০. প্রারম্ভিকা – সামবেদ সংহিতা

প্রারম্ভিকা

০১.

বেদ অপৌরুষেয়, অর্থাৎ কোন মানুষের দ্বারা এটি রচিত নয়। এটি ভগবানের বাণী। বেদেই উল্লেখিত আছে–দেবত্তং ব্রহ্ম গায়ত। এই দেবত্তং পদের অর্থ–দেবতানুগ্রহাল্লব্ধং অর্থাৎ দেবতার অনুগ্রহে বা ভগবান্ থেকে প্রাপ্ত। আবার অন্যত্র বলা হয়েছে–হে দেব! পশুচারণকারীর মতো আমরা, আপনার স্তুতিরূপ বাণীগুলি আপনাকে সমর্পণ করছি। (ভাব এই যে, পশুপালক যেমন পশুর স্বত্বাধিকারীর নিকট হতে গৃহীত পালনীয় পশুগুলিকে সায়ংকালে সেই পশুস্বামীকেই আবার প্রত্যর্পণ করে, সেইরকম হে ভগবন, আপনার নিকট হতে লাভ করে এই সব স্তুতিরূপা বাণীকে আপনাকেই অর্পণ করছি)…। আরও, বেদেই বলা হয়েছে–হে ভগবন! আপনিই আমাদের স্তোত্রমন্ত্র প্রদান করে– সত্যবাকযুক্ত করে–আপনিই সেই স্তোত্রমন্ত্র বা সত্যবাক গ্রহণ করেন। আপনিই মন্ত্রের দাতা, আপনিই মন্ত্রের গ্রহীতা। বলা হয়েছে–বিশ্বেষাং ব্ৰহ্মণা জনিতা ইৎ অসি–অর্থাৎ আপনিই সকল মন্ত্রের জনয়িতা হন। –ইত্যাদি।

তবে দৃষ্টিভেদে বিরুদ্ধ ভাবও প্রদর্শন করা যায়। বেদ থেকেই পরস্পর-বিরোধী দুই মতের প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। বেদ-মন্ত্রেরই ব্যাখ্যান্তরে প্রমাণ করা যায়, –বেদ অপৌরুষেয়; আবার বেদমন্ত্রেই প্রত্যক্ষীভূত হয়–বেদ পৌরুষেয়। কিন্তু আমরা বেদকে যে চক্ষে দেখেছি, তা পুনঃপুনঃ খ্যাপন করেছি। আমাদের মন্ত্ৰার্থই তার প্রমাণ।

প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য–বেদ যে মানুষের রচিত, তা প্রমাণের জন্য পণ্ডিতগণ এ পর্যন্ত বহু গবেষণা প্রকাশ করেছেন। এ পক্ষে ন্যূনাধিক পঞ্চাশটি মন্ত্র প্রমাণস্বরূপ উদ্ধৃত করা হয়। কিন্তু আমাদের মন্ত্রার্থের মধ্যেই আমরা প্রমাণ করেছি, সেগুলির কোনও মন্ত্রেই বেদরচয়িতা ঋষির সম্বন্ধ সপ্রমাণ হয় না।

সুতরাং এ-কথাই স্বীকার্য যে, যাঁরা বেদমন্ত্রগুলির ধারক, অর্থাৎ বেদমন্ত্রের সঙ্গে যে-সব ঋষির নাম উল্লেখিত, তারা সেগুলির দ্রষ্টা, স্রষ্টা নন।

.

০২.

পুরাকালে বেদ একটিই ছিল। ব্রহ্মদত্ত বিপুলায়তন বেদশাস্ত্র কোন ব্যক্তি, এমনকি গোষ্ঠীর পক্ষে মুখস্থ রাখা অত্যন্ত কঠিন ছিল। অথচ সেই আদিমতম কালে, যখন লেখার আবিষ্কারই হয়নি, তখন বিশালায়তন বেদশাস্ত্র মুখস্থ রাখা ছাড়া উপায়ান্তরও ছিল না। (সকলেই জানেন, শ্রবণের দ্বারা অবিকল স্মৃতিগত রাখা হতো বলেই বেদের আর একটি নাম শ্রুতি)। ঋষিদের মধ্যে যাঁর যেমন রুচি ও ক্ষমতা, সেই অনুসারেই নির্দিষ্টসংখ্যক মন্ত্র কণ্ঠস্থ রাখতেন। সুতরাং একত্রে সমগ্র বেদের স্বরূপ সম্পর্কে সম্যক প্রতীতি লাভের কোন উপায় ছিল না। কালক্রমে পদ্মযোনি ব্রহ্মার নির্দেশে শ্ৰীমন্মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন নানা স্তরে নানা ঋষির মধ্যে প্রচলিত বেদমন্ত্রগুলিকে একত্রে সংগৃহীত করেন এবং সেগুলিকে চারভাগে বিভক্ত করে এক একটি শিষ্য বা শিষ্যগোষ্ঠীকে এক একটি বিভাগ প্রদান করেন। (কৃষ্ণদ্বৈপায়ন সেই থেকে বেদব্যাস নামে খ্যাত হন)। সমগ্র বেদের এই চারটি বিভাগীয় রূপ যথাক্রমে ঋক্, সাম, যজুঃ ও অথর্ব নামে অভিহিত হয়। বেদব্যাস তার শিষ্য পৈলকে স্তুতিমূলক মন্ত্রগুলি প্রদান করেন, অর্থাৎ ঋষিবর পৈলের গোষ্ঠীভুক্ত ঋষিবর্গ বংশপরম্পরায় ঋগ্বেদের অন্তর্ভুক্ত মন্ত্রগুলির ধারকরূপে পরিগণিত হন। গীতিরূপ মন্ত্রগুলি লাভ করেন জৈমিনি। এগুলিই সামবেদ সংহিতার অন্তর্ভুক্ত। গীতেষু সামাখ্যা অর্থাৎ যজ্ঞে যে সব মন্ত্র গান করবার জন্য নির্বাচিত ছিল, সেগুলিই সামসংহিতায় বিধৃত। (ব্যাসদেব তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে ও সুমন্তুকে যথাক্রমে যজুর্বেদ ও অথর্ববেদ প্রদান করেন)।

সামবেদের মন্ত্রগুলি প্রায় সম্পূর্ণতঃই ঋগ্বেদের বা ঋমন্ত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত; অর্থাৎ সামবেদের মোট মন্ত্রের মধ্যে ৭৫টি বাদে অবশিষ্ট সব মন্ত্রগুলিই ঋগ্বেদ থেকে সংকলিত। সুতরাংবলা যায়, ঋগ্বেদের বক্তব্য মোটামুটিভাবে সামবেদেও পাওয়া যায়, অথবা বিপরীতভাবে সামবেদের বক্তব্য ঋগ্বেদের মধ্যেও বিস্তৃত।

প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, বেদকে বিশেষ ক্ষেত্রে ত্রয়ী আখ্যা দেওয়া হয়। আসলে, বৈদিক যজ্ঞে ঋক্‌ সাম-যজুঃ-রই প্রচলন ও প্রয়োজনীয়তা থাকায়, অর্থাৎ যজ্ঞীয় প্রয়োজনের বিচারে, অথর্ববেদকে বাদ রাখা হয়েছে। অনেকে যে বলেন, –অথর্ববেদ অর্বাচীন কালে রচিত, তা ভ্রান্তিমূলক। যেমন, সর্বাপেক্ষা অধিকসংখ্যায় অনুষ্ঠিতব্য সোময়াগে অথর্ববেদীয় ব্রাহ্মণদের প্রবেশই নিষিদ্ধ ছিল। (কারণ মারণ-উচাটন-বশীকরণ ইত্যাদি মানুষের স্বার্থকেন্দ্রিক অশুভ ক্রিয়াগুলি অথর্ববেদীয়গণের কর্ম বলে সর্বশুভঙ্কর যজ্ঞগুলিতে তারা অবাঞ্ছিত ছিলেন)। যজ্ঞে যে চাররকম প্রধান ঋত্বিকের প্রয়োজন–তাদের নাম–অধ্বর্যু, হোতা, উদ্গাতা ও ব্রহ্মা। অধ্বর্যু বা যজুর্বেদ-বিৎ ঋত্বিককে যজমান সর্বাগ্রে বরণ করেন। তিনি শুরু থেকে শেষপর্যন্ত যজ্ঞের সমগ্র আয়োজনের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন। সকল যজ্ঞের হোমকর্তা বা হোতা হলেন ঋগ্বেদজ্ঞ পুরোহিত, যিনি অধ্বর্যুর দ্বারা অগ্নিতে আহুতি প্রদানের পর ঋমন্ত্রে দেবতাদের আহ্বান করেন। উদগাতা বা সামবেদজ্ঞ। ঋত্বিক উথ-মন্ত্রে (অর্থাৎ সামগানে) যজ্ঞক্ষেত্র মুখরিত করে তোলেন। ব্রহ্মা বা উপদেষ্টা নামধারী (তিনটি বেদেই অভিজ্ঞ) ঋত্বিক যজ্ঞক্ষেত্রে উপস্থিত থেকে যথাযথ নির্দেশ দান করেন। ঋত্বিকবর্গের এই প্রতিটি বিভাগেও তাদের সহকারীরূপে অপরাপর ঋত্বিক অংশ গ্রহণ করেন। যেমন, অধ্বষুগণে–অধ্বর্যুর সহকারী প্রতিপ্রস্থাতা, নেষ্টা ও উন্নেতা; হোতৃগণে–হোতার সহকারী প্রশাস্তা, অচ্ছাবাক ও গ্রাবস্তোতা; উদগাতৃগণে–উদ্গাতার সহকারী প্রস্তোতা, প্রতিহর্তা ও সুব্রহ্মণ্য; এবং ব্রহ্মগণে–ব্রহ্মার সহকারী ব্রাহ্মণাচ্ছংসী, অগ্নীধ্র ও পোতা। [সায়নাচাৰ্যকৃত সামবেদভাষ্যানুক্রমণিকা দ্রষ্টব্য]। এই তালিকায় অথর্ববেদজ্ঞের কোন স্থান নেই।

তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, বেশ বহুকাল ধরে (অথর্ববেদসহ) চারটি বেদই সেগুলির যথাযথ ধারকবৃন্দের মধ্যে, অর্থাৎ তথাকথিত শিষ্য-প্রশিষ্য পরম্পরায় নানা শাখায় বা সংস্করণে বিভক্ত হয়েছিল। কোন্ বেদটি কত শাখায় বিভক্ত হয়েছিল, সে সম্পর্কে নানা মতভেদ আছে। কূর্মপুরাণে সামবেদের সহস্র শাখা, উক্ত হয়েছে। বিদেশী গবেষকগণের মতে সামবেদের এই শাখা-সংখ্যা চব্বিশ। ডঃ রাজেন্দ্রলাল মিত্রের মতে, সামবেদের কৌথুম, জৈমিনিয় ও রাণায়ণীয় শাখা যথাক্রমে গুজরাটে, কর্ণাটে ও.মহারাষ্ট্রে প্রচলিত। পূজ্যপাদ লাহিড়ী মহাশয় কৌধুমী, রাণায়ণ, শাট্যমুগ্র, কপোল, মহাকপোল, লাঙ্গালিক ও শার্দুলীয় নামে সামবেদের সাতটি শাখার উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে বঙ্গে কৌধুমী সংস্করণটিই প্রচলিত।

বেদ-সম্পর্কিত এক ইতিহাসকার বলেছেন–ব্যাসদেব জৈমিনিকে যে সামবেদ পাঠ করান, তিনি (অর্থাৎ জৈমিনি) তা তাঁর পুত্র সুমন্তু এবং পৌত্র সুত্বাকে দান করেন। এই পিতা-পুত্র সামবেদের দুটি শাখার উদ্ভাবক। সুত্বার পুত্র সুকর্মা সামবেদকে সহস্র ভাগে ভাগ করেন। সুকর্মার শিষ্যদ্বয় হিরণ্যনাভ (=কৌশল্য) ও পৌষপিঞ্জি এই সহস্র শাখাই অধ্যয়ন করেন। উত্তর দিক থেকে আগত পাঁচশত শিষ্য গুরুবর হিরণ্যনাভের কাছে সামবেদ পাঠ করে উদীচ্য সামগ নামে পরিচিতি লাভ করেন। পূর্বদিক থেকে আগত অবশিষ্ট শিষ্যেরা প্রাচ্য সামগ নামে অভিহিত হন। পৌষপিঞ্জির চারজন শিষ্য-লোগাক্ষি, কৌধুমী, কাক্ষীবান্ ও লাঙ্গলি। এঁরা আবার আপন আপন। অংশ বিভাজিত করে আরও কতকগুলি শাখা সৃষ্টি করেন। হিরণ্যনাভের কৃতি নামধারী এক শিষ্য আবার তাঁর শিষ্যদের মধ্যে নিজের অংশভূত সামগুলিকে চব্বিশভাগে বিভক্ত করে দান করেন। পরে আরও শাখার সৃষ্টি হয়। (আমরা সামবেদের কৌথুমী শাখাকে অনুসরণ করেছি)।

কতকগুলি ঋক্‌ নিয়ে গঠিত এক একটি সূক্ত। অনেকগুলি সূক্তের সমন্বয়ে এক একটি মণ্ডল গঠিত। এমন দশটি মণ্ডলে গঠিত সমগ্র ঋগ্বেদ-সংহিতা। (অবশ্য সূক্ত ও ঋকগুলির বিন্যাসের সহজতম পদ্ধতিতে সমগ্র ঋগ্বেদকে মোট আটটি অষ্টকেও বিভক্ত করা হয়েছে। প্রতি অষ্টকে আবার বর্গ হিসাবেও বিভাজন আছে। যেমন প্রথম অষ্টকে মোট সূক্তের সংখ্যা ১২১, বর্গ সংখ্যা ২৬৫ এবং মোট ঋকের সংখ্যা ১৩৭০, ইত্যাদি)। তেমনই সামবেদে দশটি (বা অনেক স্থলে দশের অধিক) মন্ত্র নিয়ে গঠিত হয়েছে এক একটি দশতি। এমন কতকগুলি দশতি নিয়ে বিগঠিত হয়েছে পূর্ব আর্চিক বা ছন্দ আর্চিক এবং উত্তর আর্চিক। এই দুটির মধ্যবর্তী আর্চিকের নাম মহানাম্নী আর্চিক এবং তাতে একটিমাত্রই দশতি।

.

০৩.

বেদমন্ত্রের পর্যায়বিভাগ প্রসঙ্গে যে-কথা বলা যায়, তা ঋগ্বেদ ও সামবেদ প্রসঙ্গে সমভাবেই প্রযোজ্য। পূজ্যপাদ দুর্গাদাস লাহিড়ী মহাশয় এই বেদমন্ত্রসমূহকে তিনরকম পর্যায়ে বিভক্ত। করেছেন। কতকগুলি মন্ত্র (১) ভগবৎ-মহিমা-জ্ঞাপক (নিত্যসত্য-তত্ত্বমূলক); কতকগুলি (২) প্রার্থনামূলক (ভগবানের নিকট প্রার্থনা-পরিজ্ঞাপক)। আর কতকগুলি মন্ত্র–(৩) আত্ম-উদ্বোধনা মূলক (ভগবৎ-কার্যে আত্মনিয়োগ-সঙ্কল্পসূচক)। সব বেদমন্ত্রই এই তিনটি পর্যায়ের মধ্যে পড়ে– এটাই তাঁর অভিমত। আমাদের মন্ত্রার্থে এই অভিমতই মান্য করা হয়েছে।

নিঘন্টু-নিরুক্ত* মতে–ঋক্ বা মন্ত্র ত্রিবিধা–পরোক্ষকৃতা, প্রত্যক্ষকৃতা ও আধ্যাত্মিকা। বলা হয়েছে–প্রথম পুরুষের বিভক্তি প্রভৃতি যে ঋকে ব্যবহৃত হয়ে থাকে, তা-ই পরোক্ষকৃতা হয়। যেমন, –ইন্দ্রো দিব ইন্দ্র ঈশে পৃথিব্যা ইন্দ্রো অপামিন্দ্র ইৎ পর্বতানাম। ইন্দ্রো বৃধামিন্দ্র ইন্মেধিরাণামিন্দ্রঃ ক্ষেমে যোগে হব্য ইন্দ্র৷৷ প্রচলিত বঙ্গানুবাদ–কি স্বর্গ, কি পৃথিবী, কি জল, কি পর্বত, সকলেরই উপর ইন্দ্রের আধিপত্য আছে। প্রবল ব্যক্তি ও বুদ্ধিমান ব্যক্তিদের উপর ইন্দ্রের আধিপত্য। কি নূতন বস্তু লাভ করবার সময়, কিলব্ধ বস্তু রক্ষা করবার কালে, সকল অবসরেই ইন্দ্রের নিকট প্রার্থনা করতে হয়। এই মন্ত্রে কর্তা ও ক্রিয়াপদ প্রথম পুরুষে ব্যবহৃত হয়েছে। এখানে সাধারণভাবে ইন্দ্রদেবের মাহাত্ম্য কীর্তিত আছে। নিঘন্ট-নিরুক্তের মতে এইরকম মন্ত্রকে পরোক্ষকৃতা মন্ত্র বলে। এমন পর্যায়ের মন্ত্রকে (পূজ্যপাদ লাহিড়ী মহাশয়ের মতানুসারে) আমরা ভগবৎ-মহিমাজ্ঞাপক নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক মন্ত্র বলেই পূর্বাপর নির্দেশ করেছি। পরোক্ষকৃতা মন্ত্রের উদাহরণে আরও কয়েকশ্রেণীর মন্ত্র নিরুক্তে উদ্ধৃত হয়েছে। তা থেকে বোঝা যায়, দেবতা যেখানে প্রত্যক্ষীভূতা নন, অর্থাৎ দেবতার উদ্দেশে যেখানে মন্ত্র উচ্চারিত হয়েছে বা কাউকেও মন্ত্র উচ্চারণ করতে বলা হচ্ছে, তা-ই পরোক্ষকৃতা মন্ত্র। এই গ্রন্থে এমন বহু মন্ত্র লক্ষণীয়। — প্রত্যক্ষকৃতা মন্ত্র সেগুলি-যেগুলিতে ভগবানকে প্রত্যক্ষভাবে সম্বোধন করা হয়েছে। এ পক্ষে যেখানে মধ্যম পুরুষের বিভক্তি প্রভৃতি প্রযুক্ত, তা-ই প্রত্যক্ষকৃতা মন্ত্র। যথা;–ত্বমিন্দ্র বলাদধি সহসো জাত ওজসঃ। ত্বং বৃষং বৃষেদসি৷ প্রচলিত বঙ্গানুবাদ–হে ইন্দ্র! তুমি বলবীর্য ও তেজঃ হতে জন্মগ্রহণ করেছ, অর্থাৎ ঐগুলিই তোমার উপাদান। হে বর্ধনকারী! তুমিই অভিলাষ-পূরণ; কা। এখানে ভগবান্ যেন প্রত্যক্ষীভূত। এখানে যেন সাক্ষাৎ-সম্বন্ধে তাঁকে সম্বোধন করা হয়েছে। নিরুক্ত-মতে এইরকম মন্ত্রগুলি প্রত্যক্ষকৃতা মন্ত্রের পর্যায়ভুক্ত। আমরা এইরকম মন্ত্রকে প্রার্থনামূলক মন্ত্ৰ-পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত করেছি। এই গ্রন্থে এমন বহু মন্ত্র আছে।

তৃতীয় শ্রেণীর যে মন্ত্রগুলিকে নিরুক্তকার আধ্যাত্মিক পর্যায়ের অন্তর্নিবিষ্ট করেছেন, সেগুলি প্রধানতঃ উত্তম পুরুষে প্রযুক্ত। যথা;অহং ভুবং বসুনঃ পূর্বস্পতিরহং ধনানি সং জয়ামি শশ্বতঃ। মাং হবন্তে পিতরং ন জান্তবোহহং দাশুষে বি ভজামি ভোজন৷ প্রচলিত বঙ্গানুবাদ (ইন্দ্রদেব বলছেন) আমি সম্পত্তিসমূহের প্রধান অধীশ্বর-হয়েছি। আমি চিরকালই সকল সম্পত্তি জয় করে নিই। প্রাণিগণ পিতার ন্যায় আমাকে ডেকে থাকে। যে দাতা, আমি তাকে ভোগের সামগ্রী দিয়ে থাকি। –এই মন্ত্রের ব্যাখ্যার সঙ্গে একটা উপাখ্যান সংযোজিত হয়। সে উপাখ্যান এই যে, বৈকুণ্ঠনাম্নী এক অসুরীর উগ্র তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে ইন্দ্র তাঁর পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করেন। তখন ইন্দ্রের নাম হয়-বৈকুণ্ঠ। ইন্দ্র যেন তখন আত্ম-খ্যাপনব্যপদেশে এই মন্ত্র আবৃত্তি করেছিলেন। যাই হোক, আমরা মনে করি, মন্ত্র সোহয়ং ভাব-দ্যোতক। ভগবান্ অথবা ভগবনত্বপ্রাপক সাধক এই ভাবের এই মন্ত্র উচ্চারণ করবার অধিকারী। আত্মখ্যাপনমূলক সুতরাং আধ্যাত্মিক পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত বলে এইরকম মন্ত্র নিরুক্তে অভিহিত হয়েছে। আমাদের বিভাগ অনুসারে এই শ্রেণীর মন্ত্র আত্ম-উদ্বোধনমূলক মন্ত্র-পর্যায়ের অন্তর্নিবিষ্ট হওয়ার যোগ্য। পক্ষান্তরে এমন মন্ত্রকে ভগবৎ-মহিমা-প্রক্ষাপক মন্ত্রও বলা যায়। –(এই গ্রন্থে প্রতিটি মন্ত্রার্থের শেষে মন্ত্রটির ভাব বিশ্লেষণের সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রটি কোন পর্যায়ভুক্ত, তা উল্লেখিত হয়েছে)।

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ চতুর্বেদের মধ্যে নিজেকে সামবেদ-রূপে ঘোষণা করেছেন। অর্থাৎ তিনি সামবেদ-রূপে অনুধ্যেয়। মোট কথা, সামবেদ ক্রমিক পর্যায়ে দ্বিতীয় (অর্থাৎ ঋগ্বেদের পরেই এটির নাম উচ্চারিত) হলেও উৎকর্ষে গীতানুসারে প্রথম। শুক্লযজুর্বেদে বেদরূপী অনন্ত দেহে সামমন্ত্রকে প্রাণরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। সেখানে ঋঙ্মন্ত্রকে বাক্য ও যজুর্মন্ত্রকে মনরূপে  উল্লেখ করা হয়েছে)।

* নিঘন্টু–যাস্ককৃত বৈদিক পর্যায় শব্দসংগ্রহ; একার্থকবৈদিকশব্দ-সূচী। নিরুক্ত–যাস্ককৃত নিঘন্টুভাষ্যগ্রন্থ।

.

০৪.

প্রতি বেদের মতো সামবেদেরও তিনটি ভাগ–সংহিতা, ব্রাহ্মণ ও উপনিষদ। সংহিতা বা মন্ত্রাংশ-দেবতাদের স্তব। ব্রাহ্মণ অংশ–কর্মকাণ্ড বা যজ্ঞকাণ্ড। উপনিষদ (=বেদান্ত) অংশ জ্ঞানকাণ্ড। সামবেদের কোন আরণ্যক নেই। (প্রারম্ভিকা অংশ দীর্ঘতর হওয়ার সম্ভাবনায় এই চারটি বিভাগের পরিচয় সাধারণ পাঠকের কাছে উপস্থিত অপ্রয়োজনীয় বিধায় বিস্তৃত আলোচনা করা গেল না। জিজ্ঞাসু পাঠক যে-কোন গবেষণালব্ধ অভিধান থেকে এ বিষয় জেনে নিতে পারেন)। আমরা সামবেদের সংহিতা অংশটিই নিবেদন করছি।

অতি প্রাচীনকাল থেকে গৌড়বঙ্গে সামবেদই বিশেষভাবে সমাদৃত ছিল। আমাদের প্রধান ব্রাহ্মণ-শাখা রাঢ়ীয়শ্রেণীর ব্রাহ্মণবর্গ (এবং তাদের যজমান অব্রাহ্মণেরাও) সকলেই প্রায় সামবেদী। সুতরাং তাদের সকল সংস্কারই সামবেদীয় পদ্ধতি অনুসারে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। বর্তমানকালে অবশ্য সামবেদ কেন, কোন বেদেরই চর্চা আমাদের মধ্যে প্রায় বিরল পর্যায়ে উপনীত বলা চলে। তবে পৌরোহিত্য করার তাগিদে, অর্থাৎ জীবিকা নির্বাহের উদ্দেশ্যে, সামবেদ নয়, ব্রাহ্মণগণ সামবেদীয় সংস্কার-পদ্ধতি অবশ্যই অধ্যয়ন করে থাকেন।

বঙ্গে বেদাধ্যয়নে এই অনীহার মূলে অনেকগুলি কারণ আছে। প্রথমতঃ বর্তমান কালে সংস্কৃত চর্চা এখানে শূন্য পর্যায়ে এসে গেছে। বেদচর্চার ক্ষেত্রে সংস্কৃতে জ্ঞান যেমন দরকার, তেমনই দরকার উপযুক্ত বঙ্গানুবাদ গ্রন্থ। (ভারতের অন্যান্য প্রদেশে সংস্কৃত চর্চার দরুণ বেদাধ্যয়নের যথোপযুক্ত পরিকাঠামো বর্তমান। উড়িষ্যার মতো রাজ্যে প্রায় প্রতি জেলায় বেদ-শিক্ষায়তন গড়ে উঠেছে এবং সরকার থেকে বেদ-শিক্ষার্থী এবং বেদ-শিক্ষকদের উৎসাহিত করার বহুরকম উদ্যোগ নেওয়া হয়। উপযুক্ত গ্রন্থ তো আছেই)। বাংলায় এ-সব দিকের যে শোচনীয় অবস্থা পরিলক্ষিত হয়, তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। হিন্দুধর্মের ধ্বজাধারী বঙ্গীয় প্রতিষ্ঠানগুলি সকলেই নিজ নিজ গুরুর জীবনী, কীর্তিকলাপ ও উদ্দেশ্য সম্বলিত বিরাট বিরাট গ্রন্থ প্রকাশে যেভাবে উৎসাহ দেখান, হিন্দুধর্মের মূল গ্রন্থ প্রকাশে তার বিন্দুমাত্রও দেখা যায় না। (অন্ততঃ এ পর্যন্ত দেখা যায়নি)। তাছাড়া বিভ্রান্তিমূলক বেদ-ভাষ্যের প্রচলন তো আছেই। পূর্ববর্তী ভাষ্যকারদের অন্ধ অনুসরণ বা অনুকরণ ছাড়া গত্যন্তরও ছিল না। (কারণ, নতুন করে বেদ-চিন্তনের মতো কঠিন পরিশ্রমেও তথাকথিত বাঙালী পণ্ডিতদের অনীহা ছিল এবং আছে)। অথচ, (স্বামী জগদীশ্বরানন্দের ভাষাতেই বলা যায়), –বৈদিক সংস্কৃতি ভারতীয় সভ্যতার মূল ভিত্তি। বেদ ধর্মতত্ত্বের সীমান্য সরোবর। অধুনা যে সকল ধর্ম ও দর্শন ভারতে প্রচলিত, তার মূল বীজ বেদেই নিহিত। ভারতীয় সর্ব ধর্ম সম্প্রদায় বেদবাক্যের দ্বারা আপন আপন সিদ্ধান্ত প্রমাণিত করেছেন। ষড়দর্শন, শাঙ্কর বেদান্ত, রামানুজের বিশিষ্টাদ্বৈত, নিম্বার্কের দ্বৈতাদ্বৈত, মধ্বাচার্যের দ্বৈত, বল্লভের শুদ্ধাদ্বৈত, চৈতন্যের অচিন্ত্য-ভেদাভেদ, আর্যসমাজ, ব্রাহ্ম সমাজ প্রভৃতি ভারতীয় সর্ব ধর্মের মূল উৎস বেদ। বৈদিক সংস্কৃত প্রাচীনতম আর্যভাষা ও বেদ মানব জাতির আদি গ্রন্থ। বিগত শতকের মধ্যভাগে ভাষা বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তখন মোক্ষমুলার প্রমুখ পাশ্চাত্য সংস্কৃতজ্ঞগণ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, ভাষাতত্ত্ব অধ্যয়নে বেদজ্ঞান সর্বাপেক্ষা প্রয়োজন। বৈদিক সংস্কৃত ভাষাসমূহের জননী। আর, আজকের পশ্চিমবঙ্গে সেই সংস্কৃতই কেবলমাত্র পুরুত মশাইয়ের মন্ত্র পড়ার ভাষা। অধিক মন্তব্য অবশ্যই নিষ্প্রয়োজন।

.

০৫.

সায়নাচার্য, স্কন্দস্বামী, মাধবভট্ট, মহীধর, ভরতস্বামী প্রভৃতি বেদভাষ্যকারগণের মধ্যে সায়নাচার্যের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে কোন সংশয় নেই। পাশ্চাত্য পণ্ডিতেরাও বেদের অনুবাদ-কল্পে কিছু কিছু মনগড়া ভাষ্যও রচনা করেছেন। শেষ পর্যন্ত এতে বেদের অপব্যাখ্যাই জনারণ্যে বেশী ছড়িয়েছে। (অবশ্য বঙ্গদেশে বেদপ্রচারে সত্যব্রত সামশ্রমী চিরকাল স্মরণীয়)।

অপব্যাখ্যা বলতে কি বোঝায়, তা অনুধাবনীয়। প্রচলিত ব্যাখ্যাগুলিতে ইন্দ্রকে বা অপরাপর দেববৃন্দকে সোমপায়ী (মাদকাসক্ত), ঋষিগণকে গোমাংস-প্রিয় ইত্যাদিরূপে দেখান হয়েছে। প্রভূত ধন, সুস্বাদু খাদ্য, সুন্দরী স্ত্রী, মেধাবী পুত্র ইত্যাদিই নাকি ঋষিবৃন্দের প্রার্থনার বিষয়–এমন কথাই ব্যাখ্যামুখে বিধৃত হয়েছে।

স্বর্গীয় পণ্ডিত দুর্গাদাস লাহিড়ী এইসব ব্যাখ্যাকে বিষম বিসদৃশ ব্যাখ্যা, কদর্থ বা কু-ব্যাখ্যা বলে ধিকৃত করেছেন। তিনি বলেছেন–এইসব মন্ত্রের ভাষ্যানুসারী যে অর্থ প্রচলিত আছে, তাতে বিস্ময়ান্বিত হতে হয়। বুঝে দেখুন–কি মন্ত্রের কি অর্থ চলে আসছে। দেশে এখনও ব্রাহ্মণ সমাজ আছে, হিন্দুসমাজ আছে, চুড়ামণিগণ আছেন, শিরোমণিগণ আছেন, সমাজপতিত্বের দাবী করেন–এমন সকল লোকও আছেন। অথচ তাদের পরমপূজ্য বেদ যে এই অবস্থায় উপনীত, সেদিকে কারও দৃষ্টি পড়ছে না–এটাই আশ্চর্য। হিন্দু! তাই বলি, –উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরান্নিবোধত।  এ-কথা যখন তিনি দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন তখনও অবিভক্ত বাংলায় শিরোমণি-চূড়ামণিগণ ছিলেন। ছিলেন ঐ জাতীয় অপব্যাখ্যাকারী বিদেশী পণ্ডিতেরাও, যাঁদের বাক্য অকাট্য বলে ধরে নেবার মতো মানসিকতাসম্পন্ন বিদ্যাবিশারদ বাঙালী জনের প্রাচুর্য ছিল। কায়েমি স্বার্থ-সম্পন্ন সম্প্রদায় খঙ্গহস্ত হয়ে উঠেছিলেন এই সমস্ত মন্তব্যকারী পণ্ডিত দুর্গাদাসের প্রতি। কিন্তু এতে অবদমিত হননি তিনি। তিনি তথাকথিত পণ্ডিতদের মধ্যে প্রচলিত বেদের বেশীরভাগ ব্যাখ্যা (বা অপব্যাখ্যা) অনুমোদন করেননি একটুও। তার মতে, অপৌরুষেয় বেদমন্ত্র মানুষের গতিমুক্তির পথই প্রদর্শন করে থাকে। কিসে মানুষ সৎপথে পরিচালিত হয়ে সৎকর্মের অনুষ্ঠানে নিজের উৎকর্ষ সাধন করে পরমার্থ-লাভে সমর্থ হয়, বেদমন্ত্র সেই তত্ত্ব প্রকটিত করছে। বলেই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সংসারে দুঃখের অন্ত নেই। নানা বিভীষিকা মানুষকে সর্বদা লক্ষ্যভ্রষ্ট করে ফেলছে। সংসারের সেই দারুণ দুঃখনাশ এবং লক্ষ্য স্থির করে মানুষকে সৎপথে পরিচালনা করাই বেদমন্ত্রের প্রধান উদ্দেশ্য–এই অকৃত্রিম বিশ্বাসে তিনি অন্বিত হয়ে উঠেছিলেন। সেই অনুপ্রাণনা সেই লক্ষ্য নিয়ে বেদমন্ত্রের সুষ্ঠু সঙ্গত এবং পরমার্থপ্রকাশক নিগুঢ় মর্মকথা উদঘাটন করাই সঙ্গত বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তিনি।

নিজে লিখে নিজের প্রতিষ্ঠিত মুদ্রাযন্ত্রে একের পর এক বেদ-সংহিতাগুলি (মূল, মর্মানুসারিণী ব্যাখ্যা, বঙ্গানুবাদ, সায়নাচার্যের ভাষ্য ইত্যাদি সহ) প্রকাশ করেছিলেন। আপন অনুসিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যে তথ্য বা যুক্তি তিনি উপস্থাপিত করেছিলেন, তা খণ্ডন করতে পারেননি তথাকথিত কায়েমি স্বার্থান্বেষীর দল। শুধু তার গ্রন্থগুলির প্রচারে অবরোধ-সৃষ্টিতেই প্রয়াসী হয়েছিলেন; কিন্তু তাতেও যে তারা সফল হয়েছিলেন, তা-ও সত্য নয়।

প্রচলিত ব্যাখ্যাগুলিকে প্রায় ভ্রান্তিমূলক প্রমাণিত করে সমগ্র বেদ-সংহিতার ঐ ঐতিহাসিক প্রকাশন স্বর্গীয় দুর্গাদাস লাহিড়ীর শাশ্বত কীর্তিতে পর্যবসিত। বঙ্গাক্ষরে এই গ্রন্থ ঊনচল্লিশ খণ্ডে, এবং প্রায় বত্রিশ হাজার পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়েছিল।

তিনি সামবেদ-সংহিতার যে বঙ্গানুবাদ প্রকাশ করেন তার প্রথম সংস্করণটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২০ থেকে ১৯২৭ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে। এটি মোট নটি খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছিল। এই গ্রন্থে তিনি সামগানগুলির স্বরলিপিও সংযোজিত করেছিলেন।

আশ্চর্যের কথা, বর্তমান কালে এই পশ্চিমবঙ্গে কখনও কখনও কেউ কেউ আমাদের হাতে বেদের যে বঙ্গানুবাদ উপহার দিতে এগিয়ে আসেন, সেই বঙ্গানুবাদ তথাকথিত অপব্যাখ্যাগুলিকেই অনুসরণ করেছে। কিন্তু স্বর্গীয় দুর্গাদাসের অক্ষয় কীর্তি আমাদের কাছে প্রায় অজ্ঞাত কিংবা অবজ্ঞাতই রয়ে গেছে। (সম্প্রতি অবশ্য তাঁর জ্ঞানকেদ নামক চতুর্বেদের সারার্থ সম্বলিত গ্রন্থটি প্রকাশিত হতে চলেছে। এটিকে কেউ কেউ বিন্দুতে সিন্ধুর দর্শনবলে অভিহিত করলেও স্বর্গীয় দুর্গাদাসের দুর্লভ সৃষ্টিকে এই প্রজন্মের বঙ্গসন্তানদের কাছে উপস্থাপনের প্রথম প্রয়াস প্রশ্নাতীতভাবে অভিনন্দনীয়)।

আমরা তাই তার নখণ্ডের সামবেদ-সংহিতাটিকে যথাসম্ভব অবিকৃত রেখে সাধারণ পাঠকের উপযোগী করে প্রকাশ করছি। এটা অবশ্য বিন্দুতে সমুদ্রের দর্শন নয়, তটিনীতে ভেসে মহাসাগরের পানে যাত্রা।

.

০৬.

 সামবেদ-সংহিতার স্বরূপ সম্পর্কে একটি সুন্দর বিবরণী পূজ্যপাদ লাহিড়ী মহাশয়ই রচনা। করে গেছেন। তার ভাষাতেই তা নিবেদন করছি।

সাম-সংহিতা সঙ্গীতমূলক। স্তরে স্তরে, তবকে তবকে, তাললয়মানরাগমূৰ্ছনার ঝঙ্কারে ঝঙ্কারে, সামগানে সঙ্গীতের সুরলহরী ব্যোম প্রতিধ্বনিত করে আছে। মর্ত্যসকলে সে সঙ্গীত শ্রবণে অধিকারী না হলেও, শব্দব্রহ্মরূপে সে সঙ্গীতের স্বর সাধকের হৃদয়ে প্রতিনিয়ত জাগরূক রয়েছে। শব্দ-ব্রহ্মরূপে পরিব্যাপ্ত সেই সঙ্গীতের সুধাঁধারায় সাধকের হৃদয় সদা অভিষিক্ত হয়ে আছে।

সঙ্গীত ভাবমূলক। ভাষায় তার অভিব্যক্তি বিড়ম্বনা মাত্র। সঙ্গীতের যিনি আলাপ করতে সমর্থ হন, তিনিই সে আনন্দ লাভ করতে পারেন; অথবা সঙ্গীতের সুধাঁধারা যাঁর হৃদয়ে প্রবেশ করে, এ সুর-তাল-লয়-মানে আলাপ করতে সমর্থ না হলেও, তিনিই সে আনন্দের অধিকারী হন। তাই সাম-গান বোঝাবার সামগ্রী নয়–হৃদয়ে ধারণা করবার সামগ্রী। সে হিসেবে, যাঁরা সঙ্গীতজ্ঞ নন, তাদের পক্ষে যে সামগানের উপযোগিতা নেই, তা-ও নয়; তারাও সে গান হৃদয়ে ধারণ করে পরম আনন্দ উপভোগ করবেন, এটাই সাম-গানের লক্ষ্য।

গায়ক না হলেও, সঙ্গীতের স্বরে সামগান শোনার সুযোগ উপস্থিত না হলেও, হৃদয়ে অনুধ্যান করলেও সামগানের সাফল্য উপলব্ধ হয়। ভাবগ্রহণই পরম পদার্থ;-পরম-পদার্থেই পরম আনন্দ। অর্থ উপলব্ধ না হলে সে ভারগ্রহণ সম্ভবপর নয়; তাই ভাষ্যের বা অর্থের প্রয়োজন হয়। যদি সুরতানলয়ে সঙ্গীতের স্বরে গাইবার সামর্থ্য না হয়, সামগানের মর্ম গ্রহণ করুন, অন্তরে অন্তরে অস্ফুট স্বরে অনুধ্যান করুন, অভীষ্ট ফল তাতেই প্রাপ্ত হবেন। অধিকারিভেদে অর্থান্তর ঘটে। যিনি যে পথের পথিক, তিনি সেই পথেই অগ্রসর হতে পারেন। কিন্তু সকলেরই স্মরণ রাখা কর্তব্য, –সামগানে পরম পদার্থ অভিব্যক্ত রয়েছে। সেই স্মৃতি লক্ষ্য রেখে, যিনি যে পথেই অগ্রসর হোন, সেই পথেই গন্তব্যস্থানে গমন করতে পারবেন। ঊষার কোলে প্রভাতের শুকতারা যখন উদয় হয়, বিভিন্ন জন বিভিন্ন দিক থেকে তা লক্ষ্য করে অনুসরণ করলেও সকলেই সেই একই লক্ষ্যস্থানে পৌঁছাতে পারে। সামগান কিংবা ঋষ্মন্ত্র (সামবেদের সামগুলি কিংবা ঋগ্বেদের ঋগুলি) সেই শুকতারা স্বরূপ। যে ভাবেই হোক অনুসরণ করুন;-বস্তুতত্ত্ব ক্রমেই হৃদগত হবে।

যা কবি, তা-ই সঙ্গীত। মাত্র সুরের ইতরবিশেষ। করিতায় যে সুর যে মূৰ্ছনা যে ভাবে বিহি হয়, সঙ্গীতে তা অন্যভাবে অন্যরূপে সংসাধিত হয়ে থাকে। বস্তু এক; পার্থক্য উচ্চারণের মাত্র। সামবেদে তাই দেখতে পাই, অধিকাংশ ঋজুন্ত্রই গেয়গান-রূপে গীত হয়ে থাকে। এমন কি সামবেদের প্রায় দ্বি-তৃতীয়াংশ (সামমন্ত্রগুলি) ঋষ্মন্ত্রেরই অনুবৃত্তি মাত্র; অথবা, ঋক্–ও সাম যেন অভিন্ন হয়ে আছে। ঋন্ত্রগুলি প্রধানতঃ অনুদাত্ত, স্বরিত, উদাত্ত, (উদারা অর্থাৎ নিম্ন স্বরগ্রাম, মুদারা অর্থাৎ মধ্য স্বরধ্বনি এবং তারা অর্থাৎ উচ্চ স্বরধ্বনি)–তিন স্বরে উচ্চারিত হয়। সামগান ষড়জ-ঋষভ-গান্ধার-মধ্যম-পঞ্চম-ধেবত-নিষাদ (স-ঋ-গ-ম-প-ধ-নি) সপ্তসুরে গীত হয়ে থাকে। সঙ্গীতের যেমন নানারকম প্রকারভেদ আছে, সামগানেও তেমনই প্রকারভেদ দেখা যায়। একই ঋষি একই গান বিভিন্ন সুরে গেয়ে গেছেন; আবার একই গান বিভিন্ন ঋষি বিভিন্নরূপে আলাপ করেছেন। এখানে উচ্চারণের বা সঙ্গীতালাপের সঙ্গে হৃদয়ের সম্বন্ধ; লৌকিক ফলাফল তার অধীন নয়। সঙ্গীতের স্বরে প্রকারভেদ থাকলেও, ভাবার্থ-সর্বত্রই এক; শব্দশক্তি উভয়ই অভিন্ন। কবিতার অপেক্ষা সঙ্গীত তন্ময়ত্ত বৃদ্ধিকর। মানুষ কি ভাবে ভগবানে ন্যস্তচিত্ত ও তন্ময়  হতে পারবে, ঋজুন্ত্রের ও সামগানের উচ্চারণ-পদ্ধতি ও মর্মাহ্-নিবহ তা-ই শিক্ষা দিচ্ছে।  

[ঐ যে উল্লেখ করা গেল, বেশীরভাগ সামমন্ত্রই একাধিক সুরে ও ভাবে এক বা একাধিক ঋষি কর্তৃক গীত হতো; সে-কারণে সেই সেই সামমন্ত্রের গেয়গানের এক বা একাধিক নাম ও এক বা একাধিক (গেয়গানের) ঋষির নামও পাওয়া যায়। এই গ্রন্থে প্রতি সামগানের মন্ত্রার্থের শেষে প্রয়োজন মতো আমরাও সেগুলি উল্লেখ করেছি। আশা করা যায়, পাঠকগণের পক্ষে তা বোধগম্য হতে অসুবিধা হবে না। ঋগ্বেদে বা অপর যে-স্থান থেকে গানগুলি সামবেদে গৃহীত হয়েছে, তারও যথাযথ উল্লেখ আছে। প্রসঙ্গতঃ জ্ঞাতব্য, ঐ মন্ত্রগুলির কয়েকটিকে সামবেদের অন্তর্ভুক্ত করার সময়ে কিছু কিছু পাঠান্তর ঘটেছিল। তবে তাতে অর্থের ও ভাবের তেমন কিছু ব্যত্যয় হয়নি।]

.

০৭.

 নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যে কোন বর্ণের মানুষ গ্রন্থপাঠে সক্ষম হলে এবং শ্রদ্ধা ও আগ্রহ থাকলে নির্দ্বিধায় বেদপাঠ করতে পারেন। এখনও যারা নারী বা ব্রাহ্মণ ব্যতীত অন্যের পক্ষে বেদপাঠ নিষিদ্ধ বলেন, তারা জানেনই না যে, আদিকালে আর্যদের মধ্যে কোন বর্ণবিভাগ ছিল না এবং বৈদিকযুগে বহু মহীয়সীই ঋষীরূপে বেদমন্ত্রের দ্রষ্টা ছিলেন। তখন সকলেই ব্রহ্মজ্ঞ, ধর্মনিষ্ঠ ও নির্লোভ ছিলেন বলে ব্রাহ্মণ (বা ব্রাহ্মণী) রূপে পরিচিত ছিলেন। কালক্রমে এঁদের মধ্যে কোনও কোনও অংশ লোভের বশবর্তী হয়ে উপরিউক্ত স্বভাব বা বৃত্তি পরিত্যাগ করায় এবং সমাজের প্রয়োজনে অপরাপর বৃত্তির অপরিহার্যতা অনুভূত হওয়ায় চারটি বর্ণের সৃষ্টি হলো। অনেকে বর্ণ ও জাতিকে একার্থক ধরেন। কিন্তু বর্ণ শব্দটি জাতি পদ থেকে স্বতন্ত্র। জাতি কথাটি জন-ধাতু থেকে এসেছে, অর্থাৎ জাতি হলো জন্মগত। কিন্তু বর্ণ জন্মগত নয়, এটি গুণ ও কর্মের দ্যোতক। জাতি অপরিবর্তনীয়; কিন্তু গুণ ও কর্ম অনুসারে মানুষের বর্ণের পরিবর্তন ঘটতে পারে। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলে পুরুষসূক্তে আমরা এই চারবর্ণের একটি সুন্দর বিবরণী পাই। (কারণ সেইকালে ধীরে ধীরে চতুর্বর্ণের উদ্ভব সূচিত হচ্ছিল)। সেখানে বলা হয়েছে বিরাট পুরুষের মুখ বা মস্তক থেকে ব্রাহ্মণের (ব্রাহ্মণোহস্য মুখমাসীৎ), বাহু থেকে ক্ষত্রিয়ের বা রাজন্যের (বাহু রাজন্যঃ কৃতঃ), ঊরু থেকে বৈশ্যের (উরূ তদস্য যদ বৈশ্যঃ), এবং পাদ থেকে শূদ্রের (প্যাং শূদ্রো অজায়ত) উৎপত্তি। এটি একটি রূপক বর্ণনা। ব্রাহ্মণের পেশা মুখ বা মস্তিষ্ককে কেন্দ্র করে; বাহুকে কেন্দ্র করে ক্ষত্রিয়ের বা রাজন্যের; ঊরু দেহকে ধারণ করে, সুতরাং সমাজ ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় কৃষি বাণিজ্য ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে বৈশ্যের পেশা; পাদদ্বয় সর্বনিম্নে থেকে আমাদের

সমাজরূপী দেহের সেবা করে, তাই অপর তিন বর্ণের সেবা করাই শূদ্রের বৃত্তি। সুতরাং স্পষ্টই তা বোঝা যায় যে, এই বর্ণবিভাগ কেবলমাত্র বৃত্তিকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল। এবং বলাই বাহুল্য, এক বর্ণের মানুষ আপন গুণগত মানের বিচারে অপর বর্ণে পরিবর্তিত এবং সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত হতে পারতেন। (মৎপ্রণীত বৈষ্ণবী পঞ্চকা গ্রন্থে আলোচিত)। এই জন্যই দেখা যায়, বর্তমানেও বৈদিক ব্রাহ্মণ কর্তৃক ধৃত গোত্র অপরাপর বর্ণের মধ্যেও প্রচলিত রয়েছে। তাছাড়া প্রাচীন ভারতে ব্রাহ্মণ ব্যতীত অপর বর্ণের মানুষকেও ঋষিত্ব অর্জন করতে দেখা গেছে। অনেকে অবশ্য বেদে উল্লিখিত বিরাট-পুরুষের সাথে শূদ্রবর্গের তুলনাকে তাদের প্রতি ব্রাহ্মণবর্গের ঘৃণা বঞ্চনা ইত্যাদিরূপে পরিঘোষিত করতে চান। কিন্তু এটা যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অথবা অজ্ঞতা-প্রসূত রটনা, তাতে সন্দেহ নেই। বেদের ঐ বর্ণনা থেকেই বোঝা যায়, সমাজরূপী বিরাট-পুরুষের সমগ্র দেহটিকে ধারণ করেছেন যাঁরা, তাঁরা আদৌ অন্ত্যজ বা অবজ্ঞার পাত্র হতে পারেন না। মস্তিষ্ক সহ মানুষের সমগ্র দেহটিই তো পাদদ্বয়ের উপর ভর করে আছে। তাছাড়া ব্রাহ্মণ ব্যতীত অন্যের পক্ষে বেদপাঠ নিষিদ্ধ–এমন কথা বেদে পাওয়া যায় না।

তবে বর্ণাশ্রম সৃষ্টি হবার পর শ্রুতি-র দ্বারা ধারণীয় বেদমন্ত্রগুলিকে অবিকৃত রাখার উদ্দেশ্যে বেদ-পরবর্তী কালে বেদের ধারক তথাকথিত ব্রাহ্মণবর্গ ব্যতীত অপরের (অর্থাৎ কায়িক পরিশ্রম নির্ভর) মানুষদের পক্ষে বেদ-চর্চাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, এ-কথাও সত্য। নারীদের ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটেছিল। কারণ ধীরে ধীরে নারীদের বিদ্যার্জনের অধিকারটার উপরেই আমরা নিষেধাজ্ঞা প্রবর্তন করে দিয়েছিলাম। (এ-সবের পশ্চাতে ভাল-মন্দ উভয় দিকেরই বিচার্য বিষয় আছে; কিন্তু সে আলোচনা এখানে অবান্তর)।

কিন্তু আজ যখন মুদ্রান্ত্রের কল্যাণে বেদমন্ত্রগুলি যথাযথভাবেই সকলের কাছে সহজলভ্য হয়ে এসেছে, এবং নারী-শিক্ষার যথেষ্ট প্রসার ঘটেছে, তখন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল বর্ণের সকল সুযোগ্য মানুষের পক্ষে বেদ-পাঠ নিষিদ্ধ করার ফিকিরি ফতোয়াকে মান্য করবার প্রয়োজনীয়তাই বা কি আছে? মনে রাখবেন, বেদের মতে, –শুধু ব্রাহ্মণ নয়, সকলেই অমৃতের সন্তান।

.

০৮.

এই গ্রন্থটির নির্মাণে অনেকেই আমাকে নানাভাবে সহায়তা করেছেন। তাদের সকলের কাছেই আমি ঋণী। এমন গ্রন্থ প্রকাশনে উদ্যোগী হওয়ার জন্য প্রকাশক অবশ্যই ধন্যবাদার্হ।

গ্রন্থটি আমার উত্তরসূরি শ্রীমান্ নীললোহিত (দৌহিত্র) ও শ্রীমান্ উদ্দালক (পৌত্র)-কে উৎসর্গ করলাম।

—শ্রীদিলীপ মুখোপাধ্যায়

শ্রীপঞ্চমী
২০শে মাঘ, ১৪১২ বঙ্গাব্দ

.

সামবেদভাষ্যানুক্রমণিকা

বন্দনা

বৃহস্পতি-প্রমুখ দেববৃন্দ, সৰ্ব্বপ্রকার পুরুষার্থসিদ্ধির প্রারম্ভে, যে দেবতাকে প্রণাম করিয়া কৃতার্থ হয়েন, সেই গজাননকে আমি প্রণাম করিতেছি।

বেদনিবহ যাঁহার নিশ্বাসস্বরূপ, যিনি বেদসমূহ হইতে নিখিল বিশ্ব নিৰ্মাণ করিয়াছিলেন, সেই বিদ্যাতীর্থ মহেশ্বরকে আমি বন্দনা করিতেছি।

.

ভাষ্য-সূচনা

 মহেশ্বরের কটাক্ষে (অর্থাৎ তাহার করুণায়) শিবরূপ ধারণ করিয়া (অর্থাৎ শিবতুল্য প্রভাবশালী হইয়া), বুমহারাজ বেদার্থ-প্রকাশের জন্য সায়ণাচাৰ্য্যকে আদেশ করিয়াছিলেন।

কৃপালু সায়ণাচাৰ্য অতি সন্তর্পণে পূৰ্ব্বমীমাংসা এবং উত্তরমীমাংসা ব্যাখ্যা করিয়া, বেদার্থ প্রকাশ করিতে উদযুক্ত হইয়াছিলেন।

সেই সায়ণাচাৰ্য, বেদার্থপ্রকাশ বিষয়ে প্রথমে যত্নপূৰ্ব্বক সামবেদের তাৎপৰ্য প্রকাশ করিতেছেন। তাহা দ্বারা তাৎপৰ্য্য বিষয়ে জ্ঞানলাভ করিতে ইচ্ছুক যে উদগাত ঋত্বিক, তিনি চরিতার্থ হইবেন (অর্থাৎ তিনি বেদার্থ জানিয়া পূর্ণ মনোরথ হইবেন)।

সমস্ত বেদে, দুইটী কাণ্ডে যজ্ঞ এবং ব্রহ্ম–এই প্রয়োজনদ্বয় সাধিত হইয়াছে (অর্থাৎ প্রথম কাণ্ডে যজ্ঞের বিষয় ও দ্বিতীয় কাণ্ডে ব্রহ্মের বিষয় লিখিত হইয়াছে)। অধ্বর্য্যু প্রমুখ ঋত্বিক-চতুষ্টয় কর্তৃক যজ্ঞ-সম্পত্তি সাধিত হইয়া থাকে। (পরশ্লোকে তাহাই ব্যক্ত করিতেছেন)।

অধ্বর্য্যু নামক ঋত্বিক ক্রিয়াসমুদয়ের দ্বারা যজ্ঞের শরীর প্রস্তুত করিয়া থাকেন এবং হোতা, ব্রহ্মা ও উদ্গাতা এই ঋত্বিকত্রয় ঐ যজ্ঞসম্বন্ধীয় শরীরকে অলঙ্কৃত করিয়া থাকেন।

ব্ৰহ্মা (প্রসিদ্ধ ঋত্বি-বিশেষ), অপর তিন জন ঋত্বিকের অপরাধ সৰ্ব্বদা (সকল সময়ে) পরিত্যাগ করিবেন (তাহাদের দোষ প্রতীকার করিবেন)। ঋচাত্ত্ব এই মন্ত্রে উক্ত অর্থ-তাৎপৰ্য্য. অভিহিত হইয়াছে।

হোতা, শস্ত্র যাজ্য ও অনুবাক্য মন্ত্র দ্বারা এবং উদ্গাতা আজ্যপৃষ্ঠ প্রভৃতি স্তোত্র দ্বারা যজ্ঞকে অলঙ্কৃত করিবেন।  

অধ্বর্য্যু নামক ঋত্বি যজুম্মন্ত্রের দ্বারা যজ্ঞকে প্রস্তুত করিয়া থাকেন। সুতরাং প্রথমে যজুৰ্ব্বেদের ব্যাখ্যা এবং শেষে ঋগ্বেদের ব্যাখ্যা উল্লিখিত হইয়াছে।

সাম-মন্ত্র সকল ঋকের আশ্রত বলিয়া সৰ্বশেষে সামবেদের ব্যাখ্যা বর্ণিত হইয়াছে। অনুষ্ঠান করিতে ইচ্ছুক, লোকের জিজ্ঞাসানুরোধে এইরূপ লিখিত হইল।

যেমন অগ্রে দেহ উৎপন্ন হয়, এবং পরে তাহার কটক প্রভৃতি ভূষণ আবশ্যক হইয়া থাকে, এবং ঐরূপ কটকাদি হইলে পরে তাহাতে মণিমুক্তা প্রভৃতির আবশ্যক হয়; সেইরূপ যজুঃ হইতে যজ্ঞের দেহ উৎপন্ন হইলে, ঋষ্মন্ত্র-সকল তাহার অলঙ্কারস্বরূপ হয়; পরে ঐ সকল ঋষ্মন্ত্রে সাম নামক মন্ত্ৰসমুদয় মণিমুক্তার ন্যায় সংযুক্ত হইয়া শোভা পাইয়া থাকে৷

.

ভাষ্যানুক্রমণিকার বঙ্গানুবাদ

অধ্বর্য্যু, হোতা, উদগাতা ও ব্রহ্মা–এই চতুৰ্ব্বিধ ঋত্বিকের কর্তব্য প্রতিপাদক যে মন্ত্র, তাহার অর্থ-প্রকাশ পক্ষে নিমোক্ত ঋকটী প্রযুক্ত হইতে পারে; যথা, ঋচাং ত্বঃ পোমাস্তে পুপুস্বান গায়ত্রং তত্বা গায়তি শরীযু। ব্রহ্মা তত্বা বদতি জাতবিদ্যাং যজ্ঞস্য মাত্রাং বিমিমীত উ ত্বঃ। উহার অর্থ এইরূপ;–ত্ব-শব্দ সৰ্ব্বনাম-প্রকরণে পঠিত এক-শব্দ-পৰ্য্যায়। এক অর্থাৎ হোতা এই নামে প্রসিদ্ধ যে ঋত্বিকু; তিনি সেই সেই স্থলে ভগ্নক্রমে পঠিত (ভ্রান্ত-উচ্চারণমূলক) যে সকল ঋক্, তাহাদিগকে যজ্ঞের অনুষ্ঠান-সময়ে একত্রে মিলিত করিয়া (যজ্ঞের) পুষ্টি সম্পাদন করিয়া থাকেন। অপর একজন উদগাতা নামক ঋত্বি; তিনি শঙ্করী নামে প্রসিদ্ধ ছন্দঃ-সমন্বিত ঋক্‌ সকলকে গায়ত্ৰাদি নামক সাম-গান করিয়া থাকেন। আর একজন ব্রহ্মা নামক ঋত্বিক; হোতা প্রভৃতি ঋত্বিয়ের বেদত্রয়বিষয়ে কোনও অপরাধ হইলে, তিনি তাহার প্রতীকার-স্বরূপ বিদ্যা পাঠ করিয়া থাকেন।

অতএব ছন্দোগ ব্রাহ্মণগণ বলিয়া থাকেন, -যিনি ব্রহ্মা, তিনিই যজ্ঞের চিকিৎসক অর্থাৎ দোষ-প্রতিকারক;– এবং তিনি যজ্ঞের নিমিত্ত ঔষধ প্রস্তুত করিয়া তাহা অর্থাৎ দোষরূপ রোগ নাশ করিয়া থাকেন। আরও; যদি ঋক্ হইতে যজ্ঞ-বিষয়ে আৰ্ত্তি অর্থাৎ ত্রুটিরূপ পীড়া উৎপন্ন হয়, তাহা হইলে ব্রহ্মা গাহপাত্য অগ্নিতে ভূঃ এই মন্ত্রে হোম করিবেন। এক যে অধ্বর্য্যু, তিনি যজ্ঞের ইয়ত্তা বিশেষরূপে নিরূপিত করিয়া থাকেন।

যদি বল, এই বেদার্থপ্রকাশক গ্রন্থে সমস্ত বেদের ব্যাখ্যা অবশ্য কর্তব্য; তাহা না করিয়া যজুঃ প্রভৃতির ব্যাখ্যা যুক্তিবিরুদ্ধ। তাহাও বলিতে পার না। কারণ, সেই ঋগাদি মন্ত্রযুক্ত যে সমস্ত বেদ, সেই মন্ত্র-বিশেষ বাচক শব্দই যজুঃ। এই শব্দ সমূহ দ্বারা যজন উপলক্ষিত, অর্থাৎ সমস্ত বেদেই যজুঃ বিদ্যমান আছে। অতএব, যজুঃ প্রভৃতি মন্ত্রবিশেষের অর্থ প্রকাশ দ্বারাই বেদার্থ-প্রকাশ সিদ্ধ হইতেছে।

আচ্ছা! মন্ত্র আর বেদে বিশেষ কি? যদি এইরূপ প্রশ্ন উত্থাপিত হয়, তাহা হইলে তাহার উত্তরে বলা যাইতে পারে যে, মন্ত্র ও ব্রাহ্মণ এই উভয়ের সমষ্টির নাম বেদ। তৎপক্ষে আপস্তম্ব স্মৃতিই প্রমাণ; যথা, –মন্ত্র ব্রাহ্মণয়োৰ্বেদ নামধেয়ং; অর্থাৎ, মন্ত্র ও ব্রাহ্মণ এই দুইটীই বেদের নাম মাত্র। বেদের যে মন্ত্র ও ব্রাহ্মণ ভাগদ্বয়, মহর্ষি জৈমিনি যুক্তি দ্বারা তদুভয়ের স্বরূপ পৃথক পৃথক্‌ নিৰ্ণয় করিয়াছেন। সেই জৈমিনীয় ন্যায়-মালায়, দ্বিতীয় অধ্যায়ের প্রথম পাদে, সপ্তম অধিকরণে, ন্যায়বিস্তরকার মন্ত্রের স্বরূপ নির্ণয় করিয়াছেন। অহে বুধিয় মন্ত্রং মে ইত্যাদি মন্ত্রে, মন্ত্র শব্দের উল্লেখ দেখা যায়। কিন্তু মন্ত্রের লক্ষণ আছে কি নাই, ইহাই সংশয়। মন্ত্রের লক্ষণ নাই; কারণ, অব্যাপ্ত্যাদি দোষের বারণ হয় না। ইহা পূৰ্ব্বপক্ষ। যাজ্ঞিকগণের সমাখ্যাতে প্রসিদ্ধিই মন্ত্রের লক্ষণ। যাহা অনুষ্ঠানের স্মারক, যাজ্ঞিকগণ তাহাতেই মন্ত্র-শব্দের প্রয়োগ করিয়া থাকেন। অর্থাৎ, –যাজ্ঞিকগণ যাহাকে মন্ত্র বলিয়াছেন, তাহাই মন্ত্র। উক্ত লক্ষণ অব্যাপ্তি প্রভৃতি দোষ-বর্জিত; সুতরাং মন্ত্রের লক্ষণ আছে, –ইহাই সিদ্ধান্ত হইল। আধান-প্রকরণে অহে বুধিয় মন্ত্রং মে গোপায় এইরূপ পঠিত হইয়াছে। উক্ত শ্রুতিতে মন্ত্রের লক্ষণ নাই; যেহেতু অব্যাপ্তি ও অতিব্যাপ্তি এই দুই দোষ অনিবার্য। উক্ত দোষদ্বয় উল্লিখিত হইতেছে; যথা, যাহা বিহিত অর্থের প্রকাশক, তাহাই মন্ত্র, –এইরূপ বলিলে বসন্তায় কপিঞ্জলালভতে, এই মন্ত্রের বিধিরূপত্ব হেতু অব্যাপ্তি দোষ হইতেছে। আর মননহেতু মন্ত্র অর্থাৎ যাহা মননের হেতু, তাহাই মন্ত্র, -এইরূপ লক্ষণ করিলে, ব্রাহ্মণরূপ অপর বেদভাগে অতিব্যাপ্তি দোষ ( যাহা লক্ষ্য নহে তাহাতে লক্ষণ যাওয়ার নাম অতিব্যাপ্তি) অবশ্যম্ভাবী। যদি বলা যায়, -যাহার অন্তে অসি এই পদ, বা উত্তম পুরুষের ক্রিয়া পদ থাকিবে, তাহাই মন্ত্র, এবং সেই মন্ত্র-লক্ষণ-সমুদায়ের মধ্যে পরস্পর অব্যাপ্তি-দোষ অনিবার্য; কিন্তু তাহাও বলিতে পার না। যেহেতু, যাজ্ঞিক-সমাখ্যান রূপ মন্ত্রের লক্ষণ সৰ্ব্বথা দোষশূন্য। উক্ত সমাখ্যান, অনুষ্ঠানের স্মারক, প্রভৃতির মন্ত্রত্ব প্রতিপাদন করিয়া থাকে। উরু প্রথস্ব ইত্যাদি বাক্য অনুষ্ঠানের স্মারক; সুতরাং উহাদের মন্ত্রত্ব সিদ্ধ হইতেছে। অগ্নিমীলে পুরোহিতং ইত্যাদি বাক্য-সকল স্তুতিস্বরূপ। ইষেত্বা ইত্যাদি ত্বান্ত ও অগ্ন আয়াহি বীতয়ে ইত্যাদি বাক্য-সকল আমন্ত্রণপদযুক্ত হওয়ায়, সমাখ্যান-বশতঃ, মন্ত্র বলিয়া প্রসিদ্ধ। অগ্নিদগ্নীন বিহর ইত্যাদি প্ৰৈষরূপ (নিয়োগপ্রতিপাদক) মন্ত্র। অধঃস্বিদাসীদুপরিস্বিদাসীইত্যাদি বিচাররূপ মন্ত্র। অম্বে অম্বিকে অম্বালিকে নমিনয়তি কশ্চন ইত্যাদি পরিদেবন (বিলাপ) রূপ মন্ত্র। পৃচ্ছামি ত্বা পরমন্তং পৃথিব্যাঃ ইত্যাদি প্রশ্নরূপ মন্ত্র। বেদিমাহুঃ পরমন্তং পৃর্থিব্যাঃ ইত্যাদি উত্তররূপ মন্ত্র। এই প্রকারে অন্যান্য উদাহরণ জ্ঞাতব্য। এইরূপ অতিশয় বিজাতীয় (অর্থাৎ পরস্পর-বিরুদ্ধজাতীয়) মন্ত্র বিষয়ে এক সমাখ্যান ব্যতিরিক্ত অন্য সকলের অনুগত এমন কোনও ধৰ্ম্ম নাই, যাহাকে লক্ষণ বলা যাইতে পারে। প্রাচীন আচাৰ্য্যগণ ঋষয়োহপি পদার্থানাং নান্তং যান্তি পৃথকত্বতঃ ইত্যাদি মন্ত্রে লক্ষণের উপযোগিতা দেখাইয়াছেন। সেই মন্ত্রের অর্থ এই যে ঋষিগণও পৃথকভাব-হেতু পদার্থ-সমুদয়ের সিদ্ধান্ত প্রাপ্ত হন নাই; অর্থাৎ তাঁহারা বিচক্ষণ হইলেও পৃথভাব-বশতঃ পদার্থের প্রকৃত নির্ণয়ে উপনীত হইতে পারেন নাই। কিন্তু পণ্ডিতগণ লক্ষণ দ্বারা সিদ্ধান্ত প্রাপ্ত হইয়া থাকেন। এতদ্বারা স্থির হয় যে, অভিযুক্ত (প্রমাণবিৎ) ব্যক্তিগণের ইহাই মন্ত্র এইরূপ সমাখ্যান (নামকথন), মন্ত্রের লক্ষণ। অর্থাৎ অসাধারণ ধর্ম।

উক্ত জৈমিনীয় ন্যায়মালায় দ্বিতীয় অধ্যায়ের প্রথম পাদে অসম অধিকরণে ব্রাহ্মণের স্বরূপ নির্ণীত হইয়াছে। প্রথমে প্রশ্ন হইয়াছে, ব্রাহ্মণ বিষয়ে লক্ষণ আছে, কি নাই? এই সংশয়ে, পূৰ্ব্বপক্ষবাদী বলিতেছেন, –ব্রাহ্মণের লক্ষণ নাই; যেহেতু বেদের ভাগ এতসংখ্যা পরিমিত, এইরূপ প্রসিদ্ধির অভাব (অর্থাৎ বেদভাগের ইয়ত্তা নাই)। এই পূৰ্ব্বপক্ষের সিদ্ধান্ত কথিত হইতেছে, মন্ত্র ও ব্রাহ্মণ এই ভাগদ্বয়ে বেদ বিভক্ত; সুতরাং মন্ত্র এ ব্যতিরিক্ত ভাগই ব্রাহ্মণ; এইরূপে ব্রাহ্মণের লক্ষণ নির্ণীত হইয়াছে। চাতুর্মাস্য-প্রকরণে আন্নাত হইয়াছে যে, –এতদব্রাহ্মণণ্যেব পঞ্চবীংষিইতি। এই স্থলে ব্রাহ্মণের লক্ষণ নাই কেন? কারণ, বেদ-ভাগ-সমুদায়ের ও ইয়ত্তার অনির্ণয়-হেতু ব্রাহ্মণভাগে এবং অন্য সমস্ত ভাগে লক্ষণের অব্যাপ্তি ও অতিব্যাপ্তি দোষের সংশোধন করিতে পারা যায় না। উদাহরণ দিবার নিমিত্ত প্রাচীনগণ পূৰ্ব্ব কথিত একটী মন্ত্রভাগ এবং অপর কতকগুলি ভাগ সংগৃহীত করিয়াছেন–হেতুর্নির্বচনং নিন্দা প্রশংসা সংশয়ো বিধিঃ। পরকৃতিঃ পুরাকঙ্গো ব্যবধারণকল্পনাৎ। অর্থাৎ, –হেতু, নিৰ্ব্বচন, নিন্দা, প্রশংসা, সংশয়, বিধি, পুরকৃতি, পুরাকল্প এবং ব্যবধারণকল্পনা। হেতু তেনহ্যন্নং ক্রিয়তে; অর্থাৎ, সেই হেতু অন্ন করা হইতেছে। নিৰ্ব্বচন, — এতদ্দধ্নোদধিত্বম; ইহাই দধির দধিত্ব। নিন্দা, — অমেধ্যা বৈ মাষা; মাষ (শস্য-বিশেষ) অপবিত্র (যজ্ঞের অযোগ্য)। প্রশংসা-বায়ুর্বৈ ক্ষেপিষ্ঠা; বায়ুদেব অত্যন্ত বেগগামী (সত্বর-ফলদায়ক)। সংশয়–তদ্ব্যচিকিৎসন জুহবানীমাহৌষাং; তাহারা সংশয় করিয়াছিলেন–হোম করিব, কি করিব না। বিধি, — যজমানেন সম্মিতৌদুম্বরী ভবতি; যজমানের শরীর-পরিমিত দীর্ঘ ঔদুম্বরী (যজ্ঞডুমুরকাষ্ঠ-নির্মিত প্রতিমা) হইবে (করিবে)। পরকৃতি–মানেব মহং পচতে; আমার নিমিত্ত মাষ পাক করিতেছে। পুরাকল্প–পুরা ব্রাহ্মণ অভৈঃ ; পূৰ্ব্বকালে ব্রাহ্মণগণ ভয় পাইয়াছিলেন। ব্যবধারণ কল্পনা–যাবহেশ্বান প্রতিগৃহ্নীয়াৎ তাবতো বারুণাংশ্চতুকপালা নিৰ্ব্বপেত; যত অশ্ব প্রতিগ্ৰহ করিবেন, ততসংখ্যক বরুণদেব-সম্বন্ধীয় চতুঃ কপাল পুরোডাশ নিৰ্ব্বপণ করিবেন। এই প্রকার অন্যান্য উদাহরণও বুঝিতে হইবে। হেতু প্রভৃতির অন্যতমই ব্রাহ্মণ–এইরূপ ক্ষণও হইতে পারে না; কারণ, মন্ত্রভাগেও হেতু প্রভৃতির সঙ্গতি হইয়া থাকে। তাহাই ব্যক্ত হইতেছে–ইন্দবো বামুশন্তি হি ইত্যাদি; হে ইন্দ্র! হে বায়ু! সমস্ত সোম তোমাদিগকে প্রার্থনা করিতেছে। এস্থলে হেতু। উদানিযুৰ্ম্মহীরিতি তস্মাদুদকমুচ্যতে; অর্থাৎ, যেহেতু ঊর্ধ্ব হইতে পতিত হইয়া পৃথিবীকে সিক্ত করে, সেইজন্য উদক বলা যায়। ইহা নিৰ্ব্বচন। মোঘন্নং বিন্দতে অপ্রচেতাঃ; অর্থাৎ অবোধ মনুষ্য, নিষ্ফল অন্ন লাভ করিয়া থাকে। ইহা নিন্দা। অগ্নিমূৰ্দ্ধাদিবঃ ককুৎ; অর্থাৎ, অগ্নিই স্বর্গলোকের মস্তক এবং স্কন্ধ স্বরূপ। ইহাতে অগ্নির প্রশংসা বুঝাইতেছে। অধঃস্বিদাসীদুপরিস্বিদাসী; তিনি উপরে আছেন, না নিম্নে আছেন? ইহা সংশয়। কপিঞ্জলানালভতে;কপিঞ্জল নামক পক্ষিবিশেষকে বলি প্রদান করিবে। ইহা বিধি। সহস্ৰমযুতাদদৎ; অর্থাৎ, সহস্র ও অযুত দান করিয়াছিলেন। ইহাই পরকৃতি। যজ্ঞেন যজ্ঞমযজন্ত দেবাঃ; অর্থাৎ, দেবগণ যজ্ঞের দ্বারা যজ্ঞ করিতেন। ইহা পুরাকল্প। আচ্ছা! যদি বলা যায়, যাহাতে ইতি শব্দের বাহুল্য আছে, তাহাই ব্রাহ্মণ এবং ইহাই ব্রাহ্মণের লক্ষণ কিন্তু তাহাও বলিতে পার না। যেহেতু, ইত্যদদা ইত্যযজথাঃ ইত্যপচঃ ইতি ব্রাহ্মণো গায়েৎ। এই ব্রাহ্মণ কর্তৃক গেয় মন্ত্রে লক্ষণের অতিব্যাপ্তি দোষ হইতেছে। যদি বল, যাহা ইত্যাহ এইরূপ বাক্য দ্বারা নিবদ্ধ হইবে, তাহাই ব্রাহ্মণ; এইরূপও বলা যায় না। যেহেতু, রাজা চিক্যং ভগং ভক্ষীত্যাহ, যোবা রক্ষাঃ শুচিরস্মীত্যাহ-এই দুইটী মন্ত্রে উক্ত-লক্ষণের অতিব্যাপ্তিরূপ দোষ হইতেছে। আখ্যায়িকারূপই ব্রাহ্মণ–ইহাও বলিতে পার না; যেহেতু, যমযমী-সংবাদ সূক্ত প্রভৃতিতে অত্যিব্যাপ্তি-দোষ অনিবাৰ্য। অতএব, ব্রাহ্মণের লক্ষণ নাই, –এইরূপ পুৰ্ব্বপক্ষ স্থির হইলে, সিদ্ধান্তে বলিতেছি, -মন্ত্র ও ব্রাহ্মণ, এই দুইটিই বেদভাগ বলিয়া স্বীকৃত হওয়ায় এই লক্ষণ পূৰ্ব্বে কথিত হওয়ায়, অবশিষ্ট (মন্ত্র ভিন্ন) বেদভাগই ব্রাহ্মণ। সুতরাং ব্রাহ্মণ লক্ষণ সিদ্ধ হইতেছে।

ঋক, যজুঃ, সাম রূপ মন্ত্র-বিশেষের লক্ষণত্রয় উক্ত অধিকারে, তিনটি অধিকরণে, মহর্ষি জৈমিনি সূত্রিত করিয়াছেন; যথা–তেষামৃগযত্ৰাৰ্থবশেন পাদব্যবস্থা, গীতিষু সামাখ্যা, শেষে যজুঃ শব্দঃ। এই তিনটি সূত্রের এ অর্থ এইরূপ –সেই মন্ত্র-সকলের মধ্যে যে মন্ত্রে অর্থাপেক্ষায় পাদব্যবস্থা (ছন্দের এক এক অংশের পাদ) আছে, তাহাই ঋক্ মন্ত্র; যে মন্ত্রে গীতি (গান) হইয়া থাকে, তাহার নাম সাম, আর, ঋক্ বা সাম মন্ত্র ভিন্ন মন্ত্র, যজুঃ নামে কথিত হইয়া থাকে। এতৎসম্বন্ধে ন্যায়বিস্তর নামক গ্রন্থে স্পষ্ট করিয়া বলা হইয়াছে, –নৰ্ক সাম যজুষাং ইত্যাদি। অর্থাৎ ঋক্, সাম ও যজুঃ, ইহাদের লক্ষণ (পরিচায়ক ধৰ্ম্ম) নাই; যেহেতু উহাদের পরস্পর মিশ্রণ লক্ষিত হয়। এইরূপ আশঙ্কায় বলিতেছেন, –পাদ, গীতি এবং মিলিত-পাঠ (পাদ ও গীতি ভিন্ন মিশ্রিত পাঠ) এই ব্যবস্থা থাকায়, পরস্পর সঙ্কর (মিশ্রণ) হইতেছে না। শ্রুতিতে আছে, –অহে বুধিয় মন্ত্র মে ইত্যাদি। যাঁহারা বেদত্রয়কে অবগত আছেন; তাহারা ত্রিবিদ বলিয়া খ্যাত। তাঁহাদের সমীপে অধ্যয়নকারিগণ ত্রৈবিদ বলিয়া পরিচিত। তাঁহারা যে মন্ত্রভাগকে ঋক্ আদিরূপে ত্রিবিধ বলিয়া থাকেন, সেই মন্ত্রভাগকে রক্ষা করুন;–এইরূপ যোজনা করিতে হইবে। তাহা হইলে, ঋক, সাম ও যজুঃ, এই ত্রিবিধ মন্ত্রভাগের ব্যবস্থানুরূপ লক্ষণ, নাই কেন? যেহেতু, সাঙ্কৰ্য্য অনিবাৰ্য্য। যদি বল, –অধ্যাপক-পরম্পরায় প্রসিদ্ধ যে ঋগ্বেদ-আদি বেদত্রয়, তাহাতে পঠিত যে মন্ত্র, তাহাই ঋন্ত্র–এইরূপই ঋক্‌-মন্ত্রাদির লক্ষণ বলিতে হইবে; কিন্তু তাহাও সঙ্কীর্ণ; কারণ, দেবো বঃ ইত্যাদি মন্ত্র যজুৰ্ব্বেদেতে প্রতিপন্ন এবং যজুম্মন্ত্রগণের মধ্যে পঠিত হইয়াছে। কিন্তু তাহা যজুম্ম নহে; যেহেতু, উক্ত যজুৰ্ব্বেদ-সম্বন্ধীয় ব্রাহ্মণভাগে, সাবিত্রী ঋক্‌-প্রকরণে, উহা তৃচ ভাবে ব্যবহৃত হইয়াছে। এতৎ সাম গায়ন্নান্তে এইরূপ প্রতিজ্ঞাপূৰ্ব্বক কোনও সাম-মন্ত্র যজুৰ্ব্বেদে স্বীকার করা হইয়াছে; সামবেদেতে অক্ষিতমসি অচ্যুতমসি, প্রাণসংশিতমসি–এই তিনটি যজুম্মন্ত্র উল্লিখিত হইয়াছে। গীয়মান সামমন্ত্রের আশ্রয়-স্বরূপ বহু ঋক্‌-মন্ত্র সামবেদে আন্নাত হইয়া থাকে। পরন্তু, উহাদের কোনও লক্ষণ নাই, যদি এইরূপ বল; কিন্তু তাহা বলিতে পার না। কারণ, পাদ প্রভৃতি (উহাদের) অসঙ্কীর্ণ লক্ষণ। সেই লক্ষণ ব্যক্ত হইতেছে, –পাদ, বন্ধ ও অর্থের সহিত যুক্ত;এবং বৃত্ত (ছন্দঃ) রচিত মন্ত্র সমূহ ঋক্, গীতিরূপ মন্ত্র সাম, বৃত্ত ও গীতি রহিত প্ৰশ্লিষ্ট (পরস্পর সম্বন্ধ-বিশিষ্ট ভাবে) পঠিত মন্ত্র সমূহ যজুঃ নামে ব্যবহৃত। এইরূপ বলিলে, কোথায়ও সঙ্কর হইতে পারে না। পূৰ্ব্বকথিত গীতিষু সামাখ্যা (গীতিমন্ত্রের নাম সাম) এই বাক্যকে স্পষ্ট করিবার নিমিত্ত, সপ্তম অধ্যায়ের দ্বিতীয় পদে, রথন্তর এই শব্দে জৈমিনি তদ্বিষয় নিরূপণ করিয়াছেন; যথা, অতদেশ্যং বিনিশ্চেতুং কবতীযু রথন্তরং ইত্যাদি। শ্রুতিতে আছে, –কবতী রথন্তরং গায়তি, কয়ানশ্চিত্ৰ অভুবৎ ইত্যাদি। এইরূপ তিনটি ঋক্‌ কিবতী নামে প্রসিদ্ধ। বামদেব্য সম্বন্ধীয় সাম অধ্যয়ন হইতে তাহা প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে। তাহাতে আপত্তি উত্থাপিত হইলে সেই কবতী ঋকে রথযুর নামক সাম অতিদিষ্ট (আরোপিত) হইয়া থাকে। সেস্থলে, অতিদেশের স্বরূপ নির্ণয় করিবার জন্য, রথন্তর এই কথা বলা যাইতে পারে। কেন? অধ্যয়নকর্তার প্রসিদ্ধি হেতু রথন্তরং গীয়তাং (রথর নামক সামগান গান করুন) এইরূপ কোনও ব্যক্তি কর্তৃক কথিত হইয়া, অধ্যয়নকারিগণ স্বরস্তোভ-বিশেষযুক্ত অভিত্বা ইত্যাদি ঋক্ পাঠ করিয়া থাকেন; কিন্তু কেবল স্বরস্তোভমাত্র পাঠ করেন না। সেই জন্য গানবিশিষ্টা ঋক্ রথর শব্দের অর্থ মাত্র। এইরূপে প্রাপ্ত পূৰ্ব্বপক্ষ বিষয়ে বলিতেছি যে, স্বরাদি বিশেষ-মাত্ৰ-স্বরূপ ও ঋক্‌-সম্বন্ধীয় বর্ণ ভিন্ন যে গান, তাহাই রথন্তর শব্দের অর্থ। কেন? লাঘব হেতু। আরও, কবতী নামক ঋয়ে গানই অতিদেশের যোগ্য (অর্থাৎ গানেরই অতিদেশ সঙ্গত); কিন্তু ঋকের অতিদেশ-যোগ্যতা নাই। যেহেতু, কয়ানঃ, অভিত্বা এই দুইটী ঋক্ এককালে আধার-আধেয়-ভাবে পাঠ করিতে পারা যায় না। অতএব গান বিশেষই রথন্তর শব্দের অর্থ, এইরূপ সিদ্ধান্ত হইল।

পুনৰ্ব্বার নবম অধ্যায়ের দ্বিতীয় পদে প্রথম অধিকরণের প্রথম বর্ণকে সাম-শব্দ যে গানমাত্ৰবাচী, ইহা স্মরণ এ করান হইয়াছে। সামোক্তি বৃহদাক্তী ইত্যাদি। অর্থাৎ, সাম উক্তি ও বৃহৎ আদির উক্তি কেবল গানবিশিষ্ট ঋক্‌-বিষয়ে হইবে অথবা গান বিষয়েই হইবে?–এই আশঙ্কায়, গান বিষয়েই হইবে–এইরূপ সপ্তম অধ্যায়ে কথিত হইয়াছে। তাহাই এই অধ্যায়ে স্মরিত হইতেছে। সামান্যবাচী সাম শব্দ এবং বিশেষবাচী বৃহদ্রথন্তর প্রভৃতি শব্দ-সমূহ কেবল গানে বর্তমান থাকে। কিন্তু গান-বিশিষ্ট ঋকেতে থাকে না; এই নিয়মই সপ্তম অধ্যায়ের দ্বিতীয় পাদে সিদ্ধ হইয়াছে। তাহা এস্থলে বক্ষ্যমাণ বিচারের উপযোগী বলিয়া স্মরিত হইতেছে।

সাম শব্দের বাচ্য যে গান, তাহার স্বরূপ, ঋক্ সম্বন্ধীয় অক্ষর-সমূহে কুষ্ট আদি সপ্তপ্রকার স্বরের দ্বারা এবং অক্ষরের বিকার প্রভৃতি দ্বারা নিষ্পাদিত হইয়া থাকে। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ এই প্রকার সাতটী স্বর ষ্ট নামে অভিহিত হইয়াছে। তাহারা অবান্তর-ভেদে বহু প্রকার হইয়া থাকে। স্বর যে সামের নিম্পাদক, ইহা ছান্দোগ্য-উপনিষদের প্রথম প্রপাঠকে প্রশ্ন এবং উত্তর দ্বারা কথিত হইয়াছে। শালবান মুনির পুত্র শিলক, চৈকিতায়ন দাম্ভ নামক ঋষিকে বলিয়াছিলেন, –আমি আপনাকে একটী বিষয় জিজ্ঞাসা করিব? দাভ বলিয়াছেন, –জিজ্ঞাসা কর। শিলক জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, –সাম্নের গতি কি হইবে? দাম্ভ উত্তর দিয়াছিলেন, –স্বরই গতি। কাথশিষ্য ঋষিগণ বলিয়া থাকেন, –উদ্গীথ-বিদ্যাতে স্বর সামসম্বন্ধী এবং সকল পদার্থ-স্বরূপ এবং সুন্দর-বর্ণ স্থানীয়। তাহারা বলেন, –সেই সামের যিনি স্ব ধন) জানেন, তিনিই সামজ্ঞ। যিনি সামজ্ঞ, স্বরই তাহার ধন অর্থাৎ সম্পত্তি হইয়া থাকে। যিনি এই প্রসিদ্ধ সামের সুন্দর (বিশুদ্ধ) অর্থ জানেন, তাহারই সুবর্ণ (উজ্জ্বল বর্ণ) হইয়া থাকে। সেই সামের একমাত্র স্বরই বিশুদ্ধ বর্ণ।

অক্ষর-বিকার প্রভৃতি সাম নিম্পাদক নবম অধ্যায়ের দ্বিতীয় পদে সপ্তম অধিকরণস্থিত অর্থৈকত্বাবিকল্পঃ স্যাৎ (২৭ সূত্র) এইরূপ সূত্রের ব্যাখ্যাকরণ সময়ে শবরস্বামি কর্তৃক তাহা স্পষ্টরূপে কথিত হইয়াছে, সামবেদে সহস্রং ইত্যাদি। অর্থাৎ, সামবেদে সহস্র প্রকার গীতির উপায় নির্দিষ্ট হইয়াছে। কাহারা সেই গীতির উপায় নামে খ্যাত? এই প্রশ্নের উত্তরে বলা হইতেছে, –আভ্যন্তরিক প্রযত্ন দ্বারা উৎপন্ন হইয়া সমুদয় স্বরবিশেষের প্রকাশকত্রী ক্রিয়ার নামই গীতি। সেই গীতি ঋকেতেই আছে; সাম নামে তাহা উচ্চারণীয় ও প্রমাণসিদ্ধ হইয়া গীত হইয়া থাকে। তাহার সম্পাদন-নিমিত্ত ঋকের অক্ষর-বিকার হইয়া থাকে। অক্ষরের বিশ্লেষ (বিভাগ), বিকর্ষণ, অভ্যাস (দ্বিরুক্তি), বিরাম (পরবর্ণের অভাব), স্তোভ (স্তম্ভন, বাধা) ইত্যাদি সমস্ত বিকার সামবেদে উল্লিখিত হইয়াছে। উক্ত বিষয়ে যে বিচার সম্ভব, তাহা ন্যায়বিস্তর গ্রন্থে কথিত হইয়াছে; যথা, সমুচ্চেয়া ইত্যাদি। অর্থাৎ বিভিন্ন গীতি-হেতু, স্তোভ সকল সমুচ্চয়-যোগ্য কিম্বা বিকল্প যোগ্য? এই সংশয়ে পূৰ্ব্বপক্ষ হইতেছে যে প্রয়োগ গ্রহণহেতু সমুচ্চয়-যোগ্য এবং অর্থের অভিন্নতা থাকায় বিকল্প হইবে। কিন্তু বিকল্পই সিদ্ধান্তসম্মত। ছান্দোগ্য উপনিষদে তবল্কারাদি বিভিন্ন শাখার অক্ষর-বিকার প্রভৃতি অসাধারণ। কারণের বিষয় কথিত হইয়াছে। সমস্ত গীতিকৰ্ম্মের অনুষ্ঠান সময়ে সেই সকল অক্ষরবিকার আদিরূপ কারণের সমুচ্চয় করিতে হইবে। কেন? যেহেতু, প্রয়োগ-বাকে সেই সকল কারণ গ্রহণ করা হইয়াছে। কিন্তু তাহাও বলা যায় না। কারণ, অধ্যয়নকালেই এক একটি শাখায় কথিত অক্ষর-বিকার প্রভৃতি দ্বারা গীতির স্বরূপ নির্ণয় হইয়াছে। সেই স্বরূপ-নিস্পত্তিরূপ প্রয়োজনের একত্ব (অভেদ) হেতু গীতির কারণ-সমুদয় প্রয়োগ বাক্যে গৃহীত হইলেও ব্রাহি যবের ন্যায় এবং বৃহদ্রথন্তরের ন্যায় বিকল্প যোগ্য হইয়াছে। গীতির উপায়গণের মধ্যে স্তোভনামক উপায় অত্যন্ত অপ্রসিদ্ধ হওয়ায় তাহার লক্ষণ সেই (দ্বিতীয়) পাদে একাদশ অধিকরণে বিবৃত হইয়াছে; যথা, স্তোভস্য লক্ষণং ইত্যাদি। বিবর্ণত্ব স্তোভের লক্ষণ নহে; কারণ, বিপরীতবর্ণত্বহেতু বর্ণ বিকারের স্তোত্ব-প্রসঙ্গ হয়, এবং অগ্ন আয়াহি (ছ, প্র. ১ দ ১১) এই ঋক মন্ত্রে অকারের স্থানে ওকার, এ করিয়া ওগ্নায়ি (গে. প্র. ১ সা ১) এইরূপ গান করা হইয়া থাকে। অধিক বর্ণই স্তোভ–এইরূপ বলিলে, অভ্যাসে অতিব্যাপ্তি দোষ হয়। পিবা সোমমিন্দ্র মন্তু ত্বা–এই ঋকেতে দতু ত্বা এই বর্ণত্রয় গানের সময় বারত্ৰয় অভ্যস্ত (উক্ত) হইয়াছে। অতএব বিকার ও অভ্যাস স্থলে অতিব্যাপ্তিদোষহেতু স্তোভের লক্ষণ নাই, –এরূপ বলিতে পার না; যেহেতু অধিক অথচ বিলক্ষণ এইরূপ বর্ণই স্তোভ নামে খ্যাত, –স্তোভের এইরূপ বিশিষ্ট লক্ষণ আছে, বলা যাইতে পারে। ইহলোকেও সভাক্ষেত্রে বিপ্রলম্ভকগণ (বিরুদ্ধকৰ্ম্মকারী বা রসপ্রদর্শকগণ) কালক্ষয়ের জন্য যে সকল অসম্বন্ধ শব্দরাশি উচ্চারণ করে, তাহাকে স্তোভ বলা যায়। তাহা হইলে, স্তোভের লক্ষণ আছে, ইহা স্থির হইল। অক্ষর-বিকার ও স্তোভ প্রভৃতির ন্যায়; বর্ণলোপও কোনও স্থলে গীতির হেতু হইয়া থাকে। অকার-লোপ-বিষয়ক বিচার, নবম অধ্যায়ের প্রথম পাদের অষ্টাদশ অধিকরণে কথিত হইয়াছে; যথা–ইরা গিরা ইত্যাদি। জ্যোতিষ্টোম-যাগে এইরূপ শ্রুতি আছে, –যজ্ঞাযজ্ঞীয়েন স্তুবীত। যজ্ঞা যজ্ঞা এই শব্দযুক্ত ঋকেতে উৎপন্ন সামকে যজ্ঞাযজ্ঞীয় বলা হইয়াছে। সেই ঋকে গিরা শব্দ পঠিত হইয়াছে, –যজ্ঞাযজ্ঞা বো অগ্নয়ে গিরা গিরা ইত্যাদি। সামগায়কগণ, গায়ি বা গিরা এইরূপ গকারের সহিতই যোনিগান করিয়া থাকেন। কিন্তু ব্রাহ্মণভাগে গ কারের লোপ করিয়া অকার যকারাদিরূপ গান বিহিত হইয়াছে; যথা, -এরং কৃতত্বদেগয়ং। তাহার অর্থ এইরূপ, –গিরা শব্দেও গকার লোপ হইলে, ইরা এই শব্দ থাকে; ইরা সম্বন্ধীয় গান–এর। উক্ত প্রকার করিয়া প্রয়োগ (অনুষ্ঠান) কালেতে সেই (এর নামক) গান করিবে, উক্ত স্থলে যোনিগান এবং ব্রাহ্মণভাগ উভয়েরই তুল্যবলত্ব প্রতিপন্ন হইয়াছে। তাহাতে কোনও বিশেষ না থাকায় (অর্থাৎ উভয়েই তুল্য হওয়ায়) পরস্পরের বিকল্পে প্রয়োগ হইবে। এইরূপে প্রাপ্ত পূৰ্ব্বপক্ষ বিষয়ে বলিতেছি, ন গিরা গিরেতি ক্ৰয়াৎইত্যাদি। অর্থাৎ, –গিরা গিরা এরূপ বলিবে না। যদি গিরা গিরা এইরূপ বলে, তাহা হইলে উদ্গাতা আত্মাকেই পাতিত করিবে (উদ্গাতা ঐরূপ উচ্চারণ করিলে পতিত হইবে, ইহাই ভাবার্থ)। এই প্রকার গ-কারযুক্ত পদের গান-বিষয়ে বাধক বলিয়া গকার-শূন্য হয়। পদ গেয় অর্থাৎ গানের যোগ্য, ইহাই বিহিত হইতেছে। সেই (ইরা) পদের আদিস্থিত ই-কারের স্থানে অকার যকার এবং ইকার এই তিনটি বর্ণ প্রযুক্ত হইয়া থাকে। সুতরাং গানকালে আয়িরা এইরূপই গান করিতে হইবে। সেই স্থলে অর্থাৎ নবম অধ্যায়ের প্রথমপাদের উপরিতন (ঊনবিংশ) অধিকরণে একটি বিশেষ বিষয় উদ্ভাবিত হইয়াছে; যথা, -ইরাপদং ন গেয়ং স্যাৎইত্যাদি। ব্রাহ্মণ-ভাগ দ্বারা বিহিত ইরা শব্দ গান করিবে না; যেহেতু, এর এই শব্দের দ্বারা গীতি উক্ত হয় নাই। কেবল বিমুক্তাদিভ্যোহণ (পা. ৫। ২। ৬৯) এই পাণিনি সূত্র দ্বারা ইরা-শব্দের উত্তর মত্বৰ্থে অণ প্রত্যয় হইয়াছে। তাহা হইলে, ইরা পদযুক্ত এর শব্দের অর্থ হইতেছে। যদি তুদ্ধিত প্রত্যয় দ্বারা প্রগীত (যাহা গীত হইয়াছে) যে ইরাপদ, তাহার সম্বন্ধ বিবক্ষিত হয়, তাহা হইলে আকার যকার ইকার রকার এবং আকার এই পাঁচটি বর্ণদ্বারা নিষ্পন্ন আয়িরা শব্দস্বরূপটীগীয়মান ইরা শব্দের প্রাতিপাদক হইতেছে। এতাদৃশ প্রাতিপাদকের উত্তর বৃদ্ধাচ্ছঃ (পা. ৪। ২। ১১৪) এই পাণিনি সূত্রের দ্বারা অন্য প্রত্যয় হইলে ব্রাহ্মণে আয়িরীয়ং কৃত্বা এইরূপ পাঠ হইতে উক্ত হেতু-বশতঃ গান করিবে না, এইরূপ পূৰ্ব্বপক্ষ স্থির হইলে, সিদ্ধান্তে বলিতেছি, –গীয়মান এরূপ গিরা পদের স্থানে ইরা পদ বিহিত হইতেছে। ইহাতে কেবল পদের বাধ হইতেছে; কিন্তু গান বাধিত হইতেছে না। বিমুক্তাদিভ্যঃ(পা. ৫। ২। ৬১) এই সূত্রানুসারে অণ প্রত্যয় হইলেও মতৌ ছঃ সূক্ত সাম্নো (পা. ৫২৫৯) এই পূৰ্ব্ব সূত্র হইতে সামএই শব্দের অনুবৃত্তিহেতু ঐর সামএইরূপ অর্থ হইতেছে; এবং ঐ সাম গীতিসাধ্য হইয়াছে। যখন তাহার বিকার এই অর্থে তাহার (সাম শব্দের) উত্তর অণ প্রত্যয় হইতে পারে, তখন ইরায়া বিকারঃ এইরূপ ব্যাস বাক্য করিলে উক্তনুরূপ গানকে পাওয়া যাইতেছে। অতএব গান করিবে, –ইহাই সিদ্ধান্ত।

 বহুপ্রকারে গানাত্মক সামের স্বরূপ নিরূপিত হইয়াছে। সেই সাম যে দেবগণের সম্বন্ধে স্তুতির কারণ, তাহাই নবম অধ্যায়ের দ্বিতীয় পদে অষ্টম.অধিকরণের প্রথম বর্ণকে নির্ণীত হইয়াছে; যথা, –ঋসামভ্যাং বিকল্পেন ইত্যাদি। কোনও বিশিষ্ট কম্মে ঋচা স্তুবতে, সাম্না স্তবতে এইরূপ শ্রুত হইয়াছে। সেই শ্রুতিতে পূৰ্ব্বযুক্তি অনুসারে ঋক্ ও সাম মন্ত্রের বিকল্প হইবে, –এরূপ বলিতে পার না; যেহেতু, বাক্য-শেষে ঋকের নিন্দা এবং সামের প্রশংসা প্রতিপন্ন হইয়াছে। ঋত্বিগণ ঋকের দ্বারা যাহা স্তব করেন (যে কৰ্ম্মের গুণকীৰ্ত্তন করেন) তাহা অসুরগণ প্রাপ্ত হয় (অর্থাৎ অসুরেরা আসিয়া নষ্ট করে)। তাহারা সাম মন্ত্রের দ্বারা যাহা স্তব করেন, তাহা অসুরগণ প্রাপ্ত হয় না। এই প্রকার বিশেষরূপে জানিয়া সামের দ্বারাই কৰ্ম্ম স্তুতি করিবে (কৰ্মারম্ভ করিবে। ইহা দ্বারা ঋকের নিন্দা করিয়া সামের প্রশংসা পূৰ্ব্বক, লিঙ প্রত্যয় দ্বারা সাম বিহিত হইয়াছে। অতএব সাম মন্ত্রের দ্বারা স্তব করিবে, ইহাই স্থির হইল।

সেই সাম যে ঋক্‌-মন্ত্রের সংস্কারক, তাহাই উক্ত পাদের দ্বিতীয় অধিকরণে নির্ণীত হইয়াছে; যথা– সামর্জং প্রতিমুখ্যং স্যাৎ ইত্যাদি। অর্থাৎ রথন্তরং গায়তি ইত্যাদি শ্রুতিতে যে গান বিহিত হইয়াছে, তাহাই সাম শব্দের অর্থ, ইহাই এই অধিকরণে পতিপাদিত হইয়াছে এবং স্মরণ করান হইয়াছে। সেই গান ঋকের প্রধান কর্ম (সংস্কারক) হইবে। কেন? কারণ যাগানুষ্ঠানের বাহিরে (অন্য সময়ে) অধ্যয়নকালেও তাহা পঠিত হইয়া থাকে। কিন্তু গুণকৰ্ম্ম হইলে ব্রীহি-প্রোক্ষণাদির ন্যায় যাগের মধ্যেই গান অনুষ্ঠিত হইত; তাহা হইলে অন্যকালীন গানের ফল, বিশ্বজিৎ আদির ন্যায় কল্পনা করিতে হইবে। যাগের মধ্যকালীন যে গান তাহা প্রজাদির ন্যায় আরাদুপকারক অঙ্গ; সেই নিমিত্ত, ইহা মুখ্য (প্রধান) কৰ্ম্ম, কিন্তু গুণকৰ্ম্ম নহে ইহাই পূৰ্ব্বপক্ষ। এস্থলে বলিতেছি–বহিঃ-পাঠ প্রধান কৰ্ম্মৰ্বকে কল্পনা করিতে পারে না। কারণ, ভূমিরথিকশুষ্কেষ্টি এই ন্যায় দ্বারা প্রয়োগ বিষয়ে পটুতার নিমিত্ত গান-অধ্যয়নের উপপত্তি হইতে পারে। (যেমন ভূমিরথিক ভূমিতে রথ অঙ্কিত করিয়া রথ-রচনা অভ্যাস করে, এবং যেমন ছাত্র শুষ্ক ইষ্টি অর্থাৎ নিষ্ফল যাগ দ্বারা অনুষ্ঠান বিষয়ে নিজের পটুতা সম্পাদন করিযা থাকে, সেইরূপ। ইহাই ভূমিরথিকশুষ্কেষ্টি ন্যায়ের তাৎপৰ্য্য)। গুণকৰ্ম্ম পক্ষে প্রয়োজন না থাকায় ইহাই (গান) প্রধান কৰ্ম্ম হইবে, এইরূপও বলিতে পার না যেহেতু, গানের দ্বারা সংস্কৃত (দোষশূন্য) ঋক্ সম্বন্ধীয় অক্ষর-সমূহ দ্বারা স্তুতি হইতে পারে; কারণ, — আজ্য প্রভৃতির দ্বারা স্তব করিবে, –এইরূপ স্তুতি বিধান আছে। সেইজন্য, ঋক্‌-সম্বন্ধী অক্ষর-সকলের স্বর বিশিষ্ট স্বরূপ যে অভিব্যক্তি, তাহাই প্রয়োজনরূপে লক্ষিত হইয়াছে। এই জন্য অদৃষ্টের কল্পনা হইতে পারে না। অতএব গান যে সংস্কার-কৰ্ম্ম ইহাই সিদ্ধান্ত হইল।

ঋক্‌-সম্বন্ধীয় অক্ষর-সমূহের সংস্কারক গীতিরূপ যে উক্ত সাম, তাহা এক একটী করিয়া ছন্দোগগণ এক একটী ঋকেতে বেদ-সাম নামক গ্রন্থে পাঠ করিয়া থাকেন। কিন্তু তাহারা ঊহ নামক গ্রন্থে এক একটী সাম তৃচের পাঠ করেন। সেই উহ গ্রন্থের বিষয় সেই নবম অধ্যায়ের দ্বিতীয় পদে, প্রথম অধিকরণের দ্বিতীয় বর্ণকে, বিচারিত হইয়াছে; যথা- উঁহু গ্রন্থ্যেহপৌরুষেয়ঃ ইত্যাদি। সামগায়কগণ যে গ্রন্থে প্রত্যেক তৃচে এক একটী সামগান করিয়া থাকেন, সেই ঊহ গ্রন্থ নিত্য এবং পুরুষ কর্তৃক প্রণীত নহে। কেন? কারণ, অনধ্যায়-বর্জন, কৰ্ত্তার অস্মরণ (ইহার প্রণেতা কে, তাহার স্মরণ না হওয়া) এবং অধ্যাপকগণ বেদ-স্বরূপ–এইরূপ প্রসিদ্ধি থাকায়, বেদ-সাম নামক যোনিগ্রন্থের সহিত সাদৃশ্য আছে। কিন্তু এ কথাও বলিতে পার না। যেহেতু, অপৌরুষেয় ॥

পক্ষে (ইহা পুরুষপ্রণীত নয় এই পক্ষে) বিধির ব্যর্থতা-প্রসঙ্গ (অর্থাৎ বিধি ব্যর্থ) হইতে পারে; যেহেতু, এ ষযোন্যাং তদুত্তরয়োগায়তি এইরূপ বিহিত হইয়াছে। তাহার অর্থ এই, –বেদ-সাম নামক গ্রন্থ অপৌরুষেয়, প্রতিপন্ন হইলে, কয়া নশ্চিত্রঃ ইত্যাদি যোনি-গ্রন্থে একটী ঋকেতে, যে বামদেব নামক সাম উপদিষ্ট হইয়াছে, তাহাই উত্তরবর্তী কা সত্যো মদানাম ইত্যাদি দ্বিতীয় ও তৃতীয় ঋকে গান করিতে হইবে। তাহাতে ঊহ গ্রন্থের বেদত্ব হইলে, এইরূপ এই বিধি, নিরর্থক হইবে। কারণ, বেদ-সামের ন্যায় অধ্যয়ন হইতেই তাহা (অর্থাৎ ঊহ গ্রন্থের বেদত্ব) সিদ্ধ হইয়াছে। উপরিস্থ দুইটী ঋকে এই সামপৌরুষেয় প্রতিপন্ন হইলেও, সামস্বরূপ এবং তাহার আশ্রয়ভূত তিনটি ঋকের বেদত্ব-হেতু জীর্ণ কূপ ও উদ্যান প্রভৃতির ন্যায়, বহু কাল-ব্যবধান বশতঃ, অনধ্যায় (অধ্যয়নাভাব) এবং কৰ্ত্তার অস্মরণ, উপপন্ন হইয়াছে। অধ্যাপকগণের বেদত্ব-খ্যাতি অস্মরণমূলক। যেমন, বচের অধ্যাপকগণ মহাব্রতানুষ্ঠানের প্রতিপাদক যে আশ্বলায়ন-প্রণীত কল্পসূত্র, তাহা আরণ্যে অধ্যয়ন করতঃ, পঞ্চম আরণ্যককে বেদরূপে ব্যবহার করিয়া থাকেন; ইহাও সেইরূপ। তাহারও বেদত্ব হউক-এই কথা বলা যাইতে পারে; যেহেতু, প্রথম আরণ্যক-কর্তৃক পুনরুক্ত হইয়াছে এবং অর্থবাদশূন্যহেতু ব্রাহ্মণের সমান হইতেছে না। সেই জন্য পঞ্চম আরণ্যকের ন্যায় ঊহ-গ্রন্থ পৌরুষেয়। পৌরুষেয় ও যুক্তিমূলক বলিয়া, যেস্থলে বক্ষ্যমাণ ন্যায়ের বিরোধ হইবে, তাহা প্রমাণ বিরুদ্ধ।  সে বিষয়ে কতকগুলি বিশেষ বিধি আছে; তাহা বহু-বর্ণকযুক্ত তৃতীয়, চতুর্থ পঞ্চম ও ষষ্ঠ অধিকরণ দ্বারা বিচারিত হইয়াছে। তাহার মধ্যে তৃতীয় অধিকরণ এইরূপ, অংশৈঃ সামঞ্জু ইত্যাদি। এ বিষয়ে একং সাম তৃচে ক্রিয়তে স্তোত্রিয়ং, এইরূপ শ্রুতি আছে। সেই শ্রুতিতে ভাগত্রয়ের বিভক্ত যে সাম, তাহার মধ্যে এক এক ভাগ এক এক ঋকে গান করিবে। কেন? যেহেতু, একমাত্র সামের ঋয়ের দ্বারা নিষ্পত্তি-সম্বন্ধে শ্রুতি আছে। এইরূপ পূৰ্ব্বপক্ষ হইলে আমরা বলিতেছি, –স্তোত্রিয়ংইহা দ্বারা সমস্ত সাম যে স্তুতি নিম্পাদক, ইহাই বিহিত হইতেছে। কিন্তু সামের অংশবিশেষ স্তুতি-নিম্পাদক নহে। গুণকথনবাক্যের নাম স্তুতি। সেই বাক্য একটী ঋকে সম্পূর্ণ হইয়া থাকে। সুতরাং সমগ্র সামের দ্বারা সেই বাক্যের সংস্কার কর্তব্য। এই জন্য প্রত্যেক ঋকে সমগ্র সামের আবৃত্তি করিবে। তাহা হইলে দ্বিতীয় ও তৃতীয় ঋকে উক্তবিধ সামের আবৰ্ত্তমান (পুনঃপুনঃ উক্তি) হেতু সামান্তরত্ব হইল না। অতএব উহার ঋত্রয়-নিপাদ্যত্ব বিরুদ্ধ হইতেছে না। সেইজন্য প্রত্যেক ঋকে সমস্ত সাম সমাপন করিবে।

চতুর্থ অধিকরণ কথিত হইতেছে। তিদিতং ইত্যাদি। অর্থাৎ–বিষম ছন্দঃ বিশিষ্ট অথবা সমছন্দঃ বিশিষ্ট যে কোনও তিনটি ঋকে স্বেচ্ছাধীন সাম গান কর্তব্য, এরূপ কোনও নিয়ামক বাক্য নাই। কিন্তু তাহা বলিতে পার না। যেহেতু, শরলেশের প্রসঙ্গরূপ নিয়ামক বাক্য রহিয়াছে। শর শব্দের অর্থ হিংসা এবং লেশ শব্দের অর্থ–অল্পতা। কারণ হিংসাৰ্থক শৃ ধাতু ও অল্পতাবাচক লিস্ ধাতু, এই ধাতুদ্বয় দৃষ্ট হইয়া থাকে। অধিকছন্দোবিশিষ্ট যোনি-ঋক্ হইতে উৎপন্ন সাম, অল্প-ছন্দোবিশিষ্ট ঋদ্বয়ে গীত হইলে সাম ভাগদ্বারা তাহার পূরণ হওয়ায়, অবশিষ্ট সামভাগের আশ্রয় থাকিল না; সুতরাং তাহা হিংসিত হইল। আর যদি যোনি অপেক্ষা অধিকছন্দোবিশিষ্ট ঋদ্বয়ে গান করা হয়, তাহা হইলে সামের অল্পতৃ-হেতু অবশিষ্ট ঋকের অংশ সামরহিত হইবে। সেই জন্য তুল্য-ছন্দোবিশিষ্ট ঋকত্রয়ে গান করা কর্তব্য, এইরূপ সিদ্ধান্ত হইল।

পঞ্চম অধিকরণের প্রথম বর্ণক বিবৃত হইতেছে, –ছন্দস্থয়ো ইত্যাদি অর্থাৎ ঋক্ পাঠের নিমিত্ত সামগায়কগণের ছন্দঃ ও উত্তরা নামে দুইখানি গ্রন্থ আছে। তাহার মধ্যে ছন্দোনামক গ্রন্থে নানাবিধ সামের যোনিস্বরূপ ঋক্‌-সকল পঠিত হইয়াছে। উত্তরা গ্রন্থে তৃচাত্মক সুক্তসকল পঠিত হইয়াছে। একটী তৃচে যে প্রথম যোনি ঋক্, তাহা ছন্দো-গ্রন্থে উল্লিখিত; আর অপর দুইটি ঋক্ উত্তরাম্মন্থস্থিত। এইরূপ স্থির হইলে, এ এ রথযুরমুত্তরয়ো গায়তি, যদযোন্যাং তদুত্তরয়োগায়তি–এই শ্রুতিতে রথন্তর-সম্বন্ধে দ্বিবিধ উত্তরা সম্ভাবিত হইয়াছে। ছন্দো-গ্রন্থে অভিত্বা শূরা এই ঋক্‌ যোনিরূপে সঠিক পঠিত হইয়াছে এবং তাহার পরে তামিদ্ধি হবামহে ইত্যাদি বৃহৎ, সমুদয় সামের উৎপত্তিস্থান-সকলে পঠিত হইয়াছে। (৩ প্র./ ১খ./ ১ঋ)। উত্তরা গ্রন্থে অভিত্বা শূর এই সূক্তে সেই ঋকের পরে ন ত্বা বা অন্য এই ঋক্ কোনও সামের যোনিরূপা নয় বলিয়া পঠিত হইয়াছে। সেই স্থলে যাদ বল, –ছন্দঃ গ্রন্থের অপেক্ষায় বিভিন্ন সামদ্বয়ের যে দুইটি যোনি ঋক্, তাহারা রথন্তর-সামের স্বকীয় যোনিভূত ঋকের উত্তরাঋক্ হইয়া থাকে এবং উত্তরা গ্রন্থের অপেক্ষায় তৃচস্থিত যে দ্বিতীয় ও তৃতীয় ঋক্, তাহারা স্বকীয় যোনিভূত যোনিভৃত ঋকের উত্তরা-ঋক হইয়া থাকে এবং সেই বিষয়ে বিশেষ নিয়ামক বাক্যের অভাবহেতু যে কোনও দুইটি উত্তরা ঋকের গান করিবে;–তাহা বলিতে পার না। কারণ, প্রতিযোগীর অপেক্ষা না থাকায়, উত্তরাএই সংজ্ঞাশব্দ সহসা বুদ্ধিতে আসিয়া থাকে। পূৰ্ব্বপঠিত যোনি ঋক্‌কে অপেক্ষা করিয়া যে উত্তরাত্ব বলা হইয়াছে, তাহা বিলম্বে বোধগম্য হয় বলিয়া, দুৰ্বল। ছন্দ গ্রন্থে পঠিত স্বীয়যোনির উত্তরভাবিনী (যাহা পরে হইয়া থাকে) ঋক্ এবং অন্য সামের যোনিভূত যে দুইটি ঋক্, তাহাদের এই প্রকার দুর্বল উত্তরাত্বই প্রসিদ্ধ (অর্থাৎ উক্তবিধ ঋদ্বয়কেই ঐরূপ উত্তরা বলা যাইতে পারে)। কিন্তু তৃচগত যে দ্বিতীয় ও তৃতীয় ঋক্, তাহাদের উত্তরাত্ব সংজ্ঞা সিদ্ধ রহিয়াছে। অতএব সেই দ্বিতীয় ও তৃতীয়া গান করিবে। এইরূপ হইলে, পূৰ্ব্ব (চতুর্থ) অধিকরণে যে তুল্যছন্দো-বিশিষ্ট ঋকসকলে গান করিবে-নির্ণীত হইয়াছে, তাহা অনুগৃহীত হইল। আরও, তৃচাত্মক সূক্ত-সমূহের মধ্যে প্রথম যে যযানি-ভূত ঋক্, তাহার নামানুসারে ছন্দোগ্রন্থের যোনিগ্রন্থ সমাখ্যা (নাম), অধ্যাপকগণ কর্তৃক প্রদত্ত হইয়াছে। কিন্তু অপর তৃচসমষ্টিরূপ গ্রন্থের উপরিতন ঋকদ্বয়ের নামানুসারে উত্তরা সমাখ্যা হইয়াছে। সেই গ্রন্থ–কৰ্ম্মের অঙ্গ প্রতিপাদক প্রকরণ বলিয়া খ্যাত। পঞ্চদশ সপ্তদশ প্রভৃতি স্তোম-সকলের তৃচেতে উৎপত্তি হইয়া থাকে বলিয়া উত্তরা-গ্রন্থস্থিত তৃচগত যে দ্বিতীয়, তৃতীয় ঋক্, তাহার এই উহ হইবে, ইহাই সিদ্ধান্ত।

অনন্তর দ্বিতীয় বর্ণক কথিত হইতেছে, ত্রৈশোহকেহতিজগতৌ ঘে ইত্যাদি। অর্থাৎ–দ্বাদশাহ (দ্বাদশ দিন) সাধ্য কর্মে চতুর্থ দিনে ত্রৈশোক নামক সাম ঊহরূপে (উ২। প্র২। আ১২) বিহিত হইয়াছে। তাহা, বিশ্বাঃ পৃতনাঃ এই অতিজগতী ঋকে উৎপন্ন। তস্যাযোনো ইত্যাদিরূপ সেই তৃচ আস্নাত হইলে, তাহাতে (সেই সামে) বৃহতীদ্বয় উপেক্ষিত হইয়া থাকে। সেই স্থানে উৎপত্তিসিদ্ধ দুইটী অতিজগতাঁকে আনয়ন পূৰ্ব্বক সেই তিনটী ঋকেতে গান করা কর্ত্তব্য। তাহা হইলে পূর্ধ্ব-নির্ণীত যে সমচ্ছন্দোবিশিষ্ট ঋক্‌-বিষয়ক গান, তাহা অনুগৃহীত হয়। অন্যথা, অতি জগতীষু স্তবন্তি–এই শ্রুতিতে শ্ৰয়মাণ যে অতিজগতীর বহুত্ব, তাহা উপপন্ন হইতে পারে না। কিন্তু তাহা বলিতে পার না। যেহেতু, উত্তরয়োগায়তি–এই শ্রুতিতে কথিত হইয়াছে যে, সংজ্ঞা রূপ উত্তরা শব্দের স্থানে যে বৃহতীদ্বয় পঠিত হইয়াছে, তাহাই মুখ্য (প্রধান)। এ বিষয়ে শ্রুতিও বহুত্ব সামর্থ্য জন্য এবং সমাসু গানএই ন্যায়-হেতু বলবতী হইয়াছে। অতএব অতিজগতীর যে বহুত্ব, তাহা বৃহতীর পক্ষেও যুক্তিসিদ্ধ হইতেছে। এই স্থলে একবিংশতি স্তোম বিহিত হওয়ায়, তাহা উপপন্ন করিবার জন্য প্রথমা ঋকের সপ্তবার আবৃত্তি করা কর্তব্য। সেই জন্য বৃহতীদ্বয়ে ত্রৈশোক নামক সামের ঊহ করিতে হইবে। এইরূপ পঞ্চম অধিকরণের সিদ্ধান্ত। অনন্তর ষষ্ঠ অধিকরণের প্রথম বর্ণক কথিত হইতেছে, রথন্তরে ককুভ ইত্যাদি। ন বৈ বৃহদ্রথন্তরম ইত্যাদি আন্নাত হইয়াছে। তাহার অর্থ এই, বৃহৎ ও রথন্তর এই দুইটি সাম, অপর সামের ন্যায় একচ্ছন্দোবিশিষ্ট নহে; যেহেতু সেই বৃহৎ ও রথন্তর সামদ্বয়ের আশ্রয়-স্বরূপ যে সকল ঋক বিদ্যমান, তাহাদের মধ্যে পূৰ্ব্ব ঋী বৃহতী-ছন্দোবিশিষ্ট অর্থাৎ তাহা বৃহতীছন্দে রচিত (৩১২সূ। ১ঋ)। কিন্তু, অপর দুইটি ঋক্ ককু ছন্দে রচিত। ইহা ভিন্ন অপর যে সকল বামদেব্য প্রভৃতি সাম আছে, তাহাদের আশ্রয়স্বরূপ তৃচে অবস্থিত তিনটি ঋক্ এক ছন্দে রচিত। সংশর (সম্যক্ হিংসা) এবং বিলেশ (বিশেষ অল্পতা) এতদুভয়ের পরিহার; এবং সমাসু গায়েৎ এই ন্যায়, উত্তরা গ্রহে নির্ণীত হইয়াছে। কিন্তু, এই স্থলে বচনাধীন বিষম-ছন্দোবিশিষ্ট (বিভিন্ন ছন্দে রচিত) ঋকে গান হইবে। উক্ত স্থলে বলা যাইতেছে যে, রথর-সামের-আশ্রয়-রূপে উত্তরা গ্রন্থে তৃচ শ্রুত হয় নাই; তাহাতে কি হইবে (অর্থাৎ তাহাতে ক্ষতি নাই)? কারণ, তাহার (রথন্তরের) আশ্রয়রূপে প্রগাথ আম্নত হইয়াছে। সেই প্রগাথ, দুইটী ঋকের দ্বারা নিষ্পন্ন হওয়ায়, দ্বচ নামে খ্যাত। উক্ত ঋদ্বয়ের মধ্যে অভিত্বাশুর এইটী প্রথমা;–তাহা বৃহতী-ছন্দোবিশিষ্ট। আর ন ত্বা বা অনন্যাদিব্যঃ এইটী দ্বিতীয়া;–ইহা পংক্তি-ছন্দোবিশিষ্ট। তাহা হইলে, সেই পংক্তি-ছন্দোবিশিষ্ট ঋক্‌কে পরিত্যাগপূৰ্ব্বক, তাহার স্থানে দাশতয়ীস্থিত যে উৎপত্তি ও ককু-ছন্দোবিশিষ্ট দুই ঋক্, তাহাকে গ্রহণ করিবে। কেন? কারণ, প্রয়োজনবশতঃ ককুভাবুত্তরে এইরূপ বাক্য উদাহৃত হইয়াছে; সেই বাক্য দ্বারা রথযুর নামক সামের আশ্রয়রূপে বিনিযুক্ত যে ককুদ্বয়, তাহাতে ককুভের উৎপত্তি-প্রয়োজন যুক্ত হইয়াছে। অন্যথা (অর্থাৎ এরূপ না বলিলে) তাহা (ককুভ-এর উৎপত্তি) নিরর্থক হইবে। আরও, –উল্লিখিত যে একমাত্র পংক্তি-ছন্দঃ, তাহা স্বীকার করিলে দুইটি ঋই প্রাপ্ত হওয়া যায়; সুতরাং একং সাম তৃচে ক্রিয়তে স্তোত্রিয়ং এই বাক্য বিরুদ্ধ হইয়া পড়ে। সেই জন্য, রথন্তর নামক সামে উত্তরবর্তী ককুভ-ছন্দোবিশিষ্ট দুই ঋক্ গ্রহণ করিবে; এই যুক্তিই বৃহৎ সামে যোগ করিবে; ইহা পূৰ্ব্বপক্ষ। ইহার সিদ্ধান্ত বলিতেছি, –উল্লিখিত বৃহতী ও পংক্তি ছন্দের মধ্যে ককু-ছন্দঃ গ্রহণ করিবে। তাহাই প্রতিপাদন করা যাইতেছে। অভিত্বাশূর ইহা প্রথমা ঋক্‌। এ ঋক্ স্তুতিরূপা এবং বৃহতীছন্দোবিশিষ্টা। অবিকৃত সেই ঋকে রথস্তর সাম গান করিবে। পরে সেই ঋকে পুনৰ্ব্বার চতুর্থ পদকে উপাদান-পূৰ্ব্বক পরবর্তী পংক্তি ছন্দের পূৰ্ব্বার্ধের সহিত যুক্ত করিবে। সেই এই অষ্টাবিংশতি (২৮) অক্ষরবিশিষ্ট ত্রিপদা (পদত্রয়-যুক্ত) দ্বিতীয় স্তুতিরূপা ঋক্‌। তাহা একটি ককুভ রূপে পরিণত হয়। সেই ককুভে স্থিত শেষ পাদকে পংক্তির উত্তরাদ্ধের সহিত সম্বন্ধ করতঃ তৃতীয় স্তুতিরূপা ঋক্ সম্পন্ন করিবে। তাহাই দ্বিতীয় ককুভরূপে অভিহিত হইয়া থাকে। প্রথন প্রকারানুসারে উল্লিখিত দুইটি ঋকে তৃচ সম্পাদিত হওয়ায়, উক্ত বচনের (অর্থাৎ একং সাম তৃচে ক্ৰিয়তে স্তোত্রিয়ং এই বাক্যের) সহিত বিরোধ হইল না। এই প্রথন বিষয়ে পুনঃপদাঃ এইরূপ শ্রুতিবাক্যই সামর্থ্য অর্থাৎ উক্ত শ্রুতিবাক্য-বলেই ঐরূপ সম্বন্ধ করা যাইতেছে। সেই শ্রুতি এই–এষা বৈ প্রতিষ্ঠিত বৃহতী যা পুনঃপদা ইত্যাদি। উক্ত শ্রুতি বাক্যের অর্থ এই, –যে বৃহতী পুনঃপদা হয়, তাহাই স্থির হইয়া থাকে অর্থাৎ প্রতিষ্ঠালাভ করে। পদ শব্দের অর্থ চতুর্থ পাদ (পদ্যের শেষ অংশ)। অপর ঋক সম্পাদনের জন্য সেই চতুর্থ পাদ পুনৰ্ব্বার পঠিত হয় বলিয়া পূৰ্ব্বোক্ত বৃহতীছন্দ, পুনঃপদা নামে খ্যাত। সেই ঋক্ মাতৃস্বরূপা, তাহার পাদ বৎসস্বরূপ। এ ক্ষেত্রে উদগাতা (ঋত্বি-বিশেষ) চতুর্থপাদকে এস্থলে পুনৰ্ব্বার আরম্ভ করিয়া থাকেন বলিয়া, মাকে সম্মুখে দেখিয়া বৎস হিং এই প্রকার শব্দ করিয়া থাকে। কেবল সামর্থমাত্র দ্বারা প্রগথন (সম্বন্ধ-স্থাপন অর্থাৎ যোজনা) হয় না; কিন্তু ছন্দোগ (সামগায়ক) গণের প্রসিদ্ধি দ্বারাও প্রগথন হইয়া থাকে। তাহারা কাকুভঃ প্রগাথ এইরূপ স্মরণ করিয়াছেন। আরও, প্রকৃষ্টরূপে গ্ৰথন হয় যাহাতে, তাহাই প্রগাথ, এইরূপ অর্থ পৰ্য্যালোচনা দ্বারাও গ্ৰথন বোধগম্য হইতেছে। আন্নত ঋক্ পাঠ হইতে যে অধিকতা, তাহাই প্রকর্ষ। পূৰ্ব্বকথিত নিয়মানুসারে পদাবৃত্তি (পাদের পুনঃকথন) পূৰ্ব্বক অপর ঋকের সম্পাদন দ্বারা সেই আধিক্য উপপন্ন হইয়া সে থাকে। তাহা হইলে সিদ্ধ হইতেছে, উৎপত্তি ও ককুড় গ্রহণ করিবে না। তাহাতে কি বক্তব্য আছে? সে স্থলে বক্তব্য এই যে, –প্রগথন দ্বারা উত্তরবর্তী ককুদ্ধয় সম্পাদন করিয়া সেই তিনটী ঋকে রথন্তর-সাম গান করা কর্তব্য এবং বৃহৎ সাম গান করা বিধেয়। এইরূপ স্থির হইলে, পংক্তি ছন্দ পাঠ করা সার্থক হইল। ককুভের  উৎপত্তি যে নিরর্থক, এইরূপ আশঙ্কাও করা যায় না। কারণ, বাচস্তোম প্রকরণে তাহার (ককুভ উৎপত্তির) প্রয়োগ রহিয়াছে। অতএব তাহা সার্থক। এই সকল কারণে প্রগ্ৰথন-বিষয়ে কোনও অনুপপত্তি (যুক্তির অভাব) থাকিল না। ইহাই সিদ্ধান্ত।

দ্বিতীয় বর্ণক কথিত হইতেছে, যৌধজয়ে রৌরবে চইত্যাদি। শ্রুতিতে রৌরব যৌধজয়ে বাহঁতে তৃচে ভবতঃ–এইরূপ আমাত হইয়াছে। তাহার অর্থ এই, –একটি সামের নাম রৌরব, এবং অপর একটীর নাম যৌধাজয়ঃ। বৃহতীছন্দোবিশিষ্ট তৃচই সেই দুইটি সামের আশ্রয়। কিন্তু উত্তরাগ্রন্থে একমাত্র প্রগাথ সেই দুই সামের আশ্রয়রূপে আন্নাত হইয়াছে। সেই প্রগাথে পুনানঃ সোম এই ঋী প্রথমা, এবং তাহা বৃহতীচ্ছন্দে রচিত। আরও দুহান উদ্দিব্যম এই ঋী দ্বিতীয়া; তাহাও বিষ্টারপংক্তি নামক ছন্দোবিশিষ্ট। সেই বিষ্টারপংক্তি ছন্দকে ত্যাগ করিয়া তাহার স্থানে উৎপত্তিবৃহতীদ্বয়বিশিষ্ট দুইটি ঋকে আনয়ন করিবে। ইহাই পূৰ্ব্বপক্ষ। বৃহতী ও বিষ্টারপংক্তির প্রগ্ৰথন-বিশেষ দ্বারা অপর বৃহতীদ্বয়কে সম্পন্ন করিবে। ইহাই সিদ্ধান্ত। সেই পূৰ্ব্বপক্ষ ও সিদ্ধান্ত–এতদুভয় স্থলে যে যুক্তি উল্লিখিত হইয়াছে, তাহা পূৰ্ব্বন্যায়ানুসারে দ্রষ্টব্য। পূর্বোক্ত স্থলে শ্রুতি-সামর্থ্য এইরূপে উল্লিখিত হইয়াছে–যষ্টিস্ত্রিষ্টুভোমাধ্যন্দিনং লবন। তাহার অর্থ এই, –রৌরব ও যৌধাজয় নামক সামদ্বয় মধ্যাহ্ন-কৰ্ত্তব্য যজ্ঞীয়-স্নানে গীত হইয়া থাকে। সেই সবনকার্যে ত্রিষ্টুভনামক ছন্দোবিশিষ্ট ষষ্টি (৬০) সংখ্যক ঋক্ আছে। প্রথন করিলে (এক ছন্দের সহিত অপর ছন্দের পরস্পর যোজনা করাকে প্ৰগ্ৰথন বলা হইয়াছে), সেই ষষ্টি সংখ্যা উপপন্ন হয়। তাহাই সপ্রমাণ করা যাইতেছে; যথা, –মধ্যাহ্ন কর্তব্য যজ্ঞিয়ন বিষয়ে একটী পবমান, চারিটি পৃষ্ঠ-স্তোত্র এবং অপর তিনটী সূক্ত আছে। তাহার মধ্যে উচ্চাতে জাতং এই একটী সূক্ত; তাহাতে গায়ত্রী নামক তিনটি ঋক্ আছে। পুনানঃ সোম এইটি দ্বিতীয় সূক্ত। তাহা প্রগাথস্বরূপ এবং তাহাতে প্রথমে বৃহতী, পরে বিষ্টারপংক্তি এই দুই ছন্দঃ আছে। প্রতুদ্রব পরিকোশং–ইহা তৃতীয় সূক্ত। উক্ত সূক্তে তিনটি ত্রিষ্ঠুভ আছে। পৃষ্ঠস্তোত্র-সমূহে অভিত্বা শুর ইত্যাদি প্রগাথুরূপ প্রথম সূক্ত। তাহার পূৰ্ব্বে বৃহতী এবং পরভাগে বিষ্টারপংক্তি ছন্দ আছে। কিয়ানশ্চিত্রঃইত্যাদি দ্বিতীয় সূক্ত; তাহাতে তিনটি গায়ত্রী ছন্দ আছে। তং বোদস্মমৃতীষহং–ইহা প্রগাথরূপ তৃতীয় সূক্ত। তাহাতে বৃহতী ও পংক্তি ছন্দঃ আছে। তিরোভিবোর্বিদদ্বসুংইহা প্রগাথরূপ চতুর্থ সূক্ত; তাহাতেও বৃহতী ও পংক্তি ছন্দঃ আছে। এইরূপ অন্য সবন-প্রকরণে সাতটি সূক্ত আছে। তাহার মধ্যে নয়টি সাম গান-যোগ্য (অর্থাৎ নববিধ সামের গান করিবে)। সেই নয়টি সাম কি কি, এস্থলে তাহাই কথিত হইতেছে; প্রথম সূক্তে গায়ত্র ও আমহীয়ব এই দুইটি সাম, দ্বিতীয় সূক্তে রৌরব ও যৌধাজয় এই দুইটি সাম, তৃতীয় সূক্তে ঔষণ (ঊষাদেব সম্বন্ধীয়) সাম, চতুর্থ সূক্তে রথন্তর সাম, পঞ্চম সূক্তে বামদেব্য নামক সাম, ষষ্ঠ সূক্তে নৌধস সাম এবং সপ্তম সূক্তে কালেয় নামক সাম। ইহাই নববিধ সাম। উক্ত সাতটি সূক্তের মধ্যে প্রথম সূক্তের সামদ্বয় যাহাতে প্রতিপন্ন হয়, সেই নিমিত্ত উক্ত সামদ্বয়ের আশ্রয়ভূত যে তিনটি গায়ত্রী ঋক্ আছে, তাহা বারম্বার উচ্চারিত হইয়া ষট্‌সংখ্যক হইয়া থাকে। বামদেব্য-সামের আশ্রয়স্বরূপ যে তিনটি ঋক্, তাহা সপ্তদশ স্তোম নিস্পত্তির জন্য দ্বিরুক্ত হইয়া সপ্তদশ-সংখ্যক গায়ত্রী ঋক্ হইয়া থাকে। এইরূপে মিলিত হইয়া ত্ৰয়োবিংশতি (২৩) সংখ্যক গায়ত্রী হইল। ষষ্ঠ সূক্তে বৃহতী ও পংক্তি এই দুই ছন্দোবিশিষ্ট যে ঋক্ আছে, তাহা প্ৰগ্ৰথন দ্বারা বাহত (বৃহতী সম্বন্ধীয়) গ তৃচ হইয়া থাকে। সপ্তম সূক্ত ও ষষ্ঠ সূক্ত–এই উভয় সূক্ত মিলিয়া সপ্তদশ স্তোম হয়। এইরূপ চতুস্ত্রিংশৎ (৩৪) সংখ্যক বৃহতী হইয়া থাকে। দ্বিতীয় সূক্তে প্ৰগ্ৰথন দ্বারা বাহঁত তৃচ সম্পাদিত হইয়াছে। সামদ্বয়ের নিমিত্ত ঐ বার্হত তৃচ বারদ্বয় উচ্চারণ করিলে ছয়টি বৃহতী হইতেছে। চতুর্থ সূক্তে রথন্তর-সাম-নিষ্পত্তির জন্য, পূৰ্ব্ববর্ণকে কথিত রীতি অনুসারে, বিশিষ্ট সম্বন্ধ দ্বারা তৃচের শেষ-পাঠ্য ককুদ্বয় নিষ্পন্ন হইতেছে। কিন্তু প্রথম যে বৃহতী ঋক্, তাহা স্বতঃসিদ্ধ হইয়াছে। সেই সূক্তে সপ্তদশ স্তোম সিদ্ধ হইয়াছে; তাহাতে পাঁচটি বৃহতী এবং দ্বাদশটী ককুভ সম্পন্ন হইয়া থাকে। উক্ত স্তোমের বিধায়ক যে ব্রাহ্মণভাগ, তাহা এইরূপে শ্রুত হইয়াছে, –পঞ্চভ্যো হিঙ্করোতি ইত্যাদি। তাহার অর্থ এইরূপ, –স্বতঃসিদ্ধ একটী বৃহতী ঋক্ এবং প্রথন দ্বারা উৎপন্ন দুইটী ককু ঋক্‌–তদুভয়ের দ্বারা একটী তৃচ নিষ্পন্ন হইয়াছে; সেই তৃচটী, তিনটি পৰ্য্যায় দ্বারা আবৰ্ত্তিত করিবে। তাহার মধ্যে প্রথম পর্যায়ে বৃহতী বারত্ৰয় এবং ককু-ছন্দরচিত-ঋক্‌ দুইটি এক এক বার গান করিবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে বৃহতী একবার, অনন্তর ককুভ তিন বার এবং সৰ্ব্বশেষস্থিত যে ককুভ, তাহা একবার গান করিবে। আর তৃতীয় পর্যায়ে বৃহতী একবার ও প্রথম ককুড় তিনবার এবং শেষ ককুড় তিন বার গান করিবে। গান করিবার সময় সর্বত্র হি এইরূপ শব্দ করিবে। তাহা হইলে দেখা যাইতেছে, তৃতীয় সূক্ত ভিন্ন অন্য ছয়টি সূক্তে এয়োবিংশতি সংখ্যক গায়ত্রী ঋক্, পঞ্চত্বারিংশৎ সংখ্যক (৪৫) বৃহতী ঋক্ এবং দ্বাদশটি (১২) ককু ঋক্ সম্পন্ন হইয়াছে। উক্ত সূক্ত-সমূহে যে ককুছন্দঃ আছে তাহা অষ্টাবিংশতি (২৮) অক্ষর-বিশিষ্ট। যদি সেই ককু-ছন্দে গায়ত্রীর দুই পাদ (ষোড়শ অক্ষর) যোগ করা হয়, তাহা হইলে চতুশ্চত্বারিংশৎ (৪৪) অক্ষর-বিশিষ্ট একটি ত্রিভ-ছন্দঃ সম্পন্ন হইয়া থাকে। এই প্রকারে দ্বাদশটি ককুভুকে ত্রিষ্ট করিতে হইলে, তাহাতে গায়ত্রীর চতুর্বিংশতি (২৪) পাদ যোগ করা আবশ্যক। যদি ঐরূপযোগ করা হয়, তাহা হইলে এয়োবিংশতি (২৩) গায়ত্রীর মধ্যে আটটী গায়ত্রী গত হইল। কারণ, গায়ত্রী-পদত্রয়বিশিষ্ট পাদয়ের অষ্টগুণ করিলে ২৪শ পাদ হইয়া থাকে। সুতরাং আটটি গায়ত্রী, ক্রমে দ্বাদশ ককুভে প্রবিষ্ট হওয়ায়, আর পঞ্চদশটী (১৫)মাত্র গায়ত্রী অবশিষ্ট থাকিল। অবশিষ্ট সেই সকল গায়ত্রীর পঞ্চচত্বারিংশৎ (৪৫) পাদকে সমসংখ্যা (৪৫) বিশিষ্ট, সমস্ত বৃহতীতে যথাক্রমে যুক্ত করিয়া, ত্রিষ্ঠুভ নিষ্পন্ন করিবে। উক্ত প্রকারে পঞ্চচত্বারিংশৎ (৪৫) ককুভে দ্বাদশ ত্রিষ্টু নিষ্পন্ন হয়। স্বতঃসিদ্ধান্তিস্রঃ অর্থাৎ তিনটি বৃহতী কোন ছন্দ অপেক্ষা না করিয়া সিদ্ধ হইয়া আছে, তৃতীয় সূক্তে এইরূপ প্ৰগ্ৰথন (যোজনা বিশেষ) বলা হইয়াছে। সেই পক্ষে যষ্টি-সংখ্যক ত্রিষ্ঠুভ পাওয়া যায়। ঐ ত্রিষ্ঠুভ সকল উত্তরাগ্রন্থে উল্লিখিত হইয়াছে। কিন্তু প্রকরণে উল্লিখিত ষষ্টি-সংখ্যক ত্রিষ্ঠুভ উৎপত্তি বৃহতী নিম্পাদন সময়ে পাওয়া যায় না। সেই জন্য স্বতঃসিদ্ধ বৃহতীর স্থলে ষষ্টি সংখ্যারূপ প্রকৃত সংখ্যার সঙ্গতি এবং উৎপত্তি বৃহতী-স্থলে তদপেক্ষা ন্যূন-সংখ্যারূপ অপ্রকৃত (অনুল্লিখিত) সংখ্যার কল্পনা করিতে হইবে। ঐরূপ প্রসঙ্গাধীন স্থির হওয়ায় ষষ্টিসংখ্যক ত্রিষ্ঠুভ বৃহতীর প্রগ্ৰথন যে অবশ্য কর্তব্য, তাহাই প্রতিপাদিত হইতেছে। অতএব ত্রিষ্টুভঃ ষষ্টি–এই বাক্যে প্রথনের সামর্থ্য আছে স্থির হইল। প্রথনের প্রণালী বলা যাইতেছে; যথা, –পুনানঃ সোম, এই বৃহতী-ছন্দোবিশিষ্ট ঋকের চতুর্থ পাদকে পুনৰ্ব্বার গ্রহণ করিয়া তাহা বারদ্বয় উচ্চারণ করিবে। তারপর তাহাকে দুহান উধর্দিব্যম এই বিষ্টারপংক্তিছন্দঃযুক্ত ঋকের পূৰ্ব্বার্ফের সহিত সংযুক্ত করিবে। সেই ঋক্ বৃহতী নামে প্রসিদ্ধ। উক্ত প্রকারে সংযোগ করিয়া যে বৃহতী ঋক্ হইয়াছে, তাহার চতুর্থ পদকে দুই বার উচ্চারণ করিয়া উক্ত বিষ্টারপংক্তির উত্তরাদ্ধের সহিত সংযুক্ত করিবে। তাহাও বৃহতী নামে খ্যাত। উক্ত প্রকার যোজনা দ্বারা যেরূপে বৃহতীদ্বয় উৎপন্ন হইল; যৌধাজয় ও রৌরব নামক সামদ্বয়ের প্রথন প্রণালীও সেইরূপ জানিবে; নৌধস ও কালেয় নামক সামদ্বয়ও ঐরূপ গঠিত হয়। ইহাই দ্বিতীয় বর্ণকের সিদ্ধান্ত।

তৃতীয় বর্ণক কথিত হইতেছে; যথা, শ্যাবাশ্বাং ধীগবে ইত্যাদি। শ্রুতিতে আছে, পঞ্চছন্দা আবাপঃ ইত্যাদি। তাহার অর্থ এই যজ্ঞনিমিত্তক তৃতীয় সবন-প্রকরণে আর্ভব নামক পবমান সূক্ত আছে; তাহাতে– পাঁচটি ছন্দ ও সাতটি সাম বিদ্যমান। তাহার মধ্যে স্বাদিষ্ঠয়া মদিষ্ঠা–ইহা একটী সূক্ত (উ১। প্ৰ২৫)। সেই সূক্তে তিনটি গায়ত্রী ঋক্ আছে। সেই ঋয়ে গায়ত্র্য ও সংহিত নামক দুইটি সাম লক্ষিত হয়। পুরোজিতী বো অন্ধসঃ–ইহা অপর একটী সূক্ত (উ১। প্র১৮)। সেই সূক্তে একটী অনুষ্ঠুভ ঋক্ এবং পরে দুইটী গায়ত্রী ঋ আছে। সেই অনুষ্ঠুভ প্রভৃতি তিনটী ঋকে শ্যাবাশ্ব (উ১। প্র১১) ও আন্ধীগব নামক দুইটী সাম আছে। ইন্দ্ৰমচ্ছসুতা ইহা অপর একটী সূক্ত (উ১। প্র১৮)। সেই সুক্তে উষ্ণিচ্ছন্দোবিশিষ্ট তিনটি ঋক এবং তাহাতে সফ নামক সাম আছে। পবস্ব মধুমত্তমং ইহা প্রগাথরূপ সূক্ত। সেই প্রগাথের পূৰ্ব্বস্থিত ঋক্ ককুছন্দোবিশিষ্ট এবং পরস্থিত ঋক্ পংক্তিছন্দোবিশিষ্ট। তত্র পৌস্কলম (উ১। প্র১৯) ইহা অপর একটী সূক্ত। তাহাতে তিনটি জগতী ঋক্ আছে; সেই জগতীয়ে কাব নামক সাম গীত হইয়া থাকে। এই পাঁচটি সূক্তের মধ্যে পুরোজিতীবঃ ও পবস্ব নামক যে দুইটী সূক্ত আছে, সেই সুক্তদ্বয়ে যদিও দুইটি দুইটি করিয়া ছন্দের উল্লেখ হইয়াছে; কিন্তু তাহা হইলেও তুল্যছন্দঃ-বিশিষ্ট যে সকল ঋক্, তাহাতেই গান হইবে–ইহা প্রতিপাদন করিবার জন্য প্রথন করা হইয়াছে। সেইরূপ ভাবে প্রথন করিলে, উল্লিখিত সূক্তদ্বয়ে ছন্দের পার্থক্য থাকে না। সুতরাং একই ছন্দঃ সম্পন্ন হইতেছে। উক্তরূপে একই ছন্দঃ নিষ্পন্ন হইতেছে বলিয়া গায়ত্রী, অনুষ্ঠুভ, উষ্ণি, ককুভ ও জগতী–এই পঞ্চবিধ ছন্দোবিশিষ্ট যে আর্ভব পবমান সূক্ত, তাহা এই তৃতীয় সবনকালে অনুষ্ঠান করিবে। উক্ত আর্ভব-পবমানের অন্তত পুরোজিতীবঃ সূক্তে শ্যাবাশ্ব ও গান্ধীগব নামক দুইটি সাম আছে। যাহাতে সমান-ছন্দোযুক্ত ঋকে সেই সামদ্বয় গীত হয়, তজ্জন্য সূক্তের শেষে দুইটী গায়ত্রীর উল্লেখ হইবে। কিন্তু পরে তাহা পরিত্যাগ করিয়া তাহার স্থানে উৎপত্তিরূপ অনুষ্টুদ্বয় আনয়ন করিতে হইবে। ইহাই পূৰ্ব্বপক্ষ। এই পূর্ব পক্ষের সিদ্ধান্তান্তৰ্গত পুরোজিতীবঃ সূক্তে যে অনুষ্ঠুচ্ছন্দের উল্লেখ আছে, তাহারই চতুর্থ পাদটীকে পুনৰ্ব্বার গ্রহণ করিয়া, প্ৰগ্ৰথন-নিয়মে দুইটী অনুষ্ঠুভ করিতে হইবে। পূৰ্ব্বপক্ষ ও সিদ্ধান্ত এই উভয়ের যুক্তি পূৰ্ব্বরর্ণকে উক্ত যুক্তির তুল্য জানিবে যে পদার্থ-শক্তি দ্বারা প্রথন হইবে, সেই পদার্থ শক্তি চতুর্বিংশতি জগত্যঃইত্যাদি শ্রুতিতে উল্লিখিত হইয়াছে। যদি প্ৰগ্ৰথন করা হয়, তাহা হইলে উল্লিখিত চতুর্বিংশতি (২৪) সংখ্যা উপপন্ন হইতে পারে। উক্ত চতুর্বিংশতি সংখ্যা কিরূপে উপপন্ন হয়, তাহা স্পষ্ট করা যাইতেছে; যথা, গায়ত্র ও সংহিত নামক সামদ্বয়ের আশ্রয়স্বরূপ যে গায়ত্রী নামে তৃচ আছে, তাহা বারদ্বয় পাঠ করিলে ছয়টী গায়ত্রী ঋক্ হইয়া থাকে। ঐ গায়ত্রী ঋক্ চতুর্বিংশতি-অক্ষরযুক্ত। কিন্তু জগতী ঋক্ আটচল্লিশ-অক্ষরযুক্ত। জগতী ঋক্‌ আটচল্লিশটী অক্ষরযুক্ত বলিয়া ছয়টী গায়ত্রী ঋকের দ্বারা তিনটি জগতী ঋক্ হইয়া থাকে। শ্যাবাশ্ব ও আন্ধীগব নামক সামদ্বয়ের আশ্রয়স্বরূপ যে অনুষ্ঠুত্ৰয় তাহা প্রথন দ্বারা সম্পন্ন হইয়া থাকে। ঐ অনুষ্ঠুভ্রত্ৰয় বারদ্বয় উচ্চারিত হইয়া ছয়টী অনুষ্ঠুভ হয়। উক্ত ছয়টি অনুষ্ঠুভের দ্বারা তিনটি জগতী সম্পন্ন হইয়া থাকে। স্বতঃসিদ্ধ জগতী একটী এবং গায়ত্রী হইতে তিনটি ও অনুষ্ঠুভ হইতে তিনটি জগতী সম্পন্ন হইয়াছে। এই সকল মিলিয়া সমষ্টিতে সাতটী জগতী উৎপন্ন হইল। উষ্ণিহি ও ককুভি এই দুইটি সপ্তমী বিভক্ত্যন্তপদ। ঐ দুইটি পদ দ্বারা বিশেষ বিধান করা হইয়াছে। সেই জন্য সফ ও পৌস্কল নামক যে সামদ্বয় আছে, তৃচে তাহার গান করিবে না। কিন্তু এক একটী ঋকে তাহা গান করিবে, –এইরূপ বোধ হইতেছে। উষ্ণি ও ককুড়–এই দুইটি ছন্দঃ প্রত্যেকে অষ্টাবিংশতি-অক্ষর বিশিষ্ট। উহাদের অক্ষর-সমষ্টির পরিমাণ–৫৬। ঐ দুই ছন্দে একটি জগতী ৪৮ অক্ষরে ও গায়ত্রীর এক পদে ৮ অক্ষরে সম্পন্ন হইয়া থাকে। ককু-ছন্দের মধ্যম পাদ দ্বাদশ-অক্ষরযুক্ত এবং এ উষ্ণি ছন্দের শেষ পাদ দ্বাদশ অক্ষরযুক্ত। উষ্ণি ও ককুভের এই মাত্র প্রভেদ। কাব নামক সামের আশ্রয় স্বরূপ যে তিনটি জগতী আছে, তাহা স্বতঃসিদ্ধ। এইরূপে মিলিয়া সমষ্টিতে একাদশ জগতী হয়। ঐ একাদশ ও জগতী আর্ভব নামক পবমান-সূক্তে বর্তমান রহিয়াছে। কিন্তু গায়ত্রীর পাদ অতিরিক্ত। আর্ভব-পবমানের ন্যায় তৃতীয় যজ্ঞীয় স্নানে, একমাত্র যজ্ঞাযজ্ঞীয় স্তোত্র আছে। যজ্ঞাযজ্ঞ বো অগ্নয়ে–এই প্রগাথই তাহার আশ্রয়। সেই প্রগাথের প্রথম ঋক্ বৃহতী, এবং উত্তর ঋক্‌ বিষ্টারপংক্তি। সেই বৃহতী ও বিষ্টারপংক্তি প্ৰগ্ৰথন (পরস্পর যোজনা) করিয়া দুইটি উত্তরা ককুড় করিবে। সেই ককুভে একবিংশতি (২১) স্তোম আছে। যে বিষ্ণুতি সেই একবিংশ স্তোম বিধান করে, সেই বিষ্ঠুতি এইরূপে শ্রুত হইয়াছে; যথা, –সপ্তভ্যো হিংকরোতি ইত্যাদি। তাহার এই অর্থ, –জ্ঞাযজ্ঞা এই প্রগাথে যে প্রথমা বৃহতী আছে, তাহা পৰ্য্যায়ক্রমে তিনবার, একবার এবং আরও তিনবার পঠিত হইয়া সমষ্টিতে সাতটি বৃহতী হয়। মধ্যম ককুভ, –প্রথম পর্যায়ে এক বার, দ্বিতীয় পর্যায়ে তিনবার ও তৃতীয় পর্যায়ে তিনবার পঠিত হইয়া থাকে। এইরূপে চতুর্দশ ককু সম্পন্ন হয়। সেই চতুর্দশ ককুভে মধ্যম যে চতুর্দশ পাদ আছে, তাহা দ্বাদশ-অক্ষর-বিশিষ্ট। সেই চতুর্দশ পাদের মধ্য হইতে সাতটি পাদ, উক্ত সাতটি বৃহতীর সহিত যুক্ত করিতে হইবে। ঐরূপে যোগ করিলে, সাতটী জগতী হইয়া থাকে। অনন্তর চতুর্দশ ককুভের অষ্টঅক্ষরবিশিষ্ট যে চতুর্দশ আদি পাদ এবং চতুর্দশ অন্ত্য পাদ অবশিষ্ট থাকিল, তাহা মিলিয়া সমষ্টিতে অষ্টবিংশতি (২৮) পাদ হইতেছে। সেই আটাইশ পাদের মধ্যে ছয় পাদের দ্বারা একটী জগতী হয়। এই ক্রমে ২৪শ পাদের দ্বারা চারিটী জগতী হইয়া থাকে। চতুর্দশ মধ্যম পাদের মধ্যে দ্বাদশ-অক্ষর-বিশিষ্ট সাতটি মধ্যম পাদ অবশিষ্ট আছে; সেই সাতটি পাদে পবমান সূক্তের অতিরিক্ত যে গায়ত্রীর (আট অক্ষরযুক্ত) এক পাদ, তাহা যুক্ত করিবে এবং ককু সকলের অবশিষ্ট যে অষ্ট-অক্ষরযুক্ত পাদ চতুষ্টয়, তাহাতে চারিটি অক্ষর যোগ করিবে। ঐরূপে যোগ করিলে আরও দুইটি জগতী সম্পন্ন হইবে। এই প্রকারে যজ্ঞাযজ্ঞীয় স্তোত্রে এয়োদশ জগতী নিরূপিত হইয়াছে। এতদ্ব্যতীত পূৰ্ব্বে পবমান সূক্তে একাদশ-সংখ্যক জগতী কথিত হইয়াছে। তাহা হইলে সমষ্টিতে চতুর্বিংশতি-সংখ্যক জগাতী নিষ্পন্ন হইল। অষ্টাক্ষর-বিশিষ্ট পাদ-চতুষ্টয়ে যে অতিরিক্ত চারিটি বর্ণ যোগ করা হইয়াছিল, সেই চারিটি বর্ণ ত্যাগ করিয়া, ঐ পাদ-চতুষ্টয় মিলিত হইলে, একটী ককুভ ছন্দ হয়। এই প্রকারে পদার্থ-শক্তির দ্বারা স্থির হইল যে, শ্যাবাশ্ব ও আন্ধীগব এই দুইটী সাম, প্রগ্রথিত তৃচে গান করিবে; কিন্তু উক্ত সামদ্বয়ে উৎপত্তিরূপ অনুষ্ঠুভের অবতারণা করিবে না।

অতঃপর চতুর্থ বর্ণক কথিত হইতেছে; যথা, –চতুঃশতে প্ৰগ্ৰথন ইত্যাদি। গো-প্রচারণস্থলে অভিবৰ্ত্তো ব্ৰহ্ম সাম ভবতি এই শ্রুতি দ্বারা ব্ৰহ্ম নামক সাম বিহিত হইয়াছে। সেই ব্ৰহ্ম নামক সামকে লক্ষ্য করিয়া চতুঃশত ইত্যাদিরূপ শ্রুতি কথিত হইয়াছে। ঐ শ্রুতির অর্থ এই, সূক্তে এক শত চারিটী প্রগাথ আছে। সেই। প্রগাথ সকলের দেবতা ইন্দ্র। তাহাদের ছন্দ বৃহতী এবং দুইটী মাত্র ঋক্ তাহাদের স্বরূপ। উক্ত প্রগাথসমূহের মধ্যে প্রথম প্রগাথের দুইটী ঋক্ এবং দ্বিতীয় প্রগাথের মধ্যে একটী ঋক্ পরস্পর যোজনা করিলে যে একটী তৃষ্ট হয়, তাহাতে অভিবৰ্ত্ত নামক সাম গান করিবে। সপ্তবার উল্লিখিত যে তিনটী ঋক্, তাহা অবিকৃতভাবে এই তৃচে রহিয়াছে; সুতরাং উক্ত তৃচ প্রধান হইয়াছে। যদি পূৰ্ব্বকথিত নিয়মানুসারে ঋকের পাদ-প্ৰগ্ৰথন হয়, তাহা হইলে উক্ত ঋ-সকল বিকৃত হইবে; তখন আর উক্ত তৃচ মুখ্য থাকিবে না। ইহাই পূৰ্ব্বপক্ষ। উক্ত পূৰ্ব্বপক্ষের সিদ্ধান্তে বলা যাইতেছে যে, –সমস্ত ঋক্ পৃথক পৃথক হইয়া থাকে; ঋকের সেই পৃথৰ্ভবকেই সাম বলা হইয়াছে। অন্যা-অন্যায় ইত্যাদি বাক্যে ঋকলের পৃথকভাব (বিভিন্নতা) বর্ণিত হইতেছে। সেই এ পার্থক্য যদি পাদপ্ৰগ্ৰথন হয়, তাহা হইলে হইতে পারে। কিন্তু যদি ঋকের প্রগ্ৰথন হয়, তাহা হইলে উক্তরূপ এই পার্থক্য থাকে না; যেহেতু, যে ঋক্ পূৰ্ব্বতৃচের শেষে থাকে, তাহা প্রথন দ্বারা উত্তর তৃচের প্রথমে হইবে। সুতরাং ঋকের পার্থক্য হইতে পারে না। এইজন্য পাদেরই প্রথন হইবে, ঋকের প্রগ্রথন হইবে না।

উক্ত বিষয়ে আরও যে বিশেষ আছে তাহা নবম ও দশম অধিকরণে চিন্তিত হইয়াছে। নবমাধিকরণ কথিত হইয়াছে আইভাবঃ ইত্যাদি। যদ্‌যোন্যাং তদুত্তরয়োর্গায়তি এইরূপ শ্রুতি আছে। সেই শ্রুতিতে কয়ানশ্চিত্র আভুবৎএই ঋী যোনি নামে খ্যাত হইয়াছে। ঐ যোনি-ঋকের কয়া এই অক্ষরদ্বয় প্রথম ভাগ এবং নিশ্চিত্র আভুবৎ এই ছয়টী অক্ষর দ্বিতীয় ভাগ। সেই দ্বিতীয় ভাগের চি অক্ষরে, চ-কারের পরে যে ই-কার আছে, তাহা লোপ করিবে; পরে তাহার স্থানে আ-ই এই বর্ণদ্বয় উল্লেখ করিলে গান নিষ্পন্ন হইবে। অনন্তর কত্ত্বা সতত্যা মদানা এই ঋী প্রথম উত্তরা নামে খ্যাত। যোনি-ঋকের যুক্তি-অনুসারে সেই উত্তরা ঋকে চতুর্থ অক্ষর (ত-কারের পরে যে যকার ও ও-কার আছে, ঐ দুই বর্ণ) লোপ করিয়া ঐ বর্ণদ্বয়ের স্থানে আ এবং ই করিতে হইবে। অভীযুণঃ এই ঋকটী দ্বিতীয় উত্তরা। তাহার চতুর্থ অক্ষর যে ণ-কার, তাহার পরস্থিত স কারের লোপ করিয়া, সেই সকারের স্থানে আ এবং ই করিতে হইবে। যদি উক্ত প্রকারে আ ও ই করা না হয়, তাহা হইলে গানের নাশ হইতে পারে। এইরূপে পূৰ্ব্বপক্ষ স্থির হইল। এক্ষণে সিদ্ধান্ত বলিতেছি;–উক্ত যোনি ঋকে অন্য বর্ণের আগম হয় নাই। যদি অন্য বর্ণের আগম না হয়, তাহা হইলে কি হইবে? চ-কারের পরে যে ই-কার বিদ্যমান আছে, ঐ ই-কার, সামগান-প্রসিদ্ধিহেতু, বৃদ্ধি হইয়া ঐ-কার হইবে। সেই ঐকার সন্ধি হইতে উৎপন্ন। এইজন্য, সেই ঐকারের দুইটী ভাগ আছে; প্রথম ভাগ আ-কার, দ্বিতীয় ভাগ ই-কার। যখন ঐ দুইটী ভাগ পৃথক পৃথক ভাবে গীত হয়, তখন আকার ঈ-কারের স্বরূপ প্রাপ্ত হইয়া থাকে। সামগায়কগণ বলিয়াছেন, –বৃদ্ধিপ্রাপ্ত তালব্য বর্ণ বলিতে ঐ-কারকে বুঝায়; হ্রস্ব ই-কার তালব্যবৰ্ণ। ই-কারের বৃদ্ধি করিলে ঐকার হয়। সেই ঐকার বিভক্ত হইলে আ-কার এবং ই-কারের স্বরূপ প্রাপ্ত হয়। তোলব্যে ই-কারের স্থানে আকার এবং ই-কার হইবে, –এইরূপ যদি স্থির হয়; তাহা হইলে, কত্ত্বা সতত্যা ও অভিযুণঃ সখীনাম এই দুইটী উত্তরা ঋকের চতুর্থ অক্ষরে তালব্য ই-কার নাই; সুতরাং ঐ চতুর্থ অক্ষরে আ-কার এবং ই-কার করিবে না। কিন্তু অভিযুণঃ সুখীনা এই উত্তরা ঋকের দ্বাদশ অক্ষর যে র-কার, সেই রকারের পরে ই-কার আছে। ঐ ই-কারের স্থানে আ-কার এবং ই-কার হইয়া থাকে। সেই আকারের ও ই-কারের স্বরূপ, উল্লিখিত নিয়মে, ঐকারকে প্রকাশ করে। এইজন্য সেই আ-কার ও ই-কার উত্তরা-ঋকের বর্ণ অনুসারে নিষ্পন্ন করা কর্তব্য। যদি উত্তরা ঋকের বর্ণ গানের নিমিত্ত না হয়, তাহা হইলে যোনি-ঋকের বর্ণ অনুসারে আকার ও ই-কার হইবে; আর যদি যোনি-ঋকের নিয়মও অবলম্বিত না হয়, তাহা হইলে গীতি বিনষ্ট হয়।

অধুনা দশম অধিকরণ বর্ণিত হইতেছে–স্তোভানোতপ্রদিশ্যন্তে ইত্যাদি। দুই ভাগের মধ্যে ঔকারদ্বয়, হো শব্দ এবং হায়ি শব্দ দ্বারা বামদেব্য নামক সামের যে স্তোভ নিষ্পন্ন হইয়াছে তাহা যোনি-ঋকে ঔহ৩ হো হায়ি এইরূপে উল্লিখিত আছে। সেই স্তোভ উত্তরা নামক দুইটি ঋকে অতিদিষ্ট হয় না। কেন? কারণ স্তোভ গীতি নহে। যদ্‌যোন্যাং তদুত্তরয়োগায়তিএই শ্রুতি দ্বারা কেবল উত্তরা ঋয়ে গানের অতিদেশ হইতেছে। কিন্তু উক্ত শ্রুতিতে যেমন প্রথম ঋক্‌-সম্বন্ধীয় বর্ণসমূহের অতিদেশ করা হয় নাই, সেইরূপ স্তোভেরও অতিদেশ হইতেছে না। এই পূৰ্বপক্ষের উত্তরে বলিতেছি, –যেরূপ স্বর, বর্ণ-বিশ্লেষণ এবং বর্ণের বিরাম প্রভৃতি গানের উপযোগী বলিয়া অতিদিষ্ট হয়, সেইরূপ স্তোভ-সকল গানের কাল-বিভাগ করিয়া থাকে। এইজন্য তাহাদেরও অতিদেশ করা হয়। ইহাই সিদ্ধান্ত।

কোন্ স্থলে গান হইবে না এইরূপ সংশয় উপস্থিত হওয়ায়, তন্নিবারণ জন্য, অষ্টম অধিকরণের দ্বিতীয় বর্ণকের অবতারণ করা হইয়াছে; বলা হইয়াছে, –গানস্য নিয়মো নোত ইত্যাদি। কৰ্ম্ম-বিশেষকে উদ্দেশ করিয়া অয়ং সহস্ৰমানব ইত্যাদিরূপ শ্রুতি প্রদর্শিত হইয়াছে। ঐ শ্রুতির অর্থ এই, –অয়ং সহস্ৰমানবঃ এই ঋকের দ্বারা আহবনীয়অগ্নির উপস্থান করিবে।  অয়ং সহস্র মানবঃ এই ঋী সংহিতাগ্রন্থে আন্নাত হইয়াছে, এবং গান-প্রতিপাদক গ্রন্থে গীত হইয়াছে। এই স্থানে গান অবশ্য কর্তব্য কি না, ইহাই সংশয়। অগ্নির উপস্থানকালে উক্ত ঋকে. গান অবশ্য কর্তব্য বলিয়া উক্ত হয় নাই, উহা নিয়ত নহে, পরন্তু বিকল্পিত অর্থাৎ ইচ্ছা হইলে গান করিতে পার, না করিলেও কোনও ক্ষতি নাই। ইহা পূৰ্ব্বপক্ষ। এক্ষণে সিদ্ধান্তে বলিতেছি, অগ্নির উপস্থানে গান নিয়ত অর্থাৎ অবশ্য কর্তব্য। কেননা সামবেদে গানের বিষয়ই আলোচিত হইয়াছে। ঋকল গানগ্রন্থে গানের যোগ্য হইবে, এইজন্যই সংহিতাতে তৎসমুদায় পঠিত হইয়াছে। কিন্তু সংহিতাতে পঠিত না হইলে, ঋক্‌-সকলের গান হয় না। কেন? কারণ, আশ্রয় ব্যতিরেকে গান করা যায় না। যদি বল, –অয়ং সহস্ৰমানবঃ এই ঋযুক্ত বাক্যের দ্বারা অগ্নির উপস্থান বিহিত হইয়াছে; প্রকরণ অপেক্ষা বাক্য প্রবল; সুতরাং ঋকের দ্বারাই অগ্নির উপাস্থান হইবে; কিন্তু তাহাও বলিতে পার না। যেহেতু, অয়ং সহস্ৰমানবঃ বাক্যে এতয়া এই সৰ্ব্বনাম শ্রুতি আছে এবং সেই শ্রুতি বাক্য অপেক্ষা প্রবলতর। সেইজন্য প্রস্তাবিত ও প্রগীত মন্ত্রে অগ্নির উপস্থান হইবে, ইহাই সিদ্ধান্ত হইল।

পঞ্চদশ আদি তিনটী অধিকরণে ধৰ্ম্মের সাঙ্কৰ্য্য চিন্তিত হইয়াছে। প্রথমে পঞ্চদশ অধিকরণ বর্ণিত হইতেছে; যথা, –বৃহদ্রথন্তরৈর্মৈঃ ইত্যাদি। জ্যোতিষ্টোমযাগে বৃহৎ ও রথন্তর সামের এক বিকল্পবিহিত হইয়াছে। সেই বিকল্প পৃষ্ঠস্তোত্রে বৃহৎ ও রথস্তর ভেদে বিবিধ হইয়া থাকে। সেই বৃহৎ ও রথন্তর এই উভয় পৃষ্ঠ-স্তোত্রে যে সকল ধৰ্ম্ম আছে, তদ্বিষয়ে এইরূপ শ্রুতি আছে; যথা, –যখন বৃহৎ নামক পৃষ্ঠের স্তুতি করিবে, তখন মনে মনে সমুদ্রের চিন্তা করিবে, আর যখন রথস্তর নামক পৃষ্ঠের স্তুতি করিবে, তখন মনের সহিত সমুদ্রের। সম্মিলন করিবে ইত্যাদি। যদি বল, সেই সকল ধর্ম বৃহৎ ও রথস্তর এতদুভয়-স্থলেই সঙ্কীর্ণ হইয়া থাকে; কারণ, বৃহৎ বা রথস্তর স্থলে পৃষ্ঠ-সিদ্ধিরূপ কাৰ্য্য এক অভিন্ন। তাহা বলিতে পারা যায় না। কারণ, বৃহৎ ও রথন্তর-সামের এইরূপ পার্থক্য নির্দেশ করা হইয়াছে। যদি উক্ত ধৰ্ম্ম-সকল সঙ্কীর্ণ হয়, তাহা হইলে কোনও বিশেষ থাকে না। সুতরাং বৃহৎ-পৃষ্ঠ ও রথস্তর-পৃষ্ঠ এইরূপ বিশেষ নির্দেশ উপপন্ন হইতে পারে না। উচ্চৈঃস্বরে গান করিবে ও বলপূৰ্ব্বক গান করিবে–ইহা বৃহৎ পৃষ্ঠের ধৰ্ম্ম; আর উচ্চৈঃস্বরে গান করিবে না, ও বলপূৰ্ব্বক গান করিবে না–ইহা রথন্তর-পৃষ্ঠের ধর্ম; সুতরাং, বৃহৎ-ধৰ্ম্ম ও রথস্তর-ধৰ্ম্ম সাহিত্য-বিরুদ্ধ হয়। সেইজন্য উভয়ের ধর্ম পৃথক পৃথক্ ব্যবস্থিত হইয়াছে। ইহাই সিদ্ধান্ত হইল।

অধুনা, ষোড়শ অধিকরণ কথিত হইতেছে; যথা, –তয়োর্ধৰ্ম্মাঃ সমুচ্চেয়াঃ ইত্যাদি। অর্থাৎ, বৈশ্য স্তোমে কথরথর নামে পৃষ্ঠ-স্তোত্র হইবে–এইরূপ শ্রুতি আছে। পৃষ্ঠ-স্তোত্রের নির্বাহক যে বৃহৎ ও রথন্তর নামক সামদ্বয় প্রস্তাবিত আছে, কথরথর নামক সাম সেই উভয়েরই স্থানীয়। এইজন্য কথরথর পৃষ্ঠস্তোত্র বৃহৎ ও রথস্তর নামক পৃষ্ঠ-স্তোত্র-সম্বন্ধীয় ধৰ্ম্মসমূহের সমুচ্চয় করিবে। উচ্চৈঃস্বরে গান করিবে ও উচ্চৈঃস্বরে গান করিবে না ইত্যাদি রূপ যে সকল বিরুদ্ধ-ধৰ্ম্ম আছে, তাহাদের বিকল্পবিধান হইবে, –ভাষ্যকারের ইহাই, মত। সমুদ্রের ধ্যান ও নিমীলন প্রভৃতিরূপ ধৰ্ম্মসমূহের পরস্পর-বিরোধ নাই। কিন্তু প্রকৃতিস্থলে যেরূপ বৃহতির ও রথস্তরে বিভিন্নতা নির্দিষ্ট আছে; এস্থলে সেরূপ নির্দেশ নাই। এইজন্য উক্ত ধৰ্ম্ম-সকলের সমুচ্চয় হইবে; ইহাই বাৰ্তিককারের অভিমত। উক্ত বিকল্প ও সমুচ্চয় বিষয়ে ভাষ্যকার এবং বাৰ্ত্তিককার উভয়ের মতের  পরস্পর বিরোধী যে পূৰ্ব্বপক্ষ তাহা অনুসন্ধান করিয়া বুঝিবে।

অনন্তর সপ্তদশ অধিকরণ কথিত হইতেছে; যথা, –দ্বিসামকে দ্বয়োর্ধৰ্ম্ম-সাঙ্কৰ্য্যং ইত্যাদি। তাহার অর্থ এইরূপ, –গোসব উভে কুৰ্য্যাৎইত্যাদি বাক্য দ্বারা গোসব প্রভৃতি কাৰ্য্যে বৃহৎ ও রথযুর নামক সামদ্বয় হইতে– নিষ্পন্ন পৃষ্ঠস্তোত্র বিহিত হইয়াছে। কিন্তু পৃষ্ঠস্তোত্রকে যদি একটী মাত্র পদার্থ বলা যায়, তাহা হইলে ধৰ্ম্মের ব্যবস্থা হইতে পারে না। এইজন্য বৃহৎ নামক পৃষ্ঠস্তোত্রে বৃহৎ ও রথন্তর এই উভয়েরই ধৰ্ম্ম বিহিত করিবে। রথন্তর-পৃষ্ঠস্তোত্রেও ঐরূপ করিতে হইবে। অতএব বৃহৎ ও রথর সম্বন্ধীয় ধৰ্ম্মসকল সঙ্কীর্ণ হইয়াছে, ইহাও বলা যায় না। কারণ, ধৰ্ম্মসকল পৃষ্ঠ-স্তোত্রে প্রযুক্ত হয় নাই, কিন্তু সাম প্রযুক্ত হইয়াছে; এইজন্য, সাম বিভিন্ন বলিয়া ধৰ্ম্মসকল ব্যবস্থিত হইয়া থাকে। অতএব ত্রিবৃৎ শব্দের যেরূপ বেদ-প্রসিদ্ধ অর্থ গৃহীত হয়; সেইরূপ ব্যবস্থিত-ধৰ্ম্মসমূহের সহিত যুক্ত যে বৃহৎ ও রথর নামক সামদ্বয়, তাহা দ্বারা নিষ্পন্ন স্তোত্রের নাম পৃষ্ঠ, ইহা বেদে অভিহিত হইয়াছে।

প্রথম অধ্যায়ের তৃতীয়পাদে পঞ্চম অধিকরণের শেষ বর্ণকে উক্ত ত্রিবৃৎপদের বিচার করা হইয়াছে। উক্ত শেষ বর্ণক এইরূপ, –লৌকিকো বাক্যগোবার্থঃ ইত্যাদি। তাহার বিবরণ নিম্নে প্রকটিত হইল; যথা ত্রিবৃবহিষ্পবমানং এই স্তুতিতে যে ত্রিবৃৎ শব্দ রহিয়াছে, তাহার অর্থ ত্রৈগুণ্য, ইহা লোকে প্রচলিত আছে। কিন্তু বাক্য-শেষ হইতে জানা যাইতেছে যে, ঋক্রয়-বিশিষ্ট তিনটী সূক্তে বহিস্প্যবমান রূপ স্তোত্র নিপাদন সমর্থ উপাস্মৈ গায়তা নরঃ ইত্যাদি যে নয়টী ঋক্ আছে, তাহাই ত্রিবৃৎ শব্দের অর্থ। ত্রিবৃৎ বলিতে উক্ত নয়টী ঋকেই বুঝাইতেছে। এস্থলে ত্রিবৃৎ শব্দে ত্রৈগুণ্য অথবা উক্ত প্রকার নয়টী ঋক্‌কে বুঝাইতেছে, ইহাই সংশয়। এস্থলে পূৰ্ব্বপক্ষবাদী বলিতেছেন, –যদিও ধৰ্ম্মনির্ণয়-বিষয়ে বেদ প্রবল, তাহা হইলেও পদ এবং পদার্থ-নির্ণয়-বিষয়ে লোকশাস্ত্র ও বেদ উভয়েরই বল সমান; সুতরাং ত্রৈগুণ্য ও নয়টী ঋক এই উভয় অর্থই বিকল্পে গ্রহণ করিতে হইবে। সিদ্ধান্তবাদী বলিতেছেন, এরূপ বলিতে পার না। যেহেতু, লৌকিক অর্থ স্বীকার করিলে, বিধিবাক্যে ত্রৈগুণ্য এই অর্থ হয়; এবং অর্থবাদবাক্যে স্তোত্রযোগ্য ঋকের নয় সংখ্যা এইরূপ অর্থ হয়। এইরূপ হইলে, বিধি ও অর্থবাদের সমানাধিকরণভাব থাকে না। সুতরাং বিধি ও অর্থবাদ এই উভয়ের একবাক্যতা হইতে পারে না। এই হেতু যাহাতে বিধির ও অর্থবাদের একবাক্যতা হয়, সেই জন্য ত্রিবৃৎ শব্দের স্তোত্রযোগ্য ঋকের নয় সংখ্যা–এই অর্থ বিধিবাক্যে নিয়মিত হইয়াছে। ইহাই এই অধিকরণের সিদ্ধান্ত।

 যেরূপে চিত্রা শব্দের নামধেয়ত্ব নিরূপিত হইয়াছে, সেইরূপে পৃষ্ঠ-শব্দ যে কোনও কার্য্যের নাম–তাহা, প্রথম অধ্যায়ের চতুর্থ পাদের তৃতীয় অধিকরণে নির্ণীত হইয়াছে; যথা, –যচ্চিত্র যজেতেতিইত্যাদি। তাহার বিবৃতি এইরূপ, –চিত্রয়া যজেত পশুকামঃ এইরূপ শ্রুতি আছে। ঐ শ্রুতিতে চিত্রা শব্দ আছে। যেমন উদ্ভিদ শব্দ যৌগিক, সেই চিত্রাশব্দও সেইরূপ যৌগিক নয়। কিন্তু ঐ চিত্রা শব্দ প্রসিদ্ধি হেতু চিত্র বর্ণ ও স্ত্রীজাতিকে বুঝাইতেছে। চিত্রা শব্দ উদ্ভিদ শব্দের ন্যায় যৌগিক নহে বলিয়া পূৰ্ব্বকথিত ন্যায় অনুসারে চিত্রা শব্দ কোনও কৰ্ম্মের নাম হইল না। তাহা হইলে, উক্ত শ্রুতিতে যজেত পদের দ্বারা, আগ্নীষোমীয়ং পশুমালভেত (অগ্নি ও সোর্মদেবের উদ্দেশে পশু হনন করিবে) এই শ্রুতি-বিহিত পশুযাগের অনুবাদ করা হইয়াছে। সেই যাগসম্বন্ধীয় পশুতে চিত্রত্ব ও স্ত্রীত্ব এই দুইটী গুণই বিহিত হইয়াছে। ইহা পূৰ্ব্বপক্ষ। এক্ষণে সিদ্ধান্ত হইতেছে, যদি চিত্ৰত্ব ও স্ত্রীত্ব এই দুইটী গুণের বিধান করা হয়, তাহা হইলে দুইটী বাক্য হইবে। সুতরাং বাক্যভেদরূপ দোষ হইতেছে। সেইজন্য কথিত আছে, –প্রাপ্তে কর্মণি নানেকঃ ইত্যাদি। তাহার অর্থ এই, যদি কৰ্ম্ম প্রমাণান্তরে পাওয়া যায়, তাহা হইলে সেই কর্মে অনেকবিধ গুণ বিধান করা যায় না। কিন্তু যদি অন্য প্রমাণে কৰ্ম্ম না পাওয়া যায়, তাহা হইলে সেই কর্মের উদ্দেশে এককালীন বহু গুণ বিধান হইতে পারে। বাক্যভেদরূপ দোষের উৎপত্তি নিবারণ জন্য যদি চিত্রত্ব ও স্ত্রীত্ব এই গুণদ্বয়-বিশিষ্ট দ্রব্যে চিত্রয়া এই করণকারক বিধান করা হয়; তাহা হইলে উক্ত বিধান জন্য সেই দ্রব্যের গৌরব হইয়া থাকে। বাক্যভেদ ও গৌরব এই দোষদ্বয় হয় বলিয়া যজেত পদের যজ ধাতুর এবং চিত্রয়া পদের অধিকরণ এক হইয়াছে। সেইজন্য চিত্রা শব্দ উদ্ভিদ শব্দের ন্যায় যাগের নাম হইয়া থাকে। বিশেষ বিশেষ দ্রব্যের দ্বারা সেই যাগ-কর্মের বিচিত্রতা প্রতিপন্ন হয়। উক্ত যাগে যে যে ছয়টি বিশেষ-দ্রব্য প্রয়োজনীয়, তাহা এইরূপে উল্লিখিত হইয়াছে; যথা, –দধি, মধু, ঘৃত, জল, ভৃষ্ট (ভাজা), যব ও তণ্ডুল। এই ছয়টি দ্রব্য দ্বারা প্রাজাপত্য কর্ম সম্পন্ন হয়। দধিমধুমৃতমালোধানাপ্লাস্তৎসংসৃষ্টংপ্রাজাপত্যং–এই বাক্যটি, চিত্রা নামক যাগের উৎপত্তি বাক্য বলিয়া প্রসিদ্ধ। দ্রব্য ও দেবতা এই দুইটি যাগ-মাত্রেরই স্বরূপ, উৎপন্ন হওয়ায় উক্ত বাক্যে দধি প্রভৃতি দ্রব্য এবং প্রজাপতি দেবতা উপদিষ্ট হইতেছে। অতএব ঐ বাক্যের দ্বারা চিত্ৰাযাগ উৎপন্ন হইয়াছে। চিত্রয়া যজেত পশুকামঃ, ইহা চিত্রা নামক যাগের ফলবোধক বাক্য। এইরূপ হইলে, চিত্রা শব্দের নামধেয়ত্বরূপ প্রকৃত অর্থ পাওয়া যায়। অগ্নীযোমীয় যজ্ঞে পশুর অনুবাদে চিত্ৰত্ব ও স্ত্রীত্ব গুণদ্বয়ের বিধান হইলে, নামধেয়ত্বরূপ প্রকৃতের হানি হয় ও অপ্রকৃত যে চিত্রবর্ণস্ত্রীপশু, তাহার প্রয়োগ হইতে পারে। যজেত পদে লি বিভক্তি আছে। ঐ লি-প্রত্যয় যে অনুবাদক, ইহা স্বীকার করা হইয়াছে। সুতরাং লিঙ প্রত্যয়ের বিধিরূপ প্রদান অর্থ বাধিত হইতেছে। অনুবাদে উক্তরূপ দোষ হইয়া থাকে বলিয়া চিত্রা পদ যাগের নামধেয় (নাম) হইয়াছে। যেরূপে চিত্রা শব্দের যাগ-নামধেয়ত্ব প্রতিপন্ন হইল, সেইরূপে বহিষ্পবমানআজ্যও পৃষ্ঠশব্দেরও কৰ্ম্ম নামধেয়ত্ব প্রতিপন্ন করিতে হইবে। বহিষ্পবমান প্রভৃতি যে কৰ্ম্মবিশেষের নাম, তাহাই ক্রমান্বয়ে বলা যাইতেছে। ত্রিবৃৎ, বহিষ্পবমান, পঞ্চদশ আজ্য এবং সপ্তদশ-সংখ্যক পৃষ্ঠস্তোত্র, এইরূপ শ্রুতি আছে। এই ত্রিবৃৎ বহিষ্পবমানইত্যাদি বাক্যত্রয়ের অর্থ ক্রমশঃ বিবৃত করা যাইতেছে। সামগায়কগণের উত্তরা নামক গ্রন্থে তৃচ স্বরূপ তিনটি সূক্ত উল্লিখিত আছে। তাহার মধ্যে উপাস্মৈ গায়তা নরঃ, –এইটী প্রথম সূক্ত। দবিদ্যতত্যা ঋচা–এইটী দ্বিতীয়; এবং পাবমানস্য তে কব, –এইটী, তৃতীয় সূক্ত। জ্যোতিষ্টোমযাগে প্রাতঃকালীন সবনের সময় সেই তিনটি সূক্তে গায়ত্র্য নামক সাম গান করিতে হইবে। ঐ তিনটি সূক্তের গান হইতে যে স্তোত্র সম্পন্ন হয়, তাহাকেই বহিষ্পবমান স্তোত্র বলে। কারণ, সেই সূত্ৰয়ে বিদ্যমান ঋক্ সকল পবমানের প্রয়োজনীয়। উক্ত স্তোত্র অন্যান্য স্তোত্রের ন্যায় সদঃ নামক মণ্ডপের মধ্যস্থলে উদুম্বর (যজ্ঞডুম্বুর) নির্মিত স্তম্ব-শাখার নিকটে প্রযুক্ত হয় না; কিন্তু সদঃ নামক মণ্ডপের বহির্দেশে বিচরণকারিগণ কর্তৃক প্রযুক্ত হইয়া থাকে। এইজন্য ঐ স্তোত্র-সম্বন্ধীয় ঋক্‌-সকলেরও বহিঃসম্বন্ধ প্রতিপন্ন হইয়াছে। সেই বহিষ্পবমান নামক স্তোত্রের ত্রিবৃৎনামে স্তোম আছে। যে ব্রাহ্মণবাক্য দ্বারা সেই স্তোম বিহিত হইয়াছে সেই ব্রাহ্মণবাক্য এইরূপ উল্লিখিত আছে; যথা, –তিসৃভভ্যা হিং করোতি ইত্যাদি। তাহার অর্থ.এই, –তিনটী পৰ্য্যায় দ্বারা সূক্তয়ে পঠিত নয়টী ঋকের গান করিতে হইবে। প্রথম পর্যায়ে, তিনটি সূক্তের মধ্যে, প্রথম তিনটি ঋক্; দ্বিতীয় পৰ্য্যায়ের মধ্যস্থিত তিনটি ঋক্‌ এবং তৃতীয় পর্যায়ে উত্তম (শেষস্থিত) তিনটী ঋক্‌। তিসৃভ্যঃ এই পদে তৃতীয়া বিভক্তির অর্থে পঞ্চমী বিভক্তি হইয়াছে। হিং করোতি বাক্যের অর্থ–গান করিতে হয় এইরূপ। ঐ ব্রাহ্মণ বাক্যে উল্লিখিত প্রকারে যে গীত (গান) হইয়া থাকে, সেই গীতিই ত্রিবৃৎ-নামক স্তোমের বিষ্ণুতি (স্তুতির প্রকার বিশেষ)। এই বিতির নাম উদ্যতী। পরিবর্তিনী ও কুলায়িনী নামে আরও দুইটী বিষ্ণুতি আছে। সেই বিষ্ণুতিদ্বয়ের মধ্যে পরিবৰ্ত্তিনী বিষ্ণুতি এইরূপে আন্নাত হইয়াছে, — তিভ্যো হিং করোতি ইত্যাদি। ইহার অর্থ, –সেই উদগাতা যথাক্রমে উল্লিখিত তিনটী ঋকের দ্বারা গান করিয়া থাকেন। এইরূপে আরও বারদ্বয় এ গান করেন। ঐ গীতিই ত্রিবৃৎ স্লোমের পরিবর্তিনী নামক বিষ্ঠুতি আছে। অনুক্রমে উল্লিখিত ঋক্‌কে পরাচী বলে। কুলায়িনী বিষ্ণুতি এইরূপে আশ্নাত হইয়াছে, –তিভ্যো হিং করোতি ইত্যাদি। তাহার অর্থ এই, এ সেই উদ্গাতা যথাক্রমে তিনটী প্রথমা উল্লেখ করিয়া গান করেন। পুনরায় মধ্যম ঋকত্রয়ের মধ্যে যে ঋক্‌ মধ্যম, তাহাকে প্রথম, যে ঋক্‌ উত্তম (শেষে পঠিত) তাহাকে মধ্যম এবং যে ঋক্ প্রথম, তাহাকে উত্তম করিয়া গান করেন। তৃতীয় বারে উত্তম ঋয়ের মধ্যে যে ঋক্ শেষে পঠিত হয়, তাহাকে প্রথম, যে ঋক্ প্রথমে আছে তাহাকে মধ্যম, এবং যে ঋক্ মধ্যে আছে, তাহাকে উত্তম করিয়া গান করিয়া থাকেন। ঐ গীতিই ত্রিবৃৎ স্তোমের কুলায়িনী নামক বিষ্ঠুতি। প্রথম সূক্তে যে মন্ত্র আছে, তাহা পাঠক্রমে (প্রথম মধ্যম ও উত্তম এই ক্রমে) গান করিতে হইবে। কিন্তু দ্বিতীয় সূক্তে মধ্যম, উত্তম ও প্রথম এবং তৃতীয় সূক্তে উত্তম প্রথম ও মধ্যম এইরূপ : ব্যক্তিক্রম করিয়া মন্ত্র-সকল গান করিতে হইবে। উক্ত উদ্যতী, পরিবৰ্ত্তিনী ও কুলায়িনী–এই বিতিয় বিকল্পে বিহিত হইয়াছে, অর্থাৎ প্রথম সূক্তে উদ্যতী ও পরিবর্তিনী, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় সূক্তে কুলায়িনী বিষ্ণুতি এইরূপ ব্যবস্থিত হওয়ায় বিকল্প হইয়াছে। উক্তরূপ বিষ্ঠুতিই স্তোমের স্বরূপ এবং বিষ্ণুতিত্রয়যুক্ত স্তোমই ত্রিবৃৎ শব্দের অর্থ। কিন্তু ত্রৈগুণ্য যে ত্রিবৃৎ শব্দের অর্থ নয়, তাহা তৃতীয় পদে নির্ণীত হইয়াছে।

উত্তরানামক গ্রন্থে তিনটী বহিষ্পবমান সূক্তের পরে আরও সূক্তচতুষ্টয় উল্লিখিত হইয়াছে। অগ্ন আয়াহি বীতয়ে (উ ১ ৪)–ইহা প্রথম সূক্ত। আনো মিত্রাবরুণাঃ (উ ১ ৫)–ইহা দ্বিতীয় সুক্ত। আয়াহি সুসমাহিতঃ (উঃ ১৩ ৬)–ইহা তৃতীয় সূক্ত। ইন্দ্রাগ্নী আগতং সুতং (উ ১৫ ২সূ)–ইহা চতুর্থ সূক্ত। এই সূক্তচতুষ্টয় যখন প্রাতঃসবন-প্রকরণে গায় নামক সাম দ্বারা গীত হয়, তখন ঐ সূক্ত-চতুষ্টয়কে আজ্য-স্তোত্র বলে। উক্ত সূক্ত-চতুষ্টয় যে আজ-স্তোত্র হয়, সে বিষয়ে এই প্রকার নির্ধ্বচন-শ্রুতি আছে; যথা, –যদাজিমীঃ ইত্যাদি। অর্থাৎ, যখন আজ্যস্তোত্র সকল, নির্দিষ্ট ক্ষণকে (এস্থলে প্রাতঃসবনই নির্দিষ্ট ক্ষণ) প্রাপ্ত হয়, তখন আজ্যস্তোত্রের আজ্যত্ব (কর্মে উপযোগিতা) প্রতিপন্ন হইয়া থাকে। সেই আজ্য-স্তোত্ৰ-চতুষ্টয়ে পঞ্চদশ নামে স্তোম হয়। ঐ পঞ্চদশ স্তোমের বিষ্ণুতি এইরূপে শ্রুত হইয়া থাকে; যথা, -পঞ্চভ্যোহিং করোতি ইত্যাদি। উক্ত শ্রুতির অর্থ এই, সেই উদ্গাতা ঋত্বিক পাঁচটী ঋক্ হইতে প্রথমে একটী ঋকের দ্বারা, মধ্যে একটী ঋকের দ্বারা এবং শেষে তিনটী ঋকের দ্বারা গান করিয়া থাকেন। এইরূপে আরও বারদ্বয় গান করিয়া থাকেন। উক্ত প্রকারে একটী সূক্তের বারত্রয় আবৃত্তি করিতে হইবে। আবৃত্তিক্ৰম এইরূপ, –প্রথম আবৃত্তিতে প্রথম ঋকের উল্লেখ তিন বার, দ্বিতীয় আবৃত্তিতে মধ্যম ঋকের উল্লেখ তিনবার, এবং তৃতীয় আবৃত্তিতে উত্তম ঋকের উল্লেখ তিনবার। এই স্তেম পঞ্চদশ নামে অভিহিত হইয়াছে। উত্তর-গ্রন্থে উল্লিখিত সূক্তচতুষ্টয়ের পরে তিনটী মাধ্যন্দিন পবমান সূক্তের উল্লেখ হইয়াছে। তারপরে আরও চারিটী সূক্ত উল্লিখিত হইয়াছে; সেই সূক্ত চতুষ্টয়ের মধ্যে অভি ত্বা শূরনোনুমঃ (উপ্র ১সূ), ইহা প্রথম সূক্ত। কিয়ানশ্চিত্ৰ আভুবৎ (উ ১ ১২সূ), ইহা দ্বিতীয় সূক্ত। তংবোদস্মমৃতীষহম (উ ১৩ ১৩), –ইহা তৃতীয় সূক্ত। তরাভিৰ্বোবিদ্বসুম্ (উ ১৭ ১৪), ইহা চতুর্থ সূক্ত। অভি ত্বা শূর প্রভৃতি চারিটী সূক্ত, ক্রমান্বয়ে রথস্তর, বামদেব্য, নৌধস এবং কালেয় এই সামচতুষ্টয় দ্বারা মাধ্যন্দিনসবনে গীত হইয়া থাকে। এইজন্য উক্ত সূক্ত-চতুষ্টয়কে পৃষ্ঠস্তোত্র বলে। অভি ত্ব শূর প্রভৃতি সূক্ত-চতুষ্টয় যে পৃষ্ঠস্তোত্র হয়, তদ্বিষয়ে স্পর্শনাৎপৃষ্ঠানি এইরূপ নিরুক্তি আছে। ঐ নিরুক্তি এ স্থলে বিশেষরূপে উল্লিখিত হইল না; তাহা স্থানান্তরে দেখিয়া লইবে। সেই পৃষ্ঠস্তোত্রে সপ্তদশ নামক স্তোম.. নিষ্পন্ন হইয়া থাকে। সেই সপ্তদশ স্তোমের যে বিষ্ণুতি, তৎসম্বন্ধে এইরূপ শ্রুতি আছে; যথা–পঞ্চভ্যো হিং গ করোতি ইত্যাদি। সেই শ্রুতির অর্থ এই, উদ্গাতা পাঁচটী ঋক্ হইতে প্রথমে তিনটী ঋকের দ্বারা, মধ্যে একটী ও শেষে একটী ঋকের দ্বারা, গান করিয়া থাকেন। দ্বিতীয় বারে প্রথমে একটী ঋকের দ্বারা, মধ্যে তিনটী ঋকের দ্বারা ও শেষে একটী ঋকের দ্বারা গান করেন; এবং তৃতীয় বারে প্রথমে একটী ঋকের দ্বারা, মধ্যে একটী ৫ ঋকের দ্বারা ও শেষে তিনটী ঋকের দ্বারা গান করিয়া থাকেন। এস্থলে প্রথম বারে প্রথম ঋকের তিন বার, দ্বিতীয় বারে মধ্যম ঋকের তিন বার এবং তৃতীয় বারে মধ্যম ও উত্তম ঋকের তিন বার করিয়া উল্লেখ হইয়া থাকে। ঐরূপ উল্লেখ হইলে যে ঋক্‌-সমষ্টি হয়, সেই ঋক্‌-সমষ্টিকেই সপ্তদশ স্তোম বলা হইয়াছে। ত্রিবৃহিষ্পবমানং ইত্যাদি বাক্যত্ৰয়ে যে ত্রিবৃৎ, পঞ্চদশ ও সপ্তদশ–এই তিনটি শব্দ আছে, তাহারা গুণ বিধায়ক বলিয়া গৃহীত হইয়াছে। বহিষ্পবমান, আজ্য ও পৃষ্ঠ এই কয়েকটী শব্দও যদি গুণ-বিধায়ক হয়, তাহা হইলে প্রতি উদাহরণেই গুণদ্বয় বিধান হইতেছে; সুতরাং বাক্যভেদরূপ দোষ অনিবার্য। বহিষ্পবমান প্রভৃতি শব্দসমূহ স্তোত্রের নাম। সেই বহিষ্পবমান প্রভৃতি স্তোত্রম-দ্বারা যাগাদি-কর্মের অনুবাদ করিয়া, সেই যাগাদি-কর্মে ত্রিবৃৎ, পঞ্চদশ ও সপ্তদশ এই গুণত্রয় বিহিত হইতেছে।

উক্ত পৃষ্ঠ প্রভৃতি স্তোত্র যে প্রধান কৰ্ম্ম, তাহা দ্বিতীয় অধ্যায়ের প্রথম পাদে, পঞ্চম অধিকরণে, নির্ণীত হইয়াছে। সেই অধিকরণ এই প্রউগং শংসছি ইত্যাদি। তাহার অর্থ এই–প্রউগং শংসতি ইত্যাদি বাক্যে যে স্তৌতি ও শংসতি পদ আছে, তাহার দ্বারা স্তোত্র ও শস্ত্রকে পাওয়া যায়। ঐ স্তোত্র বা শস্ত্র শব্দের প্রাধান্য, আছে কি না, –ইহাই সংশয়। লোকে দেবতাবোধক স্মৃতি বিদ্যমান রহিয়াছে, দেখা যায় সেইজন্য স্তোত্র বা শস্ত্র গুণকৰ্ম্ম (প্রধান কর্ম নয়) ইহাই পূৰ্ব্বপক্ষ। যদি স্তু ও শংস ধাতুদ্বয়. দেবতাবোধক স্মৃতির অনুসরণ করে, তাহা হইলে তিলব্ধ অর্থের বোধ হয়। স্মৃতি-বাক্যে স্তু ও শংস ধাতুর অর্থ অন্বিত হইলে, শ্রুত্যর্থের বোধ হয়; আর তদ্বারা অদৃষ্ট স্বীকার করিয়া স্তোত্রের ও শস্ত্রের প্রধান-কৰ্ম্মত্ব প্রতিপন্ন হইয়া থাকে। কারণ, স্মৃতি অপেক্ষা শুতিবাক্য প্রধান–ইহাই সিদ্ধান্ত। এই অধিকরণের বিবৃতি এইরূপ, জ্যোতিষ্টোম যাগে প্রউগং শংসতি নিক্কেবল্যংইত্যাদি শ্রুতি আছে। ঐ শ্রুতিতে উগও নিক্কেবল্য–এই শব্দ-দুইটী বিশেষ শস্ত্রের নাম। আজ্য ও পৃষ্ঠ শব্দ পূৰ্বে ব্যাখ্যাত হইয়াছে। প্রকৃষ্টরূপে গীত নয়, এরূপ মন্ত্রের দ্বারা নিষ্পন্ন স্তুতিকে শস্ত্র বলে, এবং প্রগীত মন্ত্রের দ্বারা নিষ্পন্ন স্তুতিকে স্তোত্র বলে। সেই স্তোত্র ও শস্ত্র যে গুণ-কৰ্ম্ম, তাহা সঙ্গত। কেন? কারণ, অবঘাতাদি স্থলে যেরূপ তুষবিমোচনরূপ ফল দৃষ্ট হইয়া থাকে, সেইরূপ উগং শংসতিইত্যাদি স্থলে দেবতার সংস্কাররূপ প্রয়োজন দৃষ্ট হইতেছে। যে সকল মন্ত্র পাঠ করা হয়, সেই সমস্ত মন্ত্রে দেবতার স্মরণ হয়, এবং সেই স্মরণের দ্বারা দেবতার সংস্কার করা হইয়া থাকে;–ইহাই প্রসিদ্ধি। এইরূপে পূৰ্ব্বপক্ষ স্থির হইল। অধুনা সিদ্ধান্ত বলিতেছি, –মন্ত্ৰসমূহ স্মরণপূর্বক দেবতার যে স্তুতি প্রযোজ্য, গুণের সহিত তাহার স্তোতব্য-স্তাবক-ভাব সম্বন্ধ আছে। সেই সম্বন্ধ প্রকাশ করাই স্তু ও শংস ধাতুর বাচ্য (মুখ্য) অর্থ। যদি মন্ত্র বাক্য সকল দেবতার সহিত গুণের উক্তরূপ সম্বন্ধ প্রকাশ করে, তাহা হইলে স্তু ও শংস ধাতুদ্বয়ের মুখ্য অর্থ পাওয়া যায়। সুতরাং শ্রুতিবাক্য উপকৃত হইবে। কিন্তু যখন ঐ মন্ত্র বাক্য সকল গুণ দ্বারা স্মরণীয় দেবতার স্বরূপমাত্র প্রকাশ করিবে, তখন স্তু ও শংস ধাতুর মুখ্য অর্থ হইবে না। লৌকিক ব্যবহারেও আছে যে, দেবদত্ত চতুৰ্ব্বেদে অভিজ্ঞ–এই কথা বলিলে, স্তুতি প্রতীত হয়; কারণ, ঐ বাক্য, গুণ দ্বারা, দেবদত্তের স্বরূপকে। বিশেষ করিতেছে। সুতরাং দেবদত্তের সহিত অভিজ্ঞতারূপ গুণের সম্বন্ধ বুঝাইতেছে। কিন্তু যখন ঐ বাক্য দেবদত্তের স্বরূপ-মাত্র প্রকাশ করিবে, তখন য়ে চতুৰ্ব্বেদজ্ঞ, তাহাকে আনয়ন কর ইত্যাদি স্থলে স্তুতি প্রতীত হইবে না। কারণ, সেই বাক্য চতুৰ্ব্বেদী পদে উপপন্ন চতুর্বেদ সম্বন্ধ দ্বারা, দেবদত্তের স্বরূপ মাত্র প্রকাশ এ করিতেছে। সুতরাং দেবদত্তের সহিত গুণের কোনও সম্বন্ধ হয় নাই। আজ্য-স্তোত্র দ্বারা দেবতাকে প্রকাশ, এ করিবে, –এইরূপ বিধিবাক্যার্থ প্রতিপন্ন হয়। অতএব স্তু ও শংস ধাতুর মুখ্য অর্থ বাধিত হইবে। ধাতুদ্বয়ের মুখ্য অর্থ থাকে না বলিয়া, যাহাতে ধাতুশ্রুতি বাধিত না হয়–সেই নিমিত্ত, স্তোত্রের ও শস্ত্রের প্রধান কৰ্ম্মত্ব স্বীকার করিতে হইবে। যদি বল, –স্তোত্রে ও শস্ত্রে এমন কোনও দৃষ্ট-প্রয়োজন নাই, যাহাতে স্তোত্র ও শস্ত্র প্রধান কৰ্ম্ম হইতে পারে; তাহা হইলে এস্থলে অদৃষ্ট স্বীকৃত হউক; অর্থাৎ, অদৃষ্ট দ্বারা স্তোত্র ও শস্ত্র প্রধান কৰ্ম্ম হইবে, ইহাই অভিপ্রায়।

পূর্বোক্ত প্রথম অধ্যায়ের দ্বিতীয় পদে, দ্বাদশ অধিকরণে, সামবিশেষে প্রযুক্ত পৃথক্ কৰ্ম্ম অভিহিত হইয়াছে; যথা, –উক্তাগ্নিষ্ট্রতমেতস্য ইত্যাদি। তাহার অর্থ এই, অগ্নিষ্ঠুৎ নামক যাগের বিষয় বলিবার পর, সেই অগ্নিতের সম্বন্ধে পশুরূপ ফল-প্রাপ্তির নিমিত্ত, রেবতীক্ষ্ণ কৃত্বা এইরূপ বারবন্তীয় নামক সাম শ্রুত হইয়াছে। এক্ষণে জিজ্ঞাস্য, –সেই রেবতী প্রভৃতি গুণ-কৰ্ম্ম অথবা পৃথক্ কৰ্ম্ম? এস্থলে ইহাই সংশয়। স্তোত্র ও শস্ত্রের ন্যায়, এস্থলে রেবতীর ও বারবন্তীয়ের পরস্পর সম্বন্ধই গুণকৰ্ম্ম হইবে। কারণ, ঐ সম্বন্ধ পশুরূপ ফলদায়ক। ইহাই পূৰ্ব্বপক্ষ। তাহার সিদ্ধান্ত হইতেছে; যথা, -যদি বারবন্তীয় সার্মের ফলের ও কর্মের সহিত সম্বন্ধ হয়, তাহা হইলে বাক্যভেদ-দোষ হইবে। উক্তরূপ সম্বন্ধ স্বীকার করিলে, বাক্যভেদ হয় বলিয়া, পশুরূপ ফল-বিষয়ে বারবস্তীয় সামরূপ গুণ-যুক্ত পৃথক্ কৰ্ম্ম অভিহিত হইয়াছে। এই অধিকরণের বিস্তরার্থ এই–ত্রিবিৎ নামক অগ্নিষ্টোম যাগে বায়ুদেবতা-সম্বন্ধীয় যে সকল ঋক্ আছে, তাহাতে একবিংশ নামক অগ্নিষ্টোম সাম গান করিবে। পরে ব্রহ্মতেজঃ কামনায় যাগ করিবে। এই বাক্যের সঙ্গে সঙ্গে এতস্যৈব রেবতীযু ইত্যাদি শ্রুতি আছে। সেই শ্রুতির অর্থ এই, –একদিন-সাধ্য অগ্নিষ্ঠুৎ নামক যে একটী যাগ বিহিত হইয়া থাকে, তাহা অগ্নিষ্টোম যাগের বিকৃত স্বরূপ। সেই অগ্নিষ্ঠুৎ যাগে পৃষ্ঠস্তোত্রে ত্রিবৃৎ নামক স্তোমযুক্ত হয় বলিয়া তাহাকে ত্রিবৃৎবলা হয়। ঐ অগ্নিষ্ঠুৎ যাগ, অগ্নিষ্টোম উথ প্রভৃতি সাতটী সোমাশ্রয়ের মধ্যে, অগ্নিষ্টোমান্তৰ্গত বলিয়া তাহাকে অগ্নিষ্টোমও বলা যায়। প্রকৃতিভূত অগ্নিষ্টোমযাগে, তৃতীয়সবণ-প্রকরণে, আর্ভব পবমান নামক সূক্ত পঠিত হইলে, পরে যজ্ঞাযজ্ঞীয়ং এইরূপ সাম গান করা হইয়া থাকে। এই সাম দ্বারা অগ্নিষ্টোম যাগের সেই যজ্ঞাযজ্ঞীয়ং সমাপ্ত করিতে হয়। এইজন্য ঐ সামকে অগ্নিষ্টোম বলা যায়। সেই সাম প্রকৃতিভূত অগ্নিষ্টোমযাগে–যজ্ঞা যজ্ঞাবো অগ্নয়ে ইত্যাদি আগ্নেয়ী (অগ্নিদেব-সম্বন্ধীয়) ঋক্‌-সমূহে গীত হইয়া থাকে। কিন্তু এই অগ্নিষ্ঠুৎযাগে, ব্ৰহ্মতেজকামী যজমান বায়ুদেবতাসম্বন্ধীয় ঋক্ সমূহে সেই সাম গান করিবে। অগ্নিষ্টোমযাগে সেই যজ্ঞাযজ্ঞীয় সামে যেমন একবিংশ নামক স্তোম যুক্ত হইয়াছে, সেইরূপ অগ্নিষ্টোমের বিকৃতিভূত এই অগ্নিষ্ঠুৎ-যাগেও একবিংশ স্তোম যুক্ত হইবে। পশুকামী যজমানের উদ্দেশে রেবতীর্ণ সধমাদে ইত্যাদি রেবতী-দেবতা-সম্বন্ধীয় ঋক্ সকলে বারবন্তীয় নামক সাম গান করিবে। ইহাই এতস্যৈব রেবতী ইত্যাদি শ্রুতির অর্থ। উক্ত শ্রুতিতে, বারবন্তীয় নামক সামের সহিত রেবতী সম্বন্ধীয় ঋক্‌-সমূহের যে সম্বন্ধ আছে, তাহাই পশুরূপ ফলের নিমিত্ত অগ্নিষ্ঠুৎ-যাগে বিহিত হইয়াছে। এতস্যৈব এই স্থলে এতৎ শব্দ প্রস্তুতকর্মের প্রতিপাদক এবং এরকার অন্য কৰ্ম্মের বাধক হইয়াছে। সুতরাং এতৎ শব্দ ও এবকার অগ্নিষ্ঠুৎ-গকেই বুঝাইয়া দিতেছে। যেমন পূৰ্ব্ব (একাদশ)- অধিকরণে প্রস্তুত অগ্নিহোত্র-যাগে ইন্দ্রিয়রূপ ফলের নিমিত্ত দধিরূপগুণ বিহিত হইয়াছে; সেইরূপ এতৎ শব্দ ও এবকার শব্দ দ্বারা লব্ধ অগ্নিষ্ঠুৎযাগে পশুরূপ ফল লাভের নিমিত্ত, বারবন্তীয় নামক সামের সহিত রেবতী ঋক্ সমূহের সম্বন্ধ বিহিত হইয়াছে। ইহাই পূৰ্ব্বপক্ষ। সম্প্রতি সিদ্ধান্ত বলিতেছি। তুমি যে পূৰ্বাধিকরণের দৃষ্টান্ত দিয়াছ, তাহা অসদৃশ। কারণ, দধি যে কার হোমের নিম্পাদক, ইহা শাস্ত্রের দ্বারা প্রতিপন্ন করা যায় না; ব্যবহার হইতেই দধির হোম-নিষ্পদকত্ব জ্ঞাত হওয়া যায়। কিন্তু দধির ইন্দ্রিয়রূপ ফলের সহিত যে সম্বন্ধ আছে, একমাত্র তাহাই শাস্ত্র হইতে জ্ঞাত হওয়া যায়; সুতরাং দপ্লেয়িকামোজুহুয়াৎ বাক্যে বাক্যভেদ দোষ হইল না। পরন্তু পশুকামো হেতেন যজেত– প্রভৃতি রেবতী ঋক্‌-সমূহের আশ্রয় স্বরূপ যে বারবন্তীয় নামক সামসমূহ, তাহা অগ্নিষ্ঠুৎযাগ নিষ্পন্ন করিয়া থাকে; সুতরাং উক্ত সাম অগ্নিষ্ঠুৎ যাগের সাধক এবং বারবন্তীয় সাম উক্ত যাগের ফল সাধন করিয়া থাকে। এইরূপে শাস্ত্র হইতে একমাত্র বারবন্তীয় সামের কর্মসাধনত্ব ও ফলসাধনত্ব, জ্ঞাত হওয়া যাইতেছে। অতএব সেস্থলে বাক্যভেদ অনিবাৰ্য্য। বাক্যভেদ দোষ বারণ হয় না বলিয়া, পশুরূপ ফলবিশিষ্ট এবং রেবতী ঋক্ ও বারবন্তীয় সাম এতদুভয়ের সম্বন্ধরূপ গুণযুক্ত একটী পৃথক কৰ্ম্ম, এতস্যৈব রেবতীযু এই শ্রুতি-বাক্য দ্বারা বিহিত করা যাইতেছে। পরন্তু এতৎ শব্দ ও এবকার শব্দ এতদুভয় দ্বারা যে কর্মের বিধান করা হইতেছে, তাহা সেই পূৰ্ব্বোক্ত পৃথক কৰ্ম্মের পক্ষে যোজিত হইবে।

এয়োদশ অধিকরণে নিধনরূপ সামভাগে যে সকল হীআদি বিশেষ আছে, তাহারা কাম্য–ইহা বিচারিত হইয়াছে। সেই অধিকরণ এইরূপ, –বৃষ্ট্যন্নস্বৰ্গকামানাং সৌভরং স্তোত্রমীরিতং ইত্যাদি। তাহার অর্থ এইরূপে বিবৃত হইয়াছে, –প্রথমে যে বৃষ্টি কামনা করে, যে অন্ন আদি ভক্ষ্য কামনা করে; এবং যাহারা স্বৰ্গকামনা করে, তাহারা প্রত্যেকেই সৌভর নাম সাম দ্বারা স্তব করিবে। সমস্ত কামনাই সৌভরমূলক। অতঃপর হীষিতি ইত্যাদি আঘ্নত হইয়াছে; অর্থাৎ, –বৃষ্টিকামীর উদ্দেশে হী এই নিধন নামক সাম গান করিবে, অন্ন প্রভৃতি কামীর নিমিত্ত ঊর্ক এবং স্বৰ্গকামীর জন্য উ এই প্রকার নিধনরূপ সাম গান করিবে। সৌভরসাম বিশেষের নাম। পাঁচ বা সাত ভাগে বিভক্ত যে সাম, তাহার শেষ ভাগের নাম–নিধন। সেই নিধন-ভাগে যে সকল হী আদি বিশেষ আছে, তাহারা সৌভর নামক সাম হইতে নিষ্পন্ন হইয়া থাকে। ঐ সকল বিশেষ, স্তোত্রনিমিত্তক বৃষ্টি প্রভৃতি হইতে অন্যান্য বৃষ্টি প্রভৃতিরূপ ফল উৎপন্ন করিবার জন্য বিহিত হইয়া থাকে। কেন? কারণ, হীষ আদি বিধিবাক্যে বৃষ্টিকামায় ইত্যাদি দ্বারা চতুর্থ বিভক্তি শ্রুত হইয়াছে। সেই চতুর্থী বিভক্তি তাদর্থে বিহিত। চতুর্থী হী, ঊর্ক ও উ নিধনত্রয় যে বৃষ্টি, অন্ন ও স্বৰ্গকামী পুরুষত্রয়ের অঙ্গ, ইহাই বুঝাইতেছে। যদি ঐ হী আদি, পুরুষের অভিলষিত ফল সম্পাদন করে; তাহা হইলে হী আদির অঙ্গত্ব উৎপন্ন হয়। হী আদির অঙ্গত্ব স্বীকৃত হইল বলিয়া সৌভর নামক সাম এবং হী এই নিধন-বিশেষ এতদুভয়ের ফলস্বরূপ দুইটি বৃষ্টি হইয়া থাকে। পরে ঐ বৃষ্টিদ্বয়ের মিলন করিলে, মহতী বৃষ্টি হয়। এইরূপে পূৰ্ব্বপক্ষ স্থির হইল। অধুনা সিদ্ধান্ত বলিতেছি, যে বৃষ্টি প্রভৃতি কামনা, সৌর-সম্বন্ধি বিধি-বাক্যে নিবদ্ধ হইয়াছে, তাহাই হী আদি বিধিবাক্যে প্রতীয়মান হইতেছে। বৃষ্টি প্রভৃতি কামনার পার্থক্য নাই বলিয়া, সৌভর-সামের ফলভূত বৃষ্টি প্রভৃতি হী প্রতিপাদক শাস্ত্রে পুনঃকথিত হইয়াছে; অতএব, হীদিতে বৃষ্টি প্রভৃতি পৃথক ফল নহে। অতঃপর যদি বলা। যায়, হীদি নিধন-বিশেষে বৃষ্টি প্রভৃতি ভিন্ন অন্য কোনও নূতন ফল নাই, পরন্তু হীদি নিধন-বিশেষ নানা শাখাতে পঠিত হইয়া থাকে বলিয়া ঐ হী আদিকে সৌভর-সামে পাওয়া গিয়াছে, সুতরাং হীষিতি বৃষ্টিকামায় ইত্যাদি বিধি-বাক্যই নিরর্থক; তাহাও বলা যায় না। কারণ, বৃষ্টি, অন্ন ও স্বর্গ এই কামনাত্ৰয়ে নিয়ম করায়, ঐ কামনাত্ৰয়ে হীদির মধ্যে যে কোনও একটী নিধন-বিশেষ পাওয়া যায়। কিন্তু হীষিতি বৃষ্টিকামায় ইত্যাদি বিধি-বাক্যে উক্ত কামনাত্ৰয়ে হীদি যথাক্রমে প্রযুক্ত হইবে, –এইরূপ নিয়ম করা হইয়াছে। বৃষ্টিকামায় ইত্যাদি স্থলে চতুর্থ বিভক্তির অর্থ–তাদর্ঘ্য (নিমিত্ত)। হীষিতি বৃষ্টিকামায় ইত্যাদি দ্বারা নির্দিষ্ট যে বৃষ্টি প্রভৃতি, তাহা পৃথক্‌ ফল না হইলেও সেই তাদৰ্থরূপ চতুর্থীর অর্থ উপপন্ন হইতেছে। কারণ, হো বৃষ্টিকামঃ l এ ইত্যাদি সৌভর বাক্যে উল্লিখিত বৃষ্ট্যাদিরূপ ফলের নিম্পাদক সৌভর নামক সামে হী উর্ক ও উ এই নিধন এই বিশেষত্ৰয় নিয়মিত হইয়া থাকে। উক্তরূপে নিয়ম প্রতিপন্ন হইতেছে বলিয়া হীষিতি বৃষ্টিকামায় ইত্যাদি দ্বারা হীষ আদি নিধন-বিশেষের নিয়ম করা হইল। সেই নিয়ম-বিধি হীদির বিধায়ক নয়, –ইহাই সিদ্ধান্ত।

সাম-গান বিষয়ে উচ্চত্ব ও নীচত্ব রূপ যে দুইটি ধৰ্ম্ম আছে, সেই ধৰ্ম্ময় তৃতীয় অধ্যায়ের তৃতীয় পাদে, প্রথম ও দ্বিতীয় অধিকরণে, যথাক্রমে বিচারিত হইয়াছে। প্রথম অধিকরণে এই কৰ্ত্তব্যমুচ্চৈঃ সামর্গভ্যাং ইত্যাদি। তাহার অর্থ, জ্যোতিষ্টোম-যাগে উচ্চৈঋচা ক্রিয়তে ইত্যাদি শ্রুতি আছে। সেই উচ্চৈফঁচা ক্রিয়তে ইত্যাদি বিধিবাক্যে মন্ত্রবাচক ঋক্, যজুঃ ও অথৰ্ব্ব প্রযুক্ত হইয়াছে। সুতরাং যদি উচ্চত্ব ও নীচত্ব মন্ত্র-ধৰ্ম্ম হয়; তাহা হইলে যে সকল ঋক্‌ যজুৰ্ব্বেদে উৎপন্ন হয়, তাহা অধ্বর্য্যু নামক ঋত্বি কর্তৃক প্রযুক্ত হইলেও উচ্চৈঃস্বরে পঠিত হইবে। কিন্তু এতৎসিদ্ধান্তও সমীচীন নহে। কেননা কোনরূপ বিরোধ উৎপন্ন হয় না বলিয়া, প্রবল উপক্রমবাক্যের অনুসরণ পূর্বক সেই উপক্রমানুসারে উপসংহার বাক্যের সমন্বয় করিতে হইবে। উপক্রম বাক্যে বেদ শব্দ এইরূপে শ্রুত হইয়াছে; যথা–এয়োবেদা অসৃজান্ত ইত্যাদি। তাহার অর্থ এই, বেদত্রয় সৃষ্ট হইয়াছে; তাহা এই, অগ্নি হইতে ঋগ্বেদ বায়ু হইতে যজুৰ্বেদ এবং আদিত্য (সূৰ্য্য) হইতে সামবেদ উৎপন্ন হইয়াছে। উপক্ৰম-বাক্যে বেদ শব্দ শ্রুত হইয়াছে বলিয়া উপক্ৰম-বাক্যস্থিত বেদ-শব্দানুসারে বিধিবাক্যস্থিত ঋক্, যজুঃ, ও সাম শব্দও বেদবাচক। অতএব, যজুৰ্ব্বেদে উৎপন্ন ঋক্‌-সকলেরও অনুচ্চস্বরে পাঠ করিতে হইবে। উপক্ৰম-বাক্য অর্থবাদ মাত্র; সুতরাং উহা দুৰ্বল। কিন্তু উপসংহার-বাক্য বিধি-স্বরূপ বলিয়া উহা উপক্ৰম-বাক্য অপেক্ষা বলবান। এতদুক্তি সমীচীন ও স্বীকার্য। কিন্তু যখন বিধির উদ্দেশ স্বরূপকে প্রাপ্ত হয়, তখনই তাহার প্রাবল্য স্বীকার করা হইয়া থাকে। কিন্তু ঋগাদি যে বেদ এই উচ্চত্ব, নীচত্ব বিচার স্থলে প্রধানতঃ উপক্রম বাক্যই সেইরূপ বুদ্ধি জন্মাইয়া দেয়। সেই প্রথম অবস্থায় বিধির উদ্দেশ্য স্বরূপ প্রাপ্ত হয় না বলিয়া, সেই বিধির উদ্দেশ্য উপক্ৰম-বাক্যের বাধক হইতে পারে না। কিন্তু ঋক্ আদি যে বেদউপক্রম বাক্যের দ্বারা এই বুদ্ধি প্রকাশিত হইলে, সেই বিধির উদ্দেশের উপক্রম ও উপসংহার বাক্যদ্বয়ের একত্ব প্রতিপাদনের পূর্বোক্ত বাক্যদ্বয় অবিরোধে স্বরূপ-লাভ (আত্মপ্রকাশ করিয়া থাকে। উক্ত প্রকারে উপক্রম ও উপসংহার এই দুই বাক্যের একত্ব প্রতিপাদন দ্বারা বিধির উদ্দেশ নির্ণীত হইয়াছে। এইজন্য ইহা বাক্য বিনিয়োগ। — অতঃপর দ্বিতীয় অধিকরণ কথিত হইতেছে; যথা, –যজুৰ্ব্বেদোক্তগমাধানইত্যাদি। তাহার অর্থ এই, বহ্নি-স্থাপনে বামদেব্য প্রভৃতি সাম অঙ্গরূপে বিহিত হইয়াছে। যদিও ঐ সমস্ত সাম যজুৰ্ব্বেদবিহিত বহ্নিস্থাপনের অঙ্গ, তাহা হইলেও উক্ত বামদেব্য প্রভৃতি সাম সামবেদে উৎপন্ন হইয়াছে। সেই সামের উৎপত্তি-বাক্য শীঘ্র বোধগম্য হয়। সেইজন্য সামবেদের ধর্মানুসারে (উচ্চৈঃস্বরে) উক্ত বামদেব্যাদি সমগ্র সাম গান করিতে হইবে। কিন্তু তাহাও বলিতে পারনা; এবং সে সিদ্ধান্তও সমীচীন নহে। কারণ, এস্থলে বিনিয়োগই প্রবল। সেই বিনিয়োগ। যজুৰ্ব্বেদে শ্রুত হইয়াছে; যথা, য এবং বিদ্বান বামদেব্যং গায়তি ইতি। ইহার অর্থ এই, –যিনি এই প্রকার (উচ্চতাদি) জ্ঞাত, আছেন, তিনি বামদেব্য সাম গান করিয়া থাকেন। গুণে (অপ্রধান অঙ্গ) যে মুখ্যের (প্রধান। পদার্থের) অনুসরণ হয়, ইহা যুক্তিসঙ্গত। এস্থলে কে গুণ ও কে মুখ্য; এই প্রশ্নের উত্তরে বলা যাইতেছে, এস্থলে আধান (বহ্নিস্থাপন) অঙ্গী, সুতরাং উহা প্রধান কর্ম; আর সামগান অঙ্গ বলিয়া গুণ (অপ্রধান) কৰ্ম্ম। আদান প্রধান কর্ম ও সামগান গুণ কৰ্ম্ম, –এইরূপ স্থির হইলে, যেমন আধানকর্মের অঙ্গস্বরূপ ধৰ্ম্মঃ শিরঃ ইত্যাদি মন্ত্ৰসমূহ অনুচ্চস্বরে পঠিত হয়, সেইরূপ সামসমুদয়কে আধানানুসারে অনুচ্চস্বরে গান করিতে হইবে। — অথবা বিনিয়োগ বিধি কৰ্ম্মে অনুষ্ঠান-নিৰ্বাহক (অর্থাৎ, কৰ্ম্মানুষ্ঠান-বিষয়ে পুরুষকে নিয়োগ করে); সুতরাং তাহা প্রধান বিধি। কিন্তু উৎপত্তি বিধি বিনিয়োগ-বিধির তুল্য নয় বলিয়া তাহা অপ্রধান। বিনিয়োগবিধি প্রধান এ বলিয়া এই যজুৰ্ব্বেদোক্ত বহ্নি স্থাপনের স্থলে বিনিয়োগ বিধি অনুসারে বামদেব্যাদি সাম অনুচ্চস্বরে গান করিতে হইবে।

পঞ্চম অধ্যায়ের তৃতীয় পদে চতুর্থ ও পঞ্চম অধিকরণে স্তোম বিচার করা হইয়াছে। তাহার মধ্যে চতুর্থ অধিকরণ এই, –স্তোমবৃদ্ধৌ ইত্যাদি। তাহার অর্থব্যাপদেশে একবিংশেনাতিরাত্রেণ ইত্যাদি শ্রুতি উল্লিখিত হইয়াছে। ঐ শ্রুতির অর্থ, –ঋত্বিক একবিংশস্তোম বিশিষ্ট অতিরাত্ৰ-নামকযাগে প্রজাকামী যজমানকে দীক্ষিত করিবেন। পুনশ্চ উক্ত ঋত্বিক তেজস্কামী যজমানকে ত্রিনবস্তোম দ্বারা ও প্রতিষ্ঠাকামী যজমানকে ত্রয়স্ত্রিংশ নামক স্তোম দ্বারা, অতিরাত্র যাগে দীক্ষিত করিবে। প্রকৃতিভূত বহিষ্পবমান নামক স্তোত্রে তিনটি তৃচ আছে। তাহার মধ্যে উপাস্মৈ গায়তা ইত্যাদি প্রথম তৃচ (উ. ১। প্র: ১। সু. ১। ২। ২ ঋ); দবিদ্যুতোরুচা ইত্যাদি দ্বিতীয় তৃচ (উ. ১. ১। সু. ১। ২। ৩ ঋ); এবং পবমানস্য তে কব ইত্যাদি তৃতীয় তৃচ (উ. ১। প্র. ৩। সু. ১২৩ ঋ); সেই তিনটী তৃচের মধ্যে প্রত্যেক তৃচের শেষে সাম গান করা হইয়া থাকে। উক্ত গান দ্বারা ত্রিবৃৎ স্তোম নিষ্পন্ন হয়। কিন্তু যেরূপ পঞ্চদশ ও সপ্তদশ প্রভৃতি স্তোম সম্বন্ধে গানবৃত্তি হয়, এই ত্রিবৃৎস্তোমে সেইরূপ গানাবৃত্তি হইবে না। উক্ত বহিষ্পবমান স্তোত্র, বিকৃতিস্বরূপ অতিরাত্র নামক যাগে অতিদেশ দ্বারা পাওয়া গিয়াছে। ত্রিবৃৎ স্তোমকে নিরস্ত করিবার জন্য, সেই অতিদেশ হইতে প্রাপ্ত বহিষ্পবমান-স্তোত্রে, একবিংশ প্রভৃতি স্তোম বিহিত হইয়াছে। বহিষ্পবমান-স্তোত্রে গানের আবৃত্তি নাই। এইজন্য উক্ত তিনটি তৃচে বিদ্যমান যে নয়টি ঋক্, তাহা দ্বারা একবিংশস্তোমের নিষ্পত্তি হয় না। অতএব সেই একবিংশ-স্তোম নিষ্পত্তির নিমিত্ত, আরও চারিটি তৃচ আনয়ন করিতে হইবে। তদ্ভিন্ন ত্রিনব (সপ্তবিংশ) স্তোম নিম্পাদনের নিমিত্ত অতিরিক্ত ছয়টি ও ত্রয়স্ত্রিংশ স্তোম নিষ্পত্তির নিমিত্ত আটটি তৃচ আনয়ন করিতে হয়। ঋকসমূহের আগমন পরে কথিত হইবে। প্রধান যাগ হইতে লব্ধ বহিষ্পবমান স্তোত্রের মধ্যে সেই অতিরিক্ত আগন্তুক মন্ত্রসমূহের সন্নিবেশ করিতে হইবে; কারণ, দ্বাদশ-দিন-সাধ্য যাগ কৰ্ম্মে উক্ত মন্ত্র-সমূহের সন্নিবেশ দৃষ্ট হইয়া থাকে। এইরূপে পূৰ্ব্বপক্ষ স্থির হইল। অধুনা সিদ্ধান্ত হইতেছে, -দ্বাদশাহ যাগে যে বাক্য উল্লিখিত আছে, তাহা এই, -স্তোত্রিয়ানুরূপৌ তৃচৌ ভবতাইত্যাদি। তাহার অর্থ, –প্রধান কর্ম সম্বন্ধীয় যে তিনটি তৃচ বহিষ্পবমানস্তোত্রে বিদ্যমান আছে, তাহারা যথাক্রমে স্তোত্রিয়, অনুরূপ এবং পৰ্য্যাস এই নামত্ৰয়ে অভিহিত হইয়াছে। অতিদেশ-প্রাপ্ত অনুরূপ ও পুৰ্য্যাস এই দুই তৃচের মধ্যে বৃষৎ শব্দ-যুক্ত কয়েকটী তৃচ নির্দেশ করিতে হইবে। অতএব দ্বাদশাহ যাগে উক্ত আগন্তুক তৃচ-মন্ত্র সমূহ নিবিষ্ট হইয়াছে। কিন্তু যাহাতে উক্ত আগন্তুক মন্ত্র-সকল অতিরাত্র যাগের মধ্যে বহিষ্পবমানে আসিতে পারে, সেরূপ কোনও বচন নাই। ফলতঃ, স্তোম-নিষ্পত্তির জন্য যে ক্রম প্রসিদ্ধ আছে, সেই ক্রমের বাধা না হয়, তন্নিমিত্ত উক্ত আগন্তুক মন্ত্র সমূহ অতিরাত্র-স্থলে-পঠিত তিনটি তৃচের শেষে সন্নিবিষ্ট হইবে। তৃচের মধ্যে তাহারা সন্নিবিষ্ট হইবে না, –ইহাই সিদ্ধান্ত।

পঞ্চম অধিকরণ কথিত হইতেছে; যথা, আর্ভবে সাম্ন আগন্তো ইত্যাদি। তাহার অর্থ এইরূপ–চতুর্থ। অধিকরণে অতিরাত্র যাগকৰ্ম্ম উল্লিখিত হইয়াছে। সেই অতিরাত্র যাগে মাধ্যন্দিন ও আর্ভব এই দুই পবমান স্তোত্ৰ-সম্বন্ধী পঞ্চদশ ও সপ্তদশ নামক স্তোমদ্বয় অতিদেশ-বিধি দ্বারা পাওয়া গিয়াছে। কিন্তু উক্ত স্তোমদ্বয়কে, নিরস্ত করিবার জন্য, তদপেক্ষা অধিক একবিংশাদি স্তোম অনুষ্ঠিত হয়। এই অনুষ্ঠান বাচনিক। যেরূপ বহিষ্পবমানে ঋকের আগম হয়, সেইরূপ উক্ত একবিংশাদি স্তোমের অনুষ্ঠানে ঋকের আগম হয় না। পরন্তু সামের আগম দ্বারা স্তোম-নিষ্পত্তি হইয়া থাকে। ইহা দশম অধিকরণে উক্ত হইবে। সেই আগন্তুক সাম, পূৰ্ব্বকথিত ঋ-সমূহের ন্যায়, প্রস্তুত তৃচের শেষে নিবিষ্ট হইয়া থাকে সেইজন্য পঠিত তৃচ সমূহের মধ্যে, এ শেষ তৃচে, উক্ত সাম গান করিতে হইবে। এইরূপ পূৰ্ব্বপক্ষ পাওয়া গেল। এক্ষণে সিদ্ধান্ত বলিতেছি। ত্রীণি হবৈ যজ্ঞস্যোদরাণি ইত্যাদি বিশেষ শ্রুতি আছে। সেই শ্রুতির অর্থ—স্তোমকে বর্ধিত করিবার নিমিত্ত তৃচের ও সহিত সামের সমন্বয়, এবং স্তোমকে হ্রাস করিবার জন্য উদ্বাপ (অনাগম) ব্যবস্থিত হয়। গায়ত্রী প্রভৃতি ছন্দে আবাপ ও উদ্বাপ হইয়া থাকে ; কিন্তু অন্য ছন্দে তাহা সম্ভবপর নহে। “উচ্চাতে জাতমন্ধসঃ—ইহা মাধ্যন্দিন পবমানের প্রথম তৃচ (উ ১৮। সূ১।২৩ঋ); স্বাদিষ্ঠয়া—ইহা আৰ্ভব পবমানের প্রথম তৃচ। উক্ত তৃদ্বয় গায়ত্রীচ্ছন্দবিশিষ্ট। এইজন্য উক্ত তৃদ্বয়ে সামের আবাপ আগম হইবে; কিন্তু ত্রিষ্টুপ ও জগতীছন্দবিশিষ্ট অপর দুইটী চে সামের আগম করিবে না। ইহাই সিদ্ধান্ত।

পূর্বোক্ত পঞ্চম অধ্যায়ের তৃতীয় পদে, পঞ্চদশ অধিকরণে, স্তোম বিচার করা হইয়াছে। সেই অধিকরণ, এক স্তোমেহন্য শব্দঃ স্যাৎ ইত্যাদি। অন্যেন ইত্যাদি বাক্যে অন্য শব্দ পূৰ্ব্ব অধিকরণে উদাহৃত হইয়াছে। সেই অন্য শব্দ এক-স্তোম বিশিষ্ট যজ্ঞে বৰ্তমান আছে। কেন? তাহার কারণ—“ত্রিবৃদন ইত্যাদি অর্থবাদের দ্বারা সেই একস্তোমবিশিষ্ট যজ্ঞের উপলব্ধি হইতেছে। উক্ত অর্থবাদের ব্যাখ্যা এই, অগ্নিষ্টোম-যাগে ত্রিবৃৎ পঞ্চদশ সপ্তদশ ও একবিংশ’ এই স্তোম-চতুষ্টয় বিদ্যমান আছে। সেই স্তোম-চতুষ্টয়ের মধ্যে ত্রিবৃং নামক স্তোম বিকৃতিজন্যযাগ প্রাপ্ত হয় (অর্থাৎ কোনও প্রধান যাগের অনুষ্ঠানানুসারে বিহিত এবং তদপেক্ষা নূন কালাদি-সাধ্য কৰ্ম্মকে বিকৃত কৰ্ম্ম কহে ; যেমন যাবজ্জীবনকৰ্ত্তব্য দর্শপৌর্ণমাস যাগের বিকৃতি—মাসসাধ্য দর্শপৌর্ণমাস যাগ)। উক্ত ত্রিবৃৎ’ স্তোম সেই যজ্ঞকে প্রকাশিত করে অর্থাৎ সেই যজ্ঞের সর্বাঙ্গব্যাপক হয়। সেই যজ্ঞে অন্য কোনও স্তোম প্রবেশ করে না; সেইজন্য একমাত্র ত্রিবৃৎ স্তোম সমগ্র যজ্ঞস্বরূপে ব্যাপ্ত হইলে, এক-স্তোমবিশিষ্ট যজ্ঞ নিষ্পন্ন হয়। এবম্প্রকারে পঞ্চদশ প্রভৃতি তিনটি স্তোমের ব্যাপ্তি স্থির করিতে হইবে। তাহা হইলে দেখা যাইতেছে যে, —অর্থবাদ হইতে এক-স্তোমবিশিষ্ট যাগসমূহই প্রথম জ্ঞান-গােচর হইতেছে। এইজন্য অন্য শব্দ দ্বারা সেই যাগ সমূহই কথিত হইতেছে। ত্রিবৃৎ, অগ্নিষ্টোম ও পঞ্চদশ উথ ইত্যাদি এক স্তোম বিশিষ্ট যজ্ঞ। ষড়রাত্রাদির মধ্যে তাহা উল্লিখিত হইয়াছে। উক্ত কারণে অন্য শব্দ, এক স্তোম বিশিষ্ট যজ্ঞ বিষয়েই প্রযুক্ত হইয়াছে, বুঝিতে হইবে। এইরূপ পূৰ্ব্বপক্ষ স্থির হইলে, তাহার উত্তরে বলিতেছি, —“সতং দীপয়তি। এই অর্থবাদ-অংশে কেবল ত্রিবৃৎ আদি স্তোমের যজ্ঞ-প্রকাশকর্তৃত্বই বলা হইতেছে। সেই যজ্ঞ। প্রকাশ-কর্তৃত্ব ধৰ্ম্মব্যাপ্তিব্যাতিরেকে কেবল সম্বন্ধ হইতেই উপপন্ন হয়। এইজন্য অন্য শব্দ অগ্নিষ্টোম-যাগের প্রতিযোগী (যাহার অভাব বুঝায় তাহাকে প্রতিযোগী বলে; এখানে অন্য শব্দে অগ্নিষ্টোম ভিন্ন যাবতীয় যাগকে বুঝাইতেছে)। সুতরাং বহু-স্তোম বা একস্তোম পক্ষে, —অন্য শব্দ সাধারণভাবে শ্রুত হইয়াছে। সেই অন্য শব্দ, এক-স্তোম-বিষয়ে প্রযুক্তবহু স্তোম বিষয়ে প্রযুক্ত নয়, –এরূপ সঙ্কোচের কোনও কারণ নাই। কারণ, অন্যেন পদস্থিত অন্য শব্দ অগ্নিষ্টোম ভিন্ন সমস্ত যাগকে বুঝাইতেছে। ইহাই সিদ্ধান্ত।

সপ্তম অধ্যায়ের তৃতীয়পাদে, তৃতীয় অধিকরণে, সমগ্র পৃষ্ঠ-স্তোত্রের অতিদেশ উদ্ভাবিত হইয়াছে; যথা, বিশ্বজিৎ সৰ্ব্বপৃষ্ঠঃ কিম্ ইত্যাদি। বিশ্বজিৎ নামক যজ্ঞে সমগ্র পৃষ্ঠ-স্তোত্র বিশিষ্ট হয়, —এইরূপ শ্রুতি আছে। উক্ত শ্রুতিতে যে সৰ্ব্বপৃষ্ঠ শব্দ আছে, তাহা অনুবাদ মাত্র। কেননা, প্রধান যাগে সমগ্র পৃষ্ঠ-স্তোত্র পাওয়া গিয়াছে। অতঃপর তদ্বিবরণ বর্ণিত হইতেছে। জ্যোতিষ্টোম যাগে মাধ্যন্দিন-পবমানের অনন্তর মাহেন্দ্র আদি চারিটী স্তোত্র (অভিত্বাশুর নােনুম প্রভৃতি) বিদ্যমান আছে। সপ্তদশ স্তোম নিম্পাদনানন্তর সেই চারিটী স্তোত্র

গীত হইয়া থাকে। পঞ্চভ্যো হিং করােতি ইত্যাদি ব্রাহ্মণণাক্ত বিধান অনুসারে একটী সূক্তে বিদ্যমান ঋয়ের। ! সপ্তদশ বার আবৃত্তি করাকে সপ্তদশ স্তোম বলে। উক্ত প্রকার সপ্তদশ স্তোত্রকে পৃষ্ঠ স্তোত্র বলা হয়। পৃষ্ঠ এ সপ্তদশ সংখ্যক হয়—এইরূপ শ্রুত হইয়া থাকে। ঐ সপ্তদশ পৃষ্ঠ-স্তোত্র অতিদেশ-বিধি দ্বারা বিশ্বজিৎযাগে

পাওয়া গিয়াছে। এইজন্য সৰ্ব্বপৃষ্ঠ শব্দ দ্বারা সেই সপ্তদশ পৃষ্ঠের অনুবাদ (পুনরুল্লেখ করা হইতেছে। ইহা প্রথম পক্ষ। জ্যোতিষ্টোম যাগে রথস্তর ও বৃহৎ–এই দুই পৃষ্ঠ বিকল্পে বিহিত হইয়াছে। উক্ত পৃষ্ঠদ্বয় বিশ্বজিৎ যাগেও অতিদেশ দ্বারা বিকল্পে পাওয়া যায়। কিন্তু সৰ্ব্বপৃষ্ঠ পদে সৰ্ব্ব শব্দ দ্বারা উক্ত পৃষ্ঠদ্বয়ের সমুচ্চয় বিধান করা যাইতেছে। তাহা হইলে অনুবাদ-জন্য বিধির ব্যর্থতা হইবে না। ইহা দ্বিতীয় পক্ষ। সৰ্ব্বপৃষ্ঠ এই পদে যে সৰ্ব্বশব্দ আছে, সেই সব্ব শব্দ বহু অর্থে প্রধান; কিন্তু দুই সংখ্যাতে প্রধান নয়। সেইজন্য সৰ্ব্বপৃষ্ঠ শব্দে ছয়-সংখ্যক পৃষ্ঠ অতিদিষ্ট হইতেছে। ষড়হ (ছয়দিনসাধ্য) যাগে প্রতিদিন এক একটী পৃষ্ঠ বিহিত হইয়াছে। উক্ত ছয়টী পৃষ্ঠ-স্তোত্র-যথাক্রমে রথস্তর, বৃহৎ, বৈরূপ, বৈরাজ, শাঙ্কর এবং রৈবত এই ছয়টী সাম দ্বারা নিষ্পন্ন করিতে হয়। বিশ্বজিৎযাগ একদিন-সাধ্য। এইজন্য উহা জ্যোতিষ্টোমগেরই বিকৃত স্বরূপ। কিন্তু ষড়হযাগের বিকৃতিস্বরূপ হয় নাই। তথাপি, বিশ্বজিৎ যাগে, সৰ্ব্বপৃষ্ঠ এই বাক্যের সামর্থ্যে, উক্ত ছয়টী পৃষ্ঠ-স্তোত্রের অতিদেশ করা যাইতেছে। ইহাই সিদ্ধান্ত।

পঞ্চম অধ্যায়ের তৃতীয়পাদে, দশম অধিকরণে, স্বর এবং সামসমূহের বিকার চিন্তিত হইয়াছে। সেই অধিকরণ এই–ন বিকারোহবিকারে বা ইত্যাদি। উক্ত অধিকরণ এইরূপে ব্যাখ্যাত হইয়াছে; যথা, সম্বৎসর-সাধ্য গবাময়ন যাগে, প্রথম ছয় মাস ও অপর ছয়মাস–এই দুই মাস-ষক (অয়নের উত্তরায়ণ ও দক্ষিণায়ণ) আছে। তন্মধ্যে বিষুবৎ নামক একটী প্রধান অহঃ-স্তোত্র বিদ্যমান আছে। সেই অহঃ-স্তোত্র দিবাভাগে কীৰ্ত্তন করিতে হয়। ঐ অহঃ-স্তোত্রের প্রথমে স্বরসাম নামক অহঃসম্বন্ধি তিনটী বিশেষ বিদ্যমান। ঐ স্তোত্রের পরে তিনটী স্বর-সাম বর্তমান আছে। এতদভিপ্রায়ে শ্রুতি আছে, –অভিতো দিবাকীৰ্ত্তংইত্যাদি। শ্রুতির অর্থ এই–দিবাভাগে কীৰ্ত্তনীয় যে অহঃস্তোত্র, তাহার সর্বত্র (আদিতে ও অন্তে) তিনটী স্বর-সাম হইবে। সেই সমস্ত স্বর-সামে গ্রহ-(যজ্ঞিয়পাত্রবিশেষ) গণের যথাযথ স্থাপনের নিমিত্ত, সপ্তদশ স্তোম প্রভৃতি ধর্ম বিহিত হইয়াছে। অন্য স্থলে (বিকৃতিযাগে) পৃষ্ঠঃ ষড়হো দৌ স্বরসমানৌ এরূপ শ্রুতি আছে। তাহার অর্থ এই, –পৃষ্ঠ ও ষড়হ এই দুইটী স্বর-সাম। পৃষ্ঠ ও ষড়হ-এই অৰ্হবিশেষদ্বয় পূৰ্ব্বকথিত স্বর-সামসমূহের বিকার নহে। কেন? কারণ, স্বর-সাম শব্দ বৈষ্ণব শব্দের তুল্য। বৈষ্ণব শব্দ যেরূপ বিষ্ণুদেবতারূপ গুণ বিধান দ্বারা প্রধান কৰ্ম্মে সঙ্গত হইয়াছে, পরন্তু লক্ষণাবৃত্তি দ্বারা ধৰ্ম্মসমূহের অতিদেশ করিতেছে না; সেইরূপ স্বর সাম শব্দ অহঃ-স্তোত্রে সামবিশেষের গুণ বিধান করিতেছে, –সপ্তদশ স্তোম প্রভৃতির ধৰ্ম্মাতিদেশ করিতেছে না। এইরূপ পূৰ্ব্বপক্ষ প্রাপ্ত হইলে, সিদ্ধান্ত বলিতেছি, অন্য উপায়শূন্য পৃষ্ঠ ষড়হঃ এই পুংলিঙ্গশব্দহেতু, পৃষ্ঠ ও ষড়হ অৰ্হবিশেষে বিহিত স্বরসামদ্বয় পূর্বোক্ত স্বরসামসমূহের বিকারস্বরূপ হইয়াছে। তাহাই স্পষ্ট করা যাইতেছে, –ষড়হ ও দুইটী স্বরসাম–এই প্রকারে যে অষ্টাহ যাগ উল্লিখিত হইয়াছে, সেই অষ্টাহযাগে, ছয় দিনে, যথাক্রমে ত্রিবৃৎ, পঞ্চদশ, সপ্তদশ, একবিংশ, ত্ৰিণব এবং ত্রয়স্ত্রিংশ এই ছয়টী স্তোম অতিদেশ দ্বারা পাওয়া গিয়াছে। এইরূপ স্থির হইলে, তৃতীয় ও ষষ্ঠ দিবসে করণীয় যে সপ্তদশ ও ত্রয়স্ত্রিংশ স্তোম, এতদুভয়ের বিপৰ্য্যায় করিয়া, সপ্তম ও অষ্টম দিনে সপ্তদশ স্তোম প্রতিপন্ন করা হয়; অর্থাৎ ঐ স্তোম যেন উক্ত দিনদ্বয়ে প্রমাণ দ্বারা প্রতিপন্ন হইয়াছে, এইরূপ স্থির করা হইয়া থাকে। অনন্তর, অর্থবাদের দ্বারা অবশিষ্ট শেষদিনত্ৰয়ে সপ্তদশ স্তোমের নিরন্তরত্বই বলা হইতেছে। যৎতৃতীয়ং সপ্তদশমহঃ ইত্যাদি বাত্যা-বিপৰ্য্যায়) বিধি। তাহার অর্থ, –তৃতীয় দিনে কর্তব্য যে সপ্তদশ স্তোম, তাহা ত্রয়স্ত্রিংশ স্তোমের স্থানকে বিপৰ্য্যায়রূপে গ্রহণ করে অর্থাৎ এ সপ্তদশ স্তোমের স্থানে ত্রয়স্ত্রিংশ স্তোম এবং এমস্ত্রিংশ স্তোমের স্থানে সপ্তদশ স্তোম হইয়া থাকে;–ইহাই এ বিপৰ্য্যায় ভাব। ত্রয়াণাং সপ্তদশনামনবধানতায়াঃ–ইহা অর্থবাদ। সেই অর্থবাদ দ্বারা যদি স্বর-সাম শব্দে আদি ও অন্ত দিনে সপ্তদশ স্তোম অতিদিষ্ট হয়, তাহা হইলে অষ্টাহ-যাগের শেষ তিন দিনে সপ্তদশ স্তোমের নিরন্তরত্ব। (অবিচ্ছেদে প্রাপ্তি) উপপন্ন হয়। অন্যথা তাহা উপপন্ন হইতে পারে না। কারণ, উক্তরূপে সপ্তদশ স্কোমের নিরন্তরত্ব উপপন্ন হয় বলিয়া, বৈষ্ণব শব্দের যুক্তি অনুসারে স্বর-সাম শব্দে গুণ-বিধি বিহিত হইবে না; কিন্তু সপ্তদশ স্তোম প্রভৃতি ধর্মসমূহের অতিদেশ বিধি হইবে। ইহাই সিদ্ধান্ত সম্মত।

অনন্তর দশম অধ্যায়ের চতুর্থ পাদের নবম অধিকরণ কথিত হইতেছে, যথা, বাধ্যং শ্লোকাদিনাজ্যাদি ন বাদ্যঃ স্তুতিলিঙ্গতঃ ইত্যাদি। তাহার ব্যাখ্যা–মহাব্রত বিষয়ে (ঋত্বিগণ) সদঃ নামক মণ্ডপের সম্মুখে শ্লোকের দ্বারা এবং পশ্চাতে অনুশ্লোকের দ্বারা স্তব করিয়া থাকেন-এইরূপ শ্রুতি আছে। উক্ত মহাব্রতে শ্লোক অনুশ্লোক প্রভৃতি সামসমূহ কর্তৃক প্রকৃতি (প্রধান) কৰ্ম্ম প্রাপ্ত হয়। অধিকন্তু আজ্য ও পৃষ্ঠাদি নামক স্তোমস্থিত রথস্তর, বামদেব্য প্রভৃতি সমস্ত সাম বাধিত হইবে। কেন? কারণ, স্তুতে এই বাক্যে বাধকতামূলক প্রকৃতিগত সামর্থ্য দেখা যাইতেছে। প্রকৃতিস্থলে আজ্যৈঃ স্তুবতে পৃষ্ঠেঃ স্তুবতে, এইরূপ শ্রুত হইয়াছে। ইহা পূৰ্ব্বপক্ষবাদীর মত। সিদ্ধান্তবাদী বলিতেছেন, –তুমি যাহা বলিলে, তাহা যুক্তিযুক্ত নয়। ভাল, তোমাকেই জিজ্ঞাসা করি, –এস্থলে (মহাব্রতে) স্তুতির অনুবাদ করিয়া, তাহাতে দেশ ও সাম এই গুণদ্বয় বিধান করিতেছ অথবা উক্ত গুণদ্বয়বিশিষ্ট স্তুতি বিধান করিতেছ? প্রথম পক্ষ বলিতে পার না; কেননা, তাহাতে বাক্যভেদরূপ দোষ ঘটে। দ্বিতীয় পক্ষে, কাৰ্য্যের বিভিন্নতা-হেতু, দেশ, সাম ও স্তুতি ইহাদের মধ্যে কেহ কাহারও বাধ্য নয়, সুতরাং তাহাদের সমুচ্চয় হইবে। এই পর্যন্ত নবম অধিকরণের মীমাংসা।

দশম অধ্যায়ের চতুর্থ পাদে, দশম অধিকরণে বলা হইয়াছে–কৌৎস্য আদি সাম প্রকৃতি-প্রাপ্ত সামের বাধক; যথা, –সমুচ্চীয়েত কৌৎসাদি যদ্বা প্রাকৃতবাধকং ইত্যাদি। তাহার ব্যাখ্যা, বিকৃতিযাগবিশেষে কৌৎস ও কাথ সাম হয়, এইরূপ শ্রুতি আছে। উক্ত কৌৎস প্রভৃতি সামকে, প্রকৃতি হইতে প্রাপ্ত সামের সহিত সমুচ্চিত (সম্মিলিত) করা হয়। কেন? কারণ, প্রকৃতি-সম্বন্ধী সামের স্তুতিবোধক সামর্থ্য নাই; এইজন্য কাৰ্য্যেরও অভিন্নতা নাই। কিন্তু তাহাও বলিতে পার না। কেননা, প্রকরণবশতঃ সামকে ও স্তুতিকে যজ্ঞের অঙ্গরূপে পাওয়া যাইতেছে। অনন্তর মন্ত্রাক্ষর-প্রকাশ সামর্থ্য রূপ প্রকৃতিগত লিঙ্গকার্য্যের অভিন্নতা প্রতীত হইতেছে। কাৰ্য্যের অভিন্নতা বোধ হইতেছে বলিয়া কৌৎস আদি সাম প্রকৃতি-প্রাপ্ত সামের বাধক হইবে। ইহাই সিদ্ধান্ত।

 একাদশ অধিকরণে এক দ্বি ইত্যাদি উক্তি আছে বলিয়া কৌৎসাদি সাম প্রকৃতিগত সামের বাধক হইবে এইরূপ নির্ণীত হইয়াছে; যথা–তৎসৰ্ববাধকং ইত্যাদি। তাহার ব্যাখ্যা এই, –এই অধিকরণে যে তং পদ আছে, তাহা পূৰ্ব্বকথিত কৌৎসাদি সামকে বুঝাইতেছে। উক্ত অধিকরণে আশঙ্কা এই যে, কৌৎস সাম প্রকৃতি প্রাপ্ত সমস্ত সামের নিবৰ্ত্তক, এবং কাথ নামক সামও উক্তরূপ সমগ্র সামের নিবৰ্ত্তক। এইরূপে কৌৎস প্রভৃতি প্রত্যেক সামের সৰ্ব্বসামনিবর্তকত্ব বলা হইতেছে। যে সাম একবচনান্ত, তাহা একমাত্র সামের নিবৰ্ত্তক, দ্বিবচনান্ত সাম সামদ্বয়ের, আর বহুবচনান্ত সাম বহুসংখ্যক সামের নিবৰ্ত্তক হইবে। এস্থলে তদ্বিষয় বলা যাইতেছে। উক্ত আশঙ্কায়, প্রথম পক্ষ পাওয়া যাইতেছে; কারণ, কৌৎস প্রভৃতি সামসমূহ, প্রত্যেকেই প্রকৃতি-প্রাপ্ত সমস্ত সামের নিবৰ্ত্তক হইবে না, এরূপ কোনও নিয়মবিধি নাই। সুতরাং শেষ পক্ষ স্বীকার করিতে হইবে। কারণ, একবচন দ্বিবচন ও বহুবচন রূপ শ্রুতি উক্তরূপ নিয়ম করিয়াছে। একবচনাদি শ্রুতি এই–কৌৎসং. ভবতি বশিষ্ঠস্য জনিত্রে ভবতঃ ক্রৌঞ্চানি ভবন্তি ইতি। প্রকৃতি-সামের নিবৰ্ত্তক কৌৎসাদি সামে এক, দ্বি ও বহুবচন শ্রুত, হইতেছে; সেই একবচনাদি বচনত্রয় দ্বারা বাধ্য প্রকৃতিগত সামসকল একাদি-সংখ্যাবিশিষ্ট হইয়াছে। সে ক্ষেত্রে অবাধিত সামবিষয়ক অতিদেশ-বিধি অনুগৃহীত হয়। কিন্তু যদি প্রকৃতিগত সমস্ত সামের বাধ হয়, তাহা হইলে সমগ্র অতিদেশ-বিধি বিরুদ্ধ হইয়া থাকে। সুতরাং সৰ্বাতিদেশ বিরুদ্ধ হইবে; পরন্তু কৌৎসাদি প্রত্যেক সাম, সমগ্র প্রকৃতিগত সামের বাধক হইবে না। ইহাই সিদ্ধান্ত।

দ্বাদশ অধিকরণে স্তোমের বৃদ্ধি ও অবৃদ্ধি, এতদুভয়-প্রকৃতি-প্রাপ্ত সামের নিবৃত্তি বিচারিত হইয়াছে; যথা, স্তোমস্থয়োবৃদ্ধাবৃদ্ধ্যোঃ ইত্যাদি। তাহার ব্যাখ্যা, বৃদ্ধস্তোম-বিশিষ্ট ও অবৃদ্ধস্তোমবিশিষ্ট কতকগুলি বিকৃতিযাগ আছে। সেই উভয়বিধ যাগে যে সকল সাম উপদিষ্ট হইয়াছে, সেই সকল সাম কর্তৃক অতিদিষ্ট সামসমূহের নিবৃত্তি হইবে; অন্যথা, সামের উৎপত্তি-বিধান ব্যর্থ বা নিরর্থক হইবে। ইহাই পূৰ্ব্বপক্ষ। অবৃদ্ধস্তোমবিশিষ্ট বিকৃতি-যাগে স্তোমের বৃদ্ধি হয় না। সুতরাং, প্রয়োজন-বশতঃ উপদিষ্ট সাম প্রকৃতি-প্রাপ্ত সামের নিবৰ্ত্তক হইবে; কিন্তু বৃদ্ধ-স্তোমবিশিষ্ট বিকৃতি-যাগে উক্ত সামের উপযোগিতা আছে বলিয়া স্তোমের বৃদ্ধি করিলে, উপদিষ্ট-সাম প্রকৃতি প্রাপ্ত সামের নিবৰ্ত্তক হইবে না। ইহাই সিদ্ধান্ত।

স্তোত্রে ছন্দঃ-বিশেয়ে সামের আবাপ হইয়া থাকে। এয়োদশ অধিকরণে তদ্বিষয় নিরূপিত হইয়াছে; যথা, –কাপি স্তোত্র ঋচি কাপি স্যাদাবাপস্তয়োৰ্ধতিঃ ইত্যাদি। তাহার ব্যাখ্যা এই, –অবৃদ্ধস্তোত্রবিশিষ্ট যাবতীয় বিকৃতি যাগে, প্রকৃতি-যাগ হইতে অতিদেশ-প্রাপ্ত সামের উদ্বাপ (পরিত্যাগ) এবং সাক্ষাৎ-উপদিষ্ট সাম সমূহের আবাপ (গ্রহণ) করিতে হইবে; আর বৃদ্ধস্তোমবিশিষ্ট যাবতীয় বিকৃতি-যাগে উক্ত অতিদেশ ও উপদেশ প্রাপ্ত উভয়বিধ সামেরই আবাপ করিতে হইবে। এতদ্বিষয় পূৰ্ব্ব (দ্বাদশ) অধিকরণে নির্ণীত হইয়াছে। সেই আবাপ ও উদ্বাপ, যে কোনও স্তোত্রে অথবা যে কোনও ঋকে, হইতে পারে। কেন? কারণ, স্তোত্রে আবাপ ও উদ্বাপ হইবে কিন্তু ঋকে হইবে না, –এরূপ কোনও নিয়ম-বিধি নাই। ইহাই পূৰ্বপক্ষ। যাহা হউক, উক্ত পূৰ্ব্বপক্ষবাদীর মত যুক্তিযুক্ত নহে। কারণ, এবকারের দ্বারা প্রকৃতি-প্রাপ্ত পবমান ব্যতীত অন্যবিধ আজ্য। স্তোত্র-সমূহে এবং পরিসংখ্যা-বিধি দ্বারা গায়ত্রী, বৃহতী ও অনুষ্ঠু ভিন্ন অন্য ছন্দঃ-বিশিষ্ট ঋক্‌-সমূহে আবাপ ও উদ্বাপ পাওয়া গিয়াছে। এবকার সম্বন্ধে এইরূপ শ্রুত হইয়াছে, –ত্রীনিহবৈ যজ্ঞস্যোদরাণি, ইত্যাদি। ঐ শ্রুতির অর্থ, গায়ত্রী, বৃহতী ও অনুষ্ঠুভ এই যে তিনটী ঋক্ আছে, তাহারা যজ্ঞের তিনটি উদর স্বরূপ হইয়া থাকে। উক্ত উদরত্রয়ে ঋত্বিগণ সামের আবাপ করিয়া থাকেন। তাহাতে উদ্বাপও সম্পন্ন হয়; (আবাপ করিলে উদ্বাপ করিতে হয়, ইহা শাস্ত্র-প্রসিদ্ধ)। ভাল! উল্লিখিত স্তোত্র বা ঋক্‌-সমূহ কিন্ন আবাপ ও উদ্বাপ অন্যস্থলে হউক; কিন্তু বিবক্ষিত-স্থলে কিরূপে তাহা পাওয়া যায়? এইরূপ প্রশ্নের উত্তরে বলা যায় যে, —ীণি হ বৈ ইত্যাদি বাক্য দ্বারা আবাপ ও উদ্বাপ বিধান করা হইয়াছে। এই জন্য, বিবিক্ষিত স্থলে, আবাপ ও উদ্বাপ পাওয়া যায়। এইরূপে পূৰ্ব্বপক্ষ প্রাপ্ত হইলে, সিদ্ধান্তে বলা যায়–ত্রীণি হ বৈ ইত্যাদি বাক্য অন্য কোনও বাক্যের পোষক নয় বলিয়া উহাকে অর্থবাদ বলা যায় না; অপূৰ্ব্ব (অদৃষ্টরূপ) ফল সম্পাদক বলিয়া অনুবাদও বলা যায় না। কারণ, উক্ত বাক্য-অর্থবাদ বা অনুবাদ হইল না বলিয়া, পবমান-স্তোত্রে এবং গায়ত্রী প্রভৃতি  ঋয়ে উভয়ই আবাপ ও উদ্বাপ হইবে; কিন্তু অন্য স্থলে হইবে না। ইহাই সিদ্ধান্ত। চতুর্বিংশ অধিকরণে নিরূপিত হইয়াছে যে, কথরথর নামক সাম নিজের উৎপাদিকা ঋকেই গীত হইবে; যথা, –বৃহদ্রথস্তরৈকীয়যোনৌ কথরথরং ইত্যাদি। তাহার ব্যাখ্যা, বৈশ্যস্তোমরূপ বিকৃতি যাগে যে পৃষ্ঠস্তোত্র বিহিত হয়, কথরথরং পৃষ্ঠং ভবতি এই শ্রুতি অনুসারে, তাহাতে কথরথররূপ সাম-বিশেষ। বিহিত হইয়াছে। প্রকৃতিরূপ জ্যোতিষ্টোমাদি যাগে যে পৃষ্ঠস্তোত্রের বিধান আছে, তাহাতে বৃহৎ ও রথন্তর এই  এ সামদ্বয় বিকল্পে বিহিত হইয়াছে। ত্বামিদ্ধি হবামহে (ছ: ৩১-৫-২) এই ঋক্, বৃহৎসামের উৎপাদিকা, এবং অভি ত্বা শূরঃ (ছ, ৩১-৫-১) এই ঋক্, রথন্তর সামের উৎপাদিকা। পুনানঃ সোমঃ (ছ, ৫১-৩-১) এই ৫ ঋক্, কৰ্থরথন্তরের উৎপাদিকা। বৃহৎও রথন্তর সামদ্বয়ের মধ্যে একটী সামের উৎপাদিকা যে ঋী, তাহাতে কথরথর নামক সাম গান করিতে হইবে। কেন? কারণ, –অতিদেশ-বিধি-দ্বারা প্রাপ্ত বৃহৎ ও রথস্তর সামদ্বয়ের কোনও বিশেষ নিয়ামক বিধি নাই। অথবা, রথন্তর সামের উৎপাদিকা যে ঋক্, তাহাতেই কথরথর সাম গান করিতে হইবে। কেন? কারণ, রথন্তর নামক সামসম্বন্ধী ধর্মের অতিদেশ করিবার নিমিত্তই রথন্তর নামের সাদৃশ্য খ্যাপন করা হইয়াছে। অতএব ঐ নাম-সাদৃশ্যই উক্ত বিষয়ের নিয়ামক। সিদ্ধান্তবাদী বলিতেছেন, তুমি (পূৰ্ব্বপক্ষবাদী) যাহা বলিলে, তাহা যুক্তিযুক্ত নহে। কারণ–বৃহৎও রথন্তর, এই সামদ্বয়ই প্রকৃতিস্থলে অঙ্গরূপে বিহিত হইয়াছে। কিন্তু উক্ত সামদ্বয়ের উৎপাদিকা দুইটি ঋক্ প্রকৃতিস্থলে অঙ্গরূপে বিহিত হয় নাই। এই জন্য, উক্ত ঋদ্বয় অতিদেশ-বিধি দ্বারা পাওয়া যায় না। বৃহৎ ও রথন্তর সামদ্বয়ের উৎপাদিকা দুইটী ঋক্‌ বিকৃতিস্থলে অতিদেশ দ্বারা প্রাপ্ত হয় না বলিয়া, তাহাদের স্ব স্ব উৎপাদিকা ঋকে কথরথর সাম গান। করিতে হইবে, –এইরূপ সিদ্ধান্ত পাওয়া যাইতেছে। সামগায়কগণের উত্তরাগ্রন্থের পাঠ হইতে সামের স্বীয় উৎপাদিকা ঋকে কথরথর প্রাপ্তির বিষয় বুঝিতে হইবে। এইরূপ স্থলে, পুনানঃ সোমঃ শ্রুতি হইতে বুঝা যায় যে, কন্থরথর সামের উৎপাদিকা ঋকের হানি হইবে না; অথচ অশ্রুত বৃহৎরথন্তরসামদ্বয়ের উৎপাদিকা ঋদ্বয়ের কল্পনাও হইবে না।

উত্তরা ঋকদ্বয়ে কণ্বরথন্তর সাম গান করিতে হইবে, –পঞ্চবিংশ অধিকরণে তদ্বিষয় নিরূপিত হইয়াছে; যথা, –সন্দেহ নির্ণয়ৌ পূর্বদেবোত্তরয়েঋচোঃ। ইত্যাদি। তাহার ব্যাখ্যা ব্যপদেশে একং সাম তৃছে ক্রিয়তে এই শ্রুতি উল্লিখিত হইয়াছে। সুতরাং তিনটি ঋক্ কথরথন্তর সামের আশ্রয়। উক্ত ঋয়ের মধ্যে একটী ঋক্ কথরথরের উৎপাদিকা, এবং অপর দুইটি স্ব স্ব উৎপাদিকা ঋকের উত্তরা। বৃহৎ ও রথস্তর সামদ্বয় সম্বন্ধেও এতদনুরূপ বিধি বিহিত হইবে। উক্ত স্থলে অতিদেশপ্রাপ্তি সম্বন্ধে বিশেষ বিধি না থাকায়, বৃহৎ ও রথযুর সামে, কিম্বা রথন্তর সামের দুইটি উত্তরা ঋকে, ইচ্ছানুরূপ কথরথর সাম গান করিতে হইবে। ইহা প্রথম পক্ষ। পক্ষান্তরে রথন্তর এই নামের সাদৃশ্য-হেতু, রথন্তর সামের দুইটি উত্তরা ঋকে, কথরথর সাম গান করিতে হইবে। প্রকৃতি-যাগে দুইটি উত্তরা ঋক্ সাক্ষাৎসম্বন্ধে অঙ্গ হয় নাই। তাহা না হইলেও প্রথমতঃ সাম-দ্বারা উক্ত ঋদ্বয়ের অঙ্গত্ব স্বীকার করা হয়; তদনন্তর অতিদেশ বিধি দ্বারা তাহাদের প্রাপ্তি হয়। এই জন্য দুইটি পক্ষের উল্লেখ করা হইয়াছে। উক্ত দুই পক্ষই পূৰ্ব্বপক্ষবাদীর অভিপ্রেত। অধুনা সিদ্ধান্তবাদীর মত উল্লিখিত হইতেছে; যথা, যোনি ঋকের ন্যায় দুইটি উত্তরা ঋও গ্রন্থে পঠিত হইয়াছে। এই জন্য উক্ত কঞ্চরথন্তরসাম, স্বীয় উৎপাদিকা ঋকের দুইটি উত্তরা ঋকে গান করিতে হইবে। ইহাই সিদ্ধান্তরূপ তৃতীয়পক্ষ। পূৰ্ব্ব অধিকরণ অপেক্ষা, এই অধিকরণের বিশেষ বিচার এইরূপ; যথা, –বৃহৎ ওরথন্তর এই সামদ্বয়ের উত্তরা ঋকে, কিম্বা স্বীয় উৎপাদিকা ঋকের দুইটি উত্তরা ঋকে, কথরথর সাম গান করা হউক। সর্বপ্রকারেই স্বীয় যোনি (উৎপাদিকা) ঋকের ত্যাগ, অর্থাৎ উদ্বাপ এবং অপর ঋকের, গ্রহণ অর্থাৎ আবাপ, এতদুভয়ই সমান। তাহা হইলে এস্থলে অতিদেশ-বিধিই প্রাপক অর্থাৎ প্রধান বিধি হইতেছে। সুতরাং পূৰ্ব্বপক্ষবাদীর আশঙ্কা অকিঞ্চিৎকর। তৃচ শব্দ সমান-ছন্দো-বিশিষ্ট, এবং একদেবতাযুক্ত তিনটি ঋকেই তাহা প্রসিদ্ধ। এই হেতু, সাক্ষাৎ তৃচে শ্রুতি দ্বারা অতিদেশ-প্রাপ্তির বাধ হইতেছে। ইহাই সিদ্ধান্তবাদীর অভিপ্রায়।

পঞ্চম-পাদের দ্বিতীয় অধিকরণে, তিস্যু এই শ্রুতিতে, প্রথম তৃচ (তিনটি ঋক) বিবক্ষিত হইয়াছে। উক্ত দ্বিতীয় অধিকরণ এই, তৃচাদ্যাসু তৃচেবাদ্যে ইত্যাদি। তাহার ব্যাখ্যা, –এক-সংখ্যা ও ত্রি-সংখ্যা, এতদুভয়ের পরস্পর ঘনিষ্ট-সম্বন্ধ বৰ্তমান। তদ্বারা বুঝা যাইতেছে যে, –একত্রিক নামক কোনও একটী যজ্ঞ হইয়া থাকে। সেই যজ্ঞ এইরূপে শ্রুত হয়; যথা–অথৈষ একত্রিকঃ ইত্যাদি। তাহার অর্থ এই, –অনন্তর একত্রিক যজ্ঞ ব্যাখ্যাত হইতেছে। সেই একত্রিক যজ্ঞে, একটি ঋকে বহিষ্পবমান স্তোত্র, তিনটি ঋকে হোতার আজ্য-স্তোত্র, পুনরায় একটি ঋকে মৈত্রাবরুণের ও ঋয়ে ব্রাহ্মণাচ্ছংসীর (ঋত্বি বিশেষের) আজ্য-স্তোত্র, পুনশ্চ আর একটি ঋকে অচ্ছাবাকের আজ্যস্তোত্র এবং তিনটি ঋকে মাধ্যন্দিন পবমান (হইয়া থাকে)। প্রধান-যাগে, মাধ্যন্দিন পবমান সূক্তে তিনটি তৃচ আছে; যথা, -উচ্চাতে জাত (উ ১। প্র ৮। সূ ২৩ ঋ), এইটী প্রথম তৃচ; ইহা গায়ত্রীচ্ছন্দোবিশিষ্টঃ। পুনানঃ সামঃ (উ ১। প্র৯। সূ১২৩ ঋ)–এইটী দ্বিতীয় তৃচ; ইহা বৃহতীচ্ছন্দোবিশিষ্ট। প্র তু দ্রব্যাং (উ ১১। প্র২০। সূ১২। ৩ ঋ)–এইটী তৃতীয় তৃচ; ইহা ত্রিষ্ঠুভ ছন্দোবিশিষ্ট। এই অভিপ্রায়েই ত্রিচ্ছন্দা আবাপো মাধ্যন্দিনঃ, –এই প্রকার শ্রুতি হইয়াছে। উক্ত প্রকারে বিচার্য্য বাক্য স্থির হইলে, একত্রিক যাগের মাধ্যন্দিন পবমানোক্ত তিসৃষ্ণু ইত্যাদি বাক্যে এই সংশয় হইতেছে যে, তিনটি তৃচের প্রথম ঋত্রয় গ্রহণ করিতে হইবে কি না? কিংবা প্রথম তৃচে বিদ্যমান ও যথাক্রমে পঠিত যে ঋয়, তাহাই গ্রহণ করিতে হইবে? এই প্রকার সংশয়ে পূৰ্ব্বপক্ষবাদী বলিতেছেন, –প্রবল-ছত্ৰয়ে বৈশিষ্ট্য শ্রুতি দ্বারা দুৰ্বল পাঠক্রমকে বাধিত করা যায়। সুতরাং উক্ত সংশয়ের প্রথম পক্ষই গ্রাহ্য। এইরূপে পূৰ্ব্বপক্ষ প্রাপ্ত হইলে, উত্তরে বলা যাইতেছে, –এই যে ছন্দঃ-বিশিষ্টতা, তাহা প্রকৃতি যাগসম্বন্ধিনী। কারণ, সেই প্রকৃতিযাগে ছন্দত্রয়বিশিষ্ট তিনটী তৃচ উপদিষ্ট হইয়াছে; যদি বল, –বিকৃতি-স্থলেও সেই ছন্দঃত্রয়-বিশিষ্ট তিনটী তৃচই অতিদিষ্ট হইয়াছে। কিন্তু তাহাও বলিতে পার। উক্ত তৃচত্রয়ের অতিদেশ হয়, এই জন্যই পাঠক্রমও অতিদিষ্টহইয়াছে। তাহা হইলে, অগ্রে আরব্ধ গায়ত্রীচ্ছন্দোবিশিষ্টতৃচের সমাপ্তি হয়। তৎপরে বৃহতীচ্ছন্দোবিশিষ্ট তৃচে প্রথম ঋকের আরম্ভ হয়; এবং সেই আরম্ভ তিস্যু প্রভৃতি বিশেষ বিধান দ্বারা বাধিত হইয়া থাকে। বৃহতীসম্বন্ধীয় তৃচস্থিত প্রথম ঋকের আরম্ভ বিশেষ-বিধি দ্বারা বাধিত হয় বলিয়া সমগ্র প্রথম তৃচ গ্রহণ করিতে হইবে। ইহাই সিদ্ধান্ত।

তৃতীয় অধিকরণে, একটী ঋকে, ধূঃ গান কৰ্ত্তব্য–এইরূপ নিরূপিত হইয়াছে। উক্ত অধিকরণ, –তৃচে স্যাদৃচি বৈকস্যা ইত্যাদি। তাহার ব্যাখ্যা, –একত্রিকযাগে বিশিষ্ট-সম্বন্ধ দ্বারা একমাত্র ঋকে যে সকল স্তোত্র সম্পন্ন হইয়া থাকে, সেই স্তোত্র-সমূহে যে ধূর্গান হয়, তাহা কি তৃচে হইবে, কিম্বা একটী মাত্র ঋকে হইবে? ইহাই সংশয়। উক্ত সংশয়-নিরসনে, অতিদেশ-বিধি দ্বারা তৃচে ধূর্গান হইবে এইরূপ পূৰ্ব্বপক্ষ প্রাপ্ত হইলে, তাহার উত্তরে বলিতেছি, –এই একত্রিক যাগে একটী মাত্র ঋকে ধুর গান হইবে। কেন? কারণ, আবৃত্তং ধূর্য স্তবতে এই শ্রুতি দ্বারা গানের আবৃত্তি বিহিত হইয়াছে। যদি বল, তৃচে গান করিলেও সামের বারত্ৰয় আবৃত্তি হইবে না কি? না, আবৃত্তি হইবে না। কারণ, আবৃত্তি স্তুতির বিশেষণ। যে পদসমূহ বা বাক্য গুণকীৰ্ত্তন করে, সেই পদসমূহের নাম স্তুতি। ঋকের আবৃত্তি ভিন্ন সেই স্তুতি ঋয়ে সিদ্ধ হয় না। যাহা হউক, ঋকের আবৃত্তি ভিন্ন স্তুতি সিদ্ধ হয় না বলিয়া একটী মাত্র ঋকে ধূর গান করিতে হইবে।

 অন্য সামের আগম হইতে স্তোমের বৃদ্ধি হয়–ইহাই ষষ্ঠ অধিকরণের বক্তব্য। ষষ্ঠ অধিকরণ এই, স্তোমবৃদ্ধিঃ কিমভ্যাসাৎইত্যাদি। তাহার ব্যাখ্যা, বিরুদ্ধ স্তোমবিশিষ্ট যাগের এইরূপ উল্লেখ আছে; যথা, একবিংশেনাতিরাত্রেণ প্রজাকামং যাজয়েৎ ইত্যাদি। এই শ্রুতির অর্থ পূৰ্ব্বে কথিত হইয়াছে। প্রকৃতি-যাগস্থিত ত্রিবৃৎ ও পঞ্চদশ প্রভৃতি স্তোম অপেক্ষা একবিংশ, ত্ৰিণব ও ত্রয়স্ত্রিংশ এই কয়েকটী স্তেম বিশেষরূপে বর্ধিত। এ প্রকৃতি-প্রাপ্ত সাম-সমূহের অভ্যাস (পুনঃপুনঃ উল্লেখ) প্রযুক্ত উক্ত একবিংশাদি স্তোমের বৃদ্ধি হয়, কিংবা প্রকৃতি প্রাপ্ত সাম ভিন্ন অন্য সামের আগমহেতু তাহার বৃদ্ধি হইয়া থাকে? অশ্রুত যে সামের আগম, তাহা কল্পনা করিতে পারা যায় না। এইজন্য প্রকৃতি-প্রাপ্ত সামসমূহের অভ্যাস হইতেই উক্ত স্তোমের বৃদ্ধি হইয়া থাকে। ইহা পূৰ্ব্বপক্ষ। অতঃপর সিদ্ধান্ত বলিতেছি, –অভ্যাসও সাক্ষাৎসম্বন্ধে শ্রুত হয় নাই। কিন্তু একবিংশাদি সংখ্যা পূরণের নিমিত্ত অভ্যাসের কল্পনা করা হয়। দ্রব্যগত সংখ্যা ভিন্ন দ্রব্যের দ্বারাই সংখ্যা পূর্ণ হইয়া থাকে। কিন্তু কেবল একদ্রব্যের আবৃত্তি দ্বারা তাহা পূরণ হয় না। দেখ, –একটীমাত্র ঘটকে, আটবার আনয়ন করিয়া, পরে আমার গৃহে আটটী ঘট আছে এরূপ বাক্য কেহ ব্যবহার করে না। উক্ত কারণে, –স্তোমের অবয়বরূপ দ্রব্যগত যে সংখ্যা, তাহাতে স্তোমের অবয়ব-স্বরূপ সমস্ত সাম-পদার্থের ভেদ বুঝাইতেছে। উক্ত ভেদ, প্রকৃতি-প্রাপ্ত সাম ভিন্ন, অন্য সামে আগম-প্রতিপাদক-সমর্থ; আবাপের উদ্দেশে অত্ৰহ্যেবাবপন্তি এইরূপ যে দেশবিশেষ নিরূপক বিধি আছে, তাহা সামান্তরের উৎপত্তি-নিম্পাদক দ্বিতীয় সামর্থ্য। ফলতঃ, সামান্তরের আগম দ্বারা স্তোমের বৃদ্ধি হইয়া থাকে। ইহাই সিদ্ধান্ত।

বহিষ্পবমানের বৃদ্ধি করিতে হইলে ঋকের আগম কর্তব্য। সপ্তম অধিকরণে তাহা নির্ণীত হইয়াছে। সেই সপ্তম অধিকরণ এই, –কিং বহিষ্পবমানৰ্দেী ইত্যাদি। প্রকৃতিস্থলে প্রাতঃসবনকালে বহিষ্পবমান স্তোত্রের স্তোম বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়; বিকৃতি-যাগে সেই স্তোমের বৃদ্ধি হইলে, পূৰ্ব্ব অধিকরণে কথিত নিয়মানুসারে, সামান্তরের আগম পাওয়া যায়। অতঃপর বলিতেছি, একং হি তত্র সাম। এই শ্রুতি দ্বারা বহিষ্পবমানের উল্লেখ করিয়া সেই বহিষ্পবমানে সামের একত্ব কথিত হইয়াছে। এইজন্য সামান্তরের আগম সম্ভবপর নয়। যদি বল, যখন সামান্তরের আগম সম্ভবপর হইল না, তখন প্রকৃতি-প্রাপ্ত সামের অভ্যাস দ্বারা একবিংশাদি সংখ্যার পূরণ হউক। কিন্তু তাহা যুক্তিসঙ্গত নহে। কারণ, পরাগবহিষ্পবমানেন স্তুবন্তি এই শ্রুতিতে পরা শব্দ দ্বারা অভ্যাস প্রতিসিদ্ধ (নিবারিত) হইয়াছে। ফলতঃ, বিকৃতিস্থিত বহিষ্পবমান স্তোত্রের বৃদ্ধি করিতে সামান্তরের আগম হইবে না;ঋকের আগম হইবে। ইহাই সিদ্ধান্ত।

একটি সাম তৃচে গান করিতে হইবে-ষষ্ঠ পাদের প্রথম অধিকরণে তদ্বিষয় নিরূপিত হইয়াছে; যথা, সামৈস্যাং তৃচে বা স্যাৎ ইত্যাদি। প্রশ্ন হইতেছে, –অধ্যয়নকারিগণ পবমান আজ পৃষ্ঠ আদি স্তোত্র-সমূহে বিহিত যে রথস্তর বৃহৎ ও বৈরাজ প্রভৃতি সাম একটী ঋকে অধ্যয়ন করেন; সেই রথযুর প্রভৃতি সাম, স্তোত্র প্রয়োগের সময়েও কি একটী ঋকে গান করিতে হইবে? কিংবা তৎকালে তৃচে গান করিতে হইবে? এস্থলে ইহাই সংশয়। অনুষ্ঠানের নিমিত্ত অধ্যয়ন হইয়া থাকে। এই হেতু, যেরূপ একটি ঋকে সামের অধ্যয়ন করা হইয়াছে, সেইরূপ একটী ঋকে সাম গান করিতে হইবে। ইহা পূৰ্ব্বপক্ষ। আট অক্ষরে প্রথম ঋকের এবং দুই অক্ষরে দুই উত্তরা ঋকের স্তুতি করা হয়। এইরূপে প্রস্তাবক (ঋত্বি-বিশেষ) ঋয়ে গেয় অংশ নিরূপণ করিয়া থাকেন। ইহাই তৃচরূপ পদার্থ-প্রতিপাদক সামর্থ্য। ঋক্ সামেবাবমিথুনৌ সম্ভবাবঃ ইত্যাদি বাক্য ঋক্‌ দেবতা ও সাম-দেবতা এতদুভয়ের পরস্পর আলাপ-রূপ অর্থবাদ। সেই অর্থবাদে সাম-দেবতা একটী ঋক্‌কে এবং অপর দুইটী ঋক্‌কে প্রত্যাখ্যান করিয়া তিনটি ঋক্ স্বীকার করিয়াছেন। এই অর্থবাদ-বাক্য দ্বিতীয় তৃচ প্রতিপাদন-সামর্থ্য। উক্ত দুই সামর্থ্য কর্তৃক পরিপুষ্ট (প্রবল) একং সাম তৃচে গীয়তে স্তোত্রিয়ং এই বচন হেতু, একটি সাম তৃচে গীত হইবে। ইহাই (ষষ্ঠ পাদের প্রথম অধিকরণের সিদ্ধান্ত।

স্বর্দক শব্দ মীলন পৰ্য্যন্ত উচ্চারিত হইবে–দ্বিতীয় অধিকরণে তদ্বিষয় বিচারিত হইয়াছে; যথা, স্বক শব্দে বীক্ষণে চ কিংস্যাঙ্গাঙ্গিহথবা। ইত্যাদি। তাহার ব্যাখ্যা, রথযুর সামের উৎপাদিকা অভি দ্বা শূর  ঋকে, স্ব শব্দ–ঈশানমস্য জগতঃ স্বদৃশ এইরূপে উল্লিখিত হইয়াছে। এস্থলে উদ্গাতার তৃচ-কর্তৃত্ব আছে; কারণ, তৎসম্বন্ধে রথন্তরে প্রস্তুয়মানে সম্মীলয়েৎ ইত্যাদি শ্রুতি আছে। উক্ত বিষয় এই, — শব্দের উচ্চারণ ও বীক্ষণ এতদুভয়ের পরস্পর অঙ্গাঙ্গিভাব বিহিত হইতেছে অথবা স্ব শব্দের উচ্চারণ নির্দেশ করা হইতেছে? উক্ত সংশয়ে পূৰ্ব্বপক্ষবাদী বলেন–সম্মীলনবাক্য হইতে বীক্ষণ বাক্য ভিন্ন। সেইজন্য সম্মীলন পৰ্য্যন্ত স্ব শব্দের উচ্চারণ-সম্বন্ধ সম্ভবপর হয় না। পরন্তু রথন্তরে প্রস্তুয়মাণে ইত্যাদি বাক্যে বীক্ষেত এই লিপ্রত্যয় বিধিরূপে শ্রুত হইতেছে। সেই কারণে, স্বৰ্ক শব্দের উচ্চারণ বীক্ষণের অঙ্গ, অথবা বীক্ষণ তাহার অঙ্গ। এইরূপে স্ব শব্দের উচ্চারণ ও বীক্ষণ, এতদুভয়ের অঙ্গাঙ্গিভাব বুঝিতে হইবে। উক্ত প্রকারে অঙ্গাঙ্গিভাব স্থির হইলে, স্ব শব্দ রহিত ঋদ্বয়ে গীত রথন্তর সামেও সম্মীলনের অনুবৃত্তি ফলবতী হইবে। প্রতি, –এই বাক্যের অন্তর্গত কৰ্ম্ম-বিজ্ঞাপক প্রতি শব্দ মীলন-কাল পর্যন্ত স্বদৃশ শব্দের উচ্চারণ কর্তব্য তাহা প্রকাশ করিতেছে। এস্থলে বাক্যের বিভিন্নতা নাই। কারণ, এস্থলে একবাক্যতার সম্ভব আছে। কিরূপে একবাক্যতা সম্ভব হয়, অতঃপর তাহাই প্রদর্শিত হইতেছে। প্রমাণ না থাকিলেও বিরোধ পরিহারের নিমিত্ত বীক্ষণ উপপন্ন হইতেছে। এই হেতু, বীক্ষণের নিমিত্ত পৃথক্ বিধি করিতে হইবে না। তাহা হইলে, স্ব শব্দের উচ্চারণ পৰ্য্যন্ত সম্মীলন করিতে হইবে–এবম্বিধ একটী বাক্য প্রতিপন্ন হইতেছে। এইরূপে স্বর্দশ শব্দের সম্মীলন সিদ্ধ হওয়ায়, উত্তরা ঋকদ্বয়ে মীলন-বিধির অভাব প্রতিপন্ন হইবে। ইহাই সিদ্ধান্ত।

দিন-ভেদে বৃহৎ ও রথন্তর সামের প্রয়োগ হইবে, তৃতীয় অধিকরণে তদ্বিষয় নিরূপিত হইয়াছে। সেই তৃতীয় অধিকরণ এই, –গবাময়নিকে পৃষ্ঠায়ড়হে প্রত্যহং দ্বয়ং।  ইত্যাদি। তাহার ব্যাখ্যা, দ্বাদশাহ-যাগে ষড়হ (ছয় দিনে) পৃষ্ঠস্তোত্র উৎপন্ন হয়। সেই পৃষ্ঠস্তোত্রে, ছয় দিনের মধ্যে, ক্রমে রথন্তর, বৃহৎ, বৈরূপ, বৈরাজ, শাঙ্কর ও রৈবত নামক ছয়টী সাম বিহিত হইয়াছে। কিন্তু, গবাময়ন-যাগে বিকৃতিরূপ যে ষড়হ পৃষ্ঠ-স্তোত্র বিহীত হয়, তদ্বিষয়ে পৃষ্ঠাঃ ষড়হো বৃহদ্রথন্তর সাম–এইরূপ শ্রুতি আছে। উক্ত শ্রুতি দ্বারা বিকৃতি-রূপ ষড়হ পৃষ্ঠ-স্তোত্রে অতিদিষ্ট বৃহৎও রথন্তর সামদ্বয় পূনৰ্বার বিহিত হইয়াছে। এই হেতু, সেস্থলে বৈরূপাদি সাম চতুষ্টয়ের বিধান নাই। অনন্তর সংশয় হইতেছে, -অবশিষ্ট বৃহৎ ও রথস্তর সামদ্বয় প্রতিদিনই কর্তব্য, অথবা, কোনও দিন বৃহৎ সাম এবং কোনও দিন রথস্তর সাম বিধেয়? বৃহৎও রথন্তর এবং তদুভয়ের সম্মিলনে সংগঠিত বৃহদ্রথন্তর, পরে বৃহৎ ও রথন্তর সামদ্বয় যে দিন বিহিত হইয়াছে, সেই দিন ইতরেতর দ্বন্দ্বের দ্বারা বৃহৎ ও রথন্তর সামের সাহিত্য বা পরস্পর সম্বন্ধ উপলব্ধি হইতেছে। সুতরাং প্রতিদিন উক্ত সামদ্বয় গান করিতে হইবে, ইহাই পূৰ্ব্বপক্ষ। তে সামনী যস্যাএই ব্যাসবাক্যের দ্বারা দিবস পদে যদি অন্য পদার্থ উপলব্ধ হয়; তাহা হইলে তুমি যাহা বলিলে, তাহাই স্বীকার্য। কিন্তু এস্থলে ষড়হই পৃথক্ পদার্থ;–দিবস পৃথক পদার্থ নয়। তাহা হইলে, সিদ্ধান্ত-পক্ষেও ষড়হে বৃহৎ ও রথস্তর সামদ্বয়ের সাহিত্য বা সম্বন্ধ সমান। কারণ, প্রকৃতিরূপ দ্বাদশাহযাগে উক্ত সামদ্বয় পরস্পর নিরপেক্ষ। সুতরাং, বিকৃতিরূপ ষড়হযাগেও সামাতিদেশ বিধি দ্বারা উক্ত নিরপেক্ষতাই অতিদিষ্ট হইতেছে। এই সকল কারণে কোনও কোনও দিনে উক্ত সামদ্বয়ের মধ্যে যে কোনও একটী সাম বিহিত হইবে। এস্থলে ইহাই সিদ্ধান্ত।

অনন্তর চতুর্থ অধিকরণ কথিত হইতেছে; যথা, –সুরেকাদশিনা কিং প্রায়ণীয়োদয় নীয়য়োঃ ইত্যাদি। তাহার ব্যাখ্যা, -দ্বাদশাহ যাগে একাদশিনা প্রভৃতিশ্রুতি আছে; সেই শ্রুতির অর্থ–অতিরাত্র-যাগে এ বিহিত প্রায়ণীয় ও উদয়নীয় এই দুই অতিরাত্র যাগে একাদশিনা দ্বারা একাদশ পশু বধ করিবে। উক্ত! এ অতিরাত্রদ্বয়ের মধ্যে প্রায়ণীয় দিনে সেই একাদশ পশুবধই কর্তব্য; উদয়নীয় দিনের কর্তব্যও তদনুরূপ। কেন? কারণ, –উভয়ত্র উদ্দেশ্য অভিন্ন বলিয়া প্রায়ণীয় এবং উদয়নীয় প্রধান-মধ্যে গণ্য। সুতরাং প্রত্যেক প্রধান কৰ্ম্মে অঙ্গের আবৃত্তি হইবে। ইহাই যুক্তিসঙ্গত। পূৰ্ব্বপক্ষবাদীরও ইহাই অভিমত। বচনান্তরেও একাদশ সংখ্যক পশু বিহিত হইয়াছে; পরন্তু প্রকরণবশতঃ তাহারা যে দ্বাদশাহ যাগের অঙ্গ, ইহাও সিদ্ধ হইয়াছে। অতঃপর দেশাকাঙ্ক্ষায়, সেই সকল পশুকে উদ্দেশ করিয়া, প্রায়ণীয় উদয়নীয় দেশরূপে বিহিত হইয়া থাকে। এস্থলে প্রশ্ন হইতে পারে, –প্রায়ণীয় ও উদয়নীয়–এতদুভয়ে, কি কারণে উদ্দেশ্যত্ব, কেনই বা প্রাধান্য, আর কেনই বা পশুর আবৃত্তি হইবে? কারণ, সেস্থলে উদ্দেশ্যহৃদি স্বীকার নিষ্প্রয়োজন। সে পক্ষেও সিদ্ধান্ত হইতেছে। দেবদত্ত ও যজ্ঞদত্তের সম্বন্ধে এক শত বিধান কর বলিলে যেমন দেবদত্তের নিমিত্ত পঞ্চাশ এবং যজ্ঞদত্তের নিমিত্ত পঞ্চাশ, –এইরূপ বিভাগ হইয়া থাকে; সেইরূপ, প্রায়ণীয় দিনে পাঁচটী পশু ও উদয়নীয় দিনে পাঁচটী পশু এইরূপ বিভাগও যুক্তিসঙ্গত। আর শেষ অবশিষ্ট যে একটী পশু, তাহা অতি-নিকটবর্তী শেষ উদবসানীয় দিনে অনুষ্ঠিত হইবে। সিদ্ধান্তবাদীর ইহাই অভিমত।

 সৰ্ব্বপৃষ্ঠ-যুক্ত বিশ্বজিৎ যাগে, যথোক্ত দেশে, পৃষ্ঠস্তোত্ৰসমূহ বিহিত হইবে, –পঞ্চম অধিকরণে তাহা বিচারিত হইয়াছে। সেই অধিকরণ এই, –কিং সৰ্ব্বপৃষ্ঠে সৰ্বাণি ইত্যাদি। উক্ত অধিকরণের ব্যাখ্যাব্যপদেশে বিশ্বজিৎ সৰ্ব্বপৃষ্ঠঃপ্রভৃতি শ্রুতির অবতারণা করা হইয়াছে। ষড়হ-যাগে ছয় দিনে, যথাক্রমে রথম্ভর, বৃহৎ, বৈরূপ, বৈরাজ, শাঙ্কর এবং রৈবত এই ছয়টি সাম দ্বারা পৃষ্ঠস্তোত্র নিম্পাদিত হইয়া থাকে। সেই সমগ্র পৃষ্ঠ নিম্পাদক সাম যে বিশ্বজিৎযাগে বিদ্যমান থাকে, সেই বিশ্বজিৎযাগকে সৰ্ব্বপৃষ্ঠ বলে। উক্ত সৰ্ব্বপৃষ্ঠযাগে মাধ্যন্দিন-পবমান ও মৈত্রাবরুণ সামদ্বয়ের মধ্যভাগরূপ পৃষ্ঠস্তোত্রদেশে সমস্ত পৃষ্ঠ-সামের বিধান হইবে; অথবা বচনানুসারে দেশ ব্যবস্থা হইবে? এস্থলে ইহাই সংশয়। পৃষ্ঠ-কার্য্যের প্রতিপাদক পৃষ্ঠ শব্দ দ্বারা পৃষ্ঠ-দেশ পাওয়া যাইতেছে; তৎপরে বচন-দ্বারা বিশিষ্টদেশ ব্যবস্থাপিত হইতেছে। ঋষিগণ পবমানে রথন্তরং করোতি ইত্যাদি বচনের উল্লেখ করিয়া থাকেন। বচন ন্যায় (যুক্তি) অপেক্ষা প্রবল। সেই জন্য পবমানাদিরূপ দেশ-বিশেষের ব্যবস্থা হইয়াছে। ইহাই সিদ্ধান্ত।

বৈরূপ ও বৈরাজ সাম উকথ এবং ষোড়শিন কাৰ্য্যের পৃষ্ঠস্তোত্রে বিহিত হইবে, ষষ্ঠ অধিকরণের তাহাই বিচাৰ্য। সেই অধিকরণ এই, –কাস্না বৈরূপ বৈরাজে ইত্যাদি। তাহার ব্যাখ্যা ব্যপদেশে উথো বৈরূপ সামা ইত্যাদি শ্রুতি বাক্যের অবতারণা আছে। তাহার অর্থ এই, উথ নামক কৰ্ম্ম বৈরূপ সামযুক্ত এবং একবিংশস্তোমবিশিষ্ট বোড়শি নামক কৰ্ম্ম–বৈরাজ সামযুক্ত। যদি বল, –সমগ্র উথ কৰ্ম্মে বৈরূপ সাম কৰ্ত্তব্য, এবং সমগ্র ষোড়শিন্ কৰ্ম্মে বৈরাজ সাম যোজনা করিতে হইবে; তাহাও বলিতে পার না। কেননা, প্রকৃতিযাগে পৃষ্ঠস্তোত্র-বিষয়ে–রথন্তর সাম ও বৃহৎ সাম কৰ্ত্তব্য, এই প্রকার নির্দেশ দেখা যায়। সুতরাং উত্থাদিরূপ বিকৃতি যাগেও বৈরূপাদির নির্দেশরূপ পৃষ্ঠ-প্রতিপাদক সামর্থ্য দ্বারা, পৃষ্ঠকাৰ্যে বৈরূপ ও বৈরাজ সাম হইতে পারে। পৃষ্ঠ দ্বারা উক্ত সামদ্বয়ের যজ্ঞ-সম্বন্ধ উপপন্ন হয়। ইহাই সিদ্ধান্ত।

অগ্নিষ্ঠুৎ যাগে ত্রিবৃৎ শব্দ স্তোমবাচক হইবে। সপ্তম অধিকরণে তদ্বিষয় নির্ণীত হইয়াছে। সে অধিকরণ এই, –ত্রিবৃদগ্নিস্ফুদিত্যেতৎ ইত্যাদি। তাহার ব্যাখ্যা ব্যপদেশে ত্রিবৃদগ্নিষ্ট্রদগ্নিষ্টোমঃ ইত্যাদি শ্রুতি উল্লিখিত হইয়াছে। উক্ত ত্রিবৃৎ শব্দ অগ্নিষ্ঠুৎযাগে সমগ্র উপকরণেই সম্বন্ধযুক্ত হয়, কিম্বা কেবল স্তোমেই সম্বন্ধযুক্ত হইয়া থাকে, –এইরূপ প্রশ্নের অবতারণা হইয়াছে। ত্রিবৃৎ, রজ্জ্ব ইত্যাদি স্থলে দেখা যায় যে, ত্রিবৃৎ শব্দ ত্রৈগুণ্যবাচী। এই হেতু, অগ্নিষ্ঠুৎযাগে যজ্ঞের সাধক দ্রব্যাদিতে যে সংখ্যা শ্রুত হয়, ত্রিবৃৎ শব্দ সেই সমস্ত এ সংখ্যাকে ব্যক্ত করিতেছে। এইরূপ পূৰ্ব্বপক্ষের উত্তরে বলা যায়, যদিও ব্যবহার-প্রযুক্ত অবয়ব-প্রসিদ্ধি দ্বারা ত্রিবৃৎ শব্দ ত্রৈগুণ্যরূপ অর্থ বুঝাইতেছে; তথাপি বেদ-বিষয়ে রূঢ়ি (প্রসিদ্ধি) দ্বারা বিবৃৎ শব্দ স্তোর্মবাচকই হইবে। কারণ, ত্রিবৃদধ্বহিষ্পবমানঃ বাক্যের পরে, নয়টি স্তোত্রীয় ঋকের ক্রমানুসারে, ত্রিবৃৎ শব্দ স্ত্রোমবাচক হইয়া থাকে, –এইরূপ কথিত হইয়াছে। ইহাই এতদধিকরণের সিদ্ধান্ত।

সংসব প্রভৃতি যাগে পৃষ্ঠ-কৰ্ম্ম হইবে–অষ্টম অধিকরণে তাহা মীমাংসিত হইয়াছে। সংসবাদৌ দ্বয়োরেকং ইত্যাদি। তাহার ব্যাখ্যা, শ্রুতিতে আছে, সংসব যাগে, গোসব যাগে এবং অভিজিৎ নামক একাহযাগে, বৃহৎও রথন্তরউভয়বিধ সাম বিহিত করিবে। উক্ত সংসবাদিতে, বৃহৎও রথন্তর সামদ্বয়ের মধ্যে, একটী পৃষ্ঠস্তোত্রে এবং অপরটি অন্য স্তোত্রে বিহিত হইবে, অথবা পৃষ্ঠস্তোত্রেই উক্ত সামদ্বয় সমুচ্চিত হইবে?–পূৰ্ব্বপক্ষবাদী এইরূপ সংশয়ের অবতারণা করেন। প্রকৃতি-যাগে উক্ত সামদ্বয়ের বিকল্প-বিধান-হেতু, একটী প্রয়োগে (অনুষ্ঠানে) সামদ্বয়ের মধ্যে একের পৃষ্ঠত্ব হয়। এই কারণে অন্য স্থলেও (বিকৃতি-যাগে) উক্ত প্রকার প্রয়োগ হওয়া যুক্তিসঙ্গত। তাহা হইলে, অবশিষ্ট সাম সৰ্ব্বপৃষ্ঠ নামক বিশ্বজিৎ-যাগের যুক্তি অনুসারে অন্য স্তোত্রে প্রযুক্ত হইবে। ইহাই পূৰ্বপক্ষ। কিন্তু অন্য স্তোত্রে প্রয়োগ-বিধায়ক কোনও বচন নাই। এই হেতু, সংসবাদি-যাগে বিশ্বজিৎ-সম্বন্ধীয় যুক্তির বৈষম্য হইতেছে। প্রকৃতি-যাগের ন্যায় বিকল্প বিধান হইলে পুনৰ্ব্বার বিধান ব্যর্থ হয়। এই সমস্ত কারণে উক্ত সামদ্বয়ের সমুচ্চয় হইবে; ইহাই এতদধিকরণের সিদ্ধান্ত।

বৃহৎ, যব ও খাদির শব্দ তত্তস্থলে নিয়মিত থাকিবে–সপ্তম অধ্যায়ের ষষ্ঠ অধিকরণে তাহা নির্ণীত হইয়াছে; যথা, –বৃহদ্যবখাদিরাশ্চ বিকল্প্যা নিয়তা উত ইত্যাদি। তাহার ব্যাখ্যা, বিশেষ বিশেষ বিকৃতি যাগে বৃহৎ-পৃষ্ঠ হইবে, –এইরূপ শ্রুতি আছে। ত্রৈধাতবীয় যাগ বিষয়ে যবময়োমধ্যঃ এই শ্রুতি দৃষ্ট হয়; এবং বাজপেয় যাগে খাদির ঘূপ হইবে ইত্যাকার শ্রুতি আছে। উক্ত বিষয়ে যদি বল, বৃহৎ ও রথস্তর, ব্রীহি ও যব এবং খাদির ও বৈন্য প্রভৃতি তত্তৎ-সম্বন্ধী প্রকৃতিযাগে বিকল্পিত হইয়াছে বলিয়া, উক্ত বিকৃতি-যাগাদি স্থলেও অতিদেশ বিধি দ্বারা বৃহৎ প্রকৃতি শব্দ বিকল্পে বিহিত হইবে। কিন্তু তাহাও বলিতে পার না। কারণ, পুনৰ্ব্বার সে ক্ষেত্রে বৃহৎ প্রভৃতির বিধান করা ব্যর্থ হয়। দোষযুক্ত বলিয়া পরিসংখ্যাও বিধান করা যায় না। সেই জন্য বৃহৎ ও রথযুর প্রভৃতি সাম তত্তস্থলে নিয়মিত হইবে। এতদধিকরণে ইহাই সিদ্ধান্ত।

বিপ্র কর্তৃক সামগান বিকল্পে বিহিত হইয়া থাকে–ইহাই অষ্টম-পাদের ষষ্ঠ অধিকরণে বিচারিত হইয়াছে। সে অধিকরণ এই, –উন্নেয়ো ব্রহ্মগানস্য নিষেধধা বিহিত স্তুতিঃ ইত্যাদি। তাহার ব্যাখ্যা-বহ্নিস্থাপনে বামদেব্যাদি সাম-সমূহের গান বিহিত হইয়াছে। উক্ত বহ্নিস্থাপন-বিষয়েই অপর একটী শ্রুতি আছে; যথা, উপবীতা বা এতস্যাগ্নয়ো ভবন্তি ইত্যাদি। উপ শব্দ সামীপ্যরূপ অর্থ বুঝাইতেছে। কালবিলম্ব না করিয়া (অতি সত্বর) অন্য কর্তৃক যে অগ্নিগণ পরিত্যক্ত হয়, –উপবীতাঃ পদে এই অর্থ উপলব্ধ হয়। উক্ত শ্রুতির বিবৃত এই, –যাগের অগ্ন্যাধেয় কর্মে ব্ৰহ্ম সাম গান করা হয়, সেই যাগের অগ্নি-সকলকে ঋত্বি ভিন্ন অপর লোক অবিলম্বে ত্যাগ করেইত্যাদি। এই নিন্দাহেতু ব্রহ্মার (ঋত্বি-বিশেষের) সামগান নিষিদ্ধ বলিয়া অনুমিত হইতেছে। সেই নিষেধ বিধি দ্বারা উদগাতার সম্বন্ধে বিহিত বামদেব্যাদি সাম-গানের প্রশংসা অধ্যাহৃত হইতেছে। এ ক্ষেত্রেও সংশয় হইতেছে। কারণ, সে স্থলে ব্রহ্মার সাম গান প্রসঙ্গই নাই, সুতরাং তাহার নিষেধ করা নিতান্ত অসম্ভব; এই জন্য উক্ত নিষেধ শশকশৃঙ্গের ন্যায় শূন্য। বন্ধ্যার পুত্র অথবা বন্ধ্যাপুত্রের নাশ, এতদুভয়ের সম্ভাবনা যেমন করিতে পারা যায় না; সেইরূপ অপ্রাপ্ত বিষয়ের নিষেধও সম্ভবপর হইতে পারে এই না। উক্ত আশঙ্কায়, বপার উৎখেদের ন্যায় এস্থলে নিষেধের সম্ভাবনা আছে বলিতে পারি। স আত্মনো বপামুদখিদৎ–এই অত্যন্ত অসম্ভব অর্থযুক্ত বাক্য দ্বারা যেরূপ মৃত প্রাজাপত্যছাগ-পশুর বিধি শ্রুত হইয়াছে, সেইরূপ এস্থলে নিষেধ সম্ভবপর হইতে পারে। এইরূপ পূৰ্ব্বপক্ষ প্রাপ্ত হইলে, তদুত্তরে বলা হইতেছে, উপবীতা বা এতস্য, এই শ্রুতি বাক্য বামদেব্য প্রভৃতি সমগ্র সামবিধির প্রশংসা সূচক হইতে পারে না; কারণ, বিধি অনেক এবং তাহা স্ব-স্ব-সন্নিধিস্থলে পঠিত হয়। অর্থবাদের দ্বারা আকাঙক্ষার নিবৃত্তি হইতেছে বলিয়া বিধিসমূহের সহিত উক্ত বাক্যের সম্বন্ধ হয় না। তাহা হইলে উক্ত বাক্যের গতি কি হইবে? এই প্রশ্নের উত্তরে উপবীতাবৈ ইত্যাদি প্রমাণ-বাক্য উল্লিখিত হইয়াছে। উক্ত বাক্যে যে ব্রহ্মন্ শব্দ আছে, তাহা বিপ্রত্ব জাতি দ্বারা উদ্গতাকে বুঝাইতেছে। যাহার গান হইবে, তাহারই নিষেধ করিবে। এই বিষয়ে প্রযুক্ত বিধি ও নিষেধ দ্বারা উদগাতার গান বিকল্পে বিহিত হইতেছে। ইহাই সিদ্ধান্ত।

একাদশ অধ্যায়ের দ্বিতীয় পদে দ্বাদশ অধিকরণে ব্রহ্ম-সাম-বিষয়ক উৎকর্ষ নিরূপিত হইয়াছে ; যথা, পৰ্য্যাগ্নিকরণে ত্যাগ আলম্ভো ব্ৰহ্মসামনি ইত্যাদি। তাহার ব্যাখ্যা ; যথা, —“বাজপেয়-যাগে সপ্তম-সংখ্যক প্রাজাপত্য পশু সঞ্চয় করিবে, এইরূপ আরম্ভ করিয়া শ্রুত হইয়াছে, —“তান্ পৰ্য্যাগ্নিকৃতানুসৃজতি ইতি এবং “ব্রহ্মসালভতে ইতি। উক্ত সপ্তদশ পশুতে অগ্নিসংস্কার করা হইলে, উত্তরকালে যে কৰ্ম্মের শেষ হইবে, উৎসর্গ শব্দে তাহা নিষিদ্ধ হইতেছে। অশ্বমেধ যাগে অগ্নিসংস্কৃত অরণ্যে (বনজাত) পশুসমূহকে উৎসর্গ করিবে-এই শ্রুতিতে কৰ্ম্ম সমাপ্তির নিষেধ প্রতিপন্ন হইয়াছে। সুতরাং, এই বাজপেয়-যাগেও উক্ত প্রকারে অগ্নিসংস্কার করা পর্যন্ত সপ্তদশ-পশু সম্বন্ধীয় কাৰ্য্য সমাপন করিতে হইবে। আঙু পূৰ্ব্বক লভ ধাতু দ্বারা ব্ৰহ্ম সামের সময় কৰ্ম্মান্তর কর্তব্য, এইরূপ প্রতীতি হইতেছে। এই প্রকারে পূৰ্ব্বপক্ষ প্রাপ্ত হইলে, তদুত্তর বলিতেছি, কৰ্ম্মান্তর-বিধিপক্ষে সপ্তদশ-পশু-জন্য অদৃষ্ট ফল হইতে ভিন্ন কোনও দৃষ্টফল কল্পনা করিতে হইবে; নচেৎ, তাহাতে বাক্যভেদরূপ দোষ প্রাপ্ত হইবে। ব্রহ্ম-সাম্নলভতে এই বাক্যে দ্রব্য বা দেবতা শ্রুত হয় নাই। এইজন্য ঐ বাক্য কৰ্ম্মান্তর প্রতিপাদক বিধি হইতে পারে না। উক্ত কারণে, অগ্নি-সংস্কারকরণানন্তর যে কর্তব্য অর্থাৎ সপ্তদশ পশুদিগের আলভন (বধ) প্রভৃতি সমাপন, ব্রহ্ম-সামকালে তাহার উৎকর্ষ বিহিত হইতেছে। উৎসর্গ শব্দ দ্বারা এবম্বিধ সিদ্ধান্ত হইলে, অর্থাধীন-প্রাপ্ত যে পৰ্য্যগ্নিকরণান্তর ভবিষ্যৎ কর্ম ব্যাপারের অবসান, তাহারই অনুবাদ (পুনরুল্লেখ) করা হইতেছে। এস্থলে ইহাই সিদ্ধান্ত।

মন্ত্রের লক্ষণ হইতে ব্রহ্মসামের উৎকর্ষ পৰ্য্যন্ত পূৰ্ব্বমীমাংসাস্থিত দ্বিষষ্টি (৬২) সংখ্যক অধিকরণ দ্বারা যজ্ঞসমূহে সামরেদের উপকারিতা বিশদরূপে প্রকাশ করা হইয়াছে। এই হেতু প্রয়ােজনীয় বলিয়া ঋগ্বেদাদির ন্যায় সামবেদের ব্যাখ্যা অবশ্য কর্তব্য। উক্ত বিষয়ে যদি কেহ আপত্তি উত্থাপন করিয়া বলেন, এই সামবেদে যে ব্রাহ্মণ-ভাগ আছে, তাহার ব্যাখ্যা হইতে পারে সত্য ; কিন্তু মন্ত্র-ভাগের ব্যাখ্যা করা যায় না। কারণ, সামবেদীয় মন্ত্র-সমূহ গীতি স্বরূপ। গীতি পদ বাকরহিত ও স্তোভ প্রভৃতি দ্বারা নিষ্পন্ন হইয়া থাকে। সুতরাং ক্রিয়া ও কারকের যােজনা দ্বারা তাহাতে এমন কোনও অর্থ ব্যক্ত হয় না, যে অর্থ ব্যক্ত করিবার নিমিত্ত আপনি গীতির ব্যাখ্যা করিবেন। কিন্তু স্বরাদিরূপ বিশেষের উল্লেখ দ্বারা যে গীতির ব্যাখ্যা হইয়াছে, সেই ব্যাখ্যা প্রাচীন পণ্ডিতগণ কর্তৃকই সেই সেই মন্ত্র গ্রহণ-বিষয়ে নিম্পাদিত হইয়াছে; সুতরাং উক্ত গীতি ব্যাখ্যা বিষয়ে আপনার যত্ন করিতে হইবে না। অতএব, মন্ত্রভাগের ব্যাখ্যা করা নিষ্প্রয়ােজন? এই আপত্তির উত্তরে বলা যাইতেছে ; যথা, —গীতি.আশ্রয়রহিত নহে; কারণ, উক্ত গীতি ঋকের আশ্রিত। এই জন্যই সামগায়কগণ উপনিষদে বলিয়া থাকেন, “তস্মাদ ঋচ্যধঢ়ং সামগীয়তে, ইতি। তাহার অর্থ—তৎপূরে ঋকে অধিরূঢ় সাম গান করা হয়। গীতির আশ্রয়-স্বরূপ সেই ঋকেও মন্ত্র বলা হয়। কারণ, মন্ত্র, বিশেষাকারে, “তেষামৃগ্যত্ৰাৰ্থবশেন পাদব্যবস্থা এইরূপ সুত্রিত হইয়াছে। পরন্তু ঋণাত্মক মন্ত্রের ক্রিয়া ও কারকের অন্বয় দ্বারা প্রকাশ্য অর্থ আছে। সেই মন্ত্ৰার্থ যজ্ঞানুষ্ঠানকালে স্মরণ করিতে হইবে। অতএব ঋকের ব্যাখ্যা অবশ্য কর্তব্য। মন্ত্র দ্বারা অর্থের (প্রয়োজনীয় পদার্থের) স্মরণ হইয়া থাকে। তদ্বিষয় প্রথম অধ্যায়ের দ্বিতীয় পদে চতুর্থ অধিকরণে নির্ণীত হইয়াছে; যথা, মন্ত্ৰা উরুপ্রথস্বেতি কিমদৃষ্টেক হেতবঃ।  ইত্যাদি। তাহার ব্যাখ্যা, –উরুথস্ব এইরূপ কোনও একটি মন্ত্র আছে। তাহার অর্থ এই, –হে পুরোডাশ! যে প্রকারে প্রাচুর্য্য হয়, সেই প্রকারে তুমি বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হও। উরুথস্ব ইত্যাদি মন্ত্ৰসমূহ যাগানুষ্ঠানকালে উচ্চারিত হইয়া অদৃষ্ট উৎপাদন করে; কেবল অর্থ প্রকাশের নিমিত্ত, মন্ত্রসমূহের উচ্চারণ করা হয় না; কারণ, –পুরোডাশ দ্রব্যের প্রথন (বন্ধন) রূপ মন্ত্ৰাৰ্থ ব্রাহ্মণ বাক্য দ্বারাও পাওয়া গিয়াছে; (উরু প্রথস্বেতি পুরোশং প্ৰথয়তি ইহাই ব্রাহ্মণ বাক্য); ইহা যুক্তিযুক্ত নহে, কারণ– অর্থ জ্ঞাপনরূপ প্রত্যক্ষ প্রয়োজন সম্ভবপর হইলে কেবল অদৃষ্টমাত্রের কল্পনা করিতে পারা যায় না। উক্ত কারণে যাগানুষ্ঠানে মন্ত্রোচ্চারণের একমাত্র দৃশ্যমান (প্রত্যক্ষ) অর্থ স্মরণই প্রয়োজন। আর যেস্থলে ব্রাহ্মণ বাক্য দ্বারা অর্থ স্মরণের সম্ভব, অথচ মন্ত্রেনৈবানুস্মরণীয় (মন্ত্রের দ্বারাই (অর্থ) স্মরণ করিতে হইবে), এইরূপ যে নিয়ম আছে; সেই স্থলে উক্ত নিয়মের দৃষ্ট প্রয়োজনের অসম্ভব হেতু অদৃষ্টই প্রয়োজন হউক।

এই চতুর্থ অধিকরণেই মতান্তরে পূর্ব পক্ষ ও উত্তর পক্ষ কথিত হইতেছে; মন্ত্র ব্রাহ্মণয়োর্যদ্বা কলহো বিনিযোজনে ইত্যাদি। তাহার ব্যাখ্যা, এই (উরুথস্ব) মন্ত্রের লিঙ্গ (পদার্থ শক্তি) দ্বারা বিনিয়োগ হইলে, ব্রাহ্মণ বাক্যের অর্থ বিবক্ষিত হয় না; এবং বাক্য দ্বারা বিনিয়োগ হইলে মন্ত্র-লিঙ্গ বিবক্ষিত হইবে না; এইরূপ উভয়ের বিরোধ হেতু প্রেরণার (বিধি বাক্যের) প্রামাণ্য নাই; ইহাই পূৰ্ব্ব পক্ষ। ইহা বিরোধ নহে; কারণ– অপেক্ষা প্রবল মন্ত্র লিঙ্গ অনুসারে বিনিয়োগ সিদ্ধ হইলে পর ব্রাহ্মণ বাক্য উক্ত বিনিয়োগের অনুবাদক হইয়াছে, ইহাই সিদ্ধান্ত। অর্থ স্মরণের নিমিত্ত ব্যাখ্যার যোগ্য যে সকল সামের উৎপাদিকা ঋক্ ছন্দঃ নামক সংহিতা .. পুস্তকে উল্লিখিত হইয়াছে, সেই সমস্ত ঋক্, উল্লেখক্রমে এই সামবেদে ব্যাখ্যাত হইতেছে। উক্ত ঋক্ সকলের স্বাধীনভাবে সমুদয় যজ্ঞে বিনিয়োগ হয় না, কারণ, ব্রাহ্মণ (অর্থবাদ) বাক্য এবং সূত্র. (মন্ত্র বাক্য) দ্বারা বিনিযুক্ত সাম সমূহের আশ্রয়রূপে সেই ঋ সকলের উপকারিতা আছে। উক্ত কারণে ঋগবেদব্যাখ্যায় যেরূপ বিনিয়োগ বিশেষরূপে অন্বেষণ করিতে হয় না, সেইরূপ সামবেদ ব্যাখ্যায় বিশেষ বিনিয়োগ অন্বেষণ করিতে হইবে না। যদিও সামান্য বিনিয়োগ ব্ৰহ্মযজ্ঞ বিষয়ে উল্লিখিত আছে; তথাপি ঐ সামান্য বিনিয়োগ সমস্ত বেদের পক্ষে একই, –এই হেতু অন্বেষণের নিমিত্ত চেষ্টাও নাই। তাহা হইলে ঋক্ মন্ত্রসমূহের ঋষি, ছন্দঃ ও দেবতা জ্ঞাত হওয়া উচিত, অন্যথাতে প্রত্যবায় হইতে পারে। সামগায়কগণ বলিয়া থাকেন, -মন্ত্রের ঋষি, ছন্দঃ ও দেবতা জানেন না এরূপ ব্রাহ্মণ দ্বারা যিনি যাগ অথবা বেদাধ্যয়ন করান; সেই যজমান স্থানু-(পত্রাদিশূন্য বৃক্ষ) ভাব প্রাপ্ত হন এবং মরিয়া গর্ত নামক নরকে যান, আর মহাপাপগ্রস্ত হন। উক্তরূপে যে বেদ পাঠ করে, তাহার বেদ সকল জাতযাম জরাগ্রস্ত, হীনবীৰ্য্য হইয়া থাকে। আর যিনি মন্ত্রের ঋষি, ছন্দঃ, ও দেবতা অবগত আছেন, তিনি পূর্ণ আয়ুঃ প্রাপ্ত হয়েন, মঙ্গলযুক্ত হয়েন এবং তাহার বেদ সকল পূর্ণবীৰ্য্য, সমগ্ৰ ফলদানে সমর্থ হইয়া থাকে; অতএব ঋষি ছন্দুঃ ও দেবতা এই কয়টী প্রত্যেক মন্ত্রে অবগত হইবে ইতি। ঋষি প্রভৃতি অবশ্য জ্ঞাতব্য, এইরূপ স্থির হইলে বচ (ঋগ্বেদজ্ঞ)গণও সেই সকল ঋকের ক্রম বিপৰ্যয় করিয়া পাঠ করিয়া থাকেন। এই সামবেদ মন্ত্রসমূহেও সেই ঋগ্বেদীয় অনুক্রমণিকায় কথিত ঋষি ছন্দঃ ও দেবতার অনুসন্ধান দ্বারা বুঝিতে হইবে।

সায়নাচাৰ্য্যকৃত সামবেদ ভাষ্যানুক্রমণিকা সমাপ্ত।

ওঁ তৎসৎ।

—- —-

3 Comments
Collapse Comments

সমৃদ্ধ হলাম।

অশেষ ধন্যবাদ।

নমস্কার আমি জিতয় কুমার শর্মা । আমি একজন গর্বিত সনাতন।। আমি আমার ধর্ম সম্পর্কে জানতে ইচ্ছুক।। তো এখন আমি বেদ অধ্যয়ন করতে চায়। কিন্তু আমি কিভাবে শুরু করব তা বুঝতেছি না।। আপনারা আমাকে একটু সাহায্য করলে অনেক উপকৃত হতাম।।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *