হেলেনা ভিজিটার্স রুমে ঢুকে একটু অবাক হলেন।
ফখরুদিন সাহেব বসে আছেন। তার হাতে জ্বলন্ত চুরুট। হেলেনা অবশ্যি তার বিস্ময় গোপন
করলেন। সহজ স্বরে বললেন, কেমন আছ?
খুব ভাল।
চুরুট টানছ? স্মোকিং এখানে নিষিদ্ধ। দেয়ালে লেখা চোখে পড়েনি?
পড়েছে। দেয়ালে লেখা ধূমপান না করার জন্যে অনুরোধ করছি। আমি অনুরোধটা রাখলাম ना। হা হা হা।
তোমার কী শরীর খারাপ?
না, শরীর বেশ ভালই আছে।
কোথায় ডুব দিয়েছিলে?
আশপাশে ছিলাম। তোমার অবস্থা কি?
ভাল।
কী-রকম ভাল?
বেশ ভালো। অপারেশনটা লাগবে না। ইচ্ছা করলে দেশে ফিরে যেতে পারি।
ইচ্ছা করছে?
হেলেনা জবাব দিলেন না। ফখরুদ্দিন সাহেব বললেন, এই মুহূর্তে দেশে ফিরতে পারছি না। এখানে আমার কিছু কাজ আছে। কাজ শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
ক’দিন লাগবে কাজ শেষ হতো?
দিন দশেক লাগবে।
কি কাজ?
ফখরুদ্দিন সাহেব এ-প্রশ্নের জবাব দিলেন না। ডাক্তাররা তার শরীরটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে চায়। দিন দশেক সময় এই কারণেই তারা চাচ্ছে। হেলেনাকে তা বলার তিনি কোনো প্রয়োজন বোধ করছেন না। আজ যে হাসপাতাল থেকে বের হয়েছেন, সেও বহু কষ্টে। বলে এসেছেন। দুঘণ্টার মধ্যে ফিরবেন। তাও সম্ভব হবে কি না কে জানে? দুঘণ্টার এক ঘণ্টা তো এখনই শেষ।
হেলেনা।
বল।
চল, একটু হেঁটে আসি।
কোথায় হাঁটবে?
এই বাগানেই হাঁটব। বেশি দূর যাব না। তোমার হাঁটাহঁটিতে কোনো বাধা নেই তো?
না, নেই।
গুড। গায়ে ওভারকোট জাতীয় কিছু একটা চাপিয়ে এস।
ছবির মতো সুন্দর বাগান। এত সুন্দর যে কৃত্রিম মনে হয়। বড় বেশি সাজানো। ফখরুদ্দিন সাহেব মাঝে মাঝে কাশছেন, কিন্তু কোনো কথাই বলছেন না। হেলেনা হঠাৎ বললেন, তুমি যে খুব অসুস্থ, একটা হাসপাতালে আছ, এই খবর কিন্তু আমি জানি।
জানলে তো ভালই।
অন্যের কাছ থেকে জানতে হল।
ফখরুদিন সাহেবের চুরুট নিভে গিয়েছিল, অনেক কায়দা করে সেটা ধরাতে হল। তিনি কিছু বললেন না।
আমাকে খবরটা না জানানোর পেছনে তোমার যুক্তিগুলি কি, একটু বল তো শুনি।
কোনো যুক্তি নেই। এস, কোথাও একটু বসা যাক। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে।
তারা বসলেন। হেলেনা মৃদু স্বরে বললেন, এখনো কি তুমি বিশ্বাস কর, টাকা দিয়ে সব পাওয়া যায়?
হ্যাঁ, করি।
মানুষ হিসেবে তুমি কি সুখী?
হ্যাঁ, সুখী। তোমার মত বানানো দুঃখ-কষ্ট আমার নেই। আমার বুদ্ধিবৃত্তি নিম্নস্তরের। আমার মত মানুষের কোনো কাল্পনিক দুঃখ-কষ্ট থাকে না। ঐ সব থাকে খুব উচ্চমার্গের লোকদের।
আমার কিন্তু ধারণা, তুমি খুব দুঃখী মানুষ।
তাই নাকি? ভেরি ইন্টারেস্টিং।
তুমি যে খুব দুঃখী, এটা তুমি নিজেও জানো।
ফখরুদ্দিন সাহেব চুরুটটা ছুড়ে ফেললেন। ঢালু জায়গা পেয়ে চুরুটটা গড়াতে গড়াতে নিচে নামছে। সেই দিকে তাকিয়ে বিদ্যুতের মতো তার মাথায় এল, মানুষের জীবনও কি এ-রকম গড়িয়ে যাওয়া নয়? কেউ কিছু দূর গিয়ে আটকে যায়, আবার কেউ যেতেই থাকে। এমন কিছু উচ্চশ্রেণীর দার্শনিক চিন্তা নয়, তবু ফখরুদিন সাহেবের বেশ ভাল লাগছে। তিনি পকেট থেকে আরেকটি চুরুট বের করে গড়িয়ে দিলেন। হেলেনা বললেন, কি করছ?
এক ধরনের খেলা, তুমি বুঝবে না?
না-বোঝারই কথা। তোমার বেশির ভাগ কাজকর্মই আমি বুঝি না।
তুমি কি করে বুঝবে বল, আমি নিজেই বুঝি না।
বলতে বলতে ফখরুদিন সাহেব খুব হাসলেন। হাসতে-হাসতে তার চোখে পানি এসে গেল। তিনি পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছলেন। হেলেনা বললেন, তোমার অসুখটা কী?
জানি না, কি। ডাক্তাররা জানার চেষ্টা করছে। কেন জানি মনে হচ্ছে, ডাক্তাররা খুঁজে খুঁজে একটা খারাপ অসুখই বের করবে। রাজকীয় কোনো অসুখ। ডায়রিয়া বা আমাশার মত অসুখে আমাকে মানাবে না; এইসব হচ্ছে ভিখিরিদের অসুখ। আমি কী ভিখিরি? হা হা হা।
লন্ডনের আকাশ আজ ঘন নীল। বাতাস মধুর। রোদের রঙ কাঁচা সোনার মত। অদ্ভুত সুন্দর একটি দিন। ফখরুদিন সাহেব এমন চমৎকার একটি দিনেও খানিকটা বিষন্ন হলেন। সুনীল আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। হেলেনা বললেন, আজ তুমি অপালার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলো।
কেন বল তো?
ওর বোধহয় খুব মন-খারাপ। কি-একটা দুঃস্বপ্ন দেখে খুব কেঁদেছে। আমাকে বলতে বলতে ও কাদাল।
কী দুঃস্বপ্ন?
একটা ছোট্ট মেয়ে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে, এইসব কি হাবিজাবি!
দুঃস্বপ্নটা কী, তা তো বুঝলাম না। রাক্ষস-খোক্ষস স্বপ্নে দেখলেও না হয় কথা ছিল। ছোট্ট মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে তো কী হয়েছে?
হেলেনা ক্লান্ত গলায় বললেন, মাঝে মাঝে সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন দেখেও মানুষ ভয় পায়। তুমি ওর সঙ্গে কথা বলবে।
আমি এক্ষুণি টেলিফোন করছি।
ফখরুদিন সাহেব উঠে দাঁড়ালেন।