপ করছে তাদের কৃতকর্মের জন্য, তাই তারা যাতে এই দুঃখজনক দণ্ডাজ্ঞা শুনে মূৰ্ছিত না হয়ে পড়ে দুঃখে তাই মুখে কোন রাগ বা ভয়ের ভাব দেখাবে না।
যদি ধীরে ও শান্তভাবে তারা তোমার আদেশ মেনে নেয় তাহলে দুঃখ দেবে তাদের মনে। আমি যেভাবে বলতে বলব তুমি সেইভাবে আদমের ভবিষ্যৎ জীবনে কি কি ঘটবে তা তাকে বলে দেবে। আমার নিষেধাজ্ঞা বা বিধান ঈভের গর্ভজাত সন্তানদের উপরেও বর্তাবে।
এইভাবে বুঝিয়ে তাদের পাঠিয়ে দেবে। তাদের মনে দুঃখ থাকলেও তারা যেন শান্তিতে যায়। ইডেনের পূর্বদিকে যেখানে উদ্যানের মধ্যে প্রবেশ করা সবচেয়ে সহজ সেখানে চেরাবজাতীয় দেবদূতেরা প্রহরায় নিযুক্ত থাকবে। তারা জ্বলন্ত তরবারি ঘুরিয়ে দূরের অবৈধ প্রবেশকারীদের সন্ত্রস্ত করে তুলবে। জীবনবৃক্ষের কাছে যাবার পথে পাহারা থাকবে যাতে কোন দুষ্ট আত্মা উদ্যানে প্রবেশ করে আমার সব গাছগুলিকে তাদের শিকারের বস্তু করে তুলতে না পারে। মানুষ যেন আবার নিষিদ্ধ ফল চুরি করে খেয়ে ভ্রান্ত না হয়।
তার সব কথা বলে থামলেন ঈশ্বর। তখন প্রধান দেবদূত চেরাবজাতীয় প্রহরী দেবদূত সেনাদের নিয়ে স্বর্গ হতে মর্ত্যে অবতরণের জন্য প্রস্তুত হলো। সেই সব প্রহরী দেবদূতদের প্রত্যেকের চারটি ঋতুস্বরূপ চারটি মুখবিশিষ্ট রোমক দেবতা জেনাসের মত চারটি করে মুখ ছিল। তাদের দেহের মধ্যে আইওর উপর প্রহরায় নিযুক্ত শতচক্ষুবিশিষ্ট আর্গাসের মত অসংখ্য উজ্জ্বল চক্ষু ছিল।
এদিকে শিশিরসিক্ত শান্ত স্নিগ্ধ মর্ত্যভূমিতে প্রভাতকালে জেগে উঠে প্রথমে তাদের প্রার্থনা সারল আদম। ঊর্ধ্বলোক হতে এক শক্তি নেমে এসে সঞ্চারিত হলো তাদের মনে। গম্ভীর হতাশা থেকে এক অভিনব আশা ও আনন্দ উদ্ভুত হলো। তবু তাদের মন থেকে এক অজানিত আশঙ্কা বিদূরিত হলো।
আদম তখন ঈভকে সম্বোধন করে বলল, ঈভ, আমার বিশ্বাস ঈশ্বরের অনুগ্রহে মর্ত্যলোকের যে সব শুভ বস্তু উপভোগ করি তা সব নেমে আসছে আমাদের জন্য। কিন্তু সেই ভোগ্যবস্তুর জন্য আমাদের পক্ষ থেকে উপযুক্ত কৃতজ্ঞতা ও ভক্তি ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করা উচিত যাতে ঈশ্বরের আশীর্বাদ ও শুভেচ্ছা আমরা লাভ করতে পারি। শুধু ভক্তি ও কৃতজ্ঞতা নয়, এর জন্য আমাদের দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে আমাদের ভক্তিবিনম্র প্রার্থনা তার উদ্দেশ্যে যথাযথভাবে উচ্চারিত হওয়া উচিত।
আমি যখন থেকে নতজানু হয়ে আমার অখণ্ড একনিষ্ঠ অন্তর হতে স্বতোৎসারিত প্রার্থনার দ্বারা রুষ্ট দেবতাকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করেছি তখন থেকেই মনে হয়েছে আমি যেন আমার চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি ঈশ্বর শান্ত হয়ে উৎকর্ণ হয়ে আমার– প্রার্থনা শুনছেন। আমার মনে হয়েছে, আমি তার অনুগ্রহবাক্য শুনতে পাচ্ছি। আমার। অশান্ত বুকে তখন শান্তি নেমে এসেছে। তোমার সন্তান-সন্ততিরা আমাদের শত্রুর মাথায় আঘাত করবে–ঈশ্বরের এই প্রতিশ্রুতিবাক্য স্মরণপথে উদিত হয়েছে আমার।
তখন ভয়ে একথা মনে স্থান পায়নি আমার। কিন্তু এখন বুঝছি এবং এই ভেবে আশ্বস্ত হচ্ছি যে মৃত্যুর ভয়াল তিক্ততা এখন অতিক্রান্ত এবং আমরা বেঁচে থাকব। এখন তোমাকে সম্ভাষণ জানাই। সত্যিই তুমি মানবজাতির আদি মাতা। তোমার জন্যই মানবজাতি বেঁচে থাকবে।
ঈভ কিন্তু একথায় উৎফুল্ল না হয়ে বিষণ্ণভাবে বলতে লাগল, আমার মত এক বিধির বিধান লঙ্ঘনকারিণী কখনই এ নাম এ উপাধির যোগ্য নয়। যে তোমার ভাল করতে গিয়ে তোমার ফাঁদে পরিণত হয়, ভর্ৎসনা, অবিশ্বাস এবং নিন্দাই তার প্রাপ্য।
কিন্তু অনন্ত ক্ষমাগুণসম্পন্ন পরম করুণাময় বিচারক এই বিধান দেন যে, যে সমগ্র মানবজাতির উপর মৃত্যুর খঙ্গকে ঝুলিয়ে দিয়েছে সে-ই হবে সমস্ত মানব জীবনের উৎস। আর তুমিও তাই আমাকে অন্য নামের পরিবর্তে আদি মানবমাতার উপাধিতে ভূষিত করলে।
সে যাই হোক, মাঠের শ্রমশীল কাজ আমাদের ডাকছে। আমরা গতকাল বিনিদ্র রাত্রি যাপন করলেও প্রভাতকাল উপস্থিত হয়েছে। আমরা নৈশ বিশ্রামলাভে বঞ্চিত হলেও এই প্রভাত তার হাস্যোজ্জ্বল গোলাপী আলোর ছটা বিকীর্ণ করে এগিয়ে চলেছে। এখন থেকে সারাদিন আমরা যেখানেই কাজ করি না কেন, তোমার কাছ ছেড়ে আর কোথাও যাব না আমি। আমরা একসঙ্গে কাজ করে একসঙ্গে হেঁটে যে আনন্দ পাই তাতে কোন শ্রমই কষ্টকর মনে হবে না আমাদের। আমাদের পতন সত্ত্বেও এই দুরবস্থার মধ্যে পতিত হলেও আমরা পরস্পরকে ভালবাসি–এটা আমাদের পরম তৃপ্তি ও আনন্দের কথা।
বিনয়ের সঙ্গে এই কথাগুলি বলল ঈভ। কিন্তু তাদের নিয়তি এ কথায় সায় দিল না। প্রথমে প্রকৃতিজগতে কয়েকটি লক্ষণ দেখা গেল। ক্রমে পশু, পাখি ও বাতাসের উপর তার প্রতিক্রিয়া দেখা গেল। সকালের কিছু পরেই বাতাস স্তব্ধ হয়ে। গেল। আকাশ অন্ধকার হয়ে উঠল।
ঈভের চোখের সামনে জোতের পাখি সুন্দর আকাশ থেকে নেমে আসতে লাগল। আদমের সামনে দিয়ে উজ্জ্বল পালকবিশিষ্ট দুটি পাখি উড়ে গেল। যে পশু বনের মাঝে হিংসা ভুলে থাকত সেই পশু বনের সবচেয়ে এক শান্ত প্রাণীকে শিকারীর মত তাড়া করে পূর্বদিকে ছুটে গেল। তা দেখে আদম কোনরূপ বিচলিত না হয়েই ঈভকে বলল, শোন ঈভ, আমাদের ভাগ্যের উপর কোন এক নূতন পরিবর্তন আসন্ন। ঈশ্বর হয়ত প্রকৃতিজগতের কয়েকটি নিরুচ্চার নীরব লক্ষণের মাধ্যমে তাঁর উদ্দেশ্যের কথা পরিব্যক্ত করছেন। তিনি হয়ত শাস্তি থেকে আমাদের অব্যাহতি দিতে চান এবং এ বিষয়ে সতর্ক করে দিতে চাইছেন আমাদের। কারণ এভাবে আর কতদিন আমাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরী না হয়ে দীর্ঘায়িত হবে, কতদিন আমাদের জীবন মাটিতে মিশে না গিয়ে এইভাবে প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুভয়ে শঙ্কিত হয়ে থাকবে?
কেন আমরা একই সঙ্গে একই সময়ে দুটি করে বস্তু দেখছি? দেখছি দুটি করে পাখি আর পশু? বেলা দ্বিপ্রহর না হতেই পূর্বদিকে অন্ধকার নেমে আসছে কেন আর পশ্চিম দিকের নীল আকাশে প্রভাতের আলো উজ্জ্বলতর ও শুভ্রতর দেখাচ্ছে কেন? মনে হচ্ছে এক শুভ্র মেঘের আকারে এক স্বর্গীয় জ্যোতিপুঞ্জ নেমে আসছে।
আদমের দেখতে সত্যিই ভুল হয়নি। কারণ তখন সত্যিই স্বর্গ থেকে দেবদূতের দল মর্ত্যলোক অভিমুখে নেমে আসছিল। তারা প্রথমে একটি পাহাড়ের উপর নামল। সংশয় আর শঙ্কায় আদমের চোখের দৃষ্টি আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল বলে সেই দেবদূতদের দেখতে পেল না আম।
প্রধান দেবদূত মাইকেল এবার তার সহকারীদের স্বর্গোদ্যানের দখল নেবার জন্য পাঠিয়ে দিয়ে নিজে একা আদম কোথায় তা দেখতে লাগল।
আদম তাকে দেখতে পেয়ে এবং সেই দেবদূত-অতিথিকে সেদিকে আসতে দেখে ঈভকে বলল, ঈভ, স্বর্গ থেকে কোন বড় খবর আসছে আমাদের জন্য। হয়ত ঈশ্বর কোন নৃতন বিধান জারি করেছেন। কারণ আমি দেখতে পাচ্ছি শুভদ্রাজ্জ্বল যে মেঘখণ্ডটি এতক্ষণ ঐ নিকটবর্তী পাহাড়টিকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল সেই মেঘখণ্ড হতে একজন স্বর্গীয় দেবসেনা বেরিয়ে আসছেন। তাকে দেখে কোন নিম্নস্তরের দেবদূত বলে মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে ঈশ্বরের কোন উচ্চপদমর্যাদাসম্পন্ন প্রতিনিধি। তবে তার আকৃতির মধ্যে ভয়ঙ্কর কিছু নেই যাতে আমি ভয় করতে পারি। আবার রাফায়েলের মত তিনি শান্ত বা সামাজিক নন, যাঁকে আমি খুব অন্তরঙ্গ বলে ভাবতে পারি। তিনি গম্ভীর এবং মহান যাতে তিনি আমার উপর রুষ্ট না হন তার জন্য এগিয়ে গিয়ে আমি শ্রদ্ধাবনত চিত্তে সাক্ষাৎ করি তাঁর সঙ্গে। তুমি এখন যাও।
আদমের কথা শেষ হতেই প্রধান দেবদূত মাইকেল তার কাছে এগিয়ে এল। তবে অলৌকিক কোন দৈব রূপ ধারণ করে নয়, মানুষের রূপেই দেখা করতে এল মানুষের সঙ্গে। তার বাহুর উপর দিকে ছিল প্রাচীনকালের রাজারাজড়া ও বীরপুরুষদের দ্বারা পরিহিত এক সামরিক অলঙ্কার। সেলিবিয়ার লোকদের দ্বারা পরিহিত নীল সামরিক অলঙ্কার থেকেও উজ্জ্বল ছিল মাইকেলের সে অলঙ্কার। তার নক্ষত্রখচিত শিরস্ত্রাণটি মাথা থেকে খুলতেই দেখা গেল যৌবনকাল শেষ হয়ে গেলেও অনন্ত অফুরন্ত যৌবন বিরাজ করছে। তার কটিদেশে একটি তরবারি আর হাতে ছিল একটি বর্শা।
আদম নত হয়ে অভিবাদন জানাল মাইকেলকে। কিন্তু তার পদমর্যাদা ক্ষুণ্ণ হবার ভয়ে কিছুই বলল না সে বা হাবভাবেও কিছু প্রকাশ করল না।
মাইকেল এবার তার আসার কারণ কোন ভূমিকা না করেই ব্যক্ত করল। সে বলল, ঈশ্বরের বিধান প্রকাশ করতে কোন ভূমিকার দরকার হয় না। তোমাদের প্রার্থনা ঈশ্বর শুনেছেন। যার ফলে তোমরা তাঁর বিধি লঙ্ঘন করার পর অনেক দিন কেটে গেলেও মৃত্যু তোমাদের গ্রাস করতে পারেনি। ইতিমধ্যে তোমরা অনেক অনুতাপ ভোগ করেছ। অনেক সময় অনেক সৎকর্মের দ্বারা একটি পাপকর্মের গুরুত্ব লঘু হয়ে যায়। ঈশ্বর তাই সন্তুষ্ট হয়ে মৃত্যুদণ্ড হতে তোমাদের মুক্তি দিয়েছেন। কিন্তু তিনি তোমাদের আর এই স্বর্গোদ্যানে বাস করার অনুমতি দেবেন না। তোমাদের এখানে থেকে স্থানান্তরিত করার জন্য আমি এসেছি। তোমাদের এখান থেকে সেই ভূমি কর্ষণের জন্য পাঠানো হবে যেখান থেকে উদ্ভূত হয়েছ তোমরা।
আর কিছু বলল না মাইকেল। কারণ এই সংবাদ শোনার সঙ্গে সঙ্গে মর্মাহত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল আদম। তার সমস্ত ইন্দ্রিয় অভিভূত হয়ে পড়ল। ঈভ একটু দূরে থাকলেও একথা শুনতে পেল।
ঈভ তখন বিলাপ করতে লাগল, ওঃ কি অপ্রত্যাশিত আঘাত! এ আঘাত মৃত্যুর থেকেও ভয়ঙ্কর। আমাকে কি এই সাধের স্বর্গোদ্যান ছেড়ে চলে যেতে হবে? যে স্থানে জন্মের পর থেকে বর্ধিত হয়েছি আমরা, যেখানকার ছায়াচ্ছন্ন বনপথে কত আনন্দে ভ্রমণ করেছি, যা দেবতাদেরও প্রমোদভ্রমণের উপযুক্ত সে স্থান ছেড়ে যেতে হবে আমাদের চিরতরে? সব দুঃখ সত্ত্বেও এখানে আমাদের মরণশীল জীবনযাপনের কত আশা করেছিলাম আমরা। হে পুষ্পনিচয়, তোমরা অন্য কোন স্থানে অন্য জলবায়ুতে জন্মাতে না। তোমাদের মধ্যে কুঁড়ি ফুটিয়ে তুলেছি, তোমাদের নামকরণ করেছি। কে তোমাদের এবার হতে লালন করবে, কে ঝর্ণা থেকে জল এনে সেচন করবে তোমাদের? হে আমাদের বাসরকুঞ্জ, তোমাকে নিজের হাতে সাজিয়ে বর্ণগন্ধময় করে তুলেছি। কত মধুর মনোহর করে তুলেছি, কেমন করে তোমাদের ছেড়ে যাব? কোন অজানা অচেনা হীন জগতে গিয়ে আমরা ঘুরে বেড়াব, কোন অপবিত্র বাতাসে নিঃশ্বাস নেব? যে সব ফল খেতে আমরা অভ্যস্ত সে ফল কোথায় পাব?
দেবদূত মাইকেল ঈভকে থামিয়ে দিয়ে শান্ত কণ্ঠে বলতে লাগল, দুঃখ করো না ঈভ। ধৈর্যসহকারে সব ক্ষতি সহ্য করো। যা তোমার নয় তা নিয়ে আবেগের সঙ্গে শোক করো না। তুমি একা কোথাও যাচ্ছ না। তোমার স্বামীও যাবে তোমার সঙ্গে। যেখানে গিয়ে তোমরা বাস করবে সেটাকেই তোমাদের জন্মভূমি ভাববে।
আদম এবার তার দুঃখের আবেগটা সামলে নিয়ে বিনয়ের সঙ্গে মাইকেলকে বলল, হে আমার স্বর্গীয় অতিথি, তোমার আকৃতি দেখে যা মনে হয় তুমি দেবদূতদের মধ্যে সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত। তুমি ঈশ্বরপ্রেরিত সংবাদ শান্তভাবে সহানুভূতির সঙ্গে ব্যক্ত করেছ আমাদের কাছে। অন্য কেউ এই ভয়ঙ্কর দুঃসংবাদ কঠোরভাবে আমাদের বললে দুঃখ, বিষাদ ও হতাশাজর্জরিত আমাদের হৃদয় হয়ত তা সহ্য করতে পারত না। এখানেই হয়ত প্রাণত্যাগ করতে হত আমাদের।
তুমি সংবাদ এনেছ, এই মনোরম স্থান, মনোহর উদ্যান যা আমাদের শত দুঃখের মধ্যে ছিল একমাত্র সান্ত্বনার বস্তু ও একমাত্র আশ্রয়স্থল তা চিরতরে ছেড়ে চলে যেতে হবে আমাদের। এই স্থান ছিল আমাদের কাছে সবচেয়ে পরিচিত। অন্য যে কোন স্থানই আমাদের অপরিচিত এবং শূন্য ও পরিত্যক্ত মনে হবে।
যদি অবিরাম প্রার্থনার দ্বারা তাঁর ইচ্ছা ও বিধানের পরিবর্তন সাধন করা সম্ভব হত, তাহলে আমার ক্রমাগত অকাতর ক্রন্দন ও প্রার্থনার দ্বারা তাঁর কর্ণকুহর ক্লান্ত করে তুলতাম। কিন্তু প্রতিকূল নিঃশ্বাসের দ্বারা যেমন কোন অবাঞ্ছিত বায়ুপ্রবাহের গতিরোধ করতে পারা যায় না তেমনি প্রার্থনার দ্বারা তাঁর অমোঘ অখণ্ডনীয় বিধানেরও গতিরোধ করা যায় না। সুতরাং তাঁর অমোঘ বিধানের কাছে আত্মসমর্পণ করলাম আমি।
আমার সবচেয়ে বড় দুঃখ এই যে, এখান থেকে অন্য কোথাও গেলে ঈশ্বরের পবিত্র মুখদর্শন হতে বঞ্চিত হব আমি। এখানকার বিভিন্ন স্থানে তার উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করতাম। এই পর্বতের উপর তিনি একবার আবির্ভূত হয়েছিলেন, এই বৃক্ষতলে তিনি একবার দাঁড়িয়ে ছিলেন, এইসব পাইন গাছের মধ্যে তাঁর কণ্ঠস্বর শুনেছিলাম, ঐ ঝর্ণার ধারে তাঁর সঙ্গে একদিন কথা বলেছিলাম। আমার সন্তান-সন্ততিদের কাছে পরে একথা বলতে পারতাম।
এখানে আমি মাটি দিয়ে কত বেদী নির্মাণ ও নদীর বুক থেকে পাথর এনে কত মন্দির নির্মাণ করে ফল-ফুল দিয়ে তাঁর পুজো করতে পারতাম। কিন্তু ঐ অজানা জগতে গিয়ে কোথায় খুঁজে পাব তার উজ্জ্বল উপস্থিতি? কোথায় দেখতে পাব তাঁর পদচিহ্ন? যদিও আমি আমার কৃত পাপকর্মের দ্বারা তাঁকে ক্রুদ্ধ করে তুলেছি তথাপি তিনি আমাকে দীর্ঘ জীবন দান করেছেন এবং আমার থেকে এক নূতন জাতির উদ্ভব হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তাই আমি আজও দূর থেকে তাঁর বিরাট গৌরবের ধ্বজা দেখতে পাই, তার দূরাগত পদধ্বনি শুনতে পাই।
একথা শুনে মাইকেল বলল, আদম, তুমি কি জান না শুধু এই পাহাড় বা উদ্যান নয়, স্বর্গ, মর্ত্যের যেখানে যত পাহাড়-পর্বত, নদী-সমুদ্র, জল-বাতাস, জড় ও জীব আছে, ঈশ্বর তাদের সবার মধ্যে বিরাজ করছেন। কোথায় নেই তিনি? তারই দেওয়া প্রাণের উত্তাপে সব জীব উত্তপ্ত। পৃথিবীকেই তিনি তোমার অধিকারে ছেড়ে দিয়েছেন। একি কম দান? সুতরাং এই ইডেন উদ্যানের সংকীর্ণ সীমার মধ্যে তাঁর সর্বব্যাপী উপস্থিতিকে খণ্ড খর্ব করে দেখোনা।
তবে অবশ্য এটা তোমার রাজধানী হতে পারত যেখান থেকে মানবজাতি সমগ্র পৃথিবীতে বিস্তারলাভ করতে পারত এবং মাঝে মাঝে পৃথিবীর বিভিন্ন দিক থেকে দলে দলে মানুষ এসে তাদের মহান আদিপিতাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে যেতে পারত। কিন্তু সে সুযোগ তুমি হারিয়েছ। এখন তোমাকে পৃথিবীর সমতলভূমিতে গিয়ে বসবাস করতে হবে। সেখানেই তোমার সন্তানদের জন্ম হবে। তবে এটা জানবে, পৃথিবীর সব উপত্যকা ও সমতলভূমির সর্বত্রই ঈশ্বর আছেন। তুমি তাঁর পদধ্বনি শুনতে পাবে। এ বিষয়ে স্থির বিশ্বাস রাখবে, কোন সংশয় করবে না।
কিন্তু এখান থেকে তোমাদের প্রস্থানের পূর্বে তোমাদের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে কিছু কথা বলতে চাই আমি। আর এর জন্যই আমাকে পাঠানো হয়েছে। তোমার ও তোমার সন্তানদের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধেই আমি কিছু বলতে চাই। ভাল-মন্দ দুই-ই শোনার জন্য প্রস্তুত থাকবে। ধৈর্য ধারণ করে আনন্দ ও বেদনার সঙ্গে জানতে পারবে মানুষের পাপপ্রবৃত্তি, পাপাসক্তি ও ঈশ্বরের পরম করুণার কথা। সুখে-দুঃখে, উন্নতি ও অবনতির মধ্য দিয়ে তোমার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবে তুমি। তুমি ঐ পাহাড়ে উঠে যাও, ঈভ কি নীচেতেই নিদ্রা যাবে?
আদম এবার কৃতজ্ঞতার সঙ্গে বলল, হে আমার পথপ্রদর্শক, তুমি আগে ওঠ, আমি নিরাপদে তোমার অনুসরণ করব। তুমি যে পথে নিয়ে যাবে সেই পথেই যাব আমি। ঈশ্বরের হাতে সমর্পণ করেছি আমি নিজেকে। যতই দুঃখ আসুক, নীরব নির্বিবাদ দুঃখভোগের দ্বারা সব দুঃখকে জয় করব আমি। বিশ্রামের দ্বারা অপনোদন করব শ্রমের সব ক্লান্তি।
দুজনে সেই পাহাড়ে আরোহণ করতে লাগল দূরস্থিত ঈশ্বরের দৃষ্টির সম্মুখে।
সেটি ছিল মর্ত্যলোকের সবচেয়ে উঁচু পাহাড় যার শিখরদেশ হতে পৃথিবীর সুদূরপ্রসারিত গোলার্ধ দুটি পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছিল। সেখান থেকে আদমকে পৃথিবীকে ভালবাসার বিভিন্ন কারণগুলি দেখানো হচ্ছিল।
সেই পর্বতশিখরে দাঁড়িয়ে যেদিকেই দৃষ্টিপাত করছিল আদম সেই দিকেই সেই বিশাল পৃথিবীর অতীত ও বর্তমানের কত গৌরবময় রাজ্য ও ঐশ্বর্যগুলি দেখতে পাচ্ছিল। সে দেখল, চীনসম্রাট খানের রাজধানী সমরখন্দ, মোগলদের রাজধানী আগ্রা ও লাহোর, পারস্যের রাজধানী ইস্পাহান, রুশসম্রাট জারের রাজধানী মস্কো এবং তাছাড়া ইউরোপ, আফ্রিকা ও আমেরিকার বিভিন্ন ঐতিহ্যমণ্ডিত রাজ্য ও রাজধানী।
কিন্তু তার থেকে মহত্তর দৃশ্য দেখাবার জন্য আদমের দৃষ্টি সেখান থেকে ফিরিয়ে অন্যদিকে নিবদ্ধ করল মাইকেল। তাকে এখন আরও অনেক কিছু দেখতে হবে। তাই তার দৃষ্টিশক্তিকে আরও স্বচ্ছ ও চোখের স্নায়ুগুলিকে আরও শক্তিশালী করার জন্য জীবনের কূপ থেকে তিন ফোঁটা জল পড়ল।
এই জলবিচ্ছুরিত শক্তি এত জোরাল ছিল যে আদমের চক্ষু মুদ্রিত হয়ে গেল আপনা থেকে, তার অন্তরাত্মা আচ্ছন্ন হয়ে পড়লে এক তন্দ্রাবেশে, সে মাটিতে ঢলে পড়ল। তখন মাইকেল তাকে তুলে ধরে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, এখন তোমার চক্ষু উন্মীলিত করো আদম। প্রথমে দেখ, তোমার থেকে যারা উদ্ভূত হবে তাদের উপর তোমার আদিম পাপের প্রতিক্রিয়া। যারা কখনো তোমার মত সেই নিষিদ্ধ ফলের বৃক্ষকে স্পর্শ করেনি, যারা সেই সর্পরূপী শয়তানের দ্বারা প্ররোচিত হয়নি, যারা কখনো কোন পাপকর্ম করেনি, তারা তোমার কৃত পাপকর্মের প্রভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে কত ভয়ঙ্কর পাপকর্মের অনুষ্ঠান করবে।
আদম এবার চোখ খুলে একটি মাঠ দেখতে পেল। সেই মাঠের একটি অংশ ছিল কর্ষিত ও কৃষিযোগ্য। তাতে ফসল কাটা হচ্ছিল। আর একটি অংশ ছিল অকর্ষিত তৃণভূমি, তাতে মেষ চরে বেড়াচ্ছিল।
সেই মাঠের মাঝখানে একটি ঘাসে ঢাকা বেদী ছিল। সেখানে এক শস্যকৰ্ষণকারী তার চাষের জমি থেকে তার প্রথম ওঠা পাকা ফসল নিয়ে এল। তারপর এক নিরীহ ও শান্তপ্রকৃতির রাখাল এক নবজাত মেষশিশু নিয়ে এসে তাকে বলি দিল দেবতার উদ্দেশ্যে। চর্বিসহ বলির মাংস আগুনে ঝলসিয়ে নিবেদন করল দেবতাকে। দেবতা আকাশে আকাঙিক্ষত বিদ্যুৎ চমকানির দ্বারা সেই বলির দান গ্রহণ করলেন। কারণ তার আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকর্ম যথাযথভাবে সম্পন্ন হয়েছিল।
কিন্তু অন্যজনের আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকর্ম ঠিকমত সম্পন্ন না হওয়ায় তার পূজার অঞ্জলি ও উপাচার গ্রহণ করলেন না দেবতা। তখন সে রেগে গিয়ে সেই রাখালের সঙ্গে উত্তপ্তভাবে তর্কবিতর্ক করতে লাগল। একসময় সে একটি পাথর দিয়ে রাখালের মাথায় জোর আঘাত করায় তার মাথা থেকে প্রচুর রক্ত ঝরতে লাগল এবং সে তৎক্ষণাৎ মাটিতে পড়ে গিয়ে মারা গেল।
এই দৃশ্য দেখে ভীত হয়ে পড়ল আদম। সে মাইকেলকে বলল, হে আমার গুরুদেব, নিরীহ ব্যক্তিটি ভক্তিসহকারে ধর্মসম্মতভাবে বলির ক্রিয়া সম্পন্ন করলেও তার কি মারাত্মক ক্ষতিই না হলো।
দেবদূতপ্রধান মাইকেলও তখন বিচলিত হয়ে বলল, এই দুই ব্যক্তি দুই ভাই, তোমারই বংশোদ্ভুত সন্তান। অন্যায়কারী ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিটিকে হত্যা করল। কারণ তার ভাই-এর পূজা উপচার দেবতা গ্রহণ করায় ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়ে সে তার প্রতি। কিন্তু ঈশ্বর এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন এবং ন্যায়বান ব্যক্তিটি রক্তাক্ত ও মৃত অবস্থায় এখন মাটিতে পড়ে থাকলেও সে তার ধর্মাচরণের পুরস্কার পাবে।
আমাদের আদিপিতা তখন বলল, কার্য ও কারণের প্রত্যক্ষ প্রমাণসমম্বিত এই দৃশ্য। কিন্তু মৃত্যু কি জিনিস তা আমি স্বচক্ষে এখন প্রত্যক্ষ করলাম। কী ভয়াল এই দৃশ্য! এ দৃশ্য চোখে দেখা, এর কথা ভাবা বা অনুভব করা খুবই ভয়ঙ্কর।
মাইকেল বলল, মানুষের উপর নেমে আসা মৃত্যুর প্রথম রূপ তুমি প্রত্যক্ষ করলে। কিন্তু মৃত্যুর আরও অনেক রূপ আছে। অনেক ভাবেই মানুষ মৃত্যুবরণ করে সমাধিগহ্বরে যায়। কিন্তু মৃত্যুর সব রূপই ভয়াবহ। তবে মৃত্যুর দৃশ্য বা চিন্তা যত ভয়াবহ, আসল মৃত্যু তত ভয়াবহ নয়। তুমি যেমন দেখলে, অনেকে মর্মান্তিক আঘাতে মৃত্যুমুখে পতিত হয়, অনেকে আবার অগ্নিকাণ্ড, বন্যা, দুর্ভিক্ষ ও খাদ্য বা পানীয়জনিত ব্যাধির কবলে পড়ে মারা যায়। ভয়ঙ্কর ব্যাধিতে আক্রান্ত বহু মানুষের দৃশ্য এখনি আবির্ভূত হবে তোমার সামনে। তখন জানতে পারবে ঈভের পাপ মানবজাতির উপর কি দুঃখই না নিয়ে এসেছে।
তখনি এক অন্ধকার স্থান তারা দেখতে পেল। সেখানে অনেক রোগগ্রস্ত ব্যক্তি শায়িত ছিল। সকলেই ভয়ঙ্কর এক একটি রোগে ভুগছিল। কেউ মাথার যন্ত্রণায়, কেউ পেটের যন্ত্রণায়, কেউ জ্বরে, কেউ আঘাতজনিত ক্ষতের যন্ত্রণায় আর্তনাদ করতে করতে ছটফট করছিল। তাদের মধ্যে উন্মাদরোগগ্রস্ত ব্যক্তিও ছিল।
বিজয়ী বীরের মতো মৃত্যু তার অব্যর্থ বাণটি দিয়ে তার শেষ আঘাত তখনো হানেনি, শুধু বাণটি তাদের উপর ভয়ঙ্করভাবে দেখাচ্ছিল। যে মৃত্যু তাদের একমাত্র মঙ্গল, মুক্তি ও আশা-ভরসা, সে মৃত্যু লাভ করতে পারছিল না তারা। শুধু দীর্ঘায়িত হয়ে চলেছিল তাদের দুঃসহ মৃত্যু-যন্ত্রণা। কোন প্রস্তরকঠিন হৃদয়বিশিষ্ট ব্যক্তিও অশ্রুশূন্য শুষ্ক চোখে সে দৃশ্য দেখতে পারে না।
সে দৃশ্য চোখে দেখতে পারল না, দুঃখে অভিভূত হয়ে কাঁদতে লাগল আদম। সে কোন নারীর গর্ভজাত সন্তান না হলেও করুণায় বিগলিত হয়ে উঠল তার অন্তর। সে করুণা অশ্রু হয়ে ঝরে পড়তে লাগল তার চোখ থেকে। তবু দৃঢ় চিন্তার দ্বারা তার আবেগাতিশয্যকে সংযত করে আদম বলতে লাগল, হেহতভাগ্য দুঃখী মানবজাতি! কী শোচনীয় তোমার অধঃপতন, কী ভয়ঙ্কর দুরবস্থাই না তোমার ভাগ্যে আছে। এই হতভাগ্য মানবজাতির জনক না হয়ে এখানেই আমার মৃত্যু হলে ভাল হত। মানবজাতির জন্ম না হওয়াই উচিত ছিল।
এ জীবন কেন আমাদের দান করা হলো যদি তা এমন ভয়ঙ্করভাবে ছিনিয়ে নেওয়া হবে আমাদের কাছ থেকে? কেন এ জীবনকে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হলো আমাদের উপর? যদি জানতাম এ জীবনের পরিণতি এই তাহলে জন্মকালে এ জীবন গ্রহণ করতাম না অথবা তখনি এ জীবনের শান্তিপূর্ণ অবসান প্রার্থনা করতাম। তাহলে দুঃখ পেতে হত না।
যে মানুষ একদিন ঈশ্বরের প্রতিরূপ হিসাবে কত সুন্দরভাবে সৃষ্ট হয়েছিল, সে মানুষ পাপগ্রস্ত হয়ে কেন এই অদর্শনীয় অবর্ণনীয় দুঃখ-যন্ত্রণার শিকার হবে? স্রষ্টার প্রতিরূপের খাতিরে মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের গুণ ও কিছু অংশ অন্তত থাকবে যে গুণ ও শক্তি বলে সে এই সব দেহগত ব্যাধি ও বিকৃতির হাত হতে মুক্তি পাবে।
মাইকেল তখন উত্তর করল, যখন তারা তাদের অসংযত ক্ষুধাকে তৃপ্ত করার জন্য পাপ করে তখনি স্রষ্টার প্রতিমূর্তি তাদের ত্যাগ করে। তখন ঈভের পাপজনিত কলুষিত কামনার প্রতিমূর্তি গ্রহণ করে তারা। তাই তার এই শাস্তি।
তারা পাপকর্মের দ্বারা ঈশ্বরের প্রতিমূর্তিকে বিকৃত করেনি, করেছে তাদের নিজেদেরই মূর্তিকে, হারিয়েছে ঈশ্বরের গুণাবলীকে। পবিত্র প্রকৃতির শুভ নিয়মগুলিকে লঙঘন করে তারা ঘৃণ্য কামনা ও দুর্বলতার পরিচয় দিয়েছে। তারা ঈশ্বরের প্রতি সব শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলে।
আদম বলল, আমি সব স্বীকার করি। ঐশ্বরিক বিধানের কাছে আত্মসমর্পণ ছাড়া অন্য কোন পথ নেই। এইসব যন্ত্রণাদায়ক পথ ছাড়া মৃত্যুর কাছে যাবার বা সমাধিগহ্বরের মাটিতে মিশে থাকার অন্য কোন পথ নেই।
মাইকেল বলল, হ্যাঁ আছে। যদি তুমি সব কিছুর ‘অতি’কে পরিহার করে চলতে পার, যদি তুমিও পরিমিত পানাহারের মধ্য দিয়ে উপযুক্ত পুষ্টি লাভ করতে পার তাহলে দীর্ঘজীবন লাভ করতে পারবে তুমি। তাহলে অকালে নির্দয়ভাবে তোমার জীবনবৃক্ষ হতে ছিন্ন হবে না তুমি। যথাসময়ে বৃদ্ধ বয়সে মৃত্যুবরণ করবে তুমি। তাহলে যৌবন পার হয়ে বার্ধক্য পর্যন্ত বাঁচতে পারবে তুমি। যৌবনের সব শক্তি সব সৌন্দর্য বার্ধক্যের মধ্যে এসে শুকিয়ে যায়। তখন সব ইন্দ্রিয়শক্তিগুলি দুর্বল হয়ে পড়ে। বাঁচার সব আনন্দ, সব উদ্যম এক নিবিড়তম হতাশা আর বিষাদে পরিণত হয়। স্তিমিত হয়ে পড়ে আত্মার সব শক্তি। অবশেষে অবসান হয় জীবনের।
তখন আদিপিতা বলল, এখন থেকে আমি আর মৃত্যুর কাছ থেকে পালিয়ে যাব না। আর জীবনকে দীর্ঘায়িত করব না। আমি শুধু মৃত্যুর সহজ ও সুন্দর উপায়টা জানতে চাই। আমি ধৈর্য ধারণ করে মৃত্যুকে বরণ করে নিতে চাই।
মাইকেল বলল, জীবনকে খুব বেশি ভালবাসবে না, আবার খুব বেশি ঘৃণাও করবে না। যে জীবন যাপন করবে তা ভালভাবে সম্ভবে যাপন করবে। সে জীবন দীর্ঘ হবে না সংক্ষিপ্ত হবে তা ঈশ্বরের হাতে ছেড়ে দাও। এখন অন্য এক দৃশ্য দেখার জন্য প্রস্তুত হও।
আদম তার সামনে তাকিয়ে এক প্রশস্ত সমতলভূমি দেখতে পেল। সে ভূমিতে বিভিন্ন রঙের তাঁবু ছিল। কয়েকটি তাঁবুর পাশে গবাদি পশুর পাল চরে বেড়াচ্ছিল। অন্য কতকগুলি তাবু থেকে বীণা, অর্গান ও কতকগুলি বাদ্যযন্ত্রের সমন্বিত সঙ্গীতের সুর ভেসে আসছিল। সে সুরলহরী উচ্চ ও নিম্নগ্রামে ওঠানামা করছিল।
সেইসব তাঁবুর বাইরে দাঁড়িয়ে একটি লোক একটি শ্রমশীল কাজ করছিল। লোহা ও পিতলের দুটি চাঁই আগুনে গলিয়ে বিভিন্ন ছাঁচে ঢালছিল। সেই ছাঁচ দিয়ে সে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি তৈরি করছিল।
সেইসব তাঁবুর অন্যদিকে নিকটবর্তী যে সব পাহাড়গুলি নিচে সমতলভূমিতে নেমে এসেছিল সেখানে একদল শান্ত প্রকৃতির লোক ঈশ্বরের উপাসনা করছিল।
এদিকে তাঁবুগুলি থেকে তখন কতকগুলি পরমাসুন্দরী নারী মণি-মুক্তাখচিত পোশাক পরে বেরিয়ে এসে নানা বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে নাচগান করতে লাগল। কতকগুলি লোক সেই নারীদের মধ্য থেকে যাকে যাকে পছন্দ করল তাদের সঙ্গে তাদের বিবাহের ব্যবস্থা করল। বিবাহের আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকর্ম সম্পন্ন হতে লাগল ফুল, মালা ও সঙ্গীত সহযোগে।
এই দৃশ্য দেখে আনন্দ পেল আদম এবং সে আনন্দ সে প্রকাশ করল মাইকেলের কাছে। সে বলল, হে দেবদূতপ্রধান, শান্তি ও আনন্দের দ্যোতক এই দৃশ্য অনেক ভাল। আগের দুটি দৃশ্যে শুধু দেখেছি খুন আর মৃত্যুর তাণ্ডব।
মাইকেল বলল, শুধু আনন্দের মাপকাঠিতে সব কিছুর বিচার করো না। মানবজীবনের উদ্দেশ্য আরও পবিত্র হওয়া উচিত। ঈশ্বরের মনোমতো হওয়া উচিত। ঐ তবুগুলিতে তুমি যে আনন্দোচ্ছলতা দেখলে সে তাঁবুগুলি দুষ্ট প্রকৃতির লীলাভূমি। সেখানে মানবজাতির যারা বাস করে তাদের অনেকে ভাই হয়ে ভাইকে হত্যা করে। যদিও বাইরে থেকে দেখে তাদের শিক্ষিত ও মার্জিত বলে মনে হয়, তথাপি তারা একবারও তাদের পরম স্রষ্টা ঈশ্বরের কথা স্মরণ করে না, তারা ঈশ্বরের কোন দান স্বীকার করে না।
ওখানে যে সব সুন্দরী নারীদের দেখলে তারা অবশ্য অনেক সুন্দর সন্তানের জন্ম দেবে। কিন্তু তারা ধর্মবোধবিবর্জিতা নাস্তিক। তারা শুধু নাচগান ও হাসাহাসি করতে জানে। কিন্তু জানে না অল্পদিনের মধ্যেই তাদের কাঁদতে হবে।
আদম তখন বিমর্ষ হয়ে বলল, হায়! কি লজ্জা আর দুঃখের কথা। যারা একদিক দিয়ে কত ভাল জীবন যাপন করতে পারত তারা কুপথে গিয়ে অধঃপতিত হবে। এখানেও দেখছি নারী হতেই মানবজাতির দুঃখ শুরু হচ্ছে।
দেবদূত মাইকেল বলল, পুরুষদের স্ত্রৈণ মনোভাব আর দুর্বলতাই এর জন্য দায়ী। পুরুষের উচিত জ্ঞান ও শ্রেষ্ঠ গুণাবলীর দ্বারা ভূষিত হয়ে ব্যক্তিত্বসহকারে নারীদের ঠিক পথে পরিচালিত করা। এবার আর একটি দৃশ্য দেখ।
আদম তখন তাকিয়ে তার সামনে আর এক বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড দেখতে পেল। সে ভূখণ্ডে অনেক নগর ও গ্রাম রয়েছে। নগরগুলি জনবহুল, সেখানে বড় বড় সৌধ, অট্টালিকা আর উঁচু উঁচু তোরণদ্বার দেখা যাচ্ছে। বলিষ্ঠদেহী বহু সশস্ত্র যোদ্ধা ভয়ঙ্কর মুখ নিয়ে অস্ত্র সঞ্চালন করে আস্ফালন করে বেড়াচ্ছে। অশ্বারোহী কত যোদ্ধা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈনিকদের দল যখন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল তখন একদল রাখাল গরু, ভেড়া ও গবাদি পশুর একটি পাল সামনের এক প্রান্তরে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। অপেক্ষমান সেনাদল তা দেখে সেই পশুপাল লুণ্ঠন করতে লাগল। রাখালরা প্রাণভয়ে পালিয়ে গিয়ে অন্য এক সেনাদলের কাছে কাতরকণ্ঠে সাহায্য প্রার্থনা করল। ফলে দুই সেনাদলের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ বাধল। দুই পক্ষেই বহু হতাহত হলো। বহু মৃতদেহ ছড়িয়ে পড়ে রইল সেই ক্ষেত্রের উপর।
তখন এক সেনাবাহিনী একটি সুরক্ষিত নগর অবরোধ করল। সেই নগরের বাইরে তারা শিবির স্থাপন করল। বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র দ্বারা তারা সেই নগর আক্রমণ করতে সেই নগরের সৈন্যরা বর্শা, তীর, পাথর আর অগ্নিবলয় ছুঁড়ে সে নগর রক্ষা করতে লাগল। দুপক্ষেই বহু সৈন্য নিহত হতে লাগল।
তখন সেই নগরমধ্যে নগরপরিষদের প্রবীণ সদস্য ও যোদ্ধাদের এক সভা বসল। সভা চলাকালে তাদের মধ্য থেকে একজন সহসা উঠে দাঁড়িয়ে ন্যায়, অন্যায়, ধর্ম, সত্য, শান্তি ও ঐশ্বরিক বিচার সম্বন্ধে যুক্তি দিয়ে তাদের বোঝাতে লাগল।
কিন্তু তার কথা শুনে সভাস্থিত নবীন-প্রবীণ সকল সদস্যই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল রাগে। তারা সকলে তার হাত ধরে তাকে নিগৃহীত করার জন্য টানাটানি করতে লাগল। তখন সহসা আকাশ থেকে এক মেঘখণ্ড নেমে এল এবং তার ভিতর থেকে কে যেন অদৃশ্য অবস্থায় সেই ন্যায়পরায়ণ ও সত্যনিষ্ঠ ব্যক্তিটিকে সকলের কাছ থেকে আশ্চর্যভাবে ছিনিয়ে নিয়ে আবার মেঘাবৃত অবস্থায় আকাশে উঠে গেল।
এই দৃশ্য দেখে চোখে জল এল আদমের। সে মাইকেলের দিকে মুখ ফিরিয়ে কাতর কণ্ঠে বলতে লাগল, এসব কি দেখছি? ওরা মানুষ নয়, মৃত্যুর দূত। ওরা মানুষ হয়ে মানুষের উপর যেরকম নিষ্ঠুর ব্যবহার করছে তাতে সেই ভ্রাতৃহন্তার পাপের থেকে দশগুণ পাপ হচ্ছে ওদের। সেই ভ্রাতৃহন্তা তার একজন ভাইকে হত্যা করছে, এরা শত শত ভাইকে হত্যা করছে। আসলে সব মানুষ সব মানুষের ভাই। এইভাবে ন্যায় অন্যায়ের দ্বারা পদদলিত হচ্ছে। যে লোকটিকে ঈশ্বর ঐন্দ্রজালিকভাবে উদ্ধার করেন ক্রুদ্ধ জনতার কবল থেকে, সেই ব্যক্তিটিই একমাত্র ন্যায় ও সত্যপরায়ণ কিন্তু ঈশ্বর তাকে উদ্ধার না করলে সে মারা যেত সেদিন।
মাইকেল বলল, এর আগে সেই প্রোদশিবিরে আনন্দোচ্ছল নাস্তিক নারীদের মধ্যে যে অশুভ অসম বিবাহ দেখেছিলে, এই সব যোদ্ধারা হলো সেই বিবাহেরই ফল। সেই সব বিবাহিত অবিমৃষ্যকারী নরনারীর সন্তান। সেই সব বিবাহিত নর-নারীর মধ্যে ভাল-মন্দ দুই-ই ছিল। তাদের মধ্যে অনেকের সে বিবাহে ইচ্ছা ছিল না। তবে বিচক্ষণতাও ছিল না। এইসব মানবিক যোদ্ধারা তাদেরই সন্তানগণ। সেকালে যুদ্ধ, বীরত্ব, শারীরিক শক্তি আর সাহসকেই মানবজীবনের সবচেয়ে বড় গুণ বলে গণ্য করত সকলে। এক জাতি যুদ্ধ ও প্রচুর নরহত্যার মাধ্যমে অন্য জাতিকে জয় করে বিজয়গৌরব লাভ করত। এইভাবে বড় বড় বীরপুরুষেরা ধ্বংসের দ্বারা গৌরব অর্জন করে যশস্বী হয়ে উঠত পৃথিবীতে।
যে লোকটিকে ঈশ্বর উদ্ধার করেন সে হচ্ছে তোমার বংশধরদের মধ্যে সপ্তম সন্তান। অন্যায়, অধর্ম ও পাপের জগতে সেই ছিল একমাত্র ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি। একমাত্র সেই বলেছিল ঈশ্বরের ন্যায়ের দণ্ড সকল অন্যায়ের উপর নেমে আসবে একদিন। ঈশ্বর সকলের বিচার করবেন।
এর দ্বারা তোমাকে দেখালাম ঈশ্বর ন্যায় ও সত্যপরায়ণ ব্যক্তিকে কিভাবে উদ্ধার করেন সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে এবং অন্যায়কারীদের একদিন ঐশ্বরিক শাস্তি ভোগ করতেই হবে। আবার দেখ।
আদম আবার তাকিয়ে দেখল সে দৃশ্য আর নেই। যুদ্ধের কণ্ঠ এখন তীব্র গর্জন থেকে বিরত হয়েছে। যুদ্ধের মারামারি কাটাকাটি এখন পরিণত হয়েছে আনন্দোচ্ছল ক্রীড়াচঞ্চলতায়। রণক্ষেত্র রূপান্তরিত হয়েছে ভোজসভা, বিলাসব্যসন আর ব্যভিচারে। পথচারীরা সুন্দরী নারীদের দেখে আকৃষ্ট হয়ে পতিতালয়ে যাচ্ছে। সেখানে গিয়ে মদ্যপান করতে করতে ঝগড়া-বিবাদে প্রবৃত্ত হচ্ছে।
অবশেষে বয়োপ্ৰবীণ এক শ্রদ্ধেয় জ্ঞানী ব্যক্তি এসে তাদের জীবনযাত্রা ভ্রান্ত ও অসৎ বলে ঘোষণা করলেন। তাদের সেই অবাঞ্ছিত কর্মের বিপক্ষে যুক্তি দেখিয়ে বারবার বিভিন্ন স্থানে আলোচনা করতে লাগলেন তাদের সঙ্গে। এমন কি কোন উৎসবে যোগ দিয়েও তিনি তাদের জ্ঞান দিতে লাগলেন। তাঁর নাম ছিল নোয়া।
কিন্তু তার সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হলো। তারা তাঁর কোন কথা না শুনে সেই অন্যায়, অবিচার, ব্যভিচারের পথেই চলতে লাগল। তখন সেই জ্ঞানী ব্যক্তি আর তাদের সঙ্গে কোন তর্কবিতর্কে প্রবৃত্ত হলেন না। তাদের আর জ্ঞান দানের কোন চেষ্টা করলেন না।
তিনি তখন দূরে একটি পাহাড়ের উপর গিয়ে তাঁবু ফেলে বাস করতে লাগলেন নির্জনে। একদিন বড় বড় কতকগুলি গাছ কেটে তার কাঠ দিয়ে এক বিশাল অর্ণবপোত নির্মাণ করলেন। দৈর্ঘ্যে, প্রস্থে, উচ্চতায় সব দিক দিয়েই সে পোত হলো বিরাট। তার একটি দিকে মাত্র একটি দরজা করা হলো। কিছু সংখ্যক মানুষ ও পশুর জন্য অনেক পরিমাণে খাদ্য ভরে নেওয়া হলো সেই জাহাজে যাতে বেশ কিছুদিন চলতে পারে। তারপর এক এক জাতীয় পশু, পাখি ও কীটপতঙ্গ হতে নারী-পুরুষ মিলিয়ে সাত জোড়া করে সেই জাহাজে তুলে নিলেন।
সবশেষে সেই ধার্মিক নোয়া তাঁর স্ত্রী, ভঁর তিনজন পুত্র আর তাদের স্ত্রীদের নিয়ে সেই জাহাজে উঠলেন। ঈশ্বর তখন আপন হাতে সে জাহাজের একটিমাত্র দরজা শক্ত করে এঁটে দিলেন।
সঙ্গে সঙ্গে তখন প্রবল দক্ষিণা বাতাস বইতে লাগল। ঘনকৃষ্ণ মেঘমালা চারদিক থেকে যেন পাখা মেলে এসে সারা আকাশটাকে ঢেকে ফেলল। ক্রমে আকাশটা এক কালো ছাদের মতো মেঘভারে নত হয়ে পৃথিবীর বুকের উপর চেপে বসে রইল।
তারপর শুরু হলো বৃষ্টি। সে বৃষ্টির যেন আর শেষ নেই। দিনের পর দিন ধরে চলতে থাকা সে বৃষ্টিতে এমন এক মহাপ্লাবন দেখা দিল যাতে সমগ্র পৃথিবী তার ঘর-বাড়ি, প্রাসাদ-অট্টালিকা, গ্রাম-নগর, পাহাড়-পর্বত, গাছপালা সব কিছু ডুবে গেল নিঃশেষে। কোথাও কোন কিছু চিহ্নমাত্র রইল না। চারদিকে শুধু জল আর জল। শুধু সমুদ্রের পর সমুদ্র। সেই বিশ্বব্যাপী মহাপ্লাবনের মাঝে জলের তলায় সব মানুষ তলিয়ে গেল, তাদের উচ্ছ্বসিত সব কণ্ঠ নীরব হয়ে গেল।
একমাত্র ধার্মিক নোয়ার সেই জাহাজটি ঈশ্বরের অনুগ্রহে ভেসে বেড়াতে লাগল সেই মহাপ্লাবনের মাঝে। উত্তাল জলরাশির বিক্ষুব্ধ তরঙ্গমালায় দুলে দুলে চলতে লাগল। সেই সব তরঙ্গাঘাতে তার কোন ক্ষতি হলো না।
মাইকেল এবার আদমকে জিজ্ঞাসা করল, চোখের সামনে তোমার সন্তানদের এভাবে বিলুপ্ত হয়ে যেতে দেখলে কত দুঃখ পাবে আদম। তোমার চোখে তখন হয়ত আর এক প্লাবন দেখা দেবে।
তখন দ্রুত জলের তলায় তলিয়ে যাওয়া তোমার সন্তানদের দেখতে তুমিও ঝাঁপ দেবে জলে। তারপর কোন দেবদূত এসে তুলে ধরবেন তোমায়।
আদম এবার বলল, ওঃ কী দুঃখের দৃশ্য! এর থেকে ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে অজ্ঞ থাকা অনেক ভাল ছিল। তাহলে প্রতিদিন আমার দুর্ভাগ্যের বোঝা আমি সহজেই বহন করে যেতাম। এখনকার মতো যুগ-যুগান্তকারী দুঃখের বোঝা আমাকে আমার বুকের উপর এমনি করে চেপে বসত না। অথচ ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আমার এই জ্ঞান কত নিষ্ফল, তাতে কোন লাভই হবে না। শুধু ভবিষ্যতে কি হবে সেই দুর্ভাগ্যের কথা আগে হতে জানতে পারার ফলে এক দুশ্চিন্তার দ্বারা অনুক্ষণ পীড়িত আমি।
এখন থেকে কেউ যেন ভবিষ্যতের কথা জানতে না চায়। ভবিষ্যতে তার সন্তানরা কি পরিমাণ দুর্ভাগ্যের কবলে পড়বে, তাদের ভাগ্যে কত দুঃখ আছে তা জানতে পেরে কিন্তু সে দুঃখ সে দুর্ভাগ্যকে নির্ধারিত করতে পারবে না তারা, শুধু ভয়ঙ্কর এক আশঙ্কা আর দুঃখে কাল কাটাতে হবে তাদের।
মানুষকে কোন বিষয়ে আগে হতে সতর্ক করে দেওয়ার কোন অর্থই হয় না। অল্পসংখ্যক যারা আপাতত দুর্ভিক্ষ বা দুঃখকে কোনরকমে এড়িয়ে যায়, পরে তাদের সেই দুর্ভিক্ষ ও দুঃখের কবলে পড়তে হয়।
পথিবীতে যুদ্ধের অবসান দেখে মনে আশা হয়েছিল আমার। ভেবেছিলাম এবার মানবজাতি সুখে শান্তিতে দীর্ঘকাল বাস করবে। পুনরায় এই আশার দ্বারা প্রতারিত হয়েছি আমি। এখন দেখছি যুদ্ধ যেমন ধ্বংস নিয়ে আসে মানুষের জীবনে, শান্তি তেমনি মিথ্যা ছলনার দ্বারা প্রতারিত করে মানুষকে। কেন এমন হয়? হে আমার স্বর্গীয় পথপ্রদর্শক, বল এই মহাপ্লাবনেই কি মানবজাতি বিলুপ্ত হবে সম্পূর্ণরূপে?
তখন মাইকেল বলল, তুমি বিজয়গর্বে গর্বিত যে সব মানুষকে ঐশ্বর্যে ও বিলাসব্যসনে মত্ত থাকে দেখেছ, যাদের কোন প্রকৃত গুণ ছিল না তারাই এই ঈশ্বরসৃষ্ট মহাপ্লাবনের প্রথম বলি হবে।
তুমি দেখেছ যারা একদিন অনেক রক্তপাত ঘটিয়ে অনেক ধ্বংস করে অনেক জাতিকে জয় করে জগতে প্রভুত্ব ও যশ অর্জন করে, অনেক উপাধিতে ভূষিত হয় এবং অনেক ঐশ্বর্যলাভ করে, তারাই পরে শান্তির সময়ে তাদের জীবনের গতিপথের পরিবর্তন করে আবার স্বাচ্ছন্দ্য, আনন্দ, অহঙ্কার, বিলাস আর আলস্যের স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয়। বিজিত জাতিরা তাদের স্বাধীনতা হারিয়ে দাসত্বের জীবন যাপন করতে থাকে। স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে সব সগুণও তারা হারিয়ে ফেলে। যে ধর্ম, যে ঈশ্বর তাদের আক্রমণকারীদের হাত হতে রক্ষা করতে পারেনি, যে ধর্ম ও ঈশ্বরের প্রতি সব ভয়, সব আস্থা হারিয়ে ফেলে তারা, যখন তাদের জীবনের সমস্ত উত্তপ্ত উদ্যম, সমস্ত কর্মতৎপরতার উত্তাপ শীতল হয়ে যায়, তখন তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য হয় কিভাবে তারা নিরাপদে বেঁচে থাকবে। কিভাবে তারা তাদের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখবে। তাদের নূতন প্রভুরা কতখানি বাঁচার আনন্দ তাদের উপভোগ করতে দেবে সেটাই তাদের একমাত্র চিন্তা হয়ে ওঠে। জগতে ও জীবনে আরো কত ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার পরিচয় দিতে হবে এই কথাই ভাবতে থাকে তারা। ফলে মানবশিক্ষার দিক থেকে দ্রুত অধঃপতন ঘটতে থাকে তাদের। ন্যায়পরায়ণতা, সহিষ্ণুতা, সত্য, ধর্মবিশ্বাস প্রভৃতির কথা সব তারা ভুলে যায়। ‘ কোন একটিমাত্র মানুষ, অন্ধকার যুগে পাপে পরিপূর্ণ পৃথিবীতে আলোর সন্তানরূপে সমস্ত প্রলোভন, প্রধানত কুসংস্কার, সমস্ত নিন্দা, ঘৃণা ও হিংসাকে অগ্রাহ্য করে ‘নির্ভীকভাবে পৃথিবীর মানুষকে অধর্ম ও অন্যায়ের পথে যাওয়ার জন্য তীব্র ভাষায় ভর্ৎসনা করবেন এবং তাদের সেই ন্যায় ও শান্তির পথ দেখাবেন যে পথে গেলে ঈশ্বরের রোষ কখনো নেমে আসবে না তাদের উপর।
কিন্তু মানুষ তার কথা শুনবে না, তার পথ অবলম্বন করবে না। তিনি শুধু তাদের কাছ থেকে বিদ্রূপ ও উপহাস লাভ করে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাবেন। তবে ঈশ্বর দেখতে পাবেন পৃথিবীতে একটিমাত্র ন্যায়পরায়ণ মানুষ এখনো জীবিত আছে। তখন ঈশ্বরের আদেশে সেই ন্যায়বান ও সৎ ব্যক্তি একটি আশ্চর্য অর্ণবপোত নির্মাণ করবে যার দ্বারা সে নিজেকে ও তার পরিবারবর্গকে সর্বধ্বংসী, সর্বগ্রাসী মহাপ্লাবনের হাত হতে উদ্ধার করতে পারবে। সে পোত তুমি দেখেছ।
তার নির্বাচিত মানুষ ও পশুপাখিসহ তিনি সেই জাহাজে উঠে বসলেই আকাশ থেকে অবিরল অবিরাম ধারায় বর্ষণ শুরু হলো। সেই বর্ষণে সমস্ত সমুদ্র ও মহাসমুদ্র তাদের সব বেলাভূমি অতিক্রম করে সমগ্র পৃথিবীকে প্লাবিত করল। এমন কি পাহাড়গুলি পর্যন্ত সব ডুবে গেল। সেই উত্তাল জলরাশির আঘাতে মর্ত্যলোকের এই স্বর্গীয় পাহাড়টি পর্যন্ত স্থানচ্যুত হয়ে যায় এবং সেখানে এক দ্বীপ জেগে ওঠে। এই ঘটনার দ্বারা এই শিক্ষা পেলে যে মর্ত্যলোকের কোন স্থানকে ঈশ্বর কোন গুরুত্ব দিতে চান না যদি না সেখানে মানুষ বাস না করে বা যাতায়াত না করে। এবার এরপর কি হলো তা দেখ।
আদম তখন সেদিকে তাকিয়ে দেখল, সব মেঘ ও বন্যার বেগ কমে গেছে। শুষ্ক দক্ষিণা বাতাসের তাড়নায় সঙ্কুচিত হয়ে উঠল বন্যায় স্ফীত মুখ। মেঘমুক্ত আকাশের সূর্য উত্তপ্ত কিরণ বিকীরণ করায় বন্যার জলে ভাটা পড়ল। সব সমুদ্র এবার স্বাভাবিক আকার ধারণ করল। বৃষ্টি একেবারে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আর স্ফীত হলো না সমুদ্রের বুক। নোয়ার জাহাজটি বন্যার জলে আর ভাসতে থাকল না, একটি পাহাড়ের উপর স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে রইল।
দেখতে দেখতে পাহাড়ের প্রস্তরমণ্ডিত মাথাগুলি জেগে উঠল। নোয়ার জাহাজ থেকে প্রথমে এক দাঁড়কাক উড়ে গেল। তারপর একটি কপোত উড়ে গেল কোন গাছ বা মাটি পাওয়া যায় কিনা তা দেখার জন্য। কিছুক্ষণ পর কপোতটি তার ঠোঁটে করে একটি অলিভ পাতা নিয়ে এল। এই অলিভ পাতা শান্তির চিহ্ন।
ক্রমে শুকনো মাটি জেগে উঠল। প্রবীণ পিতা নোয়া তখন তাঁর দলবল নিয়ে জাহাজ থেকে নেমে পড়লেন। তিনি দুহাত তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতা জানালেন ঈশ্বরকে। তখন আকাশে এক শিশিরসিক্ত মেঘ দেখা গেল। সেই মেঘে তিনরঙা এক ধনু দেখা গেল শান্তির প্রতীক হিসাবে।
এই দৃশ্য দেখে বিষণ্ণ আদম সব বিষাদ ঝেড়ে ফেলে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠল। সে বলল, হে স্বর্গীয় শিক্ষক, তুমি ভবিষ্যতের ঘটনাবলীকে বর্তমানে পরিণত করতে পার। আমি সেই শেষ দৃশ্যটি দেখে এই বুঝে আশ্বস্ত হলাম যে ভবিষ্যতে সব কিছু সত্ত্বেও মানুষ পর্যন্ত সমস্ত প্রাণীকুলের সঙ্গে বাঁচতে পারবে। অসংখ্য দুষ্ট প্রকৃতির মানুষে ভরা একটি জগৎকে ধ্বংস হয়ে যেতে দেখে যত না দুঃখ পেয়েছিলাম তার থেকে একটি সর্বগুণমণ্ডিত ও ন্যায়পরায়ণ মানুষকে বেঁচে থাকতে দেখে অনেক বেশি আনন্দ পেলাম। ঈশ্বর মানবজাতির প্রতি সব রাগ দুঃখ ভুলে গিয়ে সেই ন্যায়বান ও সাধুপ্রকৃতির মানুষ থেকে এক নূতন জগৎ গড়ে তুলতে চান। এখন বল, ঈশ্বরের শান্ত কুটির মতো আকাশে আবির্ভূত তিনরঙা ধনুকশোভিত ঐ মেঘখণ্ডটির অর্থ কি? তিনি কি আবার পৃথিবীকে জলের তলায় তলিয়ে দিয়ে ধ্বংস করতে চান?
প্রধান দেবদূত মাইকেল বলল, তুমি ঠিকই লক্ষ্য করেছ। এখন তার ক্রোধ স্বেচ্ছায় প্রশমিত করেছেন। মানবজাতির ধ্বংসে তিনি এখন অনুতপ্ত। একদিন তিনি সমস্ত পৃথিবীকে হিংসায় পরিপূর্ণ ও সমস্ত মানুষকে দুর্নীতিগ্রস্ত দেখে রাগে দুঃখে অভিভূত হয়ে পড়েন। পরে যখন তিনি দেখলেন অন্তত একজন ন্যায়বান মানুষ আছে পৃথিবীতে তখন তিনি সমগ্র মানবজাতিকে একেবারে ধ্বংস না করে ঐ একজনকে সপরিবারে বাঁচিয়ে রাখলেন। তিনি ধনুকবিধৃত মেঘখণ্ডের মাধ্যমে ঘোষণা করলেন আর কখনো কোন মহাপ্লাবনের দ্বারা ধ্বংস করবেন না পৃথিবীকে। আর কখনো সমুদ্র তার বেলাভূমি অতিক্রম করবে না, অতিবৃষ্টি ভাসিয়ে দেবে না পৃথিবীকে। ধনুকের তিনটি রঙের মাধ্যমে তিনি ঘোষণা করে দিলেন, পৃথিবীতে চিরকাল দিনরাত্রি, বীজবপন ও শস্যকর্তন শীত, গ্রীষ্ম যথারীতি চলতে থাকবে। তারপর একদিন আগুনে পরিশুদ্ধ স্বর্গ-মর্ত নূতনভাবে গড়ে উঠবে। ন্যায়ের রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হবে পৃথিবীতে।