৯. স্নর্কেল
আজকে সকালে ঘুম থেকে উঠে আমার মনে হলো না, আমি কোথায়? ঘুম ভাঙতেই আমি জানি আমি কোথায়, আমার কেবিনে। পাশে তাকিয়ে দেখলাম মামী ঘুমাচ্ছেন। মামী এরকম ডেঞ্জারাস একজন মানুষ এমন কোনো ডেঞ্জারাস কাজ নাই যেটা মামী করেন নাই কিন্তু আমি আবিষ্কার করলাম ঘুমান বাচ্চাদের মতন। পা দুটি ভাঁজ করে কেমন যেন কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমাচ্ছেন, মুখটা একটুখানি খোলা ঠিক ছোটো বাচ্চাদের মতো। আমার এরকম অসাধারণ একজন মামীকে আমার মামা ডিভোর্স করে দিয়েছেন সেটা আমার বিশ্বাস হয় না। কে জানে মামা হয়ত ডিভোের্স করেন নাই মামীই ডিভোর্স করে দিয়েছেন, যেটাই হয়ে থাকুক মামী এখন একা একা ঘুরে বেড়ান। মামী ছোটো বাচ্চাদের এত আদর করেন তার কি ইচ্ছা হয় না নিজের একটা দুইটা ছেলেমেয়ে থাকুক? সেটা কি কখনো হবে?
আমি মামীর ঘুম ভাঙাতে চাচ্ছিলাম না তাই আমার বিছানায় ঘাপটি মেরে শুয়ে থেকে আবার ঘুমানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু লাভ হলো না, ঘুমটা আরও ভালো মতন ভেঙে গেল। তখন আমি খুব সাবধানে উঠে, কোনো শব্দ না করে কেবিনের দরজা খোলার চেষ্টা করলাম কিন্তু তাতেও লাভ হলো না। মামীর ঘুম ভেঙে গেল, মামী চোখ খুলে তাকালেন।
আমি বললাম, “মামী তুমি ঘুমাও। সরি তোমার ঘুমটা ভাঙিয়ে দিলাম।”
“তুই আমার ঘুম ভাঙাসনি নিজেই ভেঙেছে।”
“তুমি আজকে তোমার কাজে যাবে না?”
“নাহ্। কাল অনেক কাজ করেছি। আজ ছুটি।”
আমি বললাম, “বাহ্! কী মজা। তাহলে আরও ঘুমাও মামী।”
মামী ঘুম ঘুম গলায় বললেন, “দেখি চেষ্টা করে।”
আমি কেবিন থেকে বের হয়ে বারান্দা দিয়ে চারিদিকে হাঁটলাম। যেদিকে তাকাই চারদিকেই একইরকম পানি। শুধু সমুদ্রের খুবই হালকা একধরনের ঢেউয়ের ছলাৎ ছলাৎ একটু শব্দ। আমি পুরোটা ঘুরে সামনের ডেকে এসে বসলাম।
সমুদ্রে সূর্য উঠতে দেখার দৃশ্যটা নিশ্চয়ই খুবই অসাধারণ হবে। আমি ভেতরে একটা কবি কবি ভাব নিয়ে বসে থাকলাম কিন্তু সূর্যটা উঠল না। কিংবা সোজা করে বলা যায় কখন কোন দিকে উঠল সেটা জানতেই পারলাম না। আকাশে ঘোলা মেঘ নাকি কুয়াশা কে জানে!
আমি কতক্ষণ বসেছিলাম কে জানে, একসময় পেছনে পায়ের শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখি মামী গলায় একটা টাওয়েল ঝুলিয়ে এসেছেন। ডেকে এসে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেলেন, এদিক সেদিক তাকিয়ে নাক কুঁচকে নিঃশ্বাস নিলেন তারপর বললেন, “কোনো একটা ছাগল এখানে সিগারেট খেয়েছে।”
আমি সাথে সাথে বুঝে গেলাম ছাগলটা কে, কিন্তু আমি কিছু বললাম না। এটা অবশ্য একটা খারাপ সংবাদ, জহির সিগারেট খাওয়ার অর্থ তার শরীরটা ভালো লাগছে। গত দুইদিন আধমরা হয়েছিল সেটা ভালো ছিল, আমাদেরকে জ্বালায় নাই। এখন যদি শরীর ভালো লাগতে থাকে তাহলে নিশ্চয়ই আমাদের জ্বালাতে শুরু করবে।
মামী পাশের ডেক চেয়ারে বসে বললেন, “কেমন হচ্ছে তোর ট্রিপ?”
“ভালো মামী। খুবই ভালো।”
“দিন রাত একটা জাহাজের মাঝে আটকা, কিছু করার নাই, কোন জিনিসটা ভালো বুঝলাম না।”
“কিন্তু এটা তো বিশাল জাহাজ, এখানে কত কী করা যায়। জাহাজটা কী সুন্দর আর মডার্ন। কোন দেশী জাহাজ এটা মামী?”
মামী সোজা হয়ে বসলেন, বললেন, “কোন দেশী মানে? এটা বাংলাদেশের তৈরি জাহাজ! বাংলাদেশ কত ভালো জাহাজ তৈরি করে তুই জানিস?”
আমি জানতাম না! জেনে আমি অবাক হয়ে গেলাম। মামী মাথা নাড়লেন বললেন, “ভালো জিনিস হলেই তোরা মনে করিস সেটা বিদেশী।”
আমি দাঁত বের করে হাসলাম, বললাম, “একটা ভালো জিনিস আছে সেটা কখনোই আমি বিদেশী ভাবি নাই।”
“সেটা কী?”
আমি চিৎকার করে এবং আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললাম, “তুমি।”
“হয়েছে! আমাকে ফ্ল্যাটারি করতে হবে না।”
“ফ্ল্যাটারি না মামী। সত্যি কথা। আমি বড়ো হয়ে তোমার মতো হতে চাই। হুবহু তোমার মতো।”
“বড়ো হয়েই মাল্টি বিলিয়ন ডলার কোম্পানির সিইও হয়ে যাবি।”
জিনিসটা কী আমি জানি না, জানার দরকারও নাই, বললাম, “কক্ষনো মামী, কক্ষনো না!”
মামী বললেন, “দেখা যাবে।”
আমি সুর পালটে বললাম, “মামী। তুমি বলেছিলে সময় হলে আমাকে স্কুবা ডাইভিং শেখাবে।”
মামী মাথা নাড়লেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম “কখন সময় হবে মামী?”
“বড়ো হলে। এটা বাচ্চাদের স্পোর্টস না। আপাতত স্নর্কেল শিখতে পারিস।”
শব্দটা বুঝতে পারলাম না। জিজ্ঞেস করলাম, “কিরকেল?”
“স্নৰ্কেল।” আমি জিজ্ঞেস করলাম, “সেটা কী?”
“স্কুবা ডাইভিংয়ের মতোই তবে চাইলে বাচ্চারা করতে পারে। অনেক সেফ।”
আমি আনন্দের একটা বিকট শব্দ করলাম। মামী হাল ছেড়ে দেওয়ার মতো মাথা নেড়ে বললেন, “স্কুবা ডাইভিংয়ে একজন ডাইভার তার শ্বাস নেওয়ার বাতাস সিলিন্ডারে করে নিয়ে যায়। তাই পানির অনেক নিচে যেতে পারে, অনেকক্ষণ থাকতে পারে। সুর্কেল করার সময় শ্বাস নেয় ছোটো একটা টিউব দিয়ে পানির ওপরের বাতাস থেকে। তাই পানির গভীরে যায় না। বলা যায় মোটামুটি ভেসে ভেসে করে।”
আমি একটু হতাশ হলাম, বললাম, “তাহলে লাভ কী?”
“পানির নিচে দেখতে পাবি।”
“পানির নিচে তো এমনিতেই দেখি।”
“না।” মামী মাথা নাড়লেন, বললেন, “পানির নিচে তুই দেখিস না। চোখের সামনে পানি থাকে বলে পানির নিচে ঝাপসা ঘোলা মতন কিছু একটা দেখিস। এটা না দেখার মতোই। কিন্তু সুর্কেল করার সময় ডাইভিং গগলস পরে বলে সবকিছু পরিষ্কার দেখা যায়। ঝকঝক করতে থাকে।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ। সত্যি।” মামী একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “আসলে স্নর্কেল করার মজা হচ্ছে কোরাল রিফে। সেখানে কোরালগুলো কী সুন্দর, কত রংবেরঙের বিচিত্র মাছ। মনে হয় পানির নিচে অন্যরকম একটা বাগান।”
“আমাদের দেশে কোরাল রিফ নাই?”
“থাকবে না কেন? আমাদের সেন্ট মার্টিন দ্বীপ হচ্ছে কোরাল দ্বীপ। কিন্তু আমরা তো সেটাকে পুরোপুরি শেষ করে দিয়েছি। মানুষের ভীড়, দ্বীপের ওপর অত্যাচার–সব মিলিয়ে কিছু বাকী নাই।” মামী বিশাল একটা নিঃশ্বাস ফেললেন।
একটু পরে বললেন, “কোরাল দ্বীপ তৈরি হতে লক্ষ লক্ষ বছর লাগে তারপর মানুষ কয়েক বছরে সেটা শেষ করে দেয়। কোরালকে দেখে মনে হয় বুঝি একধরনের গাছ, আসলে এটা প্রাণী। সমুদ্রের হাজার রকম মাছ, হাজার রকম প্রাণী সব মিলে বিশাল একটা ইকো সিস্টেম। আমরা সেই ইকো সিস্টেমকে শেষ করে দিচ্ছি।”
আমি মামীর সব কথা বুঝতে পারলাম না, ইকো সিস্টেম কথাটার মানে কী সেটাও জানি না কিন্তু মামীর মনে যে এটা নিয়ে খুব দুঃখ সেটা ঠিকই বুঝতে পারলাম।
মামী কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন, তারপর বললেন, “আমাদের এত সুন্দর, এত বিশাল একটা সমুদ্র আমরা এখনো সেটা ভালো করে স্টাডি করি না! কত না জানি রহস্য আছে এখানে। যে কোনো একটা স্টাডি করে জীবন কাটিয়ে দেওয়া যায়।”
আমার বুকের ভেতর একটা কাঁপুনি হলো। আমার মনে হলো বড় হয়ে এই সমুদ্রেই আমি থাকব। এই রহস্য দেখে দেখেই জীবন কাটিয়ে দেব।
মামী বললেন, “আমরা এখন যেখানে আছি এর আশেপাশে একটা কোরাল রিফ থাকার সম্ভাবনা আছে। আমরা খুঁজে পাচ্ছি না। যদি পেয়ে যেতাম কী মজা হতো! তাহলে তুইও একটা সত্যিকারের জীবন্ত কোরাল রিফ দেখতে পেতি।”
“কোরাল রিফ দেখতে কেমন মামী?”
“মুখে কী আর বর্ণনা করা যায়? এখানে আমাদের রিসার্চ নেট ছাড়া অন্য নেট নেই। থাকলে ইন্টারনেটে সার্চ দিলেই খানিকটা দেখতে পাবি।” মামী কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন, তারপর বললেন, “আমার ল্যাপটপে কিছু ছবি আর ভিডিও আছে। দেখতে চাইলে দেখতে পারিস।”
“দেখব মামী। আমি দেখতে চাই।”
একটা জিনিস খুঁজে বের করতে হলে সেটা দেখতে কেমন হয় জানা দরকার। মামীর কথা শুনে আমি মনে মনে ঠিক করে ফেলেছি আমি কোরাল রিফটা খুঁজে বের করে ফেলব। কোনো কিছুর সিদ্ধান্ত নিতে আমার কখনো দেরি হয় না।
.
নাস্তা করতে করতে আমি মিতিকেও স্নৰ্কেল করতে রাজী করিয়ে ফেললাম। সে রাজী হলেই অবশ্য হবে না, তার মাকেও রাজী হতে হবে। মিতির মা যখন শুনলেন মামী আমাদের স্নর্কেল করাবেন তখন আগ্রহ নিয়ে রাজী হলেন। এখানে সবাই মামীর ওপর সবকিছু নিয়ে ভরসা করে।
আমাদের কাছাকাছি জহির বসেছিল, সে আমাদের কথাবার্তা শুনছিল, সেও সুর্কেল করতে চলে আসে কিনা সেটা নিয়ে ভয়ে ছিলাম কিন্তু সে বেশী উৎসাহ দেখাল না। অন্যরা চলে গেলে বরং আমাকে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করল। বলল, “তোদের কি মাথা খারাপ হয়েছে? ঠান্ডা পানির মাঝে খাবলাখাবলি করবি?”
“পানি মোটেও ঠান্ডা না। মামী বলেছেন।”
“নির্ঘাত নিমোনিয়া হবে। কাছে কোনো হাসপাতালও নাই।”
“জাহাজে দুজন ডাক্তার আছে তুমি জানো?” একজনের কথা শুনেছি সেটা বাড়িয়ে দুজন বলে দিলাম।
“সমুদ্রের পানিতে নামবি আর নিচ থেকে কুমীর এসে কামড় দিয়ে টেনে নিয়ে চলে যাবে।”
“সমুদ্রে কুমীর থাকে না।”
“তোকে বলেছে।”
আমি মুখ শক্ত করে বললাম, “আমি জানি।”
“তাহলে বোয়াল মাছ এসে ধরে নিয়ে যাবে। সমুদ্রের বোয়াল রাক্ষসের সাইজের হবে।”
কুমীর থেকে এককথায় বোয়ালে নেমে এসেছে। কাজেই আমি আর তর্ক করলাম না। জহিরকে ঠান্ডা করার জন্য গলা নামিয়ে বললাম, “আর শোনো–তুমি ডেকে সিগারেট খেয়ো না, বুঝেছ?”
জহির ভয় পাওয়া চোখে বলল, “তুই কেমন করে জানিস?”
“না জানার কী আছে? সবাই জানে। সাবধান।”
জহির নিজেই বোয়াল মাছের মতো মুখ খুলতে লাগল আর বন্ধ করতে লাগল।
.
দুপুরে লাঞ্চ করার পর মামী আমাদের নিয়ে রওনা হলেন, বিশাল আয়োজন, মনে হলো অ্যাডভেঞ্চার করতে যাচ্ছি। অনেকগুলো ডাইভিং গগলস, আমরা যেহেতু ছোটো তাই কোনটা ফিট হবে জানেন না বলে বেশী করে নিয়েছেন। কয়েকটা নানা রঙের টিউব, একদিকে দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরার ব্যবস্থা, সেটা দিয়ে নিঃশ্বাস নিতে হয়। এটার নাম সুর্কেল। পায়ে পরার জন্য ফিন হুবহু ব্যাঙের পায়ের মতো। বেশ কয়েকটা টাওয়েল। আমাদের শুকনো কাপড়। কিছু শুকনো খাবার। ফ্লাস্কে হট চকলেট। একটা ফার্স্ট এইড বক্স। দড়ি দিয়ে বাঁধা লাইফবয়। মামী তার কোমরে একটা মারাত্মক ছুরি বেঁধে নিয়েছেন, স্কুবা ডাইভিংয়ের সময়ও এটা মামীর সাথে ছিল। শুধু হলিউডের সিনেমার দুধর্ষ নায়কদের কাছে মনে হয় এই রকম ছুরি থাকে। দেখে মনে হয় এই ছুরিটার দাম নিশ্চয়ই লাখ টাকার বেশী হবে। আমার ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছা করছিল কিন্তু বলতে লজ্জা লাগল।
আমরা লাইফ জ্যাকেট পরে স্পীডবোটে উঠেছি। মামী স্পীডবোট চালু করে সেটা চালাতে শুরু করলেন। তার মানে মামী স্পীডবোটও চালাতে পারেন। মোটর সাইকেল চালাতে পারেন, গাড়ীও চালাতে পারেন। শুধু প্লেন চালানো বাকী আছে, সেটাও নিশ্চয়ই শিখে নিবেন। দুই পাশে পানি ছিটিয়ে স্পীডবোটটা তীরের মতো ছুটতে লাগল, মামী এক পাক ঘুরে এসে এক জায়গায় থামলেন। দড়িতে বাধা কাটার মতো একটা জিনিস নিচে ফেলে বোটটাকে আটকে ফেললেন। তার মানে সমুদ্রটা এখানে খুব বেশী গভীর না, কাটার মতো জিনিসটা দিয়ে বোটটাকে সমুদ্রের তলায় আটকে ফেলা যায়। বোটটাকে আটকানোর পর মুখটা গম্ভীর করে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা দুজনই সাঁতার জানো?”
আমি বললাম, “জানি।” মিতি মাথা নাড়ল।
“তারপরও তোমাদের লাইফ জ্যাকেট পরানো হয়েছে, জাহাজে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত লাইফ জ্যাকেট খুলতে পারবে না। ঠিক আছে?”
আমি মাথা নাড়লাম। মামী মিতির দিকে তাকিয়ে মুখ স্পষ্টভাবে ধীরে ধীরে বললেন, “মিতি। তোমার যদি কোনো কথা বুঝতে অসুবিধা হয় আমাকে জিজ্ঞেস করবে আমি লিখে দেব।”
মিতি মাথা নাড়ল।
তারপর মামী আমাদের সবকিছু বুঝিয়ে দিলেন। প্রথমে আমরা এমনিতেই পানিতে নেমে একটু দাপাদাপি করলাম এবং হঠাৎ করে মনে পড়ল যে সমুদ্রের পানি আসলে লোনা! নামার সময় প্রথমবার মনে হচ্ছিল জহির মনে হয় ঠিকই বলেছিল যে পানিটা অনেক ঠান্ডা কিন্তু একটু পরেই আমাদের অভ্যাস হয়ে গেল। মামী বোটে পা দুলিয়ে বসে আমাদের লক্ষ করছিলেন। আমরা পানিতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার পর মামী আমাদের ডাইভারস গগলস পরিয়ে দিলেন। বেশ কয়েকটা চেষ্টা করার পর একটা আমার মুখে চমৎকারভাবে ফিট করল। মিতির মুখ মনে হয় ছোটো, তাকে আরও বেশী চেষ্টা করতে হলো। মামী এবারে আমাদের পানির ভেতরে মাথা ডুবিয়ে তাকাতে বললেন।
আমরা পানিতে মাথা ডুবিয়ে তাকালাম এবং একেবারে হতবাক হয়ে গেলাম। পানির নিচে সম্পূর্ণ অচেনা একটা পৃথিবী ঝকঝক করছে। কতবার পানিতে নেমেছি পানির নিচে তাকিয়েছি কখনো চিন্তা করি নাই এরকম ঝকঝকে পরিষ্কার দেখা সম্ভব। ধরেই নিয়েছি নিশ্চয়ই পানিটা ঘোলা তাই পানির নিচে সব কিছু ঘোলা, সবকিছু অস্পষ্ট, সবকিছু ঝাপসা। আমি আমার পুরো হাত পা শরীর দেখতে পাচ্ছি, মিতিকে দেখতে পাচ্ছি, এক কথায় একেবারে বেকুব হয়ে গেলাম।
নিঃশ্বাস ফুরিয়ে যাওয়ার পর মাথা তুলে তাকালাম, মামীকে বললাম, “মামী! কী সুন্দর! কী সুন্দর। সবকিছু কী স্পষ্ট।”
মিতিও মাথা নাড়ল। হাত দিয়ে বুঝিয়ে দিল কী অসাধারণ।
মামী হাসলেন, বললেন, “হ্যাঁ। গগলস পরলেই পানির নিচে অন্য রকম দেখায়।”
“কিন্তু কী সুন্দর!”
“যখন একটা মাছ দেখবি তখন বুঝতে পারবি কত সুন্দর।” মামী হাসলেন, বললেন, “আমাদের দেশের মানুষ তো পানি নিয়েই বেঁচে থাকে। জেলে মাঝি ছেলে বুড়ো সবাই। তাদের সবাইকে এরকম ডাইভারস গগলস দেওয়া দরকার। বিশেষ করে বন্যার পানি হওয়ার পর যেসব দুষ্টু ছেলেরা ব্রিজের ওপর থেকে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের। তাহলে ওরা দুষ্টুমি করে আরও অনেক বেশি মজা পাবে।”
আমরাও অনেক মজা পেলাম। যখন ডাইভারস গগলস পরে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম তখন মামী আমাদের স্নর্কেল পরিয়ে দিলেন। এখন থেকে নাক দিয়ে না, মুখ দিয়ে শ্বাস নিতে হবে, মামী সেটা আমাদের অনেকবার মনে করিয়ে দিলেন। তারপরেও প্রথমবার পানিতে নেমে অভ্যাসের কারণে নাক দিয়ে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করে নাকে পানি ঢুকে গেল। শুধু নাকে না মনে হলো নাক দিয়ে বুঝি একেবারে ব্রেনে পানি চলে গেছে! মাথা বের করে অনেকবার নাক ঝেড়ে তারপর শান্তি। মিতির কোনো অসুবিধাই হলো না, একবারেই মর্কেল দিয়ে শ্বাস নিয়ে মাছের মতো ঘুরে বেড়াতে লাগল।
আমি শেষ পর্যন্ত কায়দাটা শিখে গেলাম, তখন মনে হতে লাগল নাক দিয়ে না, মুখ দিয়েই শ্বাস নিতে হয়, এটাই স্বাভাবিক। আমরা একবারও পানি থেকে মাথা না তুলে পানির নিচে ঘুরে বেড়াচ্ছি, ব্যাপারটাই একেবারে অন্যরকম।
ভেবেছিলাম স্নৰ্কেল লাগিয়ে পানির বেশী নিচে যাওয়া যাবে না। টিউবটা পানিতে ডুবে গেলে ভেতরে পানি ঢুকে বিতিকিচ্ছি কিছু একটা ঘটে যাবে। কিন্তু মামী শিখিয়ে দিলেন, পানির ওপরে উঠে জোরে ফুঁ দিলেই সব পানি বের হয়ে টিউবটা পরিষ্কার হয়ে যায়।
পানির নিচে বেশীক্ষণ থাকলে গগলসটা জলীয়বাষ্পে ঘোলা হয়ে যায়। মামী শিখিয়ে দিলেন, ভেতরে একটু থুতু লেপে নিলেই আর ঘোলা হয় না। কী আজব!
যখন স্নর্কেল ব্যবহার করা শিখে গেলাম তখন মামী আমাদের বোটের ওপর তুলে নিয়ে আমাদের পায়ে ফিন পরিয়ে দিলেন। আমাদের পায়ের জন্য ফিনগুলো একটু বড়ো, ভেতরে একটু টিস্যু গুঁজে নিতে হলো কিন্তু শেষ পর্যন্ত। মোটামুটি ফিট হলো।
ফিনগুলো পায়ে লাগিয়ে যখন বোটে দাঁড়িয়েছি, তখন মামী বললেন, “ফিন পরে জিনের মতো হাঁটতে হয়।”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “জিনের মতো?”
মিতি মামীর কথাটা বুঝতেই পারল না, অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। মামী তখন মিতির নোট বইয়ে লিখলেন, ‘জিনের গোড়ালী পায়ের উলটো দিকে। তাই জিন যখন সামনে হাঁটে তখন পেছনে যায়। ফিন পরলে জিনের মতো উলটা দিকে হাঁটতে হয় তা না হলে আছাড় খেয়ে পড়বে!’
মামী সত্যি কথাই বলেছেন, ফিন পরে ভুল করে একটু সামনের দিকে হাঁটতে গিয়ে আরেকটু হলে আছাড় খেতাম।
পানিতে নামার পর মামী মনে করিয়ে দিলেন, পানিতে হাত দিয়ে সাঁতার কাটলে পরিশ্রম বেশী হয়। সেই তুলনায় পা দিয়ে সাঁতার কাটা সহজ। তাই আমরা যেন হাতগুলো ব্যবহার না করে শুধু পা দিয়ে সাঁতার কেটে ঘুরে বেড়াই।
সারাজীবন হাত দিয়ে দাপাদাপি করে সাঁতার কেটেছি তাই হাত না ব্যবহার করে শুধু পা দিয়ে সাঁতার কাটা এত সোজা না, আমাদের অনেক প্র্যাকটিস করতে হলো।
আমরা মোটামুটি সবকিছু শিখে গেছি, এখন যত প্র্যাকটিস করব তত এক্সপার্ট হয়ে যাব। মামী বোটের ওপর বসে থেকে আমাদের স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াতে দিলেন, বলে দিলেন দুজন যেন একসাথে থাকি আর বেশী দূরে না যাই।
আমি আর মিতি তখন পানির নিচে তাকাতে তাকাতে ঘুরে বেড়ালাম। কী যে মজা হচ্ছিল সেটা বলে বোঝানো যাবে না। নিচে অনেক গভীর না হয়ে যদি তলাটা দেখা যেত নিশ্চয়ই আরও অনেক বেশী মজা হতো।
আমরা দুজন স্বর্কেল করছি হঠাৎ মিতি আমার কাছে চলে এলো, উত্তেজিত হয়ে আমাকে ধরে দূরে কিছু একটা দেখাল। আমি তাকালাম, তারপর দেখলাম বিশাল একটা কাছিম সাঁতরে সাঁতরে আসছে। একটা কাছিম যে এত বড়ো হতে পারে আমি জীবনেও চিন্তা করি নাই।
আমাদের প্রথমে একটু ভয় লাগল কিন্তু কাছিমকে নিশ্চয়ই ভয় পাওয়ার কিছু নাই। কাছিমটা ঠিক আমাদের কাছে এসে মাথা ঘুরিয়ে আমাদের দেখল তারপর ঘুরে যেদিক দিয়ে যাচ্ছিল সেদিকে যেতে লাগল। বড়ো বড়ো পাগুলো ধীরে ধীরে নাড়ছে, মাথাটা ঘুরিয়ে দেখছে, কী যে সুন্দর লাগছে কী বলব।
আমরা একটু পরে ফিরে এলাম, উত্তেজিত হয়ে মামীকে যখন কাছিমটার কথা বললাম, মামী মাথা নাড়লেন বললেন, “হ্যাঁ, আমিও কাছিমটাকে দেখেছি। সামুদ্রিক কাছিম। খুবই নিরীহ প্রাণী।”
আমরা আরও কিছুক্ষণ থাকতে চাইছিলাম কিন্তু মামী রাজী হলেন না, বললেন একদিনের জন্য বেশী করা ঠিক না। আমরা নৌকায় উঠে শরীর মুছে নিলাম। মামী মিতিকে তার কাপড় বদলে শুকনো কাপড় পরতে সাহায্য করলেন। তারপর আমাদের শরীরে কী একটা লোশন মাখতে দিলেন। তারপর মগে গরম হট চকলেট খেতে দিলেন।
সেটা খেতে কী যে মজা লাগল বলে বোঝানো যাবে না। মনে হয় বেহেশতে গেলে সবাইকে নিশ্চয়ই এরকম গরম হট চকলেট খেতে দেওয়া হবে।
আমরা যখন ফিরে আসছিলাম তখন দেখলাম জহির বারান্দার রেলিং ধরে ভোঁতা মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। একটা রাক্ষুসে টাইপের বোয়াল মাছ আমাদের খেয়ে ফেলে নাই দেখে তার মনে হয় একটু মন খারাপ হয়েছে।