৯
হুইল চেয়ারে যে-বৃদ্ধা বসে আছেন তাঁর চেহারা এই বয়সেও অত্যন্ত সুন্দর। গায়ের রঙ দুধে-আলতায় বলে যে-কথাটি প্রচলিত আছে ভদ্রমহিলাকে দেখে তা সত্যি মনে হয়। মাথার চুল লম্বা এবং সাদা। ধবধব করছে। ধবধবে সাদা চুলেরও যে আলাদা সৌন্দর্য আছে, তা এই বৃদ্ধাকে দেখে বোঝা যায়। বৃদ্ধার হুইল চেয়ার ধরে যে—মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে তার গায়ের রঙ শ্যামলা হলেও সুশ্রী। এই মেয়েটির নামই সালেহা। কাজের মেয়ে বলে তাকে মনে হয় না। মাথায় ঘোমটা দেওয়া বলে সালেহাকে কেমন বৌ-বৌ মনে হচ্ছে।
মিসির আলি বৃদ্ধার সামনে বসতে-বসতে বললেন, ‘আপনি কেমন আছেন?’
বৃদ্ধা নরম গলায় বললেন, ‘বাবা, আমি ভালো আছি। এই বয়সে বেঁচে থাকাই ভালো থাকা।
‘আমি আমার পরিচয় দিয়ে নিই, আমার নাম মিসির আলি…..’
‘আপনাকে পরিচয় দিতে হবে না বাবা। আপনি কে আমি জানি। এখানে কি জন্যে আছেন তাও নাদিয়া বলেছে।’
‘দু’-একটা প্রশ্ন করব, যদি কিছু মনে না করেন।
‘কিচ্ছু মনে করব না। আপনি যত ইচ্ছা প্রশ্ন করেন। সব প্রশ্নের জবাব ঠিকমতো দিতে পারব কি না তাও তো জানি না—বয়স হয়ে গেছে, ঠিকমতো গুছিয়ে কিছু বলতে পারি না।’
‘এই বাড়িতে আপনি কত দিন ধরে আছেন?’
‘অনেক দিন। তা ধর কুড়ি বছর। তুমি করে বলে ফেলেছি বাবা। ভুল হয়ে গেছে।’
‘কোনো ভুল হয় নি। আপনি আমাকে তুমি করে বলুন। কিচ্ছু অসুবিধা নেই। আপনি তাহলে কুড়ি বছর ধরে এদের সঙ্গে আছেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘এরা মানুষ কেমন?’
বৃদ্ধা হাত ইশারা করে সালেহা মেয়েটাকে চলে যেতে বললেন। সালেহা চলে গেল। যাবার সময় দরজা ভেজিয়ে দিয়ে গেল। বৃদ্ধা গলার স্বর নিচু করে বললেন, ‘নাদিয়া মেয়েটা খুব ভালো। একটু পাগল ধরনের। রাতে ঘুমায় না, সিগারেট খায়। কিন্তু বড় ভালো, মেয়ে। অন্তরটা বিরাট বড়।’
‘মেয়ের বাবা-মা সম্পর্কে আপনার কী ধারণা?’
‘ওরা মন্দও না আবার ভালোও না। ভালো-মন্দে মেশানো। কিন্তু নাদিয়া মেয়েটার মধ্যে মন্দের ভাগ খুব সামান্য। এই রকম সচরাচর দেখা যায় না। নিজের ছেলেমেয়েরা আমাকে দেখে না, কিন্তু পরের মেয়ে নাদিয়া আমাকে দেখে। একবার জ্বর হল—এক শ’ চার। জ্বরে অচেতন হয়ে গেলাম। জ্ঞান ফিরলে দেখি এই মেয়ে আমার মাথায় পানি ঢালছে। চিন্তা কর বাবা—কোটিপতি বাবার মেয়ে। তার মুখের হুকুমে দশজন লোক ছুটে আসবে। সে কিনা মাথায় পানি ঢালে!’
‘আপনার ছেলেমেয়ে ক’জন?’
‘তিন ছেলে, দুই মেয়ে। বড় ছেলেটা বাহরাইনে ড্রাইভারের চাকরি নিয়ে গিয়েছিল। আর ফিরে আসে নাই। তার কোনো খোঁজখবরও জানি না। ছোটটা থাকে তার বোনের কাছে চিটাগাং। গুণ্ডামি বদমায়েশি এইসব করে। মেজো ছেলেটাকে তো বাবা তুমি দেখেছ। আব্দুল মজিদ।’
মিসির আলি বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘আব্দুল মজিদ আপনার ছেলে?’
‘হ্যাঁ বাবা। আমি জানি সে তোমাকে বলে নাই যে আমি তার মা। কাউকেই বলে না। বাপ-মা’র পরিচয় দিতে লজ্জা পায়। আমার ছেলেটা ভালো, তবে বোকা ধরনের। বোকা বলেই ভালো। বয়স তো আমার কম হয় নাই। আমি দেখেছি এই জগতে বোকারাই ভালো।’
‘বোকা বলছেন কেন? আমার কাছে তো বোকা মনে হয় না।’
‘তুমি দূর থেকে দেখেছ, এই জন্যে তোমার কাছে বোকা মনে হয় না। আসলে বোকা।’
‘এই বাড়িতে একটা বাচ্চা ছেলে মারা গিয়েছিল, আপনার মনে আছে?’
‘হ্যাঁ, মনে আছে।’
‘কি ব্যাপার বলুন তো।’
‘ঐ ব্যাপারে কিছু বলতে চাই না বাবা। ঐটা একটা অ্যাকসিডেন্ট। এই দুনিয়ায় অ্যাকসিডেন্ট তো হয়। ছেলের নিয়তি ছিল ভয় পেয়ে মৃত্যু—তাই হয়েছে। নিয়তিকে গালাগাল দিয়ে তো লাভ নাই। কারণ আল্লাহ্পাক বলেছেন—নিয়তিকে গালি দিও না, কারণ আমিই নিয়তি।’
‘পরবর্তী সময়ে যে দেখা গেল বাথরুম আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে যায়, এই সম্পর্কে আপনার ধারণা কী?’
‘মনের ভুল। দরজা হয়তো একটু শক্ত হয়ে লাগে। এম্নি ভয় পেয়ে চিৎকার শুরু করে। কথায় আছে না—বনের বাঘে খায় না, মনের বাঘে খায়? মনের বাঘটাই বড়।’
‘আপনার বেলায় কখনো এই জাতীয় কিছু ঘটে নি?’
‘না।’
‘সালেহা, ঐ মেয়েটির কি এ-রকম অভিজ্ঞতা হয়েছে?’
‘একবার নাকি হয়েছে। চিৎকার, হৈচৈ। বাথরুমের দরজা ভেতর থেকে খুলতে পারে না। আমি হুইল চেয়ারে করে গেলাম। ধাক্কা দিতেই দরজা খুলল। দরজা খুলে দেখি অচেতন হয়ে পড়ে আছে। দাঁতে দাঁতে লেগে জিহ্বা কেটে বিশ্রী অবস্থা! ঐ যে বললাম মনের বাঘ। তাকেও ধরেছে মনের বাঘে। তুমি কি নিজে মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করতে চাও?’
‘না, চাই না।’
‘না-চাওয়াই ভালো। জিজ্ঞেস করার আসলে কিছু নাই। ভয় পাওয়া এই বাড়ির মানুষের একটা রোগ হয়ে গেছে।’
মিসির আলি উঠে দাঁড়ালেন। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় দেখা হল নাদিয়ার সঙ্গে। তিনি আজও টিয়াপাখি রঙের একটা শাড়ি পরেছেন। সবুজ রঙের প্রতি এই মেয়েটির খুব দুর্বলতা। নাদিয়া থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘তদন্ত এগুচ্ছে?’
‘হ্যাঁ, এগুচ্ছে।’
‘আমার ফুপুর সঙ্গে কথা বলে এলেন?’
‘হ্যাঁ। উনি আপনার কেমন ফুপু?
‘সম্পর্ক বেশ দূরের, তবে দূরের হলেও নিকট আত্মীয় বলতে উনিই আছেন।’
‘আপনাকে খুব স্নেহ করেন বলে মনে হল।’
‘তা করেন। বেশ স্নেহ করেন। উনি আবার খুব চমৎকার গল্প বলতে পারেন। আমি এত সুন্দর করে গল্প বলতে কাউকে শুনি নি। আপনার তদন্তের ঝামেলা শেষ হলে একবার ওঁর গল্প শুনে যাবেন।’
‘তাঁর ছেলেটি সম্পর্কে আপনার কী ধারণা?
‘আব্দুল মজিদের কথা বলছেন? বিরাট বোকা। সে বয়সে আমার বড়, কিন্তু প্ৰতি ঈদে সেজেগুজে এসে আমার পা ছুঁয়ে সালাম করবে। ও আপনার খাতির—যত্ন করছে তো? আপনার দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়েছি ওর ওপর।
‘ও যত্ন করছে। ভালোই যত্ন করছে।’
‘বাড়াবাড়ি রকমের যত্ন দিয়ে সে যদি আপনাকে বিরক্ত করে আমাকে বলবেন। আমি ধমক দিয়ে দেব। ও নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে কিছু-কিছু কাজ করে, যা সহ্য করা যায় না। একবার কী করেছে শুনুন—কোত্থেকে এক মৌলানা সাহেবকে ধরে নিয়ে এসেছে। মৌলানা সাহেব নাকি দোয়া পড়ে এই বাড়ির জিন তাড়াবেন। লম্বা কোর্তা পরা মৌলানা। প্রতিটি বাথরুমে ঢুকছে আর কি দোয়া-কালাম পড়ছে। দেখুন তো কী অস্বস্তিকর অবস্থা! বাথরুম কি দোয়া পড়ার জায়গা? আচ্ছা যাই, পরে কথা হবে। আপনার তদন্ত শেষ হতে কতদিন লাগবে?
‘বেশিদিন লাগবে না। প্রায় শেষ করে এনেছি।’
‘তদন্ত শেষ হলে আবার নিজের আস্তানায় ফিরে যাবেন?
‘তা তো বটেই।’
নাদিয়া হাসতে-হাসতে বললেন, ‘আপনি ইচ্ছা করলে কিন্তু তদন্ত শেষ হবার পরেও আমার এখানে থেকে যেতে পারেন। আপনাকে কেন জানি না আমার পছন্দ হয়েছে। কী কারণে পছন্দ হয়েছে তা অবশ্যি আমি নিজেও ধরতে পারছি না।’
নাদিয়া সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলেন। মেয়েটির চেহারায় আচার-আচরণে মিসির আলি শোকের কোনো ছাপ দেখলেন না। পিতার মৃত্যুশোক সে কাটিয়ে উঠেছে। মনে হয় ভালোভাবেই কাটিয়েছে।