ধর্মের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস – রিচার্ড হলোওয়ে / ভাষান্তর : কাজী মাহবুব হাসান
A little History of Religion – Richard Holloway
প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০২০
ভূমিকার পরিবর্তে
Religion is the most powerful alternative to God.– Richard Holloway
এই বইটি হাতে নেবার জন্য অনেক ধন্যবাদ। এটি মূলত রিচার্ড হলোওয়ে’র ‘এ লিটল হিস্ট্রি অব রেলিজিয়ন’ বইটির বাংলা অনুবাদ। ধর্মতত্ত্বে দীক্ষিত এবং এডিনবরা এপিসকোপাল চার্চের প্রাক্তন বিশপ রিচার্ড হলোওয়ে একজন সুখ্যাত লেখক এবং চিন্তাবিদ। সাধারণত ধর্ম নিয়ে যারা লেখেন তাঁদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব কিছু উদ্দেশ্য থাকে, বিশ্বাসীরা ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে চেষ্টা করেন, অন্যদিকে ধর্মবিরোধীরা ধর্মের দাবিগুলো সন্দেহাতীতভাবেই ভুল প্রমাণ করতে একই পরিমাণ শক্তি খরচ করেন, এবং তাদের দাবি, এই ভুলটি একই সাথে নিষ্ঠুর এবং ক্ষতিকর। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে রিচার্ড হলোওয়ে সতর্ক গুরুত্ব বণ্টন আর পরিশীলিত ভারসাম্যময় বাক্য ব্যবহারে পৃথিবীর ধর্মগুলোর একটি আকর্ষণীয় আর কৌতূহল-জাগানো সংক্ষিপ্ত ইতিহাস রচনা করেছেন। অবশ্যই তিনি কোনো পক্ষ নেননি এবং তাঁর বিজ্ঞ বিশ্লেষণ বইটিতে উল্লেখিত সবকয়টি ধর্মের প্রতি ন্যায়বিচার করতে সক্ষম হয়েছে, একই সাথে তিনি খুব সহজাতভাবেই ধর্মবিশ্বাসের আবেদন আর এর সমস্যাগুলো ব্যাখ্যা করেছেন।
বিশপ হলোওয়ে একজন অজ্ঞেয়বাদী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন ২০০০ সালে, যখন দীর্ঘ চার দশকের কর্মক্ষেত্র, চার্চ থেকে তিনি পদত্যাগ করেছিলেন। এরপর থেকেই স্পষ্টভাবেই ঈশ্বরবিশ্বাস নিয়ে তাঁর দীর্ঘদিনের সংগ্রামের কথা তিনি বলেছেন, বিশেষ করে তাঁর বিখ্যাত স্মৃতিকথা লিভিং আলেক্সান্দ্রিয়া বইটিতে। দীর্ঘদিন থেকে হলোওয়ে বিভিন্ন প্রগতিশীল আন্দোলনের সাথে যুক্ত, যে প্রচেষ্টাগুলো চার্চ এবং রাষ্ট্রের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীগুলোর মানবাধিকার নিশ্চিত করতে কাজ করছে। যৌন-পরিচয়, মাদকাসক্তি এবং জীবনীতিশাস্ত্রের ক্ষেত্রে জটিল নৈতিক বিষয়গুলো নিয়ে প্রশ্ন এবং আলোচনায় তিনি তাঁর ঈর্ষণীয় প্রজ্ঞা ব্যবহার করেছেন একাধিক বই এবং রেডিও-অনুষ্ঠানে। তবে ঈশ্বরে অবিশ্বাস সত্ত্বেও ধর্ম নিয়ে কোনো ক্ষোভ তিনি মনে পুষে রাখেননি, যে ধর্মকে তিনি তাঁর প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের বিশাল একটি অংশ পেশা হিসাবে নিয়েছিলেন।
এই সংক্ষিপ্ত ইতিহাসে যখন বিশ্বব্যাপী বহু হাজার বছরের পরিক্রমায় ধর্মের উত্থান আর (কখনো) পতনের মানচিত্রটি তিনি এঁকেছেন, এর সমান্তরালে তিনি সেই মানব-পরিস্থিতি আর মানসিকতারও অনুসন্ধান করেছেন, যা ধর্মের জন্য মানুষের তীব্র লালসাটিকে প্ররোচিত করেছিল। তিনি লিখেছেন : আমরা এখনও জানতে চাই একটি প্রজাতি হিসাবে আমরা কোথা থেকে এসেছি, এই অকল্পনীয় বিশাল মহাবিশ্বে আমাদের অবস্থান কী, আর ‘একা’ হবার ভয়টি সম্ভবত আমাদের আবেগকে সবচেয়ে বেশি নাড়া দেয়। খুব সরলতম বাক্যে যদি সংক্ষেপিত করা হয়, তাহলে বলা যায়, কিছু আচার আর বিশ্বাসকে ঘিরে সমাজগঠনে কিংবা একজন চূড়ান্ত ন্যায়বিচারকের অস্তিত্ব আছে এমন সান্ত্বনায় অথবা এই জীবনের পরে অন্য একটি জীবনের কল্পনায় ধর্ম আমাদের আশার ক্ষুধা মেটায়।
এই ইতিহাসটির সূচনা ১৩০,০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে–যখন আমাদের পূর্বসূরিদের সমাহিত করার আচারে ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রমাণ মিলেছিল–আজকের সায়েন্টোলজি, সেকুলার মানবতাবাদী এবং ভীতিকর মৌলবাদী অবধি। এর আগে সময়ের এই বিশাল ব্যাপ্তি নিয়ে যারা কাজ করেছিলেন, তাঁরা পরিশেষে সেই ধর্মটিকে বেছে নিয়েছিলেন–যে ধর্মটি তারা সবচেয়ে ভালো জানেন, হয়তো ব্যক্তিগত পছন্দ, প্রতিপালন অথবা সাংস্কৃতিক কারণে একটি বিশেষ শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করতে। কিন্তু হলোওয়ে এই সংক্ষিপ্ত ইতিহাসে তেমন কিছু করেননি, তিনি কোনো পক্ষপাতিত্ব দেখাননি খ্রিস্টানধর্মের নানা শাখার প্রতি, তিনি যেমন একইভাবে প্রামাণিক ছিলেন ইসলাম এবং অ্যাঙলিকানিজমের ক্ষেত্রে। এবং বর্তমানে, মধ্যপ্রাচ্যের মেরুকরণের আবহাওয়ায় ইতিহাসবিদরা প্রায়শই — মুহাম্মদের অধিকাংশ বার্তা মৌলিক ছিল না যখন তিনি ধর্মপ্রচার করতে শুরু করেছিলেন অথবা ইহুদিবাদের কাছে ইসলামের অনেক ঋণ আছে–এই কথাগুলো বলা থেকে বিরত থাকেন, কিন্তু এই বিষয়ে হলোওয়ে কোনো গোঁজামিল দেননি, সুস্পষ্টভাবেই তিনি বলেছেন, মুহাম্মদের বার্তায় কোনো মৌলিকতা ছিল না এবং তিনি এমন কিছু দাবিও করেননি। বরং তার বার্তাটি যা কিছু তারা ভুলে গেছেন সেগুলো স্মরণ করিয়ে দেবার একটি তাগিদ ছিল।
তিনি একইভাবে স্পষ্ট সেই মানুষগুলোর ক্ষেত্রে, যারা স্বর্গীয় মনের একটি ‘নতুন’ অন্তর্দৃষ্টি পেয়েছেন বলে দাবি করেন, এবং তাদের নিজস্ব ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেন (এরা প্রায় সবাই পুরুষ); তিনি লিখেছেন : এভাবে ধর্ম খুবই সস্তা, এবং আধ্যাত্মিকতার বাজারে সবসময়ই আরো একটি ধর্ম যুক্ত হবার জায়গা আছে। কিন্তু পরিস্থিতি ভিন্ন হতে শুরু করে যখন সেই বিশ্বাসটি ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত কাঠামোর জন্যে হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। আর সেটাই, তিনি বলেন, ঘটেছিল প্রথম শতাব্দীতে জেরুজালেমে যিশুর সাথে এবং সপ্তম শতাব্দীতে মুহাম্মদের সাথে মক্কায়। আর এই বিষয়টি ধর্মীয় সহিংসতার বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে এসেছে।
ধর্ম পৃথিবীর সব সহিংসতার কারণ, এমন কিছু ভাবা পশ্চিমে খুব স্বাভাবিক একটি বিষয়। যদিও কিছু বিশেষজ্ঞ জোরালো যুক্তি দিয়েছেন এই দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে, যেমন, তাদের মধ্যে সুপরিচিত ধর্মীয় ইতিহাসবিদ কারেন আর্মস্ট্রং, হলোওয়ের মতো একসময় তিনিও ধর্মের সাথে যুক্ত ছিলেন (ক্যাথলিক নান), যিনি এখন সেটি ত্যাগ করার পর পুরো বিষয়টিকে একটি নির্মোহ দৃষ্টি দিয়ে দেখে থাকেন। তিনি মনে করেন, ঈশ্বরের নামের দাবি করে সহিংসতা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু বাস্তবে সেই সংঘর্ষের কারণগুলো ছিল অন্য রাজনৈতিক, সামাজিক, বর্ণবাদী এবং অর্থনৈতিক। হলোওয়ে এই দৃষ্টিভঙ্গিটি আংশিক মেনে নিয়েছেন, কিন্তু তিনি ধর্মকে এই অপরাধ থেকে দায়মুক্ত করতে অনিচ্ছুক, তিনি তাগাদা দেন এখনও। ইতিহাসের সবচয়ে খারাপতম সহিংসার কারণ হয়েছে এটি, সুতরাং যদি আমরা ঈশ্বর বলতে বোঝাই এই মহাবিশ্বের একজন প্রেমময় দয়াশীল ঈশ্বর, তাহলে তার হয় কোনো অস্তিত্ব নেই অথবা তাকে পুরোপুরিভাবে ভুল বুঝেছে ধর্ম।
অবশ্যই ১৩০,০০০ বছরের ইতিহাসকে সংক্ষেপ করার প্রচেষ্টাটির কিছু সীমাবদ্ধতা আছে; যেমন, খ্রিস্টধর্মের মেথোডিস্ট আর ব্যাপ্টিস্টরা হয়তো মনোক্ষুণ্ণ হয়েছেন, যখন তাদের উপেক্ষা করা হয়েছে এবং অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র ধর্মগোষ্ঠী কোয়েকাররা এই বইয়ে পুরো একটি অধ্যায় পেয়েছেন। একই সাথে বিশ্বাসের জটিল কাঠামোটিকে মূলসারে পরিস্রবণ করতে গিয়ে, যা বহু হাজার বছর ধরে বিবর্তিত হয়েছে, আর সেগুলো সংক্ষিপ্ত আর স্বচ্ছ বাক্যে ব্যক্ত করতে খানিকটা সমঝোতার আশ্রয় তাকে নিতে হয়। আমাদের সময়ে এই বইটির যদি কোনো বার্তা থেকে থাকে, তবে সেটি এসেছিল যখন হলোওয়ে উল্লেখ করেছিলেন, ধর্মের টিকে থাকার অসাধারণ একটি প্রবৃত্তি আছে; তিনি লিখেছেন : এটি সেই কামারের নেহাই যা বহু হাতুড়ি ক্ষয় করেছে। সুতরাং এই ধারণার ভিত্তিতে বলা যায়, আমাদের পূর্বপরিজ্ঞেয় ভবিষ্যতে এটি তার অস্তিত্ব ধরে রাখবে; আর তাদের সম্বন্ধে আরো কিছু জানতে এই আলোকিত বইটির পাতার মতো আর কোনো উত্তম জায়গা নেই।
কাজী মাহবুব হাসান
সেপ্টেম্বর, ২০১৯