০৯.০২ কিরূপ বিবাহ করা চাই
ছাহাবা মুগীরা (রাঃ) রছুলে মকবুলের (দঃ) নিকট আসিয়া নিজের বিবাহের কথা আলোচনা করিলে রছুল (দঃ) বলিলেন :-
“(পাত্রীটি) দেখিয়া লও। কেননা, সে চিরদিনের সঙ্গিনী ও সুখ-দুঃখের অংশিনী হইবে, তাহাকে অগ্রেই তোমার দেখিয়া লওয়া উচিত।”
আরও একটি হাদীছে আছে :-
“ধর্ম, ধন ও সৌন্দর্য এই তিনটি গুণ দেখিয়াই স্ত্রীলোককে বিবাহ করা হয়, তন্মধ্যে প্রথমতঃ ধর্মগুণ দেখিয়াই তোমার বিবাহ করা কর্তব্য।”
তাই বলি পাঠকগণ! বিবাহ করিতে হইলে চতুর্দিক ভালরূপে দেখিয়া শুনিয়া বিবাহ করা কর্তব্য। কারণ, দাম্পত্য জীবন সুখময়, রসময় ও আনন্দময় না হইলে বাস্তবিক উহা বিপরীত ভাব ধারণ করতঃ অশান্তি, নিরানন্দ ও অন্ধকারময় হইয়া দাঁড়ায়। জাতীয় জীবনের উন্নতি ও অবনতি বহু পরিমাণে বিবাহ নির্বাচনের উপরই নির্ভর করে, তাহা অনেক শিক্ষিত লোকেরাও ভালরূপে বুঝিয়ে উঠিতে পারে নাই।
অতএব, বিবাহ সম্বন্ধ স্থাপন করিবার পূর্বেই পাত্র ও পাত্রীর বংশ-কুল, ধর্ম-চর্চা, শিক্ষা-দীক্ষা, স্বাস্থ্য ও রূপ-গুণ সমস্ত বিষয় ভালরূপে দেখিয়া শুনিয়া বিবাহ দেওয়া বা করা কর্তব্য। যে বংশে কোন মহৎ লোকের জন্ম নাই, যে বংশে শিক্ষিত, শিক্ষিতা ছেলেমেয়ে নাই, যে বংশের ছেলেমেয়ে ক্ষীণজীবী ও স্বল্প-পুত্র হয়, যে বংশ কুষ্ঠ, গরমী, মেহ, যক্ষ্মা ও দুরারোগ্য জন্মগত ব্যাধি আছে, সে বংশে কখনও ছেলেমেয়ে বিবাহ দেওয়া বা করান উচিত নহে।
আমাদের দেশে অনেকেই পাত্রটি যেমন হউক না কেন পাত্রীটি তাহার জন্য সুন্দরী, তেজস্বিনী ও বুদ্ধিমতী জুটাইয়া দিয়া পাত্র-পাত্রীর জীবনের মধ্যে একটি গণ্ডোগোলের বা ইঁদুর-বিড়ালের সম্বন্ধ পাতাইয়া দেয়। মূলতঃ পুরুষের যেমন ভাল-মন্দ ও সৌন্দর্যবোধ আছে, স্ত্রীলোকেরও তেমনি বা ততোধিক সৌন্দর্যবোধ আছে। পুরুষ যেমন সুন্দরী স্ত্রী চায়, স্ত্রীও তেমনি সুন্দর পুরুষ চাহে। সুন্দরী স্ত্রী না হইলে যেমন যুবকেরা বিবাহ করিতে চাহে না এবং করিলেও প্রাণ দিয়া ভালবাসিতে পারে না, স্ত্রীলোকেরাও তেমনি সুন্দর পুরুষ না হইলে বিবাহ করিতে চাহে না এবং করিলেও প্রাণ দিয়া ভালবাসিতে পারে না। সুতরাং সারাজীবন তাহাদের স্বামী-স্ত্রীর ভীষণ প্রমাদ ঘটিয়া উঠে। অতএব কর্তৃপক্ষের এরূপ কাজ করা কখনও উচিত নহে।
আর বাল্যবিবাহ কদাচ সুবিধাজনক কাজ নহে। বাল্যবিবাহে যেমন বালিকাদিগের পক্ষে নিতান্ত অশুভ, বালকদিগের পক্ষেও তেমনি ঘোর অনিষ্টকর। বাল্যবিবাহের ফলে অনেক নাবালেকা স্ত্রী স্বামীর বাড়ী হইতে ভাদ্র মাসের ভরা নদী সাঁতরাইয়া পলাওয়ন করিয়া থাকে। অনেক পাত্র-পাত্রীর অকালে সোনার শরীর ভগ্ন হইয়া কালগ্রাসে পতিত হয়। কেহ কেহ দিন দিন শক্তিহীন, ক্ষীনকায় ও বিশ্রী হইতে থাকে। এইরূপ শক্তিহীন মাতৃ-পিতৃ ঔরসজাত সন্তানও প্রায়ই ক্ষীণ, হীন, ভীরু ও বিশ্রী হইয়া থাকে।
অতএব বাল্যবিবাহ প্রথা মুসলিম সমাজ হইতে চিরতরে বিদায় গ্রহণ করিলেই অনেকটা সুবিধা হয়। নবী নন্দিনী বিবি ফাতেমার (রাঃ) বিবাহ হযরত আলীর (রাঃ) সহিত সাবেলেকা অবস্থায় ১৫ বৎসর বয়সেই সংঘটিত হইয়াছিল। বাস্তবিক বাল্যবিবাহ বর্জন করিবার জন্যে মুসলমানদের ইহা একটি জ্যজ্জ্বল্য প্রমাণ।
আর ভাল-মন্দ চিহ্নসমূহও অল্প বয়সে চিহ্নিত করা যায় না। জ্ঞানী ও বিচক্ষণ লোকেরা বলিয়াছেন, তোমরা নিম্নলিখিত গুণসমূহে ভূষিতা রমণী বিবাহ করিও। যথা :-
সুন্দরী, সুকেশী–তনু লোমরাজি কান্তা,
সুভুরু সুশীলা, সতী, সুগতি, সুদন্তা।
মধ্যক্ষীণা, ভাসা আঁখি পদ্মিনী কামিনী,
শক্তিহীনা হইলেও সে শ্রেষ্ঠা রমণী।
কেননা শেখ সাদী (রহঃ) বলেন :-
সুন্দরী সতীর পতি অতি ভাগ্যবান,
মনোবাঞ্ছা পূর্ণ তার করেন রহমান।
ধার্মিকা নারীর পতি হইবে যে জন,
ইহ-পরকালে শান্তি পাইবে সে জন।
স্বামী ভক্তা সতী নারী দরিদ্র পতিরে,
পৃথিবীর রাজাতুল্য আনন্দিত করে।
অসতী দুষ্টার পতি দুনিয়া ভিতরে,
দোজখ যাতনা সম কষ্ট ভোগ করে।
সতী সাধ্বী সহচরী গৃহে আছে যার,
সদাই আনন্দময় ভুবন তাহার।
দুষ্ট রমণীর সঙ্গ করহ বর্জন,
যদ্যপি রূপেতে তার উজ্জ্বল ভুবন।
সুশীলা ও সচ্চরিত্রা নারী আছে যার,
সার্থক জীবন তার সুখী অনির্বার।
মনোহর, হিতকর, যথার্থ বচন,
মা-বাপের শুভাকাঙ্খী তনয় রতন।
সুপ্রিয়-স্বজন আর মনোমত নারী
দুর্লভ জানিবে তবে এ রতন চারি।
আরও বিজ্ঞ লোকেরা বলিয়াছেন–নিম্নলিখিত কুলক্ষণা স্ত্রী বিবাহ করিও না। যথা :-
টেরা চক্ষু কিংবা হয় চঞ্চল লোচনী,
দুঃশীলা অথবা হয় পিঙ্গল বরণী।
হাস্যকালে গণ্ডস্থলে কূপ হয় যায়,
বন্ধ্যা সে রমণী হয় জগত মাঝার।
আর অনেক জায়গায় এই রীতি আছে যে, কন্যার অলীগণ বিবাহের পূর্বে ‘বরের’ নিকট হইতে বিবাহ আঞ্জাম খরচ বাবত অথবা বংশ গৌরব রক্ষার্থে কিংবা গর্ভের সম্মানার্থে খাদ্য, পানীয় ও টাকা-পয়সা নিয়া থাকেন, সচরাচর উহাকে বিবাহের ‘পণ’ বলা হয়। কোরআন, হাদীছ ও ফেকাহের কিতাবসমূহে উহা ছরাছর হারাম বলিয়া প্রমাণিত হইয়াছে।
আর বেদাতসমূহের মধ্যে, যথাঃ- নানারকমের সোগাগিনী স্ত্রীলোকেরা বিবাহ বাড়ীতে উপস্থিত হইয়া যে সে প্রকারের এলুথেলু গান গাহিয়া আমোদ-প্রমোদে মত্ত হওয়া, কাগজ কাটিয়া কাটিয়া যাবতীয় ছবি-ছুরত, লতা-পাতা ইত্যাদি তৈয়ার করতঃ ঘর-বাড়ী সাজাইয়া লওয়া, পুরুষ লোকেরাও মেহদী দ্বারা হাত-পা রাঙ্গাইয়া লওয়া, সরিষা, সিঁদুর, হলদি ইত্যাদি বাটিয়া কাল কাপড়ে পুটুলি বাঁধিয়া বরের হাতে বাঁধিয়া দেওয়া, বাসী বিয়া, কাঙ্গন খেলা, নাচা, কুদা, বাঁশী, সানাই, বাজী, তামাশা, খারাপ উদ্দেশ্যের পণ্যাদি, কলের গান, হারমোনিয়াম ও তাস ইত্যাদি কার্য যাহা বিবাহের সময় বিবাহ বাড়ীতে সংঘটিত হইয়া থাকে, ফেক্বাহ শাস্ত্রকারেরা ঐ সমস্তকেও ছরাছর মোটা বেদাত বা হারাম লিখিয়াছেন।