১০। নেকেসিয়া
সিন্ধুযান সোপারার বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করে কিছুটা পথ উত্তরে গিয়ে তারপর পশ্চিমের দিকে চলে চারদিন ধরে। পঞ্চম দিনে গতিপথ বদল করে দক্ষিণ অভিমুখে যাত্রা করে। একটি পূর্ণদিন সেই ভাবে চলে পরের দিন আবার পশ্চিমের পথ নেয়। অষ্টম দিনে নৌকাটি অপেক্ষাকৃত ভাবে ছোট আকারের একটি সমুদ্রে এসে পড়ল। এখানে জলের রঙ আচমকাই যেন বদলে গিয়েছে।
ভারতবর্ষের উপকূলবর্তী গাঢ় নীল বর্ণের সমুদ্র এখানে এসে যেন রক্তাক্ত এক আভা পেয়েছে। ইরতেনসেনু এই লোহিত সাগরের নাম আগে শুনলেও এই প্রথমবার তা চাক্ষুস করছে। উপল বলল এইখানে সমুদ্র খুব বেশি গভীর নয়, সমুদ্রের জলের মধ্যে কিছু উদ্ভিদ ভেসে বেড়ায়, তাদের কারণেই এখানকার জল এমন বর্ণের। একদিন সেই উদ্ভিদ জল থেকে তুলে রোদে শুকিয়ে নিল মাঝিরা। তারপর তাদের উত্তপ্ত তেলে ভেজে খাওয়া হল। অগস্ত্য এবং ইরতেনসেও তার কিছুটা খেল।
সমুদ্রের জলের লবণাক্ত ভাব এই খাদ্যে বেশ পরিমাণে আছে, তবে তার সঙ্গে একটি মিষ্ট ভাবও রয়েছে। উপল বলল এই জলজ লতা বহু দিকভ্রষ্ট নাবিকের জীবন বাঁচায়। মাঝ সমুদ্রে খাদ্য ফুরিয়ে গেলে এটি জীবনধারণের একমাত্র পথ। এই সমুদ্রের ঢেউ বেশ কম। তবে এখানে বাতাস প্রবাহের জোর যেন আচমকাই বেড়ে গেল। এই অদ্ভুত দর্শন সমুদ্রের মধ্যে উত্তর-পশ্চিমের দিকে যাত্রা করল সিন্ধযান।
দ্বাদশ দিনের সকালে তারা বহুদিন পর মাটি দেখতে পেল। বহু দূরে হলুদ বর্ণের ভূমি দেখা যাচ্ছে, সেখানে যেন জেগে রয়েছে দুটি সূঁচের মতো স্তম্ভ। ইরতেনসেনু আনন্দে নৌকার উপরই লাফিয়ে উঠল। নেকেসিয়ার বন্দর দেখা যাচ্ছে!
নেকেসিয়া বন্দরটি মিশরের অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র বন্দরগুলির একটি। মাঝারি এবং ছোট আকারের কিছু নৌকা এখানে নোঙর ফেলে দাঁড়িয়ে আছে। মিশরীয়দের নৌকার আকার এবং গঠনপ্রকৃতি ভারতীয় নৌকার থেকে সামান্য আলাদা। তাদের নৌকা ভারতীয় নৌকার তুলনায় কৃশকায় কিন্তু দীর্ঘতর। ভারতীয় নৌকাগুলির গায়ে সাধারণত বাদামী বর্ণের রঙ করা থাকলেও মিশরীয়দের নৌকা হয় উজ্জ্বল হলুদ বর্ণের।
নৌকার গায়ে দেবদেবীর ছবি আঁকা থাকে। বাণিজ্যের কারণে এই নেকেসিয়ার বন্দরটি ব্যবহৃত হয় না। ছোট ডিঙি নৌকায় করে এখান থেকে সমুদ্রের সামান্য গভীরে গিয়ে মাছ শিকার করে জেলেরা। সমুদ্রের তীরে বাঁধা নৌকাগুলি এখন মন্দ লয়ে দুলছিল। খুব সাবধানে সিন্ধুযানকে এই বন্দরের মধ্যে প্রবেশ করালো উপল। জলের গভীরতা কমে আসতে আসতে একসময় বোঝা গেল নৌকা নীচের ভেজা বালিতে এসে ঠেকেছে। এখানেই নোঙর ফেলল সে।
সবার আগে নৌকা থেকে লাফ দিয়ে নামল ইরতেনসেনু। ছোট্ট এক বালিকার মতো সে সমুদ্রতীর দিয়ে ছুটতে লাগল। কত বছর পর তার দেশের মাটি তার পদস্পর্শ করেছে! নীচু হয়ে হাতের মুঠোর মধ্যে কিছুটা বালি তুলে নিল সে, নাকের কাছে নিয়ে এসে চোখ বন্ধ করে গন্ধ শুঁকতে লাগল।
ততক্ষণে অগস্ত্য এবং উপলও নৌকা থেকে নেমে এসেছে। বন্দরে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন মাঝি অবাক চোখে দেখছিল ইরতেনসেনুদের। ভিনদেশী মানুষদের সচরাচর এই বন্দরে দেখতে পাওয়া যায় না। তারা সন্দেহের চোখে অগস্ত্যদের দিকে তকিয়ে রইল। ইরতেনসেনু কিছুক্ষণের জন্য যেন এক অস্থির বালিকায় রূপান্তরিত হয়েছিল। অগস্ত্য এবং উপল তার পিছনে এসে দাঁড়াতে তার সম্বিত ফিরল। হাতের বালি ফেলে দিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে দেখল তারা কৌতুকময় মুখ নিয়ে চেয়ে রয়েছে ইরতেনসেনুর দিকে। সামান্য লজ্জিত হল সে। যেন সেই লজ্জা কাটিয়ে ওঠার জন্যই এবারে গলার স্বর গম্ভীর করে বলল, ‘তাহলে পরের যাত্রা আবার শুরু করা যাক।’
অগস্ত্যদের কোন কিছু বলার অপেক্ষা না করেই হনহন করে ইরতেনসেনু হাঁটতে থাকল সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মাঝিদের দিকে। অদ্ভুত দর্শন বস্ত্রে সজ্জিতা এই নারী তাদের দিকে এগিয়ে আসছে দেখে মাঝিরা যেন সামান্য সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল। তারা একে অপরের দিকে চাইল। আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা আরও কিছু মানুষ তাদের দলের কাছে চলে এল।
মাঝিদের কাছে এসে ইরতেনসেনু বন্ধুত্বপূর্ণ হাসি হাসল। মাঝিরা দেখল এই মেয়েটির পরনের কাপড় ভিনদেশের হলেও তার গলায় শোভিত অলঙ্কারটি মিশরীয়দের মতো। এবার তাদের অবাক করে দিয়ে মেয়েটি মিশরীয় ভাষায় বলে উঠল, ‘নমস্কার জানাই আপনাদের, আমি ইরতেনসেনু। ফারাও হাতসেপসুতের রাজধানী থীবসের প্রধান বৈজ্ঞানিক ছিলাম আমি।’
ভিড়ের মধ্যে এক প্রৌঢ় দাঁড়িয়ে ছিল। তার নাম জেজেত। জেজেত পেশায় জেলে, মাছ ধরে সংসার নির্বাহ করে। ইরতেনসেনুর নামটি শুনতেই জেজেতের মনে পড়ে গেল পাঁচবছর আগের সেই দিনটির কথা। যেদিন আকাশের সূর্য মাটিতে নেমে এসেছিল! রানি হাতসেপসুত দু’হাতে সেই সূর্যকে মাথার উপরে তুলে ধরেছিলেন। তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা জনসমুদ্রের একেবারে সামনেই ছিল জেজেত।
ওপেতের উৎসবে সামিল হওয়ার জন্য সেদিন সে মাছ ধরায় মুলতুবি রেখেছিল। নিজের স্ত্রী কন্যাকে নিয়ে সেই অত্যাশ্চর্য ঘটনা সে নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করেছিল। সেদিন তার চোখ গিয়েছিল রানির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সপ্রতিভ নারীটির দিকে। ওপেতের উৎসবের পরে সে শুনেছিল সেই রমনীর নাম ইরতেনসেনু, থীবস শহরের সবচেয়ে বিদুষী মহিলা। পাঁচ বছর আগে দেখা সেই মুখ যেন আবার আজকে জেজেতের সামনে! হ্যাঁ-হ্যাঁ! ভিনদেশী বস্ত্র পরে থাকলেও তো এই যুবতীর মুখ অবিকল সেই ওপেতের উৎসবের দিনে দেখা নারীর মতো!
ভিড় ঠেলে জেজেত সামনের দিকে এগিয়ে এল। ইরতেনসেনুর সামনে দাঁড়িয়ে মাথা নীচু করে অভিবাদন জানিয়ে সে পিছন ফিরে বাকিদের উদ্দেশে বলল, ‘তিনি সঠিক পরিচয়ই দিচ্ছেন। তাঁকে আমি দেখেছি ওপেতের উৎসবের দিনে। রাজধানীতে হেন কোন নাগরিক নেই যে ইরতেনসেনুর নাম শোনেনি।’
ততক্ষণে ইরতেনসেনু নিজের কোমরে বাঁধা কাপড়ের ছোট থলিটি থেকে বার করে এনেছে রানি হাতসেপসুতের পাঠানো সেই ধাতব সম্পুটটিকে। সেটি সে জেজেতের হাতে দিল। এই ভাষা মিশরের সাধারণ মানুষ পড়তে না পারলেও এই শীলমোহরটিকে চিনতে কারোর অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। রাজধানী থীবসের আর কার্নাক শহরের মন্দির গাত্রে এই শীলমোহর সবাই দেখেছে। স্বয়ং ফারাওয়ের পবিত্র নাম খোদাই করা রয়েছে তাতে।
জেজেত এবার দু’পা পিছিয়ে এসে দু’হাত মাথার উপরে তুলে ইরতেনসেনুকে অভিবাদন জানাল, তার দেখা-দেখি বাকি মানুষজনেরাও দুই হাত মাথার উপরে তুলল। জেজেত বলল, ‘মহামান্যা ইরতেনসেনু, আমাদের সৌভাগ্য যে এই ছোট্ট বন্দরে আপনার চরণ স্পর্শ করেছে। আপনার আবিষ্কারের সুফল থীবস শহর এখনও ভোগ করে চলেছে। চাষের জমির মাটি কর্ষণের জন্য আপনি যে যন্ত্রটি আবিষ্কার করেছিলেন তা এখনও ব্যবহৃত হয়। আপনার তৈরি করা রানি হাতসেপসুতের মন্দির ‘জেহের জেসেরু’ও তো অপূর্ব সুন্দর! সমগ্র মিশরের গর্ব মন্দিরটি। কিন্তু আমরা শুনেছিলাম কয়েকবছর আগে আপনি ভিনদেশে গমন করেন।’
‘ঠিকই শুনেছিলেন, আমি ভারতবর্ষে ছিলাম গত পাঁচ বছর।’
এবারে পিছন ফিরে অগস্ত্য এবং উপলের দিকে হাত দেখিয়ে ইরতেনসেনু বলল, ‘বাঁ-পাশের যুবকটি আমার স্বামী অগস্ত্য, আর ডান দিকের জন আমাদের বন্ধু উপল, সেইই আমাদের জলপথে এখানে নিয়ে এসেছে। আমরা এসেছি ফারাও হাতসেপসুতের জরুরী পত্র পেয়ে।’
ইরতেনসেনুর কথা শুনে বাকিরা মুখ চাওয়া চাওয়ি করল, ভিড়ের মধ্য থেকে আরও একজন এগিয়ে এল। তার নাম সিথার। এই বন্দরটির পালক হল সিথার। সিথার নৌকাদের হিসাব রাখে, মাছ বিক্রির পর জেলেদের থেকে সাপ্তাহিক খাজনা আদায় করে, প্রতিমাসে সে থীবসে গিয়ে সেই খাজনা জমা করে। এই অঞ্চলে সিথারের প্রতিপত্তি তাই সবচেয়ে বেশি। সিথার খর্বকায়, বয়স পঞ্চাশ বছর হবে হয়তো। তার পরনের কাপড় কালচে রক্তিম বর্ণের। বুকের কাছে সুতোর কাজ করা থীবসের শাসনক্ষমতার প্রতীক।
ফারাওয়ের কাজে নিযুক্ত কর্মচারীদের এই বস্ত্র পরিধান করা বাধ্যতা মূলক। আবার এই বস্ত্রের জন্যই তারা স্থানীয় অঞ্চলে বিশেষ সুযোগ সুবিধা ভোগ করে। সিথার জেজেতের হাত থেকে ধাতব সম্পুটটিকে নিয়ে ভালো করে দেখল, তারপর ইরতেনসেনুকে অভিবাদন জানিয়ে বলল, ‘নেকেসিয়ার বন্দরে আপনাকে স্বাগত জানাই। আমি সিথার, এই বন্দরের পালক, রাজপুরীর দ্বারা নিযুক্ত। আপনারা দয়া করে আমার সঙ্গে আসুন। আমি আপনাদের থীবস শহরে নিয়ে যাব।’
সিথারের পিছু পিছু ইরতেনসেনুরা চলল। কিছুটা এগিয়ে একটি গৃহের সামনে এসে দাঁড়াল তারা। আশেপাশের বাড়িগুলির তুলনায় এই গৃহটি দৈর্ঘ্যে এবং প্রস্থে বড়। সিথার বিবাহ করেনি, দুটি পরিচারক তার গৃহস্থলী সামলায়। তাদের সঙ্গে ইরতেনসেনুদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে সিথার বলল, ‘আজ সন্ধ্যা হয়ে এল। থীবসের পথ এখান থেকে বেশ কিছুটা দূরের। রাত্রে মরুভূমির মধ্য দিয়ে যাত্রা করলে ডাকাতের ভয় থাকে, রাত্রে ঠান্ডাও খুব বেশি থাকে। আপনারা দয়া করে আজ রাতটুকু বিশ্রাম করুন, আগামীকাল ভোরে আমরা যাত্রা শুরু করব। একটানা পথ চলতে থাকলে আগামীকাল বিকালের মধ্যে আমি আপনাদের থীবস শহর পৌঁছে দিতে পারব।’
ইরতেনসেনুর আর তর সইছিল না, সমুদ্র যাত্রার ক্লান্তি গায়ে নিয়েও সে চাইছিল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব থীবসে হাতসেপসুতের কাছে পৌঁছতে। কিন্তু অগস্ত্য তাকে বোঝাল যে এই স্থানে রাত্রি বাস করাটাই সমীচীন হবে। রাত্রে ভালো করে ঘুমিয়ে নিয়ে সূর্য ওঠার সঙ্গে-সঙ্গেই ক্লান্তিহীন শরীরে তারা যাত্রা শুরু করে দেবে। বারোদিন এই যাত্রায় ব্যয় হয়েই গেছে, আর একটি রাত্রি তার সঙ্গে জুড়লে তেমন ক্ষতি নেই। বরং দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার পর আবার রাত জেগে মরুভূমির মধ্য দিয়ে চলতে শুরু করলে শরীর অসুস্থ হয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে ফারাওকে কোনভাবেই সাহায্য করা হবে না তাদের।
সিথারের আবাসে কোনও অতিথি কক্ষ নেই, এই ছোট জনপদে অথিতি আগমনের কথা কেউ ভাবেই না। সিথার তার নিজের শয়ন কক্ষটি অগস্ত্য, ইরতেনসেনু এবং উপলের জন্য ছেড়ে দিয়েছে, অনেক বিরোধ সত্বেও সে ইরতেনসেনুর কথা শোনেনি। ফারাওয়ের নিকটের মানুষেরা তার প্রভুতুল্য। রাতের ভোজনের সমারোহে অগস্ত্যরা মুগ্ধ হয়েছিল। এই জনপদের প্রতিটি গৃহ থেকেই কিছু না কিছু খাবার নিয়ে আসা হয়েছে তাদের জন্য। এত খাদ্য তো তিনজনে খেয়ে শেষ করতে পারবে না।
লোকালয়ের মানুষদের সঙ্গে বসে তাই ভাগ করে খাবার খেল তারা, সিথারও তাদের সঙ্গে যোগ দিল। খাওয়ার পর অগস্ত্য এবং ইরতেনসেনু ঘুমাতে গেলেও উপল গেল না। সিন্ধযানের ক্রমাগত দোলায় অগস্ত্যদের গায়ে ব্যথা হয়ে গেলেও উপলের যথেষ্ট বিশ্রাম হয়েছে। তার এখনই ঘুম আসছে না।
সিথারের আবাসের বাইরে একটি বেশ বড় ফাঁকা জায়গার মাঝে কাঠের আগুন জ্বালানো হয়েছে, তার চারদিকে গোল হয়ে বসেই তারা একটু আগে আহার সমাধা করল। প্রায় একশত জেলে, মাঝি, সাধারণ মানুষ এখনও এই আগুনের চারপাশে বসে আছে। উপল এবার তাদের নিজের সমুদ্র যাত্রার গল্প বলা শুরু করল। মিশরীয়দের ভাষায় কথা বলতে উপল ভালোই পারে, এই দেশে সে আগেও বেশ কয়েকবার এসেছে।
ভিনদেশের ভাষা না জানলে বাণিজ্য করা প্রায় অসম্ভব হয়ে যায়। ভিনদেশী এই দীর্ঘকায় পুরুষ দুটি নেকেসিয়ার মানুষের কাছে ভীষণই আগ্রহের বস্তু। গল্প বলতে উপল খুব ভালোবাসে, তার গল্প বলার সময়ে কাল্পনিক উপাদানের অভাবও হয় না। হাত পা নেড়ে চোখ বড় বড় করে এমনভাবে সে গল্পগুলি বলে যাতে শ্রোতার কাছে তা সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়।
নিজের নানান চিত্তাকর্ষক অভিযানের কথা বলতে বলতে উপল একসময় বলল, ‘আমার সঙ্গে আসা অন্য পুরুষটি কিন্তু যে সে মানুষ নন। স্বয়ং দেবতার অংশ! অসীম ক্ষমতার অধিকারী তিনি। খুব সাধারণ ভাবে থাকেন বলে তাকে আর ফ্যালনা মানুষ ভেবে একদম ভুল কোরো না। একবার কী হয়েছিল জানো!’
অবশ্যই নেকেসিয়াবাসী জানে না কী হয়েছিল, তারা উদগ্রীব চোখ নিয়ে উপলের দিকে তাকিয়ে রইল। উপল বলে চলল, ‘ভারতবর্ষের একেবারে উত্তরে হিমালয় পর্বতের কথা তো শুনেইছো মনে হয়, সেখানে দেবতাদের বাস। তাদের সাধারণ মানুষ চোখে দেখতে পান না, কিন্তু তাদের আশীর্বাদেই ভারতবর্ষের আকাশে সূর্য-চন্দ্র ওঠে, নদীতে জল বয়। কিন্তু অগস্ত্য এক মহাঋষি, নিজের তপস্যার বলে তিনি দেবতাদের সমতুল্য হয়েছেন। তিনি সরাসরি দেবতাদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন।
‘একদিন তার ঘুম ভাঙিয়ে দেবতাদের রাজা ইন্দ্র উপস্থিত হলেন। বড়ই বিড়ম্বনার মধ্যে পড়ে তিনি অগস্ত্যর কাছে এসেছেন, তার সাহায্যপ্রার্থী হয়ে। ভারতবর্ষের দক্ষিণ অংশে অসুররা থাকে বুঝলে। তারা স্থূলকায়, কদাকার, তারা বর্বর। সবসময় তারা দেবতাদের সরিয়ে দিয়ে ভারতবর্ষের দখল নিতে চায়। তাই দেবতাদের সঙ্গে অসুরদের যুদ্ধ লেগেই থাকে।
‘তেমনই এক অসুরের নাম বৃত্তাসুর। মহাঋষি দধিচি নিজে আত্মত্যাগ করে তার শরীরের হাড়গুলি দেবরাজ ইন্দ্রকে দেন, ইন্দ্র সেই হাড় থেকে তৈরি করেন বজ্র। ওই বজ্রকে তোমরা রাতের আকাশে দেখতে পাও তো? যখন আকাশে মেঘ ডাকে, তার আগে?’
ভিড়ের মধ্য থেকে একজন বলে উঠল, ‘আমাদের বজ্রের দেবতার নাম তো বেল। তিনি যুদ্ধ করার সময় বজ্রের প্রহার করেন।’
উপল মনে হয় এতে সামান্য বিরক্ত হল, সে বলল, ‘ও হ্যাঁ, তাহলে তাই হবে, তোমাদের আকাশের বজ্রের অধিকার দেবতা বেলের হলেও ভারত ভুখণ্ডে তা দেবতা ইন্দ্রের অস্ত্র। সেই বজ্র দিয়ে ইন্দ্ৰ বৃত্তাসুরকে বধ করেন। কিন্তু বৃত্তাসুরের এক সহচর ছিল, তার নাম কালকেয়। কালকেয় ছিল বৃত্তাসুরের মতোই ক্ষমতাশালী। তার মৃত্যুর পর কালকেয় সমুদ্রের মধ্যে গিয়ে লুকায়। এবারে বিশাল সমুদ্রের মধ্যে ইন্দ্র কালকেয়কে খুঁজে পাবে কী করে?
‘কালকেয়কে না মারতে পারলে অসুরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়ও অসম্পূর্ণ থেকে যায়। লুকিয়ে থাকার কয়েক শত বছর পর হয়তো আবার এই কালকেয়ই আরও শক্তি সঞ্চয় করে ফিরে আসবে, তাই তাকে বধ করা একান্তই প্রয়োজন। ইন্দ্র তাই অগস্ত্যর শরনাপন্ন হলেন, তাঁকে বললেন যেভাবেই হোক কালকেয়কে খুঁজে দিতে হবে। অগস্ত্য তখন কী করলেন জানো?’
ভিড়ের মধ্য থেকে সমস্বরে শব্দ হল, ‘কী? কী?’
‘অগস্ত্য তখন তাঁর অমিত ক্ষমতা বলে সমুদ্রের সব জল শুষে নিলেন!
‘সব জল! সমুদ্রের তো কোন আদি অন্ত নেই, তার গভীরতার মাপ কেউ জানে না, সেই সমুদ্রের সব জল পান করলেন অগস্ত্য?’
উপলের পাশে বসে থাকা জনৈক মিশরীয় নেকেসিয়াবাসী প্রশ্ন করল। বাকি সবার মতো তার চোখেও বিস্ময় এবং অবিশ্বাস লেগে রয়েছে। উপল তার প্রশ্নের উত্তরে বলল, ‘এতে এত অবাক হওয়ার কী আছে? মহর্ষি অগস্ত্য আর কী-কী করেছেন তা জানলে তোমাদের রাতের ঘুম চলে যাবে। ইন্দ্রের বজ্রকে সে একটি ছোট কলসের মধ্যে বন্দি করে রাখতে পারে, প্রায় মৃত মানুষও তার অলৌকিক চিকিৎসায় প্রাণ ফিরে পায়, কিছুদিন আগে এক খরস্রোতা নদীর গতিপথ বদলে দিয়েছেন এই অগস্ত্য। সেখানে সমুদ্রের জল পান করা তো তুচ্ছ। তোমাদের দেবতা সেথও তো দেবতা হোরাসকে খোঁজার সময় নীলনদের জল শুষে নিয়েছিলেন, সে কথা কি আমি জানি না ভাবছ?’
ঠিক কথাই বটে, মিশরের ঈশ্বর এই কাজ পারলে ভারতবর্ষের ঈশ্বররূপী পুরুষ কেন পারবেন না?
‘তারপর কী হল শোন। অগস্ত্য তো সব জল পান করে নিলেন, এবারে সমুদ্রের গর্ভের মধ্য থেকে বেরিয়ে এল কালকেয়। তার আর লুকিয়ে থাকার কোন জায়গা রইল না, সঙ্গে সঙ্গে তাকে বধ করলেন ইন্দ্র। দেবতাদের জয় হল। ভারতের ভূমিতে শান্তি ফিরে এল।’
‘আর সেই সমুদ্রের কী হল, সমুদ্র নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল?’
‘না তা হবে কেন? সমুদ্র ছাড়া ভারতবর্ষের মানুষের চলবে নাকি? আমার মত বণিকেরা তাহলে দেশ দেশান্তরে যাবে কী ভাবে? গঙ্গা নদীর নাম তো তোমরা সবাই শুনেছ, হিমালয় থেকে জল বয়ে নিয়ে এসে সেই নদী আবার সমুদ্রের খাত ভরিয়ে ফেলল, সেই কাজ আবার হল অন্য এক মহর্ষির দৈববলে…’
উপলের কথা শেষ হওয়ার আগে সে একটি আওয়াজ শুনতে পেল, গলার ঘড়ঘড় শব্দ। এই আওয়াজটি সে চেনে, মাথা ঘুরিয়ে দেখল অগস্ত্য তার পিছনে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসছে। এতক্ষণে বাকিদের নজরও গেল অগস্ত্যর দিকে। সঙ্গে সঙ্গে সম্ভ্রমের ভঙ্গীতে তারা উঠে দাঁড়াল। এই দেবতুল্য মানুষটির জন্য এখন সম্ভ্রম জাগবে বই কী। অগস্ত্য এতে বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল, নিজের ডান হাত তুলে সবাইকে বসতে বলে উপলের উদ্দেশে বলল, ‘অনেক রাত্রি হল, ভোরে আমাদের বেরোতে হবে, এবারে আপনি শয্যায় চলুন।’
উপলও বাধ্য ছেলের মতো তার সঙ্গে চলল, যাওয়ার আগে একবার পিছন ফিরে সমবেত জনতার দিকে তাকিয়ে মুষ্টিবদ্ধ ডান হাত আকাশে তুলে চিৎকার করে বলল, ‘জয় অগস্ত্যর জয়!’
জনতাও মন্ত্রমুগ্ধের মতো উপলের কথার প্রতিফলন করে বলল, ‘জয় অগস্ত্যর জয়!’
অগস্ত্য এবারে প্রবল বিব্রত বোধ করে উপলকে একপ্রকার টানতে টানতেই নিয়ে এল। সিথারের গৃহে প্রবেশ করে উপলকে বলল, ‘এই, এগুলোর কি প্রয়োজন ছিল? এত কল্পনার জাল তুমি বোনো কীভাবে?’
উপল একগাল হেসে বলল, ‘দারুণ লাগে বুঝলে গল্পগুলো বলতে। মানুষ তো এখনও বিজ্ঞানকে সেভাবে চেনেনি। তাই তোমার আবিষ্কারগুলোর গায়ে একটু এদিক-ওদিকে রঙ মাখালেই এরকম অলৌকিক গল্প তৈরি হয়ে যায়। আমি দেখেছি এই গল্পগুলো মানুষ গোগ্রাসে ভক্ষণও করে। আমারও বলতে খুব ভালো লাগে। মহর্ষি অগস্ত্যর কার্যকলাপ আমি এভাবে যে আর কত দেশে বলে বেড়িয়েছি তার হিসাব নেই।’
এই বলে উপল আবার হাসতে লাগল, অগস্ত্যও উপলের এই কাণ্ড দেখে হাসতে শুরু করল। সত্যি, অদ্ভুত একটা মানুষ বটে উপল। নিজের প্রিয় বন্ধুর সাফল্যে সে গর্বিত তো বটেই, সেই সাফল্যের খবর দেশে বিদেশে ছড়িয়ে দিতেও তার জুড়ি নেই। যদিও সেখানে সে সামান্য কার্পণ্য করলে মনে হয় ভালো হতো।
পরদিন যখন দিগন্তে সবেমাত্র মলিন গেরুয়া আভা ছড়িয়ে পড়ছে তখন অগস্ত্যরা বেরিয়ে পড়ল। চারটি উটের পিঠে চলেছে তারা। মরুভূমির বালির মধ্য দিয়ে দ্রুত চলার জন্য উটের জুড়ি নেই। বহুক্ষণ বিনা বিশ্রামে একটানা চলতেও পারে তারা। নেকেসিয়ার জনপদটি বেশ ছোট। কয়েকদণ্ড চলার পরই তা শেষ হয়ে মরুভূমি শুরু হল। পথে আরও কয়েকটি ছোট ছোট জনপদ পড়ল, তবে অগস্ত্যরা কোথাও আর দাঁড়ায়নি। সঙ্গে থাকা শুকনো খেজুর আর জল দিয়ে ক্ষুধা-তৃষ্ণা নিবৃত্ত করেছিল।
সূর্য যখন মধ্যগগনে তখন তারা নীলনদের তীরে এসে পৌঁছল। ইরতেনসেনু দ্রুত উট থেকে নেমে নদীর দিকে ছুটে গেল। আঁজলা ভরে নদীর জল পান করল সে, নিজের চোখে মুখে ছিটিয়ে নিল। তার দেশের নদী! এই নদীর তীরে তার শৈশব, কৈশোর কেটেছে। উচ্ছ্বসিত মুখ নিয়ে ইরতেনসেনু বলল, ‘ওই দেখ অগস্ত্য, কার্নাকের মন্দির!
ডান দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে অগস্ত্য দেখল বেশ কিছুটা দূরে একটি অট্টালিকা দেখা যাচ্ছে। এত দূরে থাকার দরুণ সেটিকে পরিষ্কার ভাবে দেখা না গেলেও অট্টালিকার সামনে রাখা স্তম্ভ দুটি চোখে পড়ার মতো। স্তম্ভদুটির মাথাগুলি সূঁচালো। সেই মাথা সোনায় মোড়া। সুর্যের আলো তাতে প্রতিফলিত হওয়ার কারণে সেই চূড়ায় নজর গেলে চোখ ধাঁধিয়ে যায়।
‘রানি হাতসেপসুত স্তম্ভ দুটি বানিয়েছিলেন, মন্দিরটি আরও কয়েকশো বছরের পুরোনো।’
অগস্ত্যর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে ইরতেনসেনু। তার চোখে-মুখে গর্বের ছাপ। মন্দিরটিকে ঘুরে দেখবার ইচ্ছা ছিল অগস্ত্যর। পাঁচবছর আগে আরও কিছুটা দূরে নদীর এই প্রান্তেই অবস্থিত লাক্সরের মন্দিরটিকে এখনও ভোলেনি সে। অনন্যসুন্দর সেই মন্দিরে রানি হাতসেপসুত ফারাওয়ের রূপে অভিষিক্তা হয়েছিলেন। অগস্ত্য এবং ইরতেনসেনুর তৈরি যন্ত্র থেকে আলোক বিচ্ছুরিত হয়ে থীবসের জনগনকে হতবাক করে দিয়েছিল সেদিন। অগস্ত্য শুনেছে কার্নাকের মন্দিরটিও নাকি ভীষণই সুন্দর। তবে আজ তাদের হাতে সময় কম, ফারাওয়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য ইরতেনসে ভীষণ উৎসুক হয়ে পড়েছে। তাই আজ কার্নাকের মন্দির দর্শন করা হবে না অগস্ত্যর। তারা তিনজনে সিথারের সঙ্গে একটি ছোট নৌকায় চড়ে বসল। সাদা পাল তোলা নৌকাটি নীলনদের বুকের উপর দিয়ে নদীর অন্যপ্রান্তের দিকে চলল।
থীবস শহরটি নীলনদের দু’পাশ জুড়েই অবস্থিত। তবে রানির প্রাসাদটি রয়েছে নদীর পশ্চিম তীরে। নৌকা থেকে নেমে একটি ঘোড়ায় টানা গাড়িতে চলে তারা তিনজনে প্রাসাদের সামনে এসে দাঁড়াল। রক্ষীরা তাদের পথ আটকে দাঁড়াতে ইরতেনসেনু একজন রক্ষীর হাতে ধাতব সম্পুটটিকে দিয়ে বলল, ‘ফারাওয়ের কাছে বার্তা পৌঁছানোর ব্যবস্থা করুন, এই সম্প্রটটি তার হাতে দিলেই তিনি বুঝবেন।’
রক্ষীটি সম্পুটটিকে হাতের মধ্যে নিয়েই সেটির গুরুত্ব বুঝেছিল। সঙ্গে সঙ্গে সে প্রাসাদের অভ্যন্তরে দৌড় লাগাল। অন্য দুই রক্ষী প্রাসাদের দ্বার আবার বন্ধ করে দিয়ে নিশ্চল চক্ষে অগস্ত্যদের দিকে তাকিয়ে রইল। অগস্ত্যরা ততক্ষণে ঘোড়ায় টানা গাড়ি থেকে নেমে পড়েছে। তাদের পাশে দাঁড়িয়ে আছে সিথার। তার মাথা অবনত, সে সামান্য কাঁপছে। সে রাজকর্মচারী হলেও ফারাওয়ের প্রাসাদের এত কাছাকাছি কখনও আসেনি, তাই ভয়-সম্ভ্রমে সে হয়তো স্থির থাকতে পারছে না।
বেশিক্ষণ চুপ করে থাকা উপলের পোষায় না, অধৈর্য ভাবে প্রাসাদের বাইরের পায়চারি করতে করতে সে একসময় রক্ষী দুটির কাছে এগিয়ে গেল, বলল, ‘ভাই, এই ভাবে তোমরা অতিথিদের স্বাগত জানাও? এতক্ষণ এই রৌদ্রের মধ্যে দাঁড় করিয়ে রেখেছ, একবার একটু জলপান করাবার ইচ্ছাও জাগলো না তোমাদের মনে? এটা নিজের গৃহ হলে এভাবে অতিথিকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখতে পারতে তো?’
দ্বাররক্ষী দুটি কিছু বলল না, রোষায়িত চোখে শুধু উপলের দিকে চেয়ে রইল।
‘চেহারাটা বেশ ভালো বানিয়েছ দেখছি। কিন্তু রোদে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তো গায়ের চামড়া পুড়ে কালো হয়ে যাচ্ছে ভাই। তোমাদের ফারাওকে একটি ছাউনি বানিয়ে দিতে বলতে পারো তো।’
এই বলেই উপল একটি রক্ষীর কাঁধে হাত রাখল, সঙ্গে সঙ্গে সে এক ঝটকায় হাতটি সরিয়ে দিয়ে উপলকে ঠেলা মেরে মাটিতে ফেলে দিয়ে হাতে ধরা বল্লম উঁচিয়ে ওর দিকে তাক করল। অগস্ত্য ছুটে এসে উপল আর রক্ষীর মাঝে দাঁড়াল, উপলকে ধরে মাটি থেকে তুলে সরিয়ে নিয়ে আসতে লাগল। রক্ষী দুটি তখনও বল্লম উঁচিয়ে উপলের দিকে তাক করে রেখেছে। ইরতেনসেনু তাদের শান্ত হওয়ার আবেদন জানাচ্ছিল। এর মধ্যে উপল বলতে লাগল, ‘এভাবে আমাকে মাটিতে ফেলে দিলে তোমরা! জানো আমার সঙ্গে থাকা এই মানুষটি কে? মহামুনি অগস্ত্য! এক্ষুণি তীব্র দৃষ্টি দিয়ে তোমাদের…’
এমন সময় প্রাসাদের দরজা ভিতর থেকে খুলতে আরম্ভ করল। সঙ্গে সঙ্গে রক্ষী দুটি ত্রস্ত ভাবে পুনরায় সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। আগের রক্ষীটিকে সঙ্গে নিয়ে যিনি বাইরে বেরিয়ে এলেন তাঁর শরীরের উর্ধাঙ্গ উজ্জ্বল হলুদ বর্ণের বস্ত্র দিয়ে ঢাকা, তার উপরে থাকা সোনায় মোড়া ধাতব অঙ্গরক্ষক কাঁধ থেকে বুক অবধি বিস্তৃত। কোমরের কাছ থেকে নীল বর্ণের আরও একটি বস্ত্র নেমে এসে হাঁটুর কাছে থেমেছে। তাঁর পায়ে চর্মপাদুকা। দুই বলিষ্ঠ হাতে বাজুবন্ধ। থুতনির নীচের অংশে লাগানো আছে সোনার নকল দাড়ি। ইনি পুরুষের বেশভূষায় সজ্জিত হলেও মুখমণ্ডলের পেলবতা নারীত্বকে লুকিয়ে রাখতে পারছে না। তাঁর মাথার ডিম্বাকৃতি স্বর্ণমুকুট বলে দেয় তিনি ফারাও!
ফারাও হাতসেপসুতের এইভাবে প্রাসাদের বাইরে আসার ঘটনা আগে কখনও ঘটেছে বলে জানা যায় না। সাধারণত তিনি দ্বিতলের অলিন্দ থেকে মানুষকে দেখা দেন। অথবা প্রাসাদের বাইরে আসার প্রয়োজন হলে তিনি রথে চড়ে আসেন, তাদের পাহারা দেওয়ার জন্য ঘিরে থাকে সৈন্যদল। রক্ষী দুটি বিমূঢ় অবস্থায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেই হাঁটু ভাঁজ করে মাথা নীচু করে বসে পড়ল। সিথারও সেই ভঙ্গীতে বসে রইল মাটিতে।
হাতসেপসুতের নজর প্রথমেই এসে পড়ল ইরতেনসেনুর দিকে। তাঁর চোখ দুটি খুশিতে ঝলমলিয়ে উঠল। তিনি এগিয়ে গেলেন, ইরতেনসেনুও কিছুটা এগিয়ে এল। সে সামনের দিকে ঝুঁকে ফারাওকে অভিবাদন জানানোর আগেই হাতসেপসুত তাকে বুকে টেনে নিলেন। আলিঙ্গন করে বললেন, ‘মিশরের মেয়ে তার জন্মভূমিতে ফিরেছে কত বছর পর। তোমায় আলিঙ্গন করে আমার বুকটা জুড়িয়ে গেল। মনে হচ্ছে কত মাস পর যেন স্বস্তি পেলাম।’
‘আমারও মনে একই রকমের আনন্দ হচ্ছে ফারাও। গতকাল দেশের মাটিতে পা রেখে প্রাণ ভরে তার সুগন্ধ নিয়েছি। আজ সকালে নীলনদের জলে মুখ ভিজিয়েছি। মনে হল যেন পাঁচ বছর নয়, মাত্র কয়েকদিনের জন্য এই দেশ থেকে দূরে ছিলাম আমি।’
ইরতেনসেনুর চিবুকে হাত রেখে তার কপালে চুমু খেলেন ফারাও হাতসেপসুত। তারপর অগস্ত্যর দিকে চাইলেন। অগস্ত্য স্মিত হেসে রানিকে অভিবাদন জানালো। রানিও তার অভিবাদন গ্রহণ করলেন, ‘আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ অগস্ত্য। আমার পত্র পেয়েই আপনারা চলে এসেছেন। আমি আপনার কাছে চিরঋণী থাকব।’
‘ঋণ তো আমার ফারাও। আপনার শহরের শ্রেষ্ঠ রত্নটিকে আপনি আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। সেই ঋণ পরিশোধ করার ক্ষমতা আমার নেই। আমাকে আসতেই হতো।’
এবার অগস্ত্য তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা উপল এবং সিথারকে দেখিয়ে বলল, ‘এই যুবকটি আমার প্রাণপ্রিয় বন্ধু উপল। এইই আমাদের জলপথে মাত্র বারোদিনে এই দেশে এনেছে। উপলের মতো নাবিক ভারতবর্ষে হয়তো আর দুটি নেই। উপল আমার নিজের ভাইয়ের মতো। আর ইনি হলেন সিথার। ইনি আপনার রাজত্বের এক কর্মচারী, নেকেসিয়ার বন্দরের পালক। সিথার আমাদেরকে বন্দর থেকে আপনার প্রাসাদে নিয়ে এসেছেন।’
হাতসেপসুত বললেন, ‘অতি উত্তম। সিথার আপনার কাজের যোগ্য পারিশ্রমিক আপনি পাবেন। এইখানে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন, আপনার উপঢৌকন প্রাসাদের ভিতর থেকে আসবে।’
সিথার আনন্দে তখন কেঁদে ফেলেছিল। ফারাওয়ের দর্শন মিশরীয়দের কাছে ঈশ্বর দর্শনের সমান। তারপরে স্বয়ং ফারাওয়ের কাছ থেকে পুরস্কার পাওয়া! গতকাল সকালে ঘুম থেকে ওঠার সময়ও সিথার ভাবেনি তার সঙ্গে এমন অত্যাশ্চর্য ঘটনা ঘটবে। সে কাঁপা গলায় ফারাওয়ের নামে জয়ধ্বনি করল। ফারাও এবার ইরতেনসেনুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোমরা ভিতরে চলো। এতটা পথ অতিক্রান্ত করে নিশ্চয়ই ক্লান্ত। সামান্য বিশ্রাম করো আগে।’
ফারাও হাতসেপসুতের পাশে ইরতেনসেনু এবং তার পিছন পিছন অগস্ত্য এবং উপল প্রাসাদের ভিতরে প্রবেশ করল। প্রাসাদে ঢোকার আগে আবার রক্ষীর কাছে গিয়ে উপল নীচু স্বরে বলল, ‘কেমন দেখলে হে, ভিতরে গিয়ে ফারাওকে বলব নাকি তুমি আমাকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিলে?
রক্ষীটি এবার সকরুণ দৃষ্টি নিয়ে চাইল উপলের দিকে। কিন্তু উপল পরক্ষণেই মুখ ফিরিয়ে নিয়ে গুনগুন সুর করতে করতে হাতসেপসুতের প্রাসাদের ভিতরে প্রবেশ করল।