হযরত উযায়র (আ)-এর বর্ণনা
ইব্ন আসাকির হযরত উযায়র (আ)-এর পূর্ব পুরুষদের বংশলতিকা নিম্নরূপ বর্ণনা করেছেন : উযায়র ইব্ন জারওয়া (ভিন্নমতে সুৱীক) ইব্ন আদিয়া ইব্ন আইয়ুব ইব্ন দারাযিন। ইব্ন আরী ইব্ন তাকী ইব্ন উসব ইব্ন ফিনহাস ইবনুল আযির ইব্ন হারূন ইব্ন ইমরান। কারও কারও বর্ণনায় উযায়র (আ)-এর পিতার নাম বলা হয়েছে। সারাখা। কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে উযায়র (আ)-এর কবর দামিশকে অবস্থিত। ইব্ন আসাকির … ইব্ন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, আমার জানা নেই, ঝর্ণাটা কি বিক্রি হয়েছে না বিক্রি হয়নি, আর উযায়র কি নবী ছিলেন নাকি নবী ছিলেন না।. আবু হুরায়রা (রা) থেকেও এরূপ বর্ণিত হয়েছে। ইসহাক ইব্ন বিশর… ইব্ন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, বুখত নসর যাদেরকে বন্দী করে নিয়েছিল, তাদের মধ্যে উযায়রও ছিলেন। তখন তিনি ছিলেন একজন কিশোর। যখন তিনি চল্লিশ বছর বয়সে উপনীত হন। তখন আল্লাহ তাকে হিকমত (নবুওত) দান করেন। তাওরাত কিতাবে তার চাইতে বুৎপত্তিসম্পন্ন পন্ডিত আর কেউ ছিল না। অন্যান্য নবীদের সাথে তাকেও নবী হিসেবে উল্লেখ করা হত। কিন্তু যখন তিনি আল্লাহর নিকট তার ক্ষমতা সম্পর্কে প্রশ্ন করেন তখন তার নবুওত প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। কিন্তু এ বর্ণনাটি দুর্বল। সূত্র পরম্পরা বিচ্ছিন্ন ও অগ্রহণযোগ্য।
ইসহাক ইব্ন বিশর……আবদুল্লাহ ইব্ন সালাম (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, উযায়র হলেন আল্লাহর সেই বান্দা, যাকে তিনি একশ বছর মৃত অবস্থায় রেখে পুনরায় জীবিত করেছিলেন। ইসহাক ইব্ন বিশর বলেন, বিভিন্ন সূত্রে ইব্ন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, উযায়র ছিলেন একজন জ্ঞানী ও পুণ্যবান লোক। একদা তিনি তার ক্ষেত-খামার ও বাগ-বাগিচা দেখার জন্যে ঘর থেকে বের হন। সেখান থেকে প্রত্যাবর্তনকালে দ্বিপ্রহরের সময় একটা বিধ্বস্ত বাড়িতে বিশ্রাম নেন। তাঁর বাহন গাধার পিঠ থেকে নিচে অবতরণ করেন। তার সাথে একটি ঝুড়িতে ছিল ডুমুর এবং অন্য একটি ঝুড়িতে ছিল আঙ্গুর। খাওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি একটি পেয়ালায় আঙ্গুর নিংড়িয়ে রস বের করেন এবং শুকনো রুটি তাতে ভিজিয়ে রাখেন। রুটি উক্ত রসে ভালরূপে ভিজে গেলে খাবেন, এই সময়ের মধ্যে বিশ্রামের উদ্দেশ্যে কিছু সময়ের জন্যে চিত হয়ে শুয়ে পড়েন এবং পা দুখানা দেয়ালের সাথে লাগিয়ে দেন। এ অবস্থায় তিনি বিধ্বস্ত ঘরগুলোর প্রতি লক্ষ্য করলেন, যার অধিবাসীরাও ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। তিনি অনেকগুলো পুরাতন হাড় দেখতে পেয়ে মনে মনে ভাবলেন, মৃত্যুব পর আল্লাহ কিরূপে এগুলোকে জীবিত করবেন? আল্লাহ যে জীবিত করবেন, এতে তার আদৌ কোন সন্দেহ ছিল না। এ কথাটি তিনি কেবল অবাক বিস্ময়ের সাথে ভেবেছিলেন। অতঃপর আল্লাহ মৃত্যুর ফেরেশতাকে পাঠিয়ে তাঁর রূহ কবজ করান এবং একশ বছর পর্যন্ত মৃত অবস্থায় রেখে দেন।
একশ বছর পূর্ণ হলে আল্লাহ উদ্যায়রের নিকট ফেরেশতা পাঠিয়ে দেন। এ দীর্ঘ সময়ে বনী ইসরাঈলের মধ্যে অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়ে গিয়েছিল এবং তার ধর্মের মধ্যে অনেক বিদ্যআতের প্রচলন করেছিল। যা হোক, ফেরেশতা এসে উযায়রের কালব ও চক্ষুদ্বয় জীবিত করলেন, যাতে কিভাবে আল্লাহ মৃতকে জীবিত করবেন তা স্বচক্ষে দেখেন ও অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করেন। এরপর ফেরেশতা উয্যায়রের বিক্ষিপ্ত হাড়গুলো একত্রিত করে তাতে গোশত লাগালেন, চুল পশম যথাস্থানে সংযুক্ত করলেন এবং চামড়া দ্বারা সমস্ত শরীর আবৃত করলেন। সবশেষে তার মধ্যে রূহ প্ৰবেশ করালেন। তার দেহ এভাবে তৈরি হচ্ছে তা তিনি প্ৰত্যক্ষ করছিলেন এবং অন্তর দিয়ে আল্লাহর কুদরত উপলব্ধি করছিলেন। উযায়র উঠে বসলেন। ফেরেশতা জিজ্ঞেস করলেন, আপনি এ অবস্থায় কতদিন অবস্থান করলেন? তিনি বললেন, এক দিন অথবা এক দিনেরও কিছু কম। এরূপ বলার কারণ হল, তিনি দ্বিপ্রহরে দিনের প্রথম ভাগে শুয়েছিলেন এবং সূর্যাস্তের পূর্বে উঠেছিলেন। তাই বললেন, দিনের কিছু অংশ, পূর্ণ দিন নয়। ফেরেশতা জানালেন, না, বরং আপনি একশ বছর এভাবে অবস্থান করেছেন। আপনার খাদ্য সামগ্ৰী ও পানীয় বস্তুর প্রতি লক্ষ্য করুন! এখানে খাদ্য বলতে তার শুকনা রুটি এবং পানীয় বলতে পেয়ালার মধ্যে আঙ্গুর নিংড়ানো রস বুঝানো হয়েছে। দেখা গেল এ দুটির একটিও নষ্ট হয়নি। রুটি শুকনা আছে এবং রস অবিকৃত অবস্থায় রয়েছে।
কুরআনে একেই বলা হয়েছে …. …, অর্থাৎ তা অবিকৃত রয়েছে। রুটি ও রসের মত তাঁর আঙ্গুর এবং ডুমুরও টাটকা রয়েছে। এর কিছুই নষ্ট হয়নি। উযায়র ফেরেশতার মুখে একশ বছর অবস্থানের কথা শুনে এবং খাদ্যদ্রব্য অবিকৃত দেখে দ্বিধা-দ্বন্দূের মধ্যে পড়ে যান, যেন ফেরেশতার কথা তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না। তাই ফেরেশতা তাকে বললেন, আপনি আমার কথায় সন্দেহ করছেন, তা হলে আপনার গাধাটির প্রতি লক্ষ্য করুন। উযায়র লক্ষ্য করে দেখলেন যে, তার গাধাটি মরে পচে গলে প্ৰায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। হাড়গুলো পুরাতন হয়ে যত্রতত্র বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে রয়েছে। অতঃপর ফেরেশতা হাড়গুলোকে আহবান করলেন। সঙ্গে সঙ্গে হাড়গুলো চতুর্দিক থেকে এসে একত্রিত হয়ে গেল এবং ফেরেশতা সেগুলো পরস্পরের সাথে সংযুক্ত করে দিলেন। উযায়র তা তাকিয়ে দেখছিলেন। তারপর ফেরেশতা উক্ত কংকালে রগ, শিরা-উপশিরা সংযোজন করেছেন। গোশত দ্বারা আচ্ছাদিত করেন এবং চামড়া ও পশম দ্বারা তা আবৃত করেন। সবশেষে তার মধ্যে রূহ প্রবেশ করান। ফলে গাধাটি মাথা ও কান খাড়া করে দাঁড়াল এবং কিয়ামত আরম্ভ হয়ে গিয়েছে ভেবে চীৎকার করতে লাগল।
আল্লাহর বাণী :
এবং তোমার গাধাটির প্রতি লক্ষ্য কর; কারণ তোমাকে মানব জাতির জন্যে নিদর্শনস্বরূপ করব। আর অস্থিগুলোর প্রতি লক্ষ্য কর, কিভাবে সেগুলোকে সংযোজিত করি এবং গোশত দ্বারা ঢেকে দেই। (২ ৪। ২৫৯)।
অর্থাৎ তোমার গাধার বিক্ষিপ্ত হাড়গুলোর প্রতি লক্ষ্য কর। কিভাবে সেগুলোকে গ্ৰন্থিতে গ্ৰন্থিতে সংযোজন করা হয়। যখন গোশতবিহীন হাড়ের কংকাল তৈরি হল তখন বলা হল, এবার লক্ষ্য কর, কিভাবে আমি এ কংকালকে গোশত দ্বারা আচ্ছাদিত করি। যখন তার নিকট এ বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে গেল তখন তিনি বলে উঠলেন, আমি জানি যে, আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান। মৃতকে জীবিত করাসহ যে কোন কাজ করতে তিনি সম্পূর্ণ সক্ষম।
অতঃপর উযায়র (আ) উক্ত গাধার পিঠে আরোহণ করে নিজ এলাকায় চলে যান। কিন্তু সেখানে কোন লোকই তিনি চিনতে পারছেন না; আর তাকেও দেখে কেউ চিনতে পারছে না। নিজের বাড়ি-ঘরও তিনি সঠিকভাবে চিনে উঠতে পারছিলেন না। অবশেষে ধারণার বশে নিজের মনে করে এক বাড়িতে উঠলেন। সেখানে অন্ধ ও পঙ্গু এক বৃদ্ধাকে পেলেন। তার বয়স ছিল একশ বিশ বছর। এই বৃদ্ধা ছিল উযায়র পরিবারের দাসী। একশ বছর পূর্বে তিনি যখন বাড়ি থেকে বের হয়ে যান, তখন এই বৃদ্ধার বয়স ছিল বিশ বছর এবং উযায়রকে সে চিনত। বৃদ্ধ বয়সে উপনীত হলে সে অন্ধ ও পঙ্গু হয়ে যায়। উযায়র জিজ্ঞেস করলেন, হে বৃদ্ধা! এটা কি উযায়রের বাড়ি? বৃদ্ধ বলল, হ্যাঁ, এটা উদ্যায়রের বাড়ি। বৃদ্ধা মহিলাটি কেঁদে ফেলল এবং বলল, এতগুলো বছর কেটে গেল, কেউ তার নামটি উচ্চারণও করে না, সবাই তাকে ভুলে গিয়েছে। উযায়র নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, আমিই সেই উদ্যায়র। আল্লাহ আমাকে একশ বছর মৃত অবস্থায় রেখে পুনরায় জীবিত করেছেন। বৃদ্ধ বলল, কী আশ্চর্য! আমরাও তো তাকে একশ বছর পর্যন্ত পাচ্ছি না, সবাই তার নাম ভুলে গিয়েছে, কেউ তাকে স্মরণ করে না। তিনি বললেন, আমিই সেই উযায়র। বৃদ্ধ বলল, আপনি যদি সত্যিই উযায়র হন, তা হলে উযায়রের দোয়া আল্লাহ। কবুল করতেন। কোন রোগী বা বিপদগ্রস্তের জন্যে দোয়া করলে আল্লাহ তাকে নিরাময় করতেন এবং বিপদ থেকে মুক্তি দিতেন। সুতরাং আপনি আমার জন্যে দোয়া করুন, আল্লাহ আমার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিলে আপনাকে দেখব এবং আপনি উযায়র হলে আমি চিনব। তখন উযায়র দোয়া করলেন এবং বৃদ্ধার চোখে হাত বুলিয়ে দিলেন। এতে তার অন্ধত্ব দূর হয়ে গেল।
তারপর তিনি বৃদ্ধার হাত ধরে বললেন, আল্লাহর হুকুমে তুমি উঠে দাঁড়াও ৷ সাথে সাথে তার পঙ্গুত্ব বিদূরিত হল, সে লোকের মত উঠে দাঁড়ালো। মনে হল সে বন্ধন থেকে মুক্তি লাভ করেছে। তারপর উদ্যায়রের দিকে তাকিয়ে দেখে বলে উঠল, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আপনিই উযায়র। এরপর ঐ বৃদ্ধা বনী ইসরাঈলের মহল্লায় চলে গেল। দেখল, তারা এক আসরে জমায়েত হয়েছে। সে আসরে উযায়রের এক বৃদ্ধ পুত্ৰও উপস্থিত ছিল, বয়স একশ আঠার বছর। শুধু তাই না, পুত্রদের পুত্ররাও তথায় উপস্থিত ছিল, তারাও আজ প্রৌঢ়। বৃদ্ধা মহিলা এক
এসেছেন। কিন্তু বৃদ্ধার এ কথা তারা হেসে উড়িয়ে দিল। তারা বলল, তুমি মিথু্যক। বৃদ্ধা নিজের পরিচয় দিয়ে বলল, আমি অমুক, তোমাদের বাড়ির দাসী। উযায়র এসে আমার জন্যে আল্লাহর নিকট দোয়া করেছেন। তিনি আমার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিয়েছেন এবং পঙ্গু পা সুস্থ করে দিয়েছেন। উযায়র বলেছেন, আল্লাহ তাকে একশ বছর মৃত অবস্থায় রেখে আবার জীবিত
করে দিয়েছেন। এ কথা শোনার পর লোকজন উঠে উযায়রের বাড়িতে গেল এবং তাকে ভাল করে দেখল। উদ্যায়রের বৃদ্ধ পুত্র বলল, আমার পিতার দুই কাঁধের মাঝে একটি কাল তিল ছিল। সুতরাং সে কাঁধের কাপড় উঠিয়ে তিল দেখে তাকে চিনতে পারল এবং বলল, ইনিই আমার পিতা উদ্যায়র। তখন বনী ইসরাঈলের লোকজন উযায়রকে বলল, আমরা শুনেছি আপনি ব্যতীত অন্য কোন লোকের তাওরাত কিতাব মুখস্থ ছিল না। এ দিকে বুখত নসর এসে লিখিত তাওরাতের সমস্ত কপি আগুনে জুলিয়ে দিয়েছে। একটি অংশও অবশিষ্ট নেই। সুতরাং আপনি আমাদের জন্যে একখানা তাওরাত লিখে দিন। বুখত নসরের আক্রমণকালে উযায়রের পিতা সারূখা তাওরাতের একটি কপি মাটির নিচে পুঁতে রেখেছিলেন। কিন্তু সেই স্থানটি কোথায় উযায়র ব্যতীত আর কেউ তা জানত না। সুতরাং তিনি উপস্থিত লোকদেরকে সাথে নিয়ে সেই স্থানে গেলেন এবং মাটি খুঁড়ে তাওরাতের কপি বের করলেন। কিন্তু এতদিনে তাওরাতের পাতাগুলো নষ্ট হয়ে সমস্ত লেখা মুছে গিয়েছে। এরপর তিনি একটি বৃক্ষের নিচে গিয়ে বসলেন, বনী ইসরাঈলের লোকজনও তাঁর পাশে গিয়ে ঘিরে বসল। কিছুক্ষণের মধ্যে আকাশ থেকে দুটি নক্ষত্র এসে তার পেটের মধ্যে প্রবেশ কয়ল! এতে গোটা তাওরাত কিতাব তাঁর স্মৃতিতে ভেসে উঠলো। তখন বনী ইসরাঈলের জন্যে তিনি নতুনভাবে তাওরাত লিখে দিলেন। এ সবের জন্যে অর্থাৎ নক্ষত্রদ্বয়ের অবতরণ ও কার্যক্রম, তাওরাত কিতাব নতুনভাবে লিখন ও বনী ইসরাঈলের নেতৃত্ব গ্রহণের কারণে ইহুদীগণ উদ্যায়রকে আল্লাহর পুত্র হিসেবে আখ্যায়িত করে। উযায়র হিযকীল নবীর সাওয়াদ এলাকায় অবস্থিত আশ্রমে বসে তাওরাত কিতাবের পুনর্লিখন কাজসম্পন্ন করেছিলেন। যে নগরীতে তিনি ইনতিকাল করেছিলেন তার নাম সাইরাবায (১L, ILL)। ইব্ন আব্বাস (রা) বলেন, এ প্রসঙ্গে আল্লাহর বাণী : ০.৭, 11 4। এ11, 1 J3 (তোমাকে আমি মানব জাতির জন্যে নিদর্শন বানাবার উদ্দেশ্যে এরূপ করেছি) মানব জাতি বলতে এখানে বনী ইসরাঈলকে বুঝানো হয়েছে। কেননা উযায়র তাঁর পুত্রদের মাঝে অবস্থান করছিলেন। অথচ পুত্ৰগণ সবাই ছিল বৃদ্ধ, আর তিনি অবশ্য যুবক। এর কারণ, যখন তাঁর মৃত্যু হয় তখন বয়স ছিল চল্লিশ বছর। একশ বছর পর আল্লাহ যখন তাঁকে জীবিত করলেন তখন (প্রথম) মৃত্যুকালের যৌবন অবস্থার উপরেই জীবিত করেছিলেন। ইব্ন আব্বাস (রা) বলেছেন, বুখত নসরের ঘটনার পরে উযায়র পুনজীবিত হয়েছিলেন হাসানও এ একই মত প্রকাশ করেছেন। আবু হাতিম সিজিসন্তানী ইব্ন আব্বাসের বক্তব্যকে কবিতা আকারে নিম্নলিখিতভাবে রূপ দিয়েছেন।
তার (উদ্যায়রের) মাথার চুল কালই আছে, কিন্তু এর পূর্বেই তার পুত্র ও পৌত্রের চুল পেকে সাদা হয়ে গিয়েছে। অথচ বড় তো তিনিই।
তাঁর পুত্রকে দেখা যায় বৃদ্ধ-লাঠির উপর ভর দিয়ে চলাফেরা করে; অথচ পিতার দাড়ি এখনও রয়েছে কাল এবং মাথার চুল লাল-খয়েরি।
পুত্রের দৈহিক শক্তি-সামর্থ্য ক্ষীণ হয়ে গিয়েছে। ফলে সে যখন দাঁড়াতে ও হাঁটতে চায় তখন ছোট শিশুর ন্যায় আছাড় খেয়ে মাটিতে পড়ে যায়।
সমাজের লোক জানে, তার (উযায়রের) পুত্র নব্বই বছর পর্যন্ত তাদের মাঝে চলাফেরা করেছে। কিন্তু বিশ বছর হল ভালরূপে চলতে ফিরতে পারছে না।
পিতার বয়স চল্লিশ বছর, আর পুত্রের বয়স নব্বই বছর অতিক্রম করেছে! এ এমন একটি বিষয় যা তোমরা বুদ্ধি থাকলে তুমি অনুধাবন করতে পারবে। আর যদি এর মর্ম অনুধাবন করতে ব্যর্থ হও তা হলে তোমার অজ্ঞতা ক্ষমাহাঁ।
পরিচ্ছেদ
প্ৰসিদ্ধ মতে উযায়র (আ) ছিলেন বুনী ইসরাঈলদের অন্যতম নবী। তিনি দাউদ ও সুলায়মান এবং যাকারিয়া ও ইয়াহয়া (আ)-এর মধ্যবর্তী সময়ে আবির্ভূত হন। কথিত আছে, বনী ইসরাঈলের মধ্যে কারও নিকট যখন তাওরাত কিতাব সংরক্ষিত ছিল না, তখন উযায়রের স্মৃতিপটে আল্লাহ তাওরাত কিতাব জাগরুক করে দেন এবং বনী ইসরাঈলকে তিনি তা পড়ে শুনান। এ সম্পর্কে ওহাব ইব্ন মুনব্বিহ (র) বলেছেন, আল্লাহর নির্দেশে একজন ফেরেশতা একটি নূরের চামচ নিয়ে আসেন এবং উযায়রের মুখের মধ্যে তা ঢেলে দেন। অতঃপর তিনি তাওরাতের হুবহু একটি কপি লিখে দেন। ইব্ন আসাকির লিখেছেন, ইব্ন আব্বাস (রা) একদা আবদুল্লাহ ইব্ন সালামের নিকট নিম্নোক্ত আয়াতটি এ1113.2, … . 3, … ]] এ J L_1, (ইহুদীরা উযায়রকে আল্লাহর পুত্র বলে থাকে) উল্লেখ পূর্বক জিজ্ঞেস করেন যে, তাকে আল্লাহর পুত্র বলার কারণ কি? উত্তরে আবদুল্লাহ ইব্ন সালাম (রা) বললেন, বনী ইসরাঈলের মধ্যে এক সময়ে তাওরাত কণ্ঠস্থাকারী একজন লোকও ছিল না। তারা বলত, নবী মূসাও তাওরাত লিখিত আকারে ছাড়া আমাদেরকে দিতে পারেন নি। অথচ উযায়র নিজের স্মৃতি থেকে অলিখিত তাওরাত আমাদেরকে দিয়েছেন। তার এ বিস্ময়কর প্রতিভা দেখে বনী ইসরাঈলের একদল লোক তাকে আল্লাহর পুত্র বলে আখ্যায়িত করে। এ কারণে অধিকাংশ আলিম বলেছেন, তাওরাত কিতাবের ধারাবাহিকতা উদ্যায়রের সময়ে শেষ হয়ে যায়। তিনি যদি নবী না হয়ে থাকেন, তা হলে এ মন্তব্যটি খুবই প্ৰণিধানযোগ্য। আতা ইব্ন আবী রাবাহ এবং হাসান বসরী ও এরূপ মন্তব্য করেছেন।
ইসহাক ইব্ন বিশর. বিভিন্ন সূত্রে আতা ইব্ন আবী রাবাহ থেকে বর্ণনা করেছেন যে, ফাত্রাত (শেষ নবী ও ঈসা (আ)-এর মধ্যবর্তী বিরতিকাল) যুগের নয়টি বিষয় খুবই উল্লেখযোগ্য, যথা : বুখত নসর, সানআর উদ্যান, সাবার উদ্যান, আসহাবুল-উখদৃদ, হাসুরার ঘটনা, আসহাবুল কাহফষ্ট, আসহাবুল ফীল, ইনতাকিয়া নগরী ও তুব্বার ঘটনা।
ইসহাক ইব্ন বিশর….. হাসান থেকে বর্ণনা করেছেন যে, উযায়র ও বুখত নসরের ঘটনা ফাতিরাতকালে সংঘটিত হয়। সহীহ হাদীছে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স) বলেছেন, মরিয়ম পুত্ৰ (ঈসা)-এর নিকটবতী লোক আমিই। কেননা আমার ও তার মাঝে অন্য কোন নবী নেই।
ওহাব ইব্ন মুনাব্বিহ লিখেছেন, উদ্যায়রের আগমন হয়েছিল সুলায়মান ও ঈসা। (আ)-এর মধ্যবর্তী সময়ে। ইব্ন আসাকির আনাস ইব্ন মালিক ও আতা ইবনুস সাইব থেকে বর্ণনা করেছেন যে, উযায়রের আগমন হয়েছিল। হযরত মুসা ইব্ন ইমরান (আ)-এর যামানায়। একদা তিনি আল্লাহর কুদরত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করার জন্যে মূসা (আঃ)-এর নিকট অনুমতি প্রার্থনা করেন। কিন্তু মূসা (আ) সে অনুমতি দেননি। এই ক্ষোভে তিনি সেখান থেকে চলে আসেন এবং বলেন : এক মুহুর্তের লাঞ্ছনার তুলনায় শতবার মৃত্যুবরণ
১. সানআর বাগিচা : সূরা সাবায় উল্লিখিত ইয়ামনের রাজধানী সানআর ঐতিহাসিক বাগিচা। আল্লাহর নাফরমানির কারণে তা ধ্বংস হয়ে যায়। ২. সাবার উদ্যান : সাবা ইয়ামানের এক বিখ্যাত পুরুষের নাম। তার ছয় পুত্ৰ ইয়ামানে ও চার পুত্র সিরিয়ায় বসবাস করত। ইয়ামানের রাজধানী সানআ থেকে ৬০ মাইল পূর্বে মাআরিব নগরীতে ছিল সাবা জাতির বসতি। নগরীর দুপ্রান্তে ছিল দুই পাহাড়। পাহাড়ের ঢালের পানি রোধে দু পাহাড়ের মধ্যে বিরাট বাঁধ দেয়া হয়। উক্ত বাঁধের দুপাশে বিশাল উদ্যান গড়ে উঠে। ফলে এই জাতি ধনে-ঐশ্বর্যে অনাবিল শান্তিতে বাস করে। কিন্তু আল্লাহকে ভুলে যেয়ে তারা মূর্তি পূজায় লিপ্ত হয়। তাদের শাস্তির জন্যে আল্লাহ ইদুর দ্বারা বাঁধের নিম্নদেশ কেটে দিয়ে পাহাড়ী ঢল দ্বারা বাঁধ ভেঙে দেন। এতে উদ্যানসহ সমস্ত বসতি ধ্বংস হয়ে যায়। (এটা ঈসা (আ)-এর আবির্ভাবের পরের ঘটনা)। ৩. আসহাবুল উখদুদ : অর্থাৎ অগ্নিকুন্ডের জন্যে কুখ্যাত শাসকবর্গ। ইয়ামানের হিময়ারী বাদশাহ আবু কারিরা ইহুদী
ধর্ম গ্ৰহণ করে নিজ দেশে প্রচার করে। তার পুত্র যু-নুওয়াস ঈসায়ী ধর্মের প্রাণকেন্দ্ৰ নাজরান আক্রমণ করে ঈসরাঈলীদেরকে ইহূদী ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য করে। তারা এতে অস্বীকৃতি জানালে প্রায় বিশ হাজার লোককে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করে হত্যা করে। এর প্রতিশোধে রোমের সাহায্য নিয়ে ইথিওপিয়ার খৃষ্টানগণ ইয়ামান আক্রমণ করে দখল করে নেয়। এটা ছিল ৩৪০ খ্রিস্টাব্দের ঘটনা। ৪. আসহাবুল কাহফ : (গুহাবাসী) এশিয়া মহাদেশের পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত রোমকদের বৃহৎ নগরী আফসুস
(পরবর্তীতে তরসূস নামে খ্যাত)-এর মূর্তি পূজারী বাদশাহ্ দাকিয়ানুস (Decius) এর ভয়ে তথাকার সাত জন ঈমানদার যুবক পালিয়ে গিয়ে এক পাহাড়ী গুহায় আত্মগোপন করেন। ক্লান্ত দেহে তারা ঘুমিয়ে পড়েন। এটা ছিল ২৫০ খ্রিস্টাব্দের ঘটনা। চান্দ্র হিসেবে ৩০৯ বছর (যা সৌর হিসেবে ছিল ৩০০ বছর) ঘুমাবার পর তারা জাগ্রত হন ৫৫০ খ্রিস্টাব্দে। কিছু সময় পর পুনরায় ঘুমালে আল্লাহ তাদেরকে মৃত্যু দান করেন। এর বিশ বছর পর শেষ নবীর জন্ম হয়। ৫. আসহাবুল কীল : (হস্তী বাহিনী) ইয়ামানের খৃষ্টান বাদশাহ আবরাহা রাজধানী সানআর বায়তুল্লাহর বিকল্প এক গীর্জা নির্মাণ করে। অতঃপর ১৩টি হাতি ও ৬০ হাজার সৈন্য নিয়ে কাবা ঘর ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে মক্কার দিকে রওয়ানা হয়। আল্লাহ আবাবিলের সাহায্যে তাকে ধ্বংস করে দেন। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর জন্মের ৫০ দিন মতান্তরে ৫৫ দিন পূর্বে এ ঘটনাটি ঘটে। ৬. সূরা ইয়াসীনে উল্লিখিত ঈসায়ী ধর্মের তিনজন মুবাল্লিগকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করায় ও তাদেরকে হত্যা করায়
ইনতাকিয়া (এন্টিয়ক) নগর। আল্লাহ ধ্বংস করে দেন। ৭. তুব্বা : ইয়ামানের হিময়ারী শাসকদের উপাধি ছিল তুব্বা। এরা ইয়ামানের পশ্চিমাংশসহ দীর্ঘ দিন আরব ও ইরাক শাসন করেছে। শক্তিশালী এই রাজবংশ পরবর্তীকালে ইহুদী ধর্ম ত্যাগ করে মূর্তিপূজা শুরু করে। ফলে আল্লাহ তাদেরকে ধ্বংস করে দেন।
নিম্নোক্তভাবেঃ
ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন স্বাধীনচেতা মানুষ যুদ্ধের ময়দানে তরবারীর আঘাতকে স্বাগত জানায়, কিন্তু স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করাকে ঘৃণা করে। এমন অবস্থায় সে মৃত্যুবরণ করাকে অগ্রাধিকার দেয় যখন সে মেহমানদের আহার্য প্রদানে অপারগ হয়।
ইব্ন আসাকির প্রমুখ লেখকগণ ইব্ন আব্বাস, নুফ আল-বিকালী, সুফিয়ান ছাওরী প্রমুখ থেকে বর্ণনা করেছেন যে, উযায়র (আ) নবীই ছিলেন। কিন্তু মৃতকে জীবিত করার ব্যাপারে আল্লাহর ক্ষমতা সম্পর্কে প্রশ্ন করায় তার নবুওত প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু এ বর্ণনাটি মুনকার বা অগ্রহণযোগ্য, এর বিশুদ্ধ হওয়া সম্পর্কে সন্দেহ আছে-সম্ভববত ইসরাঈলী বৰ্ণনা থেকে এটা গৃহীত হয়েছে। এ বিষয়ে আরও একটি বর্ণনা লক্ষ্যণীয়। তা হল, আবদুর রাযযাক ও কুতায়াবা ইব্ন সাদ….. নুফ আল-বিকালী থেকে বর্ণনা করেছেন যে, একদা উযায়র আল্লাহর নিকট একান্তে আবেদন করেন : হে আমার প্রতিপালক! মানুষ তো আপনারই সৃষ্টি, যাকে ইচ্ছা! তাকে আপনি পথভ্রষ্ট করেন এবং যাকে ইচ্ছা তাকে সৎপথে পরিচালিত করেন। আল্লাহর পক্ষ হতে তাকে বলা হল, তুমি এ কথা থেকে বিরত হও। কিন্তু তিনি পুনরায় একই কথা বললেন। তখন তাকে জানান হল, তুমি এ কথা থেকে বিরত থাক। অন্যথায় নবীদের তালিকা থেকে তোমার নাম কেটে দেয়া হবে। জেনে রেখ, আমি যা কিছু করি সে বিষয়ে প্রশ্ন তোলার অধিকার কারও নেই; কিন্তু মানুষ যা কিছু করবে তার জন্যে তাকে জবাবদিহী করতে হবে। এ বর্ণনা দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, সতর্ক করার পরও তিনি ঐ কথার পুনরাবৃত্তি করেন নি। সুতরাং নবীদের তালিকা থেকে তার নাম কাটা যাওয়ার প্রশ্নই উঠে না।
ইমাম তিরমিয়ী ব্যতীত সিহাহ সিত্তাহর অন্যান্য সংকলকগণ… আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, জনৈক নবী একবার এক বৃক্ষের নিচে অবতরণ করেন। একটি পিপড়া তাঁকে দংশন করে। তিনি সেখান থেকে বিদায় হওয়ার জন্যে মালপত্র গুটিয়ে নিতে বলেন। নির্দেশ মতে মালপত্র গুটিয়ে নেয়া হয়। অতঃপর তার হুকুমে পিপাড়দের বাসা পুড়িয়ে ফেলা হয়। তখন আল্লাহ ওহীর মাধ্যমে তাকে বললেন, থাম, একটি মাত্র পিপড়ার জন্যে এ কী করছ? ইসহাক… মুজাহিদ থেকে বর্ণনা করেন যে, ঐ নবী ছিলেন। হযরত উযায়র (আ)। ইব্ন আব্বাস ও হাসান বসরী থেকে বর্ণিত যে, তিনি ছিলেন উযায়র (আ)।