১. বঙ্গভাষা ও বঙ্গলিপি ১০০০ বৎসরেরও অনেক পূর্ব্ববর্ত্তী
বঙ্গভাষা কোন্ সময়ে উৎপন্ন হইয়াছে তাহা নিশ্চয়রূপে নির্দ্ধারণ করা সম্ভবপর নহে। ইতিহাসের পৃষ্ঠায় যেমন কোন ধর্ম্মবীর কি কর্ম্মবীরের আবির্ভাব-সময় সম্বন্ধে অঙ্কপাত দৃষ্ট হয়, পাঠকগণের মধ্যে হয় ত কেহ কেহ এই অধ্যায়-ভাগে সেইরূপ একটা খ্রীষ্টাব্দ কি শতাব্দের প্রত্যাশা করিতেছেন; কিন্তু ভাষার উৎপত্তিসম্বন্ধীয় প্রশ্নের তদ্রুপ সহজ উত্তর দেওয়া যায় না। কোন কোন লেখক এই শ্রেণীর পাঠকবর্গের মনোরঞ্জনের জন্য বলিয়াছেন, ‘১০০০ বৎসর হইল, বঙ্গভাষা ও বঙ্গাক্ষরের সৃষ্টি হইয়াছে।’ ললিতবিস্তরে দেখা যায়, বুদ্ধদেব বিশ্বামিত্র নামক অধ্যাপকের নিকট অঙ্গলিপি, ব্রহ্মলিপি, ব্রাহ্মী, সৌরাষ্ট্রী ও মাগধলিপি শিখিতেছেন। ইহা ত খৃষ্ট জন্মিবার পূর্বের কথা। বিশ্বকোষের সম্পাদক শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ বসু মহাশয় কর্ত্তৃক সংগৃহীত ৯৩০ শতকের হাতের লেখা একখানি কাশীখণ্ড আমরা দেখিয়াছি। উহার অক্ষর ‘কুটিল’ অক্ষরের লক্ষণাক্রান্ত প্রাচীন বঙ্গলিপি। সেন-রাজগণের তাম্রশাসনগুলিতে ঐরূপ অক্ষরের ব্যবহার দৃষ্ট হয়; উহা ন্যূনধিক ৮০০ বৎসরের পূর্ব্ববর্ত্তী। এই সকল লিপিমালার পূর্ণাবয়ব দেখিয়া তাহা যে বঙ্গাক্ষর উৎপত্তির অব্যবহিত পরেই উৎকীর্ণ হইয়াছিল, এরূপ অনুমান করা সঙ্গত হইবে না। আমরা পরবর্ত্তী এক অধ্যায়ে ডাক ও খনার বচন সম্বন্ধে আলোচনা করিব। পাঠক দেখিবেন, উহারা সম্ভবতঃ বৌদ্ধ-যুগের বঙ্গভাষার নিদর্শন। এতদ্দেশপ্রচলিত ডাকের বচন অপেক্ষাও প্রাচীনতর বঙ্গভাষায় বিরচিত উক্তরূপ বচনের নমুনা নেপালে পাওয়া গিয়াছে। খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতাব্দীতে বিরচিত কয়েকখানি প্রাচীন বাঙ্গালা-গ্রন্থ সম্প্রতি প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে। বৌদ্ধপণ্ডিত কানুভট্ট-প্রণীত ‘চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়’ দশম শতাব্দীর শেষভাগে বিরচিত হয়। উহা সহজিয়া ভাবের প্রেমগীতসম্বলিত বাঙ্গালা-গ্রন্থ। এইরূপ আর একখানি গ্রন্থের নাম ‘বোধিচর্য্যাবতার’। প্রাচীন বঙ্গভাষার এই দুই নিদর্শন মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিত শ্রীযুক্ত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় নেপাল হইতে উদ্ধার করিয়াছেন। সুতরাং লিখিত বাঙ্গালাই এই সহস্র বৎসরের অপেক্ষা সুপ্রাচীন, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই।