১। মকর সংক্রান্তি

আজ মকর সংক্রান্তি।

পয়োষ্ণী নদীর উপরে গত তিন বছর ধরে যে বাঁধ ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে আজ তার পরীক্ষা। মধ্যগগনে থাকা সূর্যের গনগনে আঁচে পৃথিবীর মাটি তপ্ত হয়ে আছে। মাটির উপরের শিলাখণ্ড, টিলা, পাহাড়ের গায়ে আরও বহুগুণে যেন জমা হয়ে আছে সেই উষ্ণতা। অথচ সেই তাপকে উপেক্ষা করেই মানুষের ঢল নেমেছে আজ। নদী থেকে আধযোজন দূরে পাহাড়ের ঢালে তারা জমা হয়েছে এক আশ্চর্য জাদুকে নিজের চোখে দেখবে বলে।

এমন জাদু এই দেশে আগে কখনও ঘটেছে বলে জানা যায় না। স্বয়ং দেবাদিদেব মহাদেবের হয়তো এমন ক্ষমতা ছিল। কিন্তু দু’জন মানুষ যে এমন আশ্চর্য ঘটাতে পারে এমন কেউ কখনও স্বপ্নেও ভাবেনি। আজ হয় এই জাদু সফল হয়ে মানুষ ঈশ্বরকে স্পর্শ করবে, অথবা প্রলয় নেমে আসবে পৃথিবীর এই ভূমিখণ্ডটির বুকে। ভারতবর্ষ, দু’দিকে পাহাড় আর অন্য দু’দিকে সমুদ্রে ঘেরা এই সুবিশাল ভূমি। এর উত্তরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে হিমালয় পর্বত। তার হিমেল হাওয়া এই ভূখণ্ডের বুকের উপর দিয়ে বয়ে যেতে যেতে মিশে যায় সাগরের আর্দ্রতায়। দেশটির দক্ষিণ-পূর্ব আর দক্ষিণ-পশ্চিমে আছে দুই মহাসাগর, যাদের শেষ কোথায় তা কেউ জানে না। এই দুই সাগরের মাঝে যেন বল্লমের ফলার মতো নেমে এসেছে ভারত ভূখণ্ড।

ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম অংশে দু’হাজার বছর আগে গড়ে উঠেছিল এই পৃথিবীর সভ্যতম, আধুনিকতম জনপদ। হিমালয়ের উপত্যকায় জন্ম নিয়ে পশ্চিমে পাড়ি দেওয়া সিন্ধুনদ আর তার উপনদীরা ছিল এই অঞ্চলে প্রাণের উৎস। সরস্বতী, বিতস্তা, শতদ্রু এদেরকে ঘিরেই সবুজের মধ্যে প্রাণের জয়যাত্রা অব্যাহত ছিল। নদীই মানব সভ্যতার জননী, তার জল, হাওয়ায় জীবন বিকশিত হয়, চাষবাস হয়, গৃহপালিত পশুরা চরে বেড়ায় হরিৎ চারণভূমে।

সিন্ধুর জনপদও এমনই ছিল। এমনকী তারা সরস্বতী নদীর বুকেই ভাসিয়েছিল পালতোলা বড় বড় নৌকা। সেই নৌকারা যেত দূরের দেশগুলিতে বাণিজ্য করতে। কয়েকমাস অথবা কয়েকবছর পর তারা ফিরে আসত সিন্ধুর বন্দরে, তাদের বুকে থাকত ভিনদেশের শস্য, অলঙ্কার, নারী এবং পুরুষেরা।

কিন্তু কালের নিয়ম বড় অদ্ভুত। মানুষ প্রকৃতির দাসমাত্র। আচমকাই একদিন মাটি কেঁপে উঠেছিল। ভয়াবহ সেই কাঁপুনি। মনে হয়েছিল সেই দিন যেন শেষ হয়ে যাবে মানবজাতি আর তার গড়ে তোলা সভ্যতার সকল দিকচিহ্ন। সরস্বতীর তীরে বসতি তৈরি হওয়ার হাজার বছর পরে ভূকম্পন তাকে টলিয়ে দিয়েছিল। সংখ্যার হিসাব না থাকলেও প্রাণহানি হয়েছিল লক্ষাধিক মানুষের।

সেই ভয়ঙ্কর প্রলয় মিটে যাওয়ার পর পৃথিবী যখন শান্ত হল তখন এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটে গেছে, সরস্বতী নদীটি তখন আর নেই। যে খাতে নদী বইছিল সেই খাতে এক প্রকাণ্ড ফাটল। যেন সেই ফাঁক দিয়েই ভূগর্ভস্থ হয়েছেন নদী-মা। এই ঘটনার কয়েক বছরের মধ্যেই সরস্বতীর দু’পাশে থাকা গ্রাম, শহরগুলি নষ্ট হয়ে যেতে থাকল। দুর্ভাগ্য যেন লেগেই ছিল ভারতবর্ষের ললাটে। কোন অজানা কারণে মাটি হয়ে উঠল লবণাক্ত, অনুর্বর। বছরের পর বছর ধরে বৃষ্টি না হওয়ার কারণে শস্য উৎপাদন একপ্রকার অসম্ভবই হয়ে উঠল। যে ঘৃণ্য কাজের জন্য দেবী সিন্ধুর অভিশাপে সিন্ধু সভ্যতা নষ্ট হয়ে গেল তার কথা আজও ভারত ভূখণ্ডের মানুষ ভুলতে পারেনি। আজও এই ভারত ভূখণ্ডের কোনও এক মা তার শিশুটিকে সেই কথা গল্প করে বলার সময় কেঁপে ওঠেন

সিন্ধু সভ্যতা যখন কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে থাকছে তখন মানুষ আরও একবার যাত্রা করল। এবার কিছুটা দক্ষিণের দিকে ততদিনে দেশের মধ্যে বিস্তৃত হওয়া অন্য এক জাতি মিশে গেছে সিন্ধুর আদি নাগরিকদের সঙ্গে। এরা আর্য, এরা ভারতবর্ষের আদি বাসিন্দাদের তুলনায় আকারে এবং প্রকারে অন্যরকম। লম্বায় বেশ কিছুটা বেশি, গৌর বর্ণ, এদের নাক টিকালো, বড় বড় চোখ। বর্তমানে এই আর্যরা ভারত ভূমির নিয়ন্ত্রক। যে নতুন ভারত এখন জাগছে তা ভারত ভূমির শিরঃদেশ থেকে সরে এসে আশ্রয় নিয়েছে তার বুকে। বেশ কয়েকটি আর্য রাজার রাজত্ব তৈরি হয়েছে এখানে। এই নতুন রাজত্বগুলির প্রায় সবক’টিই গড়ে উঠেছে গঙ্গা, যমুনা এবং সরযু নদীর তীরে। এখন এই নদীগুলি দিয়ে হিমালয়ের আশীর্বাদ প্রবাহিত হয়। গোটা বছর নদীগুলিতে জল থাকে পর্যাপ্ত পরিমাণে। ভারতবর্ষের পূর্বদিকে একটি জঙ্গলে ঘেরা অববাহিকায় গঙ্গা এসে মিশেছে সমুদ্রে। এখানে গড়ে উঠেছে কিছু নতুন বন্দর। তবে এখন এই দেশের সবচেয়ে বড় বন্দরটি আছে পশ্চিমে। তার নাম সোপারা।

ভারতবর্ষকে যদি মানবশরীর হিসাবে কল্পনা করা যায়

ভারতবর্ষকে যদি মানবশরীর হিসাবে কল্পনা করা যায় তাহলে তার ডান বাহুর আকারে বেরিয়ে থাকা ছোট্ট অংশটির নীচেই আছে এক বিরাট হ্রদ। লোকশ্রুতি এই যে, এই হ্রদের আকার এতই বড় যে তা স্বয়ং গঙ্গার সমস্ত জল নিজের মধ্যে অনায়াসে ধারণ করতে পারবে। হিমালয় থেকে মাটির নীচের কোন গোপন সুড়ঙ্গ দিয়ে বয়ে আসা জল নাকি এই হ্রদের পুষ্টি যোগায়। এই সুড়ঙ্গ প্রকৃতির এক অজানা খেয়ালে সৃষ্টি। সোপারা হ্রদ থেকে একটি সরু অথচ গভীর খাঁড়ি জন্ম নিয়ে মিশেছে পশ্চিমের সমুদ্রে। তাই এই হ্রদের তীরে জন্ম হয়েছে ভারতের সর্ববৃহৎ বন্দরটি। হ্রদের নামে বন্দরটির নামও সোপারা। দেশের মূল বাণিজ্য চলে এই বন্দরের মাধ্যমে।

তবে আর্যদের বেশিরভাগ রাজ্যগুলি মূলত নদীমাতৃক হলেও একটি এমন রাজত্ব আছে যার প্রাণ কোনও নদী নয়, এক পর্বত। ভারতবর্ষের প্রায় মাঝ বরাবর পূর্ব থেকে পশ্চিমের দিকে বিস্তৃত এই পর্বতমালার নাম বিন্ধ্য। এই পর্বতের চারপাশে যেন এক নিজস্ব জলবায়ু তৈরি হয়েছে। পশ্চিমের সমুদ্রের লবণাক্ত হাওয়াকে বিন্ধ্য আটকায়, আবার হিমালয় থেকে বয়ে আসা ঠান্ডা বাতাস বিন্ধ্যর গায়ে ধাক্কা খেয়ে তার পাদদেশে জমতে শুরু করে। সেই বায়ু ভারী হয়ে এলে যে মেঘের সৃষ্টি হয় তাই এই অঞ্চলের মাটিতে নেমে আসে বৃষ্টিকণার আকারে।

এখানের আবহাওয়া গোটা বছরই নাতিশীতোষ্ণ, আরামপ্রদ। আবার উত্তরের কোশল বা পাঞ্চাল রাজ্যের তুলনায় এই জায়গাটি সোপারা বন্দরের বেশ অনেকটাই কাছে। তাই এখানে জনপদ তৈরি হতে বেশি সময় লাগেনি। এই অঞ্চলে যে রাজত্ব গড়ে উঠেছে তার নাম বিদর্ভ। বিদর্ভের রাজারা এখানে গত দেড়শো বছর ধরে রাজত্ব করছেন। ভারতবর্ষের বুকে প্রতিপত্তিশালী এক নগরী হিসাবে নাম করেছে বিদর্ভের রাজধানী কুন্দিনাপুরী। মগধ, কোশল, অযোধ্যার রাজপরিবারগুলির সঙ্গেও বিদর্ভের বেশ সদ্ভাব রয়েছে। কিন্তু গত পঞ্চাশ বছর যাবৎ বিদর্ভের প্রভাব এবং প্রতিপত্তি প্রবল ভাবে বৃদ্ধি পেলেও সেই সুখ কোথাও গিয়ে যেন সামান্য ক্ষুণ্ণ হচ্ছিল।

তার কারণ দুটি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *