০৯. হ্যালো মতিন

হ্যালো মতিন,

তোর সর্বশেষ চিঠিতে জানলাম তুই বিয়ে করতে যাচ্ছিস। কনের নাম তৌ। এমন অদ্ভুত নামের মেয়ে তুই জোগাড় করলি কোত্থেকে? নাম শুনেই মেয়েটিকে রহস্যময় মনে হচ্ছে। আচ্ছা, ওর নাক কি চাপা? উপজাতীয় মেয়েদের এরকম এক অক্ষরের নাম হয়? তোর তৌ কি এরকম কেউ?

চিঠি যখন পাবি তখন আমার হিসেব মতো তোদের বিয়ে হয়ে গেছে। তবে তোর বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছুই বলা যায় না। তোকে যতটুকু চিনি তুই বিবাহ করিয়া সুখে ঘর-সংসার করিতে লাগিল টাইপ না। নদ্দিউ নতিম সাহেব কি বিবাহ করেছিলেন? ভালো কথা, নদ্দিউ নতিম সাহেবের। নতুন কিছু কি বের হচ্ছে? এসেছে কোনো আইডিয়া? তুই তৌকে নিয়ে (যদি বিয়ে সত্যি সত্যি হয়ে গিয়ে থাকে) আমার এখানে হানিমুন করতে চলে আয়। দুজনে মিলে Tree house-এ থাকবি। গাছের উপর থেকে পৃথিবী দেখবি। গাছ-ঘরে কাগজ-কলম দেয়া থাকবে। তুই নতুন প্রবন্ধ ফাদবি–নদ্দিউ নতিমের বৃক্ষজীবন। তবে শোন, আমার এখানে এলে কিন্তু ফিরে যেতে পারবি না। One way ticket. এখানেই থেকে যাবি। শুরু হবে আমাদের জঙ্গল জীবন।

এখন বলি আমার খবর। মাসি-পিসি পুরোপুরি পোষ মেনে গেছে। এরা নির্বিকার ভঙ্গিতে আমার ঘরে ঢোকে। জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করে। ধমক দিলে বিরক্ত হয়ে তাকায়। আমার কিছু কথাবার্তা বুঝতেও পারে। যেমন আমি যখন বলি–Get lost. ওরা ঘর ছেড়ে চলে যায়। যদি ডাক দেই মাসি। মাসি উঁকি দেয়। পিসি বললে পিসি উঁকি দেয়। একদিন পিসির হাতে একটা ভেজা টাওয়েল দিয়ে বললাম, তারের উপর শুকাতে দিয়ে আস। বলে তারের দিকে ইশারা করলাম। সে ঠিকই ভেজা টাওয়েল শুকাতে দিল। ব্যাপারটা কাকতালীয় হতে পারে। আবার এও হতে পারে যে, এদের যথেষ্ট বুদ্ধি-শুদ্ধি আছে! একজন ভালো ট্রেইনার পেলে কাজ হতো, ওদের শেখাতে পারত। মাসির শেখার আগ্রহ তেমন নেই, তবে পিসির আছে।

মাসি-পিসি প্রসঙ্গ শেষ। এখন আসি হস্তীশাবক প্রসঙ্গে। আমাদের এখানে মাঝেমধ্যেই বার্মার ঘন জঙ্গল থেকে হাতির পাল আসে। বিষয়টা আনন্দময় না, ভীতিকর। বন্যহাতি ভয়ঙ্কর প্রাণী। এরকম একটা হাতির পাল খাগরাছড়িতে এসেছিল। এরা চলে যাবার পর দেখা গেল একটা হাতির বাচ্চা ফেলে চলে গেছে। হাতির পাল এই কাজ কখনো করবে না। এরা শিশু ফেলে চলে যাবে না। তারা কাজটা করল, কারণ হাতির বাচ্চার পা কী কারণে যেন। ভেঙে গেছে। তার হাঁটার ক্ষমতা নেই।

আমি হাতির বাচ্চাটাকে নিয়ে এসেছি। বান্দরবান থেকে পশুডাক্তার আনিয়ে হাতির পায়ে প্লাস্টার করানো হলো। পশুডাক্তার বললেন, কোনো লাভ হবে না, হাতি-ঘোড়ার পা ভাঙলে সারে না। তারা ভাঙা পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে চায় বলে পা কখনো জোড়া লাগে না। আমি দড়ি দিয়ে হাতির বাচ্চাটাকে এমনভাবে বাঁধার ব্যবস্থা করলাম যেন উঠে দাঁড়াতে না পারে। তার জন্যে দৈনিক বিশ লিটার দুধ বরাদ্দ। করা হলো। এর মধ্যে একরাতে ভয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটল। শো শো শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। দরজা খুলে বাইরে এসে দেখি হাতির বাচ্চার কাছে পাহাড়ের মতো কী যেন দাঁড়িয়ে আছে। দুপা এগিয়ে থমকে গেলাম। পর্বত সদৃশ জিনিসটা যে হাতি তা বুঝতে পেরে কলিজা শুকিয়ে গেল। আমার ধারণা এটা বাচ্চা হাতিটার মা। গন্ধ শুকে শুকে চলে এসেছে। এ কী করবে কে জানে? তার সন্তানকে বেঁধে রেখেছি, এই অপরাধে সে অনায়াসেই চারদিক লণ্ডভণ্ড করে আমাকে পায়ের নিচে ফেলে মেরে ফেলতে পারে। হাতি যত বুদ্ধিমানই হোক তার বোঝার কথা না যে আমি তার সন্তানের মঙ্গলের কারণেই তাকে বেঁধে রেখেছি।

তুই লেখকমানুষ। দৃশ্যটা কল্পনা কর। আমি একটা বন্য হাতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি। আকাশে চাঁদ। চাঁদের আলোয় সবকিছু রহস্যময় মনে হচ্ছে। বাচ্চা হাতিটাকে হাতি শুড় দিয়ে আদর করছে। পশুর আদরের এই দৃশ্য। থেকেও চোখ ফিরিয়ে নিতে পারছি না। অথচ আমার উচিত দ্রুত কোনো নিরাপদ জায়গায় চলে যাওয়া।

মা-হাতিটা পনেরো বিশ মিনিট থেকে জঙ্গলের দিকে চলে গেল। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। এখন মা হাতিটা রোজই রাতে একবার করে আসছে। আমি একবার চেষ্টা করলাম কাছে যেতে। মা-হাতি বিকট গর্জন করল, আমি তৎক্ষণাৎ পিছিয়ে এলাম। হস্তী এবং হস্তীশাবকের এই অদ্ভুত দৃশ্য তুই এসে দেখে যা। তুই লেখকমানুষ, তোর দেখায় কাজ হবে। আমি জংলিমানুষ, আমার দেখা না-দেখা একই।

এখন তোকে কিছু ভালো খবর দেয়া যাক। তিন হাজার কফির চারা লাগিয়েছিলাম। দুইশ নষ্ট হয়েছে। বাকিগুলোর অবস্থা বেশ ভালো। বৃষ্টির পানি পেয়ে তরতর করে উঠছে। দেখলেই মন ভরে যায়। তোকে একবার বলেছিলাম না। আমার এলাকায় লেকের মতো জায়গা আছে। শীতের সময় তেমন পানি থাকে না, বর্ষায় পানি আসে। এই লেক কানায় কানায় পূর্ণ। আমি কোনো মাছ ছাড়ি নি, তারপরেও প্রচুর মাছ। মাছ কোত্থেকে এসেছে কে জানে।

আমি লেকটার নাম দিয়েছি আমজাদ লেক। আমজাদ স্যারকে তোর মনে আছে না? স্কুলের অঙ্ক স্যার। আমাকে খুবই আদর করতেন। ক্লাসে ঢুকে অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলতেন। একটা কথা এখনো কানে ভাসে। ক্লাসে এসে বললেন–যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগের অঙ্ক হলো নকল অঙ্ক। আসল অঙ্ক অন্যখানে। সেই অঙ্ক ঠিকমতো করবি। আমি বললাম, স্যার, আসল অঙ্কটা কী?

স্যার বললেন, তুই একজনের জন্যে ভালো কিছু করলি, কিছু যোগ হলো। মন্দ করলি বিয়োগ হয়ে গেল। আবার খুব ভালো কিছু করলি হয়ে গেল গুণ… মৃত্যুর সময় যদি দেখা যায় ফলাফল শূন্য তাহলে বড়ই আফসোস। শূন্য ফলাফল হবে পশু-পাখির। মানুষকে শূন্য করলে চলবে না। মানুষ তো পশু না।

এসএসসি পরীক্ষার ফিস-এর টাকা জোগাড় হলো না বলে আমি লজ্জায় দুঃখে বাড়ি চলে গেলাম। এক ভোরবেলায় স্যার বাড়িতে এসে উপস্থিত। আমাকে বললেন, তোর ফিস-এর টাকা জোগাড় হয় নাই বলে তুই পালিয়ে বাড়িতে চলে এসেছিস? আমাকে বলবি না? তোর শাস্তি হচ্ছে, আমি তোকে কানে ধরে নিয়ে যাব। স্যার তাই করলেন। গয়নার নৌকায় আমরা যাচ্ছি, স্যার আমার কানে ধরে আছেন। লোকজন জিজ্ঞেস করে, ঘটনা কী? স্যার গম্ভীর গলায় বলেন, শাস্তি দিচ্ছি। আমার ছাত্র। অতি দুষ্ট।

মতিন, তুই নদ্দিউ নতিম সাহেবকে বল না, আমার স্যারকে নিয়ে একটা কবিতা লিখতে। কবিতাটা আমি শ্বেতপাথরে লিখে আমজাদ লেকের একপাশে বাঁধিয়ে দেব।

তুই ভালো থাকিস। আমার শরীরটা ভালো না। ম্যালেরিয়া হয়েছে। পাহাড়ি ম্যালেরিয়া খুব খারাপ জিনিস।

ইতি
কঠিন গাধা

পুনশ্চ : তোর লেখা নদ্দিউ নতিম সাহেবের আত্মজীবনী ইংরেজিতে অনুবাদ করছি। তোর এই লেখা একটি মহৎ সাহিত্যকর্ম হয়েছে সে-জন্যে না। রাতে আমার তেমন কিছু করার থাকে না। তবে অনুবাদ করে আরাম পাচ্ছি। লেখার শিরোনাম দিয়েছি। Autobiography of a Fictitious Poet. নামটার মধ্যে নীরোদ সি চৌধুরী গন্ধ আছে (Autobiography of an unknown Indian, পড়েছিস না?)। গন্ধ থাকুক। শিরোনাম আমার পছন্দ হয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *