০৯-১২. বদিউজ্জামান মাথা নিচু করে

০৯.

বদিউজ্জামান মাথা নিচু করে কয়েক ঢোক পানি খেল। তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাচ্ছে। তার মনে হল, পায়ে আর কোনো বোধশক্তি নেই। মাথা কেমন যেন করছে। গিরগিটিটি তাকিয়ে আছে তার দিকে। এর চোখ দুটি মানুষের মতো মনে হয় হাসছে। বুড়ো মানুষের মতো মাথা ঝুকিয়ে-ঝুকিয়ে হাসা। সে হাত ইশারা করে গিরগিটিটাকে বিদেয় করতে চাইল। কিন্তু সে যাচ্ছে না, তাকিয়ে আছে।

আচ্ছা—মিলিটারিদের সম্পর্কে যে-সব গল্প শোনা যায় সেগুলি সত্যি? শুধু-শুধু এরা মানুষ মারবে কেন? এরা নাকি নতুন কোনো জায়গায় গেলেই প্রথম ধাক্কায় চল্লিশ পঞ্চাশ জন মানুষ মেরে ফেলে ভয় দেখাবার জন্যে। এটা একটা কথা হল? সব গুজব। এরাও তো আল্লাহর বান্দা। মিলিটারিও মানুষ, রক্ত একটু গরম—এই আর কি। এটা তো দোষের কিছু না। পোশাকটাই এ-রকম, গায়ে দিলে রক্ত গরম হয়ে যায়।

বদিউজ্জামান খুকখুক করে দু বার কাশল। নিজের কাশির শব্দে নিজেই চমকে উঠল। কেমন বেকুবের মতো কাণ্ড করছে। নির্জন জায়গা। অল্প শব্দ হলেই অনেক দূর থেকে শোনা যায়। আবার কাশি আসছে। বদিউজ্জামান কাশি সামলাবার চেষ্টা করতে গিয়ে ঘড়ঘড় একটা শব্দ বের করল। গিরগিটিটা ভয় পেয়ে চলে যাচ্ছে। না, হচ্ছে না, আবার দাঁড়িয়ে পড়েছে। পানি খেতে এসেছে বোধহয়। তাকে দেখে পানি খাবার হল হচ্ছে না, আবার তৃষা নিয়ে চলেও যেতে পারছে না।

বদির আবার তৃষ্ণা বোধ হল। সে মাথা নিচু করে কয়েক ঢোক পানি খেল।

১০.

নীল শার্ট পরা লোকটি বলল, আপনারা দু জন আসেন আমার সঙ্গে। আজিজ মাষ্টার তাকাল ইমাম সাহেবের দিকে। ইমাম সাহেব ভীত স্বরে বললেন, কোথায়? নীল শার্ট পর লোকটির মূখ অস্বাভাবিক গম্ভীর। তাকে কোনো প্রশ্ন দ্বিতীয় বার করার সাহস হয় না। তবু ইমাম সাহেব দ্বিতীয় বার জিজ্ঞেস করলেন, কোথায়?

বিলের কাছে।

কেন?

মেজর সাহেব নিয়ে যেতে বলেছেন।

কী জন্যে?

এত কিছু জিজ্ঞেস করবার দরকার নেই। আপনারা উঠেন। মেজর সাহেব অপেক্ষা করছেন।

বড় ভয় লাগতেছে ভাই।

ভয়ের কিছু নাই—আসেন।

আজিজ মাস্টার একটি কথাও বলল না। নিঃশব্দে বেরিয়ে এল। সবার শেষে বেরুলেন ইমাম সাহেব। তিনি খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটছিলেন।

স্কুলঘরের বারান্দায় কেউ নেই। ধু-ধু করছে চারদিক। বসে থাকা সেপাইরা কখন গিয়েছে, কোথায় গিয়েছে, কে জানে। ঘরের ভেতরে বসে কিছুই বোঝা যায় নি। হয়তো কোনো পাহারাটাহারা ছিল না। ইচ্ছা করলেই পালিয়ে যাওয়া যেত। ইমাম সাহেব অবাক হয়ে বললেন, এরা সব কোথায় গেল?

নীল শার্ট পরা লোকটি বলল, বেশি কথা বলবেন না। আপনারা মৌলবী-মুসুল্লিরা বেশি কথা বলেন আর ঝামেলার সৃষ্টি করেন। কম কথা বলবেন।

জি আচ্ছা।

ইউনিয়ন বোর্ডের সড়ক পর্যন্ত তারা এগোল নিঃশব্দে। জুমাঘরের পাশে আট-ন জন সেপাইয়ের একটি দল দাঁড়িয়ে আছে। তারা তাকিয়ে আছে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। ইমাম সাহেবের ঘন-ঘন নিঃশ্বাস পড়তে লাগল। তিনি নীল শার্ট পরা লোকটির দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বললেন, ভাই, আপনার নাম কি?

রফিক। রফিক সাহেব, আমার জোহরের নামাজ কাজা হয়ে গেছে। পানির অভাবে অজু করতে পারি নাই।

রফিক তার কোনো জবাব দিল না। আগে-আগে হাঁটতে লাগল। কোথাও কোনো মানুষজন নেই। গ্রামের সবাই কি ঘরে দরজা বন্ধ করে বসে আছে নাকি? ইমাম সাহেব বললেন, ভাই, আপনার দেশ কোথায়? বাড়ি কোন জিলায়?

বাড়ি দিয়ে কী করবেন?

না, এমনি জিজ্ঞেস করলাম। আমার দেশ কুমিল্লা। নবীনগর।

ভালো।

সামনের মাসে ইনশাল্লাহ দেশে যাব। বহুত দিন যাই না।

রফিক কিছুই বলল না। সে হাঁটছে মাথা নিচু করে। এমনভাবে হাঁটছে যেন। পথঘাট খুব ভালো চেনা। কিন্তু এ-লোকটি এই গ্রামে আগে কখনো আসে নি। আজিজ মাস্টার বলল, মেজর সাহেব কেন ডেকেছেন আপনি জানেন?

জানি।

জানলে আমাদের বলেন।

রফিক নিস্পৃহ স্বরে বলল, একটি অপরাধীর বিচার হবে। ওর নাম, মনা। সে খুন করেছে। সেই খুন নিয়ে কোনো থানা-পুলিশ হয় নি। এক বুড়ি নালিশ করেছে মেজর সাহেবের কাছে। ঐ বুড়ির নাম চিত্ৰা বুড়ি।

ইমাম সাহেব বললেন, চিত্রা বুড়ি। খুব বজ্জাত। মসজিদের একটা বদনা চুরি করেছে।

বদনা চুরি করুক আর না-করুক মেজর সাহেব তার কথা শুনে খুব রাগ করেছেন। মনাকে ধরা হয়েছে। কঠিন শাস্তি হবে।

আজিজ মাস্টার ক্ষীণ স্বরে বলল, কী শাস্তি?

মিলিটারিদের তো আর জেল-হাজত নাই যে জেলে ঢুকিয়ে দেবে। ওদের শাস্তি একটাই। ছোট অপরাধের জন্যে যে-শাস্তি, বড়ো অপরাধের জন্যেও সেই শাস্তি।

কী সেটা?

বুঝতেই তো পারছেন, আবার জিজ্ঞেস করছেন কেন?

ইমাম সাহেব শুকনো গলায় বললেন, আমরা গিয়ে কী করব?

আপনারা শাস্তি দেখবেন।

শাস্তি দেখব।

হ্যাঁ।

এর দরকার আছে।

কী দরকার?

মেজর সাহেবের ধারণা, এটা দেখার পর আপনারা তাঁর কথা শুনবেন। কোনো কিছু জিজ্ঞেস করলে সোজাসুজি জবাব দেবেন।

ও।

শুনেন ইমাম সাহেব, আপনি কথা বেশি বলেন। কথা বেশি বলে এক বার মার খেয়েছেন। কথা খুব কম বলবেন।

জ্বি আচ্ছা।

নিজের থেকে কোনো কথা বলবেন না। এখন সময় খারাপ।

জ্বি, তা ঠিক।

ইমাম সাহেব চুপ করে গেলেন।

মীর আলি বাড়ির উঠোনে বসে ছিল। আজ বাড়িতে রান্না হয় নি। খিদের যন্ত্রণায় সে অস্থির হয়ে পড়ল। এই বয়সে খিদে সহ্য হয় না। অনুফাকে কয়েক বার ভাতের কথা বলাও হয়েছে। কিন্তু অনুফা কিছু করছে না। সে ভয়ে অস্থির হয়ে আছে। ভাত রাঁধায় তার মন নেই। ভয় মীর আলিরও লাগছে। কিন্তু খিদের কষ্ট বড় কষ্ট।

আজিজ মাস্টাররা তার বাড়ির সামনে দিয়ে যাবার সময় সে এক থালা মুড়ি নিয়ে বসে ছিল। এই বয়সে মুড়ি চিবোতে কষ্ট হয়, তবু চিবোতে হয়। যা ভাবসাব তাতে মনে হচ্ছে আজ আর রান্না হবে না। পায়ের শব্দে মীর আলি চমকে উঠে বলল, কেড়া যায়?

আমি আজিজ। আজিজ মাস্টার।

তোমার সঙ্গে কেডা যায়?

আজিজ মাস্টার জবাব দিল না।

কথা কও না যে! ও মাষ্টার, মাস্টার।

রফিক বলল, দাঁড়াবেন না, দেরি হয়ে যাচ্ছে।

ও মাস্টার, কে কথা কয়?

রফিক শীতল স্বরে বলল, আমার নাম রফিক। চাচা মিয়া, আপনি ঘরের ভেতরে গিয়ে বসেন।

মাস্টার, এই লোকটা কে? মিলিটারি?

না। আমি মিলিটারি না।

আপনার বাড়ি কোন গ্রাম?

রফিক তার জবাব দিল না! হাঁটতে শুরু করল। ইমাম সাহেব তাল মিলিয়ে হাঁটতে পারছেন না। ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছেন। তার জন্যে দুজনকেই মাঝে-মাঝে দাঁড়াতে হচ্ছে। রফিক বলল, হাঁটতে কষ্ট হলে আমার হাত ধরে হাঁটেন।

জ্বি-না। কোনো কষ্ট নাই।

লজ্জার কিছু নাই। আমার হাত ধরে হাঁটেন।

শুকরিয়া। ভাই, আপনার বয়স কত?

আমার বয়স দিয়ে কী করবেন?

এমনি জিজ্ঞেস করলাম।

আপনাকে তো বলেছি বিনা প্রয়োজনে কথা বলবেন না।

জ্বি, আচ্ছা।

আমার বয়স তিরিশ।

রফিককে দেখে বয়স আরো বেশি মনে হয়। রোগা এবং লম্বা। ছোট ছোট চোখ। কথা বললে চোখ আরো ছোট হয়ে যায়। মনে হয় লোকটি যেন চোখ বন্ধ করে কথা বলছে।

ইমাম সাহেব দোয়া ইউনুস পড়তে লাগলেন। লাইলাহা ইল্লা আন্তা সোবাহানাকা ইন্নি কুন্তু মিনাজ্জুয়ালেমিন।

মনা কৈবর্ত তার এগার বছরের ভাইকে নিয়ে তেতুল গাছের নিচে চুপচাপ বসে আছে। মনার শরীর বিশাল প্রায় দৈত্যের মতো। তার ভাইটি অসম্ভব রোগা। সে মনার লুঙ্গির এক প্রান্ত শক্ত করে ধরে আছে। তাকাচ্ছে সবার মুখের দিকে। বারবার কেঁপে-কেঁপে উঠছে। মনাকে খুব একটা বিচলিত মনে হচ্ছে না।

মেজর সাহেব প্রায় দশ গজ দূরে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছেন। তাঁর সঙ্গে এক জন নন-কমিশন্ড অফিসার। এরা দু জন নিচু গলায় নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। মেজর সাহেব সম্ভবত কোনো রসিকতা করলেন। দু জনেই উঁচু গলায় হাসতে শুরু করল। মনার ভাইটি চোখ বড়-বড় করে তাকাল তাদের দিকে। বিলের পারের উঁচু জায়গায় এক দল রাজাকার দাঁড়িয়ে। খুব কাছেই মিলিটারি আছে বলেই হয়তো তার বুক ফুলিয়ে আছে। অহঙ্কারী গর্বিত ভঙ্গি। এদের মধ্যে শুধু দু জনের পায়ে স্পঞ্জের স্যাণ্ডেল। বাকি কারোর পায়ে কিছু নেই। এরা নিজেদের মধ্যে গুনগুন করে কথা বলছে। তবে এদের মুখ শুকনো, ভয় পাওয়া চোখ।

মেজর সাহেব এগিয়ে এলেন মনার দিকে। মনার ছোট ভাইটি শক্ত হয়ে গেল। মনার সঙ্গে মেজর সাহেবের নিম্নলিখিত কথাবার্তা হল। কথাবার্তা হল রফিকের মাধ্যমে। আজিজ মাস্টার ও ইমাম সাহেবকে সরিয়ে দেওয়া হল। তারা বসে রইল বিলের পাড়ে। প্রশ্নোত্তর শুরু হল।

তুমি একটি খুন করেছ?

মনা জবাব দিল না। মাটির দিকে তাকিয়ে রইল।

চুপ করে থাকবে না। স্পষ্ট জবাব দাও বল হ্যাঁ কিংবা না।

হ্যাঁ।

গুড। স্পষ্ট জবাব আমি পছন্দ করি। এখন বল—কেন করেছ? বিনা কারণে তো কেউ মানুষ মারে না।

হে আমার পরিবারের সঙ্গে খারাপ কাম করছে।

তাই নাকি?

জ্বে আজ্ঞে।

উত্তেজিত হবার মতোই একটি ব্যাপার। তোমার স্ত্রীকে কি শাস্তি দিয়েছ?

মনা মাটির দিকে তাকিয়ে রইল। জবাব দিল না। প্রশ্নের ধারা সে বুঝতে পারছে না।

বল, বল। কুইক। সময় বেশি নেই আমার হাতে।

মনা ঘামতে শুরু করেছে।

আমার মনে হচ্ছে তুমি কোনো শাস্তি দাও নি।

জ্বি-না।

সে নিশ্চয়ই খুব রূপবতী?

মনা চোখ তুলে তাকাল। কিছুই বলল না।

বল। চট করে বল। সে কি রূপবতী?

জ্বি।

তাহলে অবশ্যি শাস্তি না-দিয়ে ভালোই করেছ। একটি সুন্দরী নামের শাস্তি দেয়ার পেছনে কোনো যুক্তি নেই। তোমার স্ত্রীর নাম কি?

মনার চোখে ভয়ের ছায়া পড়ল। মেজর সাহেবের কথাবার্তা কেমন যেন অন্য রকম হয়ে যাচ্ছে।

বল, তোমার স্ত্রীর নাম বল।

মন কিছুই বলল না। রফিক বলল, গ্রামের মানুষরা অপরিচিত মানুষের কাছে স্ত্রীর নাম বলে না।

কেন বলে না?

আমি জানি না স্যার।

তুমি তো অনেক কিছুই জান, এটা জান না?

আমি অনেক জিনিস জানি না।

মেজর সাহেব মনার দিকে আরো কয়েক পা এগোলেন। আঙুল দিয়ে ইশারা করে বললেন, এই ছেলেটি কী হয় তোমার?

এ আমার ছোট ভাই।

ওর নাম কি?

বিরু।

মেজর সাহেব তাকালেন বির দিকে। বিরু কুঁকড়ে গেল। মেজর সাহেব শান্ত স্বরে বললেন, বির, তুমি লুঙ্গি ধরে টানাটানি করছ কেন? লুঙ্গি ছেড়ে দাও। বিরু লুঙ্গি ছেড়ে দিল না। আরো ঘেঁষে গেল ভাইয়ের দিকে। তার চোখে-মুখে ভয়ের ছায়া পড়েছে। শিশুরা অনেক কিছু আগেই বুঝতে পারে। সেও হয়তো পারছে।

মনা।

জ্বি।

তুমি বড় একটা অন্যায় করেছ। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার শাস্তি হবে। তোমার কী বলার আছে?

মনা তাকিয়ে রইল। তার চোখে পলক পড়ছে না। মেজর সাহেব সিগারেট ধরালেন। অস্থির ভঙ্গিতে দৃঢ় স্বরে বললেন, এই দুজনকে পানিতে দাঁড় করিয়ে দাও। রফিক ইংরেজিতে বলল, এই বাচ্চাটিকেও?

হ্যাঁ। স্যার, এর কি কোনো প্রয়োজন আছে?

প্রয়োজন আছে। এর প্রয়োজন আছে। আমি নিষ্ঠুরতার একটা নমুনা দেখাতে চাই।

স্যার, তার কোনো প্রয়োজন নেই।

প্রয়োজন আছে। আজ এই ঘটনাটি পর মিলিটারির নামে শুনলে ব্রা কাপড় নষ্ট করে দেবে। গর্ভবতী মেয়েদের গর্ভপাত হয়ে যাবে।

তাতে কী লাভ স্যার?

লাভ-লোকসান আমার দেখার কথা, তোমার না। আমার সঙ্গে তর্ক করবে না।

রফিক চুপ করে গেল। মেজর সাহেব তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন, এ-সব কথা পরবর্তী সময়ে কেউ মনে রাখবে না। অত্যাচারী রাজারা ইতিহাসে বীরশ্রেষ্ঠ হিসেবে সম্মানিত হন। আলেকজান্ডারের নৃশংসতার কথা কি কেউ জানে? সবাই জানে–আলেকজান্ডার দি গ্রেট।

রফিক কিছুই বলল না। মেজর সাহেব সহজ সুরে বললেন, যা করতে বলা হয়েছে। কর। আর শোন, ঐ ইমাম এবং ঐ মাস্টার – ওদের দুজনকে খুব কাছাকাছি কোথাও বসিয়ে দাও। আমি চাই যাতে ব্রা খুব ভালোভাবে দৃশ্যটা দেখে।

ঠিক আছে স্যার।

বাই দা ওয়ে, আমি দেখলাম ঐ ইমাম তোমার হাত ধরে-ধরে আসছে। কী ব্যাপার?

হাঁটতে পারছিল না।

ঠিকই পারবে। দৃশ্যটি তাদের দেখতে দাও, তারপর ওদের হাঁটতে বললে হাঁটবে, দৌড়াতে বললে দৌড়াবে। লাফাতে বললে লাফাবে। ঠিক নয় কি?

হয়তো ঠিক।

হয়তো বলছ কেন? তোমার মনে সন্দেহ আছে?

জ্বি-না স্যার।

গুড। সন্দেহ থাকা উচিত নয়। রফিক।

জ্বি স্যার।

তোমাকে সঙ্গে নিয়ে আমি বেরুব। গ্রামটি ভালোমতো ঘুরে দেখতে চাই।

ঠিক আছে স্যার।

মনে হয় দেখার মতো ইণ্টারেস্টিং অনেক কিছুই আছে এ-গ্রামে।

কিছুই নেই স্যার। এটা একটা দরিদ্র গ্রাম।

রাজাকাররা মনা আর তার ভাইটিকে ঠেলে পানিতে নামিয়ে দিল। বিরু তার ভাইয়ের কোমর জড়িয়ে ধরে আছে। সে কাঁপছে থরথর করে। মনা এক হাতে তার ভাইকে ধরে আছে।

রাইফেল তাক করা মাত্র বিরু চিৎকার করতে লাগল, দাদা, বড় ভয় লাগে। ও দাদা, ভয় লাগে। মনা মৃদু স্বরে বলল, ভয় নাই। আমারে শক্ত কইরা ধর। বিরু প্রাণপণ শক্তিতে ভাইকে আঁকড়ে ধরল।

ইমাম সাহেব গুলি হবার সময়টাতে চোখ বন্ধ করে ফেললেন। এবং তার পরপরই মুখভর্তি করে বমি করলেন। আজিজ মাস্টার সমস্ত ব্যাপারটি চোখের সামনে ঘটতে দেখল। এক পলকের জন্যেও দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল না।

১১.

আলো মরে আসছে।

আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে। মেজর সাহেব আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, কি রফিক, বৃষ্টি হবে?

হতে পারে। এটা ঝড়বৃষ্টির সময়।

তোমার দেশের এই ঝড়বৃষ্টিটা ভালোই লাগে।

রফিক মৃদু স্বরে বলল, তোমার দেশ বললেন কেন? মেজর সাহেব ও গুরু দৃষ্টিতে তাকালেন। কিছু একটা বলতে গিয়েও বললেন না।

কোথাও কোনো শব্দ নেই। যেন গ্রামে কোনো জনমানুষ নেই। মেজর সাহেব হাতা গলায় বললেন, মানুষকে ভয় পাইয়ে দেবার একটা আলাদা আনন্দ আছে। আছে না?

রফিক জবাব দিল না। মেজর সাহেব বললেন, মানুষের ইনসটিংটের মধ্যে এটা আছে। অন্যকে পায়ের নিচে রাখার আকাঙ্খা। তোমার নেই?

না।

আছে, তোমারও আছে। সবারই আছে। থাকতেই হবে।

রফিক কিছু বলল না। তারা হাঁটছে পাশাপাশি। মেজর সাহেব কথা বলছেন বন্ধুর মতো। তাঁর কথার ধরন দেখে মনে হয় রফিককে তিনি যথেষ্ট গুরুত্ব দেন।

বদিউজ্জামানের বাড়ির সামনে দিয়ে যাবার সময় মীর আলি তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, কেড়া যায়? কেড়া যায়, জয়নাল মিয়া?

মেজর সাহেব থমকে দাঁড়ালেন। রফিক বলল, লোকটা স্যার অন্ধ। মেজর সাহেবকে মনে হল এই খবরে বেশ উৎসাহিত বোধ করছেন।

কে লোকটি, কথা বলে না? কে গো?

আমি রফিক।

রফিকটা কেডা? কোন বাড়ির?

ঘরের ভেতর গিয়ে বসেন চাচা।

মেজর সাহেব ঠাণ্ডা গলায় বললেন, তুমি ওকে কী বললে? রফিক ইংরেজিতে বলল, আমি তাঁকে ঘরে যেতে বললাম।

কেন

এমনি বললাম।

মীর আলি ভয় পাওয়া গলায় চেঁচাল, এরা কে? এরা কে? মেজর সাহেব বললেন, তুমি ওকে বল আমি মেজর এজাজ আহমেদ, কমান্ডিং অফিসার ফিফটি এইটথ ইনফেন্ট্রি ব্যাটালিয়ান।

স্যার, বাদ দেন। বুড়ো মানুষ।

তোমাকে বলতে বলেছি, তুমি বল। যাও, কাছে গিয়ে বল।

রফিক এগিয়ে গেল। মেজর সাহেব তাকিয়ে রইলেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। তিনি কি বুড়োর চোখেমুখে কোনো পরিবর্তন দেখতে চাচ্ছিলেন? কোনো রকম পরিবর্তন অবশ্যি দেখা গেল না। রফিক ফিরে আসতেই মেজর সাহেব বললেন, তুমি এই অন্ধ বুড়োকে বল, মেজর সাহেব আপনাকে সালাম জানাচ্ছেন।

রফিক তাকিয়ে রইল। মেজর সাহেব বিরক্ত স্বরে বললেন, দাঁড়িয়ে আছ কেন, যাও। রফিক এগিয়ে গেল। বুড়ো মীর আলি কিছুই বলল না। মাথা নিচু করে বসেই রইল।

আকাশে মেঘ জমছে। প্রচুর মেঘ। কালবৈশাখী হবে নিশ্চয়ই। তারা হাঁটছে নিঃশব্দে। রফিক একটি সিগারেট ধরিয়েছে। মেজর সাহেব তাকে মাঝে-মাঝে লক্ষ করছেন।

রফিক!

জ্বি স্যার।

তুমি তো জানতে চাইলে না আমি ওকে সালাম জানালাম কেন। জানতে চাও না?

রফিক কিছু বলল না।

রেশোবা গ্রামে আমার যে বৃদ্ধ বাবা আছেন, তিনি অন্ধ। তিনিও বাড়ির উঠোনে এই বুড়োটির মতো বসে থাকেন। পায়ের শব্দ পেলেই এই বুড়োটির মতো বলেন, ইয়ে কৌন?

পথিবীর সব জায়গার মানুষই আসলে এক রকম।

কথাটি কি তুমি বিশেষ কোনো কারণে বললে?

না, কোনো বিশেষ কারণে বলি নি।

রফিক, আমরা একটা যুদ্ধের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছি। সারভাইভালের প্রশ্ন। এই সময়ে অন্যায় কিছু হবেই। উল্টোটা যদি হত–ধর বাঙালি সৈন্য আমার গ্রামে ঠিক আমাদের মতো অবস্থায় আছে, তখন তারা কী করত? বল, কী করত তারা? যে, অন্যায় আমরা করছি তারা কি সেগুলি করত না?

না।

না? কী বলছ তুমি! যুক্তি দিয়ে কথা বল। রাগ, ঘৃণা, হিংসা আমাদের মধ্যে আছে, তোমাদের মধ্যেও আছে।

রফিক হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। হাত ইশারা করে বলল, এরা ডেডবডিটা এখনো সরায় নি। মেজর সাহেব দেখলেন দরজার পাশে বুড়োমতো একটি লোক কাত হয়ে পড়ে আছে। নীল রঙের বড়-বড় মাছি ভনভ্ন করে উড়ছে চারদিকে।

স্যার, এই লোকটির নাম নীলু সেন।

এর কি কোনো আত্মীয়স্বজন নেই? এভাবে ফেলে রেখেছে কেন?

রফিক গলা উঁচিয়ে ডাকল, বলাই, বলাই। কোনো সাড়া পাওয়া গেল না।

কাকে ডাকছিলে?

বলাইকে। ওর ছেলে কিংবা এ-রকম কিছু। এরা দু জল এই বাড়িতে থাকে।

এত বড় একটা বাড়িতে দুটিমাত্র প্রাণী থাকে?

এখন থাকে একটি।

রফিক।

জ্বি স্যার।

আমার মনে হয় তুমি সূক্ষ্মভাবে আমাকে কিছু বলবার চেষ্টা করছ।

স্যার, আমি কিছুই বলবার চেষ্টা করছি না। এখন যা বলার তা আপনি বলবেন। আমি শুধু শুনব।

এর মানে কি?

কোনো মানে নেই, স্যার। আপনি এত মানে খুঁজছেন কেন?

দু জন আবার হাঁটতে শুরু করল। কালীমন্দিরের সামনে মেজর সাহেব থামলেন। কালীমূর্তি তিনি এর আগে দেখেন নি। একটিমাত্র দরজা খোলা, পরিষ্কার কিছু দেখা যাচ্ছে না। মেজর সাহেব ঘরের ভেতরে ঢুকে দেখতে চাইলেন। রফিক বলল, স্যার, ঝড় হবার সম্ভাবনা। আমাদের তাড়াতাড়ি ফেরা উচিত।

ফিরব, তোমাদের কালীমূর্তি দেখে যাই।

তোমাদের বলা ঠিক নয়, স্যার। আমি মুসলমান।

তোমরা মাত্র পঁচিশ ভাগ মুসলমান, বাকি পঁচাত্তর ভাগ হিন্দু। তুমি মন্দিরে ঢুকে মূর্তিকে প্রণাম করলেও আমি কিছুমাত্র অবাক হব না।

রফিক কোনো জবাব দিল না। মেজর সাহেব দীর্ঘ সময় ধরে আগ্রহ নিয়ে মূর্তি দেখলেন। হাসিমুখে বললেন, চারটি হাতে এই মহিলাটিকে মাকড়সার মতো লাগছে। লাগছে না?

আমার কাছে লাগছে না। আমরা ছোটবেলা থেকেই মূর্তিগুলি এ-রকম দেখে আসছি। আমার কাছে এটাকেই স্বাভাবিক মনে হয়।

মেজর সাহেব একটা সিগারেট ধরালেন, তারপর অত্যন্ত ঠাণ্ডা গলায় বললেন, রফিক।

জ্বি স্যার?

এই মুর্তিটির পেছনে এক জন কেউ লুকিয়ে আছে।

রফিক চুপ করে রইল।

তুমি সেটা আমার আগেই বুঝতে পেরেছ। পার নি?

রফিক জবাব দিল না।

বুঝতে পেরেও আমাকে কিছু বল নি।

রফিক ক্লান্ত স্বরে ডাকল, বলাই বলাই। মূর্তির পেছনে কিছু একটা নড়েচড়ে উঠল।

তুমি কী করে বুঝলে ও বলাই?

আমি অনুমান করছি। মন্দিরে আশ্রয় নিয়েছে, তাই অনুমান করছি। বলাই নাও হতে পারে। হয়তো অন্য কেউ। হয়তো কানাই।

মন্দিরে আশ্রয় নিয়ে সে কি ভাবছে মা কালী ওকে রক্ষা করবেন?

ভাবাই তো স্বাভাবিক। অনেক মুসলমান এ-রকম অবস্থায় মসজিদে আশ্রয় নেয়। ভাবে আল্লাহ্ তাদের রক্ষা করবেন।

মেজর সাহেবের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হল। রফিক নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, অনেক জায়গায় মসজিদ থেকে টেনে বের করে ওদের মারা হয়েছে। আল্লাহ্ তাদের রক্ষা করতে পারেন নি।

তুমি কী বলতে চাচ্ছ?

আপনি যদি বলাইকে মারতে চান–কালীমূর্তি ওকে রক্ষা করতে পারবে না। এটাই বলতে চাচ্ছি, এর বেশি কিছু না।

ওকে বের হয়ে আসতে বল।

রফিক ডাকল, বলাই, বলাই। বলাই জবাব দিল না।

একটা মৃদু ফোঁপানির শব্দ শোনা গেল। প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই ঝড় শুরু হল। প্রচণ্ড ঝড়। মেজর সাহেব মন্দিরের ভেতর থেকে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। হুম-হুম শব্দ উঠছে। দেখতে-দেখতে আবহাওয়া রুদ্র মূর্তি ধারণ করল। মন্দিরসংলগ্ন বাঁশঝাড়ে ভয়-ধরানো শব্দ হতে লাগল। রফিক এসে দাঁড়াল মেজর সাহেবের পাশে। মেজর সাহেব মুগ্ধ কণ্ঠে বললেন, বিউটিফুল! কালীমূর্তির পেছনে উবু হয়ে বসে থাকা বলাইয়ের কথা তাঁর মনে রইল না। ঝড়ের সঙ্গে-সঙ্গে ফোঁটা-ফোঁটা বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। মেজর সাহেব দ্বিতীয় বার বললেন, বিউটিফুল!

সামনে খোলা মাঠ। অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। মাঠে ধূলি ও শুকনো পাতায় ঘূর্ণির মতো উঠেছে। এর মধ্যেই খালিগায়ে একজনকে ছুটে যেতে দেখা গেল। তার ভাব দেখে মনে হচ্ছে সে মহা উল্লসিত। মেজর সাহেব বললেন, লোকটিকে দেখতে পাচ্ছ? রফিক নিস্পৃহ স্বরে বললো, ও নিজাম, পাগল। আমাদের সব গ্রামে একটি পাগল থাকে।

এ-গ্রামের সবাইকে কি তুমি এর মধ্যেই চিনে ফেলেছ?

না, কয়েক জনকে চিনি। সবাইকে না।

ঐ পাগলটা কি জঙ্গলা-মাঠের দিকে যাচ্ছে না?

মনে হয় যাচ্ছে। পাগলরা বন-জঙ্গল খুব পছন্দ করে। মানুষের চেয়ে গাছকে তারা বড় বন্ধু মনে করে।

রফিক।

জ্বি স্যার।

তোমার পড়াশোনা কদ্দূর

পাস কোর্সে বি. এ. পাশ করেছি।

মাঝে-মাঝে তুমি ফিলসফারদের মতো কথা বল।

পরিবেশের জন্যে এ-রকম মনে হয়। বিশেষ বিশেষ পরিবেশে সাধারণ কথাও খুব অসাধারণ মনে হয়।

তা ঠিক।

মেজর সাহেব মাঠের দিকে তাকিয়ে রইলেন! ঝড়ের চাপ ক্রমেই বাড়ছে। মন্দিরের একটা জানালা খুলে গিয়েছে। খটখট শব্দে কানে তালা লেগে যাবার জোগাড়। রফিক বলল, স্যার কি ভেতরে গিয়ে বসবেন?

না।

পাগল নিজাম সত্যি-সত্যি কি বনের ভেতর ঢুকেছে? মেজর সাহেব তাকিয়ে আছেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাঁকে অত্যন্ত চিন্তিত মনে হচ্ছে। কপালে ভাঁজ পড়েছে।

রফিক।

জ্বি স্যার।

জর্জ বার্নার্ড শ মিলিটারি অফিসার সম্পর্কে কী বলেছেন জান?

জানি না স্যার।

তিনি বলেছেন, দশ জন মিলিটারি অফিসারের মধ্যে ন জনই হয় বোকা। বাকি এক জন রামবোকা।

জর্জ বার্নার্ড শর রচনা আমাদের সিলেবাসে ছিল না। আমি তাঁর কোনো লেখা পড়ি নি।

লোকটি রসিক। তবে তাঁর কথা ঠিক নয়। মাঝে-মাঝে মিলিটারি অফিসারদের মধ্যেও বুদ্ধিমান লোক থাকে। যেমন আমি। ঠিক না?

জ্বি স্যার।

আমার কেন জানি মনে হচ্ছে তুমি যাকে পাগল বলছ, সে পাগল নয়। সে জঙ্গলা মাঠে যাচ্ছে খবর দিতে।

নিজাম আলি পাগল। ওর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে।

কী কথা হয়েছে?

পাগলদের সঙ্গে যে-রকম কথা হয় সে-রকম। বিশেষ কিছু না।

বুঝলে কী করে, ও পাগল?

ও মিলিটারি আসায় অত্যন্ত খুশি হয়েছে। এর থেকেই বুঝেছি।

তুমি বলতে চাও মিলিটারি আসাটা কোনো আনন্দের ব্যাপার নয়?

জ্বি-না স্যার।

মেজর সাহেব ভূ কুঞ্চিত করে দূরের বনের দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, চল যাই।

কোথায়?

স্কুলে ফিরে যাই।

এই ঝড়ের মধ্যে?

মেজর সাহেব মন্দিরের চাতাল থেকে নেমে পড়লেন। ঝড়ে উড়িয়ে নিতে চাচ্ছে। কিন্তু তিনি হাঁটছেন স্বাভাবিকভাবেই। সাপের শিসের মতো শিস দিচ্ছে বাতাস। জুম্মাঘরের কাছাকাছি আসতেই মুসলধারে বৃষ্টি শুরু হল। মেজর এজাজ আহমেদ সেই বৃষ্টি গ্রাহ্যই করলেন না।

নিজের মনে গুনগুন করতে লাগলেন। কিংস্টোন ট্রয়োর একটি গান—যার সঙ্গে বর্তমান পরিবেশ সমস্যার কোনো সম্পর্কই নেই।

Pretty girls are everywhere
And when you call me I will be there.

মেজর সাহেবের গলা বেশ সুন্দর।

১২.

ঝড় স্থায়ী হল আধা ঘণ্টার মতো।

ঝড়ে গ্রামের কারোর তেমন কোনো ক্ষতি হল না। শুধু বদিউজ্জামানের নতুন টিনের বাড়িটির ছাদ উড়ে গেল। মীর আলি আতঙ্কে অস্থির হয়ে চেঁচাতে লাগল। অনুফা কী করবে ভেবে পেল না। তাদের বাড়ি গ্রামের বাইরে। ছুটে গ্রামে যাওয়ার কোনো প্রশ্ন ওঠে না। গোয়ালঘরটি এখনো টিকে আছে। সেখানে যাওয়া যায়। কিন্তু বাতাসের বেগ এখনো কমে নি। সেই নড়বড়ে চালা কখন মাথার উপর পড়ে তার ঠিক কি? সে পরীবানুকে কোলে নিয়ে তার স্বশুরের হাত ধরে দাঁড়িয়ে রইল। মীর আলি ভাঙা গলায় চেঁচাতে লাগল, বদি, বদি রে, ও বদিউজ্জামান।

বদিউজ্জামানের চোখ জবাফুলের মতো লাল। এখন আর তার আগের মতো কষ্টবোধ হচ্ছে না। পানিতে দাঁড়িয়ে থাকতে তার ভালোই লাগছে। ঝড়বৃষ্টির সময় সে নিজের মনে খানিকক্ষণ হেসেছে। কেন হেসেছে সে জানে না। কোনো কারণ ছাড়াই হাসি এসেছে। বদিউজ্জামানের ভয়ও কমে এসেছে। কিছুক্ষণ আগে একটি শেয়াল এসে তার দিকে তাকিয়ে ছিল। সে বেশ শব্দ করেই বলেছে, যাহ্ যাহ্। এই শেয়ালটি আবার এসেছে। মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাকে দেখছে। অন্ধকার হয়ে আসছে। টকটকে লাল চোখ নিয়ে বদিউজ্জামান তাকিয়ে আছে শেয়ালটির দিকে। তার ভালোই লাগছে। গিগিটিটি দুপুরের পর থেকেই নেই। বদিউজ্জামানের খুব নিঃসঙ্গ লাগছিল। এখন আর লাগছে না।

মাগরেবের নামাজ আদায় করতে চার-পাঁচ জল মুসল্লি গিয়েছিল মসজিদে। আজানের পরপরই কয়েকটি গুলির শব্দ হওয়ায় তারা নামাজ আদায় না-করেই ফিরে এল। ফেরার পথে তাদের মনে হল কাজটা ঠিক হল না। এতে আল্লাহর গজব পড়ার সম্ভাবনা। তারা আবার মসজিদে ফিরে গেল। নামাজ পড়ল। মসজিদ থেকে বেরুবার সময় দেখল রাস্তায় মিলিটারি। তারা আবার মসজিদে ফিরে গেল। রাত কাটাল সেখানেই।

সন্ধ্যার পর গ্রামের কোথাও কোনো বাতি জ্বলল না। চারদিক অন্ধকারে সবাই বসে রইল। কোনো সাড়াশব্দ নেই, শুধু কৈবর্তপাড়ায় কেউ যেন সুর করে কাঁদছে। সেই সুরেলা কান্না ভেসে আসছে অনেক দূর পর্যন্ত। চিত্রা বুড়ি বসে আছে কৈবর্তপাড়ায়। তাকে কেউ কিছু বলছে না। চিত্ৰা বুড়িও কাঁদছে। হাউমাউ করে কান্না।

বলাই কোনোখানেই বেশিক্ষণ থাকতে পারছে না। সারাক্ষণই তার মনে হচ্ছিল এই বুঝি তাকে ধরতে আসছে। সে অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই বেশ কয়েক বার জায়গা বদল করল। বেশি দূর কখনো গেল না। সেনবাড়ি, সেনবাড়ির মন্দির—এর মধ্যেই তার ঘোরাফেরা। সন্ধ্যা মেলাবার পর সে চিলেকোঠার লোহার সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে গেল। ছাদে আধ হাতের মতো পানি জমে আছে। সে বসে রইল পানির মধ্যে। বেশ কিছুক্ষণ তার ভালোই কাটল। তারপরই মনে হতে লাগল লোহার সিঁড়িতে যেন শব্দ হচ্ছে। মিলিটারিরা উঠে আসছে। সিঁড়ি কাঁপছে। তারপর আবার সব চুপচাপ। কেউ আসে নি—মনের ভুল। বলাইয়ের নিঃশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে গেল। আবার মনে হল কেউ আসছে। সিঁড়ি কাঁপছে। বলাই দ্রুত নিঃশ্বাস নিতে থাকল।

ঝড়ের সময় এক জন মিলিটারি সুবাদার ও তিন জন রাজাকারের একটি দল ছুটতে ছুটতে সফরউল্লাহ্র চালাঘরে এসে উঠেছিল। সফরউল্লাহ বাড়িতে ছিল না। মেয়েছেলেদের গ্রাম থেকে দূরে সরিয়ে নেবার কোনো ব্যবস্থা করা যায় কি না এ নিয়ে সে আলাপ করতে গিয়েছিল জয়নাল মিয়ার সঙ্গে।

ওরা সফদরউল্লাহর ঘরে ঢুকেই টর্চ টিপল। সেই টর্চের আলো পড়ল জড়সড় হয়ে বসে থাকা সফরউল্লাহর স্ত্রী ও তার ছোট বোনের মুখে। ছোট বোনটির বয়স বার। মিলিটারি সুবাদার মুগ্ধ কণ্ঠে বলল—এ-রকম সুন্দর মেয়ে সে কাশ্মিরেই শুধু দেখেছে। বাঙালিদের মধ্যে এ-রকম সুন্দর দেখে নি। সে খুবই সহজ ভঙ্গিতে এগিয়ে এসে বার বছরের মেয়েটির বুকে হাত রাখল। ঝড়ের জন্যে এই দু বোনের চিৎকার কেউ শুনতে পেল না।

মেয়েদের গ্রামের বাইরে পাঠিয়ে দেবার ব্যাপারে জয়নাল মিয়ার অভিমত হল-এর কোনো দরকার নাই। হিন্দু মেয়েদের কিছুটা ভয় থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু মুসলমান মেয়েদের কোনো ভয় নাই। জয়নাল মিয়া দৃঢ় স্বরে বলল, মুসলমানের শইলে এরা হাত দেয় না। এই গ্রামে যে তিনটা মানুষ মারা গেছে, এর মধ্যে মুসলমান কেউ আছে? কও তোমরা, আছে?

কথা খুবই সত্যি। জয়নাল মিয়া নিচু স্বরে বলল, মুসলমানের সঙ্গে ব্যবহারও খুব বালা। মীর আলি চাচারে মেজর সাব সালাম দিছে। বিশ্বাস না হইলে জিগাইয়া আও।

এই কথাটিও সত্যি। তবু মতি বলল, ঘরের মেয়েছেলেরা বড় অস্থির হইয়া পড়ছে। জয়নাল মিয়া দৃঢ়স্বরে বলল, রাইত-দুপুরে এইভাবে টানটানি করার কোনো দরকার নাই। যাও, তোমরা বাড়িত গিয়া আল্লাহ্-খোদার নাম নেও। ফি আমানিল্লাহ্। ভয়ের কিছু নাই।

যে অল্প ক জন এসেছিল তারা ঝড়ের মধ্যেই চলে গেল। ঝড় থামবার পর জয়নাল মিয়ার কাছে খবর এল—মেজর সাহেব তার সঙ্গে দেখা করতে চান। সে যেন দেরি না করে। জয়নাল মিয়া ভীত স্বরে বলল, যাও, গিয়া বল, আমি আসছি। বাঙালি রাজাকারটি বিরক্ত মুখে বলল, আমার সাথে চলেন। সাথে যাইতে বলছে।

সফরউল্লাহর বাড়ির সামনে এসে জয়নাল মিয়ার মনে হয় ভেতরের বাড়িতে মেয়েছেলে কাঁদছে। সফরউল্লাহ্উঠোনে বসে আছে। জয়নাল মিয়া জিজ্ঞেস করল, কী হইছে? সফরউল্লাহ জবাব দিল না।

কান্দে কে?

সফরউল্লাহ্ সেই প্রশ্নেরও জবাব দিল না। সঙ্গের রাজাকারটি জয়নাল মিয়ার পিঠে ঠেলা দিয়ে বলল, তাড়াতাড়ি হাঁটেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *