দুর্ব্বৃত্ত জাতি বিষয়ে
বইটি প্রকাশিত হয়েছিল উনিশ শো ষোলো খ্রিস্টাব্দে, এখন দুই হাজার একুশ–এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে এর তথ্য ও বিবরণ অন্য কোথাও আলোচিত না-হওয়ায় শতাব্দপ্রাচীন এই বইয়ের গুরুত্ব বহুগুণ বেড়েছে। এমনিতে ঔপনিবেশিক শাসকেরা সাধারণত যা করে থাকেন, এখানেও তাই করেছেন–শাসনকাজের সুবিধার কথা ভেবে ব্যবহারিক কারণেই লিখেছেন বইটি। বইয়ের নাম ‘বাঙ্গালাদেশে যে সকল দুর্ব্বৃত্ত জাতি চুরি ডাকাইতি প্রভৃতি করে তাহাদের সম্বন্ধে পুস্তক’, লেখক বাঙ্গালা পুলিশের ডেপুটি ইন্সপেক্টর-জেনেরাল এ, সি, ডালি, সি, আই, ই, আর মুদ্রক কলকাতা ‘বেঙ্গল সেক্রেটারীয়েট যন্ত্রালয়’। এ-ধরনের অন্যান্য বই প্রকাশের অভিজ্ঞতা থেকে আন্দাজ করি, এটি দাপ্তরিক প্রয়োজনে অল্পসংখ্যক বের হয়েছিল,(১) যে-কারণে বহুল প্রচারের কোনো সুযোগই আর তৈরি হয়নি।
বইয়ের শুরুতে ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসের একুশ তারিখে লিখিত ভূমিকায় এফ, সি, ডালি জানিয়েছিলেন, বাংলার অধিবাসী এবং অন্য প্রদেশ-থেকে-আসা লোকদের মধ্যে যারা চুরি-ডাকাতি করে তাদের কার্যপ্রণালী সম্পর্কে পুলিশ কর্মচারীদেরকে শিক্ষা দেওয়াই এই বই লেখার উদ্দেশ্য। আরও লিখেছিলেন :
“কাৰ্য্যক্ষেত্রে পুলিশ কর্মচারিগণকর্ত্তৃক ব্যবহারের জন্য এই পুস্তক লিখিত হওয়ায় ইহাতে দুধৃত্ত জাতিদিগের উৎপত্তি বা জাতিতত্ত্ব সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনা করা প্রয়োজন মনে হয় নাই। আশা করা যায় যে, কাৰ্য্যক্ষেত্রে যে সকল বিষয় জানা আবশ্যক হয় এই পুস্তকে কেবলমাত্র সেই সকল বিষয়ের আলোচনা থাকায় পুলিশ কর্মচারিগণ এই পুস্তক আগ্রহ করিয়া পড়িবেন, বুঝিবেন ও মনে রাখিবেন।”
স্পষ্ট বোঝা যায়, কাজের ক্ষেত্রে যে-সকল বিষয় জানা দরকার, আরও স্পষ্টভাবে বললে, এদেরকে চিনে, ধরে, শায়েস্তা করার জন্য যা যা দরকার, তারই জন্য তথ্য লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, কোনো জাতির উৎপত্তি বা জাতিতত্ত্ব সম্বন্ধে সবিস্তার বিবরণ প্রকাশ করা এ-বইয়ের লক্ষ্য নয়।
বইটি বাজারজাত করার লক্ষ্যে বের হলে, বা কোনোভাবে বাজারে এলে, যেকোনো পাঠকের মনে নিম্নোক্ত প্রশ্নগুলো জাগত :
১. এ-বইয়ে যাদেরকে ‘দুর্ব্বৃত্ত’ বলা হচ্ছে, তা সংগত কি না;
২. এরা কি জাতি, না পেশাজীবী?
৩. তারা যে এইসব অপরাধের/পেশার সঙ্গে নিজেদের জড়িয়েছে বা জড়াতে বাধ্য হয়েছে, এর নেপথ্যের সামাজিক কারণগুলো কী?
৪. পরিচয় জানতে চাইলে এদের অনেকেই তথ্য গোপন রাখতে চায় কেন?
এইসব প্রশ্নের উত্তর কোনো ঔপনিবেশিক শাসক, লেখক বা তথ্যসংগ্রাহকের কাছে পাওয়ার কথা নয়, এর উত্তর দিতে গেলে এর দায়টা যে নিজেদের ঘাড়ে নিতে হবে এর সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ তো উনিশ শো চল্লিশ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথই দিয়ে গিয়েছিলেন। ‘পল্লীসেবা’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, নিজে শহরবাসী হলেও ইংল্যান্ডের কোনো এক গ্রামে এক গেরস্ত চাষির ঘরে তিনি কিছুসময় থেকেছিলেন, কিন্তু সেখানে তাঁর থাকতে কোনো অসুবিধা হয়নি; তবু তিনি খেয়াল করেছিলেন সুযোগসুবিধা থাকা সত্ত্বেও গ্রামের চাষিরা শহরে চলে যেতে আগ্রহী এবং গ্রামে থাকার কারণে তারা নিজেদেরকে ‘বঞ্চিত’ও মনে করে। রবীন্দ্রনাথ তাদেরকে জিজ্ঞেস করে এর কারণ জেনেছিলেন–ইউরোপের শহর আর গ্রামের মধ্যে যে-ব্যবধান রয়েছে, তা পরিমাণগত, অর্থাৎ শহরে যা বহুল পরিমাণে পাওয়া যায়, গ্রামে সেরকম পাওয়া যায় না। যা বলবার জন্য রবীন্দ্রনাথ এ-অভিজ্ঞতার কথা লিখেছিলেন এখানে তা সরাসরি পড়ে নিতে পারি :
“একদিন আমাদের দেশের যা-কিছু ঐশ্বর্য, যা প্রয়োজনীয়, সবই বিস্তৃত ছিল গ্রামে গ্রামে–শিক্ষার জন্য, আরোগ্যের জন্য, শহরের কলেজে হাসপাতালে ছুটতে হত না। শিক্ষার যা আয়োজন আমাদের তখন ছিল তা গ্রামে গ্রামে শিক্ষালয়ের মধ্যে বিস্তৃত ছিল। সংস্কৃতিসম্পদ যা ছিল তা সমস্ত দেশের মনোভূমিকে নিয়ত উর্বরা করেছে–পল্লী ও শহরের মাঝখানে এমন কোনো বাধা ছিল না, শিক্ষা আনন্দ সংস্কৃতির ঐক্যটি সমস্ত দেশে সর্বত্র প্রসারিত ছিল।
ইংরেজরা যখন এ দেশে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করলে তখন দেশের মধ্যে এক অদ্ভুত অস্বাভাবিক ভাগের সৃষ্টি হল। ইংরেজের কাজ-কারবার বিশেষ বিশেষ কেন্দ্রে সংহত হতে লাগল, ভাগ্যবান কৃতীর দল সেখানে জমা হতে লাগল। সেই ভাগেরই ফল আমরা দেখছি। পল্লীবাসীরা আছে সুদূর মধ্যযুগে, আর নগরবাসীরা আছে বিংশ শতাব্দীতে। দুয়ের মধ্যে ভাবের কোনো ঐক্য নেই, মিলনের কোনো ক্ষেত্র নেই, দুয়ের মধ্যে এক বিরাট বিচ্ছেদ।”(২)
সুযোগসুবিধা পাওয়া সত্ত্বেও শুধুই পরিমাণগত ব্যবধানের কারণে যেখানে ইংল্যান্ডের গেরস্ত চাষিরা শহরে চলে যেতে উদগ্রীব, সেখানে আমাদের দেশের ভগ্ন গ্রামসমাজের সুযোগসুবিধাহীন অধিবাসীরা কি স্থির থাকতে পারবে? কার্ল মার্কস লক্ষ করেছিলেন, ইংরেজদের অবাধ বাণিজ্যের ফলে কীভাবে গ্রামের ছোটো ছোটো সংস্থাগুলো ভেঙে অদৃশ্য হয়ে গেছে। যেসব পরিবার হাতে-কাটা সূতা, হাতে-বোনা কাপড় আর হাতে-করা ‘চাষের এক বিশিষ্ট সমন্বয়ের কুটির শিল্প’ থেকে আত্মনির্ভরতার শক্তি পেত তা তারা ধ্বংস করেছে; তাদের হস্তক্ষেপে তাঁতির স্থান বাংলায় আর সূতাকাটুনির স্থান ল্যাঙ্কশায়ারে, এই ভাবে সূতাকাটুনি আর তাঁতিদের নিশ্চিহ্ন করেছে।(৩) উইলিয়াম হান্টার তার The Annuls of Rural Bengal গ্রন্থে লিখেছিলেন, যে-সকল ব্রিটিশ ভারতের ইতিহাস লিখেছেন তারা ১৭৬৯ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে প্রধানত কোম্পানির উত্থান-পতন ও তাদের সামরিক বিজয়ের মধ্যেই তাদের বিষয়বস্তু সীমাবদ্ধ। রেখেছেন। এ-বিষয়ে দুর্ভিক্ষ কমিশনাররাও বিস্তারিত বিবরণ দিতে অক্ষমতা প্রকাশ করেছিলেন, এমনকি নিখুঁত ও সবিস্তার বিবরণপ্রদানের জন্য খ্যাত মিলও এ-প্রসঙ্গে মাত্র পাঁচটি পঙক্তি ব্যয় করেছিলেন, অথচ স্থানীয় নথিপত্রে তার আশ্চর্যজনক বিবরণ লিপিবদ্ধ ছিল। এইসব নথিপত্র ঘেঁটে উইলিয়াম হান্টার লিখেছিলেন, পুরোনো রীতিনীতি সহসা অচল হয়ে পড়ায় একটি প্রাচীন পল্লীসমাজে যে দুর্দশা দেখা দিয়েছিল, এই দলিল দস্তাবেজে তার বিবরণ রয়েছে, এছাড়া একটি খণ্ড-ছিন্ন ব্যবস্থার মধ্য থেকে কেমনভাবে একটি নতুন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল, তার ব্যাখ্যাও এখানে পাওয়া যায়।(৪) ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দের সেই দুর্ভিক্ষ বিষয়ে সবচেয়ে মর্মান্তিক বেসরকারি বিবরণ রয়েছে জন শোর-এর লেখা একটি কবিতায়। বিবরণ বেসরকারি বটে, কিন্তু ব্রিটিশ নাগরিকেরা প্রাচ্যের যেসব উচ্চপদের প্রত্যাশী ছিলেন, জন শোর ছিলেন সেই রকম পদে অধিষ্ঠিত; হান্টারের ভাষায়, একজন সৎ সিভিলিয়ান, কোনোকিছুতে অতিরঞ্জন একদমই বরদাস্ত করতেন না; তিনি ছিলেন সংবেদনশীল, দুর্ভিক্ষ-প্রতিরোধে চেষ্টাকারী এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বিষয়ে লর্ড কর্নওয়ালিশের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণকারী ঐতিহাসিক ব্যক্তি। কিন্তু শেষপর্যন্ত দেশ যে প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়েছিল, চল্লিশ বছর পরে সেইসব স্মৃতি-বয়ে বেড়ানো জন শোর যে-কবিতাটি লিখে ভারমুক্ত হতে চেয়েছিলেন, সেটিই ছিল ১৭৬৯-১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষের একমাত্র বেসরকারি বিবরণ :
যে দৃশ্য আমি দেখেছি তা আমার স্মৃতির চোখে
এখনো সজীব রয়েছে,
সেই কৃশ দেহ, গর্তে-বসে যাওয়া চোখ,
আর প্রাণহীন মর্মান্তিক ক্রন্দন;
মায়ের আর্তনাদ, শিশুর শোকাকুল কান্না,
হতাশা আর যন্ত্রণার চিৎকার
আমি এখনো শুনতে পাচ্ছি।
এই বর্বর দুর্যোগে
মৃতের পাশে পড়ে আছে মৃতপ্রায়;
ঐ শোনো শিয়াল ডাকছে,
শকুনি চিৎকার করছে;
দিন-দুপুরেই তারা মরা আর
মৃতপ্রায় মানুষ নিয়ে
টানা-হেঁচড়া আর কাড়াকাড়ি করছে;
তাদের বাধা দেওয়ার মতো
কেউ আর নেই,
মৃতের সঙ্গে মৃতপ্রায় মানুষও
আজ তাদের শিকার!
এই ভয়াবহ ভীতিপ্রদ দৃশ্য
কোনো লেখনীই
বর্ণনা করতে পারে না;
বছরের পর বছর
অতিবাহিত হয়ে গেলেও
স্মৃতির পাতা থেকে
মুছে যায় না।(৫)
জন শোরের এমন মর্মান্তিক কবিতার উপস্থাপক উইলিয়াম হান্টার এই দুর্ভিক্ষের কথা বলতে গিয়ে বাঙালিদের স্বভাব ও জীবনযাত্রা সম্পর্কে এমন কিছু মন্তব্য করেছেন যা অন্য সিভিলিয়ানদের এবং বিশেষত ‘দুর্ব্বৃত্ত জাতি’র তথ্য পরিবেশক এফ, সি ডালির সঙ্গে মিলবে না। হান্টার নিম্নবঙ্গের অধিবাসীদের প্রসঙ্গে লিখেছেন, এরা সংযতবাক, আত্মতুষ্ট এবং বিদেশি পর্যবেক্ষণের প্রতি সন্দেহপরায়ণ; লিখেছেন, বাঙালি এমন ধৈর্য ও স্থৈর্যের সঙ্গে জীবন যাপন করে যে, দুর্ঘটনা ও সুযোগসুবিধা তাদের বিচলিত করতে পারে না, তারা নীরবে ধনী হয়, বিনা অভিযোগে দরিদ্র হয়, তাদের ‘ক্রোধ অসীম, কিন্তু অকথিত’, তাদের কৃতজ্ঞতাবোধ বংশপরম্পরায় বিরাজমান। গার্হস্থ্যজীবনে তারা গোপনীয়তার পক্ষপাতী এবং পরবর্তীকালে ১৮৭৬ সালের দুর্ভিক্ষের সময় সম্ভ্রান্ত ঘরের মহিলাদের সম্ভ্রান্ত ঘরের মহিলাদের কাছে সাহায্য পৌঁছে দেয়াও অসম্ভব হয়ে পড়েছিল এবং পল্লী অঞ্চলের অনেক বাড়িতেই বহু লোক বিনা অভিযোগে নিঃশব্দে দিনের পর দিন না খেয়ে মারা গিয়েছে।(৬) এরকম সংযতবাক, কৃতজ্ঞ, ধীরস্থির, অভিযোগহীন, গার্হস্থ্য জীবনে রক্ষণশীল এবং সম্ভ্রান্ত বাঙালিরাই তো পরে ‘পুরোনী রীতিনীতি সহসা অচল হয়ে পড়ায়’ ভিটেহারা, দিশাহারা, ছদ্মবেশী, এবং কেউ কেউ ক্ষুব্ধও,যারা অন্যান্য ঔপনিবেশিক শাসক এবং তাদেরই একজন নিষ্ঠ প্রতিনিধি এ, সি, ডালির বিবেচনায় ‘দুর্ব্বৃত্ত’, সুতরাং তার কাছে তাদের সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ বিররণ তো না পাওয়ারই কথা।
এরপরও, নানা পেশার লোকদের সম্পর্কে যেটুকু তথ্য ও বিবরণ এ-বইয়ে রয়েছে, তা অন্য কোথাও না-থাকায় এখন এর প্রকাশ ও প্রচার আমাদের জন্য জরুরি মনে হয়েছে। আমরা লক্ষ করেছি, এখানে কোনো কোনো জায়গায় পূর্ব্বপ্রচারিত বই ও গেজেটে বর্ণিত তথ্যের উল্লেখ পাচ্ছি যদিও, তবু এই বইয়ের বহু তথ্য আমাদের জন্য নতুন, যা পরে আর কোথাও উল্লিখিত হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। এর কারণ হয়ত এই যে, ঔপনিবেশিকদের কর্ত্তৃক যোগাযোগপ্রযুক্তি স্থাপনের ফলে ভারতের জাতিভেদ-প্রথার ভিত্তিই ক্রমশ ভেঙে পড়েছিল বলে কথিত ‘দুর্ব্বৃত্ত’দের অনেকেই ছিল [জাতি-] প্রথা-পালনকারী শেষপ্রজন্ম, যাদের কেউ কেউ নতুন নতুন পেশা গ্রহণ করলেও আগের পদবি ধরে রেখেছিল, কিন্তু সেই অবস্থায় আর ফিরে যাওয়ার সুযোগ পায়নি।
.
২
দুই ভাগে রচিত এই বইয়ের প্রথম ভাগে রয়েছে বাংলার স্থানীয় ‘দুর্ব্বৃত্ত’দের কথা, দ্বিতীয় ভাগে অন্যান্য প্রদেশ থেকে আসা ‘দুর্ব্বৃত্ত’দের প্রসঙ্গ। এখানে তাদেরকে চিহ্নিত করার জন্য চুরি-ডাকাতির নমুনা, নানারকম ছদ্মবেশ-ধারণের তথ্য, বিচিত্র জালিয়াতিসহ তাদের পেশা ও অবস্থানের যে-বিবরণ দিয়েছেন এফ, সি, ডালি, তা তিনি অনেকের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। পুলিশের তৎকালীন এসিস্ট্যান্ট সুপারিন্টেন্ডেন্ট ডবলিউ থর্প, ইনস্পেকটর শরৎচন্দ্র ঘোষের ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের কাগজপত্র এবং বাঙ্গালার ক্রিমিনাল ইনটেলিজেন্স গেজেট ইত্যাদি। এই বইয়ের লেখক, তথ্যসংগ্রাহক বা তথ্যসরবরাহকারী কেউই নিজে থেকে এদেরকে ‘দুর্ব্বৃত্ত’ বলে চিহ্নিত করেনি–বিভিন্ন সময়ে, নানা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রীয় আইন-অনুসারে বিজ্ঞাপন জারি করে এদেরকে ‘দুর্ব্বৃত্ত জাতি’ বলে ঘোষণা করা হয়।
বইয়ের প্রথম ভাগে আলোচিত হয়েছে বেদিয়া, ভূমিজ, ব্যাধ, বাগদী পোদ ও কাওরা, ঢেকারু, গায়েন, লোধা, তুঁতিয়া মুসলমান, মক্কা মওয়ালেম, ছোঠভাগিয়া মুচি ও মান্দারদের নিয়ে। আমরা খোঁজ করলে দেখব, বেদিয়া, ভূমিজ, ব্যাধ ও বাগদীদের সম্পর্কে কিছু বিবরণ অন্যান্য বইয়ে উল্লেখ থাকলেও আর কারও কথা খুঁজে পাওয়া যায় না, আর এ কারণেই এই অনালোচিত-অপ্রচারিত বইটির গুরুত্ব আমাদের কাছে আরও বেড়ে গেছে। গুরুত্বের আরেকটি কারণ, ডালি শুধু ক্ষুদ্র জাতি-পেশার লোকদের বিষয়ে তথ্যের উল্লেখ করেননি, কখনো কখনো তাদের সামাজিক অবস্থা ও ওই সময়কার রাজনৈতিক পরিস্থিতিরও উল্লেখ করেছেন।
এ-প্রসঙ্গে এখানে প্রথমেই যশোরের বেদিয়াদের কথা তোলা যায় যেখানে ডালি ‘ইম্পিরিয়াল গেজেটিয়ার অব ইন্ডিয়া’র সূত্র উল্লেখ করে বলেছেন, যে-সময়ে বোম্বাই ও মাদ্রাজ প্রদেশে মহারাষ্ট্রীয়গণের পরিবর্তে পিণ্ডারিগণ ডাকাতি শুরু করল তখন বাংলাদেশে মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে যারা আলাদাভাবে ডাকাতি করত তারাও ডাকাতের দল গঠন করে–এই বেদিয়ারা তাদেরই অবশিষ্ট অংশ। আবার, ডালি নিজের অভিজ্ঞতার সূত্রে এ-ও জানাচ্ছেন যে, বেদিয়ারা নাকি নিজেরা বলে, তারা গুজরাট থেকে এসেছে অথচ গুজরাট কোথায় অবস্থিত তা তারা নিজেরাই জানে না। বেদিয়া শব্দের অর্থ শিকারি, কিন্তু সকল অঞ্চলের বেদিয়ারা শিকার করে না, কখনো একই পরিবারে একেক জন একেক পেশায় জড়িত। কোয়ারী সাহেবের সূত্রে তাদের ধর্ম্ম বিষয়ে আরেকটি তথ্য জানিয়েছেন ডালি : এরা কালী পূজা পালন করে, মৃত্যুর ১১দিন পরে শ্রদ্ধানুষ্ঠানও করে, কিন্তু তারা বিয়ে করে মুসলমানি রীতিতে, ব্রাহ্মণেরা সেখানে পৌরোহিত্য করে না। বেদিয়াদের সম্পর্কে এমন তথ্য একালের গবেষকদের আগ্রহী করবে; আগ্রহী করবে চুরি বিষয়ে কথাবার্তা বলার সময় তারা যে কয়েকটি সাংকেতিক শব্দ ব্যবহার করে সেগুলিও। যেমন : সিদ=মাঁধী; চুরি=বেলি; পুলিশকাকারো; লুকাইয়া থাকা=চাপ্পোকা। এই শব্দগুলো ভক্তিপ্রসাদ মল্লিক সম্পাদিত অপরাধ জগতের ভাষা এবং এ-জাতীয় অন্যান্য অভিধানে এখনো অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
বইয়ের যশোর অঞ্চলের ব্যাধ নামের আরেক শিকারি গোত্রের উল্লেখ করেছেন ডালি, একসময় পাখি শিকার করা ছিল তাদের পেশা, কিন্তু পরে তারা ঘুরে-বেড়ানো শুরু করে এবং জায়গায় জায়গায় তাঁবু বানিয়ে বসবাস করে এবং প্রতারণায় দক্ষ হয়ে ওঠে। ব্যাধেরা যে ‘ক্ষত্রিয়জাত জাতিবিশেষ’ ব্রহ্মবৈবর্ত্ত-এর দশম অধ্যায়ের সূত্রে বঙ্গীয় শব্দকোষ-এ তার উল্লেখ করেছেন হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তবে এর পরেও, এদের ‘নির্দয়’ ও ‘দুষ্ট’ বলেছেন।(৭) ব্যাধেরা যেসময় যাযাবরবৃত্তি নিয়ে প্রতারণাপ্রবণ হয়ে উঠে ‘দুর্ব্বৃত্ত’ বলে চিহ্নিত হচ্ছিল, এর পরেই তো তাঁর অভিধানের জন্য তথ্য যুক্ত করেছিলেন হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। ব্যাধেরা পরে অবস্থার ফেরে যা-ই হয়ে উঠুক না কেন, তারা যে দক্ষ পাখিশিকারি জাতি, তা এদেশের নানা অঞ্চলের লোকেরা জানে।
প্রথম ভাগের আরেকটি উল্লেখযোগ্য ক্ষুদ্র গোষ্ঠী হচ্ছে গায়েন। যারা গান গায় সাধারণত আমরা তাদেরই গায়েন বলি, কিন্তু ডালির তথ্য মতে, গায়েনরা তাদের উৎপত্তি বিষয়ে বলে থাকে যে, হজরত শাহজালাল যখন যখন সিলেট জয় করতে আসেন তখন তার সফরসঙ্গীদের একজন ছিলেন জিহাদ এবং তারা সেই জিহাদেরই বংশধর। কিন্তু হজরত শাহজালালের সিলেট আগমনের ইতিহাসের প্রাচীনতম বই থেকে শুরু একালের ইতিহাসগ্রন্থ খোঁজ করে দেখলেও এ নামে তাঁর সফরসঙ্গীদের কারও নাম খুঁজে পাওয়া যাবে না।(৮) তাই এ অনুমান করা যেতে পারে যে, হয়ত ভয়ে নিজেদের পরিচয় গোপন করার জন্যই তারা এই বলে পরিচয় দিত, অথবা এও হতে পারে তারা হজরত শাহজালালের সফরসঙ্গীদের কারও বংশধর ঠিকই কিন্তু পূর্ব্বপুরুষের নাম তারা গোপন করছে বা বলতে ভুল করেছে, অথবা তথ্যসংগ্রহকারী নাম সংগ্রহ করে লেখার সময় ভুল করেছে।
গায়েনদের মধ্যে দুই দল আছেন–একদল সৎ পরিশ্রমী এবং গৃহী; অন্যদল জলচারী, নৌকা নিয়ে ঘোরে, একস্থান থেকে আরেক স্থানে ঘুরে বেড়ায়। জলচারী গায়েনদের কোনোপ্রকার নির্দিষ্ট পেশা না-থাকায় একসময় চুরি-ডাকাতিই তাদের পেশায় পরিণত হয়। তাদের কার্যক্ষেত্র পদ্মা মেঘনা ও তাদের শাখা-প্রশাখায় এবং ভৈরব, ঢাকা, চাঁদপুর ও ত্রিপুরা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ১৮৯২ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকার অতিরিক্ত পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট এদের সম্পর্কে লিখেছিলেন :
মেঘনা নদীর উপর যত চুরি ডাকাইতি হয় এই গায়েনরা নিশ্চয়ই তাহাদের প্রায় সবগুলির জন্য দায়ী। এই চুরি ডাকাইতির সংখ্যা প্রথম দৃষ্টিতেই যত মনে হয় বাস্তবিক তার অপেক্ষা বেশী, কারণ অনেক চুরি ডাকাইতির খবর থানায় দেওয়া হয় না।
এরা যে-ধরনের নৌকায় থাকত তার আলোকচিত্র বইয়ে দেওয়া আছে।
ডালি তাঁর বইয়ে বাগদি, পোদ এবং কাওরাদের সম্পর্কে প্রথমেই বলেছেন যে, এরা সর্বত্র দুর্ব্বৃত্ত জাতি বলে পরিচিত নয়, তবু এখানে তাদের স্থান দেওয়ার কারণ, বর্ধমান ও প্রেসিডেন্সি বিভাগের ডাকাতদের দলে এরা থাকে। পোদ ও কাওরাদের সম্পর্কে জানি না, আর কোথাও এদের কোনো উল্লেখ আজও দেখিনি, তবে বাগদিদের বিষয়ে এ-বইয়ে যা লিখিত হয়েছে তা তাদের ক্ষুব্ধ করবে। সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বাগদি জাতি বিষয়ে যোগেন্দ্র প্রামাণিক (৭০) ও কালো দলুই (আনুমানিক ৬০) দুই ব্যক্তির ভাষ্য নিয়েছিলেন যা ২০০৩ সালে অনুষ্টুপ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সেখানে যোগেন্দ্র প্রামাণিকের ভাষ্য ছিল এরকম :
“বলছি শুনুন। বাগদিজাতি সারা বাংলাদেশেই আছে। তা সে যেখানেই থাকুক, তাদের জন্ম হলো বনবিষ্ণুপুর। না, বাঁকুড়া বিষ্ণুপুর না; এ হলো রাম-সীতার বনবিষ্ণুপুর। পড়েছেন তো রামায়ণে, রাম বনে যাবার সময় সেখানে এক রাতে মাটিতে কুশ বিছিয়ে শুয়েছিল। রাম-সীতা দুজনেই। তা আমরা হলাম সেখানকার লোক; ওই বনবিষ্ণুপুরেই বাগদিরা হলো, মানে জন্মালো। তাই আমাদের নাম কুশমাটিয়া। …আমরা হলাম বীরের জাত, বুঝলেন।”(৯)
বীরের জাত হিসেবে যোগেন্দ্র প্রামাণিকের কথার সত্যতা কবিকঙ্কনের চণ্ডীমঙ্গল-এ আছে। মল্লরাজবংশের সঙ্গে বাগদিদের নিকট-সম্পর্ক বিষয়েও অনেকে লিখেছেন, এছাড়াও অনুকূলচন্দ্র সেনের বাঁকুড়া পরিক্রমা গ্রন্থের একটি গল্প সংকলনে ১৭৯-১৮০ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে :
“মল্লরাজা বীর হাম্বিরের চার পুত্র ছিল : দুলিয়া, তেঁতুলিয়া, কুশমাটিয়া এবং মাটিয়া–তাদের নামেই বাগদিসমাজে চারটি গোত্রের উদ্ভব হয়েছে। বীর হাম্বিরের রাজত্বকাল মুঘল যুগে সপ্তদশ শতকের গোড়ায়। গোত্র-বিভাজন নিঃসন্দেহে আরও অনেক প্রাচীন কালের কথা।”(১০)
বাগদিদের ধর্মাচার ও নানা বিষয়ে অনেক তথ্য থাকলেও এই সব তথ্যের কোনো উল্লেখ ডালির বইয়ে নেই। এর থেকে কারও কারও এমনটিও মনে হতে পারে যে, ডালি তার বইয়ে সাধারণত এমন সব তথ্য দিতে চেয়েছেন যা পড়লে আলোচিতদের চোর-ডাকাত রূপে চিহ্নিত করা যায়।
জাল মক্কা মোয়ালেমদের বিষয়ে ডালি প্রথমেই জানিয়েছেন, এদের অধিকাংশই ঢাকা জেলায় বাস করে, কিন্তু ১৮৮৩ সালে মুদ্রিত জেমস ওয়াইজের বইটিতে এদের সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই। এ থেকে এমন ধারণা করা যায় যে, এরা হঠাৎ-আবির্ভূত, আর অবস্থার ফেরে পড়ে এই অপরাধের সঙ্গে জড়িত হয়েছে এবং কোনোভাবেই সেটা তাদের মূল পেশা নয়। অথচ ডালি শুরুতে স্পষ্টভারেই জানিয়ে দিয়েছেন এরা ‘ভয়ানক দুর্ব্বৃত্ত’।
মেদিনীপুরের ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার-এ অন্তর্ভুক্ত সিভিলিয়ান ওমালির মন্তব্য উদ্ধৃত করে তুঁতিয়া মুসলমানদের সম্পর্কে একই রকম তথ্য জানিয়েছেন ডালি। সম্প্রদায় হিসেবে এদের নাকি বড়ো দুর্নাম! এরা ‘জন্মাবধি চোর ও ডাকাইত, অধঃপতিত বলে বিবেচিত, অন্য মুসলমানেরা তুঁতিয়াদের মেয়ে বিয়ে করলেও তাদের মেয়েকে এদের ঘরে বিয়ে দেয় না। অথচ ভুক্তির শুরুতেই ডালি জানিয়েছেন, যখন রেশম ব্যবসার উন্নতি ছিল তখন উঁত গাছের চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করত; পরে এরা কৃষিকাজ করে, দড়ি বানিয়ে, মাছ ধরে, দোকানদারি করে এবং রাজমিস্ত্রীর কাজ করে জীবন চালায় আর এদের মধ্যে কিছু লোক পাকা চোর ও ডাকাত। কিন্তু কথা হলো, যখন তাদের পেশা নির্দিষ্ট ছিল তখন চুরি ডাকাতি করত কি না, আর এ-অঞ্চলে রেশম চাষের অবনতির পেছনে কারা দায়ী? পনেরো শতকের শুরুর দিকে চিনা পর্যটক মা হুয়ানের বর্ণনায় বাংলায় রেশম-চাষের প্রক্রিয়ার কথা উল্লেখ আছে, বার্বোসা ও ট্যাভার্নিয়ারের বিবরণে আছে, গুজরাটের কাম্বে, আহমেদাবাদ ও সুরাটে যে রেশমি কাপড় তৈরি হত তার রেশম যেত বাংলা থেকে। এইভাবে কাঁচামালের জন্য স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করায় পনেরো শতক থেকে সতেরো শতকের দ্বিতীয়ার্ধের মধ্যে বাংলায় রেশম শিল্প পুরোপুরি বিকশিত হয়। এ-প্রসঙ্গে Strensham Master-এর ডায়েরির উপর ভিত্তি করে মমতাজুর রহমান তরফদার বলেন, ‘দেশী ও বিদেশী বণিকদের চাহিদা মেটাতে গিয়ে কাশিম বাজারে ও মালদহে যে রেশম উৎপন্ন হত তার পরিমাণ ছিল বিস্ময়কর’,(১১) কিন্তু এক শতক যেতে না যেতেই ইংরেজ বণিকরা নানাভাবে যে-অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পরিবেশ তৈরি করে তার ধকল বাংলা আর সামলাতে পারেনি। এর ফলে এদেশের বিপুল পরিমাণ পেশাজীবী পারিবারিক ও সামাজিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়ে কতটা দিশেহারা হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।
দ্বিতীয় ভাগে রয়েছে মোট ২২টি পেশার লোকদের বিবরণ, এর মধ্যে শুধু ‘ছাপ্পড় বন্দ’ নামের আরেক প্রকার পেশাজীবীর কথা জেমস ওয়াইজের নোটস অন দি রেসেস, কাস্টস এন্ড ট্রেডস অফ ইস্টার্ন বেঙ্গল বইয়ে আছে। জেমস ওয়াইজের বইয়ে এদের পেশা বিষয়ে বলা আছে যে এরা বাঁশের বাখারি আর কঞ্চি দিয়ে কুঁড়েঘর বানায় অর্থাৎ ঘরামির কাজ করে।(১২) আর ডালির বইয়ে বর্ণিত ছাপপড় বন্দে জাল টাকা বানিয়ে বাজারে চালায়। এরা ধর্মে মুসলমান, নামের সঙ্গে ‘শা’ উপাধি ব্যবহার করে, মুসলমান ভিখিরির বেশে ভারতের সকল জায়গায় ঘুরে বেড়ায়, আবার কখনো কখনো হিন্দু বলেও নিজেদের পরিচয় দেয়; এরা ঢালাই করে সিকি, দু-আনি এবং টাকা বানিয়ে নানা উপায়ে লোক-ঠকানোর চেষ্টা করে। জেমস ওয়াইজ-বর্ণিত ছাপ্পড় বন্দেরা ঘরামির কাজ করলেও তাদের সম্পর্কে তিনি যে-বিবরণ দিয়েছেন তাতে এ-অনুমান করা যায় যে, এরাও তাদের কাজের সুযোগ তৈরি করার জন্য গোপনে হীনকাজে লিপ্ত হয়। তিনি লিখেছেন : ‘ছাপর বন্দ ও ঘরামিরা কোনো এলাকায় যখন নানারকম নির্মাণসামগ্রী নিয়ে হাজির হয়, তখন ধরে নেয়া হয় আগুন লাগতে আর দেরি নাই।’
এ-পর্ব্বের প্রথমেই রয়েছে বৈদ মুসলমানদের কথা। এরা যোধপুর, উদয়পুর ও রাজপুতানা থেকে ভারতে আসে, ধর্মের দিক দিয়ে মুসলমান, কিন্তু যেখানে তারা থাকে সেখানে বৈদ বলে পরিচিত। ১৯১০ সালে ৬ আগস্টে যুক্ত-প্রদেশের সিআইডি গেজেটে প্রকাশিত মন্তব্যের সূত্র ধরে ডালি জানিয়েছেন, এরা ‘বনজরদিকের বৈদ নামক এক অন্তর্জাতি’, পরে ইসলাম ধর্ম্ম গ্রহণ করেছে, তবে প্রতারণা করার সময় এরা রামানন্দ সাধুদের মতো পোশাক পরে ছদ্মবেশ ধারণ করে।
বইয়ে পালোয়ার দোসাদ, চাকাই দোসাদ এবং (শুধুই) দোসাদদের যে-তথ্য আছে সেগুলো জনজাতি-গবেষকদের আগ্রহী করে তুলবে বলে আমাদের ধারণা। ডালি উল্লেখ করেছেন, ১৯০৪ সালের কাছাকাছি সময়ে পাটনা জেলার দোসাদদের মধ্যে সমাজ-সংস্কারবাদী আন্দোলনের সৃষ্টি হয় যার নেতা ছিল তুলসী দোসাদ। তুলসী দোসাদ একসময় ঘোষণা দিয়েছিল : ‘চৌৰ্য্যাপরাধে অপরাধী প্রত্যেক দোসাদকেই জাতিচ্যুত করা হইবে।’ এ-প্রসঙ্গে ডালির মন্তব্য :
“কিছুকাল ঐ আন্দোলনের অত্যন্ত প্রভাব দেখা গিয়াছিল। মজুর ও গৃহকাৰ্যে নিযুক্ত চাকরের কাজে সাধারণ দোসাদেরা সক্ষম ও ঐরূপ কার্যে নিযুক্ত অন্যান্য জাতির ন্যায় সাধু।”
ডালির কথা থেকেই বোঝা যায়, প্রকৃত নেতা ও কাজের সুযোগ পেলে ‘বিস্তর বদমায়েস ও পাকা সিঁধেল চোর’ও সৎ ও সাধু হয়ে যায়। ব্রিটিশ শাসকেরা তো রাজ্য শাসনের জন্য এদেরকে ‘দুর্ব্বৃত্ত জাতি হিসেবে চিহ্নিত করে জেলে পুরেছে, শাস্তি দিয়েছে, কিন্তু এদেরকে সৎ ও সাধু করার জন্য কোনো কাজের সুযোগ করে দিয়েছিল কি কখনো? বা এদের অবস্থার উন্নতির জন্য অন্য কোনো ভূমিকা কি রেখেছিল? বইটি পড়তে পড়তে এরকম আরও অনেক প্রশ্ন তৈরি হয়, নতুন করে এর আলোচনা করার সময় যা কোনোভাবে এড়িয়ে যাওয়া চলে না।
বইটি প্রথম পাঠেই এই প্রশ্ন জাগে যে, দুই ভাগে যে ৩৩টি জাতি/গোষ্ঠীর উল্লেখ করেছেন ডালি এদের অধিকাংশেরই তো স্থায়ী কোনো পূর্ব্বসূরি নেই, আর তার পরেও দু-একটি ছাড়া জাতি বা উপজাতি হিসেবে এদের কোনো স্বীকৃতিও তো নেই। এরা যে সবদিক দিয়ে অবহেলিত এবং হিসাবেরও অযোগ্য বলে বিবেচিত সেকথা পাচ্ছি সুবোধ ঘোষের ‘বাংলার আদিবাসী’ প্রবন্ধে। তাঁর মতে, ভারতের অন্যান্য জায়গার মতো বাংলাদেশেও কিছু ক্ষুদ্র যাযাবর সমাজ রয়েছে, যাদের মধ্যে উপজাতিদের কিছু বৈশিষ্ট্য থাকলেও তাদের উপজাতি না বলে উপসমাজ বলা উচিত। তার কারণ এরা আদিবাসী নয়, তাদের ইতিহাস আলাদা, এরা শিক্ষা-দীক্ষা ও সামাজিকতায় ‘খুবই অবনত’। তাঁর ভাষায় :
এদের এক একটা জীবিকা অবশ্যই আছে। যেমন কারও পেশা পাখি ধরা, কারও শেয়াল মারা, কারও গো-সাপ শিকার করা ইত্যাদি। কোনো কোনো উপসমাজ বন্য ওষধি বিক্রি করে, কেউ বা বাঁশ ও ও বেতের ডালা ঝুড়ি তৈরি করে বিক্রি করে। এদের এইসব উপসমাজের অনেকে আবার একেবারেই জীবিকাহীন। জীবিকাহীন হলে স্বাভাবিকভাবে নৈতিক অবনতি যেমন হয়ে থাকে, অনেক উপসমাজের মধ্যে সেটা খুবই হয়েছে। বৃটিশ শাসন-নীতি অনুসারে এইসব জীবিকাহীন উপসমাজকে ‘অপরাধপ্রবণ গোষ্ঠী’ (Criminal Tribes) নামে চিহ্নিত করা হয়েছিল। এদের সম্পর্কে ‘গোষ্ঠী’ ‘ট্রাইব’ (Tribe) কথাটা ব্যবহৃত হলেও এদের উপজাতি না বলে উপসমাজই বলা উচিত। ভারতের অন্যান্য আদিবাসী সমাজের সঙ্গেও এদের কোনো সাংস্কৃতিক সাদৃশ্য দেখা যায় না।(১৩)
উপজাতি বা আদিবাসী বলা সংগত কি না একথা বলতে গিয়ে এখানে এদের উল্লেখ করেছেন সুবোধ ঘোষ। তিনি ভারতীয় বলেই এদেরকে ব্রিটিশদের মতো ‘দুর্ব্বৃত্ত জাতি’ না বলে ‘অপরাধপ্রবণ গোষ্ঠী’ বলেছেন, তবে আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না এরা কখনো জীবিকাযুক্ত, কখনো জীবিকাহীন এবং কখনো নিরূপায় জীবিকা-বদলকারী ভিটেমাটিহীন/ভিটেমাটিছাড়া সেই কথিত ‘দুর্ব্বৃত্ত জাতি’ই।
সুবোধ ঘোষ যে বলেছেন, কোনো কোনো ‘জাত’কে অপরাধপ্রবণ বা দুর্ব্বৃত্ত বলে চিহ্নিত করা হয়েছে তা ঠিক, বইয়ের প্রথম ভাগে যে-বাগ্দি’দের কথা বলা আছে তা অন্যান্য বইয়েও পাওয়া যায়। একইভাবে ‘বেদিয়া’, ‘ব্যাধ, ‘ভূমিজ’ এবং ‘ভড়’-এর উল্লেখ অন্যান্য জাতি-উপজাতি বিষয়ক বই ও লেখায় পাওয়া যায়, কিন্তু অধিকাংশ গোষ্ঠীর উল্লেখ তো অন্যত্র বা পরবর্তী সেন্সাসেও নেই। জাতি পুরাবৃত্ত নামে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে একটি তথ্যসমৃদ্ধ বই লিখেছিলেন সূৰ্য্য কুমার তর্কর্সরস্বতী, সেই বইয়ে তিনি যে-জাতিসমূহের পরিচয় দিয়েছিলেন তাতে পরিশিষ্ট অংশে মুসলমান জাতি ও ইউরোপীয় প্রাচীন জাতিদের বিষয়েও আলোচনা আছে কিন্তু এদের সম্পর্কে কোনো আলোচনা নাই।(১৪) তাহলে এই প্রশ্ন তো উঠতেই পারে যে, হিসাব ও বিবেচনা-অযোগ্য এইসব ‘উপসমাজ’ বা গোষ্ঠীর লোকদের আবির্ভাব হলো কোথা থেকে? ডালি তার বিবরণের একজায়গায় লিখেছেন, এরা নিজেদের সম্পর্কে কিছুই বলতে চায় না। কথা ঠিক, যারা জীবিকাহীন এবং সময় সময় জীবিকা বদলায় বা বদলাতে বাধ্য হয়, ছদ্মবেশ ধারণ করে, নিজেদেরকে কখনো মুসলমান কখনো হিন্দু বলে পরিচয় দেয়, তারা তো আত্মগোপন করবেই। ফলে ব্রিটিশ শাসকেরা এদেরকে প্রধানত তাদের আচরণ ও তাদের চুরি-ডাকাইতির দিকে লক্ষ রেখে তাদের সম্বন্ধে যথাসাধ্য তথ্যসংগ্রহ করার চেষ্টা করেছে। সেই তথ্য থেকেই বের হয়ে এসেছে এরা কোথায় কোথায় চুরি-ডাকাতি করে, কীভাবে করে এবং এরা এই স্থানের অধিবাসী অন্য কোথাও থেকে এসেছে।
ডালি যদিও তার বইয়ে ‘দুর্ব্বৃত্ত জাতিদিগের উৎপত্তি বা জাতিতত্ত্ব সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনা’ করার প্রয়োজন বলে মনে করেননি, কিন্তু আমাদের মনে হয়েছে, তিনি প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে যথাসাধ্য বিবরণই দিয়েছেন, তাদের সম্পর্কে এর চেয়ে বেশি তথ্য তার পক্ষে দেওয়া বা পাওয়া সম্ভব ছিল না। তার কারণ, যেসময়ে এদের আবির্ভাব হয়েছে তখন চাইলেও তাদের কোনো পরম্পরা বা আবির্ভাবের নির্ধারিত কার্যকারণ খুঁজে পাওয়া ছিল কঠিন। দীর্ঘদিনের পুরোনো ব্যবস্থা ভেঙে যাওয়ার পর নতুন ব্যবস্থা আসন গাঁড়ার আগের অবস্থা সম্পর্কে ভিনসেন্ট স্মিথের মন্তব্য উদ্ধৃত করেছিলেন শ্রীপান্থ : ‘ভূমিহীন এবং জীবন-জীবিকা থেকে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া মানুষের এই বেপরোয়া নায়ক সন্ধানই সেদিনের ভারতের অন্তরের কাহিনি।’ সেই সময়কার প্রেক্ষাপটের উল্লেখ করতে গিয়ে শ্রীপান্থ আরও বলেছিলেন, সামাজিক রীতিনীতি, ধর্মীয় আচার-আচরণের নৈরাশ্য আর বিপুল অন্ধকারের কথা। তখন চলছিল শিশুহত্যা, সন্তান বিসর্জন, দাস-ব্যবসা, এমনকি সাধু সন্ন্যাসীরা পর্যন্ত শাস্ত্রের বদলে হাতে তুলে নিয়েছিল শস্ত্র :
“বর্গীদের মত পিণ্ডারিদের মত–’নাগা সন্ন্যাসী’, ‘বৈরাগী, ‘গোঁসাই’, ‘দাদুপন্থী’, বাংলার ‘সন্ন্যাসী’ সেদিন নাকি অনেক সাধকদলের হাতে শাস্ত্রের বদলে শস্ত্র। ইতিপূর্বে তা ছিল না। পরেও না। এ শুধু সেদিনেরই ইতিহাস যখন বর্তমানই একমাত্র কাল। ওরা তখন কেউ সিন্ধিয়ার বাহিনীভুক্ত, কেউ জয়পুরের। কেউ বা নিরন্ধ্র অন্ধকারে দুর্ধর্ষ পথিক দল। ঠগী তাদেরই সহযাত্রী–তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় সবচেয়ে নিপূণের দল। ঠগী সেই অন্ধকার যুগের সর্বোত্তম প্রতীক।”(১৫)
এই ঠগীদের চিনতে গেলে সেই অন্ধকার যুগকে চিনতে হবে, আর ঠগীকে চিনতে পারলে ডালির ‘দুর্ব্বৃত্ত জাতি’দেরকেও চেনা সহজ হবে। চেনাটা এজন্যই জরুরি যে, এদের আচরণে, ছদ্মবেশে, আত্মগোপন-চেষ্টায়, তাদের চেহারায় আমাদের ধ্বস্ত সময়ের, অন্ধকার যুগের ইতিহাস লেখা রয়েছে। মিরজাফর, উমিচাঁদ জগৎ শেঠের চক্রান্তে যখন সিরাজের প্রতিরোধের চেষ্টা ব্যর্থ হল তখন এ-অঞ্চলে হাভাতে নগণ্য মানুষেরা দুর্ভিক্ষ বন্যা মহামারির মধ্যে তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনে কখনো কখনো ঘুরে-দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছিল, ইংরেজদের রেকর্ডে তারাই ডাকাত; ওয়ারেন হেস্টিংস এবং কর্নেল স্লীম্যানের মতে, এই ডাকাতরা ইংরেজ ডাকাতদের মতো নয়, অন্য কোনো অঞ্চলের ডাকাতদের সঙ্গে এদের তুলনা চলে না। রঞ্জিত সেন লেখেন : ‘ডাকাতি সংক্রান্ত তত্ত্বের মূল জায়গা হল এই যে, ডাকাতির দ্বারা দুটি বাসনা, আবেগ (Passion) পরিতৃপ্ত হয়েছিল। একটি হল ‘Class Hatred, আরেকটি হল ‘Hatred agaist the English’, বহু জায়গায় এই ডাকাতরা ঘুরে দাঁড়িয়েছে জমিদারের বিরুদ্ধে, মহাজনদের বিরুদ্ধে, যারা অত্যাচার করছে তাদের, আবার বৃহত্তর ক্ষেত্রে সুযোগ পেলেই ইংরেজের বিরুদ্ধে।’(১৬) এ-সম্পর্কে দেশ পত্রিকায় ‘বাঙলার ডাকাত–সেকাল একাল’ শিরোনামে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ লিখেছিলেন পঞ্চানন ঘোষাল। তাঁর মতে, মুসলমানদের আক্রমণের ফলে গৌড় বাংলা হিন্দু নৃপতিদের পতন হয়, কিন্তু তাদের এমন বহু সৈন্য রয়ে যায় যারা মুসলমানদের কর্তৃত্ব মেনে নেয়নি, এরাই পরে সুযোগ পেলে মুসলমানদের আক্রমণ করত, কখনো কখনো গেরিলা কায়দায় মুসলমান বাহিনীর অভিযানের পথে অতর্কিত আক্রমণ করে ওদের রসদ লুঠ করে পালিয়ে যেত—’এদের মধ্য থেকেই পরবর্তীকালে অনেকে অধঃপতিত হয়ে পেশাগতভাবে ডাকাত হয়।’ এরপর তিনি উল্লেখ করেন। ইউরোপের শিল্প বিপ্লব ও বাঙলার ঐতিহ্যবাহী শিল্প-ধ্বংসের কথা, যার ফলে বাঙলার পেশাজীবীরা নিরূপায় হয়ে কৃষিকাজে আগ্রহী হয় কিন্তু পর্যাপ্ত কৃষিজমির অভাবে কর্মহীন হয়ে তাদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ চোর-ডাকাতের দল তৈরি করে।(১৭) ‘দুর্ব্বৃত্ত জাতি’রা তো সেই সময় বা পরবর্তী সময়েরই সৃষ্টি।
রবীন্দ্রনাথ জমিদারির কাজে গ্রামে গিয়ে গ্রামের মানুষদের ভয়াবহ অবস্থা দেখে ব্রিটিশ-শাসকদের প্রতি তাঁর আগ্রহ চিরতরে চলে গিয়েছিল এবং মৃত্যুর তিনমাস আগে ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে শাসকদের বিষয়ে তাঁর মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে গিয়েছিলেন।
ব্রিটিশ শাসকেরা সর্বত্র একথা প্রচার করতে চাইত যে, জনবাহুল্য আর কুসংস্কারাচ্ছন্নতার জন্য ভারতবাসীদের অবস্থার উন্নতি করা যায় না। দার্শনিক উইল ডুরান্ট সভ্যতার ইতিহাস লিখবেন বলে ভারতে এসে জনগণের দুরবস্থা দেখে শাসকদের সঙ্গে এ-বিষয়ে আলাপ করতে চাইলে তারা তখন তাঁকে এমনটিই বোঝাতে চেয়েছিল।(১৮) বহু বিষয়ে ওয়াকিবহাল থাকা সত্ত্বেও ইউরোপীয়দের মতো একটা সময় পর্যন্ত কার্ল মার্ক্সও মনে করতেন এখানকার বিবর্তন হাজার হাজার বছর ধরে স্থির হয়ে আছে, এবং বাইরের কোনো ধ্বংসাত্মক আক্রমণ না-এলে এর কোনো পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু পরে তিনি লক্ষ করেছেন, একদিকে ব্রিটিশ শাসন ভারতের সমাজকাঠামো তো ভেঙে দিয়েছেই এবং তাতে কোনো বৈপ্লবিক গতিশীলতার সৃষ্টি হচ্ছে না। এখানে ইউরোপের রীতিনীতি, রাষ্ট্রীয় বিধিব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়ার ফলে এখানকার সমাজব্যবস্থা ‘উদ্ভট’ রূপ নিচ্ছে।(১৯)
কিন্তু ব্রিটিশ শাসকেরা এই ‘উদ্ভট’ত্ব এবং সমাজ অসংগতিগুলো চেপে রাখতে চেয়েছে সবসময়, কারণ তা না করলে এদেশ শাসনের কোনো যুক্তিই তাদের থাকত না।
.
৩
বইটি শতবছর পরে প্রকাশিত হলেও এর বানান, শিরোনাম, উপশিরোনাম এবং এর বিন্যাস যথাসাধ্য অবিকল রাখার চেষ্টা করেছি। এতে সেই সময়কার ভাষাচিন্তা ও তাদের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে।
.
তথ্যসূত্র
১. জেমস ওয়াইজের নোটস অন দি রেসেস, কাস্টস এন্ড ট্রেডস অফ ইস্টার্ন বেঙ্গল বইটি সম্পর্কে মুনতাসীর মামুন লিখেছেন : “ওয়াইজের বইটি মুদ্রিত হয়েছিলো ঠিকই। মুদ্রিত হয়েছিলো ১৮৮৩ সালে, লন্ডনের সেন্ট মার্টিন লেনের ‘হার ম্যাজেস্ট্রিস প্রিন্টার হ্যারিসন এন্ড সন্স’ থেকে। নামপত্রে মুদ্রিত হয়েছে ‘নট পাবলিশড। আমি যে ফটোকপি পেয়েছি তাতে দেখা যায়, গ্রন্থকার বইটির একটি কপি উপহার দিয়েছিলেন ঐতিহাসিক হেনরি বিভারিজকে। হেনরি আবার ১৪.০৪.১৯২৩ মালে ব্রিটিশ মিউজিয়ামকে বইটি উপহার দেন। তাতে হাতের লেখায় উল্লেখ করা হয়েছে বইটি মাত্র বারো কপি ছাপা হয়েছে।”;
২. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘পল্লীসেবা’, রবীন্দ্র-রচনাবলী চতুর্দশ খণ্ড, বিশ্বভারতী, কলকাতা ১৩৯৮, পৃ. ৩৮৩;
৩. কার্ল মার্কস ফ্রেডারিক এঙ্গেলস, উপনিবেশিকতা প্রসঙ্গে, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৭১, পৃ. ৪১;
৪. উইলিয়াম হান্টার, পল্লীবাংলার ইতিহাস, ওসমান গনি অনূদিত, দিব্যপ্রকাশ, ঢাকা, ২০০২, পৃ. ২৪;
৫. পূর্বোক্ত, পৃ.৩৬-৩৭;
৬. পূর্বোক্ত, ২৮;
৭. হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্গীয় শব্দকোষ দ্বিতীয় খণ্ড, সাহিত্য অকাদেমি, কলকাতা, পঞ্চম মুদ্রণ ২০০১, পৃষ্ঠা ১৬৩৯;
৮. হজরত শাহজালালের আগমনের ইতিহাসের প্রাচীনতম গ্রন্থ ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে লিখিত মৌলভি নাসির উদ্দিন হায়দারের ফারসি ভাষায় লিখিত সুহেলে এমন অবলম্বনে রচিত মৌলভি মবশ্বির আলি চৌধুরীর তারিখে জালালি (বাংলা অনুবাদ : মোস্তাক আহমাদ দীন) নামক উর্দুগ্রন্থে যেমন ‘জিহাদ’ নামের কোনো সফরসঙ্গীর কথা নেই, তেমনি এসময়ের লিখিত কোনো গ্রন্থেও তার উল্লেখ পাওয়া যায় না। এ থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, এরা, তাদের ভাষায় দুর্ব্বৃত্তরা, শাসকদের ভয়ে নিজেদের পরিচয় আড়াল করবার জন্য এমন সব পরিচয় দেওয়ার চেষ্টা করত যার সত্যতা সহজে যাচাই করা সম্ভব নয়;
৯. অনিল আচার্য সম্পাদিত অনুষ্টুপ, ‘বাগদিজাতি যোগেন্দ্র প্রামাণিক ও কালো দলুই’, সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা, ২০০৩, পৃ. ৯২;
১০. পূর্বোক্ত, পৃ. ৯৩;
১১. মমতাজুর রহমান তরফদার, মধ্যযুগের বাংলায় প্রযুক্তি ও সমাজ বিবর্তন, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৯৩, পৃ. ১৩;
১২. জেমস ওয়াইজ, পূর্ব্ববঙ্গের বিভিন্ন জাতি, বর্ণ ও পেশার বিবরণ (নোটস অন দি রেসেস, কাস্টস এন্ড ট্রেডস অফ ইস্টার্ন বেঙ্গল), ফউজুল করিম অনূদিত, ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর বেঙ্গল স্টাডিজ, ঢাকা, ১৯৯৮, পৃষ্ঠা ৬৭;
১৩. পবিত্র সরকার ও অন্যান্য সম্পাদিত বঙ্গদর্পণ প্রথম খণ্ড, ‘বাংলার আদিবাসী’, সুবোধ ঘোষ, সমাজ-রূপান্তর সন্ধানী তৃতীয় সহস্রাব্দ সমিতি, কলকাতা, ২০০১, পৃষ্ঠা ৪৮-৪৯;
১৪. সূৰ্য কুমার তর্কসরস্বতীর জাতি পুরাবৃত্ত বইটি হিন্দু শাস্ত্রের আলোকে রচিত। এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৩১ সালে ভট্টাচার্য এন্ড কো., প্রাচ্য শিক্ষা পরিষদ শিলচর, ভারত থেকে। বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯২০ সালে। প্রথম প্রকাশের ভূমিকায় লেখকের নামের পাশে উল্লিখিত হয়েছে, ‘মধুসূদন হাউস, পঞ্চখণ্ড, সিলেট, নভেম্বর ২১, ১৯২০;
১৫. শ্রীপান্থ, ঠগী, দে’জ পাবলিশিং কলকাতা, ১৯৮৭, পৃষ্ঠা ৪৬;
১৬. শেখর ভৌমিক সম্পাদিত সাম্প্রতিক ইতিহাসচর্চা, ‘বাংলার গ্রামাঞ্চলে ডাকাতি : অষ্টাদশ শতকের একটি সামাজিক প্রতিরোধ’, রঞ্জিত সেন, ইন্দিরা প্রকাশনী কলকতা, ২০০৫, পৃষ্ঠা ৮৪;
১৭. সাগরময় ঘোষ (সম্পাদিত] দেশ, ‘বাঙলার ডাকাত-সেকাল ও একাল’, পঞ্চানন ঘোষাল, কলকাতা, [৪ মার্চ, ১৯৮৯, পৃ. ৩৪-৩৫;
১৮. এ-প্রসঙ্গে ১৯৩০ সালে নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত উইল ডুরান্টের দি কেস ফর ইন্ডিয়া বইটি পড়ে দেখা যেতে পারে;
১৯. পার্থ চট্টোপাধ্যায় ইতিহাসের উত্তরাধিকার, আনন্দ, কলকাতা, ২০১৭, পৃষ্ঠা ১০২।
মোস্তাক আহমাদ দীন
.
ভূমিকা
চুরি ডাকাইতি প্রভৃতি করাই যাহাদের কাৰ্য্য এরূপ যে সকল বিশেষ বিশেষ দুর্ব্বৃত্ত জাতি বঙ্গদেশে বাস করে বা অন্যান্য প্রদেশ হইতে বাঙ্গালায় আসে তাহাদের কার্যপ্রণালীসম্বন্ধে পুলিশ কর্মচারীদিগকে শিক্ষা দেওয়া এই পুস্তকের উদ্দেশ্য। কাৰ্য্যক্ষেত্রে পুলিশ কর্মচারীগণ কর্ত্তৃক ব্যবহারের জন্য এই পুস্তক লিখিত হওয়ায় ইহাতে দুর্ব্বৃত্ত জাতিদিগের উৎপত্তি বা জাতিতত্ত্ব-সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনা করা প্রয়োজন মনে হয় নাই। আশা করা যায় যে, কাৰ্য্যক্ষেত্রে যে সকল বিষয় জানা আবশ্যক হয় এই পুস্তকে কেবলমাত্র সেই সকল বিষয়ের আলোচনা থাকায় পুলিশ কর্মচারিগণ এই পুস্তক আগ্রহ করিয়া পড়িবেন, বুঝিবেন ও মনে রাখিবেন। পুলিশের আসিষ্টান্ট-সুপারিন্টেন্ডেন্ট ডবলিউ গ্রুপ সাহেব (ইনি এ সম্বন্ধে কিছু দিনের মধ্যে স্পেশাল ডিউটিতে ছিলেন) এবং ইনস্পেক্টর শরৎচন্দ্র ঘোষ ক্রিমিনাল ইনভেষ্টিগেসন ডিপার্টমেন্টের কাগজপত্র হইতে আমার জন্য এই পুস্তকের উপাদান সংগ্রহ করেন। বাঙ্গালার ক্রিমিনাল ইনটেলিজেন্স গেজেটে “দুর্ব্বৃত্ত জাতিদিগের কথা” এই নামে সময়ে সময়ে অনেক কথা প্রকাশ করা গিয়াছে। সেইগুলি সংশোধিত ও পরিবর্তিত করিয়া উপযুক্ত আকারে এই পুস্তকের অন্তর্ভুক্ত করা হইয়াছে।
এ, সি, ডালি।
রাইটার্স বিলডিংস।
২১শে জুন, ১৯১৫।