১০। দেশে-বিদেশে

১০. দেশে-বিদেশে

আমি একজন বিশ্ব নাগরিক,
প্রত্যেক নাগরিক আমার আত্মীয়স্বজন।

.

আমার পেশাগত জীবনের পুরো কালপর্বে সদাসর্বদা জাতীয় কাজে ব্যস্ত থাকায় আমার হাতে বিদেশ ভ্রমণ করার সুযোগ হয় নি। যা হোক,দেশের ফার্স্ট সিটিজেন হিসাবে ভারতে আসা রাষ্ট্রপ্রধানদেরকে স্বাগত জানানো এবং তাদেরকে সরকারিভাবে সম্মানিত করাটাই নিয়ম। বিদেশি ডেলিগেটরা সফরে এলে তাদের প্রতি আতিথেয়তা প্রদর্শনের জন্য রাষ্ট্রপতিভবনের উদ্দীপনাময় টিমের কাজ বেড়ে যায়। আমাকেও তাদের সফর সম্বন্ধে সবচেয়ে সচেতন থাকতে হয়েছিল। আমাদের উপকারের জন্য আমাদের যোগ্যতাকে তাদের সামনে তুলে ধরা কর্তব্য। এজন্য ওয়ার্ল্ড নলেজ প্লাটফরম এর ধারণা অর্জন করার প্রয়োজন ছিল। আমি এই জ্ঞান অর্জনের জন্য বিশেষজ্ঞ ও উচ্চপদস্থ অফিসারদের সাথে আলোচনা করেছিলাম। আমরা সফরকারীদেরকে ভারতের আইটি, ই-গভার্ন্যান্স ও ফার্মাসিটিউক্যালের যোগ্যতা প্রদর্শন করতাম। আমি খুশি ছিলাম প্রত্যেকটা মিটিং এবং সফরে আমাদের দ্বিপাক্ষিক কিংবা বহুপাক্ষিক প্রকল্পের পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে আলোচনা হয়েছিল।

বিদেশে প্রত্যেকটা সফরই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সুদান সফরকালে আমার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল দেশটির দক্ষিণ ভাগ রাজধানী খাতুম থেকে একটা অয়েল পাইপলাইন স্থাপনের জন্য প্রায় এক বিলিয়ন ডলার মূল্যের চুক্তি সম্পর্কে। আজ সুদান থেকে পাইপলাইনের সাহায্যে তেল ভারতে আসছে। ইউক্রেনে একটা বড় ধরনের প্রোগ্রাম ছিল। এই সফরে মহাশূন্য সহায়তা সম্পর্কে আগাম কথাবার্তা হয়। যা হোক, আমি মাত্র কয়েকটা সফরের সংক্ষিপ্তসার এখানে তুলে ধরবো। আমি ২০০৪ এর সেপ্টেম্বর এ সাউথ আফ্রিকা সফরে যাই। প্রেসিডেন্ট থাবো এমবেকি আমাকে প্যান আফ্রিকান পার্লামেন্টে ভাষণ দেবার জন্য অনুরোধ করলেন। জোহান্সেবার্গে তিপান্নটি আফ্রিকান দেশ এখানে প্রতিনিধিত্ব করছিল। আমি আনন্দের সাথে তার অনুরোধ গ্রহণ করলাম। আমি আমার টিমের সাথে মিলিতভাবে আমার বক্তৃতার খসড়া করলাম। ওখানে তুলে ধরলাম ভারতের কোন কোন যোগ্যতার অংশীদার আফ্রিকান জাতিগুলোকে করতে পারি। ফলশ্রুতিতে আফ্রিকান জাতিগুলোর সাথে আমাদের একটা নেটওয়ার্ক গড়ে উঠলো। বারটা ইউনিভার্সিটি ও সতেরোটি বিশেষায়িত হাসপাতাল কে ভারত থেকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য সেবা, এবং ই-গভার্নান্স সেবা গ্রহণের প্রস্তাব দিল। প্রাথমিকভাবে বিশেষজ্ঞরা ই-গভার্ন্যান্স নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার জন্য ৫০ মিলিয়ন থেকে ১০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ের একটা এস্টিমেট প্রদান করলো। প্যান আফ্রিকান পার্লামেন্টে প্রস্তাব পাঠানোর আগে আমি প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এর কাছে ব্রিফ পেশ করলাম। তিনি অনুধাবন করলেন যে প্রস্তাবটাতে ভারত সম্পর্কে আফ্রিকায় একটা ফোকাস পড়বে এবং এর ফলে প্যান আফ্রিকান দেশগুলোর সাথে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ সহযোগিতা প্রতিষ্ঠিত হবে।

প্যান আফ্রিকান ই-নেটওয়ার্ক এখন একটা সুপ্রতিষ্ঠিত অর্জন। ভারত সরকার ২০০৯ এর ফেব্রুয়ারিতে আনুষ্ঠানিকভাবে এই সেবা উদ্বোধন করে। আজকের দিনে ই-নেটওয়ার্ক আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সামাজিক দায়িত্বশীল পরিসেবা হিসাবে বিবেচিত।

.

আমার মনে পড়ে ২০০৬ এ ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের প্রেসিডেন্ট জোসেপ বোরেল ফন্টলেস রাষ্ট্রপতিভবনে আমার সাথে মিলিত হন। আমাদের আলোচনার প্রাক্কালে বিষয়টা সম্বন্ধে দীর্ঘক্ষণ তিনি আমার সাথে কথাবার্তা বলেন। বিষয়টা আমার মনে ধরে। ওই আলোচনাটা নাগরিকদেরকে আলোকিত করে গড়ে তোলা বিষয়ক ছিল। আমার ওয়েবসাইট থেকে বিষয়টা সম্বন্ধে তিনি অবগত হন। বিষয়টির উপর আমাকে তিনি অসংখ্য প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেন। তার প্রশ্নগুলো চিন্তাভাবনায় পূর্ণ, গভীর আর কাজের ছিল। আমাদের আলোচনা শেষে তিনি আমাকে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে ভাষণ দিতে আহবান জানান। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সাতাশটি দেশের ৭৮৫ জন সদস্য এই পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্ব করছিলেন। তারা ছিলেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সরাসরি নির্বাচিত সদস্য। তিনি আমাকে বললেন তার প্রেসিডেন্টের মেয়াদ ২০০৬-এর ডিসেম্বরে শেষ হবে। একারণে তিনি ২০০৬ শেষ হবার আগেই বহু সংখ্যক কমিটমেন্ট রেখে যেতে চান। তিনি আরো জানালেন যে ২০০৭ এর এপ্রিল পর্যন্ত তিনি তার বক্তব্য শেষ করতে পারবেন না। ওই সময় ফন্টলেস এর কাছ থেকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন হান্স গার্ট পোট্টারিং।

আমার ভাষণ টি ছিল বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আমার সফরের আগেই অমি বিশেষভাবে প্রস্তুতি নিয়ে ছিলাম বন্ধুবান্ধব, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, বিজ্ঞানী এবং তরুণদের সাথে মতবিনিময় করে। আমি এই উপলক্ষ্যে আমার লেখা ‘ম্যাসেজ ফ্রম মাদার আর্থ’ কবিতাটিকেও আমার ভাষণের মধ্যে সংযোজিত করেছিলাম। কবিতাটিতে প্রতিফলিত হয়েছিল ইউরোপিয়ান জাতির কথা, যার মধ্যে তারা একে অপরের সঙ্গে অনেক নিষ্ঠুর লড়াইয়ের কথা উঠে এসেছিল। আর তারাই সকল সদস্য রাষ্ট্র অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সমৃদ্ধি, সুখ শান্তির মাধ্যমে এক সময় ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। এটা অবশ্যই ওই এলাকার অগ্রযাত্রায় অনুপ্রেরণা স্বরূপ ছিল।

আমি ২৫ এপ্রিল সকালে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পার্লামেন্টে পৌঁছালে প্রেসিডেন্ট ও তার সহকর্মীরা আমাকে স্বাগত জানালেন। ৭৮৫ জন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রতিনিধি এবং কানায় কানায় ভরা ভিজিট’স গ্যালারী দেখে আমি আপ্লুত হলাম।

আমার ভাষণের শিরোনাম ছিল ‘ডায়নামিকস অব ইউনিটি অব নেশনস’, যাতে সভ্যতার সাথে তাল মিলিয়ে চলার উপর গুরুত্ব দেবার কথা ছিল। সভ্যতার সংকটের পরিবর্তে ভারতের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার কথা আমার ভাষণে আমি ব্যক্ত করেছিলাম। আমার ভাষণে তুলে ধরেছিলাম আলোকিত নাগরিকত্বের বিবর্তনের কথা, যার মধ্যে তিনটি উপাদান ছিল : মূল্যবোধ সম্মত শিক্ষা ব্যবস্থা, ধর্মকে আধ্যাত্মিক অনুষঙ্গে রূপান্তর, জাতীয় উন্নয়নের মাধ্যমে সামাজিকিকরণ। আমি আরো বলেছিলাম ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের উদ্দীপনার কথা। মাঝে মাঝে করতালি দিয়ে আমার বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়েছিলেন শ্রোতারা। আমার ভাষণের শেষে আমার লেখা ‘মাতৃভূমির বার্তা’কবিতাটি সমস্ত সদস্যের অনুমতি নিয়ে আবৃত্তি করেছিলাম।

মাতৃভূমির বার্তা

সুন্দর পরিবেশ চালিত হয়
সুন্দর মনগুলোর দিকে;
সুন্দর মনগুলো জন্ম দেয়
সতেজতা আর সৃজনশীলতাকে।

স্থল আর সমুদ্রের সৃজনকারী আবিষ্কারকরা
সৃজিত মনগুলো নতুনকে আবিষ্কার করে
সৃজিত মহান বৈজ্ঞানিক মনগুলো
সৃজিত হয় যে কোনো স্থানে, কেন?

জন্ম দেয় বহু আবিষ্কার
একটা মহাদেশ আর অচেনা জমিন আবিষ্কৃত হয়,
অপ্রত্যাশিত পথগুলো প্রকাশমান হয়,
সৃজিত হয় চলার নতুন পথ

উত্তম মনগুলোতে
নিকৃষ্টতমেরও জন্ম হয়েছিল
যুদ্ধ আর ঘৃণার বীজগুলোকে ছড়াতে
শত শত বছরের যুদ্ধ আর রক্তে।

লক্ষ লক্ষ আমাদের বিস্ময়কর শিশু,
জীবন হারিয়েছিল জলে ও স্থলে;
বহু বহু দেশ অশ্রুর বন্যায় ভেসেছিল,
অনেকেই দুঃখের সাগরে ডুবে গিয়েছিল।
তারপর, এক সময়ে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের রূপকল্প এলো,
শপথ নিল,
মানবিক জ্ঞান থেকে কখনো ফিরে যাওয়া আর নয়,
আর নয় একে অপরের বা নিজেদের মধ্যে লড়াই।

তাদের চিন্তাভাবনায় একতাবদ্ধতা
কাজ আর কাজে ব্যাপৃত হওয়া।
ইউরোপকে সমৃদ্ধ আর শান্তিময় করে গড়ে তুলতে
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের জন্ম।

ওই সমস্ত আনন্দের সংবাদে মুগ্ধ
সবখানের লোকজন।
ওহ! ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, তোমাদের রূপকল্প
ছড়িয়ে দাও সর্বত্র, আমাদের বাঁচিয়ে রাখো বাতাসকে ভালোবেসে।

.

কবিতা আবৃত্তি শেষ হবার পর পার্লামেন্টের প্রত্যেক সদস্য স্বতস্ফুর্তভাবে আমাকে অভিনন্দিত করায় আমার হৃদয় আপ্লুত হলো। তাদের প্রশংসা আমি আমার জনগণের উদ্দেশ্যে নিবেদন করলাম। তাদের অভিনন্দনের জবাবে আমি ভারতের কোটি কোটি জনগণের শুভেচ্ছা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশগুলোর নাগরিকদের উদ্দেশ্যে জ্ঞাপন করলাম। আমার ভাষণের পর প্রেসিডেন্ট পোট্টারিং যা বললেন তা এখানে উদ্ধৃত করছি।’মি.কালাম প্রেসিডেন্ট আব্দুল কালাম, ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের পক্ষ থেকে আমি আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি আপনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্দীপনাময় ভাষণ দেবার জন্য। আমরা একজন রাষ্ট্রপ্রধান, বিজ্ঞানী আর একজন কবির কাছ থেকে এই অসাধারণ বক্তৃতা শুনতে পেলাম, যা চমৎকার। মহান দেশ ভারতকে শুভেচ্ছা। আমাদের আন্তরিক শুভেচ্ছা মহান দেশ ভারত আর ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মধ্যে সহযোগিতাকে। সর্বান্তকরণ থেকে মি. প্রেসিডেন্টকে শুভকামনা রইলো।’

আমার ভাষণের পরে অনেক সদস্য আমার ভাষণে সুনির্দিষ্ট বিষয়ের উপর আমার সাথে আলাপ করতে চাইলেন। তাদের একটা সাধারণ ধারণা জন্মালো যে ভারত একটা মহান দেশ। মানবিক মূল্যবোধে দেশটি ঋদ্ধ।

সারা পৃথিবীর মানুষের মনে ঐক্যের বাণী পৌঁছে দেবার লক্ষ্যে আমার বিবেচনায় ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পার্লামেন্টে আমার ভাষণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অনেক দেশে আমার ভাষণ থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছে। ইউটিউব সহ অসংখ্য ওয়েবসাইটস এর মাধ্যমে গ্লোবাল দর্শকদের কাছে আমার ভাষণ পৌঁছে যায়।

ভারতে ফিরে আসার পর আমি পার্লামেন্টে ভাষণ দিয়ে আমাদের দেশের কিছু সংখ্যক মিশনে যেমন এনার্জি ইনডিপেনডেন্স ও বিল্ডিং নলেজের উপর ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কাজ করার ইচ্ছার কথা জানালাম, যাতে ভারত এই সমস্ত বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারে।

.

আমি গ্রিসে গিয়ে সক্রেটিস কেভ এ বিশেষ সফরে যেতে মনস্থ করলাম। লোকজন খুব কমই এই কেভ দেখতে যায় কারণ এটা একটা পার্বত্য এলাকার দুর্গম স্থানে অবস্থিত। আমার অনুরোধে, আমার সফরের আয়োজন করা হলো। আমি ওখানে গিয়ে ম্লান আলোতে গুহাটা দেখলাম। মাত্র কয়েক মিনিট ওখানে ছিলাম। আমার মনের মধ্যে এক ধরনের ধ্যানগম্ভীর ভাব বিরাজ করছিল। আমি ভেবে বিস্মিত হলাম বিশ্বের মহানতম চিন্তানায়কদের মধ্যে অন্যতম হয়েও কেন তাকে বিষ খায়িয়ে হত্যা করা হয়েছিল। আমার স্মরণ হলো তার জীবনের চেয়েও তার বাণী ছিল গুরুত্বপূর্ণ। হঠাৎ করে গুহাটাতে অন্ধকার নেমে এলেও যে কেউ তার রেখে যাওয়া আলো দেখতে পাবে যুগ যুগ ধরে।

.

২০০৫ সালে আমি সুইজারল্যান্ড সফর করি। বিমানবন্দরে নামার পর একটা বিস্ময় আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। বিমান বন্দরে ভাইস প্রেসিডেন্ট আমাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বললেন যে আমার সফর উপলক্ষে ২৬ মে ২০০৫ তারিখকে সায়েন্স ডে উদযাপন করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এটা সুইস সরকারের অপ্রত্যাশিত একটা সিদ্ধান্ত। আমি প্রেসিডেন্টের সাথে দেখা করে এজন্য ধন্যবাদ জানালাম। তিনি আমাকে জানালেন যে আমার ‘ইগনাইটেড মাইন্ডস এবং ইন্ডিয়া ২০২০ এই দু’খানা বই পড়েছেন। তিনি তার ক্যাবিনেটকে স্পেস ও ডিফেন্স সায়েন্সে আমার অবদানের কথা জানালেন। সায়েন্স ডে ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে আমার সফরসূচি দীর্ঘতর করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। আমি সেখানকার সায়েন্টিফিক ল্যাবরেটরিগুলো পরিদর্শন করার এবং রিচার্স স্টুডেন্ট ও শিক্ষাবিদদের সাথে মিলিত হবার সুযোগ পেলাম। আমি জুরিখের সুইস ফেডারেল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতেও গেলাম, জার্মানি থেকে এসে ওখানেই আইনস্টাইন প্রথম পড়াশুনো করেন। আমি সেখানকার বোস আইনস্টাইন ল্যাবরেটরি দেখতে যাই। ওখানে ছয়জন ছাত্র বোস আইনস্টাইন থিওরির উপর কাজ করছিলেন। সেখানকার ফ্যাকাল্টি ও ছাত্রছাত্রীদের কাছে ভাষণ দেবার সুযোগ পেলাম। আমি সেখানে ‘টেকনোলজি এন্ড ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট’ এই টপিক এর উপর আমার বক্তব্য পেশ করলাম। আমি স্যার সি.ভি রামন-এর এক্সহোরটেশন টু স্টুডেন্টস-এর উপর বক্তব্য দিয়ে আমার কথা শেষ করি। ‘আমাদের প্রয়োজন বিজয় অর্জনের জন্য উদ্দীপনা। উদ্দীপনাই আমাদেরকে সঠিক স্থানে পৌছে দেবে। আমাদের সঠিক গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য উদ্দীপনার প্রয়োজন।’

.

আমি নেলসন ম্যান্ডেলার কথা বলা থেকে বিরত থাকলে ঠিক হবে না। ২০০৪ এ আমি নেলসন ম্যান্ডেলার সাথে দেখা করি। তার মতো ব্যক্তিত্বের কাছে আমি দুটো বড় ধরনের শিক্ষা লাভ করি। অদম্য উদ্দীপনার ও ক্ষমা করার গুণ।

কেপ টাউন তার টেবল পর্বতের জন্য বিখ্যাত। তিনটা চূড়ার নাম টেবল পিক, ডেভিল পিক ও ফেক পিক। দিনের বেলা চূড়াগুলোর অপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়। পাহাড় চূড়ায় ছেড়াছেড়া মেঘের আনাগোনা, মাঝে মাঝে কালো, মাঝে মধ্যে সাদা সাদা মেঘ। আমরা কেপ টাউন থেকে হেলিকপ্টারে চড়ে রোবেন দ্বীপ দেখতে গেলাম। দ্বীপটিতে পৌঁছিলে ড. ম্যান্ডেলার সাথের সহবন্দি সাউথ আফ্রিকার আহমেদ কাথার আমাকে স্বাগত জানালেন। আমি ছোট্ট রুমটি দেখে বিস্মিত হলাম। ড. ম্যান্ডেলার মতো ছয় ফুট লম্বা মানুষটি ছয় বছর ওই রুমটাতে কারাবন্দি থেকে সংগ্রাম চালিয়ে যান। তার জীবনের দীর্ঘ সময় ওই দ্বীপে কাটে। বস্তুতপক্ষে, তিনি বন্দিশালায় বসে তার বিখ্যাত বই লং ওয়াক টু ফ্রিডম বইটি রচনা করেন।

তার সাথে দেখা করা আমার জন্য একটা বড় ঘটনা ছিল। তার সাথে করমর্দন করে আমি যেন একটা মহান আত্মার স্পর্শ অনুভব করলাম। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে তার হাতের ছড়িটা ছেড়ে দিলেন। আমি তাকে হাত দিয়ে ধরলাম। আমি তার থেকে দুটো শিক্ষা অর্জন করলাম।

.

আমার ছোটবেলার স্মৃতি মনে পড়ে। ট্রেনের সাথে আমার সম্পৃক্ততা ছোটবেলা থেকেই। আমি ছোটবেলা ট্রেন থেকে সংবাদপত্র সংগ্রহ করে রামেশ্বরম শহরে বিলি করার ব্যবস্থা করতাম। দেশগ্রাম দেখা আর তার ঘ্রাণ নেবার জন্য ট্রেন ভ্রমণ অতি উত্তম। কুয়াশায় চারদিক ঢেকে থাকলে মাঠের প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী ও গ্রামগুলো যেন ট্রেনের কাছে চলে আসতো। আমার কাছে ট্রেন ভ্রমণ ছিল অতি প্রিয়। আমি প্রেসিডেন্টাল ট্রেন চালু করার সিদ্ধান্ত নিলাম।

দুটো কোচের একজোড়া মিলিয়ে প্রেসিডেন্টাল সেলুন, যা রাষ্ট্রের প্রধানের জন্য সংরক্ষিত। কোচে একটা ডাইনিংরুম, একটা ভিজিটিংরুম, একটা লাউন্স রুম, একটা কনফারেন্সরুম আর প্রেসিডেন্টর জন্য একটা বেডরুম। সেখানে আরো ছিল একটা কিচেন আর প্রেসিডেন্টের সেক্রেটারি ও স্টাফদের জন্য চেম্বার। রেলওয়ে স্টাফদেরও থাকার ব্যবস্থা ছিল। কোচগুলো দামী আসবাবপত্র আর সিল্কের কুশন দিয়ে সুসজ্জিত করা হয়েছিল।

কোচগুলো ১৯৬০ থেকে ১৯৭০ এর প্রথম পর্যন্ত চলতে দেখা গিয়েছিল। সে সময় একটা রীতি চালু হয়ে গিয়েছিল প্রেসিডেন্ট তার মেয়াদ শেষ করার পর দিল্লি থেকে যাত্রা করে তার ইচ্ছে মত যে কোন স্থানে যাত্রা করতেন। ১৯৭৭ এ নীলম সঞ্জীব রেড্ডি এভাবে শেষ ট্রেন যাত্রা করেন। তারপর থেকে নিরাপত্তাজনিত কারণে কোচগুলোকে ব্যবহার করা না হলেও ট্রেনগুলোকে যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করার কাজ চলে আসছিল। আমি ছাব্বিশ বছর পর ২০০৩ এর ৩০ মে তে হরনাথ থেকে পাটনা পর্যন্ত ৬০ কিলোমিটার ট্রেন ভ্রমণ করি। কোচগুলোকে আধুনিক সরঞ্জামে সাজানো হয়। স্যাটেলাইট ভিত্তিক যোগাযোগ ব্যবস্থাও কোচগুলোতে সংযোজিত হয়।

আমি আরো দুটো ট্রেন ভ্রমণ করেছিলাম। একটা ছিল ২০০৪ এ চন্ডিগড় থেকে দিল্লি পর্যন্ত। তৃতীয় ট্রেন ভ্রমণ যাত্রা ছিল ২০০৬ এ দিল্লি থেকে দেরাদুন পর্যন্ত। হরনাথ থেকে পাটনা পর্যন্ত ট্রেন যাত্রার বহুমুখী উদ্দেশ্য ছিল। আমি হরনাথে রেলের একটা ওয়ার্কসপের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করি। রেলওয়ে মিনিস্টার নিতিশ কুমার এতে খুবই খুশি হন। তার নিজের রাজ্যে রেলের অনেকগুলো কমপ্লেক্স স্থাপন করতে দেখে সকলেই হেসেছিল।

আমি আমার ভাষণে হরনাথের শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলাম যে আমি একটা প্রাচীন ঐতিহাসিক সাইট নালন্দা থেকে অনেক কিছু জানতে এসেছি। আমি আশা করেছিলাম বিহারের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়কে নতুনভাবে পুনোরুদ্ধার করা হবে, সেখান থেকে পৃথিবীতে ছড়িয়ে যাবে শান্তির বাণী।

ওই ট্রেন জার্নিটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বিহারের পনেরোটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরদের আমি ট্রেন ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানিয়ে ছিলাম। তাদের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সমস্যাদি নিয়ে এক ঘন্টা আলোচনা করেছিলাম। আমি তাদের কাছে জোর দিয়ে বলেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এমন কোর্স চালু করতে হবে যাতে রাজ্যগুলোর উন্নয়ন ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সমস্যা দূর করার জন্য বিহারের গভর্নর বিশেষ আগ্রহ দেখান। দু’বছর পরে আমি দেখতে পাই বিহারের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্যালেন্ডার ভিত্তিক পরীক্ষা চালু হয়েছে।

ট্রেন ভ্রমণের একটা আনন্দদায়ক পাদটিকা। পাটনা রেলওয়ে স্টেশনে আমি রাষ্ট্রীয় জনতা দলের নেতা লালুপ্রসাদ যাদব এবং জনতাদল (ইউনাইটেড) এর নেতা নিতিশ কুমার কে দেখতে পেলাম, তারা আমাকে স্বাগত জানাতে এসেছেন। তারা উভয়ে আলাদা আলাদা পথের মানুষ। আমি ট্রেন থেকে নামামাত্র দুই রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে একসাথে দেখলাম। তাদেরকে পরস্পরের সাথে করমর্দন করতেও দেখলাম। স্টেশনে উৎফুল্ল জনতার জমায়েত চোখে পড়লো।

২০০৪ এর ৫ জানুয়ারি চিলড্রেন’স সায়েন্স কংগ্রেস উদ্বোধন করতে আমি চন্ডিগড় যাই। আমি ওখানকার সায়েন্টিফিক কমুনিটিতেও ভাষণ দেই। গুরুত্বপূর্ণ কাজ থাকায় ৬ জানুয়ারি আমি দিল্লিতে ফিরে আসি। অতি প্রত্যুষে কুয়াশার আশংকা থাকায় সঠিক সময়ে দিল্লিতে ফিরবার জন্য আমাকে ট্রেনে আসতে হয়। সায়েন্স কংগ্রেসের উদ্বোধন করায় আমি বিশেষভাবে আনন্দিত হই। দেশের সারা অংশ থেকে প্রায় এক হাজার ছাত্রছাত্রী তাদের প্রজেক্ট নিয়ে ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিল।

২০০৬ এ আমি তৃতীয়বার ট্রেনে ইন্ডিয়ান মিলিটারী একাডেমীর প্যারেড অনুষ্ঠানে সালাম গ্রহণ করার জন্য দেরাদুন যাই। সময়টা শীতকাল হওয়ায় সকালে কুয়াশা হলে সঠিক সময়ে পৌঁছানো অনিশ্চিত হতে পারে ভেবে বিমানে না গিয়ে ট্রেনে যেতে হয়। রাতেও বেশ কুয়াশা ছিল। ট্রেন সফদার জং স্টেশন থেকে কোথাও না থেমে দেরাদুন পৌঁছে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ নিরাপত্তা বিধানের জন্য বেশ কয়েকটা চেকপোস্ট তৈরি করে।

উৎফুল্ল স্নাতক উপাধিধারী অফিসারদের সাথে মিলিত হতে পেরে আমি আনন্দিত হলাম। অনেক স্নাতক অফিসার আমাকে প্রশ্ন করলেন প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে ভারত কি ধরনের অগ্রগতি করতে যাচ্ছে। সীমান্ত সংলগ্ন কয়েকটা নর্থদান ইউনিটস এ একটা সফরের সময় এক দল অফিসারদের সাথে আমি মিলিত হয়েছিলাম। সীমান্তের ওপারের পাকিস্তানী আর্মি পারসোনেল আমার এই সফরের প্রতি লক্ষ্য রেখেছিলেন। আমি সেখানে বিভিন্ন ইউনিটের দু’শত তরুণ অফিসারদের সামনে বক্তব্য রেখেছিলাম। আমার বক্তব্য দেবার পর বাদা খান্না এর উদ্দেশ্যে রওনা হবার আগে আমি তরুণ অফিসারদের কাছে একটা প্রশ্ন রেখেছিলাম। আমি বললাম, ‘প্রিয় তরুণ অফিসারবৃন্দ, তোমাদের সামনে সেনা বাহিনীর সার্ভিসের তিরিশ বছরের চেয়েও বেশি সময় পড়ে আছে, তোমরা কি আমাকে বলতে পার, তোমরা একজন অফিসার হিসাবে কোন অনুপম মিশন সম্পাদন করতে পছন্দ করো।’ সিনিয়র অফিসাররা নীরব ছিল কিন্তু তরুণ অফিসাররা হাত তুললো। আমি একজন অফিসারকে জবাব দেবার জন্য বেছে নিলাম। আমাকে সালাম জানিয়ে অফিসারটি বললো, ‘স্যার, আমার একটা স্বপ্ন আছে। সেই স্বপ্নটা হলো আমার জাতির যে সমস্ত জমিন অন্যেরা দখল করে রেখেছে সেইগুলো ফিরে পাওয়া।’ সবার মধ্যে যেন বিদ্যুত প্রবাহিত হয়ে গেল। প্রত্যেকেই তরুণ অফিসারটিকে অভিনন্দন জানালো। আমি স্নাতক উপাধি প্রাপ্ত তরুণ অফিসারদের কাছে সেই তরুণ অফিসারের দেওয়া উত্তরটার কথা জানালে সেখান থেকেও একই জবাব এলো। ‘আমরাও অবশ্যই ওইটাই করবো, স্যার।’ এইসব কারণে ট্রেন জার্নিটা আমার স্মৃতিতে গাঁথা হয়ে আছে।

[আমি সুদানে সবচেয়ে সুন্দরতম একটা দৃশ্য দেখেছিলাম, যেখানে ব্লু নাইল আর হোয়াইট নাইল এক জায়গায় মিলিত হয়ে সঙ্গমস্থলে আলাদা একটা রঙে পৃথক নদীতে রূপান্তরিত হয়েছে। একই রকম থাকলেও লোকজনদের সাথে মিলিত হয়ে আমরাও পরিশুদ্ধ হই।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *